চিত্রচোর – ৩

রাত্রি আন্দাজ আটটার সময় আমরা তিনজন বসিবার ঘরে দোরতাড়া বন্ধ করিয়া বসিয়াছিলাম। নৈশ আহারের এখনও বিলম্ব আছে, ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় বসিয়া বলবর্ধক ডাক্তারি মদ্য চুমুক দিয়া পান করিতেছে; সত্যবতী তাহার পাশে একটা চেয়ারে র‍্যাপার মুড়ি দিয়া বসিয়াছে। আমি সম্মুখে বসিয়া মাঝে মাঝে পকেট হইতে সিগারেটের ডিবা বাহির করিতেছি, আবার রাখিয়া দিতেছি। ব্যোমকেশের গঞ্জনা খাইবার আর ইচ্ছা নাই। চায়ের জলসার আলোচনাই হইতেছে।

আমি বলিলাম, ‘আমরা শিল্প-সাহিত্যের কত আদর করি ফাল্গুনী পাল তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। লোকটা সত্যিকার গুণী, অথচ পেটের দায়ে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে।’

ব্যোমকেশ একটু অন্যমনস্ক ছিল, বলিল, ‘পেটের দায়ে ভিক্ষে করছে তুমি জানলে কি করে?’

বলিলাম, ‘ওর চেহারা আর কাপড়-চোপড় দেখে পেটের অবস্থা আন্দাজ করা শক্ত নয়।’

ব্যোমকেশ একটু হাসিল, ‘শক্ত নয় বলেই তুমি ভুল আন্দাজ করেছ। তুমি সাহিত্যিক, শিল্পীর প্রতি তোমার সহানুভূতি স্বাভাবিক। কিন্তু ফাল্গুনী পালের শারীরিক দুর্গতির কারণ অন্নাভাব নয়। আসলে খাদ্যের চেয়ে পানীয়ের প্রতি তার টান বেশি।’

‘অর্থাৎ মাতাল? তুমি কি করে বুঝলে?’

‘প্রথমত, তার ঠোঁট দেখে। মাতালের ঠোঁট যদি লক্ষ্য কর, দেখবে বৈশিষ্ট্য আছে; একটু ভিজে ভিজে, একটু শিথিল—ঠিক বোঝাতে পারব না, কিন্তু দেখলে বুঝতে পারি। দ্বিতীয়ত, ফাল্গুনী যদি ক্ষুধার্ত হয় তাহলে খাদ্যদ্রব্যগুলোর প্রতি লোলুপ দৃষ্টিপাত করত, টেবিলের উপর তখনও প্রচুর খাবার ছিল। কিন্তু ফাল্গুনী সেদিকে একবার ফিরেও তাকাল না। তৃতীয়ত, আমার পাশ দিয়ে যখন চলে গেল তখন তার গায়ে মদের গন্ধ পেলাম। খুব স্পষ্ট নয়, তবু মদের গন্ধ।’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিজের বলবর্ধক ঔষধটি তুলিয়া লইয়া এক চুমুক পান করিল।

সত্যবতী বলিল, ‘যাক গে, মাতালের কথা শুনতে ভাল লাগে না। কিন্তু ছবি চুরির এ কি ব্যাপার গা? আমি তো কিছু বুঝতেই পারলাম না। মিছিমিছি ছবি চুরি করবে কেন?’

ব্যোমকেশ কতকটা আপন মনেই বলিল, ‘হয়তো পাণ্ডেসাহেব ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু—। যদি তা না হয় তাহলে ভাববার কথা। … পিক্‌নিকে গ্রুপ ছবি তোলা হয়েছিল। আজ চায়ের পার্টিতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা সকলেই পিক্‌নিকে ছিলেন—পাণ্ডে ছাড়া। …ছবির তিনটে কপি ছাপা হয়েছিল; তার মধ্যে একটা চুরি গেছে, বাকি দুটো আছে কিনা জানা যায়নি—নেগেটিভটাও পাওয়া যাচ্ছে না। —’ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ ছাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘ইনি ছবির কথায় এমন ঘাবড়ে গেলেন কেন বোঝা গেল না।’

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর আমি বলিলাম, ‘কেউ যদি একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ছবিটা সরিয়ে থাকে তবে সে উদ্দেশ্যটা কি হতে পারে?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘উদ্দেশ্য কি একটা অজিত? কে কোন্ মতলবে ফিরছে তা কি এত সহজে ধরা যায়? গহনা কর্মণো গতিঃ। সেদিন একটা মার্কিন পত্রিকায় দেখেছিলাম, ওদের চিড়িয়াখানাতে এক বানর-দম্পতি আছে। পুরুষ বাঁদরটা এমনি হিংসুটে, কোনও পুরুষ-দর্শক খাঁচার কাছে এলেই বৌকে টেনে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে।’

সত্যবতী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, ‘তোমার যত সব আষাঢ়ে গল্প। বাঁদরের কখনও এত বুদ্ধি হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘এটা বুদ্ধি নয়, হৃদয়াবেগ; সরল ভাষায় যৌন ঈর্ষা। মানুষের মধ্যেও যে ও-বস্তুটি আছে আশা করি তা অস্বীকার করবে না। পুরুষের মধ্যে তো আছেই, মেয়েদের মধ্যে আরও বেশি আছে। আমি যদি মহীধরবাবুর মেয়ে রজনীর সঙ্গে বেশি মাখামাখি করি তোমার ভাল লাগবে না।’

সত্যবতী র‍্যাপারের একটা প্রান্ত ঠোঁটের উপর ধরিয়া নত চক্ষে চুপ করিয়া রহিল। আমি বলিলাম, ‘কিন্তু এই ঈর্ষার সঙ্গে ছবি চুরির সম্বন্ধটা কি?’

‘যেখানে স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা আছে সেখানেই এ ধরনের ঈর্ষা থাকতে পারে।’ বলিয়া ব্যোমকেশ ঊর্ধ্বমুখে ছাদের পানে চাহিয়া রহিল।

বলিলাম, ‘মোটিভ খুব জোরালো মনে হচ্ছে না। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে না কি?’

‘পারে। চিত্রকর ফাল্গুনী পাল চুরি করে থাকতে পারে। একটা মানুষকে একবার মাত্র দেখে সে ছবি আঁকতে পারে, তার এই দাবি সম্ভবত মিথ্যে। ফটো দেখে ছবি সহজেই আঁকা যায়। ফাল্গুনী সকলের চোখে চমক লাগিয়ে দিয়ে বেশি টাকা রোজগার করবার চেষ্টা করছে কিনা কে জানে!’

‘হুঁ। আর কিছু?’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘ফটোগ্রাফার নকুলেশবাবু স্বয়ং ছবি চুরি করে থাকতে পারেন।’

‘নকুলেশবাবুর স্বার্থ কি?’

‘তাঁর ছবি আরও বিক্রি হবে এই স্বার্থ।’ বলিয়া ব্যোমকেশ মুচকি মুচকি হাসিতে লাগিল।

‘এটা সম্ভব বলে তোমার মনে হয়?’

‘ব্যবসাদারের পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। আমেরিকায় ফসলের দাম বাড়াবার জন্য ফসল পুড়িয়ে দেয়।’

‘আচ্ছা। আর কেউ?’

‘ঐ দলের মধ্যে হয়তো এমন কেউ আছে যে নিশ্চিহ্নভাবে নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চায়—’

‘মানে—দাগী আসামী?’

এই সময় ঘরের বন্ধ দ্বারে মৃদু টোকা পড়িল। আমি গিয়া দ্বার খুলিয়া দিলাম। অধ্যাপক সোম গরম ড্রেসিং-গাউন পরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহাকে স্বাগত করিলাম। আমরা আসা অবধি তিনি প্রায় প্রত্যহ এই সময় একবার নামিয়া আসেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজব হয়; তারপর আহারের সময় হইলে তিনি চলিয়া যান। তাঁহার গৃহিণী দিনের বেলা দু’ একবার আসিয়াছেন। বটে, কিন্তু সত্যবতীর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা করিবার আগ্রহ তাঁহার দেখা যায় নাই। সত্যবতীও মহিলাটির প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করে নাই।

সোম আসিয়া বসিলেন। তাঁহাকে একটি সিগারেট দিয়া নিজে একটা ধরাইলাম। ব্যোমকেশের সাক্ষাতে ধূমপান করিবার এই একটা সুযোগ; সে খিঁচাইতে পারিবে না।

সোম জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আজ পার্টি কেমন লাগল?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ লাগল। সকলেই বেশ কর্ষিতচিত্ত ভদ্রলোক বলে মনে হল।’

সোম সিগারেটে একটা টান দিয়া বলিলেন, ‘বাইরে থেকে সাধারণত তাই মনে হয়। কিন্তু সেকথা আপনার চেয়ে বেশি কে জানে? মিসেস বক্সী, আজ যাঁদের সঙ্গে আলাপ হল তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কাকে ভাল লাগল বলুন।’

সত্যবতী নিঃসংশয়ে বলিল, ‘রজনীকে। ভারি সুন্দর স্বভাব, আমার বড্ড ভাল লেগেছে।’

সোমের মুখে একটু অরুণাভা ফুটিয়া উঠিল। সত্যবতী সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া বলিয়া চলিল, ‘যেমন মিষ্টি চেহারা তেমনি মিষ্টি কথা; আর ভারি বুদ্ধিমতী। —আচ্ছা, মহীধরবাবু এখনও মেয়ের বিয়ে কেন দিচ্ছেন না? ওঁর তো টাকার অভাব নেই।’

দ্বারের নিকট হইতে একটি তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শুনিয়া আমরা চমকিয়া উঠিলাম—

‘বিধবা! বিধবা! বিধবাকে কোন্ হিঁদুর ছেলে বিয়ে করবে?’ মালতী দেবী কখন দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন জানিতে পারি নাই। সংবাদটি যেমন অপ্রত্যাশিত, সংবাদ-দাত্রীর আবির্ভাবও তেমনি বিস্ময়কর। হতভম্ব হইয়া তাকাইয়া রহিলাম। মালতী দেবী ঈর্ষাতিক্ত নয়নে আমাদের একে একে নিরীক্ষণ করিয়া আবার বলিলেন, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না? উনি জানেন, ওঁকে জিজ্ঞেস করুন। এখানে সবাই জানে। অতি বড় বেহায়া না হলে বিধবা মেয়ে আইবুড়ো সেজে বেড়ায় না। কিন্তু দু’কান কাটার কি লজ্জা আছে? অত যে ছলা-কলা ওসব পুরুষ ধরবার ফাঁদ।’

মালতী দেবী যেমন আচম্বিতে আসিয়াছিলেন তেমনি অকস্মাৎ চলিয়া গেলেন। সিঁড়িতে তাঁর দুম্ দুম্ পায়ের শব্দ শোনা গেল।

আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিভূত হইয়াছিলেন অধ্যাপক সোম। তিনি লজ্জায় মাথা তুলিতে পারিতেছিলেন না। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিয়া গেল। শেষে তিনি বিড়ম্বিত মুখ তুলিয়া দীনকণ্ঠে বলিলেন, ‘আমাকে আপনারা মাপ করুন। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কোথাও পালিয়ে যাই—’ তাঁর স্বর বুজিয়া গেল।

ব্যোমকেশ শান্তস্বরে প্রশ্ন করিল, ‘রজনী সত্যিই বিধবা?’

সোম ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘হ্যাঁ। চৌদ্দ বছর বয়সে বিধবা হয়। মহীধরবাবু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কৃতী ছাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের দু’দিন পরে প্লেনে চড়ে সে বিলেত যাত্রা করে; মহীধরবাবুই জামাইকে বিলেত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে বিলেত পর্যন্ত পৌঁছল না; পথেই বিমান দুর্ঘটনা হয়ে মারা গেল। রজনীকে কুমারী বলা চলে।’

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। আমি সোমকে আর একটি সিগারেট দিলাম এবং দেশলাই জ্বালাইয়া ধরিলাম। সিগারেট ধরাইয়া সোম বলিলেন, ‘আপনারা আমার পারিবারিক পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছেন। আমার জীবনের ইতিহাসও অনেকটা মহীধরবাবুর জামাইয়ের মত। গরীবের ছেলে ছিলাম এবং ভাল ছাত্র ছিলাম। বিয়ে করে শ্বশুরের টাকায় বিলেত যাই। কিন্তু উপসংহারটা সম্পূর্ণ অন্য রকমের হল। আমি বিদ্যালাভ করে ফিরে এলাম এবং কলেজের অধ্যাপক হলাম। কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারলাম না। কাজ ছেড়ে দিয়ে আজ সাত বছর এখানে বাস করছি। অন্ন-বস্ত্রের অভাব নেই; আমার স্ত্রীর অনেক টাকা।’

কথাগুলিতে অন্তরের তিক্ততা ফুটিয়া উঠিল। আমি একটু ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কাজ ছেড়ে দিলেন কেন?’

সোম উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘লজ্জায়। স্ত্রী-স্বাধীনতার যুগে স্ত্রীকে ঘরে বন্ধ করে রাখা যায় না—অথচ—। মাঝে মাঝে ভাবি, বিমান দুর্ঘটনাটা যদি রজনীর স্বামীর না হয়ে আমার হত সব দিক দিয়েই সুরাহা হত।’

সোম দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন। ব্যোমকেশ পিছন হইতে বলিল, ‘প্রোফেসর সোম, যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করি। যে গ্রুপ ছবিটা কিনেছিলেন সেটা কোথায়?’

সোম ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘সেটা আমার স্ত্রী কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। তাতে আমি আর রজনী পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলাম।’

সোম ধীরপদে প্রস্থান করিলেন।

রাত্রে আহারে বসিয়া বেশি কথাবার্তা হইল না। হঠাৎ এক সময় সত্যবতী বলিয়া উঠিল, ‘যে যাই বলুক, রজনী ভারি ভাল মেয়ে। কম বয়সে বিধবা হয়েছে, বাপ যদি সাজিয়ে গুজিয়ে রাখতে চান তাতে দোষ কি?’

ব্যোমকেশ একবার সত্যবতীর পানে তাকাইল, তারপর নির্লিপ্ত স্বরে বলিল, ‘আজ পার্টিতে একটা সামান্য ঘটনা লক্ষ্য করলাম, তোমাদের বোধ হয় চোখে পড়েনি। মহীধরবাবু তখন ছবি চুরির গল্প আরম্ভ করেছেন, সকলের দৃষ্টি তাঁর দিকে। দেখলাম ডাক্তার ঘটক একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, রজনী চুপি চুপি তার কাছে গিয়ে তার পকেটে একটা চিঠির মতন ভাঁজ-করা কাগজ ফেলে দিলে। দু’জনের মধ্যে একটা চকিত চাউনি খেলে গেল। তারপর রজনী সেখান থেকে সরে এল। আমার বোধ হয় আমি ছাড়া এ দৃশ্য আর কেউ লক্ষ্য করেনি। মালতী দেবীও না।’