কমেডি
ট্রাজেডি
সনেট

দ্য টেমিং অফ দ্য শ্রু

দ্য টেমিং অফ দ্য শ্রু

ব্যাপটিস্টা মিনোলা একজন ধনী লোক। ইতালির অন্তর্গত পাদুয়া শহরের অধিবাসী তিনি। তার কোনও পুত্র-সন্তান নেই, শুধু দুটি মেয়ে। একজনের নাম ক্যাথারিনা, অপরজন বিয়াংকা।

মেয়ে দুটি দেখতে পরমাসুন্দরী হলেও এখনও পর্যন্ত তাদের বিয়ে হয়ে ওঠেনি, আর খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হবার সম্ভাবনাও নেই। বড়ো মেয়ে ক্যাথরিনার বিয়ে হবার পথে অন্তরায় তার অতিরিক্ত বদমেজাজ। যখন তখন সে রেগে ওঠে, অকারণে গালিগালাজ দেয়, এমনকি মারধোরও করে। শুধু ছোটোরাই নয়, বড়োদেরও রেহাই দেয় না সে। ধনী-গরিব কাউকেও সে কেয়ার করে না। এক এক সময় শুধু বাইরের লোক নয়, নিজের বাবাকেও এমন কড়া কথা বলে যে তা শুনে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে ওঠে। এ সব জেনে শুনে কেউ আর এগিয়ে আসে না ও মেয়েকে বিয়ে করতে। কেবল নিজেদের শহরেই নয়, শহরতলি আর আশেপাশের গ্রামের ছেলেরাও জেনে গেছে তার বদমেজাজের কথা। কাজেই বিয়ের শখ থাকলেও কেউ আর ওদের বাড়ির ধারেপাশে ঘেঁসে না।

ক্যাথারিনার ছোটো বোন বিয়াংকা ঠিক তার উলটো। সে দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মিষ্টি তার স্বভাব। কিন্তু তার বিয়ের পথে বাধা হয়েছে তার নিজের দিদি। তার বাবা বলেন বড়ো মেয়ের বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ছোটো মেয়ের বিয়ে দেবেন না তিনি।

বিয়াংকার পাণিপ্রার্থী পাদুয়া শহরের যুবকদের মধ্যে রয়েছে হর্টেনসিও আর গ্রেমিও। তারা উভয়েই ধনী এবং বিয়াংকাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে, একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে।  ব্যাপটিস্টার অভিমত জানা সত্ত্বেও তারা উভয়ে একসাথে গিয়ে দেখা করল তার সাথে— স্বতন্ত্র ভাবে প্রস্তাব দিল বিয়াংকাকে বিয়ে করার।

তাদের কথা শুনে দাঁত খিচিয়ে বলে উঠল ব্যাপটিস্টা, আমি তো আগেই বলেছি ছোটো মেয়ের বিয়ের কথা মোটেও ভাবছি না। আগে বড়ো মেয়ের বিয়ে দেব, তারপর সে কথা ভাবিব। যদি সাহস থাকে তো তাকে বিয়ে কর, নইলে তার উপযুক্ত একটা পাত্র এনে দাও। তবেই ভাবিব ছোটো মেয়ের বিয়ের কথা। ব্যাপটিস্টা যখন এ কথা বলছিল, তখন আশে-পাশেই ঘুরঘুর করছিল ক্যাথরিনা। আর বিয়াংকা। বাবার কথা শোনার পর তাদের দুজনকে আচ্ছা করে দুকথা শুনিয়ে দিল ক্যাথারিনা। সাথে সাথে বিয়াংকাও জানিয়ে দিল এখন মোটেই বিয়ের ইচ্ছে নেই তার। বাড়িতে থেকে লেখা-পড়া আর গান-বাজনা করে সময় কাটাৰে সে। বিয়াংকার কথা শোনার পর ব্যাপটিস্টা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি ছোটো মেয়ের জন্য একজন গৃহশিক্ষক রাখবেন। তিনি গ্রেমিও আর হর্টেনসিওকে বললেন, ইচ্ছে করলে তারা একজন উপযুক্ত গৃহশিক্ষককে পাঠিয়ে দিতে পারে।

এভাবে ব্যাপটিস্টার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পর তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর রেফারেযি ছেড়ে বন্ধুর মতো আলোচনায় বসল। হর্টেনসিও প্রস্তাব দিল দাজ্জাল ক্যাথরিনার জন্য একজন উপযুক্ত পোত্র খোজা হোক। প্রথমে রাজি না হলেও শেষমেশ গ্ৰেমিও রাজি হলেন এ প্রস্তাবে স্থির হল ক্যাথরিনার উপযুক্ত পোত্র খুঁজে দেবার পর আবার দুজনে প্রতিদ্বন্দ্বিতীয় নামবেন। বিয়াংকার জন্য।

পাদুয়ার নিকটবতী পিসা শহরে বাস করতেন ভিনসেনসিও নামে একজন ধনী ব্যবসায়ী। তিনি তার একমাত্র পুত্ৰ লুসেনসিওকে পাদুয়ায় পাঠিয়েছিলেন ব্যবসার দরুন পাওনা টাকাকড়ি আদায়ের ব্যাপারে। তার ভূত্য অ্যানিও ছিল লুসেনসিওর সাথে। শুধু ভৃত্য নয়, তাকে পরম হিতৈষী বন্ধুর মতো দেখতেন লুসেনসিও। ব্যাপটিস্টা যখন হোর্টনসিও আর গ্ৰেমিওর সাথে বিয়াংকার বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা বলছিলেন, ঘটনাচক্ৰে লুসেনসিও সে সময় এসে পড়েন। সেখানে। রূপসি বিয়াংকাকে দেখে খুব ভালো লেগে যায়। তার। আড়াল থেকে ব্যাপটিস্টার কথা শুনে তিনি স্থির করলেন। তিনি নিজেই বিয়াংকার শিক্ষক হবেন। শিক্ষক সেজে তিনি কীভাবে বিয়ে করার চেষ্টা করবেন। সে কথা তিনি জানিয়ে দিলেন তাঁর ভৃত্য ত্ৰানিওকে। সবশেষে তাকে বললেন, তুমি আমার ছদ্মবেশে পাদুয়ার আড়তে বসে টাকাকড়ি আদায়ের ব্যবস্থােটা চালিয়ে যাও আর ব্যাপটিস্টার সাথে মাঝে মাঝে দেখা করে বিয়াংকাকে বিয়ে করার প্রস্তাবটাও দিয়ে যাবে। দেখা যাক দুদিক থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাবার ফল কী হয়!

মনিবের একমাত্র ছেলের হিতৈষী বন্ধু হিসেবে তার কথা ফেলতে পারল না। ব্র্যানিও। দামি পোশাক পরে লুসেনসিওর ছদ্মবেশে সে গিয়ে বসল। পাদুয়ার আড়তে। এদিকে আসল লুসেনসিও তখন ক্যাম্বিও নামে এক গরিব শিক্ষক সেজে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল ব্যাপটিস্টার বাড়িতে। সে সাহিত্য পড়াবে বিয়াংকাকে।

 

বাড়ি ফিরে আসার পর হর্টেনসিও দেখতে পেল তার পুরোনো বন্ধু পেত্রুসিও বেজায় পেটাচ্ছে তার নিজের চাকর গ্রেমিওকে। পেক্রসিও ভেরোনার অধিবাসী। সে খুব বদমেজাজি। সামান্য কারণেই রেগে ওঠা তার স্বভাব। যাই হোক হর্টেনসিও এসে পড়ায় এ যাত্ৰা মারের হাত থেকে রক্ষা পেল গ্রেমিও। বন্ধুকে দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল পেত্রুসিও। কথা শুনে জানা গেল খুব সামান্যতে সে এমন রেগে গিয়েছিল গ্রেমিওর উপর যে সে নিজেকে আর আয়ত্তের মধ্যে রাখতে পারেনি। কথায় কথায় হর্টেনসিও জানতে পারল যে অল্প কিছুদিন আগে পেত্রুসিওর বাবার মৃত্যু হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে সে আজ বড়োলোক বাবার রেখে যাওয়া ধনসম্পত্তি, বিরাট বাড়ি, ফলের বাগান, খেতি-খামার, গাড়ি-ঘোড়া আর দাস-দাসীর মালিক। এক কথায় সে আজ ভেনিসের সেরা ধনীদের একজন। এসব সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত বিয়ে করেনি সে। এখন বাপের টাকা খরচ করে সে দেশভ্রমণে বেরিয়েছে। ইচ্ছে আছে। এই সুযোগে মনের মতো পাত্রী পেলে বিয়েটাও সে সেরে ফেলবে দেশভ্রমণের ফাঁকে। প্রথম সুযোগেই পাদুয়ায় পুরনো বন্ধু হর্টেনসিওর বাড়িতে এসেছে পেত্রুসিও।

হাসতে হাসতে মন্তব্য করল হর্টেনসিও, যাক, তাহলে এতদিনে তোমার বিয়ে করার সুমতি

হয়েছে। কিন্তু ভাই, যে সে মেয়ে হলে তো তোমার চলবে না।

অবাক হয়ে বলল পেত্রুসিও, কী বলছি তুমি? যে সে মেয়ে হলে চলবে না। তার অর্থ কী!

ঠিকই বলেছি আমি, হাসতে হাসতে মন্তব্য করল হর্টেনসিও, তুমি নিজে যেমন বদরাগী তেমনি তোমার প্রয়োজন একটা দজল ঝগড়াটে বউ —— অবশ্য বড়োলোক বাপের আদুরে মেয়ে হলেই ভালো হয়।

হর্টেনসিওর কথা শুনে পেত্রুসিও বলল, কী বললে, বড়োলোক বাপের আদূরে মেয়ে! তুমি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছি বন্ধু। তবে সত্যি সত্যি যদি তেমন ঝগড়াটে দাজ্জাল মেয়ে হাতের কাছে পেয়ে যাই, তাহলে তাকে বিয়ে করতে রাজি আছি আমি। আসলে টাকার উপর প্রচণ্ড লেভ পেক্রসিওর। অগাধ সম্পত্তির মালিক হয়েও সে সন্তুষ্ট নয়, তার চাই আরও টাকা।

অধীর আগ্রহের সাথে জানতে চাইল হর্টেনসিও, তুমি ঠিক বলছি তো পেত্রুসিও? দেখ! বড়োলোকের মেয়ে দেখতে সুন্দর, তবে স্বভাবে দজাল, এক নম্বর ঝগড়াটে–এরূপ মেয়ে হলে তুমি সত্যিই তাকে বিয়ে করবে?

কেন করব না? বলল পেত্রুসিও, ওরকম মেয়ে পেলে আমি এককথায় রাজি। মনে হচ্ছে তোমার হাতে আমন মেয়ে আছে। তা ভাই! বড়োলোক বাপ জামাইকে ভালোমতো দেবে-থোবে তো?

নিশ্চয়ই দেবে বলেই ব্যাপটিস্টার বড়ো মেয়ে ক্যাথরিনার কথা বন্ধুকে খুলে বলল হর্টেনসিও। তার কথা শুনে পেত্রুসিও বলল, বেশ! আমি রাজি আছি। ঐ দজাল মেয়েকে বিয়ে করতে। চলো, এখনই গিয়ে ওর বাবার সাথে কথা-বার্তা বলে সবকিছু পাকা করে আসি। তবে আমাকে ভালো যৌতুক দিতে হবে। ভালোমতো যৌতুক পেলে কীভাবে ওই দজল মেয়েকে চিট করতে হয় তা দেখিয়ে দেব ওর বাবাকে, অবশ্য তোমরাও দেখতে পাবে।

ক্যাথারিনাকে বিয়ে করতে পেত্রুসিও রাজি হওয়ায় এবার কায়দা করে নিজের কথাটা বলল হর্টেনসিও। সে মিন মিন করে বলল, বেশ ভাই, তাহলে আমার একটা উপকার কর তুমি। তুমি তো জানি ক্যাথরিনার ছোটো বোন বিয়াংকাকে আমি বিয়ে করতে চাই। কিন্তু এ ব্যাপারে। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এক বন্ধু গ্রেমিও। তাই এখন বলা যাচ্ছে না শেষমেশ কার ভাগ্যে শিকে ছিড়বে। তবে একটা মতলব ভেবেছি আমি। যদি কোনওভাবে ঐ বুড়োর অন্দরমহলে ঢুকে মাঝে মাঝে বিয়াংকার সাথে কথা বলার সুযোগ পাই, তাহলে নিশ্চয়ই তার মন আমার দিকে কুঁকবে। তাহলে তাঁকে বিয়ে করাটাও আমার পক্ষে সহজ হবে। অবশ্য এ ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিয়াংকার বাবা ব্যাপটিস্টামিনোেলা। বুড়ো আমায় হাড়ে হাড়ে চেনে। ও আমায় কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। অন্দরমহলে। তাই ভেবেছি শিক্ষকের বেশে এবার ঢুকে পড়ব ওর অন্দরমহলে। তুমি তো ক্যাথারিনার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যােচ্ছ বুড়োটার কাছে। কথাবাতাঁর সুযোগে তুমি যদি গৃহশিক্ষক হিসাবে আমার কথা বল, তাহলে মনে হয় সে রাজি না হয়ে পারবে না।

পেত্রুসিও রাজি হয়ে গেল হর্টেনসিওর প্রস্তাবে। এবার দুজনে খাওয়া-দাওয়া সেরে সেজেগুজে রওনা দিল ব্যাপটিস্টার বাড়ি অভিমুখে।

পথে যেতে যেতে তাদের দেখা হল গ্ৰেমিও আর শিক্ষকের ছদ্মবেশধারী লুসেনসিওর সাথে। এর সামান্য কিছুক্ষণ আগে রাস্তায় লুসেনসিওর সাথে দেখা হয়েছে গ্রেমিওর। সে গ্রোমিওকে বলেছে গৃহশিক্ষকের একটা কাজ জোগাড় করে দিতে। ছদ্মবেশধারী লুসেনসিওকে তাই ব্যাপটিস্টার কাছে নিয়ে যাচ্ছে গ্ৰেমিও। যেতে যেতে ছদ্মবেশী লুসেনসিওকে তালিম দিচ্ছে গ্ৰেমিও—বিয়াংকাকে এমন প্রেমের কাব্য পড়াতে হবে যাতে সে আবেগ মধুর চোখে তার দিকে তাকায়। প্রতিদ্বন্দ্বী হর্টেনসিওকে মাঝপথে দেখে অবাক হলেও সে উচ্ছসিতভাবে জানায় যে অনেক কষ্টে সে একজন গৃহশিক্ষকের সন্ধান পেয়েছে আর অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে সে তাকে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপটিস্টার কাছে।

গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে বলল হর্টেনসিও, বাঃ! গ্ৰেমিও! তুমি তো বেশ কাজের ছেলে দেখছি! এরই মধ্যে গৃহশিক্ষক জোগাড় করে ফেলেছি? এরপর ইসারায় পেত্রুসিওকে দেখিয়ে বলল, একে জান তো?ইনি ভেরোনার এক বিশিষ্ট ধনী, নাম পেক্রসিও। আমার কাছে ক্যাথারিনার সব কথা শুনে ইনি স্থির করেছেন তাকে বিয়ে করবেন। তাই ক্যাথারিনার বাবার কাছে তাকে নিয়ে যাচ্ছি। সে ব্যাপারে কথাবার্তা বলার জন্য।

এবার চারজনে একসাথে রওনা দিল ব্যাপটিস্টার বাড়ির দিকে। ব্যাপটিস্টার বাড়ির কাছাকাছি আসতে আসতে লুসেনসিও দেখতে পেল তারই দামি পোশাক পরে ব্যাপটিস্টার বাড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর ভৃত্য ত্ৰানিও আর তার পেছনে রয়েছে অপর এক ভূত্য বায়েন্দেলো। বায়ন্দেলোর একহাতে রয়েছে কিছু বই আর অন্য হাতে বেহালা। সব কিছুই তাকে আগে থেকে জানিয়ে রাখা হয়েছিল, মইলে সে হয়তো ছদ্মবেশধারী লুসেনসিওকেই অভিবাদন জানিয়ে বসত। সে এমন আচবণ করল যাতে মনে হবে দামি পোশাক পরা ত্ৰানিওই তার আসল মনিব।

ত্ৰানিওর পোশাক-আসাক আর আচার-আচরণে হর্টেনসিও আর গ্ৰেমিও বুঝতে পারল এবার বিয়াংকার পাণিপ্রার্থী আরও একজন এসে জুটল। আলাপের শুরুতেই ত্ৰানিও জানিয়ে দিল সে পিসাের এক ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে-নাম লুসেনসিও। বিয়াংকার রূপ-গুণের কথা শুনে সে এসেছে তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ করতে।

সে সময় বাড়িতেই ছিলেন ব্যাপটিস্টা। তিনি আদরের সাথে এদের নিয়ে ঘরে বসালেন।

আত্মপরিচয় দেবার পর পেত্রুসিও ব্যাপটিস্টাকে জানালেন যে তিনি তার বড়ো মেয়ে ক্যাথারিনাকে বিয়ে করতে চান এবং ভাবী পত্নীকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য সাথে নিয়ে এসেছেন একজন নামি শিক্ষককে যিনি একাধারে গণিতজ্ঞ ও সংগীত বিশারদ, এই বলে তিনি ইশারায় দেখিয়ে দিলেন হর্টেনসিওকে।

 

পেত্রুসিওর ধনী পিতাকে ভালোভাবেই জানতেন ব্যাপটিস্টা। তার ভাবতেই অবাক লাগিছে এরূপ নামি লোকের একমাত্র ছেলে স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে চায়। তার বদমেজাজি মেয়েকে, তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন পেত্রুসিওর প্রস্তাবে। সেই সাথে মেয়েকে লেখাপড়া আর গানবাজনা শিখিয়ে ভদ্রস্থ করতে তিনি বহাল করলেন গৃহশিক্ষক লিসিয়া রূপী ছদ্মবেশধারী হর্টেনসিওকে।

এবার গ্রেমিও এগিয়ে এসে ব্যাপটিস্টাকে বলল বিয়াংকাকে কাব্য-সাহিত্য পড়বার জন্য সেও একজন অভিজ্ঞ শিক্ষককে নিয়ে এসেছে। সে ছদ্মবেশী লুসেনসিওকে দেখিয়ে বলল, এই ভদ্রলোকের নাম ক্যাম্বিও। ইনি গ্রিক-ল্যাটিনসহ অনেকগুলি ভাষায় সুপণ্ডিত। বর্তমানে রিমস বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত। এরূপ পাণ্ডিত্যের কথা শুনে ব্যাপটিস্টা আর আপত্তি করলেন না। তাকে বিয়াংকার গৃহশিক্ষক হিসেবে রাখতে। এমনিতেই তার মন খুশিতে ভরেছিল বড়ো মেয়ে ক্যাথারিনাকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে এক সুপাত্র আসায়।

নিজেকে লুসেনসিও হিসাবে পরিচয় দিয়ে এবার ত্ৰানিও এগিয়ে এসে প্রস্তাব দিল বিয়াংকাকে বিয়ে করার। সেই সাথে মেয়েদের শিক্ষার সুবিধার্থে বায়েন্দেলোর হাত থেকে বইগুলি এবং বেহালা নিয়ে ব্যাপটিস্টাকে উপহার দিল ত্ৰানিও। খুবই খুশি মনে উপহারগুলো নিলেন ব্যাপটিস্টা। এরপর ছদ্মবেশী হর্টেনসিওর হাতে বেহালাটা দিয়ে বললেন, যান, এবার অন্দরমহলে গিয়ে যত্ন করে বাজনোটা শেখান আমার বড়ো মেয়েকে। একইভাবে বইগুলো ছদ্মবেশী লুসেনসিওর হাতে দিয়ে বললেন, আপনিও ভেতরে গিয়ে এই কাব্যসাহিত্যগুলি যত্ন করে পড়ান ছোটো মেয়েকে। ত্ৰানিও যখন দেখলেন তার মতলব হাসিল হয়েছে, তিনি ব্যাপটিস্টার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বায়েন্দেলোকে সাথে নিয়ে। তারা চলে যাবার পর এবার নিশ্চিন্ত হয়ে পেত্রুসিওর সাথে কথাবার্তা বলতে লাগলেন ব্যাপটিস্টা।

এমন সময় বাপারে! মারে! বলে চেঁচাতে চেঁচাতে চটে বাইরে এল হর্টেনসিও। তার মাথায় অনেকটা জায়গায় কাটা। সেখান থেকে দরদরি করে রক্ত বের হচ্ছে।

তার এরূপ অবস্থা দেখে উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলেন ব্যাপটিস্টা, কী হল? আপনার এরূপ অবস্থা কে করল?

চেঁচিয়ে বললেন হর্টেনসিও, আপনার বড়ো মেয়ে ছাড়া এ কাজ কে আর করবে? দেখুন দিকি আমার মাথার অবস্থা!

ব্যাপটিস্টা বললেন, কী করেছে আমার বড়ো মেয়ে?

খেঁকিয়ে উঠে বললেন হর্টেনসিও, আবার জানতে চাইছেন কী করেছে। আপনার বড়ো মেয়ে? বেহালা বাজাবার সময় বারবার ভুল করছিল ক্যাথারিনা। আমি যেই হাত ধরে শিখিয়ে দিতে গিয়েছি আমনই রেগে উঠল সে। তারপর বেহালাটা হাতে নিয়ে পরপর কবার এমন মারল যে মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড।

তাকে বাধা দিয়ে বললেন ব্যাপটিস্টা, থাক, আর আপনাকে বলতে হবে না। আমি সব বুঝতে পেরেছি। মেয়ের এই আচরণে খুবই দুঃখ পেলেন তিনি।

মনে মনে এই ভেবে ভয় পেলেন ব্যাপটিস্টা যে এতদিনে যদিও বা পাত্র জুটল, কিন্তু এ সব কাণ্ড দেখে সে আবার ভোগে না পড়ে। তাই এই বিরক্তিকর পরিস্থিতিটা এড়িয়ে যাবার জন্য তিনি বললেন, যাক, আর দরকার নেই ক্যাথারিনাকে গান-বাজনা শিখিয়ে। আপনি বরঞ্চ আমার ছোটো মেয়েকে ওসব শেখান। আপনি ভেতরে গিয়ে আমার ছোটো মেয়ে বিয়াংকাকে বললেই ও পরম যত্নে মলম লাগিয়ে দেবে আপনার মাথার কাটা জায়গাগুলিতে। কথা শুনে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেল অন্দরমহলে। বিয়াংকার ঘরে গিয়ে দেখল তাকে কাব্য পড়াচ্ছে লুসেনসিও আর শোনার ভান করে তার দিকে হাঁ করে চেয়ে রয়েছে বিয়াংকা।

মেয়ের আচরণের জন্য পেত্রুসিওর কাছে ক্ষমা চাইলেন ব্যাপটিস্টা-কারণ তার ভয় রয়েছে পাছে পেত্রুসিও আবার হাতছাড়া হয়ে না যান। তিনি তাকে আশ্বাস দিলেন বিয়ের পর বদমেজাজি। মেয়ে ঠান্ডা হয়ে যাবে। পেত্রুসিও বেশ উপভোগ করছিলেন ভাবী স্ত্রীর কাণ্ড-কারখানা, কিন্তু মুখ ফুটে তা প্রকাশ করলেন না ব্যাপটিস্টার কাছে। বরঞ্চ তিনি ব্যাপটিস্টাকে বললেন তিনি যেন যথা শীঘ্ৰ সম্ভব তার সাথে বদমেজাজি ক্যাথারিনার বিয়েটা সেরে ফেলেন। কিন্তু পেত্রুসিও বললে কী হয়, কিছুক্ষণ আগে দেখা তার শান্ত মেয়ের গুণপনার কথা এখনও পর্যন্ত ভুলতে পারেননি। ব্যাপটিস্টা! তাই পেত্রুসিও বারবার বলা সত্ত্বেও তার সত্বর বিয়ের ব্যাপারে কোনও আশ্বাস দিতে পারলেন না ব্যাপটিস্টা। কিন্তু পেত্রুসিও ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর ছেলে। সে জানে কীভাবে লোককে বশে এনে তাকে চালাতে হয়। তাই ধৈর্য ধরে রইল সে। শেষমেশ তারই জয় হল। বিয়েতে ব্যাপটিস্টা নগদ কুড়ি হাজার টাকা দেবেন — এ প্রতিশ্রুতিও তার কাছ থেকে আদায় করে নিলেন। পেত্রুসিও। বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেল। কথা-বার্তা শেষ হয়ে যাবার পর ভাবী শ্বশুরের অনুমতি নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা করল ক্যাথারিনার সাথে। বেহালা দিয়ে হর্টেনসিওর মাথা ফাটিয়ে দেবার পরও রাগ কমেনি ক্যাথারিনার। গানের মাস্টারের দালাল বলে সে যথেচ্ছ গালাগাল দিল পেত্রুসিওকে। চুপচাপ সে সব সয়ে গেল পেত্রুসিও। তাতে আরও রাগ বেড়ে গেল ক্যাথারিনার। সে দু-চার ঘা লাগিয়ে দিল ভাবী বরকে। হাসিমুখে সে সব সহ্য করে যাবার আগে পেত্রুসিও বলল, আজ আমি যাচ্ছি। তবে আগামী রবিবার সেজেণ্ডজে আসছি। তোমায় বিয়ে করতে। তুমি কিন্তু তৈরি থেক।

দীতে দাঁত চেপে উত্তর দিল ক্যাথারিনা, ও! তাহলে তোমার এই মতলব! ঠিক আছে, আগে তো আমায় বিয়ে কর তারপর দেখিয়ে দেব বিয়ের কী মজা। কীভাবে তোমার হাড়মাস আলাদা করতে হয় তা খুব জানা আছে আমার।

জবাবে কিছু না বলে চুপচাপ সেখান থেকে চলে এল পেত্রুসিও। সে এবার ভেনিসে বিয়ের পোশাক কিনতে যাবে আর সেখান থেকে নির্দিষ্ট সময়ে সে এসে যাবে ক্যাথারিনাকে বিয়ে করতে — এই কথাগুলি ব্যাপটিস্টাকে বলে সেদিনের মতো তার কাছ থেকে বিদায় নিল সে।

 

এদিকে অন্দরমহলে হর্টেনসিও আর লুসানসিওর মধ্যে বেজায় সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে বিয়াংকাকে কাব্য-সাহিত্য পড়ানো আর গান-বাজনা শেখানো নিয়ে। একদিকে মাথাভর্তি ব্যান্ডেজ নিয়ে বেহালায় তার বাঁধছে। হর্টেনসিও আর অন্যদিকে মোটা একটা কবিতার বই খুলে বিয়াংকাকে পড়াচ্ছে লুসেনসিও–

হিক ইবার্টি সিমোয়েস, হিক এস সিগিয়া টেলাস, এস্টেটিরাট প্রায়ামি, রিজিয়া সেলসা টেনিস। কিন্তু এসবের কিছুই মাথায় ঢুকছে না বিয়াংকার। সে বলল, মাস্টারমশাই! এসব কঠিন শব্দের অর্থ কী?

গলা নামিয়ে লুসেনসিও বলল, ঠিক আছে। আমি বলছি, তুমি মন দিয়ে শোন। হিক ইবার্ট সিমোয়েস অর্থাৎ আমি লুসেনসিও, হিক এস্ট-এর অর্থ পিসাের ভিনসেনসিও আমার বাবা। সিগিয়া টেলাসের মানে তোমাকে বিয়ের আশায় শিক্ষক সেজেছি আমি। হিক এস্টোটিরাট প্রায়ামি-এর অর্থ হল তোমার বাবার কাছে যে লোকটি নিজেকে লুসেনসিও বলে পরিচয় দিয়েছে সে আমারই ভৃত্য ত্ৰানিও। রিজিয়া শব্দের অর্থ আমাদের পাদুয়ার আড়তে বসে সে আমার পরিচয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সবশেষে রইল সেলসা টেনিস অর্থাৎ তোমার বুড়ো বোপকে ধাপ্পা দেবার জন্যই এসব করতে হয়েছে আমাকে। মূল লাতিন কবিতার মনগড়া ব্যাখ্যা করে নিচু গলায় বিয়াংকাকে শোনাচ্ছে সে–এককথায় কাব্য-সাহিত্য পড়বার নামে সে ধাপ্পা দিয়ে চলেছে বিয়াংকাকে।

এবার হর্টেনসিওর পালা। সে বলল, বেহালার তার বাধা হয়ে গেছে আমার! আমি এবার গান শেখাব বিয়াংকাকে?

বিয়াংকা বলে উঠল, একবার শোনান তো দেখি কেমন তার বেঁধেছেন আপনি। বিয়াংকার কথা শুনেই বেহালায় টুংটাং আওয়াজ করল হর্টেনসিও। মোটেও ঠিক হয়নি তার বাঁধা, বলল বিয়াংকা, আবার নতুন করে বঁধুন। হর্টেনসিও শুরু করলেন নতুন করে তার বাঁধা।

লুসেনসিও বললেন বিয়াংকাকে, এবার বল দেখি এতক্ষণ ধরে যা শেখালাম তার অর্থ ক৩ঢ়ক বুঝেছি তুমি।

চারিদিক দেখে নিয়ে বলল বিয়াংকা, বেশ, তাহলে শুনুন। হিক ইবার্ট সিমোয়েস অর্থাৎ আমি তোমায় চিনি না। হিক এস্ট সিগিয়া টেলাস-এর অর্থ আমি তোমায় এতটুকুও বিশ্বাস করি না। হিক এস্টেটিরাট প্রায়ামি অর্থাৎ গানের মাস্টারমশায় যেন এসব শুনতে বা বুঝতে না পারেন। রিজিয়া মানে বেশি আশা করো না। আর, সেলসা টেনিসের অর্থ হল তবে একেবারে হাল ছেড়ে দিও না।

এবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও হর্টেনসিওর দিকে ঘুরে বসল বিয়াংকা, কারণ তাকে রাখা দরকার। হর্টেনসিও খসখস করে একটা কাগজে লিখে বিয়াংকার হাতে দিয়ে বলল, এই রইল স্বরলিপি। এর উপর চোখ বুলিয়ে দেখ।

বিয়াংকা দেখল কাগজে লেখা রয়েছে :

সারেগা — তোমাকে পাবার জন্য পাগল হয়ে গেছে বেচারি হর্টেনসিও।

রেগামা–হর্টেনসিওকে বিয়ে না করলে সে আর প্রাণে বাঁচবে না।

গামাপা–প্ৰাণের চেয়েও তোমায় বেশি ভালোবাসে হর্টেনসিও।

পাধানি–একটা প্রার্থনা আছে তোমার কাছে।

ধানিপা–হে প্ৰাণেশ্বরী! দয়া করি আমায়। এর বেশি আমি আর কিছুই চাই না।

এভাবে কাব্য-সাহিত্য পড়ানো আর গান-বাজনা শেখানোর নামে বিয়াংকাকে ধাপ্পা দিয়ে হর্টেনসিও আর লুসেনসিও — দুজনেই প্রেম করতে শুরু করে দিল তার সাথে।

 

পেত্রুসিওর সাথে ক্যাথারিনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাই বিয়াংকার বিয়ের ব্যাপারে আলাপআলোচনা করতে আর কোনও আপত্তি রইল না ব্যাপটিস্টার। কিন্তু মুশকিল হল গ্রোমিও, হর্টেনসিও আর লুসেনসিও — তিনজনই চাইছে বিয়াংকাকে বিয়ে করতে। এদিকে আসল লুসেনসিও শিক্ষক সেজে কবিতার মোটা মোটা বই নিয়ে বিয়াংকার চারপাশে ঘুরঘুর করছে আর যে লুসেনসিও বিয়াংকাকে বিয়ে করতে চাইছে সে আসলে লুসেনসিওর ভৃত্য ত্ৰানিও।

বিয়াংকার বিয়ের উমেদারদের মধ্যে করে কত আর্থিক সঙ্গতি সেটা জানার জন্য ব্যাপটিস্টা তাদের বললেন, আমি কুড়ি হাজার মোহর যৌতুক দেব ছোট মেয়ের বিয়েটে। কিন্তু আমি জানতে চাই তোমাদের মধ্যে কে কত যৌতুক দেবে তার স্ত্রীকে। স্বামী যদি আগে মারা যায়, তাহলে কি স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হবে আমার মেয়ে? সবার সামনে তিন যুবককে এ সব প্রশ্ন করলেন ব্যাপটিস্টা। সাথে সাথে এও জানিয়ে দিলেন যে বেশি যৌতুক দেবে, তার সাথেই বিয়াংকার বিয়ে দেবেন তিনি।

গ্রেমিওর চেয়ে অনেক বেশি ধনী হর্টেনসিও। তাই ব্যাপটিস্টার সিদ্ধান্ত জেনে নিজেকে সরিয়ে নিল গ্রেমিও। আবার হর্টেনসিওর চেয়ে অনেক বেশি ধনী লুসেনসিও। কিন্তু তার বাবা এখনও বেঁচে আর সম্পত্তি দূর পিসা শহরে। ব্যাপটিস্টা বললেন, যদি লুসেনসিওর বাবা এখানে এসে বলেন যে তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি লুসেনসিওকে আর তার অবর্তমানে আমার মেয়েকে দিতে রাজি হন, তাহলে আমি ছোটো মেয়ে বিয়াংকার বিয়ে দেব লুসেনসিওর সাথে।

ব্যাপটিস্টার এই সিদ্ধান্ত শুনে হর্টেনসিও স্থির করল বিয়াংকার আশা ছেড়ে দিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই সে বিয়ে করে ফেলবে তার পরিচিত এক বিধবা মহিলাকে।

লুসেনসিওর হয়ে তাঁর ভৃত্য ত্ৰানিওই বিয়ের সব কথাবার্তা চালাচ্ছে। মনিবের আদেশেই সে তার দামি পোশাক পরে লুসেনসিও সেজেছে বিয়াংকাকে বিয়ে করার জন্য। ব্যাপটিস্টার কথা শুনে সে এবার এক কাজ করে বসল। সে নিজে যেমন নকল লুসেনসিও, তেমনি একজনকে লুসেনসিওর নকল বাবা সাজিয়ে হাজির করল ব্যাপটিস্টার সামনে। এর মধ্যে অবশ্য কোনও বদ মতলব নেই ত্ৰানিওর। মনিবের কাজ হাসিল করতেই সে একজনকে লুসেনসিওর নকল বাবা নিয়ে এসেছে।

 

দেখতে দেখতে ক্যাথারিনার বিয়ের দিন এসে গেল। তার আত্মীয়-স্বজনরা সবাই সেজেগুজে প্রতীক্ষা করছে বরের। কিন্তু যার অপেক্ষায় রয়েছে সবাই, সেই বর পেত্রুসিওর দেখা নেই। এদিকে বেলা বাড়ছে। পাদ্রিও বিয়ে দেবার অপেক্ষায় রয়েছেন। ঘাবড়ে গেলেন ব্যাপটিস্টা। শেষে কি কথা দিয়েও তার বড়ো মেয়েকে বিয়ে করতে আসবে না পেত্রুসিও? মনে মনে খুবই ভয় পেলেন তিনি। বিয়ে নিয়ে আত্মীয়-স্বজনরা ঠাট্টা করতে লাগল ক্যাথরিনাকে। রাগে-দুঃখে কেঁদে ফেলল সে।

সবাই যখন তার আশা ছেড়ে দিয়েছে, সে সময় একটা বুড়ো ঘোড়ায় চেপে শুধুমাত্র একজন ভৃত্যকে নিয়ে হাজির হলেন পেত্রুসিও। বরের দামি পোশাক নেই তার পরিধানে–তালি দেওয়া একটা কিস্তৃত আকারের আলখাল্লা পরেছেন তিনি। সাধারণত রাস্তার ভিখারিরা সে ধরনের পোশাক পরে থাকে। তার দু-পায়ে রয়েছে দু-রকম জুতো একটা ফিতে বাঁধা, অন্যটা বকলস আঁটা।

এমন বাহারি সাজ দেখে চুপ মেরে গেছে বাড়ির মেয়েরা। ক্যাথারিনা রেগেমেগে যা তা গালি-গালাজ করতে লাগিল পেক্রসিওকে।

পেত্রুসিও কিন্তু মোটেও রাগ করল না। ক্যাথারিনার কথায়। সে বলল, তুমি কি আমায় বিয়ে করবে না। আমার পোশাককে? আগে আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর পোশাক কিনতে আর কত সময় লাগবে?

শেষমেশ আত্মীয়-স্বজনরা বাধ্য হল পেত্রুসিওর মতে সায় দিতে। তারা উভয়কে গির্জায় নিয়ে এল বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। সেখানে পেত্রুসিও যা শুরু করল তা নিছক পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়।

পাদ্রি জিজ্ঞেস করলেন ক্যাথারিনাকে, তুমি কি রাজি আছ পেত্রুসিওকে বিয়ে করতে? ক্যাথারিনা জবাব দেবার আগেই পেত্রুসিও চেঁচিয়ে বলে উঠল, হ্যা, হ্যা, ও রাজি আছে, হাজার বার রাজি আছে। পাদ্রি সাহেব চমকে উঠলেন তার চিৎকার শুনে। বাইবেলটা তার হাত থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেল। সেটা তুলে নেবার জন্য পাদ্রি একটু নিচু হতেই পেত্রুসিও তাকে এমন ধাক্কা মোরল যে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। তাকে সবাই ধরাধরি করে টেনে তুলল। শেষমেশ প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাদের বিয়েটাও হয়ে গেল। বিয়ের পর মেয়ে-জামাই আর আত্মীয়দের নিয়ে ব্যাপটিস্টা বাড়িতে ফিরে এলেন। এবার বর-কনেকে নিয়ে একসাথে খাবার

পালা। এ ব্যাপারে বহু লোককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ব্যাপটিস্টা।

পেত্রুসিও বলল তার শ্বশুরকে, আমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়। বিয়ের ভোজে যোগ দেওয়া। বাড়িতে আমার জরুরি কাজ পড়ে আছে। তাই এখনই আমায় ফিরে যেতে হবে। তবে আমি এক যাব না, আমার সাথে ক্যাথারিনাও যাবে।

পেত্রুসিওর কথা শুনে ক্যাথারিনা রেগে উঠে বলল, কী বললে তুমি! বিয়ের ভোজ না খেয়ে যেতে হবে? তোমার ইচ্ছে হয় তুমি যাও, ভোজ না খেয়ে আমি যেতে রাজি নই।

ব্যাপটিস্টা বোঝাতে লাগলেন ক্যাথরিনকে, নাঃ মা! তা হয় না। এখন তোমার বিয়ে হয়েছে। স্বামীর ইচ্ছানুসা চলতে হবে তোমাকে। তুমি যদি তা মেনে না নাও তাহলে সবাই দোষ দেবে তোমাকে। ও যখন বাড়ি যেতে চাইছে, তখন তোমাকেও যেতে হবে ওর সাথে।

বাবার কথা শুনে ভোজ না খেয়েই স্বামীর সাথে চলল ক্যাথারিনা। বিয়ে করতে আসার সময় দুটো হাড়জিরজিরে ঘোড়া নিয়ে এসেছে পেত্রুসিও। ঘোড়া দুটোর অবস্থা দেখলে করুণা হয়। গায়ের লোম উঠে গিয়ে মাঝে মাঝে সাদা মতো টাক পড়েছে। দুটো ঘোড়ার একটিতে উঠলেন পেত্রুসিও ও তাঁর ভৃত্য আর অন্যটিতে সদ্য পরিণীত স্ত্রী। কিছু সময় ভাল মতোই চলল ঘোড়া দুটো। তারপর পেছন থেকে পেত্রুসিওর তাড়া খেয়ে ঘোড়া এমনভাবে দৌড়াল যে মাটিতে ছিটকে পড়ে গেলেন ক্যাথারিনা — গায়ের দামি পোশাক ধুলো-কাদায় মাখামাখি হয়ে উঠল। ক্যাথারিনাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেল তার ঘোড়া। তখন নিজের ঘোড়ার পিঠে বউকে চাপিয়ে চললেন পেত্রুসিও। ধুলো-কাদা মাখা দামি পোশাক নিয়ে ঝুলতে ঝুলতে শ্বশুর বাড়িতে এসে পৌঁছোল ক্যাথারিনা। তার মাথা হোঁট হয়ে গেলা লজ্জায় আর অপমানে। কপূরের মতো যেন গায়েব হয়ে গেছে তার দাপট।

বাড়িতে পৌঁছে চাকর-বাকরদের ডেকে গালি-গালাজদিয়ে তাদের ভূত ছাড়িয়ে দিল পেত্রুসিও। তাদের অপরাধ তারা কেন সারিবদ্ধ হয়ে বউকে অভিনন্দন জানায়নি। শুধু গালি-গালাজ দিয়েই ক্ষাস্ত হল না সে–ক্যাথারিনার সামনেই চড় মোরল চাকর-বাকিরদের গালে। স্বামীর হাব-ভাব দেখে বেজায় ভয় পেল ক্যাথারিনা পাছে সে না মেরে বসে তাকে। শান্ত হবার জন্য সে মিনতি করতে লাগল। তার স্বামীকে।

নিজের রাগ ঝেড়ে দিয়ে পেত্রুসিও বলল, যাও, তোমাদের গিন্নি মার জন্য ভালো খাবারদাবার নিয়ে এস। তাড়াহুড়ার জন্য নিজের বিয়ের ভোজ খেতে পারেননি উনি।

হুকুম পেয়েই ভূত্যেরা কয়েক প্লেট ভালো খাবার এনে সাজিয়ে রাখল মনিব-মনিবানীর সামনে! প্লেটে হাত নিয়েই লাফিয়ে উঠে বললেন পেত্রুসিও, ছিঃ ছিঃ মাংসটা যে পুড়ে কালো হয়ে গেছে? এ খাবার কি কেউ খেতে পারে? বলিহারি তোদের বুদ্ধিকে! এ খেলে যে তোদের গিন্নিমা অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এ যে বিষ! বলেই খাবারগুলিটান মেরে বাইরে ফেলে দিল পেক্রসিও। এদিকে ক্যাথারিনার অবস্থা তখন শোচনীয়। খিদেয় তার পেটের নাড়ি জুলছে। কোনও মতে কান্না চেপে সে বলল, মিছামিছি। তুমি নষ্ট করলে খাবারগুলো। মাংসটা তো ভালোই ছিল। কত যত্ন করে ওরা এসব রোধেছিল আর তুমি কিনা সে সব নষ্ট করে ফেললে?

মিষ্টি মিষ্টি করে ক্যাথরিনাকে বোঝাতে লাগলেন পেত্রুসিও, আমি বেশ বুঝতে পারছি কেটি খিদের সময় খাবার না পেয়ে কত কষ্ট হচ্ছে তোমার। কিন্তু অখাদ্য খাবার খাওয়ার চেয়ে বরঞ্চ উপোস করা ভালো। তাতে অন্তত শরীরের ক্ষতি হবে না। তুমি তো নিশ্চয়ই মান যে শরীরের কল-কব্জাগুলোরও প্রয়োজন আছে বিশ্রামের। সে সব কথা থাক। পথে আসতে তোমার খুব কষ্ট হয়েছে। চল, এবার ঘুমোনো যাক। তুমি মুখে বলছি না বটে, কিন্তু তোমার চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যথায় তোমার সারা শরীর যেন ছিড়ে পড়ছে। ভালো করে এক ঘুম দিয়ে দাও, দেখবে ব্যথা কোথায় পালিয়ে গেছে। সকালে ঘুম ভেঙে উঠে ভালো করে খেয়ে নেবে।

তখন আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই ক্যাথরিনা। এই পাগলের হাতে তার কী দুৰ্দশা হবে সে কথা ভেবে শিউরে উঠছে সে। ভয় আর উৎকণ্ঠায় শুকিয়ে আসছে তার চোখ-মুখ।

এবার পেত্রুসিও শোবার ঘরে ঢুকােল নতুন বউকে নিয়ে। চেঁচিয়ে বলে উঠল সে, এ কি হাল বিছানার? এই কি বালিশ, চাদর আর লেপের নমুনা? এত সাহস তোদের যে এই সমস্ত রাস্তার জিনিস তোরা আমার বউয়ের শোবার জন্য পেতেছিস! কী ভেবেছিস তোরা আমায়? রাস্তার ভিখিরিও এমন ইটের মতো শক্ত বিছানায় শোয়না। দেখছি কিছুক্ষণ আগে আমার হাতে মার খেয়েও বিন্দুমাত্র শিক্ষা হয়নি তোদের! আমারই খাবি, পরবি আর দু-হাতে আমারই টাকা ওড়াবি? এদিকে কাজের বেলায় বিলকুল ফাঁকি দিবি! দাঁড়া তোদের মজা দেখাচ্ছি আমি। ভালোয় ভালোয় কাল গিন্নিমা তোদের সবার কাজ-কর্ম বুঝে নিক, তারপর পরশু সকলে ঘাড় ধরে সবাইকে খেদিয়ে দেব। চাকরই হও বা যেই হোক, আমার কথা মতো না চললে সবাইকে দূর করে দেব আমি, সেটা কিন্তু আগেই বলে রাখছি? — বলতে বলতে মোলায়েম রেশমি চাদরে-চাকা বিছানা খাট থেকে তুলে নিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন পেত্রুসিও। সারারাত খাটের শক্ত কাঠে ঠেস দিয়ে বসে রইল ক্যাথরিনা। খেতে না পেয়ে তার মাথা ঘুরছে। যখনই ক্যাথারিনা ঘুমোবার উপক্রম করছে, ঠিক তখনই পেত্রুসিও কোনও না কোনও প্রসঙ্গ নিয়ে চেঁচামেচি করছে যাতে ঘুম যাচ্ছে পালিয়ে।

এভাবেই কেটে গেল পরের দিন। পেক্রসিওর তাড়নায় রাতে জল ছাড়া আর কিছুই জোটেনি ক্যাথারিনার ভাগ্যে। ঠিক আগের মতোই আজ রাতেও তাকে ঘুমোতে দিল না পেত্রুসিও। দুদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে আধমরা অবস্থা ক্যাথারিনার। কথায় কথায় যখন পেত্রুসিও বুঝতে পারল যখন-তখন ক্যাথারিনার মাথা গরম করার ভাবটা কমেছে, সে রান্না ঘরে গিয়ে কয়েক টুকরো পোড়া রুটি জোগাড় করে সুন্দর করে প্লেটে সাজিয়ে শোবার ঘরে ক্যাথারিনার সামনে নিয়ে গেল। ক্যাথারিনা তখন বিছানা ছেড়ে উঠে চোখে-মুখে জল দিয়েছে। সে প্লেটটা ক্যাথারিনার সামনে রেখে আদর করে বলতে লাগল, এই দেখ কেটি, নিজ হাতে কেমন খাবার তৈরি করেছি আমি। এই কদৰ্য খাবার দেখে জল এসে গেল ক্যাথারিনার চোখে। কিন্তু বেচারি কীই বা আর করতে পারে! ক্ষুধার মুখে ওই পোড়া রুটিকেই রাজভোগ ভেবে টপটপ খেয়ে ফেলল। যতই হোক, দু-দিনের অনাহারের জ্বালা তো বটেই।

পেত্রুসিও এরপর একজন নামি দর্জিকে ক্যাথারিনার কাছে নিয়ে এল। ক্যাথারিনার জন্য সে গাউন আর টুপি তৈরি করে নিয়ে এসেছে। তার খুবই পছন্দ হল দামি কাপড়ে তৈরি সে সব পোশাক। কিন্তু সে কথা স্বামীকে বলতে গিয়েই যত বিপত্তি। নাক কুঁচকে চড়া গলায় দর্জিকে বলতে লাগল পেত্রুসিও, এটা কী করেছ তুমি? এটা কি একটা গাউন আর এর নাম টুপি? এর চেয়ে রান্নার একটা বাটি কিনে আমার স্ত্রীর মাথায় পরিয়ে দিলেই তো সব কামেলা মিটে যেত। ছিঃ ছিঃ তুমি কি ভেবেছ আমার স্ত্রী কুলি-কামিনের মেয়ে আর তাই একটা বদখত আলখাল্লা এনে তাকে গাউন বলে গছাবার চেষ্টা করছ? নাঃ হে, আমার ঘরে ওসব রাদি মাল চলবে না।

দর্জি তো অবাক পেত্রুসিওর কথা শুনে। দেশ জুড়ে তার কত নাম-ডাক সেরা দর্জি হিসেবে। আমির-ওমরাহ, বড়ো ঘরের মেয়ের বউরা সবাই তারিফ করে তার তৈরি পোশাকের। আর এর মতো একজন সাধারণ ব্যবসায়ী বলে কিনা আমি বাজে দর্জি!

দর্জির মনের ভাব বুঝতে পেরে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল পেক্রসিও, ওহে! তোমার পোশাকগুলি নিয়ে এখনই চলে যাও। কিছুক্ষণ বাদে আমি ওগুলির দাম পাঠিয়ে দিচ্ছি।

পোশাকগুলি অপছন্দ করার পেছনে যে অন্য কারণ রয়েছে সেটা বুঝতে পারল দর্জি। তাই সে আর কোনও কথা না বলে পোশাকগুলি থলিতে পুরে নিয়ে চলে গেল তার দোকানে।

ক্যাথারিনাকে সাস্তুনা দিয়ে বলতে লাগল, নতুন পোশাক না হয় নাই হল, তার জন্য দুঃখ করো না। চলো, পুরনো পোশাক পরেই আমরা পাদুয়ায় যাই। বুঝলে কোটি, টাকাই সবকিছু। টাকাই আমার জীবনের ধ্যান, জ্ঞান, ঈশ্বর। অর্থবান লোক ছোড়া পোশাক পরে গেলেও লোকেরা তাকে মাথায় তুলে রাখে। বাপের বাড়ির কথা শুনে আনন্দে নেচে উঠল ক্যাথারিনার মন। বলল, চল, আমরা এখনই বেরিয়ে পড়ি পাদুয়ার উদ্দেশ্যে।

ঘড়ি না দেখেই পেত্রুসিও বলল, এখন সকাল সাতটা। মনে হয় এখনই বেরিয়ে পড়লে দুপুরের খাওয়ার পাট মিটে যাবার আগেই পাদুয়ায় পৌঁছাতে পারব আমরা।

স্বামীর কথায় অবাক হয়ে বলল ক্যাথারিন, কি বলছি তুমি? এখন সকাল সাতটা? ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখ এখন বেলা দুটা বাজে। এ সময় বেরিয়ে পড়লে রাতের খাবার সময় হয়তো পৌঁছান যাবে।

যতটুকু বা বাগে এসেছিল পেত্রুসিও, বউয়ের কথা শুনে ততখানিই বিগড়ে গেল সে।

চোখ পাকিয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল পেক্রসিও, কী বললে এখন দুপুর দুটো বাজে, সকাল সাতটা নয়? সামান্য একটা ঘড়িও আমার ইচ্ছেমতো চলবে না? ঠিক আছে, এই ঘর ছেড়ে এক পাও বাইরে যাব না আমি। আমার ইচ্ছেমতো সময় যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার ঘড়ি দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পিসা, মিলান, ভেনিস–কোথাও যাব না আমি।

এতক্ষণে ক্যাথারিনা বুঝতে পেরেছে মাথা নিচু না করলে কোনও কাজই হাসিল হবে না। এ বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই তার রাগ, বদমেজাজ–সবই হারিয়ে গেল। সে বুঝতে পেরেছে তার স্বামী তার চেয়ে অনেক বেশি রাগী আর বদমেজাজি। এর সাথে মানিয়ে চলতে গেলে তার জেদ, বদমেজাজ–এমনকি বুদ্ধি বিবেচনাও তাকে ত্যাগ করতে হবে। নইলে পদে পদে দুর্ভোগ আর অশান্তি ভোগ করতে হবে তাকে। তাই চটজলদি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সে বলল, ঠিকই বলেছ তুমি। আমারই ভুল হয়েছে। এখন তো সকাল সাতটা বাজে। এ সময় বেরিয়ে পড়লে দুপুর নাগাদ নিশ্চয়ই আমরা পৌঁছে যাব পাদুয়ায়।

হেসে হেসে বউকে বলল পেত্রুসিও, তাহলে এখন দুপুর দুটো নয়, সকাল সাতটা বাজে! বেশ, তাহলে আমরা এখন বেরিয়ে পড়ি।

পাদুয়ায় পথে যেতে যেতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হল তাদের। কথায় কথায় জানা গেল ওই ভদ্রলোক পিসা নগরীর ধনী ব্যবসায়ী ভিনসেনসিও। কিছুদিন আগে ব্যবসা-পত্রের সাথে ছিল তার বিশ্বস্ত ভূত্য ত্ৰানিও। কিন্তু পাদুয়ায় যাবার পর থেকে তিনি কোনও খোঁজ পাচ্ছেন না তার ছেলে এবং ভূত্যের। ভিনসেনসিও জানালেন যে তাদের খোঁজ নিতে তিনি নিজেই পাদুয়ায় যাচ্ছেন।

পেত্রুসিও আর ক্যাথারিনার কাছে চেনাচেন ঠেকােল দুটো নামই –লুসেনসিও আর ত্ৰানিও। পেত্রুসিওর বুঝতে বাকি রইল না যে যুবক তার শ্যালিকাকে বিয়ে করবে বলে ধনুকভাঙা পণ করে আছে, সে আর কেউ নয়, এই বৃদ্ধেরই গুণধর পুত্র। লুসেনসিও যে পাদুয়ার ধনী ব্যক্তি ব্যাপটিস্টার ছোটো মেয়েকে বিয়ে করার সংকল্প করেছে সে কথা ইচ্ছে করেই আগে-ভাগে বৃদ্ধ ভিনসেনসিওকে জানিয়ে রাখল পেক্রসিও। এমনও ইঙ্গিত করতে ভুলল না যে ইতিমধ্যে হয়তো তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।

আগেই বলা হয়েছে যে লুসেনসিওর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁর ভৃত্য ত্ৰানিওই লুসেনসিও সেজেছে। ত্ৰানিও প্রেরিত নকল ভিনসেনসিও ইতিমধ্যেই ব্যাপটিস্টার সাথে দেখা করে তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে বিয়াংকার সাথে লুসেনসিওর বিয়ে দিতে রাজি হলে পত্রিপক্ষের পক্ষ থেকে প্রচুর যৌতুক দেওয়া হবে। লোভী ব্যাপটিস্টাও টাকার গন্ধ পেয়ে রাজি হয়ে গেছেন এই বিয়ে দিতে। পাছে ছেলে হাতছাড়া হয়ে যায়। এ জন্য তিনি বলেছেন যে লুসেনসিওর বাগদানের দলিলটা তিনি সে রাত্রেই লিখে ফেলতে চান পাদুয়ায় ভিনসেনসিওর আড়তে বসে। ব্যাপটিস্টা বলে দিয়েছেন যে একজন কাজের লোককে সাথে নিয়ে আগেই সেখানে পৌঁছে যাবে বিয়াংকা আর তিনি পরে যাবেন। এ প্রস্তাবে মুখে সায় দিলেও ত্ৰানিওর ধােন্দা অন্যরকম। সে মতলব করেছে বিয়াংকা সেখানে পৌঁছান মাত্র তার মনিব লুসেনসিও তাকে নিয়ে সোজা চলে যাবেন গির্জায়। সেখানে দুজনে বিয়েটা সেরে ফেলবে। কাজটা যাতে নির্বিঘ্নে হয়ে যায়, সেজন্য গির্জার পাদরি আর দলিল লেখকের সাথে আগে-ভাগেই চুক্তি করে রেখেছে ত্ৰানিও।

ভিনসেনসিওর আড়তে বসে যখন ব্যাপটিস্টা আর নকল ভিনসেনসিও বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা বলছেন, ঠিক সে সময় সেখানে এসে হাজির হলেন আসল ভিনসেনসিও। এবার বেজায় ঝগড়া আর কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল দু ভিনসেনসিওর মধ্যে। এ বলে আমি আসল, তুমি নকল, আর ও বলে তুমি নকল, আমি আসল। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে আসল ভিনসেনসিওরই জেলে যাবার জোগাড়। ঠিক সে সময় বিয়ের পোশাকে সেজেগুজে সেখানে এল লুসেনসিও আর বিয়াংকা। কিছুক্ষণ আগে তারা গির্জায় গিয়ে গোপনে বিয়ে করেছে। এতদিন পরে বাবাকে সামনে পেয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল লুসেনসিও, আশীৰ্বাদ চাইল। ধনী ব্যবসায়ীর সুন্দরী মেয়েকে তার ছেলে বিয়ে করেছে জেনে তাদের উভয়কেই আশীর্বাদ করল ভিনসেনসিও। নকল ভিনসেনসিও যখন দেখতে পেল যে সবাই আসলকেই পাত্তা দিচ্ছে, তখন ধরা পড়ার আগেই সেখান থেকে সরে পড়ল সে।

মনিব তার ছেলে-বাউকে আশীর্বাদ করছেন দেখে এবার এগিয়ে এল ত্ৰানিও। লুসেনসিওর সাথে বিয়ে দেবার জন্য সে যা যা করেছে সব খুলে বলে মনিবের কাছে মার্জনা চাইল সে। ত্ৰানিওর কাছ থেকে সব কথা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার জোগাড় ভিনসেনসিও আর ব্যাপটিস্টার। ব্যাপটিস্টা ভাবতে পারেনি তার দুই মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে এত কাণ্ড ঘটে গেছে। এবার দুই বেয়াই তাদের ছেলেমেয়ের বিয়ের উৎসব করতে সত্বর এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করলেন।

নিমন্ত্রিত হয়ে স্ত্রী ক্যাথারিনাকে সাথে নিয়ে সেই ভোজসভায় এসেছে পেত্রুসিও। বিয়াংকার আশা ছেড়ে দিয়ে অল্পদিন আগে হর্টেনসিও বিয়ে করেছে তার পরিচিত এক সুন্দরী বিধবা যুবতিকে। ভোজসভায় সেও এসেছে স্ত্রীকে নিয়ে! সবাই পেট পুরে ভোজ খাবার পর পরিবেশিত হল নানা সুস্বাদু পানীয়। সাধারণত মেয়েরা ওসব খায় না। তাই ক্যাথারিনা। আর বিয়াংকা অন্দরমহলে চলে গেল হর্টেনসিওর বউকে সাথে নিয়ে।

মদিরা পানের সাথে সাথে শুরু হল। ঠাট্টা-তামাশা। বিশেষ করে সবাই লেগেছে পেক্রসিওর পেছনে–ক্যাথারিনার মতো দজাল মেয়েকে বিয়ে করে সে নাকি পস্তাচ্ছে, ভবিষ্যতে এর জন্য তাকে নাকের জলে চোখের জলে এক হতে হবে–এমনই সভার মনোভাব। তিন বউয়ের মধ্যে ক্যাথারিনাই সবচেয়ে খারাপ হবে — হাসি-মশকরার মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাই একথা বোঝাতে চাইছে পেক্রসিওকে। কিন্তু এসব কথায় কান না দিয়ে এক মনে মন্দিরা পান করে চলেছে সে। শেষমেশ তার শ্বশুর ব্যাপটিস্টা যখন বললেন যে বউয়ের জন্যই সারা জীবন অশান্তি ভোগ করতে হবে, তখন সে আর প্রতিবাদ না করে পারল না। সবার সামনেই সে বলে বসল, লুসেনসিও আর হর্টেনসিওর বউ-এর চেয়ে আমার বউ ক্যাথরিন অনেক বেশি বাধ্য আর সুশীলা। সে বাইবেলের অনুশাসনের মতো মনে করে স্বামীর কথাকে। সে জানে স্বামীর আজ্ঞা পালন না করলে মহাপাতকী হতে হয়। পেক্রসিওর এ কথাকে রসিকতা বলে উড়িয়ে দিল সবাই।

তখন পেত্রুসিও বলল, আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস হচ্ছে না? আমার কথা সত্যি না। মিথ্যা তা যাচাই করতে চান আপনারা? বেশ তো, তাহলে বাজি ধরুন — পেত্রুসিওর স্বর আত্মবিশ্বাসে ভরা।

ক্যাথারিনার স্বভাবের সাথে ভালোভাবেই পরিচিত লুসেনসিও আর হর্টেনসিও তারা নিশ্চিত বাজি হেরে যাবে পেত্রুসিও। তাই উভয়ে একশো মোহর করে বাজি ধরল। সবাই জানে পুরুষদের মন্দিরা পানের আসরে মেয়েরা থাকে না–আগে ভাগেই চলে যায়। তারা স্থির করল এই প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে বাজি ধরবে। ঠিক হল পেক্রসিও, লুসেনসিও আর হর্টেনসিও — যে যার স্ত্রীকে টেবিলে আসার জন্য ডেকে পাঠাবে। যার স্ত্রী আসবে সেই বাজি জিতবে।

সর্বপ্রথম লুসেনসিও ডেকে পাঠাল তার বউ বিয়াংকাকে। কিন্তু সেনা এসে জানিয়ে দিল অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন সে আসতে পারবে না।

এবার হর্টেনসিও মিনতি জানিয়ে তার টেবিলে আসার জন্য অনুরোধ করল স্ত্রীকে। কিন্তু সে এল না। জানিয়ে দিল, পুরুষদের মদ্যপানের আসরে স্ত্রী লোকের যাবার নিয়ম নেই। তাই আমি যেতে পারব না।

সর্বশেষে এল পেক্রসিওর পালা। সে একজন ভৃত্যকে ডেকে বলল, যা, ভেতরে গিয়ে আমার স্ত্রীকে বল সে যেন সব কাজ ফেলে এখনই এখানে চলে আসে।

সবাই ধরে নিল বদমেজাজি ক্যাথারিনা তো আসবেই না, উলটো কড়া জবাব পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু সবার ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে ক্যাথারিনা চলে এল সেখানে। এসেই বলল, কী হয়েছে, আমায় ডাকছ কেন?

পেত্রুসিও বলল, লুসেনসিও ডেকেছিল তোমার বোন বিয়াংকাকে আর হর্টেনসিও ডেকেছিল তার স্ত্রীকে। কিন্তু তারা কেউ আসেনি। স্বামী ডাকলে যে সব কাজ ফেলে ছুটে আসতে হয়, সে বোধ তাদের নেই। আর সে শিক্ষাও কেউ তাদের দেয়নি। তুমি এসে প্রমাণ করেছ যে ওদের চেয়ে তুমি অনেক সুশীলা। তোমার স্থান ওদের অনেক উপরে। যাও, এবার ভেতরে গিয়ে ওদের দুজনকে ডেকে নিয়ে এস। ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণ বাদে হর্টেনসিওর বউ আর ছোটোবোন বিয়াংকাকে সাথে করে নিয়ে এল ক্যাথারিনা।

সত্যিই বাজিমাত করে দিল পেত্রুসিও। তার শ্বশুর ব্যাপটিস্টাও খুশি হলেন এই দেখে যে তার বদমেজাজি মেয়ে কেমন শান্ত-শিষ্ট হয়ে গেছে পেত্রুসিওর মতো স্বামীর হাতে পড়ে। সবার সামনে তিনি জানিয়ে দিলেন মোটা পুরস্কার দেবেন বড়ো জামাইকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *