১. আমি ব্রিজ বানাই

সব কিছু ভেঙে পড়ে – উপন্যাস – হুমায়ুন আজাদ

উৎসর্গ
যাদের আমি পাই নি
যারা আমাকে পায় নি

প্রথম প্রকাশ – ফাল্গুন ১৪০১ : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫

.
০১.

আমি ব্রিজ বানাই; বলতে পারতাম সেতু বানাই, তবে সেতু কথাটি, অন্যদের মতোই, সাধারণত আমিও বলি না, বলি ব্রিজ;–ব্রিজ বললেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় আমার কাছে, চোখের সামনে ব্যাপারটি আর বস্তুটি দাঁড়ানো দেখতে পাই। সেতু বললে এখন আর কিছু দেখতে পাই না। বড়ো কয়েকটি ব্রিজ আমি বানিয়েছি, এখনও একটি বানাচ্ছি; কিন্তু সব সময় আমি ভয়ে থাকি ওই ব্রিজগুলো হয়তো এ-মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর শব্দ করে ভেঙে পড়বে। তবে জানি এ-মুহূর্তে পড়বে না, যদিও পড়বে; ভবিষ্যতে ভেঙে পড়ার শব্দ এখনই আমি শুনতে পাই, দেখতে পাই তার দৃশ্যও। ছোটোবেলায় আমি একটি সাঁকো, বাঁশের পুল, নিয়ে ভেঙে পড়েছিলাম; আমার বানানো ব্রিজগুলোর পাশে সেটা কিছুই নয়, কিন্তু সব ব্রিজকেই আমার ওই সাঁকোটির মতো নড়োবড়ো মনে হয়। ব্রিজ একটি কাঠামো; সব কিছুই আমার কাছে কাঠামো;–বিশতলা টাওয়ার, জানালার গ্রিলে বৃষ্টির ফোঁটা, রাষ্ট্র, শিশিরবিন্দু, সভ্যতা, বুড়িগঙ্গার ব্রিজ, সমাজ, সংসার, বিবাহ, পনেরো বছরের বালিকা, তার বুক, দুপুরের গোলাপ, দীর্ঘশ্বাস, ধর্ম, আর একটি পর একটি মানুষ-পুরুষ, নারী, তরুণী, যুবকের সাথে আমার সম্পর্ক, অন্যদের সম্পর্ক, সব কিছুই আমার কাছে কাঠামো। কাঠামোর কাজ ভার বওয়া; যততদিন ভার বইতে পারে। ততোদিন তা টিকে থাকে; ভার বইতে না পারলে ভেঙে পড়ে। কোনো কাঠামোই চিরকাল ভার বইতে পারে না। কাঠামোগুলো যখন তৈরি করা হয়, তখন একটা ভারের হিশেব থাকে; কিন্তু দিন দিন ভার বাড়তে থাকে সেগুলোর ওপর, একদিন বাড়তি ভার আর সহ্য করা সম্ভব হয় না সেগুলোর পক্ষে। তখন ভেঙে পড়ে। সত্য হচ্ছে ভেঙে পড়া, কাঠামোর কাজ ওই ভেঙে পড়াকে, চরম সত্যকে, কিছু কালের জন্যে বিলম্বিত করা; কিন্তু একদিন সব কাঠামোই ভেঙে পড়বে। আমার পেশা ভেঙে পড়াকে একটা চমৎকার সময়ের জন্যে বিলম্বিত করা। আমার বন্ধু কলিমুল্লাহ কবিতা পছন্দ করে;–কবিতা একদিন আমিও পছন্দ করতাম–সেও ব্রিজ বানায়, কথায় কথায় সে বলে ব্রিজ হচ্ছে নদীর ওপর লোহার সঙ্গীত, বিম-পিয়ার-স্প্যানের লিরিক; তখন আমি সঙ্গীত আর লিরিকের কাঠামোর কথা ভেবেও ভয় পাই, সঙ্গীত ও লিরিকের প্রচণ্ডভাবে ধ্বংস হওয়ার শব্দ শুনতে পাই, ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখতে পাই।

ব্রিজ বানাতে বানাতে আমি চারদিকে ব্রিজ দেখতে পাই, ব্রিজ খুঁজি; কোনো মানুষকে দেখলেই তার ব্যক্তিগত ব্রিজের অবস্থা কী;–সে কার সাথে কেমন ব্রিজ দিয়ে নিজেকে যুক্ত করেছে, তার খালের বা নদীর এপার-ওপারের সম্পর্ক কী, তার কতোগুলো ব্রিজ নড়োবড়ো, কতোগুলো ব্রিজ ভেঙে পড়েছে, কতোগুলো সে আবার নতুনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছে, তা জানতে ইচ্ছে করে; তার মুখের দিকে তাকালে অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্রিজের কাঠামো দেখতে পাই। তবে আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। প্রত্যেকেই এমন ভাব করে যে তার প্রত্যেকটি ব্রিজ চিরকাল ধরে ঠিক আছে, চিরকাল ধরে ঠিক থাকবে; কিন্তু আমি যেহেতু কাঠামো নিয়ে কাজ করি, কী উপাদান, কতোটা টেকসই, তা আমার মোটামুটি জানা, তাই তাদের ভান দেখে আমার দুঃখ হয়। আমার ব্রিজগুলোই কি আমি ঠিকমতো রাখতে পেরেছি? নদীর ওপর বানানো আমার ব্রিজগুলোর কোনোটি আজো ভেঙে পড়ে নি; কিন্তু সেগুলোর থেকেও শক্ত উপাদানে আমি যে-সব ব্যক্তিগত ব্রিজ বানিয়েছিলাম, তার অনেকগুলোই ধসে পড়েছে; যে-ব্রিজগুলো আমার জীবনকালে হয়তো ধসে পড়বে না, সেগুলোর বিমে ফাটল ধরেছে, স্তম্ভে ভয়ঙ্কর চাপ পড়ছে; সেগুলোকে আমি টিকিয়ে রাখতে পারবো না, যদিও সবাই চায় আমি ওগুলো টিকিয়ে রাখি; কিন্তু সেগুলো যে নিরর্থক হয়ে গেছে, তা আমি ভালো করেই জানি। আমার ওই ব্রিজগুলো আছে, কিন্তু সেগুলোর ওপর দিয়ে কোনো। চলাচল নেই; তাই ওগুলো থাকার কোনো অর্থ হয় না।

কিন্তু ব্রিজ, অর্থাৎ সাঁকো, আমার ভালো লাগে। খাল, নদী, পরিখা, পুকুর হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা; ব্রিজ হচ্ছে সম্পর্ক ছেলেবেলায় সাঁকোর ওপর দিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক পথ ঘুরে আমি ইস্কুলে গেছি, মামাবাড়ি যাওয়ার সোজা পথে কোনো সাঁকো ছিলো না বলে সোজা পথ দিয়ে না গিয়ে আমি অনেক পথ ঘুরে গেছি, সে-পথ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রথম একটি কাঠের সাঁকো পড়তো, তারপর অনেক দূর হাঁটার পর পড়তে একটা বড়ো লোহার পুল। মাঘ মাসেই কাঠের পুলটির নিচের খাল শুকিয়ে যেতো, সেখান দিয়ে একটা রাস্তা হতো; সবাই ওই রাস্তা দিয়েই যেতো, পুলটি দাঁড়িয়ে থাকতো। শুকনো কঙ্কালের মতো, তখন সেটি দেখে আমার কষ্ট হতো। আমি তখনও পুল দিয়েই যেতাম, যদিও যেতে আমার ভালো লাগতো না; যে-পুলের নিচে পানি নেই, তাকে পুল। মনে হতো না, তাই এক সময় আমিও পুলের নিচের রাস্তা দিয়েই যেতাম, পুলটির। দিকে তাকিয়ে কষ্ট পেতাম। লোহার পুলটি যে-দিন ভেঙে পড়লো, সেদিন আমার কষ্টের সীমা ছিলো না; ছেলেবেলায় যা কিছুকে আমার অবিনশ্বর মনে হতো, তার প্রথমেই ছিলো লোহার পুলটি;–অমন শক্ত কাঠামো তখন আমি আর দেখি নি, আমার বিশ্বাস ছিলো ওটা কখনো ভেঙে পড়বে না। লোহার পুলের কথা মনে হলেই আমার। বাবাকে মনে পড়ে, এখনও মনে পড়ছে; তার সম্পর্কে বড়ো হওয়ার পর আমি কিছু ভাবি নি, কিন্তু যখন কিশোর আমি তখন বাবাই ছিলেন আমার ভাবনার বড়ো বিষয়, ওই। লোহার পুলটির মতোই। বাবা দেখতে লোহার পুলটির মতোই বিরাট আর শক্ত ছিলেন; লুঙ্গি আর দামি পাঞ্জাবি পরতেন, হাঁটতেন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে; কোথাও যাওয়ার। সময় তার পেছনে আমাদের শক্ত চাকরটা যেতো, তাছাড়া আরো দু-চারজন লোক তার দু-পাশে থাকতো সব সময়ই। বাবার পাশে লোকগুলোকে মানুষই মনে হতো না, নেড়ি কুকুরের মতো দেখাতো; তবে ওই লোকগুলোর মুখে আমি কোনো যন্ত্রণার ছাপ দেখতে পেতাম না, কিন্তু বাবার মুখে দেখতে পেতাম। ওই লোকগুলোর যন্ত্রণাবোধেরই শক্তিই সম্ভবত ছিলো না। রাবার সম্ভবত কোনো ব্রিজ ছিলো না; তাঁর কাছে যারা আসতো তারা এতো সামান্য ছিলো যে বাবার সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক হতেই পারে না। বাবার মুখের দিকে তাকালে আমি ব্রিজহীনতার কষ্ট দেখতে পেতাম। ছোটোবেলায়ই আমি। বুঝতে পেরেছিলাম আমরা প্রত্যেকেই খালের একপার,–খালের রূপকটিই আমার মনে হতো যেহেতু আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে একটি বড়ো খাল চলে গিয়েছিলো, তাই। অন্যপারের সাথে, অন্য কারো সাথে, অন্য অনেকের সাথে সাঁকো বাধা.দরকার; কিন্তু বাবা কোনো সাঁকো বাঁধতে পারেন নি।

আমাদের পুবের পুকুরটি বেশ বড় ছিলো, সেটি ঘিরে ছিলো অনেকগুলো ঘাট। আমাদের ঘাটটির থেকে দক্ষিণে, পুকুরটি যেখানে পুব দিকে বাঁক নিয়েছে, সেখানে। ছিলো মোল্লাবাড়ির ঘাট; ওই ঘাটে একদিন খুব ভোরবেলা, আমার যখন আট বছর বয়স হবে, আমি ওই বাড়ির একটি নতুন বউকে গোসল করতে দেখি। সে-দিন খুব। ভভারে ঘুম ভেঙে গেলে আমি আমাদের দোতলা ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুকুরের দিকে তাকাই, শুপুরি আর নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখি নতুন বউটি গোসল করছে। সেটা শীতকাল ছিলো, জলের ওপর ধুয়োর মতো কুয়াশা উড়ছিলো, শিশিরে শুপুরি আর নারকেলগাছগুলো ভিজে গিয়েছিলো, সে-কনকনে ঠাণ্ডায় এতো ভোরে বউটি কেনো গোসল করে ভেবে আমি অবাক হই। বউটি গোসল করে শাড়ি বদলায়, পরার শাড়িটি পানিতে ছুঁড়ে মেরে দু-তিনবার ধোয়, তারপর শাড়িটি দু-হাতে চেপে একটি বলের। মতো বানিয়ে সিঁড়ির মাথায় রেখে দিয়ে বাড়ির দিকে চলে যায়। সে কেনো অতো ভোরে গোসল করলো? মাকে কি জিজ্ঞেস করবো ঘুম থেকে উঠলে? কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই জিজ্ঞেস করে কোনো সত্য জানতে আমার ইচ্ছে করে না, সত্য আমি নিজে। জানতে চাই, নিজে বের করতে চাই। বিকেলবেলা আমি একবার মোল্লাবাড়ি যাই; মাঠে যাবো বলে আমি বেরিয়েছিলাম, কিন্তু মোল্লাবাড়ি গিয়ে উঠি। বউটিকে আমি আগেও দেখেছি, একদিন সে আমাদের বাড়ি এসেওছিলো; আমাকে দেখেই সে ঘর থেকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। তার জড়িয়ে ধরা আমার ভালো লাগে, কিন্তু আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। বউটি আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে, এবং আমার আরো ভালো লাগতে থাকে।

আপনি এতো ভোরে গোসল করেন কেনো?

আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি।

বউটি অবাক হয়, বিব্রত হয়, এবং হেসে ফেলে।

আমি ভোরে গোসল করি তুমি জানো কীভাবে? বউটি নিচু গলায় বলে।

ভোরে ঘুম ভাঙলে আমি বারান্দায় দাঁড়াই, তখন দেখি আপনি গোসল করছেন, আমি বলি।

নতুন বউরা ভোরেই গোসল করে, বউটি হেসে হেসে আমার গাল টিপতে টিপতে বলে, তোমার বউও ভোরে গোসল করবে।

আমি তার বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড় দিই।

নতুন বউরা কেনো ভোরবেলা গোসল করে?–প্রশ্নটি ঘুরতে থাকে আমার মাথার মধ্যে। নতুন বউরা সুন্দর থাকতে চায়, ভোরবেলা গোসল করলে বউরা সুন্দর হয়ে ওঠে; নতুন বউদের চামড়া খুব ঝলমল করে, ভোরবেলা গোসল করে বলেই হয়তো, এমন একটা উত্তর আমার ভেতরে তৈরি হয়ে যায়। পরের দিন ভোরেও তাকে আবার আমি গোসল করতে দেখি, কুয়াশার ভেতরে সে গায়ে পানি ঢেলে গোসল করছে, তার শরীর থেকে ধুয়োর মতো কুয়াশা উড়ছে, সে বদনা দিয়ে মাথায় পানি ঢালছে, বাঁ হাত দিয়ে বারবার বুক ঘষছে, তার দু-পায়ের মাঝখানে তলপেটের দিকে পানি ঢালছে, ঘষছে, কুয়াশা উড়ছে; আমার শরীর কেনো যেনো হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে; আমি ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ি। পরে আমি বুঝতে পারি বউটির সাথে তার পুরুষটির একটি সাঁকো তৈরি হয়েছে। বিয়ে একটা ব্রিজ, এমন একটা ধারণা আমার তখনি হতে থাকে; বউটির বাড়ি শিমুলিয়া আর লোকটির বাড়ি দক্ষিণের মোল্লাবাড়ি, তাদের কখনো দেখা হয় নি, কিন্তু একটা সাঁকো তৈরি হয়ে গেছে তাদের মধ্যে, তাই তারা এখন এক ঘরে। ঘুমোয়, আর বউটি প্রত্যেক ভোরে উঠে কুয়াশার মধ্যে গোসল করে। আমি বুঝে উঠতে থাকি মানুষ দু-প্রকার, পুরুষ আর মেয়েমানুষ, আর তাদের মধ্যে একটা রহস্যজনক সাঁকো তৈরি হয়। তখন থেকে পৃথিবী আমার চোখে দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়, মেয়ে আর পুরুষমানুষ, এবং আমি তাদের মধ্যের ব্রিজগুলো খুঁজতে থাকি, দেখতে থাকি, মাঝেমাঝে আগুনের মতো জ্বলে উঠি আর কখনো বরফ হয়ে যাই।

পাশের বাড়ির মোহাম্মদ আবদুর রহমানদের ঘর ছিলো একটি। মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বাবা ছিলো মৌলভি, সিলেটে চাকুরি করতো; বাড়ি আসতো আট-দশ মাস। পরপর; রহমানকে সে বাবা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলে ডাকতো, আমরা রহমানকে রহমান বললে আমাদের ডেকে বুঝিয়ে দিতো যে সে রহমান নয়, সে মোহাম্মদ আবদুর রহমান, তাকে ওই নামেই ডাকা উচিত, নইলে কবিরা গুনাহ হবে; সে-মোহাম্মদ। আবদুর রহমানের বাবা বাড়ি এলে একটা ঘটনা ঘটতো। মোহাম্মদ আবদুর রহমানের মাও মৌলভি ছিলো মনে হয়; মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বাবা বাড়ি এলেই সে লম্বা। করে ঘোমটা দিতো, সন্ধ্যার আগেই সুন্দর করে চুল আঁচড়াতো, চোখে সুরমা পরতো, আর সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর মোহাম্মদ আবদুর রহমান, তার একটি ছোটো ভাই ও একটি বড়ো বোন আমাদের পশ্চিমের ঘরে ঘুমোনোর জন্যে কাঁথাবালিশ নিয়ে উঠতো। বোনটি আমার থেকে বড়ো ছিলো, বালিশ নিয়ে এসে আমাদের ঘরে ঘুমোতে সে লজ্জা পেতো। মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বাবা বাড়ি এলেই মোহাম্মদ আবদুর রহমানের মা। ভোরবেলা গোসল করতো, উঠোনের তারে শাড়ি ঝুলিয়ে দিতো; মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বোনটি মায়ের ঝোলানো শাড়ি দেখে লজ্জা পেতো। কিছু দিন পর মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বোনটির বিয়ে হয়, সেও ভোরবেলা গোসল করতে শুরু করে। ভোরবেলা গোসল করে তার কালো রঙ ঝলমল করে ওঠে। মোহাম্মদ আবদুর। রহমানের মা আর বোন কিছু দিন ধরে একই সাথে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে থাকে, ঘাটে গিয়ে একসাথে গোসল করতে থাকে; মোহাম্মদ আবদুর রহমানের বোনের গালে অনেকগুলো দাঁতের দাগ ফুটে থাকতে দেখি আমি, তবে তার মায়ের গালে কোনো দাগ দেখতে পাই না।

আমি বেড়ে উঠেছি সবুজের মধ্যে-আমাকে ঘিরে ছিলো গাছপালা; আমি বেড়ে উঠেছি নীলের নিচে-আমার মাথার ওপর ছিলো জমাট নীল রঙের আকাশ; আমি বেড়ে উঠেছি জলের আদরে-আমাকে ঘিরে ছিলো নদী, আষাঢ়ের খাল আর ভাদ্রের বিল; এবং আমি বেড়ে উঠেছি নারীপুরুষের মধ্যে আমাকে ঘিরে ছিলো নারী, পুরুষ, তাদের শরীর, কাম, ভালোবাসা। আমি গাছপালার ভেতরে ঢুকতে পেরেছি, আকাশের নিচে হাঁটতে পেরেছি, জলে সাঁতার কাটতে পেরেছি; কিন্তু নারী আর পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকতে পারি নি; আমি বুঝতে পেরেছি ওটি নিষিদ্ধ এলাকা, ওই এলাকায় সরাসরি ঢুকতে পারা যাবে না, কারো কাছে কিছু জানতে চাওয়া যাবে না, শুধু দূর থেকে দেখতে হবে, দেখে চোখ বুজে ফেলতে হবে, এবং চোখ বুজে দেখতে হবে। আমারও একটি শরীর ছিলো, আমার শরীরেরও কতকগুলো একান্ত ব্যাপার ছিলো-ছোটোবেলা থেকেই আমি তা বোধ করে এসেছি, কিন্তু সেগুলোর কথা কাউকে বলতে পারি নি। ক্ষুধা লাগলে বলেছি, সাথে সাথে সাড়া পড়ে গেছে; মাথা ধরলে বলেছি, তাতে আরো সাড়া পড়েছে; কিন্তু ওই ক্ষুধা আর মাথা ধরার থেকেও ভয়ঙ্কর অনেক পীড়ন আমি টের পেয়েছি আমার শরীরের ভেতর, তা আমি কাউকে বলতে পারি নি। আমি বুঝতে। পেরেছি শরীর এক মারাত্মক আগুন, প্রত্যেকটি মানুষ বয়ে বেড়ায় একেকটি লেলিহান অগ্নি। আমি পুরুষ-অগ্নি দেখেছি, নারী-অগ্নি দেখেছি, তাদের গোপন দাউদাউ জ্বলা দেখেছি, নিভে যাওয়া দেখেছি; আমার মনে হয়েছে মানুষ সম্ভবত অন্যের সাথে সবচেয়ে নিবিড় সাঁকোটি তৈরি করে শরীর দিয়ে। মানুষের শরীর খুব মারাত্মক ব্যাপার, ছোটোবেলায়ই বুঝেছি আমি। আমি শরীর দেখে, নারীর আগুন দেখে প্রথম কবে কেঁপে উঠেছিলাম? আমার মনে নেই, কারোই হয়তো মনে থাকে না; কিন্তু আজো চোখ বুজলে ঝিলিকের পর ঝিলিক দেখতে পাই। চোখ বুজে তাকালে আমি মাছরাঙা দেখতে পাই, আমের বোল দেখি, টিয়েঠুটো আমগাছে সিঁদুর দেখি, চিল দেখি, আর দেখতে পাই আমাদের কাজের মেয়ে, যে আমার থেকে অনেক বড়ো ছিলো, কদবানের বুক। ভরে দুটি সবুজ পেঁপে,–সে ঘর ঝাট দিচ্ছে, তার সবুজ পেঁপে কাঁপছে, সে গোসল। করে আমার সামনেই লাল গামছা দিয়ে মুছছে পেঁপে, আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমার অন্ধ চোখের কথা কেউ জানে না, কদবান কখনো টেরও পায় নি।

পুরুষদের আমি ছোটোবেলা থেকেই এক বিস্ময়কর প্রাণী হিশেবে দেখে এসেছি; মনে হয়েছে এর ক্ষুধাতৃষ্ণা কখনো মিটবে না। আমারও একদিন এমন ক্ষুধা দেখা দেবে ভেবে আমি ভয় পেয়েছি, উল্লাসও বোধ করেছি। আমাদের বুড়ো চাকরটি তার বউকে বেশ মারতো, তার রোগা বউটি তার ভয়ে কাঁপতো, বউর সামনে সে কখনো হাসতো না; কিন্তু কদবানকে দেখলে সে গলে যেতো, তার ভাঙা গাল হাসিতে ভরে উঠতো। কদবানের গোসল করার সময় সে ঘাটের পাশের মরিচ আর কচু খেত নিড়াতে শুরু করতো, কচুপাতার আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকতো কদবানের দিকে, এমনভাবে তাকাতো যেনো কিছু সে দেখতে পায় না। কদবানও তাকে খাটাতো, এবং কদবান তাকে খাটালে তার সুখের শেষ থাকতো না। কোনো কোনো দিন গোসলের পর কদবান তাকে ডাকতো, সে দৌড়ে ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হতো। কদবান তাকে শাড়ি ধুয়ে দেয়ার আদেশ দিতো, আর সে আনন্দের সাথে কদবানের শাড়ি ধুতে শুরু করতো, মনে হতো কদবানের যদি গোটাদশেক শাড়ি থাকতো তাহলে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেগুলো ধুয়ে তার প্রাণমন ভরে উঠতো। কদবানকে একটু ছোঁয়ার জন্যে তার হাত কাপতো। কদবানের হাত থেকে হুঁকো নেয়ার সময় তার হাত কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে পড়তো কদবানের। হাতের ওপর, তখন তার হাত আর নড়তো না; কদবান ঠেলা দিয়ে তার হাতে হুঁকো। ধরিয়ে দিতো। দক্ষিণের বাড়ির শালু ফুপুর দিকে কে চঞ্চল হয়ে তাকাতো না? শালু ফুপুকে দেখলে আমি মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। চকচকে কালো ছিলো তার গায়ের রঙ, বুক দুটি সাংঘাতিকভাবে উঁচু, আর পেছনের দিকটা ভয়ঙ্কর; সে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি ঝড়ের বেগে যেতো, তার বুক ঢেউয়ের মতো কাঁপতো, তার পেছনটা নৌকোর মতো দুলতো; সে গিয়ে দাঁড়াতে কারো রান্নাঘরের দরোজায়, কারো বড়ো ঘরের দরোজায়, উঁচু গলায় কথা বলতো; আবার ঝড় জাগিয়ে অন্য কোনো বাড়িতে যেতো। আমি একদিন শুনতে পাই বাবা তাকে ডাকছেন কালো শশী বলে। শশী শব্দের অর্থ তখন আমি জেনে গেছি, কিন্তু কালো শশী শোনার পর আমার ভাবনাগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যায়, কালো চাঁদের কথা ভাবতে ভাবতে আমার রক্তনালি ভরে উজ্জ্বল অন্ধকার ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

ছোটো খালা বেড়াতে এলে আমাদের খুশির শেষ থাকতো না, এবং বাবাকেও খুব খুশি দেখাতো। ছোটো খালা আমাদের বাড়ি দু-এক মাস পরপরই বেড়াতে আসতো, তাকে দেখলে আমরা সবাই খুশি হয়ে উঠতাম। তার ঝলমলে রঙ আর গোলগাল মুখ দেখে আমাদের বুক ভরে উঠতো, কেননা ছোটো খালা মানেই ছিলো আদর, আরো আদর, এবং আরো আদর। আমি তখন বড়ো হয়ে গেছি, তবু খালা আমাকে ঘষে ঘষে গোসল করিয়ে দিতো, চুল আঁচড়ে দিতো; ইস্কুলে খাওয়ার জন্যে আধুলি বা টাকা দিতো। চমৎকার চমৎকার রান্না তৈরি করতো ছোটো খালা, আনন্দে আমাদের বাড়িটা। ঝলমল করে উঠতো। সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন বাবা, যদিও তা দেখা যেতো না, কিন্তু আমি দেখতে পেতাম; ছোটো খালার নাম ধরে বাবা ডাকতেন, একটা সুর ঝরে পড়তো বাবার গলা থেকে; ছোটো খালা পাখির মতো উড়ে গিয়ে উপস্থিত হতো, কখনো পান নিয়ে কখনো তামাক নিয়ে, কখনো শুধুই একটা ঝলমলে মুখ নিয়ে। মায়ের নাম ধরে ডাকতে বাবাকে কখনো শুনি নি। মায়ের সাথে বাবার আসলে কোনো কথাই হতো না। বাবার সাথে মায়ের কোনো ঝগড়া ছিলো না, মাকে বাবা কখনো গালাগালিও করতেন না, মাকে অনেকক্ষণ না দেখলে তোর মা কইরে বলে আমার। কাছ থেকে মায়ের খবর নিতেন; কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার মুখে কখনো আভা ফুটে উঠতে দেখি নি, আর মাকেও কখনো চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখি নি বাবাকে দেখে বা না দেখে। বাবা ও মায়ের মধ্যে যতোটুকু কথা হতো, তার সবটাই কাজের। কথা; আর কাজের কথা মানুষের বেশি থাকে না বলে তাদের বিশেষ কথাই হতো না। আমি আরো কয়েকটি বাবা আর মা দেখেছি; রফিকের, সিরাজের, রোকেয়ার মা ও বাবাকে দেখেছি, দেখে বুঝেছি মা ও বাবার কাজ মা ও বাবা হওয়া, এবং তাদের মধ্যে

এর বেশি আর কোনো সাঁকো না থাকা। রফিকের বাবা মাঝেমাঝেই মারতো ওর মাকে, আর রফিকের মা ওর বাবাকে খাইনকার পো বলে গালি দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার জন্যে বাক্স গোছাতো, কিন্তু তার যাওয়া হতো না। অথচ ওই রফিকের বাবাই আমাদের বাড়ি এসে মাকে ভাবিছার বলে মধুরভাবে ডাকতো, কদবানকে। তামাক সেজে আনতে বলতো, কদবানের হাত থেকে হুঁকো নেয়ার সময় অনেকক্ষণ ধরে তার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকতো। সিরাজের বাবা সকালের খাবার খেয়েই বাজারে চলে যেতো, দুপুরের পর বাড়ি ফিরতো, আবার খেয়েই বাজারে চলে যেতো; আমরা যখনই যেতাম দেখতাম সে চায়ের দোকানে বসে আছে, চা খাচ্ছে গল্প করছে বিড়ি টানছে। সব সময়ই হাসি হাসি তার মুখ। কিন্তু সিরাজের মায়ের সাথে ধমক না দিয়ে সে কথা বলতো না।

তখন থেকেই আমার সন্দেহ হতে থাকে, সন্দেহটা গম্ভীর হতে থাকে যে বাবা ও মা হওয়ার মধ্যে কোনো একটা গভীর সংকট রয়েছে; এ-কাঠামোটি ভেতরে ভেতরে। দুর্বল, বাইরে থেকে তাকালেই শুধু মনে হয় বাবা ও মায়ের মধ্যে একটা শক্ত ব্রিজ। রয়েছে, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় অনেক আগেই ব্রিজটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কোনো ব্রিজ নেই, তাদের মধ্যে একটা প্রথা রয়েছে। বাবার সঙ্গে মায়েরও কোনো ব্রিজ ছিলো না, কিন্তু ছোটো খালার সাথে বাবার একটা ব্রিজ ছিলো, তা দুজনের মুখ। দেখলেই বোঝা যেতো। মাও তা বুঝতো বলেই মনে হয়, তবে মায়ের তাতে কোনো আপত্তি ছিলো বলে মনে হয় না। আমি আমাদের দোতলার দক্ষিণ দিকের একটি ঘরে থাকতাম, বাবা থাকতেন উত্তর দিকের একটি ঘরে, মা ও আমার ছোটো বোনটি একতলায় থাকতো। দোতলায় আরো একটি ঘর ছিলো, মা তাতে থাকতে পারতো, বাবা তাকে সেখানেই থাকতে বলতো, বা বাবার সাথে একই ঘরে থাকতে পারতো, কিন্তু মা বোনটিকে নিয়ে একতলায় থাকতেই পছন্দ করতো। ব্রিজ তৈরিতে মায়ের কোনো আগ্রহ আমি দেখি নি। খালাকে মা-ই মানুষ করেছে, বিয়েও দিয়েছে, খালাকে মা নিজের মেয়ের মতোই আদর করতো; এবং আমি দেখেছি খালাকে মা বাবার ঘরে পাঠিয়ে দিতো মাঝেমাঝেই কখনো পান হাতে, কখনো বাবার ঘরটি গুছিয়ে দেয়ার জন্যে, কখনো বাবার হাতপা টিপে দেয়ার জন্যে। অবশ্য আমাদের বাড়িটা ছিলো। খালারই বাড়ি, ছোটোবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে আছে খালা, শুধু বিয়ে হওয়ার পর একটু দূরে সরে গেছে; তাই খালা আমাদের বাড়ির কোথায় যাবে বা যাবে না, সেটা কারো বলে দিতে হতো না; আর সে কোন ঘরে কখন কী করবে, তাও কারো বলার অপেক্ষা করতো না। আর খালার সব কিছুই এতো ঝলমলে ছিলো যে তাকে দেখলে সবাই ঝলমল করে উঠতো। আমি ঘরে ফিরে যখন দেখতাম আমার ঘরটি ঝকঝক করছে, বুঝতাম খালা আমার ঘর ঘুরে গেছে; এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই যে। খালাকে দেখতে পাবো, তাতেও নিশ্চিত থাকতাম। খালা এসে হাজির হতো, হাতে কোনো খাবার।

হাসান ভাই, মেজো কাকার ছেলে, পড়তো কলেজে, তাকে আমি তখন আমার। স্বপ্নের নায়ক মনে করতাম। তার চুল আঁচড়ানোর ভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করতো, হাঁটার সময় বাঁ হাতে যেভাবে লুঙ্গি ধরে হাঁটতো, তাতে মুগ্ধ হতাম। আমি তার মতো চুল আঁচড়ানোর স্বপ্ন দেখতাম, আর ঠিক করে রেখেছিলাম যখন লুঙ্গি পরবো, তখন হাসান ভাইয়ের মতো বাঁ হাতে লুঙ্গি ধরে হাঁটবো। হাসান ভাই তৃতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেছিলো, তখন আমি তৃতীয় বিভাগ কাকে বলে বুঝতে পারি নি; ভেবেছিলাম আমি যেমন ক্লাশে থার্ড হয়েছি, হাসান ভাইও তেমনি থার্ড হয়েছে। আমাদের বাড়িতে। যে-আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিলো, তাতে আমার সন্দেহ ছিলো না যে হাসান ভাই থার্ড হয়েছে। হাসান ভাই মুনশিগঞ্জ থেকে ফিরে এসে পাগল করার মতো গল্প শোনাতে লাগলো আমাকে। একটি মেয়ের ছবি দেখিয়ে বললো, এর নাম সুচিত্রা, সিনেমার নায়িকা। জানিস চাইলে এই মেয়েটিকে আমি বিয়ে করতে পারি। মেয়েটির মুখ দেখে। আমার বুক কাঁপছিলো, অতো সুন্দর মুখ আমি আর দেখি নি, আমার একটু ঈর্ষা হলো; কিন্তু হাসান ভাইকে আমি অবিশ্বাস করতে পারলাম না, আমার খুবই বিশ্বাস হলো যে হাসান ভাই চাইলেই ওই মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারে। হাসান ভাই বললো, তবে সিনেমার নায়িকা আমি বিয়ে করবো না, কলেজের কতো ভালো ভালো মেয়ে আমার পেছনে ঘোরে। আমার রক্ত ঝলক দিয়ে উঠলো। তখন থেকে হাসান ভাই ঘর থেকে বেরোলেই আমাকে ডাকে, আমি তার পেছনে আর পাশেপাশে হাটি; হাসান ভাই। আমাকে একের পর এক মেয়ের গল্প শোনাতে থাকে। হাসান ভাই আমার বুকের ভেতরে মেয়ের পর মেয়ে ঢুকিয়ে দেয়, মেয়েদের মুখ ঠোঁট চুল বাহু আমার চোখে। নতুনভাবে রূপ ধরতে শুরু করে। তখন হাসান ভাইয়ের জগত মেয়েতে ভরে গেছে, মেয়ে ছাড়া তার আর কোনো কিছুতে স্বাদ নেই, কোনো কথা বলে সুখ নেই; আমিও তার কথা শোনার জন্যে ব্যাকুলতা বোধ করতে শুরু করেছি। বিকেল হলেই আমাকে বলতো, চল। কখনো সড়ক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, কখনো নদীর পারে বসে হাসান, ভাই আমাকে তার বুক বোঝাই মেয়েদের গল্প শোনাতো।

হাসান ভাই, আপনি সব সময় মেয়েদের গল্প করেন কেনো? আমি কখনো জিজ্ঞেস করতাম।

তুই বুঝবি নারে মেয়েরা কী জিনিশ, হাসান ভাই বলতো, এই বয়সে মেয়ে ছাড়া আর কিছু ভালো লাগে না।

হাসান ভাই সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলতো, মেয়েদের কথা না ভাবলে ভাত খেতে ইচ্ছে করে না, রাতে ঘুম হয় না।

হাসান ভাইয়ের সিগারেটের গন্ধটা আমার ভালো লাগতো। এখন আমি প্রচুর সিগারেট খাই, দামি বিদেশি সিগারেট ছাড়া খাই না, কিন্তু সিগারেটে আমি কোনো স্বাদ পাই না; যখন আমার সিগারেটে স্বাদ পেতে ইচ্ছে করে তখন আমি ভাবতে থাকি হাসান ভাই নদীর পারে বসে সিজর্স সিগারেট খাচ্ছে, আমি পাশে বসে আছি, তার সিগারেটের ধোয়ার অদ্ভুত গন্ধে আমার বুক ভরে যাচ্ছে। হাসান ভাই শেফালির গল্প করছে, নুরজাহানের গল্প করছে, বকুলের গল্প করছে, আমার রক্ত ঝিরঝির করছে। শেফালির গল্পটা তার প্রিয় ছিলো–শেফালি অর্থাৎ রবি সাহার মেয়ে শেফালি, যে হাসান ভাইয়ের সাথে পাশ করে বসে আছে, হাসান ভাই যাকে ইচ্ছে করলেই বিয়ে করতে। পারে, যে হাসান ভাইয়ের সাথে পালিয়ে যেতে চায়। শেফালিকে আমি দেখেছি, তাকে দেখতে আমারও ভালো লাগে, কার ভালো লাগে না শেফালিকে দেখতে? স্যারদেরও ভালো লাগে শেফালিকে দেখতে। হাসান ভাই শেফালির গল্প বলতে শুরু করে। শেফালি একদিন সন্ধ্যায় হাসান ভাইকে তাদের বাড়িতে যেতে বলেছে, হাসান ভাই গিয়ে দেখে বাড়িতে আর কেউ নেই-পুজো দেখার জন্যে সবাই বাজারের মন্দিরে গেছে; শেফালি হাসান ভাইয়ের জন্যে উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শেফালি চুল আঁচড়ে। বুকের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। হাসান ভাই যেতেই শেফালি তার হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে যায়, হাসান ভাই বুঝতে পারে শেফালি কী চায় হাসান ভাইয়ের কাছে। হাসান ভাই শেফালিকে জড়িয়ে ধরে, শেফালির ব্লাউজ খুলে ফেলে, দুধে হাত দিয়ে দেখে মাখনের মতো নরম। আমার চোখ তখন সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেছে, কান বধির হয়ে গেছে; হাসান ভাইয়ের কোনো কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না। অন্ধকারের ভেতর কী। যেনো আমার চোখের সামনে ধবধব করছে, অন্ধকারের মধ্যে এক অসহ্য কোমলতা আমাকে ঢেকে ফেলছে।

হাসান ভাইকে আমার হিংসে হয়; আমি একবার শেফালিদির পেছনে পেছনে ইস্কুলে গিয়েছিলাম, মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম, শেফালিদির ধবধবে পা মাটিতে পড়ছে আর উঠছে দেখে দেখে আমার চোখ দুধের রঙে ভরে গিয়েছিলো। শেফালিদির আর কিছু দেখার কথা ভাবার আমার সাহস হয় নি, কিন্তু হাসান ভাই সব দেখেছে, সব ছুঁয়েছে, আমার হিংসে হতে থাকে। কিন্তু তখনও মেয়ে আমার রক্তের মধ্যে ঢোকে নি; কোনো মেয়ের কথা ভাবার থেকে তখনও আমি বেশি সুখ পাই মেঘের কথা ভাবতে, যে-পাখিটি গতকাল আম গাছের ডালে এসে বসেছিলো, দুটি বড়ো হলদে ডানা। ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে উড়ে গিয়েছিলো, তার ডানার হলদে রঙের কথা ভাবতে। আমার, কোনো কষ্ট নেই, কিন্তু হাসান, ভাইয়ের খুব কষ্ট, আমি বুঝতে পারি; এবং আমার ভয় লাগতে থাকে একদিন আমারও এমন কষ্ট হবে। আমি দেখতে পাই আমাদের গ্রামের সবাই খুব কষ্টে আছে; বাবা কষ্টে আছেন, হাসান ভাই কষ্টে আছে, সিরাজের রফিকের বাবারা কষ্টে আছে, আমাদের শক্ত চাকরটি আর বুড়ো চাকরটি কষ্টে আছে। হাসান ভাইয়ের সাথে আমার আর বেরোনোর সাহস হয় না; বেরোলেই আমি হয়তো আরো। ভয়ঙ্কর কথা শুনতে পাবো, তাতে আমারও কষ্ট হবে। শেফালির কথা শোনার পর থেকে আমিও যেনো কষ্ট পেতে শুরু করেছি, সে-রাতে ঘুমোতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছিলো।

আমি বড়ো হতে থাকি, একের পর এক ঘটনা দেখতে পাই; ওই ঘটনাগুলো আমাকে প্রস্তুত করতে থাকে। আমি বুঝতে পারি জীবন স্তরে স্তরে সাজানো, আর ওই স্তরগুলোর মধ্যে বাইরের স্তরগুলো হচ্ছে প্রথাগত সত্য, ভেতরের স্তরগুলো আরো সত্য, যা আমরা স্বীকার করতে চাই না। আমাদের বাড়ির উত্তরে গভীর জঙ্গল, অনেক বড়ো বড়ো গাছ–আম, শিমুল, নিম, তেঁতুল, গাব, নারকেল, আর লম্বা লম্বা ঘাস, তার পর ছিলো একটি মাঠ। ওই মাঠে অনেকেই গরু চরাতো, আম্বিয়াও সেখানে গরু চরাতে। মেয়েটা একেবারেই অন্য রকম ছিলো, ওর বাবার সাথে আমাদের বাড়ি কখনো দুধ কখনো চিংড়ি মাছ বেচতে আসতো। ওর বাবা ছিলো একেবারে বুড়ো, খালে চিংড়ি ধরে বেচতো, দুধও বেচতো; গরু চরানোর দায়িত্ব ছিলো আম্বিয়ার। কাউকে দেখলেই

সে ফিকফিক করে হাসতো, ঠিকমতো কথাও বলতে পারতো না। একটা ছেঁড়া কাপড় পরতো সে, তার বুক পিঠ সবই দেখা যেতো। আমার সমান বয়সই তার, আমার। বয়সের মেয়েদের বুক উঁচু হয়েছে সারা গ্রাম ভরে, তারা যত্নের সাথে বুক ঢেকে রাখছে, কিন্তু আম্বিয়ার কোনো বুক ছিলো না; তাই ঢাকার কথাও সে ভাবে নি। তার মুখটা বাঁকা। তার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হতো না। এক দুপুরে আমি ওই মাঠে গেছি, গিয়ে দেখি আমাদের গ্রামের কয়েকটি বড়ো বড়ো ছেলে, যাদের আমি দাদা বলি, আম্বিয়াকে কোলে করে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আম্বিয়া চিৎকার করছে না, গালি দিচ্ছে মাঝেমাঝে। তারা আম্বিয়াকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কোনো চিৎকার শুনতে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর ওই ছেলেরা আর আম্বিয়া জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। আমি ভেবেছিলাম সে কাঁদতে থাকবে, কিন্তু। দেখি সে খলখল করে হাসছে। আমাকে দেখে বললো, তুই আইলি না ক্যান, তর। ইচ্ছা অয় না? সে খলখল করে হাসতে হাসতে তার গরুটাকে নতুন জায়গায় গোছর। দিতে দিতে বলে, কাইল তুইও আহিছ।

মামুন ছিলো ছোটো খালার ছেলে, দেখতে আমারই মতো, আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোটো। মামুনকে আমি খুব ভালোবাসতাম দেখতে আমার মতোই ছিলো। বলে; ও আমাদের বাড়ি বেড়াতে এলে আমার পেছনেই লেগে থাকতো সব সময়। মামুনের একটা বড়ো গৌরব ছিলো সে দেখতে আমার মতো। আমি এতোবার শুনেছি যে মামুন দেখতে আমার মতো তাতে আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিলো যে দেখতে আমার মতো হওয়া গৌরবের বিষয়। বাবা মামুনকে আমার মতোই আদর করতেন। মামুন। এলে আমরা দুজন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গল, এক মাঠ থেকে আরেক মাঠে ছুটে বেড়াতাম। পথে পথে শুনতাম, ওরা দেখতে একই রকম; যেনো এক মায়ের পেটের ভাই।

খালা বলতো, মামুন তোর আপন ভাই, তুই ওকে দেখে রাখবি।

আমি বলতাম, আচ্ছা।

এক বিকেলে মামুন আর আমি নদীর পারের কাশবনের ভেতর দৌড়োদৌড়ি করছিলাম, তখন একটি বুড়ী আমাদের ডাকে। সে একটা বোঝা তার কাখ থেকে নামিয়ে বিশ্রাম করছিলো, এখন আর বোঝা কাঁখে তুলতে পারছে না, আমাদের সে। ডাকে তার বোঝা কাঁখে তুলে দিতে। আমি আর মামুন তার বোঝা তুলে দেয়ার পর সে দোয়া করতে করতে আমাদের ভালোভাবে দেখে। বুড়ী বাইচ্চা থাক বলে আমাদের দোয়া করে, আমার ও মামুনের মুখে হাত বুলোয়, এবং জানতে চায় আমরা একই মায়ের পেটের ভাই কিনা। আমি তাকে বলি যে আমরা একই মায়ের পেটের ভাই নই, খালাতো ভাই। বুড়ী আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে পথে চলতে শুরু করে। তার বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলার অভ্যাস ছিলো, যেমন থাকে গ্রামের সব। বুড়ীরই। আল্লার দুনিয়ায় কত দেহুম, বুড়ী ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটতে হাঁটতে বলতে থাকে, খালাতো ভাইরা দ্যাকতে একরকম, তয় মাগী দুইডা অইলেও বাপ একটাই। কত দ্যাকলাম। শুনে আমি চমকে উঠি, মামুন কিছু বুঝতে পারে নি বলে চমকায় না। নদীর পারে কাশবনে আমি গুচ্ছগুচ্ছ অন্ধকার দুলতে দেখতে থাকি, মামুনকে আমার অচেনা মনে হতে থাকে। মনে হয় আমি আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবো না, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। আমি বসে পড়ি, মামুন অবাক হয়ে আমার পাশে বসে। জোনাকিরা দেখা দিতে থাকে, সেগুলোকেও আমার কয়লার টুকরো মনে হয়।

রাতে ঘুমোতে আমার কষ্ট হয়, আমি ঘুমোতে পারি না। মামুন ঘুমিয়ে আছে, ওর কোনো কষ্ট হচ্ছে না। বড়ো হলে, বুঝতে পারলেই কষ্ট বাড়ে। চারপাশে অনেক রাত, এক গাছ থেকে আরেক গাছে বাদুড় উড়ে যাওয়ার শব্দ পাচ্ছি, আমি ঘর থেকে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকি, কোনো নতুন বউকে গোসল করতে দেখি না, বোঝা কাঁখে একটি বুড়ীকে হেঁটে যেতে দেখি। তখন দেখতে পাই। বাবার ঘর থেকে কে যেনো বেরোচ্ছে, অন্ধকারে তাকে ছায়া বলে মনে হয়, কিন্তু তাকে আমি চিনতে পারি। তার শাড়ির আঁচল জড়ানোর ভঙ্গি, হাঁটার ভঙ্গি আমি চিনতে পারি। মনে হয় সুখে ভেঙে পড়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। আমি চিৎকার করে উঠতে পারতাম, কিন্তু তখন আমার কণ্ঠে কোনো শব্দ ছিলো না, শরীরে কোনো রক্ত ছিলো না। বাবার মুখ আমার মনে পড়ে, তখন আমার অন্য রকম ভাবনা হয়। আগে আমার মনে হতো বাবার কোনো সাঁকো নেই, এখন মনে হতে থাকে বাবার একটি সাঁকো আছে, একথা ভেবে আমার ভালো লাগতে থাকে। তখন আমার ঘুম পায়, আমি ঘুমিয়ে পড়ি, আমার কোনো কষ্ট হয় না। ভোরে উঠে আমি, বাবাকে দেথি, ইচ্ছে করেই খালাকে দেখি; দুজনকেই আমার খুব সুখী মনে হয়, যেমন সুখী মনে হয় সাঁকোর দু-পারকে। বাবাকে আমার খারাপ লাগে না, খালাকে আমার খারাপ লাগে না। তবে কয়েক দিন ধরে ওই ঘটনাটি আমি ভাবি, আমার মনে হতে থাকে মানুষ এমনই; মনে হয় মানুষ বাইরে এক রকম, তার বাইরেরটা সত্য নয়; মানুষ ভেতরে অন্য রকম, তার ভেতরেরটাই সত্য; কিন্তু ভেতরেরটা কেউ দেখতে দেয় না। বাবার ভেতরেরটা কেউ জানে না, বাইরেরটা জানে; তার বাইরেরটা দেখে কেউ। তার সামনে কথা বলতে পারে না। ভেতরেরটা জেনে ফেললে কি সবাই বাবাকে ঘেন্না করবে, বিপদে ফেলবে? না, বাবার ভেতরেরটা আমি কাউকে জানতে দেবো না; বাবাও কখনো জানবেন না যে আমি তার ভেতরেরটা জানি।

আমার দাদা খুন হয়েছিলেন, ছোটোবেলা থেকেই আমি তার কথা শুনে এসেছি। তিনি খুন হয়েছিলেন বলে তাকে আমার মহাপুরুষ মনে হতো; আমি মনে করতাম। কেউ খুব বড়ো হয়ে গেলে ছোটোরা তার বিরুদ্ধে চলে যায়, তাকে সহ্য করতে পারে না, তখন ছোটোরা তাকে খুন করে। খুন করে ছোটোরা নিজেদের বড়ো করে তোলে নিজেদের কাছে। দাদার যে-বর্ণনা বারবার আমি শুনেছি তাতে তাকে মহাপুরুষ না। ভাবার কোনো উপায়ই আমার ছিলো না। তিনি দেখতে বড়ো ছিলেন, চারপাঁচজন তার সাথে জোরে পারতো না; তিনি অল্প বয়সেই ধানের ব্যবসা করে অনেক টাকা। করেছিলেন, ওই টাকা দিয়ে বিলে কিনেছিলেন কানি কানি জমি আর দিঘি। তার খুনের পর পঞ্চাশটা সিন্দুক ভেঙে পুলিশের লোকেরা মনের পর মন রুপোর টাকা বের। করেছিলো, ঘোড়ায় করে সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলো। এক রাতে তিনি খুন হয়ে যান। সে-সন্ধ্যায় তিনি খাওয়াদাওয়া করে বাইরে যান, রাতে জঙ্গলের পাশের পথে খুনীরা। তাকে খুন করে ফেলে রাখে। তার গলা থেকে শরীর আলাদা করে দেয়। তবে তাঁকে খুন করার জন্যে কেউ শাস্তি পায় নি, কেউ ধরা পড়ে নি। একদিন আমি একটা সিন্দুক খুলে কতকগুলো পুরোনো কাগজ পাই, মোটা মোটা মসৃণ ঘিয়ে রঙের কাগজ, তার। ভেতরে আরো কতকগুলো কাগজ। কাগজগুলো খুলে দেখি দাদার খুনের মামলার কাগজপত্র ওগুলো। আমি পড়তে শুরু করি, একজায়গায় এসে আমি চঞ্চল হয়ে উঠি।

উকিল দাদীকে জিজ্ঞেস করছে, আপনার স্বামী সেই সন্ধ্যায় কী খেয়েছিলেন?

দাদী বলছেন, মাছ, ভাত, দুধ, মধু।

উকিল বলছে, আপনার স্বামীর পেটে পিঠা পাওয়া গেছে, আপনি কি তাঁকে পিঠা খাইয়েছিলেন?

দাদী বলছেন, না।

উকিল বলছে, ধর্মাবতার, এই লোকের চরিত্র ভালো ছিলো না। এই লোক সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামেরই কোণায় তার উপপত্নীর বাড়ি যায়। সইজুদ্দিন জোলার বউ তার উপপত্নী ছিলো একথা গ্রামের সবাই জানে।

দাদার দুটি বউ ছিলো, এক দাদীকে আমিও দেখেছি–বেশ সুন্দর; তবু তিনি সইজুদ্দিন জোলার বউয়ের কাছে যেতেন এটা আমাকে অবাক করে। সইজুদ্দিন জোলার বউ বেঁচে আছে, তাকে আমি দেখেছি; কালো কুচকুচে, ঘেন্না হয়। দাদা তার কাছে যেতেন, কেনো যেতেন? সইজুদ্দিন জোলার বউর কী ছিলো যে দাদা দুটি বউকে রেখে তার কাছে যেতেন? দাদাও কি কোনো সাঁকো ছিলো না, তিনি তো দুটি সাঁকো বাঁধার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু একটিও বাঁধতে খারেন নি? কোনো পুরুষই কি ঠিকমতো সকো বাঁধতে পারে না? নাকি বাঁধা সাঁকো তাকে আর আকর্ষণ করে না? তখন দিকে দিকে ছুটতে থাকে? বাবার সাথে খালার একটা সাঁকো আছে, মায়ের সাথে বাবার। কোনো সাঁকো নেই; বাবার জন্যে আমার মায়া হয়, মায়ের জন্যে আমার মায়া হয়। নবম শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে আমি প্রায় সবই বুঝি, কিন্তু আমি কাউকে বুঝতে দিই নি যে আমি বুঝি; তাতে তারা বিব্রত বোধ করতো, তাদের গোপনে গড়ে তোলা সাঁকোগুলো নড়োবড়ো হয়ে উঠতো। তখন থেকেই আমার এমন একটি বোধ জন্মে যে মানুষের কোনো স্খলন দেখেই উত্তেজিত হওয়ার কোনো অর্থ হয় না, মানুষ এমন প্রাণী যা কোনো ছক অনুসারে চলতে পারে না। কিন্তু মানুষ ছকের কথা বলতে, আর ছক। তৈরি করতে খুব পছন্দ করে।

সে-সন্ধ্যায় হাসান ভাইয়ের ঘরে না গেলে ভালো হতো, কিন্তু আমি যে গিয়েছিলাম এতে আমার কোনো অপরাধবোধ হয় নি; বরং মনে হয়েছে না গেলে আমি জীবনের। একটি সোনালি খণ্ড হারাতাম। এমন সুন্দর একটি দৃশ্য কখনো দেখতে পেতাম না। সে-দিন ঈদের চাঁদ উঠেছিলো, আমার রক্তে ঝলক লেগেছিলো; চাঁদ ওঠার সন্ধ্যায়। আমি বন্ধুদের সাথে বাড়ি বাড়ি বেড়ানোর অধিকার পেতাম। বাড়ি বাড়ি বেড়িয়ে সন্ধ্যার বেশ পরে ঘরে ফিরে দেখি বাবা নেই, মা শুয়ে আছে, ঈদের সব আয়োজন করা হয়ে। গেছে, এবং আমার কিছু করার নেই। তখন আমি হাসান ভাইদের দোতলায় যাই, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠি, হাসান ভাইয়ের ঘরের দরোজা ঠেলে ঢুকি। আমি ঢুকতেই হাসান। ভাই আর কদবান মেজে থেকে লাফিয়ে ওঠে। দুজন উলঙ্গ মানুষকে লাফিয়ে উঠতে। দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিলো। হাসান ভাই তার লুঙ্গিটা ধরে খাটের ওপর উঠে দুটি বালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। কদবান তার শাড়ি আর। ব্লাউজ পরার চেষ্টা করে। তার নতুন লাল শাড়ি আর ব্লাউজ থেকে একটা অদ্ভুত সুগন্ধ ভেসে আসতে থাকে আমার দিকে। কদবান শাড়ি পরতে গিয়ে বারবার ভুল করে, তার শাড়ি খসে পড়ে যেতে থাকে। তার বুকের সবুজ পেপে দুটি দেখে আমার চোখ মুগ্ধ। হয়, এই প্রথম আমি চোখের সামনে সম্পূর্ণ মুক্ত বুকের পেঁপে দেখতে পাই। কদবান কিছুতেই ব্লাউজ পরে উঠতে পারে না, পরার চেষ্টা করতেই তাঁর সবুজ পেঁপের বাগান ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে ওঠে। কদবানের পেঁপের দিকে লক্ষ বছর ধরে আমার থাকিয়ে থাকার ইচ্ছে হয়; কিন্তু আমি বেরিয়ে আসি।

আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাসান ভাইয়ের সুচিত্রা, শেফালি, নুরজাহান, বকুলের কথা ভাবতে থাকি। তারা কি সত্য হাসান ভাইয়ের জীবনে? শেফালিদির সাথে এক সন্ধ্যায়। তার যা ঘটেছিলো, তা কি সত্য? তা কি সত্য নয়? শেফালিদিদের বাড়ি কি হাসান ভাই কখনো গেছে। আমার মন বলতে থাকে, হাসান ভাই কখনো ওই বাড়িতে যায় নি। শেফালি হাসান ভাইয়ের জন্যে কখনো কোনো সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে থাকে নি, হাসান ভাই কখনো শেফালির শাড়ির ভেতর হাত দেয় নি। সত্যি কি দেয় নি? আমি জানি না, আমি জানি না। এমন সময় হাসান ভাই আমার ঘরে ঢোকে। হাসান ভাই আমার দু-হাত তার দু-মুঠোতে ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকে, কোনো কথা বলতে পারে না। আমি তার মুখের দিকে তাকাই; হাসান ভাইয়ের মুখ দেখে আমার কষ্ট হয়।

কোনোদিন বলবো না, আমি বলি।

হাসান ভাই আমার হাত ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার মাথা নিচু থেকে আরো নিচুতে নামতে থাকে; আমার মনে হয় নামতে নামতে হাসান ভাইয়ের মাথা আমার পায়ের কাছে নেমে যাবে। আমার খুব কষ্ট হতে থাকে, হাসান ভাইয়ের মাথা। আমি এতো নিচুতে দেখতে চাই না।

কোনোদিন বলব না, আমি আবার বলি।

আমি কদবানকে বিয়ে করবো, হাসান ভাই বলে। তার চোখের জলের ফোঁটা আমার হাতে লাগে।

কেউ রাজি হবে না, আমি বলি।

একমাসও যায় নি তারপর, কদবান একদিন রান্নাঘরের মেজের ওপর পড়ে যায়, বমি করতে থাকে। দু-দিন আমাদের বাড়িটা বেশ থমথম করে। তার পরদিন ভোরে উঠে দেখি কদবান নেই। কিন্তু আমরা কেউ কোনো প্রশ্ন করি নি। কেউ কারো কাছে। জানতে চায় নি কদবান কোথায়? কদবানের এক ভাই আমাদের বাড়িতে মাঝেমাঝে কাজ করতো, সেও কখনো কদবানের নাম উচ্চারণ করে নি। আমি কখনো কদবানের নাম বলি নি, মা কখনো কদবানের নাম বলে নি, বাবা কখনো কদবানের নাম বলেন। নি। আমাদের বাড়িতে যারা আসতো, তারা কখনো কদবানের নাম বলে নি। যেনো কদবান পৃথিবীতে কখনো ছিলো না। মাঝেমাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগতো, কদবান কি পৃথিবীতে এখনো আছে? কদবানের জন্যে শোকে আমার বুক ভরে গিয়েছিলো, আমি তার ঝকঝকে কালো রঙের সৌন্দর্য দেখে দেখে বেড়ে উঠেছিলাম, তার সবুজ পেঁপে আমার চোখে রূপের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো। কদবানকে মনে হলে আজো আমার চোখের সামনে সবুজ পেঁপেভরা পেঁপে গাছ দুলে ওঠে।

যাকে দেখে প্রথম আমি সৌন্দর্যকে দেখি তার নাম তিনু আপা। তাঁর হাতপামুখ। ছিলো ঘন দুধ দিয়ে তৈরি, আমার তাই মনে হতো; এবং আমার মনে হতো তার শরীরে কোনো হাড় ছিলো না। চাঁদের থেকেও ধবধবে আর গোল ছিলো তার মুখ। একটি খালের উত্তর পাশে ছিলো তাদের বাড়ি, শুপুরি আর নারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা। তিনু আপা বিকেলে সুন্দর শাড়ি পরে সামনের দিকে ফুলিয়ে চুল আঁচড়িয়ে মুখভরা মিষ্টি হাসি স্থির করে রেখে তাদের ডালিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে খাল ও খাল পেরিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আমি কোনো কোনো বিকেলে তাঁদের বাড়ির ভেতরের পথ দিয়ে যেতাম, দেখতাম তিনু আপা দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসতেন তিনু আপা। আমি মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকাতাম, দেখতাম তার পায়ের পাতার আলোতে মাটি দুধের মতো হয়ে গেছে। তিনু আপা কখনো হাত উঁচু। করে ডালিম গাছের ডাল ধরে কথা বলতেন আমার সাথে, আমি দেখতাম তার লাল ব্লাউজ উপচে ঘন দুধ গলে পড়ছে। তিনু আপা একবার আমার হাত দেখতে চেয়েছিলেন, আমি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম, তার আঙুলগুলো আমার আঙুল আর। মুঠোতে ঘন দুধের মতো জড়িয়ে যাচ্ছিলো; আমি মনে মনে চাইছিলাম তিনু আপা যেনো আমার হাত কখনো না ছাড়েন। তিনু আপার সাথে আমি এক্কাদোক্কা খেলতাম কখনো কখনো, আমি মনপ্রাণ দিয়ে খেলতাম, কিন্তু আমার খেলার থেকে তিনু আপার। খেলা দেখতেই বেশি ভালো লাগতো। তিনু আপা যেভাবে চাড়া ছুঁড়তেন, তার ডান হাত যেভাবে নিচু থেকে ওপরের দিকে উঠতো, চাড়া কোনো ঘরে পড়ার পর তার ঠোঁট যেভাবে নড়তো, তাতে আমার নিশ্বাস থেমে যেতে চাইতো। সবচেয়ে সুন্দর ছিলো ঘর থেকে ঘরে তাঁর লাফিয়ে চলা। তিনি যখন ঘর থেকে ঘরে লাফিয়ে যেতেন, একটুও শব্দ হতো না; তার পা একরাশ শিউলিফুলের মতো মাটির ওপর ঝরে পড়তো, তিনু আপা মাটির ওপর শিউলি ঝরিয়ে ঝরিয়ে ঘর থেকে ঘরে লাফিয়ে যেতেন। লাফানোর সময় তার শরীরটি ঢেউয়ের মতো দুলতো, আমি চোখের সামনে দুধসাগরের ক্ষীরসাগরের ঢেউ দেখতে পেতাম; বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার পরও আমার চোখে দুধসাগর ক্ষীরসাগর দুলতে থাকতো। দুধের ঢেউয়ের মতো আমার চোখে ঘুম। নামতো।

তিনু আপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে–খবরটি আমি এক বিকেলে জানতে পাই, আমার বুক হঠাৎ কেঁপে ওঠে, আমি খুব কষ্ট বোধ করি। আমি ভেবেছিলাম তাঁকে ডালিম গাছের নিচে দেখতে পাবো, কিন্তু পাই না, তার বদলে খবরটি পাই; আমার বিকেলটি ঘোলা হয়ে উঠতে থাকে। মাঠে না গিয়ে আমি নদীর পারের দিকে চলে। যাই, গাছপালা নদীর ঢেউয়ে আমি কোনো সৌন্দর্য দেখতে পাই না। আমি তিনু আপার ঠোঁট দেখতে পাই, মনে হতে থাকে নদীর আকাশে তিনু আপার ঠোঁট ঝিলিক দিয়ে। উঠছে; আমি তার বাহু দেখতে পাই, নদীর ঢেউয়ে তার বাহু দুলে উঠতে দেখি; তার। ধবধবে দুধের মতো দেহটি আমার সামনে ঘর থেকে ঘরে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে। থাকে। আমি দেখতে পাই তিনি লাফিয়ে চলছেন আর তার পেছনের দিকটি নদীর ঢেউয়ের ওপর সোনার কলসির মতো দুলছে। সে-রাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখি; দেখতে পাই তিনু আপাকে নিয়ে আমি খুব দূরে কোথাও চলে গেছি; তিনু আপা বলছেন, তুমি আমাকে নিয়ে খুব দূরে কোথাও চলো, আমি তাঁকে নিয়ে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। তিনু আপা আর হাঁটতে পারছেন না, আমার হাত ধরে হাঁটছেন; শেষে আমার বুকের ওপর লুটিয়ে পড়লেন।

সেই প্রথম আমি বিষণ্ণতা বোধ কৃরি, এর আগে এমন কিছু আমি অনুভব করি নি। আগে আমি আনন্দ আর সুখ বোধ করেছি, শরীরে আর মনে কষ্টও পেয়েছি, কিন্তু কোনো কিছু ভালো না লাগার অনুভূতি আমার হয় নি। তখন আমি সব কিছু অস্পষ্ট। দেখতে থাকি, আমার চোখের ওপর একটি কুয়াশার পর্দা লেগে থাকে সব সময়, মনে হতে থাকে আমি কাউকে চিনি না, আমার কোনো বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই। বড়ো একলা লাগতে থাকে। আমি নদীর পারে একা একা হাঁটতে থাকি, বই পড়তে পারি না, ঘুমোতে আমার কষ্ট হয়। আমার শরীর ব্যথা করতে শুরু করে; তখন আমি আর তিনু। আপাকে দেখতে পাই না, একটা অচেনা লোককে দেখতে পাই, দেখি লোকটি তিনু আপার পাশে শুয়ে আছে। আমার খুব কষ্ট হতে থাকে, আমি ঘুমোতে চাই, ঘুমোতে পারি না; মনে হতে থাকে জীবনেও আমার কখনো ঘুম আসবে না। কিন্তু আমাকে ঘুমোতে হবে, নইলে আমি বাঁচবো না। আমি আমার শরীরের ওপর হাত বুলোতে থাকি; মাথা, মুখ, বাহু, উরুতে হাত বুলোতে থাকি; এক সময় আমার হাত দু-পায়ের মাঝখানের অঙ্গটির ওপর গিয়ে পড়ে। আমার হাত ওটির কঠিনতা বোধ করতে শুরু করে, এর আগে আমি ওটি ছুঁতে লজ্জা পেয়েছি, কিন্তু আজ ওর কঠিনতা থেকে আমি সরে আসতে পারি না, আমি ওকে বারবার ছুঁতে থাকি, তিনু আপা একবার যেমন করে আমার আঙুল নেড়েছিলেন, আমি তেমনভাবে নাড়তে থাকি, আমার ঘুম পেতে থাকে, নদীর ঢেউয়ে আমি ভাসতে থাকি। আমার আকাশে বিদ্যুৎ ঝলক দিয়ে উঠতে থাকে, আমি ক্ষীরসাগরে সাঁতার কাটতে থাকি, এক সময় আকাশপাতালসূর্যচাঁদ ভেঙেচুড়ে আমি কাঁপতে থাকি, আমার ভেতর থেকে সূর্যচাঁদরা গলগল করে বেরোতে থাকে। আমি কোমল আগুনের শিখার ওপর ঘুমিয়ে পড়ি।

সেবার আমি একলা বেড়াতে যাই রাজবাড়ি, মেজো বোনের বাসায়। এর আগে দুবার আমি ওই শহরে গেছি, তাই একলা আমি যেতে পারবো এতে কেউ সন্দেহ করে না; আমারও ভালো লাগে যে আমি একলা যাচ্ছি। বাঘড়া থেকে আমি গাজি ইস্টিমারে উঠি, বাবা আমাকে ইস্টিমারে উঠিয়ে দিয়ে যান। আমি ওপরের ডেকে উঠে কোনো জায়গা পাই না, দিকে দিকে সবাই বিছানা পেতে শুয়ে আছে, বসে আছে; কোথাও একটু জায়গা নেই। আমি সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। একটি লোক আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। লোকটি দেখতে বেশ ভালো, মুখে অল্প দাড়ি আছে, মাথায় টুপিও রয়েছে। বয়সে বাবার মতোই হবে। লোকটিকে আমার ভালোই লাগে। আমি কেনো দাঁড়িয়ে আছি সে জানতে চায়। সে আমাকে বলে তার বিছানার পাশে জায়গা আছে, আমি। সেখানে গিয়ে বিছানা পেতে শুতে পারি। নানা দিক ঘুরে, অনেক মানুষ পেরিয়ে, সে ডেকের শেষ দিকে নিয়ে যায় আমাকে; সেখানে তার বেশ বড়ো বিছানাটি পাতা। রয়েছে। বিছানার পাশে জায়গাও রয়েছে। সে তার বিছানাটি কিছুটা গুটিয়ে আরো। জায়গা করে দেয়; আমি সেখানে আমার বিছানা পাতি। সে চা আনায়, আমি তাকে বলি যে আমি চা খাই না; কিন্তু কুকিজটি খেতে সে আমাকে বাধ্য করে। সে জাহাজের রেস্টুরেন্টের লোকটিকে বারবার ডেকে কুকিজ আনতে বলে, কুকিজটি সে আমার হাতে গুঁজে দেয়, সেটি না খেলে খুব খারাপ দেখায় বলে আমি সেটি খাই। কুকিজ খেতে। অবশ্য আমার সব সময়ই ভালো লাগে। লোকটিকেও আমার খারাপ লাগে না। লোকটি বলে আমার সমান তারও একটি ছেলে রয়েছে, সেও টেনেই পড়ে। তখন বেশ রাত, ইস্টিমারের শব্দ আর ঘোলাটে আলোতে সব কিছু আমার অদ্ভুত লাগছে। লোকটি গৃমিয়ে পড়েছে মনে হয়, কিন্তু আমার শুতে ইচ্ছে করছে না। দিকে দিকে লোকেরা ঘুমিয়ে পড়ছে, তাদের ঘুমোনোর ভঙ্গি দেখে মনে হয় তারা সারাজীবনে ঘুমোয় নি, আজই প্রথম ইস্টিমারে উঠে ঘুমোনোর সুখ পেয়েছে। আমিও এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। একটু শীত লাগে, ঘুমের ঘোরে আমার মনে হয় কে যেনো আমার গায়ে চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে, তাতে আমার ঘুমিয়ে পড়তে আরো ভালো লাগে। ঘুমের ঘোরে আমি টের পাই একটি হাত আমার হাফপ্যান্টের সামনের দিকের বোতাম খুলছে, আমি হাত দিয়ে হাতটি সরিয়ে দিই; কিন্তু হাতটি আবার সামনের দিক দিয়ে ঢুকে আমার অঙ্গটিকে। নাড়তে থাকে। আমি হঠাৎ উঠে বসে আমার হাফপ্যান্টের সামনের দিকে হাত দিই, লোকটি দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়, দেখি আমার হাফপ্যান্টের বোতামগুলো খোলা। আমি ঘুম থেকে উঠে বসে থাকি, লোকটি অন্য দিকে মুখ দিয়ে ঘুমোতে থাকে। ভোর হলে সে অজু করে নামাজ পড়ে, আমার সাথে কোনো কথা বলে না।

আমার বোনের বাসা ছিলো রেলকলোনির পাশে। আমি তখন সাইকেল চালাতে শিখেছি। দুলাভাইয়ের একটি সাইকেল ছিলো, সেটি নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়তাম; খুব ভালো লাগতো আমার রেলকলোনির পাশের গুঁড়োগুড়ো কয়লাবিছানো পথে সাইকেল চালাতে। খুব মসৃণ ছিলো ওই পথ, একটুও ঝাঁকুনি লাগতো না। একদিন সাইকেলের চেইন পড়ে যায়, একটি লোক এসে আমাকে চেইন লাগাতে সাহায্য করে। তার সাহায্য আমি চাই নি, সে নিজেই আসে, চেইন লাগিয়ে দেয়, এবং আমাকে পাশের দোকানে নিয়ে চা খাওয়াতে চায়। লোকটির কথা শুনে আমি বুঝতে পারি সে বিহারি, আমার ভয় লাগে, আর চা আমি খাইওনা, তাই তার সাথে আমি যাই নি। লোকটি বলে সে রেলে কাজ করে, আমি চাইলে সে আমাকে ট্রলিতে করে বেরিয়ে আনতে পারে। ট্রলিতে চড়ার সখ ছিলো আমার;–সাইকেল চালাতে চালাতে আমি দেখেছি। রেলের লোকেরা ট্রলিতে করে সাঁই সাঁই করে ইস্টিশনের দিকে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। একদিন বিকেলে সে আমাকে ট্রলিতে করে বেড়াতে নিয়ে যায়; তার সাথে আমি কয়েকবার ইস্টিশনের দিকে যাই, আবার ফিরে আসি। তাকে আমার বেশ ভালো লাগে। পরের দিন দুপুরে সে আমাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করে। ওই কলোনির সব বাসাই ছিলো মূলিবাঁশের, আমাকে সে তার বাসাটি দেখিয়ে দেয়। পরের দিন দুপুরে আমি তার বাসায় যাই। আমি ঢুকতেই সে ঠেলে দরোজা বন্ধ করে দেয়, আমি অবাক হই; এবং সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পাই, সে আমাকে নিয়ে মেজের ওপর গড়িয়ে পড়ে; আমি টের পাই সে তার একটি বিশাল শক্ত অঙ্গ আমার গায়ে লাগাতে চাচ্ছে। আমি তার অঙ্গটিকে ডান মুঠোতে শক্ত করে ধরে ফেলি, নখ বিধিয়ে দিই; বাঁ হাত দিয়ে তার অণ্ড দুটিকে চেপে ধরি। গো গোঁ করে সে মেজের ওপর উল্টে পড়ে। আমি দরোজা খুলে বাইরে বেরোই, আস্তে আস্তে বাসার দিকে হাঁটতে থাকি।

আমার পনেরো বছর হতে না হতেই অনেক কিছুই ভেঙে পড়ে আমার চোখের সামনে, আমার মনের ভেতরে। আমি, সব সময়ই, চারপাশে অনেক ভালো ভালো কথা শুনতে পাই, শুনে আমার কেমন হাসি পায়, যদিও আমি হাসি না। বইয়েও আমি অনেক ভালো ভালো কথা পড়ি, পড়ে আমার হাসি পায়। আমার মনে হতে থাকে মানুষ ভালো ভালো কথা বলতে পছন্দ করে, এটা মানুষের স্বভাব; কিন্তু মানুষ দুর্বল প্রাণী। আমাদের বাড়ি থেকে তাকালে উত্তর দিকে একটা মঠ দেখা যেতো, আমার মনে হতো মঠটি এখনই ভেঙে পড়বে; একবার আমি একটি মসজিদে শিরনি দিতে গিয়েছিলাম, মৌলভির হাতে গামলাটি দিয়েই আমি দৌড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো ওই পুরোনো দালানটি এখনই ভেঙে পড়বে। ওই দুটির কোনোটিই হয়তো এখনো ভেঙে পড়ে নি, হয়তো পড়েছে, অনেক দিন ওগুলোর কথা আমার মনে পড়ে নি।

আমার ভেতর একটি লাল ক্ষুধা জেগে উঠছে, তার সাথে পেরে উঠছি না আমি, টের পাচ্ছি আমি ভাঙছি; আমার ভেতরে ভাঙন শুরু হয়েছে, আমি তার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ওই ভাঙনের শব্দ অত্যন্ত মধুর, আমি সারাক্ষণ ব্যাকুল হয়ে থাকছি ওই ভাঙনের শব্দ শোনার জন্যে। সব কিছু আমার অন্য রকম লাগতে শুরু হয়েছে। মা সব সময় শুয়ে থাকে, যখনই ঘর থেকে বেরোই দেখি শুয়ে আছে, যখন ফিরি দেখি শুয়ে আছে। মা খুব ক্লান্ত, মা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। মা অনেক সময় মেজেতে শুয়ে থাকছে, রান্নাঘরের খাটালেও শুয়ে থাকছে কখনো। অথচ মার জন্যে আমার মায়া হচ্ছে না; আমি তার পাশ দিয়ে যাচ্ছি আসছি, তাকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না। মাও আমাকে বেশি ডাকছে না আজকাল, মা খুব ক্লান্ত। বাবাকে বাড়িতে দেখি না, বাবাও ভেঙে গেছেন আরো; তারা ভেঙে গেছেন, এবং আমি ভাঙছি। আমার ভাঙন তাঁদের ভাঙনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি রক্তে কাপন বোধ করছি, আমার রক্ত উলঙ্গ পাগল হয়ে গেছে, আমি তার কলকল প্রবাহের শব্দ শুনছি; রক্তের ঘর্ষণে আমার গায়ের ত্বক অ্যালিউমিনিআমের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আমি যেখান দিয়ে যাই, আমার মনে হয়, সেখানকার বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠছে আমারই রক্তের মতো; পুকুরে নামলে মনে হয়। পুকুর হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠলো, পুকুরের পানি গর্জন করে উঠলো আমার রক্তের মতো।

আমি নিজে নিজে সুখ পেতে শুরু করেছি; নিজের শরীরের ভেতরে যে এতো শিমুল বন ছিলো, সেখানে মধুর চাক ছিলো, তাতে এতো মধু ছিলো, সে-মধুর চাক ভাঙতে যে এতো সুখ, তা আমার জানা ছিলো না। জানার পর আমি আমার ভেতরের মধুর চাক। ভাঙতে শুরু করি, ভেতর থেকে জমাট মধু বের হয়ে আসতে থাকে। বোশেখের রোদে হেঁটে হেঁটে একবার আমি বিলের ভিটায় যাই, চারপাশে গলানো পারদের মতো রোদ, ভিটায় একটি বড়ো কাঠবাদামের গাছ, তার পাশে একটি ঝোঁপ, আর ঝোঁপের পাশে সবুজ ছায়ার অন্ধকার। আমি সে-ছায়ায় বসে রোদ পান করতে থাকি, আমি রোদের স্তরের ওপর রোদের স্তর দেখতে থাকি, রোদ রসের মতো লোমকূপের ছিদ্র দিয়ে আমার ভেতরে ঢুকতে থাকে। দূরে অনেকগুলো গরু চরছে, কোনো রাখাল দেখা যাচ্ছে না, বোরোধানের খেতের ভেতরে সবুজ আগুন জ্বলছে। আমার ভেতরে আগুন লেগে যায়। আমি আমার মধুর চাকে হাত দিই, বিলকিসকে মনে পড়ে, যাকে আমি দু-দিন আগে। পুকুরে গোসল করতে দেখেছি, কদবানের পেঁপে দুটিকে আমার সবুজ মনে হতো, বিলকিসের দুটিকে আমার সবুজ মনে হয় নি, পেঁপে মনে হয় নি, শ্রাবণের আকাশের ভেজা চাঁদ মনে হয়েছে, আমার ভেতর থেকে গলগল করে মধু বেরিয়ে আসতে থাকে। কাঠবাদাম গাছের পাশের ঝোপে আমি মধুর প্লাবনে ডুবে যাই।

আমার রক্তের মধু প্রাণ ভরে পান করেছি আমি, আমার রক্তমাংস আষাঢ়ের আকাশের মতো বস্ত্র ও বিদ্যুতে খানখান ফালাফালা হয়ে গেছে, আমার ভেতর থেকে নালি বেয়ে বেয়ে মধু ঝরেছে। একটি ধর্মের বই তখন হাতে আসে আমার, তাতে আমি পড়ি ওইভাবে চাক ভেঙে মধু বের করা পাপ, তখন আমার ভয় লাগতে থাকে, দোজগের আগুন দেখতে পাই, কেননা বইটি ভরেই জ্বলছিলো দোজগের আগুন। কিন্তু পাপ আর দোজগের আগুন ওই মধুর প্লাবনে বারবার নিভে যেতে থাকে। সুন্দরের মধ্যে গেলেই আমার ইচ্ছে হতো চাক ভাঙতে। একবার দুপুরে আমার ডাব খেতে ইচ্ছে হয়; আমি আমাদের নারকেল বাগানে যাই। একটি নারকেল গাছ বেয়ে বেয়ে আমি উঠতে থাকি। গাছটিকে জড়িয়ে ধরতেই আমার কেমন যেনো লাগে, একটু ওপরে উঠতেই আমার ভালো লাগতে থাকে গাছটিকে জড়িয়ে ধরে থাকতে, আমি খুব কোমলভাবে গাছটিকে জড়িয়ে ধরি, কোমলভাবে একটু একটু করে ওপরের দিকে উঠি, গাছটিকে। আমার আর গাছ মনে হয় না, বিলকিস মনে হয় কদবান মনে হয় তিনু আপা মনে হয়, আমি চোখে জ্বলজ্বলে অন্ধকার দেখতে থাকি, আমার সমগ্র জগত অন্ধকার হয়ে ওঠে, আমার তীব্র আলিঙ্গনে গাছটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আমি গাছটিকে জড়িয়ে ধরে। গাছের গায়েই যেনো ঘুমিয়ে পড়ি। একবার পদ্মার পারে বিকেলবেলা গিয়ে দাঁড়াই। আমি। আমার পেছনে নারকেল গাছের সারি, আমার পায়ের নিচে কোমল বেলেমাটি, দূরে নদীতে ছোটো ছোটো নৌকো ভাসছে-জেলেরা ইলিশ ধরছে। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে। দেখি পদ্মার জল গলানো সিঁদুরের মতো হয়ে গেছে, পশ্চিমের আকাশ ছুঁয়ে সিঁদুরের ঢেউ উঠছে; সেই সিঁদুরগোলানো পানির ঢেউ লেগে পশ্চিমের আকাশ ভিজে গেছে, আমি ভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠি। আমার লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয় পশ্চিমের আকাশের পানিতে, ওই পানির সমস্ত সৌন্দর্য মাংস দিয়ে অনুভব করার। তীব্রতা বোধ করি আমি, কিন্তু বুঝতে পারি কোনো কিছুই চরমভাবে অনুভব করার শক্তি আমার শরীরের নেই, তখন আমি নারকেল গাছের শেকড়ের ওপর বসে পড়ি; পদ্মার পশ্চিম পারের মতো রঙিন মধু ঝরতে থাকে আমার রক্ত আর মাংস থেকে।

সোনামতির প্যাট অইছে, খবরটা মাকে দিচ্ছিলো কালার মা; আমি পাশের ঘর থেকে শুনছিলাম।

তুমি শুনলা কার কাছে? মা জিজ্ঞেস করলো।

চৈদ্দগ্রামের কে না জানে, কালার মা বলছিলো, বাইরে ত এই কিচ্ছায় কান পাতন যায় না।

কে এই কাম করল? মা জিজ্ঞেস করে।

কে আর করব, ইদ্রিসসা জোয়াইনকাই করছে, কালার মা বলে, অই ভাদাইমা ছাড়া আর কে করব।

কালার মা খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে; পাড়া থেকে পাড়ায় ছড়ানোর মতো একটি ঘটনা সে পেয়ে গেছে, পেয়ে খুব তৃপ্তি পাচ্ছে; কিন্তু আমি কোনো চঞ্চলতা বোধ করছি না, শুধু সোনামতি আপার মুখটা আমার মনে পড়ছে, যাকে আমি মুখোমুখি আপাই বলি, আর মনে পড়ছে ইদ্রিসদার মুখটাও। তারা দুজনে মিলে একটা খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছে, আমি বুঝতে পারি, বিয়ে না করে এমন কাজ করা তাদের ঠিক হয় নি। সোনামতি আপাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে, কলাপুরিনারকেল গাছ দিয়ে ঘেরা, আর তার পাশেই, একটি ছোটো খালের পাড়ে, ইদ্রিসদাদের বাড়ি, সেটিও ঘেরা কলাপুরিনারকেল গাছ দিয়ে। অনেক দিন তাদের বাড়ি আমি যাই নি, আজ বিকেলে একবার যাবো। সোনামতি আপা আর ইদ্রিসদা একটা খুব খারাপ কাজ করেছে। খুব খারাপ কাজ করেছে তারা?, আমার মনে এমন একটি প্রশ্ন আসছে, অনেকক্ষণ ধরে প্রশ্নটিকে আমি তাড়াতে পারছি না। আমাদের গ্রামের কে কে এমন। খারাপ কাজ করতে রাজি নয়? সোনামতি আপা রাজি হলে কে কে এমন কাজ করতো না? তারপর পালিয়ে যেতো না? বিকেলে আমি সোনামতি আপাদের বাড়ি গিয়ে দেখি তিনি দক্ষিণের ঘরে তার মায়ের পাশে বসে আছেন। তার মা খুব অসুস্থ, বাঁচবে না। আমাকে দেখে বিষণ্ণভাবে হাসলেন সোনামতি আপা; আমার চোখে পড়লো বেশ বড়ো পেট হয়েছে তাঁর। দাঁড়াতে তার কষ্টই হচ্ছিলো। তখন ইদ্রিসদা এলেন। আমাকে তিনি দেখতেও পেলেন না যেনো, পাগলের মতো লাগছিলো তাকে; তিনি, চিৎকার করছিলেন, গ্রামের যেই শালারপোই যেই কথা কউক না ক্যান, আমি সোনামতিরে বিয়া করুমই। ইদ্রিসদা পালিয়ে যায় নি দেখে ভালো লাগলো আমার।

বিচার হবে সোনামতি আপা আর ইদ্রিসদার;–বিচার আমি দেখতে পাবো না, ছোটোদের ওই বিচারে থাকতে দেয়া হবে না। আমার খুব ইচ্ছে বিচার দেখার; মকবুল আর হান্নানেরও খুব ইচ্ছে। ওরাই আমার কাছে প্রস্তাবটি নিয়ে আসে। বিচার হবে। সোনামতি আপাদের উঠোনে, সন্ধ্যার পর; উঠোনের পাশে রয়েছে রান্নাঘর, আমরা চুপ করে রান্নাঘরের বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে বিচার দেখতে পারবো। কোনো শব্দ না করলেই চলবে, বড়োরা আমাদের খেয়ালও করবে না, তারা ব্যস্ত থাকবে বিচার নিয়ে। বিচার পেলে বড়োদের আর কোনোদিকে খেয়াল থাকে না। ওই বড়োদের অনেককেই। আমরা তখনই বড়ো বলে বিশেষ মান্যগণ্য করছি না; তাদের দেখলে যদিও সালাম। দিই, আড়ালে অনেককে ছাগল, পাগল, মুরগিচোরা, টাউট বলতে শুরু করেছি। যেমন তোতাখা আর কফিল মাতবরকে বছরখানেক ধরে আমরা সালাম দিই না, পথে দেখা হলে মাথা নিচু করে অন্য দিকে চলে যাই। কিন্তু তোতাখা আর কফিল মাতবর মাঝেমাঝে আমাদের ডাকে।

কি মিয়ারা, সিয়ানা অইয়া গ্যাছ বুঝি, তারা বলে, আইজকাইল আর সেলামআদাব দেও না।

সালামাইকুম, বলে আমরা কেটে পড়ি।

তারা থাকবে বিচারে, তারা বিচার করবে। বাবাও থাকবেন, মকবুল আর হান্নানের। বাবাও থাকবেন। কিন্তু আমাদের বিচার দেখতে হবে।

বিচারটা দেখতেই হবে, কোনোদিন তো আমাদের নিয়েও এমন বিচার হতে পারে, মকবুল বলে।

আমি মকবুলের কথা শুনে ভয় পাই, আমাকে নিয়ে এমন বিচার হচ্ছে ভাবতে পারি না।

তুই কার পক্ষে? মকবুল আর হান্নান আমাকে জিজ্ঞেস করে।

এতে আবার পক্ষ নিতে হবে নাকি? আমি জিজ্ঞেস করি।

যদি হয়? ওরা জানতে চায়।

আমি সোনামতি আপা আর ইদ্রিসদার পক্ষে, আমি বলি।

হ, আমরা সোনামতি আপা আর ইদ্রিসদার পক্ষেই, ওরা বলে। মকবুল একটু বেশি করেই জোর দেয় কথাটির ওপর, এবং একটি সিগারেট ধরায়, আমি অবাক হই।

বাবার পকেট থেকে চুরি করেছি, মকবুল হাসতে হাসতে বলে।

সোনামতি আপাদের রান্নাঘরের বেড়ার আড়ালে সন্ধ্যার অন্ধকারে লুকিয়ে আমরা বিচার শুনছি, দেখতে পাচ্ছি না বেশি; তবে তাদের সবার গলাই চেনা আমাদের, কে। কথা বলছে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। আবুল হাশেমের গলাটাই শোনা যাচ্ছে বেশি। বুড়োরা অত্যন্ত অশ্লীল কথা বলতে পারে, তারা তা অবলীলায় বলে যাচ্ছে। খানকি শব্দটি। তাদের বেশ প্রিয়, বারবারই বলছে। হাশেম জোরে চিৎকার করে বলছে তার চোখেই প্রথম ঘটনাটি ধরা পড়ে;–একরাতে সে দেখতে পায় সোনামতি আর সোনামতির মা যে-ঘরে থাকে, ইদ্রিস সে-ঘরের দরোজায় এসে আস্তে হাঁটু দিয়ে তিনবার টু দেয়। তখন ওই ঘরের দরোজা খুলে যায়। আবুল হাশেম ঘটনাটি পরীক্ষা করেও দেখে। একরাতে সে নিজে সোনামতির মায়ের ঘরে গিয়ে তিনবার হাটু দিয়ে টু দেয়, তখন। সোনামতি দরোজা খুলে দেয়; তাকে দেখে সোনামতি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে। সোনামতিকে জিজ্ঞেস করে সোনামতি কেনো দরোজা খুলেছে, সোনামতি মিথ্যা কথা বলে যে বাইরে যাওয়ার জন্যে সে দরোজা খুলেছে। আবুল হাশেমের সাথে আরো। তিনচারজন চিৎকার করতে থাকে। সোনামতি আর তার মা যে-ঘরে থাকে, হাশেম সে-ঘরটির বিস্তৃত বর্ণনা দেয়। সে বলে ঘরটিতে কোনো খাট নেই চৌকি নেই, মাটিতে দুটি বিছানা রয়েছে; একটিতে থাকে সোনামতির আধমরা মা, যার মরার বেশি বাকি নেই, যার হুঁশ নেই; অন্যটিতে থাকে সোনামতি। হাশেম চিৎকার করে বলে যে ইদ্রিস আর সোনামতি মায়ের পাশে শুয়ে কবিরা গুনা করেছে, তাদের লাজলজ্জার বালাই নেই: আর সোনামতির মায়েরও লাজলজ্জা নেই, নিজের পাশে শুয়ে সে নিজের মেয়েকে জিনা করতে দিয়েছে। সোনামতির মাকে ডাকা হয়, কিন্তু তার কোনো হুঁশ নেই; হাশেম বারবার জিজ্ঞেস করে, সে যা বলেছে তা সত্য কিনা; সোনামতির মা কোনো কথা বলে না, হয়তো সে কিছু শুনতে পায় নি। তোতাখা চিৎকার করে বলে যে খানকির ঘরে তো খানকিই হবে, সোনামতির বাপ বছরের পর বছর জাহাজে কাজ করেছে, আর। খানকিটা বছরের পর বছর যারেতারে দিয়ে পেট বানিয়েছে; তার মেয়ে তো খানকিই হবে। এবার মনে হলো সোনামতি আপার মা শুনতে পাচ্ছে, সে আস্তে আস্তে উত্তর দিতে চেষ্টা করছে; সে বলছে, আমি জুদি বছর বছর সোনামতির বাপ ছাড়া অন্যের লগে পেড বানাইয়া থাকি, তয় ত আমি বিদাশ থিকা মরদ ভাড়া কইর‍্যা আনি নাই, আপনাগো কারো লগেই পেড বানাইছি। একটা হৈচৈ পড়ে যায় চারপাশে, সোনামতির মা আর কথা বলে না। বিচার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। ইদ্রিসদা চিৎকার করে ওঠেন, জিনা আমি বুঝি না, সোনামতির লগে আমার ভাব হয়েছে, আমি তারে বিয়া। করুম। সোনামতির পেটের পোলা আমার। তার দু-দিন পর দু-বাড়িতে সারাদিন ধরে কোরান পড়া হলো, সোনামতি আপার আর ইদ্রিসদার বিয়ে হয়ে গেলো।

1 Comment
Collapse Comments

আমাদের সমাজের অন্ধকার দিকগুলো কী অবলীলায় বর্ণনা করেছেন হুমায়ুন আজাদ!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *