সমাজ ও বিবাহ

সমাজ ও বিবাহ

হিন্দুর প্রচলিত বিবাহ-রীতির আংশিক পরিবর্তন ও পরিবর্তিত রীতিকে বিধিবদ্ধ করার জন্য আইনের এক খসড়া তৈরি হয়ে জনসাধারণের অবগতি ও বিচারের জন্য প্রচার হয়েছে। ইংরেজি ১৯৪১ সালে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট যে ‘হিন্দু-আইন কমিটি’ নিয়োগ করেন এ খসড়া সেই কমিটি প্রস্তুত করেছেন। এ কমিটির সভাপতি হচ্ছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি শ্ৰীযুক্ত বেনেগাল নরসিংহ রাও, এবং সভ্য আছেন ওই হাইকোর্টের ভূতপূর্ব বিচারপতি শ্ৰীযুক্ত দ্বারকানাথ মিত্র, বোম্বাই-এর শ্ৰীযুক্ত ঘরপুরী ও শ্ৰীযুক্ত যোশী।

এই খসড়া অনুসারে আইন পাশ হলে তা কার্যকরী হবে ইংরেজি ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে, অর্থাৎ এখন থেকে তিন বছর পরে।* আগামী তিন বছরে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় অবস্থা-তার শাসনযন্ত্র ও আইন-প্রণয়নের বিধি ব্যবস্থা কেমন দাড়াবে তা অনিশ্চিত। কারণ তা প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভর করবে বর্তমান যুদ্ধের গতি ও পরিণতির উপর। কিন্তু এই অনিশ্চয়ের মধ্যেই এই প্ৰস্তাবিত আইনের আলোচনা প্রয়োজন। ভারতবর্ষের ভাবী রাষ্ট্রচেহারা যা-ই হোক এ মহাদেশের হিন্দু জনসাধারণকে তাদের বিবাহ-বিধির নানা পরিবর্তনের প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখতেই হবে। চলতি রাষ্ট্র-ব্যবস্থার বদল ঘটলে সে প্রয়োজন কমবে না, বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বছর তিনেক পূর্বে অলকা’ পত্রিকায় ‘বাঙ্গালী হিন্দু’ নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সে লেখা অনেক লোকে পড়েছেন এমন দুরাশা ও অহংকার মনে রাখি না। সুতরাং সংক্ষেপে বলছি, সে প্রবন্ধে দেখাতে চেষ্টা করেছি যে, বর্তমান হিন্দু-সমাজে ঐক্যের, ও একতায় যে বল আনে সে বলাধানের প্রধান অন্তরায় জাতিভেদের গণ্ডিতে আমাদের শতধা বিভক্ত সমাজ। হিন্দুশাস্ত্ৰ-বৰ্ণিত বৰ্ণভেদের সঙ্গে আধুনিক জাতিভেদের জটিলতা ও অন্ধ কঠোরতার মিল খুব কম, এবং এ জাতিভেদ মরণে দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ জাতি ছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে আর কারও কাম্য হতে পারে না। সে প্রবন্ধে আরও বলেছিলাম যে, এ জাতিভেদের ভিত্তি জাতির গণ্ডির বাইরে বিবাহের নিষিদ্ধতায়। এ নিষেধবিধিকে দূর না করলে হিন্দু-সমাজ কোনও দিনই দৃঢ়বদ্ধ এক সমাজ হয়ে গড়ে উঠবে না। এবং দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম যে, এই নিষেধের সমর্থনে বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক যুক্তি নাম দিয়ে যা সব বলা হয় সেগুলি যা আছে—তার সমর্থনে মনগড়া কল্পনামাত্র, সত্যে তাদের কোনও ভিত্তি নেই। এই নিষেধকে বহাল রেখেও আমাদের জাতিগত ভেদবুদ্ধিকে এড়িয়ে হিন্দু-সমাজে সংহতি আনার আর যে-সব চেষ্টা-যেমন অ-জলচল জাতির হাতে মাঝে মাঝে সভা করে জল খেয়ে তাদের কৃতাৰ্থ করা, বছরে একবার তাদের সঙ্গে একপঙক্তিতে ভোজন করে তাদের সঙ্গে ভ্ৰাতৃত্ব-স্থাপন—সম্পূর্ণ পণ্ডশ্রম, নিজের মন ও পরের মনকে ফাকি দেওয়া। শুয়ে শুয়ে হাত পা ছুড়ে খুব এগিয়ে যাচ্ছি কল্পনা আত্মপ্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।

প্রস্তাবিত আইনে জাতিভেদের এই নিষিদ্ধ গণ্ডি কতটা দূর হয়েছে এ প্রবন্ধের তাই প্রধান আলোচ্য। প্রসঙ্গত এ খসড়ার অন্য মূল বিষয়গুলির কিঞ্চিৎ আলোচনা করব। আইন করে জাতিভেদ দূর করা যাবে না জানা কথা। কিন্তু হিন্দু-সমাজের ভিতরে যদি এ গণ্ডিকে লঙ্ঘনের বেগ সঞ্চিত হয়ে থাকে। তবে আইন নানা বাধা দূর করে তার গতিৰ পথে সহায় হতে পারে।

এই খসড়ায় দুই রকমের বৈধ হিন্দু-বিবাহ স্বীকৃত হয়েছে –শাস্ত্রীয় বিবাহ ও লৌকিক বিবাহ। শাস্ত্রীয় বিবাহে অসবর্ণ, সপিণ্ড, একগোত্র ও সমান প্রবর বীরকন্যার মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। হোমাগ্নি-সাক্ষাতে মস্ত্ৰোচ্চারণ ও সপ্তপদীগমন এ বিবাহ-সিদ্ধির প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান। তবে কোনও দেশাচার বা জাতি ও উপজাতি প্রভৃতির মধ্যে প্রচলিত রীতি ও আচার অনুযায়ী বিবাহও বৈধ শাস্ত্রীয় বিবাহ বলে গণ্য হবে। লৌকিক বিবাহে বর্ণ-পিণ্ড-গোত্র-প্রবারের বাধা নেই। বরবধু এই আইনের নির্দিষ্ট কোনও সম্পর্কে সম্পর্কিত না হলেই তাদের মধ্যে বৈধ বিবাহ সিদ্ধ হতে পারবে। এই আইন-নিষিদ্ধ সম্পর্কগুলি হচ্ছে একের সঙ্গে অন্যের সন্তান সম্পর্ক, ভ্রাতা-ভগ্নী সম্পর্ক, পিতৃব্য-ভ্ৰাতৃকন্যা কি মাতুল-ভগিনীকন্যা সম্পর্ক ও পিতৃম্বসা-ভ্রাতুষ্পপুত্ৰ কি মাতৃম্বসা-ভগিনীপুত্র সম্পর্ক। প্রাদেশিক গভর্নমেন্টের নিযুক্ত জনৈক কর্মচারী ও তিনজন সাক্ষীর সমক্ষে বরবধুর পরস্পরককে স্বামী-স্ত্রী রূপে গ্রহণের অঙ্গীকার এ বিবাহের প্রযোজনীয় অনুষ্ঠান। শাস্ত্রীয় ও লৌকিক এ দু’রকম বিবাহেরই ব্যাবহারিক ফল সমান। উভয় প্রকারে বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তান-সন্ততিরা এক হিন্দু-দায়াধিকার আইনে শাসিত হবে। লৌকিক বিবাহের ফলে কেউ তার পরিবার থেকে বিচুত হবে না বা দেবোত্তর প্রভৃতির সেবায়েতি বা অধ্যক্ষতা থেকে ৰঞ্চিত হবে না। দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা লোপ হবে না, এবং লৌকিক বিবাহকারী পুত্রকে মৃত গণ্যে তার পিতার দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা হবে না।

অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন যে, এই নতুন আইনের হিন্দু-বিবাহবিধি বর্তমান কালে হিন্দুর বৈধ বিবাহের, অর্থাৎ হিন্দুর যে বিবাহ ইংরেজের আদালতে বৈধ বলে স্বীকৃত হয়, তারই ঈষৎ পরিবর্তিত সংস্করণ। শাস্ত্রীয় বিবাহে প্রচলিত হিন্দু-বিবাহের সমস্ত বিধিনিষেধ বহাল আছে। কেবল বরকন্যার সপিণ্ডত্ব নির্ণয়ে পিতৃপক্ষে সাত ও মাতৃপক্ষে পাঁচ পুরুষ গণনার একটা নিয়ম বেঁধে দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রকম প্রচলিত গণনারীতির একটা সমন্বয় করা হয়েছে। এবং অসবর্ণ-বিবাহের নিষেধে বলা হয়েছে যে, ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য, শূদ্র, —এই চার মূল বর্ণের গণ্ডি ভেঙে বিবাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু প্রতি বর্ণের মধ্যে যে সব জাতি ও উপজাতি আছে তাদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ নয়। এ রকম বিবাহের বৈধত্ব ইংরেজের আদালতে অনেক দিন থেকে স্বীকৃত হয়ে আসছে। যদিও সকল স্থানে এ নিয়মের প্রয়োগ সহজ নয়, এবং অনেক স্থানে সন্দেহহীন প্রয়োগ অসম্ভব। কারণ বর্তমান হিন্দু-সমাজ বহু বিচিত্র জাতিতে বিভক্ত, তার অনেক জাতি কোন মূল বর্ণের অন্তর্গত তার নির্ণয় দুরূহ। এ সব জাতির উৎপত্তির শাস্ত্রীয় ইতিহাস হচ্ছে যে, এরা চারবর্ণের মিশ্র-বিবাহের ফলে উৎপন্ন সংকর জাতি, বা ওই সংকরজাতিগুলির মধ্যে মিশ্র-বিবাহের ফলে উৎপন্ন অতিসংকর বা প্রকীর্ণসংকর জাতি বা ওই প্রকীর্ণজাতিগুলির মধ্যে মিশ্র বিবাহের ফলে উৎপন্ন প্রকীর্ণসংকরজাতি। শাস্ত্ৰে সংকর ও প্রকীর্ণসংকরজাতির অনেকগুলির নাম আছে, কিন্তু যেমন মিতাক্ষরাকার বলেছেন সেগুলি দৃষ্টান্তমাত্র-প্রদর্শনাৰ্থমুক্তং, কারণ ‘সংকীর্ণ সংকরজাতনামানস্তাদ্বক্তৃমশক্যত্বাৎ’-সংকীর্ণসংকরজাতিগুলির সংখ্যা অনন্ত জন্য নিঃশেষে তাদের নাম বলা যায় না। এই সংকর ও সংকীর্ণসংকরজাতিগুলি কোনটি কোন বর্ণের অন্তর্গত তার নির্ণয়ের নিয়ম কি? যে জাতিগুলি অনুলোম, অর্থাৎ উচ্চ বৰ্ণ-জাতি পুরুষের সঙ্গে নিম্ন বর্ণ-জাতি স্ত্রীর বিবাহের ফল। —তাদের সম্বন্ধে একটা নিয়ম পাওয়া যায় যে, সস্তানের বর্ণ হবে মাতার বর্ণ। যেমন শঙ্খ বলেছেন, ‘ব্রাহ্মণেন ক্ষত্রিয়ায়ামুৎপাদিতঃ ক্ষত্ৰিয় এবং ভবতি, ক্ষত্ৰিয়েণ বৈশ্যায়াং বৈশ্য এবং ভবতি’ ইত্যাদি, যদিও শঙ্খবচনের যথার্থ অর্থ অর্থাৎ বিবক্ষা নিয়ে বিবাদ আছে। কিন্তু প্রতিলোম অর্থাৎ নিম্ন বর্ণ-জাতি পুরুষের সঙ্গে উচ্চ বর্ণ-জাতি স্ত্রীর বিবাহের ফলে যে সব সংকর জাতির উৎপত্তি তাঁরা কোন বর্ণের অন্তর্গত? অর্বাচীন অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত আধুনিক স্মৃতি যা এখন প্রচলিত, তাতে প্রতিলোম বিবাহ অতি নিন্দিত। শাস্ত্ৰমতে সূত-বৈদেহিক-চাণ্ডাল-মাগধ প্রভৃতি জাতি প্রতিলোম বিবাহে উৎপন্ন। শাস্ত্ৰে স্পষ্ট নির্দেশ না থাকলেও মোটের উপর বলা যায় যে, এরা সকলেই শূদ্রবর্ণের অন্তর্গত। কিন্তু সংকর জাতির বর্ণনির্ণয়ের জটিলতার এখানেই শেষ নয়। যদি ধরেই নেওয়া যায় যে, বর্তমানে কোনও জাতির নাম যদি শাস্ত্ৰবৰ্ণিত কোনও সংকর জাতির নাম হয় তবে নামসাদৃশ্যে সে জাতিকে শাস্ত্রোক্ত সংকরজাতি বলে গণ্য করতে হবে, তা হলেও অনেক জাতি এখন রয়েছে যাদের নাম কোনও প্রামাণিক শাস্ত্রগ্রন্থে নেই। এ সব জাতির বর্ণ নির্ণয় করতে হলে জানতে হবে তাদের উৎপত্তির ইতিহাস। বহুস্থলেই এ ইতিহাসের কোনও মালমশলা নেই। এ রকম জাতির উৎপত্তির ইতিহাস নামে যা চলে তার লক্ষ্য সত্য-নির্ণয় নয়, তার উদ্দেশ্য জাতির সিঁড়িতে নিজের জাতিকে দু-এক ধাপ টেনে তোলা, বা পাশের জাতিকে দু-এক ধাপ নীচে ঠেলা। বাংলাদেশ থেকে পরিচিত দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। বাংলার বৈদ্যারা অনেক দিন থেকে দাবি করে আসছিলেন যে তাঁরা শাস্ত্রোক্ত ‘অম্বষ্ঠ’ জাতি, অর্থাৎ ব্রাহ্মণের বৈশ্য স্ত্রীর সন্তানেরা তাদের আদি পুরুষ। ‘বিপ্ৰান্মুধাবসিক্তো হি ক্ষত্রিয়ায়াং বিশঃ স্ক্রিয়াম অম্বষ্ঠঃ’ (যাজ্ঞবল্ক্য)। সুতরাং শঙ্খস্মৃতির বচন অনুসারে তাঁরা বৰ্ণে বৈশ্য ও দ্বিজ। বাংলার হিন্দু-সমাজে এ দাবি মোটের উপর গ্রাহ্য হয়েছিল। সম্প্রতি অনেক বাঙালি বৈদ্য বলছেন যে প্রকৃতপক্ষে তাঁরা বর্ণে ব্ৰাহ্মণ। বৈদ্যরা যে ‘অম্বষ্ঠ’ সুতরাং বৰ্ণে বৈশ্য, তার প্রধান প্রমাণ ছিল যে, অম্বষ্ঠের শাস্ত্ৰবিহিত বৃত্তি হচ্ছে চিকিৎসা‘সূতানামশ্ব-সারথমম্বষ্ঠানাং-চিকিৎসনম (মনু); এবং ইংরেজের আগমনে বৃত্তিতন্ত্র ভঙ্গের পূর্বে বৈদ্যদের জাতিগত বৃত্তি ছিল চিকিৎসা ও মোটের উপর তাঁরা দ্বিজের আচার পালন করতেন। বৈদ্যরা ব্ৰাহ্মণ, এর সমর্থনে এ রকম প্রমাণের অভাব হওয়ার কথা নয়। সত্য যেখানে অজ্ঞাত, কল্পনা সেখানে অবারিত। বাংলার কায়স্থেরা নিজেদের শূদ্র বলেই স্বীকার করে আসছিলেন। কলকাতা হাইকোর্টের এক নজির আছে যে কায়স্থের ছেলের সঙ্গে তাতির মেয়ের বিবাহ সিদ্ধ, কারণ দুজনেই শূদ্রবর্ণের অন্তর্গত। সকলেই জানেন অনেক বাঙালি কায়স্থ দাবি করছেন যে প্রকৃতপক্ষে কায়স্থেরা ক্ষত্ৰিয়বৰ্ণ, এবং তাঁরা দ্বিজোচিত আচারও পালন করছেন। যে প্রমাণে বাংলার বৈদ্যারা নিজেদের বৈশ্য কি ব্ৰাহ্মণ বলেন বাঙালি কায়স্থের ক্ষত্ৰিয়ত্বের পোষকে সে রকম প্রমাণ উপস্থিত করা কিছু কঠিন নয়। আদালতে এ রকম সব দাবি উপস্থিত হলে কোন প্রমাণে তার বিচার হবে? কোন শাস্ত্ৰ, ইতিহাস কি প্রত্নতত্ত্ব প্রমাণ বলে গ্রাহ্য হবে? অথবা অনতিকাল পূর্বের দেশাচারই হবে সবচেয়ে গ্রাহ্য প্রমাণ? সুতরাং প্রস্তাবিত আইনের অসবর্ণ-বিবাহের বিধি-নিষেধ শুনতে যত সরল, তার ব্যাবহারিক প্রয়োগ তত সহজ নয়। অধিকন্তু এর মূলেই আছে বড় গলদ। সংকর জাতিগুলির উৎপত্তির যে শাস্ত্ৰেতিহাস, হিন্দুর অনেক জাতিকে তার কাঠামে কিছুতেই ফেলা যায় না। কারণ স্বীকার না করে উপায় নেই যে অনেক জনসমষ্টি চারবর্ণের বাইরে থেকে এসে একটা জাতির নাম নিয়ে হিন্দুসমাজে মিশে গেছে। সে সব জাতির বর্ণনির্ণয়ে তাদের উৎপত্তির সত্য ইতিহাস অবাস্তর। কাল্পনিক ইতিহাস সৃষ্টি করলেই তবে তাদের বর্ণ-নিরূপণ সম্ভব হয়।

প্ৰস্তাবিত আইনের ‘লৌকিক বিবাহ’ ১৮৭২ সালের প্রসিদ্ধ তিন আইনের ১৯২৩ সালে যে সংস্কার হয়েছে তারই কিছু পরিবর্তিত রূপ। মূল তিন আইন অনুসারে যদি কোনও হিন্দু অসবর্ণ বিবাহ করত। তবে তাকে স্বীকারোক্তি করতে হত যে ধর্মে সে হিন্দু নয়। কারণ ওই আইন অনুসারে বিবাহ কেবল তাদের মধ্যেই হতে পারত যাঁরা খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, মুসলমান, পারসি, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন কোনও ধর্মকেই নিজের ধর্ম বলে স্বীকার করে না। কিন্তু ইংরেজের আদালতে বিচার হল যে এ অস্বীকার কেবল বিবাহাৰ্থ। সুতরাং তিন আইনে অসবর্ণ বিবাহকারী হিন্দু ও তাদের সন্তানদের দায়াধিকারের আইন হিন্দু-আইন। ১৯২৩ সালের সংস্কারে ব্যবস্থা হল যে যাঁরা নিজেদের হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈনধর্মাবলম্বী বলবেন তঁরাও তিন আইন অনুসারে বিবাহ করতে পারবেন। সুতরাং ওই আইন অনুসারে অসবর্ণ বিবাহেছুক হিন্দু ধর্মে হিন্দু পরিচয়েই সে বিবাহ করতে পারবে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হল যে এ রকমে বিবাহিত হিন্দুর দায়াধিকার আইন হিন্দু-আইন থাকবে না, হবে ‘ভারতবষীয় উত্তরাধিকার’ আইনের দায়ভাগবিধি, অর্থাৎ খ্রিস্টানদের দায়াধিকার আইন। এ বিবাহের ফলে হিন্দু তার পরিবার থেকে বিচুত হবে, দেবোত্তরে কোনও স্বত্ব থাকবে না, দত্তকগ্ৰহণ নিষিদ্ধ হবে, তাকে মৃত্যগণ্যে তার পিতা দত্তকগ্ৰহণ করতে পারবে। অর্থাৎ হিন্দু স্বীকারে যখন এ রকম বিবাহ করেছ তখন হিন্দু-আইন আর তোমার প্রতি প্রযোজ্য নয়! হিন্দু-আইন বহাল রাখতে হলে বিবাহের সময় বলতে হবে যে তুমি হিন্দু নও। পূর্বেই বলেছি যে প্রস্তাবিত আইন ১৯২৩ সালের সংস্কারের এই আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত ব্যবস্থাগুলিকে রদ করেছে।

8

তিন আইনের ১৯২৩ সালের এই অদ্ভুত সংস্কারগুলি অকারণ নয়। ওদের উদ্দেশ্য ছিল অসবর্ণ বিবাহের নামে ‘হিন্দুধৰ্ম গেল’ বলে যাঁরা সরব হন তাঁদের আশ্বস্ত করা। করুক না লোকে হিন্দু নাম নিয়েই এ রকম বিবাহ। বিবাহের পর তাঁরা তো আর কোনও অর্থেই হিন্দু থাকছে না। বুরং ইংরেজ আদালতের বিচার উলটে বলা যায় যে, এদের হিন্দুত্ব স্বীকার কেবল বিবাহাৰ্থ। আর বর্জন করে আত্মরক্ষার রীতিতে হিন্দু-সমাজ বহুদিন যে মরণান্ত বীৰ্য দেখিয়ে আসছে। এ বিবাহ স্বীকার হবে তার-ই একটা প্রকাশ। প্রস্তাবিত আইনে যে দুরকম হিন্দুবিবাহের ব্যবস্থা হয়েছে তারও উদ্দেশ্য এই সনাতনীদের আশ্বস্ত করা। শাস্ত্রীয় বিবাহে যখন চলতি নিষেধ সব বহাল থাকল। তখন একটা অশাস্ত্রীয় ‘লৌকিক বিবাহ’ স্বীকারে ক্ষতি কী! কিন্তু এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। যদি সনাতনীদের তুষ্ট করে এ আইন পাশ করাতে হয় তবে এ আইন পাশ হবে না। কারণ দুরকম বিবাহের ব্যাবহারিক ফল যেখানে এক, অশাস্ত্রীয় লৌকিক বিবাহের পতি-পত্নীর হিন্দুর সমাজ ও ধর্মে সকল দাবি যখন সম্পূর্ণ বহাল থাকবে তখন সনাতনপন্থী তুষ্ট বা আশ্বস্ত হবে কীসে? এ দ্বৈত যে মায়ামাত্র তা বুঝতে বেশি শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসনের দরকার হয় না। আর যদি সনাতনীদের বিরোধ সত্ত্বেও এ আইন পাশ হয় তা হবে তাদের মতের জোরে যাঁরা সমগ্ৰ হিন্দু-সমাজের যুগ-উপযোগী পরিবর্তন চায়, সে সমাজের বিধি-বন্ধন থেকে ব্যক্তিবিশেষের মুক্তিমাত্র চায় না। এ রকম ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মূল্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্ত সমাজের উপর তার ফল গৌণ ফল। হিন্দুর বর্তমান সমাজ এই গৌণ উপায়ে পরিবর্তনের চেষ্টায় যুগ ছাড়িয়ে এসেছে। এখন প্রয়োজন সমস্ত সমাজের হিতে হিন্দুর সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিবর্তন, যার ফলে হিন্দু-সমাজ পাবে নুতন দৃঢ় গড়ন ও সে সমাজে আসবে নুতন প্রাণ ও নুতন বল।

প্ৰস্তাবিত আইনে অপরিবর্তিত শাস্ত্রীয় বিবাহ’ বিধির পাশে পরিবর্তিত এক ‘লৌকিক বিবাহ-রীতি দাঁড় করানোর ব্যবস্থা এই কাম্য পরিবর্তনের অনুকুল নয়। এ ব্যবস্থার বাহ্য আকার হচ্ছে সেই সব পূর্ব চেষ্টার অনুরূপ যা হিন্দু-সমাজের চলতি বিধিকে বহাল রেখে তার বন্ধন থেকে মুক্তিকামী লোকদের ছাড়পত্র দিতে চেয়েছে, যদিও এর আন্তরিক উদ্দেশ্য গৌণভাবে সে বিধির বদল ঘটানো। কিন্তু এ আইন পাশ হলেও এই বাহ্যিক আকারেরই জয় হবে, এর আন্তরিক উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এর ফলে হিন্দু-সমাজের বিবাহ-রীতির কোনও বড় পরিবর্তন ঘটবে না, যেমন ঘটেনি মূল তিন আইনে বা তার পরিবর্তিত রূপে। তার কারণ কিছু নিগূঢ় নয়। যে হিন্দু তার বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থার পরিৱর্তন চায় এ পরিবর্তন আসবে যতটা সম্ভব হিন্দুর আচার ঐতিহ্যকে বজায় রেখে। পরিবর্তনের ফল হবে পরিবর্তিত হিন্দু-সমাজ, পূর্বের সঙ্গে যোগসূত্রহীন সম্পূর্ণ নূতন বস্তু নয়। এই মনোভাবের কাছে পাণিগ্রহণ-মন্ত্ৰ-উচ্চারণে বিবাহ আর রাজকর্মচারীর কাছে রেজিষ্টি করে বিবাহ এক জিনিস নয়। হিন্দু-সমাজ থেকে অসবর্ণ বিবাহের বাধা দূর করার প্রকৃষ্ট উপায় নয় ও বিবাহকে ধর্মানুষ্ঠানে অপাঙক্তেয় করা, যাতে প্রচলিত শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানেও বিবাহ সিদ্ধ হবে না, ওর সিদ্ধির জন্য দরকার হবে প্ৰতিজ্ঞাপত্ৰ স্বাক্ষর ও রেজিষ্ট্রি।

এ আইনের দু’রকম বিবাহ-বিধির প্রস্তাব আরও নিরর্থক, কারণ কি শাস্ত্রীয় কি লৌকিক উভয় বিবাহই করা হয়েছে একপত্নীক; এক স্ত্রী বর্তমানে স্বামীর পুনর্বিবাহ অসিদ্ধ হবে। আশা করা যায়। এ প্রস্তাবে সনাতনীদেরও খুব বেশি আপত্তি হবে না। আইনে যা-ই হোক, সমাজে আধুনিক হিন্দুর বিবাহ মোটের উপর একপত্নীক। অর্থাৎ আমাদের মনের সম্মতি একপত্নীক বিবাহের আদর্শের দিকেই। বহু-বিবাহ আইনে নিষিদ্ধ করলে অন্য দেশে ও সমাজে মাঝে মাঝে যে সব অসুবিধা ঘটে তা আমাদের মধ্যেও ঘটবে। কিন্তু তার কুফলের পরিমাণ বহু-বিবাহের কুফলের তুলনায় অনেক কম। মানুষের কোনও নিয়ম সম্পূর্ণ দোষমুক্ত করা যায় না। যেটা মোটের উপর ভাল তাকেই বেছে নিতে হয়।

শাস্ত্রীয় ও লৌকিক প্ৰভেদ যদি আইনে রাখতেও হয়, এবং শাস্ত্রীয় বিবাহে যদি অসবর্ণ বিবাহ নিষিদ্ধই থাকে। তবুও সে বিবাহে গোত্র-প্রবারের বাধা দূর করে বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রের আরও প্রসার করা আজ অত্যন্ত প্রয়োজন। বিবাহযোগ্যা কন্যার পিতামাতা মাত্রই জানেন হিন্দু-সমাজের সংকীর্ণ বিবাহক্ষেত্ৰ কত বড় বিপত্তি। অথচ সগোত্র সমানপ্রবারের বাধা আজ সম্পূর্ণ অর্থহীন। থিয়োরি হচ্ছে যে, জমদগ্নি প্রভৃতি কয়েকজন ব্ৰাহ্মণ সকল ব্ৰাহ্মণের আদিপুরুষ। এই কয়জনের নামই গোত্ৰনাম। সুতরাং যে ব্ৰাহ্মণের বংশপরম্পরা যে গোত্র প্রসিদ্ধ ধরতে হবে তিনি সেই নামের আদিপুরুষ ব্ৰাহ্মণের বংশধর। ‘প্রবরে’র ব্যাপার আরও একটু ঘোরালো। প্রতি গোত্রে অনেকগুলি করে প্রবর আছে। সেগুলিও ব্যক্তিবিশেষের নাম। একটা প্ৰসিদ্ধি এই যে, ‘প্রবর’ প্রবর্তক ঋষিরা ‘গোত্ৰ’ প্রবর্তক ঋষিদের পুত্রপৌত্র। সুতরাং সগোত্র ও সমান প্রবর লোকেরা যত দূরের সম্পর্কই হোক এক বংশের লোক। এবং যাদের প্রবর এক তাদের সম্পর্কটা ওরই মধ্যে একটু নিকট। কিন্তু মুশকিল। এই যে, ভিন্ন গোত্রেও এক প্রবারের নাম আছে। যেমন উপমনু গোত্রের এক প্রবর বিশিষ্ট, আবার পরাশর গোত্রেরও এক প্রবর বিশিষ্ট। অর্থাৎ ভিন্ন গোত্রের লোক এক প্রবর হতে পারে। আমরা সবাই জানি সেই জন্যই সমানপ্রবারের বাধা বিবাহে সগোত্রের অতিরিক্ত আর এক বাধা। সুতরাং মেধাতিথি মনুভাষ্যে প্রশ্ন তুলেছেন যে, প্রস্তাবিত বরকন্যা যদি ভিন্নগোত্রের হয় তবে কি করে তাঁরা এক ঋষির সন্তান গণ্যে সমানপ্রবর হতে পারে। এবং মীমাংসা করেছেন যে, স্মৃতি যখন বলছেন হতে পারে তখন তাই স্বীকার করতে হবে। কারণ গোত্রপ্রবর জিনিসটি সম্পূর্ণ শ্রুতি-স্মৃতির এলাকার অর্থাৎ অলৌকিক বস্তু। লৌকিক যুক্তিতে ওর ব্যাখ্যা করা যাবে না। প্রকৃত কথা এই যে, ভাষ্যকার ও নিবন্ধকারদের সময়ে প্রবারের যথার্থ অর্থের স্মৃতিও লোপ হয়েছিল। এবং নানা পরস্পরবিরোধী কল্পনা তার স্থান পূরণ করছিল। পাঠক যদি রঘুনন্দনের উদ্ধাহতত্ত্বে ধৃত মাধবাচার্যের প্রবারের ব্যাখ্যার সঙ্গে, অসপিণ্ডী চ যা মাতুরসগোত্ৰ চা পিতুঃ’-এই মনু বচনের মেধাতিথির ভাষ্য মিলিয়ে দেখেন তবেই এ সত্য হৃদয়ঙ্গম হবে। গোত্র-প্রবারের যথাৰ্থ ব্যাখ্যা যাই হোক সকলেই একমত যে, এক ব্ৰাহ্মণ ভিন্ন অন্য কোনও বর্ণের বংশগত গোত্র-প্রবার সম্ভব নয়, কারণ গোত্ৰ-প্রবর প্রবর্তক ঋষিরা ছিলেন সবাই ব্ৰাহ্মণ। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের যে গোত্র-প্রবর সে হচ্ছে তাদের পুরোহিতদের গোত্র-প্রবর তাদের আরোপ করে। ‘যদ্যপি রাজন্য বিশাং প্রতিস্বিক গোত্ৰাভাবাৎ প্রবরাভাবঃ তথাহিপি পুরোহিতগোত্রাপ্রবরেী বেদিবেী’ (মিতাক্ষরা)। কিন্তু এই আরোপিত গোত্র-প্রবরই আবার বিবাহে বাধা! শূদ্রের বিবাহাৰ্থ কোনও গোত্র-প্রবর নেই। ‘প্রাগুরু মনুশাতাতপবচনে দ্বিজাতিগ্রহণং সৈগোত্রবর্জনে শূদ্ৰব্যাবৃতাৰ্থম’ (উদ্ধাহতত্ত্ব)। কিন্তু মজা এই যে, যাদের পূৰ্বপুরুষেরা নিজেদের শূদ্র বলতেন এবং যাঁরা এখন নিজেদের দ্বিজ বলে তাঁরা কল্পিত গোত্র-প্রবারের বাস্তব বন্ধনে নিজেদের বাঁধতে বাধ্য হচ্ছেন!

কিন্তু ব্ৰাহ্মণের পক্ষেও এই গোত্র-প্রবারের বাধার স্বরূপ কি? রক্তসম্বন্ধজন্য বিবাহ নিষেধের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। যার সঙ্গে রক্তের সম্বন্ধ সপিণ্ড-সম্বন্ধ সীমার বাইরে হলেই তার সঙ্গে বিবাহ চলে এবং বাংলাদেশে সে সীমার মধ্যেও কন্যা ব্রিগোত্রান্তরিত হলে তাকে বিবাহ করা যায়, কিন্তু যেখানে রক্তসম্বন্ধের কোনও ইতিহাস নেই, কেবলমাত্র বংশ-পরম্পরাগত দুইটি নামসাম্য বিবাহের অলঙ্ঘনীয় বাধা! যদি স্বীকার করা যায় যে একশো পুরুষ পূর্বে সগোত্ৰ স্ত্রীপুরুষের পূর্বপুরুষ এক ছিল, কোন যুক্তিতে সেটা বিবাহে বাধা হতে পারে? সপিণ্ডের সঙ্গে বিবাহ নিষেধ। সপিণ্ড শব্দের অর্থ যাদের পিণ্ড বা দেহ এক, একন্দেহ থেকে যাঁরা উদ্ভূত। সিপিণ্ডতা তু এক শরীরাবয়বান্বয়েন ভবতি’ (মিতাক্ষরা)। কিন্তু এই অনাদি সংসারে সকলের মধ্যেই সকলের এ রকম সপিণ্ডতা সম্ভব, কিন্তু সেটা অতিপ্ৰসঙ্গ, কারণ তা হলে কোনও বিবাহই সম্ভব হয় না। ‘তাচ্চ সর্বত্র সর্বস্য যথাকথাং চিদামাদীে সংসারে ভবতীত্যাতিপ্ৰসংগঃ’ (মিতাক্ষরা)। সুতরাং সপিণ্ড শব্দের অর্থকে নিতে হবে কাট-ছাট করে একটা নিয়মিত কার্যকরী গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে, পঙ্কজ শব্দের অর্থে যেমন করা হয়। অতশ্চায়ং সপিণ্ডশব্দোহবায়শাক্ত্যা সর্বত্ৰ প্ৰবৰ্ত্তমানেহপি নির্মস্থা পঙ্কজাদি শব্দ বন্নিয়ত বিষয় এব’ (মিতাক্ষরা)। সেই জন্যই বিবাহের সপিণ্ডতা মাতার বংশে পাঁচ পুরুষ ও পিতার বংশে সাত পুরুষেই শেষ হয়। ‘পঞ্চমাৎ সপ্তমাৎ উর্ধাৎ মাতৃতঃ পিতৃতস্তথা’ (যাজ্ঞবল্ক্য)। হিন্দু-বিবাহে সগোত্রপ্রবারের নিষেধ বর্জনের চেয়ে হিন্দু-শাস্ত্রকারদের এ যুক্তির সুষ্ঠুতর প্রয়োগের ক্ষেত্র আর নেই।

হিন্দু-বিবাহে সপিণ্ডের মধ্যে বিবাহ নিষেধের বিধি নিকট সম্পর্কিত স্ত্রীপুরুষের মধ্যে বিবাহ নিবারণের নিয়ম। এ নিষেধ সকল সমাজের বিবাহরীতিতেই কোনও-না-কোনও রকম আছে। হিন্দু-সমাজের প্রচলিত নিয়মে পিতার বংশে সাত ও মাতার বংশে পাঁচ সিঁড়ি উপরে ও নীচে এই নিষিদ্ধ সীমার গণ্ডি। অনেকে সম্ভব জানেন যে, এ বিষয়ে সকল শাস্ত্রকার একমত ছিলেন না। কোনও কোনও শাস্ত্রকার ওই গণ্ডিকে সংক্ষেপ করে পিতৃপক্ষে পাঁচ ও মাতৃপক্ষে তিন পর্যন্ত মাত্র গণনার বিধি দিতেন। ‘শ্ৰীনতীত্য মাতৃতঃ পঞ্চােতীত্য চ পিতৃতঃ’ (পৈঠনসি)। পরবর্তী কালের ভাষ্য ও নিবন্ধকারেরা পৈঠনসি-প্রমুখদের মতো এই বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন যে, ও দুই সংখ্যার উল্লেখ তার চেয়ে কম সংখ্যার নিষেধের জন্য, সংখ্যা দুটিকে স্থাপনের জন্য নয়, কারণ তা না হলে স্মৃতিবাক্যের পরস্পর বিরোধ হয়। ‘তদপ্যর্বাঙ নিষেধাৰ্থং ন পুনস্তৎপ্রাপ্তার্থমিতি সর্বস্মৃতী নামবিরোধঃ’ (মিতাক্ষরা)। সকল স্মৃতিকার যে সমস্ত বিষয়ে একবিধি দিয়েছেন এটা স্পষ্টতই সত্য নয়, ভাষ্যকারীদের ‘ওয়ার্কিং হাইপথেসিস’ মাত্ৰ–যার উপর নির্ভর করে নিজের মতের বিরুদ্ধ শাস্ত্ৰবাক্যকে যা কিছু একটা দুর্ব্যাখ্যা দিয়ে সরিয়ে রাখা যায়। সাত আর পাঁচ এই সহজ কথা বলা যার অভিপ্ৰায় সে কখনও ব্যাখ্যাকারদের উপর ভরসা রেখে বলতে যায় না পাঁচ। আর তিন। গোলাপচন্দ্ৰ শাস্ত্রী তাঁর ‘হিন্দু আইন’ পুস্তকে বলেছেন যে, বাংলাদেশের ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে পৈঠনসির পাঁচ। আর তিন মতবাদই কাৰ্যত চলে। যদিও বাঙালি স্মার্ত রঘুনন্দন সাত আর পাঁচ গণনার জোর পক্ষপাতী। আমার মতে প্ৰস্তাবিত আইনে সপিণ্ডত্বের সীমা পাচ আর তিন নির্দেশ করা উচিত। এ নিয়মের পক্ষে শাস্ত্ৰও আছে, এবং বর্তমান হিন্দু-সামাজিক বোধ ও রুচিরও তা বিরুদ্ধ নয়। এ নিয়মে বিবাহ্য বর ও বিবাহ্য কন্যার ক্ষেত্র বড় হবে, যার সামাজিক প্রয়োজন আছে।

এ আইনে শাস্ত্রীয় বিবাহের নিষিদ্ধ সম্বন্ধের গণ্ডি প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খুব বড়, কিন্তু লৌকিক বিবাহের ওই গণ্ডি তিন আইনের নিষিদ্ধ গণ্ডির চেয়েও ছোট। প্রস্তাবিত আইনের এই নিষিদ্ধ সম্পর্কের বিবরণ পূর্বেই দিয়েছি। এ নিয়মে খুড়তুতো জোঠতুতো ভাই-বোনের বিবাহ নিষিদ্ধ নয়। কমিটি তাদের টীকায় বলেছেন যে, এ রকম বিবাহের বৈদিক প্রমাণ আছে, এবং এর ঐতিহাসিক দৃষ্টাস্তের অভাব নেই। সত্য কথা। কিন্তু প্রাচীন প্রথার নজির তখনই কার্যকরী হয় যখন সে প্রথাকে পুনরায় চল করার সামাজিক প্রয়োজন আছে, এবং সামাজিক মন ও রুচি তার প্রতি একান্ত বিমুখ নয়। এ আইনের লৌকিক বিবাহের নিষিদ্ধ সম্পর্কের সীমা এত অপ্ৰসর যে এমন অনেক বর-কন্যার বিবাহ সম্ভব যে-বিবাহ আধুনিক হিন্দুর সামাজিক বোধ ও রুচিতে প্ৰকাণ্ড ঘা দেয়। কমিটি বলেছেন যে তাদের প্রস্তাবিত এই নিষিদ্ধ সম্পর্কের তালিকা পৃথিবীর প্রায় অন্য সব দেশের নিষেধের তালিকার সঙ্গে এক। কথাটা সর্বাংশে সত্য বলে মনে হয় না। বহু সভ্যদেশের নিষিদ্ধ সম্বন্ধের সীমা এর চেয়ে বড়। নিকট সম্পর্কিতের মধ্যে বিবাহ নিষেধের জীব-বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আধুনিক বিজ্ঞানের মতে খুব দৃঢ় নয়। ওর যথার্থ ভিত্তি হচ্ছে সামাজিক পরিবেশের ফলে সামাজিক রুচির বিরুদ্ধতা। সুতরাং কোনও বিশেষ সমাজের বিমুখ রুচিকে অন্য সমাজের দৃষ্টান্তে এখানে অগ্রাহ্য করা চলে না। আমার মতে শাস্ত্রীয় বিবাহের গণ্ডি কিছু খাটো করে, এবং লৌকিক বিবাহের গণ্ডি অনেকটা বাড়িয়ে বিবাহ-নিষেধের সম্বন্ধ-গণ্ডিকে এক করা উচিত। পৈতীনসির বিধি স্বীকার করলে আপাতত কাজ চলতে পারে। এবং তাতে দু’রকম বিবাহ-বিধি রাখার একটা কারণ লোপ হয়। এ পর্যন্ত হিন্দু-বিবাহ আইনের খসড়ার যে আলোচনা করেছি তাতে আমার মত সংক্ষেপে এই দাড়ায়।

১। ‘শাস্ত্রীয়’ ও ‘লৌকিক’ দু’ রকম পৃথক বিবাহবিধি থাকবে না। হিন্দু বিবাহবিধি হবে এক রকম।

২। সে বিধিতে বর-কন্যার অসবর্ণত্ব বৈধ বিবাহের বাধা হবে না।

৩। সগোত্র বা সমানপ্রবর বর-কন্যার বিবাহ হতে পারবে।

৪। বিবাহের সপিণ্ডত্ব পৈঠীনসির মতানুযায়ী হবে পিতৃপক্ষে পাঁচ ও মাতৃপক্ষে তিন।

৫। বিবাহ হবে একপত্নীক।

কমিটি যেমন প্রস্তাব করেছেন তিন আইন অনুসারে কোনও হিন্দু, যিনি নিজেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে স্বীকার করেন, তার বিবাহ হবে না। ওই আইন বা অনুরূপ আইন থাকবে তাদেব জন্য যাঁরা ‘ব্রাতা’–যাঁরা সংস্কার রহিত; যাঁরা কোনও ধর্মমতকে সামাজিক বিধির নিয়ামক স্বীকার করেন না। ভবিষ্যৎ কালের এক অখণ্ডজাতি ভারতবর্ষের তাঁরা সম্ভব পথপ্রদর্শক অগ্রদল। তাদের নমস্কার কবি। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের হিন্দু-সমাজ নূতন কলেবর নিয়ে শক্তিমান হয়ে গড়ে উঠুক।

———–
* এই রচনাটি সন ১৩৪৯ সালের কার্তিক মাসে লিখিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *