৫. ফিরোজার একটি দেবর জন্ম নিয়েছে

ফিরোজার একটি দেবর জন্ম নিয়েছে, ফিরোজা আমার স্ত্রী, ধরে নিচ্ছি তারা মাঝেমাঝে ঘুমায়, আমি কি এখন তাদের দুজনকে খুন করতে বেরোবো, রক্তে বিবাহকে পবিত্র করবো? বিয়েতে আমরা কোনো শপথ করেছিলাম পরস্পরের প্রতি? আমার মনে পড়ছে না; মৃত্যু আমাদের পৃথক না করা পর্যন্ত আমরা একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো, এমন কোনো শপথ আমরা করি নি, অন্তত আমার মনে পড়ছে না, বিয়েতে আমি কী বলেছিলাম তা-ই আমার মনে পড়ছে না। আমি বিশ্বস্ত নই, ফিরোজা বিশ্বস্ত নয়; কে কখন বিশ্বস্ত ছিলো? বিশ্বস্ত থাকতে হয় কেনো? আমি বাসায় ফিরে আসার পর আমার শরীরে কি মাহমুদা রহমানের ছাপ থাকে; ফিরোজা যদি আজ রাতে তার দেবরের সাথে মিলিত হয়, আমি ফিরে গিয়ে ফিরোজার শরীর তন্নতন্ন করে পরখ করি, তাহলে কি দেবরের কোনো ছাপ খুঁজে পাবো? আমি এখন কোথায় যাবো? মাহমুদা রহমানের কাছে যেতে পারি, রাত বারোটা পর্যন্ত থাকতে পারি, তাঁর বাচ্চা দুটি সারাক্ষণ পাশে বসে থাকবে আমার, ওদের জন্যে আইস্ক্রিম কিনতে হবে, যেতে ইচ্ছে। করছে না; পবিত্র সুন্দরী মহীয়সী বিধবাটিকে মনে পড়ছে, অনেক দিন ধরেই মনে। পড়ছে, বিধবা আমার মনে ঝিলিক দিচ্ছেন মাঝেমাঝে, অনেক দিন তার বাসায় যাওয়া হয় নি, তাঁর বাসায় যাবো? এখন কি তিনি বাসায় থাকবেন তার বাসায় কি খুব ভিড় থাকবে? যে-কয়েকবার গেছি খুব বিখ্যাত মানুষদের সাথে দেখা হয়েছে, এক সোফায়। অততগুলো বিখ্যাত আমি কখনো দেখি নি, অতো বিখ্যাতদের পাশে আমাকে মানায় না; আর বিখ্যাতদের মুখ থেকে কেমন বিশ্রী একটা গন্ধ বেরোয়, পাশে বসে কথা–বলতে থাকলেই আমি ওই গন্ধটা পেতে থাকি, সহ্য করা বেশ কষ্টকর হয়ে ওঠে। সৌন্দর্যের পাশে ওই বিখ্যাত লোকগুলোকে আমার চাঁড়ালের মতো ঘিনঘিনে মনে হয়। তাঁরা অবশ্য স্তবগান জানেন, অসংখ্য স্তবগান তাঁদের মুখস্থ, তাঁরা রূপসী বিধবাটিকে দেবী করে তুলতে চাচ্ছেন, আর চাচ্ছেন দেবীর সঙ্গে একটু-আধটু ঘুমোনোর। দেবী চাইলে তারা না করবেন না। আমি তাকে দেবী করে তুলতে পারবো না, স্তবগান। কখনো শিখি নি, কিন্তু তিনি দেবী দেবী বোধ না করলে কারো ডাকে সাড়া দেন না মনে হয়। আমি কি সেই পবিত্র সুন্দরী মহীয়সীর কাছে যাবো, তাঁর করুণা চাইবো; তিনি কি আমাকে উদ্ধার করবেন উদ্দেশ্যহীনতা থেকে?

এক বন্ধুর সাথে প্রথম গিয়েছিলাম তার বাসায়, বন্ধুটি কোনো পূর্বধারণা দেয় নি। আমাকে, শুধু বলেছিলো আমাকে সে একটি অপূর্ব বিধবা দেখাবে; তরুণী, রূপসী, করুণাময়ী বিধবা, যা আমি আগে দেখি নি, পরেও দেখবো না। তাকে দেখে আমি মুগ্ধ হই, তাঁর রূপ আর করুণা অপার বলেই মনে হয় আমার। খুব দামি সৌন্দর্য আর বিষণ্ণতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে ছিলো; তিনি একটি দামি শাড়ি পরেছিলেন, তবে তিনি যে-বিষণ্ণতা আর সৌন্দর্য পরে ছিলেন, তার দাম আরো অনেক বেশি, কোটি মুদ্রার বেশি। আমি তার থেকে বেশ দূরেই বসা ছিলাম, তিনি আমাকে মাঝেমাঝে দয়া করে দেখছিলেন, দূরকেও তিনি অবহেলা করেন না, স্মিত হাসিও বিলোচ্ছিলেন আমার দিকে তাকিয়ে, যেমন অন্যদের দিকেও তিনি তাঁর করুণা বিতরণ করছিলেন। অনেক ভক্ত এসেছিলো তার স্লিপারের তলে।

ভাবী, আপনাকে যতো দেখি ততোই মুগ্ধ হই, এক ষাট-বছর-পেরোনো বিখ্যাত ওই তরুণী বিধবাটির স্তব করছিলেন, কী করে যে আপনি এমন বেদনার মধ্যে এমন স্থির থাকতে পারছেন। আপনাকে দেখা মানে স্বৰ্গকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া। একে আমরা ভাগ্য বলে মানি।

কিন্তু এই রাষ্ট্র, আরেক ষাট-ছোঁয়া বিখ্যাত বলছিলেন, ভাবীকে তার প্রাপ্য দিচ্ছে না। দাদা দেশের জন্যে যা করে গেছেন, তার জন্যে আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঋণী হয়ে থাকবো তার কাছে, ভাবীর কাছে। অথচ ভাবীকে জিগাতলার এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে (আট কামরার) পড়ে থাকতে হচ্ছে। ভাবীকে একটি ভবন বরাদ্দ করা উচিত। ছিলো বনানী কি গুলশানে (দাদা দুটি বাড়ি রেখে গেছেন বনানী আর গুলশানে); আমি অবশ্য এর জন্যে লড়াই করে যাবো।

আর, ভাবী বলছেন, আমি একটু জাতিসংঘের বৈঠকে সরকারি প্রতিনিধি হয়ে যেতে চেয়েছিলাম, নিউইঅর্ক শহরটা আমার ভালো লাগে বলে, কিন্তু তারা আমাকে দলে রাখতে চাচ্ছে না, এর আগে আমি মাত্র দু-বার গেছি বলে।

এজন্যেই দেশটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আরেক স্বনামখ্যাত বলছেন, দাদার কাছে। দেশের যা ঋণ, তাতে ভাবী দু-বার কেনো দুশো বার যাবেন, তাতে কার কী বলার থাকতে পারে।

আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তাঁদের জিভ থেকে লালা ঝরছে, জিভ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, স্তবগানের সাথে তারা উপভোগ করে চলছেন বিধবাটিকে; বিধবাও জানেন আর জানাটা উপভোগ করেন যে কিছুটা পরোক্ষ সম্ভোগের সুযোগ না দিলে ভক্তরা তাকে দেবী করে তুলবেন না। তবে এ-ভক্তরা শুধু চরণতলে থাকার মতো নয়, আরোহণের কামনা। তাদের চোখেমুখে জ্বলজ্বল করছে, সে-ই ভাগ্যবান যাকে দেবী নিজের বক্ষে স্থান দেন। আমার ওই দেবীকে মনে পড়ছে, আমার রক্তনালি জুড়ে যে-কর্কশ একটা আগুন জ্বলছে, তা স্নিগ্ধ হয়ে উঠতে পারে শুধু ওই দেবীর বিষণ করুণায়। কিন্তু আমাকে কি, যে একান্ত ভক্ত হয়ে ওঠে নি দেবীর, যে পদতলে গিয়ে দাঁড়িয়েছি মাত্র কয়েকবার, তার করুণা বিলোবেন? তিনি কি এতো অপার করুণাময়ী হয়ে উঠতে পেরেছেন? একবার গিয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবান বোধ করেছিলাম, তিনি আমাকে বসার ঘর থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন বারান্দায়, ছায়াঘেরা সেই বারান্দা, আমি কয়েক মিনিট একান্ত একলা তাঁর মুখোমুখি বসার অধিকার পেয়েছিলাম; আমার মনে আরো অধিকার পাওয়ার সাধ জন্ম নিতে যাচ্ছিলো। তখন এক বলিষ্ঠ পুরুষ প্রবেশ করেন, তাঁর জুতোর শব্দও বলিষ্ঠতা প্রকাশ করে, বুঝতে পারি এ-বলিষ্ঠ পুরুষ সরাসরি প্রবেশাধিকারপ্রাপ্ত দেবীর কাছে। বলিষ্ঠের পাশে দেবীকে মনে হচ্ছিলো পৌরসভার ট্রাকের চাকার পাশে বসা এক প্রজাপতি বলে, চাকা যখন ঘুরতে শুরু করবে প্রজাপতি তখন কংক্রিটে মিশে যাবে। দেবী আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন বলিষ্ঠ পুরুষ জমশেদ মোল্লার সাথে, নাম শুনে তাকে চিনতে পারি। দেশের এক প্রধাম কালোবাজারির পাশে নিজেকে আমার খুবই অসহায় লাগতে থাকে।

দু-তিন সপ্তাহ দেশে ছিলাম না, জমশেদ মোল্লা বললেন, তবে আপনার কথা সব সময়ই মনে হয়েছে। জমশেদ মোল্লা পকেট থেকে একটি প্যাকেট বের করে দেবীর হাত দিতে দিতে বললেন।

দেবী হেসে সেটি গ্রহণ করতে করতে বললেন, ড, না ট?

জমশেদ বললেন, ড।

দেবী জানতে চাইলেন, কতো?

জমশেদ বললেন, পাঁচ।

দেবী হাসলেন, বললেন, এ-ধারটা শোধ করতে বছরখানেক লাগবে।

জমশেদ বললেন, কেনো? আপনি অন্য কোথাও ধার করেন না কি?

দেবী বললেন, না করলে কি চলে?

জমশেদ একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, দরকার হলে আমার কাছেই ধার করবেন, অন্য কোথাও আপনি ধার করেন আমার ভালো লাগে না।

দেবী আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, মাঝেমাঝে ধার করতে হয়, জমশেদ ভাইর কাছেই বেশি ধার পাই। আপনার কাছেও চাইবো কোনো দিন।

আমি দেবীর খানিক করুণা লাভ করি; তিনি আমার কাছেও ধার চাইবেন, আমাকেও ধন্য করবেন দেবী, আমিও তার বিবেচনার বাইরে নই। দেবী বাইরে যাবেন, জমশেদ মোল্লার সাথে বাইরে একটা কাজ আছে দেবীর; না, দেবী আমাকে বিদায়। করে দিয়ে কাজটি বাসায়ই সম্পন্ন করবেন না, দেবীর বিবেচনা রয়েছে, জমশেদ

মোল্লার সাথে তিনি কাজ করতে চলে গেলেন, আমার দিকে তাকিয়ে করুণায় আমাকে সিক্ত করে দিলেন। দেবী বোধ হয় আজ রাতেই তার ধারের অংশবিশেষ শোধ করবেন, জমশেদ মোল্লাকে যেমন দেখাচ্ছে তাতে তিনি ধারের কিছুটা না তুলতে পারলে রাস্তায়। গিয়ে গোটা কয়েক মানুষ খুন করবেন। দেবী সবচেয়ে বেশি ধার পান জমশেদ মোল্লার কাছে, পাঁচ হাজার ডলার শোধ করতে তার বছরখানেক সময় লাগে, কেননা তিনি অন্যদের কাছেও ধার করেন, সেগুলো শোধ করতে হয় তাঁকে, সবার ধার এক সাথে শোধ করা যায় না। তবে কয় কিস্তিতে তিনি শোধ করেন পাঁচ হাজার ডলার? এক। কিস্তিতেই? না কি ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কিস্তি কম-বেশি হয়? মাসে দেবী একজনের কয় কিস্তি শোধ করেন? জমশেদ মোল্লার পাঁচ হাজার ডলার কি দেবী পাঁচ কিস্তিতে শোধ করবেন? তার মানে আড়াই মাসের কিস্তি? আমার কাছে যদি দশ হাজার টাকা ধার চান, দেবী আমার অবস্থা জানেন, তিনি নিশ্চয়ই আমার কাছে এর বেশি ধার চাইবেন না, তাহলে তিনি তা কয় কিস্তিতে শোধ করবেন? এক কিস্তিতেই? এক কিস্তিতেই দশ হাজার টাকা? আমার মতো ব্রিজ বানানো ইঞ্জিনিয়ার কি বারবার ধার দিতে পারবে?

যদি আমি এখন দেবীর কাছে যাই, মনে করা যাক তিনি একলা আছেন, তিনি যদি আমার কাছে ধার চান, মাত্র দশ হাজার টাকাই ধার চান, আমি কি তাকে দিতে পারবো? আমার উচিত ছিলো বেশ কিছু টাকা, বিশ হাজারের মতো, তুলে অফিসেই রেখে দেয়া; কে জানে কখন দেবী ধার চাইবেন, কে জানে কখন আমার ধার দিতে ইচ্ছে করবে। যেমন এখন আমার ইচ্ছে করছে দেবীকে ধার দিতে। দেবীকে ধার দেয়ার আগ্রহটি আমার ভেতরে তীব্র হয়ে উঠছে, যদিও দেবী আজো আমার কাছে ধার চান নি, কিন্তু আমার ভেতরে ধার দেয়ার তীব্র কামনা জাগছে। আমি ধার দিতে চাই শুধু দেখার জন্যে দেবী কীভাবে ধার শোধ করেন। দেবীর ধার শোধ করার মুহূর্তগুলো আমি অনুভব। করতে চাই, উপলব্ধি করতে চাই, অভিজ্ঞতার মধ্যে পেতে চাই। এখন কি সরাসরি চলে যাবো দেবীর মন্দিরে? দেবীকে কি সরাসরি গিয়ে ধার দেয়া যায় দেবী না। চাইলেও? আর গিয়ে যদি দেখি জমশেদ মোল্লাকে নিয়ে তিনি কাজে যাচ্ছেন, পাঁচ হাজার ডলারের কোনো কিস্তি শোধ করতে যাচ্ছেন, বা তাকে ঘিরে বসে আছেন তাঁর কামনাব্যাকুল স্তবগানরত ব্রাহ্মণবৃন্দ? ফিরোজা কি তার দেবরের টেলিফোন পেয়েছে? তারা কি এখনো কথা বলছে? ফিরোজাও কি মাঝেমাঝে দেবরের কাছে থেকে ধার নেয়? ফিরোজা কীভাবে দেনা শোধ করে? দেবীকে আমি টেলিফোন করি।

ভাবী, আমি মাহবুব, আমি বলি, আমাকে কি চিনতে পারছেন?

আপনাকে চিনবো না তা কি হতে পারে! খিলখিল করে হাসেন দেবী, তাঁর খিলখিল হাসির একটা রঙ দেখতে পাই আমি, তার খিলখিল হাসি শুনে মনে হয় আমি কয়েক মাইল দূর থেকে টেলিফোন করছি না, তার বুকের ওপর শুয়ে আছি, সেখান থেকে খিলখিল হাসিটা উঠছে। তিনি বলেন, আর তো এলেন না।

আসতে তো সব সময়ই ইচ্ছে হয়, আমি বলি। তাহলে আসেন না কেনো? দেবী বলেন। অপেক্ষায় ছিলাম কোনো দিন আপনি আমার কাছে ধার চাইবেন, আমি বলি, তখন আসবো।

আবার খিলখিল হাসেন দেবী, তার হাসির রঙে দিকদিগন্ত ঢেকে যাচ্ছে, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু তার হাসির রঙ দেখতে পাচ্ছি, আশ্বিনের নদীর পারে কাশের। মেঘ দেখতে পাচ্ছি।

আমাকে ধার দিতে কি আপনার খুব সাধ হয়? দেবী বলেন।

অনেক দিন ধরেই ধার দেয়ার স্বপ্ন দেখে আসছি, আমি বলি।

তার সাথে আর কি স্বপ্ন দেখছেন? দেবী বলেন।

আপনি কীভাবে ধার শোধ করেন, আমি বলি।

দেবী আবার খিলখিল হাসেন, শিশির পড়ছে তাঁর গুচ্ছগুচ্ছ হাসির ওপর, শিশিরে ভিজে যাচ্ছে তার হাসি, তিনি বোধ হয় আর হাসতে পারবেন না।

দেবী বলেন, আমাকে সবাই ধার দিতে চায়, আমি না চাইলেও।

আমি বলি, আপনি ভাগ্যবান।

দেবী বলেন, আর সবাই ধার দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আমি কীভাবে ধার শোধ করি দেখার জন্যে। আমি অবশ্য শোধ করে দিই। আপনি কি আজই আমাকে ধার দিতে চান?

আমি বিপদগ্রস্ত, আমার পকেটে ছ-সাত হাজারের বেশি হবে না; কিন্তু দেবী কি এতো কম ধার নেবেন, তাকে কি এতো কম ধার দেয়া যায়?

আমি বলি, ভাবী, আজই ধার দেয়ার মতো অবস্থা আমার নেই, দশের নিচে। কেমনে আপনাকে ধার দিই!

দেবী আবার খিলখিল হাসেন বলেন, আপনি তো জমশেদ মোল্লা নন যে পাঁচ হাজার ডলার ধার চাইবো, চলে আসুন, আজ আমার মনে ভালো নেই।

দেবীর মন ভালো নেই, মন ভালো না থাকলেই দেবীদের বেশি ভালো দেখায়, বেশি ভালো লাগে; বিষণ্ণতা মুখের ত্বককে কোমল করে তোলে, আজ দেবীকে আমার আরো বেশি ভালো লাগবে। আমি আর দেরি করি না, ড্রাইভার প্রথম ভেবেছিলো বাসায় যাবো, তারপর মনে করেছে লালমাটিয়া যাবে, তাকে আমি জিগাতলা যেতে বলি; দেবীর সত্যিই মন ভালো নেই, তিনি তৈরি হয়ে দরোজার পাশে দাঁড়িয়েই ছিলেন। গাড়ি গিয়ে থামতেই তিনি আমার পাশে উঠে বসেন, তাঁর ডান হাতটি আমার বাঁ। হাতের ওপর এসে পড়ে, একবার তাকান আমার দিকে, সত্যিই বিষণ্ণতায় তিনি আরো রূপসী হয়ে উঠেছেন। দেবীকে নিয়ে এখন কোথায় যাই? আমি সব সময়ই এতো। অপ্রস্তুত। দেবী আমাকে উদ্ধার করেন এক পাঁচতারা হোটেলের নাম বলে।

মন ভালো না থাকলে এই হোটেলটি আমার ভালো লাগে, দেবী বলেন, দশ তলায় উঠলে মনে হয় আমি আবর্জনার মধ্যে নেই।

আপনি কি আবর্জনার মধ্যে আছেন? আমি বলি।

আপনি বুঝতে পারেন না? দেবী বলেন। তাঁর হাতটি খুব উষ্ণ মনে হচ্ছে আমার, রওশনের হাতের মতো, মুঠোতে ধরতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ধরি না।

দশতলায় আমরা একটি কক্ষ নিই, কক্ষে প্রবেশ করি, দেবী আমার পাশে, দেবী। আমার সাথে, এখানে কোনো আবর্জনা নেই। দেবীর বিষণ্ণ শরীর থেকে আমি বিষণ্ণতার সুগন্ধ পেতে থাকি, ভেজা কাঁঠালচাপার গন্ধ, আমি বুঝে উঠতে পারি না দেবীকে নিয়ে আমি কী করবো? আমি কি আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত দেখতে পাওয়াকে সহ্য করতে পারবো, আমি কি পেরে উঠবো, যেমনভাবে পেরে ওঠে জমশেদ মোল্লা? আমাকে কি। এখন জমশেদ মোল্লা হয়ে উঠতে হবে? দেবী আমার থেকে কোনো ধার নেন নি, আমি কি করে তার কাছে থেকে ধার আদায় করে নেবো? দেবী গিয়ে বিছানার ওপর কাত। হয়ে শুয়েছেন, আমি এখনো দূরে দাঁড়িয়ে আছি, তার বিছানার পাশে যেতে আমার ভয় লাগছে, যেনো আমি এক পনেরো বছরের বালক, আমি ভয় পাচ্ছি। আমি কিছু পেরে উঠবো না। কিন্তু দেবী কি তা পছন্দ করবেন? তার কি মনে হবে না জমশেদ মোল্লারাই ভালো এই সব ইঞ্জিনিয়ারটিঞ্জিনিয়ারের থেকে? দেবী আমার দিকে স্মিত হেসে তাকিয়ে আছেন। আমি সামনের দিকে পা বাড়াতে পারছি না।

আপনি ধার আদায় করতে জানেন না, দেবী স্মিত হেসে বলেন, আপনাকে আমার ছেলেবেলার সেই বালকটির মতো মনে হচ্ছে, সেও ধার আদায় করতে জানতো না।

আমি তো এখনো ধার দিই নি, আমি বলি, যা দিই নি তা আদায় করবো কীভাবে?

আপনি কি এখন ধার দিতে পারবেন, দেবী বলেন, যদি আমি বলি আমার পঞ্চাশ হাজার টাকার খুব দরকার? আমি দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর দেবী বলেন, মনে করুন আপনি ধার দিয়েছেন, আমি নিয়েছি।

দেবীকে আমি ধার দিয়েছি, এমন একটা বোধ হয় আমার, দেবী তা তুলে নিতে বলছেন, আমি দেবীর দিকে এগিয়ে যাই, আমি আর বালক নই, আমিও পারি, ধার। আদায় করে নিতে পারি, যা জমশেদ মোল্লা পারে আমাকে তা পারতে হবে, আমাকে হতে হবে জমশেদ মোল্লা। না, আমি হয়ে উঠবো শিল্পী, স্থপতি, কবিও হয়ে উঠবো আমি, এমন কিছু আমি আজ সৃষ্টি করবো যা এ-বিষণ্ণ করুণ সুন্দর রূপসী শরীরে আর কেউ সৃষ্টি করে নি। অন্যরা ঋণ আদায় করে নিয়েছে আমি ঋণ আদায় করবো না, তার কোনো অধিকার আমার নেই, আমি আমার ঋণ শোধ করবো এমন কিছু সৃষ্টি করে যা কখনো এ-শরীরে কেউ সৃষ্টি করে নি। আমি প্রথম দেবীর পদতল স্পর্শ করি, পদ্মের। মতো দুটি পদতল, ওষ্ঠ দিয়ে চুম্বন করি, দেবী শিউরে ওঠেন, হয়তো কেউ এর আগে এখানে ওষ্ঠ রাখে নি; আমি তাঁর প্রতিটি পদাঙ্গুলিকে জিভ ও ওষ্ঠের সাহায্যে পুজো করতে থাকি। তিনি আমার পুজো গ্রহণ করেন। আমি ধীরে ধীরে ওষ্ঠ ও জিভ দিয়ে পুজো করতে করতে পবিত্র দুটি জানু পাই, দুটি প্রবাল দ্বীপের মতো জানু, সেখানে আমি অনেকক্ষণ বাস করি। দেবী বারবার কেঁপে উঠতে থাকেন। আমার মনে হতে থাকে। জাহাজডুবির পর আমি খড়কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে দেবীর জানুদ্বীপে এসে আশ্রয় পেয়েছি। এক সময়, অনন্ত কাল পরে যেনো, আমি দেবীর মন্দিরের দ্বারে পৌঁছেই, ছায়াচ্ছন্ন মন্দির, বিশুদ্ধ তার জ্যামিতি, আমি মুগ্ধ হই, তার দরোজার পর দরোজার। রঙিন আভায় আমার চোখ ভরে যায়। আমি মন্দিরের দ্বারে এক পরম পুজোরীর মতো সাষ্টাঙ্গে অবনত হই, এ-দরোজা দিয়ে অনেক আদিম জন্তু প্রবেশ করেছে আর বেরিয়ে এসেছে, কোনো গোলাপ পাপড়ি পড়ে নি। আমি আমার ওষ্ঠের আর জিভের গোলাপ। ফোঁটাতে থাকি, গোলাপের পর গোলাপ ফোঁটাতে থাকি, ওষ্ঠ আর জিভ দিয়ে মন্দিরের দরোজা খুলতে থাকি, ভেসে যেতে থাকি দেবীর অনন্ত ঝরনাধারায়। পৃথিবীতে কি। তখন ভূমিকম্প হয়েছিলো, হোটেলটি কি তখন চুরমার হয়ে গিয়েছিলো? দেবী গলে সম্পূর্ণ অমৃতধারায় পরিণত হয়ে যান। আরো ওপরে, আরো ওপরে, আরো ওপরে; দেবীর যুগল চাঁদের জ্যোৎস্নায় আমার মুখ আলোকিত হয়ে ওঠে। এখন আমার সামনে সম্পূর্ণ উন্মোচিত দেবী। রওশনকে মনে পড়ছে, দেবীর চাঁদ নিয়ে আমি খেলা করি, খেলা করি, খেলা করি; দেবী আর আমি একাকার হয়ে যাই। অনন্ত ঢেউ উঠতে থাকে, মহাজগত তরঙ্গিত হয়ে উঠতে থাকে, প্লাবনে সূর্যাদতারা ডুবে যায়, দেবী আর আমি চরম অন্ধকারের জ্যোতিতে মিশে যাই।

 এতো সুখ আছে, দেবী অনেকক্ষণ পর চোখ মেলে বলেন, আমি জানতাম না। দেবী লতার মতো পেচিয়ে আছেন আমাকে।

আমি তো ঋণ আদায় করি নি, সুখ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম, আমি বলি। আপনার কি মনে হয় আমি সত্যিই ধার চাই? দেবী বলেন, সত্যিই কি আমার টাকার খুব দরকার?

তা আমি জানি না, আমি বলি।

আমার টাকার বেশি দরকার নেই, কিন্তু আপনি তো দেখেছেন আমাকে ঘিরে সব সময়ই ওরা আছে, দেবী বলেন, আপনি তো বোঝেন ওরা আমার কাছে কী চায়?

তা আমি বুঝি, আমি বলি।

ওরা আমার জন্যে সব করতে প্রস্তুত, দেবী বলেন, যদি আমি শুধু দেহখানি দিই। আমি তো সবাইকে দেহ দিতে পারি না। আমি যদি বিয়ে করে ফেলতাম ওরা আসতো, ওরা আমার জন্যে কিছু করতো না, ওরা আমাকে বিখ্যাত করে তুলেছে, বিখ্যাত হতে আমার ভালোই লাগে। আমি আবার বিয়ে করলে ওরা আমাকে বিখ্যাতও করতো না, ওরা আমাকে বেদনার দেবীরূপে দেখতে চায়, আমিও তাই হয়ে উঠেছি। আমার একটি দেবর তো লেগেই আছে আমাকে বিয়ে করার জন্যে, কিন্তু দেবরের সাথে ঘুমোচ্ছি ভাবতেই আমার ঘেন্না লাগে।

আপনি ধার কেনো নেন? আমি জানতে চাই।

ওদের ঠেকানোর জন্যে। পঁয়ষট্টি বছরের এক নামকরা বুড়ো আমাকে ভাবী ডাকে, আর ঘুমোতে চায় আমার সাথে। তার সাথে আমি কেনো ঘুমোবো? জমশেদ মোল্লা। আমাকে ভাবী ডাকে, আর ঘুমোতে চায় আমার সাথে। তার সাথে আমি কোনো ঘুমোবো? সেজন্যেই আমি ধার চাই। বুড়ো বেশি টাকা দিতে পারবে না, আমি তার কাছে চল্লিশ হাজার ধার চাই, একবার সাধ মেটানোর জন্যে সে চল্লিশ হাজার ধার দেয়, পরে আর তার সাধ থাকে না। কিন্তু জমশেদ মোল্লার টাকা আছে, সাধেরও শেষ নেই। তার থেকে আমি পাঁচ হাজার ডলারের কম ধার নিই না, আর তা শোধ করি দু কি তিনবারে।

আপনার ভক্ত অনেক, অনেককে তৃপ্ত রাখতে হয় আপনাকে, আমি বলি।

আমি ওদের স্বভাব বুঝি, দেবী বলেন, একেকজনের স্বভাব অনুসারে আমি খাদ্য দিই। একটি ভক্ত আছে দেশি কুকুরের মতো, ও বেশি কিছু চায় না, ওকে আমি ডান। পায়ের বুড়ো আঙুলটি চুষতে দিই, চুষতে পেরে ওর সুখের শেষ থাকে না। দেবী চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ, তাঁর গভীর ঘুম পেয়েছে, তার চোখ বুজে আসছে, চোখ বুজতে বুজতে বলেন, আরো কিছু সৃষ্টি করুন, যাতে আমি আবর্জনার কথা ভুলে যেতে পারি।

আমি ধার দিই নি, আমি ধার আদায় করছি না; আমি সৃষ্টি করছি, আমিও কিছু ভুলে যেতে চাই, ফিরোজাকে তার দেবর ফোন করেছে কি না, তা ভাবতে চাই না, ভুলে যেতে চাই; আমি দেবীকে সৃষ্টি করতে চাই। এটা আমার সৃষ্টির রাত, আজ রাতে আমি স্রষ্টা। দেবী নিজেকে তুলে দিয়েছেন আমার হাতে, নগ্ন বিষণ্ণ কাতর সুন্দর দেবী, তাঁর। শরীর ধার শোধ করেছে এতো দিন, আজ রাতে ওই শরীর চায় কিছু সৃষ্টি। আমি তাকে আঙুলের ছোঁয়ায় সৃষ্টি করে তুলতে চাই। সুখের জন্যে, যখন আমি সুখ চাচ্ছি না আমি সুখ সৃষ্টি করতে চাচ্ছি অন্যের শরীরে, তখন আমাকে হতে হবে সুরস্রষ্টা, যার হাতের ছোঁয়ায় বেহালা হাহাকার করে, বীণা বেজে ওঠে। আমি দশ আঙুল ছড়িয়ে দিয়ে দেবীর দেহবীণা বাজাতে শুরু করি। তাঁর প্রতিটি তন্ত্রীতে আমার আঙুলের ছোঁয়া লাগে, তিনি বাজতে থাকেন, সুর উঠতে থাকে তার গ্রীবা থেকে, বাহু থেকে, বগলের কৃষ্ণ রোমরাজি থেকে, চাঁদ থেকে, হ্রদ থেকে। দেবীর ডান চাঁদের লাল চক্রে কয়েকটি লাল রোম ঘাসের মতো জড়িয়ে আছে, বাহুতে টিকার দাগদুটি ঘুমন্ত অগ্নিগিরির মতো জ্বলজ্বল করছে। বাজাতে বাজাতে আমার আঙুল গিয়ে পৌঁছে বিশুদ্ধ গোলাপের ওপর, গোলাপের পাপড়ির ওপর, গিয়ে পৌঁছে গোলাপ বেটার ওপর, পাপড়ি থেকে বোটায়। আর বোটা থেকে পাপড়িতে আমার আঙুল বীণাবাদকের আঙুলের মতো সুর তুলতে শুরু করে, পাপড়ির পর পাপড়িতে আঙুল পড়তে থাকে, দেবী বেজে ওঠেন, বাজতে থাকেন, পাপড়ি পেরিয়ে আমার আঙুল গোলাপপেয়ালার ভেতরে প্রবেশ করে, মধু উপচে পড়তে থাকে গোলাপপেয়ালা থেকে। দেবী চৈত্রের বাতাসে আন্দোলিত গোলাপের মতো কাঁপতে থাকেন, গোলাপ ভেঙেচুরে সমস্ত পাপড়ি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমি শুধু ঝংকার শুনতে থাকি। তখন আমি প্রবেশ করি গোলাপপেয়ালার মধুর ভেতর, আমি মরে যেতে থাকি, আমি বেঁচে উঠতে থাকি, দেবী মরে যেতে থাকেন, দেবী। বেঁচে উঠতে থাকেন, আমরা অনন্ত মৃত্যু আর পুনরুজ্জীবনের মধ্যে দুলতে থাকি।

আমি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছি আজকাল প্রায়ই, প্রায়ই রওশনকে স্বপ্ন দেখছি, আর–পরীক্ষার স্বপ্ন দেখছি। দুটিই অপ্রাসঙ্গিক আমার জীবনে, কিন্তু ওই দুটিই ফিরে ফিরে দেখছি, আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে, আর ঘুমোতে পারছি না। রওশনকে আমি আজকাল মনেই করতে পারি না, তার মুখ মনে করতে পারি না, কিন্তু স্বপ্নে তার মুখ অবিকল আগের মতো দেখতে পাই; শুধু সে আগের মতো বাঁধানো কবরের পাশে দাঁড়ায় না, দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে কোনো পাহাড়ের পাশে বা মাঠের মাঝখানে, আমাকে দেখে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, আমাকে চিনতে পারছে না, তার সাথে যারা আছে আমি তাদের চিনি না। আবার দেখতে পাই পরীক্ষা দিতে গেছি, অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার, পরীক্ষা শেষ হওয়ার বাকি নেই, আমাকে কেউ প্রশ্নপত্র দিচ্ছে না, আমি চিৎকার করে প্রশ্নপত্র চাচ্ছি, আমাকে বলা হচ্ছে আর প্রশ্নপত্র নেই। আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। দুটির কোনোটিই আমি বুঝে উঠতে পারছি না, যা আমার জীবনে সম্পূর্ণ নিরর্থক তার স্বপ্ন আমি কেনো দেখি? আমি কি নিরর্থকতার স্বপ্ন দেখছি, এ-স্বপ্ন দুটি কি আমাকে। মনে করিয়ে দিচ্ছে আমার জীবন নিরর্থক হয়ে গেছে? আমি কি গোপনে গোপনে অনুভব করছি ওই নিরর্থকতা? কিন্তু কী অর্থপূর্ণ? আমি কোনো কিছুতেই কোনো অর্থ খুঁজে পাই না, বেঁচে থাকা আমার কাছে নিরর্থক, বেঁচে-না-থাকাও আমার কাছে নিরর্থক; নদীর ওপর ব্রিজ থাকা আমার কাছে নিরর্থক, না-থাকাও নিরর্থক।

ফিরোজার সাথে দেখা হচ্ছে না, অর্চির সাথে দেখা হচ্ছে না, যদিও আমরা একই। ফ্ল্যাটে আছি, আমি অবশ্য বেশি সময় থাকার সুযোগ পাচ্ছিনা; আমাদের সম্পর্ক পিতা, স্বামী, মাতা, স্ত্রী, কন্যার, কিন্তু দেখা হচ্ছে না। যতোটুকু দেখা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা হয় আমাদের অন্যদের সাথে। আমি যখন দুপুরে বাসায় ফিরি তখন অর্চি বাথরুমে, সে আর বাথরুম থেকে বেরোয় না। আমি ভেবে পাই না অর্চি বাথরুমে কী করে, একজন মানুষের কেনো গোসল করতে এতোটা সময় দরকার হয়? অর্চি কি বাথরুমের ঝরনার নিচে থাকতেই পছন্দ করে? ওর শরীর জুড়ে কি ক্লান্তি নেমেছে, ঝরনাধারার নিচে থেকে থেকে কি অর্চি আবার তার শক্তি ফিরে পায়? আমি ওকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে সাহস করি না। চারপাশের ময়লা ওর শরীরে হয়তো জমছে, অর্চি হয়তো ময়লা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্যে বাথরুমের ঝরনার নিচে চিরকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে চাচ্ছে।

অর্চিকে আমি জিজ্ঞেস করি, অর্চি, তোমার কী ভালো লাগে?

আমার কিছু ভালো লাগে না, অর্চি বলে, কিচ্ছু ভাল্লাগে না।

নদী বা সমুদ্র দেখতে তোমার ইচ্ছে করে না? আমি জিজ্ঞেস করি।

না, ইচ্ছে করে না, অর্চি বলে, আমার কিছুই ইচ্ছে করে না।

আমাদের মহাপুরুষদের কথা তুমি কখনো ভাবো? আমি বলি।

হাহাহা করে ওঠে অর্চি, আমি ভয় পাই; অর্চি অবলীলায় বলে, ওদের কথা ভাবার আমার সময় নেই, ওরা বড়ো অকওআর্ড পিপল, ওদের থেকে পপ সিংগারস আর মাচ মোর অ্যাট্রাকটিভ, আই অ্যাডোর দেম।

ফিরোজাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, অর্চির সাথে ইস্কুলে যাচ্ছে আসছে, প্রাইভেটে যাচ্ছে আসছে, খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছে মনে হয়। উদ্দেশ্যহীনতার ক্লান্তিতে ভুগছে ফিরোজা? অর্চির কিছুই ভালো লাগে না, তবে তার একটা উদ্দেশ্য আছে, অনেক লেটারফেটার তাকে পেতে হবে, পাবেই, না পেলে তার চলবে না, বা ফিরোজার চলবে না; ফিরোজার কিছু পাওয়ার নেই। অর্চির লেটারগুলো কি সার্থক করে তুলবে ফিরোজাকে? আমাকে করবে না, ফিরোজাকে কি করবে? করবে বলে মনে হচ্ছে। সে চাকুরিটা করতে পারতো। আমি আজ ইস্কুল থেকে অর্চিকে আনতে গিয়ে ইস্কুলের সামনে রাশিরাশি সারিসারি ফিরোজাকে দেখে চমকে উঠি। অর্চির ছুটি হওয়ার বেশ আগেই আমি ইস্কুলে হাজির হই, দেখি সারিসারি ফিরোজা বসে আছে সামনের ফুটপাতে, মাঠের গাছের নিচে, অনেকে পাজেরোতে, আর ঝকঝকে টমোটায়-আমার ভয় লাগতে থাকে। তারা অপেক্ষা করে আছে তাদের কন্যা আর পুত্রদের জন্যে। প্রতিটি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তারা ক্লান্ত; তারা এসব সোনালি বাচ্চাদের গর্ভে ধারণ করেছে, গর্ভে নিয়ে বারবার ক্লিনিকে ছোটাছুটি করেছে, তারপর চিৎ হয়ে প্রসব করেছে, এখন বছরের পর বছর ইস্কুলের সামনে বসে আছে। একটি মহিলা দু-পা ছড়িয়েই বসেছে, যেমন ছড়াতে হয় বিয়োনোর সময়; বিয়োনোর অভ্যাসটি তার যায় নি মনে হয়, হয়তো তার পেটে আরেকটি এসেছে, হায়রে রাত্রির ক্ষৎকালীন উন্মাদনা, তাই ঠিক মতো। বসতে পারছে না। ওইটিকে নিয়েও তার এখানে আসতে হবে বছরের পর বছর। আমি এদের শরীরে জং দেখতে পাচ্ছি, শ্যাওলা দেখতে পাচ্ছি। ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত এরা। অনেক বছর ধরে হয়তো একটা ভালো পুলকও বোধ করে নি, কেঁপে ওঠে নি; নিয়মসম্মতভাবে নিচে শুয়েছে। এদের স্বামীরা ঝকঝকে অশ্বের মতো বিচরণ করে চলছে নিশ্চয়ই, আমিও বিচরণ করছি; তারা ক্লান্ত নয়, না কি তারাও ক্লান্ত?

অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছি শুয়ে পড়বো, কিন্তু বুঝতে পারছি না শুয়ে পড়বো কি না; ফিরোজাও বুঝতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে; টিভি থেকে ভিসিআরে যাচ্ছি, ভিসিআর থেকে টিভিতে যাচ্ছি, ফিরোজা কিছু বলছে না, আমি কিছু দেখছি না, ফিরোজাও কিছু দেখছে না বলেই মনে হচ্ছে, নইলে টিভি থেকে ভিসিআরে আর ভিসিআর থেকে টিভিতে যাওয়া আসায় সে বাধা দিতো, বিরক্ত হতো, বাধা দিচ্ছে না, বিরক্ত হচ্ছে না, আমি বুঝতে পারছি না শুয়ে পড়বে কি না। টিভির মেয়েগুলোর মেদের দাপাদাপি। বিরক্তিকর লাগছে, বাসি মনে হচ্ছে, কিন্তু বন্ধ করে দিতে পারছি না, আমি জানি না বন্ধ করে দেয়াটা ফিরোজার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না। বন্ধু করে দেয়ার একটি ভয়ানক পরিণতি হচ্ছে আমাদের পৌঁছোতে হবে এক অভিন্ন সিদ্ধান্তে যে আমরা দুজনই ঘুমোতে চাই, বিছানায় শুয়ে পড়তে চাই। আমরা কি অমন অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পিরবো? আমি অমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহস পাচ্ছি না। আজ অবশ্য ফিরোজাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় লাগছে, সে অন্যের বউ হলে সারা সন্ধ্যা আমি হয়তো অনবরত কথা বলে যেতে পারতাম, নিজের বউ বলে কিছুই বলতে পারছি না, তার সাথে আমি তো নদী, ব্রিজ, ঝড়, বা জীবন নিয়ে আলোচনা করতে পারি না। বাস্তবতা নিয়ে আর কতোক্ষণ। কথা বলা যায়? চা খাবো, চিনি লাগবে কি না, আজ রাতে কী খাবার, অর্চির পড়াশুনো কেমন এগোচ্ছে ধরনের কথা ছাড়া অন্য কোনো কথাই হয় নি সারা সন্ধ্যা, এখন আর কথাই পাচ্ছি না। ফিরোজাকে আকর্ষণীয় লাগছে, তার ঠোঁট বেশ ভেজা দেখাচ্ছে, আমি তাতে আরো ভয় পাচ্ছি, ফিরোজা মনে করতে পারে আজ তাকে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। বলে আমি লম্পটের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছি। না, আমি লম্পট নই। আমি টিভি থেকে ভিসিআরে ভিসিআর গ্রেকে টিভিতে যাতায়াত করতে থাকি, এক সময় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। ফিরোজার হাতে এখন রিমোট কন্ট্রোল, ফিরোজা ভিসিআর থেকে টিভিতে টিভি থেকে ভিসিআরে যাতায়াত করতে থাকে, কিছুই তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। আমি চোখ বোজার চেষ্টা করি, চোখ বুজে থাকি; চোখ বুজলে আমি। সাধারণত অনেক কিছু দেখতে পাই, কিন্তু আজ কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ফিরোজা টিভি আর ভিসিআর বন্ধ করে তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আলোটা নেভায় না, আলোটা নেভানোর সাহস তার হচ্ছে না মনে হচ্ছে; আলোটা নেভালেই মনে হবে আমরা অভিন্ন সিদ্ধান্তে এসে গেছি যে এখন ঘুমোতে হবে।

আলোটা কি নিভিয়ে দেবো? আমি এক সময় জিজ্ঞেস করি।

না, ফিরোজা বলে।

উঠে গিয়ে সে আবার ভিসিআর থেকে টিভিতে যাতায়াত করতে থাকে, যাতায়াত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে শুয়ে পড়তে চায়।

আলোটা কি নিভিয়ে দেবো? ফিরোজা আমাকে জিজ্ঞেস করে।

না, আমি বলি।

উঠে গিয়ে আমি আবার টিভি থেকে ভিসিআরে ভিসিআর থেকে টিভিতে যাতায়াত করতে থাকি, যাতায়াত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার শুয়ে পড়ার ইচ্ছে হয়।

বাতিটা নিভিয়ে দিই? আমি জিজ্ঞেস করি।

দাও, ফিরোজা বলে।

আমি গিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে পড়ি। এখন আমার একটি বড়ো দায়িত্ব ঘুমিয়ে পড়া, এখন ফিরোজার বড়ো দায়িত্ব ঘুমিয়ে পড়া; কিন্তু আমরা কি ঘুমিয়ে পড়তে। পারবো? অন্ধকারে আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি না ফিরোজা কীভাবে শুয়েছে, চোখ বন্ধ করেছে কি না, আমাকেও সে দেখতে পাচ্ছে না নিশ্চয়ই, হয়তো দেখার চেষ্টা করছে। আমি কীভাবে ঘুমাচ্ছি, যেমন আমিও দেখতে চাচ্ছি। ফিরোজাকে কি আমি ডাকবো? ডাকা কি ঠিক হবে? সে তো উঠে এসে আমার পাশে শুতে পারতো। আমি কি গিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়বে, সেটা কি নিজেকে ছোটো করা হবে না? পাশে শুয়ে পড়লেই কি আমি তাকে ছুঁতে পারবো? ফিরোজা যদি পছন্দ না করে? ফিরোজা কি চাচ্ছে আমি তার পাশে গিয়ে শুই, তাকে জড়িয়ে ধরি, আমার যা ইচ্ছে করি? ঘড়িটা তার অদ্ভুত সুন্দর আওয়াজ করছে, এখন রাত কতো হলো, কততক্ষণ ধরে আমি ঘুমোনোর চেষ্টা করছি? ফিরোজা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? সে একবার এদিক আরেকবার ওদিক ফিরে শুলো মনে হয়, সেও কি ঘুমোচ্ছে না? ফিরোজা কি জানে আমি মাহমুদা রহমানের সাথে। মাঝেমাঝে ঘুমোই, আর দু-একবার ঘুমিয়েছি দেবীর সাথে? তার জানার কথা নয়, তবে সে সন্দেহ পোষণ করে আমার সম্বন্ধে, যেমন আমি সন্দেহ পোষণ করি। আমি কি একটু উত্তেজিত? ফিরোজও? আমার কি একটু প্রশমন দরকার? ফিরোজারও? আমি জানি না। মনে করা যাক ফিরোজা আর আমার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, সে অন্য কারো স্ত্রী, দিনাজপুর থেকে ট্রেনে এসেছে, আমি অন্য কারো স্বামী, ট্রেনে এসেছি। সিলেট থেকে, মধ্যরাত, কোনো রেলস্টেশনে একই ঘরে ঘুমোতে বাধ্য হচ্ছি, তাহলে। এখন আমরা কী করতাম? নিজ নিজ বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তাম? যদি আমরা একই ঘরে ঘুমোভে রাজি হতাম তাহলে আমরা ঘুমোতাম না, মুখোমুখি বসে চা খেতাম, সে আমাকে দিনাজপুরের গল্প শোনাতো, আমরা চা খেতাম, আমি তাকে সিলেটের গল্প শোনাতাম, আমরা চা খেতাম, অদ্ভুত লাগতো আমাদের চা আর গল্প; সে আমার কাছে আমার বাল্যকালের গল্প শুনতে চাইতো, আমাকে বাক্স থেকে বিস্কুট বের করে দিতে, আমি তার কাছে তার বাল্যকালের গল্প শুনতে চাইতাম, বাক্স থেকে তাকে চকোলেট বের করে দিতাম। তারপর যদি আমাদের একটু শীতশীত লাগতো, যদি আমাদের একটু ঘুমঘুম লাগতো, আমরা প্রথমে একজন আরেকজনের আঙুল ছুঁতাম, পরে গাল। চিবুক ছুঁতাম, ঠোঁট ছুঁতাম, একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর সব ভাষা ভুলে গিয়ে কেউ কাউকে জিজ্ঞেস না করে বাতি নিভিয়ে দিতাম, আমরা মাত্র একটি শয্যা ব্যবহার করতাম, আরেকটি শয্যা শীতে কাতর হয়ে একলা পড়ে থাকতো।

ফিরোজা আর আমি তা পারছি না, আমরা স্বামীস্ত্রী, আমরা কেউ কারো কাছে বাল্যকালের গল্প শুনতে চাই না; আমার বাল্যকালের গল্প শুনে ফিরোজার ঘেন্না লাগবে, ফিরোজার বাল্যকালের গল্প আমার বিরক্তিকর মনে হবে, ফিরোজা, গল্প বলতে গেলে। সব কিছু জড়িয়ে ফেলে, কিছু বাদ দিতে চায় না, শেষ করে উঠতে পারে না, আমরা দুই শয্যায় পড়ে আছি। আমি জানি ফিরোজা উঠে আসবে না, মেয়েদের আশ্চর্য সংযম আছে, ওরা মনকে চেপে রাখতে পারে যখন মন চায়, শরীরকে চেপে রাখতে পারে যখন শরীর চায়। আমি পারি না। এর আগেও এমন হয়েছে, ফিরোজা আশ্চর্যভাবে চেপে। রেখেছে নিজেকে, যদিও তারই দরকার ছিলো বেশি; কিন্তু আমি চেপে রাখতে পারি নি, যদিও আমার কোনো দরকার ছিলো না। এখনো আমার খুব দরকার নেই, কিন্তু আমি ঘুমোতে পারছি না, ঘুমোতে না পারা খুবই জঘন্য ব্যাপার।

তুমি কি ঘুমোচ্ছো? আমি অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলি।

ফিরোজা কোনো উত্তর দিচ্ছে না। আমি কি আবার আমার স্বগতোক্তি করবো? আমার কণ্ঠস্বর কি ওই বিছানা পর্যন্ত পৌঁছে নি?

তুমি কি ঘুমোচ্ছো? আমি আবার স্বগতোক্তির মতো বলি।

ফিরোজা এবার সাড়া দেয়, বলে, কেননা, তাতে কী দরকার তোমার?

আমি বিব্রত বোধ করি, বিছানায় উঠে বসি; বলি, আমার ঘুম আসছে না।

ফিরোজা বলে, আমি তার কী করতে পারি?

আমি বলি, একটা রাবার নামও না।

ফিরোজা চুপ করে থাকে, আমি আবার বলি, একটা রাবার নামাও না।

ফিরোজা বলে, আমার সাথে শুধু এটুকুই তো কথা।

আমি আবার বিব্রত বোধ করি, কোনো কথা বলি না। অনেকক্ষণ নীরবতার পর পর ফিরোজা বলে, দরকার হলে তুমিই নামাও।

আমি বলি, কোথায় আছে আমি তো জানি না।

ফিরোজা বলে, যেখানে থাকার সেখানেই আছে।

অন্ধকারে আমি সে-জায়গাটি হাতড়াতে থাকি, প্রচুর কাপড় আর এলোমেলো জিনিশে ঢেকে আছে সব কিছু, যা খুঁজছি তা আমার হাতে লাগছে না। একটি বড়ো। বাক্স থাকার কথা। তাহলে কি সব ফুরিয়ে গেছে? ফুরিয়ে যাওয়ার তো কথা নয়। এক সময় বড়ো বাক্সটিতে হাত লাগে, আমি ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটি ছোটো প্যাকেট বের করে আনতে চাই। ছ-সাতটি ছোটো প্যাকেট, আমার মনে হয়, থাকার কথা; কিন্তু দু-তিনটি প্যাকেট মাত্র পড়ে আছে। বাকিগুলো গেলো কই? আমরা আটাশ-ত্রিশটির মতো ব্যবহার করেছি, এ-কক্ষে, এতো সময় আমরা পেলাম কই? তাহলে ফিরোজা কি বাকিগুলো ব্যবহার করেছে? আমি একটু কেঁপে উঠি। ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করবো প্যাকেট এতো কমলো কী করে? সে কি রেগে উঠবে না? কিন্তু প্যাকেট এতো কমলো কী করে? আমাদের তো দশ পনেরো বিশ দিনেও কিছু হয় না। ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করবো? একটু হাল্কা ভঙ্গিতে?

এই, আমি বলি, প্যাকেট এতো কম কেনো!

ফিরোজা একটু রেগে ওঠে, আমি বসে বসে খেয়েছি।

আমি বলি, মাঝেমাঝে বাইরেটাইরে নিয়ে যাও না তো।

ফিরোজা রাগে না, বলে, দরকার হলে তো নিইই।

আমি বিব্রত হই, বলি, মাঝেমাঝেই নাও মনে হয়।

ফিরোজা বলে, এরপর একটি খাতা বানিয়ে হিশেব লিখে রেখো।

আমি একটু হাসার চেষ্টা করি, বলি, একটা সেক্রেটারি নিয়োগ করতে হবে এর জন্যে।

ফিরোজা বলে, একটা চেস্টেটি বেল্টও কিনে আনতে পারো।

আমি বলি, আজকাল বাজারে কি চেস্টেটি বেল্ট পাওয়া যায়?

ফিরোজা বলে, পাওয়া না গেলে ব্রিজট্রিজ রেখে তুমি একটা কারখানা খুলতে পারো। তোমার তো কোটিপতি হওয়ার সাধ আছে।

ফিরোজার প্রস্তাবটি চমৎকার; রিয়াদ, তেহেরান, ভাটিকান বা মতিঝিলের ধার্মিক ব্যাংকটির সাথে যোগাযোগ করলে খারাপ হয় না, তারা এ-প্রকল্পে মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে উৎসাহের সঙ্গে। সুদমুক্ত ঋণ পাওয়া যাবে। কিন্তু আমি কি ফিরোজাকে চেস্টেটি বেল্ট পরাতে পারবো? উল্টো দেখা যাবে মাহমুদা রহমানকে তার আলহজ স্বামী খান দুই চেস্টেটি বেল্ট পরিয়ে গেছে, এমনকি জমশেদ মোল্লা আমারই কারখানায় উৎপাদিত চেস্টেটি বেল্ট পরিয়ে দিয়েছে দেবীর কোমরে।

ফিরোজা ভেঙেচুরে যাচ্ছে, আমাকে ঘেন্না করে সে শক্ত হয়ে থাকবে বলে আমি ভয় পাচ্ছিলাম, এখন সে এতো ভাঙছে যে আমি ভয় পাচ্ছি, ফিরোজা কি এখনো মনে করে আমি ঠিক পারি না? আমি কি ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করবো, ফিরোজা কি উত্তর দেবে? এটা কি উত্তর দেয়ার সময়? ঘেন্নাটোর মতো বিশ্রী ব্যাপারগুলো এ-সময় মনে থাকে না, ঘেন্নার কথা মনে থাকে আগে; এ-সময় মানুষ দেবতা হয়ে ওঠে; মানুষের। মন ঘেন্না করতে পারে, ঘেন্না করে, ঘেন্না করে নানা সমস্যা তৈরি করে; কিন্তু শরীর ঘেন্নার উর্ধ্বে, শরীর কোনো ঘেন্না জানে না, ধর্ম জানে না, দর্শন জানে না, রাজনীতি জানে না; শরীর জানে জলের মতো ঝরতে মোমের মতো গলতে ফুলের মতো ফুটতে। শরীরের কাজ শেষ হয়ে গেলে আবার মন কাজ করতে শুরু করে, মনের কাজ সব সময়ই সমস্যা তৈরি করা, খুব ভেতর থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে খুব মারাত্মক কিছু বের করা। আমি মনের কাজকে দমিয়েই রাখতে চাই, তবে ফিরোজা মনের কাজ ছাড়া বেঁচে। থাকতে পারে না বলেই মনে হয়।

আমাকে দরকার তোমার শুধু এটুকুর জন্যে, ফিরোজা বলে।

একে শুধু এটুকু বলছো কেনো?

আমি বলি। এটুকু ছাড়া আর কী?

ফিরোজা বলে। এটাই তো বড়ো কাজ জীবনের, আমি বলি।

আমার তো তা মনে হয় না, ফিরোজা বলে।

তোমার ভালো লাগে না? আমি বলি। ফিরোজা কোনো উত্তর দেয় না। সে ঘুমিয়ে পড়তে চায়, আমি আমার শয্যায় এসে শুয়ে পড়ি, এবার আমার ঘুম আসে, ফিরোজারও এসে গেছে মনে হয়।

মাহমুদা রহমান মারাত্মক রসিকতা করতে পারেন, নিজেকে নিয়েও, টেলিফোনেই অবলীলায় তিনি ভয়ঙ্কর রসিকতা করে চলেন। আমার ভয় লাগে কখন কে আমাদের সংযোগের মধ্যে ঢুকে পড়ে, সব কিছু উল্টেপাল্টে যায়।

টেলিফোন বাজলে আমি ধরে বলি, হ্যালো।

তিনি এখন আর আমি বলেন না, বলেন, আপনার উপপত্নী।

আমি প্রথম প্রথম বিব্রত বোধ করতাম, এখন আর করি না, বরং ভাবতে ভালোই লাগে যে আমার একটি উপপত্নী আছে। আমার পিতার একটি ছিলো, তার পিতার হয়তো দুটি ছিলো, তার পিতার হয়তো একগণ্ডা ছিলো। উপপত্নী কী, কী হলে কেউ উপপত্নী হয়, উপপতি হয়?

আমার বলতে ইচ্ছে হয়, বলুন, উপপত্নী, আপনি কেমন আছেন? কিন্তু আমি বলতে পারি না, মনে মনে ভালো লাগলেও তা উচ্চারণ করার সময় আমার গলা বন্ধ হয়ে আসে; আমি বলি, আপনার রসিকতাবোধ ভয়ঙ্কর।

তিনি আগে বলতেন, আপনি ভাগ্যবান, একটি টাকা ব্যয় না করেও এমন একটি উপপত্নী পেয়েছেন।

আমি বলতাম, আপনি কী যে বলেন!

তিনি বলতেন, আমি সত্যিই বলি, ভাবতে আমার ভালোই লাগে যে আমি আপনার উপপত্নী।

আমি বলতাম, আপনার ভালো লাগা খুবই সাংঘাতিক।

এখন আমিও রসিকতা করি, না করে উপায় নেই, সব কিছু গুরুত্বের সাথে নিলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়বো।

এখন যখন বলেন, কী ভাগ্যবান আপনি! একটি পয়সাও ব্যয় না করে এমন একটি উপপত্নী পেয়েছেন!

আমি বলি, কিন্তু যে-সেবাটি দিই তার দাম?

তিনি হেসে বলেন, মিলিয়ন ডলার?

আমি বলি, তিন মিলিয়ন।

তিনি বলেন, কীভাবে?

আমি বলি, পতির কাছে পেতেন একটি সেবা, আমি গরিব, কিছু দিতে পারি না, তাই আমি দিই তিনটি সেবা, প্রত্যেকটির দাম ভেবে দেখুন।

মাহমুদা রহমান হাসেন, আমি তার শব্দ পাই।

তিনি একদিন বলেন, একটি কথা কি আপনি কখনো ভেবেছেন?

আমি বলি, কী কথা?

তিনি বলেন, উপপত্নীকে পত্নী করে নিলে কেমন হয়?

আমি শিউরে উঠি, কথা বলতে পারি না, ব্রিজ ধসে পড়ছে দেখতে পাই।

তিনি বলেন, ভয় পাচ্ছেন মনে হচ্ছে।

আমি বলি, হ্যাঁ, পাচ্ছি।

তিনি বলেন, ভয় এখন থাক, চলে আসুন।

আমি না করতে পারি না; না করলে তিনি মনে করবেন আমি, একটা আস্ত কাপুরুষ, শুধু ভয়ই পাই নি, পালিয়ে যাওয়ারও পথ খুঁজছি। হঠাৎ তাঁর পত্নী হওয়ার সাধ জাগলো কেনো? তিনি তো একজনের পত্নী হয়ে দেখেছেন, তার সুখ মহত্ত্ব প্রেম কাম সবই দেখেছেন, তাহলে তার এমন সাধ হলো কেনো? তিনি কি মনে করছেন হাফিজুর রহমানের পত্নী হওয়াতেই সব বা অনেকটা গোলমাল হয়ে গেছে, তার বদলে তিনি যদি মাহবুব হোসেনের বিবাহিত পত্নী হতেন বা এখন হন, সব ঠিক হয়ে যাবে, তিনি সুখে আচ্ছন্ন হয়ে যাবেন? আমার তা মনে হয় না; ফিরোজার সাথে জড়িয়ে গেছি বলে আমার গোলমাল হচ্ছে আমার মনে হয় না, মাহমুদা রহমানের সাথে বিয়ে হলেও একই গোলমাল হতো। তিনি ভাবছেন ব্যক্তিই মূল সমস্যা, যদি ঠিক লোকটিকে পাওয়া যেতো, সব ঠিক হয়ে যেতো, সব ঠিক থাকতো, অর্থাৎ আমি হাফিজুর রহমানের থেকে। বেশি ঠিক মানুষ,–অন্তত এখন তাঁর মনে হচ্ছে, আমার সাথে বিয়ে হলে তিনি আরো বেশি ঠিক থাকতেন; আমি ভাবছি অন্যরকম, আমার কাছে কাঠামোই মূল সমস্যা, ব্যক্তি গৌণ। নিকৃষ্ট ব্যক্তির সাথে থাকা সম্ভব নয়, এটা ঠিক; কিন্তু সমস্যা হচ্ছে উৎকৃষ্ট। ব্যক্তির সাথেও থাকা অসম্ভব, কিন্তু আমরা থাকছি। এ-কাঠামো আমার সমস্ত কিছু হরণ করে নিজেকে টিকিয়ে রাখে। আমি বোধ করি আমাদের কোথাও একটা ব্যাপার আছে যে আমরা একে অন্যের প্রতি টান বোধ করবো কাম বোধ করবো প্রেম বোধ করবো, এটা চমৎকার ব্যাপার; তবে আরেকটা ব্যাপারও আছে আমাদের, সেটা চমৎকার নয়, বেশ খারাপই, তা হচ্ছে আমরা একে অন্যের প্রতি টান বেশি দিন ধরে রাখতে পারবো না। হাতপা বেঁধে সাঁতার দেয়া সম্ভব নয়, বিবাহ হচ্ছে হাতপা বেঁধে সাঁতার দেয়ার। অসম্ভব চেষ্টা, যা কেউ পেরে ওঠে না। মাহমুদা রহমান আর আমি সাঁতার দিই, তিনি। ভাবছেন যদি আমরা একটি কাঠামো তৈরি করে ফেলি, বিবাহের কাঠামো, তাহলেও আমরা সাঁতার দিতে পারবো; কিন্তু আমি জানি তখন আমরা সাঁতার দিতে পারবো না। তিনি হাফিজুর রহমানের সাথে সাঁতার কাটার সুখ পান নি, আমি ফিরোজার সাথে পাই না, ফিরোজা আমার সাথে পায় না; ফিরোজা যদি মাহমুদা রহমান হলো আমার। সাঁতারে সুখের শেষ থাকতো না।

তিনি বলেন, উপপত্নী থাকতে আমার ভালোই লাগছিলো, কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না।

আমি বলি, আমি কখনো আপনাকে আমার উপপত্নী মনে করি নি। তাহলে আপনাকে গুলশানে বাড়ি ভাড়া করে দিতাম, মাসে বিশ হাজার টাকা দিতাম। ভরণপোষণের জন্যে।

ওসব আমার দরকার ছিলো না, তিনি বলেন, আগে আমাদের মাঝেমাঝে দেখা হলেই আমার হতো, এখন আমার সব সময় দেখার ইচ্ছে হয়। আমি শুধু আপনাকে পালিয়ে সকালবেলা পেতে চাই না, রাতভর পেতে চাই।

আমি বলি, এমন হলো কেননা আপনার?

তিনি বলেন, গোপনে মিলিত হয়ে হয়ে এখন আমার মনে হচ্ছে আমি দেহ দিচ্ছি, এটা আমার ভালো লাগছে না; আমি একসাথে বেড়াতে যেতে চাই, দুপুরে বাসায়। দেখতে চাই, রাতে একসাথে ঘুমোতে চাই।

আমি বলি, আপনার মধ্যে চিরন্তন নারীত্ব জেগে উঠেছে মনে হচ্ছে, ওটিকেই আমি ভয় পাই বেশি।

তিনি বলেন, আমি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী হতেও রাজি আছি।

আমি বলি, আমার স্ত্রীকে আমি ছেড়ে দিতে পারি, সে আমাকে ছেড়ে দিতে পারে, তবে আর কোনো স্ত্রীর কথা আমি ভাবি না, দ্বিতীয় স্ত্রীর কথাই ওঠে না।

তিনি বলেন, আপনি শুধু আমার দেহটিকেই ভোগ করতে চান। যদি আমি দেহ ভোগ করতে দিই, তবে শুধু আপনাকে কেননা, অন্য অনেককেও আমি দিতে পারি, তাতে আমার সুখ বাড়বে।

আমি বলি, নারীদের নিয়ে এটি এক বড়ো সমস্যা, তারা মনে করে পুরুষরাই। তাদের দেহ ভোগ করে, তারা পুরুষদের দেহ ভোগ করে না। আমি কি শুধু আপনার দেহ ভোগ করেছি, আপনি কি আমার দেহ ভোগ করেন নি? আমিই কি শুধু সুখ পেয়েছি, আপনি কি সুখ পান নি? আসলে আপনিই পেয়েছেন বেশি সুখ; আপনি। পুলকের পর পুলকে ভেঙে পড়েছেন, আপনি যতো পুলক বোধ করেছেন আমি ততো। বোধ করি নি। তবে আপনার স্বাধীনতা রয়েছে কার সাথে আপনি জড়িত হবেন তা ঠিক করার।

তিনি কেঁদে ফেলেন, আপনাকে যে আমি সম্পূর্ণ পেতে চাই।

আমি জানি না সম্পূর্ণ পাওয়া কাকে বলে, তিনি বিয়েকেই হয়তো ভাবছেন সম্পূর্ণ পাওয়া। আমি তো তাকে সম্পূর্ণ পেতে চাই না। কয়েক মাস আগে হাফিজুর রহমান দেশে বেরিয়ে গেলেন, তখন আমার মনে হয় নি যে মাহমুদা রহমানকে আমার সম্পূর্ণ পেতে হবে, হাফিজুর রহমান যাতে তার সাথে মিলিত হতে না পারে তার ব্যবস্থা। করতে হবে। বরং আমি একটু দূরে থাকতে পেরে স্বস্তিই পেয়েছি। তখনও মাহমুদা। রহমান আমাকে ফোন করেছেন, আমি বেশ কয়েক বার বেড়াতেও গেছি তার বাসায়, বুঝতে পেরেছি হাফিজুর রহমান মরুভূমির পিপাসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন, দিনরাত পান করছেন, খাচ্ছেন।

মাহমুদা রহমান ফোন করেছেন, ভদ্রলোকের ক্ষুধা মিটছে না। স্বামী বলে বাধাও দিতে পারছি না।

আমি বলেছি, অনেক দিন ধরে ক্ষুধার্ত আর পিপসার্ত, তাই একটু বেশিই খাবেন, বেশিই পান করবেন। খেতে দিন, পান করতে দিন, সওয়াব হবে।

তিনি বলেছেন, কিন্তু উটের মতো খায় আর পান করে, যাকে খাচ্ছে তার কথা ভাবে না। আর সওয়াব? দিনে আশি লক্ষ বছরের সওয়াব আদায় করছে।

আমি বলেছি, যে খায় সে নিজের কথাই ভাবে, নিজের পেট ভরছে কি না, খেতে ভালো লাগছে কি না, সেটাই তার বিবেচনার বিষয়; তার খাওয়ার ফলে খাদ্যের কেমন লাগছে সেটা তার ভাবার বিষয় নয়।

তিনি বলেছেন, কেউ কেউ তো তেমন নয়।

আমি বলেছি, ওই কেউ কেউ শুধু খায় না, নিজেকেও খেতে দেয়।

তিনি বলেছেন, দ্রলোক আমাকে প্রেগন্যান্ট করে রেখে যেতে চায়।

আমি বলেছি, অর্থাৎ তিনি নিজেকে আপনার ভেতরে রেখে যেতে চান, যাতে তাকে আপনি সব সময় বোধ করেন।

তিনি বলেছেন, না, না, তা হয় না; আমি আর ওই সব চাই না।

তিনি এখন আমাকে সম্পূর্ণ পেতে চান, আমাকে সম্পূর্ণ পাওয়ার মধ্যে আমি কোনো মহিমা দেখতে পাই না, যেমন আমি মাহমুদা রহমানকে সম্পূর্ণ পাওয়ার মধ্যেও কোনো মহিমা দেখি না, বিপর্যয় দেখতে পাই। ফিরোজা বিপর্যয়ের একটা আভাসও দিয়েছে, সে আমার কাছে জানতে চেয়েছে মাহমুদা রহমান সম্পর্কে, তিনি কেমন আছেন সে-সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ফিরোজার কি এটা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ আগ্রহ, না কি এর ভেতর কোনো পাপ রয়েছে? ফিরোজা কি জানতে পেরেছে যে আমার সাথে মাহমুদা রহমানের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, মাঝেমাঝে আমি তার বাসায় অসময়ে যাই? কী করে সে জানবে? জানার হাজার পথ খোলা রয়েছে। ড্রাইভার জানিয়েছে, আমাদেরই কেউ জানিয়েছে? ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে অবশ্য আমি কিছু বুঝতে পারি নি; পারি নি বলেই আমার সন্দেহ হচ্ছে তার মনে পাপ আছে, তার আগ্রহ নিষ্পাপ নয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে আলোচনার সময় মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে যখন কিছু। বোঝা যায় না, তখন, আমার বিশ্বাস, বুঝতে হবে অত্যন্ত মারাত্মক কিছু রয়েছে অত্যন্ত গভীরে। ফিরোজার গভীরেও কিছু থাকতে পারে, হয়তো আছেই, তা বাইরে দেখা দিতে বেশি সময় নেবে না। আমাকে তৈরি থাকতে হবে একটা সংকটের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্যে, কিন্তু আমি তো ফিরোজার মতো নিরীহ মুখে মারাত্মক ব্যাপারগুলো ভেতরে চেপে রাখতে পারি না। সংকটটি এসেই যায়, ফিরোজা বেশি আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে।

মাহমুদা ভাবীকে না কি তুমি আজকাল খুব সাহায্য করছো? ফিরোজা বলে।

তুমি কোথায় শুনলে? আমি বলি।

কোথায় শুনলাম সেটা ভিন্ন কথা, তাঁকে নানা সাহায্য করছে কি না আমি তাই জানতে চাই, ফিরোজা বলে।

তার দরকার হলে মাঝেমাঝে সাহায্য তো করিই, তাঁর স্বামী আমাদের বন্ধু ছিলেন, আমি বলি।

যেমন তুমি বিদেশে গেলে তোমার কোনো কোনো বন্ধু আমাকেও সাহায্য করবে, ফিরোজা বলে।

আমি অবশ্য কখনো বিদেশে যাবো না, আমি বলি।

সাহায্য করার জন্যে কখন তাঁর বাসায় যাও? ফিরোজা প্রচণ্ড প্রশ্ন করে।

যখন দরকার হয়, আমি বলি।

ফিরোজা কি আরো এগোবে, সব সত্য আজ সন্ধ্যায়ই উদঘাটন করবে? ফিরোজা আর এগোয় না, আমি স্বস্তি পাই; তবে আজ রাতে ফিরোজার সাথে সম্পর্কের একটা বাসনা আমার ছিলো,-দু-সপ্তায় কোনো সম্পর্ক হয় নি, সেটা নষ্ট হয়ে যায়; আমার পক্ষে আর তাকে ডাকা সম্ভব হবে না, সে তো ডাকবেই না। ফিরোজা কি আমার আর মাহমুদা রহমানের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে, সে কি মনে করে আমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে? আমার তা-ই মনে হয়। ফিরোজা মাঝেমাঝেই বলে বিবাহিত পুরুষগুলোই বেশি ইতর হয়, কুকুরের মতো, চল্লিশ বছর হয়ে গেলে তারা ইতরামো ছাড়া আর কিছুই জানে না, তাদের জিভ লকলক করতে থাকে সব সময়; কিছু না পেলে তারা কাজের মেয়েগুলোর দিকেই হাত বাড়ায়, বউয়ের থেকে কাজের মেয়েগুলোর স্বাদই তাদের বেশি ভালো লাগে। আমাকে নিয়ে ফিরোজা অবশ্য এ-সন্দেহটা পোষণ করে না, যদিও আমাদের বাসার কাজের মেয়েটি সুন্দরী; কারণ আমি বাসায়ই থাকি না, যতোক্ষণ থাকি ফিরোজাও থাকে। তবে আমার মনে হয় ফিরোজা মনে করে মাহমুদা রহমানের সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে, সেটা শারীরিক, কেননা এ-বয়সে অন্য কোনো সম্পর্ক হতে পারে না। ফিরোজার সম্পর্কটি কেমন? টেলিফোন–দেবরটি তার থেকে পাঁচ-ছ বছরের ছোটো হবে; তবে ফিরোজাকে তার পাশে বালিকাই মনে হয়; একদিন দেবরটিকে আমি বাসায়ও দেখেছি, বিকেলবেলা আমি বাসায় থাকবো সে। হয়তো ভাবতে পারে নি, আমাকে দেখে সে খুব বিব্রত বোধ করছিলো। খুব বিনয়ের সাথেই সে কথা বলছিলো ফিরোজার সাথে, আমার সাথেও, ফিরোজা তাকে তুমি বলছিলো, সে ফিরোজাকে আপনি বলছিলো, বিনয়ে সোফায় দু-পা আর দু-হাত জড়ো করে বসে কথা বলছিলো অবতারটি। অবতারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব না কী পড়ায়, অস্ট্রেলিয়া থেকে একটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় পিএইচডিও এনেছে। ভাবীর সাথে তার নিষ্পাপ নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক? নিষ্পাপ সম্পর্কই যদি তাহলে অন্যের স্ত্রীকে ভাবী ডেকে সম্পর্ক করার কী দরকার ছিলো, ছোঁকরা একটা কবুতর বা দোয়েল বা শাপলা বা আকাশের মেঘের সাথে সম্পর্ক করলেই পারতো। মানুষের সাথে কেনো? মানুষের সাথে সম্পর্ক কখনো নিষ্পাপ হয়? নিষ্পাপ সম্পর্ক কখনো টেকে? ফিরোজার সাথে তার সম্পর্ক কী? নিশ্চয়ই নৃতাত্ত্বিক। ছোঁকরা প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো চষে এখন দেশে চষতে চাচ্ছে। ফিরোজার মুখে একটা বয়সের ব্যক্তিত্বের ছাপ পড়েছে, ছোঁকরাটির মুখে বালক বালক ভাব এখনো রয়েছে, ফিরোজা কি এ-বালকটির নিচে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে? হয়তো পারে, বালকের স্বাদ অপূর্ব মনে হতে পারে তার; আর বালকটির অসামান্য অনুভূতি হওয়ারই কথা, সব বালকই তার চেয়ে বয়সে বড়ো কোনো নারীকে পরাভূত করার দিবাস্বপ্ন দেখে, আমিও দেখতাম। বালকটির বয়স যত বাড়বে কচি লাউডগার জন্যে ততোই পাগল হবে; কিন্তু ফিরোজার সাথে বালকের কী সম্পর্ক?

বালকটি কি মুগ্ধ হয়ে শুধু ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর কোনো দিকে তাকায় না, ফিরোজার গলার স্বর শুনে শুনেই বিভোর হয়ে যায়, অন্য কোনো সুর তার শুনতে ইচ্ছে করে না? ফিরোজা আর বালকটির কি এখনো সোনালি রুপোলি গল্পের পর্ব চলছে? সে কি ফিরোজাকে শুনিয়ে যাচ্ছে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরের গল্প, ফিরোজা বালিকার মতো শুনে চলছে? না কি তারা পরস্পরের শরীরের কাছাকাছি এসে গেছে? হয়তো এসে গেছে, এসে গেছে বলেই মনে হচ্ছে; ফিরোজা নিজের আর আমার শরীরের প্রতি এতো নিস্পৃহ হয়ে পড়েছে হয়তো সে-জন্যেই, বালকটি তাকে পরিতৃপ্ত করে চলছে বলেই হয়তো এতো নিরাসক্ত হতে পারছে সে আজকাল। তারা। প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিচ্ছে তো, না কি কাকের বাসায় একটি কোকিলের ছানা দেখা দেবে অচিরেই, এবং আমাকে সেটি নিজের বলে মেনে নিতে হবে, যদিও আমি অত্যন্ত সাবধান? আমার তো প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছে হবে না যে ওই ছানাটির জন্যে আমি দায়ী নই, অন্য কেউ দায়ী। ছানাটি দেখে এমনও হতে পারে যে আমার ভালো লেগে যাবে, আমার খুব মায়া হবে, অনেক দিন পর একটি বাচ্চার মাংসের ছোঁয়া পেয়ে। আমার ত্বক শিউরে উঠবে, তখন নৃতাত্ত্বিক আর ফিরোজা আমাকে নিয়ে হাসবে। অন্য রকমও হতে পারে, ফিরোজা রক্ত দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে অবতারটির কাছে ছুটে যেতে পারে, তাকে বিয়ে করার জন্যে কান্নাকাটি করতে পারে, তখন অবতারটি। ফিরোজাকে নাও চিনতে পারে; এবং হতাশ ফিরোজা একটি আত্মহত্যার উদ্যোগ নিতে পারে, সে সফল হতে পারে, ব্যর্থও হতে পারে। তখন দোষ হবে আমার, মানবতাবাদীরা সবাই চিৎকার করে বলবে আমার পীড়ন সহ্য করতে না পেরেই ফিরোজা ট্রাকের বা ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে; আমার মতো পাষণ্ড দ্বিতীয়টি আর হয় না। রগরগে সাংবাদিকগুলো খুঁজে বের করবে যে আমি একটি অত্যন্ত লম্পট পুরুষ, নারী থেকে নারীতে ছুটে বেড়ানোই আমার কাজ, আমার এক ডজন উপপত্নী রয়েছে, আর সে-শোকেই ফিরোজা আত্মহত্যা করেছে। আমি কি ফিরোজাকে পরামর্শ দেবো সে যা-ই করুক প্রতিরোধের ব্যবস্থাটি যেনো গ্রহণ করে? তবে ফিরোজা যদি আসলেই ঘুমোয় বালকটির সাথে, আর আমি যদি তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি, আমার কেমন লাগবে? …

ফিরোজাকে সন্ধ্যার একটু পরে ধানমণ্ডি আট নম্বরসড়কে দেখতে পাবো আমি ভাবি নি; আমার ধারণা ছিলো সে অর্চির সাথে অংকের মাস্টারের বাসায় আছে; অর্চি অংক শিখছে, ফিরোজা আর দশজন দায়িত্বশীল মাতার মতো মাস্টারের অপেক্ষাগারে বসে হিন্দি ছবি দেখে জীবন সার্থক করছে। দায়িত্বশীল মাতাদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা না করলে ব্যবসা জমবে না, এটা আজকাল মহৎ মাস্টার দোকানদাররাও বোঝে, আমি। শুনেছিলাম ফিরোজা বিকেলে সেখানেই থাকে, অংক শেষ হলে অর্চিকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। গর্ভবতী হওয়ার কী সুখাবহ পরিণাম। আমি দেখলাম ফিরোজার গাড়িটি। আটনম্বর সড়কের একটি বাড়ি থেকে দ্রুত বেরোলো, হয়তো একটু পরেই অংককষা। শেষ হবে অর্চির, শেষ হওয়ার আগেই সে গিয়ে অপেক্ষাগারে বসবে, অর্চি বেরিয়ে। দেখরে মা বসে আছে। সে বুঝতে পারবে না তার জননী ধামণ্ডির আটনম্বর সড়কে একটু ভ্রমণে গিয়েছিলো। আমি যে এ-সময় এ-পথ দিয়ে যাবো ফিরোজা ভাবে নি; আমি ড্রাইভারকে দ্রুত গাড়ি চালাতে বলতে পারি, গিয়ে উঠতে পারি অর্চির অংকের মাস্টারের বাসায়, কিন্তু আমি তা করবো না; তা ছাড়া অংকের মাস্টারের বাসাটা কোন দোজগে তা আমি জানি না। এ-সড়কে ফিরোজার কোনো আত্মীয় আছে বলে আমি শুনি নি, তবে কোনো পরমাত্মীয় থাকতে পারে, যার ঠিকানা আমি জানি না। নৃতাত্ত্বিক অবতারটি কি এখানে থাকে? অর্চি যখন অংক শেখে তখন কি ফিরোজা নৃতত্ত্ব শেখে? দুজনের ঘনিষ্ঠ একান্ত নগ্ন নৃতত্ত্ব? আমি ভালো করে ফিরোজাকে দেখতে পাই নি, তার চুলের অবস্থা বা শাড়ির ভাজ দেখতে পাই নি, পেলে আমি একটা ধারণা করতে। পারতাম তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে; হয়তো তাও পারতাম না। আমি রক্তের উষ্ণতা টের পাই আমার, কিন্তু বেশি উষ্ণ হতে দিই না; অবতারটির যদি একটা বউ থাকতো আমি কিছুটা প্রতিশোধ নিতে পারতাম, পারার কথা ভাবতাম। ফিরোজাকে যে আমি আটনম্বর সড়কে দেখেছি, তাও আমি বলবো না, অন্তত আজই বলবো না, বললে নিজেকে আমার ছোটো মনে হবে, নিজেকেই আমি ঘৃণা করবো।

ফিরোজা ঘুমিয়েই থাকে যদি বালকটির সাথে আমি কেনো উত্তেজিত হবো (আমি একটু উত্তেজিত), কেনো আমার রক্ত বলক দিয়ে উঠবে (আমার রক্ত একটু ফুটছে), পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে থাকবে (একটু কাঁপছে)? আমি কি ঘুমোই না অন্য নারীর সাথে? আমি কি দু-গোলার্ধের নারীশরীরসংস্থান জানি না? আমি কি ব্যাংকক, তোকিও, লন্ডন, নিউইঅর্ক, মাদ্রজ যাই নি? আমি কি মঙ্গোলীয় মসৃণতা, জাপানি গন্ধ, শ্যামদেশীয় বর্তুলতা, মার্কিন মুখমন্দারতা, কৃষ্ণাঙ্গিনী পেশলতা, আর তামিলিনী কৃষ্ণ আগুনের স্বাদ পাই নি; এবং পাই নি মাহমুদা রহমান আর দেবীর শরীরের প্রসাদ? আর রওশনের স্বর্গখণ্ড? আমি যখন আমার জীবনের দিকে তাকাই ব্যাংকের হিশেব, উত্তরার। বাড়ি, নদীর ওপর ব্রিজগুলোর কথা মনে পড়ে না, ঝিলিক দিতে থাকে ওই সব শরীর, ওই সব জ্যোতির্ময় বাঁক উচ্চতা গভীরতা, ওই সব হিরণয় অবসাদ, যা আমাকে সুখে আনন্দে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। আমি জানি সবই নিরর্থক, ওই ব্রিজ নিরর্থক, সূর্য। নিরর্থক, সব কাঠামোই ধসে পড়বে, আমি মাটিতে মিশে যাবো, মাটি শূন্যতায় মিশে যাবে। এর মাঝে অর্থপূর্ণ হচ্ছে ওই সব জ্যোতির টুকরোগুলো। আমার ইদ্রিয়গুলো। প্রখর, আমার কোনো একটি ইন্দ্রিয় মাত্র একটি কাজ করে না, প্রত্যেকটি অসংখ্য কাজ করে, আমি করতে শেখাই। চোখ দিয়ে আমি শুধু দেখি না, চোখ দিয়ে আমি ছুঁই, চোখ দিয়ে আমি খাই, পান করি, এমনকি চোখ দিয়ে আমি মিলন করি। নিরর্থক। এভাবে আমার কাছে হয়ে ওঠে অর্থপূর্ণ। ফিরোজা অন্য কারো সাথে মিলিত হলে আমি কাপবো কেনো? সে আমার স্ত্রী বলে? তার দেহের ওপর আমার সমস্ত অধিকার বলে, তার সমস্ত বাক সমস্ত রন্ধ্র আমার বলে? সেখানে অন্য কেউ হাত দিলে আমার পুরুষতায় আঘাত লাগে বলে? কিন্তু আমি কি কপি না?

আশ্চর্য, বিস্মিত হই আমি, ওই সন্ধ্যায় ফিরোজাকে আমার বেশি আকর্ষণীয়, বেশি আবেদনময় মনে হয়। আমাকে হঠাৎ বাসায় দেখতে পেয়ে প্রথম একটু বিচলিত হয়। সে, কিন্তু জ্বলজ্বল করতে থাকে, মনে হয় ফিরোজার ভেতরে কোনো তীব্র আলো ঢুকেছে, যা তার ত্বক ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে। এখন আমি আটনম্বর সড়কের কথা তুললে সমস্ত আলো নিভে যাবে, অন্ধকার নেমে আসবে, তার মাংস আর আত্মা কালো হয়ে উঠবে। কালো হয়ে উঠবে আমার মাংসও। ফিরোজকে বেশ চঞ্চল মনে হয়, সে বাতাসে ভাসছে; একটি বালক তাকে একটি লাল নীল বেলুনের মতো বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে।

তোমাকে আজ ঝলমলে মনে হচ্ছে, আমি বলি।

তাহলে তুমিও আমার দিকে তাকাও? ফিরোজা বলে, তাকানোর উপযুক্ত মনে করো!

সবাই আজ তোমার দিকে নিশ্চয়ই খুব বেশি করে তাকিয়েছে, আমি বলি।

তাকাক, তাদের ভালো লাগলে লাগুক, ফিরোজা বলে, কারো যদি ভালো লেগে থাকে আমার তাতে আপত্তি নেই।

আমি আপত্তির কথা বলি নি, আমি বলি, তাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।

তোমার অভিযোগের কী আছে? ফিরোজা বলে, আর আমার দিকে তির্যক চোখে তাকায়। ফিরোজা সম্ভবত আমার চোখে ঈর্ষা দেখতে চায়।

আমি আর কোনো কথা বলি না, আলো নিভিয়ে দিই; ফিরোজা বিস্মিত হয়। আমি তাকে টেনে এনে জোর করি, এমন জোর কখনো করি নি, কখনো করবো ভাবি নি; কিন্তু জোর করতে আমার আশ্চর্য ভালো লাগে। ফিরোজা প্রথম বাধা দিতে চেষ্টা করে, নখ দিয়ে খামচি দেবে বলে মনে হয়, কিন্তু সে অবিলম্বে সাড়া দিতে থাকে, আমি অবাক হই। আমার আজকের আচরণ সম্পূর্ণ অপরিচিত আমার, ফিরোজার তো অবশ্যই; আমার অদ্ভুত লাগতে থাকে যে ফিরোজা আমার প্রতিটি নতুন উদ্যোগে প্রথম একটু বাধা দিয়ে তারপরই উপভোগ করতে থাকে। আমি রক্তের স্বাদ টের পাই, লবণাক্ত স্বাদ; মানুষের রক্তের আশ্চর্য স্বাদ রয়েছে; বিভিন্ন স্থানের রক্ত বিভিন্ন রকম মনে হয় আমার। আমি এমন সব পথে যাত্রা করতে থাকি যে-পথে কখনো ভ্রমণ করি নি, ফিরোজা প্রথম বাধা দেয়, কিন্তু আমার জোর-ভ্রমণ তার কাছে চমৎকার লাগতে থাকে। দুর্গম দুরূহ দুস্তর পথ, আমি খুঁড়িয়ে চলি, গড়িয়ে চলি, দস্যুর মতো চলি। আমি ফিরোজাকে চিনতে পারি না, মনে হতে থাকে আমি ফিরোজার সাথে নেই, কোনো ক্রীতদাসীর সাথে আছি; কালো, অন্ধকারের মতো কালো, আগুনের মতো প্রচণ্ড ক্রীতদাসী, যাকে হনন করার সমস্ত অধিকার আমার রয়েছে। আমি হনন করতে থাকি, ফিরোজা হননে আনন্দ পেতে থাকে, ক্রীতদাসীর কণ্ঠের রক্তের মাংসের শব্দে গন্ধে রঙে আমার অন্ধকার পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে; আদিম অন্ধকারে আমরা আর বিধিবদ্ধ কাঠামোয় আটকে থাকি না, রক্তাক্ত গলিত উদ্বেলিত পাপবিদ্ধ সুখমৃত প্রভুদাসী হয়ে। উঠি।

আমাদের খালে বাঁশের পুল, মাঠের পথে ডোবার ওপর ভেঙে পড়া কাঁঠাল গাছ, পাথরের গাঁথনি সেতু, দো-আঁশলা গাঁথনি সেতু, প্রিস্ট্রেসড কংক্রিট, স্টিল ট্রাসেড, ক্যান্টিলিভার সেতু, ঝুলন্ত সেতু, ধারাবাহিক সেতু, খিলান সেতু, পিয়ার, ওপরকাঠামো, অবকাঠামো, পিলপায়া, রওশন, ফিরোজা, মাহমুদা রহমান, আমি, দেবী, বাঁশের পুল, ভেঙে পড়া কাঁঠাল গাছ, পাথরের গাঁথনি, দো-আঁশলা গাঁথনি, ঝুলন্ত, প্রিস্ট্রেসড, খিলান, ক্যান্টিলিভার, কিন্তু আমি কোনো সেতু দেখছি না, আমার সাথে আর কারো কোনো ব্রিজ তৈরি হয় নি, আমি সেতু বাঁধতে পারি নি, কেউ পারে না। মাহমুদা রহমানের বাসায় কয়েক দিন যাই নি, তিনিও এখন দশটা বাজলেই বেজে ওঠেন না; আমি কোনো কোনো দিন ফোন করেছি, অনেকক্ষণ ধরে বাজে, তিনি ধরেন না। বাইরে তাঁর কাজ পড়েছে হয়তো, না কি বাসায় থেকেও ওই সময়ে ফোন ধরেন না, ফোন তাকে বিরক্ত করে। আমি সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবো, নিতে ইচ্ছে করছে আমার; আর মাহমুদা রহমান নয়, দেবী নয়, ফিরোজাও নয়, আমি একা, সম্পূর্ণ একা। আমি বোধ করি আমার সময় বড়ো বেশি বেড়ে গেছে, একঘণ্টা আর ষাট মিনিট নেই, হাজার হাজার মিনিট হয়ে উঠেছে, আমার ওই সময়টা ভরে রাখার মতো কোনো সম্পদ নেই। জীবন আরো নিরর্থক আরো শূন্য হয়ে উঠেছে। আমি যদি আরো তিরিশ বছর বেঁচে থাকি, আমার ভয় লাগতে থাকে, তাহলে এতোগুলো বছর আমি বহন করবো কীভাবে? আমার যা কাজ তা শেষ করে আমি আর কিছু খুঁজে পাই না। মাহমুদা রহমানের কাছে যাচ্ছি না, যাবো না; কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আমার তাকেই মনে পড়ছে, আমার এখন পান। করতে ইচ্ছে করছে। আমি বেরিয়ে পড়ি, পাঁচতারা হোটেলটিতে গিয়ে পান করি, পান করতে করতে আমার আরো বেশি মাহমুদা রহমানকে মনে পড়ে; তাঁকে টেলিফোন, করবো না, কিন্তু পানের টেবিলেই যদি একটি টেলিফোন থাকতো তাহলে এখনি তাঁকে ফোন করতাম। পান করতে করতে আমার ক্ষোভটা কেটে যায়, পান করলে আমি অনেক বেশি সরল হয়ে উঠি, দেবতা হয়ে উঠি, মানুষের ঘৃণা ক্ষোভ পাপগুলো থাকে না, আমি শেষ করে উঠে দাঁড়াই। মাহমুদা রহমানকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে ছুঁতে ইচ্ছে করছে; এতো বেশি আর কখনো দেখতে আর ছুঁতে ইচ্ছে করে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *