৪.০৭ গুরুদুয়ারার আঙিনায়

গুরুদুয়ারার আঙিনায় হারিকেনের গোলাকার আলো দেখা যাচ্ছিল। রাতের খাবারের জন্য মহিলারা চুলায় আগুন জ্বলিয়েছিল। ঐ আগুনের আলোও দেখা যাচ্ছিল। বড় হল ঘরটায় মিত সিং বসে সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনা করছিলেন। তাঁর চারপাশে লোক বসে ছিল। যে কামরায় ইকবাল তাঁর জিনিসপত্র রেখে গিয়েছিলেন, সেই কামরাটি ছিল তালা দেয়া।

ইকবাল তাঁর জুতা খুলে, মাথায় একটা রুমাল দিয়ে ঐ লোকগুলোর পাশে গিয়ে বসলেন। দুএকজন লোক সরে দিয়ে তাঁকে বসার জায়গা করে দিল। ইকবালা লক্ষ্য করলেন, দুএকজন লোক তাকে দেখে কানাকানি করছে। লোকগুলো প্ৰবীণ এবং তাদের পোশাক শহুরে লোকের মতো। দেখে মনে হয়, তারা উদ্বাস্তু।

প্রার্থনা শেষে মিত্ত সিং পবিত্র গ্ৰন্থখানি ভেলভেটের কাপড়ে জড়িয়ে কুলঙ্গিতে রেখে দিলেন। কেউ কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি ইকবালের সাথে কথা বললেন।

শুভ সন্ধ্যা ইকবাল সিংজি। আপনি ফিরে আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনার নিশ্চয় ক্ষুধা লেগেছে?

ইকবাল বুঝতে পারলেন, মিত সিং ইচ্ছাকৃতভাবেই তাঁর উপাধি উল্লেখ করেছেন। তিনি উত্তেজনামুক্ত হলেন। কয়েকজন লোক তাঁর পাশে এসে তাঁকে শুভ সন্ধ্যা জানালেন।

শুভ সন্ধ্যা, তাদের কথার জবাব দিয়ে ইকবাল মিত সিং-এর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।

সরদার ইকবাল সিং অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য মিত সিং বললেন, একজন সমাজ কৰ্মী। তিনি বহু বছর বিলেতে ছিলেন।।

ইকবালের প্রতি একাধিক প্রশংসনীয় দৃষ্টি পতিত হলো বিলেত ফেরৎ। বার বার উচ্চারিত হলো শুভ সন্ধ্যা। ইকবাল অস্বস্তি বোধ করলেন।

আপনি একজন শিখ, ইকবাল সিংজি?, একজন লোক জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ। পনেরো দিন আগে তিনি হয়ত দৃঢ়তার সাথে বলতেন, না অথবা আমার কোন ধর্ম নেই বা ধর্ম অপ্রাসঙ্গিক। পরিস্থিত এখন অন্য রকম। তবে একথা ঠিক যে, তিনি একজন শিখের ঘরেই জন্মগ্রহণ করেন।।

বিলেতে থাকার সময় কি আপনি চুল কেটে ফেলেন? আগের ব্যক্তি আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

না জনাব, ইকবাল জবাব দিলেন। আমি আমার চুল কখনও লম্বা হতে দেই নি। লম্বা চুল ও দাঁড়ি ছাড়াই আমি একজন শিখ।

আপনার পিতামাতাও নিশ্চয় উদার, তাঁর সহায়তায় মিত সিং এগিয়ে এলেন। এই বক্তব্যে সন্দেহ নিরসন হলেও ইকবাল নিজের বিবেকের কাছে ছোট হয়ে গেলেন।

মিত সিং তাঁর পাজামার দড়ির সাথে বাঁধা এক গোছা চাবি বের করলেন। তিনি পাশে টুলের ওপর রাখা হারিকেন নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে একটা কামরার দিকে গেলেন।

এই কামরায় আমি আপনার জিনিসপত্র তালা দিয়ে রেখেছিলাম। ঐ সব জিনিস আপনি বুঝে নিন। আমি আপনার জন্য খাবার যোগাড় করছি।

না ভাইজি! আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমার কাছে যথেষ্ট খাবার আছে। আমি চলে যাওয়ার পর গ্রামে কি ঘটেছে তাই আমাকে বলুন। এসব লোকই বা কারা?

দরজার তালা খুলে মিত সিং কুলঙ্গিতে রাখা আলোর প্রদীপ জ্বলিয়ে দিলেন। ইকবাল তাঁর ব্যাগ খুলে সব জিনিস খাটিয়ার ওপর রাখলেন। তাঁর কাছে ছিল মাছ, মাখন ও পনিরের অনেক টিনের প্যাকেট। এ্যালুমিনিয়ামের অনেক কাটা চামচ, চামচ, ছুরি ও প্লাষ্টিকের কাপ-পিরচও ছিল তাঁর কাছে।

ভাইজি, কি হচ্ছে এখানে? ইকবাল আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

কি হচ্ছে? কি হয়নি। তাই আমাকে জিজ্ঞাসা করুন। ট্রেন ভর্তি মৃতদেহ এসেছে মানো মাজরা গ্রামে। একবার আমরা পুড়িয়েছি, একবার মাটি দিয়েছি। নদীর পানিতে অসংখ্য মৃতদেহ ভাসছে। মুসলমানদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের স্থানে পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুরা এসেছে। আর কি জানতে চান। আপনি?

ইকবাল হাতের রুমাল দিয়ে প্লাস্টিকের কাপ ও পিরচ মুছলেন। তিনি তাঁর ফ্লাস্ক বের করে ঝাকালেন। ফ্লাস্ক ভর্তি, তিনি বুঝলেন।

ফ্লাঙ্কে কি আছে?

ওহ্ এটাতে? ওষুধ। ইকবাল আসল কথা চেপে বললেন। এটা খেলে আমার ক্ষুধার উদ্রেক হয়, মৃদু হেসে তিনি বললেন।

এরপর আপনি টেবলেট খান হজম হওয়ার জন্য?

ইকবাল হাসলেন। হাঁ। এটা খেলে পায়খানা পরিষ্কার হয়। গ্রামে কেউ খুন হয়েছে।

না, অতি সাধারণভাবে মিত সিং বললেন। তিনি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন ইকবালকে বাতাসের গদি ফু দিয়ে ফুলাতে দেখে। কিন্তু এখানে খুন-জখম হতে পারে এ গদির ওপর ঘুমাতে খুব আরাম, তাই না? বিলেতে কি সব লোক এর ওপর ঘুমায়?

আপনি কি বলতে চান—এখানে খুন-জখম হবে? গদির মুখ বাঁধতে বাঁধতে ইকবাল জিজ্ঞাসা করলেন। সব মুসলমানরা তো চলে গেছে, তাই না?

হাঁ, কিন্তু ওরা আজ রাতে ব্রিজের কাছে ঐ ট্রেনটাতেই আক্রমণ করবে। ঐ ট্রেনে করে চন্দননগর ও মানো মাজরা গ্রামের মুসলমানদের পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনার বালিশেও বাতাস ভর্তি হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। ওরা কারা? নিশ্চয় গ্রামবাসীরা নয়?

আমি ওদের সবাইকে চিনি না। কয়েকজন লোক সামরিক পোশাকে সামরিক গাড়িতে করে এসেছিল। তাদের কাছে পিস্তল ও বন্দুক ছিল। উদ্বাস্তুরা ওদের সাথে যোগ দিয়েছে। মাল্লি বদমায়েশ ও তার দলের লোকেরাও যোগ গিয়েছে। ঐ দলে। গ্রামের কিছু লোকও আছে। আচ্ছা, ভারি কোন লোক এর ওপর শুলে এটা ফেটে যায় না? মিত সিং গদি টিপতে টিপতে জিজ্ঞাসা করলেন।

এই ঘটনা, মিত সিং-এর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইকবাল বললেন। ওদের পরিকল্পনা এখন বুঝতে পারছি। সেজন্য পুলিশ মাল্লিকে ছেড়ে দিয়েছে। জুগ্‌গাও ওদের সাথে যোগ দেবে বলে আমার ধারণা। সব কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত। বিছানার ওপর শুয়ে ইকবাল ঘাড়ের নিচে বালিশ দিলেন। ভাইজি, আপনি কি এটা থামাতে পারেন না? ওরা তো সবাই আপনার কথা শোনে।

মিত সিং গদির ওপর হাত বুলিয়ে মেঝের ওপর বসলেন।

বুড়ো ভাই-এর কথা কে শোনে? এখন সময় খুব খারাপ ইকবাল সিংজি, সময় খুব খারাপ। বিশ্বাসও নেই, ধৰ্মও নেই। এই দুঃসময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদে চুপচাপ থাকাই ভাল, তিনি গন্দির ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বললেন।

ইকবাল উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেয়া আপনার উচিত। নয়। আপনি কি ওদের বলতে পারেন না যে, ঐ ট্রেনে যারা আছে তাদের তোমরা চাচা, চাচি, ভাই ও বোন বলে সম্বোধন করেছ?

মিত সিং দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ঘাড়ে রাখা গামছা দিয়ে চোখের কোণা থেকে পানি মুছলেন।

আমি কিছু বললেও ওদের কি এসে যায়। তারা জানে, তারা কি করছে। তারা ওদের হত্যা করবে। তাদের অভিযান সফল হলে গুরুদুয়ারায় এসে তারা ধন্যবাদ। জানাবে। তারা পাপমুক্তির জন্যও প্রার্থনা করবে। ইকবাল সিংজি, এখন আপনি আপনার কথা বলুন। আপনি কি ভাল ছিলেন? থানায় পুলিশ কি আপনার সাথে ভাল ব্যবহার করেছে?

হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ভাল ছিলাম। মিত সিংকে থামিয়ে দিয়ে ইকবাল বললেন, কেন আপনি কিছু করছেন না? আপনি কিছু একটা করুন।

আমার ক্ষমতা অনুযায়ী আমি করেছি। কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয় তা লোকদের বলাই আমার কাজ। তারা যদি অন্যায় কাজ করতে এগিয়ে যায়, আমি ভগবানের কাছে তাদেরকে ক্ষমা করার প্রার্থনা করব। আমি শুধু প্রার্থনা করতে পারি। বাকি কাজ করতে পারে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট। আর পারেন। আপনি।

আমি? আমি কেন? অবাক বিস্ময়ে ইকবাল তাঁকে বললেন, এখানে আমি কি করতে পারি? এসব লোককে আমি চিনি না। তারা একজন অচেনা লোকের কথা শুনবেই বা কেন?

আপনি যখন এখানে আসেন, তখন ওদের কিছু বলার জন্যই এসেছিলেন। এখন ওদের উদ্দেশে কিছু বলছেন না কেন?

ইকবাল কোণঠাসা হয়ে পড়লেন। ভাইজি, লোকেরা যখন বন্দুক ও বর্শা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন তাদের সাথে কথা বলার জন্য প্রয়োজন বর্শা ও বন্দুকের। এটা যদি আপনি না করতে পারেন তা হলে তাদের পথের সামনে থেকে সরে দাঁড়ানোই ভাল।

আমিও ঠিক ঐ কথা বলছি। আমি মনে করেছিলাম, সমস্যা সমাধানে আপনি আপনার ইউরোপীয় জ্ঞান কাজে লাগাবেন। আপনার জন্য কিছু সম্বজি এনে দেই। আমি কিছুক্ষণ আগে রান্না করেছি, মেঝে থেকে দাঁড়াতে গিয়ে বললেন মিত সিং।

না, না ভাইজি। আমার যা প্রয়োজন সব টিনের মধ্যে আছে। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে আমি আপনার কাছ থেকে চেয়ে নেব। খাওয়ার আগে আমার সামান্য কিছু কাজ আছে।

মিত সিং বিছানার পাশে একটা টুলের ওপর হারিকোনটা রেখে হল ঘরে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *