1 of 4

১.০৯ সিনবাদ আর বাজপাখি

সিনবাদ আর বাজপাখি

য়ুনান বলতে শুরু করে। এক সময়ে ফার শহরে এক প্রবল পরাক্রান্ত বাদশাহ বাস করতো। ঈষত্তর নাম শাহেনশাহ সিন্যবাদ। খেলাধূলা, শিকার এবং অশ্বারোহণে ভারি ওস্তাদ ছিলো সে। তার একটা পোষা শিকারী বাজপাখী ছিলো; দিবারাত্র তার সঙ্গে সঙ্গে থাকতো সেই পাখীটো। কোনও সময়ই সঙ্গ ছাড়া করতো না। এমন কি, রাতের বেলাতেও যদি শিকারে বেরুতে, পাখীটাকে হাতের মুঠোয় বসিয়ে সঙ্গে নিয়ে যেত। জিগরিদোস্তের মতো ভালোবাসতো তাকে। অর্থাৎ প্রাণের বন্ধু। তার গলায় শিকলি দিয়ে বাঁধা থাকতো একটা সোনার পেয়ালা। জলটল খাওয়ার জন্যে।

একদিন সিনাবাদের কাছে এসে তার বাজপাখীর প্রধান পরিচারক জানালো, আজকের এই দিনটা শিকারের পক্ষে বহুৎ আচ্ছা। যাবেন নাকি, শাহজাদা?

সিন্যবাদ বললো, ঠিক আছে, তোমরা সব গুছিয়ে নাও, যাবো।

লোক-লস্কর আর তার প্রাণ-প্রিয় বাজপাখীকে নিয়ে রওনা হলো সিনাবাদ শিকার সন্ধানে। বেশ কিছু দূরে এক পাহাড়ের উপত্যকায় উপস্থিত হলো এক সময়। শিকারের জাল পাতা হলো, চারদিক বেষ্টন করে। দেখা গেলো, একটা রামছাগল ধরা পড়েছে জালে। সিনাবাদ সবাইকে হাঁসিয়ার করে দিলো, সাবধান ছাগলটা যেন না পালায়। যে ওকে পালাতে দেবে তাকে আমি জবাই করবো।

জালটাকে গুটিয়ে জন্তুটাকে কাছে আনা হলো। রামছাগলটা সিনবাদের সামনে এসে পিছনের পা দু’টোয় ভর দিয়ে খাড়া হয়ে, সামনের পা দু’টো করজোড়ের ভঙ্গী করে দাঁড়িয়ে পড়লো। সিনাবাদের মনে হলো, ছাগলটা বুঝে সালাম জানাতে চায়। মজা লাগলো। প্রচণ্ড শব্দ করে হেসে উঠে হাততালি দিয়ে উঠলো। বুঝিবা একটু অন্যমনস্কও হয়ে পড়েছিলো। হঠাৎ তড়াক করে একটা লাফ দিয়ে সিনাবাদের কাঁধের পাশ দিয়ে শো করে বেরিয়ে গেলো। বেশ কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়েই চো দৌড়। একেবারে হাওয়া। ব্যাপারটা পলকের মধ্যে ঘটে গেলো। এমনটা যে ঘটতে পারে কেউ ভাবতেই পারেনি। প্রথমটা হ’কচাকিয়ে গেলেও দারুণ ক্ষিপ্রতায় ঘোড়ার পিঠে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে তাড়া করে চললো ছাগলটাকে। শুধু তার চিৎকার শোনা গেলো, আমার হাত থেকে পালিয়ে কেউ কখনও নিস্তার পায়নি। তুমি পাবে? যেমন করে পারি ধরবোই তোকে।

তীরবেগে ছুটে চললো তার ঘোড়া। শেষে নাগালে পেলো রামছাগলটাকে। ছাগলটাও ছুটছে, ঘোড়াও তার পিছনে পিছনে। উভয়েরই ক্ষিপ্রগতি। ছাগলটাকে ধরি। ধরি করেও ধরা যায় না। এমন সময় বাজপাখীটা উড়ে গিয়ে ছাগলটার সামনে থেকে গোত্তা মেরে ধারালো ঠোঁট দু’টো ঢুকিয়ে দিলো ওর চোখের মধ্যে। যন্ত্রণায় ছটফট করে ছিটকে পড়ে গেলো ছাগলটা। গড়াতে গড়াতে আটকে গেলো একটা ঝোপের সঙ্গে। তামার দস্তানা পরা হাতের এক মুষ্ঠাঘাত করলো সিন্যবাদ। সাত হাত দূরে ছিটকে পড়লো রামছাগলটা। আর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ।

ছাল চামড়া ছাডিয়ে ছাগলটাকে জিনের নিচে ঝুলিয়ে রওনা হলো। সিন্যবাদ। আর তার ঘোড়া উভয়েই তখন দারুণ পিপাসার্তা। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। প্ৰাণ যায় যায়, এমন অবস্থা; খর রৌদ্র-তাপে ধরিত্রী দগ্ধ হচ্ছে তখন। যে দিকে তাকাও ধুধু করে উত্তপ্ত বালুক রাশি। কোথাও জলের সন্ধান নাই।

এইভাবে যেতে যেতে পথের একটা বঁক ঘুরতেই সিনবাদ দেখলো, অদূরে একটা বিশাল বৃক্ষ। আর তার নিচে একটা পুকুর। কিন্তু পুকুরের জল যেন কেমন থকথকে পুরু। গোলা ময়দার মতো। চামড়ার দস্তানা পরা হাতে বাজপাখীর গলা থেকে সোনার পেয়ালাটা খুলে নিয়ে পুকুর থেকে এক পেয়ালা জল ভরে এনে পাখীটার মুখের সামনে তুলে ধরলো সিন্যবাদ। কিন্তু কী আশ্চর্য, এক ঝাপটায়। পেয়ালাটা ছিটকে ফেলে দিলো পাখীটা। পেয়ালাটা আবার ভরে নিয়ে এলো। আবার ওর মুখের সামনে তুলে ধরলো। এবারও এক ঝাপটায় ছুঁড়ে দিলো পেয়ালাটা। এবার বিরক্ত হলো সিন্যবাদ। যাই হোক আবার ভরে আনলো জল। এবার সে ঘোড়ার মুখের কাছে ধরতে গেলো। কিন্তু সেই একই ঘটনা-পাখার ঝাপটায় পাখীটা আবার ফেলে দিলো পেয়ালাটা। এবার সিনাবাদ ক্রুদ্ধ, কুপিত হলো! তলোয়ার বের করে দু’টো পাখাই কেটে ফেললো পাখীটার। নিজে নিজেই বলতে লাগলো, ওটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নিজেও খাবে না, খেতেও দেবে না। কাউকে।

পাখীটার দেহ থেকে রক্ত ঝরিছে। কিন্তু সেদিকে ভ্বক্ষেপ নাই তার। মাথা উঁচু করে ইশারায় দেখিয়ে দিলো সেই বিশাল বৃক্ষটা। সিন্যবাদ। এবার ভালো করে লক্ষ্য করে, গাছটার ডালে জড়ানো অসংখ্য ময়াল সাপ। তাদের মুখ থেকে বিষ মেশানো লালা ঝরে ঝরে পড়ছে পুকুরের জলে। এই দৃশ্য দেখে ব্যথায় মথিত হতে লাগলো সিনবাদের হৃদয়। অনুতাপে দগ্ধ হতে থাকলো সমস্ত সত্তা।

প্রাসাদে ফিরে এসে ছালছাড়ানো ছাগলটাকে বাবুর্চির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, পাকাও ৷ সিনবাদের হাতের মুঠির ওপর বসে বাজপাখীটা তখনও খুঁকছিলো। একটুক্ষণ পরে ঝাঁপ করে পড়ে গেলো নিচে। সিন্যবাদ তুলে দেখলো, সব শেষ।

অনুতাপের অনলে পুড়তে লাগলো সিন্যবাদ। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে সে। আর কেউ না, আর কেউ না, আমি—আমি নিজেই তাকে খুন করেছি। আমার প্রাণের দোস্ত, আমার কলিজা…

বাদশাহ য়ুনান থামালো।

উজির বললো, কিন্তু জাঁহাপনা আপনার এ কাহিনীর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আপনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, সিন্যবাদ তার পরম সুহৃদ, উপকারী বন্ধু সেই বাজপাখীটাকে হত্যা করে পরে অনুতপ্ত হয়েছিলো। কিন্তু ওই রায়ান আপনার পরম সুহৃদ-উপকারী বন্ধু আদপেই না। ও হচ্ছে ফন্দীবাজ, দারুণ শয়তান। কিন্তু হুজুর এখন ভালো মন্দ বিচার করতে পারছেন না। রায়ানের মোহে আপনি আচ্ছন্ন। আপনার মোহ কেটে গেলে আপনা থেকেই বুঝতে পারবেন। এখন আপনাকে হাজার বোঝালেও বুঝবেন না।

সেই উজির আর বাদশাহ পুত্রের কাহিনী কি জানেন আপনি? উজির যেমন তার বাদশাহ পুত্রের অনিষ্ট করতে গিয়ে নিজেই ধ্বংস হয়েছিলো। তেমনি আপনিও একদিন নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *