৪. আমি নদীর দিকে হাঁটতে থাকি

আমি নদীর দিকে হাঁটতে থাকি, আমি বুঝতে পারি না কোন দিকে হাঁটছি, নদীর দিকে না অন্ধকারের দিকে, আমার খুব কষ্ট হয়, কাঁদতে ইচ্ছে হয়, সূর্য ডুবছে নদীতে, আমার ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, আর কি সূর্য উঠবে, আমি কিছু দেখতে পাই না, সবুজ গাছগুলোকে কালো মনে হয়, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, রওশনের মুখটি আমি মনে করতে চাই, মনে করতে পারি না, কিছুই আমি মনে করতে পারি না, আরেকবার রওশনকে দেখতে ইচ্ছে হয়, রওশন বাঁধানো কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, আমি আর বাড়ি ফিরবো না, অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো, আমাকে কেউ আর দেখতে পাবে না, রওশনকে নিয়ে আমার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, যেনো আমি রওশনদের বাঁশবাগানে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, রওশন আমাকে দেখতে পেয়েছে জানালা দিয়ে, পালিয়ে চলে এসেছে রওশন, আমরা নৌকোয় উঠে ভেসে চলেছি, আমরা নিজেদের জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। কিন্তু আমি সন্ধ্যায়ই বাড়ি ফিরি, যেমন আগে ফিরতাম। আমি খুব শূন্য বোধ করি, রওশনই আমাকে প্রথম দেয় শূন্যতার বোধ। আমি কি ভেঙে পড়বো, পনেরো বছর পাঁচ মাসের আমি নিজেকে বারবার প্রশ্ন করি, আমি কি ভেঙে পড়বো? আমার ইচ্ছে হয় ভেঙে পড়তে। কে যেনো আমার ভেতর থেকে বলে, না। ঘুমোতে আমার কষ্ট হয়, আমি ঘুমোতে পারি না, আমি ঘুমোতে জানি না; চোখ বুজলেই আমি একটি লোককে দেখতে পাই, যাকে আমি কখনো দেখি নি, লোকটি রওশনের ব্লাউজ খুলছে, আমার রক্ত জ্বলছে, দুটি লাল রঙলাগা চাঁদ বেরিয়ে পড়ছে, আমি দেখতে পাই লোকটি রওশনের লাল রঙলাগা চাঁদ ছুঁচ্ছে, কালো হাত দিয়ে রওশনের চাঁদ দুটিকে পিষছে লোকটি, আমি কেঁপে উঠি, ঘুমোতে পারি না; আমি দেখতে পাই লোকটির হাত আরো নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, লোকটি রওশনের শাড়ি সরিয়ে দিচ্ছে কালো হাত দিয়ে, রওশন নগ্ন, লোকটি একখণ্ড মেঘ দেখতে পাচ্ছে রওশনের, মেঘের আড়ালে লোকটি সোনার খনি খুঁজছে, আমি দেখতে পাই লোকটি উলঙ্গ হচ্ছে, লোকটি রওশনের সাথে অসভ্য কাজ করছে, অমি নিঃশব্দে চিৎকার করে উঠি, একবার মনে হয় রওশন লোকটিকে সহ্য করতে পারছে না, সে বাধা দিচ্ছে লোকটিকে, আমার একটু ভালো লাগছে, কিন্তু রওশন লোকটিকে ফেরাতে পারছে না, লোকটি অসভ্য কাজ করছে, রওশন শুধু শুয়ে আছে চিৎ হয়ে, পরমুহূর্তেই আমার মনে হয়, আমি দেখতে পাই, রওশনের ভালো লাগছে; রওশন লোকটিকে চুমো খাচ্ছে, লোকটিকে রওশন জড়িয়ে ধরছে নিজের লাল রঙুলাগা দুই চাঁদের মধ্যে, লোকটি উলঙ্গ হয়ে রওশনকে পা ছড়াতে বলছে, আমি দেখতে পাই, সুখের ঘোরে পা ছড়িয়ে দিচ্ছে রওশন, লোকটি রওশনের মেঘের ভেতরে ঢুকছে, রওশন চোখ বন্ধ করে সুখে জড়িয়ে ধরছে লোকটিকে, রওশন কেমন শব্দ করছে, আমি দেখতে পাই রওশন লোকটির তালে তালে শরীর দোলাচ্ছে, রওশনের যৌবন সুধা পান করছে লোকটি, রওশন তাকে আরো সুধা পান করতে দিচ্ছে, লোকটি রওশনের যৌবন সুধা রাতভর পান করছে দিনভর পান করছে, আমি নিঃশব্দে চিৎকার করে উঠি, আমি ঘুমোতে পারি না, মনে মনে বলতে থাকি, রওশন, তুমি বলেছিলে আমিই পান করবো তোমার যৌবন সুধা, আমার সাথেই তুমি করবে অসভ্য কাজ, তুমি কথা রাখে নি, আমিও কথা রাখবো না; আমিও অসভ্য কাজ করবো, আমিও যৌবন সুধা পান করবো, তখন তুমিও ঘুমোতে পারবে না।

আমার প্রথম ব্রিজটি, যেটি তৈরির সাথে আমি বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম, যার নকশাই করেছিলাম আমি, সেটি শুরুতেই ভেঙে পড়েছিলো; মনে হচ্ছিলো ফুলঝর নদীর ওপর আমার ব্রিজ কোনো দিন দাঁড়াবে না; কিন্তু এখনো ওই ব্রিজ দাঁড়িয়ে আছে, আরো কয়েক দশক দাঁড়িয়ে থাকবে। বেশ সুন্দর নাম ছিলো ব্রিজটির, নদীটির নাম আরো সুন্দর; তবে নদীটি আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো দুই তীরের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি, নদীর ওপর সঙ্গীত লেখা, সহজ কাজ নয়। আমার মনে প্রশ্নই জাগিয়ে দেয় যে যা বিচ্ছিন্ন, তা কি আসলেই সম্পর্কিত হতে চায়; কিছু কি আসলেই পারে সম্পর্কিত হতে? ফুলঝর নদীর দু-তীরের সম্পর্ক ছিলো না, আমি সম্পর্কের একটি কাঠামো তৈরির চেষ্টা করছিলাম; নদীর ওপর ব্রিজের কাজ চলছিলো ঠিকঠাক; ব্রিজটি বেশি বড়ো হবে নয়, আট শো ফুটের মতো দীর্ঘ, পাশে বত্রিশ, আমি নিশ্চিত ছিলাম সব কিছু ঠিক সময়ে ঠিক মতো হয়ে যাবে, কিন্তু হঠাৎ বন্যা আসে। বন্যা হঠাৎই আসে; রওশন ও আমার ব্রিজ, ফুলঝর নদীর ব্রিজের অনেক আগে, হঠাৎ বন্যায়ই ভেসে গিয়েছিলো; আমি নদীর ওপর ব্রিজ বানাতে গিয়ে দেখি সেভাবেই বন্যা আসছে। যমুনার বাঁধ ভেঙে প্রচণ্ড স্রোত বইতে শুরু করে ফুলঝর নদী দিয়ে, ওই স্রোতের বড়ো কাজই হয় দু-দুটি ভিত্তিকূপ ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমার চোখের সামনেই ঘটনাটি ঘটে, অনেকেই চিৎকার করে উঠেছিলো, ঠিকাদারের চিৎকার ছিলো শোনার মতো, কিন্তু আমি ওই দৃশ্য দেখছিলাম নির্বিকারভাবে। ভিত্তিকূপ তৈরি হচ্ছে দেখে আমার যেমন লেগেছিলো, ভেসে যাচ্ছে দেখে তার থেকে ভিন্ন কোনো আবেগ আমার জাগে নি। কাঠামোর কাজ অবধারিত ভেঙে পড়াকে বিশেষ একটা সময়ের জন্যে ঠেকিয়ে রাখা; ওই ভিত্তিকূপ নিজেও কাঠামো, একদিন ধ্বংস হয়ে যেতোই, তবে ওই কূপের কাছে আশা করেছিলাম একটা বিশেষ সময়ের জন্যে ওটি টিকে থাকবে, কিন্তু টিকে থাকতে পারে নি। কিছুই টেকে না, সব কিছুই ভেঙে পড়ে, কোনোটি আগে কোনোটি পরে।

ভিত্তিকূপ ধসে পড়েছিলো বলে আমরা দমে যেতে পারি নি; ব্রিজ আমাদের দরকার, ফুলঝর নদীর ওপর ব্রিজ দরকার, সম্পর্ক দরকার। আগে যেভাবে ভিত্তিস্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম, তা আর চলে নি; অন্যভাবে অন্যখানে ভিত্তিস্থাপন করতে হয়েছিলো আমাদের, ব্রিজের নকশাও বদল করতে হয়েছিলো সম্পূর্ণরূপে; কিন্তু আমরা সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম একটি ব্রিজ, নদীর দুই পারের মধ্যে সম্পর্ক। ফুলঝর নদীর ওপর ওই ব্রিজ এখনো দাঁড়িয়ে আছে, চোখ বুজলেই ব্রিজটিকে দেখি আমি; ওটি আমার প্রথম ব্রিজ, ওটি আরো অনেক বছর দাঁড়িয়ে থাকবে, সম্পর্ক পাতিয়ে চলবে উত্তরবঙ্গের। সাথে ময়মনসিং আর টাঙ্গাইলের, কিন্তু ওই কাঠামো চিরকাল থাকবে না। আমি এখন একটি বড়ো ব্রিজ নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছি; এ-ব্রিজ সরকারের একটি বড়ো কৃতিত্ব বলে গণ্য হবে, অনেক বিদেশি টাকা ভিক্ষা করতে পেরেছে তারা; যে-মন্ত্রীটি এ-এলাকায় দিন দিন অপ্রিয় হয়ে উঠছে, ব্রিজটি তৈরি হওয়ার পর সে আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠবে বলে রাজনীতিকভাবে আশা করা হচ্ছে, ভোট এলে ছিনতাই না করে সে পাশটাশ করবে, তার কাঠামোগুলো ঠিক থাকবে; কিন্তু আমি আর কোনো কাঠামোর ওপরই বিশ্বাস রাখতে পারছি না। উদ্বোধনের সময়ই যদি প্রধান মন্ত্রী, আর পঞ্চাশটি মন্ত্রী, আর একপাল রাজদূত নিয়ে ব্রিজটি নদীর ভেতর তলিয়ে যায়, তাদের আর খুঁজে না পাওয়া যায়, তাতে আমি খুব কষ্ট পাবো না; বরং চোখ ভরে সেই দৃশ্য। নির্বিকারভাবে দেখবো। কিন্তু আসলেই কি আমি নির্বিকারভাবে দেখবো, দেখতে পারবো? আমি কি এতোটা নির্বিকার হয়ে উঠতে পেরেছি?

চল্লিশ পেরিয়েছি, সব মিলে ভালোই আছি; আমার ব্যক্তিগত কাঠামোটিও চমৎকারই বলে মনে হচ্ছে, যদিও এর ওপরও আমি বিশ্বাস রাখি না, যে-কোনো সময় এটা ধসে পড়তে পারে। মনে মনে একটা ভয় আছে আমার, ধসে পড়ার ভয়, আমি ধসে পড়তে চাই না। দিন দিন আরো আকর্ষণীয় হচ্ছি শুনতে পাই; এমন অনেকের। মুখে শুনি যে হেসে উড়িয়ে দিতে পারি না, চুপচাপ ভেতরে জমিয়ে রাখি। সৌন্দর্য আর প্রশংসা সব সময়ই ভালো। যে-ব্রিজটি তৈরি করছি এখন, যার নকশা আমিই করেছি, দেখাশোনা করছি, সেটি আমাকে উদ্বেগে রাখছে বছর দুই ধরে, কেনো যেনো আমার ভয় হচ্ছে এটি ভেঙে পড়বে। হয়তো ভেঙে পড়বে না, আসলে ভেঙে পড়বেই না, আমার ব্যক্তিগত কাঠামো ভেঙে পড়ার পরও ওই ভয়ঙ্কর নদীটির ওপর ব্রিজটি দাঁড়িয়ে থাকবে, দুই পারের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে; তবু আমার ভয় হয় ব্রিজটি ভেঙে পড়বে, আমি দেখতে পাই ভেতরে ভেতরে এটি জীর্ণ হচ্ছে, এটি ভেঙে পড়ছে। এটি ভেঙে পড়ছে দেখার সময় আমি অন্য কিছু দেখতে পাই, আমার পাড়াটিকে দেখতে পাই। আমি এক ভালো আবাসিক এলাকায়ই থাকি, অধিকাংশেরই গাড়ি আছে, কারো কারো একাধিক আছে; বাড়িও আছে অনেকের, যাদের নেই তাদের শিগগিরই হবে; কিন্তু তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখা যায় তাদের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোটি ভেঙে পড়েছে। হয়তো তারা তা বুঝতে পারে, হয়তো পারে না; কিন্তু ভেঙে যে পড়েছে। কোনো সন্দেহ নেই।

ঘুম থেকে ওঠার পর একবার উত্তরের বারান্দায় যাওয়া আমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটি আমার উৎকৃষ্ট অভ্যাসগুলোর একটি; বারন্দায় গেলে সামনের দালানের বারান্দায় বেগম আর জনাব নুর মোহাম্মদকে দেখতে পাই। যদিও তাদের সাথে আমার বিশেষ আলাপ নেই, তবু তাঁদের দেখলে আমার ভালো লাগে; আমি কি তাঁদের দেখার জন্যেই বারান্দায় যাই? তাদের বয়সের ফারাকটি একটু বেশিই; নুর মোহাম্মদ নিশ্চয়ই পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছেন, তবে তাঁর দেহখান বেশ বলিষ্ঠ, বারান্দায় তিনি খালি গায়েই দাঁড়ান, তার বুকের লোমগুলো দেখা যায়; তাকে একটি স্বাস্থ্যবান মোষের মতো দেখায়। বেগম নুর মোহাম্মদ চল্লিশ হবেন, এককালে তিনি একটি ধবধবে হরিণী ছিলেন সন্দেহ নেই, সে-ছাপ রয়ে গেছে তার শরীরে, যদিও তার মুখ ভরে ক্লান্তি নেমেছে। তাঁর মুখে দূর থেকে আমি যা দেখতে পাই, তা কি আসলে ক্লান্তি? না কি। ভোরবেলাকার রোদে আমি ঠিক মতো তাঁর মুখটি দেখতে পাই না? তাঁদের আমি প্রতিদিনই বারান্দায় দেখতে পাই, কিন্তু কখনো তাদের কথা বলতে দেখি না, একজনকে আরেকজনের দিকে তাকাতেও দেখি না। নুর মোহাম্মদ অনেকক্ষণ ধরে। নিজের বুক মালিশ করেন, আর দক্ষিণপশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকেন; আবার কখনো কনুই বারান্দার রেলিংয়ের ওপর রেখে শরীরটা ভেঙে দাঁড়ান, নিচের মাটি দেখেন। বেগম নুর মোহাম্মদ বসেন এক কাপ চা নিয়ে, চায়ের কাপটি তিনি বারান্দার রেলিংয়ের ওপর রেখে বাঁ হাত দিয়ে ধরে রাখেন, কিন্তু চায়ের পেয়ালায় তাকে মুখ দিতে বিশেষ দেখি না, পুব দিকে তিনি তাকিয়ে থাকেন ভাবলেষহীনভাবে। আমি অনেকবার খেয়াল করে দেখার চেষ্টা করেছি তার মুখে কোনো ভাবের আভাস দেখা যায় কি না, তিনি নুর মোহাম্মদ সাহেবের দিকে বিরক্তির সাথেও অন্তত একবারও তাকান কি না, কিন্তু আমি তা দেখতে পাই নি।

বেগম ও জনাব নুর মোহাম্মদ কি সারারাত শারীরিক শ্রম করার পর ক্লান্ত? এ-বয়সে অধিক নৈশ শ্রম কি পোষাচ্ছে না তাদের? তবু তারা শ্রম করে চলছেন? মেয়েটি তাদের দিল্লিতে, ছেলেটি নিউইয়র্কে বলে আবার একটি শিশু আনতে চাইছেন তাঁরা? শ্রমের ক্লান্তি নিয়ে সকালবেলা তারা কি একজন আরেকজনের দিকে তাকানোর আগ্রহও বোধ করেন না? তবে তারা কি সারারাতে একবারও, ঘুমের মধ্যেও, একজন ছুঁয়েছেন আরেকজনকে? আমি জানি না, আমার জানার কথা নয়, তারা এক শয্যায়। ঘুমোন কি না, একই ঘরে ঘুমোন কি না। দেখে মনে হচ্ছে এখন তাদের একজন হঠাৎ বারান্দায় পড়ে গেলে আরেকজন খুব বিরক্ত হবেন; বেগম নুর মোহাম্মদের খুব খারাপ লাগবে চায়ের পেয়ালা সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াতে, নুর মোহাম্মদ সাহেবের খারাপ লাগবে রেলিং থেকে কনুই সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে। তাদের একজন পুরুষ। আরেকজন মেয়েলোক, একই ঘরে তাঁদের থাকার কথা ছিলো না; কিন্তু তারা পরস্পর বিবাহিত বলে, একজন স্বামী আরেকজন স্ত্রী বলে-যেমন ফিরোজা ও আমি বিবাহিত বলে থাকছি, তারাও থাকছেন, অনেক বছর ধরে তাদের একজনের শরীরের ওপর আরেকজনের অধিকার সবাই মেনে নিচ্ছে; কিন্তু তারা এতো দূরে কেনো? তাদের দেখে যেমন মনে হচ্ছে তাতে বিশ্বাসই করতে কষ্ট হচ্ছে কখনো তাঁদের একজন উলঙ্গ দেখেছেন আরেকজনকে। না দেখলে তারা এত দিন একসাথে থাকতে পারতেন না, নিশ্চয়ই দেখেছেন, হয়তো আজ রাতেই দেখেছেন, কিন্তু একই বারান্দায় তাঁরা এতো দূরে কেনো?

আমি নুর মোহাম্মদ আর বেগম নুর মোহাম্মদের কথা ভাবছি কেনো, নিজের কথাই তো ভাবতে পারি; ওরা দুজন অন্তত ভোরবেলা একসাথে বারান্দায় আসেন, কিন্তু আমি। তো একলাই আসি, ফিরোজা বারান্দায়ও আসে না। ফিরোজা আসে না বলে কি আমার খারাপ লাগে? আমি কি চাই এই এখন যখন আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে নুর মোহাম্মদ। দম্পতিকে দেখছি, তখন ফিরোজা আমার পাশে এসে দাঁড়াক, আমরা একসাথে সামনের দালানের দম্পতিকে দেখি, দূরের দু–একটি পাখি আর গাছের ডালে পাতার সবুজ দেখে মুগ্ধ হই? না, আমি চাই না ফিরোজা এখন আমার পাশে এসে দাঁড়াক; সে এসে দাঁড়ালে আমার বিরক্তি লাগবে, আমি অবশ্য তা প্রকাশ করবো না, একটু হাসারও চেষ্টা করবো হয়তো, কিন্তু আমি চাই না ফিরোজা এখন আমার পাশে এসে দাঁড়াক। স্বামী-স্ত্রী খেলা যথেষ্ট হয়েছে, এ-ভোরবেলা তা আর খেলতে ভালো লাগবে না। ফিরোজা যে আসে না এতে আমার খারাপ লাগে না, বরং অত্যন্ত ভালো লাগে; সে না এলে আমি বেগম নুর মোহাম্মদের দিকে ভালোভাবে তাকাতে পারতাম না, বা আমি আসা বন্ধ করে দিতামা। ফিরোজা আসে না বলে আমার ভালো লাগে। তাহলে। ফিরোজা কি আমাকে ক্লান্ত করে, আমি কি ক্লান্ত করি ফিরোজাকে? এখন আমি যদি ফিরোজাকে ডাকি, সে কি ঝলমল করতে করতে ছুটে আসবে? সে আমার ডাক শুনতেই হয়তো পাবে না, যেমন আমিও তার ডাক শুনতে পাই না মাঝেমাঝে।

আমাদের-ফিরোজার ও আমার-ব্রিজটি ভেঙে পড়ছে বলেই মনে হচ্ছে; ঠিক ভেঙে পড়ছে না, তবে ওই সাঁকো দিয়ে অনেক দিন আমরা চলাচল করছি না; কাঠামোটি দাঁড়িয়ে আছে, তার ওপর কোনো পায়ের শব্দ নেই। ফিরোজার মুখ দেখার জন্যে আমি কোনো ব্যাকুলতা বোধ করি না, বেশির ভাগ সময় না দেখলেই ভালো লাগে; ফিরোজারও তাই হয় নিশ্চয়ই, আমার মুখের দিকে সে অনেক দিন তাকায়ই নি, আমিও বোধ হয় তাকাই নি, মাঝেমাঝে আমি তার মুখটিকে মনে করতে পারি না। আমরা যে একজন ঘেন্না করি আরেকজনকে, পাশাপাশি বসতে আমাদের বমি পায়, এমন নয়; কিন্তু আমরা কোনো উল্লাসও বোধ করি না। ফিরোজাকে দেখে আমি অনেক বছর চঞ্চল হই নি; বাসায় ফিরে যখন দেখি সে বাসায় নেই, তখন দু-একটি সন্দেহ। মনে উঁকি দেয়, কিন্তু কোনো উদ্বেগ বোধ করি না; যখন দেখি সে ফিরে আসছে তখন কোনো কাঁপন লাগে না। আমাদের সব কি ঠিক আছে? আমরা কি ঠিক আছি? একটি বেজি দৌড়ে যাচ্ছে দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছটির পাশ দিয়ে, ঢুকছে জঙ্গলের মধ্যে, দেখে। আমার ভালো লাগছে, মন ভরে উঠছে; ফিরোজা যদি ওই বেজিটি হতো, দেখে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু আমরা স্বামীস্ত্রী, ভোরবেলা কৃষ্ণচূড়া গাছের পাশ দিয়ে দৌড়ে যাওয়া বেজি আমরা কোনো দিন আর হয়ে উঠতে পারবো না আমাদের কাছে। আমাদের সব কিছু কি ঠিক আছে?

আমরা এক বিছানায় ঘুমোই না, আমারই এটা ভালো লাগে না; ঘুমোনার সময়, কারো একটা হাত বা পা আমার গায়ে এসে পড়লেই আমার ঘুম ভেঙে যায়, ঘুমোনার সময় আমার গায়ের ওপর বিশ্বসুন্দরীর বাহু, স্তন, জংঘাও আমার সহ্য হবে না। আমি কামপ্রেমহীন ঘুম পছন্দ করি। ঘুমোতে যেতে সাধারণত আমার দেরি হয়; আর, ফিরোজার রাত্রিজ্ঞান একান্ত নিজস্ব ও অদ্ভুত, কোনো দিন সন্ধ্যার পরই তার মনে হয় রাত গম্ভীর হয়ে গেছে, আর জেগে থাকা যায় না, সে আর জাগতে পারে না, বালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে, মানুষের পৃথিবী তখন তার ভালো লাগে না তার মোয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়। আমি কোনো কোনো দিন দেরি করে ফিরি, দেখি ফিরোজা ঘুমিয়ে পড়েছে; ঘুমন্ত মানুষকে ডাকতে আমার ইচ্ছে হয় না, খুব শারীরিক দরকারেও না। একটি ঘুমন্ত মানুষকে ঠেলে জাগিয়ে প্রস্তুত করে দরকার মিটিয়ে আরেক বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ার কথা ভাবতেই আমার ঘেন্না লাগে। আবার কখনো রাত দশটায় ঘুমোতে গিয়ে দেখি ফিরোজার মনে হচ্ছে রাতই হয় নি, তার দু-একটা অনুষ্ঠান দেখা দরকার, একটি সিনেমা পত্রিকার কয়েক পাতা পড়া তার বাকি আছে; তখন আমি শুয়ে পড়ি, রাতে আর আমাদের দেখা হয় না। কোনো কোনো রাতে আমার ঘুম আসে না, অনেকটা শারীরিক দরকারেই, দরকারটা মিটে গেলে একটা চমৎকার ঘুম হতে পারতো; কিন্তু আমি ফিরোজাকে ডাকি না। এটা চলে আসছে অনেক বছর ধরে, কিন্তু আমরা বেশ আছি; তবে আমার মনে হয় আমাদের কিছু একটা হয়েছে। আমাদের। সাঁকোটিতে আর চলাচল নেই; তাতে আর আমাদের পায়ের ছাপ পড়ে না; ওটি আছে, সবাই দেখছে, আমরাও দেখছি, এই সব।

আমি জানি না ফিরোজার আর কোনো ব্রিজ আছে কি না, কিন্তু আমি যতোই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছি ততোই আকর্ষণীয় হচ্ছি, আর ততোই আমার ব্রিজের সংখ্যা বাড়ছে; সেগুলোতে চলাচলও অনেক বেশি। ফিরোজা-আমি বিবাহিত, আমরা স্বামীস্ত্রী, এটি আমাদের সর্বজনস্বীকৃত ব্রিজ, এটিই আমার একমাত্র ব্রিজ বলে অন্যরা মনে করার ভান করে, আমিও করি। এছাড়া অন্য কোনো ব্রিজ অন্যরা মেনে নেবে না, যদিও তারাও নিজেদের ব্রিজে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত, তারাও অন্য ব্রিজ তৈরি করে চলছে, বা তৈরি করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। একটি পুরুষ আর একটি নারী কতো দিন একসাথে থাকার পর ক্লান্ত হয়? কতোবার একসাথে ঘুমোনোর পর, ঠিক কতোটি সঙ্গমের পর, তারা পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ হারায়? মানুষের গঠন আমি জানি না; আমি জানি না মানুষের ভেতরে এমন কিছু আছে কি না যা পালন করে অন্যের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার দায়িত্ব; আছে নিশ্চয়ই, আমি তা টের পাই, বারবার আমি টের পেয়েছি; কিন্তু সেটির শক্তি কতোটা? কতো দিন সেটি আকর্ষণ বোধ করে যেতে পারে? ওই আকর্ষণ বোধ। করার শক্তিটির নামই সম্ভবত প্রেম। প্রেম বিয়ের শর্ত নয়, বিবাহিত জীবনেরও শর্ত নয়, কোনো ধর্মই চায় না স্বামীস্ত্রী প্রেমের মধ্যে থাকবে; এখন মানুষ একটু বেশি দাবি। করছি বিয়ের কাছে, শুনতে ভালো শোনায় বলে। কোনো কালে কোনো স্বামীস্ত্রী। ভালোবেসেছে একে অন্যকে, এটা আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না; সহবাস, সঙ্গম, সন্তান, দায়িত্ব, এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়া, বেশ এই, এই তো বিয়ে। যেমন আমরা, ফিরোজা আর আমি, আমাদের মধ্যে বিশেষ কোনো গোলমাল নেই, সবই ঠিক আছে; কিন্তু আমার মনে হয় কোথাও একটি বড়ো গোলমাল ঘটে গেছে, যার জন্যে আমি। দায়ী নই, ফিরোজাও দায়ী নয়।

ভাত খেতে বসেছি, খাওয়া আমার শেষ হয়ে এসেছে, ফিরোজা আমার পাতে বড়ো এক চামচ ভাত তুলে দেয়।

আমি তো ভাত চাই নি, আমি অবাক হয়ে বলি।

চাও নি তাতে কী, ফিরোজা বলে, ভাত তো তুমি নিতেই।

তুমি কী করে জানলে? আমি বলি।

অন্য কেউ দিলে খুব তো খুশি হতে, আমি দিচ্ছি বলেই, ফিরোজা বলে।

আমি আর কথা বলি না, ভাত খাই; আমি পছন্দ করি না আমার পাতে কেউ ভাত তুলে দিক; এটা আমার ত্রুটি, ভাত তুলে দিলে খুশি হতে হয়, কিন্তু আমি হতে পারি না। কেননা হতে পারি না? ফিরোজা আমার পাতে ভাত তুলে দিলে আমার কেনো ভালো লাগে না, সে কি ফিরোজা বলে? অন্য কেউ হলে সত্যিই কি আমি আনন্দিত হতাম? ফিরোজার ভাত তুলে দেয়ার মধ্যে আমি কোনো চাঞ্চল্য দেখি না, আমার পাতে ভাত তুলে দিয়ে সে সুখ পাচ্ছে, আমার মনে হয় না; এমনকি সে একটি দায়িত্ব পালন করছে, এটা তাও নয়। হতো যদি আমার হাত অবশ হয়ে গেছে, দুর্ঘটনায় একটি হাত হারিয়ে ফেলেছি, ভাত তুলতে পারছি না, সে তুলে দিচ্ছে, একটি উপকারী দায়িত্ব পালন করছে, তাহলে কৃতজ্ঞ বোধ করতাম; কিন্তু এই হঠাৎ ভাত তুলে দেয়ার মধ্যে একটু প্রভুত্ব করার ঝোঁক আছে, সে আমার বৈধ স্ত্রী, যখনতখন ইচ্ছে করলেই সে আমার। পাতে ভাত তুলে দিতে পারে, আমার দরকার থাক বা না থাক।

আমি এক কাপ চা খেতে চাই। কাজের মেয়েটি জানে আমি ঠিক কী রঙের চা খেতে পছন্দ করি; মেয়েটি দু-মাসেই শিখে ফেলেছে, জেনে ফেলেছে ঠিক কতোটা চিনি চাই আমার; ফিরোজা অবশ্য তা জানে না, তাতে আমার একটুও দুঃখ নেই, বরং আমি কখনোই চাই না ফিরোজা আমার জন্যে চা তৈরি করে আনুক। চা বানানোর মতো। একটি কাজের জন্যে কাজের মেয়েই যথেষ্ট, তার জন্যে একটি বিবাহিত স্ত্রী দরকার পড়ে না। কাজের মেয়েটি পিরিচটি খুব যত্নের সাথে মোছে, একফোঁটা চাও তাতে লেগে থাকে না; চা খাওয়ার আগে আমি চামচ দিয়ে চা নাড়তে পছন্দ করি, মেয়েটি হয়তো দেখেছে, আমিই হয়তো তাকে বলে দিয়েছি চায়ের সাথে চামচ দেয়ার, তাই সাথে সে একটি পরিচ্ছন্ন চামচও দেয়। আমি ওই চা খেয়ে তৃপ্তি পাই। আমি মনে মনে চাই মেয়েটি চায়ের পেয়ালা আমার সামনের টেবিলে এনে রাখুক। মেয়েটিকে একবার দেখে কি আমার ভালো লাগে? আমি জানি না, তবে সচেতনভাবে মেয়েটিকে দেখার আগ্রহ আমার হয় নি কখনো। কোনো কোনো দিন ফিরোজা মেয়েটির হাত থেকে। চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে আমার সামনে রাখে, কয়েক ফোঁটা চা ছলকে পিরিচে পড়ে, চামচটি মেঝেতে পড়ে যায়; চামচটি উঠোনোর জন্যে ফিরোজা মেয়েটিকে ডাকতে থাকে। আমার আর চা খেতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু চা আমি খাই; না খেলে একটা ঘটনা ঘটে যাবে, আমি অমন ঘটনায় অংশ নিতে চাই না। বাবাকেও দেখেছি। কদবানের হাতের চা সুখের সাথে খেতে, মা চা নিয়ে এলে বাবার সামনে চা অনেকক্ষণ ধরে পড়ে থাকতো, ঠাণ্ডা হয়ে যেতো; তারপর মা তাড়া দিলে তিনি একবারে চা গিলে ফেলতেন, সেদিন আর চা খেতেন না।

আমার ছোটো বোনটি, ইসমত, একটি সমস্যায় পড়েছে; তাকে আমার উদ্ধার করতে হবে, যদিও উদ্ধার করা অসম্ভব আমার পক্ষে, এসব ক্ষেত্রে কেউ উদ্ধার করতে পারে না। ইসমত আমার ছোটো বোন, ওকে আমি পছন্দ আর অপছন্দ দুটোই করি, ও তার একটার খবরও জানে না; আমি কখনো প্রকাশ করি নি ওকে আমি পছন্দ করি, এও জানতে দিই নি ওকে আমি অপছন্দ করি। এমএ পর্যন্ত ওর আসার কথা ছিলো না, বাবা-মা কেউ চায় নি, তেরো বছর থেকেই ওর বিয়ের চেষ্টা চলছিলো, আমি বাধা। দিয়েছি, ও নিজেও বাধা দিয়েছে। সবাইকে অবাক করে ইসমত এমএ পর্যন্ত চলে। আসে; এবং এমএ পড়ার সময়ই আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলে। ছেলেটা এক ক্লাশ নিচে পড়তো ওর থেকে, তাঁদরও ছিলো বেশ, বিশ্বের সব কিছু সে সবার চেয়ে। বেশি জানতো, কাউকেই পাত্তা দিতো না, আমার সাথে দু-একদিন এমনভাবে কথা বলেছে যেনো আমি ক্লাশ ফোরের ছাত্র। এ-বিয়েতে সবাই খেপে উঠেছিলো ইসমতের ওপর।:আমি খেপি নি। ওর বিয়ে করার ইচ্ছে বা দরকার হয়েছে, ও বিয়ে করেছে, তাতে আমার কী; একটা চাড়ালকেও যদি ও বিয়ে করে থাকে, চাঁড়ালের সাথেই যদি ও ঘুমোতে চায়, তাতে আমি বাধা দিতে পারি না। শরীরটা ওর, জীবনটা ওর। বিয়ে। করাটা দরকারই হয়ে পড়েছিলো ওর জন্যে, নইলে প্রথম ভাগনেটি পিতার পরিচয়। ছাড়াই জন্মাতো, কারো ভালো লাগতো না, ঝামেলা হতো। ইসমত আর তার তাঁদরটি বেশ প্রজননশীল ছিলো, বিস্তৃত হচ্ছিলো তারা তীব্র বেগে, চার বছরেই চার চারটি বাচ্চা জন্মাতে পেরেছিলো; একটা বাচ্চাকে ইসমতের পেটে রেখেই তাঁদরটি এক সন্ধ্যায় খুন হয়ে যায়। খুন হয়ে যাওয়ার পর আমি প্রথম বুঝতে পারি তাঁদরটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

ইসমত ভালো চাকুরিই করে, তবে নিশ্চয়ই ওর কষ্ট হচ্ছে সংসার চালাতে, কিন্তু ও কারো সাহায্য চায় নি; বরং ও-ই সাহায্য করে অনেককে। গ্রাম থেকে আত্মীয়রা এসে আমার বাসায় ওঠে না, হয়তো সাহস করে না, বা স্বস্তি পায় না, এতে আমার ভালোই লাগে; ওঠে ওর বাসায়, এতে আমার কিছুটা খারাপই লাগে। আমি দু-একজনকে আমার বাসায় উঠতে বলেও দেখেছি, তারা এককাপ চা খেয়ে চলে যায়, আর আসে না। একবার আমি অনেক রাত পর্যন্ত একজনের জন্যে না খেয়ে বসে ছিলাম, সে আসে নি; ফিরোজা অবাক হয়েছিলো গ্রামের একটি আত্মীয়ের জন্যে আমার বসে থাকা দেখে। বছর চারেক আগে ইসমত একটি হিন্দু ছেলেকে হিন্দু বলা ঠিক হচ্ছে না মনে হচ্ছে, কেউ কেউ আমাকে সাম্প্রদায়িক ভাবতে পারে-বাসায় জায়গা দেয়; ছেলেটা। আমাদের গ্রামেরই, ওর পিতাকে আমি মাছটাছ বিক্রি করতে দেখেছি, মদনকুমার না। হরিপদ নাম ছেলেটার, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলো, কিন্তু অত্যন্ত চৌকশ ছেলে সে। এর বেশি সংবাদ আমি রাখি না, তবে শুনি মদন নাটকটাটক করে খুব নাম করেছে, এক পত্রিকায় আমি তার সাক্ষাৎকারও পড়েছিলাম। অভিনয় যে এখন এতো শ্রদ্ধেয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমার জানা ছিলো না, মদনকুমারের সাক্ষাৎকার পড়েই আমার চোখ। খুলে যায়; ফেলটেল করা বাউণ্ডুলেরাই এসব করে বলে আমি জানতাম, ওর সাক্ষাৎকার পড়ে বুঝতে পারি অভিনয় আজকাল শ্রেষ্ঠ প্রতিভারাই করেন। তাই হবে, এ পর্যন্ত কেউ আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসে নি। ছোঁকরাকে মনে মনে আমি একটু ঈর্ষাও করি। ইসমত ছোঁকরাকে বিয়ে করছে শুনে আমি উত্তেজিত হই নি, ভালোই লাগছিলো, আমরা তো আর ব্রাহ্মণ নই; মা কিছুটা উত্তেজিত হয়েছিলো; কিন্তু ইসমত যা করতে চায়, তা সে করে। ইসমতের একটি পুরুষ দরকার ছিলো, ছোঁকরার একটি থাকাখাওয়ার জায়গার দরকার ছিলো, আমি আপত্তির কিছু দেখি নি। ছোঁকরা দেখতে। বেশ, ইসমতের প্রথম তাঁদরটার থেকে অনেক বেশ, গজারমাছের মতো, বয়সে বছর দশেকের ছোটো; ইসমত নিশ্চয়ই সব কিছু পরখ করেই নিয়েছে। খোকাও হয়েছে। একটি বছর দুয়েক আগে, কিন্তু ইসমত এখন একটু সমস্যায় পড়েছে।

দাদা, একটু বাধা দাও এতে, ইসমত খুব আবেগের সাথে বলে আমাকে, কেঁদেও। ফেলতে পারে বলে মনে হচ্ছে। ইসমতকেও এতোটা বিহ্বল হতে আমি আগে কখনো দেখি নি; তাঁদরটা খুন হয়ে যাওয়ার পরও ইসমত এতোটা কাতর হয় নি।

আচ্ছা, দেখি, আমি বলি, আজই দেখছি।

তোমার সাথে তো মেয়েটির আম্মার পরিচয় আছে, তুমি তার সাথে একবার কথা বলো, ইসমত বলে, মদন এতোটা বিশ্বাসঘাতক হবে আমি কখনো ভাবি নি। গলা ধরে আসতে চাচ্ছে ইসমতের, খুব কষ্ট পাচ্ছে, আরো কষ্ট পাবে ইসমত।

তুই জানতি না আগে? আমি বলি।

এসব ব্যাপারে বউই জানে সবার পরে, ইসমত বলে, এখন দেখি সবাই জানে। অনেক আগে থেকে, শুধু আমি ছাড়া। ইসমতকে বেশ অভিজ্ঞও মনে হচ্ছে। অবাক লাগছে, আমাকে একবারও কেউ বলে নি।

মদনকুমার কয়েক দিন ধরে ইসমতের বাসায় আসছে না। আগে মদন দুপুরে আসতো না, তাতে ইসমতের কোনো সন্দেহ হয় নি। কিন্তু রাতে না আসায় ইসমত প্রথমে ভয় পায়, পরে খবর পায় মদন একটি তেলতেলে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে অন্য এক বাসায় উঠেছে। ইসমত বেশ কষ্ট পাচ্ছে, মেয়েটি বাচ্চা বলে বেশি কষ্ট পাচ্ছে, বুড়ি হলে এতো কষ্ট পেতো না, হঠাৎ ইসমত নিজেকে বুড়ি ভাবছে, ইসমতের মুখে প্রতারিতের অপমানিতের মুখ দেখতে পাচ্ছি। মেয়েটির মায়ের সাথে আমার পরিচয় আছে। মেয়েটির বাবা আমাদের ফার্মেই ছিলেন, তাঁর কাছে ব্রিজের অনেক কিছু আমি। শিখেছি, কয়েক বছর আগে হঠাৎ হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে ব্রিজট্রিজ ফেলে রেখে চলে। গেছেন। মেয়েটিকেও আমি চিনি, আমি বুঝতে পারছি ইসমতকে উদ্ধার করতে আমি পারবো না, কেউই পারবে না, ইসমতের ধসে পড়া ব্রিজ আমি সারাই করতে পারবো না; ওই মেয়েকে ছেড়ে মদন ইসমতের কাছে ফিরবে না। দেশ খুব সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছে, দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু মদন দেখছি একটির পর একটি মুসলমান মেয়েকে নিকে করে চলছে। মেয়েটির নামও আমার মনে পড়ছে, তিলোত্তমা, ইসমতই মনে করিয়ে দেয়। মেয়েটি আমার কোলেও দু-একবার বসেছে। ফয়েজ সাহেবের বাসায় আমি বেশ কয়েকবার গেছি, মেয়েটি তখন মাধ্যমিকে পড়ে হয়তো, খুব ঝলমলে, উপচে পড়ছে সব কিছু। সে এসেই কোলে বসতো, জড়িয়ে ধরতো। আমি অস্বস্তি বোধ করতাম, উত্তাপও; ফয়েজ সাহেব কিছু মনে করতেন না, তবে আমি যে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছি তাতে তিনি অস্বস্তি বোধ করতেন।

ভাবী, আমি মাহবুব বলছি, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি ফয়জুন্নেসা ফয়েজকে ফোন করি, আপনার সাথে আমি একটু দেখা করতে চাই।

আমার সাথে আজকাল আর কে দেখা করে, ফয়জুন্নেসা ফয়েজ একটু শ্বাস একটু ক্ষোভ মিলিয়ে বলেন, আমার কি সেই দিন আছে!

দুঃখিত ভাবী, আপনার কথা প্রায়ই মনে পড়ে, কিন্তু সময় করে উঠতে পারি না, আমি একটু বিনয়ের ভাব করি।

বিনয়ের দরকার নাই, আসতে চাইলে এখনই আসেন, ফয়জুন্নেসা ফায়েজ বলেন, আজকাল আর এই সব দ্রতা ভালো লাগে না।

আমি আসছি, ভাবী, বিব্রত হয়ে আমি টেলিফোন রাখি।

ফয়জুন্নেসা ফয়েজ বাসায় একলাই আছেন। কয়েক বছরে বেশ বয়স হয়ে গেছে। তাঁর; তবে ঠোঁট এখনো আগের মতোই লাল, বাহু আগের মতোই ভোলা, পেট এখনো আগের মতোই আকর্ষণীয়। ফয়েজ সাহেবের তিনি দ্বিতীয়, আর ফয়েজ সাহেব তার তৃতীয়।

মদন নামের একটি ছেলেকে, আমি কথা শেষ করতে পারি না।

মদ্‌না, দি বাস্টার্ড, ফয়জুন্নেসা ফয়েজ বলেন, আপনি ওই বাস্টার্ডটার পক্ষে কথা বলতে এসেছেন? খুব উত্তেজিত ফয়জুন্নেসা ফয়েজ।

না, ভাবী, আমি কথা বলতে এসেছি মদনের বিপক্ষেই। মদনের সাথে আমার ছোটো বোনের বিয়ে হয়েছিলো, আমি বলি, একটি বাচ্চাও আছে।

আমি জানতাম বাস্টার্ডটা বিয়ে করেছে, একটি মুসলমান মেয়েকেই করেছে, সে যে আপনার বোন, তা জানতাম না। বাস্টার্ডটাকে আমি পছন্দই করতাম, সে বলতো সে আমাকে পছন্দ করে, বলতো আমার জন্যেই এ-বাসায় আসে, আমি বিশ্বাস করতাম। তার বউ আছে এটা কোনো সমস্যাই ছিলো না, বাস্টার্ডটাকে ভাগানোর কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। আমি চেয়েছিলাম মাঝেমাঝে সঙ্গ।

আপনি মনে হয় ভুল করেছিলেন, আমি বলি।

ভুল করেছিলাম, তবে ভাগ্য ভালো মেনোপজটা অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো, নইলে একটা ঝামেলা হতো। ফয়জুন্নেসা ফয়েজ বলতে থাকেন, হারামজাদার বাচ্চা দুপুর হলেই এখানে চলে আসতো, খেতো এখানেই, তিলোত্তমা ওকে জড়িয়েটড়িয়ে ধরতো, কিন্তু রিলেশনটা ছিলো আমার সঙ্গেই। খেপে ওঠেন। ফয়জুন্নেসা ফয়েজ।

এখন কী করা যায় বলুন, একটা কিছু করা দরকার, আমি বলি।

কিছু করতে পারলে আমি নিজের জন্যেই করতাম, ফয়জুন্নেসা ফয়েজ বলেন, তিলোত্তমা চার মাসের প্রেগন্যান্ট, আমিও দেড় বছরের প্রেগন্যান্ট হতে পারতাম মেনোপজটা না হলে।

আমার বোনটি ভেঙে পড়েছে, আমি বলি, ওও মদনকে বিশ্বাস করতো।

আমি কি কম ভেঙে পড়েছি মনে করেন? ফয়জুন্নেসা ফয়েজ বলেন, মদনের সাথে দুপুরগুলোর কথা কি আমার মনে পড়ে না? মেয়ের কাছে হেরে যেতে আমার কষ্ট লাগে না? ও আমার অভ্যাসই বদলে দিয়েছিলো, রাতের বদলে দুপুর। খুব দক্ষ ছিলো মদন।

আমি কথা হারিয়ে ফেলি, শুধু বুঝতে পারি ইসমতকে আমি উদ্ধার করতে পারবো না।

ফয়জুন্নেসা ফয়েজ বলেন, তিলোত্তমার কাছে আমি দাঁড়াতে পারি না, তার যৌবন আছে, আপনি তো তাকে দেখেছেন, মদনা তিলোত্তমাকে রেখে আপনার বোন বা আমার কাছে ফিরে আসবে না।

দেয়ালে তিলোত্তমার ছবিটার ওপর আমার চোখ পড়ছে বারবার, আমি তার সাথে একমত; আমি যদি মদন হতাম তাহলে কি ফিরতাম, দেয়ালের ওই ছবিটি যার, তার শরীরটি ফেলে কি পাঁচপাঁচটি বাচ্চার মায়ের শরীরের কাছে ফিরতাম? মদনকে জেলে পাঠাতে পারি, হয়তো পাঠাতেও হবে, তবে মদন আনন্দে জেলে যাবে, জেলে যেতে তার কষ্ট হবে না, সুখই লাগবে, বেরিয়ে তিলোত্তমার কাছে যাবে তিলোত্তমা যতো দিন। তিলোত্তমা আছে, তারপর অন্য কোথাও যেতে পারে, কিন্তু তার আগে যাবে না, আমিও যেতাম না।

ফয়জুন্নেসা ফয়েজ বলেন, আপনার বোনের একটি পুরুষ দরকার, আমারও একটি পুরুষ দরকার, আমি এখনো বাতিল হয়ে যাই নি। পুরুষ আমি পাবো, পেতেই হবে আমাকে, রাস্তাঘাটে পুরুষের অভাব নেই, কুত্তার মতো ঘুরছে তারা, কিন্তু মদনার মতো একটা ছোঁকরা পাবো কি না জানি না।

আমাকে উঠতে হবে, ইসমতকে আমি উদ্ধার করতে পারবো না, কাউকেই পারবো না। উদ্ধার করার কথা ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে, আমি হয়তো সুস্থ নই, নইলে এমন নিরর্থক কাজের ভার আমি নিলাম কী করে? ইসমতের একটি পুরুষ লাগবে, ইসমতকে একটি পুরুষ নিজেই খুঁজে নিতে হবে, তা ইসমত পারবে; ইসমত চাইলে ইসমত পারে, কিন্তু মদনকে সে পাবে না। মনে হচ্ছে মদনকে ইসমত ফিরে পেতে চায়, এখানেই আমার একটু কষ্ট হচ্ছে, যে ফিরে পেতে চায় সে ভিক্ষুক, ইসমত এখন ভিক্ষুক, আমার কষ্ট হচ্ছে, মদনকে ফিরে পেতে চায় ইসমত, হয়তো তার ঘুম হয় না। কাউকে ফিরে পেতে চাওয়ার মধ্যে গভীর যন্ত্রণা আছে, ইসমত সে-যন্ত্রণার মধ্যে আছে। পরিত্যাগ করা বেশ সুখকর; যে পরিত্যাগ করে, সে ফেলে যায় বাসি মাল, যে-বাসি মাল তার আর রোচে না, সে আরো টসটসে কিছু পেয়েছে, তার স্বাদ তীব্র, সে কোনো অভাববোধের মধ্যে থাকে না; ইসমত এখন বাসি বস্তু, মদনের অখাদ্য, এখন চরম অভাববোধের মধ্যে রয়েছে ইসমত, আর ফয়জুন্নেসা ফয়েজ; তাদের কাউকেই আমি উদ্ধার করতে পারবো না। আমাকে এখন উঠতে হবে।

আপনি মাঝেমাঝে দুপুরবেলা আসতে পারেন, ফয়জুন্নেসা ফয়েজ বলেন।

ধন্যবাদ ভাবী, আসতে চেষ্টা করবো, কিন্তু আমি বেশ ব্যস্ত থাকি, আমি বলি।

তার মানে আমার শরীরে আপনার চলবে না, উত্তেজিত হন ফয়জুন্নেসা ফয়েজ, আপনার তরতাজা শরীর দরকার, পুরুষদের আমি ভালোভাবেই চিনি। তিলোত্তমা যদি আসতে বলতো তাহলে আপনার কোনো ব্যস্ততা থাকতো না।

আমি বেরোনোর জন্যে উঠে দাঁড়াই, ফয়জুন্নেসা ফয়েজ উঠবেন না মনে হচ্ছে, আমার তা দরকার নেই। ইসমত অপেক্ষা করে আছে, আমার খারাপ লাগছে ইসমত অপেক্ষা করে আছে, অর্থাৎ আশা করছে আমি তার শান্ত সুবোধ মদনকে ধরে নিয়ে যাবো, মদন তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলবে ভুল হয়ে গেছে, সে আর তিলোত্তমার কাছে যাবে না, তার কাছেই থাকবে, তার কাছেই সে সুখ পায়, অন্য কোথাও পায় না, সে। তিলোত্তমাকে ভালোবাসে না, ইসমতকেই ভালোবাসে। রাতে আবার এক সঙ্গে ঘুমোবে, ইসমত আশা করে আছে, এটাই আমার খারাপ লাগছে। ইসমতের আজকাল ঘুম হচ্ছে না, সে খুব হতাশ হয়ে পড়েছে, নিজেকে বুড়িই মনে করছে; সে যতোবার কথা বলছে মদনকে দোষ দিচ্ছে না, দোষ দিচ্ছে তিলোত্তমাকে, তিলোত্তমা একটি খানকি, সে-ই নিয়ে গেছে তার মদনকুমারকে, মদনকুমারের মতো দুধের শিশুকে, মদনকুমারের কোনো দোষ নেই, সব দোষ তিলোত্তমার। হেরে যাওয়ার কাঁটাটা ধারালোভাবে ঢুকে গেছে ইসমতের ভেতরে, আরেকটি পুরুষ না পাওয়া পর্যন্ত কাঁটাটা গেঁথে থাকবে, ভেতরে পচবে, আরো জ্বালা দেবে, খসবে না। শরীরটিও কষ্ট পাচ্ছে ইসমতের, এমন অবস্থায় শরীর আরো খাই খাই করে, সবখানে ব্যথা করতে থাকে, মনে হতে থাকে কেউ ভেঙে চুরমার করে দিলে শাবল দিয়ে খুঁড়ে তছনছ করে দিলে শান্তি হতো, ইসমতের তেমন হচ্ছে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমি তার কোনো উপকার করতে পারি না।

একটি মানুষের আরেকটি মানুষ দরকার হয়, একটি শরীরের আরেকটি শরীর দরকার হয়, শরীরকে কেউ এড়াতে পারে না; শরীরটি ঠিক থাকলে মনটা ঠিক থাকে, সব ঠিক থাকে। মানুষ বা আমার গোত্রটি অবশ্য শরীরের কথা স্বীকার করতে চায় না, অনেকগুলো মিথ্যে কথা বলে, আর সারাক্ষণ অসুস্থ থাকে। এখন ইসমতকে যদি বলি একটি পুরুষ নিয়ে কয়েক ঘণ্টা চমৎকার সময় কাটিয়ে দে, মদনের কথা আর মনে। পড়বে না, ইসমত আমাকে খুব খারাপ ভাববে, মদনের থেকেও খারাপ ভাববে, কিন্তু আমি জানি ইসমত সেরে উঠবে, রিকশা নিয়ে তাকে ছোটাছুটি করতে হবে না। একবার আমি ফিরোজাকে সারিয়ে তুলেছিলাম, ফিরোজা রোদের মতো ঝরঝরে হয়ে উঠেছিলো, মনেই হয় নি তার জীবনে একটি মারাত্মক দুর্ঘটনা মাত্র কয়েক দিন আগে ঘটে গেছে। ফিরোজা জন্মের পর কোনো শোকের অভিজ্ঞতা বোধ করে নি, সুখ ছাড়া আর কিছুই সে জানে না, সে কোনো মৃত্যু দেখে নি, কখনো কাঁদে নি; কয়েক বছর আগে হঠাৎ ফিরোজার পিতা মারা যান। তাঁর মরার কোনো কথাই ছিলো না।

ভদ্রলোকের অত্যন্ত চমৎকার স্বাস্থ্য ছিলো, সব কিছুতে তীব্র আকর্ষণ ছিলো, নারীও তার বাইরে ছিলো না; আমার খুব ভালো লাগতো ভদ্রলোককে, তিনি ক্লাবে থেকে ফিরেই। টেলিফোন করতে গিয়ে পড়ে যান। কাকে তিনি টেলিফোন করতে চেয়েছিলেন কেউ। জানে না, যন্ত্রটি হাতে নিয়েই তিনি নিচে পড়ে যান; আর ওঠেন নি। তিনি ডায়াল শেষ করে যেতে পারেন নি। ফিরোজার ওই প্রথম শোক আর কান্নার অভিজ্ঞতা। প্রথম কয়েক দিন ফিরোজার কান্না ভালো লাগছিলো আমার;–মেয়েকে, অর্চিকে, জড়িয়ে ধরে কাঁদছে ফিরোজা, নিজের জন্মদাতার জন্যে কাঁদছে, বুক ভরে কাঁদছে, অর্চি বুঝতে পারছে না, তবু কেঁদে ফেলছে, দেখে আমার ভালো লাগছিলো। কান্নায় বাড়িঘর পবিত্র হয়ে উঠছিলো; বাতাস শুদ্ধ হয়ে উঠছিলো। ফিরোজা বালিশ চেপে ধরে কাঁদছিলো কখনো, বালিশটাকে রজনীগন্ধার গুচ্ছের মতো লাগছিলো, পবিত্র শোকের সুগন্ধ উঠছিলো চারদিকে; আবার কখনো টেলিভিশন দেখতে দেখতে কাঁদছিলো, পরিশুদ্ধ হয়ে উঠছিলো টেলিভিশনের সমস্ত আবর্জনা। কেঁদে কেঁদে ফিরোজা রূপসী হয়ে উঠছিল, আমার চোখে তাই লাগছিলো, তার মুখের ত্বক মসৃণ হয়ে উঠছিলো, চোখে সৌন্দর্য ঝলমল করছিলো।

ফিরোজার কান্নায়, দিন দশেকের মধ্যে, আমি বিরক্তি বোধ করতে থাকি, বাসাটিকে আমার স্যাৎসেঁতে লাগে; মনে হতে থাকে সব কিছু ভিজে যাচ্ছে, জানালায় পর্দায়। আলনায় বিছানায় বালিশে মেঝেতে শোকেসে পুতুলের মুখে ময়লা লাগছে; কোনো কিছু ছুঁতেই আমার ঘেন্না লাগতে থাকে। রাতে ঘুমোতে গিয়ে দেখি ফিরোজা কাঁদছে, বালিশ থেকে মাথা তুলতে পারছে না, দিন দশেক ধইে মাথা তুলতে পারছে না সে। প্রথম আমার দ্বিধা লাগছিলো, কোনো শোকার্তকে জড়িয়ে ধরা ঠিক হবে কি না, তার কাপড় পেরিয়ে চামড়া পর্যন্ত পৌঁছোনো ঠিক হবে কি না, ব্যাপারটি বলাকার হয়ে যাবে কি না, আমি একটি অপরাধ করতে যাচ্ছি কি না, এসব দ্বিধা আমাকে বিব্রত করছিলো; কিন্তু। ফিরোজার কান্না সহ্য করা অত্যন্ত অসম্ভব হয়ে উঠছিলো আমার পক্ষে। আরো কান্না সহ্য করতে হলে আমার মাথার ভেতরটা পাথরের মতো নিরেট হয়ে উঠবে, ভারী হয়ে উঠবে, শূন্য হয়ে উঠবে মনে হচ্ছিলো। কিন্তু ফিরোজাকে জড়িয়ে ধরলে আমাকে সে একটা বদমাশ ভাবতে পারে, যে পিতৃবিয়োগাতুর কন্যাকেও রেহাই দেয় না, যার কোনো নৈতিকতা নেই; তবে আমি ফিরোজাকে জড়িয়ে ধরলে সে সাড়া দেয়, তাতে আমি বিব্রত হই, একটি হুক খুলতে পারছিলাম না, কয়েকবার চেষ্টা করার পরও সেটি আটকে থেকে প্রাণপণে দায়িত্ব তার পালন করছিলো, হুক নিয়ে আমি সব সময়ই সমস্যায় পড়ি, আমি খুব অস্বস্তি বোধ করছিলাম ফিরোজাকে পীড়িত করছি ভেবে, কিন্তু ফিরোজা আঙুল দিয়ে সেটি অবলীলায় খুলে দেয়, অন্যান্য খোলার কাজগুলোও সে নিজেই করে, আগে যা সে করতে চাইতো না। ফিরোজার কান্না কমে আসতে থাকে, আমি যতোই অগ্রসর হতে থাকি সে ততোই শোক থেকে উঠে আসতে থাকে, কমতে থাকে স্যাঁৎস্যাঁতে ভাবটি, ফিরোজার দীর্ঘশ্বাসগুলোর আয়তন ও উত্তাপ বদলে যেতে থাকে। আমার ভয় হতে থাকে যে আমি সমাপ্ত হলে ফিরোজা আবার হয়তো কান্নায় ফিরে যাবে, আমার সমাপ্ত হওয়া চলবে না; ফিরোজারও বোধ হয় একই ভয় হতে থাকে।

কেমন আছো? খুব ক্লান্ত আমি জিজ্ঞেস করি।

ভালো, ফিরোজা বলে, ভালো; তাকে অক্লান্ত মনে হয়।

এবার রাখবো? আমি ভয়ে ভয়ে অনুমতি চাই।

না, না, ফিরোজা বলে, এতো তাড়াতাড়ি না।

ফিরোজা আর কাঁদছে না, মাঝেমাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, তবে সেগুলোর রূপ বদলে যাচ্ছে, রঙ বদলে যাচ্ছে। আমি কোনো অনৈতিক কাজ করছি না, কোনো শোকাতুরের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি না, আমি বরং তাকে শোক থেকে তুলে আনছি। ফিরোজাও বড়ো বেশি চাইছে শোক থেকে উঠে আসতে, তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গ কান্না ভুলে যেতে চাচ্ছে, আমি তাকে পিতৃশোক থেকে উদ্ধার করছি, কোনো অনৈতিক কাজ করছি না। ফিরোজা ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়, ভোরে তাকে ঝরঝরে দেখায়, সে উঠে এসেছে, সে যে গভীর শোকের মধ্যে ছিলো এতো দিন তার কোনো ছাপ তার মুখে আমি দেখতে পাই না।

ফিরোজা আর আমার ব্রিজটি টিকে আছে, হয়তো টিকে থাকবে, একটা সময় এসেছিলো যে ব্রিজটি ভেঙেই পড়ে যাচ্ছিলো, যদিও ভেঙে ফেলার মতো সাহস হয়তো আমার হতো না; আমি সকলের চোখে ভালো থাকতে চাই, ছেলেবেলা থেকেই, ভাঙাভাঙি এখানে কেউ পছন্দ করে না, সবাই ধসে পড়ার পরও ভাব করতে পছন্দ করে যে তাদের ব্রিজের গায় একটিও আঁচড় লাগে নি, ধ্বংসস্তূপের ওপরে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে থাকতে পছন্দ করে সবাই, আমিও করি। তখন অর্চি এসে ব্রিজটাকে রক্ষা করে। অর্চি। যে এসে গেলো এটা খুবই আকস্মিক ঘটনা, কখন ঘটে যায় আমি টেরও পাই নি, ফিরোজা আর আমার মধ্যে যা ঘটতো তখন তা হতো খুবই আকস্মিক আর ক্ষণকালীন, দুজনের কেউই বুঝে উঠতে পারতাম না আমরা কিছু একটা করেছি। অবশ্য একেই, আকস্মিকতা আর ক্ষণকালীনতাকেই, আমি স্বাভাবিক ভাবতাম, এবং আমার ঘেন্নাও ধরে যাচ্ছিলো এর ওপর, তা ওঠা আর নামা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। উত্তেজিত থাকতাম আমি সব সময়, চারপাশে আমি নারীর শরীর দেখতে পেতাম, ব্রিজগুলোর দিকে তাকালে নদীকে গভীর খাপ মনে হতো, ব্রিজকে মনে হতো বিশাল তরবারি। বারবার মনে হতো খাপ আর তরবারির মিল হচ্ছে না, দুটি উল্টোপাল্টা পড়ে আছে। ব্রিজে ওঠার সময় ট্রাকগুলো যে-শব্দ করে, তাকে আমার গভীর ক্লান্তির শব্দ মনে হতো। ফিরোজা আর আমি তখনো একই বিছানায় ঘুমোতাম, কিন্তু পরস্পরকে ছুঁতে ইচ্ছে হতো না; ফিরোজা একবার খুব হতাশ হয়ে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে বলেছিলো, না, তুমি ঠিক মতো পারো না, আমার তা মনে হতো বারবার; কে পারে, কে পারে, এমন সব প্রশ্ন জাগতো। ওই অবস্থায়ই অর্চি এসে ব্রিজটাকে টেনে ধরে রাখে।

না পারা এক ধারাবাহিক জ্বরের মতো কাজ করে, আমি ওই জ্বরে বছরের পর বছর ভুগেছি, আমার সে-সময়ের সমস্ত কাজে তার ছাপ লেগে আছে। সমস্ত কিছুর ওপর আমার লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হতো তখন; চোখের সামনে যা কিছু পড়তো আমি চোখ দিয়ে, মনে মনে জিভ দিয়ে, চুষতাম। মাওয়া সড়কে কয়েকটি ব্রিজ আমি দেখাশোনা। করছিলাম, সেখানে পাথর ভাঙতো যে-মেয়েরা তাদের দু-তিনটিকে আমি দূর থেকে, জিপের জানালা দিয়ে, আমার চোখ দিয়ে চুষতাম। ওরা আমাকে পছন্দই করতো, আমি গেলেই সামনে এসে দাঁড়াতো, জিপের সামনে এসে দাঁড়াতো কখনো, আমি মনে মনে শোষণ করতাম, তারা কেউ তা জানতো না। আমার প্রতিটি লোমকূপ তখন শোষণের কৌশল শিখেছিলো। তারা কেউ যদি আমাকে ডাকতো, আমি সাড়া দিতে পারতাম না; প্রকৃতিকে ধন্যবাদ, তারা কেউ আমাকে ডাকে নি। কিন্তু মনে মনে আমি তাদের। বারবার, দিনে দুপুরে সন্ধ্যায় মধ্যরাতে ঘুমের ভেতরে ঘুমের বাইরে, উপভোগ করেছি। একটি মিশমিশে কালো মেয়েকে আমার কালো আগুনের মতো মনে হতো, তার শরীর থেকে কালো শিখা উঠছে আমি দেখতে পেতাম, ফিরোজার পাশে শুয়ে আমি ওই মেয়েটিকে রাতের পর রাত জড়িয়ে ধরেছি, তার পায়ের পাতা থেকে শুরু করে তার প্রতিটি স্প্যান প্রতিটি ভিত্তিকূপ লেহন করেছি। তার দুটি পুরু ঠোঁট ছিলো, ফিরোজার তিনটি ঠোঁট জোড়া দিলেও অতোখানি হবে না; কথা বলার সময় হলদে রঙের একটি প্রচণ্ড জিভ বেরিয়ে আসতো তার মুখের ভেতর থেকে, মনে হতো একটা গোখরো বেরিয়ে আসছে তার গহ্বর থেকে। তাকে দেখলেই আমার মনে হতো একটি কয়লার পাহাড়ে আগুন লেগেছে, তার তাপ আমার মাংসে এসে লাগতো। আরেকটি মেয়ে ছিলো লাউয়ের ডগার মতো, ছেলেবেলায় আমি জাংলায় লাউয়ের ডগা দুলতে দেখেছি, ওই মেয়েটিকে দেখলে আমি জাংলাভরা লাউডগা দেখতে পেতাম; চারপাশ সবুজ মনে। হতো। আমি তাদের কথা ভুলে গেলেও হঠাৎ তারা আমার রক্তে এসে প্রবেশ করতো। একবার ডেন্টিস্টের চেয়ারে শুয়ে আমি কাতরাচ্ছিলাম, আর সহ্য করতে পারছিলাম না, তখন ওই মেয়ে দুটিকে আমি দেখতে পাই; তারা পাথর ভাঙছে, দেখতে পাই কালো আগুন জ্বলছে, লাউডগা লকলক করছে; আমার যন্ত্রণা কমে আসে, আমার কেমন যেনো লাগতে থাকে, রক্ত ঘোলা হয়ে উঠতে থাকে, ডেন্টিস্ট যখন দাঁত তুলছিলো আমি এক প্রচণ্ড পুলকে চেয়ার উল্টেপাল্টে দেয়ার উপক্রম করি। ডেন্টিস্ট বিব্রত হয়ে বলেন, আমি খুব দুঃখিত, আমি খুব দুঃখিত; কিন্তু আমি তখন চোখ আর মেলতে পারি নি।

ফিরোজা ঘরে বসে পচতে পছন্দ করে; একটা কলেজে সে পড়াতো বিয়ের আগে, বিয়ের পরেই ছেড়ে দেয়, কারণ ভবিষ্যতে তো ছেড়ে দিতেই হবে, সংসার দেখতে দেখতেই তার সময় কেটে যাবে; চাকুরি তার ভালো লাগে না। চাকুরি তার জন্যে জরুরি নয়, সেখান থেকে যা পাবে তাতে তার তেলের খরচও উঠবে না। বিয়ের পর কিছু দিন ধরে আমি অবশ্য একটা জোকের মতো লেগেছিলাম তার শরীরে; অসভ্য। কাজের পর অসভ্য কাজ করে সাধ মিটছিলো না আমার, ফিরোজারও অনেকটা। ফিরোজার শরীরটিকে আমার কাছে একটি বিস্ময়ের মতোই লেগেছিলো, তবে প্রতিবার অসভ্য কাজ করে আমি যেনো প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম কারো ওপর, হয়তো রওশনের। ওপর, মনে মনে বলছিলাম, দেখো, আমি এখন অসভ্য কাজ করছি, আমি ফিরোজার শরীর দেখছি, ঘূচ্ছি, তার ভেতরে যাচ্ছি, তার ওপর ঘুমিয়ে পড়ছি, রওশন তুমি এখন কোথায়! কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ফিরোজা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

এসব আমার আর ভালো লাগে না, ফিরোজা বালিশ জড়িয়ে ধরে বলে, ঘুমোতে ভালো লাগে আমার এর চেয়ে, আমাকে ঘুমোতে দাও।

আমি হাত সরিয়ে নিই, দু-চার দিনের মধ্যে আর হাত বাড়াই না; বাড়াতে গেলেই আমার দ্বিধা লাগে, সাত-আট দিনের মধ্যে আর হাত বাড়াই না; বাড়াতে গেলেই দ্বিধা লাগে, দশ-পনেরো দিনের মধ্যে আর হাত বাড়াই না। ফিরোজা সুখে ঘুমোতে থাকে। ফিরোজা কেনো এতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, তার কেনো ভালো লাগছে না? আমি কি পারছি না? আমি কি শুধুই বিরক্ত করি?

এই শোনো, আমি ডাকি, একটি রারার নামাবো?

ইচ্ছে হলে নামাও, ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে বলে ফিরোজা, বেশি বিরক্ত কোরো না।

বাক্স থেকে একটি রাবার নিয়ে এসে দেখি সম্পূর্ণ ঘুমিয়ে পড়েছে সে, আমিও শীতল হয়ে পড়েছি, সাপের রক্তের মতো ঠাণ্ডা আমার রক্ত; এখন আমাকে দশ হাজার ফিরোজা ডাকলেও আমি সাড়া দিতে পারবো না। বাথরুমে গিয়ে ফ্লাশ করে আমি রাবারটির ভার থেকে মুক্ত হই।

কলেজের কাজটি ফিরোজা ছেড়ে দিয়েছিলো আগেই। এখন তার আছে কর্মহীন সুখ, ঘুম, বেড়ানো, শাড়ির দোকান, বাপের বাড়ি, এই যাওয়া এই ফিরে আসা, আর। আমাদের ক্ষণিক আকস্মিক ক্লান্তিকর পরস্পরপীড়ন।

অধ্যাপনাটা তুমি না ছাড়ালেও পারতে, আমি কখনো বলি।

ওসব আমার ভালো লাগে না, ফিরোজা বলে, পড়ানোটড়ানো ভালো লাগে না।

শুনেছি মেয়েদের কলেজে না পড়ালেও চলে, মাঝেমাঝে গেলেই হয়, আমি বলি, তুমিও মাঝেমাঝে যেতে পারতে, অন্তত নতুন শাড়িগুলো দেখাতে পারতে মেয়েগুলোকে, ওরা ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত হতে পারতো।

তোমার বউ অধ্যাপিকা তুমি বলতে পারতে সকলকে, ফিরোজা বলে, বেশ লাগতো, কিন্তু আমার একদম ভালো লাগে না।

তুমি ঠিক ধরেছো, আমি বলি, আমাদের এক আইএ ফেইল ঠিকাদারের একটি ডক্টরেট বউ আছে, ইকোনোমিক্সে পিএইচডি, ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়; ঠিকাদার হতে ইচ্ছে করে।

তুমিও একটি ডক্টরেট বিয়ে করলে পারতে, ফিরোজা বলে, ইঞ্জিনিয়ার আর পণ্ডিতে বেশ মিল হতো।

তখন একথা মনে পড়ে নি, আমি বলি।

তুমি বউটিকে দেখেছো? ফিরোজা জানতে চায়।

না, আমি বলি, তবে বউটির কথা আমি মাঝেমাঝে ভাবি।

অন্যের বউয়ের কথা ভাবাই তো তোমাদের কাজ, ফিরোজা বলে, কী ভাবো তুমি তার সম্বন্ধে?

ডক্টরেট বউটি আইএ ফেইল ঠিকাদারটির নিচে কীভাবে শোয়? আমি বলি।

শোওয়া ছাড়া আর তোমার কথা নেই, ফিরোজা বলে।

আমি আর কথা বলি না। ফিরোজা বেশ মোটা হচ্ছে, সে যে সুখে আছে তার পরিচয় তার মাংস ঠেলে বেরোতে চাচ্ছে, আমার সন্দেহ হচ্ছে তার মগজেও মাংস জন্মাচ্ছে। আমি তাকে একটু ভয়ই পাচ্ছি মনে হচ্ছে, তাকে আমি এমন কিছু বলি না। যাতে মনে হয় আমি ভালো নেই, সব ঠিক আছে এটা আমি দেখাতে চাই। আমি ব্রিজ তৈরি করি, আমার ব্রিজ ভেঙে পড়ছে এটা কেউ জেনে ফেলুক আমি তা চাই না। ফিরোজার আমাকে বেশ বিব্রত করে মাঝেমাঝে।

তোমার অফিসে আজ দশ বারো বার ফোন করেছি, ফিরোজা দুপুরে খাওয়ার সময় বলে, একবারও পেলাম না।

অফিসে ফোন লেগেই আছে, আমি বলি, কারো না কারো সাথে কথা বলছিলাম হয়তো, তাই অ্যানগেইজড ছিলো।

কাজের ফোনে তো বেশি সময় লাগার কথা নয়, ফিরোজা বলে, অকাজের আলাপেই বেশি সময় লাগে।

তুমি কি মনে করো আমি অকাজের আলাপ করি ফোনে? আমি বলি।

আমার তো তাই মনে হয়, ফিরোজা বলে।

আমিও তো মাঝেমাঝে বাসায় লাইন পাই না, আমি বলি, তুমিও কি অকাজের আলাপ করো?

ফিরোজা চুপ করে যায়, আমার আর খেতে ইচ্ছে করে না; দুপুরে একটু বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছে ছিলো, এখন আর ইচ্ছে করে না; খাওয়ার পরই অফিসে ফিরে যাই। আমি হেসে উড়িয়ে দিতে পারি না ফিরোজার কথাগুলো, আমি আজ মিসেস রহমানের সাথে একটু বেশিক্ষণ ধরেই কথা বলছিলাম, বলতে ভালো লাগছিলো, অনেক দিন আমি মন। খুলে কথা বলি নি। ফিরোজার সাথে মন খুলে কথাই হলো না কখনো, রওশনের সাথে সেই কবে বলেছিলাম। মাহমুদা রহমান দু-তিন সপ্তাহ ধরে ফোন করছেন, একটু একটু করে আমাদের আলাপ বাড়ছে, তার কথা শুনতে ভালো লাগছে আমার। তিনি কি হাফিজুর রহমানের সাথে এমন মধুর মিষ্টি করে কথা বলতেন, যেমন আমার সাথে বলেন? আমরা কি সবাই বন্ধনের বাইরে গেলে মধুর হয়ে উঠি, তেতো হয়ে উঠি। বন্ধনের মধ্যে? মাহমুদা রহমান, আমার মনে হয়, গত দেড় দশক এমন মধুরভাবে কথা বলেন নি, যেমন আমিও বলি নি। হাফিজুর রহমান আমার সহকর্মী ছিলেন, মাসছয়েক আগে সৌদি আরব চলে গেছেন, তাঁর বিদায়ের পার্টিতে আমরা গিয়েছিলাম, ফিরোজাও ছিলো। এ-মাসেই মাহমুদা রহমান আমাকে ফোন করেন, খুব একটা দরকারে, হাফিজুর রহমান আল মদিনা থেকে আমারই সাহায্য নিতে বলেছেন, আমি তাকে সাহায্যও করেছি, সাহায্য করতে অনেক দিন পর আমার ভালো লেগেছে। মাহমুদা রহমান প্রতিদিনই একবার ফোন করেন। খুব অদ্ভুত লাগছে আমার যে তার ফোন। পেতে আমার ইচ্ছে করে, আমার ব্যক্তিগত নম্বরটিও আমি তাকে দিয়েছি, তিনি দশটা বাজলেই বেজে ওঠেন। ওই সময় আমি আমার ঘরে কাউকে দেখতে পছন্দ করি না। তিনি খুব নিঃসঙ্গ বোধ করেন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত, এ-সময়টাতে তাঁর কন্যা দুটি ইস্কুলে থাকে, ইস্কুলে দিয়ে এসেই তার নিঃসঙ্গ লাগতে থাকে, আমাকে ফোন করে তাঁর মনে হয় তিনি নিঃসঙ্গ নন। আমারও তাই মনে হয়, মনে হয় আমিও নিঃসঙ্গ নই। অনেক বছর পর আমার ভালো লাগছে তুচ্ছ কথা, সামান্য কথা, নিরর্থক কথা।

হ্যালো, আমি রিসিভার তুলি।

হ্যালো, আমি, ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে, তিনি একক হয়ে উঠছেন।

অপেক্ষা করছিলাম, আমি বলি।

কার? মাহমুদা রহমান বলেন।

আপনিই বলুন, আমি বলি।

বলতে সাহস হয় না, তিনি বলেন, হাসেন, হাসির শব্দ শোনা যায়। আমি হাসি শুনতে থাকি, তিনি বলেন, আজ আসবেন?

ইচ্ছে হচ্ছে, আমি বলি।

তবে সময় হবে না, তিনি বলেন, তাহলে একটু বেশি করে কথা বলুন।

কেনো? আমি বলি।

আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে ভালো লাগে, তিনি বলেন, আপনি কি গান গাইতেন, বা কবিতা লিখতেন? তিনি বলেন।

গান গাই নি কখনো, তবে একবার কবিতা লিখেছিলাম, আমি বলি।

কী নিয়ে লিখেছিলেন? তিনি বলেন।

আর্কিটেকচারের ওয়াজেদা মনসুরকে নিয়ে লিখেছিলাম, আমি বলি।

এখন কাউকে নিয়ে লিখুন না, তিনি বলেন।

আমি আসতে চাই, আমি বলি।

এখনই, তিনি বলেন।

একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমাদের, আমি একটা মুক্তির স্বাদ পাই, আমার চামড়ার তলে যে-জ্বরটি আমাকে পোড়াচ্ছিলো, সেটি ছেড়ে যায়; মাহমুদা রহমানকেও মুক্তির। স্বাদে বিভোর চঞ্চল মনে হয়। তার শরীরটি এতো দিন যেনো একটা ময়লা ডোবায় ডোবানো ছিলো, সেখান থেকে উঠিয়ে সেটিকে ঝকঝকে করে মাজা হয়েছে, তার ভেতর থেকে একটা দ্যুতি বেরোচ্ছে। প্রথম যেদিন সাড়ে দশটায় আমি তার উদ্দেশে। বেরোই আমার মনে হচ্ছিলো সবাই আমাকে দেখছে, ড্রাইভার ভেবেছিলো আমি মাওয়া সড়কে যাবো; সে একটু অবাক হয়, কিন্তু বিচলিত হয় না যখন আমি তাকে। লালমাটিয়ায় যেতে বলি। হাফিজুর রহমানের বাসা তারা অচেনা নয়, অফিসের গাড়ি নিয়ে সে বহুবার ওই বাসায় গেছে। আমরা একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। আমি কি। মাহমুদা রহমানকে ভালোবাসি, মাহমুদা রহমান কি আমাকে ভালোবাসেন? প্রশ্নটিকে অবান্তর মনে হয় আমার, আমাদের সম্পর্কটাকে ওই আবেগের থেকে অনেক বেশি মনে হয় আমার; আমরা একে অন্যকে মুক্তি দিয়েছি, এটা অনেক বড়ো প্রেমের আবেগ আর বিবাহের স্কুল প্রথা থেকে। আমরা কি কয়েক ঘন্টা টেলিফোনে বা মুখোমুখি বসে কথা বলে মুক্তি পেতে পারতাম, যদি না মুক্ত হতো আমাদের শরীর? মনের মুক্তির জন্যে। শরীরের মুক্তি দরকার। মাহমুদা রহমানের শরীরটিকে যেদিন আমি প্রথম সম্পূর্ণ দেখি এক অলৌকিক অনুভূতি হয় আমার, চোখের সামনে থেকে একটি পর্দা সরে যায়, আমি দেখি সুন্দরকে। এ-শরীরের সাথে জড়িত হওয়ার জন্যে আমার কি ভালোবাসা। দরকার এ-শরীরের অধিকারীকে? এমন প্রশ্ন আমার মনে জাগে; এবং মনে হতে থাকে এ-শরীর, নারীর শরীর স্বভাবতই সুন্দর, এর সাথে জড়িত হওয়ার জন্যে জন্মজন্মান্তরের। ভালোবাসা দরকার নেই, দরকার নেই কোনো পূর্ব-আবেগ, দেখামাত্রই একে ভালোবাসা যায়, জড়িত হওয়া যায় এর সাথে। আমি জড়িত হয়ে পড়ি, আমরা জড়িত হয়ে পড়ি। মাহমুদা রহমানের সাথে যদি আমার বিয়ে হতো, বা যদি তাকে এখন আমি বিয়ে করি, তাহলে আমরা পরস্পরের কাছে যা পাচ্ছি, পরস্পরকে যা দিচ্ছি, তা কি পেতাম, তা কি দিতাম, তা কি পাবো, তা কি দিতে পারবো? আমরা দুজনের কেউই বিয়ের কথা ভাবি না, দুজনেই আমরা তা পরখ করে দেখেছি।

আমি আপনার উপপত্নী, তিনি হেসে বলেন।

আমি চমকে উঠে বলি, কেনো?

নিজেকে উপপত্নী ভাবতে ভালো লাগছে, তিনি বলেন, পত্নীর থেকে ভালো।

কারো উপপতি হতে আমার ভালো লাগবে না, আমি বলি, আমি পতি আর পত্নীর সম্পর্কের বাইরে থাকতে চাই।

তাহলে আমাদের সম্পর্কটি কী? তিনি বলেন, প্রত্যেক সম্পর্কেরই একটি নাম থাকা দরকার।

আমি নামহীন সম্পর্ক চাই, আমি বলি।

আমি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম, ফিরোজা বলেছে আমি ঠিক মতো পারি না, এখানেও পারবো না, মাহমুদা রহমানও বিরক্ত হয়ে উঠবেন, আমাকে আর। টেলিফোন করবেন না, অন্য কাউকে করবেন, এমন একটি ভীতি আমার ছিলো। আমাকে পারতে হবে, এ-ব্রিজটির ভিত্তিকূপ শক্তভাবে স্থাপন করতে হবে আমাকে, যাতে কোনো বন্যায় ভেসে না যায়। আমি বিস্ময়করভাবে দক্ষ হয়ে উঠি, নদীর ওপর ব্রিজ বাঁধতে যেমন তেমনি শরীরের সাথে ব্রিজ বাঁধতে; আমার মনে হতে থাকে আবেগ হচ্ছে বন্যার মতো, তার কাজ কাঠামোর ওপর আকস্মিক অভাবিত চাপ প্রয়োগ করা, যার জন্যে কাঠামোটি প্রস্তুত নয়, তার কাজ কাঠামোকে বিপর্যস্ত করা; সম্পর্কের কাঠামোর বেলাও তা সত্য, তাই আবেগের সমস্ত চাপকে পরিহার করতে হবে। আমাকে হতে হবে দক্ষ প্রকৌশলী, কুশলী স্থপতি; নিরুত্তাপ, ঠাণ্ডা, লক্ষ্যের দিকে স্থির। আমি তা-ই হয়ে উঠি। আগে আমার ধারণা ছিলো শরীরের সাথে শরীরের সম্পর্ক একটি প্রত্যঙ্গের সাথে আরেকটি প্রত্যঙ্গের সম্পর্ক, এখন আমি আবিষ্কার করি ওই সম্পর্ক একটির নয়, সর্বাঙ্গের, যা ফিরোজার সাথে আমার হয় নি, হবে না কখনো। ফিরোজার সাথে আমার যে-সম্পর্ক, আমরা যে বিবাহিত, এটাকেও আমার একটি বাধা মনে হয়; বিবাহ সব কিছু খুলে ফেলতে দেয় না, একটা সীমার মধ্যে আটকে রাখে। আমাকে। মাহমুদা রহমানের সাথে সে-সীমাটুকু নেই, আমরা সীমাহীনভাবে অসভ্য। হয়ে উঠতে পারি, যা আমি পারি না ফিরোজার সাথে, তার সাথে আমার সভ্য থাকতে হয়। অর্চির সাথে দেখা হচ্ছে না আজকাল। অর্চি, আমার মেয়ে, বিস্ময়করভাবে বেড়ে উঠেছে যে কয়েক বছরে, যাকে দেখলে আমি প্রথম চিনতে পারি না, চিনতে পেরে বিস্মিত হই, তার সাথে এখন আমার দেখাই হচ্ছে না। ওকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। বাসায় ফিরলে দেখি সে রজ্জব স্যারের বাসায় গেছে, নইলে আক্কাস আলি স্যারের বাসায় গেছে, নইলে পন্টু স্যারের বাসায় গেছে, নইলে গোপাল স্যারের বাসায় গেছে, স্যারদের দোকান থেকে মালের পর মাল কিনছে, ওই মাল না কিনলে চলবে না; অংক কেনার জন্যে দৌড়োচ্ছে হাতির পুলে, ইংরেজির জন্যে মগবাজারে, বাঙলার জন্যে আজিমপুরে, ইসলামিয়াতের জন্যে মক্কা না মদিনায়; অর্চি শুধু দৌড়োচ্ছ আর দৌড়োচ্ছে। ফিরোজা হুইশল দিচ্ছে, অর্চি দৌড়োচ্ছে; ফিরোজাও খুব খাটছে। আমার মেয়ে, অর্চি, দৌডুক; অনেক দৌড়োতে হবে ওকে, অনেক ইঁদুর দৌড়ে ওকে অংশ নিতে হবে। আমি যে দেখতে পাচ্ছি না ওকে, ভালোই; ওকে জিততে হবে, আমার চোখের। বাইরে থেকে হলেও ও জিতুক। ওর ঘরে সাধারণত আমি যাই না, ও পছন্দ করে না। ওর ঘরে কেউ যাক। ওর ঘরে গেলে দেখি সব কিছু ছড়িয়ে আছে, বিছানায় টেবিলে মেঝেতে ছড়িয়ে আছে নোংরা কাগজে ছাপা বই নিউজপ্রিন্টের খাতা ইংরেজি হিন্দি গানের ক্যাসেট, আর ও-ও সব সময়ই এলোমলো হয়ে আছে।

সব কিছু এমন ছড়ানো কেনো? আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাই।

ছড়ানো না থাকলে আমি কিছু খুঁজে পাই না, অর্চি বলে, সাজানোগোছানো ঘর আমি সহ্য করতে পারি না, যাচ্ছেতাই নোংরা লাগে।

আমরা তো সব গুছিয়ে রাখতাম, আমি বলি।

তোমরা খুব গেঁয়ো ছিলে, অর্চি বলে, যাও তো আব্বা, কথা বলার আমার একদম সময় নেই।

তোমার কি কিছু লাগবে? আমি আরেকটুকু কথা বলতে চাই।

আহা, আমার কিছু লাগবে না, অর্চি বলে, লাগবে কি না আমার ভাবতে হবে, এখন আমার ভাবার সময় নেই।

আমি আর কথা বলার সাহস করি না, ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, যদিও ওর সাথে। আমার আরো কথা বলার ইচ্ছে করে। অর্চি কী পছন্দ করে, কীভাবে বেড়ে উঠছে, ও কী স্বপ্ন দেখে, কোনো স্বপ্ন দেখে কি না আমি জানি না। ওকে দেখলে মনে হয় ও কেন্দ্রে আছে, ওর বয়সে আমি কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে ছিলাম, কেন্দ্র কোথায় আমি জানতাম না, কেন্দ্রে যেতে হবে তাও কখনো মনে হয় নি, এখনো মনে হয় কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে আছি। অর্চির সাথে কথা বললে প্রতি মুহর্তেই আমি বোধ করি ও আছে কেন্দ্রে, আমি আছি প্রত্যন্তাঞ্চলে। এই সেদিনও এতোটুকু ছিলো, আমার সাথে একটা সম্পর্ক। ছিলো, এখন দশম শ্রেণীতে অর্চি, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক নেই, বা আছে যা আমি বুঝতে পারি না, কোনো দিন পারবো না। অর্চি যখন ছোট্ট ছিলো, আমি ওর সাথে খেলতাম; ও একটা ব্রিজকে জোড়া লাগিয়ে রেখেছে। ওর তখন নিঃসঙ্গ লাগতো। নিজেকে, এখন লাগে না; এখন অন্যের সঙ্গই অসহ্য মনে হয় ওর।

ছোট্ট বয়সে একবার অর্চি আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিলো; সেদিন থেকে আমি, ওর সামনে পাহাড়ের মতো দাঁড়াতে পারি না, আজকাল একেবারেই পারি না। অর্চি আমাকে বলে, আব্বু, এসো আমরা ভাইবোন খেলি; আমি বিস্মিত হয়ে তাকাই, অসহায়ভাবে বলি, এসো, খেলি, কীভাবে খেলতে হবে বলো; অর্চি আমাকে চমৎকার চমৎকার আদেশ দিতে থাকে। সেদিন থেকে আমি আর ওর পিতা নই, ওর থেকে ছোটো কেউ, যাকে অর্চি আদেশ দিতে পারে। তবে অর্চি আমাকে ভাই বলে স্নেহ করেছে অনেক দিন, তারপর ভুলে গেছে; এখন অবশ্য আমার মনে হয় অর্চি আমাকে অমন কিছু বলুক, কিন্তু কিছুই বলে না। ওর দুঃখের কথা, ছোটোবেলায়, বলতো। আমাকে, এখন বলে না; ওর কি দুঃখ নেই, দুঃখের কোনো কথা নেই? ফোরে পড়ার সময় ওর খুব ইচ্ছে হতো ক্লাশের ক্যাপ্টেন হতে, বারবার চেষ্টা করেও হতে পারে নি; ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্যে মাসে মাসে ওর ক্লাশে পরীক্ষা হতো, মন দিয়ে অর্চি পড়তো, পরীক্ষা দিয়ে এসে একটু কষ্টের সাথে বলতো, হতে পারলাম না, আব্বু। ওর কষ্ট দেখে আমার কষ্ট হতো, ভালোও লাগতো এজন্যে যে কষ্টে অর্চি ভেঙে পড়ে নি। ওদের ক্লাশের প্রথম মেয়েটি বারবার ক্যাপ্টেন হতো, তার সাথে পেরে উঠতে না অর্চি, সে-মেয়েটি নিশ্চয়ই খুব মেধাবী ছিলো। একবার অর্চি প্রায় ক্যাপ্টেন হয়েই গিয়েছিলো, কিন্তু ওই মেধাবী মেয়েটি তা মেনে নিতে পারে নি, তাকে ক্যাপ্টেন হতেই হবে। অর্চি খাবার টেবিলে প্রায় কেঁদেই ফেলে, খুব কষ্টে চোখের পানি চেপে রাখে, আমি ওর জন্যে খুব হাল্কা একটু কষ্ট পাই। সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে অর্চি ক্যাপ্টেন হয়ে গিয়েছিলো, আপা ঘোষণাও করে দিয়েছিলো; কয়েক মিনিট ক্যাপ্টেন থেকে খুব সুখ লাগছিলো। অচির। অমন সময় নাশিন, সে-মেধাবী মেয়েটি, অর্চির খাতা জোর করে ছিনিয়ে নেয়, নিয়ে পড়তে থাকে; পড়ে এক সময় লাফিয়ে চিৎকার করে ওঠে, আপা, অর্চি বাঁকা বি লিখতে ভুল করেছে; দৌড়ে মেয়েটি খাতা নিয়ে যায় আপার কাছে। আপা এবার চশমা মুছে চোখে লাগিয়ে দেখতে পায় সত্যিই অর্চি বাঁকা বি লিখতে ভুল করেছে, তাই আপা অর্চির ক্যাপ্টেনের পদ বাতিল করে দিয়ে নাশিনকে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করে। অর্চি কেঁদে ফেলে, আমি শুনে ভয় পাই।

নাশিন কি তোমার বন্ধু? আমি জিজ্ঞেস করি।

হু, অর্চি বলে।

শুনে আমি আরো ভয় পাই, এমন ভয়ঙ্কর বন্ধুদের মধ্যে আছে অর্চি!

নাশিনকে তুমি আর বন্ধু মনে কোরো না, আমি বলি।

আমার যে আর বন্ধু নেই, অসহায়ভাবে অর্চি বলে।

সে তোমাকে কোনো দিন ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিতে পারে, আমি বলি।

তাহলে আমি আর বন্ধু পাবো কোথায়? অর্চি কেঁদে ফেলে।

অর্চি কি আজো ওই বন্ধুদের সাথেই আছে? না কি তার কোনো বন্ধু নেই? সম্পূর্ণ। একাই আছে? ওর ঘরে সব সময় উচ্চ আওয়াজ হয়, মহাজাগতিক গোলমাল চলে, ক্যাসেট বেজেই চলে, ইংরেজি হিন্দি, চিৎকার ওঠে, ওগুলো অর্চি সহ্য করে কেমনে? ও কি আওয়াজের মধ্যেই থাকতেই পছন্দ করে, ওর মতো অন্যরাও? আমি আমার এক প্রিয় গায়িকার, যখন আমি গান শুনতাম, যখন আমি ছাত্র ছিলাম, একটি ক্যাসেট অনেক খুঁজে অর্চির জন্যে নিয়ে এসেছিলাম। অর্চি তার নাম শোনে নি, তার নাম শুনেই বমি করে ফেলতে চায়, শোনার মতোই ওর মনে হয় না, আর বাজনোর সাথে সাথেই। যেনো বমি করে ফেলে; আমার মনে হয় অর্চি আমার মুখের ওপরই বমি করে দিচ্ছে। দূরে কোথাও রেকর্ড বাজতো, কোনো বিয়ে বাড়িতে, ওই সুর কতো সন্ধ্যায় কতো রাতে গাছপালার ভেতর দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার ভেতরে এসে ঢুকতো, আমার রক্ত কাঁপতে থাকতো; অর্চির রক্ত কাঁপে না, অর্চির রক্ত ঝা ঝা করে।

এ নিয়ে দুবার হলো, দিন সাতেক আগে একবার হয়েছিলো, আজ আবার হলো, ফোনটা আমি ধরলাম; ফোনটা আমার নয়, ফিরোজার; ফিরোজা বাথরুমে বলে আমি ধরলাম, ছেলেটি বেশ গভীর কণ্ঠে বলছে, ভাবী, আমি। ছেলেটি নিশ্চিত যে ফিরোজাই। ফোন ধরবে, আমি এ-সময়ে বাড়ি থাকি না, তাই সে হ্যালো বলেও সময় নষ্ট করে নি, ভাবীর কাছে তার এককতা জানিয়েছে, একটা ঝলমলে সাড়া প্রত্যাশা করেছে। আমি কি এখন বলবো, কাকে চান? বলাটা কি, শোভন হবে, বললে কি সে আমাকে–বলবে কাকে সে চায়? সে কি বলবে না, আমি দুঃখিত, রং নাম্বার। আমি বলি, ফিরোজা বাথরুমে আছে, আপনি একটু ধরুন। শুনেই টক করে ছেলেটি ফোন রেখে দেয়; একটু বোকাই দেখছি ছেলেটি বা একটু বেশি ঘাবড়ে গেছে, আমাকে একটু ভুল। নাম্বারও বলতে পারতো। বাথরুম থেকে কি ফিরোজা ফোনের শব্দ শুনেছে? যদি। ফিরোজা বুদ্ধিমান হয়, আমি আজো জানি না সে বুদ্ধিমান কি না, এবং ফোনের শব্দ শুনে থাকে, তাহলে ফিরোজা একটু দেরি করেই বেরোবে বাথরুম থেকে, যেনো আমি বুঝতে না পারি সে একটি ফোনের জন্যে উৎকণ্ঠিত ছিলো। ছেলেটি নিশ্চয়ই পরে ফোন করবে, আমাকে নিয়ে একটু হাসাহাসিও করবে হয়তো, কীভাবে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে বলতে বলতে দুজনে হাসবে; কিন্তু ফিরোজা বাথরুম থেকে বেরোলে আমি কী বলবো? বলবো কি তার একটি ফোন এসেছিলো, আমার এক অচেনা অনুজ ফোন করেছিলো? ফোনটা যে নিশ্চিতভাবে ফিরোজারই তা আমি প্রমাণ করবো কীভাবে, আর না বলেই থাকবে কী করে? তার ফোন এসেছিলো, আমি ধরেছিলাম, এটা চেপে যাওয়া কি অসৎ কাজ হবে না, নিজেকে কি আমার একটা খুব ঈর্ষাকাতর স্বামী মনে। হবে না? ফিরোজা বেশ দেরি করেই বেরোয় বাথরুম থেকে। আমি কি ধরে নেবো। ফিরোজা ইচ্ছে করেই দেরি করে বেরিয়েছে বাথরুম থেকে, মুখ বারবার সাবান দিয়ে ধুয়েছে যাতে মুখে উৎকণ্ঠা উদ্বেগের কোনো ছাপ না থাকে?

 তোমার একটা ফোন এসেছিলো, আমি বলি।

ফিরোজা বিব্রত হচ্ছে, ফোনের শব্দ সে শুনেছে মনে হয়। আসলেই কি বিব্রত হচ্ছে ফিরোজা? না কি তা আমার বোঝার ভুল? ফিরোজা কোনো আগ্রহ দেখায় না।

এ-ফোনটি আসবে বলে, ধরতে গিয়ে বিব্রত হবে বলেই কি ফিরোজা বাথরুমে। ঢুকেছিলো? আমি ফিরোজার মুখ পড়তে পারি না, তার মুখটি আমার কাছে এক অচেনা লিপিখচিত পৃষ্ঠা মনে হয়।

তোমার একটা ফোন এসেছিলো, আমি আবার বলি।

কে করেছিলো? ফিরোজা খুব আগ্রহহীন হতে চেষ্টা করে।

তোমার কোনো দেবর করেছিলো, আমি বলি।

বাজে কথা বোলো না, ফিরোজা বলে।

বাজে কথা বলছি না আমি, আমি বলি, ভাবীকে চাচ্ছিলো সে।

দেখো সবাইকে নিজের মতো মনে কোরো না, ফিরোজা বলে, তোমরা তো অফিসে গণ্ডা গণ্ডা মেয়েলোকের সাথে ফোন করেই সময় কাটাও।

তুমি রেগে যাচ্ছো, আমি বলি, আর ধরা পড়ে যাচ্ছো।

ধরা পড়ার কী আছে, ফিরোজা বলে, যাদের কাছে স্বামীরা ফোন করে না তাদের কাছে দেবররা তো ফোন করবেই।

আমি আর কোনো কথা বলি না, আমাকে বেরোতে হবে; বেরোনোর আজ ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু বেরোতেই হবে, আমার রক্ত এলোমেলো কাজ করতে শুরু করছে। বেরিয়ে কোথায় যাবো? অফিসে? অফিসেই যাবো। আমি তো রাত দশ এগারোটা পর্যন্ত অফিসেই থাকি, আজ বাসায় থাকবো ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন আমাকে বেরোতে হবে। আমি অফিসে চলে যাই। ফিরোজাকে হয়তো তার দেবর আবার ফোন করেছে, আমি কি একবার বাসায় ফোন করে দেখবো ফোন অ্যানগেজড কি না? না, অ্যানগ্যাজড থাকলে আমার রক্ত আরো এলোমেলো হয়ে যেতে পারে; হয়তো অর্চি ফোনে কথা বলছে, আজকাল ওর খুব ঘন ঘন ফোন আসছে, তবু আমার মনে হবে ফিরোজা দেবরের সাথে কথা বলছে। নিজের কাছে নিজেকে ছোটো মনে হবে। না, আমি বাসায় ফোন করবো না; ফিরোজা কথা বলুক তার দেবরের সাথে। ফিরোজা কি দেবরের সাথে বেড়াতে যায়? কখন যায়? কোথায় যায়? কতো দিন ধরে যায়? কী করে? দেবরটি দেখতে কেমন? ফিরোজার সাথে বেশ মানায়? যেখানে ইচ্ছে যাক, যা ইচ্ছে করুক; আমি এখন কী করি? ফিরোজাকে কি এরই মধ্যে তার দেবরটি দেখেছে, সম্পূর্ণ দেখে ফেলেছে? ফিরোজা দেখতে দিয়েছে? মাঝেমাঝেই দেখে, আজো কি দেখার ইচ্ছে। আছে? ফিরোজা কীভাবে সাড়া দেয়? আমি রওশনকে দেখতে পাচ্ছি, একটি হাত। রওশনকে খুলছে, রওশনের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, রওশন কেঁপে কেঁপে উঠছে, রওশন শব্দ করে নিশ্বাস নিচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *