০৮. শৃংখলা

শৃংখলা

বিবাহ কী? বিশেষ ভাবে বহন করা? বি + বহ্ ধাতু + ঘঞ? বিবাহ কি আত্যন্তিক ভাবে অনুষ্ঠান বা রাষ্ট্রবিধি নির্ভর? অর্থাৎ পুরোহিত, পাদরি বা মোল্লার মধ্যস্থতায় নিষ্পাদিত একটি চুক্তি অথবা রেজিস্ট্রেশনে সম্পাদিত একটি পারস্পরিক চুক্তি? এইগুলির দ্বারা অনুষ্ঠিত বিবাহে যে দুটি মানুষ যুগ্ম জীবনযাপনে প্রবৃত্ত হয় তার মধ্যে পরে নানা অসংগতি ও বিরোধ দেখা দিতে পারে এবং অনেক সময়ে দেখা দেয়ও। ‘কেহ কাহাকেও লঙ্ঘন করিবে না’ ইত্যাকার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মাঝে মাঝে একপক্ষ অপরকে লঙ্ঘন করে থাকে। যতক্ষণ মৃত্যু আমাদের না বিচ্ছিন্ন করে’ ততক্ষণ দু’জনের পরস্পরের সঙ্গে সুখে দুঃখে, রোগে ভোগে একত্র থাকার অঙ্গীকার সত্ত্বেও বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। অবস্থাবিশেষে প্রেম অন্তর্হিত হওয়ার পরেও মৃত বিবাহের জের টেনে চলা গ্রিক পুরাণের সিসিফাস্-এর দণ্ডের সমতুল্য হয়ে যায়— সে দণ্ডের কোনও প্রতিকার বা অবসান নেই। বিচ্ছেদ দেখা দেয় কখনও দু’জনের মধ্যে কোনও তৃতীয়ের আবির্ভাবে কখনও বা উভয়ের যুগ্ম জীবনের মধ্যে কোনও এক বা একাধিক অসঙ্গতির ফাটল দেখা গেলে, কখনও আগন্তুক কোনও আঘাত বা মতদ্বৈধে। কারণ যাই হোক, ধর্ম বা আইনের সামনে গৃহীত শপথের বন্ধন যে অক্ষয় নয় তা বারে বারেই দেখা গেছে। তা হলে দুটি মানুষের মিলিত জীবনের পক্ষে এ শপথ অপরিহার্যও নয়, ইষ্টসাধকও নয়।

অথচ অনাদ্যন্ত কাল ধরে নারী ও পুরুষ পরস্পরকে পেতে এবং সে পাওয়াকে স্থায়ী করতে চেয়েছে। এটা একটা সুস্থ স্বভাবিক চাওয়া, যার রূপ, ঐশ্বর্য ও মাধুর্য পাঁচ ছয় হাজার বছর ধরে সাহিত্যে চিত্রিত ও অভিনন্দিত হয়েছে; সে চিত্র মানুষকে মুগ্ধ করেছে, আগ্রহী করেছে আপন উপলব্ধিতে এই মিলনকে পেতে, স্থায়ী করতে। তা হলে ধর্ম বা আইনের সমর্থন ছাড়াও এই মিলনের জন্য আকুতির একটি প্রকৃতিগত ভিত্তি আছে। ধর্ম বা আইন এ মিলনকে বাইরে থেকে একটা ছকের মধ্যে ভরে একে নিরাপদ ও স্থায়ী করতে চেষ্টা করেছে। তাতে সমাজ স্বস্তি পেয়েছে। সন্তানরা এবং দম্পতিও এক ধরনের একটা নিরাপত্তা বোধ পেয়েছে। কিন্তু, এই মিলনের ভিত্তি যদি হয় একটি নারী ও একটি পুরুষের অন্তরের টান, তা হলে যথার্থ নিরাপত্তার ভিত্তি তো সেই অন্তরের টানেই। সেই টান যদি একদিন শিথিল হয় তা হলে আইন বা ধর্ম তখন বাইরে থেকে চাপানো বন্ধন মাত্র হয়ে ওঠে এবং সে বন্ধনের মধ্যে সন্তানের সামাজিক স্বীকৃতি, লালন, ইত্যাদির নিরাপত্তা থাকলেও দম্পতির মানসলোকে সে নিরাপত্তা তো ততক্ষণে কৃত্রিম হয়ে উঠেছে।

এ কথা ভুললে চলবে না যে, ঐক্যদাম্পত্যে মানুষ পৌঁছেছে ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পরে। গোষ্ঠী দাম্পত্য, কৌম দাম্পত্য, কৌল (কুল বা বৃহৎ পরিবারের) দাম্পত্য পার হয়ে তবে দাম্পত্য পৌঁছেছে ঐক্যদাম্পত্যে। এবং দাম্পত্যের ইতিহাসে এর স্থায়িত্বও নেহাৎ কম নয়। এর আশ্রয়ে দাম্পত্য এমন এক স্থিতি লাভ করেছিল যা সভ্যদেশে একে এত দীর্ঘস্থায়ী করেছে। আজ বহু ব্যতিক্রম বহু বিঘ্নে এ সম্বন্ধের প্রান্তে একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। পরিবার নিয়ে এঙ্গেলস, দাম্পত্য নিয়ে সিমোন্ দ বোভোয়া অনেক সংশয় প্রকাশ করে এ দুটির ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। এখন বিবাহ সম্বন্ধে আইন খোলা রেখেছে অবাঞ্ছিত দাম্পত্য থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ, ফলে অনিচ্ছায় আমরণ বন্দিত্ব মেনে নেওয়া আজ আর বাধ্যতামূলক নয়। যদিও এ মুক্তির সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক সমস্যাও দেখা দেয়— সন্তানের ভবিষ্যৎ, উপার্জনহীনা বধূর ভবিষ্যৎ, সংযুক্ত আয়ে কেনা সামগ্রী ও বাসস্থানের বিভাগ, ইত্যাদি, তবুও অসহ্য দাম্পত্য মুখ বুজে বহন করার দায় আজ আর কোনও পক্ষেরই নেই। কাজেই এখন আর একবার দাম্পত্য সম্বন্ধে নতুন করে ভাবা যেতে পারে।

ব্যতিক্রম এখনও স্বল্প সংখ্যক হলেও কিছু কিছু ঘটছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজে। বিয়ে না করে একত্রবাস, বিয়ে ভেঙে অন্যের সঙ্গে একত্রবাস, বিয়ে রেখেও যুগপৎ এক বা একাধিক সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সাহচর্য— সদর রাস্তায় না হলে খিড়কির রাস্তায়– এ সবের ফলে বিবাহ ব্যাপারটাই আর একবার কাঠগড়ায় উপস্থিত। বলা বাহুল্য, এ সব ব্যতিক্রম ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও মাত্রায় বহুকাল ধরেই সমাজে চলিত ছিল, আজ এগুেলো অনেক বেশি প্রকাশ্য এবং নায়ক নায়িকারা অনেক বেশি নিঃসংকোচ। এবং এগুলি প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহের প্রতি এক ধরনের অনুচ্চারিত প্রতিস্পর্ধা। এ ছাড়াও বর ও কন্যাপক্ষের চেষ্টায় সংঘটিত বিয়ে ও প্রেমের বিয়ে ছাড়াও নতুন এক ধরনের বিয়ে ইতস্তত ঘটছে। সেখানে সম্ভাব্য পাত্র ও পাত্রী প্রেমে না পড়ে বিজ্ঞাপন দেখে বা অন্য কোনও ভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে দু’জনে একত্রে বসে সেই সব আলোচনা করছে, যার অনেকটাই আগে দু’পক্ষের মা বাবারা করতেন। এক কথায়, এর মূল ব্যাপারটা হল বৈষয়িক হিসেব— আয় ব্যয়, বাসস্থান, আসবাবপত্র, পারিবারিক দায়িত্ব, জীবনযাত্রার আর্থিক মান, সঞ্চয় ও ব্যয় সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত, শখ শৌখিনতা সম্বন্ধে আলোচনায় ঐকমত্যে পৌঁছবার প্রয়াস, মোটামুটি জীবন সম্বন্ধে ধারণা। গরমিল থাকলে আলোচনায় তার নিরাসনের চেষ্টা এবং সব দিকে সন্তোষজনক বোঝাপড়া হলে তবে বিবাহ। এ সব বিবাহের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেম অনুপস্থিত থাকে এবং ব্যাপারটা নতুন হলেও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সংসার প্রেম ও আবেগ ছাড়াই ঠিক চলছে,, পরস্পরকে সহনীয় বা পছন্দ করা যায় এমন সহাবাসিক রূপে মেনে নিয়ে। এই দাম্পত্যে যৌন সম্পর্ক আছে, আর আছে বৈষয়িক, ব্যবহারিক সহযোগিতা, হয়তো চিন্তার ক্ষেত্রে কিছু সাযুজ্য, রুচির ক্ষেত্রে ঐক্য। কিন্তু প্রেম এ সব বিয়েতে কদাচিৎ দেখা যায়, এবং এ সব দম্পতি প্রেমের জন্যে উৎসুকও নয়, প্রেমের অভাবে এরা ক্লিষ্টও নয়। এটা একটা আধুনিক বিকল্প কার্যকর এবং নিরাপদ। এ ব্যবস্থা থেকেও বেরোবার পথ বিবাহ বিচ্ছেদ— আইনের দিক খোলা, কাজেই আগের বন্ধন এখানে গোড়ার থেকেই বেশ শিথিল বলেই বেরোবার দিনে মারাত্মক কিছু প্রতিক্রিয়া হয় না। যেমন হিসাব করে গুছিয়ে শুরু করা গিয়েছিল মোটামুটি নিরুত্তাপ দাম্পত্য, চিড় দেখা গেলে বা দু’জনের একজনের অন্য কারও প্রতি আসক্তির উদ্রেক হলে আবার তেমনই হিসেব করেই তাঁবু গুটিয়ে ফেলা। পাশ্চাত্য দেশে অবশ্য এটি বেশ কিছুকাল যাবৎ চলিত আছে।

বিনা বিবাহে একত্রবাসও অধুনা-আচরিত আর একটি বিকল্প। বিচ্ছেদের পথে এখানে আইনের কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ এর শুরুতেও আইন বা অনুষ্ঠানের কোনও ভূমিকা ছিল না। নানা কারণেই দ্বৈমত্য দেখা দিতে পারে; সেটা অলঙ্ঘনীয় হলেও তল্পি গুটিয়ে যে যার পথে রওনা হতে পারে। তিক্ততা না থাকারই কথা, তবু মাঝে মাঝে ঈর্ষার উদ্রেক হয় এবং তখন তিক্ততা দেখা দেয়। সচরাচর এ সব দাম্পত্যে সন্তান আসে না, এলেও তা নিয়ে সমাজ বা আইনের কিছু করণীয় থাকে না, কারণ এর শুরুতে ওই দুটিকে পরিহার করা হয়েছিল।

প্রাতিষ্ঠানিক কারণে বিবাহ কি তা হলে আজ অবান্তর হয়ে গেছে? এতগুলো বিকল্প দেখে তাই মনে হওয়া সম্ভব। সমাজে এখন যুগপৎ যত রকম দাম্পত্য আছে— সংবিধানসিদ্ধ, সামাজিক ভাবে অনুষ্ঠিত বিবাহ, বিনা বিবাহে সহবাস, বিবাহ ভেঙে অপর সঙ্গী বা সঙ্গিনীর নিবিড় সান্নিধ্যে প্রকাশ্যে বা গোপনে সহবাস, একে অপরের স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে প্রকাশ্য সহবাস— এ সব গুলির দ্বারা প্রতিপন্ন হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহের উপযোগিতা সম্বন্ধে মানুষের সংশয়; বিকল্পের অনুসন্ধান এবং নানা বিকল্পের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে পাশ্চাত্য সমাজে বিবাহবন্ধনের শৈথিল্য বিশেষ ভাবে লক্ষিত হয় এবং তখন থেকেই সাহিত্যে এটি বিশেষ ভাবে প্রতিফলিত। সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণাতেই আনুষ্ঠানিক বিবাহ সম্বন্ধে এমন অনেক কথা উচ্চারিত হয় যাতে বিবাহের ভিত্তি সম্বন্ধেই মানুষ সন্দিহান হয়। মনস্তাত্ত্বিকরা এমন কথাও বলেন যে, মানুষ মাত্রেরই যৌনবৃত্তিতে দ্বিচারিতা বা বহুচারিতা প্রকৃতিদত্ত; সমাজ তাকে গোপন করতে শেখায় এবং তার ফলে নানা মানসিক ব্যাধি দেখা দেয়। এ কথা সত্যি হলেও বলতে হয় চুরি করা, মারামারি করা, ইত্যাদি সমাজের পক্ষে অশুভ প্রবণতাও বহু মানুষের অবচেতনে জন্মগত লক্ষণ, সেগুলিকে প্রকাশ্যে প্রশ্রয় দিলে সমাজ কী করে টিকে থাকবে? আজ তো সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসাবেই বাস করে, এইটিই তার পক্ষে কল্যাণকর। পারস্পরিক সাহচর্যে সমাজের যে ছকটি আজ প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে অন্তর্নিহিত বহু বিকৃতি, অন্যায় ও অত্যাচারের অবকাশ আছে ঠিকই, এবং মানুষ যুগে যুগে তার প্রতিবাদ করে তাকে প্রতিরোধ করে সংশোধন প্রয়াসী হয়েছে, হবেও। তবে দুটি নরনারীর এই একত্রবাসের মূল কাঠামোটা ভেঙে ফেলবে না, কারণ এর মধ্যে তার গোষ্ঠীগত আশ্রয় ও নিরাপত্তা। এটিকে রক্ষা করতে গেলে অবচেতনে নিহিত— সমাজের পক্ষে হানিকর— বহু প্রবণতাকে নিজের মধ্যে দমন করতে হয় যাতে ব্যক্তির ইষ্টসিদ্ধি বা আপাত-তৃপ্তির জন্যে মানবগোষ্ঠীর ক্ষতি না হয়।

এমনই এক প্রবণতা বহুগামিতা। আবার বলছি, ঐক্যদাম্পত্যে যেখানে দম্পতির কোনও পক্ষের অন্যায় বা অত্যাচার কিংবা অপমান ঘটে, সেখানে তা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার এবং পরে আবার একটি সুখী দাম্পত্য খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা স্বৈরাচারিতা নয়। সে অধিকার মানুষের সহজাত। একাধিক বারের হলেও; যদি না তা কেবলমাত্র নুতনত্বের সন্ধানে দায়িত্ববোধহীন ছোটাছুটি হয়। কিন্তু বহুচারিতার প্রবৃত্তি যদি নিজের মধ্যে নিরুদ্ধ না করা হয় তা হলে যে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেবে তা শুধু দাম্পত্যের ভিতই টলিয়ে দেবে তাই নয় সমাজ দেহে এমন আঘাত করবে যা সহ্য করার কোনও দায়িত্ব সমাজের নেই। যেখানে সমাজের অন্যায় শৃঙ্খলে মানুষ অত্যাচারিত, সেখানে মানুষ অবশ্যই বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ করে অন্যায়ের প্রতিকারের চেষ্টা করবে। কিন্তু যেখানে উদ্দাম স্বেচ্ছাচারিতার দ্বারা সমাজের শৃঙ্খলা ভাঙার চেষ্টা, সেটা গোষ্ঠী স্বার্থের বিরুদ্ধ। সেখানে সমাজের পক্ষে যা হানিকর তেমন প্রবণতা দমন করার দায় নিশ্চয়ই যে কোনও সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধ মানুষের আছে। উচ্ছৃঙ্খলতা শব্দটি দু’ ভাবে নিষ্পন্ন হতে পারে: শৃঙ্খল ভাঙা অথবা শৃঙ্খলা ভাঙা। শৃঙ্খলাও মাঝে মাঝে শৃঙ্খল হয়ে ওঠে, তখন তাকে ভাঙলে সমাজের মঙ্গলই হয়। কিন্তু যে শৃঙ্খলা ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’, সুস্থ সংহতির জন্য যা আছে, তাকে ভাঙা সমাজ দেহে অকারণে আঘাত করা। সমস্ত উদ্দাম প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার সুযোগ কোনও সমাজই দিতে পারে না। দিলে সমাজে উন্মত্ত তাণ্ডব দেখা দেবে এবং বহু নিরপরাধ মানুষ অকারণে কষ্ট পাবে। বহুগামিতার প্রবৃত্তি সুস্থ দায়িত্ববান মানুষ নিজের মধ্যে নিজের বিবেকের প্রণোদনাতেই দমন করে। কারণ অন্য কারও উদ্দামতা তার স্বার্থকে ঘা দিতে পারে। কাজেই বিবাহ মানেই শৃঙ্খলবন্ধন নয়। যখন বিবাহ সে রকমটা হয়ে ওঠে, তখনকার যা আপদ্ধর্ম তা স্বাভাবিক অবস্থায় প্রয়োগ করা চলে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *