০৩. ওয়াগন চুরির অভিযান

তৃতীয় অভিযান

পাণ্ডব গোয়েন্দা – ৩ – তৃতীয় অভিযান – ওয়াগন চুরির অভিযান / ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়

পাণ্ডব গোয়েন্দারা একদিন রামরাজাতলার দিকে বেড়াতে গেল। জায়গাটা ওদের এলাকা থেকে অনেক দূর। তাই পঞ্চুকে আর সঙ্গে নিল না। রামরাজাতলা জায়গাটা সত্যিই ভাল। প্রতি বছর রামনবমী থেকে শ্রাবণের শেষ রবিবার পর্যন্ত মেলা বসে। সেই মেলা দেখে ওরা অদূরে শংকরমঠের দিকে গেল।

এ জায়গাটা বেশ নির্জন। ওরা পাঁচজনে সেই নির্জনে একটা পুকুরের ধারে গিয়ে বসল। আগে এই পুকুর মাছে ভর্তি ছিল। লোকে এসে মুড়ি-ফুলুরি মাছেদের খেতে দিত। এখন ব্যাঙে ভর্তি।

ভোম্বল দু’শো গ্রাম চিনাবাদাম কিনেছিল। সেই বাদাম প্রত্যেকের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নিল ওরা। তারপর বসে বসে বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেতে লাগল।

এমন সময় হঠাৎ অদূরে সশব্দে একটা বোমা ফাটল। আর তারপরই দেখা গেল হইহই করে লোকজন ছুটে চলেছে। দোকানপাট বন্ধ হচ্ছে। সে এক হুলুস্থল ব্যাপার যাকে বলে।

বাবলু বলল, “সেরেছে। আজ তো দেখছি বাড়ি ফেরার দফা গয়া।”

বিলু বলল, “এখনই নিশ্চয়ই বাস বন্ধ হয়ে যাবে।”

বাচ্চু-বিচ্ছু ভয় পেয়ে বলল, “কী হবে তা হলে?”

এমন সময় আবার একটা বোমা ফাটল। কয়েকজন যুবক হঠাৎ একটা ঝোপের ভেতর থেকে পাইপগান বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে কালো পোশাক পরে বেরিয়ে এসে যেদিকে বোমা ফাটল সেই দিক লক্ষ্য করে ঠা-ঠা-ঠা করে গুলি ছুড়ল কয়েকটা।

ওদিক থেকেও আবার এদিকে গুলির জবাব এল।

বাবলু বলল, “গতিক সুবিধের নয় বিলু। দু’দলে মারামারি হচ্ছে। আমরা কোথাও লুকিয়ে পড়ি চল।”

হঠাৎ আলো নিভে গেল।

এই ঝামেলার মধ্যে তার কাটাও শুরু হয়ে গেছে তখন। অথবা তার কাটবার জন্যই এই ঝামেলা।

বিলু বলল, “সেই ভাল। এখন পালাতে যাওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার চেয়ে লুকোনোই যাক। কেন না যেভাবে গোলাগুলি ছুটছে তাতে যে-কোনও মুহুর্তে উদোর পিণ্ডি বুধের ঘাড়ে লেগে যেতে পারে।”

ভোম্বল বলল, “তবে আর দেরি নয়। তাড়াতাড়ি আয়।”

ওরা পাঁচজনে সেই অন্ধকারে মঠের পাশে একটা বাড়িতে গিয়ে ঢুকল। আলো না থাকায় ভেতরটা ছিল ঘন অন্ধকারে ঢাকা। ওরা তাই পা টিপে টিপে পরস্পর পরস্পরকে ধরাধরি করে নিরাপদ একটু আশ্রয় খুঁজতে লাগল।

ভোম্বল বলল, “এ কোথায় এসে ঢুকলুম রে ভাই? ভূতের বাড়ি নয়তো।”

বিলু বলল, “যে বাড়িই হোক। সাড়া-শব্দ না দিয়ে চুপচাপ বসে থাক।”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “কোনও লোকজনও তো নেই।”

বাবলু বলল, “সম্ভবত পোড়ো বাড়ি।”

এই বলে ওরা একটু একটু করে যেতে যেতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল। দেখল একটা ঘরের ভেতর থেকে ক্ষীণ একটু আলোর রেখা বাইরের দালানে এসে পড়েছে। আর ঘরের ভেতর কারা যেন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।

একজন বলছে, “অত ভয় করলে চলবে কেন? খুন-খারাপির এই তো সময়। আমরা কেটে কুটে রেখে দিয়ে চলে যাব আর হাঙ্গামাকারীদের ঘাড়ে দোষ চেপে যাবে। মাঝখান থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেকসুর খালাস পেয়ে যাব আমরা।”

আর একজন বলল, “তবে ভাই প্রথম কোপটা কিন্তু আমিই দেব। আগে প্রত্যেকদিন একটা করে মুণ্ডু না নামালে রাতে আমার ঘুম হত না। মানুষ মেরে মেরে হাতে কড়া পড়ে গিয়েছিল। এখন যেন কী রকম ভোঁতা মেরে যাচ্ছি।”

প্রথম জন বলল, “কিন্তু এখনও আসছে না কেন?”

অপর জন বলল, “বোধহয় বুঝতে পেরে গেছে।”

“অসম্ভব।”

“আসে যদি আজই শেষ করে দেব।”

“সময়ে না আসাটাই তো চিরঞ্জাবীবাবুর স্পেশালিটি। আজকাল আবার সাধু হতে চান। বলেন কি না এসব পেশা ছেড়ে দেবেন।”

“উনি যে বলছেন এই ডাকাতিই ওনার জীবনের শেষ ডাকাতি। আজ বাদে কাল কাজ। কিন্তু আসছেন কই? কোথায় হবে, কী করে কীভাবে হবে এসব কী না জানলে হয়? নিজে না আসতে পারেন কাউকে পাঠাতেও পারতেন।”

“তার মানেই উনি টের পেয়েছেন ডাকাতি করে ফেরার সময় আমরা ওঁকে শেষ করে দেব বলে।”

এবার একটা অন্য গলা বলল, “আর একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক। কেউ না কেউ আসতেও তো পারে। তা ছাড়া যা দিনকাল পড়েছে তাতে আসা যাওয়ার কোনও গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। ঝামেলা তো লেগেই আছে চারদিকে। সেইজন্যেই হয়তো আসতে পারছে না।”

“দেখা যাক।”

পাণ্ডব গোয়েন্দারা অবাক হয়ে সব শুনছিল।

ভোম্বল চুপিচুপি বলল, “এ যে একেবারে বাঘের গুহায় ঢুকেছি রে বাবলু।”

বাবলু বলল, “তাই তো দেখছি।”

বিলু বলল, “ব্যাপার গুরুতর।”

বাবলু বলল, “রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। তোরা এক কাজ কর, বাইরে বেরিয়ে যা। আমি একা এখানে থেকে যতটা অনুমান করতে পারি করে নিই।”

ভোম্বল বলল, “কী করবি তুই?”

“তোরা বাইরে যা না। যা করবার আমি করছি। তবে একটা কথা, যদি আমি বিপদে পড়ি তবে আমি জোরে সিটি দেব। তোরা তখন এদিকে না এসে সোজা থানায় চলে যাবি।”

বাবলুর কথামতো আচ্ছা’ বলে ওরা বাইরে চলে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে সাড়া এল, “কে?”

“আমি।”

একজন বলল, “বললুম আসবে। নিশ্চয়ই চিরঞ্জীবের লোক।”

“অন্য কেউও তো হতে পারে?”

“অন্য কে আসতে যাবে?”

দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল ফরসা লম্বা ন্যাড়-মাথা একটা লোক। লোকটা ঠিক ন্যাড়া নয়। মাথাটা কেশহীন। তেলা। মাকুন্দ যাকে বলে। গোঁফ, দাড়ি, ভুরু কিছু নেই। ধড়ের ওপর চোখ-মুখ-নাক আর কান বসানো যেন একটা মাংসর তাল। গায়ে ডোরাকাটা নাইনলের গেঞ্জি। লোকটা বলল, “কে তুই?”

বাবলু সাহস করে বলল, “আমি চিরঞ্জাবীবাবুর কাছ থেকে আসছি।”

“এত দেরি হল যে?”

“কী করব, রাস্তায় খুব গোলমাল।”

“তাই বলে এত দেরি? এই তো লাইনের ওপারেই বাড়ি। দু-মিনিটের পথ নয়। উনি নিজেই বা এলেন না কেন?”

“তা জানি না। তবে উনি বললেন চারিদিকে খুব পুলিশের উপদ্রব। যেখানে সেখানে বোমা ফাটছে। যদি কিছু হয়ে যায় তাই আমাকে পাঠালেন। কাল কোথায় যেন যেতে হবে সে সম্বন্ধে একটু লিখে দিন।”

ন্যাড়া-মাথা বলল, “দিচ্ছি। কিন্তু তুই চিরঞ্জাবীবাবুর কে?”

“কেউ নই। এই পাড়াতেই থাকি। আমাকে উনি বললেন এই খবরটা এখান থেকে নিয়ে যেতে পারলেই পাঁচটা টাকা দেবেন।”

ন্যাড়া-মাথা বলল, “হুম। ঠিক আছে। তুই দাঁড়া। আমি এখুনি সব লিখে দিচ্ছি।”

বাবলু অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে রইল। একবারও ভেতরে ঢোকবার চেষ্টা করল না। কেন না ভেতরে ঢুকলেই আলোতে ওরা ওর মুখ দেখতে পাবে। আর তার ফলে পরবর্তীকালে ওদের সঙ্গে দেখা হলেই ওরা চট করে চিনে ফেলবে ওকে।

একটু পরেই ন্যাড়া-মাথা ওর হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিল।

বাবলুও চিঠি পাওয়া মাত্রই উধাও হয়ে গেল সেটা নিয়ে।

তারপর বাইরে এসে দেখল বিলু, ভোম্বল, বাচ্চুু, বিচ্ছু উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

বাবলুকে দেখেই বিলু বলল, “কী করে এলি বাবলু?”

“এখন কথা বলার সময় নয়। কেটে পড়ি চল। কাল সকালে দেখা করিস।”

ওরা ফিরে পড়ল।

পরদিন সকালে ন্যাড়া-মাথার দেওয়া চিঠিটা নিয়ে পাণ্ডব গোয়েন্দারা জোর আলোচনায় বসল। চিঠিতে যা লেখা ছিল তা হল এই—প্রিয় চিরঞ্জাবীবাবু, আপনি আমাদের হয়ে আর কাজ করতে চাইছেন না এটা খুবই দুঃখের কথা। যাই হোক। এসব কাজ কাউকে দিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে করাতে গেলে বিপদ বাড়ে। কাজেই আমরাও আর আপনাকে চাই না। কাল শালিমারের তিন নম্বর গেটের নর্থ সাইডে যে ওয়াগনটা আছে সেটা আমরা ভাঙতে যাচ্ছি। এটা ভাঙতে পারলে আমরা কয়েক লক্ষ টাকা লাভ করতে পারব। আর তা যদি হয় তবে আমাদেরও বেশ কয়েক বছরের জন্য এসব কাজ না করলেও চলবে। এই ব্যাপারে আপনাকে আমাদের একান্তই দরকার। কেন না ওয়াগন ভাঙার ব্যাপারে আপনার হাত যে রকম খেলা দেখায় তার কাছে আমরা নিতান্তই শিশু। মনে রাখবেন এটাই আমাদের শেষ কাজ। আসা চাই কিন্তু। ইতি—।’

চিঠি পড়া হলে বাবলু বলল, “কী বুঝলি?”

বিলু বলল, “শয়তানের গলায় নরম সুর মানে স্রেফ টোপ ছাড়া আর কিছুই নয়।”

“হ্যাঁ। ওরা জানে এইভাবে চিঠি লিখলে চিরঞ্জাবীবাবু গলে যাবেন এবং ওদের খপ্পরে আর একবার এসে পড়বেন।”

ভোম্বল বলল, “তবে যাই বলিস ভাই চিরঞ্জাবীবাবু কিন্তু ঘুঘু লোক। কাজটাজ দিব্যি গুছিয়ে নিয়ে এখন আর ধরা-ছোঁয়া দেবার নামটি নেই।”

বাবলু বলল, “আসলে উনি বুঝতে পেরে গেছেন ওনার দিন শেষ হয়ে আসছে। তাই আর ধরা ছোঁয়া দিচ্ছেন না।”

বাচ্চুু বলল, “এখন তা হলে কী করতে চাও তোমরা?”

বাবলু বলল, “দুটো কাজ আমরা করতে চাই। প্রথম কাজ হল চিরঞ্জাবীবাবুর সঙ্গে দেখা করা। দ্বিতীয় কাজ ওয়াগন ভাঙার সময় চোট্টাগুলোকে হাতেনাতে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া।”

বিলু বলল, “চিরঞ্জাবীবাবুর বাড়ি জানিস তুই?”

“ওদের কথাবার্তা শুনে যা অনুমান করেছি তাতে মনে হয় লাইনপারেই ওঁর বাড়ি।”

ভোম্বল বলল, “কিন্তু দেখা করবি কী করে?”

“এই চিঠি নিয়েই দেখা করব।”

বিছু বলল, “তার মানে একটা লোককে ধরে-বেঁধে খুন হতে আনাবে তোমরা?”

বাবলু বলল, “না। এ চিঠি পেলেও উনি আসবেন না। যাক, আজ রাত্রে ওয়াগন ভাঙার সময় কিন্তু আমাদের নতুন অভিযান শুরু হবে। তোরা সবাই আজকের অভিযানের জন্যে তৈরি থাক। আজকের এই অভিযানে পঞ্চুুও আমাদের সঙ্গে থাকবে। কী রে পঞ্চুু, রাজি তো?”

পঞ্চু তাড়াতাড়ি ল্যাজ নেড়ে ডেকে উঠল, “ভৌ ভোঁ।”

বাবলু বলল, “আমি ততক্ষণে এক গিয়ে চিরঞ্জাবীবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি।”

 নতুন রোমান্সের গন্ধ পেয়ে সকলেরই খুব আনন্দ হল। সবাই যথাসময়ে আসবে বলে ঘাড় নেড়ে রওনা হল যে যার বাড়ির দিকে। লাইনপারে গিয়ে বাবলুকে খুব বেশি খুঁজতে হল না। রাস্তার ডান দিকে দু-একটা বাড়ির পরেই একটা নতুন দোতলা বাড়ির কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল বাবলু। বাইরেই নেমপ্লেট। স্পষ্টাক্ষরে লেখা আছে নাম—চিরঞ্জাবী রায়।

বাবলু কলিং বেল টিপতেই একটা বামনাকৃতি লোক বেরিয়ে এসে বলল, “কাকে চাই?” “চিরঞ্জাবীবাবু আছেন?”

“না।”

“কোথায় গেছেন উনি?”

“দেওঘর গেছেন।”

বাবলু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল—“বাবুকে বলো আমি একটা জরুরি চিঠি নিয়ে এসেছি। উনি যেন আমার সঙ্গে দেখা করেন।”

“বললাম তো বাবু নেই। কেউ নেই বাড়িতে।”

“আছেন আছেন। উনি যে পরদাটার আড়ালে লুকিয়ে আছেন তার তলা দিয়ে ওঁর জুতো পরা পা দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া চুরুটের ধোঁয়াও ভেসে আসছে এদিকে। এখনও গন্ধ পাচ্ছি।”

পরদার আড়াল থেকে একটা বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর বলে উঠল তখন, “রাধেশ্যাম, ওকে ভেতরে আসতে দাও।”

বাবলু ভেতরে ঢুকতেই চিরঞ্জীব আত্মপ্রকাশ করলেন। বেশ ভদ্রলোকের সাজপোশাক। কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় পাকা শয়তান একটি।

বাবলু চিঠিটা দিতে চিরঞ্জাবীবাবু সেটা পড়ে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, “ওরা কি আমাকে চারপেয়ে গাধা বলে মনে করেছে?”

বাবলু বলল, “আপনি যাবেন নাকি?”

“না।”

“আমিও তাই বলি। ওরা আপনাকে খুন করবার ষড়যন্ত্র করেছে। আপনি যাবেন না।”

চিরঞ্জাবীবাবুর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবার। বললেন, “তুমি কে ভাই?”

বাবলু বলল, “আপনি আমাকে চিনবেন না। যে লোকগুলো এই চিঠিটা আপনাকে দিয়েছে আমি লুকিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছি। ওরা আমাকে বলেছে এই চিঠিটা আপনাকে দিলে দশটা টাকা দেবে আমাকে।”

শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন চিরঞ্জাবীবাবু বললেন, “আর ও টাকা তুমি পেয়েছ। এসব কাজ করতে গেলে আগে টাকা নিয়ে তারপর করতে হয়। এখন গিয়ে দেখবে সব ভোঁ ভোঁ কেউ কোথাও নেই। যাক। ওদের হয়ে আমিই তোমাকে দশটা টাকা দিচ্ছি। কেন না তোমার বুদ্ধি এবং আমার প্রাণের প্রতি মমতা দেখানোর জন্য এটা তোমার প্রাপ্য।” বলে চিরঞ্জাবীবাবু উঠে ভেতর ঘরে গেলেন।

তারই মধ্যে বাবলু চারদিকে একবার ওর ধূর্ত নজর বুলিয়ে নিল। এই ঘরের লাগোয়া একটা ঘর রয়েছে। সেটা এই দিনের বেলাতেও অন্ধকার। ঘরের এক কোণে একটা টর্চ রয়েছে। সেটা জ্বেলে ঘরের ভেতর ফেলতেই এক জায়গায় দুটাে বন্দুক ও একটা রিভলভার দেখতে পেল।

চিরঞ্জাবীবাবু এরই মধ্যে কখন যে বাবলুর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবলু তা টেরও পায়নি। উনি গম্ভীর গলায় বললেন, “ওগুলো আমার আত্মরক্ষার জিনিস। ওতে নজর দিয়ে না। এই নাও টাকা। যাও চলে যাও।”

বাবলু টাকা নিয়ে চলে এল।

আসবার সময় এক অন্ধ ভিখারিকে দিয়ে দিল টাকাটা।

শালিমারের গঙ্গার ধার থেকে একগাদা রেললাইন সোজা পশ্চিমে পদ্মপুকুর হয়ে সাঁতরাগাছিতে পৌচেছে। এই লাইনেরই তিন নম্বর গেটের সামনে শেষ বিকেলে পাণ্ডব গোয়েন্দারা এসে দাঁড়াল।

এখন শ্রাবণ মাস। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। তবুও পাণ্ডব গোয়েন্দারা পেছপাও হবার নয়।

দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। আর সন্ধে উত্তীর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল হু হু করে।

বিলু বলল, “এমন হবে জানলে আসতুম না। অথচ এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার ছেড়ে দিতেও মন কেমন করছে।”

ভোম্বল বলল, “এই দুর্যোগে কী আসবে ওরা ?

বাবলু বলল, “দুর্যোগেই তো ওদের সুযোগ। চোর, ডাকাত, ওয়াগন ব্রেকাররা তো এই সব দুর্যোগের জন্যই অপেক্ষা করে।”

এমন সময় আচমকা বিদ্যুতের চাবুক হেনে সশব্দে মেঘ গর্জন হল। আর সঙ্গে সঙ্গে ভৌ ভৌ করে দু-তিনজন লোকের দিকে ক্ষিপ্রবেগে ছুটে গেল পঞ্চু।

বাবলু দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলল পঞ্চুকে।

চারদিকে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। তবুও ইয়ার্ডের আলোয় বাবলু দেখল সেই ন্যাড়-মাথা লোকটা এবং তার সঙ্গে আরও যে দুজন লোক ছিল তারা প্রাণপণে ছুটছে।

বাবলু পঞ্চুকে ধরতেই লোকগুলো ফিরে এল। ফিরে এসে ন্যাড়া-মাথা রীতিমতো ধমকের সুরেই বাবলুকে বলল, “এই খোকা, এমন সন্ধের সময় তুমি এখানে কী করছ?”

বাবলু ভাবল লোকটা বুঝি চিনে ফেলবে ওকে। কিন্তু না। লোকটা চিনতেই পারল না। চিনবেই বা কী করে? কাল তো ভাল করে মুখও দেখেনি ওর। বাবলু বলল, “আমরা এখানে গঙ্গার ধারে বেড়াতে এসেছি।”

“তুমি আমাদের দিকে কুকুর লেলিয়ে দিলে কেন?”

“চোখের মাথা খেয়েছেন নাকি? ও তো এমনিই চোর মনে করে তেড়ে গেছে।”

বলামাত্রই ফোঁস করে উঠল নাড়া-মাথা, “আমরা চোর।”

“আপনারা কী তা আপনারাই জানেন।”

ন্যাড়া-মাথা এবার কটমট করে তাকাতে লাগল বাবলুর দিকে। সঙ্গী দুজনও রাগে ফুলতে লাগল। ততক্ষণে বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুও এসে পড়েছে।

ন্যাড়া-মাথা বলল, “এরা কারা?”

“আমার বন্ধু।”

“ঠিক আছে। তোমরা চলে যাও এখান থেকে। খুব খারাপ জায়গা এটা। এখানে থেকে না।”

বিলু বলল, “খারাপ জায়গা তো আপনারা আছেন কেন?”

ন্যাড়া-মাথা ধমকে উঠল, “চুপ করো। আমরা রেলের লোক।”

বাবলু বলল, “কিন্তু আপনাদের জামা-কাপড় দেখে তো রেলের লোক বলে মনে হচ্ছে না। আপনারা এখানে কী করছেন?”

“সে কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে?”

এমন সময় হঠাৎ তড়বড়িয়ে বৃষ্টি নামল। ন্যাড়া-মাথা আর তার সঙ্গী দুজন তাড়াতাড়ি একটা গুমটির ভেতর গিয়ে ঢুকল। ওদের দেখাদেখি পাণ্ডব গোয়েন্দারাও জুটল গুমটিতে।

গুমটির মধ্যে রেলের দুজন খালাসি রান্না করছিল তখন। তারা অবাক হয়ে বলল, “আপনারা!”

ন্যাড়া-মাথা বলল, “আমরা একজনের কাছে একটু দরকারে এসেছিলাম। এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি নেমে গেল। বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।”

বাবলু বলল, “তবে যে বলছিলেন আপনারা রেলের লোক?”

ন্যাড়-মাথা কটমট করে বাবলুর দিকে তাকাল।

বাবলু বলল, “তা হলে আমরা যা ভেবেছি আপনারা তাই।”

“কী ভেবেছ তোমরা?”

“যা ভেবে আমাদের কুকুরটা আপনাদেরকে তাড়া করেছিল।”

একজন খালাসি বলল, “তোমরা এখানে কী করে এলে ?”

বাবলু বলল, “আমরা ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছি। বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।”

আর একজন বলল, “তোমাদের বাড়ি কোথায়?”

“অনেক দূর। এমন বৃষ্টি হবে জানলে এখানে আসতুম না।”

“তাই তো। মহা মুশকিলের ব্যাপার। এ যা বৃষ্টি, এ তো সহজে থামবে না দেখছি।”

ন্যাড়-মাথা হঠাৎ ভাল মানুষের মতো বলে উঠল, “তা আর কী হবে, একটু বসুক। এই বৃষ্টিতে যাবেই বা কোথায়। ”

একজন সঙ্গী বলল, “এই সময় বেশ একটু গরম চা পাওয়া যেত।”

একজন খালাসি বলল, “চা আর এখানে কোথায় পাবেন ? সেই তিন নম্বর গেটের কাছে চায়ের দোকান।”

বাবলু বলল, “একজন গিয়ে নিয়ে এলেই তো হয়।”

ন্যাড়া-মাথা ভেংচে বলল, “কে আনবেটা কে? তুমি?”

বাবলু বলল, “একটা কেটলি আর ছাতা পেলে আমিই আনতে রাজি আছি। অবশ্য আমাদেরকেও ভাগ দিতে হবে।”

লোভনীয় প্রস্তাব। একজন খালাসি বলল,“ছাতা কেটলি দুই-ই আছে। কিন্তু এত জলে যাবে কী করে?”

“ঠিক যাব।”

খালাসিটা তখন ছাতা আর কেটলি বাবলুকে দিল। ন্যাড়-মাথা দিল দুটো টাকা। বাবলু সেই বৃষ্টিতেই পঞ্চুকে নিয়ে চলে গেল চা আনতে।

বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু বাবলুর ব্যাপার কিছুই বুঝতে না পেরে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। বাবলু যে এই দুর্যোগে উপযাচক হয়ে চা আনার ঝুঁকিটা কেন নিল তা ওদের মাথাতেই এল না!

বাবলু অবশ্য অনেকক্ষণ থেকেই মনে মনে চাইছিল তিন নম্বর গেটের নর্থসাইডে ওত পাততে। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি এসে পড়ায় সব ভেস্তে যাচ্ছিল। সুযোগ হল এতক্ষণে। সেই প্রবল বর্ষণের মধ্যে তাই ছাতা মাথায় সে চলল চা আনতে। আসলে এই সুযোগে ওয়াগনটা দেখতে চায় সে।

স্পটে এসে বাবলু দিশেহারা হয়ে পড়ল। ওয়াগনের পর ওয়াগন। এর মধ্যে কোনটে ভাঙতে চায় এরা তার টেরই পেল না। হঠাৎ এক জায়গায় অন্ধকারে একটা পুলিশ ভ্যানের মতো কালো ভ্যান দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল ও ।

ভ্যানের ভেতর একজন বিদঘুটে চেহারার লোক বসেছিল। বাবলুকে বার বার ভ্যানটা নিরীক্ষণ করতে দেখে বাজখাই গলায় বলে উঠল, “এই খোকা, কী দেখছ! কী চাই এখানে?”

কী আবার দেখব। কিছুই না।”

“তবে যাও ভাগো এখান থেকে।”

”কেন যাব? আমি এখানে চা আনতে এসেছি। চা নিয়ে তারপর যাব।”

লোকটা বলল, “এখানে চায়ের দোকান কোথায়?”

“তা জানি না। আমরা এখানে বেড়াতে এসে বৃষ্টির জন্যে আটকে গেছি। গুমটিতে একজন ন্যাড়-মাথা আর দু’জন লোকও আটকে পড়েছে। তারাই আমাকে চা আনতে পাঠাল।

বাবলুর কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে লোকটা বলল, “তাই নাকি, তাই নাকি? আচ্ছা ন্যাড়া-মাথা লোকটাকে কীরকম দেখতে বল তো?”

“ঠিক চোরেদের মতো। সঙ্গের লোক দু’জনকেও তাই। আপনাকে যেমন বিচ্ছিরি দেখতে অনেকটা ওইরকম।”

লোকটির মনের রাগ মনে চেপে বলল, “ওরে ব্যাটা, আমি এখানে একা জমে যাচ্ছি আর ওঁরা কিনা বৃষ্টিতে গা বাঁচিয়ে আয়েশ করে বসে আছেন।” তারপর বাবলুকে বলল, “ওরা তিনজনে কী করছে দেখলে ?”

“চুপচাপ ভাল মানুষটির মতো দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি থামলে বোধহয় কোনও দুষ্কর্ম করতে যাবে। ওখানে অন্য লোক আছে বলে হয়তো সুবিধে হচ্ছে না। তাই কোনও কথাবার্তা বলছে না। তবে কিছু একটা করতে ওরা যাবে। আপনাকে দেখেও তো ওদের লোক বলে মনে হচ্ছে। তাই না?”

“হ্যাঁ তাই। কিন্তু তুমি এসব কী করে জানলে?”

“বা রে! এসব আবার জানতে হয় নাকি? কোন লোকটা পুরুতঠাকুর, কে ডাক্তার আর কে ওয়াগন ব্রেকার এ কী কাউকে চিনিয়ে দিতে হয়? এই যে পুলিশগুলো রাস্তায় যখন ঘোরে তখন তাদের দেখলেই পুলিশ বলেই মনে হয়। তাদের কি তখন ফুচকাওয়ালা বলে ভাবতে ইচ্ছে করে? তেমনি কাবুলিওয়ালা আর ফেরিওয়ালাকে চেহারা দেখেই চিনে নিতে হয়।”

লোকটা ভয়ানক রেগে বলল, “চোপ রও ডেপো কোথাকার। তারা কোথায় আছে বলো শিগগির।”

“বললুম তো, ওই ওধারের গুমটিতে।”

“আমাকে নিয়ে চলো সেখানে।”

“একটা ছাতায় দু’জনকে কী করে কুলোবে? তার চেয়ে আমি বরং গাড়িতে বসি। আপনি আমার ছাতাটা নিয়ে যান। পারেন তো চা-টাও নিয়ে যান আপনি।”

“কিন্তু এই জলে অন্ধকারে আমি গুমটিটা চিনব কেমন করে?”

আমার কুকুর সঙ্গে দিচ্ছি। ওই আপনাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে।”

“দাঁড়াও তবে ছাতা আর কেটলি দাও। আমিই কিনে আনছি চা। তুমি গাড়িতে বসে।”

বাবলু আর পঞ্চু দু’জনেই গাড়িতে ঢুকে বসে রইল। তারপর লোকটি চা নিয়ে এলে পঞ্চুকে সঙ্গে দিয়ে দিল বাবলু।”

লোকটি চলে যেতেই আসল কাজ শুরু হল বাবলুর গাড়ির ভেতর হাতড়ে সে একটা টর্চ দেখতে পেল। টর্চের আলোয় প্রথমেই দুটো বন্দুক নজরে পড়ল তার। সে দুটো নিয়ে সর্বাগ্রে ভিজে ভিজেই ভ্যানের মাথার তুলে রাখল। যাতে ওরা এসে দরকারের সময় খুঁজে না পায়। তারপর একটুক্ষণ কী যেন ভাবল। ভেবেই একটা পেরেক জোগাড় করে গাড়ি থেকে নেমে সর্বাগ্রে প্রতিটি চাকার হাওয়া খুলে দিল। গাড়ির চাবিটাও খুলে নিয়ে পকেটে রেখে সোজা এগিয়ে চলল গুমটির দিকে।

বাবলু যখন গেল তখন ওদের চা পর্ব শেষ হয়েছে। বাবলুকে দেখেই চমকে উঠল সকলে, “আ রে, তুমি যে একেবারে ভিজে চান করে গেছ। ভিজে ভিজে এলে কেন?”

“কী করব, আমার যে একা থাকতে ভয় করছিল।”

“তা বেশ করেছ। আমরাও ভিজে ভিজেই যাই। এ বৃষ্টি সহজে থামবে না।”

“আপনারা আমাদেরকে আপনাদের গাড়িতে করে একটু পৌছে দেবেন?”

লোকগুলো খালাসি দু’জনকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে বলল, “বেশ তো, দেব।”

ওরা সকলে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই বাইরে এল। খানিক এসেই ন্যাড়-মাথা বলল, “তোমরা ভিজে ভিজেই বাড়ি যাও। আমাদের এখানে একটু কাজ আছে। যেতে দেরি হবে।”

বাবলু বলল, “কেন, আমরা যদি গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসি? আপনাদের কাজ শেষ হলে একসঙ্গে যাব।”

“না, তা হয় না। আমাদের একটা ওয়াগন এসেছে। তার মাল আজ না খালাস করলে সরকার বাজেয়াপ্ত করে দেবে। সেই সব মাল আমরা ভ্যানে বোঝাই করব।”

“তা করুন না। ফেরার সময় আমাদের নামিয়ে দেবেন।”

অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হ্যা বলতে হল। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চুু, বিচ্ছু এবং পঞ্চুর মুখে টুশব্দটি নেই। যেতে যেতে ন্যাড়া-মাথা সঙ্গীদের বলল, “চিরঞ্জাবীবাবু তা হলে এল না।”

যে লোকটা ভ্যানে ছিল সে বলল, “আমি যতক্ষণ ভ্যানে বসেছিলাম ততক্ষণ তো আসেনি।”

ন্যাড়-মাথা শয়তানের হাসি হেসে বলল, “না এলেও কী আমার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে? তালে পেলেই ঝেড়ে দেব একদিন।”

কথা বলতে বলতেই গাড়ির কাছে চলে এল ওরা। ন্যাড়া-মাথা বলল, “তোমরা সব গাড়ির ভেতরে ঢুকে বসে থাক। আর একটু নজরে রেখ গাড়ির দিকে কেউ আসে কি না। দিনকাল খারাপ তো। চোর-ডাকাতও আসতে পারে।”

বাবলু বলল, “যদি পুলিশ আসে তা হলেও?”

ন্যাড়া-মাথা বলল, “যদি পুলিশ আসে তা হলে সর্বাগ্রে আমাদের জানিয়ে দেবে। ও ব্যাটারা ভারী বদ।” এই বলে ভ্যানের পিছন দিকটা খুলে ওরা ওয়াগনের দিকে এগোল।

একটা ওয়াগন পাশেই শান্টিং লাইনে দাঁড় করানো ছিল। ওরা সেটাকে ভাঙবার জন্যে অনেক কসরত করতে লাগল।

এমন সময় হঠাৎ বিলু চেচিয়ে উঠল, “পুলিশ! পুলিশ!”

যেই না চাঁচানো লোকগুলো যেন ম্যাজিকের মতো উবে গেল। তারপর প্রায় মিনিট কুড়ি বাদে আবার এসে হাজির হল। ন্যাড়-মাথা তো বিলুকে এই মারে কী সেই মারে।

আর একজন বলল, “কেন তামাশা করছ ভাই আমাদের সঙ্গে? তার চেয়ে চুপচাপ বসে থাক। আমরা যাবার সময় কিছু টাকা দিয়ে যাব তোমাদের। তোমরা বেশটি করে কোনও হোটেলে ঢুকে মুরগির মাংস আর পাউরুটি পেট ভরে খেয়ে নিয়ো।” এই বলে ওরা আবার কাজ করতে চলে গেল।

ওরা যখন নিশ্চিন্তমনে কাজ করছে বাবলু তখন বিলুকে বলল, “তুই এবার একটু ম্যানেজ কর। আমি ততক্ষণে পঞ্চুকে নিয়ে কোথাও গিয়ে চট করে থানায় একটা ফোন করে আসি।”

“তা হলেও কোনও অসুবিধে হবে না। কোনওরকমেই মাল নিয়ে পালাতে পারবে না বাছাধনরা। গাড়ির চাবি আমার কাছে তা ছাড়া চাকারও হাওয়া খুলে দিয়েছি।” এই বলে বাবলু চলে গেল।

বেশি দূর যেতে হল না। একটা পাবলিক টেলিফোনে রিং করে সব কথা পুলিশকে জানিয়ে ফিরে এল সে। ফিরে যখন এল তখন ভ্যান বোঝাই হয়ে গেছে। ন্যাড়া-মাথার দলও তখন ফিরে আসছে মনের আনন্দে। নির্বিঘ্নে কাজ হয়ে গেছে তাই খুব খুশি ওরা। বাবলুর বুক তো ধড়াস করে উঠল।

ধড়াস করে উঠল ওদের বুকও। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিতে গিয়েই বলল, “এই রে! সর্বনাশ হয়েছে। এই শয়তান ছেলেমেয়েগুলো সেই থেকে ঘটর-ঘটর করছিল। দিয়েছে চাবিটাকে ফেলে।”

ন্যাড়া-মাথা আঁতকে উঠে বলল, “সে কী!”

“আর সে কী। খোঁজ—খোঁজ।”

সেই অন্ধকারে বৃষ্টিতে টর্চের আলোয় দারুণ খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেল। ন্যাড়া-মাথা বাবলুর চুলের মুঠি ধরে বলল, “চাবি তুই-ই নিয়েছিস বল শিগগির চাবি কোথায়?”

ন্যাড়া-মাথা বাবলুকে ছাড়তেই বাবলু পকেট থেকে চাবিটা বার করে অন্ধকারে দূরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “ওই ফেলে দিয়েছি কুড়িয়ে নাও।” বলেই ন্যাড়া-মাথার কাছ থেকে খানিকটা তফাতে সরে এসে চ্যাঁচাতে লাগল, “লিয়ো, পঞ্চু লিয়ো। কামড়ে ছিড়ে দে সব কটাকে।”

বাবলুর নির্দেশ পাওয়া মাত্রই পঞ্চু ভৌ ভোঁ করে তেড়ে গেল। নাড়া-মাথা তখন এক লাফে একটা লাইট-পোস্টের অর্ধেক ওপরে। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুও খেলা জমেছে দেখে নেমে এল গাড়ি থেকে। এমন সময় হঠাৎ একটা জোরালো আলো এসে পড়ল সকলের মুখের ওপর। পুলিশ! একজন দারোগা এবং সাতজন পুলিশ। রিভলভার-বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে এল ওদের দিকে, “হ্যান্ডস আপ।”

বাবলু পঞ্চুকে ডেকে নিল। ন্যাড়া-মাথা এবং বাকি তিনজন হাত ওপরে উঁঠিয়ে এগিয়ে এল ধরা দিতে। পুলিশের লোকেরা প্রত্যেককে অ্যারেস্ট করল। অ্যারেস্ট করে নিজেদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে এমনভাবে বেঁধে রাখল যাতে পালাতে না পারে।

পুলিশের একজন লোক ন্যাড়া-মাথাদের ভ্যানে বসে গাড়ি স্টার্ট দিতে গেল। বাবলু বলল, “চাবিটা আমি ফেলে দিয়েছি স্যার।”

দারোগাবাবু বললেন, “তোরা কে রে? কোথায় ফেলেছিস চাবি। নিয়ে আয় শিগগির।”

বাবলু অত্যন্ত মর্মাহত হল এই নতুন দারোগার কথায়। তবু ও পঞ্চুর সাহায্যে চাবিটা কুড়িয়ে এনে দিতেই দারোগাবাবু বললেন, “যা সব। ঘরের ছেলে ঘরে যা। এইটুকু বয়সেই বখাটে মেরে গেলে ভবিষ্যতে করবি কী? লেখাপড়া করগে যা।”

পাণ্ডব গোয়েন্দাদের চোখে যেন জল এসে গেল।

বিলু বলল, “এ রকম অপমান আমরা কখনও হইনি।”

ওদিকে দারোগাবাবু নিজেই তখন চাবি ঘুরিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। কিন্তু এ কী ! গাড়ি চলে না কেন? একজন পুলিশ চেঁচিয়ে উঠল, “আ রে, একটা চাকারও যে হাওয়া নেই। মনে হয় এই ছেলেমেয়েগুলোই দিয়েছে বারোটা বাজিয়ে।”

ওরা তখন অপর গাড়িটার সাহায্যে এই গাড়িটাকে বেঁধে কোনওরকমে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগল। অপমানিত পাণ্ডব গোয়েন্দারা অযথা আর দাঁড়িয়ে না থেকে স্নান মুখে ফিরে এল। কিছু পথ আসার পরই অন্য একটি পুলিশভ্যান এসে ওদের সামনে হর্ন বাজিয়ে থামল। ভ্যানের ভেতর ওদের পরিচিত দারোগাবাবু ছিলেন। বললেন, “কী হল? ফিরে আসছ যে তোমরা! ওদের খবর কী?”

বাবলু বলল, “ফিরে আসব না তো কী করব স্যার? এমন লোকদের পাঠিয়েছেন আপনি যে তারা এসে অপমান করেই তাড়িয়ে দিল আমাদের।”

“সে কী ! আমরা তো কোনও লোক পাঠাইনি। তোমার ফোন পেয়ে এই তো সবে আসছি। নিশ্চয়ই কোনও গোলমাল হয়েছে। চলো দেখি? তোমাদের তাড়িয়ে দেবে এমন সাধ্য কার?”

হেডলাইট নিভিয়ে ভ্যানটা একটু এগিয়ে এসে থেমে দাঁড়াল এক জায়গায়। তারপর এক ঝাঁক পুলিশ নির্দেশ মতো বেরিয়ে এসে চুপিসারে বাবলুদের সঙ্গে এগিয়ে চলল।

দূর থেকে অন্ধকারেও বোঝা গেল ইয়ার্ডের গায়ে পাবলিক রোডের ওপর কারা যেন একটা গাড়ির সঙ্গে আর একটা গাড়িকে বেঁধে টানতে টানতে আনছে। দারোগাবাবু টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেলেন। চারদিক থেকে পুলিশ এসে ঘিরে ফেলল গাড়িদুটোকে।

গাড়ির ভেতর থেকে বাবলুদের যারা অপমান করেছিল সেই পুলিশগুলো নেমে এল ওপক্ষের দারোগাবাবু হাসতে হাসতে এসে বললেন, “নমস্কার স্যার। গোটাকতক ওয়াগন ব্রেকারকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছি আজ। তুলে নিন আপনার ভ্যানে। আমার দায়িত্ব শেষ।” বলে নিজের পুলিশদের বললেন, “ওহে চলো সব। এখানকার দারোগাবাবু এসে গেছেন।”

ওরা ন্যাড়া-মাথা এবং তার তিন সঙ্গীকে নামিয়ে দিল। বাবলুদের দারোগাবাবু ওপক্ষের দারোগাকে বললেন, “কে আপনি? আপনাকে তো চিনলাম না ঠিক।”

“আজ্ঞে আমি জগাছা থানার দারোগ।”

যেই না বলা দারোগাবাবু অমনি তার পেটের কাছে রিভলভার ঠেকিয়ে বললেন, “ধাপ্পা দেবার জায়গা পাওনি বাছাধন? জগাছা থানার দারোগা আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। বল তুই কে?” বলেই ঠাস করে এক চড়।

যেই না মারা অমনি নকল গোঁফ দাড়ি খুলে গেল সব।

বন্দি নাড়া-মাথা তখন চিৎকার করে উঠল, “এ কী! চিরঞ্জাবীবাবু! তুমি আবার আগুন নিয়ে খেলতে এসেছিলে? বিশ্বাসঘাতক।”

বলেই দারোগাবাবুকে বলল, “স্যার, আপনি আমাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলান, তাতে আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু মরবার আগে আমার একটা আশা অন্তত মেটান। আমাকে দয়া করে পাঁচ মিনিটের জন্যে মুক্তি দিন। আমি নিজে হাতে ওকে খুন করি।”

তারপর বাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইটি, তোমাদের যে কী বলে ধন্যবাদ দেব তা ভেবে পাচ্ছি না। এতক্ষণ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছি দেখে মনে মনে তোমাদের মুণ্ডপাত করছিলাম। এখন তোমাদের জন্যে আমাদের তিনজনেরই শক্র ধরা পড়ল বলে তোমাদের আমি প্রাণ ভরে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তোমরা যুগ যুগ জিয়ো!”

এমন নাটক পাণ্ডব গোয়েন্দারা আগে কখনও দেখেনি। তাই একেবারে হতবাক হয়ে গেল। সত্যিকারের পুলিশের হাতে নকল পুলিশ সমেত দুৰ্বত্তরা প্রত্যেকেই গ্রেপ্তার বরণ করল। ইতিমধ্যে বৃষ্টি যে কখন থেমে গিয়েছিল তা ওদের খেয়ালই নেই। ওরা ফিরে আসবার সময় দারুণ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল বিলু, “থ্রি চিয়ার্স ফর পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

সবাই সমস্বরে বলল, “হিপ হিপ হুরর রে।”

পঞ্চু ওর ভাষাতেই ডেকে উঠল, “ভৌ ভৌ ভোঁ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *