০১. সেমেটিয় গোষ্ঠীভূত আরব জাতি

ইসলাম-পূর্ব যুগ

অধ্যায় ১
সেমেটিয় গোষ্ঠীভূত আরব জাতি
সেমিটিয় গোষ্ঠীর ধাত্রী আরব ভূখণ্ড

অনুসন্ধানের কারণ

আধুনিক ঐতিহাসিকদের অন্বেষণে আরব-ইতিহাসের উৎস-সন্ধান বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। ভাবতে অবাক লাগে, আরবের মত বিশাল এক রাষ্ট্র এবং তার জনগণ সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় সম্পূৰ্ণ উপেক্ষিত। শুধু ভৌগোলিক আয়তনের বিচারেই আরবের তুলনায় নেহাতই ক্ষুদ্র অন্যান্য অনেক রাষ্ট্র অনুসন্ধিৎসু ঐতিহাসিকদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে অনেক বেশি।

আরবের আয়তন ইউরোপের এক-চতুর্থাংশ বা আমেরিকার এক-তৃতীয়াংশ। কিন্তু আরব এবং আরবীয়দের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের তুলনায় অজানার অনুপাত বিস্ময়করভাবে বেশি। সুমেরু এবং কুমেরু সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেই তুলনায় আরব সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।

সেমেটিয় গোষ্ঠীর সম্ভাব্য ধাত্রী এই আরব ভূখণ্ড। এখান থেকেই সমুদ্ধির পথে যাত্রা করা পথিকরা উত্তর কালের ইতিহাসে ব্যাবিলনিয়, অ্যাসিরিয়া, ফিনিশিয় বা হিব্ৰু নামে পরিচিত হয়। বিশুদ্ধ সেমেটিয় চরিত্রের উৎস অনুসন্ধান কবতে হবে আরবের বালরাশির মধ্যেই। কারণ, এখানেই রোপিত ও অন্ধরিত হয়েছিল ইহুদি ধর্ম এবং পরবর্তীকালের খ্রিস্টধর্মের বীজ। মধ্যযুগে এই আরবেই জন্ম হয় এমন এক মহামানবের, যিনি সেই সময়ের সভা বিশ্বের বৃহদংশই জয় করেছিলেন। প্রবর্তন হয় ইসলাম ধর্মের, যা বিশ্বের প্রায় সব জাতি এবং গোষ্ঠীর মধ্যে পল্লবিত এবং এখনও যার ছত্ৰচ্ছায়ায় রয়েছেন ৪৫ কোটি অনুগামী। সমসাময়িক বিশ্বের প্রতি আট জনের এক জন হযরত মুহাম্মাদের অনুগামী এবং আযানের সূর প্রতি ২৪ ঘণ্টার অধিকাংশ সময়েই এই বিশ্বের গরিষ্ঠাংশে ধ্বনিত হচ্ছে।

আরবীয়দের নামের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে লিয়েছে বিশ্বজয়ী শাসকদের নামের জ্যোতির্বলয়। আরব জাতির অভ্যুত্থানের একশ বছরের মধ্যেই অতলান্তিক সাগবেব বিস্তীর্ণ বালুতটে থেকে চীনের নিবিড়তম অঞ্চল পর্যন্ত এই বিশ্বজয়ীরা তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। আয়তনে এই সাম্রাজ্য ছিল সুবর্ণযুগের রোম সাম্রাজ্যের থেকে ও বিপুল ও বিশাল। ত্বরিৎ এবং ব্যাপক এই বিস্তার ইতিহাসে নজিরবিহীন। বর্ণ ভাষা এবং আকৃতিতে বিভিন্ন যে অজস্ৰ জনগোষ্ঠী সাম্রাজ্য বিস্তারের বিপুল এই উদ্যোগে আরবীয় রাজদণ্ডের আওতায় আসে তার তুলনায় হেলেনিয়, রোমান, অ্যাংলো-স্যাকসন বা রাশিয়ান সাম্রাজ্যও তুচ্ছ।(১)

আরবীয়রা শুধু এক বিশাল সাম্রাজ্যই গড়েননি, সৃষ্টি করেছিলেন এক সংস্কৃতির। নীল নদের উপত্যকা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের তীরভূমি এবং ভূমধ্যসাগরের পূর্বতটে যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল আরবীয়রা ছিলেন তারই উত্তরসূরি। গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির ধারায় পরিপুষ্ট আরবীয়রা এই সংস্কৃতির নির্যাস পৌঁছে দিয়েছিলেন মধ্যযুগের ইউরোপের বিদগ্ধজনের কাছে। দীপ্তবুদ্ধির এই পরিক্রমই উত্তরকালের প্রতীচ্যে এনেছিল নবজাগরণের আশ্বাস! আরবীয় এবং আরবী ভাষীদের অগ্রণী ভূমিকাতেই মধ্যযুগে মানবসভ্যতার বিকাশ ও বৃদ্ধি। ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের মতই তৃতীয় এবং সর্বশেষ একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা আরবীয়রা। ঐতিহাসিকদের বিচারে, ইসলামধর্ম এই দুই ধর্ম সঞ্জাত। তাই অন্যান্য সব ধর্মের তুলনায় ইসলামের নৈকট্য এই দুই ধর্মের সঙ্গেই। কারণ, সেমেটিয় জীবনচর্যাই এই তিন ধর্মের উৎস। খ্রিস্টধর্মের অল্প কয়েকটি অনুশাসনে রদবদল ঘটালেই ধর্মপ্রাণ এক মুসলমানের কাছে তা গ্ৰহণীয় হয়ে উঠতে পারে। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ইসলাম আজও এক চলিষ্ণু ও জীবন্ত বিশ্বাস, কোটি কোটি মানুষের জীবনচর্যার রূপরেখা।

মধ্যযুগের কয়েক শতাব্দী জুড়ে আরবী ভাষা ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল চিন্তার বাহক। কিন্তু আজ তা ব্যাপ্ত হয়েছে কয়েক কোটি মানুষের কথ্য ভাষায়। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে অন্যান্য ভাষার তুলনায় আরবীতেই বেশি চর্চিত হয়েছে দর্শন, ইতিহাস, ধর্ম, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূবিদ্যা। পশ্চিম ইউরোপের ভাষায় আরবীর প্রভাব আজও স্পষ্ট। বহু আরবী শব্দই এই সব ভাষার শব্দ-তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। লাতিনের পরেই আরবী বর্ণমালার ব্যবহার হত বিশ্বে সব থেকে বেশি। পারসি, আফগান, উর্দু এবং তুর্ক, বারবার ও মালয়ের অধিকাংশ ভাষাই লেখা হত আরবী বর্ণমালায়।

ব্যাবিলনিয়, ক্যালডিয়া, হিট্রাইট এবং ফিনিশিয়ারা আজ বিলুপ্ত। কিন্তু আরবীয় এবং আরবী-ভাষীদের অক্তিত্ব ইতিহাসের কাল থেকে আজও প্রখরভাবে বিদ্যমান। তাদের ভৌগোলিক অবস্থান বিশ্ববাণিজ্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশে। বর্তমানের রাজনীতিতে আরবের অবস্থান প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঠাণ্ডা লড়াইয়ের মধ্যভূমিতে। আরবের বালুরাশির মধ্যেই সঞ্চিত রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম তরল শক্তি-তেল। খনিজ এই তেলের প্রথম সন্ধান মেলে ১৯৩২ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আরবে সার্বভৌমত্বের চেতনা আসে এবং তার পর আসে স্বাধীনতা। ইসলামের অভু্যত্থানের পর আরব ভূখণ্ড এই প্রথম সংহত এক শাসনের (সুয়ুদি) অধীনে আসে। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ১৯৫২ সালে মিশর সাধারণতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসাবে নিজেকে চিহ্নিত করে। এর সাত বছর আগে, ফরাসি শাসনমুক্ত হয় সিরিয়া। এখানেও চালু হয় সাধারণতন্ত্র। মনে রাখতে হবে, সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস থেকেই গড়ে উঠেছিল বর্ণময় উমাইয়াদ সাম্রাজ্য। আব্বাসীয় রাজবংশের অবলুপ্তির পর থেকেই আল-ইরাক বাস্তবিকভাবে নৃপতিবিহীন। তবে, বাগদাদে এক সুলতানকে একবার বসানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তারপর রাজতন্ত্র আল-ইরাকেও বাতিল হয়ে যায়। জন্ম নেয়। সাধারণতন্ত্র। তবে, এদের মধ্যে লেবাননেই প্রথম প্রতিষ্ঠা হয়। সাধারণতন্ত্রের। ট্রান্স জর্ডন এবং প্যালেস্তাইনের একাংশ মিলে ১৯৪৯ সালে গড়ে ওঠে। জর্ডনের হাশিমি রাজ্য। ফরাসি শাসন থেকে ১৯৫০ সালে মুক্ত হয় উত্তর আফ্রিকার মরক্কো, টিউনিশিয়া, মরিতানিয়া এবং আলজিরিয়া। ইতালির অধীনতা থেকে ১৯৬০ সালে স্বাধীন হয় সিরিয়া। স্বাধীনতার প্রতীক-মুক্ত বিহঙ্গ ফিনিক্স আরবের অ্যাকাশে আবার ডানা মেলে।

সাম্প্রতিক অভিযান

প্রাচীন ইউরোপের ধারণা ছিল শুধু দক্ষিণ আরব সম্পর্কে। হেরোডোটাস এবং অন্যান্যদের লেখায় এর পশ্চিম উপকূলের উল্লেখ পাওয়া যায়। দক্ষিণ আরব সম্পর্কে গ্রিক ও রোমানদের উৎসাহের কারণ ছিল দুটি। প্রথমত, এখানে ধুনো-গুগগুল এবং রান্নার মশলা পাওয়া যায়; দ্বিতীয়ত, ভারত ও সোমালিল্যাণ্ডের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগসূত্র হিসাবে দক্ষিণ আরবের গুরুত্ব। কিন্তু মধ্যযুগের শেষপাদ এবং আধুনিক যুগের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বৃহত্তর আরব ইউরোপের কাছে অপরিচিতই ছিল। তবে, সম্প্রতি সূচনা হয়েছে নতুন করে আরবকে চেনার প্ৰয়াস। এই প্রয়াসের নান্দীপাঠ করেছেন ভূপৰ্যটক, খ্রিস্টধর্ম-প্রচারক, বণিক এবং ১৮১১ থেকে ১৮৩৬ পর্যন্ত মিশর অভিযানের ভারপ্রাপ্ত ফরাসি ও ইংরাজ সরকারের পদস্থ আমলারা। তা ছাড়া, কূটনৈতিক দূত এবং অনুসন্ধিৎসু বৈজ্ঞানিকরাও ত্বরান্বিত করেছেন এই প্রয়াস।

সম্প্রতিকালে আরব সম্পর্কে প্রথম অন্বেষণ শুরু করেন পণ্ডিত কার্সটেন নাইবুর। ১৭৬১ সালে ডেনমার্কের রাজার উদ্যোগে পাঠানো এক অভিযাত্রী দলের সদস্য ছিলেন তিনি। প্রাচীন ইউরোপের সব চেয়ে চেনা জায়গা ছিল দক্ষিণ আরবের আল-ইয়ামান। আরবকে নতুন করে চেনার প্রথম পাঠ শুরু হয় এখান থেকেই। আরব ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কেন্দ্ৰ আল-হিজাজ ভৌগোলিকভাবে ইউরোপের খুব কাছে হলেও এ জায়গা সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায়নি। সম্প্রতিকাল পর্যন্ত মাত্র জন্য ১২ ইউরোপিয় ধমীয় নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে এখান থেকে তথ্য সংগ্ৰহ করতে পেরেছেন।

১৮১২ সালে জোহান লুডউইগ বার্কহার্ড নামে সুইডেনের এক অধিবাসী শিক্ষিত সমাজের কাছে তুলে ধরেন পেত্র-কে। ইবরাহীম ইবনে-আবদুল্লাহ ছদ্মনামে তিনি মক্কা এবং মদীনায় যান। তার বিবরণী সংস্কার করার মত তথ্য এ. পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বার্কহার্ডের মুসলিম সমাধি আজও কায়রোর সব থেকে বড় কবরস্থানে রক্ষিও। ১৯২৫ সাল পর্যন্ত মাত্র আর একজন ইউরোপিয়ই মক্কার দৈনন্দিন জীবন পর্যবেক্ষণের সুখে, গ, পেয়েছেন। তিনি হলেন লিডেনের অধ্যাপক স্নাউক হারগ্রোনজে। তিনি মক্কায় যান ১৮৮৫-৮৬ সালে। ১৮৪৫ সালে সুইডেনের তরুণ পণ্ডিত জর্জ অগাস্টাস ওয়ালিন ভাষাতত্ত্বের গবেষণা চালাতে নাজদে পৌঁছান। ১৮৬১ সালে লেবানন থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পর তৃতীয় নেপোলিয়ান চেয়েছিলেন মধ্য-আরবে নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে। ১৮৬৩ সালে সেই উদ্দেশ্যে তিনি উইলিয়াম জিফোর্ড প্যালগ্রেভ নামে এক ইংরাজকে সেখানে পাঠান। প্যালগ্রেভ ছিলেন ইহুদি পরিবারের সন্তান এবং এক খ্রিস্টিয় সঙেঘর সভ্য। তিনি লেবাননের যাহলাহু অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। নাজদের প্রত্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলে গিয়েছেন বলে দাবি করলেও বাস্তবে প্যালগ্রেভ ও সব জায়গায় যাননি। আরব্য রজনীর বিখ্যাত অনুবাদক সার রিচার্ড এফ বার্টন ১৮৫৩ সালে মক্কা ও মদীনায় যান তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে এবং আল-হাজ্জ-আবদুল্লাহ ছদ্মনামে। উত্তর আরবে যে দুজন ইউরোপিয় মহিলা গিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন অ্যানি ব্লান্ট। ১৮৭৯ সালে তিনি নাজদে পৌঁছান বিচিত্র সব অভিযানের যাত্রী হয়ে। এই সব অভিযানের একটি ছিল আরবী ঘোড়ার খোজ করা। ১৮৭৫ সালে চার্লস এম ডাউটি নামে এক ইংরাজ নাসিরানি’ (খ্রিস্টান) এবং ইংলিসি’ হিসাবে উত্তর আরবে অভিযান চালান। তঁর এই অভিযানের রোজনামচা ‘ট্রাভেলস ইন অ্যারাবিয়া ডেজার্টা’ ইংরাজি সাহিত্যের এক ধ্রুপদী রচনা। ঠিক তেমনই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক রচনা টি ই লরেন্সের সেভেন পিলারস অব উইজডম বিশেষভাবে প্রশংসিত। সাম্প্রতিক অভিযানগুলির অন্যতম উত্তর আরবে আলোয়িস মুসিল নামে এক চেকোস্লোভাকিয়াবাসীর। এই এলাকা সম্পর্কে তাকে বিশেষজ্ঞ বলা যায়। এছাড়া উল্লেখযোগ্য, আমিন রিহানি নামে আমেরিকায় থাকা এক লেবাননবাসী। আরব মুলুকের সব রাজাদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলেছিলেন তিনি। এলডন র্যাটার ১৯২৫-২৬ সালে মক্কা ও আল-মদীনায় গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বারট্রাম টমাসের বিশেষ কৃতিত্বের কথাও বলতে হয়। ১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রাচ্যের ভাষা বিশেষজ্ঞ টমাসই প্রথম আরবের দক্ষিণে আলরাব আল-খালি মরুভূমি অতিক্রম কবেন। এর আগে পর্যন্ত কোন পর্যটক বা অনুসন্ধানীর দৃষ্টি পড়েনি এই মরুভূমির দিকে। ঠিক এক বছর পরে তঁকে অনুসরণ করেন এইচ সেন্ট জে বি ফিলবি এবং আল-হাজ আবদুল্লাহ। ১৯৩২ সালের ৭ জানুয়ারি পারস্য উপসাগরের কাছে আল-হুফুফ থুেকে তাঁদের যাত্রা শুরু হয়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে আল-রাব আল-খালি মরুভূমি অতিক্রম করতে তাদের সময় লাগে ৯০ দিন।

দক্ষিণ আরবীয়দের ভাষায় তাদের নিজের কথা জানার সুযোগ এনে দেয় হিময়ারাইট লিপি। ১৮৬৯-৭০ সালে ফরাসি বিশেষজ্ঞ জোসেফ হেলভি এবং ১৮৮২ থেকে ১৮৯৪ সালে অস্টিয়াবাসী ইহুদি এডওয়ার্ড গ্লেজার এই লিপি আবিষ্কার করেন। জোসেফ হেলভি এক ভিখারির ছদ্মবেশে এই লিপি উদ্ধারের কাজে জেকসালেমে যান। তবে এই লিপির পাঠোদ্ধার হয়েছে সম্প্রতি। আরবী ভাষায় ইসলামি সাহিত্য রচিত হয়েছে অনেক পরে এবং এদের সংখ্যা ও প্রচুর। এই সব লেখায় মৌলিকতার অভাব এবং অনুকরণের প্রবণতা থাকলেও প্রাচীন আরবের ইতিহাস জানার এটি এক উল্লেখযোগ্য সূত্র। বিক্ষিপ্তভাবে লাতিন ও গ্রিক সাহিত্যেও আরবের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া, ফারাও এবং অ্যাসিরিয়-ব্যাবিলনিয় রাজবংশের ইতিহাসের পুরাতাত্ত্বিক লিপিতে আরবের নিদর্শন মেলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি পাঠোদ্ধার হওয়া হিময়ারাইট লিপি এবং আধুনিক পর্যটনকারী ও অভিযাত্রীদের বিবরণী। প্রাচীন আরব সম্পর্কে জানার এগুলিই আমাদের মুখ্য উপকরণ।

গোষ্ঠী সম্পর্ক

সেমেটিয় গোষ্ঠীর আজকের দুই প্রতিনিধি আরবীয় এবং ইহুদি। কিন্তু মূল সেমেটিয় গোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য রক্ষার ক্ষেত্রেও ইহুদিদের তুলনায় বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে আরবীয়রা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সেমেটিয় গোষ্ঠীর ভাষাগুলির মধ্যে আরবী অনেকটাই নবীন। কিন্তু ভাষার বাঁধুনি ও শৈলীতেও হিব্রু বা অন্য ভাষার তুলনায় সেমেটিয়ার সঙ্গেই আরবীর মিল বেশি। তাই সেমেটিয় ভাষা চর্চার অন্যতম সূত্রই হল আরবী। সেমেটিয় ধর্মের যুক্তিপূর্ণ ও পরিমার্জিত রূপের সঙ্গে মূল ইসলাম ধর্মের অনেক সাদৃশ্য। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইহুদিরা। তাই এই দুই মহাদেশে সেমেটিয় বা সেমেটিয় বৈশিষ্ট্যধারী বলতে ইহুদিদেরই বোঝায়। কিন্তু আসলে তীক্ষ্ণ নাসা এবং অন্যান্য যেসব গড়নকে সেমেটিয় আখ্যা দেওয়া হয় আদপেই তা সেমেটিয় নয়। প্রকৃতপক্ষে তা ‘সেমেটিয়াদের’ থেকে ইহুদিদের আলাদা করে। হিটাইট-হুররিয়ান ও হিব্রুদের(৩) মধ্যে প্রাচীন যুগে যে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হয়। এইসব বৈশিষ্ট্য তারই ফল।

আকার, প্রকৃতি, মানসিকতা, সামাজিক বিন্যাস এবং ভাষা-বৈশিষ্ট্যে সেমেটিয় গোষ্ঠীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্ৰতিভূ আরবীয়দের আরবীয় হয়ে ওঠার, বিশেষত যাযাবর জীবনচর্যায় অভ্যস্ত হওয়ার কারণ আরবের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা এবং নিঃসঙ্গ মরুজীবনের একঘেয়েমি। এই নির্মম বিচ্ছিন্নতা এবং প্রাকৃতিক কার্পণ্যের বিনিময়েই তারা রক্ষা করেছিল তাদের সেমেটিয় শুদ্ধতা।

আরবরা তাদের বাসভূমিকে বলে ‘জাজিরাত আল-আরব’ বা ‘আরবদের দ্বীপ’। সমস্ত দিক থেকেই বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের তিনদিকে জল এবং একদিকে বালি। ভূমি এবং ভূমিপুত্রদের অবাধ এবং অসঙ্কুচিত সম্পর্কের এ এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

ভারত, গ্রিস, ইতালি, ইংল্যাণ্ড বা আমেরিকার ইতিহাস যেমন বহিরাগতদের বারংবার প্রবেশ ও অনুপ্রবেশের সংঘাত এবং অভিঘাতে বিচলিত এবং বিচিত্রিত, অভিবাসনের সেরকম কোন ঐতিহাসিক তথ্য আরবের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি আরব-আক্রমণের বা বিজয়-প্রয়াসের কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র। অন্তত ইতিহাসের সালতামামির তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, আরবের মানুষ তাদের বাসভূমিতে আদিলগ্ন থেকেই এক রকম জীবন কাটাচ্ছে।(৪)

ইংরাজি ‘সেমাইট’ শব্দটির উৎস ওল্ড টেস্টমেন্টের (জেনেসিস, ১০. ১) ‘শেম’ শব্দে নিহিত। লাতিনে অনুদিত বাইবেলে এই শব্দটির সন্ধান মেলে। প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী তথাকথিত সেমেটিয়রা নোয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্রের বংশধর এবং জাতিগতভাবে সমগোত্রীয়। কিন্তু সেই মতবাদ আজ আর গ্রহণযোগ্য নয়। তা হলে সেমেটিয়দের প্রকৃত পরিচয় কী?

পশ্চিম এশিয়ার ভাষাতাত্ত্বিক মানচিত্র বিচার করলে দেখা যায় সিরিয়া, প্যালেস্তাইন, মূল আরব-ভূখণ্ড এবং আল-ইরাকে বর্তমানে আরবীভাষী মানুষেরই বসবাস। কিন্তু ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, খ্রিস্টের জন্মের চরহাজার বছর আগে ব্যাবিলনিয় (এখানকার রাজধানী আক্কাদু, আগাদের নামানুসারে এদের আদি নাম আক্কাদিয়ান) অ্যাসিরিয়া এবং পরে ক্যালডিয়ানরাই টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের মধ্যবর্তী উপত্যকা দখল করেছিল। ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর আমোরাইট এবং ক্যানোনাইটদের (ফিনিশিয়া সহ) নিয়েই গঠিত ছিল সিরিয়ার জনসংখ্যা। ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ আরামিয়রা সিরিয়ায় এবং হিব্রুরা প্যালেস্তাইনে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করে। ১৯ শতক পর্যন্ত আমরা একথা উপলব্ধি করতে পারিনি যে, এইসব জাতির মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। ১৯ শতকেরই মধ্যভাগে পাঠোদ্ধার করা হয় প্রাচীন কীলকাকার লিপির। সেইসঙ্গে অ্যাসিরিয়া ব্যাবিলনিয়, হিব্রু, আরামাইক, আরবী এবং ইথিওপিয় ভাষার তুলনামূলক বিচার করে দেখা যায়। এইসব ভাষার মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। এরা সকলেই সমগোত্রীয়। এমনকী ক্রিয়ার গঠন, কাল বা সর্বনামের মত ব্যকরণগত দিক থেকেও এইসব ভাষার গঠনশৈলী একইরকম। এইসব ভাষায় যাঁরা কথা বলতেন তাদের চেহারায় যেমন সাদৃশ্য ছিল, বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা ধর্মবিশ্বাসেও তেমনই আশ্চর্যরকমের মিল। ভাষার এই নিবিড় বন্ধন এইসব জাতির মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্যেরই পরিচায়ক। এই ঐক্যের বৈশিষ্ট্য হল গভীর ধর্মীয় প্রেরণা, সুদূরপ্রসারী কল্পনা, সুস্পষ্ট ব্যক্তিস্বতন্ত্র্য এবং নিষ্ঠুর মনোভাব। এর থেকে একটি সিদ্ধান্তেই আসা যায়—ব্যাবিলনিয়, অ্যাসিরিয়, আরামিয়, ফিনিশিয়, আমোরাইট, ক্যালডিয়ান, হিব্রু, আরবী এবং আবিসিনিয়রা পৃথক জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশের আগে নিশ্চয়ই কোন এক ভূখণ্ডে এক সময়ে এক জাতি হয়েই বাস করত।

সেমেটিয় গোষ্ঠীর ধাত্রী আরব

তা হলে কোথায় ছিল এইসব মানুষের আদি নিবাস? এব্যাপারে জ্ঞানীজনেরা একাধিক অনুমানের আশ্রয় নিয়েছেন। যাঁরা সেমেটিয় ও হ্যামাইটদের মধ্যে জাতিগত সম্পর্ক বিচার করেছেন, তাদের মতে পূর্ব-আফ্রিকাই ছিল সেমেটিয়দের বাসভূমি। অপরদিকে বাইবেলের ঐতিহাসিকতায় বিশ্বাসীরা ন্মনে করেন, মেসোপটেমিয়াতেই সেমিটিয়দের মূল নিবাস। তবে এক্ষেত্রে, আরব উপদ্বীপের সপক্ষে পেশ করা যুক্তিকেই সার্বিকভাবে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করা হয়। মেসোপটেমিয়া-সংক্রান্ত তত্ত্ব অনুযায়ী, সেমেটিয়রা নদীর উপকূলের কৃষিপ্রধান জাতি থেকে যাযাবরে পরিণত হয়। কিন্তু এই তত্ত্ব প্রাচীনযুগের সমাজতাত্ত্বিক নিয়মের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। আফ্রিকার সপক্ষ যুক্তির বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক সংশয়।

আরবের ভূভাগের অধিকাংশই মরু। সীমানা জুড়ে সামান্য কিছু জমি বসবাসের যোগ্য। সীমানার প্রহরায় রয়েছে লবণাক্ত সমুদ্র। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বাড়তি জমির প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু কোথায় জমি? একদিকে তপ্ত মরু— অপরদিকে আরব সাগর। দু’দিকেই বাধা দূর্লঙ্ঘা। পথ একটাই। আরব সাগরের পশ্চিম তট ধরে উত্তরাভিমুখে গিয়ে নীলনদের উর্বর উপত্যকায় পৌছানো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ বছর আগে, সেমেটিয়দের এক গোষ্ঠী এই পথেই অথবা পূর্ব-আফ্রিকা হয়ে নীলনদের উপত্যকায় পৌঁছেছিল। মিশে গিয়েছিল। এখানে বসবাসকারী হ্যামিটিয় জনগোষ্ঠীব্য সঙ্গে। আর এই মিশ্রণেই উত্তরকালের ইতিহাসে জন্ম নিয়েছিল মিশরিয়রা। এরাই হলেন সেই মিশরিয়া যাঁরা মানবসভ্যতার প্রথম সোপানগুলি গড়ে দিয়েছিলেন। নির্মাণের কাজে পাথরের ব্যবহার কিংবা সৌর বর্ষপঞ্জি এদেরই দান; প্রায় একই সময়ে পূর্বতটি ধরে আর একটি গোষ্ঠী টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর উপত্যকায় এসে পৌছায়। এখানে তখন সুমেরিয়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ। ইউফ্রেটিস-তাটের এই সভ্যতা সুমেরিয়রাই গড়েছিলেন। যাযাবর হিসাবে সেমেটিশ্নরণ এখানে পৌঁছেই শিখেছিলেন গৃহবাসী হতে, বাড়ি তৈরির কলাকৌশল, চাষ-আবাদ এবং বর্ণমালা। সুমেরিয়রা কিন্তু সেমেটিয় ছিলেন না। এখানে এই দুই গোষ্ঠীর মিশ্রণেই জন্ম নিল পরবর্তীকালের ব্যাবিলনিয়র। সংস্কৃতির যে উত্তরাধিকার আমবা ভোগ করছি তার প্রথম পুরুষ এরই। এদেব হাতেই জন্ম নিয়েছিল ধনুৰ্ব্বান, চাকওয়ালা গাড়ি এবং ওজন ও মাপ।

সেমেটিয গোষ্ঠীর এই বর্ণময় উত্থানের আর এক সঙ্গী আমোবাইট গোষ্ঠী। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে এই দুই গোষ্ঠীর মেলবন্ধন ঘটে। আমোরাইট গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। ক্যানোনাইট এবং ফিনিশিয়দের নিয়ে; এই ক্যান্যানাইটরাই ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরে পশ্চিম সিরিয়া ও প্যালেস্তাইন জয় করেন। সমুদ্রতটবাসী ফিনিশিয়দের নামকরণ করেন গ্রিকলা। সভ্যতার সেরা আবিষ্কার বর্ণলিপি প্রথম তৈরি ব-রেছিলেন। এঁরাই ২২টি সাঙ্কেতিক চিহ্নের এই লিপি ফিনিশিয়দেব হাতেই ব্যাপক প্রচার পায়।

খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১২০০-র মধ্যে দক্ষিণ-সিরিয়া ও প্যালেস্তাইনে পৌঁছান হিব্রুরা। (পরবর্তীকালের সিরিয়াবাসী) আরামিয়ানরা পৌঁছান উত্তর সিরিয়ায় বিশেষত কোয়েলি সিরিয়ায়।(৬) একেশ্বরবাদ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে প্রথম স্পষ্ট ধারণা দিয়েছিলেন এই হিব্রুরাই এবং এই ধারণাই উত্তরকালে খ্রিস্ট এবং ইসলামধর্মে পল্লবিত!

প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নাবাটিয়ানরা সিনাইট অঞ্চলের উত্তর-পূর্লে তাদের সভ্যতা গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে রোমানদের প্রভাবে এই সভ্যতা উন্নতির যে শীর্ষে উঠেছিল, তার প্রমাণ পার্বত্য-রাজধানী পেত্রার ধ্বংসাবশেষে আজও প্রতীয়মান।

এক ভূখণ্ড থেকে আর এক ভূখণ্ডে যাতায়াতের নতুন এবং চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় সাতের শতকে ইসলামের ছত্ৰছায়ায়। এই জনজোয়ারে শুধু আরবের মূল ভূখণ্ড নয়, প্লাবিত হয়েছিল পারস্য উপসাগরের শীর্ষ থেকে ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ পর্যন্ত যদি কোন বক্ররেখা আঁকা যায়। তার অন্তৰ্গত সমগ্ৰ জনাঞ্চল। এই ঢেউ পৌঁছেছিল মিশর, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, পারস্য এবং মধ্য এশিয়ার(৭) কিছু অঞ্চলেও।

এই তরঙ্গের শেষ অভিঘাত ইতিহাসের পূর্ণ চেতনার মধ্যেই পডে। তাই যে সব ইতিহাসবিদ মনে করেন, সেমেটিয় গোষ্ঠীর ধাত্রীভূমি আরব, তারা এই ঐতিহাসিক অভিঘাতকে সপক্ষ যুক্তির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেন। এদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে অন্যান্য এই ধরনের গোষ্ঠীর তুলনায় সেমেটিয়দের চরিত্র বৈশিষ্ট্য আরবীয়দের মধ্যেই শুদ্ধতমরূপে বিদ্যমান এবং জীবনচর্যায় প্রকাশিত। বিদ্বৎজনের মতে, এঁদের ভাষা এবং উচ্চারণও আদিম সেমেটিয় উচ্চারণের খুব কাছাকাছি। ক্ৰমিক এই গতায়াতের যে সালতামামি আগে দেওয়া হল তার তুলনামূলক বিচারে দেখা যায়, পরবর্তী এক হাজার বছরে জনসংখ্যার বৃদ্ধি যে হারে ঘটেছে তাতে অন্য ভূখণ্ডের সন্ধানে যাওয়া ছাড়া সেমেটিয় গোষ্ঠীর অন্য কোন উপায় ছিল না। যে সব পণ্ডিত এই ধারণার অনুসারী তারাই এই গতায়াতকে ‘তরঙ্গ’ নামে অভিহিত করেছেন। ইউরোপিয়রা যেভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেমেটিয় গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি; ছোট একটি দল প্রথমে অজানা বহির্বিশ্বের সন্ধানে যাত্রা করে, ক্ৰমে অনুসরণকারী দলের সংখ্যা বাড়তে থাকে যতক্ষণ না পুরো জনগোষ্ঠীই উদ্বেল হয়ে ওঠে।

ধূসর মরু থেকে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের শস্য-সবুজ ক্ষেত্রে অবিরত মানুষের ঢল নামা বা বিক্ষিপ্ত অথচ ক্ৰমিক জনগোষ্ঠীর আগমণ ছিল প্ৰায় নিত্যদিনের ঘটনা। তাই এই স্থান ও কালের দীর্ঘ ও বন্ধুর ইতিহাস জানার ও বোঝার সূত্র এটিই। পরিযায়ী এই গোষ্ঠী নিকটতম শ্যামল-সভ্যতায় পৌঁছে কিছু পরিমাণে তাদের আচার-ব্যবহার ও সংস্কৃতি গ্রহণ করত, পরিবর্তে দেওয়ার চেষ্টা করত নিজেদের ধ্যান-ধারণা এবং অভিজ্ঞতার ফসল। কিন্তু কোনক্ষেত্রেই ভূমিপুত্রদের সমূলে উৎপাটনের কোন চেষ্টা থাকত না। দক্ষিণ-পূর্ব প্রাচ্যের ইতিহাসে ঠিক এমনটিই ঘটেছিল। এই ইতিহাসের এক বৃহদংশই পরিযায়ী আরব এবং দক্ষিণ-পূর্ব প্রাচ্যের ভূমিপুত্রদের সংগ্রামের ইতিহাস। আসলে, অভিবাসন বা ঔপনৈবিশকতা যে দখলেরই মার্জিত রূপ এখানকার ইতিহাসই তার প্রমাণ।

এই অভিবাসনে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, প্রায় সব ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত টিকে গিয়েছে। সেমেটিয় ভাষাগোষ্ঠী। বহুক্ষেত্রে এই জয়ই পরবর্তীকালের ইতিহাসচর্চায় দিকনির্দেশকের কাজ করেছে। যেমন, মেসোপটেমিয়ায় যদি সুমেরিয় ভাষা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকত তা হলে সেমিটিয়ভাষীরা যে আদৌ কখনও এখানে এসে পৌঁছেছিল তার খুঁজে বার করা কঠিন হয়ে পড়ত। প্রাচীন মিশরের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেমিটো-হ্যামিটিক এক ভাষার উদ্ভব হয়েছে। এবং সে কারণেই মিশরিয়দের আমরা সেমিটিয় গোষ্ঠীর অন্তর্গত বলে মনে করি না। তাই, ‘সেমেটিয়’ শব্দটির ভাষাগত ব্যঞ্জনা জাতিগত ব্যঞ্জনার থেকে অনেক বেশি। অ্যাসিরিয়-ব্যাবিলনিয়, আরামাইক, হিব্রু, ফিনিশিয়, দক্ষিণ আরবীয়, ইথিওপিয় এবং আরবী ভাষাকে একটি সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা ‘উরসেমিটিস’ হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সমতুল একটি উদাহরণ হল, রোমানের সঙ্গে লাতিন ভাষার সম্পর্ক। সাহিত্যের অঙ্গনে অন্তত কিছু শব্দে লাতিন আজও চলিষ্ণু; কিন্তু সেমেটিয় ভাষা সম্পূর্ণই লুপ্ত। কারণ এই ভাষার মূল গঠনই ছিল বাচিক। তবে, সেমেটিয় ভাষার উত্তরসূরিদের জঙ্গমতা থেকেই অনুমান করা যেতে পারে মাতার অমেয় ক্ষমতা।

সেমেটিয়দের জন্মভূমি হিসাবে আরবকে (নাজদ অথবা আল-ইয়ামান)। চিহ্নিত করলেও একটি সম্ভাবনা কিন্তু বাদ দেওয়া যায় না। সম্ভবত সেমেটিয়দের উদ্ভব আরও প্রাচীনকালে, পূর্ব-আফ্রিকায়। হ্যামাইট নামে এক শ্বেত গোষ্ঠীর সঙ্গে বিজড়িত হয়ে। এই জনগোষ্ঠী থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি দল চলে আসে আরবের বাব-আল-মান্দবো। উত্তরকালে এরাই

হিসাবে এবং আরব সভ্যতার বিস্তার যে বিশাল ভূখণ্ডে তাই হল সেমেটিয় গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক মানচিত্র।

টীকা 

১. ডি জি হোগাৰ্গ, দ্য পেনিষ্ট্রেশন অফ অ্যারাবিয়া (নিউ ইয়র্ক, ১৯০৪) পৃ ৭।
২. অ্যারিবিয়ান ও অ্যারাবিস (আরবীভাষী মানুষজন) যেভাবে এই গ্রন্থে ব্যবহৃত হয়েছে তার পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য মূল ইংরজি গ্রন্থের ৪৩ পৃষ্ঠায় ৩ নং টীকা দেখুন।
৩. জর্জ এ বার্টন, সেমিটিক অ্যাণ্ড হ্যামিটিক অরিজিনস (ফিলাডেলফিয়া, ১৯৩৪) পৃ ৮৫-৭।। ইগনেস জে গেলব, হুবরিয়ানস অ্যাণ্ড সুবারিয়ানস (শিকাগো, ১৯৪৪), পৃ. ৬৯-৭০।
৪. বারট্রাম টমাস, দ্য নিয়ার ইস্ট অ্যাণ্ড ইণ্ডিয়া (লণ্ডন, নভেম্বর ১, ১৯২৮), পৃ. ৫১৬-১৯; সি রাথজোনস, জার্নাল এশিয়াটিক, CCXV নং ১(১৯২৯) পু ১৪১-৫৫।
৫. সি, লিওনার্দ উলি, দ্য সুমেরিয়ানস (অক্সফোর্ড, ১৯২৯) পু ৫-৬
৬. হলো সিরিয়া, অধুনা আল বিকা, উত্তর ও দক্ষিণ লেবাননের মাঝে অবস্থিত।
৭. হুগো উইকেলার, দ্য হিস্ট্রি অফ ব্যাবিলনিয়া অ্যাণ্ড অ্যাসিরিয়া; অনু-জেমস এ ক্রেগ (নিউ ইয়র্ক, ১৯০৭, পৃ. ১৮-২২।
৮. বাটন, পৃ ২৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *