০২. কনকাঞ্জলি

কনকাঞ্জলি

বিবাহ = বি + √বহ + ঘঞ; অর্থ বিশেষ ভাবে বহন করা। বিশেষ ভাবে, অর্থাৎ দেহমনের সব অসুবিধে, সংকটের সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করা। বিবাহ একটি বিশেষ দায়িত্ব যা শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নিবদ্ধ থাকে। বিয়ে বা বিয়েবাড়ি বলতে চোখে ভাসে শানাই, আলো, ভিড়, রান্নার গন্ধ, হৈ-হট্টগোল, অল্পস্বল্প বাদবিতণ্ডা, উচ্চহাস্য, রঙিন শাড়ি, সুদৃশ্য (কখনও কুদৃশ্যও) গয়না, গান, অনবরত লোকজনের আনাগোনা— পুরো আবহাওয়াটাই উৎসবের কিন্তু তারও আগে একটা উদ্যোগপর্ব আছে, যেটা শুরু হয় ঘটকালি থেকে। পাত্রপাত্রী নির্দিষ্ট হলে বরপক্ষ কনে দেখে, কনেপক্ষ বর দেখে। তার পরে দেনাপাওনার দীর্ঘ সংগ্রাম এবং দু-পক্ষের দরাদরির নিষ্পত্তি হলে তবে বিয়ের প্রস্তুতি। আশীর্বাদ, অধিবাস, গায়েহলুদ, বিয়ে, বৌ-ভাত। এখনও ভারতবর্ষে অধিকাংশ বিয়ের ছকটা মোটামুটি একই রকম। লক্ষ্য করা যায় যে, সমস্ত প্রস্তুতি পর্ব জুড়ে যে দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়াটি চলে তার নিয়ামক দুটি পরিবার; নেপথ্য থেকে চালায় সমাজ, তার নেপথ্যে থাকে রাষ্ট্র। কিন্তু সবচেয়ে গৌণ, সবচেয়ে নেপথ্যবর্তী এবং এক হিসাবে সবচেয়ে উপেক্ষিত হল সেই দুটি মানুষ যাদের বিয়ে হচ্ছে। এখন শহরে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত মেলে যেখানে সম্বন্ধ করে যে বিয়ে সেখানেও বরের পছন্দ অপছন্দের কিছু দাম দেওয়া হয়; তার চেয়ে অনেক কম ক্ষেত্রে কনের পছন্দের ওপরে কোনও গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ দেশে এখনও বর-কনে বিয়ে করে না, তাদের বিয়ে হয়; তারাই সবচেয়ে নিষ্ক্রিয়, বিয়ের সময়ের আগে তারা নেহাৎই দুটো প্রতীক হিসেবে থাকে।

বিবাহ একটি দ্বিপাক্ষিক যৌথ কর্ম। ম্যাকফারলেন যেমন বলেছেন, ‘বিবাহ একটা দলগত খেলা এবং দম্পতিটিকে, বিশেষত বধূটিকে বিবাহের দিন পর্যন্ত সব হাঙ্গামার বাইরে রক্ষা করা হয়।’[১] এই রকম বিয়েতে বরকনের ইচ্ছে রুচি, সম্মতি আপত্তি সম্বন্ধে পাত্রপক্ষ ও পাত্রীপক্ষের একটা ঔদাসীন্য বা তাচ্ছিল্য থাকে। বলা বাহুল্য, প্রথম বিবাহে বর-কনে অনভিজ্ঞ হবেই, কেবলমাত্র বারবার বিয়ে করলে তবেই তারা বিয়ে সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হতে পারে! দু-পক্ষের অভিভাবক গুরুজনেরা ভাবেন ও বলেন বরকনে তো নেহাৎ অর্বাচীন, অনভিজ্ঞ, একটা আমরণ চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে যে-বিয়ে, সে সম্বন্ধে ওরা কী বোঝে? তার মধ্যে কত ভ্রমপ্রমাদের সম্ভাবনা থাকে, নিছক যৌবনসুলভ আবেগেই নারীপুরুষের মিলনের প্রবর্তনা এটা নয়, এ ভাবে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো স্থৈর্য তাদের থাকে না। অতএব প্রবীণ, বিবাহিত, বহুদর্শী, অভিজ্ঞ গুরুজনরাই কেবল এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা রাখেন। এ সব তত্ত্বকথার পেছনে কখনও কখনও সদিচ্ছা অবশ্যই থাকে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ক্ষেত্রে থাকে ‘আমার পাঁঠা আমি ল্যাজে কাটব’ এই মনোভাব। আরও থাকে ব্যবসায়িক মনোভাব— এখনও অধিকাংশ অভিভাবকরা পণযৌতুক নিয়ে দরাদরি— প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্ন ভাবে— রীতিমতো উপভোগ করেন। অতএব ছেলেমেয়ে মানুষ করার পূর্ণ মূল্য শোধ করে নেন তাদের জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী বেছে নেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করে। অবশ্য যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বধূটি শ্বশুরবাড়িতেই বাস করতে আসে, তাই সম্ভাব্য নতুন পারিবারিক সদস্যকে যাচাই করে নেওয়ার মধ্যে তাদের একটা প্রত্যক্ষ স্বার্থও থাকে।

[১. ‘Marriage is a team game, and the couple, esp, the girl is kept out of harm’s way until the actual wedding day. ‘ Marriage and love in England. p. 293]

বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা অদ্ভুত জগাখিচুড়ি আছে। কিছু কিছু বৈদিক অনুষ্ঠান রয়ে গেছে— বৈদিক যুগের শেষাংশের, সঙ্গে কিছু বৈদিক মন্ত্রও। কিন্তু তার সঙ্গে এসে জুড়েছে বিস্তর লৌকিক অনুষ্ঠান। শুধু স্ত্রী-আচারে নয়, বিয়ের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবেও এগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। যুগে যুগে বিকশিত হয়ে পরিবর্ধিত আকারে এখন যা দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে আছে বরকে আসনে বসিয়ে সবস্ত্রা সালংকারা কন্যা দান করা। হোম করা হয়, আবার বহু পরবর্তী যুগের সংযোজন শালগ্রাম শিলা বিষ্ণুর প্রতীক হয়ে সাক্ষী থাকে— অগ্নির মতো। বৈদিক যুগের মতো পাণিগ্রহণ ও সপ্তপদী গমন হয়। যোক্তবন্ধন অর্থাৎ বরকনের কাপড়ের শেষ প্রান্তে গিঁট বাঁধা হয়। মালাবদল অর্বাচীন কালের সংযোজন। পুরনো কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত আকারে রয়ে গেছে, যেমন অশ্বারোহণ। এটি বৈদিক; বর একখণ্ড পাথর বধূর সামনে রাখলে সে তার ওপরে দাঁড়ায়, তখন বর বলে, ওই পাথরের মতো স্থির হয়ো।[২] তেমনই বহু প্রাচীনকালের রীতি অনুসারে ধ্রুবনক্ষত্র ও অরুন্ধতী দর্শনের স্মৃতিমাত্রই অবশিষ্ট আছে; সত্যিকার নক্ষত্র দুটিকে এখন বেশি কেউ চেনেও না, দেখেও না। কিন্তু মন্ত্রটি জরুরি। বর সেটি বলে: আকাশ ধ্রুব, পৃথিবী ধ্রুবা, এই জগৎ ধ্রুব, ধ্রুব এই পর্বতরা, এই স্ত্রী পতিকূলে ধ্রুবা।[৩] লক্ষণীয়, ধ্রুবত্ব, স্থিরত্ব শুধু বধূটির কাছেই অপেক্ষিত। সে-ই প্রতিজ্ঞা করবে আমি পতিকুলে ধ্রুবা হব, অরুন্ধতীর দ্বারা আমি অবরুদ্ধ। অর্থাৎ প্রাচীন পতিব্রতা ঋষিপত্নী আমাকে পতিকুলে স্থির থাকবার জন্যে অবরুদ্ধ করেছেন। পাণিগ্রহণের পরে বধূর শুদ্ধির জন্যে বর কিছু মন্ত্র পড়ত— ছ’টি আহুতি দিত বিনা মন্ত্রে এবং বলে যেত, ‘এই নারীর চোখের পাতার চুল, মাথার চুল, চরিত্র, কথা, হাসি, দেহ ও বস্ত্রের রন্ধ্র থেকে নিঃসৃত রশ্মিকণা (আরোক), দত্ত, হস্ত, পদ, ঊরু, উপস্থ, জঙ্ঘাসন্ধিতে, তার সর্বাঙ্গে যা কিছু ঘোর ও অশুচি আছে, তা শুদ্ধ হোক।’

[২. এহি অশ্মানমতিষ্ঠ অশ্মেব ত্বং স্থিরা ভব। কৈশিকসূত্র (১০:৭৭)

৩. আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র (১:৭:২২)]

প্রশ্ন আসে, পুরুষ কি স্বতই শুচি, আর যত অশুচিতা তা শুধু নারীর দেহে মনে আচরণে? তা শোধন করার দায় বা অধিকার কোথা থেকে পায় পুরুষ? আসলে তার চাই একটা শুচি কুমারী কন্যা এবং সম্ভাব্য অশুচিতার প্রতিকার স্পর্ধা শাস্ত্রই পুরুষকে জুগিয়েছে। পুরুষের অশুচিতার সম্ভাবনা পর্যন্ত শাস্ত্রে স্বীকৃত নয়। এই বৈষম্যের ভিত্তিতেই শাস্ত্রে নিষ্পন্ন হয় বিবাহ, এবং অনুষ্ঠানের পদে পদে এই বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। কন্যার পিতা ভাবী জামাতাকে আসন দিয়ে অভ্যর্থনা করে বলেন ‘আপনাকে অর্চনা করছি’ (অর্চয়িষ্যামো ভবন্তম্) এবং জামাতা অনুমতি দেয় ‘হ্যাঁ, অর্চনা করুন’ (ওম্ অর্চয়)। সম্প্রদানের মধ্যেও কন্যা ব্যক্তি থেকে বস্তু হয়ে ওঠে: সে বস্তুর তৎকালীন মালিক পিতা ভাবী মালিক জামাতার কাছে কন্যারূপ বস্তুটিকে দান করেন— সবস্ত্রা, সালংকারা, এবং পণযৌতুক সহ। এর মধ্যেও প্রচ্ছন্ন থাকে বধূটির সামাজিক সত্তার অবমাননা, তাকে বস্তু রূপে হস্তান্তরিত করা।

বিয়ের প্রায় প্রতি পর্বে এই ধরনের অবমাননা অন্তর্নিহিত ছিল। একটি মাত্র মন্ত্রে কন্যার দীর্ঘ আয়ু কামনা করে বলা হয়েছে, তুমি সম্পদ ধারণ কোরো। বলা বাহুল্য, এ সম্পদ তার পতিকূলেরই, কোনও সম্পত্তিতে কন্যার তো স্বতন্ত্র কোনও অধিকার ছিল না। একটি অনুষ্ঠানে কন্যা মাদুরে পা রাখবে, তখন উচ্চারিত হবে ‘পতি দেবতা’ এবং ‘পতিযান কামনীয়’ অর্থাৎ কন্যা কামনা করছে যে, সে পতিলোকে যেতে পারে। যেটা লক্ষণীয়, তা হল শাস্ত্রে অন্য দুটি যান আছে ‘দেবযান’ ও ‘পিতৃযান’, অর্থাৎ দেবলোক থেকে মোক্ষ ও পিতৃলোক থেকে পুনর্জন্মের পথ। দেবতা ও পিতৃগণের মতো উচ্চ আসন সৃষ্টি হল পতির, এবং পত্নীর কামনা হল, সে যেন পতিলোকে ঠাঁই পায়। লাজহোম (আগুনে খই দিয়ে হোম) অনুষ্ঠানে পতির দীর্ঘায়ু, শতবর্ষ পরমায়ু কামনা করে বধূ বলে, তার শ্বশুরবাড়ির সকলের যেন শ্রীবৃদ্ধি হয় (দীর্ঘায়ুবস্তু মে পতিঃ শতং বর্ষাণি জীবত্বেধন্তাং জ্ঞাতয়ো মম)। সপ্তপদীগমনের মন্ত্রগুলিতে উভয়ের মিলিত জীবনের শ্রীবৃদ্ধির কামনা আছে। পাণিগ্রহণের মন্ত্রে বর বধূকে বলে: ‘আমার ব্রতে তুমি তোমার হৃদয় ধারণ কর, তোমার চিত্ত আমার চিত্তের অনুগামী হোক। বৃহস্পতি তোমাকে আমার জন্য নিযুক্ত করুন।’[৪] লক্ষণীয়, বধূটিরও যে চিত্ত আছে, আগামী বিবাহিত জীবন সম্বন্ধে যে তারও কিছু স্বপ্ন, কিছু কামনা থাকতে পারে সে বিষয়ে শাস্ত্র ও সমাজ সম্পূর্ণ উদাসীন। এক সময় বর বধূ সম্বন্ধে প্রার্থনা করে, এর যে পতিঘাতিকা তনু তাকে ধ্বংস কর, ‘এর যে পুত্রহীনা তনু, পশুহীনা তনু তা দূর হোক— যাস্যাঃ পতিঘ্নী তনুস্তামস্যা অপজহি, যাস্যা অপুত্রা তনূঃ যাস্যা অপশব্যা তনস্তামস্যাঃ অপহতা।’

[৪. মম ব্রতে তে হৃদয়ং দধাতু মম চিত্তমনু চিত্তং তেহস্ত।… বৃহস্পতিত্ত্বা নিযুক্ত মহ্যম। মানব গৃহ্যসূত্র (১:১০:১৩)]

এই অনুষ্ঠান ও মন্ত্রগুলির মধ্যে নারীর, বিশেষত বধুর সম্বন্ধে যে মনোভাব বিবৃত আছে তা হল: প্রথমত প্রকৃতির সৃষ্টি যে নারী, যে স্বভাবত অশুচি, অকল্যাণী, পুরুষপরতন্ত্র, হীন এবং কতকটা যেন ঊনমানব। বিয়ের অনুষ্ঠানের ও মন্ত্রের মধ্যে দিয়ে তার শুচিতা সম্পাদন করে বর তাকে নিজের, পরিবারের ও সমাজের জীবনে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। নইলে সে সংসার ও সমাজে অকল্যাণ আনবে; স্বামীকে হত্যা করবে, পুত্রদের হারাবে ও পশুর বিনাশের কারণ হবে। দ্বিতীয়ত, তার স্বতন্ত্র চিত্ত বলে কিছুই নেই বা থাকলেও না থাকাই বাঞ্ছনীয়। তার স্বতন্ত্র চিত্তের অবনমন ঘটিয়ে সম্পূর্ণ স্বামীর চিত্তের অনুগামী, স্বামীর ব্রতের অনুব্রতা হওয়াই তার চূড়ান্ত কর্তব্য। তৃতীয়ত, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির কল্যাণসাধনে সে আত্মনিয়োগ করবে। এতে দোষের কিছু থাকত না, যদি তার আপন বাপের বাড়ির প্রতি কোনও কর্তব্য করবার কোনও সুযোগ বা অধিকার তাকে দেওয়া হত, অথবা তার স্বামীও তার শ্বশুরবাড়ি, অর্থাৎ বধূটির বাপের বাড়ির সম্বন্ধে কোনও কর্তব্য সাধনের কোনও দায়িত্ব বোধ করত। বিবাহ অনুষ্ঠানে বধূর গোত্রান্তর এমনই আমূল এবং সর্বাত্মক, এমনই আত্যন্তিক যে তার পূর্বসত্তার প্রায় পূর্ণ বিলোপ ঘটিয়ে তাকে— শুধু তাকেই— তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে একাত্ম হতে হত। চতুর্থত, স্বামীর জীবনে সে ধ্রুবা হবে। যেমন ধ্রুবা অরুন্ধতী: পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে, বধূ প্রতিজ্ঞা করবে স্বামীর জীবনে এবং শ্বশুরকুলে সে থাকবে পাথরের মতো স্থির অটল। লক্ষ্যণীয়, অনুরূপ কোনও প্রত্যাশা বরের সম্বন্ধে কোনও অনুষ্ঠানেই উচ্চারিত হয়নি।[৫]

একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিবাহের ক্ষেত্রে এবং সামাজিক অবস্থানে নারীর এই রূপটিই স্বীকৃত: সে পুরুষের তুলনায় হীন, আর্থিক সামাজিক, ভরণপোষণ ও সুরক্ষার জন্যে স্বামী তথা শ্বশুরবাড়ির ওপরে একান্ত নির্ভরশীল ও আশ্রিত; কাজেই সে হবে স্বামীর ছায়ানুগামিনী। সব সমাজই আগাগোড়া এ ব্যবস্থা করেছিল যাতে সে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির মুখাপেক্ষিণী থাকে। এবং সমাজ এই আয়োজিত নির্ভরশীলতাকে ব্যবহার করেছিল তাকে অধীন রাখবার জন্য। আউরবাখের মতে পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ভূমিকার মধ্যেই নারীদের জীবনযাপন করতে প্রণোদিত করা হয়।[৬] মিলের চোখে নারীকে সর্বত্র চিরকাল বোঝানো হয়েছে যে, যেহেতু প্রকৃতিই তাকে দুর্বল ও পরাধীন করে নির্মাণ করেছে অতএব স্বাধীন, স্বনির্ভর ভাবে বাঁচবার তার কোনও পথ নেই, অতএব বিবাহই তার একমাত্র গন্তব্য।[৭] নারীর হীনত্ব প্রতিপাদনে দৃঢ়পরিকর মনু বলেন, সর্বগুণহীন পুরুষও সর্বগুণযুক্তা নারীর পূজ্যা। (৫:১৫৪) ওই উক্তি সম্ভব হল একটি উপপাদ্য মেনে নিয়েই: পুরুষ বলেই পুরুষের উৎকর্ষ, নারী বলেই ব্যক্তিগত গুণ, যোগ্যতা বিচারের কোনও মানদণ্ড এখানে স্বীকৃত নয়। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই পুরুষের উৎকর্ষ, নারীর ও পুরুষের মনের মধ্যে স্বতঃসিদ্ধের মতো দৃঢ়প্রোথিত। অথচ কয়েক দশক ধরে নারীর স্বাধিকারবোধে প্রণোদিত যে আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে, শুধু তার মধ্যেই নারীর স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি।

[৫. এ পর্যন্ত বিয়ের যে মন্ত্র ও অনুষ্ঠানগুলির উদ্ধৃতি দেওয়া হল সেগুলি দশকর্মের জন্য নির্দিষ্ট বাঙালির, ধর্মজীবনে সুপ্রচলিত ‘পুরোহিতদর্পণ’ গ্রন্থ থেকে উৎকলিত। ঈষৎ পরিবর্তিত ক্রম ও আকারে এগুলিই ভারতীয় হিন্দু বিবাহের বিভিন্ন পর্যায়ে ও অনুষ্ঠানে আচরিত হয়।

৬. ‘Women were exhorted to live in and through patriarchial family roles. ‘ Women and the Demon, p. 61

৭. ‘Marriage being the destination approved by society for women, and prospect they are borught up to… ‘ The subjection of women. p. 246 ]

নারীর এই হীনতার বোধ যেহেতু সমাজে বহুকাল ধরে পরিব্যাপ্ত সেই জন্যেই বিবাহের অনুষ্ঠানে ও মন্ত্রে এর প্রতিফলন। অতএব দুটি অসম মানুষের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় : উৎকর্ষ পুরুষের, ন্যূনতা নারীর। দাম্পত্যেও এর দীর্ঘ ছায়া পড়ে। লোকাচারেও এরই প্রতিবিম্ব। বিয়ে করতে যাওয়ার আগে বর ও তার মায়ের মধ্যে একটি সংলাপ প্রচলিত। বরসাজে সজ্জিত, যাত্রায় উদ্যত ছেলেকে মায়ের প্রশ্ন: ‘কোথায় যাচ্ছ বাবা?’ বর: ‘মা,তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।’ তিনবার এই নাট্যাংশ অভিনীত হয়। শুধু যে বর, তার মা ও বাড়ির লোকেরা এটা বিশ্বাস করে তা-ই নয়, বধূ ও তার বাড়ির লোকেরাও এটা বিশ্বাস করে, অর্থাৎ বধূটি যে শ্বশুরবাড়ির দাসী এ বিশ্বাস বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি দৃঢ়ভিত্তি। আগেই বলেছি, অন্নবস্ত্রের জন্য বধূ স্বামীর ওপরে নির্ভরশীল তাই দাসী-ভৃত্যের মতোই সে ভরণীয়া ভার্যা, তাকে খাওয়াতে হবে।[৮]

[৮. মধ্যযুগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে স্ত্রী স্বামীকে ‘লর্ড’ বলে সম্বোধন করত, এবং ভৃত্যও প্রভুকে ওই সম্বোধনই করত। এই ‘লর্ড’ শব্দটির বুৎপত্তি হল, half-ward; half অর্থাৎ loaf বা রুটির জন্যে যে নির্ভরশীল। স্ত্রী এবং ভৃত্য ও ব্যাপারে একই পর্যায়ে পড়ে। সংস্কৃতেও ‘ভৃত্য’ শব্দ নিষ্পন্ন ‘ভৃ’ ধাতুর উত্তরে ‘ক্যপ্’ প্রত্যয় দিয়ে, ‘ভার্যা হয় ভৃ ধাতুতে ‘ণ্যৎ’ প্রত্যয় দিয়ে। অর্থ একই, ভরণীয়।]

বধূটির কন্যা অবস্থায় এই অন্নঋণ ছিল পিতার কাছে, ঋণী ব্যক্তি বন্ধক রাখা বস্তুর মতোই স্বাধীন নয়; তাকে দান করা যায় না। তাই বিয়ের আগে বাপের সঙ্গে মেয়েকে কনকাঞ্জলি নামে একটি নির্মম নাট্যাংশ অভিনয় করতে হয়। একমুঠো ধুলো বাপের হাতে দিয়ে মেয়ে বলে: ‘সোনামুঠি নিয়েছিলাম, ধুলোমুঠি দিয়ে শোধ করলাম।’ এ অনুষ্ঠান রূপকাশ্রিত, কারণ পিতার কাছে কন্যা ঋণমুক্ত না হলে তাকে সম্প্রদান করা যাবে না, তাই পিতৃকুলের ঋণ সে প্রতীকী ভাবে শোধ করে এমন মর্মান্তিক উচ্চারণে। এর মধ্যে নিহিত থাকে পিতৃকুল সম্বন্ধে তার সব দায়িত্বের অস্বীকৃতি। তিনদিন অশৌচ মেনে, চতুর্থীশ্রাদ্ধ করেই পাত্রান্তরিত বধূটি মৃত পিতা বা মাতার সম্বন্ধে সব কর্তব্য সমাধা করে।

শ্বশুরবাড়িতে বধূবরণের সময়ে আঁকা লক্ষ্মী-পদচিহ্নে পা দিয়ে হেঁটে সে ঢোকে, দুধ উথলে পড়া দেখে, দুধে আলতায় দাঁড়িয়ে জ্যান্ত মাছ ধরে এবং সেখানকার প্রশ্নের উত্তরে সে বলে শ্রীবৃদ্ধি উথলে পড়া দেখছে, কারণ এই তার দায়িত্ব— শ্বশুরবাড়ির সম্পদ বাড়িয়ে তোলা। বৌভাতের দিনে সে রেঁধে পরিবেশন করে শ্বশুরবাড়ির লোকদের ও অতিথিদের— অন্তত এইটিই যথার্থ পাকস্পর্শের তাৎপর্য। সে দিন স্বামী তাকে এক থালা ভাত ও একখানা কাপড় দিয়ে তার সারা জীবনের অন্নবস্ত্র-সংস্থানের দায়িত্ব নেয়। বধূটির পোষ্যতাই তার বশ্যতাকে বাধ্যতামূলক করে তোলে। তার অন্নসংস্থান করে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি, তাই পুরুষ, এ ক্ষেত্রে স্বামী, প্রাধান্য পায় দম্পতির অবস্থানে। ব্যুভেয়ার-এর কথায় যতক্ষণ স্বামী দম্পতির আর্থিক দায়িত্বভার গ্রহণ করে ততক্ষণ তাদের মধ্যেকার এই (সাম্য) একটি অলীক ভ্ৰম মাত্র।[৯] উপার্জনক্ষম, বা বিত্তবান পরিবারের সন্তান যে স্বামী, সে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ একক, যা বধূটি সেই অর্থে কখনওই হতে পারে না। পণ, যৌতুক, সৌদায়িক, স্ত্রীধন থাকা সত্ত্বেও দৈনন্দিন ভরণপোষণের ব্যাপারে যেযেতু বধূটি স্বামী-শ্বশুরের মুখাপেক্ষী, তাই সে কখনওই স্বামীর মতো স্বয়ংসম্পূর্র বা স্বনির্ভর ব্যক্তি হতে পারে না।[১০] সামাজিক ভাবে পুরুষ স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ব্যক্তি।

[৯. ‘…as long as the man retains economic responsibility for the couple, this (equality) is only an illusion.’ The Second Sex p. 498

১০. A man is socially an independent and complete individual, ibid, p. 447]

অনুষ্ঠান সব সময়েই প্রতীকী। বিবাহের অনুষ্ঠানের প্রতীকগুলি অনুধাবন করলে বোঝা যায়, বধূটি ভরণপোষণের পরিবর্তে স্বামী, শ্বশুর ও তাদের আত্মীয় পরিজনের পরিচর্যায় একান্ত ভাবে আত্মনিয়োগ করবে— এইটেই অপেক্ষিত। কিন্তু কর্তব্য সবটাই একতরফা, নারীর কর্তব্যেই অবসিত এবং অধিকারও একতরফা পুরুষের। এইখানেই বৈষম্যের ভিত্তি, অশান্তির বীজ। বহু বিবাহে সংঘর্ষ আসে যখন বধূটি তার বাপের বাড়ির জন্য কিছু করতে চায়। ওই যে শাস্ত্রে আছে বিবাহিত নারীর সমস্ত উপার্জনে তার স্বামীর অধিকার, এটাও লোকের মনে এত গভীর ভাবে প্রোথিত যে, আজ বাইরে কাজ করে উপার্জন করে যে মেয়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে বাপের বাড়িতে সাহায্য করতে পারে না; যদি বা করে স্বামীর অনুমতি নিয়ে এবং কতকটা কুণ্ঠার সঙ্গে। আশার কথা, ব্যতিক্রম বাড়ছে এবং কিছু কিছু সদাশয় স্বামী ও শ্বশুরবাড়ি এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছেন। আড়াই হাজার বছরের শাস্ত্র এবং বহু প্রাচীন লোকাচার মিলে যে অধিসংগঠনটি বিবাহকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেছে তা নেহাৎই একপেশে। তাই তা আজ এমন ভাবে টলে উঠেছে, কারণ মানুষের চেতনায় দীর্ঘকাল ধরে এই বৈষম্যে অস্বস্তি জন্মেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, বহু সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ ও পরিবার চিরকালই সমাজে ছিল ও আছে এবং তারা এই বৈষম্যে পীড়া বোধ করেছে। শাস্ত্র যে বহু অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, লোকাচারে যে বহু অনাচার নিহিত আছে সে বিষয়ে চেতনা ধীরে ধীরে বেড়েছে। ইদানিং বেশ কিছু পরিবারে দাম্পত্যকলহের হেতু শাশুড়ি সম্পর্কে বধূর সম্পূর্ণ উপেক্ষা, ঔদাসীন্য, কখনও কখনও ব্যবহারে অহেতুক রূঢ়তা, নির্মমতাও। বহু ক্ষেত্রে শাশুড়ি বধূটিকে উৎপীড়ন করেন এটা যেমন বহুকাল ধরেই সত্য, তেমনই বেশ কিছু পরিবারে, শ্বশুর শাশুড়িও উৎপীড়িত এও সত্য। বেশ কিছু শ্বশুর-শাশুড়ি সহায়সম্বলহীন পুত্রের পরিবারে আশ্রিত— এ ক্ষেত্রে হয়তো আর কতকটা মানবিক বোধ নিয়ে সমাধান খুঁজলে ভাল হত। তেমনই দাম্পত্যে যদিও বহু সহস্রাব্দ ধরে বধূটি ঊনমানবের স্থানে থেকে অত্যাচারিত হয়ে এসেছে, তেমনই এখন বেশ কিছু সংসারে, স্ত্রীর প্রবল দাপটে স্বামী পীড়িত। বলাই বাহুল্য, দাম্পত্যের মূল রস— প্রেম— শুকিয়ে গেছে। তাই এক পক্ষের পুরুষ অহমিকা অবিচার ও অত্যাচারে পরিতৃপ্তি খুঁজছে। এও বহু সহস্রাব্দব্যাপী শাশুড়ির বধূ নির্যাতনের প্রতিবাদ— ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে প্রতিস্থিতি। কিছুকাল হয়তো চলবে, পরে ইতিহাসের নিয়মেই সংহতি আসবে, যখন বধূ বা শাশুড়ি কেউই কাউকে নির্যাতন করবে না; একত্রে বাস করতে হলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি সূত্র নিজেরাই আবিষ্কার করবে। যেখানেই যে পক্ষই যার ওপরেই অত্যাচার করুক না কেন, সেটা অমানবিক এবং তা বন্ধ করা প্রয়োজন। দাম্পত্য দুটি পরিবার ও দুটি ব্যক্তির সম্পর্কে জড়িত বলে এর নানা জটিল অনুষঙ্গ আছে, অতএব নীতিনিষ্ঠ মমতাপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হলে এ ধরনের জটিলতার গ্রন্থিমোচন সম্ভব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *