১.০৮ পরদিন সকালে ইকবালকে গ্রেফতার করা হলো

পরদিন সকালে ইকবালকে গ্রেফতার করা হলো।

মিত সিং তাঁর পানি ভর্তি পিতলের মাগটি নিয়ে মাঠের জঙ্গলের দিকে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন একটা গাছের ডাল দিয়ে দাঁতন করতে করতে। অতিক্রান্ত ট্রেনের গুড় গুড় শব্দ, মুয়াজ্জিনের আজান ধ্বনি এবং গ্রামের অন্যান্য কোলাহলের মধ্যে তাঁর বেশ ঘুম হয়েছিল। দুজন কনস্টেবল গুরুদুয়ারায় এসে তাঁর কামরা দেখল। সেলুলয়েডের কাপ ও প্লেট, এলুমিনিয়ামের ঝকঝকে চামচ ও ছুরি, থার্মোফ্লাঙ্ক তারা পরীক্ষা করে ছাদের ওপর উঠে গেল। তারা ইকবালকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিল। ইকবাল চোখ ডলাতে ডালতে উঠে বসলেন। তাঁকে বেশ আতঙ্কগ্ৰস্ত মনে হলো। অবস্থা কি হয়েছে তা পুরোপুরি বুঝে ওঠার এবং সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়ার আগেই তিনি তাঁর পরিচয় ও পেশা সম্পর্কে কনস্টেবলদের বললেন। তাদের একজন তাঁর ঘুমন্ত চোখের ওপর ছাপানো একখানা হলুদ কাগজের খালি অংশ পূরণ করে তা মেলে ধরল।

এটা আপনার গ্রেফতারের ওয়ারেন্ট, উঠে পড়ুন।

অপর কনস্টেবলটি তার বেল্টের সাথে রাখা হাতকড়ার একটি অংশ খুলে নিয়ে ইকবালের হাতে লাগাবার জন্য তার সংযুক্তি চাবি দিয়ে খুলল। হাতকড়ার দৃশ্য ইকবালকে যেন ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। তিনি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে কনষ্টেবলদের মোকাবিলা করলেন।

এভাবে গ্রেফতার করার কোন অধিকার তোমাদের নেই, তিনি চিৎকার করে উঠলেন। তোমরা আমার সামনেই গ্রেফতারী পরোয়ানা তৈরি করেছ। এখানেই এর শেষ নয় মনে রেখো। পুলিশ শাসনের দিন চলে গেছে। তোমরা যদি আমার গায়ে হাত দাও। তাহলে সারা বিশ্বকে আমি তা জানিয়ে দেব। সংবাদপত্রে আমি প্রকাশ করে দেব, তোমাদের মতো লোক কিভাবে কর্তব্য পালন করে।

কনস্টেবল দুজন হতবাক হয়ে গেল। ঐ যুবক লোকটির কথা বলার ধরন, রাবারের বালিশ, পদি ও কামরার অন্যান্য জিনিস যা তারা দেখেছে এবং সব কিছুর উৰ্ব্বে তাঁর আক্রমণাত্মক ভঙ্গি-সব কিছু তাদের কেমন যেন অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে নিক্ষেপ করল। তাদের মনে হলো, তারা যেন একটা ভুল করে ফেলেছে।

বাবু সাহেব, আমরা শুধু ডিউটি করছি। এসব বিষয় আপনি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সাথে বোঝাপড়া করবেন, একজন কনস্টেবল বিনম্রভাবে কথাগুলো বলল। অন্যজন হাতকড়া হাতে অস্বস্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল।

পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট, সবার সাথেই বোঝাপড়া করব। ঘুমন্ত মানুষকে বিরক্ত করা! এ ভুলের জন্য তোমাদের দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। কনষ্টেবল দুজন কিছু বলবে এই আশা করে ইকবাল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, তারা কিছু বললে সেই কথার ওপর ভিত্তি করে আইন-শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে তিনি কিছু বলবেন। কিন্তু তারা চুপ করে রইল অনুগতভাবে।

তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমি মুখ-হাত ধোব, কাপড় বদলাব এবং আমার জিনিসপত্র কারও হাওলা করে যাব, ইকবাল বেশ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতেই কথা বললেন। তারা কিছু বলুক, এ সুযোগও তিনি তাদের করে দিলেন।

ঠিক আছে বাবু সাহেব। আপনার যত সময় লাগে লাগুক।

পুলিশদের এই অসামরিক মনোভাব তাঁর ক্রোধকে প্রশমিত করল। তিনি তাঁর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচতলায় তাঁর কামরায় নেমে এলেন। এরপর তিনি পাতকুয়ার ধারে গেলেন, কুয়া থেকে এক বালতি পানি উঠিয়ে হাত-মুখ ধোয়া শুরু করলেন। তাঁর কাজকর্ম দেখে মনে হলো, তাঁর কোন তাড়া ছিল না।

ভাই মিত সিং দাঁতন করতে করতে গুরুদুয়ারায় এলেন। পুলিশের উপস্থিতি তাঁকে অবাক করল না। পুলিশরা যখনই গ্রামে এসে সরদারের বাড়িতে থাকার জায়গা পেত না তখনই তারা গুরুদুয়ারায় চলে আসত। মহাজনের খুন হওয়ার পর পুলিশদের আগমন নিশ্চিত, একথা তিনি ধরেই নিয়েছিলেন।

শুভ সকাল, মিত সিং তাঁর হাতের দাঁতনটা ফেলে দিয়ে বললেন।

শুভ সকাল, পুলিশ দুজন উত্তর দিল।

আপনারা চা বা অন্য কিছু খাবেন? ঘোল?

আমরা বাবু সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছি, পুলিশরা বলল। বাবু সাহেবের তৈরি হওয়া পর্যন্ত যদি কিছু দেন তাহলে ভালই হয়।

মিত সিং সাধারণভাবে উদাসীনতা দেখালেন। পুলিশের সাথে তর্ক-বিতর্ক করা বা তাদের কাজ নিয়ে উৎসাহ দেখানো তিনি পছন্দ করলেন না। ইকবাল সিং সম্ভবত একজন কমরেড। কারণ তিনি কমরেড-এর মতোই কথা বলেন।

আমি তাঁর জন্যও এক কাপ চা তৈরি করি, মিত সিং বললেন। এরপর ইকবালের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি আপনার বোতলে রাখা চা খাবেন?

অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাকে, টুথপেস্ট মুখে বললেন ইকবাল। তিনি একবার থুথু ফেললেন। বোতলে রাখা চা এতক্ষণে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এক কাপ গরম চা পেলে কৃতজ্ঞ থাকব। আমি যতদিন বাইরে থাকিব ততদিন কি আমার জিনিসপত্রগুলো দেখবেন দয়া করে। ওরা কি কারণে যেন আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছে। কারণ সম্পর্কে ওরাও কিছু জানে না।

মিত সিং এমন ভান করলেন যেন তিনি কিছুই শুনতে পাননি। পুলিশ দুজনকে

দেখা গেল কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়।

বাবু সাহেব, এতে আমাদের কোন দোষ নেই, একজন পুলিশ বলল। আমাদের ওপর আপনি কেন রাগ করছেন। রাগ যদি করতে হয় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ওপরই করুন।

ইকবাল তাদের প্রতিবাদ অবজ্ঞা করে আরও জোরে দাঁত মাজতে লাগলেন। তিনি হাত মুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখের পানি মুছতে মুছতে কামরায় ঢুকলেন। তিনি গদি ও বালিশের বাতাস ছেড়ে দিয়ে তা গোল করে ভাঁজ করলেন। হোন্ডআলোর ভিতর যে সব জিনিস ছিল তা বার করলেন এসব জিনিসের মধ্যে ছিল বই, কাপড়-চোপড়, টর্চ লাইট, একটা বড় ফ্লাস্ক। তিনি এসব জিনিসের একটা তালিকা করে তা পুনরায় হোন্ডঅলের মধ্যে রেখে দিলেন। মিত সিং যখন চা নিয়ে এলেন, তিনি তাঁর কাছে হোল্ড অলটা বুঝিয়ে দিলেন।

ভাইজি, আমার সব জিনিস। এই হোন্ডঅলের মধ্যে রেখে দিয়েছি। এগুলো দেখতে আপনার খুব কষ্ট হবে না বলে মনে হয়। আমাদের এই স্বাধীন দেশে আমি পুলিশের চেয়ে আপনাকেই বেশি বিশ্বাস করি।

পুলিশ দুজন অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মিত সিং অম্বস্তিবোধ করলেন।

নিশ্চয়ই বাবু সাহেব, তিনি খুব ক্ষীণ স্বরে বললেন। আমি আপনার মতো পুলিশেরও সেবক। এখানে সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ। আপনি কি আপনার নিজের কাপে চা খাবেন?

ইকবাল তাঁর সেলুলয়েডের চায়ের কাপ ও চামচ বের করলেন। কনষ্টেবল দুজন মিত সিং-এর কাছ থেকে পিতলের মগ নিল। মাথার পাগড়ির বাড়তি অংশ দিয়ে তারা মগের চারপাশে জড়িয়ে নিল। উদ্দেশ্য, হাতে যেন পরম না লাগে। নিজেদের আরও নিরাপদ রাখার জন্য তারা ফু দিয়ে চায়ে চুমুক দিল বেশ শব্দ করে। ইকবালের যেমন তাড়া ছিল না তেমনি কোন ভীতিও ছিল না। পুরো পরিস্থিতি ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তিনি বসেছিলেন স্প্রিং-এর খাটিয়ার ওপর। পুলিশ দুজন দরজার চৌকাঠের নিচের অংশে আর মিত সিং বাইরে মেঝের ওপর বসে ছিলেন। তারা ইকবালের সাথে কথা বলার সাহস পেল না, যদি তিনি আবার খারাপ ব্যবহার করেন, এই ভয়ে। যে কনষ্টেবলের হাতে হাতকড়া ছিল সে অতি সন্তৰ্পণে হাতকড়াটা তুলে নিয়ে পকেটে পুরে রাখল। তারা চা খাওয়া শেষ করে এদিক ওদিক তাকাল অসহিষ্ণুভাবে। ইকবাল বসে রইলেন। মাঝে মাঝে তাদের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালেন এবং অতি ধীর গতিতে চায়ে চুমুক দিলেন। কয়েকবার তিনি শূন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। চা খাওয়া শেষ করে তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।

আমি প্রস্তুত, তিনি বললেন। নাটকীয়ভাবে তিনি তাঁর দু’হাত প্রসারিত করে বললেন, হাতকড়া লাগাও।

হাতকড়ার প্রয়োজন নেই, বাবুজি, একজন কনষ্ট্রেবল বলল। আপনি বরং আপনার মুখটা ঢেকে নিন, অন্যথায় সনাক্তকরণ প্যারেডে সবাই আপনাকে চিনে ফেলবে।

ইকবাল যেন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। এভাবেই তোমরা ডিউটি করা? আইনে যদি বলা হয় হাতকড়া লাগাতে হবে, তাহলে হাতকড়া লাগাও। কেউ আমাকে চিনে ফেললেও আমি ভয় করি না। আমি চোর বা ডাকাত নই। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। আমি গ্রামের মধ্য দিয়েই যাব। গ্রামের লোক আমাকে দেখুক। তারা দেখুক, তারা যা চায় না পুলিশ সেই কাজ করে।

ইকবালের এই কথা একজন পুলিশের সহ্য হলো না। সে তৎক্ষণাৎ বলল:

বাবুজি, আমরা আপনার সাথে সদায় ব্যবহার করে আসছি। সব সময় আপনাকে জি, জি বলে আসছি। কিন্তু আপনি চান আমাদের মাথার ওপর বসতে। আমরা আপনাকে হাজার বার বলেছি যে, আমরা শুধু ডিউটি করছি। কিন্তু বার বার আপনি এমন কথা বলছেন যাতে, বিশ্বাসযোগ্য হয় যে, ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে আমরা এ কাজ করছি। এরপর পুলিশটি তার সহকমীরি দিকে তাকিয়ে বলল, লোকটার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দাও। সে তার খোলা মুখ নিয়ে যা খুশি করুক। আমার মুখ এরকম হলে আমি তা লুকিয়ে রাখতাম। আমরা রিপোর্ট করব যে, তিনি মুখ ঢাকতে অস্বীকার করেছেন।

এই বিদ্রুপের ত্বরিত উত্তর ইকবালের কাছে ছিল না। তাঁর নাক বাঁকা এ কথা তিনি জানতেন। অনিচ্ছ সত্ত্বেও তিনি তার হাতের উলটো দিক দিয়ে নাক ঘষলেন। তার দৈহিক বিবরণের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তাঁর হাতে হাতকড়া লাগানো হলো এবং একজন পুলিশের বেল্টের সাথে চেন দিয়ে আটকে রাখা হলো।

বিদায় ভাইজি, আমি শীঘ্ৰ ফিরে আসব।

বিদায় ইকবাল সিংজি, গুরু আপনাকে রক্ষা করুন। বিদায় সেন্ট্রি জি।

বিদায়।

গুরুদুয়ারার আঙ্গিনা পেরিয়ে তারা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মিত সিং সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। হাতে তাঁর চায়ের কেট্‌লি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *