৪.০৩ মিত সিং-এর কামরায়

বড় হল ঘরের পাশে মিত সিং-এর কামরায় যে মহিলা ও শিশুরা আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। আগম্বুকেরা স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ঐ কামরায় প্রবেশ করল। ঘরে আরও হারিকেন আনা হলো। একটা খাটিয়ার ওপর নেতা একটা ম্যাপ বিছিয়ে দিল। একটা হারিকেন সে উঁচু করে ধরল। স্বেচ্ছাসেবীরা তার চারপাশে দাঁড়িয়ে ম্যাপটি নিরীক্ষণ করল।

নেতা বলল, তোমরা এখন যেখানে আছ, সেখান থেকে ব্রিজ ও নদীর অবস্থান লক্ষ্য করতে পারছি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওদের যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে।

তোমাদের কারও কাছে বন্দুক আছে?

তারা একে অন্যের দিকে তাকাল। না, কারও কাছে বন্দুক নেই।

এটা আলোচনার কোন বিষয়ই নয়, নেতা বলল। আমাদের কাছে ছয়-সাতটা রাইফেল আছে। সম্ভবত কয়েকটা স্টেনগানও আছে। তোমরা শুধু তলোয়ার ও বর্শ নিয়ে আসবে। বন্দুকের চেয়ে এগুলো বেশি কাজে লাগবে।।

নেতা কিছুক্ষণ থামল।

আমাদের পরিকল্পনা এই রকম। আগামীকাল সূর্যাস্তের পর অন্ধকার ঘনিয়ে এলে আমরা ব্রিজের প্রথম খিলানের ওপর আড়াআড়ি দড়ি বেঁধে দেব। দড়িটা থাকবে ইঞ্জিনের ধোয়া নির্গত হওয়ার নলের এক ফুট ওপরে। দড়ির নিচ দিয়ে ট্রেন অতিক্রম করার সময় ট্রেনের ছাদের ওপর বসে থাকা লোকগুলো দড়িতে বেধে নিচে পড়ে যাবে। এতে কম করে হলেও চার-পাঁচ শ লোককে আমরা ঘায়েল করতে পারব।

স্বেচ্ছাসেবীদের চোখে যেন বিদ্যুত খেলে গেল! এটা যে একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ তা তাদের চোখের ভাষায় স্পষ্ট হলো। তারা মাথা নেড়ে একে অপরের কথায় সায় দিল। সর্দার ও মিত সিং দরজার পাশে দাড়িয়ে সব কথা শুনছিলেন। নেতা তাঁদের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধভাবে বলল :

ভাইজি, এসব কথা শুনে আপনার লাভ কি? আপনি যান। প্রার্থনা করুন।

সর্দার ও মিত সিং নিঃশব্দে ওখান থেকে সরে গেলেন। সর্দার জানতেন, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তাঁকেও চলে যেতে বলবে নেতা।

সর্দারকে লক্ষ্য করে নেতা বলল, এই যে সর্দার সাহেব, এসব ঘটনা সম্পর্কে থানায় আপনার রিপোর্ট করা উচিত।

সবাই তার কথায় হাসল।

ছেলেটি হাতের ইশারায় সবার হাসি থামিয়ে দিল। সে বলল, কাল মধ্যরাতের পর চন্দননগর থেকে ট্রেনটি ছাড়ার কথা। ট্রেনে কোন আলো থাকবে না। ইঞ্জিনও থাকবে অন্ধকারে। রেল লাইনে এক শ গজ অন্তর অন্তর আমরা একজন করে লোক নিয়োগ করব, ওদের হাতে থাকবে টর্চলাইট। ট্রেন অতিক্রম করার সময় একজন লোক টর্চ জ্বালিয়ে সিগন্যাল দেবে। ফলে পরবর্তী লোকটি বুঝতে পারবে ট্রেন আসছে। অবশ্য ট্রেনের শব্দ শুনেও তোমরা বুঝতে পারবে ট্রেন আসছে। বেঁধে রাখা দড়িতে আটকে যেসব লোক ট্রেনের ছাদ থেকে ব্রিজের কাছে পড়বে, তাদের মারার জন্য ব্রিজের কাছেই তলোয়ার ও বর্শা নিয়ে লোক মোতায়েন থাকবে। তাদের হত্যা করে নদীতে ফেলে দিতে হবে। যাদের কাছে বন্দুক থাকবে তারা রেল লাইন থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে ট্রেনের জানোলা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়বে। ট্রেন থেকে তাদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি নিক্ষিপ্ত হওয়ার কোন আশংকা নেই। ট্রেনে মাত্র ডজনখানেক পাকিস্তানী সৈন্য থাকবে। অন্ধকারে তারা বুঝতেও পারবে না কোথায় গুলি করতে হবে। বন্দুকে গুলি ভরার সময়ও ওরা পাবে না। তারা যদি ট্রেন থামায়, তাহলে আমরা ওদের দেখব এবং সময়ের সুযোগ নিয়ে যত লোককে পারা যায় হত্যা করব।

পরিকল্পনাটি যথার্থ মনে হলো। প্রতিপক্ষের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগের কোন সম্ভাবনা নেই। সবাই খুশি হলো।

এখন ভোর হতে আর দেরি নেই, ছেলেটি ম্যাপ ভাঁজ করতে করতে বলল। কিছুটা সময় তোমাদের ঘুমানো উচিত। কাল সকালে আমরা ব্রিজের কাছে যাব। ওখানে গিয়ে আমরা ঠিক করব রাতে কে কোথায় অবস্থান নেব। শিখ জাতি খোদার পছন্দনীয় জাতি। আমাদের খোদার জয় হোক।

বৈঠক শেষ হলো। আগন্তুকর গুরুদুয়ারায় আশ্রয় নিল। মাল্লি ও তার দলের লোকেরাও মন্দিরে থেকে গেল। গ্রামের অনেক লোক ইচ্ছা করেই মন্দির ছেড়ে নিজের বাড়িতে চলে গেল। তাদের আশঙ্কা ছিল, মন্দিরে যে ষড়যন্ত্র নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে তারা উপস্থিত ছিল এবং সে কারণে সম্ভাব্য অপরাধমূলক কাজেও তারা জড়িয়ে পড়তে পারে। গ্রামের সর্দার দুজন লোককে সাথে নিয়ে চন্দননগর থানার দিকে রওনা হলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *