চিত্রচোর – ১১

১১

অপরাহ্ণ পাঁচটার সময় আমি আর ব্যোমকেশ মহীধরবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হইলাম। তিনি বসিবার ঘরে ছিলেন। দেখিলাম তাঁহার চেহারা খারাপ হইয়া গিয়াছে। মুখের ফুটি-ফাটা হাসিটি ম্রিয়মাণ, চালতার মতন গাল দুইটি ঝুলিয়া পড়িয়াছে।

বলিলেন, ‘আসুন আসুন। অনেক দিন বাঁচবেন ব্যোমকেশবাবু, এইমাত্র আপনার কথা ভাবছিলাম। শরীর বেশ সেরে উঠেছে দেখছি। বাঃ, বেশ বেশ।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিন্তু আপনার শরীর তো ভাল দেখছি না।’

মহীধরবাবু বলিলেন, ‘হয়েছিল একটু শরীর খারাপ—এখন ভালই। কিন্তু একটা বড় ভাবনার কারণ হয়েছে ব্যোমকেশবাবু।’

‘কি হয়েছে?’

‘রজনী কাল রাত্রে কলকাতা চলে গেছে।’

‘সে কি! একলা গেছেন? আপনাকে না বলে?’

‘না না, সে সব কিছু নয়। বাড়ির পুরোনো চাকর রামদীনকে তার সঙ্গে দিয়েছি।’

‘তবে ভাবনাটা কিসের?’

মহীধরবাবুর মনে ছল চাতুরী নাই। সোজাসুজি বলিতে আরম্ভ করিলেন, ‘শুনুন, বলি তাহলে। কলকাতায় রজনীর এক মাসী থাকেন, তিনিই ওকে মানুষ করেছেন। কাল বিকেলে ওর মেসোর এক ‘তার’ এল। তিনি রজনীকে ডেকে পাঠিয়েছেন—মাসীর ভারি অসুখ। রজনীকে রাত্তিরের গাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। ও এমন প্রায়ই যাতায়াত করে, পাঁচ ছ’ ঘন্টার রাস্তা বৈ তো নয়। রজনী আজ সকালে কলকাতায় পৌঁছে গেছে, ‘তার’ পেয়েছি।

‘এ পর্যন্ত কোনও গোলমাল নেই। তারপর শুনুন। আজ সকালে দু’খানা চিঠি পেলাম; তার মধ্যে একখানা রজনীর মাসীর হাতের লেখা—কালকের রারিখ। তিনি নিতান্ত মামুলি চিঠি লিখেছেন, অসুখ-বিসুখের কোনও কথাই নেই।’

মহীধরবাবু শঙ্কিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘এমনও তো হতে পারে চিঠি লেখবার পর তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

মহীধরবাবু বলিলেন, ‘তা একেবারে অসম্ভব নয়। কিন্তু অন্য চিঠিখানার কথা এখনও বলিনি। বেনামী চিঠি। এই পড়ে দেখুন।’

তিনি একটি খাম ব্যোমকেশকে দিলেন। খামের উপর ডাকঘরের ছাপ দেখিয়া বোঝা যায় এই শহরেই ডাকে দেওয়া হইয়াছে। ব্যোমকেশ চিঠি বাহির করিয়া পড়িল। সাদা এক তক্তা কাগজের উপর মাত্র কয়েকটি কথা লেখা ছিল—

আপনার চোখের আড়ালে একজন ভদ্রবেশী দুষ্ট লোক আপনার কন্যার সহিত অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হইয়াছে। ইহারা যদি ইলোপ করে, কেলেঙ্কারির একশেষ হইবে। সাবধান! ডাক্তার ঘটককে বিশ্বাস করিবেন না।

ব্যোমকেশ চিঠি পড়িয়া ফেরত দিল। মহীধরবাবু কম্পিত স্বরে বলিলেন, ‘কে লিখেছে জানি না। কিন্তু এ যদি সত্যি হয়—’

ব্যোমকেশ শান্তভাবে বলিল, ‘ডাক্তার ঘটককে আপনি জানেন। সে এমন কাজ করবে বলে আপনার মনে হয়?’

মহীধরবাবু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, ‘ডাক্তারকে তো ভাল ছেলে বলেই জানি; যখন তখন আসে আমার বাড়িতে। তবে পরচিত্ত অন্ধকার। আচ্ছা, সে কি আছে এখানে?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আছে। আজ সকালেই তাকে দেখেছি।’

মহীধরবাবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘আছে? যাক, তাহলে বোধ হয় কেউ মিথ্যে বেনামী চিঠি দিয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘ডাক্তার কিন্তু আজ রাত্রে কলকাতা যাচ্ছে।’

মহীধরবাবু আবার ব্যাকুল হইয়া বলিলেন, ‘অ্যাঁ—যাচ্ছে! তবে—?’

ব্যোমকেশ দৃঢ়স্বরে বলিল, ‘মহীধরবাবু, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, কোনও কেলেঙ্কারি হবে না। আপনি মিথ্যে ভয় করছেন।’

মহীধরবাবু ব্যোমকেশের হাত ধরিয়া বলিলেন, ‘সত্যি বলছেন? কিন্তু আপনি কি করে জানলেন—আপনি তো—’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি এমন অনেক কথা জানি যা আপনি জানেন না। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে মিথ্যে আশ্বাস দিচ্ছি না। রজনী দেবী দু’দিন পরেই ফিরে আসবেন। তিনি এমন কোনও কাজ করবেন না যাতে আপনার মাথা হেঁট হয়।’

মহীধরবাবু গদ্গদ স্বরে বলিলেন, ‘ব্যস, তা হলেই হল। ধন্যবাদ ব্যোমকেশবাবু। আপনার কথায় যে কত দূর নিশ্চিন্ত হলাম তা বলতে পারি না। বুড়ো হয়েছি—ভগবান একবার দাগা দিয়েছেন—তাই একটুতেই ভয় হয়।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওকথা ভুলে যান। আমি এসেছি আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে।’

মহীধরবাবু ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, ‘বলুন বলুন।’

‘আপনার মোটরখানা আজ রাত্রে একবার দিতে হবে। জংশনে যাব। একটু জরুরী কাজ আছে।’

‘এ আর বেশি কথা কি? কখন চাই বলুন?’

‘রাত্রি ন’টার সময়।’

বেশ, ঠিক ন’টার সময় আমার গাড়ি আপনার বাড়ির সামনে হাজির থাকবে। আর কিছু?’

‘আর কিছু না।’

এই সময় পাণ্ডে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সকলে মিলিয়া চা ও প্রচুর জলখাবার ধ্বংস করিয়া বাড়ি ফিরিলাম।

ঠিক ন’টার সময় মহীধরবাবুর আট সিলিন্ডার গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে আসিয়া থামিল। আমি, ব্যোমকেশ ও পাণ্ডে সাহেব তাহাতে চাপিয়া বসিলাম। গাড়ি ছাড়িয়া দিল। একটি কালো রঙের পুলিস ভ্যান আগে হইতেই দাঁড়াইয়াছিল, সেটি আমাদের পিছু লইল।

শহরের সীমানা অতিক্রম করিয়া আমাদের মোটর জংশনের দীর্ঘ গৃহহীন পথ ধরিল। দুই পাশে কেবল বড় বড় গাছ; আমাদের গাড়ি তাহার ভিতর আলোর সুড়ঙ্গ রচনা করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে।

পথে বেশি কথা হইল না। তিনজনে পাশাপাশি বসিয়া একটার পর একটা সিগারেট টানিয়া চলিয়াছি। একবার ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার আসামী ফার্স্ট ক্লাসের কিকিট কিনবে।’

‘হ্যাঁ। আমারও তাই মনে হয়। যে ক্লাসেই উঠুক, ইন্সপেক্টর দুবে পাশের কামরায় থাকবে।’

‘পুলিস মহলে আসল কথা কে কে জানে?’

‘আমি আর দুবে। পাছে আগে থাকতে বেশি হৈ চৈ হয় তাই চুপিসাড়ে মহীধরবাবুর গাড়ি নিতে হল। পিছনের ভ্যানে যারা আছে তারাও জানে না কি জন্যে কোথায় যাচ্ছি। পুলিসের থানা থেকে যত কথা বেরোয় এত আর কোথাও থেকে নয়। ঘুষখোর পুলিস তো আছেই। তা ছাড়া পুলিসের পেটে কথা থাকে না।’

পুরন্দর পাণ্ডে নির্মলচরিত্র পুরুষ, তাই স্বজাতি সম্বন্ধেও তিনি সত্যবাদী।

দশটার সময় জংশনে পৌঁছিলাম। লাল সবুজ অসংখ্য আকাশ-প্রদীপে স্টেশন ঝলমল করিতেছে।

পুলিসের ভ্যানে দুইজন সাব-ইন্সপেক্টর ও কয়েকটি কনস্টেবল ছিল। পাণ্ডে তাহাদের স্টেশনের ভিতরে বাহিরে নানা স্থানে সন্নিবিষ্ট করিলেন; তারপর স্টেশন-মাস্টারের সঙ্গে দেখা করিলেন। বলিলেন, ‘আমার একটা ‘লগ’ আসবার কথা আছে। এলেই খবর দেবেন। আমরা ওয়েটিং রুমে আছি।’

আমরা তিনজনে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে গিয়া বসিলাম। পাণ্ডে ঘন ঘন হাতঘড়ি দেখিতে লাগিলেন।

ঠিক সাড়ে দশটার সময় স্টেশন-মাস্টার খবর দিলেন, ‘‘লগ’ এসেছে। সব ভাল। ফার্স্ট ক্লাস।’

এখনও পঁয়তাল্লিশ মিনিট।

কিন্তু পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় যত দীর্ঘই হোক, প্রাকৃতিক নিয়মে শেষ হইতে বাধ্য। গাড়ি আসার ঘণ্টা বাজিল। আমরা প্ল্যাটফর্মে গিয়া দাঁড়াইলাম। আমাদের সকলের গায়ে ওভারকোট এবং মাথায় পশমের টুপি, সুতরাং সহসা দেখিয়া কেহ যে চিনিয়া ফেলিবে সে সম্ভাবনা নাই।

তারপর বহু প্রতীক্ষিত গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল।

পাণ্ডে সাহেব নাটকের রঙ্গমঞ্চ ভালই নির্বাচন করিয়াছিলেন। আয়োজনেরও কিছু ত্রুটি রাখেন নাই; কিন্তু তবু নাটক জমিতে পাইল না, পটোত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে যবনিকা পড়িয়া গেল।

গাড়ির প্রথম শ্রেণীর কামরা যেখানে থামে আমরা সেইখানে দাঁড়াইয়াছিলাম। ঠিক আমাদের সামনে প্রথম শ্রেণীর কামরা দেখা গেল। জানালাগুলির কাঠের কবাট বন্ধ, তাই অভ্যন্তরভাগ দেখা গেল না। অল্পকাল-মধ্যে দরজা খুলিয়া গেল। একজন কুলি ছুটিয়া গিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল এবং দুইটি বড় বড় চামড়ার সুটকেস নামাইয়া রাখিল।

কামরায় একটি মাত্র যাত্রী ছিলেন, তিনি এবার বাহির হইয়া আসিলেন। কোটপ্যান্ট-পরা অপরিচিত ভদ্রলোক, গোঁফ-দাড়ি কামানো, চোখে ফিকা নীল চশমা। তিনি সুটকেস দু’টি কুলির মাথায় তুলিবার ব্যবস্থা করিতেছেন, পাণ্ডে এবং ব্যোমকেশ তাঁহার দুই পাশে গিয়া দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ একটু দুঃখিত স্বরে বলিল, ‘অমরেশবাবু, আপনার যাওয়া হল না। ফিরে যেতে হবে।’

অমরেশবাবু! ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অমরেশ রাহা! গোঁফ-দাড়ি কামানো মুখ দেখিয়া একেবারে চিনিতে পারি নাই।

অমরেশ রাহা একবার দক্ষিণে একবার বামে ঘাড় ফিরাইলেন, তারপর ক্ষিপ্রহস্তে পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া নিজের কপালে ঠেকাইয়া ঘোড়া টানিলেন। চড়াৎ করিয়া শব্দ হইল।

মুহূর্তমধ্যে অমরেশ রাহার ভূপতিত দেহ ঘিরিয়া লোক জমিয়া গেল। পাণ্ডে হুইসল বাজাইলেন; সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের বহু লোক আসিয়া স্থানটা ঘিরিয়া ফেলিল। পাণ্ডে কড়া সুরে বলিলেন, ‘ইন্সপেক্টর দুবে, সুটকেস দুটো আপনার জিম্মায়।’

একজন লোক ভিড় ঠেলিয়া প্রবেশ করিল। চিনিলাম, ডাক্তার ঘটক। সে বলিল, ‘কি হয়েছে? এ কে?’

পাণ্ডে বলিলেন, ‘অমরেশ রাহা। দেখুন তো বেঁচে আছে কি না।’

ডাক্তার ঘটক নত হইয়া দেহ পরীক্ষা করিল, তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘মারা গেছে।’

ভিড়ের ভিতর হইতে দন্তবাদ্যসহযোগে একটা বিস্ময়-কুতূহলী স্বর শোনা গেল, ‘অমরেশ রাহা মারা গেছে—অ্যাঁ! কি হয়েছিল? তার দাড়ি কোথায়—অ্যাঁ—!’

ফটোগ্রাফার নকুলেশ সরকার।

ডাক্তার ঘটক ও নকুলেশবাবুকে লক্ষ্য করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনাদের গাড়িও এসে পড়েছে। এখন বলবার সময় নেই, ফিরে এসে শুনবেন।’