২. মুলতানি স্টিমার

‘মুলতানি’ স্টিমার

২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৫
সন্ধ্যা

এবারে কাল যখন স্টিমার ঝালকাটি পৌঁছল তখন সন্ধ্যা ঘোর হয়েছে। দু’খানা ফ্ল্যাটের একখানাকে এখানেই খুলে রাখা হল; ওতে নাকি কাছাড়ের মাল আছে, অন্য স্টিমারে টেনে নিয়ে যাবে। সুমামাদের এ স্টিমার কলকাতা থেকে বরাবর কোথাও না-থেমে এসেছে; কেবল খুলনাতে আড়কাঠি তুলে নেবার জন্য নদীর মধ্যেই অল্পীক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। আমার বাটলারের এবং স্টিমারের লোকজনদের কাঁচা রসদের পুজি ফুরিয়ে এসেছে। সুতরাং তা সংগ্রহের চেষ্টা ঝালকাটিতে স্টিমার লাগানো হল। এ অসময়ে তরিতরকারি কিছু পাওয়া গেল না। বাটলার মাছ ও মুগের ডাল কিনে আনল। পথে আমার খাদ্য সংগ্রহের জন্য স্টিমার-কোম্পানি কিছু-কিঞ্চিৎ অবশ্য বাটলারের হাতে দিয়েছিল। সেটাকে উপেক্ষা করে বাটলারের নামবার সময় সে জন্য তাকে কিছু দিয়ে দিয়েছিলুম। মনে হচ্ছে বুড়ো বাটলারের কর্মে উৎসাহ ও সেলামের বহর দু-ই বেড়েছে।

ফ্ল্যাট খোলার জন্য আমাদের স্টিমার যেখানে থেমেছিল সেখানে মিরভি’ নামে একখানা স্টিমার যাত্রার জন্য প্ৰস্তুত হয়ে ধোয়া ছাড়ছিল। আমাদের সারেং ডাকাডাকি করে তথ্য সংগ্ৰহ করলে যে, সে স্টিমার চাদপুর হয়ে ঢাকা যাবে। আমাদের এ স্টিমারে গুটি-পনেরো-ষোলো যাত্রী আছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন যাবে চাদপুর। মরভি স্টিমারের সারেঙের সঙ্গে কথা বলে চাদপুর-যাত্রীদের ওই স্টিমারে তুলে দেওয়া হল। বন্দোবস্তাটি সম্ভব ঘরোয়া; স্টিমার-কোম্পানির সঙ্গে সম্বন্ধ নেই।

এবারেও এখন রোজা চলছে। এই যাত্রীরা দিনের উপবাসের পর সন্ধ্যায় নামাজের শেষে কোনওদিন চিড়েভাজা, কোনওদিন ছোলাভাজা দিয়ে রোজা ভাঙে। রাত একটু হতে-না-হতেই খাওয়া শেষ করে–ভাত, ডাল, একটা কিছু ভাজা কি তরকারি। সকলে সার দিয়ে বসে যায়, একজন পরিবেশন করে। রাত একটু গভীর হলেই সমবেত কষ্ঠে ধর্মসংগীত গাওয়া হয়। গানের মধ্যে ‘আল্লা রসুল’ এই কথাটা মাত্র ধরতে পেরেছি। কাল আর গান হল না; বোধহয় মূল গায়েন চাদপুরের যাত্রী ছিল।

স্টিমার বরিশাল পৌঁছেছিল রাত প্ৰায় বারোটায়, আজ ভোরে সারেঙের মুখে শুনলুম। সেখানে স্টিমার বাধেনি। সারেং নবাব আলির বাড়ি চট্টগ্রাম, খাস শহর চট্টগ্রামে। এ কথা নবাব আলি একটু গর্বের সঙ্গে প্রথম দিনই আমাকে জানিয়েছিল। স্টিমারে আর যাঁরা সব চট্টগ্রামের লোক আছে তাদের কারও বাড়ি শহরে নয়, শহর থেকে অন্তত বিশ-পাঁচিশ মাইল দূর দূর। নবাব আলি লোকটির বয়স বছর-পঞ্চাশ হবে। বেশ গোলগাল চেহারা। খাবার হজম হয়, এবং অধিকাংশ খাদ্যকে চর্বিতে পরিণত করার রাসায়নিক ব্যবস্থা শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে আছে।

বরিশাল ছাড়িয়ে কিছু পরেই কুয়াশার জন্যে স্টিমার নোঙর করে রাখতে হয়েছিল। সকালেও এমন ঘন কুয়াশা ছিল যে, বেলা প্রায় আটটার আগে স্টিমার রওনা হতে পারেনি। দুপুরের আগে থেকেই নদী প্রশস্ত হতে আরম্ভ করেছে। দুপুর যখন গড়িয়ে গেল তখন নদী বেশ চওড়া, আকাশের অনেকখানির ছায়া জলের মধ্যে পড়েছে। খুলনা-বরিশালের মানুষের ঘর-গৃহস্থলির সঙ্গে মিশে-থাকা ছোট সব নদী ছাড়িয়ে এসেছি; এ নদীতে উদার পদ্মার মুক্তির ডাক এসে পৌঁছেছে। এক পাড় উচু, ভাঙন-ধরা। মাঝে মাঝে ছোট-বড় চর। সেখানে কলাগাছ-ঘেরা মানুষের বসতি। যেতে যেতে ডাইনে বাঁয়ে একেবেঁকে সব নদী বেরিয়ে চলেছেঃ নৌকার পালে অনেক দূর পর্যন্ত তাদের গতিপথ বোঝা যাচ্ছে। নদীতে ভারী হালকা বহুরকমের নৌকা। এক-একখানা ছোট নৌকার গড়নে ছবির রেখার সুষমা। মাঝে মাঝে প্ৰকাণ্ড সব ফ্ল্যাট টেনে স্টিমার চলেছে। কাচিৎ একখানা প্যাসেঞ্জার স্টিমার।

বেলা তিনটেয় স্টিমার মাদারিপুর ছাড়াল। নদী থেকে দেখা গেল, ঢেউ-তোলা টিনের ঘর ও অল্প গুটিকয়েক পাকা বাড়ির সমষ্টি।

বরিশাল এক-ফসলের দেশ। ধান কাটা শেষ হয়েছে, কাজেই নদীর পাডের মাঠ সব ফাঁকা, কেবল সুপারি-নারকেলের শ্যামলতায় প্ৰসন্ন। মাদারিপুরের পর থেকে নদীর পাড় বিচিত্র। একটু পরে পরেই হলদে সবুজ সরষেক্ষেতের সার চলেছে। মাঝে মাঝে অল্প আখের চাষ। আর তিসির ক্ষেতের চিকন ঘন সবুজে চোখ জুড়িয়ে যায়। কাছে দূরে সব গ্রাম, আম জাম ও বাঁশের কুঞ্জে ঢাকা।

বিকেল বেলা স্টিমারের কেরানি এলেন আমার টিকিটের পরিচয় তাঁর খাতায় টুকে নিতে। বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোক, কৃষ্ণলেশহীন। শুভ্ৰ শ্মশ্রু; রোমান সেনেটারের চেহারা। তেত্রিশ বছর স্টিমার-কোম্পানির কেরানিগিরি করছেন। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। ভদ্রলোকটির একটু আইনের পরামর্শ দরকার। বাড়ির কাছে একখানি জমি কিনেছেন। এখন প্রকাশ হচ্ছে যে, সাধু বিক্রেতাটি ও-জমি ও অন্য জমি পূর্বেই একজনের কাছে রেহান দিয়েছিল, আর সে কথা ফাস না করে ভদ্রলোককে ও অন্যান্য লোককে সেই রেহানি জমিগুলি বিক্রি করেছে। এখন রেহানাদার রেহানি দলিলটি ভদ্রলোকের কাছে বিক্রি করতে রাজি আছে, তার কেনা উচিত কি না এবং কিনলে কীরকম নালিশ রুজু করতে হবে। ব্যাপারটি কিছুই অসাধারণ নয়; এ রকম হামেশা ঘটছে। ভদ্রলোককে তার করণীয় সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়া গেল।

আটটা বেজে গেছে, আমার খাবার তৈরি। এ রাত্রে স্টিমার যখন পদ্মায় পড়বে তখন সম্ভব ঘুমিয়ে থাকব। আর যদি জাগি-ও, অন্ধকারে কিছু দেখা যাবে না। আজ অমাবস্যা। খুব ভোরে কেবিন থেকে বেরিয়েই পদ্মার সঙ্গে চোখাচে্যুখি হল। আকাশ নীলাভ ধূসর, পুবে অল্প লাল রং, ভোরের অস্পষ্ট আলোতে তার সমস্তটার ছায়া পদ্মার জলের উপর রহস্যের যবনিকার মতো কঁপিছে। স্টিমার ডান পাড় ঘেঁষে চলেছে; বায়ে চক্রাকারে শীতের পদ্মার প্রশান্ত বিস্তার, বহুদূরের তরুশ্রেণির আবছায়া কালো রেখায় সীমানা টানা। কুয়াশা প্ৰায় নেই। নৌকার চলাচল আরম্ভ হয়েছে। সামনে কিছু দূরে একখানা নোঙর-করা স্টিমার দেখা যাচ্ছে। সূর্যোদয়ের পর থেকেই কিছু কিছু কুয়াশা জমতে আরম্ভ করেছে। বেলা সাতটার পর সাদা কুয়াশা এতটা ঘন হয়ে এল যে, বা পাড়ে একটা জায়গায় স্টিমার বাঁধতে হল। উচু পাড়। সামনেই একটা ছোট বসতি। খান সাত-আটেক খড়ের ঘর; দু’খানা টিনের। কয়েকটা খড়ের গাদা। গোটা-দশেক গোরু গোল হয়ে খুব নিবিষ্টমনে জাব খাচ্ছে। নদী আর বসতির মাঝের জমিটুকুতে দুটি কলাঝোপ, ছোট একখানি সরষেখেত আর অল্প গোটা-কয়েক তামাকের চারা। কয়েকজন ছেলেমেয়ে ও দু-তিনটি বয়স্ক লোক স্টিমার দেখতে দাঁড়িয়ে গেল, যদিও স্টিমারের যাতায়াত এখানকার নিত্য বহুবারের ঘটনা।

স্টিমারের পাশ দিয়ে ক্ৰমাগত জেলে-নৌকা চলেছে। স্টিমারের লোকেরা মাছ কেনার জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। ‘হালদার, মশায় প্রভৃতি অনেক সম্মানের সম্বোধনে জেলেদের ডাকা হল; কিন্তু কারও নৌকাতেই নেই, তাঁরা সবে মাছ ধরতে বেরিয়েছে। হালের কাছে এক-একজন জেলের আত্মসমাহিত গভীর মুখ দেখে, শেকসপিয়রের কোন একটা সংস্করণে ‘কোরিয়লেনাস’-এর এক ছবি দেখেছিলাম, তাই হঠাৎ মনে পড়ে গেল।

বেলা আন্দাজ ন’টায় কুয়াশা কেটে গেলে স্টিমার চলতে শুরু করল। দু’পাশে দূরে কাছে অসংখ্য নৌকা চলেছে–জেলে-ডিঙি, যাত্রীর নৌকা, বোঝাই কিস্তি। দু-তিনখানা নামজানা যাত্রী-স্টিমার বেগে বিপরীত দিকে চলে গেল।

মাঝে মাঝেই লম্বা নিচু কাঁচি চর জলের ওপর ভেসে উঠেছে। কতক বালু ভেজা, ধূসর, কতক সাদা ধবধবে–ভোরের রৌদ্রে চিকচিক করছে। অল্প পরেই গোয়ালন্দের স্টিমার-ঘাট দেখা গেল। স্টিমারের সাের তিন-চার থাকে ঘাটে লেগে আছে, কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে ধোঁয়া উঠছে। বড় বড় ফ্ল্যাট মাঝ-নদীতে ছেড়ে দেওয়া। এক পাশে নৌকার সার। পাড়ের উপর গোয়ালন্দ-চরের বাজারের হালকা ছাউনি ও ততোধিক হালকা বেড়ার দোকানঘর; আর সেই রকমেরই রেলের টিকিট আপিস ও পোস্ট-টেলিগ্ৰাফ আপিসবাবুদের কোয়ার্টার্স-সমেত।

নেয়ে-খেয়ে স্টিমার থেকে নামার সময় বাটলার মীেলা বক্স অনুনয় জানালে যে, মাছ-তরকারি কেনার পয়সা যে আমি দিয়েছি। এটা যেন স্টিমার কোম্পানির কর্তৃপক্ষ না জানে। তাকে অভয় দিলুম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *