১. মিঙ্গিন স্টিমার

মিঙ্গিন স্টিমার

২৪ ডিসেম্বর ১৯৩৪
সোমবার। সন্ধ্যা

শনিবার রাত দশটায় ছেলেরা স্টিমার থেকে নেমে গেলে অল্পক্ষণ পরেই শুয়ে পড়া গেল। রাত দুটোয় একবার উঠেছিলাম। চার দিকে আলো। স্টিমার পুল খোলার প্রতীক্ষা করছে।

রবিবার প্রাতে উঠে স্টিমার কতদূর এল খোেজ নেবার জন্য বাইরে এসে দেখি, সামনেই জগন্নাথ ঘাটৈর সিন্টমারের গুদাম ও আপিস। ব্যাপার কী? সারেং এসে খবর দিল যে, শনিবার শেষরাত্রে পুল খোলার সময় বিলাতি ডাক এসে পড়ায় তখন পুল খোলা যায়নি, এবং পরে আর খোলা সম্ভব ছিল না, সুতরাং রবিবার শেষরাত্রের পূর্বে স্টিমার ছাড়বে না। আবার বাড়ি যাওয়া ও ফিরে আসার হাঙ্গামা মনে করে রবিবার সমস্ত দিন ও রাত জগন্নাথ ঘাটের সামনে গঙ্গার মাঝে কাটিয়ে দেওয়া গেল–যখন তোমরা মনে করছিলে যে আমি বহু দূর চলে গেছি। কলকাতার নীচের গঙ্গার উপর যে একটা বিচিত্র জীবনযাত্রা প্রতিদিন চলে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল। ভোর হতেই নদী জুড়ে নানারকম নৌকার ও নানা চেহারার বাষ্পপীয় জলযানের ব্যস্ত গতায়াত আরম্ভ হয়–লোক নিয়ে, মাল নিয়ে এবং বাহ্যিদৃষ্টিতে অকারণে। দুপুরের পর এ গতি কিছু মন্দা হয়ে আসে; আবার বিকাল হতে-না-হতেই নদী যেন গা-মোড়ামুড়ি দিয়ে আলস্য ভেঙে ওঠে। নৌকার দলের গতি দ্রুত হয়, বাষ্পীয় যানগুলি গম্ভীর ও তীক্ষু আওয়াজ করতে করতে জলচর প্রাণীর মতো উজান ভাটিতে ছুটতে থাকে। মধ্যাহ্নের জনবিরল নদী লোকসমাগমে ভরে ওঠে। একটা দিন এই দেখে কাটল।

রবিবার রাত সাড়ে চারটেয় হাওড়া-পুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে স্টিমার ছেড়েছে। একখানা ফ্ল্যাট বা পাশে প্রথম থেকেই বাধা ছিল। সোমরা সকাল ছাঁটায় বজবজে ডান দিকেও আর-একখানা ফ্ল্যাট বাঁধা হয়েছে। দু’দিকে দুই ফ্ল্যাট নিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে আমাপের স্টিমার চলেছে। স্টিমারখানি ভাল ও নূতন। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জল ও পাট দিয়ে প্রতিদিন ডেক মাজা হচ্ছে। আমিই একমাত্র যাত্রী। সুতরাং সবগুলি কেবিন যাদৃচ্ছি ব্যবহার করছি।

সারেংটির বাড়ি নোয়াখালি। মাথায় একটু ছিট আছে। পয়ত্ৰিশ বছর স্টিমারে কাজ করছে, এখন মাইনে একশো আশি টাকা। আমাকে জানালে যে, চামড়া কালো বলে মাইনে এত কম; সাদা চামড়া হলে পাঁচ-ছাঁশো হত। এবং এই চামড়ার তফাতের জন্যই নাকি, যদিও তার স্টিমারে একজন ভারী বাবু যাচ্ছে, তবুও স্টিমার-কোম্পানি সামনের ডেকে একটাও ইজিচেয়ার দেয়নি, দুটো বেতের কুর্সি দিয়েই সেরেছে। আগের বছর এই স্টিমারেই এক সাহেব গিয়েছিল, বিশেষ ভারী নয়; তখন ইজিচেয়ার, পারদা এবং পাঁচ মন বরফ ছিল। পাঁচ মন না হলেও বরফ এবারও আছে। সেই বরফে তরিতরকারি তাজা রাখা হচ্ছে। এই যে দুদিকে দুই ফ্ল্যাট বেঁধে দেওয়া, সারেঙের মতে এও একটা সাদা-কালোর ভেদবুদ্ধির ব্যাপার। আমাদের স্টিমারের সঙ্গে আরও একখানা সুন্দরবনগামী স্টিমার ছেড়েছে। বজবজের ফ্ল্যাটখানি নাকি তারই নেবার কথা। কিন্তু তাতে তিন-চারটি সাহেব যাচ্ছে বলে এই উলটো ব্যবস্থা হয়েছে।

বেলা সাড়ে দশটায় ডায়মন্ড হারবার ছড়িয়েছি। সেখান থেকেই নদী বেশ প্রশস্ত। স্টিমার বা পাড় ঘেঁষে এসেছে। ঢালু পাড়; অনেক জায়গায় প্রায় জল পর্যন্ত ঘাস ও ছোট ছোট গাছ-গাছড়া কোথাও কাছে, কোথাও দূরে লোকের বসতি। অন্য পাড়ে গাছের ঘন সবুজ সরু রেখা ছাড়া কিছু দেখা যায় না।

বেলা প্রায় চারটেয় স্টিমার বড় নদী ছেড়ে একটি সরু খালে ঢুকেছে৷ খালের নাম ‘নামকানা’ খাল। এত সরু যে, দুই ফ্ল্যাটসমেত আমাদের স্টিমার তার প্রায় সবটাই জুড়ে থাকে। এই খাল দিয়ে অতি আস্তে আস্তে চলে ঘণ্টাখানেক পরে একটি মোটের উপর প্রশস্ত নদীতে পড়া গেল, নাম সপ্তমুখী’। কিন্তু এমন অগভীর যে সূৰ্যান্তের সঙ্গে সঙ্গে স্টিমার নোঙর করতে হল। জোয়ার এলে তবে চলবে। নামকানা খােলই সুন্দরবনের আরম্ভ। কিন্তু খালের দুই পাশে এবং সপ্তমুখী নদী যতটা এসেছি তার পড়ে এখন আর বন নেই। চাষ-আবাদ ও লোকালয়। সারেং বললে, আরও চার ঘণ্টা চলার পর সুন্দরবনের বন আরম্ভ হবে।

শীত যেমন ভাবা গিয়েছিল তেমন কিছু নয়। আজ সমস্ত দিন স্টিমার দক্ষিণে চলেছে, সুতরাং উত্তরের হাওয়া লাগেনি। সামনের ডেকে সারাদিন রোদ। আরামে চলে এসেছি।

জোয়ার এসেছে। নোঙর তুলে স্টিমার চলতে আরম্ভ করল। রাত প্রায় আটটা। খুলনা পৌঁছনো পর্যন্ত রাতদিন স্টিমার চলবে, কোথাও থামবে না।

 

২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৪
মঙ্গলবার। সন্ধ্যা

আজ ভোর থেকে এবং কাল রাত্রে যখন ঘুমিয়ে ছিলুম তখন থেকেই স্টিমার চলেছে আঁকাবাঁকা সব ছোট ছোট নদী দিয়ে। মাঝে মাঝে বেশ প্রশস্ত নদী পাওয়া যাচ্ছে। … … চোখ চলে ডালপালা-বিরল সোজা সরু গাছ ও আগাছার ঘন জঙ্গল। … … ও জনমানবের চিহ্ন নেই। আকাশে পাখি নেই, কাকও নয়। মাঝে … … গাঙচিল উড়ে যাচ্ছেল আর দুটো-একটা বক জলের ধারে স্তব্ধ তন্ময় … … মৎস্যচিন্তা করছে। বনের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট সব খাল এসে নদীতে পড়েছে। আমরা যে-সব নদী দিয়ে যাচ্ছি তা ছাড়া বহু ছোট-বড় নদী চারদিকে বয়ে চলেছে। কোনও জায়গায় একখণ্ড বনে ঢাকা জমির তিন দিকেই নদী–দেখতে চমৎকার। এ-সব নদী-নালার মধ্য দিয়ে পথ চিনে স্টিমার চালানো অভ্যাসের কাজ। সারেং বললে যে, এ পথ সম্বন্ধে সারেংদের পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। বনের ধারে ধারে টিনে সাদা রং দিয়ে পথের চিহ্নও অনেক জায়গায় দেওয়া আছে।

বেলা আন্দাজ সাতটায় সুন্দরবন ডেসপ্যাচ-সার্ভিসের একখানা কলকাতাগামী স্টিমারের সঙ্গে দেখা হল। নাম ‘বুরানওয়ালি’। দু’খানা ফ্ল্যাট দু’দিকে নিয়ে চলেছে। সেখানে নদী এত ছোট যে আমাদের স্টিমার একপাশে দাড় করিয়ে তাকে পথ দিতে হল।

বেলা প্ৰায় সাড়ে এগারোটার সময় একখানা ছোট নৌকা দেখা গেল। বোঝা গেল লোকালয় কাছে এসেছে। অল্পক্ষণ পরে নদীর ধারে গাছের তলায় কয়েকটা বানরের দেখা পাওয়া গেল। শুনলুম অনেক ভাগ্যবান লোক আমার মতো সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে স্টিমারে যেতে হরিণের দল ও রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ দেখতে পেয়েছে। আমার ভাগ্য বানরের উপর আর উঠল না।

মুসলমানদের এটা রোজার মাস। স্টিমারের দোতলার পিছনের ডেকে যেখানে মাল বোঝাই আছে তার কতকটা পরিষ্কার করে তেরো-চোদ্দোজন স্টিমারের খালাসি ও কর্মচারী সূৰ্যাস্তের পর নামাজ পড়ে। একসারে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ওঠাবসা করে; দেখতে বেশ। এর অনেকটাই যে আমাদের পূজা-অৰ্চার মতোই বাহ্যিক কসরত মাত্র তা মনে করতে ঠিক এখন ইচ্ছা হচ্ছে না। নমাজের পর সকলে গোল হয়ে বসে রোজা ভাঙে অর্থাৎ খেতে আরম্ভ করে। এক-এক থালায় দু-তিনজন খাচ্ছে। খাদ্য ডাল ভাত এবং একটা কিছু তরকারি। এরা সমস্ত দিন উপবাসী থেকে স্টিমারের খালাসির হাড়ভাঙা খাটুনি মুখ বুজে সমানে খেটে যাচ্ছে। পূর্ব-বাংলার এই মুসলমান খালাসিদের দেখে বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটু ভরসা হয়।

সারেং বলছে, আজ রাত আন্দাজ দশটা-এগারোটায় স্টিমার খুলনা পৌঁছবে। তারপর খুলনা থেকে বরিশাল যাবে চার-পাঁচ জায়গায় থেমে মাল নামাতে নামাতে। স্টিমারের কেরানিবাবু (বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক) বললেন যে, বৃহস্পতিবারের পূর্বে বরিশাল পৌঁছানো যাবে না। আমার রবিবার কলকাতা পৌঁছতেই হবে। সুতরাং এবার আর গৌয়ালন্দ পর্যন্ত যাওয়া হল না। বরিশাল থেকেই বরিশাল-খুলনা এক্সপ্রেস স্টিমারে খুলনা হয়ে কলকাতা ফিরব।

 

২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বুধবার। ভোর ৭টা

কাল রাত দশটায়, যখন খুলনা পৌঁছতে মাত্ৰ ঘণ্টা দুই দেরি, তখন কুয়াশার জন্য স্টিমার নোঙর করতে হল। কুয়াশা কিছু বেশি নয়; জ্যোৎস্নায় নদীর পারের গাছপালা বেশ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কুয়াশার জন্য সার্চলাইটের আলো ভাল না খোলায় শেষে নৌকা চাপা পড়ে এই ভয়ে সারেং স্টিমার নোঙর করে রাখে। আজ ভোররাত্রে ছেড়ে এই মাত্র খুলনা পৌঁছল। বেলা বারোটা আন্দাজ বরিশাল রওনা হবে। এখন নেমে তোমাদের একটা টেলিগ্রাম করতে ও এই চিঠি পোস্ট করতে যাচ্ছি। এ-সব কাজ স্টিমারের লোকেরাই করত, কিন্তু শহরটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছা।

 

২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৪

বুধবার। সন্ধ্যা

বেলা দশটার মধ্যেই স্টিমার খুলনা ছেড়ে রওনা হল। এখন চলেছি মানুষের ঘরকন্নার সাথি ছবির মতো ছোট নদী দিয়ে। দুই পাড়ে ধানক্ষেত। ধান কাটা শেষ হয়েছে। বাদামি রঙের ফাকা মােঠ; গোরু চরছে। মাঝে মাঝে চৌকো সরষেক্ষেত, হরিত-কপিশ–সব ফুল এখনও ফোটেনি। একটু পর-পরই লোকালয়; খোড়ো ঘর, ঢেউ-তোলা টিনের ঘর–আম, নারকেল, কলাগাছে ঘেরা। কচিৎ একটা পাকা বাড়ি, সম্ভব জমিদাববাবুদের। স্নানের ঘাটে লোকের ভিড়; পাড়ের উপর ছাগলছোনা লাফাচ্ছে। কোথাও নদীর ধারে হাটের জায়গা; বেড়াহীন ছোট ছোট টিনের চালা, গোটকয়েক টিনের চাল টিনের বেড়ার ঘর–স্থায়ী দোকান ও মহাজনদের গুদাম৷ উজান-ভাটিতে নৌক চলেছে নানা ধরনের–পাল তুলে, দাড় টেনে, লাগি ঠেলে। পাড়ের উপর দিয়ে লোক-চলাচলের পথ, নানা বেশের লোক চলেছে–কারও মাথায় ছাতি, কারও কঁধে মোট। নদীর দুই পারে দূর দিয়ে চলেছে শ্যামল গাছের সার। এ নদীর যাঁরা নাম দিয়েছিল মধুমতী, তাদের রুচির প্রশংসা করতে হয়।

ক্ৰমে দুপুর গড়িয়ে গেল। স্নানের ঘাট সব খালি হয়ে এসেছে। এক-এক জন লোক তাড়াতাড়ি এসে চট করে দুটো ডুব দিয়ে তখনই উঠে যাচ্ছে।

আমাদের সারেং রহমত আলির নৌক চাপা দেবার ভয় অত্যন্ত বেশি। বোধহয় কোনওদিন ও কাজ করে বিপদে পড়েছিল। কিন্তু খোঁড়ার পা-ই খানায় পড়ে। বেলা যখন দুটো, আর স্টিমার এসেছে কালিয়া গ্রামের কাছাকাছি, তখন স্টিমারের বাঁ দিকের ফ্ল্যাটের সঙ্গে একখানা বড় পাট-বোঝাই নৌকার একটা মৃদু-রকম ঠোকাঠুকি হল। ফলে নৌকখানি হল কিঞ্চিৎ জখম, তবে বেশি কিছু নয়। দোষ কাকেও বড় দেওয়া যায় না। দুই ফ্ল্যাট সমেত আমাদের স্টিমারের এই ছোট নদীতে ঘোরাফেরা একটু সময়সাধ্য, আর জোর বাতাস থাকতে চেষ্টা করেও নৌকাখানা সময়মতো সরে যেতে পারেনি। এরকম ঘটনা ঘটলে সারেংকে নিকটবতী পুলিশ-থানায় রিপোর্ট পাঠাতে হয়। স্টিমারের লোকজনদের মধ্যে অনেক জেলার লোক ছিল–চাটগাঁ, নোয়াখালি, কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিং।। দেখলুম। সকলে একমত যে, এ অঞ্চলের লোক বড় সহজ নয়; তিলকে তাল করে তোলার মতো কল্পনার জোর নাকি এদের প্রচুর আছে। সারেঙের ইচ্ছ, তার রিপোর্টটা ইংরেজিতে লেখা হয়। স্টিমারে চলনসই। ইংরেজি লেখকের অভাব, সুতরাং ঘটনার রিপোর্টটা লিখে দিতে হল। কালিয়া স্টেশনে স্টিমার থামিয়ে স্টেশনমাস্টারবাবুকে সেই রিপোর্ট দেওয়া হল থানায় পাঠিয়ে দেবার জন্য। তার মুখে শুনলুম, এখানে ইতিমধ্যেই রটে গিয়েছে যে, স্টিমার একখানা পাঁচশো-মনি বোঝাই নৌক চাপা দিয়ে একবারে ডুবিয়ে দিয়েছে। কালিয়া ছাড়বার অল্পক্ষণ পরে স্টিমারের কেরানিবাবু এলেন একটা লেখার খসড়া নিয়ে। তিনি নাকি স্টিমারের নিবপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তি; এরকম ঘটনার একটা রিপোর্ট তাকেও লিখে রাখতে হয়। যা লিখেছেন তা তাঁর মনঃপূত হচ্ছে না। লেখার উপর চোখ বুলিয়েই কারণটা বুঝলাম। সেটা আমার লেখা সারেঙের রিপোর্টেব্য হুবহু নকল। কী করা যায়–ওকেই অদল-বদল করে নিরপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তির রিপোর্ট করে দেওয়া গেল।

 

২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বৃহস্পতিবার

খুলনা ছাড়িয়ে এখন বরিশাল জেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আজ ভোর থেকেই নদীর দুই পাড়ে নারকেল-সুপারির সার চলেছে অবিচ্ছেদে। কিন্তু নদীর চেহারা গেছে বদলে। দুই পাড়ের সুস্পষ্ট সীমারেখার মধ্যে বহতা নদীর যে সুষমা। এ নদীর তা নেই। খুলনার নদীর চেয়ে এ নদী প্রশস্ততর, কিন্তু এর দুই পাড়ই ঢালু, আর সে পাড় বালুর নয়, কাদার। নদীতে স্নানের ঘাট বড় দেখছিনে। গ্রামগুলি সব নদীর থেকে দূরে দূরে। কালকের খুলনার নদী ছিল তরুণী কলহাসিনী গৃহলক্ষ্মী, আর এ যেন ঈষৎস্কুলাঙ্গী প্রৌঢ়া গৃহিণী–সিঁথিতে সিন্দূর, পরনে চওড়াপাড় শাড়ি, কিন্তু কপোলে কপালে কৰ্কশ বলিরেখা দেখা দিয়েছে।

আমাদের সারেঙের মতে বরিশালের লোকের মতো সুখী লোক কোথাও নেই। এদের সকলেরই যথেষ্ট ধানের জমি আর নারকেলের বাগান আছে, যাতে ধান ও নারকেল ফলে অসম্ভব রকম। এদের নাকি ধারকর্জে নেই। আর প্রায় সকলের বাড়ির কাছ দিয়েই নদী কি নালা গিয়েছে, তাতে মাছের যেমন ভাবনা নেই, যাতায়াতেরও তেমনি সুবিধে। যে বাড়ির পাশ দিয়ে নদী কি নালা যায়নি সে বাড়িতে নাকি লোকে সহজে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। এই সঙ্গে সারেং আরও একটা খবর জানালে। খুলনার মেয়েরা নাকি লঙ্কামরিচ বাটে না; তাদের রান্না যে কী করে হয় তা রহমত আলির বুদ্ধির অতীত।

আমাদের এ স্টিমার সব স্টেশনে থামে না; যেখানকার মাল আছে কেবল সেখানেই থামে। আর একশো মনের চেয়ে কম হলে সে স্টেশনের মাল এ স্টিমারে বোঝাই হয়নি। কিন্তু যে স্টেশনে থামছে সেখানেই দেরি হচ্ছে অনেক। কারণ স্টিমারকে স্টেশনে ভিড়তে হচ্ছে আগে ফ্ল্যাট-দুখানি মােঝ-নদীতে খুলে রেখে; আবার যাবার মুখে ও-দুখানিকে দু’পাশে বেঁধে নিতে হচ্ছে। এইরকম কসরত করতে করতে বেলা দশটার পর পৌঁছলুম হুলার হাট স্টেশনে। স্টেশনটি একটু বড় এবং এর মালও আমাদের স্টিমারে আছে যথেষ্ট।

 

২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা

সাড়ে-তিনশো মন মাল নামিয়ে হুলার হাট ছাড়তে বেলা বারোটা বেজে গেল। বেলা প্ৰায় দেড়টার সময় পৌঁছলুম কাউখালি বলে এক স্টেশনে। ছোট স্টেশন, মালও নামল অল্প। আর সৌভাগ্যক্রমে এবারে ফ্ল্যাট নিয়েই স্টিমার পাড়ে লাগতে পারল। ভাবলুম কাউখালি ছেড়ে রওনা হতে দেরি হবে না। এমন সময় সারেঙের অ্যাসিস্ট্যান্ট এক ছোকরা জানালে যে, স্টিমার এখন এইখানেই নোঙর করে থাকবে যতক্ষণ না ভাঁটা আরম্ভ হয়। আর খুলনাগামী বরিশাল এক্সপ্রেস স্টিমার পাস না করে–অর্থাৎ রাত প্ৰায় সাড়ে আটটায়। সারেং এসেও সেই খবর দিল। এখান থেকে বরিশাল যেতে, কতক দূর যেতে হয় একটা সরু খাল দিয়ে। সেইজন্য নিয়ম যে, ফ্ল্যাটগ্ৰস্ত স্টিমারগুলি বরিশালের দিকে যাবে ভাটার সময়, আর বরিশাল থেকে আসবে যখন জোয়ার।

কাউখালির স্টেশনমাস্টারবাবু দেখা করতে এলেন। পরিচয় দিলেন তিনি আমার স্বজাতি। অবশ্য সারেঙের কাছে উপাধিসমেত আমার নামটা শুনেছেন। তার বাড়ি এই জেলাতেই ঝালকাটির কাছে; গ্রামের নামটা ভুলে গেছি। এখানে পাঁচ বছর আছেন। স্টেশনের লাগাও কোয়ার্টার্স, গোলপাতার। কাছেই একটা বন্দর, স্টিমার থেকে দেখা যায়। কাছাকাছি লোকজন অনেক আছে। কিন্তু এ জায়গায় নাকি খাবার জিনিসের ভারী অসুবিধা। বাঙালির খাবার দুধ আর মাছ, তা এ নদীতে মাছ বেশি পাওয়া যায় না; আর দুধের সের যখন অন্য সব জায়গায় পাঁচ-ছ’ পয়সা তখন এখানে, ঠিক কত বললেন মনে নেই, তবে তিন আনার কাছাকাছি একটা মারাত্মক সংখ্যা। নেমে গিয়ে চারটে ডাব পাঠিয়ে দিলেন। একটা খেয়ে দেখলুম। অতি চমৎকার মিষ্টি জল। রোজা ভাঙার পর শরীর ঠান্ড করবার জন্য সারেংকে একটা দিলুম। সে বলছে তার মন ভাল নেই। তিনজন খালাসির জ্বর, একজনের হাতে চোট লেগেছে। শর্ট হ্যান্ডে কাজ চালাতে হচ্ছে। বোধহয় কালকের কালিয়ার কাছের ব্যাপারটারও মন খারাপের সঙ্গে কিছু সম্পর্ক আছে।

স্টেশনের কিছু পুবে পশ্চিম-মুখ হয়ে স্টিমার নোঙর করল। এই নদীর নাম কাউখালির খাল। বয়ে যাচ্ছে এখানে পুবে-পশ্চিমে। অল্পদুর পুবে নদীটি দু’ভাগ হয়ে এক ধারা গেছে উত্তরে বানারিপাড়ার দিকে, আর দক্ষিণে সরু। ধারাটি পার হয়ে আমরা যাব বরিশাল। ডাইনে সুপারি-নারকেলের দেয়ালে ঘেরা অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি দুটি ধানক্ষেত। সব ধান কাটা হয়নি, বোধহয় শুকিয়ে গেছে; কেমন একটা শুষ্ক নিস্ফল চেহারা। বানারিপাড়ার বাঁকের কাছটিতে গাছপালাগুলি বুকে পড়ে নদীর আয়নায় মুখ দেখছে। তার উলটো দিকে নদীর ঠিক পাড়ের উপরেই একটা বড় সুপারি।-বাগান। নদীর ধার দিয়েই রাস্তা, বোধহয় যাচ্ছে বন্দরের দিকে। বড় বড় নৌকা গুণ টেনে চলেছে সেই রাস্তা দিয়ে।

সূৰ্য পশ্চিমে ঢলতে আরম্ভ করেছে। ডেক রৌদ্রে ভরা। সামনের নদীর জল গলানো সোনা, চোখ ঝলসে যায়।

বেলা পড়তে শুরু হল। নদীর পাড়ের রাস্তাটি দিয়ে লোক-চলাচল আরম্ভ হয়েছে। খানিকটা ফাঁকা জায়গাতে অনেকগুলি ছেলে জুটে হাডু-ডু খেলছে। ছোট ছেলেদের এক দল, আর তার চেয়ে বড়দের এক দল। তাদের চেয়ে বড় চার-পাঁচটি ছেলে খেলছে না; নানা রঙের র্যাপাব। গায়ে, দাঁড়িয়ে গল্প করছে ও খেলা দেখছে। এরা সম্ভব মাতকাবর বনে গেছে। সুপারিনারকেল বনের ওপারে সূর্য অস্ত গেল। পশ্চিম-আকাশে আর নদীর জলে গোলাপি আভা। ক্রমে সন্ধ্যা ঘোর হয়ে আসছে। উত্তর-পারে খানচারেক বড় নৌকা এক সার বেঁধে নোঙর করল। দক্ষিণের রাস্তায় একজন একটা হ্যাসাক জ্বালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বন্দর থেকে বোধহয় গ্রামের দিকে। আমাদের স্টিমারের পিছনের ডেকে নমাজের আজান দিচ্ছে। চারদিক ক্ৰমে স্তব্ধ অন্ধকার হয়ে এল। কেবল মাঝে মাঝে নৌকার দাঁড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

 

২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৪
শুক্রবার

কাল রাতে এক্সপ্রেস স্টিমার চলে গেলে রাত দশটায় আমাদের স্টিমার নোঙর তুলে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু কয়েকশো গজ গিয়েই বানারিপাড়ার বাঁকের মুখটার অল্প দূরে আবার নোঙর করল। কুয়াশায় সার্চলাইট খেলছে না। সেখানেই সারারাত কাটল, সকালটাও কেটে যাচ্ছে। কারণ বরিশাল-খুলনা মেল স্টিমার পাস না করলে যাবার জো নেই। সে স্টিমার এখানে পৌঁছবার কথা সকাল ন’টায়, কিন্তু দশটা বেজে গেলেও তার দেখা নেই। খুলনা থেকে বরিশাল এক্সপ্রেস স্টিমার এখান দিয়ে রাত তিনটেয় যাওয়ার কথা, গেল বেলা প্ৰায় নটায়। কুয়াশার খেলা। ‘আলোরে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে।’

গেল মাছ কিনতে। স্টিমার যেখানে নোঙর করে আছে তার কাছেই বাজার। সূর্যোদয়ের কিছু পর থেকেই বহু ছোট নৌকা বাজারের দিকে চলেছে পসরা নিয়ে। তরিতরকারির নৌকা, বোধহয় অল্প মাছের নৌকা, আর বেশির ভাগ নৌকার জিনিস হচ্ছে ধান ও খেজুরের রস। খেজুরের রস নৌকা করে স্টিমারে বিক্রি করতে এনেছে।

বাটলার ও উপেন মাছ কিনে ফিরল। একটা ছোট রুই মাছ ও একটা ইলিশ মাছ এনেছে। মাছ নাকি বাজারে বেশি নেই। কাউখালির স্টেশনমাস্টারবাবু কালই সে অভিযোগ করেছিলেন। স্টিমার সরু খালটিতে ঢুকলা। খালের নাম বারুশী কি বারণী তা নােয়াখালি জেলার সারেং ও চাটগাঁ জেলার তার অ্যাসিস্ট্যান্টের উচ্চারণে ঠিক বোঝা গেল না। যা হোক, ফ্ল্যাটসমেত স্টিমারের পক্ষে খাল যে বারণী তাতে সন্দেহ নেই। খালে ঢুকেই এতে চলাফেরায় এত বিধি-নিষেধের কারণ বোঝা গেল। খালটি এত সরু যে দু’ফ্ল্যাট-সুদ্ধ আমাদের স্টিমার তার প্রায় সবটাই জুড়ে চলেছে। খালে ঢোকার অল্প পরেই খুলনা-যাত্রী মেল স্টিমারের সঙ্গে দেখা। আমাদের স্টিমার দাড় করিয়ে কোনও গতিকে তাকে পথ দেওয়া হল।

লোকালয়ের ভিতর দিয়ে খালটি বেঁকে বেঁকে চলেছে। বরিশালের সব জায়গার মতো দু’ধারে নারকেল খেজুর সুপারির বন। ঘরের চালে লাউ-এর লতা, আশেপাশে কলাগাছ। খাল থেকে সরু সরু সব নালা বেরিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে গেছে। তাদের উপর বাঁশের বঁকানো উচু সাঁকো, কচিৎ কাঠের পুল।

খাল যখন এসে বড় নদীতে পড়ল তখন বোলা প্ৰায় একটা। সেই বড় নদীর একরকম মুখেই ঝালকাটির স্টেশন ও বন্দর। এই ঝালকাটি স্বদেশির যুগে যে খুব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল তা সম্ভব মনে আছে। ফ্ল্যাট দুখানি খুলে রেখে স্টেশনে লাগতে লাগতে প্ৰায় দুটো বাজল। এ স্টিমার বরিশাল পৌঁছতে রাত প্ৰায় নটা-দশটা হবে। বরিশাল থেকে এক্সপ্রেস স্টিমার ছেড়ে আসে সন্ধ্যা ছাঁটায়। সুতরাং এবার আমার বরিশাল-দর্শন বরিশালের সৌভাগ্যে হল না। ঝালকাটিতেই নেমে পড়া গেল। বরিশাল থেকে খুলনা এক্সপ্রেস স্টিমার এখানে রাত আটটায় পৌঁছবে। ততক্ষণ ঝালকাটিতেই অপেক্ষা করব।

স্টিমারের লোকের ও স্টেশনের লোকের উপদেশে এখানকার ডাকবাংলায় এসে উঠেছি। সারেং ও স্টিমারের পাঁচ-ছ’জন খালাসি সঙ্গে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল। এখানকার স্টিমারআপিসের লোকেরাও খোঁজ-খবর নিচ্ছে। এইমাত্র একজন মুসলমান কর্মচারী ডাকবাংলায় এসে জিজ্ঞাসা করে গেলেন, কোনও কিছুর প্রয়োজন আছে কি না, এবং বলে গেলেন সময়মতো আমার জিনিসপত্র নিতে লোক পাঠিয়ে দেবেন, আমি যেন কোনও চিন্তা না করি। ডাকবাংলাটি স্টিমার-ঘাট থেকে বেশি দূর নয়। দু’কামরা টিনের ঘর, বাঁশের সিলিং ও বেড়া। মেঝে সিমেন্ট করা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে এই চিঠি লিখছি। সামনে রাস্তাব ওপারেই একটা বড় ধানক্ষেত। ধান পেকেছে, এখনও কাটা হয়নি। তারপর নদী। নৌকার চলমান পাল দেখা যাচ্ছে। ওপারের সুপারি-নারকেল-বনের নীচ দিয়ে চলন্ত বড় নৌকার ছই দেখতে পাচ্ছি। উত্তর দিকটায় নদীর জল অনেকটা দেখা যাচ্ছে–রৌদ্রে গলা ইস্পাতের মতো ঝকঝকি করছে। তার এক পাশে স্টেশনের ফ্ল্যাটের কুশ্ৰী দেহটা।

ডাকবাংলার সামনের ছোট মাঠটায় দুটি খঞ্জন নেচে বেড়াচ্ছে। রোগা একটা বাছুর ঘাস খাচ্ছে। সামনে রাস্তার পাশে চারটে ঝাউগাছ। একটার গা ঘেঁষে এক খেজুরগাছ, হাঁড়ি বঁধা রয়েছে। একটা কাক হাঁড়ির মুখে গলা ঢুকিয়ে রসাকর্ষণের বৃথা চেষ্টা করছে। ডাকবাংলার উত্তর ঘেঁষে এক ঘোলা জলের ডোবা। তার ওপারে মিউনিসিপ্যাল আপিস, তার পর পুলিশের থানা। তারপরে বাজারের সব টিনের চাল দেখা যাচ্ছে। ছ’দিন জল-প্রবাসের পর ডাঙার জীবের ডাঙা মন্দ লাগছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *