৪. চাষের জমির মালিকি স্বত্ব

ইংরেজ-শাসনের আরম্ভে চাষের জমির মালিকি স্বত্ব জমিদারদের না দিয়ে চাষিদের দিলে (তার পূর্বে চাষিরাই জমির মালিক ছিল কি না সে-তর্ক ছেড়ে দিচ্ছি) চাষিরা যে পরবর্তী কালের অনেক অন্যায় ও জুলুম থেকে রক্ষা পেত। তাতে সন্দেহ নেই। ফলে, চাষির আত্মসম্মান অনেকটা অক্ষুন্ন থাকত, এবং সম্ভব, বাংলার চাষি-সম্প্রদায় এখনকার চেয়ে স্বাধীন ও দৃঢ়চিত্ত হত। কিন্তু আজ তাঁরা যে ফসল ফলাচ্ছে মালিকি স্বত্বের জাদুতে তার চেয়ে প্রকারে ও পরিমাণে ভাল ও বেশি ফসল ফলাত কিনা তাতে সন্দেহ আছে। প্ৰাণের তাগিদে চাষি নালায়েক জমিতে চাষ বিস্তৃত করেছে জমিদারকে নজর ও খাজনা দিয়ে। লাভের আশায় নূতন ফসল চাষ করেছে, কি অল্প জমিতে যে-ফসলের চাষ হত তার আবাদ অনেকগুণ বাড়িয়েছে–যেমন পাট ও গোল-আলু। এতে জমিদারের কোনও সাহায্য পায়নি, যদি সরকারের সাহায্য পেয়ে থাকে তা নগণ্য। চাষির অতি সামান্য যা উদ্ধৃত্ত, এ দেশের কৃষিব তাই মূলধন। পুরুষপরম্পরাগত বহু প্ৰাচীন যে জ্ঞান ও কৌশল চাষি বাপপিতামহের কাছে শেখে এ দেশে তাই কৃষিবিদ্যা। চাষের যে যন্ত্রপাতি বাংলাব চাষি আজ ব্যবহার করে বহু শতাব্দী ধরে তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দেড়শো বছর পূর্বে বাংলাদেশের চাষে যে মূলধন, বিদ্যাবুদ্ধি ও কৌশলের প্রয়োগ হত দেড়শো বছর পরেও তাই হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য কোনও বদল হয়নি। জমিদারেরা চাষের জমির মালিকি স্বত্ব পেয়ে এর কোনও বিষয়ে কিছুমাত্র উন্নতির চেষ্টা করেননি। তাদের সামাজিক পদমর্যাদা যাই হোক, দেশের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোটা মুনাফায় রাজস্বের ইজারাদার ছাড়া তাঁরা আর কিছু নন। এবং এক প্রাচীন দলিল ছাড়া তাদের টিকিয়ে রাখার অন্য কোনও কৈফিয়তও নেই। কিন্তু মালিকি স্বত্ব জমিদারের হাত থেকে চাষির হাতে তুলে দিলেই চাষের উন্নতি হয়ে দেশ কৃষিসম্পদে ভরে যাবে, এমন বিশ্বাস কর্নওয়ালিসি ম্যাজিক-বিশ্বাসেরই চাষি-সংস্করণ। মালিকি জাদু জমিদারের কাছে ফলেনি ইচ্ছার অভাবে, চাষির কাছে ফলবে না ক্ষমতার অভাবে।

বাংলায় ও ভারতবর্ষে ইংরেজ-শাসনের আমলেই অন্য অনেক সভ্যদেশে কৃষির জন্মান্তর ঘটেছে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও সমাধান পশ্চিম ইউরোপের মনে ও জীবনে যুগান্তর এনেছে মানুষের জীবনযাত্রায় তার ব্যাপক প্রয়োগ আরম্ভ হয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকেই। কৃষিকার্যে তার প্রয়োগ আরম্ভ হয়েছে তারও অনেক পরে, মোটামুটি গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। চিরস্থায়ী বন্দােবস্তের সময় যে বিদ্যায় ও কৌশলে এদেশের চাষের জমি চাষ হত, অন্য সভ্যদেশের কৃষিবিদ্যা ও কৌশল তা থেকে বেশি। তফাত ছিল না। আজ আমরা বক্তৃতায় প্রবন্ধে প্রদর্শনীতে ছক কেটে তুলনায় দেখাই, নানা দেশের বিঘা প্রতি ফসল কত বেশি, আমাদের দেশে কত কম। সকলেই জানি, তার কারণ সে-সব দেশে কৃষির সহায় নূতন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও কৌশল, আর সে জ্ঞান ও কৌশলের প্রয়োগ আমাদের দেশের কৃষিতে নেই। বাংলার ও ভারতবর্ষের চাষের জমির আজ প্রথম প্রয়োজন ও প্রধান সমস্যা–এই নুতন জ্ঞান ও কৌশল কৃষির কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করা। দেশে খাদ্যশস্যের যে-ফলন হয় গুণে ও পরিমাণে দেশের সমস্ত লোককে সুস্থ ও কর্মঠ শরীরে বঁচিয়ে রাখার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়; লোকসংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে এই অপ্রাচুর্যের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এই লোকের অধিকাংশ হচ্ছে চাষি ও তাদের পরিবার। অন্য কৃষিপণ্য যা উৎপন্ন হয়। চাষির ও দেশের দারিদ্র্য তাতে ঘোচে না। এ অবস্থার একমাত্র প্রতিকার চাষের কাজে নূতন জ্ঞানবিজ্ঞান-কৌশলের প্রয়োগ, নানা সভ্যদেশ আজ যা করছে। জমির মালিক জমিদারেরা এ-কাজে কোনও সাহায্য করবেন, এমন কল্পনা কেউ করে না। চাষিরা নিজে থেকে এতে উদ্যোগী হবে, সে ভরসাও কারও নেই–জমির ভোগদখলে যত সুবিধাই তাদের হোক আর জমির খাজনার হার যত কমানোই হোক। অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা এদেশে বৈজ্ঞানিক কৃষি প্রবর্তনে কি কি প্রয়োজন তার তালিকা মধ্যে মধ্যে প্রকাশ করে থাকেন। জমিতে জৈব ও রাসায়নিক সার দেওয়া, উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার, জলসেচ ও জলনিকাশের ব্যবস্থা, ভূমি-উদ্ভিদ-আবহ-বিদ্যার নানা তথ্যের ব্যাবহারিক প্রয়োগ। সংবাদপত্র থেকে চোখ তুলে যখন তাকাই দেশের চাষির দিকে–তার দাবিদ্র্য, তার অস্বাস্থ্য, তার অশিক্ষা, এবং ফলে তার মনের নিদারুণ দৈন্য ও ক্ষুদ্রতা দেখে তখন ওইসব ফর্দ ও ফিরিস্তি নির্মম পরিহাস বলে মনে হয়। এ চেষ্টা সার্থক হতে পারে। যদি সমস্ত দেশের শুভবুদ্ধি ও কর্মের উৎসাহ উদ্ধৃদ্ধ হয়, এবং দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রশক্তির মধ্য দিয়ে সে-বুদ্ধি ও উৎসাহ যদি আত্মপ্রকাশের পথ পায়। চাষের জমিতে মালিকি স্বত্বের লোভ দেখিয়ে এ ভার শ্রেণি-বিশেষকে দেওয়া চলে না, দিয়ে ফললাভের আশা করাও চরম মুঢ়তা।

আমাদের দেশে যে সরকারি কৃষিশালা কি পরীক্ষাগার নেই, তা নয়; দু-চারটে আছে। এ দেশে বৈজ্ঞানিক কৃষি প্রবর্তনে চাষিকে সাহায্য করা তাদের কাজ নয়। নূতন জ্ঞানের আবিষ্কারে ও অথবা তা কাজে লাগাবার উপায়-উদ্ভাবনেও এদের সার্থকতা নয়। এদেশে ইংরেজ-শাসন যে পূর্বকালের রাজশাসনের মতো শান্তি ও শৃঙ্খলা-রক্ষার উদ্দেশ্যে সৈন্য ও পুলিশ-শাসন মাত্র নয়, একালের আদর্শ অনুযায়ী দেশবাসীর সর্ব-হিতে-রত মঙ্গলময ব্যবস্থা–তারই চিহ্নস্বরূপ এদের দাড় করিয়ে রাখা হয়। এগুলি প্ৰতীকমাত্র, বস্তু নয়। ছোট-বড় লাটের বক্তৃতার এরা উপাদান জোগায়। এবং প্রসঙ্গত, গুটিকয়েক ইংরেজের বড় মাহিয়ানায়, ও কয়েকজন ইংরেজিশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ভারতবাসীর ছোট মাহিয়ানায় চাকুরি সৃষ্টি করে। অথচ, কৃষিতে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও কৌশলের প্রয়োগে ফসলের প্রকার ও পরিমাণ বহুগুণে বাড়ানো খুব বেশিদিনের কাজ নয়। চোখের সামনে সোভিয়েট রুশিয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রাক-সোভিয়েট রুশিয়ায় কৃষির অবস্থা প্রায় আমাদের দেশের মতোই ছিল। মাত্র পাঁচিশ বছরের চেষ্টার ফল আজ সমস্ত পৃথিবীর বিস্ময়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ব্যাবহারিক প্রয়োগ সভ্যতার বহিরঙ্গ। তার প্রসার মানুষের বুদ্ধির স্তরে। সে-স্তর ছাড়িয়ে অন্তর্মুখীন হওয়ার তার প্রয়োজন নেই। সেইজন্য তাকে আয়ত্ত করতেও জাতির সময় লাগে না।

কিন্তু চাষের জমিতে এই বৈজ্ঞানিক কৃষির প্রবর্তন দেশের সমগ্ৰ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্রভাবে ঘটানো সম্ভব নয়। এই আংশিক পরিবর্তন নির্ভর করে সমগ্রের গতি ও পরিণতির উপর। যেদিন আমাদের দেশের ধনতান্ত্রিক জীবনকে নতুন পৃথিবীর উপযোগী করে ভেঙে গড়ার কাজ আরম্ভ হবে, কৃষির উন্নতির প্রকৃত চেষ্টাও সেই দিন আরম্ভ হবে, তার পূর্বে নয়। সোভিয়েট রুশিয়ার দৃষ্টান্তই প্রত্যক্ষ প্ৰমাণ। সেই ভাঙা-গড়ার মধ্যে চাষের জমির দখল-ভোগের ব্যবস্থা কেমন রূপ নেবে বা নেওয়া উচিত হবে, তার আগাম নকশা বা blue print তৈরি করতে বসা আজ পণ্ডশ্রম। যতদিন আমাদের দেশের হিতচিন্তার গুরুভার বিদেশিকেই কষ্ট করে বহন করতে হবে, ততদিন কমিশন বসবে, সমুদ্রপার থেকে মোট ভাতায় অজ্ঞাতনামা বিশেষজ্ঞেরা আসবেন, রিপোর্ট তৈরি হবে, চাকুরির সৃষ্টি হবে, আর দেশের অবস্থা ও দুরবস্থা যেমন আছে তেমনি থাকবে। তাই স্বাভাবিক। বিদেশির শ্রম লাঘব করে দেশেব ধনসৃষ্টি ও বণ্টনের ভার যেদিন দেশের লোককেই নিতে হবে তখন শুভবুদ্ধির যদি নিতান্ত অভাব না হয়, তবে চাষের জমির মালিকি স্বত্ব–ব্যবহার, অব্যবহার ও অপব্যবহারের অধিকার–কেউ পাবে না। সে নুতন ব্যবস্থার প্রধান প্র৩িবন্ধক হবে বর্তমান চাষি সম্প্রদায়; কারণ, চাষের জমির মালিকি স্বত্বের বড় অংশ তাঁরা পেয়েছে, তার চেয়ে বড় আর কিছু তাঁরা পায়নি এবং কল্পনা করতেও শেখেনি। সোভিয়েট রুশিয়ার ইতিহাস তারও দৃষ্টান্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *