৩.৫ সারা রাত ধরে বৃষ্টি

সারা রাত ধরে বৃষ্টি ঝরল মাঝে মাঝে। কিন্তু ভোরের দিকে একনাগাড়ে বৃষ্টি শুরু হলো। গ্রামের যে সব লোক প্রায় সারা রাত জেগে ছিল, তারা বৃষ্টির শব্দে ঘুমিয়ে পড়ল। তদুপরি ভোরের নির্মল ঠাণ্ডা বাতাসের আমেজ তাদের গভীর ঘুমে অচেতন করে দিল।

মোটর গাড়ির হর্ন এবং কর্দমাক্ত নরম মাটিতে অল্প গতির গিয়ারে গাড়ি চালাবার জন্য ইঞ্জিনের বিকট শব্দে সারা গ্রামের লোকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। গাড়ির বহর মানো মাজরা গ্রামে এসে গাড়ি ঢোকার মত একটা চওড়া রাস্তার খোঁজ করতে শুরু করল। সামনে একটা জীপ। জীপের সাথে লাগানো একটা লাউড স্পীকার। ঐ জীপে ছিলেন দুজন অফিসার-একজন শিখ (ভৌতিক ট্রেনটা আসার পর যিনি আসেন) ও অন্যজন মুসলমান। জীপের পেছনে বারোটির বেশি ট্রাক। একটা ট্রাকে পাঠান সৈন্য এবং অন্য আর একটা ট্রাকে শিখ সৈন্য ভর্তি। প্রত্যেক সৈন্যের কাছে স্টেনগান।

গ্রামের ধারে এসে গাড়ির বহর থেমে গেল। একমাত্র জীপটাই সামনের দিকে এগুতে পারল। আরও কিছু দূর সামনে গিয়ে জীপটা পিপুল গাছের নিচে সিমেন্টে বাঁধানো স্থানে থামল। দুজন অফিসোরই গাড়ি থেকে নামলেন। শিখ অফিসারটি গ্রামের এক লোককে সর্দারকে ডেকে আনতে বললেন। মুসলিম অফিসারটি পাঠান সৈন্যদের কাছে গিয়ে তাদের সাথে কথা বললেন। তিনি তাদের তিন জন করে এক একটা দলে বিভক্ত হয়ে সব ঘরে গিয়ে মুসলমানদের বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিতে বললেন। কয়েক মিনিট পরে মানো মাজরা গ্রামে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হল–পাকিস্তানগামী সব মুসলমান এখনই বেরিয়ে এসো। সব মুসলমান বেরিয়ে এসো। এখনই।

ধীরে ধীরে মুসলমানরা তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। গরুর গাড়ির ওপর বোঝাই করা চারপাই, বিছানাপত্র, টিনের বাক্স, কেরোসিন তেলের টিন, মাটির কলসি, পিতলের আসবাবপত্র ও গরু-ছাগল নিয়ে তারা রাস্তায় নামল। মানো মাজরার অন্য লোকেরা রাস্তায় বেরিয়ে এলো ওদের বিদায় জানাতে।

দুজন অফিসার ও গ্রামের সর্দার গ্রাম ছাড়লেন সবার শেষে! তাদের পেছনে পেছনে জীপ চলল। ধীর গতিতে। তাঁরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করছিলেন। বেশির ভাগ আলোচনাই হচ্ছিল মুসলমান অফিসার ও সর্দারের মধ্যে।

গরুর গাড়িসহ বিছানাপত্র, টিনের পত্র, হাঁড়ি-পাতিল নেয়ার ব্যবস্থা আমার নেই। সড়ক পথে এসব গাড়ি পাকিস্তানে যাবে না। আমরা প্রথমে ওদের চন্দন নগর উদ্বাস্তু কাম্পে নিয়ে যাচ্ছি এবং সেখান থেকে ট্রেনে করে লাহোরে নিয়ে যাব। ওরা শুধু কাপড়-চোপড়, বিছানাপত্ৰ, নগদ টাকা পয়সা ও গয়নাপত্র সাথে করে নিয়ে যেতে পারবে। অন্য সব কিছু ওদের এখানে রেখে যেতে বলুন। আপনি ওদের জিনিসপত্র দেখাশুনা করবেন।।

মানো মাজরার মুসলমানদের পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এ খবরটায় সর্দার বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তিনি জানতেন, ওদের উদ্ধান্তু ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাত্র কয়েক দিনের জন্য এবং কয়েক দিন পরেই ওরা ফিরে আসবে নিজেদের ঘরে।

না সাহেব, আমরা কিছুই বলতে পারিনে, সর্দার বললেন, যদি দুএক দিনের ব্যাপার হতো, আমরা ওদের জিনিসপত্র দেখ-ভাল করতে পারতাম। আপনিও পাকিস্তানে চলে যাচ্ছেন। ওদের ফিরে আসতে হয়ত কয়েক মাস লেগে যাবে। সম্পত্তি খুব খারাপ জিনিস। সম্পত্তি মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলে। না, আমরা কিছুই ছুতে পারব না। ওদের ঘরবাড়ি যেন ঠিক থাকে তা আমরা দেখব।

মুসলমান অফিসারটি কিছুটা বিরক্ত হলেন। আপনার সাথে বাদানুবাদ করার সময় আমার নেই। আপনি দেখছেন, আমার কাছে মাত্ৰ বারোটি ট্রাক আছে। গরুমহিষের গাড়ি আমি ট্রাকে তুলতে পারি না।

না সাহেব, অতি দৃঢ়তার সাথে সর্দার বললেন, আপনার যা খুশি তাই বলতে পারেন। আপনি আমাদের ওপর রাগও করতে পারেন। কিন্তু আমরা আমাদের ভাইয়ের সম্পত্তি স্পর্শ করব না। আপনি কি চান, আমরা ওদের শক্ৰ হই?

বাহ বাহ, সর্দার সাহেব, হাসতে হাসতে মুসলমান অফিসারটি জবাব দিলেন, সাবাশ, গতকাল আপনারা ওদের খুন করতে চেয়েছিলেন, আজ বলছেন ওরা আপনাদের ভাই। কাল আবার আপনারা আপনাদের মন পরিবর্তন করতে পারেন।

এভাবে আমাদের খোঁচা দিয়ে কথা বলবেন না। ক্যাপ্টেন সাহেব। আমরা সব ভাই এবং ভবিষ্যতেও আমরা ভাই হিসাবে থাকব।

ঠিক আছে সর্দার সাহেব। আপনারা সব একে অন্যের ভাই, অফিসারটি বললেন, আপনার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু ওসব জিনিস। আমি ট্রাকে নিতে পারব না। শিখ অফিসার ও গ্রামের লোকদের সাথে আপনি আলোচনা করে দেখুন। আমি মুসলমানদের সাথে কথা বলছি।

মুসলমান অফিসারটি জীপের ওপর দাঁড়িয়ে উপস্থিত লোকদের উদ্দেশে বললেন। তিনি অতি সতর্কতার সাথে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করলেন।

আমাদের কাছে মাত্র বারোটি ট্রাক আছে। আপনারা যারা পাকিস্তানে যেতে চান, তাদের সবাইকে দশ মিনিটের মধ্যে গাড়িতে উঠতে হবে। এরপর আমাকে অন্য গ্রামের মুসলমানদের আনতে যেতে হবে। সাথে করে যেসব জিনিস নেয়া যায়, সেই সব জিনিসই কেবল নেবেন, অন্য কিছু নেবেন না। গরু-ছাগল, গরুর গাড়ি, চারপাই, কলসি এবং এ ধরনের জিনিস আপনারা গ্রামের বন্ধু-বান্ধবদের কাছে রেখে যান। সময়-সুযোগ পেলে এসব জিনিস আমি পরে আপনাদের কাছে পৌছিয়ে দেব। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আপনাদের দশ মিনিট সময় দিলাম। এরপর গাড়ি চলে যাবে।

মুসলমানরা তাদের গরুর গাড়ি ফেলে জীপের চারপাশে এসে জমায়েত হলো। তারা অফিসারের কথার প্রতিবাদ জানাল এবং চিৎকার করে কথা বলতে শুরু করল। মুসলমান অফিসারটি জীপ থেকে নেমে মাইক্রোফোনের কাছে গেলেন।

চুপ করুন। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দেবে। গাড়িতে আপনারা উঠুন, বা না উঠুন, সে ব্যাপারে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই।

একটু দূরে যে সব শিখ চাষী দাঁড়িয়ে ছিল, তারা অফিসারের ঐ আদেশ শুনতে পেল। তারা শিখ অফিসারের কাছে গোল পরামর্শের জন্য। অফিসারটি ওদের উপস্থিতি গ্রাহ্যই করল না। কাদামাটির রাস্তায় চলমান গাড়ি, গরু-বাছুর ও ট্রাকের বহরের দিকে লক্ষ্য করে তিনি গর্বের সাথে নিজের বর্ষাতি কোটের উঁচু কলারের দিকে তাকাচ্ছিলেন বার বার।

কেন, সর্দার সাহেব, ভয়ে ভয়ে মিত সিং জিজ্ঞাসা করলেন, গ্রামের সর্দার কি ঠিক কথা বলেননি। কারও উচিত নয়, অন্যের সম্পত্তি স্পর্শ করা। এতে ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা থাকে সব সময়।

মিত সিং-এর আপাদমস্তক একবার ভাল করে দেখলেন শিখ অফিসারটি। তারপর বললেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন ভাইজি। এতে ভুল বুঝাবুঝির ভয় থাকেই। কারও উচিত নয় অন্যের সম্পত্তি স্পর্শ করা। অন্যের স্ত্রীর দিকেও কারও তাকানো উচিত নয়। একজনের জিনিস অন্যে নিয়ে যাক, একজনের বোনের সাথে অন্য কেউ ঘুমোক-এসব কিছু একজন কেবল দেখতে পারে! আপনি বুঝতে পারছেন, লোকে চায় ওরা পাকিস্তানে যাক। আপনার সামনে কি আপনার মা-বোন ধর্ষিত হয়েছে, আপনাকে কি উলঙ্গ করা হয়েছে? আপনাকে লাথি মেরে পিছনে থুথু নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে?

অফিসারের এই ধরনের উক্তি উপস্থিত চাষীদের মুখে চপেটাঘাতের শামিল। কেউ যেন বিক্ৰপাত্মক হাসি হাসল। সবাই ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। মাল্লি ও তার পাঁচজন সঙ্গী দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে আরও কয়েকজন যুবক উদ্ধাস্তু। ওরা শিখ মন্দিরে থাকে। ওদের কেউ মানো মাজরার বাসিন্দা নয়।

স্যার, এই গ্রামের লোকেরা তাদের আতিথেয়তার জন্য বিখ্যাত, মাল্লি হাসতে হাসতে বলল। ওরা নিজেদেরই দেখ-ভাল করতে পারে না, অন্যের ভাল-মন্দ দেখবে কি করে? কিন্তু চিন্তা করবেন না। সর্দার সাহেব, আমরা মুসলমানদের সম্পত্তি দেখব। ঐ অফিসারকে আপনি বলে দিন, ওসব জিনিস আমাদের জিন্মায় রেখে যেতে। গ্রামের লোকেরা যেন ওসব জিনিস লুঠ না করে, তা নিশ্চিত করার জন্য আপনি কয়েকজন সৈন্য মোতায়েন করে দিন। সব জিনিস আমাদের কাছে নিরাপদে থাকবে।

সময়টা হট্টগোলের। মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছিল, চিৎকার করছিল সব শক্তি দিয়ে। অফিসারটির শেষ সিদ্ধান্ত শোনার পরও গ্রামের লোকেরা তাকে ঘিরে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। তারা একাধিক প্রস্তাবও রাখল অফিসারটির  কাছে। তিনি তাঁর শিখ সহকর্মীর কাছে এগিয়ে গেলেন ভীত বিহ্বল স্বধৰ্মীয় মুসলমানদের নিয়ে।

যে সব জিনিস রেখে যাচ্ছি তা কি আপনি বুঝে নিতে পারবেন?

শিখ অফিসারটি কিছু বলার আগেই চারদিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। তিনি চুপ করে রইলেন। গোলমাল থেকে নিজেকে। মুসলমান অফিসারটি ঘুরে দাঁড়িয়ে গর্জন করে বললেন, চুপ করুন।

গোলমাল থেমে গেল। আবার কিছু বলতে শুরু করলেন তিনি। হাতের তর্জনী তুলে প্রতিটি কথা স্পষ্ট করে বললেন :

পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। হাতে করে যা নেয়া যায় তাই নিয়ে ট্রাকে উঠুন। যাঁরা উঠবেন না, তাঁরা এখানে থেকে যাবেন। এটাই শেষ সময়। আমি আবার বলছি, এটাই শেষ সময়।

সব কিছুর নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, পাঞ্জাবী ভাষায় শিখ অফিসারটি কোমল স্বরে। বললেন, পাশের গ্রামের এই লোকগুলো গোলমাল না থামা পর্যন্ত ওদের গাড়ি, গরু-বাছুর, ঘর দেখবে-এমন ব্যবস্থা করেছি। আমি সব মালের একটা তালিকা তৈরি করে আপনার কাছে পরে পাঠিয়ে দেব।

তাঁর সহকর্মী এ কথার উত্তর দিলেন না। তাঁর ঠোঁটে ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি খেলে গেল। মানো মাজরার শিখ ও মুসলমানরা অসহায়ভাবে তা দেখল।

কোনো ব্যবস্থা করার সময় ছিল না। এমন কি বিদায় কথাটা বলারও সময় ছিল না। ট্রাকের ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয়া হলো। পাঠান সৈন্যরা মুসলমানদের ঘিড়ে তাড়িয়ে  নিয়ে এক দু’মিনিটের জন্য তাদের গরুর গাড়ির কাছে নিয়ে গেল। তারপর নিয়ে গেল ট্রাকের কাছে। তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল। কাদা-মাটির রাস্তায় সৈন্যরা তাদের তাড়িয়ে ফিরছিল। গ্রামের লোকেরা একে অপরকে ভাল করে দেখারও সুযোগ পেল না। ট্রাকে উঠে দূরে দাঁড়ানো গ্রামবাসীর দিকে তাকিয়ে তারা হাত নেড়ে বিদায় নিল। মুসলমান অফিসারটি জীপে চড়ে ট্রাকগুলোর চারপাশে একবার ঘুরে এলেন সব কিছু ঠিক আছে কি না তা দেখার জন্য। এরপর তিনি শিখ অফিসারের কাছে এলেন বিদায় নিতে। যন্ত্রের মতো তাঁরা করমর্দন করলেন। তাঁদের মুখে হাসি দেখা গেল না, আবেগের কোন লক্ষণও স্পষ্ট হলো না। ট্রাকের সামনে গিয়ে জীপ দাঁড়াল। মাইক্রোফোনে ঘোষিত হলোঃ তারা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। অফিসারটি জোর দিয়ে বললেন, পাকিস্তান। তার সৈন্যরা একযোগে বলল চিরদিনের জন্য। গাড়ির বহর ছুটিল চন্দননগরের দিকে। যতক্ষণ ওদের দেখা গেল, শিখরা দাঁড়িয়ে দেখল। চোখের পানি মুছল তারা দু’হাত দিয়ে। তারপর ঘরে ফিরে গেল বেদনাভরা হৃদয় নিয়ে।

মানো মাজরার দুঃখের পেয়ালা তখনও পূর্ণ হয়নি। শিখ অফিসারটি সর্দারকে ডেকে পাঠালেন। সর্দারের সাথে গ্রামের সবাই এলো। কেউ ঘরে একাকী থাকতে চাইল না। শিখ সৈন্যরা গ্রামের সব লোককে ঘিরে ফেলল। শিখ অফিসারটি ঘোষণা দিলেন যে, তিনি মাল্লিকে অপসারিত মুসলমানদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তির জিম্মাদার নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার বা তার লোকের কোন কাজে কেউ বাধা দিলে তাকে গুলি করা হবে।

মাল্লির দলের লোক ও উদ্বাস্তুরা সময়ক্ষেপণ না করে গাড়ি থেকে গরুর বাঁধন খুলে দিল। গাড়িতে রাখা মালপত্র লুঠ করল। তারপর গরু ও মহিষগুলোকে তাড়িয়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *