৪.০৬ টাঙ্গা চন্দননগর ছেড়ে গেল

বিকেলের দিকে টাঙ্গা চন্দননগর ছেড়ে গেল। এ যাত্রা ছিল পুরোপুরি ঘটনাবিহীন। এ সময় জুগ্‌গা সামনের সিটো পুলিশ ও গাড়ি চালকের সাথে বসেছিল। পিছনের সিটে বসে ছিলেন ইকবাল।

কথা বলার মানসিকতা কারোরই ছিল না। বিপদের সময় যখন কেউ গাড়ি নিয়ে ঘরের বাইরে যেতে সাহস পায় না, সে সময় পুলিশ গাড়ি চালক ভোলাকেই খোঁজ করে। ভোলা নিৰ্ভয়ে তার হাড় জিরজিরে ধূসর রংয়ের ঘোড়া গাড়িতে জুড়ে বেরিয়ে পড়ে। এবারও সে গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছে। মাঝে মাঝে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারা আর মুখ দিয়ে খিস্তি কাটা তার স্বভাব। এবারও সে একইভাবে গাড়ি চালাতে শুরু করল। অন্যরা নিমগ্ন রইল তাদের নিজের চিন্তায়।

গ্রামের পথ ছিল নীরব ও শান্ত। রাস্তার পাশের নিচু জমি পানিতে পূর্ণ থাকায় পরিবেশটাি মনে হচ্ছিল আরও শান্ত। চাষাবাদের জমিতে কোন পুরুষ বা মহিলাকে দেখা গেল না। মাঠে কোন গরু-ছাগলকেও দেখা গেল না। দু’টো গ্রাম তারা অতিক্রম করল। কিন্তু কুকুর ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। ঐ গ্রাম দুটিতে। দুএকবার তাদের নজরে এল, কেউ যেন দেয়ালের পাশ দিয়ে বা কোন ঘরের কোণা দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। তাদের কাছে দেখা গেল বন্দুক বা বর্শা।

ইকবাল বুঝতে পারলেন যে, জুগ্‌গা ও কনস্টেবল, দুজন শিখ তাঁর সাথে থাকায় তাঁকে থামতে বলা এবং নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। তিনি যে শিখ, বেঁচে থাকার জন্য একথা প্রমাণ করতে হয় যেখানে, সেখান থেকে চলে যাওয়াই উত্তম বলে তিনি মনে করলেন। মানো মাজরা থেকে তিনি তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে প্রথম ট্রেনেই চলে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেন। এখন সম্ভবত কোন ট্রেন নেই। যদি কোন ট্রেন থাকেও, তাহলে তিনি কি ঐ ট্রেনে ঝুকি নিয়ে যাত্রা করবেন? ইকবাল নামের জন্য এবং পরে… ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দিলেন। লিঙ্গের অগ্রবর্তী চামড়ার অংশ কাটা হয়েছে কি হয়নি তার ওপর একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোথাও মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে? এটা দুর্ভাগ্যজনক না হলেও হাস্যকর তো বটে। কয়েকদিন তাঁকে মানো মাজরায় থাকতে হবে মিত সিং-এর আশ্রয়ে। মিত সিং-এর চেহারা অগোছালো, প্রতিদিন দুবার তিনি মাঠে যান প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। এই চিন্তাও তাঁর কাছে অস্বস্তিকর মনে হলো।

তিনি যদি দিল্লীতে গিয়ে সভ্যতার ধারে কাছে থাকতে পারতেন! তিনি সেখানে গিয়ে তাঁর গ্রেফতারের কথা বলতেন। তাঁদের দলীয় পত্রিকা তাঁর ছবিসহ প্রথম পৃষ্ঠায় এই শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করত:

বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে এ্যাংলো-মার্কিন পুঁজিবাদী ষড়যন্ত্র : সীমান্তে কমরেড ইকবাল গ্রেফতার

এতে তিনি সত্য সত্যই খ্যাতনামা হয়ে যেতেন।

জুগ্‌গার চিন্তা নূরানের কি হয়েছে তা নিয়ে। পাশের লোক বা গ্রামের মনোরম দৃশ্যের দিকে তার খেয়াল নেই। মাল্লির কথাও সে প্রায় ভুলে গেছে। তার মনে একটা ক্ষীণ আশা রয়েছে, নূরান এখনও মানো মাজরায় আছে। ইমাম বখশ চলে যাক, এটা গ্রামের কেউ চায় না। অন্য মুসলমানদের সাথে ইমাম বখশ চলে গেলেও নূরান হয়ত মাঠে ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে আছে, আর না হয় সে তার মায়ের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তার আশা, তার মা তাকে তাড়িয়ে দেবে না। তার মা যদি তাকে তাড়িয়ে দেয়, তাহলে সে নিজে তার মাকে ছেড়ে যাবে। সে আর কোনদিন তার মার কাছে ফিরে আসবে না। নূরানকে আশ্রয় না দেয়ার জন্য সারা জীবন তাকে অনুশোচনা করে কাটাতে হবে।

জুগ্‌গা তার নিজের চিন্তায় বিভোর ছিল। কখনও সে উদ্বিগ্ন আবার কখনও বা ক্রুদ্ধ হচ্ছিল মনে মনে। শিখ মন্দিরে প্রবেশের জন্য ছোট গলিপথটায় ঢোকার জন্য গাড়ির গতি কম হওয়ার সাথে সাথেই জুগ্‌গা চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। বিদায়ের সময় কারও সাথে সে একটা কথাও বলল না।

ইকবাল গাড়ি থেকে নেমে হাত-পা ঝাড়তে লাগলেন। গাড়ি চালক ও কনস্টেবল দুজন চাপা গলায় কি যেন কথা বলল!

আপনার আর কোন সেবা করতে পারি বাবু সাহেব? কনস্টেবলটি বলল।

না। ধন্যবাদ তোমাকে। আমি ঠিক আছি। তোমার কাজে আমি মুগ্ধ।

গুরুদুয়ারায় একা একা যাওয়ার কথা ইকবাল চিন্তা করলেন না। কিন্তু কাউকে সাথে করে তিনি সেখানে যাবেন, এটাও তিনি পছন্দ করলেন না।

বাবুজি, আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে। সারা দিন আমার ঘোড়াটা বাইরে, দানা পানি কিছুই দিতে পারিনি। তাছাড়া সময়টাও খারাপ আপনি জানেন।

হ্যাঁ। তোমরা যেতে পার। ধন্যবাদ। বিদায়।

বিদায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *