১৩. জীবনবোধের পুনর্মূল্যায়ন

জীবনবোধের পুনর্মূল্যায়ন

কর্ণ যেদিন কুন্তির আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন সে দিন তাঁরও দুটি বিকল্পই ধর্মে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সুচির-প্রতীক্ষিত জননী মাতৃস্নেহ-বুভুক্ষু সন্তানকে আমন্ত্রণ করছেন জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয়ের মর্যাদায়, আপন মাতৃস্নেহের আশ্রয়ে, একে স্বীকার করার মধ্যে অন্যায় ছিল না। সত্যই তো তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, জয়ী হলে অনুজ পাণ্ডবদের ঊর্ধ্বে তাঁর স্থান হত; এ গৌরব স্বীকার করলেও কোথাও সত্যের অপলাপ ঘটত না। প্রত্যাখ্যানের মধ্যে দীর্ঘ-সঞ্চিত অভিমান নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু আরও কিছু ছিল: অধিরথ এবং রাধার কাছে আশৈশবকাল যে স্নেহসিক্ত আশ্রয়ে লালিত, তার অমর্যাদা ঘটত। দাতা কর্ণেরও অদেয় ছিল কুন্তিকে এ দান। বীর কর্ণেরও অদেয় ছিল কুন্তিকে এ দান। বীর কর্ণ বীরের সদগতি থেকে ভ্রষ্ট হলেন না, সূর্যের সন্তান জ্যোতির্ময় আত্মত্যাগে শ্রেয়স্তর বিকল্প স্বীকার করে নিলেন, পরাজয় ও মৃত্যু অবধারিত জেনেও। এইখানেই কর্ণের মহত্ত্ব; প্রথম কৌরবপর্যায়ের মহাকাব্যের তিনিই তো নায়ক। সেই চরিত্র মেঘের পশ্চাতে বিদ্যুৎ-রেখার মতো মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছে, তাই অক্লেশে ক্লেশবরণ করতে পারলেন। অখ্যাত, দুর্যোধনের আশ্রিত, সূতপুত্র, এই পরিচয় নিয়েই পৃথিবী ত্যাগ করতে সম্মত হলেন। তাঁর ধর্মসংকট তীব্র ও মর্মন্তুদ, তাই সেইখানে তাঁর ধর্মবিজয় এত গৌরবের।

ভুলে গেলে চলবে না যে, সব মহাকাব্যের নায়কই মানুষ, উপনায়ক ও প্রতিনায়করাও মানুষ। সংগ্রামটা দেবাসুরে নয়, মানুষে মানুষেই। এবং এই সংগ্রাম যখন চরিত্রগুলির মর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয় এবং তাঁদের এনে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রায় সমান গুরুত্বের দুটি ধর্মগত বিকল্পের সামনে, তখনই তাঁদের চরিত্রবলের চূড়ান্ত পরীক্ষা। পরীক্ষা এই কারণে যে, যে কোনও বিকল্পই সমাজ ধর্মসংগত বলে স্বীকার করে নেবে— নীতিভ্রষ্ট বা অধার্মিক বলে দোষারোপ করবে না। বিকল্পগুলির ওজন আপাত ভাবে সমান বলেই সংকট, এবং আত্মত্যাগের পক্ষ, আপাত লাভের ও সমৃদ্ধির পক্ষ ত্যাগ করার মধ্যেই তাদের আত্মিক জয় নিহিত।

মহাকাব্য এ ভাবে ধর্মসংকটকে চিত্রিত করে কেন? মানুষ মহাকাব্যের কাছে কী প্রত্যাশা করে?— পথনির্দেশ। পাঠকশ্রোতাদের জীবনও ধর্মসংকট-সংকুল, বারে বারেই তাদের সামনে দুটি শ্রেয় পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীর রূপে দেখা দেয়। এর মধ্যে যেহেতু কোনওটিই ধর্মাচরণের নীতিবহির্ভূত নয়, তাই সংকট। আদর্শকে কত উচ্চে মানুষ স্থাপন করতে পারে এবং তার জন্যে কত মর্মযন্ত্রণার মূল্য দিতে পারে তারই নিরিখ ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মহাকাব্যের কেন্দ্র চরিত্রগুলি। ধর্মসংকটে যারা হার মানল তারা প্রতিনায়ক, মানুষের ধর্ম-জিজ্ঞাসা, ধর্ম-প্রত্যাশা সেখানে গিয়ে প্রতিহত হল। স্বার্থসন্ধানী, আত্মসুখপরায়ণ থেকেও কতকদূর পর্যন্ত ধর্মপথে থাকা যায়, কিন্তু এমন একটি গিরিশিখর আছে যা শুধু কঠিন দুঃখে অধিরোহণ করা যায় বলেই তার উচ্চতা, শুভ্রতা মানুষকে সম্ভ্রমে নত করে। ইচ্ছে করলে সে দুঃসাধ্য শৈলশিখরকে নীচে থেকে প্রদক্ষিণ করেও জীবনের পথ-পরিক্রমা সমাধান করা যায়। কিন্তু মহান যাঁরা তাঁরা ওই পথক্লেশের ভয়ে বিচলিত হন না, বরং স্বেচ্ছায় দুঃখবরণ করে ওই উত্তুঙ্গ শিখর অভিমুখে আরোহণ করেন। নিচের থেকে মানুষ ওই ঊর্ধ্বগামী দুঃখসাধনব্রতী আদর্শনিষ্ঠ মানুষের পরিক্রমা চেয়ে দেখে। শ্বাপদ আছে, আছে পথের দুঃসহ একাকিত্ব ও নৈঃসঙ্গ্য; কিন্তু আন্তরবলে বলীয়ান, নৈতিক শৌর্যে দৃঢ়চিত্ত যে-মানুষ পথের এই সব বিপদ জেনে দুঃখময় পথ বরণ করেছেন, নিচের মানুষ তাঁদের দেখে পথনির্দেশ পায়, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় তারা আপন জীবনের ধর্মসংকটে কোন বিকল্পকে আশ্রয় করবে তার এক দিকনির্দেশ পায়।

এই পাওয়াটা সত্য হয়, কারণ মহাকাব্যের নায়কও দেবতা নয়, প্রতিপক্ষও অসুর নয়। মানুষের সংকটে মানুষই পথ দেখাতে পারে। নির্দোষ পাণ্ডবরা দ্বাদশবর্ষ বনে নির্বাসিত, রামলক্ষণ-সীতাকে চতুর্দশ বৎসর বনবাসী দেখে নিষ্কারণে নির্যাতিত মানুষ শক্তি পায়। যখন দুটি নীতিনিষ্ঠ বিকল্পের দুরত্যয় সংকটের সামনে মানুষ এসে পৌঁছয় তখন মহাকাব্যের চরিত্রদের অনুরূপ বিপর্যয়কালের আচরণ দীপবর্তিকা হয়ে পথ দেখায়। নীতির সংকটে জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে; রোগ শোক ব্যাধি দৈন্যের চেয়ে অনেক বেশি এই নীতির সংকটের অন্ধকার। কিংকতর্ব্যবিমূঢ়তা মানুষের জীবনে পথচিহ্ন বিলোপ করে। তখনই মহাকাব্যের মানুষ-নায়ক পথভ্রষ্ট এই মানুষের অভিমুখে বাহু প্রসারিত করে, আত্মিক দীপালোকের পথে তাদের প্রবর্তনা দেয়। সে পথ দুঃখ ক্লেশে সমাকীর্ণ, এবং সেই কারণেই ধর্মসংকট হতে উত্তীর্ণ মানুষ গৌরবে আলোকিত। দুর্বল অনুগামী নিজেকে বলতে পারে, ‘ধর্মাধর্মবিভ্রান্ত ওই মানুষটি যদি এত যন্ত্রণার মূল্যে শ্রেয়স্তরকে বরণ করতে পেরে থাকে, তবে আমিও পারি।’ এবং টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়, পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় কঠিন পথে, কঠিন উত্তরণের গৌরবের অভিমুখে।

পরিশেষে, এই ধর্মসংকটগুলির যোগফল কী? কেন এগুলিকে মহাকাব্যে এ ভাবে উপস্থাপিত করা হয়? উদ্দেশ্য একটিই: জীবনবোধের পুনর্মূল্যায়ন। কতকগুলি বিশ্বাস ও মূল্যবোধ সমাজে ব্যাপ্ত থাকে, সেগুলি মানুষ উত্তরাধিকার-সূত্রে পায় এবং তা থেকে জীবনের পথসংকেত পায়। তার পর, সহসা কোনও অনাশঙ্কিত ঘটনায় পুরনো মূল্যবোধ হঠাৎ অর্থহীন, অচল হয়ে যায়। দুটি পরস্পরবিরোধী মূল্যবোধের সামনে তখন মানুষ দিগভ্রান্ত বোধ করে। তখন তার প্রয়োজন হয় নতুন মূল্যবোধের। এই প্রয়োজন ধর্মসংকটের; এমন বহু বিচিত্র ধর্মসংকটের সম্মুখীন হয়েছেন মহাকাব্যের চরিত্রেরা, এবং পরিবর্তিত পরিবেশে নিজেদের আন্তর-বোধ ও শুভবুদ্ধির দ্বারা প্রণোদিত হয়ে প্রয়োজনীয় নতুন মূল্যবোধের সন্ধান পেয়েছেন। পাঠকশ্রোতা যখন জীবনের অনুরূপ সন্ধিক্ষণে দুটি বিরোধী নীতির মধ্যে নির্বাচন করতে বাধ্য হন তখন মহাকাব্যের নায়কের অনুরূপ অবস্থার সিদ্ধান্ত ও আচরণ তাঁকে পথ দেখায়। মানুষের জীবনের অন্তঃসংঘাতে মহাকাব্যের মানুষ-নায়কের সিদ্ধান্তই পথ দেখাতে পারে। তাই কৃষ্ণ মহাভারতের নায়ক হতে পারেন না। বন্ধুকে আত্মিক সংকট থেকে ত্রাণ করবার উপায় হিসেবে বিশ্বরূপ-দর্শন করানোর জাদু যাঁর আয়ত্তে আছে তিনি তো দেবতা, সর্বশক্তিমান; স্বল্পশক্তি মানুষ তাঁর কাছ থেকে কোনও নির্দেশ পায় না, কারণ মানুষের শক্তি সীমিত। তাই যুধিষ্ঠির নায়ক, কারণ বারে বারে তিনি অন্তর্দ্বন্দ্বে, মূল্যবোধের দ্বৈধতায় পীড়িত হন, দুটি বিপরীত নীতির সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বোধ করেন, বহু যন্ত্রণার মধ্যে দ্বিধা নিরসনের জন্যে একটি মূল্যবোধকে বেছে নেন। এই সময়ে তিনি নৈতিক সংশয়ে মুহ্যমান সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান এবং মানুষ তাঁর কাছে সংকেত পায় নিজের মূল্যবোধের সংঘাতে সিদ্ধান্ত খুঁজে নিতে।

মহাকাব্যের মূল বিষয়গুলিই হল এই ধর্মসংকট। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র ভিন্ন ভাবে এর সমাধান করেছে। ধর্মসংকট দুর্যোধনের কাছেও এসেছিল: পাণ্ডবদের উৎকর্ষ মেনে নেওয়া অথবা কেবলমাত্র ক্ষত্রিয়ধর্মের অনুশাসন মেনে যুদ্ধ করে যাওয়া। তার পর একদিন এল বিরাটপর্বের শেষে, যখন পাণ্ডবদের উৎকর্ষ পরাজয় হানল দুর্যোধনের ওপরে। সে দিন দুর্যোধনের কী প্রতিক্রিয়া? বসে আছেন প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করা সংকল্প নিয়ে; তাঁকে সে দিন পথ দেখাল কে? কৃত্যারা; অর্থাৎ পাতালের মন্দশক্তি। ম্যাকবেথকে যেমন ডাইনিরা অর্থ-সত্য অর্ধ-মিথ্যার প্রহেলিকা দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিল ঠিক তেমনই কৃত্যারা দুর্যোধনকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা করল।[১] মানুষ তাই নৈতিক সংকটে দুর্যোধনের আচরণ বা সিদ্ধান্ত থেকে কোনও যথার্থ অনুপ্রেরণা পায় না। পুরুষের অর্থাৎ যথার্থ মানুষের সংজ্ঞা দিয়েছে মহাভারত: ‘যার পুণ্যকর্মের ধ্বনি আকাশ ও পৃথিবীকে স্পর্শ করে সে ততদিনই জীবিত থাকে যত দিন ওই ধ্বনি থাকে।’[২] আত্মিক শৌর্যে ঋদ্ধ নায়ক, দুরূহ ধর্মসংকটে যাঁর শুভবুদ্ধি তাঁকে মানুষের হিতকর সিদ্ধান্তের সন্ধান দেয়, তেমন নায়কের আচরণ আজও পথনির্দেশ করে শ্রেয় ও প্রেয়ের দ্বন্দ্বে তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ, দুটি শ্রেয়ের মধ্যে আনুপাতিক গুরুত্ব নির্ধারণ করে আপন আচরণকে তার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে। তাই মানুষ যুগে যুগে বারে বারে ফিরে আসে জীবনবোধের উৎস-সাহিত্য মহাকাব্যে। সকল শ্রেষ্ঠ সাহিত্যই জীবনের পুনর্মূল্যায়নে প্রতিষ্ঠিত; এর আদিমতম সূচনা মহাকাব্য। এই কারণেই তা অমর।

***

১. ভীষ্মপর্ব; (২৪:৪-৮)

২. আরণ্যকপর্ব; ২৪০] পুরো অধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *