কমেডি
ট্রাজেডি
সনেট

মার্চেন্ট অব ভেনিস

মার্চেন্ট অব ভেনিস

আসলে ইতালি দেশটা একটা উপদ্বীপ। উত্তর ছাড়া অন্য তিন দিক দিয়েই একে বেষ্টন করে। আছে ভূমধ্যসাগরের জলরাশি। আদ্রিয়াতিক উপসাগর হিসেবেই পরিচিত সমুদ্রের পূর্ব অংশটি। ভূগোলের ছাত্ররা সবাই এটা জানে। তারা এও জানে এরই উপর অবস্থিত মধ্যযুগীয় ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য নগর ভেনিস।

শুধু উপরে নয়, আদ্রিয়াতিক সাগরের ভেতরে অবস্থিত ভেনিস নগরী। এভাবেই কথাটা ঘুরিয়ে বলা চলে আদ্রিয়াতিক শুধু যে ভেনিসের নাড়িতে আর রন্ধেরন্ধে প্রবেশ করেছে তাই নয়, সমুদ্র আর নগর যেন একাকার হয়ে মিশে গেছে। এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে সুন্দর একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেবার প্রথা প্রচলিত ছিল ভেনিস নগরে। প্রতি বছর একটা বিশেষ দিনে বিবাহ বন্ধনের প্রতীক হিসেবে একটা মহামূল্য রত্নাঙ্গুরীয় জলে নিক্ষেপ করতেন ভেনিসের শাসনকর্তা ডোগবা ডিউক।

ভেনিস শহরের বৈশিষ্ট্য এই যে এখানে কোনও রাজপথ ছিল না। ছোটো, বড়ো অসংখ্য খাল ব্যবহৃত হত লোক চলাচলের জন্য। সমুদ্রের জল সেই সব খাল দিয়ে অবাধে প্রবেশ করত গৃহস্থের অন্দরে। দু-বার জোয়ারের সময় দোকানের সিঁড়িগুলি পর্যন্ত দৈনিক ধুয়ে দিত সমুদ্রের জল। অন্যান্য শহরের রাস্তায় যেমন অগুনতি গাড়ি-ঘোড়া চলে, ভেনিসের জলপথে তেমনি দেখা যেত অসংখ্য গণ্ডোলা নৌকা। সেগুলির কোনটা থাকত যাত্রী-বোঝাই আবার কোনওটা মালে ভর্তি।

ভেনিসের এই বৈশিষ্ট্য এখনও বর্তমান। যদিও কাল ধর্মের প্রভাবে সে বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি আজ প্রায় অবলুপ্ত বললেই চলে। মধ্যযুগে ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির কোনও সীমারেখা ছিল না। বণিকেরা সবাই ছিলেন ধনকুবের। তাদের জাহাজ পৃথিবীর সবদেশে যাতায়াত করত। ব্যাসানিও ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের মানুষ। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্মৃর্তি করা। ঘুমের সময়টুকু বাদ দিয়ে নাচ-গান, শিকার, জুয়ো খেলা –এরূপ একটা না একটা আনন্দে মেতে থাকতেন তিনি। পূর্বপুরুষের কষ্টার্জিত অৰ্থ এভাবেই বন্ধু-বান্ধবদের সাথে উড়িয়ে দিতেন তিনি। আন্তনিওর পক্ষে সম্ভব হত না। এ সব উৎসবে যোগ দেবার। কারণ বিলাসী হলেও তিনি ছিলেন কাজের লোক। কাজ-কর্ম নষ্ট করে এ সব উৎসবে যোগ দেবার কোনও সার্থকতা খুঁজে পেতেন না তিনি।

আয় থেকে অনেক বেশি ছিল ব্যাসানিওর ব্যয়। কাজেই তার ধনভাণ্ডার যে একদিন শেষ হবে সে তো জানা কথা। দেখতে দেখতে একদিন খালি হয়ে গেল তার ধনভাণ্ডার। কিন্তু তাতেও তার চৈতন্য হল না। ধার করেও নিজের ঠাট বজায় রাখতে লাগলেন ব্যাসিনিও।

একে একে সবই বিক্রির পর্যয়ে চলে এল —মফস্‌সলের জমিদারি, শহরের অতিরিক্ত ঘরবাড়ি, অপ্রয়োজনীয় জাহাজ, ব্যবহৃত আসবাবপত্র, সবই মহাজনের কাছে ধার নিতে হল তাকে আর সবশেষে আন্তনিওর কাছে ধার।

ধার করে এই রাজসিক ব্যয়ভার বেশিদিন টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই মাঝে মাঝে অর্থকষ্ট দেখা দিতে লাগল ব্যাসানিওর। এর একটা উপায় খুঁজে বের করতেই হবে তাকে। হয় তাকে অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে বাবুগিরি ত্যাগ করতে হবে। খুবই সঙ্কটের মাঝে পড়ে গেল ব্যাসানিও। আর কতই বা ধার নেওয়া যায় আন্তনিওর কাছ থেকে! বন্ধুর কাছে হাত পাততে খুবই লজ্জা হয় ব্যাসানিওর।

কী করে নিজের ভাগ্য ফেরানো যায় সে কথাই সব সময় চিন্তা করেন ব্যাসানিও। বন্ধুরা তো সবাই সুখের পায়রা। তাদের কাছে সাহায্য চেয়ে কোনও লাভ নেই। প্রকৃত হিতৈষী বলে যদি কেউ থাকে তবে তা আন্তনিও। তিনি সর্বদাই বলেন, তুমি এর একটা উপায় বের কর বন্ধু। আর সে কাজে সাফল্য অর্জন করতে গেলে যা যা সাহায্য, সহযোগিতার দরকার আমার কাছ থেকে তুমি তা পাবে। কিন্তু বেচারা ব্যাসানিওর মাথায় কোনও মতলবই আসছে না।

শেষে একদিন ভগবান মুখ তুলে চাইলেন তার দিকে। বেলমন্ট গ্রামে মারা গেলেন এক ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন সে গ্রামের জমিদার, সেই সাথে কোটিপতি। এই ভদ্রলোকটির বাড়িতে একসময় দু-চার দিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন ব্যাসানিও।

এই মৃত জমিদারের আপনজন বলতে ছিলেন তার একমাত্র মেয়ে পোর্সিয়া। পিতার অগাধ সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী ছিলেন তিনি। তখনও পর্যন্ত বিয়ে হয়নি তার। যার গলায় তিনি বরমাল্য দেবেন। সে হবে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী। শুধু ধন-সম্পদে নয়, রূপ-গুণেও তিনি ছিলেন সেরা। প্ৰভাতের মতো নির্মল আর পবিত্র ছিল তার সৌন্দর্য। মন থেকে তাকে এখনও পর্যন্ত মুছে ফেলতে পারেননি ব্যাসানিও। তার মনে হয় সে সময় পোর্সিয়ার সামান্য কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল তার উপর।

সম্প্রতি পিতৃবিয়োগ হয়েছে পোর্সিয়ার। পিতার অগাধ সম্পত্তির একমাত্র অধিকারিণী তিনি। আর ব্যাসানিওকে আজ কপর্দকশূন্য বললেও কম বলা হয়। দেনার দায়ে মাথার চুল বিকিয়ে গেছে তার। খুব শীঘ্র প্রচুর টাকার ব্যবস্থা না হলে পাওনাদারদের হাতে লাঞ্ছনার সীমা থাকবে না তার। কারাবাস তো স্বাভাবিক ব্যাপার, আর তা হলে অভিজাত বংশের সন্তান ব্যাসানিওর পক্ষে আত্মহত্যা ছাড়া গতি নেই।

এই সংকট থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় পোর্সিয়াকে বিয়ে করা। তাহলে শুধু সংকটমোচন নয়, জীবনে আর অর্থকষ্টের সম্মুখীন হতে হবে না। তাকে। বিলাস-ব্যসনে অপার আনন্দে কেটে যাবে তার জীবনের দিনগুলি।

এ কি নিছক দুরাশা? এক সময় পোর্সিয়া তাকে অনুগ্রহ করতেন বলে মনে পরে ব্যাসানিওর। কিন্তু সময় বদলে গেছে। তখন পোর্সিয়া নিজে ধনী হয়ে ওঠেনি। ব্যাসানিও তখন ছিলেন বিত্তশালী, স্মৃর্তিবাদ। আজ অভাবে তিনি ক্লান্ত। চেহারা, মেজাজ রুক্ষ। পোর্সিয়াকে আকর্ষণ করার শক্তি অপহৃত। তবু ভরসা পোর্সিয়া হালকা মানসিকতার মেয়ে নয়। সে একবার মন দিয়েছিল কাকে তাকে নিশ্চয়ই এত তাড়াতাড়ি ভুলে যায় নি। সুতরাং ভাগ্য নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া যেতে পারে।

এই ভেনিসীয় বণিকদের মধ্যে সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন আন্তনিও। একদিকে তিনি ছিলেন প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী, অন্যদিকে সেই ঐশ্বর্যের সদ্ব্যবহারে মুক্তহস্ত ছিলেন তিনি। তার দরজা থেকে কখনও বিমূখ হয়ে কেউ ফেরেনি। আর্তের সেবায় এগিয়ে যাওয়াটাকেই তিনি নিজের পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করতেন।

অভিজাত বংশের সন্তান আন্তনিওর পক্ষে বিলাস-ব্যসনে থাকাটাই স্বাভাবিক। অনেক সময় তার ইচ্ছে না থাকলেও বন্ধু-বান্ধবের চিত্ত বিনোদনের জন্য বড়ো বড়ো ভোজের আয়োজন করতে হত। দেহ-সৌষ্ঠব বজায় রাখার জন্য মহার্ঘ্য বেশভূষায় সজ্জিত হতেন তিনি। অভাবগ্ৰস্ত অভিজাত যুবকদের সাহায্য করতে তিনি সব সময় প্রস্তুত থাকতেন। অনেকেই তার কাছ থেকে ধার নিয়ে আর পরিশোধ করত না। কেউ ঋণ পরিশোধ করতে এলেও তার কাছ থেকে কোনও সুদ নিতেন না তিনি।

আন্তনিওকে সর্বদাইঘিরে থাকতেন স্যালারিও, ব্যাসানিও, গ্রাসিয়ানো, লোরেঞ্জ প্রভৃতি অভিজাত বংশীয় যুবকেরা! আন্তনিওর মন ছিল যেমনি উদার তেমনি ছিল তার প্রচুর অর্থ–এই দুকারণে সবাই ইচ্ছে করত তাকে বন্ধুভাবে পেতে। সবার সাথে সুমধুর ব্যবহার করতেন স্নেহশীল আন্তনিও, যদিও তার কিছুটা পক্ষপাতিত্ব ছিল বন্ধু ব্যাসানিওর উপর।

ব্যাসানিও ছিলেন আন্তনিওর মতো এক অভিজাত বংশের সন্তান। ধন-সম্পদ তারও কিছু কম ছিল না। কিন্তু একটা বিষয়ে তার সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল আন্তনিওর সাথে। টাকা-পয়সা যতই ব্যয় করুন না কেন, ব্যবসাকে কখনও অবহেলার চোখে দেখতেন না আন্তনিও। সর্বদা সাত-সমুদ্র আলোড়িত করে ফিরত তাঁর বাণিজ্য তরী। ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতেন তিনি।

কিন্তু ভাগ্য পরীক্ষা কি করে? কোটিপতি পোসিয়ার পাণি-প্রার্থনা করতে গেলে কমসে কম লাখাপতির মতো জাকজমকের প্রয়োজন। একটা প্ৰবাদ আছে যে রাজা কোয়ান্টুরা এক ভিখারিণী মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস, শাস্ত্র বা রূপকথায় এমন কোনও উদাহরণ নেই যে একজন রানি সিংহাসন থেকে নেমে এসে একজন ভিক্ষুকের পায়ে আত্মসমর্পণ করেছেন।

মনে মনে একটা হিসাব করতে বসলেন ব্যাসানিও। পোসিয়ার পাণিপ্রার্থী হয়ে বেলমেন্টে যেতে হলে দামি সাজ-পোশাকের প্রয়োজন। সেই সাথে দশ-বারো জন জমকালো পোশাক পরা ভৃত্য, কিছু যানবাহন এবং প্রয়োজনীয় অর্থ থাকা চাই যা দিয়ে পাথেয় ও পারিতোষিক দেওয়া সম্ভব হবে। সুষ্ঠুভাবে এসব করতে গেলে অন্ততপক্ষে তিন হাজার ডুকাট স্বর্ণমুদ্রার প্রয়োজন।

হিসাব কষার পর কয়েকদিন বিষন্ন মনে চুপচাপ রইলেন ব্যাসানিও। ভাবতে লাগলেন কোথায় পাওয়া যাবে এই তিন হাজার ডুকাট স্বর্ণমুদ্রা? এক পয়সা যার সম্বল নেই সে এত টাকার অলীক স্বপ্ন দেখে কী করে?

তা ছাড়া কেইবা তাকে ধার দেবে এত টাকা? কিন্তু আশা মোহিনী। সে বারবার ব্যাসানিওর মনকে উত্তেজিত করে বলতে থাকে–একবার দেখিনা আন্তনিওর কাছে এ প্রস্তাবটা রেখে। সে ভালো লোক, তোমায় সত্যিই ভালোবাসে। আন্তনিওর কাছ থেকে তুমি টাকাটা হয়তো পেলেও পেতে পোর। তাছাড়া তুমি তো আর সে টাকাটা মেরে দিচ্ছ না। পোর্সিয়ার সাথে বিয়ে হলেই তুমি আন্তনিওর ধারা আর সেই সাথে আগের সমস্ত ধার শোধ করে দিতে পারবে। শেষমেশ বন্ধ আন্তনিওর কাছে যেতে বাধ্য হলেন ব্যাসানিও।

তিনি আন্তনিওকে বললেন, বন্ধু, তোমার কাছে ঋণের শেষ নেই আমার। অর্থ আর কৃতজ্ঞতার ঋণ উভয়ই সমান। কোনওদিন যে এসব শোধ করতে পারব সে আশা আমার নেই। এদিকে আমার যে কত শোচনীয় অবস্থা সে খবর জানা নেই তোমার। অবিলম্বে আমি যদি প্রচুর অর্থ জোগাড় করতে না পারি, তাহলে সবার সামনে অপমানিত হতে হবে আমাকে। এমন কি পাওনাদারদের নালিশের ফলে আমার কারারুদ্ধ হওয়াও আশ্চর্য নয়। এখনই এর একটা বিহিত না করলে নয়। আর তুমি ছাড়া আর কারও পক্ষে এ ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।

বন্ধুর এই করুণ অবস্থা দেখে খুবই কাতর হয়ে পড়লেন আন্তনিও। ভাবলেন, কীভাবে এ বিপদের নিরসন হতে পারে? ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলেন ব্যাসানিওর মাথায় কোনও উপায় এসেছে কিনা। পোর্সিয়া ঘটিত ব্যাপারটা তখন আন্তনিওকে খুলে বললেন ব্যাসানিও। পোর্সিয়া যে এক সময় ব্যাসানিওর প্রতি অনুরক্তির আভাস দিয়েছিলেন সে কথাও বন্ধুকে জানাতে ভুললেন না ব্যাসানিও। তিনি হিসাব কষে বন্ধুকে দেখিয়ে দিলেন যে পোর্সিয়ার পাণিপ্রার্থী হতে গেলে সবার আগে দরকার তিন হাজার ডুকাটি স্বর্ণমুদ্রা। পোর্সিয়ার সাথে বিয়ে হলেই তিনি যে বন্ধুর প্রাপ্য সব টাকা শোধ দিয়ে দেবেন। সে কথাও বন্ধুকে জানাতে ভুললেন না ব্যাসানিও।

ধৈর্য ধরে ব্যাসানিওর সব কথা শুনলেন আন্তনিও। তারপর অসহিষ্ণুভাবে বললেন তাকে, তুমি কি আমায় চেন না যে আজ এভাবে দুঃখের কঁদুনি গাইছ? জেনে রাখ, আমার হাতে এক পয়সা থাকলে তার আধিপয়সা থাকবে তোমার প্রয়োজনের জন্য। আমি ধার হিসেবে টাকাটা তোমায় দেইনি। আর তুমি তা ফেরত দেবে সে আশাও আমি মনে স্থান দেইনি। টাকাটা ফেরত দিতে এলেও আমি তা নেব না। যদি না সে সময় প্রচণ্ড অর্থকষ্টে পড়ি।

তবে এখন এসব আলোচনা না করাই ভালো। তোমার মাথায় যে মতলবটা এসেছে তা নেহাত খারাপ নয়। অনেক দুঃস্থ যুবক মুক্তি পেয়েছে প্রেমের দেবতার কৃপায়। পাত্র হিসেবে তুমি যে অনুপযুক্ত সে কথা বলার সাহস কারও নেই। তুমি বিলাসী হলেও দুশ্চরিত্র নও। লেখাপড়া না জানলেও তুমি যে ভেনিসের প্রথম সারির অভিজাতদের একজন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া তুমি বলছি যে বেলমন্টে থাকাকালীন পোর্সিয়া তোমার উপর কৃপাদৃষ্টি দেখিয়েছে, সে কথা সত্যি হলে তো সোনায় সোহাগা। আর তা সত্যিই না হলেও হতাশ হবার কিছু নেই। কারণ তোমাকে অগ্রাহ্য করা কোনও মেয়ের পক্ষে সম্ভবপর নয়। অনেক সময় জুয়া খেলে লাখ লাখ টাকা তুমি নষ্ট করেছ। আর এখন তিন হাজার ডুকাট টাকাও লোকসান হয়, সেটা এমন কিছু বেশি। নয়। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কী জান অত টাকা তোমার নেই, আর আমারও নেই।

আন্তনিওর কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন ব্যাসানিও। তিনি বললেন, কী বলছি হে? তিন হাজার ডুকাট টাকা তোমার কাছে নেই? এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? অন্য কেউ হলে না হয় ভাবতাম আমায় সাহায্য করবে না বলে অর্থাভাবের অজুহাত দিচ্ছে। কিন্তু তোমার সম্বন্ধে সে কথা মনে আনাও পাপ। তোমাকে আমি বহুদিন ধরে চিনি। তোমার সম্বন্ধে আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?

আন্তনিও বললেন, তুমি যদি আমায় চেন, তাহলে বিশ্বাস কর আমার কথা। এই মুহূর্তে তিন হাজার ডুকাটি আমার হাতে নেই। তা বলে কি নিঃস্ব, মোটেই নয়। আমার সম্পত্তি আছে বইকি। গুদামভরা পণ্য রয়েছে, সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে আমার বিশাল বিশাল জাহাজ। নিঃস্ব না হলেও এখন আমার হাতে নগদটাকা নেই। তিন হাজার ডুকাট কেন, দু-মাস বাদে এলে আমি ত্ৰিশ হাজার ডুকাটিও অক্লেশে তুলে দিতে পারব তোমার হাতে। কিন্তু এই মুহূর্তে তিন হাজার কেন, তিনশো। দিতেও আমি অপারগ। আন্তনিওর কথা শুনে নিরাশ হয়ে বলল ব্যাসানিও, দুমাস বাদে পোর্সিয়া কি আর আমায় বিয়ে করতে রাজি হবে? তুমি তো জান না পৃথিবীর নানা দেশ থেকে পাণিপ্ৰথীরা এসে হাজির হয়েছে। বেলমন্টের প্রাসাদে। তাদের অনেকেই নানা গুণ–সম্পন্ন, নেপলসের রাজাও রয়েছেন তাদের মাঝে। তাছাড়া রয়েছেন জার্মানির কাউন্ট প্যালাটাইন, ফরাসিদের একজন, ব্রিটেনের একজন এবং স্কটল্যান্ডের একজন জমিদার, এমনকি মিশরের একজন প্রতিনিধিও এসেছেন। খানকতক মমি উপহার নিয়ে। এতসব প্রার্থীকে বাতিল করে পোর্সিয়া দুমাস অবিবাহিতা থাকবেন। এ আশা আমি করি না।

এতসব নামি প্রার্থীর কথা শুনে সত্যিই ভয় পেয়ে গেল আন্তনিও। সত্যিই তো, যে কোনও সময় ঠিক হয়ে যেতে পারে পোর্সিয়ার বিয়ে। তাহলে তো ছাই পড়বে ব্যাসানিওর সব আশায়।

শেষমেশ তাকে বলতেই হয়, বন্ধু, তাহলে তুমি এক কাজ কর। খোজ নিয়ে দেখ কোথায় ধার পাওয়া যায় তিন হাজার ডুকাট। অবশ্য শুধু হাতে কেউ তোমায় এত টাকা ধার দেবে না। তুমি সবাইকে বলবে এই ধারের জন্য জামিন থাকবেন আন্তনিও। আশা করি তা হলে ধার পেতে অসুবিধে হবে না তোমার। দুমাসের মধ্যে আমার জাহাজগুলি ফিরে আসবে সে আশা আমি রাখি। তাহলেই সে ধার শোধ করে দেব। আমার পক্ষে কষ্টকর হবে না।

ব্যাসানিও বললেন, আর এর মধ্যে যদি পোর্সিয়ার কৃপা পেয়ে যাই তাহলে জাহাজ আসা পর্যন্ত তোমায় অপেক্ষা করতে হবে না!

আন্তনিও হা হা করে হেসে উঠে বললেন, সে তো বটেই। আশা করি জাহাজ ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়। কিন্তু খারাপ দিকটাও ভাবা দরকার। ধর, যদি পোর্সিয়া তোমায় অপছন্দ করে তাহলেও নিরাশ হবার কিছু নেই। তুমি মহাজনের কাছে তিন মাসের সময় চাইবে। তাহলেই যথেষ্ট। আর দুমাসের মধ্যে আমার জাহাজগুলি তো এসেই যাবে। তখন এই ধার শোধ দেওয়া আমার পক্ষে মোটেই কষ্টকর হবে না।

তোমার নাম করলে আর কেউ সুদ চাইবে না, কারণ তুমি তো ধার দিয়ে সুদ নেও না, বললেন ব্যাসানিও।

আন্তনিও বললেন, আমি জানি খ্রিস্টান মহাজনেরা সুন্দ নেবে না, কারণ টাকা ধার দিয়ে সুদ নেওয়া বাইবেলে নিষিদ্ধ। তাছাড়া ভেনিসের জন সাধারণের কাছে আমার একটা ব্যক্তিগত খাতির আছে। তুমি খোজ নিয়ে দেখা খ্রিস্টান মহাজনের কাছে ধারা পাওয়া যায় কিনা। না পেলেও তাতে ভয় পাবার কিছু নেই। কোনও ইহুদি যদি ধার দিতে চায় তাহলে আমরা সেটা নেব। আমরা যে কোনও সুন্দ দিতে রাজি। কারণ আমাদের প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।

আন্তনিওর মহত্ত্বে নূতন করে মুগ্ধ হয়ে আবার ধারের চেষ্টায় বেরিয়ে পড়লেন ব্যাসানিও। আগে যারা ব্যাসানিওকে দেখলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত, এবার তারাই আন্তনিওর নাম শুনে খাতির করে তাকে বসিয়ে ধারের প্রস্তাবনা ভালোভাবে জেনে নিত। কিন্তু দুৰ্ভাগ্য ব্যাসানিওর, সে সময় কোনও খ্রিস্টান বণিকের হাতেই টাকা ছিল না। তাদের সবার জাহাজও সে সময় আন্তনিওর মতো সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করত। দু-মাসের মধ্যেই সব জাহাজ বন্দরে ভিড়বে। তখন আন্তনিওর নাম করে যােত ইচ্ছে ধার নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু জাহাজ না ফেরা পর্যন্ত আন্তনিওর মতো সবাই সাময়িকভাবে নিঃস্ব। কাজেই তিন হাজার ডুকাট বের করা এখন কারও পক্ষে সম্ভবপর নয়।

হতাশ হয়ে পড়লেন ব্যাসানিও। পোর্সিয়াকে বিয়ে করা আর বোধ হয় তার ভাগ্যে নেই। এই ভেনিস শহরে দুমাসের আগে টাকা পাবার কোনও আশা নেই। আর এই দুমাসের মধ্যে পোর্সিয়ার পাণিপ্রার্থীরা কেউ সফল হবে না, এ আশা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়।

বণিকদের দ্বারে দ্বারে ধার চেয়ে বিফল হয়ে একদিন অপরাস্তুে যখন বাড়ি ফিরে আসছেন। ব্যাসানিও, এমন সময় খাল ধার থেকে কে যেন ডেকে উঠল তাকে। সাথে সাথে ফিরে দাড়ালেন তিনি। দেখলেন এক লম্বা দাড়িওয়ালা নুঢুক্ত দেহ তির্যকদূষ্টির বৃদ্ধ ডাকছে তাকে। তিনি চিনতে পারলেন লোকটিকে —ও আর কেউ নয় ইহুদি শাইলক। প্যালেস্টাইনের অধিবাসীদের বলা হয়। ইহুদি। প্ৰভু যিশুর আবির্ভাব ও ধর্মপ্রচারের আগে ইহুদি ধর্ম প্রচলিত ছিল প্যালেস্টাইনে। এই ইহুদি পুরোহিতদের প্ররোচনায় যিশুখ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল রোমের শাসকেরা।

টাকা-পয়সার লেনদেনই ছিল ইহুদিদের প্রধান উপজীবিকা। ইউরোপের সমস্ত দেশেই ছড়িয়ে ছিল তারা। সমাজ ও রাষ্ট্রে আর্থিক ব্যবস্থাপনার উপর প্রচুর প্রভাব ছিল তাদের। ব্যবসা-বাণিজ্যের বড়ো একটা ধার ধারত না তারা। দুর্দশাগ্ৰস্ত লোককে টাকা ধার দিয়ে চড়া হারে সূদ নিত তারা। এই ভেনিস শহরে শাইলকের মতো নির্মম সুদখোর আর কেউ ছিল না। এমনকি অন্যান্য ইহুদিরাও তার এই অস্বাভাবিক অর্থ-লালসার জন্য ঘৃণা করত শাইলককে।

হঠাৎ ব্যাসানিওকে ডাকলেন কেন শাইলক?

নিশ্চয়ই এর কারণ আছে।

ভেনিসীয় বণিকদের টাকা-পয়সা লেন-দেনের জায়গািটার নাম রিয়ালতো। একটা বড়ো খালের উপরিস্থিত সুপ্ৰশস্ত পুল হল এটা। এই পুলের উপর জড়ো হয়ে আর্থিক বিষয়ে আলোচনা করতেন বণিকেরা। শাইলকের প্রতি বণিকদের যতই বিতৃষ্ণা থাক না কেন, এখানে আসতে তার কোনও বাধা ছিল না। কারণ তাকে বাধা দেবার অধিকার কারও নেই। এখানকার আলোচনা থেকেই শাইলক জানতে পেরেছেন তিনহাজার ডুকাটি ধারের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ব্যাসানিও। আর লোকের মুখে মুখে একথাও ছড়িয়ে পড়েছে যে এই ধারের জন্য জামিন হতে রাজি আছেন। মাননীয় আন্তনিও।

ব্যাসানিওকে ডেকে জানতে চাইলেন শাইলক, কেমন আছেন ব্যাসানিও?

শাইলকের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল ব্যাসানিওর এবং তাকে তিরস্কার করতেও ছাড়তেন না। কিন্তু এ সময় শাইলেককে এখানে দেখে ক্ষীণ আশার আলো দেখা দিল তার অস্তরে। হোক না ইহুদি, শাইলকও তো টাকা ধার দিয়ে থাকে। আর আন্তনিও তো বলেই দিয়েছেন। খ্রিস্টানদের কাছে না পেলে ইহুদিদের কাছে টাকা ধার করলেও তার কোন আপত্তি নেই। শাইলক যখন এখানে উপস্থিত আছে তখন তার কাছে প্রস্তাবটা করে দেখতে ক্ষতি কী।

সরলহাদয় ব্যাসানিও কিন্তু জানতেন না তার প্রয়োজনের কথা আগে থেকেই জেনে গেছেন শাইলক। শুধু তাই নয়, আন্তনিও যে এর মধ্যে জড়িয়ে আছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই ধূর্ত শাইলাক আজ এসেছে এখানে।

যদিও ব্যাসানিওকে ডেকে থামিয়েছে শাইলক, কিন্তু সে প্রকাশ করেনি কেন ডেকেছে তাকে। শাইলক চায় যার প্রয়োজন প্রস্তাবটা তার মুখ থেকেই আগে আসা উচিত।

ব্যাসানিও কিন্তু এত সব বুঝলেন না। তিনি আগ বাড়িয়ে পা দিয়ে বসলেন শাইলকের ফাদে। তিনি হাসিমুখে শাইলককে বললেন, এই যে শাইলাক! খুবই ভালো হল তোমার সাথে দেখা হয়ে। তুমি তো শহরের শ্রেষ্ঠ মহাজনদের একজন। তা তুমি কি আমায় তিনহাজার ডুকাটি ধার দিতে পার? খুব বেশিদিনের জন্য নয়, মাত্র তিনমাসের জন্য টাকাটা ধার চাইছি আমি। আন্তনিও জামিন হবেন। এর জন্য তুমি যা সুদ চাইবে তিনি তাই দেবেন।

ব্যাসানিওর কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন শাইলক, বললেন, টাকা? আন্তনিও? তার আবার টাকার অভাব! জামিন না হয়ে তিনি নিজেই তো টাকাটা দিতে পারেন। ইচ্ছে করলে তিনি আমার মতো দু-পাঁচটা সুদখোর ইহুদিকে অনায়াসেই কিনে নিতে পারেন।

ব্যাসানিও উত্তর দিলেন, তা অবশ্যই তিনি পারেন। তবে বর্তমানে তিনি কিছু অসুবিধার মধ্যে রয়েছেন। জাহাজগুলি ফিরে না। আসা পর্যন্ত নগদটাকার আমদানি নেই। অথচ আমার এখনই প্রয়োজন তিন হাজার ডুকাট। আমি বলি কি তুমি তো অনায়াসেই এ টাকাটা আমায় ধার দিতে পার।

এ কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন শাইলক। কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না মাত্র তিনমাসের জন্য কেন, তায় আবার জামিন আন্তনিও। সুদও যা খুশি। একটু ভেবে বললেন, কত টাকার প্রয়োজন আপনার, তিন হাজার ডুকাট? সে যে অনেক টাকা। কিন্তু…।

বিরক্ত হয়ে বললেন ব্যাসানিও, ও নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন? আন্তনিওই তো জামিন রয়েছেন।

বাধা দিলে বললেন শাইলক, ঠিকই বলেছেন। আপনি। লোক হিসেবে আন্তনিও মোটেই খারাপ নন।

ব্যাসানিও খুব রেগে গেলেন শাইলকের কথা বলার ধরনে। শাইলক তাকে টাকা ধার দিক বা নাদিক, ওর মতো ঘূণ্য লোকের কাছ থেকে আন্তনিও সম্পর্কে বিদ্রুপ বা সমালোচনা, কোনওটাই শুনতে রাজি নন তিনি। তাই তিনি বলে উঠলেন, আন্তনিও যে ভালো লোক সে কথা কি ভেনিসের মানুষ জানে না? এতে কি আপনার কোনও সন্দেহ আছে?

সাথে সাথেই জিভ কেটে বললেন শাইলক, আরে নামশাই, আন্তনিও সম্পর্কে আমার কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু উনি ভালো লোক এ কথার অর্থটা আপনার ঠিক বোধগম্য হয়নি। ভালো লোক আমরা তাকেই বলি যার আর্থিক অবস্থা ভালো। আর যতদূর জানি আন্তনিওর আর্থিক অবস্থা এমন কিছু খারাপ নয় যাতে তাকে তিনহাজার ডুকাট ধার দেওয়া চলে না।

শাইলকের কথা শুনে বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন ব্যাসানিও, মাত্র তিন হাজার ডুকাটি? আপনি কি জানেন তার এক একখানা জাহাজে মাল থাকে ত্ৰিশ হাজার ডুকাটের?

ব্যাসানিওর কথা শুনে গম্ভীর হয়ে বলল শাইলক, তা হতে পারে। তবে জাহাজ তো কাঠ ছাড়া আর কিছু দিয়ে তৈরি হয় না। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন কাঠের জাহাজ মাঝে মাঝে সমুদ্রে ডুবে যায়। তাছাড়া চড়ায় বেঁধে জাহাজ অচল হয়ে যেতে পারে, চোরা পাহাড়ে ধাক্কা লেগে তলা ফেসে যেতে পারে, জলে ডুবে যেতে পারে, আগুনে পুড়ে যেতে পারে–এরূপ যে কোনও ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তার উপর আবার রয়েছে বোম্বোটেদের উৎপাত। না বাবা, আর যার সাহস থাক শাইলক রাজি নয় নগদটাকায় মাল কিনে জাহাজে পাঠাতে। হাঁ, কী যেন বলছিলেন আপনি? এক হাজার ডুকাট ধার চান?

ব্যস্ত হয়ে বললেন ব্যাসানিও, এক হাজার নয়, তিনহাজার। আর তাও মাত্র তিনমাসের জন্য।

শাইলক বলনেল, মাত্র তিনমাস? আমি তো ভেবেছিলাম এক বছরের জন্য কারণ সেটাই আমাদের রীতি কিনা। যা হোক, আমি না হয় তিনমাসের কথাই মেনে নেব। যদিও আন্তনিওর জাহাজগুলি সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা সত্তেও আন্তনিওর জমিনে টাকা ধার দেব আমি। তবে কি জানেন, আমি একবার দেখা করতে চাই আন্তনিওর সাথে। সে ব্যবস্থা করা সম্ভব কি?

এ যেন মেঘনা চাইতেই জল। এ সময় অদূরে খালের ধারে দেখা গেল আন্তনিওকে। এ সময় তাকে এখানে দেখতে পেয়ে সেটাকে দৈব যোগাযোগ বলে মেনে নিলেন ব্যাসানিও। তিনি আশায় রইলেন এই ভেবে যে এবার তার কার্যোদ্ধার হবে। কিন্তু আন্তনিওকে দেখেও না দেখার ভান করল শাইলক। সে এমন ভাব দেখাতে লাগল যেন ধারের ব্যাপারটা নিয়ে সে চিন্তামগ্ন।

কাছে এসে আন্তনিও ব্যাসানিওর কাছে জানতে চাইলেন সে কোনও আশার আলো দেখতে পেয়েছে কিনা। ব্যাসিনিও জনাস্তিকে তার বন্ধুকে জানাল এই মাত্র শাইলকের সাথে কথা হয়েছে এবং মনে হয় সে রাজি আছে। তখন শাইলককে উদ্দেশ করে বললেন আন্তনিও, ওহে শাইলাক! তুমি আমাদের এই উপকারটা করবে কি?

সুপ্তোত্থিতের মতো আন্তনিওর দিকে তাকিয়ে বলল শাইলক, এক বছরের জন্য এক হাজার ডুকট, তাই না? বাধা দিয়ে বললেন ব্যাসানিও, না হে, তিন মাসের জন্য তিন হাজার ডুকাট। আর তার জন্য জামিন হবেন আন্তনিও — এ কথা তো বারবার বলেছি তোমায়! একটু আগেই তো তুমি বলেছিলে আন্তনিওর সাথে দেখা হলে ভালো হয়। এই তো তিনি এসে গেছেন। এবার তোমার যা জিজ্ঞেস করার তা করে নাও।

ব্যাসানিওর কথা যেন শুনতেই পেল না। শাইলক। সে আপন মনে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। ব্যাসানিও স্পষ্ট শুনতে পেলেন শাইলকের কথা। সে বলছিল, আমি কুত্তা? কুত্তার কি টাকা থাকে? সে কি কাউকে তিন হাজার ডুকাট ধার দিতে পারে? তিন মাস কেন, এক মাসের জন্যও সে তা পারে না। অথচ এই কুত্তার কাছেই এসেছেন অভিজাত বংশীয় মাননীয় খ্রিস্টান ভদ্রলোকেরা….।

ব্যাসানিও রেগে গিয়ে বললেন, কী বলছি তুমি?

শাইলক উত্তর দিলেন, বলছি আমি তো একটা কুত্তা। মহামান্য আন্তনিও হাজার বার আমায় কুত্তা বলে গালাগাল দিয়েছেন। প্রকাশ্যে হাজার লোকের সামনে তিনি একাজ করেছেন। অথচ আমার কী অপরাধ তা আমি জানি না। তিনি বলেছেন টাকা ধার দিয়ে সুদ নেওয়া কুত্তার কাজ। আমার অভিমত অকারণে আমি কেন টাকা ধার দেব। লোকের উপকারের জন্য? বেশ তো, আমি যখন লোকের উপকার করতে যাব, তখন লোকেরাও উচিত প্রতিদানে আমার উপকার করা। বিনামূল্যে কারও কাছ থেকে কিছু নেওয়া কি উচিত? উপকার চাইলে তার দাম দিতে হবে। সেই দামটাই সুদ। দাম না দিয়ে রুটি, মাংস কিছুই কেনা যায় না। অথচ যারা রুটি বেচে, মাংস বেচে টাকা নেয়, কই মহামান্য আন্তনিও তো কখনও তাদের কুত্তা বলেন না!

শাইলকের কথা শুনে রীতিমতো রেগে গেলেন আন্তনিও। তিনি বললেন, এ কথা ঠিক যে আমি তোমায় কুত্তা বলেছি। তবে রুটি বেচে পয়সা নেওয়া আর ধার দিয়ে সূদ নেওয়া এক কথা নয়। আর তোমার সুদের চাপাটাও খুব কম নয়। আমি নিজের চোখেই দেখেছি। ওই চাপে পড়ে কত লোক পথের ফকির হয়ে গেছে। আমি নিজে সুদ নেই না, সেজন্য প্রচণ্ড ঘৃণা করি সুদখোর লোককে। তাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি তোমাকে। আমি তোমায় কুত্তা বলেছি আর চিরকাল বলব সে কথা। তোমার কাছে ধার চাইছি বলে তুমি মনে কর না যে অন্যভাবে আমি তোমায় সম্বোধন করব।

কুটিল হেসে শাইলক বলল, তবুও তুমি আমার কাছ থেকে ধারা পাবার আশা করা? কেন করব না, বললেন আস্তানিও, কারণ ওটাই তো তোমার পেশা। তোমার কাছ থেকে টাকা নিলে তো তোমারই উপকার হয়। কেউ টাকা ধার না নিলে সুন্দ পাবে কোথায়? আর সুদ না পেলে তুমি দু-দিনেই গুকিয়ে যাবে, তবে অভাবে নয়, মনস্তাপে। টাকা ধার নিয়ে আমি তার সুন্দ দেব, তাহলে কেন ধার দেবে না তুমি? আমি সুদ দেব আবার কুত্তা বলে তোমায় গালাগাল দেব। তবুও তুমি হাসিমুখে ধার দেবে! এবার বল কত সুদ চাও তুমি। আমি তোমায় এত চড়া সুন্দ দিতে রাজি আছি যা তুমি আজ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে পাওনি। চড়া সুদ আমি এজন্যই দেব যাতে রিয়ালতোর উপর দাঁড়িয়ে বলতে পারি, তোমরা সবাই দেখ ওই কুত্তা শাইলক আমার কাছ থেকে কীরূপ চড়া সুন্দ আদায় করেছে। তুমি স্বপ্নেও ভেব না। ধার চাইছি বলে আমি তোমায় বন্ধুভাবে মেনে নিচ্ছি। আর তুমিও আমায় বন্ধু ভেবে ধার দিও না। মনে কর শক্রকে বিপদে ফেলার আশায় তুমি তাকে ধার দিচ্ছি।

এরপর গভীর হয়ে বললেন আন্তনিও, কিন্তু তোমার সিদ্ধান্তটা তো জানা গেল না। স্পষ্ট করে বল তুমি আমায় টাকা ধার দেবে কিনা?

গভীর মনস্তাপের সাথে বলল শাইলক, টাকা দেব না কেন? তোমাদের যখন দরকার তখন নিশ্চয়ই দেব। তবে আমার নিয়ম হচ্ছে ধার দিয়ে সুদ নেওয়া আর তোমাদের হচ্ছে সুদ না নেওয়া। বেশ তো তোমাদের নিয়মই আমি মেনে নিচ্ছি। এক পয়সাও সুদ নেব না আমি। এতে যদি তোমাদের বন্ধুত্বের কিছুটাও পেতে পারি, আমার বিবেচনায় সেটাই পরম লাভ।

শাইলকের কথা শুনে প্ৰথমে বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি আন্তনিও। তবে কি শাইলক সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা এতদিন ধরে মনে পুষে রেখেছেন তিনি? তবে কি সত্যিই ও খারাপ লোক নয়? বেশ তো, ফলেন পরিচিয়তে। এই ধারের ব্যাপারটাতেই বোঝা যাবে ওর আসল পরিচয়।

শাইলক বলল, বেশ তো শুভস্য শীঘ্ৰং। তবে আমার কাছে তো অত টকা নেই। কাছেই আমার এক আত্মীয় আছে তার নাম তুবাল। যা কম পড়বে তা ওর কাছ থেকে নিয়ে নেব। যাই, ওর বাড়ি থেকে বাকি টাকাটা নিয়ে আসি। তোমরা এর মধ্যে উকিলের কাছে গিয়ে দলিল লেখা পড়ার কাজটা সেরে ফেল। সুন্দ-ফুদ নয়, দলিলে শুধু একটা কথা লেখা থাকবে-অবশ্য সেটা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়— দলিলে তোমরা শুধু লিখে দিও যদি তিনমাসের মধ্যে টাকাটা পরিশোধ না হয় –অবশ্য আন্তনিওর কাছ থেকে টাকাটা আমি নেব, ব্যাসানিওকে অকারণ জড়ােব না। এর মধ্যে — যে জমিনদার প্রকারান্তরে সেই দেনাদার। তাই দলিলটা আন্তনিওই দেবেন। –আর সুদের পরিবর্তে স্রেফ তামাশার জন্যই একটা শর্ত লেখা হবে তাতে যে….।

অসহিষ্ণভাবে আন্তনিও বললেন, পরিষ্কার করে বলো না বাপু, দলিলে কী লেখা হবে। তোমার প্যাচালো কথা-বার্তা শুনে আমার সন্দেহ তো বেড়েই যাচ্ছে।

শাইলক বলল, না, না, সন্দেহের কিছু নেই। এতে। সন্দেহ করলেই তো সব কাজ পণ্ড হয়ে যায়। দলিলে যা স্পষ্ট করে লিখতে হবে তা হল নির্দিষ্ট দিনে ধার শোধ দিতে অপারগ হলে আন্তনিওর শরীরের যে কোনও জায়গা থেকে এক পাউন্ড মাংস আমি কেটে নিতে পারব। তোমরা যখন ইহুদিকে পিশাচ বলেই মনে কর, তখন এরূপ একটা পৈশাচিক শর্তই দলিলে লেখা থাক।

চমকে উঠলেন ব্যাসানিও, না, এরূপ একটা শর্ত কিছুতেই দলিলে লেখা যাবে না। আমি কিছুতেই এমন দলিলে সই করতে দেবনা আন্তনিওকে।

ব্যাসানিওর কথায় ক্ষুন্ন হয়ে বলল শাইলক, আরে, আমি কি সত্যিই তোমার বন্ধুর দেহের মাংস কেটে নেব? এতে আমার লাভ? গোরু-শুয়োরের মাংস হলে না হয় খাওয়া যেত। মানুষের মাংস কুকুরকে দিলেও সে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আসলে পরিহাসের ছলে তোমাদের মনোভাব পরীক্ষা করছিলাম আমি। দেখছি, বিনা সুদে টাকা ধার দিতে রাজি হয়েও তোমাদের মনের অবিশ্বাস দূর করতে পারিনি আমি। যাই হোক, তোমরা যখন আমায় বিশ্বাস কর না তখন কী দরকার আমার সাথে কাজ-কারবার করে।

কথাটা বলেই নিজের বাড়ির দিকে যাবার উপক্রম করল শাইলক। আন্তনিও তাকে ডেকে ফেরালেন। তিনি নিজেও কম আশ্চর্য হননি শাইলকের কথা শুনে, তবে ভয় পাবার পাত্র তিনি নন। সুযোগ পেলেই শাঁইলক যে দেহের মাংস কেটে নিয়ে তার মৃত্যু ঘটাবে এটা আন্তনিওর বদ্ধমূল ধারণা। তবুও তিনি ভয় না পেয়ে বোঝাতে লাগলেন ব্যাসানিওকে, এতে ভয় পাবার কী আছে? একথা ঠিকই যে অভিসন্ধি নিয়ে ঐ রূপ একটা শর্ত আরোপ করতে চাইছে লোকটি। কিন্তু তাতে আমাদের কিছু এসে যাবে না। দুমাসের মধ্যেই আমাদের জাহাজগুলি বন্দরে ফিরে আসবে —অবশ্য দলিলে লেখা থাকবে তিন মাস। তাহলে পুরো একমাস সময় হাতে থাকবে আমাদের। ওই সময়ের মধ্যে জিনিস বেচে তিনহাজার ডুকাট তো সামান্য ব্যাপার, লক্ষ ডুকাট জোগাড় করতে পারব আমি। বন্ধু, এ নিয়ে তুমি আর ভেব না।

ব্যাসানিওর আপত্তি সত্ত্বেও আন্তনিও শাইলককে বললেন তিনি তার শর্তেই টাকা ধার করতে রাজি আছেন। এরপর দু-বন্ধু উকিলের কাছে দলিল লেখাতে গেলেন। স্থির হল খানিকক্ষণ বাদেই শাইলক ওই উকিলের বাড়িতে গিয়ে টাকা দেবেন। আর দলিলটা নিয়ে আসবেন।

বাড়ির দিকে যেতে যেতে নিজ মনে বলতে লাগল শাইলক, এবার দেখা যাবে কে কুত্তা। আমার সমস্ত অপমানের প্রতিশোধ এবার কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেব।

 

০২.

শাইলকের কাছ থেকে টাকা পেয়ে মনের আনন্দে ব্যাসানিও লেগে পড়লেন বেলমন্ট যাত্রার আয়োজনে। শৌখিন পোশাক-আসাক তৈরি করালেন নিজের জন্য। সুন্দর দেখতে চাকর-খানসামা জোগাড় করা, যাত্রার আয়োজন করা — এরূপ নানা কাজ রয়েছে, অথচ বিন্দুমাত্র সময় নেই হাতে। এ সময়, ল্যান্সলেট নামক এক যুবক এসে একদিন রাস্তায় ধরল তাকে। লোকটি দেখতে সুন্দর, কথাবার্তায় চটপটে, রসিক এবং চঞ্চল। সে একসময় শাইলকের ভূত্য ছিল। কিন্তু সেখানে তার মন টেকেনি। ব্যাসানিও যদি তাকে একটা কাজের জোগাড় করে দেন, তাহলে সেই মুহূর্ত থেকেই সে কাজে যোগ দিতে রাজি।

ঠিক এ ধরনের লোকই এ মুহুর্তে প্রয়োজন ব্যাসানিওর। কাজেই ল্যান্সলিটকে কাজে নিতে তার কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। তবু তিনি জিজ্ঞেস করলে ল্যান্সলিটকে, দেখ বাপু,শাইলক ধনী আর আমি নিতান্তই গরিব। ওখান থেকে চলে এসে আমার কাজে কি তোমার মন বসবে। —এ কথাটা তোমার ভেবে দেখা উচিত। ল্যান্সলেট সাথে সাথেই জানাল শাইলকের বাড়িতে কাজ করার আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের মেয়ের প্রতি যেরূপ জঘন্য আচরণ করছে শাইলেক, তাতে ভূত্য হয়েও নীরবে তা দেখতে রাজি নয়। ল্যান্সলট। বিশেষ করে সে জন্যই সে শাইলকের কাজ ছেড়ে দিতে চায়।

শেষমেশ ব্যাসানিও ওকে চাকরি দিলেন। অন্য ভৃত্যদের তুলনায় তার জন্য দামি পোশাকের ব্যবস্থা করে দিলেন ব্যাসানিও। এবার ল্যান্সলট গেল শাইলকের কাছে বিদায় নিতে। এইখ্রিস্টানটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে শাইলকও বেঁচে যায়। এদের দৌরাত্ম্যে ইহুদিদের পারিবারিক সম্পর্ক পর্যন্ত ক্ষুন্ন হবার জোগাড়।

আজকাল লোরেঞ্জো নামে এক খ্রিস্টান যুবক যাতায়াত শুরু করেছে শাইলকের বাড়িতে। তার উদ্দেশ্য শাইলকের মেয়ে জেসিকার সাথে পরিচয় করা। জেসিকা এক সুন্দরী তরুণী, তাছাড়া খ্রিস্টধর্মের প্রতি তিনি যথেষ্ট অনুরাগিণী। সে চেষ্টায় আছে পিতৃগৃহ ছেড়ে দিয়ে লোরেঞ্জোর সাথে চলে যাবার জন্য।

ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ব্যাসানিওর বেলমন্ট যাত্রার দিন। ইতিমধ্যে একজন সঙ্গীও পেয়ে গেলেন তিনি। তিনি হলেন তার বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম নাম গ্রাসিয়ানো। গ্রাসিয়ানোর কেমন যেন ধারণা হয়েছে। বেলমন্টের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে তার ভবিষ্য জীবন।

ব্যাসানিওর কোনও আপত্তি নেই গ্রাসিয়ানোকে সাথে নিতে। তবে একটা বিষয়ে তাকে সাবধান করে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করলেন তিনি। তিনি গ্রাসিয়ানোকে বললেন, দেখ বন্ধু, তোমার রসিকতা বড়োই চটুল ধরনের। সেখানে গিয়ে যদি তুমি রসনা সংযত না কর, তাহলে আমিও কিছুটা খেলো হয়ে পড়ব তোমার সহচর হিসেবে। হয়তো এ কারণে আমার বিয়ের প্রস্তাবটাই তুচ্ছ হয়ে যাবে পোর্সিয়ার বিচারে।

কথাটা শুনেই জিভ কামড়ে বললে গ্রাসিয়ানো, বল কী বন্ধু! তোমার বিয়ের প্রস্তাবে ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ কি আমার দ্বারা সম্ভব? তুমি দেখ, বেলমন্টে পৌঁছে আমি জিভের লাগাম টেনে রাখব, একটিও বেফাঁস কথা বেরুবে না। আমার মুখ দিয়ে। শেষমেশ বেলমন্টের উদ্দেশে রওনা হলেন ব্যাসানিও।

পোর্সিয়ার পাণিপ্রার্থী সম্মানিত অতিথিরা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছেন তার বেলমন্টের প্রাসাদে। সবাই নিজ নিজ জায়গায় অবস্থান করছেন। কেউ আর জায়গা ছেড়ে যেতে চায় না। কোনও কারণে একজন দেশে ফিরে গেলে, সাথে সাথেই এক বা একাধিক প্রার্থী এসে হাজির হয় তার জায়গায়। পোর্সিয়া কাউকে চটাতে চান না, কিন্তু তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার জোগাড়। এরা কেউ পরীক্ষা দিতেও রাজি নয়। অথচ সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে বিয়ের ব্যাপারে পোর্সিয়ার কোনও নিজস্ব মতামত নেই। তারা প্ৰয়াত পিতা তিনটি বাক্স রেখে গিয়েছেন। বাক্সগুলির মধ্যে একটি সোনার, একটি রূপার এবং অবশিষ্টটি সিসার। যে কোনও পাণিপ্রার্থীই হোক, এই তিনটি বাক্সের সামনে হাজির হতে হবে তাকে। পাণিপ্রার্থী ব্যক্তিটি তার ইচ্ছেমতো যে কোনও একটি বাক্সর উপর হাত রাখবেন। তারপর সে বাক্স খোলা হবে। বাক্সের ভিতর থাকবে প্রার্থীর প্রার্থনার উত্তর। উত্তর সম্মতিসূচক হলে পোর্সিয়া তাকে বিয়ে করতে বাধ্য, নইলে নয়। পোর্সিয়ার পছন্দ অপছন্দের কোনও মূল্য দিয়ে যাননি তার পিতা। তার ভাগ্য নির্ধারণের ভার নির্ভর করছে বাক্সের লটারির উপর।

এ সব কথা জানা সত্ত্বেও বেলমন্টের প্রাসাদে ঠাই হয়ে বসে আছেন পাণিপ্রার্থীরা। তারা পরীক্ষাও দেবেন না বা প্রাসাদ ছেড়েও যাবেন না। এই নিয়ে পোর্সিয়ার সহচরী নোরিসা আজকাল বিদ্রুপ করতেও শুরু করেছে।

এ নিয়ে সেদিন কথায় কথায় পোর্সিয়াকে সে বলছিল, ঠাকুরানি! লটারির ঝামেলা না থেকে যদি ইচ্ছামতো পতি নির্বাচনের ক্ষমতা আপনার থাকত, তাহলে কার গলায় মালা দিতেন। আপনি? সে কি নেপলসের রাজা?

পোর্সিয়া তার শুভ্ৰ দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে রেখে হাসি গোপন করার চেষ্টা করলেন। তা সত্ত্বেও তার চোখের কোন থেকে হাসির বিদ্যুৎ যেন ঠিকরে পড়তে লাগল। চটুল স্বরে তিনি উত্তর দিলেন, তা কি আর না দিয়ে পারি? কোথায় পাব এমন পাত্র? শুধু ঘোড়া আর ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়া পৃথিবীর আর কিছুই চেনেন না নেপলসের রাজা। তার সবচেয়ে গর্বের বিষয় হল তিনি নিজে ঘোড়ার পায়ে নাল পরাতে পারেন। সুন্দরী নারী ছেড়ে একটা জুতসই ঘোটকীর সাথে বিয়ে হলেই ওর সুখের সম্ভাবনা বেশি।

এ কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল নোরিসা। তার হাসি যেন আর থামতেই চায় না। কোনও মতে হাসি চেপে রেখে সে বলল, বেশ তো, নেপলসের রাজা না হয়ে হোক জার্মানির প্যালটাইন কাউন্ট। এতে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি নেই?

বিরক্তির সাথে উত্তর দিল পোর্সিয়া, তাতে কী আর আপত্তি হতে পারে? সমস্ত অসন্তোষ যেন এসে বাসা বেঁধেছে। ওর মাথায়। সব সময় ভু কুঁচকেই আছে। এই বয়সেই যার এত মেজাজ, ভবিষ্যতে সে যে একজন হিরাক্লিয়াস হয়ে উঠবেন তা কে বলতে পারে। হিরাক্লিয়াসের কথা জানিস কি? তিনি হলেন সেই রাগী দার্শনিক, মুখে হাসি ফোঁটাটাও যাঁর কাছে অমার্জনীয় অপরাধ।

নকল দুশ্চিন্তার ভান করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল নেরিসা, তাহলে আপনার তালিকা থেকে কাউন্ট প্যালতিনও বাতিল?

বাতিল বলে বাতিল? দৃঢ়স্বরে জবাব দিল পোর্সিয়া, আমি মড়ার মাথাকেও বিয়ে করতে রাজি আছি তবুও ওই কাউন্টকে নয়।

দারুণ বিতৃষ্ণায় কুঁচকে ওঠে পোর্সিয়ার ঠোঁট — মসিয়ঁ লী বন? না, তাকে বারণ করার উপায় নেই কারণ স্বয়ং ভগবান তাকে পাঠিয়েছেন মানুষের আকারে। কাউকে বিদ্রুপ করা উচিত নয় তা আমি মানি। কিন্তু ওরূপ লোক সম্পর্কে মাথা ঠান্ডা রেখে কথা বলা খুবই শক্ত। বানরের মতো অনুকরণপ্রিয় স্বভাব ওই লোকটির। ওর স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে যা করছে তা নকল করা। পাখি গান গাইছে, আমনি শুরু হয়ে গেল লী-বনের রাগিণী। রাস্তায় ছাগলছানা লাফাচ্ছে, আর তিনিও ঘরের ভিতর নাচতে শুরু করে দিলেন। পৃথিবীর এক আজব চিজ এই লী-বননেপলসের রাজার চেয়েও বেশি তার ঘোড়াপ্রীতি, কাউন্ট প্যােলাটাইনের চেয়েও বেশি ভূভঙ্গ বিলাসী তিনি। হাতে যখন কাজ থাকে না তখন আরশির সামনে নিজের ছায়ার সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন তিনি। ব্যক্তিত্ব বলে লোকটার কিছু নেই। কখনও সে হচ্ছে জ্যাক, কখনও ডিক, কখনও জন বা হ্যারিস আবার কখনও বা ডেভিডের মতো। যত সব অনাসৃষ্টির ব্যাপার।

হতাশ হয়ে নেরিস বলল, তাহলে ওই ইংরাজ ভদ্রলোকটি যার নাম ককসব্রিজ!

পোর্সিয়া ঘাড় নেড়ে বললেন, না বাপু, উনি না জানেন ফরাসি না ইংরাজি না ইতালিয়ান। আমি আবার ওদিকে ইংরেজি বুঝিনে। তবে ভাষাগত অসুবিধে সত্ত্বেও বলতে হয় লোকটা ছবির মতো সুন্দর।

বিজয়গর্বে হেসে উঠে বলল নেরিসা, এবার তাহলে পথে আসুন।

বিরক্তির স্বরে বলল পোর্সিয়া, তাহলে আর কী? ছবি ছাড়া আর কিছু নয় লোকটা। দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা ছাড়া ওকে দিয়ে আর কী কাজ হবে? হাত, পা, মুখ, চোখ — ওর সবই আছে, নেই শুধু প্ৰাণ!

আপনি বড়ো নিষ্ঠুর, ঠাকুরানি, বলল নেরিসা।

মোটেই না, জবাব দিল পোর্সিয়া, ওর না আছে প্ৰাণ, না আছে ব্যক্তিত্ব। ওর পোশাকটার দিকে চেয়ে দেখেছিস কখনও? দামি পোশাক তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সহজেই অনুমান করা যায় জ্যাকেটটা কেনা হয়েছে ইতালি থেকে, পাজামাটা ফ্রান্স থেকে আর টুপিটা? আমার দৃঢ় বিশ্বাস জার্মানি ছাড়া আর কোথাও ওরূপ টুপি তৈরি হয় না।

খিল খিল করে হেসে উঠে বলল নেরিসা, তাতে হয়েছে কী? যেখানকার যা ভালো, তিল তিল করে তা সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করেছেন তিনি। সে তো ভালেই হয়েছে!

সাথে সাথে উত্তর দিলেন পোসিয়া, আত্মসাৎ আর করতে পারলেন কই। পাঁচমিশেলি জিনিস তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফুটে উঠেছে তার দেহে। ঠিক সে ভাবেই তার আচার-আচরণের মাঝে যখন-তখন ফুটে ওঠে খাপছাড়া ঢং—যার একটার সাথে অন্যটার মিল নেই। লোকের চোখে তাকে একটা গরমিলের মতো মনে হয়।

ইংরেজ ভদ্রলোক সম্পর্কে হতাশ হয়ে এবার বলে উঠল নেরিসা, তাহলে ওর পড়শি স্কটিশ ভদ্রলোকটির কথা এবার ভাবুন!

ছেঃ ও তো একটা কাপুরুষ, বলল পোর্সিয়া, সেদিন দেখলি না। ইংরেজীটা কেমন ওর কান মলে দিল। আর ও কী বলল জানিস? বলল, সুযোগ পেলে দেখে নেব।

নোরিসা  বলল, তই নাকি? তাহলে বাদ দিন ওর কথা। এবার ওই জার্মান ব্যারনটার কথা ভাবুন। ওই যে স্যাক্সনির ডিউকের ভাগনে।

পোর্সিয়া বললেন, কী বললি, ওকে? সকালবেলা ওকে দেখলেই আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে ওঠে। কেন, জনিস? সকাল থেকেই ও মদ গিলতে শুরু করে। আর বিকেলে? তখন তো জানোয়ারের সাথে ওর কোনও পার্থক্যই থাকে না। ওর গলায় মালা দেবার চেয়ে সারা জীবন আইবুড়ি থাকা অনেক ভালো।

কৌতুকে জ্বলে ওঠে নোরিসার চোখ। ও বলে, কিন্তু ও যদি সত্যি সত্যিই আসল বাক্সটা খুঁজে বের করে, তাহলে তো ওর গলাতেই মালা দিতে হবে আপনাকে। এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকবে না। আপনার। আর আপনি যদি বিয়ে না করেন তাহলে বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধাচারণ করতে হবে আপনাকে।

পোর্সিয়া বললেন, আমি সেটাও ভেবেছি বইকি! ও যাতে আসল বাক্সের কাছে যেতে না পারে তার একটা উপায়ও আমি বের করেছি। ও যদি বাক্সের পরীক্ষায় রাজি থাকে, তাহলে বাজে বাক্স দুটোর উপর দু-গ্লাস ভালো মদ রেখে দিবি। মদ দেখলেই ও সেদিকে হাত বাড়াবে আর হাত বাড়ানো মানেই তো বেছে নেওয়া।

আপত্তি করে বলল নোরিসা, ঠাকুরানি! সেটা তো জোচাচুরি হয়ে যাবে।

হোক না জোচ্চুরি, বললেন পোর্সিয়া অমন মাতালের হাতে পড়ার চেয়ে একটু-আধটু জোচ্চারির সাহায্য নেওয়া ঢের ভালো আর আমার বাবার আত্মা তাতে ক্ষুব্ধ হবেন না।

নোরিসা  বলল, ঠাকুরানি, আমি আর জ্বালাতন করব না। আপনাকে। ওরা সবাই যে যার দেশে চলে যাচ্ছে। বাক্স পরীক্ষা করার মতো সাহস ওদের নেই।

পোর্সিয়া বললেন, তাহলে ফিরে যাক ওরা। বাবার নির্দেশ আমি অমান্য করতে পারব না। বাক্স তিনটের মধ্য থেকে আসল বাক্সকে যে বাছাই করতে পারবে না, তার গলায় মালা দেব না আমি। তাতে যদি সারা জীবন কুমারী থাকতেও হয় তাতেও আপত্তি নেই আমার। আমার সৌভাগ্য যে লোকগুলি চলে যেতে চাইছে। ওদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে চলে গেলে আমার মনে দুঃখ হবে।

একটু দ্বিধার সাথে বলল নোরিসা, একটা কথা বলব ঠাকুরানি, আপনি কিছু মনে করবেন না। কতাঁর জীবিতকালে মনফেরাতের মাকুইসের সাথে একজন ভেনিসিও যুবক মাঝে মাঝে এখানে আসতেন। তিনি ছিলেন একাধারে বীর এবং বিদ্বান। তার কথা কি আপনার মনে পড়ে?

এবার আর চিন্তা করতে হল না পোর্সিয়াকে। তিনি বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি তুই কার কথা বলছিল–তিনি তো ব্যাসানিও। কী বললি, তার নাম ব্যাসানিও নয়?

সাহস পেয়ে বলল নোরিসা, সুন্দরী রমণীর পাণিগ্রহণ করতে হলে একজন পুরুষের যে সব গুণ থাকা দরকার, আমার দেখা সমস্ত পুরুষদের মধ্যে একমাত্র ব্যাসানিওর মাঝেই রয়েছে সে সব গুণ।

এ সময় একজন ভৃত্য এসে জানোল মরক্কোর সুলতানের বার্তা নিয়ে একজন দূত এসেছে। সুলতান আজ রাতেই এসে পৌছবেন বোলমন্টে। পোর্সিয়ার পাণিগ্রহণের জন্য যে কোনও পরীক্ষাতেই আপত্তি নেই তার।

ক্লাস্ত স্বরে বলে উঠল পোর্সিয়া, না, আর পারা যায় না। একদল যেতে না যেতেই আর একদল এসে হাজির। মরক্কোর সুলতান; সে তো নিশ্চয়ই কালো চামড়ার লোক। কিন্তু আমার বাবা এমন ব্যবস্থা করে গেছেন যে কালো চামড়ার লোক হলেও তাকে উপেক্ষা করার শক্তি আমার নেই। পরীক্ষা করার সুযোগ দিতেই হবে তাকে।

জেসিকা শাইলকের একমাত্র সস্তান। বাবার সাথে কোনও দিক দিয়েই মিল নেই তার। তার মুখখানা যেমন কোমল, অন্তরটিও সেরূপ। সে বিয়ে করতে চায় খ্রিস্টান যুবক লোরেঞ্জোকে, যে আবার ব্যাসানিওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

 

জেসিকা ভালোভাবেই জানে তার বাবাকে। মেয়ের বিয়ের কথাটা ভাবাও শাইলকের কল্পনার বাইরে—কারণ বিয়ে মানে তো অহেতুক খরচ। শাইলক কখনও এমন মহাপাপ করতে পারে না। তার উপর আবার খ্রিস্টানের সাথে বিয়ে? যে খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে শাইলক দু-চোখে দেখতে পারে না তাদেরই একজনের হাতে তুলে দেবে মেয়েকে? এ কখনও সম্ভব নয়। খ্রিস্টানরা যদি শুধু ডুকাট ধার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, তাতে বিশেষ আপত্তি নেই শাইলকের। কিন্তু যে তার মেয়েকে বিয়ে করবে। সে তো তার সিন্দুকের দিকেও হাত বাড়াবে। পুত্ৰহীন শাইলকের একমাত্র উত্তরাধিকারী তার মেয়ে জেসিকা।

লোরেঞ্জোর সাথে বিয়ে দিতে তার বাবা রাজি হবেন। এ কথা কল্পনাও করতে পারে না জেসিকা। তাই সবকিছু সে সযত্নে গোপন রেখেছে। এ ব্যাপারে যা কিছু পরামর্শ করার দরকার তা সে লোরেঞ্জোর সাথেই করে। অবশ্য বন্ধুসমাজে কথাটা গোপন রাখতে পারেনি লোরেঞ্জো। কারণ কোনও ব্যবস্থা নেবার প্রয়োজন হলে সেটা তার একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। সাহায্যের প্রয়োজন নিশ্চয়ই হবে এবং সেটা বন্ধু-বান্ধব ছাড়া আর কার কাছ থেকে আশা করা যায়!

এ সব সামান্য ব্যাপারের অনেক উর্ধের্ব আন্তনিও, তাই তাকে বিরক্ত করতে সাহস হয়নি লোরেঞ্জোর। ব্যাসানিও অবশ্য এ সব ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। কিন্তু তিনি তার নিজের প্রেমের ব্যাপারে সর্বদাই এত উন্মনা ও ব্যতিব্যস্ত যে এসময় তাকে জেসিকার কথা বলা সম্পূর্ণ নিরর্থক। ওদের দু-জনকে বাদ দিয়ে সে তার অন্য বন্ধুদের বলেছে এবং তার মধ্যে গ্রাসিয়ানো, স্যালিরিনো প্রভৃতি বন্ধুরা সবাই এককথায় রাজি হয়েছে তাকে যথাসম্ভব সাহায্য করতে।

শাইওলকের বিদায়ী ভৃত্য ল্যান্সলটের মারফত লোরেঞ্জার কাছে সেদিন একটা চিঠি পাঠিয়ে ছিল জেসিকা। ল্যান্সলটের প্রতি কোনোদিনই ভালো ব্যবহার করেনি শাইলক কারণ সে ছিল খ্রিস্টান। ল্যান্সলট একটু অলস প্রকৃতির, তদুপরি শৌখিন। শাইলকের ঘরে এ ধরনের ভৃত্যু বেমানান। এক কথায় সে ছিল ধনী ব্যক্তির ঘরে মানানসই একজন চাকর। শাইলক এ ধরনের লোককে মোটেও সহ্য করতে পারে না। তাই অনেকদিন ধরেই ল্যান্সলেট খোজ করছিল। অন্য কাজের। ভাগ্যক্রমে ব্যাসানিওর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় নতুন কাজটা সে পেয়েছে। সে চাইছে যাবার আগে পূর্বতন প্রভুর যতটা সম্ভব ক্ষতি করে যাওয়ার। জেসিককে যথাসম্ভব সাহায্য করতে রাজি।

জেসিকার চিঠি পেয়ে লরেঞ্জো তার বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে ল্যান্সলেট মারফত একখানা চিঠি পাঠিয়েছে জেসিকাকে। লোরেঞ্জো বারবার সাবধান করে দিয়েছে ল্যান্সলিটকে সে যেন চিঠিটা অন্য কারও হাতে না দেয়।

বিয়ের উদ্দেশ্যে বেলমন্ট যাত্রা করছেন ব্যাসানিও। ভাগ্যপরীক্ষা করার আগে বন্ধুদের জন্য একটি ভোজের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। গ্রাসানিও প্রমুখ বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দিল। এই ভোজে শাইলককে নিমন্ত্রণ করা দরকার। কারণ তিনহাজার ডুকাট ধার দিয়ে সে যে ব্যাসানিওর উপকার করেছে সে জন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। কেননা ওই টাকা না পেলে ব্যাসানিওর বেলমন্ট যাবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য টাকা ধারণ দেবার ব্যাপারে শাইলকের কোনও মহানুভবতা নেই। তার মতলব যে ভালো নয়, তা শুধু ব্যাসানিও কেন, অন্য সবারও অজানা নয়। তবে তার মতলব যাই হোক না কেন, সেটাই যথেষ্ট। যে টাকাটা পাওয়া গেছে তার কাছ থেকে। এটাই পরম লাভ। কাজেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ পেয়ে কেন তা থেকে বঞ্চিত হবেন ব্যাসানিও? ল্যান্সলটের হাত দিয়ে তিনি নিমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিলেন শাইলকের কাছে।

ল্যান্সলিটকে দেখেই বিদ্রুপের স্বরে বললেন শাইলক, কীহে বাপু, কেমন আছ নতুন মানিবের বাড়িতে? বুঝলে, ওখানে আর এখানে অনেক তফাত। এখানে তো সকাল-বিকেল, যখন খুশি ইচ্ছামতো খেতে পারতে, সেখানে শুধু একবার সকালে আর একবার বিকেলে। তুমি কি ভেবেছি সেখানে পেটপুরে খেতে পাবে? রামঃ রামঃ সেই পাত্ৰই বটে খ্রিস্টানেরা! খিদে পেলে খেতে পাবে না। আর ঘুম পেলে শোবার জোগাড় নেই। আর পোশাকের কথা না বলাই ভালো। ছিড়ে ন্যাকড়া হয়ে গেলেও কিছুতেই নতুন পোশাক দেবে না। ওরা। তাই বলছি, কেমন আছ হে নতুন মনিবের বাড়িতে?

ল্যান্সলেট বিনীতভাবে জবাব দিলে, হে আমার প্রাক্তন মনিব! না খেয়েও আমি সেখানে ভালোই আছি। আমার বর্তমান মনিবের কাছ থেকে এই নিমন্ত্রণ পত্রটা নিয়ে এসেছি। আপনি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবেন তো?

শাইলক বলল, না যাওয়াই উচিত কারণ ওরা তো ভালোবেসে নিমন্ত্রণ করেনি আমায়। নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে ওদের। খোশামোদ করে আরও কিছু টাকা নেবার ধান্দায় আছে ওরা। কিন্তু কিছুতেই আর সেসব হবে না। ইচ্ছে হলে, তোমার নতুন মনিবকে এসব কথা বলে দিতে পারল্যান্সলেট। কারণ ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। আন্তনিওর প্রতি আমার অনেকদিনের ভালোবাসা রয়েছে। তাই তার উপকারে এসেছি আমি। তবে সে টাকা এখন সমুদ্রে ভাসছে।

অবাক হবার ভান করে বলল ল্যান্সলেট, সমুদ্রে ভাসছে? এ কেমন কথা?

তাছাড়া আর কী বলব বল! বলল শাইলক, কেন যে নগদ টাকায় মাল কিনে লাভের আশায় সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয় লোকেরা, তা বাপু আমার মাথায় ঢেকে না। ঝড় হল তো জাহাজ ডুবে গেল। আর বোম্বেটেরা লুট করলে তো হয়ে গেল। অথচ দেখ, সমুদ্রে মাল না পাঠিয়েও কেমন দু-পয়সা রোজগার হচ্ছে আমার।

ল্যান্সলেট বলল, ওটা তো সুদের টাকা। মানুষদের ঠকিয়ে… এ পর্যন্ত বলে জিভ কেটে চুপ করে সে। হাজার হলেও তো পুরনো মনিব। তার অসম্মান করা উচিত নয়। বেরসিক হওয়া সত্ত্বেও লোকটি অভদ্র নয়।

ল্যান্সলটি যতটুক বলেছে সেটাই যথেষ্ট শাইলককে রাগাবার জন্য— কী বললে, সুদ নেওয়া মানে লোক ঠকানো? আর কম দামে মাল কিনে চড়া দরে বেচা বুঝি লোক ঠকানো নয়? কে যে কতখানি সাধুতা আমার জানা আছে। তফাত এই আন্তনিও খরিদারদের ঠকায় আর আমি ঠিকই দোকানিদের। খরিদারের যেমন মাল কেনা ছাড়া গতি নেই, তেমনি দেনাদারও বাঁচে নাটাকা ধার করতে না পারলে। তাদের প্রয়োজনের সুযোগে আমরা দু-পয়সা লুটে নিই, ব্যাপারটা এই আর কী।

শাইলককে বাধা দিয়ে বলে উঠল ল্যান্সলেট, আমি আসল ব্যাপারটার কথা বলছি। মানে, আপনি নিমন্ত্রণে যাবেন তো?

আমার না যাওয়াই উচিত, বলল শাইলক, কিন্তু ভাবছি গেলে ওরা আর আমার কীই বা করবে। এমন কঁচা ছেলে আমি নই যে ওদের কথায় ভুলে গিয়ে হাজার দু-হাজার ডুকাট বিলিয়ে দিয়ে আসব। বরঞ্চ আমি গিয়ে ওদের কিছু খরচা করিয়ে দিয়ে আসব। শুনেছি। ওরা নাকি ভালো খায়-দায়। শুধু শুয়োরের মাংসটা না দিলেই হল।… ওরে জেসিকা কোথায় গেলি।

কিন্তু জেসিকার কাছ থেকে কোনও সাড়া পেলেন না তিনি। তখন তিনি চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন মেয়েকে। জেসিকার আসতে কিছুটা সময় লেগে গেল। এদিকে শাইলক কিন্তু অবিরাম বলেই চলেছে, আমার মোটেই ইচ্ছে নেই যাবার। গেলে আমার কিছু না কিছু ক্ষতি হবেই। কাল রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি টাকার থলির। ওটা এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন-রীতিমতো অশুভ। না জানি আর কী কী রয়েছে আমার কপালে।

তাকে সাত্ত্বনা দিয়ে বলে উঠল ল্যান্সলেট, ওসব চিস্তা মন থেকে দূর করে দিন। কেই বা আপনার ক্ষতি করতে পারে? তার চেয়ে চলুন কিছুটা আনন্দ উপভোগ করে আসি। আজ ওখানে নাচ-গানের আসর বসছে। আপনাকে দেখতে পেলে খুবই খুশি হবেন প্ৰভু ব্যাসানিও। কত নাচ, গান, স্মৃর্তি হবে সেখানে। চার বছর আগে ইস্টার সোমবারের বিকেলে যখন আমার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল, তখনই জানতাম আমার অদূদ্ষ্টে রয়েছে আজ প্ৰভু ব্যাসানিওর বাড়িতে নাচ দেখা, গান শোনা আর ভোজ খাওয়া।

সে সব কথায় কোনও কান দেয় না। শাইলক। সে আপন মনেই বলতে থাকে, নাচ-গান না ছাই! এ সময় জেসিকাকে সামনে দেখে সে বলল, ওরে জেসিকা! আজ একবার না বেরুলেই নয়। তুই দরজা বন্ধ করে থাকিবি। যদি রাস্তায় জয়ঢাক বা বাঁকা-বাঁশির আওয়াজ শুনিস, তাহলেও দরজা খুলবিনা তুই। খ্রিস্টানরা যদি মুখে রং মেখে সং সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে তো ঘুরুক না। তুই কিন্তু ভুলেও রাস্তায় যাবি না সে সব দেখার জন্য।

সংক্ষেপে উত্তর দিল জেসিকা, ঠিক আছে, যাব না।

শাইলক বলল, তুই কিন্তু মোটেও জানলাগুলি খুলবি না। ও সব শব্দ কানে আসাও পাপ। আমি জানিনা। কী জন্য যাচ্ছি কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। ওহে ল্যান্সলেট, তোমার প্রভুকে গিয়ে বল যে তোমার প্রাক্তন মনিব একটু বাদেই আসছেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। তবে শুয়োরের মাংসটা যেন তার টেবিলে দেওয়া না হয়। ওটা খেতে নিষেধ আছে আমাদের।

যাবার আগে ল্যান্সলট চুপি চুপি জেসিকাকে বলে গেল সে যেন বাবার কথামতো দরজাজানালা বন্ধ করে বসে না থাকে।

শাইলক বললেন, যাবার আগে তোকে কী বলে গেল রে ল্যান্সলেট? বিরক্তির সাথে জেসিকা বলল, বিশেষ কী আর বলে যাবে? দুঃখ করে গেল যে ওখানে যাবার পর একদিনও পৌঁটপুরে খেতে পায়নি সে। আশা আছে আজ এই ভোজের কল্যাণে সে পেট পুরে খেতে পাবে।

খিলখিল করে হাসতে হাসতে পোশাক পালটাতে গেল শাইলক। এটা তার বদ্ধমূল ধারণা যে খ্রিস্টানিরা তাদের ভৃত্যদের পেট পুরে খেতে দেয় না।

কিছুক্ষণ বাদেই তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেল শাইলক। এদিকে রাত্রিশেষে জেসিকার জানোলার নীচে এলে দাঁড়ালেন ব্যাসানিও। তার সাথে রয়েছে গ্রাসিয়ানো, স্যালারিনো প্রভৃতি বন্ধুরা। তাদের ভয়ের কোনও কারণ নেই, কারণ ওরা জানেন শাইলক এখন ব্যাসানিওর বাড়িতে বসে নাচ দেখছেন। বাড়িতে কোনও চাকর-বাকরও নেই। ল্যান্সলট চলে যাবার পর কৃপণ ইহুদি আজ পর্যন্ত কোনও চাকর রাখেনি।

খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর জেসিকা এসে দাঁড়াল জানালার পাশে। তার পরনে পুরুষের পোশাক। সে দড়ি বেঁধে একটা বাক্স নিচে নামিয়ে দিল। লরেঞ্জোকে ডেকে সে বলল, সাবধানে ধর এই বাক্সটা। এতে রয়েছে আমার সমস্ত অলংকার। আমি দেখি কিছু স্বর্ণমুদ্রা জোগাড় করে আনতে পারি কিনা।

গহনার বাক্স হাতে নিয়ে জেসিকার অপেক্ষায় রইল লোরেঞ্জো। কিছুক্ষণ বাদে দু-হাতে দুটো মোহর ভর্তি থলি নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল জেসিকা। তখন অন্ধকার রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। কাজেই কেউ তাদের দেখার আগেই পালিয়ে গেল ওরা।

 

এদিকে মরক্কোর সুলতান এসে আতিথ্য গ্ৰহণ করে রয়েছেন পোসিয়ার প্রাসাদে। একটা রাজ্যের রাজা তিনি–রাজ্য ছেড়ে বেশিদিন বাইরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আগামীকাল তিনি নিজেই ভাগ্য পরীক্ষা দিতে চান। তাতে অবশ্য পোর্সিয়ার কোনও আপত্তি নেই। কারণ এ সব অবাঞ্ছিত অতিথিরা যত তাড়াতাড়ি বিদায় হন ততই ভালো। ঠাট্টা করে নোরিসা  বলল, যদি এই অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের মধ্যে সঠিক বাক্সটা কেউ টেনে বের করে, তাহলে? এ কথা শুনে কালো ছায়া নেমে আসে পোর্সিয়ার মুখের উপর। কিন্তু পরীক্ষণেই তিনি বললেন, এ নিয়ে আমার কোনও আশঙ্কা নেই। আমি মনে করি ঈশ্বর কখনই আমার প্রতি এত নিষ্ঠুর হবেন না।

পরদিন সকালেই মরক্কোর সুলতানকে নিয়ে আসা হল এক সুসজ্জিত সুরম্য কক্ষে। সেই কক্ষের একপ্রান্তে ঝুলছে একটা স্বর্ণখচিত মখমলের পর্দা। টেবিলের উপর সারি দিয়ে সাজানো রয়েছে তিনটি ধাতুনির্মিত আধার। পর্দা সরাতেই সুলতান দেখতে পেলেন একটি আধার সোনার, একটি রূপার এবং শেষেরটি সিসার।

আধারগুলির কাছে গিয়ে সুলতান পরীক্ষা করতে লাগলেন প্রত্যেকটিকে। সোনার আধারটির গায়ে উৎকীর্ণ রয়েছে এই কথাগুলি : আমায় যে বেছে নেবে সে এমন কিছু পাবে যার জন্য পৃথিবীর সবাই উদগ্ৰীব।

রুপোর আধারটির গায়ে লেখা আছে এই ছত্রটি : আমায় বেছে নিলে নিজ যোগ্যতার পুরস্কার পাবে তুমি।

আর সিসের পাত্রটির গায়ে যা লেখা আছে তা এই : আমাকে যে বেছে নেবে সর্বস্ব পণ করতে হবে তাকে। হয়তো সর্বস্ব হারাতেও হতে পারে।

সবকিছু দেখার পর সুলতান বললেন, আমি কী করে বুঝব যে সঠিক পত্রিটি বেছে নিয়েছি? সুলতানের সাথেই ছিলেন পোর্সিয়া। সাথে সাথেই তিনি উত্তর দিলেন, ওই আধারগুলির মধ্যে একটিতে রয়েছে আমার প্রতিকৃতি। সেই আধারটি যিনি বেছে নেবেন তার গলায় মালা দেব আমি।

আপন মনে আল্লাকে ডাকতে লাগলেন সুলতান–হে আল্লা, তুমি আমায় সঠিক পথে চালনা কর। এরপর মনোযোগ সহকারে তিনি আবার পাঠ করলেন আধার তিনটির গায়ে উৎকীর্ণ প্ৰতিলিপি। প্ৰথমে সিসের পত্রটি পরীক্ষা করে দেখলেন তিনি–সর্বস্ব পণ করতে হবে! কিন্তু কীসের জন্য? এ তো বড়ো আবদারের কথা! এটা যেন লোককে ভয় দেখাতে চাইছে! যদি সর্বস্ব পণ করব তো প্রতিদানে কী পাব? সিসের মতো নিকৃষ্ট বস্তুর কাছ থেকে আমার মতো মহৎ লোক কি যোগ্য প্রতিদান আশা করতে পারে? নাঃ, সিসের সাথে কারবার করা আমার পোষাবে না।

এরপর রুপের পালা! এ বলছে যোগ্যতা অনুযায়ী পুরস্কার দেবে আমায়? কী স্পর্ধা! আমার কি যোগ্যতার অভাব? একটা স্বাধীন দেশের বীর রাজা আমি, ওই নিকৃষ্ট রৌপ্যাধারটা কিনা আমার যোগ্যতার প্রশ্ন তুলতে চায়? ওর ছায়াও মাড়াব না আমি।

এবার দেখা যাক সোনা কী বলছে–পৃথিবীর লোক যা কামনা করে তাই পাওয়া যাবে তার কাছ থেকে। বাঃ বেশ বলেছে তো! এসো স্বৰ্ণধার, আমি বেছে নিলাম তোমাকে।

পোর্সিয়াকে উদ্দেশ করে সুলতান বললেন, এবার চাবিটা দিন।

মুখের হাসি গোপন করে চাবিটা সুলতানকে দিলেন পোর্সিয়া।

কাঁপা হাতে বাক্সের ডালাটা খুললেন সুলতান। তিনি আশা করেছিলেন এর মধ্যে পোর্সিয়ার প্রতিকৃতি থাকবে। কিন্তু তার বদলে এ কী রয়েছে!

প্রতিকৃতি তো নয়, একটা বীভৎস জিনিস সাজানো রয়েছে স্বর্ণাধারের ভেতর। জিনিসটি একটি মাথার খুলি। তার চক্ষুকোটরে ঢোকানো রয়েছে একখানা পাকানো কাগজ। সেটা টেনে নিয়ে পড়তে লাগলেন সুলতান–যা চকচক করছে তাই সোনা নয়। বাইরে থেকে দেখে কোনও জিনিসের বিচার করা উচিত নয়। –কথাটা বহুবার শুনেছ। তবুও তোমার চৈতন্য হয়নি। মরীচিকার সন্ধানে ঘুরে বহু লোক প্ৰাণ পর্যন্ত হারিয়েছে। সমাধিস্তম্ভের বাইরে সোনালি কারুকার্য থাকলেও ভেতরে কিন্তু থাকে গলিত শব আর মাংসভুক কীট। তোমার সাহসের অনুপাতে বুদ্ধির জোর বেশি থাকলে পরীক্ষার ফলও অন্যরকম হত। এখন তুমি যেতে পার। জন্মের মতো সুযোগ হারিয়েছ তুমি।

ভগ্নহৃদয়ে দেশে ফিরে গেলেন মরক্কোর সুলতান।

পরদিনই এলেন আরাগনের রাজা। ইনিও বীর, বয়সে তরুণ। কিন্তু সবকিছু দেখে শুনে মনে হয়, তিনি বুদ্ধির ধার ধারেন না। সমাদরের সাথে পোর্সিয়া তাকে নিয়ে এলেন পরীক্ষার ঘরে। সেঘরে পাশাপাশি সাজানো রয়েছে সোনা, রুপো এবং সিসে নির্মিত তিনটি আধার। পর পর তিনটি আধারে উৎকীর্ণ লিপি পাঠ করলেন আরাগন রাজ। অনেক ভেবে তিনি স্থির করলেন সোনা বা সিসে নয়, রুপোর আধারটিই হল খাঁটি জিনিস। কারণ ওতে লেখা আছে — আমার কাছ থেকে তুমি যোগ্যতার অনুরূপ পুরস্কার পাবে।

আরাগনরাজের যোগ্যতা তো স্বীকার করে নিয়েছে। সারা পৃথিবী। তার যোগ্য পুরস্কারের অর্থই পোর্সিয়ার সাথে তার বিয়ে। চাবি চেয়ে নিয়ে তিনি দ্রুত খুলে ফেললেন রুপোর আধারটি।

কিন্তু কী আশ্চর্য! ওর ভেতর তো পোর্সিয়ার কোনও প্রতিকৃতি নেই। — রয়েছে একটা হাস্যোজুল সঙের মূর্তি আর সেই মূর্তির দাঁতে আটকানো আছে একটা কাগজ। কাগজে লেখা আছে বাইরে থেকে দেখতে সুন্দর হলেও ভেতরে ফাঁপা–এরূপ বহু অপদার্থ রয়েছে পৃথিবীতে। তারাই পোর্সিয়ার প্রতিকৃতি তালাশ করবে। আমার ভেতর। জন্মের মতো শেষ হয়ে গেছে তোমার সময়। এবার যেতে পার তুমি।

লিপিটা পাঠ করার পর আর একমুহূর্তও দেরি না করে বেলমন্ট ছেড়ে চলে গেলেন আরাগনের রাজা।

আরাগনের রাজার অনুচরগণ পোর্সিয়ার প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাবে ঠিক এমন সময় একজন ভৃত্য এসে বলল, ঠাকুরানি! ভেনিস থেকে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তার সাথে রয়েছে প্রচুর মূল্যবান উপহার সামগ্ৰী। ভদ্রলোক নিজে অবশ্য পাত্র নন, দূত মাত্র। পিছনেই আসছে আসল বর

পোর্সিয়া বললেন, চল, গিয়ে দেখে আসি। নোরিসা  মনে মনে ভাবছে —বরের পর বরের আপ্যায়ন করে আর পারি না। এবার ব্যাসানিও এলে বাঁচি। আমার মন বলছে ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত হয়ে ব্যাসানিওই আসছেন ঠাকুরানির স্বামী রূপে। উনি ছাড়া আর কেউ পারবে না আধারগুলির রহস্য ভেদ করতে।

 

০৩.

ভেনিস থেকে যে ভদ্রলোক এসেছেন তিনি হলেন গ্রাসিয়ানো, ব্যাসানিওর দৃত। অচিরে ব্যাসানিও এলেন বোলমন্টে। শাইলকের কাছ থেকে প্রাপ্য টাকার এমন সুন্দর সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি যে তার ঘোড়া আর অনুচরদের জাঁকজমক দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। তাকে দেখে মনেই হয় না। তিনি রাজা-মহারাজা নন, সম্রাস্তবংশীয় একজন সাধারণ ভদ্রলোক মাত্র।

অবশ্য ব্যাসানিওর সাথে পূর্ব পরিচয় রয়েছে পোর্সিয়ার।

পোর্সিয়ার পিতা জীবিত থাকাকালীন কয়েকবার অতিথি রূপে এখানে এসেছিলেন ব্যাসানিও। পোর্সিয়া মুখে কিছু না বললেও একমাত্ৰ নোরিসা জানে সে সাক্ষাতের ফলে পোর্সিয়ার মনে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ব্যাসানিও। তাই ব্যাসানিওকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে নোরিসা — পোর্সিয়ার মুখেও আনন্দের ছাপ দেখা যায়। কিন্তু তার বিয়ের ব্যাপারে বাবা যে ব্যবস্থা করে গেছেন তার উপর কোনও হাত নেই তার। সমস্ত ব্যাপারটাই নির্ভরশীল দৈবের উপর। ধাতুনির্মিত তিনটি আধার রয়েছে। তার মধ্য থেকে বেছে নিতে হবে একটিকে। যদি সেটা খোলার পর তার মধ্যে পোর্সিয়ার প্রতিকৃতি পাওয়া যায়, তাহলেই সেই বিবাহাৰ্থী পোর্সিয়াকে লাভ করতে সক্ষম হবে।

সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে ব্যাসানিওকে। নইলে পোর্সিয়ার সাথে তার বিয়ের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

এক একবার পোর্সিয়ার মনে লোভ হচ্ছে ব্যাসানিওকে আধারগুলির প্রকৃত রহস্য জানিয়ে দিলেই তো হয়। তার প্রতিকৃতি কোন আধারের মধ্যে রয়েছে তা তো পোর্সিয়ার অজানা নয়। সে একটু ইঙ্গিত দিলেই এই মুহুর্তে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।কিন্তু পরীক্ষণেই সে মন থেকে দূর করে দেয় এ প্রলোভনকে। কারণ তাতে মৃত পিতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। নাঃ, তার দ্বারা এ কাজ মোটেও সম্ভব নয়। এর জন্য যদি তার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে যায় তাও সে মেনে নিতে রাজি।

তাই চটজলদি পরীক্ষার ব্যাপারটা সমাধা করতে হবে। তারপর ভাগ্যে যদি মিলন থাকে তো হবে, নইলে চিরদিনের মতো বিরহ যাতনা। অনিশ্চায়ের আগুন তো অন্তত নিভে যাক।

ব্যাসানিওকে নিয়ে পরীক্ষার ঘরে এলেন পোর্সিয়া; আজকের মতো আর কোনও দিন সন্দেহ আর আশঙ্কায় কেঁপে ওঠেনি তার হৃদয়।

ব্যাসানিওর সামনে ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল রেশমি পর্দা। চোখের সামনে ভেসে এল তিনটি ধাতু-নির্মিত আধার, যার একটির ভেতর রয়েছে পোর্সিয়ার প্রতিকৃতি। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে সুমধুর সংগীত আর সে সংগীতের কী চমৎকার বাণী।

গান শুনতে শুনতে বলছেন ব্যাসানিও, বাহ্যিক দৃশ্যের মূল্য কতটুকু? পৃথিবীর লোকেরা তো চিরকালই প্রতারিত হয়েছে বাইরের চাকচিক্য দেখে। আইনের কথাই ধরা যাক না কেন। মামলার মধ্যে হয়তো কিছু নেই, কিন্তু উকিলের জোরালো বক্তৃতার ফলে এর অন্তঃসারশূন্যতা কারও চোখে পড়ে না। যদি কোনও প্রধান আচার্য বাইবেল থেকে পাঠ করে তার পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাহলে ধর্মীয় মতবাদকেও পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। যে কোনও পাপকে পুণ্যের আবরণে মুড়ে চালিয়ে দেওয়া যায়। কাজ না করেও কোনও কাপুরুষ লোক হারকিউলিসের মতো বলবান বলে প্ৰতিভাত হতে পারে।

কাজেই ওই একই কারণে আমি সোনা ও রুপো–দুটোকেই উপেক্ষা করব। কারণ ওই তুচ্ছ সিসের দুৰ্নিবার আকর্ষণ আমায় টানছে। ওর উপর উৎকীর্ণ লিপিকে প্রতিশ্রুতি তো নয়ই, বরঞ্চ সতর্কবাণী রূপে গ্ৰহণ করা যেতে পারে। ওর বিবর্ণিতাই আমার কাছে শুভ্রতার প্রতীক। হে সিসে! আমি তোমাকেই বেছে নিলাম। ভাগ্য আমার প্রতি সুপ্ৰসন্ন হোক।

পোর্সিয়ার মনে হল তিনি যেন দু-খানা অদৃশ্য ডানায় ভর করে উড়ে চলেছেন–তার চারদিকে যেন রয়েছে রামধনু রাঙা নতুন জগৎ। সেই জগৎ থেকে ভেসে আসছে অপূর্ব সব সংগীত। দেবাঙ্গনারা যেন ফুলের মালা নিয়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে পোর্সিয়াকে — শুধু পোর্সিয়াকে কেন, পোর্সিয়া-ব্যাসানিও যুগলকে তারা দাঁড় করিয়েছে এক তরঙ্গ শীর্ষে–দুজনকে একত্রে বেঁধেছে পারিজাত মালার বন্ধনে। একেই কি বলে স্বৰ্গা! এই তো শুভ-সূচনা আনন্দ-সুখের। পোর্সিয়ার নারীজন্ম আজ সার্থক।

ব্যাসানিও একদৃষ্টি তাকিয়ে রয়েছেন আধারের মধ্যে রাখা পোর্সিয়ার প্রতিকৃতির দিকে। কোনও সন্দেহ নেই ছবিটা একজন নিখুঁত শিল্পীর সৃষ্টি। ছবিটা দেখতে দেখতে ব্যাসানিও হঠাৎ লক্ষ করলেন ছবিটার নিচে পড়ে আছে একটা কাগজ। ব্যাসানিও সেটা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন — বাহ্যিক রূপ দেখে তুমি বিচার করেনি। তাই সাফল্য যখন তোমার দুয়ারে এসেছে, তখন সানন্দে বরণ করে নাও তাকে। পৃথিবীর বুকে আজ থেকে আর তোমায় সুখের খোঁজে বের হতে হবে না। আজ থেকে তিনি একান্তভাবে তোমারই।

কাগজটা পড়ার পর পোর্সিয়াকে বললেন ব্যাসানিও, এই চিঠির নির্দেশ আমার কাছে যতই লোভনীয় হোক না কেন, আপনার সমর্থন না পেলে এর কোনও মূল্য নেই আমার কাছে।

সাথে সাথেই জবাব দিলেন পোর্সিয়া, হে আমার প্রভু ব্যাসানিও! এই যে আপনি আমায় দেখছেন, বেলমন্টের জমিদারির অধীশ্বরী, সুরম্য প্রাসাদের অধিকারিণী, অগণিত দাস-দাসী অনুচরদের ভাগ্যবিধাত্রী–এই আমি আজ থেকে আপনার একান্ত অনুগতা। আমি একটা সাধারণ মেয়ে, লোকে আমায় রূপসি বলে, ঈর্ষা করে আমার ধন-সম্পদের। আমি জানি আমার এই রূপ ও ঐশ্বৰ্য সত্ত্বেও আমি আপনার যোগ্য নই। আমার দুঃখ হয় কেন আমি এর চেয়ে বেশি রূপসি হলাম না। কোন পারলাম না। আরও বেশি গুণের অধিকারিণী হতে? এর চেয়ে হাজার গুণ বেশি গুণ। ঐশ্বর্য কেন আমি পেলাম না। পিতার কাছ থেকে? যদি এসব আমি পেতাম, তা হলে সবই উৎসর্গ করে দিতাম আপনার চরণে–তৃপ্তি পেতাম। আমার যা আছে তা যৎসামান্য হলেও আজ থেকে আপনার। আমার এই প্রাসাদ, জমিদারি, অর্থসম্পদ, মায় আমি —এখন থেকে আপনিই এ সবের প্রভু। এই আংটিটি আপনার আঙুলে পরিয়ে দিয়ে সেই সাথে সর্বস্ব সমর্পণ করলাম। আপনাকে। আমার মিনতি অভিজ্ঞান মনে করে এই আংটিটি সযত্নে রক্ষা করবেন। এটি যদি আপনি কোনওদিন হাতবদল করেন, তাহলে জানিব, আপনি আর আমায় ভালোবাসেন না।

ব্যাসানিও জবাব দিলেন, বেঁচে থাকতে এ আংটি আমি আঙুল থেকে খুলব না।

তখন নোরিসা  বলে উঠল, হে আমার ঠাকুরানি ও প্ৰভু! আপনারা আমাদের সশ্রদ্ধ অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আজ থেকে আপনাদের সুখেই আমাদের সুখ।

ওদিক থেকে বলে উঠল গ্রাসিয়ানো, বন্ধু ব্যাসানিও! তোমাদের দু-জনের জন্য রইল আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। তবে আমারও একটা বক্তব্য আছে। যদি তোমাদের আপত্তি না থাকে, তাহলে এই সুযোগে আমিও একটা বিয়ে করে ফেলতে চাই। এ ব্যাপারে তোমাদের কী অভিমত?

ব্যাসানিও হেসে বলল, এতো ভালো কথা। কিন্তু পাত্রী কই? বিয়ে করতে গেলে তো পাত্রীর দরকার, আর তারও সম্মতির প্রয়োজন।

গ্রাসিয়ানো বলল, সে সব ঠিক হয়ে আছে। এই সামান্য সময়ের মধ্যে আমি নোরিসার সাথে একটা বোঝাপড়া করে ফেলেছি। ও বলেছে ব্যাসানিও যদি পোর্সিয়াকে লাভ করতে সক্ষম হন, তাহলে আমাকে বিয়ে করতে তার কোনও আপত্তি নেই। এবার তাহলে দুটো বিয়েই এক সাথে হয়ে যাক?

পোর্সিয়া নোরিসার কাছে জানতে চাইলেন গ্রাসিয়ানোর কথা সত্য কিনা। ঘাড় নেড়ে সায় দিল নেরিসা। সবার আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে গেল।

ব্যাসানিও বললেন, একই দিনে একই গির্জায় দুটো বিয়ে সম্পন্ন হবে। বিশাল প্রাসাদ আনন্দকোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠল।

 

কিন্তু কেউ জানত না এত শিগগির বিষাদের ছায়া নেমে আসবে আনন্দের উপর।

এদিকে আসতে দেখা গেল লরেঞ্জো, জেসিকা আর স্যালারিনোকে। তারা একটা ভীষণ দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছেন ভেনিস থেকে। ব্যাসানিওর হতে একটি চিঠি দিলেন স্যালারিনো। চিঠিটা পড়তে পড়তে কালো হয়ে উঠল ব্যাসানিওর মুখ। মাঝে মাঝেই তিনি শিউরে উঠছিলেন।

পোর্সিয়া জানতে চাইলেন চিঠিটা কীসের। তিনি এখন ব্যাসানিওর ধর্মপত্নী। কাজেই তার ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখের অংশীদার তিনিও।

ব্যাসানিও সবকিছু খুলে বললেন পোর্সিয়াকে — জানালেন শাইলকের কাছে আন্তনিওর ঋণের কথা — যে ঋণের টাকা দিয়ে ব্যাসানিও আজ আসতে পেরেছেন বোলমন্টে। তিনি চিঠির বিষয়বস্তু জানালেন পোর্সিয়াকে। তিনমাস পার হবার পরও আন্তনিওর একটি জাহাজও ফিরে আসেনি। দলিলের বলে পিশাচ শাইলক গ্রেফতার করিয়েছে আন্তনিওকে। সে ডিউকের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছে আন্তনিওর বুকের একপাশ থেকে এক পাউন্ড মাংস যেন তাকে কেটে নেবার অনুমতি দেওয়া হয়।

বোলমন্টের রৌদ্রোজুল আকাশ যেন ছেয়ে গেল দুর্যোগের ঘন মেঘে।

 

০৪.

চিরকাল কারও একভাবে যায়না। সেরূপ আন্তনিওর ভাগ্যও হঠাৎ আচ্ছন্ন হয়ে গেছে দুর্যোগের ঘন মেঘে। তিনমাস আগে তার যেসব জাহাজগুলি নানা সমুদ্রে বিচরণ করছিল, তাদের একটিও ফিরে আসেনি বন্দরে। কোনও জাহাজ হয়তো চিন-সমুদ্রের ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা লেগে জলমগ্ন হয়ে গেছে, কোনটি হয়তো জলদস্যুদের হাতে আটকা পড়েছে বার্বারির উপকূলে, আবার কোনোটি হয়তো বিষুব ঝড়ের তাড়নে ছুটতে ছুটতে কোন গভীর সমুদ্রে অদৃশ্য হয়ে গেছে তা কে জানে। কাজেই যে কুবেরের ভাণ্ডার তার হাতে আসার কথা ছিল, সে সবই গ্রাস করে নিয়েছেন বরুণ দেবতা। ফলে তিনি নিঃস্ব হয়ে বাধ্য হয়েছেন পিশাচ শাইলকের দয়াপ্রার্থী হতে।

বন্ধু ব্যাসানিওর বেলমন্ট যাত্রার ব্যবস্থা করতে আন্তনিও তার ব্যক্তিগত জামিনে তিন হাজার ডুকাট ধার নিয়েছেন শাইলকের কাছ থেকে। চড়া সূদ দিতে রাজিছিলেন আন্তনিও। কিন্তু সততার অভিনয় করে ধূর্ত শাইলক তাকে বিনা সুদেই ধার দেয়, শুধু শর্ত থাকে ধার শোধ দিতে না পারলে আন্তনিওর দেহের যে কোনও জায়গা থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নেবে শাইলক। প্রথম থেকেই অবশ্য ব্যাসানিও আপত্তি করেছিলেন শর্তটিার সম্বন্ধে। কিন্তু তাতে ক্ষোভের ভান করে। পাপিষ্ঠ শাইলক বলেছিল, দেখেছ, কীরূপ সন্দেহপরায়ণ এই খ্রিস্টানেরা! যেহেতু ওরা খারাপ, তাই বিশ্বসুদ্ধ লোককেই খারাপ ভাবে ওরা। আরে! আমি কি সত্যি সত্যিই আন্তনিওর শরীরের মাংস কেটে নেব? মানুষের মাংস কি খাওয়া যায়? ওদিয়ে আমার কী হবে? আমি শুধু দেখতে চাইছিলাম। আমার উপর তোমাদের আস্থা আছে কিনা। যদি আস্থা না থাকে, তাহলে আমার সাথে কারবার করো না।

কিন্তু কোনও আপত্তিতেই কান দেয়নি আন্তনিও। সে বলেছিল, দলিলে তো তিনমাস সময় দেওয়া রইল। আর দু-মাসের মধ্যেই ফিরে আসবে আমার সমস্ত জাহাজগুলি। অন্তত একটা জাহাজ ফিরে এলেও আমি হাসতে হাসতে শোধ দিতে পারব শাইলকের দেন। তাছাড়া আমাদের হাতে দু-মাসের পরিবর্তে সময় রয়েছে তিন মাস। কাজেই কোনও চিন্তা নেই।

কিন্তু বিধির বিধান খণ্ডাবে কে? যেখানে ভয়ের লেশমাত্রও ছিল না। সেখানে আজ ভীষণ ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তিনমাস কেটে গেল, অথচ আজও ধার শোধ দেওয়া হল না। তার স্বজাতি ত্যুবলের সাথে পরামর্শ করে শাইলক আগে থেকেই সরকারের কাছে দরখাস্ত জমা দিয়ে সব কাজ গুছিয়ে রেখেছিল। সময় পার হবার ঠিক শেষ মুহুর্তেই হঠাৎ সরকারি পেয়াদা এসে দেনার দায়ে গ্রেফতার করল আন্তনিওকে।

আন্তনিওর বিচার হবে ডিউকের আদালতে শাইলক প্রার্থনা জানিয়েছে দলিলের শর্ত অনুযায়ী আন্তনিওর বুকের কাছ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নেবার অনুমতি দেওয়া হোক তাকে।

ব্যাপার-স্যাপার দেখে বেজায় চমকে গেল ভেনিসবাসীরা আন্তনিওকে যেমন সবাই আন্তরিক ভালোবাসত, তেমনি শাইলককে ঘৃণা করত না এমন লোক সেদেশে বিরল। সেই পাষণ্ড ইহুদির কাছে যারা ঋণী ছিল, তারা প্রকাশ্যে নিন্দা না করলেও মনে মনে অভিশাপ দিতে লাগল তাকে। কিন্তু সে অভিশাপে শাইলকের আর কি ক্ষতি হবে? কারণ আইন তার পক্ষে আর ভেনিসিও আইন অনুযায়ী খ্রিস্টান ও ইহুদিদের মাঝে কোনও পার্থক্য নেই।

যে শর্ত দলিলে রয়েছে তার অন্যথা হবার উপায় নেই। ডিউক ইচ্ছে করলেও আন্তনিওকে সাহায্য করার কোনও পথ তার সামনে খোলা নেই। একমাত্র শাইলক মুখ না খুললেই এ অবস্থা থেকে পরিত্ৰাণ পাওয়া যেতে পারে। তবে এ যাত্রায় আর রক্ষা নেই আন্তনিওর। শহরের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা একযোগে হত্যে দিয়ে পড়লেন শাইলকের দুয়ারে। স্বয়ং ডিউকই বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন।

সবার মুখে এক কথা–শাইলক যত চড়া সুন্দই চাক না কেন, নগরবাসীরা সবাই চান্দা তুলে মিটিয়ে দিতে প্ৰস্তুত আন্তনিওর ঋণের টাকা, শুধু আন্তনিওকে বীচার অধিকার দিতে হবেশাইলাককে। বুকের পাশ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিলে আর কি কেউ বাঁচার আশা করে?

কিন্তু শইলক তার শর্তে অনড়। আন্তনিওকে শিক্ষা দেবার এমন সুযোগ সে হাতছাড়া করতে রাজি নয়–তা সে নাগরিকবৃন্দ ও ডিউক যতই অনুরোধ করুক না কেন তাকে।

শাইলক কি আর তাদের ধার ধারে?

রূঢ় ভাষায় সে সবাইকে তিরস্কার করে বিদায় দিয়েছে।

একদিন শাইলক কয়েদখানার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। কারারক্ষক দেখতে পেল তাকে। সে তখনই আন্তনিওকে কারাগার থেকে বাইরে নিয়ে এল। — উদ্দেশ্য আন্তনিও নিজে একবার মিনতি জানাক শাইলকের কাছে। তাতে হয়তো শাইলক দয়া করতে পারে তাকে, হয়তো চক্ষুলজ্জাও বোধ করতে পারে।

কিন্তু আন্তনিওকে কারাগারের বাইরে দেখতে পেয়ে বেজায় রেগে ওঠে শাইলক। সে কারাধ্যক্ষকে তিরস্কার করে বলতে থাকে, এই তোমার কাজের নমুনা? এভাবেই সরকারি কাজ করবে তুমি? ও পালিয়ে গেলে তো আমার পাওনা টাকার দফা-রফা। এভাবেই কি তোমরা আইনের মর্যাদা রাখবো?

তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে আন্তনিও বলতে লাগলেন, না, না, শাইলক, এ ভদ্রলোকের কোনও দোষ নেই। আমি পালাব না। শুধু তোমাকে দুটো কথা বলার জন্য আমি ওর অনুমতি চেয়েছিলাম। উনি দয়া করে আমায় সে অনুমতি দিয়েছেন।

শাইলক দাঁত খিচিয়ে জবাব দিল, কী বললে, দুটো কথা? তোমার সাথে কোনও কথা বলতে রাজি নই আমি। মনে নেই, রিয়ালতো পুলের উপর দাঁড়িয়ে সমস্ত বণিকদের সামনে তুমি কতবার আমায় কুকুর বলে গালাগাল দিয়েছ? কুকুরের সাথে মানুষের কোনও কথা থাকতে পারে না। সুযোগ পেলে মানুষ কুকুরকে লাথি মারে তেমনি কুকুরও সুযোগ পেলে মানুষের পায়ে দাঁত বসিয়ে দেয়–এই হল উভয়ের সম্পর্ক। তোমার অনেক লাথি হজম করেছি আমি। এবার তুমি প্ৰস্তুত হও আমার কামড় খাবার জন্য। তোমার কোনও কথা আমি শুনব না। তোমার প্রতি কোনও দয়া নেই। আমার।

এরমধ্যে নাগরিকরা এসে ভিড় জমিয়েছেন সেখানে। আন্তনিওর বন্ধু স্যালারিনোও রয়েছেন তাদের মাঝে আন্তনিও তাকে অনুরোধ করলেন সে যেন বোলমন্টে গিয়ে ব্যাসানিওকে এ ব্যাপারে জানায়। বন্ধুর জন্য আজ তার জীবন বিপন্ন। এ নিয়ে মনে কোনও ক্ষোভ নেই আন্তনিওর। তিনি শুধু এইটুকু চান ব্যাসানিওকে যেন জানিয়ে দেওয়া হয় তার প্রতি কোনও অভিমান বা রাগ নেই আন্তনিওর।

কারারক্ষক বাধ্য হল আন্তনিওকে কারাগারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। আর দেরি না করে স্যালারিনো রওনা দিলেন বেলমন্ট অভিমুখে। রাস্তায় তার সাথে দেখা হয়ে গেল লোরেঞ্জো ও জেসিকার। তিনি তাদের সাথে নিয়ে উপস্থিত হলেন পোর্সিয়ার প্রাসাদে।

 

হঠাৎ যেন নিভে গেল বেলমন্টের আনন্দ-আসরের সব আলো। প্রিয় বন্ধুর এই বিপর্যয়ে দারুণ মর্মাহত হল ব্যাসানিও। পোর্সিয়ার মতো দুর্লভ নারীরত্ন প্রাপ্তিও তার কাছে শূন্যগর্ভ পরিহাস বলে মনে হতে লাগল। আন্তনিওর ছোট্ট চিঠিটা পড়তে পড়তে বেদনায় স্নান হয়ে গেল তার মুখ, বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস। কিছুক্ষণ আগে যে চোখে ছিল আনন্দের আভা, এখন সেখানে দেখা দিল অশ্রু।

স্বামীর এই অবস্থা দেখে তার কারণ জানতে চাইলেন পোর্সিয়া। আন্তনিওর চিঠিটা তাকে পড়ে শুনিয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বললেন ব্যাসানিও, বন্ধুভাগ্যের দিক দিয়ে আমি ছিলাম পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। সে সৌভাগ্য থেকে আমায় বঞ্চিত করলেন নিষ্ঠুর নিয়তি। আন্তনিও মারা গেলে আমার জীবনটাও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। এমনকি তোমার মতো নারীরত্ন পাওয়াটাও সুখী করতে পারবে না আমায়।

সমবেদনার স্বরে বললেন পোর্সিয়া, ব্যাপারটা তুমি আমার খুলেই বল না যাতে আমি সবকিছু বুঝতে পারি। তুমি তো জান আমি তোমার স্ত্রী। তোমার সুখ-দুঃখের অংশীদার। আমি-সবকিছু জানার আমার অধিকার আছে। তুমি আমার কাছে কিছু লুকিও না।

ব্যাসানিও তখন তার জীবন-বৃত্তান্ত বলতে শুরু করলেন পোর্সিয়াকে–দেখ পোর্সিয়া, আমি তোমায় আগেই বলেছি। বর্তমানে আমার কাছে কোনও অর্থ-সম্পদ নেই। এই যে এত জাকজমকের সাথে বন্ধু ও পরিচারক পরিবেষ্টিত হয়ে ভেনিস থেকে বোলমন্টে আসতে পেরেছি তা শুধু ধারের টাকায়। আমার নিজের কোনও টাকা-পয়সা নেই। ভেনিসে আমার যত প্রভাবপ্রতিপত্তি থাক না কেন, সেখানে এমন কেউ নেই যে আমাকে টাকা ধার দেবে। তাই আমার বন্ধু আন্তনিও আমার জামিন হয়েছেন। ভেনিসের নামি বণিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার অন্তত এক ডজন জাহাজ সর্বদাই সমুদ্রে ঘুরে ফিরে বিদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে রত। কিন্তু সে সময় তার কাছে কোনও নগদটাকা ছিল না। তাই তিনি আমায় বললেন, বন্ধু, তুমি টাকা ধার নেবার ব্যবস্থা কর। খালি হাতে কেউ তোমায় টাকা না দিলে আমি নিজে তোমার জামিন হব। আমি জামিনদার হলে কেউ তোমায় তিনহাজার ডুকাট দিতে আপত্তি করবে না। দুৰ্ভাগ্যক্রমে সে সময় প্রতিটি বণিকের জাহাজই বাইরে বাইরে ঘুরছিল। সেগুলি ফিরে না আসা পর্যন্ত কারও হাতে নগদ টাকা নেই। কোথাও মিলছে না তিনহাজার ডুকাট। এ সময় আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন শাইলক নামে এক ইহুদি মহাজন। সে কিন্তু আমার কাছ থেকে কোনও দলিল নিতে আগ্রহী ছিল না। তার বক্তব্য এই যে দলিলটা সম্পাদন করতে হবে আন্তনিওকে। আমার জন্য আন্তনিও তাতেও রাজি হয়ে গেলেন। তখন এক অদ্ভুত প্ৰস্তাব দেয় শাইলক। সে বিনাসুদে আন্তনিওকে টাকা দেবে। যদিও সেটা তার আচরণের পরিপন্থী। সুদ সে নেবে না। কিন্তু তার পরিবর্তে দলিলে অদ্ভুত একটা শর্ত রাখতে চাইল শাইলক। শর্তটা হল তিনমাসের মধ্যে আন্তনিও ধার শোধ দিতে না পারলে তার বুকের পাশ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নেবে শাইলক। এরূপ নৃশংস শর্তে টাকা ধার নেবার ঘোরতর বিরোধী ছিলাম আমি। তোমাকে পাবার জন্য বন্ধুকে এরূপ বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়াটা সঙ্গত মনে করিনি আমি। আমি তাকে বলেছিলাম, বন্ধু, আমি বেলমন্ট যাবার সংকল্প ত্যাগ করছি। শাইলক যে কেমন ভয়ানক লোক তা আমরা উভয়ে জানি। আমার মোটেই সাহসে কুলোয় না। তার সাথে এরূপ শর্তে কারবার করতে।

আন্তনিও কিন্তু মোটেও ভয় পাননি। শুরু থেকেই তিনি বলতেন, ইহুদিটা যতই পাপিষ্ঠ হোক না কেন, সে আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ আমরা তিনমাস সময় পাচ্ছি। আর দুমাসের মধ্যেই জাহাজগুলি বাণিজ্য সম্ভারে বোঝাই হয়ে বন্দরে ফিরে আসবে। অতএব ওই ভয়ানক প্ৰস্তাবের খপ্পরে পড়ার কোনও আশঙ্কা আমার নেই। এতে যদি আমরা ভয় পেয়ে ধার না নিই, তাহলে কোনওদিনই তোমার পক্ষে বেলমন্ট যাওয়া সম্ভব হবে না। পোর্সিয়াকে পাবার কোনও চেষ্টাই তুমি করতে পারবে না। কাজেই ওই শর্তে ধার নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় রইল না।

এভাবে সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করে ব্যাসানিও বলতে লাগলেন, আন্তনিওর দৃঢ়তার ছোয়াচ এসে লাগল আমার হৃদয়েও — রাজি হয়ে গেলাম আমি। দলিল তৈরি হবার পর তাতে সই করে তিন হাজার ডুকাট ধার নিলেন আমার বন্ধু। সেই টাকার জোরে আজ আমি স-পারিষদ তোমার সামনে দাঁড়িয়ে। ভগবান এখানে সদয় হয়েছেন আমার প্রতি। আমি পেয়েছি তোমাকে। কিন্তু অন্যদিকে হেরে গেছি আমি। আমার মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্ৰপাত হয়েছে। পাপিষ্ঠ শাইলকের অভিযোগে আজ কারারুদ্ধ হয়েছেন বন্ধু আন্তনিও।

ব্যাকুল স্বরে জানতে চাইলেন পোর্সিয়া, কীভাবে এমনটি হল? তার এতগুলি জাহাজ…?

নৈরাশ্যজনিত স্বরে জবাব দিলেন ব্যাসানিও, তার এতগুলি জাহাজের একটিও ফিরে আসেনি বন্দরে। সমুদ্রে যেতে যেতে কোনটি জলে ডুবেছে, কোনটি জলদসু্য লুট করেছে আবার কোনটি বা ঝড়ের দাপটে অদৃশ্য হয়ে গেছে অজানা সমুদ্রে। তিনমাস আগে যিনি ছিলেন কোটি কোটি টাকার মালিক, আজ তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্ব। ধার শোধ দেবার ক্ষমতা নেই তার। এদিকে দলিল অনুযায়ী তিনমাস শেষ হয়ে গেছে।

পোর্সিয়া বললেন, তিনি তো মাত্র তিনহাজার ডুকাটি ধার নিয়েছেন। ওই টাকাটা আমরা শোধ দিয়ে দিলেই তো ইহুদি বাধ্য হবে তাকে ছেড়ে দিতে।

কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন স্যালোরানো। তিনি বিমৰ্ষভাবে বললেন, কিন্তু মহোদয় তা সম্ভব নয়। ভেনিসের বণিকেরা সবাই চান্দা করে ওই টাকাটা শোধ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে রাজি নয় শাইলক। তার বক্তব্য দলিলের মেয়াদ শেষ হবার দরুন সে টাকা নেবে না। শাস্তি স্বরূপ দলিলে যে শর্তের উল্লেখ আছে এখন সে তাই চায় অর্থাৎ আস্তোনিওর বুকের একপাশ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নেবে সে।

আশ্চর্য হয়ে পোর্সিয়া বললেন, সে কী কথা? মানুষ এমন নৃশংস হতে পারে যে দেনার দায়ে কারও শরীর থেকে মাংস কেটে নেবে? আমার মনে হয়। ভয় দেখিয়ে বেশি টাকা আদায়ের মতলবে আছে সে। যাই হোক, তুমি এখন ভেনিসের পথে রওনা দাও ব্যাসানিও। আমি তোমাকে প্রচুর অর্থ দিচ্ছি। যত টাকাই লাগুক, তুমি শাইলককে তা দিয়ে আন্তনিওকে মুক্ত করে আনবে। আমি আর তুমি অভিন্ন। কাজেই আমার টাকা তুমি তোমার বন্ধুর জন্য ব্যয় করবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে। বরঞ্চ সেটা না করলেই অন্যায় হবে। তোমার জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি যদি আস্তানিওর বিনিময়ে ক্রয় করতে হয়, তাহলে কোনও দিন সুখী হবেন না তুমি।

স্থির হল সেই মুহূর্তে ব্যাসানিও ও পোর্সিয়া এবং স্যালারিনো ও নেরিসা — গির্জায় গিয়ে অনাড়ম্বরভাবে বিয়েটা সেরে ফেলবেন। বিয়েটা তো আগে হয়ে যাক, জাকজমকের কথা পরে ভাবা যাবে। বিয়ের পর আর দেরি না করে ব্যাসানিও চলে যাবেন ভেনিসে — সাথে থাকবে শুধু গ্রাসিয়ানো আর প্রচুর অর্থ।

এভাবেই সব কিছু নির্বিঘ্নে সমাধা হয়ে গেল। গ্রাসিয়ানোকে সাথে নিয়ে ব্যাসানিও রওনা হলেন ভেনিসের পথে। তার বন্ধু-বান্ধব ও সহচরেরা সবাই রয়ে গেল বেলমন্টের প্রাসাদে। এদের মধ্যে ছিল লোরেঞ্জো এবং তার নব বিবাহিতা পত্নী শাইলকের কন্যা জেসিকা।

ব্যাসানিও চলে যাবার পর লোরেঞ্জো ও জেসিককে ডেকে বললেন পোর্সিয়া, তোমাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। যদি তোমরা সেটা রক্ষা কর, তাহলে খুবই উপকার হবে আমার।

এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন তাঁরা দুজনে।

পোর্সিয়া বলতে লাগলেন, আমি স্থির করেছি। যতদিন পর্যন্ত আমার এবং নেরিসার স্বামী ফিরে না আসেন ততদিন পর্যন্ত দু-মাইল দূরের একটা মঠে গিয়ে আমরা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব যেন আমাদের স্বামীরা নিরাপদে ফিরে আসেন। আমি চাই ততদিন পর্যন্ত তোমরা এই গৃহস্থলীর ভার নাও। তোমাদের দুজনকে আমার লোকজনেরা প্ৰভু ও প্রভুপত্নী বলে মেনে নেবে। আশা করি এতে তোমাদের কোনও আপত্তি নেই।

ওদের আপত্তি করার কীই বা আছে? নিরাশ্রয় অবস্থায় অযাচিতভাবে এরূপ একটা সুযোগ পেয়ে যাওয়ায় ওরা তো বর্তে গেল।

কর্মচারী আর দাস-দাসীদের সবাইকে ডেকে পোর্সিয়া জানিয়ে দিলেন তার আদেশ; তারপর তিনি তার নিজের ঘরে গিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিটাতে মোহর এটে তিনি বোলথাজার নামে একজন পুরোনো চাকরকে ডেকে গোপনে তাকে চিঠিটা দিলেন। এভাবে তাকে নির্দেশ দিলেন :

ডাক্তার বেলারিও নামে আমার এক আত্মীয় আছেন পাদুয়া নগরে। তিনি আইনের ডাক্তার। তার কাছে তুমি এই চিঠিটা নিয়ে যাবে। কিছু কাগজপত্র ও পোশাক তিনি তোমাকে দেবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি সেগুলি আমার কাছে নিয়ে আসবে। পথে কোথাও দাঁড়াবে না। বেগবান ঘোড়ায় চড়ে তুমি যাবে আর আসবে। তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব মিরাজ নদীর খেয়াঘাটে। ওই কাগজপত্র ও পোশাকগুলি তুমি সেখানে আমায় দেবে। আমার অনুরোধ, ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে।

ডাক্তার বেলারিও একজন নামি আইনবিদ। জটিল মামলা পরিচালনার জন্য দেশ-বিদেশের নানা জায়গা থেকে ডাক আসে তার। তার মতামতকে প্রামাণ্য বলে মেনে নেওয়া হয় আইনঘটিত জটিল প্রশ্নে। শাইলক-আন্তনিও মামলায় সাহায্য করার জন্য সম্প্রতি তাকে নিয়োগপত্র দিয়েছেন। ভেনিসের ডিউক। সে ব্যাপারে যথেষ্ট পড়াশুনো করে ভেনিস যাত্রার আয়োজন করছেন বেলারিও। এমন সময় পোর্সিয়ার চিঠি নিয়ে বোলথাজার এসে হাজির তার কাছে।

পোর্সিয়ার চিঠি পড়ে খুবই অবাক হলেন বেলারিও। যদিও তিনি তার এই সুন্দরী আত্মীয়ার নানা খামখেয়ালের সাথে পরিচিত, কিন্তু এমন একটা ব্যাপার। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। যাই হোক, পোর্সিয়ার অনুরোধ তিনি অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। তিনি বেলথাজারের হাতে একপ্রস্থ করে উকিল ও মুহুরির পোশাক এবং আইনের বই দিয়ে দিলেন। তাছাড়া বোলথাজারের মারফত তিনি এ মামলার কাগজপত্রও যথাসময়ে পাঠিয়ে দিলেন পোর্সিয়ার কাছে।

মিরাজ নদীর খেয়াঘাটে পৌঁছে বোলথাজার দেখতে পেল সেখানে তার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছেন কর্ত্রী ঠাকুরানি। বেলথাজারের কাছে বেলারিওর দেওয়া জিনিসপত্রগুলি দেখে মনে কিছুটা স্বস্তি এল পোর্সিয়ার। তিনি তখনই নোরিসাকে নিয়ে ভেনিসে রওনা দিলেন।

সব দিক দিয়েই পোর্সিয়ার বিশ্বস্ত ছিল নোরিসা। সে পোর্সিয়ার কাছে জানতে চাইল, আচ্ছা! ঠাকুরানি, এত তোড়জোড় কীসের জন্য। আমি বুঝতে পারিছ না। এই পুরুষের পোশাকগুলি আমাদের কোন কাজে আসবে? আপনি যদি সবকিছু খুলে বলেন তাহলে স্বস্তি পাই। আর যদি সত্যিই আমাদের ভেনিসে যাবার প্রয়োজন হয়, তাহলে তো আমরা অনায়াসেই স্বামীদের সাথে যেতে পারি।

পোর্সিয়া উত্তর দিলেন, না, তা কোনও মতেই সম্ভব নয়। স্বামীরা আমাদের উদ্দেশ্য আগে থেকে জানতে পারলে সব কাজ পণ্ড হয়ে যাবে।

এবার অবাক হবার পালা নোরিসার। অনেক চাপাচাপির পর পোর্সিয়া বললেন, পুরুষের ছদ্মবেশে আমরা ভেনিসে চলাফেরা করব। –প্রয়োজনে ডিউকের বিচারকক্ষেও প্রবেশ করব –অবশ্য বেলারিওর প্রতিনিধি হিসেবে। আগে থেকে স্বামীরা এসব জানতে পারলে হয়তো উত্তেজনা বশে সবকিছু ফাস করে দেবেন। তখন আর কোনও সার্থকতা থাকবে না। এ ছদ্মবেশের। আমাদের আসল পরিচয় সবাই জেনে যাবে। আর মাঝপথে পণ্ড হয়ে যাবে আমাদের আসল কাজ।

নেরিস বলল, ধরে নেওয়া যাক স্বামীরা আমাদের গোপন রহস্য ভেদ করতে পারল না। তবুও কিন্তু ভয় রয়ে যায় তাদের চোখে ধরা পড়ার। কারণ নারী-পুরুষের আচরণের মধ্যে এমন স্বাতন্ত্র্য রয়েছে যা সহজে নজর এড়াবার নয়।

উত্তরে পোর্সিয়া বললেন, তোমার কথাটা যুক্তিসঙ্গত। কাজেই খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে আমাদের। কোনও মতেই ধরা পড়া চলবে না। পুরুষদের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে হবে। কারণ পুরুষদের পদক্ষেপে নারীদের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা লাগে। হাত-পা ছুড়ে সব সময় চেঁচিয়ে কথা বলব আমরা — আলোচনার বিষয়বস্তু হবে শুধু লড়াই আর খুনোখুনি। কোমরে একটা লম্বা ছোরা ঝোলানো থাকবে। আর নানারূপ কাল্পনিক গল্প করব যার তার সাথে। শুনে সবাই ভাববে। এরা বোধহয় সবে স্কুলের গণ্ডি পার হয়েছে। কারণ শৈশব ছেড়ে যারা যৌবনে প্রবেশ করতে চলেছে তারাই সচরাচর এরূপ বাচাল হয়ে থাকে।

এভাবে নেরিসাকে উপদেশ দিতে দিতে শেষমেশ ভেনিসে এসে পৌঁছুল পোর্সিয়া। সেখানে তার নিজের এবং আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িও ছিল। কিন্তু সেগুলির কোনওটাতে না উঠে আশ্রয় নিলেন এক অভিজাত হোটেলে। সেখান থেকেই তারা শাইলক বনাম আন্তনিও মামলার খবরাখবর নিতে লাগলেন। রাস্তায় দু-এক বার ব্যাসানিও এবং গ্রাসিয়ানোর সাথে দেখাও হয়ে গেল। কিন্তু তারা নিজ নিজ পত্নীকে চিনতে পারলেন না। আর এরাও তাদের পরিচয় গোপন করলেন।

 

০৫.

ভেনিসের সর্বোচ্চ আদালত আজি লোকে লোকরণ্য। বিচারাসনে বসে রয়েছেন স্বয়ং ডিউক। দর্শকদের জন্য নির্দিষ্ট আসনে বসে রয়েছেন ভেনিসের বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তাদের সবার মুখে রয়েছে বিষন্নতার ছাপ। শ্যইলক আগেই খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছে — ভেনিসের আইন যে শুধুমাত্র মুখের কথা নয়, প্রকৃতই আইন তা দেখতে চাই আমি। আইন অনুযায়ী আমি আন্তনিওর এক পাউন্ড মাংসের অধিকারী। তা না পেলে আমি মনে করব এখানকার আইন আইন নয়— শুধু প্ৰহসন মাত্র। আর পৃথিবীর লোকেরাও এটা স্বীকার করবে এক কথায়।

ভেনিসের পক্ষে সত্যিই এ খুব সাংঘাতিক কথা। কারণ সারা পৃথিবী জুড়েই ভেনিসের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। আর নানা কারণে ভেনিসের লোকদেরও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে দীর্ঘদিন বাস করতে হয়। সে কারণে ভেনিসের ন্যায়পরায়ণতার প্রতি বিদেশির আস্থা না থাকলে তারা এখানে আসতে চাইবে না এবং এখানকার লোকেরাও বিদেশে গিয়ে ঘৃণা এবং পরিহাসের পাত্ৰ বলে বিবেচিত হবে। সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষুন্ন হবে। এ কথা মনে রেখে ভেনিসীয় আইনে এখানকার বাসিন্দা এবং বিদেশির জন্য সমান নাগরিক অধিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজেই কোনও অজুহাতেই শাইলকের দাবি অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা নেই বিচারকর্তাদের।

আন্তনিওকে ডেকে এনে গভীর সমবেদন জানালেন ডিউক। আন্তনিও তার উত্তরে বললেন, মাননীয় ডিউক! আপনার দয়া তুলনাহীন। আমি শুনেছি আমার মতো একজন সামান্য ব্যক্তির প্রাণরক্ষার জন্য আপনি স্বয়ং আবেদন করেছেন শাইলকের কাছে। শুধু আপনি কেন, নগরবাসীরাও সমবেতভাবে ওই ইহুদির কাছে আমার জন্য করুণা ভিক্ষা করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। যার হৃদয়ে দয়া বস্তুটার অভাব, তার কাছে দয়া ভিক্ষা করে লাভ কী? আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আপনি ও নগরবাসীরা আমার জন্য যা করেছেন। সেজন্য আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

এবার ডিউক ডেকে পাঠালেন শাইলাককে। সে বিচারকক্ষে প্রবেশ করল। তার হিংস্র-কুটিল দৃষ্টি, ললাটের স্পষ্ট রেখা, কোমরে বাধা একটা লম্বা ছোরা — দেখে মনে হচ্ছিল ছোরাটা যেন আন্তনিওর রক্ত পানের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।

শাইলককে উদ্দেশ করে ডিউক বললেন, এতদিন ধরে আমরা তোমার কাছে আবেদন জানিয়েছি, যাতে তুমি আন্তনিওর প্রতি করুণা প্ৰদৰ্শন কর। কিন্তু তুমি আমাদের সমস্ত আবেদননিবেদন রুক্ষভাবে অগ্রাহ্য করে স্পষ্টভাষায় জানিয়েছ আইন অনুযায়ী যেন আন্তনিওর শরীরের এক পাউন্ড মাংস কেটে তোমায় দেওয়া হয়। তুমি যে সত্যিই এত কঠোর হতে পার তা এখনও পর্যন্ত আমরা বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এরূপ নৃশংসতার ভান করছ। আর আমরা এও আশা করি যে চরম মুহুর্তে তুমি দয়া প্রদর্শন করে। বিস্ময়ে আমাদের হতবাক করে দেবে। এখন সেই চরম মুহূর্ত এসে গেছে। আর অপেক্ষা করার সময় নেই। তুমি যদি এখনও দয়া প্রদর্শন না কর, তাহলে বাধ্য হয়ে আদালতকে বলতে হবে যে আন্তনিওর দেহের এক পাউন্ড মাংস কেটে নেবার অধিকার তোমার রয়েছে। আমি নিজে এবং নগরবাসীদের পক্ষ থেকে তোমার কাছে মিনতি জানাচ্ছি। যদি সত্যিই তুমি দয়া দেখাতে চাও, তাহলে আর দেরি করোনা।

ডিউকের কথা শুনে খোঁকি কুকুরের মতো দাঁত বের করে বলতে লাগল শাইলক, কী বললেন, দয়া? বাস্তবে ও শব্দটার কোনও অস্তিত্ব আছে কি? আপনারা নিজেরা কখনও মমতা দেখিয়েছেন? বাজার থেকে টাকা দিয়ে কিনে আনা দাসদাসীদের প্রতি আপনারা কখনও দয়া দেখিয়েছেন–সদয় ব্যবহার করেছেন তাদের প্রতি? কঠোর পরিশ্রম করা সত্ত্বেও তারা পেট পুরে খেতে পায় না, শুতে পায় না। পশুর মতো জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় তারা। হে ভদ্রমহোদয়গণ! আন্তনিওর প্রতি আমার মনোভাবও সেইরূপ। তিনহাজার ডুকাটি দিয়ে আমি ওর শরীরের এক পাউন্ড মাংস কিনেছি। এবার আমার পাওনাটা আমায় নিতে দিন–দেশের আইনের কাছে এটুকুই আমার আশা। কারণ এ দেশের আইনে ধনী-দরিদ্র, খ্রিস্টান-ইহুদিতে কোনও পার্থক্য নেই। —সবার সমান অধিকার! আমার পাওনা এক পাউন্ড মাংস আমি পেতে চাই। অনেকে জানতে চেয়েছেন মাংস দিয়ে আমি কী করব। সে আমি যাই করি না কেন, এরূপ অবাস্তর প্রশ্ন করার অধিকার আপনাদের কারও নেই।

এভাবে একটানা বলার পর কিছুক্ষণ ক্লান্ত হয়ে থামল শাইলক। আদালতে আন্তনিওর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্যাসানিও। এই সুযোগে তিনি বলে উঠলেন, দেখ শাইলাক! তোমার পাওনা তিনহাজার ডুকাটের তিনগুণ অর্থ আমি তোমায় ফেরত দিচ্ছি। এই নাও সেই অর্থ। এবার বল অর্থহীন এক পাউন্ড মাংসের জন্য তুমি কি নয় হাজার ডুকাট ছেড়ে দেবে?

কর্কশ স্বরে উত্তর দিল শাইলক, একটা ইদুর আছে আমার বাড়িতে। সে আমার জামা-কাপড় কেটে ফেলে, খাবার-দাবার নষ্ট করে দেয়, এমনকি হাত-পাও কামড়ে দেয়। এই ইদুরটা না মরা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। ইদুরটাকে মারার জন্য প্রয়োজনে আমি বিশহাজার স্বর্ণমুদ্রাও দিতে রাজি। কারণ ইদুরটা বেঁচে থাকার অর্থই আমার মৃত্যু। ওই টাকাটা আমার জীবনের দাম — ইঁদুরের মাংসের দাম নয়।

বাধা দিয়ে আন্তনিও বললেন, কেন ওই জানোয়ারটার সাথে বাগবিতণ্ডা করে নিজেকে ছোটো করছি ব্যাসানিও? ও মানুষ হলে না হয় ওর কাছে মানবিকতার আবেদন করা যেত। ওর শরীরের মধ্যে যে আত্মা রয়েছে আমার মনে হয় সেটা নেকড়ের আত্মা।

নিজের কোমরে ঝোলানো ছোরাটায় হাত দিয়ে শাইলক বলল, এই নেকড়ের দাঁত যখন তোমার বুকে বিধবে, তখন আরও দৃঢ় হবে তোমার বিশ্বাস।এরপর ডিউককে সম্বোধন করে লালল, অযথা কেন সময় নষ্ট করছেন মহামান্য ডিউক? এবার তাড়াতাড়ি বিচারটা সেরে বাড়ি ফিরে যান, আর আমি বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করি।

ডিউক বললেন, পদুয়ার ডাক্তার বেলারিওকে আমি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম বিচার চলাকালীন আইনের ব্যাখ্যা দেবার জন্য। কারণ এরূপ আশ্চর্যজনক মামলা ভেনিস তো দূরের কথা, পৃথিবীর কোনো আদালতেও বোধহয় আজ পর্যন্ত হয়নি। কাজেই খুব সাবধানতার সাথে বিচার করতে হবে। যে মামলার কোনও নজির নেই, সেখানে বিচারের সময় পদে পদে ভুল হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। এজন্যই আমি ডেকে পাঠিয়েছি দেশের সর্বোচ্চ আইন বিশারদ বেলারিওকে। কেউ দেখত ডাক্তার বেলারিও আদালতে এসেছেন কিনা। যদি তিনি না এসে থাকেন, তাহলে তার অপেক্ষায় আজ আদালতের কাজ মুলতবি রাখতে বাধ্য হব আমি।

ডিউকের আদেশে একজন রক্ষী বেরিয়ে গেল। ডাক্তার বেলারিওর খোঁজে। শইলকও রেগেমেগে তার অসন্তোষ প্রকাশ করতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে রক্ষী ফিরে এল সাথে একজন যুবককে নিয়ে। যুবকটির বেশভূষা দেখলে মনে হয় সে কোনও আইনজীবীর কেরানি।

আসলে এই কেরানিটি হল ছদ্মবেশিনী নেরিস। বেলারিও দুটি পোশাক পাঠিয়েছিলেন বেলথাজারের মারফত। পোশাক দুটির মধ্যে একটি উকিলের এবং অপরটি মুহুরির। নেরিসার পরনে ছিল ওই মুহুরির পোশাক। সেই পোশাকে নোরিসাকে এমন মানিয়েছিল যে তার স্বামী গ্রাসিয়ানো পর্যন্ত তাকে চিনতে পারেননি।

ডিউককে সসম্রামে অভিবাদন জানিয়ে নেরিস বলল, হঠাৎ কঠিন অসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন ডা. বেলারিও। সে কারণে মহামান্য ডিউকের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও ভেনিসে আসতে পারেননি তিনি। পরিবর্তে একজন সুদক্ষ সহকারীকে পাঠিয়েছেন। ডিউককে সাহায্য করার জন্য। আইনবিষয়ক যে কোনও প্রশ্ন উনি সুন্দরভাবে সমাধান করে দেন। তার উপর যথেষ্ট আস্থা আছে ডা. বেলারিওর। তার বক্তব্য তিনি এই চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছেন— বলেই বেলারিওর চিঠিটা ডিউকের সামনে পেশ করলেন নেরিসা।

ডিউক চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন–মাননীয় ডিউক মহোদয় সমীপেষু, আপনার আদেশ অনুযায়ী ভেনিসে গিয়ে শাইলক-আন্তনিওর মামলার দায়িত্ব নেবার ইচ্ছা! আমার খুবই ছিল এবং সেজন্য আমি যথেষ্ট প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় আমার পক্ষে ভেনিস যাত্রা মোটেই সম্ভবপর নয়।

সামান্য কিছুদিন আগে রোম থেকে আমার একজন সমব্যবসায়ী বন্ধু আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। বয়স কম হলেও তিনি আইনবিদ্যায় যথেষ্ট পারদশী। শাইলকের মামলার সমস্ত ঘটনাটা আমি তাকে জানিয়েছি। এ ব্যাপারে আলোচনা, পরামর্শ যা করা দরকার তা আমরা উভয়ে মিলে করেছি। আমি যেতে অপারগ হওয়ায় তাকে অনুরোধ করেছি। তিনি যেন আমার প্ৰতিনিধি স্বরূপ ভেনিসে গিয়ে আইনি ব্যাপারে। আপনাকে সাহায্য করেন।

আমার উক্ত বন্ধু ডা. বেলথাজার সম্মত হয়েছেন আমার প্রস্তাবে। তিনি এই চিঠি আপনার কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার অনুরোধ, বয়স কম বলে আপনি তাকে অবহেলা করবেন না। আমার চেয়ে আইনের জ্ঞান তার কোনও অংশে কম নয়। এ মামলার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিমত আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে আপনি একজনের জায়গায় দুজন আইনজ্ঞের সাহায্য পেতে চলেছেন। আর বেশি কিছু বলার নেই।

ইতি
আপনার একান্ত অনুগত
ডা. বেলারিও।

চিঠিটা পড়ার পর ডিউক উৎসুক হয়ে উঠলেন, এই নবীন আইনজ্ঞকে দেখার জন্য। তিনি নেরিসাকে বললেন, ওকে, তোমার প্রভু ডাক্তার বেলথাজার কি আদালতে এসেছেন?

নেরিস উত্তর দিলেন, হ্যাঃ মহামান্য ডিউক, তিনি আদালতের বাইরে অপেক্ষা করছেন। আপনি যদি সত্যিই এ মামলা পরিচালনার ভার তাকে দিতে ইচ্ছক হন, তাহলে আমি এখনই গিয়ে তাকে নিয়ে আসতে পারি।

ডিউক তখনই আদালতের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মচারীকে নেরিসার সাথে পাঠিয়ে দিলেন এই তরুণ আইনজীবীকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে আসার জন্য। কিছুক্ষণ বাদে তাদের সাথে ছদ্মবেশিনী পোর্সিয়া আদালতকক্ষে প্রবেশ করলেন।

পোশাক-আশাকে পোর্সিয়াকে আইনজীবী ছাড়া অন্য কিছু মনে ভাবার অবকাশ ছিল না। তিনি তার তরুণ্য ও রমণীসুলভ সৌন্দর্যকে এমন গভীরতার আড়ালে ঢেকে রেখেছিলেন যে তার স্বামী ব্যাসানিও পর্যন্ত তাকে চিনে উঠতে পারেননি।

আদালত কক্ষে প্রবেশ করে বোলথাজাররূপী পোর্সিয়া যথারীতি অভিনন্দন জানালেন ডিউককে। তারপর উপস্থিত জনসাধারণকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে ডিউককে বললেন, এই মামলা সম্পর্কে যা কিছু আমার জানার ছিল, তা আমি ইতিমধ্যেই জেনে নিয়েছি আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু ও উপদেষ্টা ডাক্তার বেলারিওর কাছ থেকে। এখন আমি জানতে চাই কে আন্তনিও আর কেইবা শাইলক। ডিউক নিজেই দেখিয়ে দিলেন আন্তনিও এবং শাইলাককে। তারপর মামলা শুরু করার নির্দেশ দিলেন বোলথাজারকে।

শাইলককে ডেকে পোর্সিয়া বললেন, মহাশয়, মামলাটি সত্যিই নতুন ধরনের। তবে নতুন হলেও এর মধ্যে আইনগত কোনও ত্রুটি নেই। কাজেই এটিকে বিচারের জন্য গ্ৰহণ করতে কোনও বাধা নেই।

শাইলক আনন্দে বলে উঠল, বা! আপনি তো দেখছি ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন!

পোর্সিয়া বলতে লাগলেন, একটা বিশেষ শর্তে আন্তনিও আপনার কাছ থেকে তিনহাজার ডুকটি ধার নিচ্ছেন— এভাবে স্বেচ্ছায় একটা দলিল সম্পাদন করে দিয়েছেন আন্তনিও। শর্ত এই–তিন মাসের মধ্যে যদি আন্তনিও ধার শোধ করতে না পারেন তাহলে… যাই হোক, ও ব্যাপারে আমি পরে আসছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সত্যিই কি আন্তনিও ধার পরিশোধ করতে অক্ষম?

সাথে সাথেই বলে উঠলেন ব্যাসানিও, মাত্র তিন হাজার কেন, ওর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ দেবার জন্য তৈরি হয়ে এসেছি আমি।

অধীরভাবে বলে উঠল শাইলক, টাকা দিলেও তা নিচ্ছে কে? শর্তের সময় পার হয়ে গেছে।

গম্ভীর স্বরে বললেন পোর্সিয়া, সত্যিই তো! শর্তের সময়-সীমা পার হয়ে গেছে। কাজেই দলিলের শর্ত অনুযায়ী আন্তনিওর দেহ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নেবার অধিকারী শাইলক। তিনি যদি স্বেচ্ছায় তার দাবি ত্যাগ না করেন, তাহলে তাকে বাধা দেবার কারও অধিকার নেই!

উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল শাইলক, বা! এই তরুণ বয়সে আপনি তো আইনটা ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। ঠিক যেন দ্বিতীয় দানিয়েল। দানিয়েলের পর এমন বিজ্ঞ বিচারক আর দেখা যায়নি পৃথিবীতে।

পোর্সিয়া বলতে লাগলেন, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার করলে শাইলককে অনুমতি না দেবার কোনও কারণ নেই আদালতের। তিনি অনায়াসেই আন্তনিওকে মেরে ফেলতে পারেন তার শরীরের মাংস কেটে নিয়ে। এক্ষেত্রে শাইলক দয়া প্ৰদৰ্শন না করলে কোনও উপায় নেই। কাজেই দয়াবান হতে হবে শাইলাককে।

সাথে সাথেই রেগে যায় শাইলক, বলে, এমন কোনও আইন আছে যা আমাকে দয়া প্ৰদৰ্শন ফরাতে বাধ্য করতে পারে?

পোর্সিয়া বললেন, এখানে বাধ্য করার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। দয়া জিনিসটা স্বতঃস্ফুর্ত। দুঃখীর দুঃখ হরণ, তাপিতকে শাস্তি দেওয়া, হিংসা ও ক্রোধের আগুনকে নিভিয়ে দেবার শক্তি একমাত্ৰ দয়াতেই আছে। রাজদণ্ডের চেয়েও এ অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। দয়া যে করে এবং যে পায়, উভয়েই সমান সুখী হয়। কোনও সন্দেহ নেই আমরা সর্বদা ন্যায় বিচারের প্রশংসা করি। দয়ার স্পর্শে যখন ন্যায়ের কঠোরতা কোমল হয়ে আসে, তখন সেটাই হয়ে ওঠে ভগবানের মহৎ বিচার। আচ্ছা শইলক, দয়া প্রদর্শনের এমন সুযোগ পেয়ে তুমি কি তার সদ্ব্যবহার করতে চাও না?

শাইলকের ধৈর্য আর বাঁধ মানে না। সে অধীর হয়ে বলে ওঠে, অতশত কথার ধার ধারি না আমি। আমায় বলুন। এ ব্যাপারে আদালতের রায় কী?

যেন হতাশ হয়েছেন এভাবে পোর্সিয়া বললেন, তাহলে আর কী হবে? এবার আপনি কি কিছু বলবেন আন্তনিও?

অবিচলিত কণ্ঠে বললেন আন্তনিও, আমার বক্তব্য এই যে এরূপ বেদনাদায়ক দৃশ্য যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই মঙ্গল। শাইলাক আমার প্রাণ না নিয়ে ছাড়বে না। আইন ওরই পক্ষে। কাজেই আইনমাফিক কাজ হোক। বন্ধু ব্যাসানিও, তুমি ভেব না যে আমি মরতে ভয় পাচ্ছি। আমার মতো নিজস্ব হয়ে অপরের গলগ্রহ স্বরূপ বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই আমার কাম্য। গরিব লোকের কষ্টের শেষ নেই এ পৃথিবীতে — বিশেষ করে ধনী থেকে যে হঠাৎ গরিবে পরিণত হয়েছে। তার ভাগ্যে রয়েছে শুধু দুঃখ আর লাঞ্ছনা। আমার এটুকুই সাস্তুনা যে এসব থেকে আমি মুক্তি পেতে চলেছি। তুমি যে মনোমতো স্ত্রী পেয়েছ তাতে আমি খুবই খুশি হয়েছি। ঈশ্বরের কাছে আমার প্রার্থনা এই যে আমার মৃত্যু যেন তোমাদের বিবাহিত জীবনের সুখের পথে বাধা হয়ে না। দাঁড়ায়।

আন্তনিওর কথা শুনে চোখের জল আর বাধা মানে না ব্যাসানিওর। তিনি কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠেন, ঈশ্বর জানেন যে আমার স্ত্রী বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারীরত্ন। তোমাকে বাঁচাবার জন্য যদি তার মতো নারীরত্নকেও জীবনের মতো পরিত্যাগ করতে হয় তাতেও আমার কোনও দুঃখ নেই। ব্যাসানিওর খেদোক্তি শুনে হেসে মন্তব্য করলেন তরুণ আইনজীবী, আপনার পরম সৌভাগ্য যে এসময় আপনার স্ত্রী এখানে নেই। নইলে এতবড়ো উদারতা দেখাবার সাহস আপনি পেতেন না।

গ্রাসিয়ানোও বা কম যান কীসে। তিনি বললেন, স্বৰ্গে গিয়ে যদি আমার স্ত্রী দেবদূতদের অনুনয় করে তাদের হৃদয় এমনভাবে আদ্র করে দিতে পারতেন যাতে করুণাবশত তারা এই ইহুদিটার হৃদয় কোমল করে দিতে পারত, তাহলে এই মুহুর্তে স্ত্রীকে স্বৰ্গ পাঠাতেও আমার কোনও আপত্তি নেই।

এমন একটা মস্তব্যের জবাব না দিয়ে কি থাকতে পারে কেরানিরূপী নেরিসা, বাড়িতে স্ত্রীর সামনে বসে এরূপ মন্তব্য করলে এতক্ষণে আপনাদের মধ্যে ঝগড়া বেধে যেত।

এসব কথাবার্তাগুলি যেন শাইলকের কানে বিষ ঢালিছিল। সে নিজের মনে বলতে লাগল, খ্রিস্টান স্বামীরা সত্যিই অদ্ভুত ধরনের। এরচেয়ে আমার মেয়ে যদি একটা খুনে-ডাকাত ইহুদিকেও বিয়ে করত, তাহলে সুখী হবার সম্ভাবনা ছিল তার।

শাইলক প্রকাশ্যে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল, আজ কি আদালতের কোনও কাজ-কর্ম হবে না। এরূপ রসিকতা চলতে থাকবে? যদি কোনও কাজকর্ম নাই হয় তাহলে শুধু শুধু বসে থেকে লাভ কী? তার চেয়ে ভেনিসের আইনের গুণগান করতে করতে বাড়ি চলে যাওয়াই শ্রেয়।

অনন্যেপায় হয়ে বলে উঠলেন পোর্সিয়া, আদালত তাহলে এই রায় দিচ্ছে যে আন্তনিওর বুকের কাছ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নেবেন শাইলক ও ভালো কথা, আপনি কি একজন ডাক্তার সাথে নিয়ে এসেছেন শাইলক?

আশ্চর্য হয়ে বললেন শাইলক, ডাক্তার! আবার ডাক্তার কেন?

সাথে সাথেই জবাব দিলেন পোর্সিয়া, মাংস কেটে নেবার পর আন্তনিওর মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। সেরূপ পরিস্থিতিতে ডাক্তারের সাহায্যের প্রয়োজন আছে বইকি।

শাইলক বললেন, কিন্তু দলিলের কোথাও তো লেখা নেই যে অস্ত্ৰোপচারের সময় ডাক্তার রাখতে হবে?

না, দলিলে অবশ্য তা লেখা নেই, বললেন পোসিয়া। তবে মানবতার খাতিরে আপনার একজন ডাক্তার রাখা উচিত।

ও সব মানবতা-ফানবতার কোনও দাম নেই। আমার কাছে–বললেন শাইলক, দলিল অনুযায়ীই কাজ হবে। ওহে আন্তনিও! তুমি প্ৰস্তুত তো! আমি এবার তোমার মাংস কাটব।

পোর্সিয়া বললেন, না, আর কিছু করার নেই। এবার শাইলক আন্তনিওর বুকের কাছ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে পারেন, আইন তার পক্ষে। বাধ্য হয়ে আদালতকে সেই অনুযায়ী রায় দিতে হচ্ছে।

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে উপস্থিত জনতার বুক থেকে। এ নিছক হত্যা হলেও তাকে আটকাবার কোনও ক্ষমতা নেই তাদের। আইনের বেড়াজালে তাদের হাত-পা বঁধা। নিস্তব্ধ সভাকক্ষে শুধু শোনা যাচ্ছিল শাইলকের ছুরিতে শান দেবার আওয়াজ। সবশেষে শোনা গোল শাইলকের কর্কশ স্বর, ওহে আন্তনিও! এবার প্রস্তুত হও।

এবার আন্তনিও আলিঙ্গন করলেন ব্যাসানিওকে। তারপর এগিয়ে গেলেন জামা খুলতে খুলতে। সাথে সাথে ছুরি হাতে উঠে দাঁড়ালেন শাইলাক–ছুরিতে আলো পড়ে তা ঝকঝাক করে ওঠে। হিংস্রতার একটা ছাপা পড়ে শাইলকের চোখে-মুখে।

হঠাৎ এ সময় বলে উঠলেন পোর্সিয়া, দাঁড়াও শাইলাক! একটা কথা আছে।

আবার কথা! বিরক্ত হয়ে ফিরে দাঁড়াল শাইলক। তার হাতের ধারালো ছুরির চোখে মুখে রক্তপিপাসা।

দলিলে যা নেই তা তো হবে না–বললেন পোর্সিয়া। নিশ্চয়ই তা হবে না–বিজয়ীর স্বরে বলল শাইলক। সহজ-স্বাভাবিক স্বরে বললেন পোসিয়া, দলিলে এক পাউন্ড মাংসের কথা লেখা আছে, কিন্তু কোথাও এক ফোটা রক্তের উল্লেখ নেই শাইলক।

পোর্সিয়ার এ কথায় মুহূর্তের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেল আদালত-কক্ষ। মনে হল যেন সূচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। এক মুহূর্ত সময় লাগল। জনতার এ কথাটা বুঝতে। তারপরই সমবেত উল্লাস্যধ্বনিতে ফেটে উঠল বিচার-কক্ষ। পোর্সিয়ার এই ছোট্ট কথাটার যে এত তাৎপর্য তা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে নাগরিকেরা।

কথাটার গুরুত্ব প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি শাইলক। মাংস কাটলে রক্ত পড়বে এতো স্বাভাবিক। স্বভাবতই দলিলে তার কোনও উল্লেখ নেই। ধীরে ধীরে কথাটার গুরুত্ব বুঝতে পারে সে। বুঝতে পেরেই সে উপলব্ধি করল তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। চোেখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসছে। একটু আগেই সে জোর গলায় বলেছে যে দলিলে যা নেই তা হবে না। এখন যদি সে নিজেরই পাতা ফাঁদে পড়ে যায়, তার জন্য সম্পূর্ণ দোষী সে। বোকার মতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষে বলে ওঠে, রক্তের কথা লেখা নেই দলিলে?

পোর্সিয়া বললেন, এই তো রয়েছে দলিল। পড়ে দেখ ওতে লেখা আছে আন্তনিওর বুকের এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে পারবে তুমি। কিন্তু কোথাও রক্তের উল্লেখ নেই। এবার কেটে নাও এক পাউন্ড মাংস। কেউ তোমায় বাধা দেবে না, কারও অধিকার নেই তোমাকে বাধা দেবার। তুমি শুধু লক্ষ রাখবে এক ফোটা রক্ত যেন মাটিতে না পড়ে। এক ফোটা রক্ত পড়লে কী হবে তা জান তো? ভেনিসের আইনে খ্রিস্টানের রক্তপাত করলে ইহুদির প্রাণদণ্ড হবে।

পোর্সিয়ার কথায় জয়ধ্বনি করে ওঠে সমবেত জনতা। সুযোগ পেয়ে এবার ব্যাসানিও বলে উঠলেন, দেখ ইহুদি, চেয়ে দেখ! যেন দ্বিতীয় দানিয়েল এসেছেন বিচার করতে।

শাইলক বুঝতে পারল এবার তার খেলা শেষ। মনে মনে এই তরুণ আইনজীবীকে অভিশাপ দিতে দিতে সে বলে ওঠল, বেশ! আমি ছেড়ে দিচ্ছি মাংসের উপর আমার দাবি। শুধু আমার কাছে ধারের দরুন মূল টাকার যে তিনগুণ বেশি অর্থ দিতে চেয়েছিল ব্যাসানিও তা পেলেই আমি মামলা তুলে নিতে রাজি।

ব্যাসানিও তৎক্ষণাৎ রাজি। সে ব্যাগ খুলে একরাশ স্বর্ণমুদ্রা টেবিলের উপর ঢেলে দিয়ে বলল, এই রইল নহাজার ডুকাট। এগুলি আমি তোমার জন্যই তৈরি রেখেছি।

ছোরাটা কোমরে গুজে শাইলক ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে টাকাগুলি নেবার জন্য, এমন সময় সবাইকে শুনিয়ে বলে উঠলেন পোর্সিয়া, মামলা যখন আদালতের বিচারাধীন তখন তার ফয়সালাও নির্ভর করছে আদালতের উপর। এখন আর স্ব-ইচ্ছায় ব্যাসানিও টাকা দিতে এবং সে টাকা শাইলক নিতে পারে না। মামলার গোড়াতেই শাইলককে বলা হয়েছিল সে যেন তিনগুণ বেশি টাকা নিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলে। কিন্তু এই ধর্মাধিকরণে দাঁড়িয়ে সমবেত জনতার সামনে সে এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিল। সে জোর গলায় বলেছিল দলিলে যা লেখা আছে সেই অনুযায়ী কাজ হবে! এখন আমরাও জোর গলায় বলছি দলিলের লেখা অনুযায়ীই কাজ হোক। দলিলের মেয়াদ অনুযায়ী যখন তিন মাসের মধ্যে ধার শোধ দেওয়া যায়নি, তখন আন্তনিওর এক পাউন্ড মাংস কেটে নিক শাইলক। কিন্তু মাংস কেটে নেবার সময় যদি এক ফোটা রক্ত পড়ে বা কাটা ংস দাঁড়িপাল্লায় ওজন করার সময় একচুল এদিক-ওদিক হয়, তাহলে কিন্তু শাইলককে ছেড়ে কথা বলবে না আদালত। খ্রিস্টানের রক্তপাত ঘটালে যে সাজা, মাংস কাটলেও তাই—অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড। তাছাড়া তিনগুণ অর্থ কেন দেওয়া হবে তাকে? দয়া প্রদর্শন করলে তিনগুণ কেন ছয়গুণ অর্থ দেওয়া যেত তাকে। দয়ার কথা শুনে সে হিংস্ৰ কুকুরের মতো দাঁত দেখিয়েছে, এবার আইনও সেইমতো চলবে। টাকা সে কোনও মতেই পাবে না। — পাবে শুধু এক পাউন্ড মাংস। ওহে ইহুদি! সাবধান! মাংস কাটার সময় যেন এক ফোটা রক্তও না পড়ে আর কাটা মাংসের পরিমাণ যেন একচুল কম-বেশি না হয়। আর দেরি না করে এবার কেটে নাও এক পাউন্ড মাংস।

কাতরকণ্ঠে বলে উঠল শাইলক, তিনগুণ টাকার দরকার নেই। আমার ঋণের আসল টাকাটা তোমরা আমায় ফেরত দিয়ে দাও।

শাইলককে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন পোর্সিয়া, তিন হাজার ডুকাটও পাবে না তুমি। কারণ দলিলে সে কথা লেখা নেই। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবার পর এখন তোমার প্রাপ্য শুধু এক পাউন্ড মাংস।

গ্রাসিয়ানো বলে উঠলেন, বুঝলে ইহুদি! এই হল দ্বিতীয় দানিয়েল।

গ্রাসিয়ানোর কথায় কান না দিয়ে বলে উঠল শাইলক, তাহলে আর কী! রইল তোমাদের টাকা। এবার আমায় ছুটি দাও। বাড়ি চলে যাই আমি। শাইলক আর কী করে! রাগ প্রকাশের কোনও উপায় না পেয়ে সে ভেতরে ভেতরে খাঁচায় আবদ্ধ বাঘের মতো ফুসছিল। ক্ষমতা থাকলে সে সব খ্রিস্টানগুলোর বুকের মাংস কেটে নিত। কিন্তু তা হবার নয়।

সাথে সাথে বলে উঠলেন পোর্সিয়া, ওহে শাইলক, ধীরে! এত সহজেই কি আর বাড়ি যাওয়া যায়? দেশের আইনেরও তো কিছু বক্তব্য আছে। এ ব্যাপারে। আইনে আছে যদি কোনও বিদেশি ভেনিসে এসে ভেনিসবাসীর জীবনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে, তাহলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড — সাথে সাথে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির অর্ধেক যাবে রাজকোষে, বাকি অর্ধেক সেই ব্যক্তি পাবে যার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হয়েছে। কাজেই তোমার সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক এখন আন্তনিও আর বাকি অর্ধেক ডিউকের। আর তোমার প্রাণদণ্ড হবে কিনা সেটা ডিউক ঠিক করবেন। তার রায়ের উপর কোনও আপিল করা যাবে না।।

পোর্সিয়ার কথা শুনে আনন্দে জয়ধ্বনি করে ওঠে। জনতা। টিটকিরি দিয়ে বলে উঠল গ্রাসিয়ানো, ওহে ইহুদি! দেখলে তো দানিয়েল কে? কী কুক্ষণেই না কথাটা উচ্চারণ করেছিলে তুমি।

শাইলক বলল, তোমরা যদি আমার সম্পত্তি ভাগবাঁটোয়ারা করে নাও তাহলে বেঁচে থাকা অর্থহীন। টাকা না থাকলে কী হবে বেঁচে থেকে? তার চেয়ে আমার মৃত্যুর ব্যবস্থা কর তোমরা। বেচারা ইহুদি। ফাঁসির দড়িটাও কিনে নেবার ক্ষমতা ওর নেই–সমবেদনা জানিয়ে বলল গ্রাসিয়ানো!

এতক্ষণে মুখ খুললেন ডিউক–খ্রিস্টানরা যে ইহুদিদের মতো কঠোর এবং নৃশংস নয় তা বোঝাবার জন্য তুমি প্ৰাণভিক্ষা চাইবার আগেই আমি প্ৰাণদান করছি তোমায়। তবে তোমার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপারটা আমার একার উপর নির্ভরশীল নয়। আইনত তোমার সম্পত্তির অর্ধাংশ আন্তনিওর প্রাপ্য। তিনি চাইলে দরিদ্রতার হাত থেকে তোমায় রক্ষা করতে পারেন।

আন্তনিও বললেন, শুধু একটিমাত্র শর্তে আমি অংশটা ফিরিয়ে দিতে পারি শাইলাককে। শাইলকের একমাত্ৰ কন্যা জেসিকা গোপনে বিয়ে করেছে এক খ্রিস্টান যুবককে। পিতার রোযের আশঙ্কায় সে বাড়ি ছেড়ে স্বামীর সাথে রয়েছে আমার বন্ধু বাসানিওর স্ত্রীর আশ্রয়ে বেলমন্ট গ্রামে। এখন শাইলক যদি এভাবে উইল করে দেয় যে তার মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি পাবে তার মেয়ে ও জামাই, তাহলে আমি এই মুহূর্তে সম্পত্তিটা ফিরিয়ে দিতে রাজি আছি শাইলাককে।

ডিউক বললেন, এতো খুব ভালো কথা। শাইলকের সম্পত্তির যে অংশটা রাজকোষে বাজেয়াপ্ত হবার কথা সেটা আমি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারি। যদি সে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিতে রাজি হয়। শাইলক, তুমি কি চাও না। আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে সম্পত্তি রক্ষা করতে?

অপ্ৰসন্নভাবে জবাব দিল শাইলক, রাজি না হয়ে আর উপায় কী! আমি তো ভিক্ষাবৃত্তি গ্ৰহণ করতে পারব না। পরীক্ষণেই সে মিনতি জানিয়ে ডিউককে বলল, এবার তাহলে আমায় বাড়ি যাবার অনুমতি দিন। প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র তৈরি করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলেই আমি তা সই করে দেব।

ডিউক বললেন, ঠিক আছে, এবার তুমি যেতে পোর। তবে মনে রেখা সই না করলে তুমি কিন্তু বিপদে পড়বে। সম্পত্তি তো বেহাত হবেই। সেই সাথে তোমার প্রাণভিক্ষাও প্রত্যাহার করে নেব আমি।

নিচু গলায় বলল গ্রাসিয়ানো, আহা! ইহুদিটার কি এমন সুমতি হবে যে সই করতে অস্বীকার করবে? তাহলে ওকে ফঁাসির দড়িতে ঝুলতে দেখে চক্ষু সার্থক হবে।

মাথা নিচু করে ফিরে গেল শাইলক। তার ইচ্ছা ছিল আন্তনিওর প্রাণ নেওয়া। সে আশা সফল হতে হতে কোথা থেকে কী সব হয়ে গেল। সবকিছু ভেস্তে গেল।

কোথা থেকে একটা ভূইফোঁড় এসে এমন একটা নজির দেখাল। যার বিপক্ষে কোনও যুক্তিই খাড়া করতে পারল না শাইলক। একেই বোধহয় বলে ভবিতব্য। আর ঈশ্বরও তেমনি সদয় খ্রিস্টানদের প্রতি। যতই ওদের ফাঁদে ফেলা যাক না কেন, একটা না একটা রাস্তা দিয়ে ওরা ঠিক বেরিয়ে আসবে।

এবার আদালত ভঙ্গ করে প্রাসাদে ফেরার জন্য তৈরি হলেন ডিউক। যাবার আগে পোর্সিয়াকে ডেকে তার ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বললেন, এই অল্প বয়সে আপনি যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, প্ৰজ্ঞ বেলারিওর কাছ থেকে ওর চেয়ে আমরা বেশি কিছু প্রত্যাশাও করতে পারতাম না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আপনি উত্তরোত্তর প্রতিষ্ঠা লাভ করুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনার দ্বারা জনগণ উপকৃত হবে। আপনি যদি আমার আতিথ্য গ্ৰহণ করে আমার সাথে আহার করেন তাহলে খুবই খুশি হব আমি।

ডিউকের সৌজন্যে পরম আপ্যায়িত হলেও তার নিমন্ত্রণ একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল পোর্সিয়াকে। ডিউকের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হলে কিছুতেই তার পক্ষে ব্যাসানিওর আগে বেলমন্টে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। কেননা তিনি আগে থেকেই স্থির করে রেখেছেন। বেলমন্ট থেকে তার অনুপস্থিতির কথা কিছুতেই স্বামীকে জানতে দেবেন না তিনি। তিনি বিনীত ভাবে ডিউককে বললেন, আপনার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারলে খুবই খুশি হতাম আমি। কিন্তু বিশেষ কারণে আমাকে এখনই পাদুয়ায় ফিরে যেতে হবে। সেখানে একটা জরুরি মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমার উপর। আপনি তো জানেন আমাদের সময় হল অপরের সম্পত্তি। আমি খুবই দুঃখিত এই মুহূর্তে নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই।

ডিউক দুঃখিত হলেও বুঝতে পারলেন পোর্সিয়ার অসুবিধার কথা। যেখানে জরুরি মামলার দায়িত্ব রয়েছে। এই তরুণ আইনজীবীর উপর, সেখানে তাকে আটকে রাখা ঠিক নয়। ডিউক পোসিয়াকে বললেন তিনি যেন ফিরে এসে তার আতিথ্য গ্রহণ করেন। তারপর আন্তনিও ও ব্যাসানিওকে উদ্দেশ করে ডিউক বললেন, আপনাদের মনে করিয়ে দেওয়া নিম্প্রয়োজন যে এই তরুণ আইনজীবীকে আপনারা যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবেন, যদিও তিনি আপনাদের যে উপকার করেছেন তার তুলনায় কোনও পারিশ্রমিকই ওর উপযুক্ত নয়। তিনি আন্তনিওর জীবন দান করেছেন যা অর্থ দিয়ে কেনা যায় না।

এরপর ডিউক আদালত ছেড়ে চলে গেলেন। আস্তে আস্তে উপস্থিত জনতাও চলে যেতে লাগল। কোর্টের একদিকে রইল পোর্সিয়া ও নেরিস এবং অন্যদিকে আন্তনিও, ব্যাসানিও, গ্রাসিয়ানো ও অপর বন্ধুরা। বিনীত কণ্ঠে ব্যাসানিও এই তরুণ আইনজীবীকে বললেন, আমি বা আমার বন্ধু আন্তনিও, কেউ আপনার ঋণ এ জীবনে পরিশোধ করতে পারব না। তবুও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ আপনাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবার ব্যবস্থা করছি আমরা। যে নহাজার ডুকাট আমরা শাইলককে দিতে চেয়েছিলাম সেটাই আমরা আপনাকে সামান্য উপহার হিসাবে দিতে চাই। দয়া করে আপনি এটা গ্রহণ করুন।

সাথে সাথে জিভ কামড়িয়ে বললেন পোর্সিয়া, বলছেন কী মশায়! একটা মামলার পারিশ্রমিক নহাজার ডুকাট? এটা নিলে যে লোকে আমায় ইহুদির চেয়ে ঘূণ্য জীব বলবে।

এদিকে ব্যাসানিও যতই অনুরোধ করেন, টাকার কথা ততই হেসে উড়িয়ে দেন পোর্সিয়া। শেষমেশ ব্যাসানিও বললেন, তাহলে মাঝামাঝি একটি রফা করা যাক। আমাদের আসল ঋণ ছিল তিনহাজার ডুকাটি। ওটা শাইলককে দিলে অতিরিক্ত কিছু দেওয়া হত না। আপনার বুদ্ধি আর নিজ কর্মফলে সেটা থেকে বঞ্চিত হয়েছে শাইলক। তাহলে এই তিন হাজার ডুকাট আপনি অনায়াসেই পারিশ্রমিক হিসেবে নিতে পারেন। এতে আমাদের দুপক্ষেরই সুবিধা হবে — ঋণের অতিরিক্ত আমাদের কিছু দিতে হবে না। আর আপনাকেও কেউ ইহুদির চেয়ে ঘূণ্য জীব বলতে পারবে না। আপনার মতো একজন প্রথম শ্রেণির আইনজীবীর পারিশ্রমিক হিসেবে তিন হাজার ডুকাট মোটেই বেশি নয়।

তবুও টাকা নিতে রাজি হলেন না পোর্সিয়া। তিনি বললেন, ভালো কাজ করতে পারলে সব সময় একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। আপনাদের কাজ করতে পেরে আমিও সেই আত্মপ্রসাদ লাভ করছি। এ কাজের জন্য পারিশ্রমিক নিলে আমার অন্তরের তৃপ্তিটুকু নষ্ট হয়ে যাবে। ওই তিন হাজার ডুকাটের চেয়ে ওর মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি। দয়া করে পারিশ্রমিক নেবার কথা আমাকে আর বলবেন না। ব্যবসা শুরু করার আগে সমস্ত আইনজীবীরাই শপথ নিয়ে থাকেন যে তাঁরা সর্বদা অন্যায়ের বিপক্ষে লড়বেন। পারিশ্রমিক নিলে সে শপথ ভঙ্গ করা হয়। অনুগ্রহ করে আমাকে আর প্রলোভন দেখাবেন না।

এ কথা শুনে চুপ করে যেতে হল ব্যাসানিও এবং আন্তনিওকে! শেষে আন্তনিও প্রস্তাব দিলেন, বেশ তো! টাকার কথা না হয় রইল। তবে আপনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতার চিহ্ন স্বরূপ সামান্য কিছু উপহার তো আমরা নিশ্চয়ই আপনাকে দিতে পারি। আশা করি সেটা নিলে আপনার অমর্যাদা হবে না।

মনে মনে হেসে বললেন পোর্সিয়া, না, তা অবশ্য হবে না। কোনও উপহার বা স্মৃতিচিহ্ন নিতে আমার বাধা নেই। তবে আপনি যদি বলেন যে একলক্ষ টাকা নিতে হবে, তাহলে আমার আপত্তি আছে। আপনি যদি আমার পছন্দমতো জিনিস নিতে দেন তাহলে আমি রাজি আছি।

সমস্বরে উত্তর দিলেন আন্তনিও এবং ব্যাসানিও, আমরা রাজি আছি। এবার বলুন আপনি কী নেবেন?

আন্তনিওর হাতের দিকে তাকিয়ে পোর্সিয়া বললেন, আপনার হাতের ওই দস্তানা জোড়া আমায় দিন। আমি ওগুলি সযত্নে রেখে দেব আপনার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।

এমন একটা সামান্য জিনিস পোর্সিয়া বেছে নেওয়ায় মনে মনে খুব ক্ষুন্ন হলেন আন্তনিও। কিন্তু কী আর করা যাবে? তিনি দস্তানা জোড়া খুলে পোর্সিয়াকে দিলেন। এবার ব্যাসানিওর দিকে তাকিয়ে বললেন পোর্সিয়া, আপনার কাছ থেকে আর দস্তানা নেব না। মনে হচ্ছে দস্তানার নিচে কী যেন উচু হয়ে আছে। মনে হয় ওটা আংটি। বেশ, ওই আংটিটাই আমায় দিন। আপনার স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ওটা আমি আঙুলে পরব।

পোর্সিয়ার কথা শুনে যেন বজ্ৰপাত হল ব্যাসানিওর মাথায়। শেষমেষ উকিলবাবুকিনা চেয়ে বসলেন ওই আংটিটিা। ওটা যে ওর বিয়ের আংটি-আংটিটা দেবার সময় পোর্সিয়া মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছিল আমি যেন ওটা সযত্নে রক্ষা করি। কেমন করে সেটা তিনি তুলে দেবেন। উকিলবাবুকে? আংটিটা দেখতে না পেলে পোর্সিয়া যখন জানতে চাইবে সেটা কোথায় গেল, তখন কী জবাব দেবেন তাকে?

সংকটের মাঝে পড়ে গেছে ব্যাসানিও। উকিলবাবু হাত বাড়িয়ে রয়েছেন। আংটিটার জন্য। কিন্তু ব্যাসানিও সেটা দেবার কোনও ইচ্ছা প্ৰকাশ করছেন না দেখে তিনি পরিহাস করে বললেন, কী মশায়! আংটি দেবার কথা শুনেই উবে গেলে আপনার বদান্যতা? দেবার হলে দিন, নইলে রইল আপনার আংটি। নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। হাতে আরও দু-চারটা কাজ রয়েছে। জড়ানো স্বরে বলল ব্যাসানিও, মহাশয়, এ সামান্য আংটিটিা আপনাকে দিতে আমার লজ্জা করছে। এর বদলে আপনি কোনও একটা দামি উপহার নিন না কেন।

মুখে বিরক্তির ভান করে বললেন পোর্সিয়া, কী বললেন, সামান্য জিনিস? আন্তনিওর কাছ থেকে যে দস্তানা আমি নিয়েছি, আপনার আংটিটা কি তার চেয়েও তুচ্ছ? মূল্যবান উপহার নেবার ইচ্ছে থাকলে আপনাদের প্রস্তাবিত নহাজার ডুকাটি আমি কখনই প্রত্যাখ্যান করতাম না। আপনি আমায় উপহার দেবার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। উপহার নেবার তেমন আগ্রহ আমার নেই। তবে দিতে চাইলে ওই আংটিটিই আমায় দিন। এনিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার মতো সময় আমার নেই।

কিন্তু ব্যাসানিও নিরুপায়। এমনকি আন্তনিও পর্যন্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন তার দিকে। আংটিটা দিতে ব্যাসানিওর যে কেন এত অনীহা তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। শেষমেশ উপায় না দেখে সত্যি কথাটাই বলে ফেললেন ব্যাসানিও–মহাশয়, আংটিটা দেবার ব্যাপারে আমার খুব অসুবিধা আছে। বিয়ের সময় স্ত্রী আমায় এটা উপহার দিয়েছেন। আমি তার কাছে প্ৰতিজ্ঞা করেছি যে জীবিত থাকাকালীন আমি এই আংটি কখনও হাতছাড়া করব না। সবে বিয়ে হয়েছে আমাদের। এত তাড়াতাড়ি কী করে আমার প্রতিজ্ঞা ভাঙব? তাহলে যে ছোটো হয়ে যাব তার কাছে। তিনি আর কখনও আমায় বিশ্বাস করবেন না। আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ এর বদলে হিরের বা মুক্তোর তৈরি আংটি নিন।

ব্যাসানিওর কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন পোর্সিয়া, আপনার স্ত্রী প্রকৃত পাগল না হলে সব কথা শোনার পর নিশ্চয়ই তিনি অবিশ্বাস করবেন না। আপনাকে। আপনি যদি পারিশ্রমিক হিসেবে আংটিটা আমায় দেন, তাহলে সেটা অসংগত মনে হবে না। তার কাছে। আসল কথা হচ্ছে আমাকে কিছু দেবার ইচ্ছে আমার নেই। এক ধরনের লোক আছে যারা মুখে খুব উদারতার কথা বলে, কিন্তু কাজের সময় নানা অজুহাতে পিছিয়ে আসে। যাক, আপনার কাছ থেকে শিখলাম কী ভাবে ভিক্ষুকের সাথে ব্যবহার করতে হয়।

বেজায় রাগ করেছেন এরূপ ভান করে আদালত ছেড়ে চলে গেলেন পোর্সিয়া। অতি কষ্টে হাসি চেপে তার পেছু পেছু গেলেন নেরিস। ওরা চলে যাবার পর আন্তনিও বললেন, বন্ধু! তোমার অবস্থােটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। তবুও বলব, তোমার উচিত ছিল স্ত্রীর বিরাগভাজন হবার ঝুঁকি নিয়েও আংটিটা ভদ্রলোককে দিয়ে দেওয়া। আমার মনে হয় তোমার স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন যে এটা না করে তোমার কোনও উপায় ছিল না। আমি নিজে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলব যাতে তিনি তোমার উপর অপ্ৰসন্ন না হন। উকিলবাবুকে তার প্রার্থিত জিনিসটি না দিলে আমার মনে হয় সব কথা শুনে তিনি নিশ্চয়ই তোমায় তিরস্কার করবেন। কারণ অবস্থা অনুযায়ী সবসময় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

আন্তনিওর কথা শুনে ব্যাসানিও স্থির করলেন আংটিটা তিনি উকিলবাবুকে দিয়ে দেবেন। আংটি দিতে না পারায় মনে মনে নিজের কাছেই লজ্জিত হয়ে আছেন ব্যাসানিও। আন্তনিওর কথা শুনে তার দ্বিধা দূর হয়ে গেল। তিনি হাত থেকে আংটি খুলে নিয়ে গ্রাসিয়ানোর হাতে দিয়ে বললেন, বন্ধু! তুমি এখনই ছুটে চলে যাও। উকিলবাবু নিশ্চয়ই বেশি দূর যেতে পারেননি। আগে আমি যে অনিচ্ছা প্ৰকাশ করেছি। তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে এই আংটিটা তুমি তাকে দেবে এবং আমাদের সাথে নৈশ ভোজের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানাবে।

তৎক্ষণাৎ আংটি নিয়ে ছুটে চলে গেলেন গ্রাসিয়ানো ইচ্ছে করেই বেশিদূর যাননি পোর্সিয়া। তিনি কাছাকাছিই ছিলেন। আংটি সম্পর্কে ব্যাসানিওর মতের কোনও পরিবর্তন হয় কিনা সেটা দেখার খুব আগ্রহ ছিল পোর্সিয়ার। গ্রাসিয়ানোকে দেখে তিনি এমন ভাব করলেন যেন তিনি তাকে এই প্রথম দেখছেন। যথোচিত শিষ্টাচার সহ তিনি তাকে বললেন, মশায়! আমায় দেখিয়ে দেবেন কি ইহুদি শাইলকের বাড়িটা কোথায়? একটা দলিলে তার সই নেবার প্রয়োজন আছে।

সাগ্রহে বলল গ্রাসিয়ানো, নিশ্চয়ই আপনাকে দেখিয়ে দেব শাইলকের বাড়ি। তাছাড়া একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি আমি। আন্তনিও এবং ব্যাসানিও — উভয়ের বন্ধু আমি! আদালতে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আপনার মতো ভালো উকিল আমি আগে কখনও দেখিনি। বন্ধু ব্যাসানিওর কাছ থেকে যে আংটিটি আপনি উপহার হিসেবে চেয়েছিলেন…

বাধা দিয়ে বলে উঠলেন পোর্সিয়া, থাক, আপনার বন্ধুর উপহারের কোনও প্রয়োজন নেই আমার। যথেষ্ট আংটি রয়েছে আমার ঘরে; আর কম হলেও সেটা কিনে নেবার ক্ষমতা আছে আমার। উনিই তো আমায় খোসামোদ করেছেন স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ একটা কিছু নেবার। আমি যেই একটা জিনিস চাইলাম, উনি বললেন না। ওটা নয়, অন্য কিছু নিন। একে কি ভদ্রতা বলে?

ব্যাসানিও তাড়াতাড়ি আংটিটা পোর্সিয়ার সামনে তুলে ধরে বললেন, আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না–এটা আমার বন্ধু ব্যাসানিওর নববিবাহিতা স্ত্রীর প্রথম উপহার। সে কারণে তিনি আপনাকে ওটা দিতে ইতস্তত করছিলেন। যাকগে সে কথা, আপনার কাছে অপরিশোধ্য ঋণের বঁধনে বাধা পড়েছি আমরা সবাই। সবকিছু বাদ দিয়ে আপনার তৃপ্তি সাধন করাই এখন আমাদের কর্তব্য। তাই বন্ধু এই আংটিটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনার জন্য। আপনি এটা নিলে তিনি বাধিত মনে করবেন নিজেকে।

যখন পোর্সিয়া দেখলেন যে তার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তিনি আর কথা না বাড়িয়ে আংটিটা নিয়ে নিলেন। তারপর গ্রাসিয়ানো নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানালেন পোসিয়াকে। আগের মতোই পোর্সিয়া জবাব দিলেন যে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয় কারণ পাদুয়ায় তার জরুরি কাজ রয়েছে।

পোর্সিয়ার অনুরোধে কেরানিরূপী নেরিসাকেশাইলকের বাড়ির দিকে নিয়ে চলল গ্রাসিয়ানো। সেখানে গিয়ে দলিলে শাইলকের স্বাক্ষর নেবে নেরিসা।

নেরিসা যেতে যেতে বলল, আপনাদের বন্ধু আন্তনিওর মধ্যে যে ভদ্রতাবোধ রয়েছে, আমরা আশা করেছিলাম। আপনাদের মধ্যেও তা থাকবে। আমরা তো আন্তনিওর প্রাণ বাঁচিয়েছি। এর জন্য নিশ্চয়ই কিছু উপহার আমাদের প্রাপ্য।

গ্রাসিয়ানো বললেন, উপহার নিশ্চয়ই আপনাদের প্রাপ্য। কিন্তু আমি তো নিঃস্ব। উপহার দেবার মতো কীই বা আছে আমার?

নেরিস বলল, কী বললেন। আপনি নিঃস্ব? ওই তো আপনার হাতে আংটি রয়েছে। ওই আংটিটা পেলেই যথাযোগ্য পুরস্কার পেয়েছি বলে মনে করব আমি।

ঠিক একই কারণে ব্যাসানিওর মতো। আপত্তি জানালেন গ্রাসিয়ানো। তার স্ত্রী নেরিসা তাকে দিয়েছেন ওই আংটি। কিন্তু নেরিসার বাক্যবাণের জোয়ারে ভেসে গেলেন তিনি। তার কোনও ওজার-আপত্তি টিকল না।

শেষমেশ গ্রাসিয়ানো স্থির করলেন ব্যাসানিও যখন তার আংটিটা দিতে পেরেছেন, তখন তিনি দিলেও এমন কিছু মারাত্মক ক্ষতি হবে না। এ নিয়ে নেরিসা কোনও ঝামেলা করলে তিনি অনায়াসেই ব্যাসানিওর উদাহরণ দেখিয়ে পার পেয়ে যাবেন।

গ্রাসিয়ানোর কাছ থেকে আংটিটা নিয়ে নেরিসা চলে গেল শাইলকের বাড়ির ভেতরে। শাইলাককে দিয়ে দলিলে সই করিয়ে সে ফিরে এল পোর্সিয়ার কাছে। আর দেরি না করে পোর্সিয়া তাকে নিয়ে রওনা হলেন বোলমন্টের পথে। কারণ কালই আন্তনিওকে নিয়ে ব্যাসানিও রওনা দেবেন। বেলমন্ট অভিমুখে। যে করেই হোক স্বামীর আগে তাকে সেখানে পৌঁছতে হবে।

 

০৬.

পরদিন সন্ধ্যার পর পোর্সিয়ার প্রাসাদের সামনে বসে গেল আনন্দের মেলা। উপরে জ্যোৎ মা . প্লাবিত আকাশ আর নিচে নানা বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলে এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছে বাদকেরা! পোর্সিয়ার অবর্তমানে এ প্রাসাদের দায়িত্বে রয়েছেন লোরেঞ্জো এবং জেসিকা। তাঁরা খবর পেয়েছেন মঠ থেকে খুব দ্রুত ফিরে আসছেন পোর্সিয়া। তাই তারা আগাম নাচ-গানের আসর বসিয়েছে প্ৰসাদের সামনে।

দূর থেকেই নাচ-গানের সুমধুর আওয়াজ ভেসে আসছিল পোর্সিয়ার কানে। পুরুষের পোশাক বদলিয়ে তিনি ও নেরিস উভয়ে নারীর বেশ ধারণ করেছেন। তাদের আসতে দেখেই এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানাল লোরেঞ্জো ও জেসিকা। সবাইকে যথোচিত সম্ভাষণের পর পোর্সিয়া জানালেন কাছের ও দূরের কোন কোন মঠ ও গির্জায় তারা আন্তনিওর কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা জানিয়েছেন।

এ সময় ব্যাসানিওর এক ভৃত্য স্টিফানো দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে ভেনিস থেকে এসে পৌঁছোল বোলমন্টে। সে জানাল খুব শীঘ্রই তার প্রভু আস্তানিওকে নিয়ে এসে পড়বেন।

দেখতে দেখতে আন্তনিও আর গ্রাসিয়ানোর সাথে এসে পড়লেন ব্যাসানিও। আন্তনিওকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে জেনে খুবই আনন্দ প্রকাশ করলেন পোর্সিয়া। কিন্তু তার আচার-আচরণ, কথা-বার্তায় এমন কিছু প্রকাশ পেল না যাতে বোঝা যায়। এ সবের মূলে রয়েছেন তিনি।

পোর্সিয়া আন্তনিওকে নিজের প্রাসাদে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন এমন সময় তার কানে এল নেরিস ও গ্রাসিয়ানোর মধ্যে বিবাদের আওয়াজ। তিনি হেসে উঠে বললেন, কী ব্যাপার! তোমরা এরই মধ্যে ঝগড়া শুরু করে দিলে? আরে! বিয়ের পর এখনও যে তেরাত্তির পার হয়নি।

সাথে সাথে নেরিস বলে উঠল, এরূপ ব্যবহার করলে তেরাত্তির তো দূরের কথা, তিন মিনিটও শাস্তিতে থাকা সম্ভব নয়। আমার পক্ষে। বিয়ের সময় আমি ওকে একটা আংটি দিয়ে ছিলাম। উনি গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বেঁচে থাকতে আংটিটাি কাউকে হস্তান্তর করবেন না। আর এখন উনি কিনা আংটিটিা কাকে বিলিয়ে দিয়ে নাচতে নাচতে হাজির হয়েছেন আমার সামনে। এমন কাণ্ড দেখলে বোবা পাথরও সরব হয়ে উঠবে।

গম্ভীর স্বরে বললেন পোর্সিয়া, এটা তুমি ঠিক কাজ করনি গ্রাসিয়ানো। হাজার হোক, এটা তোমার স্ত্রীর দেওয়া প্রথম উপহার। সেটা যদি তুমি কাউকে দিয়ে দাও। তাহলে….।

গ্রাসিয়ানো চেঁচিয়ে বলে উঠল, ঠাকুরানি! সে একটা কেরানিমাত্র। যে উকিলবাবু আন্তনিওর প্রাণরক্ষা করেছেন, সে তারই কেরানি — একটা বেঁটে মতো ছোকরা, দেখতে ঠিক নেরিসার মতো, দলিলের ব্যাপারে সে খুব খাটাখাটি করেছিল। তাই পুরস্কারস্বরূপ যখন সে আংটিটা চাইল, আমি আর না করতে পারলুম না।

পোর্সিয়া বললেন, উপকার ঠিকই করেছিল তাতে কোনও দ্বিমত নেই। তার জন্য অর্থ দিলেই পারতে। এভাবে স্ত্রীর আংটিটা তোমার দেওয়া উচিত হয়নি। আমিও তো বিয়ের সময় স্বামীকে একটা আংটি দিয়েছিলাম। আমি স্থির নিশ্চিত আংটিটা তিনি কখনও হাতছাড়া করবেন না।

এ সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন গ্রাসিয়ানো। সাথে সাথেই তিনি বলে ওঠেন, তাহলে শুনুন ঠাকুরানি। আপনার স্বামী তার আংটিটাি উকিলবাবুকে দেবার পরই কেরানি ছোকরাটি নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠে আমার আংটিটি নেবার জন্য। আমিও ভেবে দেখলাম ব্যাসানিও যখন তার উপহারের আংটি বিলিয়ে দিতে পারে, তাহলে আমারই বা আপত্তি কীসে?

গ্রাসিয়ানোর কথা শুনে এমন ভাবে নিশচুপ হয়ে গেলেন পোর্সিয়া যেন তার মাথায় বাজ পড়েছে। ব্যাসানিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে। অতি কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে পোর্সিয়া বলে ওঠেন, স্বামী! এ কথা কি সত্যি? বিবৰ্ণ মুখে পোর্সিয়ার সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ব্যাসানিও, আংটিটা যখন হাতে নেই তখন তুমিই বিচার কর কথাটা সত্যি কিনা।

লজ্জায় ঘৃণায় এতটুকু হয়ে গেলেন পোর্সিয়া। বললেন, তোমাদের বিবেক এতটুকু বাধল না স্ত্রীদের সাথে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে? তোমরা দু-বন্ধু উভয়েই সমান পাপে পাপী। নেহাত বিয়ে হয়ে গেছে। তাই ফেরাবার উপায় নেই। ব্যাসানিও-পোর্সিয়ার মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক শুরু না হতেই শেষ হতে চলেছে।

ঝড়ের মতো এভাবে তিরস্কারের বন্যা বয়ে চলল। মাঝে ব্যাসানিও যদিওবা দু-একটা কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু স্রোতের মুখে তা খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। পোর্সিয়ার স্থির বিশ্বাস ভেনিসে গিয়েই আংটিটা দিয়েছেন ব্যাসানিও উকিলকে আংটি দেবার কথা নিছক বানানো। এমন উকিল কি দেখা যায় যে নয়। হাজার ডুকাটি না নিয়ে সামান্য একটা আংটি পুরস্কার স্বরূপ নিয়ে গেল?

উকিলরা যে সচরাচর লোভী হয় তা সবার জানা। আর এ উকিল নিলোভ হলে স্ত্রীর উপহার শোনা মাত্রই সেটা আর নিত না। নির্লোভ ব্যক্তি কি এরূপ সৌজন্যহীন হতে পারে?

নিজেকে নিয়ে বড়োই বিব্রতবোধ করছিলেন আন্তনিও। এ সবের মূলে যে তিনিই, সে কথা ভেবে খুবই সঙ্কোচ হচ্ছিল তার। ব্যাসানিওর পক্ষ নিয়ে দু-একটা কথা বলতে গিয়েছিলেন আন্তনিও, কিন্তু তার কথায় কানই দিলেন না পোর্সিয়া। শুধু তাকে বললেন, বন্ধু আন্তনিও! আপনি ভাববেন। না যে স্বামীর প্রতি অবিশ্বাস হেতু আমি আপনাকে অশ্রদ্ধা করছি। আমার বাড়িতে আপনার সমাদরের কোনও অভাব হবে না। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের এখানেই ইতি। যে আমার আংটির অমর্যাদা করতে পারে, সে আমার ভালোবাসার কী মূল্য দেবো?

আন্তনিও বললেন, এখন আমি বুঝতে পারছি আপনার উপহারটা হাতছাড়া করা কোনওমতেই উচিত হয়নি ব্যাসানিওর। আগে বুঝতে পারলে কখনওই এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতাম না। কিন্তু ভদ্রলোকের ঋণ শোধ করার অন্য কোনও উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে এ অন্যায় কাজ করতে হয়েছে আমাদের। দয়া করে এ কথাটা আপনি বিশ্বাস করুন।

সাথে সাথে বললেন পোর্সিয়া, পুরুষ মানুষকে কোনও বিশ্বাস নেই। তবে আপনার কথা বিশ্বাস না করেও একটা আপসে আসতে রাজি আছি আমি।

আন্তনিও বললেন, একবার ব্যাসানিওর জন্য নিজেকে জামিন রেখেছিলাম। এবার জামিন রইল আমার আত্মা। ব্যাসানিও যদি পুনরায় অবিশ্বাসী হন, তাহলে অনস্তকালের জন্য আমি নরকে যেতে রাজি আছি।

এবার মনে মনে কিছুটা প্ৰসন্ন হলেন পোর্সিয়া। তিনি আঙুল থেকে একটি আংটি খুলে নিয়ে আন্তনিওকে বললেন, শুধু আপনার খাতিরে, আপনার সামনে এই দ্বিতীয় আংটিটা আমি আমার স্বামীর আঙুলে পরিয়ে দিচ্ছি। এটার ভাগ্যও যেন আগেরটার মতো না হয়ে পড়ে। তাহলে কিন্তু আমাদের মুখ-দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে।

আংটিটা দেখে অবাক হয়ে গেলে ব্যাসানিও। এটা তো সেই আগের আংটি যা তিনি গতকাল ভেনিসে দিয়ে এসেছেন উকিলবাবুকে। তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। কীভাবে এই অভাবনীয় ঘটনা ঘটল।

কর্ত্রীর দেখাদেখি নেরিসাও দ্বিতীয় একটি আংটি উপহার দিয়েছেন ব্যাসানিওকে এবং তিনিও অবাক হয়ে গেছেন। আংটিটা দেখে, কারণ এটাই তো সেই আংটি যা তিনি গতকাল দিয়ে এসেছেন মুহুরি ছোকরাকে।

এরপর শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। মাঝে মাঝে কিছু উত্তর। হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়ে সমাধান হয়ে গেল সবকিছুর। বেলারিওর চিঠিতেই প্রমাণ হয়ে গেল যে পোর্সিয়া উকিল সেজে ভেনিসে গিয়ে। আন্তনিওর জীবন বঁচিয়েছেন। এমন গুণী স্ত্রীর জন্য গর্বের সীমা রইল না ব্যসানিওর।

এবার পোর্সিয়া শাইলকের দানপত্র তুলে দিলেন লোরেঞ্জোর হাতে। দানপত্র অনুযায়ী শাইলকের মৃত্যুর পর তার সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবেন লোরেঞ্জো এবং জেসিকা। গদগদম্বরে বলে ওঠে লরেঞ্জে, ঠাকুরানি! আপনি ধন্য। যেখানেই আপনি যান না কেন, সেখানেই আপনার উপর অজস্র ধারায় বর্ষিত হবে ঈশ্বরের করুণা।

ঈশ্বরের করুণার আরও একটা প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখিয়ে এবার সবাইকে হতবাক করে দিলেন পোর্সিয়া। আন্তনিও হারিয়ে যাওয়া তিনখানি জাহাজ বাণিজ্য সম্ভারে পূর্ণ হয়ে হঠাৎই এসে পৌঁছেছে আদ্রিয়াতিক সাগরে। এ সংবাদ তিনি কালই জানতে পেরেছেন ভেনিসে অবস্থিত তার কর্মচারীদের কাছ থেকে। তারা আন্তনিওকে খবরটা দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু পোর্সিয়া তাদের নিরস্ত করেন এই বলে যে তিনি নিজেই খবরটা দিতে চান আন্তনিওকে।

সবার মন এবার কানায় কানায় ভরে উঠেছে আনন্দে। শুধু গ্রাসিয়ানোই বিরস মুখে বলে, সবাই প্ৰাণ খুলে আনন্দ করছেন, করুন। আমি বাধা দিতে চাই না তাতে। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও একটা ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত আমি—সেটা নেরিসার আংটিটা নিয়ে। কখন যে কী ঘটে যায় তা কে জানে। সারাজীবন ওটা নিয়ে উৎকণ্ঠিত থাকতে হবে। আমাকে।

এবার সব উৎকণ্ঠা দূর করে পোর্সিয়া বলে উঠলেন, আমিই সেই আইনজীবী আর নেরিস মুহুরি। আমরা দুজনেই পুরুষের ছদ্মবেশে জাহাজে করে ভেনিসে গিয়েছিলাম। আর তোমরা রওনা দিয়েছিলে আমাদের একদিন আগে। স্বয়ং লোরেঞ্জোই আমাদের সমস্ত কাজের সাক্ষী। এবার সবাই ভেতরে চলে আসুন-ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *