২.৬ বৃষ্টির ধারা কমে গিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি

বেলা এগারোটার দিকে বৃষ্টির ধারা কমে গিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। দিনটিও আলোকোজ্জ্বল হলো আগের চেয়ে। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব তার সাইকেলের সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। মেঘের ফাঁক দিয়ে দূরে নীলাকাশ দেখা গেল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্য দিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ল। জাফরানী রঙের আলোকচ্ছটার খিলান বর্ষণসিক্ত মাটির ওপর যেন ঢেউ খেলতে লাগল। দিগন্ত আকাশে রামধনু দেখা গেল। মনে হলো, সমস্ত চন্দননগর শহরটা যেন বিবিধ রঙ দিয়ে বাঁধিয়ে দেয়া হয়েছে।

সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব বেশ দ্রুত সাইকেল চালালেন। তাঁর হেড কনষ্টেবল মাল্লির গ্রেফতার সম্পর্কে থানা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করার পূর্বেই তিনি থানার পৌঁছাতে চান। থানা ডায়রির পাতা ছিড়ে ফেলা এবং উকিলের নানা ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া খুবই অস্বস্তিকর। হেড কনস্টেবল লোকটা বেশ অভিজ্ঞ। কিন্তু ইকবাল ও জুয়ার গ্রেফতারের পর ঐ লোকটার ওপর ইন্সপেক্টর সাহেবের আস্থা কিছুটা শিথিল হয়ে পড়েছে। রুটিন মাফিক ছাড়া অন্য কোন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কাজে তাকে আর বিশ্বাস করা যায় না। বন্দীদের কোথায় আটকে রাখতে হবে, সে কি তা জানে? সে ছিল একজন চাষী। সে কারণেই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর ব্যাপারে তার একটা ভীতি আছে। ইকবালকে বিরক্ত করার সাহস তার নেই (ওর সেলে সে একটা চারপাই, একটা টেবিল ও একটা চেয়ার রেখেছে)। সে যদি জুগ্‌গা ও মাল্লিকে ইতোমধ্যে অন্য একটা সেলে রেখে দিয়ে থাকে তাহলে ওরা দুজন হত্যা ও ডাকাতি নিয়ে আলোচনা করে একে অপরকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেবে।

সাইকেল চালিয়ে ইন্সপেক্টর সাহেব যখন থানায় ঢুকলেন, তখন থানার বারান্দা বেঞ্চিতে বসা, কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানোল। একজন তাঁর সাইকেল ধরল, একজন তাঁকে তাঁর রেইন কোট খুলতে সাহায্য করল। বর্ষার মধ্যে বাইরে যেতে হওয়ায় ইন্সপেক্টর সাহেবের মুখ দিয়ে কয়েকটা কথা বেরিয়ে এলো।

ডিউটি, ইন্সপেক্টর সাহেব গভীরভাবে বললেন, ডিউটি। বৃষ্টি কোন বাধা নয়। এমন কি ভূমিকম্প হলেও প্রথমে ডিউটি করতে হবে। হেড কনস্টেবল ফিরে এসেছে?

হ্যাঁ স্যার। কয়েক মিনিট আগে তিনি মাল্লির দলের লোকদেরকে ধরে এনেছেন। তিনি তাঁর বাসায় গেছেন চা খেতে।

দৈনন্দিন ডায়রিতে তিনি ওদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন?

না স্যার। তিনি বললেন, আপনার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব আশ্বস্ত হলেন। তিনি রিপোর্ট রুমে গিয়ে পাগড়িটা বুলিয়ে রেখে একটা চেয়ারে বসলেন। টেবিলে সব ধরনের রেজিস্টার সাজানো ছিল। বিভিন্ন কলামবিশিষ্ট হলুদ পাতাযুক্ত একটা বড় রেজিস্টার টেবিলের ওপরে খোলা ছিল। মানো মাজরা ব্লেষ্ট হাউজ থেকে ঐ দিন সকালে ফিরে আসার কথা লেখা আছে ঐ অন্তর্ভুক্তিতে।

উত্তম, দু’হাত ঘষে তিনি চীৎকার করে উঠলেন। উরুতে চাপড় দিলেন দু’হাত দিয়ে, দু’হাত কপালে ঠেকালেন এবং চুলে হাত বুলালেন। ঠিক আছে, তিনি যেন নিজেকেই বললেন ঠিক আছে।

একজন কনষ্টেবল তার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এলো চামচ দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে।

আপনার কাপড়-চোপড় নিশ্চয় ভিজে গেছে। কনষ্টেবিলটি ঐ কথা বলতে বলতে কাপটি টেবিলের ওপর রাখল। চা-এ শেষবারের মতো একটা নাড়া দিয়ে।

কনষ্টেবলের দিকে না তাকিয়ে ইন্সপেক্টর সাহেব চায়ের কাপটি তুলে নিলেন।

জুগ্‌গা যে সেলে আছে, সেই সেলে কি মাল্লির দলকে আটকে রেখেছ?

তৌবা! তৌবা! কনষ্টেবলটি তার দু’হাত কাঁধ পর্যন্ত তুলে বলল। স্যার, থানায় একটা খুন হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমরা যখন মাল্লিকে এখানে আনি, জুগ্‌গা ওকে দেখে প্রায় পাগল হয়ে ওঠে। এমন গালিগালাজ আমি আর কখনও শুনিনি। মা, বোন, মেয়ে—কাউকে সে রেহাই দিয়ে কথা বলেনি। ওরা ঘাবড়ে না। যাওয়া পর্যন্ত সে এমনভাবে লোহার দরজা ঝাঁকাতে থাকে যে, আমরা মনে করলাম, কবৃজা থেকে না দরজাই খুলে যায়। ঐ সেলে মাল্লিকে রাখার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আর মাল্লিও ঐ সেলে যেত না। সিংহের খাঁচায় মেষ শাবক কি যেতে চায়?

ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, জুগ্‌গার কথায় মাল্লি গালিগালাজ করেনি?

না। তাকে ভীতিসন্ত্রস্ত মনে হচ্ছিল। মানো মাজরা ডাকাতির ব্যাপারে তার কিছুই করার নেই, এ কথাই সে বার বার বলছিল। অথচ জুগ্‌গা তাকে বলে যে, সে তাকে নিজের চোখে দেখেছে। একবার সে বাইরে বেরুতে পারলে সবার সাথেই হিসাব মিটিয়ে নেবে এবং তাদের মা, বোন ও মেয়েদের দেখে নেবে। জবাবে মাল্লি তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে, সে আর এখন জুল্লাকে ভয় পায় না। কারণ জুগ্‌গা এখন ঐ তাঁতী মেয়েটার সাথে ঘুমানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। ঐ সময় জুয়া আচরণ করে পশুর মতো। মাল্লির কথায় জুগ্‌গার চোখ দু’টো লাল হয়ে উঠে। মুখে হাত রেখে সে গোংক্লাতে থাকে। বুক চাপড়ায় কয়েকবার। লোহার দরজায় বার বার আঘাত করে সে ঘোষণা করে যে, সে মাল্লির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরা টুকরা করে ফেলবে। মানুষকে এমনভাবে রাগতে আমি কখনও দেখিনি। আমরা কোন কুঁকি নিতে সাহস পাইনি। তাই জুগ্‌গার রাগ না কমা পর্যন্ত আমরা মাল্লিকে রিপোটিং রুমেই রেখে দেই। এরপর আমরা জুগ্‌গাকে বাবুর সেলে পাঠিয়ে মাল্লির দলকে জুগ্‌গার সেলে ঢুকিয়ে দেই।

বেশ ভালই তামাশা হয়েছে দেখছি, বিকৃত হাসি দিয়ে ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, আরও তামাশা দেখতে পাব আমরা। মাল্লির লোকজনকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি।

কনষ্টেবলটি হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সাবইন্সপেক্টর সাহেব রাজকীয় কায়দায় হাত নাড়িয়ে তাকে নিবৃত্ত করলেন।

নীতি, তুমি জান! আমি যতদিন চাকরি করছি ততদিন চাকরি করলে তুমি বুঝতে পারবে। যাও, গিয়ে দেখা হেড কনস্টেবলের চা খাওয়া হয়েছে কিনা। বলবে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

কিছুক্ষণ বাদেই হেড কনস্টেবল এসে উপস্থিত হলো। ঢেকুর তুলে সে তার পরিতৃপ্তির কথা প্রকাশ করল। তার যোগ্যতা নিয়ে কারও প্রশংসার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে সে সহ্য করতে পারে না। ইন্সপেক্টর সাহেব তার বিনম্র হাসিকে উপেক্ষা করে তাকে দরজা বন্ধ করে বসতে বললেন। হেড কনষ্টেবলের প্রকাশভঙ্গি পরিতৃপ্তি থেকে উদ্বিগ্নতায় এসে উপনীত হলো। সে দরজা বন্ধ করে টেবিলের অপর দিকে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, স্যার কি আদেশ?

বসুন বসুন, সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন শান্তভাবে। তাড়াহুড়ার কিছু নেই।

হেড কনষ্টেবল বসল। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব কাঠ পেন্সিলের সূচালো অংশটা সন্তৰ্পণে কানের মধ্যে ঢুকিয়ে ঘুরাতে লাগলেন। কিছুক্ষণ ঘোরানোর পর পেন্সিলটা বের করে তিনি সঁচালো অংশে লেগে থাকা বাদামী রঙের খৈল পরখ করতে লাগলেন। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে তিনি ম্যাচ বাক্সের ওপর কয়েকবার টোকা দিয়ে জ্বালালেন। বেশ শব্দ করেই তিনি সিগারেটে টান দিলেন। নাক দিয়ে নিঃসৃত ধোঁয়া টেবিলের ওপর আঘাত পেয়ে সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।

হেড কনস্টেবল সাহেব, জিহ্বায় লেগে থাকা তামাকের ছোট একটা টুকরা সরিয়ে তিনি বললেন, আজ অনেক কাজ করতে হবে। সব কোজ আপনি নিজে করবেন, এটাই আমার ইচ্ছা।

বেশ গুরুত্ব দিয়েই হেড কনস্টেবল বলল, জি স্যার।

মাল্লি ও তার দলের লোকদের মানো মাজরায় নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তাদের এমন এক জায়গায় ছেড়ে দিন যেন গ্রামের লোক দেখতে পায় যে, তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মন্দিরের কাছেই তাদের ছেড়ে দেয়া সম্ভবত উত্তম হবে। গ্রামের লোকদের কাছে এমনি এমনি জিজ্ঞাসা করবেন, তারা সুনতানা বা তাদের লোকদের কাউকে দেখেছে। কিনা। কেন? সে সম্পর্কে তাদের কিছু বলবেন না। এমনি এমনি জিজ্ঞাসা করবেন।

কিন্তু স্যার, সুলতানা ও তার দলবল তো পাকিস্তানে চলে গিয়েছে। সবাই তো একথা জানে।

সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব পেন্সিলের সূচাগ্র পুনরায় ক্যানের মধ্যে ঢুকিয়ে খৈল বের করে টেবিলের ওপর ঘষে দিলেন। সিগারেটে একটা জোরে টান দিয়ে অবজ্ঞা ভরে ঠোঁট উল্টালেন। এরপর দ্রুত ধোঁয়া ছাড়লেন এক রাশ। টেবিলের ওপর রক্ষিত রেজিস্টারে বাধা পেয়ে ঐ ধোঁয়া গিয়ে লাগল হেড কনন্টেবলের মুখে।

আমি জানি না যে, সুলতানা পাকিস্তানে চলে গেছে। ধরে নিলাম, মানো মাজরায় ডাকাতির পর সে চলে গেছে। কখন সে চলে গেছে তা গ্রামবাসীদের কাছে জানতে চাওয়া তো দোষের কিছু নয়। না দোষ আছে কিছু?

হেড কনন্টেবলের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হলো।

আমি বুঝেছি স্যার। আর কোন আদেশ?

হ্যাঁ। গ্রামবাসীদের আরও জিজ্ঞাসা করবেন, মুসলিম লীগ কামী ইকবাল যখন মানো মাজরায় ছিলেন, তখন কোন অঘটন সম্পর্কে তারা কিছু জানে কিনা।

হেড কনষ্টেবলকে আর একবার বিমর্ষ দেখাল।

স্যার, বাবুর নাম তো ইকবাল সিং। তিনি শিখ। তিনি বসবাস করতেন ইংল্যান্ডে এবং এ কারণে তার চুল ছোট করে কাটা।

সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব হেড কনস্টেবলের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। ইকবাল নামের অনেকেই আছেন। আমি বলছি মোহাম্মদ ইকবালের কথা, আর আপনি ভাবছেন ইকবাল সিং-এর কথা। মোহাম্মদ ইকবাল মুসলিম লীগের কর্মী হতে পারে।

বুঝতে পেরেছি। স্যার, একই কথা পুনরুক্তি করল হেড কনস্টেবল। কিন্তু সতি্যু সত্যি সে কিছুই বুঝতে পারেনি। সে ধারণা করল, নির্দিষ্ট সময়ে সে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারবে। আপনার আদেশ পালিত হবে স্যার।

আরও একটা বিষয়, চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, একজন কনস্টেবলকে বলবেন, আমার কাছ তাহকে একটা চিঠি নিয়ে মুসলমান উদ্বাস্তু ক্যাম্পের কমান্ডারকে দিতে। আগামীকাল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা মুসলমান গ্রাম থেকে মুসলমানদের সরিয়ে নেয়ার সময় মানো মাজরায় কিছু কনষ্টেবল পাঠাতে হবে। একথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন।

হেড কনস্টেবল অনুধাবন করল যে, এ কথার অর্থ পরিকল্পনা মোতাবেক তাঁর কাজে সাহায্য করতে হবে। এজন্য সে মানসিক প্রস্তুতি নিল, দ্বিতীয়বার তাঁকে সালাম দিল এবং সালামের সমর্থনে বুটের আওয়াজ শোনা গেল। হ্যাঁ স্যার, সে একথা বলে স্থান ত্যাগ করল।

সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব তার পাগড়ি মাথায় পরলেন। খোলা এক দরজার কাছে গিয়ে তিনি রেল ষ্টেশনের প্লাটফর্মের দিকে তাকালেন। প্লাটফর্মের দেয়ালে যে লতা বেয়ে বেয়ে ওপরের দিকে উঠছিল, তা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে। পড়ে থাকা পাতাগুলো সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠেছে। বাঁ দিকে পুলিশদের থাকার জায়গা। ওখানে দেখা গেল, চারপাই-এর ওপর পরিচ্ছন্নভাবে বিছানাপত্র গুটানো। পুলিশদের থাকার জায়গার ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে থানার দু’টো কামরা। অতি সাধারণ দু’টো কামরা। কামরা দু’টোর সামনে ইটের দেয়ালের পরিবর্তে আছে লোহার রেলিং। থানার বারান্দা থেকে কামরা দুটিতে কি আছে তা সব দেখা যায়। কাছের কামরাটিতে দেখা গেল, ইকবাল একটি চেয়ারে বসে, তার পা দু’টো চারপাই-এর ওপর। ম্যাগাজিন পড়ছেন তিনি। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একাধিক পত্রিকা। জুগ্‌গা সিং বসে আছে মেঝের ওপর। হাত দু’টো রেলিং-এর মাঝে। অলসভাবে সে তাকিয়ে আছে পুলিশদের কোয়াটারের দিকে। অন্য সেলটিতে মাল্লি ও তার লোকজন এলোমেলোভাবে বসে গল্প করছে। হেড কনষ্টেবল ও তিনজন পুলিশকে রাইফেল ও হাতকড়া নিয়ে আসতে দেখে তারা উঠে দাঁড়াল। পাশের সেলে পুলিশের আগমন জ্বল্পা লক্ষ্যই করল না। সে মনে করল, মাল্লিকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শুনানির জন্য।

জুগ্‌গাত্ সিং-এর আক্রমণাত্মক চেহারা দেখে মাল্লি ভয় পেয়ে যায়। জুগ্‌গাকে দেখে সে এতটাই ঘাবড়ে যায় যে, গোলমালের ভয়ে সে যে কোন শর্তে শান্তি স্থাপনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। সে জানে, ঐ জেলায় জুগ্‌গার মতো ভয়ঙ্কর লোক আর কেউ নেই। কিন্তু জুগ্‌গার গালাগালি তাকেও অসহিষ্ণু করে তোলে। মাল্লি তার নিজের দলের নেতা। সে মনে করে যে, জুগার ঐ অপমানের জবাবে তার কিছু করা দরকার, অন্তত নিজের লোকদের কাছে তার মান-মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার তাগিদে। যদি সে অনুমান করতে পারত যে, তার বন্ধুত্বসুলভ আচরণে জুগ্‌গা একই আচরণ করবে, তাহলে সে মানহানিকর মন্তব্য থেকে বিরত থাকত। সে অপেক্ষায় রইল, আবার একটা সুযোগের আশায়। তখন প্রচণ্ডতার জবাব প্রচণ্ডতার মাধ্যমেই দেয়া যাবে। লোহার দরজা তাদের শান্ত করল। তাছাড়া রাইফেল হাতে পুলিশও তো ছিল।

পুলিশরা মাল্লি, ও তার দলের লোকদের হাতকড়া লাগিয়ে একটা লম্বা শিকলের সাথে সংযুক্ত করল। শিকলের এক প্রান্ত রইল। একজন কনষ্টেবলের কোমরবন্ধের সাথে। হেড কনষ্টেবল তাদের অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিল। দুজন কনস্টেবল রাইফেল হাতে পিছনে রইল। তারা যখন সেলের বাইরে এলো, জুগ্‌গা একবার মাল্লির দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর সে কোন কথা না বলেই অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

তুমি পুরানো বন্ধুত্বের কথা ভুলে গিয়েছ, মেকি বন্ধুত্বসুলভ কণ্ঠে মাল্লি বলল, এমন কি তুমি আমাদের দিকে ফিরেও তাকালে না। আমরা তোমার আসার অপেক্ষায় রইলাম।

ওর সাথীরা হাসল। ওকে থাকতে দাও, ও ওখানে থাকুক।

জুগ্‌গা বসে রইল নিথর পাথরের মতো। ওর দৃষ্টি মেঝের ওপর নিবদ্ধ।

তুমি এত রাগ করেছ কেন বন্ধু! কিসের দুঃখ তোমার? কারও ভালবাসা কি তোমার দিলকে উত্থালপাথাল করছে?

এসো এসো, চলে এসো, পুলিশ বলল অনিচ্ছা সত্ত্বেও। তারাও দৃশ্যটা। উপভোগ করছিল।

আমাদের পুরানো বন্ধুকে কি আমরা শুভ বিদায় বলে যেতে পারব না? শুভ বিদায় সর্দার জুগ্ধা সিংজি। তোমার কি কারও কাছে কোন সংবাদ দেয়ার আছে? তাঁতীর ঐ মেয়েটার কাছে ভালবাসার কোন কথা?

লোহার দরজার ফাঁক দিয়ে জুয়া এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি। ক্ৰোধে তার চেহারা রক্তিম হয়ে উঠল। দেহের সব রক্ত যেন তার মুখে এসে জমা হলো। লোহার দরজার মধ্যে তার হাতের পেশী দৃঢ় হলো।

মাল্লি তার বন্ধুদের দিকে তাকাল। ওরা তখন মুচকি হাসছিল। সর্দার জুয়াত্ সিংকে আজ কিছুটা উতলা মনে হচ্ছে। আমাদের বিদায়ের জবাব সে আজ দেবে না। এজন্য অবশ্য আমরা কিছু মনে করি না। তার প্রতি রইল আমাদের শুভবিদায় বার্তা।

মাল্লি দু’হাত করজোড়ে লোহার দরজার কাছে মাথা নোয়াল। চিৎকার করে সে বলতে শুরু করল, শুভ বিদায় …।

আকস্মিকভাবে জুগ্ধ তার একটা হাত লোহার দরজার ফাঁক দিয়ে মাল্লির পাগড়ির পিছনের অংশের চুল ধরল। মাল্লির পাগড়ি খুলে পড়ল। শিকারী কুকুর যেমন এক খণ্ড কম্বলকে একদিক থেকে অন্যদিকে নাড়া দেয়, তেমনিভাবে সে মাল্লির মাথাটা বার বার সামনে পিছনে করে লোহার রডের সাথে ঠকতে লাগল। প্রতিটি আঘাতের সাথে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকল অশ্রাব্য গালি, এবার তোকে মাকে… এবার তোর বোনকে… এবার তোর মেয়েকে… এবার তোর মাকে আবার… এবার তোর বোনকে আবার…।

ইকবাল সব কিছুই প্রত্যক্ষ করছিলেন চেয়ারে বসে। ঘটনার প্রচণ্ডতা লক্ষ্য করে তিনি চেয়ার ছেড়ে দরজার ধারে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা চুপ করে আছ কেন? দেখছি না লোকটাকে ও মেরে ফেলবে?

পুলিশ গর্জে উঠল। একজন তার রাইফেলের বট দিয়ে জুগ্‌গার মুখে গুতো মারল। কিন্তু মুখ সরিয়ে জুগ্‌গা আঘাত থেকে রক্ষা পেল। মাল্লির সারা মাথা তখন রক্তে ভরা। তার মাথার খুলি ও কপাল থেতলে গেছে। সে আর্তচিৎকার করছিল। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব একদম সেলের কাছে গিয়ে তাঁর দম্ভের প্রতীক লাঠি দিয়ে জুগ্‌গার হাতে আঘাত করলেন একাধিকবার। কিন্তু জুগ্‌গা মাল্লির মাথা ছাড়ল না। এবার তিনি কোমরবন্ধ থেকে রিভলবার বের করে জুগ্‌গার দিকে তাক করে বললেন, শুয়োর কোথাকার! হাত ছাড় নইলে গুলি করব।

দু’হাত দিয়ে মাল্লির মাথা উঁচু করে জুগ্‌গা ওর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। সেই সাথে জুড়ে দিল কিছু অশ্রাব্য গালি। এরপর জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে সে মাল্লিকে ছেড়ে দিল। মাল্লি মাটিতে পড়ে গেল। তার চুলে ঢেকে গেল মুখ ও কাঁধ। তার সাথীরা তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল, রক্ত মুছে দিল, পাগড়ি দিয়ে মুখ মুছে দিল। শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে মাল্লি অভিশাপ দিল, তোর মায়ের মৃত্যু হোক, তুই একটা শুয়োরের বাচ্চা…তোকে আমি দেখে নেব …। মাল্লি ও দলের লোকেরা এগিয়ে গেল। বেশ দূর থেকে তখনও মাল্লির কান্নার শব্দ শোনা গেল।

রেগে যাওয়ার আগে জুগ্‌গা যে অবস্থায় ছিল, ঠিক সেই অবস্থায় ফিরে এলো।

ইন্সপেক্টর সাহেবের লাঠির আঘাতের চিহ্ন সে হাতের উল্টো দিকে দেখতে লাগল।

ইকবাল আগের মতো তখনও চিৎকার করছিলেন। জুগ্‌গা ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, চুপ করুন। বাবু! আমি আপনার কি করেছি যে, আপনি এত কথা বলছেন।

ইকবালের সাথে এত কৰ্কশভাবে জুগ্‌গা আগে আর কখনও কথা বলেনি। এতে ইকবালও কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন।

ইন্সপেক্টর সাহেব, এখন তো পাশের সেলটা খালি। ওখানে কি আমাকে রাখা যায়?

তিনি অনুনয় করে বললেন।

ইন্সপেক্টর সাহেব মুচকি হোসলেন।

নিশ্চয়ই ইকবাল সাহেব। আপনার সুবিধার জন্য যা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব তাই করব। টেবিল-চেয়ার দেয়া হবে। সম্ভব হলে একটা বৈদ্যুতিক পাখাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *