১০. দেবতা না মানুষ?

দেবতা না মানুষ?

মহাভারতের মতো গ্রন্থিল মহাকাব্যটির সুর অনেকটাই খাদে নেমে এসেছে শেষের দুটি অংশ— ‘মহাপ্রস্থান’ও ‘স্বর্গারোহণ’ পর্বে, কিন্তু পুরোপুরি নামেনি, মাঝে মাঝে উঁচু পর্দাতেও উঠেছে। মৌষলপর্বে অর্জুনের কাছে যদুকুল ধ্বংসের বিবরণ শুনে যুধিষ্ঠিরের মনে একটা বৈরাগ্য এল, অর্জুনেরও কৃষ্ণের বিরহে কষ্ট এবং কৃষ্ণের শেষ ইচ্ছা— তাঁর রাজ্যের নারীদের রক্ষা করা— রাখতে না পারার জন্যে মর্মান্তিক যাতনা হল। যুধিষ্ঠির বললেন ‘কাল’ আমাকে আকর্ষণ করছে। আমি আর সংসারে থাকব না।[১] অর্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদীরও মনে একই রকম বৈকল্য ও ঔদাসীন্যের উদয় হল; সকলেই সংসার ছেড়ে যেতে চাইলেন। যজ্ঞ করে অগ্নিকৃত্য শেষ করে, ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে, সব সম্পত্তি ব্রাহ্মণদের দান করে, বল্কল ধারণ করে তাঁরা পরিব্রজ্যা নিলেন। পরীক্ষিৎ নাবালক, তার শিক্ষার ভার কৃপাচার্যকে দিয়ে যুধিষ্ঠির বললেন, এর পুত্র রাজা হবেন। ততদিন ধৃতরাষ্ট্রের বৈশ্যাগর্ভজাত সন্তান যুযুৎসুকে রাজত্ব করতে বললেন। সকলে বল্কলধারণ করে সমবেত প্রজাদের নিষেধ ও রোদন উপেক্ষা করে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক ঘুরে উত্তরের দিকে এগোলেন— পাঁচ ভাই ও দ্রৌপদী; একটি কুকুরও পথ থেকে তাঁদের সঙ্গ নিল। অগ্নিদেব এসে অর্জুনকে বললেন, তিনি যেন তাঁর গাণ্ডীব ধনু, যা বরুণের কাছ থেকে অর্জুনের জন্যে অগ্নি সংগ্রহ করেছিলেন, সেটি যেন অর্জুন বরুণকে প্রত্যর্পণ করে মহাপ্রস্থানে যান। শুনে অর্জুন গাণ্ডীব ধনুটি জলে ফেলে দিলেন।[২]

পথ চলতে চলতে হঠাৎ পড়ে গেলেন দ্রৌপদী; ভীম যুধিষ্ঠিরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন দ্রৌপদীর অর্জুনের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল, সেই পাপে এই মৃত্যু। এর পরে নকুল— তাঁর প্রাজ্ঞতার অহংকারের জন্যে; সহদেব— তাঁর রূপাভিমানের জন্যে; অর্জুন— এক দিনে সব শত্রু বিনাশ করবেন এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করতে পারার জন্যে; এবং অবশেষে ভীম— তাঁর ভোজনপ্রিয়তার জন্য প্রাণ হারালেন। একা যুধিষ্ঠির ও তাঁর সঙ্গী কুকুরটি স্বর্গের দ্বারে পৌঁছতে দেবদূত কুকুরটি ফেলে রেখে যুধিষ্ঠিরকে সশরীরে স্বর্গে যেতে আহ্বান করলেন। যুধিষ্ঠির রাজি হলেন না, বললেন নিষ্কারণে বিশ্বস্ত সহযাত্রীকে পরিত্যাগ করতে পারবেন না। তখন দেখা গেল কুকুর স্বয়ং ধর্ম। স্বর্গে পৌঁছে যুধিষ্ঠির ভাইদের ও দ্রৌপদীকে দেখতে চাইলেন।[৩]

শেষতম পর্ব স্বর্গারোহণ। যুধিষ্ঠির প্রথমে দেখতে পেলেন কৌরব বীরদের। বিস্ময় প্রকাশ করলে নারদ বললেন যাদের পাপ বেশি পুণ্য কম, তারা আগে স্বর্গ ভোগ করে নরকে যায়। পুণ্যবান আগে নরকে যায়, তাই যুধিষ্ঠির নরকে যাতনাক্লিষ্ট ভাইদের ও দ্রৌপদীকে দেখতে পেলেন। যুধিষ্ঠির আসতেই নরকবাসীরা সকলে একবাক্যে তাঁকে অনুরোধ করলে যেন তিনি সেখানে অপেক্ষা করেন; কারণ নরকের দুঃসহ যন্ত্রণা, উৎকট পূতিগন্ধ, নানা রকম উৎপীড়নের কাতরোক্তি এ সবই যুধিষ্ঠির আসা-মাত্রই থেমে গেল। আলোকময় পরিবেশ, সুগন্ধ বায়ু ও শ্রুতিসুখকর ধ্বনিতে নরকবাসীরা তাদের যন্ত্রণা ভোগ থেকে পরিত্রাণ পেল। তখন নরকবাসীরা সকলে বিশেষ ভাবে যুধিষ্ঠিরকে অনুনয় করতে লাগলেন যেন তিনি সেখানেই থাকেন, কারণ তিনি আসাতে তাঁদের যন্ত্রণার লাঘব হয়েছে। যুধিষ্ঠির দেবদূতকে দেবতাদের জানাতে বললেন যে, তিনি ওইখানেই থাকবেন, যন্ত্রণাকাতর নরকবাসীদের আরাম দিতে। এর পর দেবতারা এসে যুধিষ্ঠিরকে স্বর্গে নিয়ে গেলেন। পথে স্বর্গের গঙ্গায় অবগাহন করে মানবদেহ ত্যাগ করে দিব্য শরীর ধারণ করে স্বর্গে এলেন। দেখলেন, তাঁর ভাইরা, দ্রৌপদী ও কৃষ্ণ সেখানে আছেন। শুনলেন, স্বয়ং লক্ষ্মী দ্রৌপদীরূপে মর্তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এর পরের অংশ অপ্রাসঙ্গিক— ফলশ্রুতি অংশ।[৪]

মহাপ্রস্থান ও স্বর্গারোহণ অংশে বেশ কিছু ব্যাপারে পাঠকের সাড়া দ্বৈধতাকে স্পর্শ করে। মৌষল পর্বের শেষাংশে ও মহাপ্রস্থানের প্রথমাংশে দেখি, কৃষ্ণের মৃত্যু, যদুকুলধ্বংস, অর্জুনের গাণ্ডীব ধনু প্রত্যর্পণ, ইত্যাদির মধ্যে বীরদের ক্ষত্রিয়কৃত্য যেন ফুরিয়ে গেল। নিরস্ত্র ক্ষত্রিয়ের কী পরিচয়? এখন তাঁরা বানপ্রস্থী, কাজেই যজ্ঞকর্ম বা ক্ষাত্রকর্ম থেকে মুক্ত। কিন্তু বানপ্রস্থেও তাঁরা রইলেন না, ধীরে ধীরে হিমালয়ে আরোহণ করতে লাগলেন। প্রথমে পতন ও মৃত্যু ঘটল দ্রৌপদীর। ভীমের প্রশ্নে ধর্মপুত্রের উত্তর দ্রৌপদীর অপরাধ অর্জুনের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব। মনে পড়ে, দ্রুপদের রাজসভায় বীর্যশুল্কা দ্রৌপদী দাঁড়িয়ে, হাতে সাদা ফুলের একগাছি মালা। উৎকণ্ঠিত আগ্রহে দেখলেন তরুণ বীর অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করছেন, ওষ্ঠাধরে আনন্দিত হাসি ও হাতে পুষ্পমাল্য নিয়ে শুচিস্মিতা দ্রৌপদী এগিয়ে এসে পরম পরিতৃপ্তির সঙ্গে অর্জুনকে মালা পরিয়ে দিলেন। কুমারী হৃদয়ের সে মুহূর্তের আত্মনিবেদনের চরিতার্থতা, সে কি ভুলবার। দৈবদুর্বিপাকে আরও চার ভাইকে পরে বরণ করতে হয়েছিল, কিন্তু জীবনের প্রথম প্রেম যার প্রতি উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল সে তো অর্জুনই। তাঁর দুর্ভাগ্য অর্জুন পর পর অন্য তরুণীদের পাণিগ্রহণ করেন, দ্রৌপদীর সেই শুচিশুভ্র প্রেম তার প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। অর্জুনের ওপর নিষ্ফল অভিমান করেছেন, কর্তব্যে ত্রুটি ছিল না অন্য স্বামীদের প্রতি, কিন্তু প্রথম প্রেম কি শাসন মানে? অর্জুনের প্রতি নিষ্প্রতিদান অনুরাগ তো দ্রৌপদীর জীবনে মর্মন্তুদ যন্ত্রণার মধ্যে গোপনে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে— এ কি পাপ হতে পারে? অথচ ধর্মপুত্র বললেন, এই তার পাপ। এই পাপে তাঁর মৃত্যু। লক্ষণীয়, প্রথম পতন ও মৃত্যু একমাত্র নারী অভিযাত্রিকটিরই, সে কি নারী বলেই?

যুদ্ধের মধ্যে প্রবল ক্ষোভে ও আক্রোশের মুহূর্তে অর্জুন হঠকারীর মতো দাম্ভিক প্রতিজ্ঞা করে বসেন— একদিনে সব শত্রু নিপাত করবেন। এ উচ্চারণে অর্জুনের তখনকার ক্রুদ্ধ আস্ফালনই ছিল। বক্তা শ্রোতা সকলেই জানত এটা সম্ভাব্যতার সীমার বাইরে। এমন তো কত কথাই মানুষ তীব্র আবেগের মুখে বলে; অথচ সেই পাপে নাকি অর্জুনের মৃত্যু। নকুল-সহদেবের বিজ্ঞতা ও রূপের অভিমান কখনও উদগ্ররূপে প্রকাশ পায়নি, কারও ক্ষতিও করেনি। তবু সেই মনোভাব এমন অমার্জনীয় যে সেই পাপে তাঁদের মৃত্যু ঘটল। ভীম অসামান্য বলশালী, দীর্ঘদেহী, আহারে তাঁর প্রয়োজনও বেশি ছিল, রুচিও বেশি ছিল। স্বয়ং কুন্তি জানতেন শক্তিমান পুত্রের প্রয়োজন বেশি, তাই ভোজ্যের অর্ধাংশ ভীমের জন্যে রাখতেন, বাকিটা বাকি চার ভাইয়ের। প্রয়োজনে দৈহিক বলের জন্য সব পাণ্ডবদেরই ভীমের শরণার্থী হতে হয়েছিল। সেই মানুষটা ভোজনপ্রিয় ছিল বলে তাঁর মৃত্যু ঘটল! অর্থাৎ তাঁর সংযম যথেষ্ট ছিল না, তিনি নিষ্কাম ভাবে আহার করতেন না। শুনলে সকলেরই মনে হয়, পাপ ও দণ্ডের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্যই এখানে নেই। শেষ পর্যন্ত একা চলেন যুধিষ্ঠির, পিছনে কুকুরটি। এটি স্বেচ্ছায় তাঁদের অনুগামী হয়েছিল বলে একে ত্যাগ করে স্বর্গে যেতে রাজি হননি যুধিষ্ঠির। এতে তাঁর মহত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে, যদিও কুকুরটি সত্য অর্থে আশ্রিত ছিল না, শুধু অনুগামীই ছিল। তাই তাকে ত্যাগ করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মৃতের সঙ্গে (অর্থাৎ মৃত ভাইদের ও দ্রৌপদীর) জীবিতের কি সম্পর্ক? কুকুরটি জীবিত শরণার্থী, একে ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।[৫] তা না হয় না ত্যাগ করুন, কিন্তু সারা জীবনের সহচর ও সঙ্গিনীর সঙ্গে ক’প্রহরের ব্যবধানে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল? এই মহানুভব উচ্চারণে যুধিষ্ঠিরের শরণাগতরক্ষণের নিদর্শন থাকতে পারে, কিন্তু মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিনের সঙ্গীদের বিস্মৃত হওয়ার অকৃতজ্ঞতাও রয়েছে।

এর পরে প্রশ্ন ওঠে যুধিষ্ঠিরের সশরীরে স্বর্গে পৌঁছনোর ব্যাপারে। সামান্য ভোজনবিলাসিতা, প্রজ্ঞাভিমান বা রূপাভিমান, ক্রুদ্ধ মুহূর্তের অবিমৃষ্যকারী প্রতিজ্ঞা, অতি স্বাভাবিক প্রেমজ পক্ষপাতিত্ব, এইগুলি যদি মৃত্যুর কারণ হতে পারে, তা হলে স্বয়ং ধর্মপুত্রের যে স্পষ্ট মিথ্যাভাষণে শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ আচার্যের প্রাণহানি ঘটেছিল সেই মিথ্যাভাষী কোন সুবাদে সশরীরে স্বর্গে পৌঁছন? বলা প্রয়োজন, এই ব্যবস্থাপনা— দ্রৌপদী ও তাঁর চার স্বামীর মৃত্যু ও যুধিষ্ঠিরের সশরীরে স্বর্গগমন— এ সবই দেবতাদের, যাঁদের মধ্যে ধর্মও আছেন। রূপকে পাওয়া যাচ্ছে, যে কুকুরটি যুধিষ্ঠিরের অনুগমন করেছিল, বাৎসল্যের জন্যে যাকে ত্যাগ করে তিনি স্বর্গে যেতেও রাজি হননি, সে সত্যিই কুকুর নয়, স্বয়ং ধর্ম, যুধিষ্ঠিরের পিতা। এটা তাঁর ধর্মপরায়ণতা বলে গণ্য হল এবং যুধিষ্ঠিরকে ধর্মের অনুগামী না দেখিয়ে মহাকাব্যকার দেখালেন ধর্ম স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের অনুগামী। পরে আমরা দেখব, যুধিষ্ঠির নিষ্পাপ নন, কিন্তু কোনও এক স্তরে তিনি ধর্মের উন্নত শিখর স্পর্শ করেছিলেন যার দ্বারা ধর্ম তাঁর অনুগমন করছে— এই রূপকটি যথাযথ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ধর্ম যুধিষ্ঠিরের চিরানুগামী, কারণ যুধিষ্ঠির নিজেই সতত ধর্মচারী।

এ তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পরে ব্যাপারটা একটা নতুন আলো দেখা দেয়: ধর্ম ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য একটা সম্পর্ক। তা হলে, সেই প্রাণঘাতী মিথ্যাটা কি পাপ নয়? অর্জুনের উত্তেজিত দম্ভোক্তি, যা শুনলেই বোঝা যায় যে এটাকে কার্যে পরিণত করা অর্জুনের বা অন্য কোনও বীরেরই সাধ্য ছিল না, যা ছিল শুধু অসহিষ্ণু রোষের প্রকাশ, সেটাকেই তাঁর প্রাণনাশী মিথ্যা বলে প্রতিপাদন করছেন যিনি, তিনি স্বয়ং মারাত্মক মিথ্যা-উচ্চারণে আচার্য হন্তারক। এখানে বিচারে ন্যায় কোথায়? সমতা বা ভারসাম্য কোথায়? নেই। ওই মারাত্মক মিথ্যাভাষণ সম্পর্কে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করতেও পারতেন। যুদ্ধে পাণ্ডবদের ক্ষমতার সীমাও এতে নিশ্চিত হয়ে গেল: সম্মুখসমরে দ্রোণকে পরাজিত বা নিহত করতে পারতেন না পাণ্ডববীররা— এ কথাও স্বীকৃত হয়ে রইল। অবশ্য কৃষ্ণের পরামর্শে অন্য কৌরব বীরদেরও মৃত্যু ঘটেছে অ-ক্ষত্রিয়োচিত আচরণের দ্বারা। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মিথ্যা বলা তো সজ্ঞানে করা পাপ। তা ছাড়া, শাস্ত্রে বলে ‘মৃগয়াক্ষঃ পরীবাদঃ’, ইত্যাদি আটটি অন্যায় আসক্তি হল ব্যসন, এবং পরিত্যাজ্য। দ্যূতক্রীড়া (অক্ষ)-ও তার মধ্যে পড়ে। অধিকন্তু, পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রীকে একা পণ রাখতে কে তাঁকে অধিকার দিয়েছিল? কিংবা ভাইদের পণ রাখতে? অথবা সকলের যৌথ সম্পত্তি? এই সবই অন্যায়। যখন মনে পড়ে যে, কলি-আক্রান্ত নলও দময়ন্তীকে বাজি রাখতে রাজি হননি, সেখানে দেখি সজ্ঞানে সুস্থ শরীরে যুধিষ্ঠির পর পর এ সব অন্যায় করলেন। এখানে পাঠক কী ভাববেন? ধর্ম আর যুধিষ্ঠির অভিন্ন হলে এই কি ধর্ম? যুদ্ধান্তে গান্ধারীর কাছে যিনি যুদ্ধের দায়িত্ব নিজের ওপরে নিয়েছিলেন তিনি কি তখন শুধুই ভদ্রতা করে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন? যে পাপ-বোধে সিংহাসনের জন্যে যুদ্ধ করেও করতলগত সিংহাসন গ্রহণ করতে পারছিলেন না সে-আত্মগ্লানি কি অভিনয় মাত্র? তা তো নয়, তিনি তো অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে রাজি হলেন সত্যকার একটা অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতেই। কাজেই যুধিষ্ঠির একাধিক অন্যায় করেছিলেন এবং সে নিয়ে তাঁর কোনও মোহ ছিল না। তা হলে এই সশরীরে স্বর্গে পৌঁছনোর ব্যাপারটা কী? দেবতাদের ভুল? পাঠক এইখানে এসে যুধিষ্ঠিরের নিষ্পাপ ধর্মাত্মতা সম্বন্ধে সন্দিহান হন। অথচ কার্যক্ষেত্রে তাঁকে নিষ্পাপ ধর্মাত্মা বলেই প্রতিপন্ন করছে মহাকাব্য।

এ জায়গায় পৌঁছে পাঠকের প্রতিক্রিয়াতে ধাক্কা লাগে এবং ধীরে ধীরে যে সমাধানটি পাঠকের প্রত্যয়ে উদিত হয় তা হল, যুধিষ্ঠিরের বিচার এবং বস্তুত কোনও মানুষের বিচারই একমাত্রিক হতে পারে না। যুধিষ্ঠিরের একাধিক বিচ্যুতি ছিল, কিন্তু কোনও একটি পরিমাপে পড়ে যুদ্ধের প্রাক্কালে যুধিষ্ঠিরের মর্মন্তুদ অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা। সে দিন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের ক্ষত্রিয়ধর্মচ্যুত হতে দ্বিধা ছিল না। ভিক্ষুকের মতো আচার্যদের পায়ে ধরে যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি প্রার্থনা করতে তাঁর বাধেনি। অর্জুনের দ্বিধাও অর্জুনের চরিত্রে নতুন এক আত্মিক মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু অর্জুনের দ্বিধা স্বজনহত্যার আশঙ্কায়। সে তাঁর পারিবারিক সত্তার আত্মীয় আনুগত্যের ক্ষেত্রে দ্বিধা; তিনি নিজে যুদ্ধ করতে অসম্মত। কিন্তু যুধিষ্ঠির পুরো যুদ্ধ ব্যাপারটাতেই অসম্মত। মনে পড়ে, সিংহাসনে ন্যায়সংগত অধিকার থাকা সত্ত্বেও পাঁচটি গ্রামের বিনিময়ে একদা সিংহাসনের দাবি প্রত্যাহার করতেও তিনি সম্মত ছিলেন। এর মধ্যে রাজকীয় গৌরব তো নেই-ই, সামাজিক এবং ধর্মগত মানদণ্ডে একটা দৈন্য ও অসম্মানও যেন নিহিত ছিল। এইখানে যুধিষ্ঠির এমন এক বড় মাপের মানুষ হয়ে ওঠেন যিনি ক্রান্তদর্শী। আপাত লাভ, যশ, খ্যাতি, বিজয়-সমারোহ ও রাজত্বের লোভকে ছাপিয়ে যিনি দেখতে পেয়েছেন নরহত্যা পাপ,– তা সে যে কারণেই হোক না কেন। কোনও কারণেই কোনও মানুষকে বধ করায় তাঁর অন্তর্নিহিত ধর্মবোধ সায় দেয় না; তাতে আপাত ভাবে ক্ষত্রিয়ধর্ম বা বীরধর্মের নীতি থেকে ভ্রষ্ট হতেও তাঁর বাধে না। এই মনোভাবের সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতি আছে যুদ্ধশেষে তাঁর আন্তরিক আত্মগ্লানি ও সিংহাসনে অনীহার। এক যুধিষ্ঠিরই সে দিনের সমাজের প্রত্যাশিত বর্ণধর্মের ওপারে মানবধর্মের শেষ বিচারে সগৌরবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত এইখানেই, এই বিচারদৃষ্টির মহিমাতেই, তিনি ধর্মপুত্র, যিনি সশরীরে স্বর্গে প্রবেশ করার অধিকারী। মহাভারত নানা ভাবে জীবনের তুঙ্গতম শিখরে এই মানবত্বের জয়গান করেছে। করেছে বহু জটিল ঘটনা সংস্থাপনার দ্বারা, ফলে এই মহাকাব্যে সাড়া দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

রামায়ণে পত্নী-অপহারক রাক্ষসকে বধ করার প্রয়াসে দ্বিধার অবকাশ সেই, পারিবারিক মূল্যবোধ ও ক্ষাত্রধর্মের কর্তব্য পালনে দ্বিধার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যেখানে একটা কর্তব্য— বর্ণধর্মের আদর্শ— পালন করতে গেলে অন্য একটা বৃহত্তর কর্তব্য— মানবধর্মের নির্দেশ— পালন করা যায় না, সত্তার মহত্তর সংজ্ঞার নিরিখে একটা ধর্মপালনে পাপের সম্ভাবনা থাকে, সেখানে সমস্ত ব্যাপারটা চিন্তা, সংবেদনা এবং এক চূড়ান্ত অর্থে আধ্যাত্মিক শুদ্ধতার জবাবদিহির সংকট উপস্থাপিত করে। মনে পড়ে, শান্তিপর্বে ভীষ্মের উক্তি, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই। যুদ্ধে এই মানুষকেই রাখতে হয়, যার ওপরে কেউ নেই। কাজেই মানবজিঘাংসা যার কাছে সব থেকে বড় পাপ তার ধর্ম-বোধ ক্ষত্রিয়তার ওপারে শ্রেষ্ঠ নীতির নিরিখই শুধু মানে। মহাকাব্যকারের দৃষ্টি যে শিখরে উত্তীর্ণ, পাঠককে অস্পষ্ট ভাবে হলেও সে উচ্চতা দূর থেকে প্রত্যক্ষ করে বুঝতে হয় এ মহাকাব্যের গভীরে কোন মহত্তর ন্যায়নীতিবোধ ক্রিয়াশীল। অতএব সাড়া দিতে গিয়েও পাঠক সংকটে পড়েন এবং নিজের বোধের অন্তঃস্থলে সে সংকট অতিক্রম করে তবে মহাকাব্যের মর্মবস্তুটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।

স্বর্গারোহণ পর্বে দেখি যুধিষ্ঠির স্বর্গগঙ্গায় অবগাহন করে মর্ত্যদেহটি সেখানেই রেখে দিব্যদেহ নিয়ে উঠেছেন।[৬] তা হলে তাঁর বৈশিষ্ট্য শুধু মর্ত্যদেহ নিয়ে স্বর্গে পৌঁছনোতে? এই আপাতবিরোধী দুটি ঘটনার মধ্যে কবি সম্ভবত বলতে চাইছেন যুধিষ্ঠিরকেও পাপ স্পর্শ করেছিল তাই স্ব-শরীরে তিনি স্বর্গে পৌঁছতে পারলেন, বাস করতে পারেন না। কিন্তু আর সকলের চেয়ে তিনি যে মাথায় বড়, সে কথাটি এর মধ্যে বিধৃত রইল। পৃথিবীর সমস্ত মহাকাব্যের অন্ত্য দৃশ্যেই নায়ক একাকী, তাই মহাপ্রস্থানপর্বের শেষ থেকে মঞ্চে যুধিষ্ঠির একাই, পাঠকের দৃষ্টি পুরোপুরি তাঁর ওপরেই নিবদ্ধ।

স্বর্গে দেবদূত দ্রৌপদীকে দেখিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘ইনি আসলে পদ্মা, স্বয়ং লক্ষ্মী আপনাদের পাঁচ ভাইয়ের বধূরূপে মর্তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।’[৭] এখানে বেশ কিছু ব্যাপার গোলমেলে ঠেকে। দ্রৌপদীর স্বামীরা ভিন্নভিন্ন দেবতার অংশে জন্মেছেন, কিন্তু তাঁরা সবাই মানুষ এবং কেউই বিষ্ণুর অংশে জন্মাননি। তা হলে দাঁড়াল এই, যে লক্ষ্মীকে ভোগ করলেন পাঁচটি মানুষ, তাঁরা কেউই বিষ্ণু বা বিষ্ণুর অংশও নন। দ্রৌপদী দ্রুপদরাজার যজ্ঞবেদী থেকে উঠেছিলেন আর লক্ষ্মীর উৎপত্তি সমুদ্র থেকে। আসলে মহাকাব্যের নায়কনায়িকাদের দেবতার অংশে জন্মানোর কথা মাঝে মাঝেই বলা হয়ে থাকে, কিন্তু এখানে সম্পর্কে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা, তা ঘটল ওই দ্রৌপদীর ওপরে লক্ষ্মীত্ব পরে আরোপিত হওয়ার জন্যে। ফলে পাঠকের মধ্যে খটকা থেকে যায়, বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী এই ভিন্ন ভিন্ন দেবতার অংশে জন্মানো পাঁচ ভাইয়ের বধূ হন কি করে? কেউ এ প্রশ্ন করেননি, কোনও উত্তরও দেওয়া হয়নি। শূন্যে প্রলম্বিত হয়ে থাকে সংশয়। মহাকাব্যের মানবিক মূল্যবোধ এতে খণ্ডিত হয় না, সামাজিক সতীত্বের প্রশ্নই শুধু অনুত্তরিত থেকে যায়। এর দ্বারা মহাকাব্যে অন্য এক মহিমা লগ্ন হয়।

স্বর্গে পৌঁছবার পর যুধিষ্ঠিরকে জানানো হল, যেহেতু তিনি ছলনার দ্বারা দ্রোণের মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন, সে জন্যে তাঁকেও ছলনার দ্বারা অল্পক্ষণের জন্য নরকদর্শন করানো হল।[৮] আগেই বলেছি, দ্রোণের মৃত্যু ঘটানো ছাড়াও যুধিষ্ঠিরের অন্য পাপ ছিল, কিন্তু শুধু এইটিরই উল্লেখ করা হল, এই পাপেই নাকি তাঁকে স্বল্পকাল নরকে থাকতে হয়েছিল। নরকদর্শনের মধ্যে তাঁর নৈতিক স্খলনের স্বীকৃতি আছে নাকি এটা মিথ্যাবচনের দ্বারা দ্রোণবধের প্রায়শ্চিত্ত? এখানে কার্যকারণের অসামঞ্জস্য পাঠককে উদ্বেলিত করে: যুধিষ্ঠির ভাইদের দেখতে চেয়েছিলেন বলে তাঁকে নরকে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি পৌঁছনোমাত্রই নরকবাসীদের সব যন্ত্রণার অবসান ঘটল, নারকীয় পরিবেশ লুপ্ত হয়ে মনোরম, উপভোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি হল। তা হলে যুধিষ্ঠির এক মুহূর্তের জন্যেও কিন্তু নরকভোগ করলেন না, যদিও মিথ্যাভাষণের দ্বারা আচার্যের মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন, ‘ব্যসন’ বলে বর্ণিত জুয়া খেলেছিলেন— নিজের অপটুতা ও পরাজয়ের সম্ভাবনা জেনেও। এবং বাজি রেখে খেলে হারলেন যে সম্পত্তি তা তাঁর একার নয়, ভাইদের বাজি রাখার অধিকার যুধিষ্ঠিরের ছিল না। কারণ তাঁরাও দ্রৌপদীর স্বামী, দ্রৌপদীকে বাজি রেখে হারবার অধিকার ছিল না, কারণ দ্রৌপদী অন্য ভাইদেরও স্ত্রী— এত সব পাপের জন্য কী প্রায়শ্চিত্ত? নরকদর্শন, যে নরক তাঁর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই নরকত্ব থেকে মুক্ত হল। মুহূর্তকাল, দূর থেকে শুধু নরক দেখাতেই এত পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল? এ কেমন নৈতিক বিচার? পাঠক বিমূঢ় বোধ করেন। একটিমাত্র সমাধানে ঠেকে সব জিজ্ঞাসা: যুধিষ্ঠির মানবিক নীতির মানদণ্ডে বড় মাপের মানুষ ছিলেন। যুদ্ধ এবং যুদ্ধের অনিবার্য মনোভাব যে জিঘাংসা এবং তার অনিবার্য পরিণতি যে লোকক্ষয়, বিশেষত যারা মরবে তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সৈন্যই সিংহাসনকামী নয়— এই সব নিয়ে নিরন্তর মর্মপীড়ায় দগ্ধ হয়েছেন যুধিষ্ঠির। সেই যন্ত্রাণাতেই জীবৎকালেই তাঁর বহু পাপ ক্ষালন হয়েছিল। তাই যন্ত্রণার নরকেই তিনি আন্তর শুচিতায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং সেই কারণেই নরক তাঁর স্থান নয়।

স্বর্গ-নরক পাপ-পুণ্য নিয়ে এই অতি দুরূহ জটিল বোধ রামায়ণে কুত্রাপি নেই। সেখানে কর্তব্য অকর্তব্য অধিকাংশ স্থলেই সরলরৈখিক। যেখানে নয়, যেমন বালীকে ও শম্বুককে বধ করা এবং বারবার সীতা পরিত্যাগ, সেখানে রামচন্দ্রের যন্ত্রণা নেই— একেবারে শেষে বিচ্ছেদবোধ ছাড়া, এবং সেটাও দাম্পত্য আবেগপ্রসূত, কোনও গভীর নীতির সংকট তাঁর নেই। লঙ্কায় সীতা পরিত্যাগের সময়ে রামচন্দ্র যে সব মর্মান্তিক কটুকথা সীতাকে বলেন তার ভূমিকায় ওই অধ্যায়ের শুরুতেই বলা আছে ‘হৃদয়ান্তগর্তং ভাবং প্রবক্তমুপচক্রমে’ অর্থাৎ ওই কটুকথা রামের মনোগত ভাব; দেবতারা সীতার সতীত্ব প্রতিপাদন করবেন জেনে লোকনিন্দার ভয়ে সীতাকে পরীক্ষা করবার ছলে ওই সব বলেননি। সীতা চিতায় দেহত্যাগ করবেন এইটে জেনেও বাধা দেননি— সীতা যে রাবণের অঙ্কশায়িনী হননি এ কথা বিশ্বাসই করতে পারেননি বলে। মনে পড়ে, উত্তরকাণ্ডে রাম অযোধ্যার সিংহাসন ভরতকে দেন, লব-কুশকে নয়; তখনও তা হলে সীতার সতীত্বে পুরো বিশ্বাস আসেনি? আর যুদ্ধ ক্ষেত্র লঙ্কায় তো অযোধ্যার প্রজা কেউ ছিল না, কাজেই প্রজার জ্ঞানের জন্য ওই সব বলেছিলেন এ কথা একেবারেই প্রণিধানযোগ্য নয়। অতএব রামের কাছে নৈতিক সংকট যতবার এসেছে— একমাত্র পিতৃসত্য রক্ষা ছাড়া এবং ভরতের অনুরোধে তা থেকে বিচ্যুত না হওয়া ছাড়া— সর্বত্রই রাম নৈতিক সংকটে অন্যায়কে অবলম্বন করেছেন। এবং কোথাও পাঠকের চিত্ত নৈতিক দ্বিধায় দোলাচল হয় না। রামায়ণের নৈতিক জগৎ সাদাকালোয় বিভাজিত— ধূসর বা দো-রঙা কিছু নেই।

স্বর্গারোহণের শেষ দিকে সব কৌরববীর সেনাপতি ও আচার্যরা স্বর্গে এসে গেছেন। কোনও কারণ দেখানো হয়নি; অল্পকাল স্বর্গবাস ও দীর্ঘকাল নরকবাস তাঁদের প্রাপ্য বলে শোনা গিয়েছিল আগে, কিন্তু কার্যত দীর্ঘকাল নরকবাস তাঁদের করতে হয় না। কেন, তা বলা হয়নি। মনে হয়, বীর হিসেবে তাঁদের অম্লান কল্পমূর্তি পাণ্ডবদেরও ওপরে; কারণ কৌরব সেনাপতিরা পাণ্ডবদের কুচক্রে অন্যায় যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এইখানে কৌরবদের একটা নৈতিক জিৎ রয়ে গেল, যা পাণ্ডবরা অর্জন করতে পারেননি। কৃষ্ণের পরামর্শে উদ্যোগপর্বে উভয়পক্ষে স্বীকৃত শর্তগুলি পাণ্ডবরা নির্বিচারে পদদলিত করেছেন। কৌরবরা যুদ্ধকালে সে রকম অন্যায় করেননি। অভিমন্যুবধের উল্টোদিকে ঘটোৎকচ বধ আছে। কোনও একটা জায়গায় কৌরবরা বীরধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হননি বলে বীরের স্বর্গ থেকে তাঁদের বিচ্যুত হতে হয়নি। হিসেবটি খুবই সূক্ষ্ম, বহুমুখীন এবং বহুধাব্যাপ্ত। ভাবতে হয়, মননে, সংবেদনে স্থির হয়ে গ্রহণ করতে হয়; না হলে আপাত বৈষম্য দুর্লঙ্ঘ্য থেকে যায়। এত আয়াস কোনও রামায়ণ-পাঠককে করতে হয় না।

শেষ অংশে দু’বার বলা হয়েছে: ‘রাজাদের নরক দর্শন করতেই হয়’;[৯] কোনও কারণ দেখানো হয়নি। প্রশ্নটার বোধহয় দুটো সমাধান আছে। প্রথমত, রাজা বিজিগীষু বা বিজয়কামী হলে যুদ্ধ করতেই হবে, এবং রাজ্য-বিস্তারের জন্যে যে যুদ্ধ, তাতে নিরপরাধের বিরুদ্ধেই যুদ্ধযাত্রা এবং নিরপরাধের প্রাণহানি অনিবার্য; সে পাপ রাজাকে স্পর্শ করেই। আর রাজা যদি বিজিগীষু নাও হন, তবু শাসন করতে গেলেই দণ্ড বিধান করতেই হয় এবং তার মধ্যে নিরাপরাধের দণ্ডিত হওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকে। যদি অপরাধীরই দণ্ডবিধান হয়, তবু তার মধ্যে কিছু নিষ্ঠুরতা থাকেই, সে পাপও রাজাকে স্পর্শ করে। এ ছাড়া চরবৃত্তির ছলনা, প্রয়োজনে নিরপরাধকে প্রতারণা করে ইষ্টসিদ্ধি করা এ সবের পাপও আছে। এ সব বোঝা গেলেও প্রশ্ন থাকে যে, এ ধরনের আচরণ তো অর্থনীতি ও রাজনীতি-সম্মত, এতে পাপ কোথায় যে রাজাকে নীতিসঙ্গত আচরণ করেও নরকদর্শন করতে হবে? আবার তাই মহাভারতের ভিত্তিভূমি যে নীতিসংকট, ধর্মসংকট সেইখানেই পৌঁছে যেতে হল। এ সংকট রাজধর্মের সঙ্গে মানবধর্মের। ব্যবহারিক জগতে এর কোনও সমাধান নেই; তাই একটা কল্পিত চূড়ান্ত রায় দেওয়া হল: একটা ধর্মের নীতির সঙ্গে অন্য ধর্ম বা নীতির সংঘাতে শেষ পর্যন্ত মহত্তর নীতির পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার। তাই অপেক্ষিত ক্ষত্রিয়ধর্মে রাজধর্ম পালন করেও মানুষ শেষ মানবিক বিচারে দণ্ডিত হতে পারে। এ সবের উপস্থাপনা ওই মানবধর্মের চূড়ান্ত জয় ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে। মহাভারতে এ উদ্দেশ্য যতটা ঊর্ধ্বে অধিষ্ঠিত, তার জয়ের স্থাপনাও ততটাই ঊর্ধ্বে। এবং এ-তত্ত্বকে প্রণিধান করতে গেলে বহু অভ্যস্ত নীতির স্তর পেরিয়ে যেতে হয়। এই কারণেই পাঠকের কাছে মহাভারতের দাবি এত বেশি জটিল, এত মর্মযন্ত্রণায় তার উপলব্ধি; শুধু মাত্র বোধে নয়, বোধিতে। সহজেই অনুমান করা যায়, এই আয়াস-সাধ্য জীবনবোধের অন্বেষা সাধারণ পাঠককে বিভ্রান্ত করবে, নিরুৎসুক করবে; ফলে মহাভারতে সাড়া দেওয়া তার পক্ষে দুঃখসাধ্য হয়ে উঠবে কাজেই, জনপ্রিয়তার ভিত্তি এখানে নেই। অনেক সহজে সাড়া দেওয়া যায় রামায়ণে— পাঠককে তা ব্যাকুল, মর্মপীড়াগ্রস্ত বা বিমূঢ় করে না। তাই বলা হয়েছে ‘রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যম্’, রামের মতো আচরণ করতে হবে। সেখানে মহাভারত বলছে, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কেউ নেই, এবং এই সুদীর্ঘ মহাকাব্যটি জুড়ে সেই মানুষের সংজ্ঞানিরূপণ করা হয়েছে, নৈতিক মূল্যবোধের সংঘাতের মধ্যে দিয়ে।

***

১. মৌষলপর্ব; (৫:২২-২৫)

২. মহাপ্রস্থানিকপর্ব; (১:৩,৪)

৩. মহাপ্রস্থানিকপর্ব; (১:১২, ১৩)

৪. মহাপ্রস্থানিকপর্ব; (১:৪০)

৫. মহাপ্রস্থানিক (৩:৩৫, ৩৬)

৬. স্বর্গারোহণপর্ব; ৫:৫ অধ্যায়

৭. মহাপ্রস্থানিকপর্ব; (৩:১৪)

৮. স্বর্গারোহণপর্ব; (৩:৩৯, ৪০)

৯. স্বর্গারোহণপর্ব; (৪:১)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *