১.১২ সন্ধ্যার সময় একজন পুলিশ

সন্ধ্যার সময় একজন পুলিশ একটা চেয়ার নিয়ে ইকবালের কামরায় এলো।

এ সেলে কি আরও একজন আসছে? ইকবাল আশঙ্কা প্রকাশ করলেন।

না বাবুজি। ইন্সপেক্টর সাহেব। তিনি আপনার সাথে কথা বলতে চান। তিনি এখনই আসছেন।

ইকবাল কোন জবাব দিলেন না। চেয়ারটা ঠিক আছে কি না পুলিশটা পরখ করে দেখল। তারপর সে চলে গেল। বারান্দায় কারও কথার আওয়াজ পাওয়া গেল। এরপরেই ইন্সপেক্টর সাহেবেকে দেখা গেল।

ভিতরে আসতে পারি?

ইকবাল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন।

ইন্সপেক্টর সাহেব, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন।

আমরা আপনার ভৃত্য, মিঃ ইকবাল। আপনি আমাদের আদেশ করবেন। আর আমরা তা পালন করব, ইন্সপেক্টর সাহেব মৃদু হেসে বললেন। অবস্থা অনুসারে গলার স্বর ও আচরণ পরিবর্তন করতে পারায় তিনি গর্ব অনুভব করলেন। এটাই কূটনীতি।

খুনের অভিযোগে আপনারা যাকে গ্রেফতার করেছেন তার সাথে এমন সদয় ব্যবহার করবেন। এটা আমার জানা ছিল না। খুনের অভিযোগে আপনারা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, তাই না? গতকাল পুলিশরা যে ট্রেনে মানো মাজরায় আসে, আমিও সেই ট্রেনে এসেছিলাম। একথা পুলিশ আপনাকে বলেনি বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

আমরা কোন অভিযোগ আনিনি। সেটা আদালতের ব্যাপার। সন্দেহবশত আমরা আপনাকে আটক করেছি। রাজনৈতিক আন্দোলনকারীকে সীমান্ত এলাকায় থাকার অনুমতি আমরা দিতে পারি না। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব তখনও হাসছিলেন। আপনি যেখানকার লোক সেই পাকিস্তানে গিয়ে আপনি আন্দোলন করছেন না কেন?

এ কথায় ইকবাল খুবই রেগে গেলেন। কিন্তু তাঁর কথায় রাগের প্রকাশ না ঘটার জন্য তিনি সচেষ্ট হলেন।।

ইন্সপেক্টর সাহেব, পাকিস্তানের লোক বলতে আপনি সত্যি কি বোঝাতে চাইছেন??

আপনি মুসলমান। আপনি পাকিস্তানে চলে যান।

এটা নির্জলা মিথ্যা কথা, ইকবাল রাগে ফেটে পড়লেন। আপনি জানেন এটা মিথ্যা। আপনার নির্বুদ্ধিতা ঢাকা দেয়ার জন্য আপনি আমার বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা মামলা খাড়া করেছেন।

ইন্সপেক্টর সাহেব উত্তরে বেশ কটু কথাই শোনালেন।

মিঃ ইকবাল, আপনার মুখ সামলে কথা বলা উচিত। আমি আপনার বাপের কামাই খাই না যে, আপনার কথায় আমি স্বীকার করে নেব যে, ঐ অভিযোগ মিথ্যা। আপনার নাম ইকবাল এবং আপনার খৎনা আছে। আমি নিজে আপনাকে পরীক্ষা করেছি। তাছাড়া মানো মাজরায় আপনার উপস্থিতি সম্পর্কে আপনি কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেন নি। অভিযোগ করার জন্য এটাই যথেষ্ট।

আদালতের জন্য এটাই যথেষ্ট নয়। সংবাদপত্রের জন্যও এটা কোন বিষয় নয়। আমি মুসলমান নই-তাছাড়া এটা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। আমি কেন মানো মাজরায় এসেছি তা আপনাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনারা যদি আমাকে ছেড়ে না দেন তাহলে আমি হেবিয়াস করপসের আবেদন করব এবং আদালতকে বলব, আপনারা কেমন কর্তব্য পালন করেন।

হেবিয়াস করপাস আবেদন? ইন্সপেক্টর সাহেব সহস্যে উচ্চারণ করলেন। ইকবাল সাহেব, আপনি বোধ হয়। অনেক দিন বিদেশে কাটিয়েছেন। এখনও আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এখানে থাকলে আপনি সব কিছু বুঝতে পারবেন।

ইন্সপেক্টর সাহেব আকস্মিকভাবে সেল ত্যাগ করলেন। তাঁর সেলের লোহার গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। পাশের সেলের দরজাটি ইন্সপেক্টর সাহেব খুললেন। এই সেলেই রয়েছে জুগ্‌গা।

শুভ দিন, ইন্সপেক্টর সাহেব।

ইন্সপেক্টর সাহেব ঐ অভিবাদনের জবাব দিলেন না।

তুমি কি তোমার বদমায়েশি আর কোনদিন ছাড়বে না।

হুজুর, আপনার যা খুশি তাই বলুন। কিন্তু এবার আমি নির্দোষ। গুরুর নামে শপথ করে বলছি, আমি নির্দোষ।

জুগ্‌গা মেঝোয় বসে আর ইন্সপেক্টর সাহেব দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ডাকাতির রাতে তুমি কোথায় ছিলে?

ঐ ডাকাতির সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, মূল প্রশ্ন এড়িয়ে জুয়া জবাব দিল। ডাকাতির রাতে তুমি কোথায় ছিলে? একই প্রশ্নের পুনরুক্তি করলেন ইন্সপেক্টর সাহেব।

জুগ্‌গা মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, আমি ক্ষেতে গিয়েছিলাম। ঐ রাতে পানি দেয়ার পালা ছিল আমার।

সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব বুঝলেন যে, সে মিথ্যা বলছে। পয়োনালীর লোককে এটা জিজ্ঞাসা করে নেয়া যাবে। তুমি যে গ্রামের বাইরে যাচ্ছ, এ কথা কি সরদারকে জানিয়েছিল?

জুগ্‌গা তার পা দু’টো সরিয়ে মেঝের দিকেই চেয়ে রইল।

তোমার মা বলল যে, তুমি ক্ষেতে গিয়েছিলে শুয়োর তাড়াতে। জুগ্‌গা পুনরায় তার পা সরিয়ে রাখল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে সে আবার বলল, এ ডাকাতির সাথে আমি জড়িত নই। আমি নির্দোষ।

ডাকাত কারা?

হুজুর, আমি কি করে জানব কারা ডাকাতি করেছে? ঐ সময় আমি গ্রামের বাইরে ছিলাম। তা না হলে মানো মাজরায় কেউ এসে ডাকাতি ও খুন করতে সাহস করত বলে আপনি মনে করেন?

কারা ডাকাতি করেছে? ভয় প্রদর্শন করে ইন্সপেক্টর সাহেব একই প্রশ্ন করলেন। আমি জানি তুমি তাদের চেনা। তারাও তোমাকে চেনে। তোমার জন্য তারা কাচের চুড়ি উপহার দিয়ে গেছে।

জুগ্‌গা উত্তর দিল না। পাছায় বেত না পড়লে বা মলদ্বরে লাল শুকনো ঝাল না ঢোকালে কি কথা বলবে না তুমি?

জুগ্‌গা আঁতকে উঠল। ইন্সপেক্টর সাহেব কি বোঝাতে চাইছেন তা সে জানে। একবার তার অভিজ্ঞতা হয়েছে। খাটিয়ার পায়ার নিচে হাত-পা রেখে তার ওপর ছয়-সাত জন পুলিশ বসে। অণ্ডকোষ মুড়িয়ে ও পিষে দেয়া হয় যতক্ষণ পর্যন্ত লোকটি যন্ত্রণাকাতর হয়ে জ্ঞান না হারায়। মলদ্বার দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে গুড়ো শুকনো ঝাল গলিয়ে দেয়া হয়। এর করুণ অনুভূতি কয়েক দিন পর্যন্ত থাকে। এর ওপর পানি বা খাবার দেয়া হয় না। ঝালযুক্ত খাবার ও অত্যধিক ঠাণ্ডা পানি লোহার গেটের বাইরে এমন জায়গায় রাখা হয় যা তার নাগালের বাইরে। এই স্মৃতির কথা স্মরণ করে সে আঁতকে উঠল।

না, সে বলল, খোদার দোহাই, না। সে মেঝের ওপর শুয়ে দু’হাত দিয়ে ইন্সপেক্টর সাহেবের পা জড়িয়ে ধরল। হুজুর দয়া করুন। এ ধরনের নম্রতা প্রকাশ করতে নিজের কাছেই তার লজ্জা করছিল। কিন্তু সে জানে যে, ঐ ধরনের শাস্তি সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি নির্দোষ। গুরুর নামে শপথ করে বলছি, ঐ ডাকাতির সাথে আমি জড়িত ছিলাম না।

দীর্ঘদেহী ও বিরাট বপুর অধিকারী জুগ্‌গা তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে ইন্সপেক্টর সাহেবের পা জড়িয়ে আছে, এ কথা ভাবতেই তাঁর গর্ব হলো। দৈহিক নির্যাতন সহ্য করে কেউ কথা বলেনি, এমন কাউকে তিনি দেখেন নি। এজন্য প্রয়োজন দৈহিক নির্যাতনের পদ্ধতি সতর্কতার সাথে ঠিক করা। কেউ ক্ষুধায় কাতর হয়। ইকবালের মতো লোক পুলিশের সামনে বিবস্ত্র হতে চায় না। কেউ হয়ত হাত বাঁধা অবস্থায় মুখের কাছে মশার গুন গুন শব্দ শুনতে পারে না। কেউ অনিদ্রা সহ্য করতে পারে না। এসব শাস্তি পেলে সবাই প্রকাশ করে গোপন কথা।

ডাকাতদের নাম বলার জন্য আমি তোমাকে দু’দিনের সময় দিলাম। ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন। অন্যথায় ভেড়ার লেজের মতো না হওয়া পর্যন্ত তোমার পাছায় বেতমারা হবে।

ইন্সপেক্টর সাহেব জুগার হাত থেকে পা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন। তাঁর এই আগমন ব্যর্থ হলো। তাঁকে পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। দুই বিপরীতধর্ম লোককে নিয়ে কাজ করা সত্যি হতাশাব্যঞ্জক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *