সংশয় ও নাস্তিক্যের ধারা
এ সব সত্ত্বেও মৃত্যুর পরে কিছু থাকে অথবা থাকে না–এই দুরকম লোকপ্রতীতিকে অবলম্বন করে প্রশ্ন এসেছিল; এ ছাড়াও জিজ্ঞাসা ছিল বুদ্ধির স্তর থেকে। উত্তর যখন এল তা ব্রহ্মা এবং আত্মা সম্বন্ধে নানা আচার্যের নানা মতের সমাহার হিসেবেই, এবং সেগুলি যেহেতু বিভিন্ন মানুষের সমাধান বা প্রত্যয়, তাই পরস্পরের মধ্যে কোনও সংহতি ছিল না। যুক্তির স্তরে সংগতিও ছিল না। এটা উপনিষদের সমস্ত স্তরের সমস্ত আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। এক তো বিভিন্ন উপনিষদ বিভিন্ন লোকের রচনা, এবং তাঁরা যে যার প্রত্যয় বা উপলব্ধি অনুসারে তত্ত্ব উপস্থাপিত করেছেন। বস্তুত সংগতিপূর্ণ উত্তর দেওয়ার বা পরস্পরের মতের সমর্থন করার তাদের কোনও দায় ছিল না। এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হল উপনিষদে সৃষ্টিতত্ত্ব:
‘তিনি একাকী ছিলেন তাই আনন্দ পাননি, দ্বিতীয়কে সৃষ্টি করে তার সঙ্গে মিলিত হলেন, তখন সৃষ্টি করলেন।. …প্রথমে শুধু জলই ছিল, তার মধ্যে বীজ নিক্ষেপ করলেন, তাই থেকে সৃষ্টি হল।…. তিনি নিজেকে দ্বিদল বীজের মতো দু’ভাগ করলেন এবং দুই অংশ মিলে সৃষ্টি করলেন।’
এমনই বহু ধরনের কথা। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে মানুষের দীর্ঘকালের প্রশ্ন ও কৌতুহল নিয়ে আচাৰ্যরা নিজের নিজের উপলব্ধি দিয়ে উত্তর দিচ্ছেন। স্বভাবতই সেগুলির মধ্যে কোনও সংহতি নেই। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কালে যে সব সৃষ্টিতত্ত্ব উদ্ভাবিত হচ্ছে সেগুলিই বিধৃত আছে উপনিষদের বিভিন্ন অংশে। যেহেতু এই আচাৰ্যরা দাবি করেননি যে তাঁর উপলব্ধিটাই একমাত্র সত্য অথবা অন্যদের উপলব্ধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ তত্ত্বই তিনি উপস্থাপিত করবেনতাই স্বাভাবিক ভাবেই বৈচিত্র্য ও পার্থক্য রয়ে গেছে। অনেকটা অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো; খণ্ড-খণ্ড ভাবে হাতির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যারা দ্যাখে তারা কেউই ভুল দ্যাখে না, আবার কেউই সম্পূর্ণদ্যাখে না। প্রশ্নকারীরা বিভিন্ন সমাধানের মধ্যে যেটি তাদের রুচিসম্মত বা অভিপ্রেত সেটিই মেনে নেয়, বিসংবাদের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। উপনিষদে কেউ সার্বিক সংগতি বা মতৈক্য প্রত্যাশাও করেনি, তার অভাব নিয়ে বিচলিতও হয়নি।
আবার পরে বিভিন্ন দর্শনপ্রস্থানগুলি যখন নির্মিত হচ্ছিল তখন খোঁজ পড়ল সংহতির: বহির্বিশ্ব, জড়াজগৎ, জীবজগৎ, শরীর, আত্মা, পরলোক এসব নিয়ে দ্বিধাহীন ঐকমত্যের দাবি উঠল। উপনিষদে তা ছিল না বলে শুরু হল টীকাভাষ্যের, এবং তা চলল প্ৰায় পৌনে দু-হাজার বছর ধরে। দেড় হাজার বছর পরে শংকরাচার্য তার প্রস্থানত্রয়ে ওই ঐকমত্য দেখাবার জন্যে বিস্তর কসরত করলেন। অসম্ভব বিদ্বান ও বুদ্ধিমান এবং গভীর শাস্ত্রজ্ঞানের অধিকারী শংকর নানা রকম ভাবে ভাষ্য নির্মাণ করে একটি সংহতিপূর্ণ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন; এটিই অদ্বৈত বেদান্ত। উপনিষদ থেকে সমস্ত শাস্ত্রসস্তারকে ব্যবহার করলেনতার মতের পরিপোষক শাস্ত্র হিসাবে দেখাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যাপারটা ওইখানেই থামল না; শুদ্ধাদ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, ইত্যাদি নানা শাখায় ও মতভেদে এর পরিবর্তিত ও বিবর্তিত সংস্করণ নির্মিত হয়ে চলল। কিন্তু যে-কথা আমাদের প্রতিপাদ্য তা হল, উপনিষদে অধিকাংশ স্থলেই প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের যুক্তিগত সংগতি নেই, এবং মনে হয়, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথাও ছিল না; তখনকার সমাজে চিন্তাশীল মানসজগতে সঞ্চারমাণ অন্যান্য বহু প্রশ্নের আংশিক উত্তর বা উত্তরকল্প আলোচনাতেই লোকে সন্তুষ্ট থাকত। নচিকেতার প্রশ্ন, মৃত্যুর পরে কিছু থাকে কি না, এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে যম বলতে লাগলেন পিতৃযান-দেবযান— যার মধ্যে অবশ্য প্রচ্ছন্ন আছে উত্তর: থাকে, আত্মা মৃত্যুর পরেও থাকে। এ জীবনে ঠিক মতো আচরণ করলে তার মরণোত্তর গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ আত্মা সম্বন্ধে কয়েকটি মাত্র ইতিবাচক লক্ষণ জানা যায়: এইন্দ্ৰিয়-বহির্ভূত, এর মাপ বুড়ো আঙুলের পরিমাণ, মৃত্যুকালে এটি মাথার ব্রহ্মরন্ধ ভেদ করে বিনির্গত হয় এবং কর্ম অনুসারে বিভিন্ন পথে হয় জন্মান্তর নয় মোক্ষাপ্রাপ্ত হয়। একে না বিশ্বাস করলে মানুষের অধোগতি হয় এবং দেবতাদের ঊর্ধ্বের্ব পরামলোকে এর শেষ পরিণতি। স্পষ্টতই, এ সব তত্ত্ব সাধারণ লোক কেবলমাত্র আবছা ভাবেই অবধারণ করতে পারত, এবং যেহেতু তাদের কাছে জীবনসংগ্রামটা কঠিনতর বাস্তব ছিল, তাই তারা এ সব প্রণিধান করে বোঝবার চেষ্টা করার অবকাশ পেত না। এই সময়ের কিছু পরে কর্মবাদ বিবৃত হলে সাধারণ মানুষ জন্মান্তর থেকে ছুটি পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠল এবং তাদের বোঝানো হল উচ্চত্রিবর্ণের নিঃশর্ত পদসেবা করাই তাদের পরকালের উন্নতির একমাত্র পন্থা।
নচিকেতার প্রশ্নের উত্তরে যম শুধু মৃত্যুর পর আত্মা থাকে। তাই বলছেন না, সাধারণ মানুষের আর-একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিচ্ছেন: আত্মার জন্মান্তর হয়। ঠিক পথে জীবনযাপন না করলে বারে বারেই জন্মাতে হয়–পিতৃযানের পথে। আর যথার্থ জ্ঞানের উদয় হলে আত্মব্রিহ্মের একত্বের বোধ জন্মালে পুনর্জন্ম থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় ও ব্রহ্মো লীন হয়ে মোক্ষ লাভ করা যায়। র্যাকে জেনে মুক্ত হয় ও অমৃতত্ব প্রাপ্ত হয়–যং জ্ঞাত্বা মুচ্যতে জন্তুর মৃত্যুত্বং চ গচ্ছতি।’ (কঠ, ২:৩:৮) তা হলে অমরত্বের পথ হল কোনও সৎকর্ম, সদভিপ্রায়, সদাচরণ, যজ্ঞানুষ্ঠান বা লোকহিতকর কোনও ক্রিয়া নয়–জ্ঞান। এ পথটিও নতুন। আরও একটি জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক ভাবে চলিত প্রশ্ন, নচিকেতা আলাপের শুরুতেই যা উচ্চারণ করেছিল, তার অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন উত্তর দেন যাম; বলেন, ‘পরমাত্মাকে বাক্য দিয়ে জানা যায় না, মন বা চোখ দিয়েও নয়; যারা আত্মা সম্বন্ধে ‘আছে।’ এই কথা বলে, (তাদের এই উপায় ছাড়া) আর কোন ভাবে আত্মাকে জানা যায়?’(১) নচিকেতার বাকি প্রশ্নের উত্তর বাকি রইল: যারা বলে মৃত্যুর পরে কিছু থাকে না তাদের কোনও গতি হয় না, এ-ও এক ধরনের উত্তর যাতে সংশয়ীদের পক্ষে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অথচ বিস্তর সংশয়ী মানুষ সংসারে আছে; সেদিনও অনেকে ছিল; তাদের কী গতি হবে তার কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। অর্থাৎ যম যা বলছেন, মৃত্যুর পর আত্মার অস্তিত্ব, দ্বিবিধ অবস্থান, পুনর্জন্মকে জয় করা, মোক্ষ লাভ করা এ সম্বন্ধে শেষ কথা হল, আত্মা আছে। এটি মেনে নেওয়া। যে-সমাজে বহু মানুষ বলে আত্মা নেই, মৃত্যুর পরে কিছু থাকে না, সেখানে নচিকেতার প্রশ্নের উত্তরে যম একটি ফতোয়া দিলেন। মৃত্যুর পরে আত্মা থাকে, এ কথা স্বীকার করলে তার পরের ধাপগুলোও কিন্তু এল ফতোয়ার চেহারায়। তা হলে সংশয় নিরসনের যে-উপায় উপনিষদ দিয়েছে তা যুক্তিবহ নয়, প্রমাণসহ নয়, যমের অনুজ্ঞামাত্র: ‘আছে’ বলে বিশ্বাস করতে হবে, না হলে মহতী বিনষ্টি। সংশয়ী একটুও টলল না, বিশ্বাসীর তো প্রথম থেকেই কোনও সমস্যাই ছিল না। অর্থাৎ নচিকেতা যে অত তোয়াজ করেছিলেন যমকে, ‘আপনার মতো প্রবক্তা এ বিষয়ে কোথায় পাব আর’ সেটা তত্ত্বত অমূলক। যম যা জানেন’ তা-ই বললেন; যে বিশ্বাস করে তাকে বোঝালেন; যে করে না তাকে কিছুই দিলেন না।
ভাষার দিক থেকে, আলোচনার আঙ্গিকের দিক থেকে ব্রহ্মোদ্যে বা ওই জাতীয় আলোচনায় পাই প্রশ্নোত্তরের পরম্পরা, যা এক জায়গায় এসে থেমে যায়। তখন প্রশ্নকারীকে ধমক খেতে হয়, ‘মাতিপ্ৰাক্ষীঃ’–অতিপ্রশ্ন কোরো না, যা জানিবার নয় তা জানতে চেয়ে না। মনে পড়ে, নচিকেতাকে প্রশ্ন থেকে নিরস্ত করতে গিয়ে যম বলেছিলেন ‘দেবৈরিত্রাপি বিচিকিৎসিতং পুরাঃ’, পুরাকালে এ ব্যাপার (মরণোত্তর সভা) সম্বন্ধে দেবতাদেরও সংশয় ছিল। তাদের সে-সংশয় কী ভাবে কখন গেল, অথবা আন্দীে গেল কি না তার কোনও ইঙ্গিত যম দেননি। বিষয়টির গভীৰ্য বোঝাতে এ ভাবে নচিকেতাকে থামিয়ে দিতে চাইলেন। দেবতাদের মৃত্যু নেই এমন কথাই শাস্ত্ৰে বলে (অমরকোষে আমরা’, ‘নির্জর’ এ সব দেবতার প্রতিশব্দ) তা হলে মৃত্যুর পর কিছু থাকে কি না, এমন প্রশ্ন তারা করবেন কেন? অবশ্য স্বয়ং যম এক সময়ে মানুষ ছিলেন, শাস্ত্র তার বিষয়ে বলে, ‘মর্ত্যদের মধ্যে প্রথম যিনি মারা যান–যো মমার প্রথমে মর্তনাম।’ (অথর্ব ১৮:৩:১৩)। তা হলে মৃত্যুর পর যমের অস্তিত্বই তো নচিকেতার প্রশ্নের উত্তর, অবশ্য তিনি পিতৃযান ও দেবযান দুটি বিকল্পেই বাইরে, কারণ তাঁর পুনর্জন্মও হয় না, মোক্ষও হয়নি। দুটি মাত্র বিকল্প যিনি উপস্থাপিত করেছেন, তিনি নিজে এ দুয়ের বাইরেই রয়ে গেলেন। এ সম্বন্ধে নচিকেতা কোনও প্রশ্নও করলেন না।
সংশয়ের একটা প্রকাশ প্রশ্নে। প্রশ্ন সংহিতা-সাহিত্য থেকেই আছে–যজ্ঞ ও দেবদেবীর বিষয়ে। ব্ৰাহ্মণসাহিত্যে প্রশ্ন যজ্ঞের অনুপুঙ্খ নিয়ে–সংখ্যা, দিক, উপকরণ, প্রণালী নিয়েএ সব প্রশ্নের উত্তর প্রায়ই যুক্তিনিরপেক্ষ, অনুষ্ঠানটিকে রহস্যাবৃত রাখবার চেষ্টা। আরণ্যকে ও উপনিষদে সত্যিকার প্রশ্ন এবং তার উত্তর দেওয়ার ধারা দেখা দিল। এখানেও বহু ক্ষেত্রে প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের কোনও সামঞ্জস্য নেই। কিন্তু যেটা প্রণিধান করবার বিষয়, সেটা হল। তখনকার দেশের বাতাসে সংশয়ের অকুণ্ঠ প্রকাশ, তার নিরসনের চেষ্টা, তর্ক, আলোচনা, ব্রক্ষোদ্য এবং গুরুশিষ্য আলোচনার ও বিতর্কের একটি ধারা প্রবর্তিত হয়। প্রশ্নোপনিষদ তো। ওই নামেই অভিহিত, কিন্তু অন্যান্য উপনিষদেও দেখি জিজ্ঞাসুরা ইতস্তত যাচ্ছেগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রবীণ মনীষীদের সঙ্গে বিতর্কে প্রবৃত্ত হচ্ছে। পুত্র পিতার কাছে, শিষ্য গুরুর কাছে, স্ত্রী স্বামীর কাছে, এক মনীষী অন্য এক মনীষীর কাছে সংশয়ের সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
এই সময়ে বস্তুগত জীবনের ভিত্তিতে নানা পরিবর্তন ঘটে। তার ফলে সমাজমানসের অধিসংগঠনে বহু সংশয় জগতে থাকে এবং উত্তর যথাযথ না পেলেও সংশয় প্রকাশ করতে কুষ্ঠা নেই। আলোচনা ও বিতর্ক সমাজে বিশেষ ভাবে প্রচলিত। কর্মকাণ্ডে যজ্ঞে যে সব ঐহিক সুখের প্রতিশ্রুতি ছিল সেগুলি সম্বন্ধে অনেক জিজ্ঞাসুই বিমুখ। অসংকোচে সংশয় প্রকাশ করা, তর্কে প্রবৃত্ত হওয়া এ যুগের (খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকের) একটি লক্ষণ। আর প্রশ্নই-বা কত। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মানসক্রিয়া, বহির্বিশ্ব, জীবনমৃত্যুপরলোক, দেবতার ভূমিকা, উৎপত্তি, সংখ্যা, জীবনের পরিণাম, লক্ষ্য, নানা বিষয়ে প্রশ্ন এদের মনে জাগাবুক। তা-ও তো আমরা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের–দীন-দুঃখী চাষিমজুর, অন্ত্যজ, প্রাগাৰ্য, নারী ও শূদ্রের বিশিষ্ট সংশয় ও প্রশ্নের কোনও চিহ্নই উপনিষদে পাই না। কিন্তু যা পাই তাতে একটি সজীব মানসিকতার প্রকাশ দেখি। প্রশ্ন-পরম্পরা চলে, পরিণামে কখনও ধিক্কার কখনও-বা পুরস্কার, কিন্তু যে-মনে প্রশ্ন জাগাবুক তাকে সহজে নিরস্ত করা যাচ্ছে না বেশ লক্ষ্য করা যায়।
প্রশ্নোত্তর শিক্ষার একটা স্বীকৃত পদ্ধতিই ছিল। উপনিষদে দেখি ছাত্র ঐহিক থেকে পারমার্থিক নানা বিষয়ে শিখছে গুরুকে প্রশ্ন করে কিংবা আচার্যের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়াসে। অর্থাৎ ততদিনে সংশয় এবং সংশয় থেকে উখিত প্রশ্ন ব্যক্ত করা ও তার সমাধানের জন্য যোগ্য মনীষীর কাছে গিয়ে উত্তর খোজা–এ ব্যাপারটা একটা সমাজসম্মত শিক্ষণপ্রণালী হয়ে গেছে। বহু বারই জিজ্ঞাসুকে তার প্রার্থিত উত্তর দেওয়া হচ্ছে না। বিকল্প কিছু দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আছে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি বার আছে সংশয়ে সম্মুখীন হওয়ার সাহস। এটি সমাজমানসের সুস্থতার একটি লক্ষণ।
সংহিতাব্রাহ্মণে অর্থাৎ যজ্ঞযুগের কর্মকাণ্ডে যে সব প্রশ্ন করা হয়েছিল সেগুলি মুখ্যত হল: দেবতারা আছেন কি না, তাদের জন্মাতে কে দেখেছে, তাঁরা থাকলেও ভক্তদের প্রার্থনা শোনেন কি না, যে-প্রণালীতে, যে-স্তব ও যে-হব্য দিয়ে তাদের আহ্বান করা হয় তা তাঁদের মনঃপূত হয় কি না, হলেও ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার ক্ষমতা তাদের আছে কি না, ক্ষমতা থাকলেও ইচ্ছে আছে কি না। এ ছাড়াও পরলোক আছে কি না এমন প্রশ্নও করা হয়েছে। দেবতা (ইন্দ্র) নেই এমন কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্যই এগুলি অনুত্তরিত প্রশ্নই থেকে গেছে, সে জনাস ইন্দ্র’ বলে নেম ভাগবের ইন্দ্রের অনস্তিত্ব ঘোষণার যে-উত্তর দেওয়ার চেষ্ট করা হয়েছে, সে-উত্তর বস্তুত উত্তরই নয়। কতকগুলি ঘোষণামাত্র, ফলে প্রশ্নগুলি রয়েই গেছে।
জ্ঞানকাণ্ডে আরণ্যক উপনিষদে প্রশ্নের ধরন পালটে গেছে। প্রথম যুগের কিছু কিছু প্রশ্ন আছে কিন্তু এখন প্রশ্নগুলির পরিসর অনেক বেড়েছে। বিশ্বপ্রকৃতির উদ্ভব, আচরণ, দেবতাদের আচরণ, মানুষের দেহ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, তাদের উদ্ভব, কর্মভূমিকা, আপেক্ষিক গুরুত্ব ও তাৎপৰ্য, শরীরের সঙ্গে মনের আপেক্ষিক সম্পর্ক, বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানুষের শরীরমনের সংযোগ এ সব নিয়ে নানা প্রশ্ন নানা মানুষ করেছে। এ ছাড়াও যে-প্রশ্নটি এই পর্বে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে তা ঠিক জ্ঞানকাণ্ডের যুগের নতুন বিষয় নয়, প্রশ্নটি পুরাতন, উত্তরটিই নতুন। প্রশ্ন হল, মরণোত্তর অবস্থা, এ নিয়ে পূর্বেও মানুষ ভেবেছে, সন্দেহ করেছে, প্রশ্ন করেছে, কোনও উত্তর পায়নি। এখন বারে বারে নানা ভাবে এ প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে; এর তীক্ষ্ণতম প্রকাশ যমের কাছে নচিকেতার প্রশ্নে। প্রশ্নগুলি ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য বা মৌলিক নয়, সারা পৃথিবীতেই মোটের ওপর মরণোত্তর অবস্থান নিয়ে এই ধরনের প্রশ্নই উত্থাপিত হয়েছে, উত্তরগুলি প্রত্যেক দেশে পৃথক। এ দেশে উপনিষদ থেকে শুরু করে। পরবর্তীর্ণ দর্শনপ্রস্থানগুলিতে প্রায় সর্বত্রই বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করে উত্তর পায়নি, পেয়েছে কিছু শাস্ত্রীয় অনুশাসন। পাশ্চাত্য দর্শনের প্রথম দিকে ধর্মতত্ত্বই দর্শন ছিল, পরে দর্শনচর্চা সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায়।
উপনিষদে আমরা যে-স্তরে আলোচনা পাই তা সম্পূর্ণতই বেদনির্ভর। কিন্তু জ্ঞানকাণ্ডে, বিশেষত উপনিষদে বেদের আদিপর্ব অর্থাং সংহিতািব্রাহ্মাণে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত দুটি নতুন তত্ত্ব উদ্ভাবিত হল ওই মৌলিক–মরণোত্তর অস্তিত্ব— প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার জন্যে; সে-দুটি তত্ত্ব হল, দেহাতিরিক্ত আত্মা ও জন্মান্তরবাদ। উত্তর যথার্থ না হলেও এর মধ্যে একটি যুক্তির ছক দেওয়ার চেষ্টা বেশ বোঝা যায়। দেহ যদি সম্পূর্ণত নশ্বর হয় তা হলে মৃত্যুতেই জীবনের চরম পরিসমাপ্তি হয়। তাতে সুখী মানুষের অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থকরার জন্য কোনও আধার থাকে না, পাপীর শাস্তিরও নয়। তাই আত্মা বলে দেহব্যাতিরিক্ত একটি সত্তকে কল্পনা করা হল। বহু সংশয়ের নিরসনের জন্যে এই আত্মাকে বারে বারে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। মানবিক সকল অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বের্ব বা বাইরে এর স্থিতি, তাই দেহ সম্বন্ধে আমাদের যা জ্ঞান তা দিয়ে আত্মাকে ধারণা করা যাবে না। অতএব শাস্ত্রকাররা প্রভূত প্রয়াসে এবং নিরলস উদ্যম এই আত্মাকে নেতিবাচক নানা ভাবে বর্ণনা করতে লাগলেন। ইতিবাচক কিছু বলা বিপজ্জনক এবং অবাঞ্ছিতও, তাই সে-পথ পরিহার করাই নিরাপদ। শুধু অঙ্গুষ্ঠমাত্র বলে এর পরিমাণ নির্ধারণ করলেন। সুখী ধনী সার্থক মানুষ তৃপ্ত হলেন এই জেনে যে মৃত্যুতেই সব শেষ হয় না, পরজন্মে আবার সবই ভোগ করা যাবে; কিছু দুঃখী মানুষও সান্ত্বনা পেল এই ভেবে যে, যথাযথ শাস্ত্রসম্মত আচরণ করলে তারা আবার জন্মে। এ জন্মে যা পেল না তা পাবে; এ সবের জন্যে জন্মান্তরিবাদের আমদানি করা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কিছু জীবনবিমুখ বৈরাগ্যবান আর জন্মাতে চাইলেন না। আর অগণ্য সাধারণ মানুষ যারা অভাবে, অস্বাস্থ্যে, অনাহারে, বিপর্যয়ে, অত্যাচারে জর্জরিত ছিল তাদের মনে হল: জীবন তো এই, একটানা যাতনা ভোগের ইতিহাস, এর পুনরাবৃত্তি তো যন্ত্রণারই অভিজ্ঞতা। কাজেই তারা এর পুনরাবর্তন থেকে মুক্তি চাইল। অতএব উপস্থাপিত করা হল আত্ম-ব্রহ্মা-ঐক্য তত্ত্ব অর্থাৎ মোক্ষ। ঋগ্বেদের আমল থেকে বহু অনুত্তরিত প্রশ্ন এ ভাবে যেন একটি উত্তরের আভাস পেল। আত্মার সত্তা নচিকেতার মূল প্রশ্নের এবং ঋগ্বেদ থেকে বহুসংশয়িত উক্তির উত্তর। এ আত্মা স্বৰ্গে বা নরকে চিরদিন থাকে না, এ পৃথিবীতেই ফিরে ফিরে আসে। এতে ঋগ্বেদের সেই বারংবার উচ্চারিত প্রার্থনা: পশ্যেমা শরদঃ শতং জীবেম শরদঃ শতম–একশো শরৎ দেখব। একশো শরৎ বাঁচব’, ‘জ্যোক পশ্যেম। সূর্যমুচ্চরস্তম–উদীয়মান সূর্যকে দীর্ঘকাল ধরে দেখব –তারই উত্তর। এইখানে আমরা জটিল একটি অবস্থার সম্মুখীন হই; যার পুনর্বার জন্মাবার আগ্রহ নেই তার বিকল্প করণীয় কী? যম বলছেন, ব্রহ্ম যাকে দয়া করে ওই অভেদবুদ্ধি দেন সে-ই মোক্ষকরা উপলব্ধি পায়, অন্যেরা পায় না। অর্থাৎ মানুষের হাতে তার মুক্তির কোনও যথার্থ উপায় নেই। অর্থাৎ শেষ প্রশ্নটা অনুত্তরিতই রইল।
সমাজে সংশয় নানা চেহারায় ছিল সংহিতা-যুগ থেকেই, এবং নচিকেতার কথায় আছে নাস্তিক্যও ছিল। নাস্তিক্য সম্বন্ধে শব্দকল্পদুম বলে, ঈশ্বরাপ্রামাণ্যবাদী আর বেদাপ্রামাণ্যবাদী অর্থাৎ ঈশ্বর বা বেদকে প্রমাণ বলে যারা মানে না। প্রতিশব্দ বা পৰ্যায়শব্দ হল বাৰ্হস্পত্য, নাস্তিক্য, লৌকায়ন্তিক (হেমচন্দ্রর অভিধানের মতে)। এদের মধ্যে চাৰ্ব্বকমত হল, ভূমি, জল, অগ্নি ও বায়ু এই চারটি ভুতিবস্তুকে স্বীকার করে (আকাশকে ভূত বলে স্বীকার করে না–আকাশভিন্নভূতচতুষ্টয়বাদী)। এ ছাড়া এবং প্রত্যক্ষ ছাড়া এরা অনুমান, উপমান, আপ্তবাক্য স্বীকার করে না–প্রত্যক্ষমেকং চার্বােকাঃ। চার্বাক ছাড়া বৃহস্পতিও এই ধরনের মত পোষণ করতেন। মনে পড়ে দেবতাদের গুরু বা আচার্যের নাম বৃহস্পতি, আর মনে পড়ে যমের উক্তি দেবৈরত্ৰাপি বিচিকিৎসিতং পুরা’–পুরাকালে দেবতাদেরও সংশয় ছিল; মৃত্যুর পর কিছু থাকে কি না। বৃহস্পতি তার কী উত্তর দিয়েছিলেন জািনবার উপায় নেই। কিন্তু পুরাকাল থেকে দেবতা মানুষ সকলে মৃত্যুর পর কিছু থাকে কি না সে নিয়ে সংশয় পোষণ করতেন। ঈশ্বরের অস্তিত্বও প্রামাণ্য, অর্থাৎ ঈশ্বরবচন বলে সব কিছু মেনে নেওয়াতে প্রথম থেকেই মানুষের আপত্তি ছিল। পরে আপত্তি বা সংশয়ের সীমা প্রসারিত হল, বেদের প্রামাণ্য অস্বীকার করায়। দুটি অতিলৌকিক প্রমাণই অস্বীকৃত হচ্ছে; ঈশ্বর তো অতিলৌকিক বটেই। আর বেদকে অপৌরুষেয় বলা মাত্রই বেদও অতিলৌকিক হয়ে গেল। মানুষ যখন এ দুটি প্রমাণ মানতে অস্বীকার করল তখন সে যা মানল তা প্রত্যক্ষলোকে এবং মানুষের জগতে সীমাবদ্ধ রইল, তা হল লোকায়ত; দেবায়ত বা লোকাতিগ নয়। এ কথা সত্য যে প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করলে জ্ঞানের জগৎ খর্ব হয়ে থাকে; তেমন হলে, কলকাতায় বসে আফ্রিকা দেখা যায় না বলে আফ্রিকা অপ্রমাণ হয়, অথবা অশোক আকবর প্রত্যক্ষ নন বলে অপ্রমাণ হয়ে যান। তাই অনেক আটঘটি বেঁধে যথার্থ কাঠামোর মধ্যে অনুমিতি (অনুমান)। অর্থাৎ তর্ককে স্বীকার করতেই হয়েছে। বেদের সংজ্ঞাই দেওয়া হয়েছে: ‘প্রত্যক্ষ বা অনুমান দ্বারা যা বোঝা যায় না সেটাকে যা বোঝায়। তাই-ই বেদ-প্রত্যক্ষেণানুমিত্যা বা যন্ত্রপায়ো ন বুধ্যতে।’ এবং, বিদন্তি বেদেন তস্মাদ্বেদস্য বেদতা।’ দুটির বাইরে যে-প্রমাণ তৰ্কশাস্ত্র স্বীকার করে তা হল, ‘শব্দ’ অর্থাৎ বেদবাক্য। বাক্য দু’রকমের–আনুষ্ঠানিক বা যজ্ঞের অনুষ্ঠান-সম্পর্কিত— এবং তাত্ত্বিক অর্থাৎ দেবতাদের বিষয়ে বা ধর্ম, নীতি ইত্যাদি অনুষ্ঠান-নিরপেক্ষ বিষয়ের কথা।
বেদবিরোধী প্রস্থানগুলি, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের কাছাকাছি যে সব সংশয়বাদী মূল বৈদিক ধর্মধারার বাইরে চলে যাচ্ছিল তাদের তত্ত্বে সংহত হয়ে রয়ে গিয়েছিল দু’ রকমেরই সংশয়। এ সব সংশয়ের অনেকগুলিরই অন্তরালে প্রবাহিত ছিল নাস্তিক্য, সম্ভবত সকল সংশয়ী এ বিষয়ে অবহিতও ছিলেন না, তবু মূল সংশয় অনেকক্ষেত্রেই নাস্তিক্যকে স্পর্শ করে, যদিও সর্বদা নয়। সংশয়গুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রইল অনুত্তরিত, অসমাধিত। মানুষ পাঁচ-ছাঁশো বছর ধরে নানা রকম প্রশ্ন করে গেছে, যথার্থ উত্তর মেলেনি। অতএব সংশয়ের তথা নাস্তিক্যের ভিত্তিও রয়ে গেল। আর রয়ে গেল প্রশ্ন করার, তর্ক করার এক সজীব ধারা,—বিশ্ব জ্ঞান চর্চায় যা এক অসামান্য অবদান।
——————
(১) নৈব বাচনে মনসা প্রাপ্তংশক্যোন চক্ষুষা। অতীতি বুঝতোহন্যত্র কথং তদুপলভ্যতে৷ (কঠ, ১:১:১০)
——————
সংক্ষিপ্ত গ্রন্থপঞ্জি
Agarwal, VS 1963 Hymn of Creation the Nasad a Sikta, Varanasi Armstrong, DM 1973 Belief, Truth and Knowledge, Cambridge, UK Atler Rober 198 Sacred History of Prose fiction, Near Eastern Studies, Vol 22 The Creation
of the Sacred Literatitre, Jniversity of California Press Bandyopadhyaya, NC 1945 Economic Life and Progress in Ancient India, Calcutta Banerji, N B 1974. The Spirit of Indian Philosophy, New Delhi Bhattacharj, S 2000. The Indian Theogony, Penguin Bhyattachary 1, S 1987 Doubt Belief of Knowledge, New Delhi Blacker, C& Lowe, M (ed) 1977 Weltformeln der fruheit, Die kosmologen der alten kulturen
Köln Brandon, SGF 1963 Man and his Destiny in the Great Religions, Manchester Burnyat, M (ed) 1983 The Skeptical Tradition, Berkeley Berger Peter: 1969 The Social Polity of Religion, Faber and Faber Berger Peter: 1970 A Rumour of Angels, Penguin. Chakrabart, A K, Motilal B K 1994. Knowing from Words, Dordrecht Cihattiopadhyaya, D.P. 1964 İndian Philosophy. New Delhi (4th edn 1979) Chattopadhyaya, D.P. 1977 What is living and what is dead in Indian Philosophy. People’s
Publishing House Dasgupta, SN 1922 A History of Indian Philosophy, Cambridge, U.K (1955). Frauwallner, E. 1953, Geschichte der indischen philosophie. Vo!, Salzburg Gupta, U. 1987. Materialism in the edas, New Delhi. Geertz, Clifford. 1968. Islam observed, Yale University Geertz, Clifford 1973. The Interpretation of Culture, N.Y.
lallic, P (ed.), 1964. Scepticismo Man and God, Connecticut Herman, A.L 1976 An Introduction to Indian Thought, New Jersey. Heesterman, J.C. 1968-69 On the Origin of the Nästika in Wissenschaft Zeitschript für die süd
and Ostasiens Band XI-X, Halbfass, W. 1988 India and Europe, An Essay in understanding, Suny Press Halbfass, W. 1991. Tradition an Reflection, New York. Herbert, H & Mauss, Marcel: 1964 Sacrifice: its nature and function, London. Hulin, M. 979. L’Hridusine, Paris, Jha, G (ed) 924. Tantravartuka, Vois, i & İl, Calcutta, (2nd cdn 1983) Jha, G (ed) 1900-1904 Slokayārtuka, Delhi (2nd edn 1995) Kuiper, F.B.J. 1983. Ancient linduan Cosmogorry, Delhi Kulke, H & Rothermund Dietmar. 1995 A History of India, London Kirkegaard: 1952. Six Existentialist Thinkers, Routledge and Kegan Paul
R8 R
long, A A. 1986 Hellenistiar Philosophy, Duckworth Mann, U 1974 Schöpfungsmythen vom Ursprung und Sunn Stuttgart Macinico, N 95 lindan The usim, ondon. Marrett, R R 194 The Threshold of Religion. Oxford Mitta, KK 1974. Materialism in Indian Thought, Delhi Maser, P 1985 Knowledge and Evidence, Cambridge, UK Mukhopadhyaya, P.K 1985. Indian Realism A Rigorous Descriptive Metaphysics, Calcutta McClosky, J. M. 1964 God and Evil in God and Evil, led Helson Pike, Prentice liaii. Nakamura, Hame’ 1985 A Comparative History of Ideas, Tokyo Protagoras. Frag 4 The Sophist Patrick, M M 1983. The Greek Skeptics, London Swanson, GE 1964. The Birth of the gods, Michigan Sontheimer, GD. & Kulke li (ed) 1989 Hinduism Revused. Delhi Toporov, VN. 1977. Les sources cosmologiques des premieres descriptions histortoques,
Brukelles Thomson, G 1955 Studies in Ancient Greek Society, Vols. I & II, Lawrence and Wishart, London Taylor, PB & Audem Włł –1969 The Elder Edda Selections, Random House. Warder, A K 1970. Indian Buddhism, Motula Banarasidas. Wolf. A 1974 Religion and Ritual in Chinese Society, Standord University Press,
ARCES
Agass, J ‘Privileged Access’. Inquiry, 12. (196), pp. 420-26 Aimeder. R Truth and Evidcnce, Philosophical Quarterly 24, (1974), pp. 365-68 Annus, D B o Knowledge, Belief and Rationality’, „Journal of Philosophy, 74 (1977), pp 219-25. Barkes, J ‘Knowledge, ignorance and Presupposition’. Analysis, pp. 33-45. Bronsted Mogens 1967 The Transformations of the concept of gate in literature’, in Ringgen
Helmer (cd). Fatalistic Beliefs in Religion, Folklore and Literature, Stockholm Corronda Pensa 1972 The Field of Indian Religions’ in J Branchi, C.J. Blecker. A Bausani (ed.) Some Internal and Comparative Problems in Methods of Istory of Religions, Br Collins, A Reflections on Rg Veda X, 129, Journal of indo-European Studies, 3, (1975), pp.
27-8 Kapstein, Minda’s search for self and the beginnings of philosophical perplexities in India’,
Religion Studies, Cambridge, 1988. Mater, W H A re-examination of Rg Veda X, 129, the Nasadiya Hymn’Journal of Indo-European
Studies, 3 3. pp 219-37. Polome, EC ‘Vedic Cosmogonies and their Indo-European Back-ground’. The Mankind
Quarterly 24, (1983), pp 61-69 Sellars, W Skepticism and inquiry’, Philosophical Forum. 7, (1975-76), pp. 203-07.
OGONARES ANO ENCYCLOPAEDAS
Dictionary of the History of ideas, 1975 Macmian Encyclopaedia of Philosophy, 1967. Macmillian Encyclopaedia of Religion, 1987 Macmillan Encyclopaedia of Religion and Ethics, 1958, The New Schaff–Herzog Encyclopaedia of Religious Knowledge, 1958. Oxford Dictionary of the Christian Church,
Leave a Reply