০৪. মহাভারতে নৈতিক অভিঘাত

মহাভারতে নৈতিক অভিঘাত

ছোটখাট উপাখ্যানের মতোই মহাভারতের কাহিনিতে বৃত্তের কেন্দ্রীয় উপজীব্যেও এবং কাহিনির তাৎপর্যে সাড়া দেওয়া, রামায়ণের সরলরৈখিক কাহিনিতে সাড়া দেওয়ার চেয়ে কঠিন। রামায়ণের কলেবর মহাভারতের এক-চতুর্থাংশ, এই কারণে রামায়ণে ঘটনার পারম্পর্য মনে রাখাও অনেক সহজ। মহাভারতের ঘটনার বিস্তৃতি ও জটিলতা, চরিত্রের সংখ্যা ও পরস্পরের সংঘাত— এ সবই এ-কাব্যের দুরূহতার কারণ। কিন্তু মূল দুরূহতা এর নৈতিক অভিঘাতে পাঠকের সাড়া দেওয়ার সমস্যায়। উদ্যোগ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, সৌপ্তিক ও স্ত্রী— এই ক’টি পর্বেই মূলত যুদ্ধকাণ্ড বিবৃত হয়েছে। উদ্যোগ পর্বে দু’ পক্ষই কতকগুলি যুদ্ধের শর্ত স্বীকার করে নেন: শত্রুকে পিঠের দিকে আঘাত করা চলবে না; অধোনাভি আঘাত করা চলবে না; যে শত্রু ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম চাইছে বা কোনও কারণে সময় চাইছে তাকে সময় দিতে হবে— এমনকী প্রয়োজনে সাহায্যও করতে হবে। সূর্যাস্তের পরে যুদ্ধ করা যাবে না এবং নারী বা শিশুকে আঘাত করা অশাস্ত্রীয়।[১] এই সব শর্ত করার পরে দু’পক্ষের প্রস্তুতি— অস্ত্রশস্ত্র, সেনাপতি নিরূপণ, আগত রাজা ও সৈন্যদলের কর্তব্য নির্ধারণ, ব্যূহরচনা, যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে দু’পক্ষে গোপন মন্ত্রণা। তার পর যুদ্ধের নির্দিষ্ট দিনে ঊষাকালে কৌরবের অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্য সমাবেশ। পাণ্ডবদের অনুগত রাজা, রাজন্য ও সৈন্যদলকে যুদ্ধের জন্যে ব্যূহবদ্ধ করা।

সব আয়োজন শেষ, এখন যুদ্ধ আরম্ভের সূচনা করবে যে-শঙ্খধ্বনিটি শুধু তারই প্রতীক্ষা। নাটকীয় প্রতীক্ষার মূহূর্তে। ঠিক সেই সময়ে দেখা গেল, জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির পাণ্ডব-শ্রেণি ছেড়ে ছুটে গিয়ে একে একে কৌরবপক্ষে দণ্ডায়মান বয়োবৃদ্ধ, যশোবৃদ্ধ আচার্য ও সেনাপতিদের পায়ে পড়ছেন, বলছেন, ‘যেমন করে হোক, এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধ করুন। এ ঘটতে দেওয়া অন্যায়, আপনারা থামান এ যুদ্ধ।’ কী বললেন কুরুপক্ষীয় যশস্বী, বর্ষীয়ান, তেজস্বী আচার্য ও সেনাপতিরা? ‘অর্থস্য পুরুষো দাসো দাসস্তর্থো ন কস্যচিৎ। ইতি সত্যং মহারাজ বদ্ধো্যস্মর্থেন কৌরবেঃ।।— পুরুষ অর্থের দাস: অর্থ কারও দাস নয়। আমরা কৌরবদের কাছে অর্থের দ্বারা বদ্ধ, অতএব, ক্লীবের মত বলছি, যুদ্ধবিরতি ছাড়া আর কোনও প্রার্থনীয় থাকে তো বল।[২]

এই নাটকীয় ঘটনায় প্রশ্ন ও উত্তর দুটিই এমন জটিল যে সহজে কোনও সাড়া জাগে না। কেন? ছুটে যাচ্ছেন কে? পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, বিধিমতে কুরুরাজ্যের সিংহাসনে যাঁর জ্যেষ্ঠাধিকার। এর আগে পাঁচটি গ্রামের বিনিময়ে তাঁর হয়ে সে-অধিকার ছাড়তে প্রস্তুত ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে জানানো এবং দীন ভাবে আজ তাঁর এই শান্তিভিক্ষা, এ দুটোই তাঁর পক্ষে ধর্মত্যাগ। প্রাচীন ভারতবর্ষে ধর্মের দুটো সমাজস্বীকৃত সংজ্ঞা ছিল: বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম। বর্ণধর্মের নিরিখে ক্ষত্রিয় যুধিষ্ঠিরের কর্তব্য তাঁর ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্যে এ যুদ্ধ করা। আশ্রমধর্মের নিরিখে তিনি গার্হস্থ্যাশ্রমে ছিলেন। সে আশ্রমে ধর্ম, অর্থ এবং কাম তাঁর লক্ষ্য এবং সাধনের বিষয়। এ দুই দিক থেকেই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যা করলেন তা অধার্মিক। পাঠক শ্রোতা তাঁর মধ্যে ক্ষত্রিয়োচিত ও পুরুষোচিত দৃঢ়তার অভাব দেখে, এ ব্যাপারে অসহিষ্ণু বোধ করে। অতএব পাঠকের এ প্রতিক্রিয়া যথার্থই বিধিসঙ্গত।

তবে যুধিষ্ঠির এমন কাজ করলেন কেন? তিনি কাপুরুষ, অশাস্ত্রজ্ঞ বা মূর্খ তো ছিলেন না। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের যে আন্তর অশান্তি তাঁকে পাঁচটি গ্রামের বিনিময়ে কুরুসিংহাসনে অধিকার ত্যাগ করতে প্ররোচনা দিয়েছিল, সেই অশান্তি, অস্থৈর্য ও অনিশ্চিত-বোধই তাঁকে এ-কাজে প্রবৃত্ত করেছিল। স্বজনঘাতী যুদ্ধের বিনিময়ে কুরুসিংহাসনও তাঁর কাম্য মনে হয়নি, কারণ ক্ষত্রিয় ধর্মের চেয়েও তাঁকে অনুপ্রাণিত করছিল মানবধর্ম। যে কোনও কারণেই হোক, হিংসা, নরহত্যা, ভ্রাতৃ-রক্তপাত তাঁর কাছে নিতান্ত ঘৃণ্য ও গর্হিত মনে হচ্ছিল। আরও বেশি এই কারণে যে, এই মূল্যে সিংহাসনের অধিকার লাভ করার চেষ্টা তাঁর কাছে অমানবিক মনে হয়েছিল। অর্থাৎ ক্ষত্রিয়কৃত্যের চেয়ে মানবধর্মকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেই এত দীন ভাবে গুরুজনদের পায়ে পড়ে যুদ্ধ ও ভ্রাতৃহত্যা নিবারণ করবার চেষ্টা করলেন।

এটাই কিন্তু সাধারণ পাঠক বা শ্রোতার কাছে প্রত্যাশিত ছিল যে, তিনি শঙ্খধ্বনি শুনে ক্ষত্রিয়দর্পে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ শুরু করবেন, কেননা তাঁর পক্ষে এটি ধর্মযুদ্ধ। অতএব তাঁর আচরণ সমর্থন করা দূরে থাক, পাঠকের কাছে এটা ভীরু কাপুরুষতার মতোই ঠেকে; তাদের তিনি হতাশ করেন। আর মহারথী আচার্যরা কী বললেন? অমানবিক ভ্রাতৃঘাতী এই যুদ্ধ বন্ধ করবার কোনও সাধ্য তাঁদের নেই, কারণ তাঁরা কৌরবপক্ষের কাছে অর্থের দাস, অর্থ কারও দাস নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্যে মহারথীরা ভিন্ন ভিন্ন কারণে কৌরবপক্ষ সমর্থন ও আশ্রয় করেছেন, কৌরবরা অন্যায় যুদ্ধের প্রবর্তন করছেন জেনেও। এই সব আচার্য কৌরব, পাণ্ডব উভয় পক্ষেরই শ্রদ্ধেয়, গুরু বা গুরুকল্প। যুধিষ্ঠিরের মতোই সাধারণ পাঠকও তাঁদের কাছে জীবনের উন্নততর মূল্যবোধ প্রত্যাশা করে। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা স্বীকার করলেন তাঁরা

কৌরবদের অন্নদাস, অতএব, ‘ক্লীবের মত কথা বলেছেন’। যুদ্ধ থামাবার নৈতিক অধিকার তাঁরা খুইয়ে বসে আছেন— অর্থের জন্যে কৌরবদের আশ্রয় গ্রহণ করে। আজ তাঁরা ন্যায়-অন্যায় যথাযথ ভাবে বুঝেও অন্ন-ঋণ অস্বীকার করতে পারেন না। বিদ্যায় জ্ঞানে সমৃদ্ধ এই আচার্যরা জীবনে মহৎ আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে অন্যায় পক্ষে থেকে অগৌরবের মৃত্যু বরণ করলেন। এর করুণ দিকটি শ্রোতাদের স্পর্শ করে; সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধের বহুমুখীনতার সামনে এসে হতবাক বোধ করেন তাঁরা। এ কেমন আচার্য? মাথা উঁচু করে যাঁদের দিকে তাকানোর কথা, তাঁদের উক্তিতে কী অপরিসীম দৈন্য। ন্যায়নীতি, আত্মমর্যাদাবোধ আচার্য-পদের গরিমা সবই ধূলিলুণ্ঠিত হল, একদিন অর্থের জন্যে কৌরবপক্ষ অবলম্বন করেছিলেন বলে। স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে কী মর্মান্তিক দুঃখেই না সে ভুলের মূল্য শোধ করতে হয়। শ্রদ্ধেয় আচার্যদের মুখে এই অশ্রদ্ধেয় স্বীকারোক্তি পাঠককে নৈতিক মূল্যবোধের সংঘর্ষের মুখোমুখি নিয়ে আসে: আচার্য বলে শ্রদ্ধা করবে, না, স্বার্থবুদ্ধিতে মনুষ্যত্বের মর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে তাঁরা আজ ‘ক্লীবের মত কথা বলছেন’ বলে ঘৃণা করবে? যুগপৎ দুটোই অর্থবহ এবং সে কারণে পাঠকের প্রতিক্রিয়া দ্বিধান্বিত ও সংশয়াকুল হয়ে ওঠে।

যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে, এমন সময়ে অর্জুন বেঁকে বসলেন: স্বজনের রক্তের পথ বেয়ে তিনি সিংহাসনের অধিকার চান না। এখানেও ক্ষত্রিয় বর্ণধর্ম এবং তারও ওপরে যার স্থান নেই মানবধর্মের সংঘাত। এ দুটি ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূল্যবোধকে প্রতিহত, পরাস্ত করছে মহাভারতের ও কিছু পূর্বকালের বৌদ্ধ মূল্যবোধের অহিংসা-নীতি। ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধেও অহিংসা পরম ধর্মরূপে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে সত্য, কিন্তু যেখানে বৈদিক ধর্মাচরণে পশুবধ আবশ্যিক, সেখানে হিংসা ত ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গরূপেই থেকে গেছে। এর ঊর্ধ্বে কোনও বিশুদ্ধ মানবিক মৈত্রী, সর্বজীবে দয়া ও অহিংসার নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়েই বর্ণধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন কি যুধিষ্ঠির ও অর্জুন? খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম ষষ্ঠ শতক থেকে জৈন-বৌদ্ধ-আজীবিক ও অমনই বিস্তর বেদপ্রতিবাদী প্রস্থানের প্রভাবে আর্যাবর্তে যে নতুন বাতাস বইছিল, তার মধ্যে অহিংসা প্রবল ভাবে দেখা দেয়। মহাভারত রচনা শুরু হয় সেই সময় যখন এই অহিংসাবাদ বৈদিক ধর্মাচরণকে অস্বীকার করছে যখন; মানবমৈত্রী ও করুণা বিকল্প ধর্মাচরণে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে। কাজেই তখনকার মহাকাব্যের নায়ক হিংসাকে বর্জন করে ঊর্ধ্বতন এক আদর্শকে বরণ করবেন, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। পাঠক ও শ্রোতা কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করেন, কারণ বর্ণধর্ম তো সমাজ-অনুমোদিত ধর্ম এবং সেই কারণে অবশ্য-পালনীয়। ক্ষত্রিয় যখন স্বধর্ম পালন করতে পরাঙ্মুখ হল, তখন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ও বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের কাছে প্রত্যাশিত আচরণ না পেয়ে পাঠকের চিরাভ্যস্ত হিসেবে গোলমাল হয়ে যায়। এবং তখন এ কাব্যে সাড়া দেওয়ার জন্যে পাঠককে নতুন করে, স্বতন্ত্র ভাবে ভাবতে হয়। এই ভাবে ভাবতে বাধ্য করে যে কাব্য, তা নিয়ে পাঠকের স্বস্তি থাকে না। রামায়ণ দু-একটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া তাকে ভাবায় না; বরং গল্প বলে, প্রচলিত মূল্যবোধগুলিই পুনর্বার পরিবেশন করে, মনোরম বর্ণনায় তাকে মুগ্ধ করে। যা সে জীবনের ধ্রুব সত্য বলে বিশ্বাস করে এসেছে পারিবারিক সম্পর্কগুলি সম্বন্ধে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে, তাকেই সে পাচ্ছে বারে বারে নতুন নতুন উপাখ্যানের পরিবেশে। কোথাও ধাক্কা লাগছে না, বরং তার অভ্যস্ত বিশ্বাসভূমির ওপরে দাঁড়িয়েই নবতর ভূমিকায় সে-বিশ্বাসের সমর্থন পেয়ে সে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরতে পারছে তার পুরনো অভ্যস্ত বিশ্বাসগুলিকে। এতে আছে স্বস্তি, যার থেকে আসে কাব্যের জনপ্রিয়তা।

অর্জুনের প্রশ্ন ছিল সারথি কৃষ্ণের কাছে: যাদের জন্যে লোকে বেঁচে থাকতে চায়, সেই অতিপ্রিয় আত্মীয়দেরই হত্যা করে, যে-বিজয়, যে-কীর্তি, যে-রাজ্য, তা আমি চাই না। মূলত এটা যুধিষ্ঠিরের বিবেকদংশনেরই নতুন এক উচ্চারণ। কোনও আচার্যের কাছে নয়, স্বয়ং কৃষ্ণের কাছে। যুধিষ্ঠিরকে কৃপ, দ্রোণ, ভীষ্মরা যা বলেছিলেন তার মধ্যে ছিল ব্যক্তিগত আত্মগ্লানি, মূল্যবোধের প্রতারণা। কৃষ্ণ অর্জুনকে যা বললেন তা সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর:

‘তুমি যাদের মারবে তাদের কর্ম তাদের আগেই মেরে রেখেছে, তুমি নিমিত্তমাত্র হও, সব্যসাচী। এ তো সত্য যে, ‘জন্মিলে মরিতে হবে’। তা ছাড়া, কেউই ত আসলে মরে না, শস্যের মতো ক্ষণিক মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আবার উজ্জীবিত হয়। এদের তো তুমি কোনও ফল লাভের আশায় মারছ না; নিষ্কাম ভাবে ফলপ্রত্যাশা ত্যাগ করে তোমার ক্ষত্রিয়োচিত কর্ম তুমি কর।’

এ ছাড়াও দীর্ঘক্ষণ ধরে কৃষ্ণ অর্জুনকে নানা দার্শনিক যুক্তি দিলেন— প্রক্ষিপ্ত অংশে এর দৈর্ঘ্য আঠারো অধ্যায়। সত্যকার যুদ্ধের প্রাক্কালে দু’পক্ষ একক কৃষ্ণের উপদেশ অতক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনেছিল এটা অবাস্তব। যাই হোক, কিছু অংশও যদি বলে থাকেন ওই মর্মে, তা হলে তার প্রত্যেকটারই উত্তর ছিল: শত্রুর কর্মই যদি তাকে আগে থেকে মেরে রেখে থাকে, তা হলে অর্জুন তাকে পুনর্বার হত্যা কেন করবেন? বিশেষত, তার এবং শত্রুর কাছে যখন এটা বাস্তব মৃত্যুরই রূপ নেবে। স্বজনহত্যার মতো এমন নিষ্ঠুর কর্মে ‘নিমিত্তই বা হবেন কেন? শস্যের মতো শত্রু যদি পুনর্জাত হয়, সে তার নির্দিষ্ট পরমায়ুর শেষে শয্যায় প্রাণত্যাগ করুক না কেন? যুদ্ধে অস্ত্রাঘাতে তাকে হনন করা কেন? সবচেয়ে বড় কথা, যুদ্ধটা তো মোটেই নিষ্কাম নয়— সিংহাসনটা কৌরবরা পাবে না পাণ্ডবরা, লড়াই তাই নিয়েই; অতএব উভয়তই এটা সকাম। অর্জুন মনের মধ্যে নিষ্কাম হলে তো এ যুদ্ধ থেকে তাঁর সরে থাকাই উচিত, যেমন ছিলেন বলরাম। এ ছাড়া আরও অনেক যুক্তিগত, তত্ত্বগত ফাঁক আছে, তার আলোচনা অন্যত্র করেছি।[৪] এখানে লক্ষ্য করতে হবে, পাঠকের প্রতিক্রিয়া: অর্জুনের অত্যন্ত মর্মান্তিক যুক্তি ও মানবিক জুগুপ্সাতে সকলে সাড়া দিতে পারে; আবার জুগুপ্সা ক্ষত্রিয়োচিত নয় বলে পাঠকের মনে এতেও দ্বিধার উদয় হয়। গীতায় অর্জুন শ্রোতা, কিন্তু তাঁর দ্বিধার শেষ নিরসনটা কৃষ্ণ যুক্তি দিয়ে করতে পারেননি, অধ্যায়ের পর অধ্যায় ভিন্ন ভিন্ন দর্শন প্রস্থান উপস্থাপিত করেও বুঝলেন, অর্জুনের প্রথম আত্যন্তিক ব্যাকুলতা ঘোচেনি। তখন কৃষ্ণ জাদুর অবতারণা করলেন। অর্জুন দেখতে পেলেন কৃষ্ণ তাঁর বিশ্বজাগতিক রূপে প্রকাশিত।[৫] এ অংশটা অতিলৌকিক; বর্ণনা যতই চিত্তগ্রাহী হোক না কেন, এটার সাহিত্যিক চরিত্র কিন্তু রূপকথাধর্মী এবং সাধারণ পাঠকের সাধারণ দ্বিধাসংশয় এতে উড়িয়েই দেওয়া হল। ক্ষত্রিয়ের বর্ণধর্ম অনুসারে আচরণ করতে যিনি বলছেন তিনি স্বয়ং কৃষ্ণ; যুক্তিতে যতই ফাঁক থাক, বক্তাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। কাজেই অর্জুন যুক্তির উত্তরে পেলেন জাদু এবং স্তম্ভিত হয়ে কৃষ্ণের বশ্যতা স্বীকার করলেন। পাঠক ভেবে দেখে না যুক্তির স্তরে প্রতিযুক্তি কতটা নিশ্ছিদ্র। নির্বাক বিস্ময়ে জাদুতে বিমূঢ় হয়ে উদ্যত সংশয়কে নিরস্ত করে। এই কৌশল রামায়ণেও বারবার দেখেছি: লৌকিক সংকটের সমাধান অতিলৌকিকে। সেখানেই রূপকথাধর্মী রামায়ণের জনপ্রিয়তার একটি সূত্র; গীতার জনপ্রিয়তারও, অন্তত এর শেষাংশের।

***

১. উদ্যোগপর্ব; (১৪৪:১১-১৪)

২. ভীষ্মপর্ব; (১:২৯-৩২)

৩. ভীষ্মপর্ব; (৪১:৩৬-৭, ৫১-২, ৬৬-৭, ৭৭-৮)

৪. আমার ‘গীতা নিয়ে প্রশ্ন’ রচনা দ্রষ্টব্য

৫. ভীষ্মপর্ব; (৩৩:৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *