০৮. নচিকেতার প্রশ্ন

নচিকেতার প্রশ্ন

যজ্ঞের নিষ্ফলতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন যে স্পষ্ট হচ্ছিল তার বড় একটি প্রমাণ আছে মুণ্ডক উপনিষদে। এখানে বলা হয়েছে, যজ্ঞ হল অদৃঢ় নৌকো, অর্থাৎ গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে না ওই ‘অদৃঢ় (তলাফুটো?) যজ্ঞরূপ নৌকোগুলো— প্লবা হোতা অদৃঢ়া যজ্ঞরূপাঃ।’(১:২:৭) সোজা কথায়, যজ্ঞে আর অভীষ্ট ফল পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা দেখেছি, এর ফলে এক দিকে যেমন বেদবিরোধী বেশ-কিছু প্রস্থানের উদ্ভব হল, অন্য দিকে তেমনই ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যেও লক্ষ্যণীয় কিছু পরিবর্তন এল। এর পটভূমিকা ক্রমবর্ধমান সংশয়, সমাজের এক বড় অংশে যজ্ঞ সম্বন্ধে দোলাচলতা। এই পটভূমিকায় যজ্ঞ সম্বন্ধে পূর্বের মতো বিশ্বাসও যেমন আর নেই, পূর্বের মতো নিষ্ঠার সঙ্গে যজ্ঞ সম্পাদন করাও তেমনই কমে আসছে।

এমনই এক অবস্থার রচনা কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় শাখার অন্তর্গত কঠোপনিষদ; যজুর্বেদ যজ্ঞ-অনুষ্ঠান সম্বন্ধে নির্দেশ দেয় অধ্বর্যুকে, যিনি হাতেকলমে যজ্ঞ করেন। অর্থাৎ এর সঙ্গে মন্ত্র আবৃত্তি বা গানের তত যোগ নেই যতটা আছে যজ্ঞকর্ম বা যজ্ঞ সম্পাদনের। কঠোপনিষদ একটি বৃহৎ ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপনিষদ— বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্যের পরে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর শুরু হচ্ছে বাজশ্রবার পুত্র-যজ্ঞফল কামনা করে সমস্ত সম্পত্তি দক্ষিণায় দান করার মধ্য দিয়ে (সম্ভবত এটি বিশ্বজিৎ যজ্ঞ, যার দক্ষিণা হল যজমানের সমস্ত ধন)। তাঁর নচিকেতা নামের এক ছেলে ছিল।[১] যখন দক্ষিণাগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন কুমার নচিকেতার মনে শ্রদ্ধা’ উদিত হল। তাঁর মনে হল, ‘যেসব গাভি জীবনে শেষবার জলপান করেছে, তৃণভক্ষণ করেছে, দুধ দিয়েছে, যাদের আর বাছুর জন্মাবে না, এমন সব গাভিদের যে-যজমান দান করেন তিনি তো তেমন লোকে যান যেটি দুঃখময়।[২]

এখানে কয়েকটি কথা লক্ষ্য করবার মতো। যজমান যে-যজ্ঞে গাভিগুলি দান করছেন সে-যজ্ঞের শাস্ত্রীয় দক্ষিণা হল, যজমানের তাবৎ সম্পত্তি। কুমার নচিকেতা দেখলেন, এই গাভিগুলি বৃদ্ধা এবং আসন্নমরণা, এরা আর কোনও দিন ঘাস খাবে না, জল খাবে না। এদের কাছ থেকে আর কোনও দিন দুধ বা গোবৎস পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ এগুলি, আজকের ভাষায়, ভাগাড়ে যাওয়ার মতো গাভি। বাজশবার যজমানের সংসারে এগুলি খরচের খাতায়, যা দেওয়ার এরা শেষ পর্যন্ত দিয়েছে, এখন গোহত্যা না করে সম্পূর্ণ নিরর্থক এই জীবগুলিকে আমরণ খোরাক জোগাতে হবে। অতএব তৃতীয় যে-রাস্তাটি যজ্ঞ করে দিয়েছে তা হল, এদের দক্ষিণা হিসেবে কোনও ঋত্বিক পুরোহিতকে দান করা। এতে গ্রহীতা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সম্বন্ধে বাজশ্রবসের প্রগাঢ় অবজ্ঞা সূচিত হচ্ছে। এমন দক্ষিণা যার বাবা সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সেই কুমার নচিকেতার এ সব দেখে একটা বিশ্বাস জন্মাল। মনে রাখতে হবে, শ্রদ্ধার মূল অর্থ বিশ্বাস (ইন্দো-ইউরোপীয় ধাতু c + дδ থেকে সংস্কৃতে শ্রদ্ধা এসেছে। কেন্তুম গোষ্ঠীর ভাষায় আমরা ল্যাটিনে ও ইংরেজিতে পাই credo, credit, credible অর্থাৎ এর মূল অর্থ বিশ্বাস)। নচিকেতার মনে একটা বিশ্বাসের উদয় হল। কী সেই বিশ্বাস? এমন হাড়-জিরজিরে মুমূর্ষু গাভিগুলি দক্ষিণায় দিলে তো শাস্ত্র-অনুসারে বাজশ্রবসের অক্ষয় নরকপ্রাপ্তি হবে, এ কী করছেন তিনি? তাই পিতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা আমাকে কাকে দান করবেন?’ এক বার) দু’বার, তিন বার। তখন তাকে (বাজশ্রবস) বললেন, ‘মৃত্যুকে দেব তোকে।’[৩]

এখানে লক্ষ্যণীয় নচিকেতার বর্ণনা ‘কুমারং সন্তং’ মানে কুমার থাকতেই, অর্থাৎ নচিকেতা অপ্রাপ্তযৌবন কিশোর। তার সম্ভবত মনে হয়েছে এতগুলি বৃদ্ধা গাভি দান করলে পিতার অক্ষয় নরকবাস হবে। একটি তরুণ কিশোরকে সঙ্গে দিলে হয়তো সে-শাস্তি খানিকটা কমতে পারে। স্বভাবতই এ প্রশ্নে পিতা বিব্রত, বিরক্ত, কারণ ছেলের কাছে যজ্ঞের দক্ষিণার ফাঁকিটা ধরা পড় গেছে; আরও বিরক্তির কারণ হল, যে-যজ্ঞের দক্ষিণা হল যথাসর্বস্ব, তারই দক্ষিণায় সাজানো ওই মুমূর্ষু গাভিগুলি। রাগের কারণ হল, কিশোর বালক যদি এটা ধরে ফেলে থাকে, তা হলে তো সকলেই ধরতে পারবে। ছেলে প্রশ্ন করছে, ‘আমাকে কাকে দান করবে – বলা বাহুল্য, বাজশ্রবসের কোনও অভিপ্রায়ই ছিল না নচিকেতাকে কাউকে দান করার। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছেলে এক বার, দু’বার, তিন বার প্রশ্ন করতে বাপের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, বললেন, ‘তোকে দান করব মৃত্যুকে।’ আজকের ভাষায়: ‘তুই যমের বাড়ি যা।’ এবং ছেলে সেই মানেই বুঝল, তবে যাওয়ার আগে সে বাপকে প্রশ্ন করল, ‘আমি অনেকের মধ্যে প্রথম, আবার অনেকের মধ্যে মধ্যম (অর্থাৎ একেবারে অধম আমি নই)। যমের এমন কী কাজ আছে যা আমাকে দিয়ে সিদ্ধ হবে?’[৪] পরে যা বললেন তার অর্থ, ‘পূর্বপুরুষ এবং বর্তমানের মানুষদের দেখে (জানা যায়) যে-মানুষ শস্যের মতো, পক্ব হয়ে বিনষ্ট হয় আবার শস্যেরই মতো পুনর্বার জন্মগ্রহণ করে।’[৫] এ কথার অন্তরালে নচিকেতা পিতাকে বলতে চায়, মৃত্যুতে যেহেতু শেষ পরিসমাপ্তি নয়, পুনর্জন্ম আছে, তাই যম আমাকে গ্রহণ করলেও, অর্থাৎ আমি মরলেও আবার জন্মাব। সুতরাং আপনি যখন বলে ফেলেছেন আমাকে মৃত্যুর কাছে সমর্পণ করবেন, তখন সে-কথাটা রাখুন, আমাকে মৃত্যুর কাছে যেতে দিন।

নচিকেতা যমের বাড়ি গেল। যম বাড়ি ছিল না, তাই নচিকেতা তিন দিন যমের বাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করল না। যম ফিরলে বাড়ির লোকেরা বলল, ‘ব্রাহ্মণ অতিথি স্বয়ং অগ্নির মতো গৃহে প্রবেশ করেন, লোকে তাঁর শান্তিবিধান করে, (অতএব) হে বৈবস্বত যম, (গৃহস্বামী হিসাবে) তাঁকে পাদোদক দাও।’[৬] ‘ব্রাহ্মণ যার বাড়িতে অনাহারী হয়ে থাকে, আকাঙ্ক্ষিত ও প্রাপ্ত বস্তু, সৎসঙ্গের সুফল, ইষ্টাপূর্ত, পুত্রপশু সেই অল্পবুদ্ধি মানুষের সবই ধ্বংস হয়ে যায়।’[৭] তখন যম নচিকেতাকে (পাদোদক অর্ঘ্য আসন দিয়ে) বললেন, ‘যেহেতু তুমি তিনরাত্রি আমার বাড়িতে অনাহারী হয়ে থেকেছ, আমার নমস্য অতিথি হয়েও, তাই তোমাকে আমি নমস্কার করছি, হে ব্রাহ্মণ, আমার কুশল হোক, তুমি তিনটি বর চাও।’[৮] প্রথম বরে নচিকেতা চাইল, তার পিতা যেন ক্রুদ্ধ না থাকেন তার প্রতি, সদয় ও প্রসন্ন হন, যমের কাছ থেকে ফিরে গেলে যেন ভাল ভাবে সম্ভাষণ করেন। যম বর দিলেন, উদ্দালকের পুত্র বাজশ্ৰবা তোমাকে দেখে আগেকার মতোই স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করবেন, ক্রোধ ভুলে যাবেন, দীর্ঘকাল সুখে থাকবেন। দ্বিতীয় বরে নচিকেতা চাইলেন, ‘স্বর্গে কোনও ভয় নেই, আপনি (অর্থাৎ মৃত্যু) সেখানে নেই, জরার আশঙ্কাও নেই। মানুষ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দুটিকেই অতিক্রম করে শোক পার হয়ে সেখানে বাস করে। যম, স্বর্গকামী মানুষ যে-অগ্নিবিদ্যার সাহায্যে অমরতা পায় তা আপনিই জানেন, শ্রদ্ধান্বিত হয়ে আমি এসেছি। এ বিষয়ে আপনি আমাকে বলুন, এটিই আমার দ্বিতীয় বর।’[৯] যম দ্বিতীয় এ বর দিতে রাজি হলেন, বললেন, ‘তোমাকে ভালো করে বলছি, শোনো, নচিকেতা, অগ্নিকে জেনে স্বর্গলাভ করা যায়। স্বর্গলাভ প্রাপ্তির ও (সেখানে) প্রতিষ্ঠার উপায় এই অগ্নির তত্ত্ব গুহাতে নিহিত বলে জেনো।[১০]

দ্বিতীয় বরে নচিকেতা জানতে চাইল কোন সেই আপাতগূঢ় অগ্নিবিদ্যা (= যজ্ঞাগ্নির স্বরূপ), যা জানলে তার সাহায্যে মানুষ স্বর্গে যেতে পারে এবং সেখানে থাকতে পারে, অর্থাৎ কোন অগ্নিবিদ্যার জ্ঞানে অক্ষয় স্বর্গবাস অর্জন করা যায়। স্বর্গে হয়তো জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞ করে যাওয়া যায়, কিন্তু তখনকার সমাজে সকলে পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে, কাজেই অল্পকাল স্বর্গে বাস করে আবার তো মর্তে ফিরে আসতে হতে পারে। নচিকেতার প্রশ্ন স্বর্গ দিয়ে জন্মান্তার এড়ানো, কী সেই অগ্নিবিদ্যা যা আয়ত্ত করলে স্বর্গ থেকে আবার মর্তে এসে জন্মাতে হয় না।

বলা বাহুল্য, এ প্রশ্ন শুধু নচিকেতার নয়, সে-যুগের বহু মানুষের তীব্র বাসনার উচ্চারণ এটি। মর্তলোকে জীবনে নানা দুঃখকষ্ট, অভাব-অভিযোগ-অত্যাচার-নির্যাতন। জন্মান্তরের ফলে মর্তে এলে এই তো ভাগ্য। পুনর্জন্ম মানে এই সবই, অন্তিমে পুনমৃত্যু এবং আবার এ সবের পুনরাবর্তন। একমাত্র প্রতিকার হল অক্ষয় স্বর্গবাস; তাতে পুনর্জন্ম ও পুনমৃত্যু থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়, অতএব, এর মধ্যে দিয়েই বারংবার দুঃখময় জীবনের পুনরাবৃত্তি থেকে মুক্তি এবং অন্তহীন সুখের সম্ভাবনা। যমের অপরাধবোধ ছিল। ব্রাহ্মণ তাঁর বাড়িতে ত্রিরাত্রি উপবাস করেছে, কাজেই নচিকেতার প্রার্থিত বর দিতে রাজি হলেন। সেই সৃষ্টির আদিম অগ্নির কথা তাঁকে বললেন, বেদিনির্মাণ করতে যতগুলি যে রকম ইষ্টক লাগে তা সবই বললেন। কী ভাবে (সে-যজ্ঞে) অগ্নিচয়ন করতে হয়, প্রীত হয়ে দু’বার করে নচিকেতাকে সব বললেন। নচিকেতা তা গ্রহণ করলে যম আরও বললেন, তোমার প্রতি প্রীত হয়ে তোমাকে এবার চতুর্থ একটি বর দিচ্ছি: ‘এই অগ্নিটি তোমারই নামে (অর্থাৎ ‘নচিকেত অগ্নি’ বলে) ) খ্যাত হবে। তুমি এই ঝংকারিণী বহুরত্নখচিত মালাটিও নাও।’[১১] এখানে লক্ষ্য করি, নচিকেতা বহু মানুষের মুখপাত্র হিসাবে জরামৃত্যু দুঃখযন্ত্রণা থেকে চিরকালীন মুক্তির পথটি জানতে চাইছে দ্বিতীয় বরে— জন্মান্তরে বিশ্বাসের যুগে এটি শ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে স্থায়ী আনন্দের জন্য প্রার্থনা। এটি কিন্তু নচিকেতার প্রাপ্য দ্বিতীয় বর, এখানে নচিকেতা খুব যুক্তিযুক্ত একটি প্রার্থনা করে এবং যম তা দিতে স্বীকার করেন: এর জন্যে যমের বিশেষ ভাবে প্রীত হওয়ার কিছু ছিল না। তবু যম খুশি হয়ে আরও দুটি পুরস্কার বা উপহার দিলেন: ওই স্বর্গের অগ্নিবিদ্যা ‘নাচিকেত অগ্নি’ নামে অভিহিত হবে এবং তারই সঙ্গে একটি বহুমূল্য মালাও দিলেন, নচিকেতা সেগুলি গ্রহণ করল। পরবর্তী দুটি শ্লোকে যম বললেন, ‘মাতা, পিতা ও আচার্যের উপদেশ পেয়ে যে তিন বার নাচিকেত অগ্নি চয়ন করে এবং বেদাধ্যয়ন, যজ্ঞ এবং দান করে সে, জন্মমৃত্যু অতিক্রম করে; যে নাচিকেত অগ্নিকে আত্মার বলে জেনে ধ্যান করে, সে যমের বন্ধন থেকে বিমুক্ত হয়ে শোকরহিত হয়ে স্বর্গে আনন্দ থাকে।’ (১:১:১৮,১৯) এ কথার শেষে যম নচিকেতাকে বললেন, এইবারে তুমি তৃতীয় বরটি প্রার্থনা করো। যেহেতু যম তাকে আগেই অনেক কিছু দিয়েছেন, স্বভাবতই তিনি আশা করতে পারেন, নচিকেতার আর তেমন কিছু প্রার্থনীয় নেই, তাই বললেন, ‘তোমার তৃতীয় বরটি প্রার্থনা করো, নচিকেতা।’

তৃতীয় বর সম্বন্ধে নচিকেতা বললেন, ‘মানুষের মৃত্যুর পরে এই যে সংশয়— কেউ কেউ বলে (মৃত্যুর পরে) কিছু থাকে আবার অনেকে বলে কিছুই থাকে না— আপনার দ্বারা উপদিষ্ট হয়ে আমি এ বিষয় জানতে চাই, বরগুলির মধ্যে এইটিই তৃতীয় বর।’[১২] এ প্রশ্ন সুদীর্ঘকাল থেকেই মানুষকে উদ্‌বেজিত রেখেছে— শুধু প্রাচীন ভারতে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কি মানুষ শেষ হয়ে যায়, না মৃত্যুর পরে কিছু অবশিষ্ট থাকে? ঋগ্বেদের শেষতম অংশ দশম মণ্ডলে অন্ত্যেষ্টির সঙ্গে জড়িত যে-মন্ত্রগুলি পাওয়া যায় সেগুলির ভিত্তি হল, মৃত্যুর পরে মানুষ যমের তত্ত্বাবধানে সুখেই থাকে; এ বিশ্বাসের ভিত্তিতেই ওই শ্লোকগুলি রচিত: সম্ভবত তখন পৃথিবীর সর্বত্রই অধিকাংশ মানুষই মরণোত্তর অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল।

পুরাকালে প্রত্ন-উৎস উৎখননে যে সব বস্তু শবের সঙ্গে সমাহিত হত, তা থেকেই বোঝা যায় যে সারা পৃথিবীতেই এটি একটি ব্যাপক বিশ্বাস ছিল। অস্তিত্ব অনস্তিত্বকে স্বীকার করতে চায় না, ফলে মরণোত্তর সত্তা অধিকাংশ দেশে এবং কালে স্বীকৃত ছিল, এখনও আছে। কিন্তু মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পর্যায় থেকে মানুষের স্বতন্ত্র বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে এবং তার একটি বড় প্রকাশ হল সন্দেহ। কাজেই নচিকেতা যমকে বলছে, মৃত্যুর পরে কিছু থাকে এ কথা কেউ কেউ বলে, তেমনই কিছুই থাকে না এ কথাও কেউ কেউ বলে। মনে রাখতে হবে যে এ উপনিষদ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকে রচিত, তখনই নচিকেতা বলছেন, ‘কেউ কেউ বলেন মৃত্যুর পরে কিছুই থাকে না’। অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব নবম বা অষ্টম শতকেই এই সংশয় সমাজে প্রসার লাভ করেছে। ওই সময়েরই শেষাংশে বেদবিরোধী প্রস্থানগুলির উদ্ভব এবং খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকে এগুলি সমাজে প্রত্যক্ষ ভাবে পরিদৃষ্ট। কঠোপনিষদ কৃষ্ণযজুর্বেদীয় উপনিষদ, অর্থাৎ এর উদ্ভব যজ্ঞের পটভূমিকায়, এই যজ্ঞে যারা হাতেকলমে কাজ করত তাদেরই মধ্যে। তাদেরই এক উত্তরপুরুষ কিশোর নচিকেতা দেখছে তার পিতা যজ্ঞে কতটা অবিশ্বাসী, যে-গাভি দান করার সম্পূর্ণ অযোগ্য সেগুলি অনায়াসে দক্ষিণায় দান করছেন তিনি। অর্থাৎ নচিকেতা এই মৌলিক অবিশ্বাস নিজের বাড়িতেই যজমান পিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করে ক্ষুব্ধ হয়েছে।

যাই হোক, যম তিনটি বর দেবেন প্রতিজ্ঞা করেছেন, তাই তৃতীয় বর যখন নচিকেতা চাইল তখন তাঁর না দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, তবু চেষ্টা করলেন, নচিকেতাকে নিবৃত্ত করতে, বললেন, ‘এই ব্যাপারে স্বয়ং দেবতাদেরও আগে সংশয় ছিল। এই ধর্মের তত্ত্ব এত সূক্ষ্ম যে সহজে বোঝা যায় না। তাই, নচিকেতা, তুমি অন্য কোনও বর প্রার্থনা করো, আমাকে এ নিয়ে উপরোধ কোরো না, এ অনুরোধ ছেড়ে দাও।’[১৩] এখানে লক্ষ্য করি যে, যম নিজের অঙ্গীকার থেকে সরে আসতে চাইছেন; ব্রাহ্মণ প্রার্থী তার গৃহে ত্রিরাত্রি উপবাসী ছিল বলে তাঁর যে অপরাধবোধ, তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে নিজের প্রস্তাব ছিল তিনটি বর। এমন কোনও শর্ত ছিল না যে যমের ইচ্ছামতো বরই চাইতে হবে, বরং চিরন্তন রীতি অনুসারে প্রার্থীর অভিলষিত বস্তুই সে চাইবে। সে-বর দিতে যমের আপত্তি কোথায়? প্রথমত এ ধৰ্ম বড়ই সূক্ষ্ম, এত সূক্ষ্ম যে সহজে বোঝা যায় না; কিন্তু যম কেমন করে জানলেন যে নচিকেতার বুদ্ধি যথেষ্ট সূক্ষ্ম নয়, সে বুঝবে না এই সূক্ষ্ম তত্ত্ব? নিজের কুযুক্তিকে সমর্থন করতে গিয়ে যম বলছেন, এই ব্যাপারে পূর্বকালে দেবতারাও সংশয়িত ছিলেন। এর সোজা মানে হল মৃত্যুর পর কিছু থাকে কি না সে-বিষয়ে দেবতাদেরও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কেমন দেবতা তাঁরা যাঁরা ত্রিকালজ্ঞ নন? যাঁরা মর্তলোকের ওপারে বাস করেন, তাঁদেরও সংশয় ছিল মৃত্যুর পরে কিছু থাকে কি না তা নিয়ে। লক্ষ করলে দেখি, যম বলছেন, ‘পুরা’ অর্থাৎ পূর্বকালে দেবতাদের এ বিষয়ে সংশয় ছিল। সহজ ব্যঞ্জনা হল, এখন আর সে-সন্দেহ দেবতাদের নেই, তাঁরা জানেন মৃত্যুর পরে কিছু থাকে কি না। কিন্তু তাঁরা সন্দেহ করেন কি না, জানেন কি না সে-কথা এ পটভূমিকায় তো সম্পূর্ণ অবান্তর, কারণ যমের অঙ্গীকার তো কোনও শর্তাধীন ছিল না; যে-কোনও তিনটি বর নচিকেতা চাইবে, যম তা পূরণ করবেন, এমনই তো কথা ছিল। এখন এ পশ্চাদপসরণের চেষ্টা কেন? নচিকেতা বললেন, ‘দেবতাদেরও এ বিষয়ে সন্দেহ ছিল, হে মৃত্যু, আপনি স্বয়ং এ তত্ত্বকে দুর্বিজ্ঞেয় বলছেন, আপনার মতো বক্তা আমি অন্য আর কাউকে পাব না, এই বরের তুল্য কোনও বরই হতে পারে না।’[১৪]

নচিকেতার যুক্তিগুলির কোনও খণ্ডন হয় না। প্রথমত, এ এমন একটা বিষয় যা নিয়ে স্বয়ং দেবতারাও সন্দিহান ছিলেন, দেবতাদের মানুষ সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান বলেই জানে, তাঁদেরও জ্ঞান তা হলে এখানে এসে ঠেকে যেত? তা হলে মর্ত্যমানুষ নচিকেতার এ বিষয়ে কৌতূহল তো আরও স্বাভাবিক, আরও যথার্থ। দ্বিতীয়ত, প্রশ্নটা হল মরণোত্তর সভা, আর প্রশ্নটা করা হচ্ছে স্বয়ং মৃত্যুকে, কাজেই তাঁর চেয়ে কে আর বেশি যোগ্য এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে? তৃতীয়ত, যম স্বয়ং বলছেন বিষয়টা দুর্জ্ঞেয়, কিন্তু এক বারও বলছেন না যে এর সমাধান নেই। বরং ইঙ্গিতটা যেন এমন যে, মানুষ নচিকেতা সেই সমাধান জানবার যোগ্য নয়, যা দেবতারাও জানতেন না। নচিকেতার যুক্তি হল মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থা সম্বন্ধে স্বয়ং মৃত্যুদেবতার চেয়ে যোগ্যতর ব্যাখ্যাতা বা শিক্ষক তো আর কেউ হতে পারে না, অতএব যমের বরে যখন এমন দুর্লভ সুযোগ জুটেছে তখন তা হাতছাড়া করা অবিবেচনার কাজ হবে, তাই যম তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন করে নচিকেতার প্রশ্নের উত্তর দিন। এটিই তাঁর শেষতম বর এবং যমের বরে এ জ্ঞানে তার অধিকার আছে। উত্তরে যম বললেন:

শতায়ু পুত্র পৌত্র প্রার্থনা করো, বহু গাভী, সুবর্ণ, হস্তী ও অশ্ব চাও, বৃহৎ আয়তনের ভূমি চাও, যত বৰ্ষ ইচ্ছা বাঁচবার বর চেয়ে নাও। আর এ সবের সমতুল্য অন্য কোনও বস্তু পেতে চাও, তাও চেয়ে নাও। সুদীর্ঘ জীবন, সুবর্ণ ও বস্ত্র প্রার্থনা করো, আমি তোমাকে তোমার সব কামনা পূরণ করে ভোগ করবার ব্যবস্থা করে দেব। এ পৃথিবীতে যে সমস্ত কামনা দুষ্প্রাপ্য, ইচ্ছামতো সে সব কাম্যবস্তু তুমি প্রার্থনা করো। এই সব সুন্দরী রমণী, এদের সঙ্গে রথ ও বাদ্যযন্ত্র আছে, এমন-সব বস্তু মানুষের অপ্রাপ্য, আমার দান এই সব কিছু দিয়ে তুমি নিজের পরিচর্যা করাও, নচিকেতা, শুধু মৃত্যুর পরের ব্যাপারটি সম্বন্ধে আমাকে প্রশ্ন কোরো না।[১৫]

মৃত্যু নচিকেতাকে যা যা প্রার্থনা করতে বলছেন, তার সবই কর্মকাণ্ডে যজ্ঞ থেকে পাওয়ার কথা। পিতার আচরণে নচিকেতা এমন যজ্ঞ সম্বন্ধে বীতস্পৃহ, তা-ও সে জানে যে এ সবের বাইরে অন্য কোনও কাম্যবস্তু সে-যুগে বা সমাজে অকল্পনীয় ছিল। পৃথিবীতে রাজৈশ্বর্য এবং কল্পনীয় সর্বপ্রকার সুখভোগের তাবৎ উপকরণ। যম নচিকেতাকে দিতে সম্মত, শর্ত একটাই: মরণের পরের অবস্থা নিয়ে নচিকেতা যেন কোনও প্রশ্ন না করে। প্রকারান্তরে যম তাঁর প্রতিশ্রুত তৃতীয় বরটি প্রত্যাহার করে নিতে চান, বিনিময়ে মর্তে সুচিরকাল স্বর্গের সর্বসুখ দান করতে চান। এর আগে অবশ্য দীর্ঘকাল স্বর্গবাসের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। নচিকেতার প্রার্থিত বস্তুটি দিতে অস্বীকার করার মধ্যে যে-প্রচ্ছন্ন মিথ্যাচারিতা আছে, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এত ঐশ্বর্য ও সুখ দিতে চান যাতে ওইটি ঢাকা পড়ে। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়, নচিকেতা হঠাৎ-পাওয়া এ সুযোগ ছাড়তে রাজি নয়। সে বলে :

হে যম, যে সব উপহার আপনি দিতে চান সে সবই তো ক্ষণস্থায়ী (আজ আছে কাল নেই), এগুলি (ভোগের দ্বারা) ইন্দ্রিয়ের তেজ ক্ষীণ করে দেয়, তা ছাড়া (এত ভোগ করার পক্ষে) জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, (কাজেই) এই রথ, ইত্যাদি, এই নৃত্যগীত এ সব আপনারই থাকুক। সম্পত্তিতে মানুষের আত্যন্তিক তৃপ্তি নেই, আপনার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে, তখন বিত্তলাভ ঘটবেই, আপনি যতদিন ইচ্ছা করেন ততদিনই বাঁচব, কিন্তু যে-বর আমি কামনা করি তা এই-ই। [১৬]

এখানে নচিকেতা যমের কথার উত্তরে কতকগুলি মোক্ষম যুক্তি দিয়েছে। যমের প্রস্তাবিত সুখভোগে কেন নচিকেতা প্রলুব্ধ নয়, সে-কথা সে স্পষ্ট করেই জানায়, ‘যাঁদের জরামৃত্যু নেই সেই দেবতাদের কাছে পৌঁছেও পৃথিবীর মানুষ জানে যে সমস্ত ইন্দ্রিয়ভোগ্য সুখ— সঙ্গীত, সম্ভোগ ও আনন্দ— সব কিছুই অনিত্য, অতএব অতিদীর্ঘ জীবনে কে আনন্দ পাবে? হে মৃত্যু, এই যে বিষয়টিতে (আমাদের) পরলোক সম্বন্ধে এই যে মহৎ সংশয় সে-কথাই আপনি আমাকে বলুন। (আত্মার গহনে) অনুপ্রবিষ্ট রহস্যগূঢ় এই যে বিষয় সেইটিই আমার (অভীষ্ট) বর, নচিকেতা আপনার কাছে অন্য বর কামনা করে না।[১৭] এই সব কথায় নচিকেতা যমের প্রতিশ্রুত সমস্ত আনন্দের উপকরণ প্রত্যাখ্যান করে জানতে চাইল, মৃত্যুর পরে কী থাকে। যম বললেন: শ্রেয় ও প্রেয়ের মধ্যে যে শ্রেয়কে বরণ করে সে সাধু হয়, যে প্রেয়কে বরণ করে পরমার্থ থেকে সে চ্যুত হয়। (একই কথা কঠ. ১:২:১,২-তে)। নচিকেতা, তুমি আপাত সুখের পথ ছেড়েছ বুদ্ধিমানের মতো, (কঠ. ১:২:৩); কাম্যবস্তুর দ্বারা তুমি প্রলুব্ধ হওনি, (কঠ. ১:২:৪); অবিদ্যার মধ্যে যারা বিচরণ করে ও নিজেদের শাস্ত্রজ্ঞ মনে করে, তারা মূর্খ। (কঠ. ১:২:৫) পরের শ্লোকে যম বললেন, ‘যারা মনে করে শুধু ইহলোকই আছে, পরলোক নেই তারা বারেবারে আমার বশীভূত হয়।’[১৮] এর অর্থ হল, যারা নাস্তিক অথবা পরলোকের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী, তাদের পুনর্জন্ম হয় ও বারংবার মৃত্যুভোগের দ্বারা তারা যমের (= মৃত্যুর) বশে আছে। পরের শ্লোকে যম বললেন, আত্মার সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়ার যোগ্য লোক বিরল, ফলে অধিকাংশ মানুষই এ সম্বন্ধে কিছু জানতেই পারে না, এবং উপদেশ পেয়েও অনেকে ঠিকমতো জানতে পারে না। (কঠ. ১:২:৮) পরে বললেন, ‘এ বুদ্ধি তর্ক দিয়ে লাভ করা যায় না। তার্কিক নয় এমন কোনও জ্ঞানী আচার্য উপদেশ দিলে ভাল ভাবে জানা যায়, নচিকেতা তোমার সত্যজ্ঞান হয়েছে, তোমার মতো প্রশ্নকারী আমার কাছে যেন আসে। (কঠ. ১:২:৯) এখানে যম স্পষ্ট করেই বলছেন, আত্মজ্ঞান যুক্তি দিয়ে পাওয়া যায় না, যমের মতো জ্ঞানী বিচক্ষণ আচার্যের উপদেশেই শুধু পাওয়া যায়। অর্থাৎ বিদ্যাটি গুরুমুখী, যুক্তির জগতের বাইরে এর অবস্থান। এবং যেহেতু সাধারণ মানুষ তেমন আচার্যের সন্ধান পায় না, পাবে না, তাই ওই জ্ঞান সৌভাগ্যবান মুষ্টিমেয় কয়েক জনেরই ভাগ্যেই জুটবে।

এর পরে যম নচিকেতাকে বললেন, সে কাম্য বিষয় পরিত্যাগ করে এই জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে; মানুষ এ জ্ঞান লাভ করে সূক্ষ্ম আত্মাকে লাভ করে। (কঠ. ১:২:১৩) ‘সমস্ত বেদ যে-লক্ষ্যকে নির্দেশ করে, সমস্ত তপস্যা যার কথা বলে, যাকে কামনা করে মানুষ ব্রহ্মচর্য পালন করে, তোমাকে সেই লক্ষ্য সংক্ষেপে বলছি: ওম্‌ই হল তাই— সর্বে বেদা য‍ পদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি। যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি— ওমিত্যেতৎ।।’ (কঠ. ১:২:১৫) এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব: সমস্ত বেদবিদ্যা, তপস্যা, ব্রহ্মচর্য সব কিছুই একটি অক্ষরে সংগৃহীত: ওম্। এবং এর পরের দুটি শ্লোকে ওম্-এর মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে— এই একটি অক্ষরই ব্রহ্ম। এটি জানলেই যে যা চায় তা পায়, এর দ্বারা মানুষ ব্রহ্মলোকে সম্মানিত হয়। (কঠ. ১:২:১৬,১৭) এর পরের পাঁচটি শ্লোকে আত্মার লক্ষণ বর্ণিত হয়েছে: জ্ঞানে, বিদ্যায়, স্বাধ্যায়ে, মেধায় এঁকে পাওয়া যায় না, ইনি যার প্রতি দয়া করে আত্মপ্রকাশ করেন, সে-ই শুধু একে পায়। কর্মকাণ্ডে ছিল বেদশিক্ষার মহিমা, জ্ঞানকাণ্ডে এল জ্ঞানের মাহাত্ম্য, আত্মব্রহ্ম-উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা- কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে, এ সবের দ্বারা আত্মজ্ঞান হয় না। একটু আগে যে-বিচক্ষণ আচার্যের সাহায্যে আত্মজ্ঞান লাভ করার কথা শোনা গেল, সেটারও আর প্রযোজ্যতা রইল না। কারণ, সেটা ছিল প্রবচন, মেধা ও শ্রুতের অন্তর্গত এবং এখন শোনা গেল এ সবের কোনও উপযোগিতা নেই, আত্মা যার কাছে নিজেকে প্রকাশ করে কেবল সে-ই জানতে পারে। খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বে একে বলে grace এবং এর সংজ্ঞা হল grace is unmerited favour (ভগবৎকরুণা হল অনর্জিত কৃপা)। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান যুক্তি ও জ্ঞানের স্তর থেকে সরে চলে গেল রহস্যের স্তরে, কারণ আত্মা কাকে কৃপা করে তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করবে তার নির্ণায়ক আর কিছুই রইল না, সম্পূর্ণ অজ্ঞেয় ও অজ্ঞাত লোকে চলে গেল সমস্ত ব্যাপারটা।

প্রায় ভাগ্যের আয়ত্ত হয়ে উঠল আত্মজ্ঞান। ব্রহ্মের মাহাত্ম্য কীর্তন করে এই বল্লীটি শেষ হয়েছে যে-শ্লোকে তা হল ‘ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় দুই-ই যাঁর অন্ন, মৃত্যু যাঁর ব্যঞ্জন তিনি কোথায় আছেন সে-কথা কেই-বা জানে?’[১৯] অর্থাৎ সেই ব্রহ্মকে কেউই জানে না। মনে পড়ে, নচিকেতা ব্রহ্মকে জানতে আসেনি, মৃত্যুর পর কিছু থাকে কি না তা-ই জানতে এসেছিল; প্রসঙ্গত উঠল ওম্-এর মাহাত্ম্য, আত্মব্রহ্মের কথা এবং শেষ হল এই বলে যে ব্রহ্মকে কেউই জানতে পারে না। এর পরে প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় বল্লী থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় বল্লী অর্থাৎ কঠোপনিষদের শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মবিদ্যার কথা। ইন্দ্রিয়, মন, বিজ্ঞান, বুদ্ধি এবং পুরুষের কথা, এটির শেষে শুনি: ‘পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছুই নেই তিনিই চূড়ান্ত, তিনিই পরম গতি— পরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ।।’(কঠ. ১:৩:১১) ‘সমস্ত প্রাণীতে গোপন আত্মা এই পুরুষ প্রকাশিত হন না, একাগ্রতাযুক্ত সূক্ষ্মবুদ্ধির দ্বারা সূক্ষ্মদর্শীরা এঁকে দেখতে পান— এষঃ সর্বেষু ভূতেষু গূঢ় আত্মা না প্রকাশতে। দৃশ্যতে ত্বয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষদর্শিভিঃ।।’(কণ্ঠ. কঠ. ১:৩:১২) তা হলে একাগ্র সূক্ষ্মদর্শী মানুষের সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে এঁকে দেখা যায়। এখন আর ভগবৎকৃপার প্রসঙ্গ উঠছে না। বিচক্ষণ আচার্য নেপথ্যে থাকতেও পারেন। এর একটা শ্লোক পরে সেই বিখ্যাত শ্লোক: ‘ওঠো, জাগো, শ্রেষ্ঠদের কাছে গিয়ে (কিংবা বর লাভ করে) জানো, ক্ষুরের সূক্ষ্ম ধারালো অগ্রভাগের মতো তীক্ষ্ণ সেই দুর্গম পথ— উত্তিষ্ঠত জাগ্ৰত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।’ (কঠ. ১:৩:১৪) কোন্ পথ? ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথ, জেগে উঠে তা লাভ করবার জন্যে কী প্রয়োজন— শ্রেষ্ঠ আচার্য, সূক্ষ্মবুদ্ধি ও একাগ্রতা, না ভগবৎকৃপা, তার উল্লেখ নেই। পরবর্তীকালে বেদান্তে ব্রহ্মের যে-সংজ্ঞা তাতে তিনি নির্গুণ, কৃপা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। যা বলতে চেষ্টা করছি তা হল, নচিকেতার প্রশ্নটি দ্ব্যর্থহীন, স্পষ্ট, ঋজু। কিন্তু উত্তর— যদি কিছু থেকে থাকে— তা গভীর অন্ধকার অরণ্য। শংকরাচার্যের ভাষ্য এ রচনার দেড় হাজার বছরের পরের— অন্তর্বর্তীকালের সমস্ত চিন্তাচর্চার উত্তরাধিকার তার অন্তরালে নিহিত আছে, এখানে সেটা প্রযোজ্য নয়, কারণ এই যুগের চিন্তার ওপরে দুর্ভেদ্য বহু প্রলেপ পড়েছে। এর পরের শ্লোকে সর্বলক্ষণবিনির্মুক্ত ব্রহ্মকে জানলেই ‘মৃত্যুমুখ থেকে মুক্ত হওয়া যায়— নিচায্য তমৃত্যুমুখাৎ প্রমুচ্যতে।।’ (কণ্ঠ. ১:৩:১৫) নচিকেতার প্রশ্নটা কিন্তু মৃত্যুমুখ থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় কী, তা ছিল না, মৃত্যুর পরে কিছু আছে কি না, তাই ছিল। প্রথম অধ্যায়ের শেষ শ্লোকটি ‘মাহাত্ম্য’ শ্লোক, ‘মৃত্যু কর্তৃক কথিত নচিকেতার এই সনাতন উপাখ্যান বললে বা শুনলে মেধাবী ব্রহ্মলোকে সম্মানিত হন।’[২০] এটাও কিন্তু নচিকেতার প্রার্থিত বর ছিল না, এই ব্রহ্মলোকে সম্মানিত হওয়া; তাঁর প্রশ্নের সদুত্তর এখনও যম দেননি।

এর পরের বল্লীতে যম বলছেন, পণ্ডিতেরা অধ্রুব অর্থাৎ অস্থায়ী ইন্দ্রিয়সুখের জগতে ধ্রুব বা স্থায়ী সুখের খোঁজ করেন না। (কঠ. ২:১:২) যার দ্বারা সমস্ত ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা জন্মায় তা সব এঁরই দ্বারা হয়; ‘ইনিই সেই— এতদ্বৈ তৎ।’ (কঠ. ২:১:৩) এর পরেরটি বাদে পাঁচটি শ্লোকে আত্মা যে দৃশ্য-ভোগ্য জগতের বহির্ভূত, গোপন একটি সত্তা তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে; এই পাঁচটি শ্লোকের প্রত্যেকটিরই শেষে যোগ করা হয়েছে, ‘এতদ্বৈ তৎ’; অর্থাৎ কী নয়, কী হতে পারে না, সেই নেতি-নেতি প্রক্রিয়ায় আত্মার স্বরূপ ঘোষণা করা হয়েছে। ‘এখানে যা ওখানেও তা-ই, ওখানে যা এখানেও তাই, যে একে বিভিন্ন (নানা)-ভাবে দেখে সে মৃত্যু থেকে মৃত্যুই প্রাপ্ত হয়— যদেবেহ তদমুত্র তদন্বিহ। মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি।।’ (কঠ. ২:১:১০) অর্থাৎ আত্মা ও ব্রহ্মের একত্ব ঘোষণা করে বলা হল, যে এই একত্ব দেখতে পায় না সে বারংবার মৃত্যুর অধীন হয় অর্থাৎ জন্মান্তরে পুনমৃত্যু ভোগ করে। এর পরের দুটি শ্লোকে বলা হয়েছে অত্মরাত্মার আকৃতি বা আয়তন বুড়ো আঙুলের মতো (অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষঃ) এবং পরের দুটি শ্লোকের শেষেও আছে ‘এতদ্বৈ তৎ’। অর্থাৎ আত্মা পরমাত্মা, ব্রহ্ম বললে আকৃতিগত কোনও বৃহত্ত বোঝায় না। আদিম যুগে মানুষের বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুকালে প্রাণ মস্তিষ্কের ওপরের রন্ধ্র থেকে নির্গত হয়। অতএব তাকে ক্ষুদ্রায়তন কল্পনা করাই সংগত, তাই সে বুড়ো আঙুলের মতো। লোককথায় আমরা নানা দেশে যে-বুড়ো আঙুলের মতো জাদু-শিশুর কথা পড়ি, যে বড়দের মতো বা বড়দের চেয়েও বেশি শক্তির কাজ সম্পন্ন করে, এ সবই এর পেছনে ক্রিয়াশীল। আত্মা-ব্রহ্ম, যার চেয়ে শক্তিশালী আর কিছুই কল্পনা করা যায় না, তাঁর গুরুত্ব আকৃতি বা আয়তনে নয়, ঐশী বা অতিলৌকিক শক্তিতে।

দ্বিতীয় বল্লীর দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রথম, চতুর্থ ও অষ্টম শ্লোকের শেষে, এবং তৃতীয় বল্লীর প্রথম শ্লোকেও ‘এতদ্বৈ তৎ’ ধ্রুবপদটি পাই। অর্থাৎ নানা ভাবে সদর্থক ও নঞর্থক বর্ণনার দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপ উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে: ব্রহ্ম কী নয়, কী ভাবে তার সন্ধান করলে সে-চেষ্টা ব্যর্থ হবে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাইরে স্বতন্ত্র সেই দুর্জ্ঞেয় সত্তার অবস্থান প্রতি মানুষের অন্তরাত্মার মধ্যে তাঁর অধিষ্ঠান। বায়ু, অগ্নি ও সূর্য যেমন দৃষ্ট, অনুভূত হয়, কিন্তু মানুষের ইন্দ্রিয়ের বাইরে বিষয় হিসেবে তাদের স্বতন্ত্র অবস্থান, আত্মারও তেমনই। মনে রাখতে হবে, দেহবহির্ভূত আত্মা এই সময়েই দেখা দিল একটি ভাবপদার্থ হিসেবে, মানুষের অবধারণার বাইরে এর অস্তিত্ব; তাই এর স্বরূপ বোঝানো যাবে কী করে? প্রথমত, এ কী নয়, ভুল করে একে কী কী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সঙ্গে একাত্ম বলে মনে করতে পারে লোকে সেইগুলো থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র বলে একে বোঝাবার জন্যে ওই নেতি-নেতি প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্বতঃস্বরূপে আত্মা কী, তা বোঝাবার জন্যে আশপাশ থেকে এর বর্ণনা করা হয়েছে যেন আভাসে লোকে আত্মাকে বুঝতে পারে। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের বর্ণনার মধ্যে স্বভাবতই অনেক অস্পষ্টতা, অনির্দেশ্যতা আছে; কিন্তু এ ছাড়া ওই কাল্পনিক সত্তাটিকে জনসমক্ষে গ্রহণযোগ্যতারূপে উপস্থাপিত করা যেত না। এ ভাবেও যায়নি। তার অনেক প্রমাণ আছে।

প্রথমত, যে সময়ে আত্মব্রহ্ম তত্ত্ব প্রতিপাদনের চেষ্টা চলছে সে সময়ে মুষ্টিমেয় কয়েক জনকে বাদ দিলে দেশসুদ্ধ লোক অশিক্ষিত, বৃহৎসংখ্যক শূদ্র। নারী আদিবাসী এবং দরিদ্র ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনেকেই অশিক্ষিত। এদের মধ্যে বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পেটভাতায়, এদের দৈনন্দিন জীবনে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় — এরা অবসর-সময়ে নেশা করে, উৎসব করে, আলস্য যাপন করে, এবং আর যা-ই করুক দর্শনচিন্তা করে না। ফলে ওই আত্মব্রহ্মতত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় বা উৎসাহ এদের ছিল না। কোথাও যজ্ঞ হলে দূর থেকে এরা দেখত, প্রয়োজন মতো মজুর খাটত, গার্হস্থ্য জীবনে প্রাগার্য পূজাপদ্ধতি যা অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল, তাতেই এদের চলে যেত। এরা ধরেই নিয়েছিল, এদের অপার দুঃখদুর্দশা ঘোচাবার সাধ্য দেব-মানব কারুরই নেই। তবু অসহ্য হয়ে উঠলে দেবতার কাছে কেঁদে পড়ত। সে-দেবতা আর যে-ই হোন আত্মা বা ব্ৰহ্ম নয়। দ্বিতীয়ত, এই তত্ত্ব যে জনসমাজে বিস্তার লাভ করেনি তার একটা প্রমাণ, যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েই চলছিল, আর সঙ্গে সঙ্গে সমাজে প্রাগার্য প্রভাবে নানা চেহারায় পূজাও ঢুকে পড়েছিল। তৃতীয়ত, আত্মব্রহ্মতত্ত্ব নিয়ে সমাজে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা হয়ে এসেছে, এখনও হচ্ছে। এর মধ্যে খুব কম গ্রন্থকারের পরস্পরের সঙ্গে ঐকমত্য আছে। অর্থাৎ তত্ত্বটি দুরূহ, দুর্বোধ্য এবং পণ্ডিতরা একে প্রথম থেকেই বিজ্ঞজনগ্রাহ্য বলেছেন, এবং সেটি প্রমাণ করবার জন্যে নানা ভাবে ভাষায়, শব্দবিন্যাসে, অলংকারে অর্থাৎ উপমা ও রূপকে নানা ধরনের বিমূর্ত বর্ণনায়— এটিকে তাঁরা দুর্গম করে রেখেছিলেন। নচিকেতাকে তো যম স্পষ্টই বললেন, অতি সূক্ষ্ম বুদ্ধি ছাড়া এ তত্ত্ব বোঝে এমন সাধ্য কার আছে? চতুর্থত, ধরে নেওয়া যায় যে, সে সময়েও সূচ্যগ্রসূক্ষ্ম বুদ্ধি বেশ-কিছু লোকের ছিল, তারাও কিন্তু ওই সূক্ষ্মবুদ্ধির জোরে ব্রহ্মজ্ঞানে অধিকারী নয়, কারণ এ বিদ্যা তর্ক অর্থাৎ যুক্তি দিয়ে পাওয়ার নয়— নৈষা তর্কেণ মতিরাপনেয়া। তা হলে পাবে কে?

ব্রহ্ম কৃপা করে যার কাছে আত্মপ্রকাশ করবে শুধু সে-ই পাবে। আগে দেখেছি, গুণাতীত ব্রহ্মে কৃপারূপ উপাধি (লক্ষণ, বা ধর্ম) আরোপ করা অযৌক্তিক। ব্ৰহ্ম ব্যক্তি নয়, পদার্থ এবং নির্গুণ, কৃপা তিনি করবেন কেমন করে? যাই হোক, উপনিষদ যখন বলছে তখন না হয় ধরে নেওয়া গেল যে তিনি মধ্যে-মধ্যে কৃপা করে থাকেন, তখন তার প্রসাদধন্য জিজ্ঞাসু ব্যক্তি ব্রহ্মস্বরূপ জানতে পারে। শেষ প্রশ্ন থেকে যায়, সূক্ষ্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও যখন জানবার নিশ্চয়তা নেই, তখন তো আরও বেশি অনিশ্চিত ব্রহ্মকৃপা হি কেবলম্-এর পাত্র কে হবে সে-ব্যাপারটা। তা হলে পারিশেষ্যাৎ দাঁড়াল এই যে, ব্রহ্ম যার কাছে আত্মপ্রকাশ করবে ব্রহ্মজ্ঞান তারই হবে; সে যে কে আর কে নয়, এ সম্বন্ধে শাস্ত্র নীরব। কারণ বিদ্যাবুদ্ধি শিক্ষা এ সব যখন যথার্থ যোগ্যতা নয়, তখন কৃপা নেহাতই আকস্মিক হয়ে দাঁড়ায়। পরবর্তী ভাষ্যকাররা অবশ্য বলেছেন, ভোগ্য বিষয় থেকে যে ইন্দ্রিয়সমূহকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে, যে অধ্রুব জগতে ধ্রুব ব্রহ্মের সন্ধান করে না অর্থাৎ মনকে যে নির্লিপ্ত বিষয়বিমুখ করে নিয়েছে সে অনুকূল পাত্র। শাস্ত্র এ-ও বলেছে, বুদ্ধি যার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সে-ও অনুকূল পাত্র। কিন্তু শাস্ত্র এ-ও বলেছে যে এ সব সত্ত্বেও সে ব্রহ্মকৃপা না-ও লাভ করতে পারে।

তা হলে সমস্ত ব্যাপারটা রহস্যাবৃত হয়ে রইল, এবং তা-ই থাকে। শুধু ভারতবর্ষে নয় পৃথিবীর সমস্ত ধর্মতত্ত্বে। ইংল্যান্ডে ক্যাভিন প্রবর্তন করলেন প্রাক্-নিরূপণ তত্ত্ব (predestination theory) যার অর্থ, ঈশ্বর কাকে মুক্তি দেবেন কাকে দেবেন না সে-কথা মানুষের জন্মের আগেই ঠিক করা থাকে; তা হলে যে মুক্তি পাবে যেহেতু সে মুক্তি অর্জন করার মতো কোনও সৎকর্ম করেনি তা হলে তার মুক্তির হেতুও ‘ব্রহ্মকৃপা হি কেবলম্’। এমন তত্ত্ব ইসলামেও আছে, অন্য ধর্মেও আছে, এবং ঠিক এইরূপে না হলেও অন্যরূপে সর্বত্রই আছে। সাধে আর আজীবিকরা বলত, ভাল কাজই কর মন্দ কাজই কর, তাতে তোমার ভাগ্যের কোনও ইতরবিশেষ হবে না। চুরাশি লক্ষ জন্মের পরে আপনা-আপনিই আত্মা মোক্ষ লাভ করবে। এই অনির্দেশ্যতা সমস্ত ধর্মাচার্যের হাতের বেত্রদণ্ড। ভাল কাজ করে ভাল ফল না হলে ওই যুক্তি— নৈষা তর্কেণ মতিরাপনেয়া। কী হবে তা তোমার কর্মের ওপরে নির্ভর করে না, একটা অনির্দেশ্য কিছু খুব দরকার, নইলে দুই আর দুয়ে চার হয়ে যাবে। যমের সংজ্ঞা অনুসার ঐহিক সুখে নির্লোভ সূক্ষ্ম বুদ্ধিমান নচিকেতা তো ব্রহ্মজ্ঞানের আদর্শ পাত্র ছিল, যদিও সে-বেচারি ব্রহ্মজ্ঞানের জন্যে আসেনি, এসেছিল পরলোকতত্ত্ব জানবার জন্যে। তবু তাকে আত্মব্রহ্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তর জ্ঞান দেওয়া হল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাকে যোগ্যতা-লভ্য করে রাখা হল না, অনর্জিত ব্রহ্মকরুণার অন্তর্গত করে রাখা হল।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় (শেষ) বল্লীর শুরু ‘এই সনাতন অশ্বত্থের মূল ঊর্ধ্বে, শাখা নীচে, সে-ই শুক্র, সে-ই ব্রহ্ম, সে-ই অমৃত বলে অভিহিত। এই পৃথিবী তাতেই আশ্রিত, তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না। এ-ই সেই।’[২১] এখানে ব্রহ্মের নতুন এক ধরনের বর্ণনা করা হল। চিত্রকল্পটি প্রকৃতির বিরুদ্ধ, ঊর্ধ্বমূল নিম্নশাখ গাছ হয় না, কাজেই এ শ্লোকটিকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া চলবে না।

গাছের শেকড় যেখানে থাকে সেখান থেকে সে প্রাণরস আহরণ করে; এই ব্রহ্ম-অশ্বত্থ তা হলে আকাশ থেকে রস আহরণ করে? অবাশাখ মানে নীচের দিকে শাখা, আকাশের নীচে অর্থাৎ পৃথিবীতে, অতএব পরিদৃশ্যমান। অর্থাৎ ব্রহ্মের যে-অংশ দৃশ্যমান তা হল এই জগৎসংসার, এখানে গাছের শাখা, ফল, পাখির কোটর, ছায়া, আশ্রয়, সৌন্দর্য। এর মূল সুন্দরও নয়, স্পষ্ট দৃশ্যমানও নয়, কিন্তু এর সত্তার উৎস আকাশে। সেখানকার সৌন্দর্য চোখে পড়ে না, তবু আছে। মনে পড়ে উপনিষদেরই কথা, ‘কে শ্বাস নিত, কে বেঁচে থাকত যদি এই আকাশ আনন্দ না হত?— কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যোৎ যদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যা।’ব্ৰহ্মকে সনাতন বনস্পতি অশ্বত্থের সঙ্গে তুলনা করে রচয়িতা বলতে চান এর নীচেরটুকুই দেখা যায়, মূল দেখা যায় না। অর্থাৎ অন্যত্র নানা অংশে যেমন একে রহস্যাবৃত জ্ঞানের অগোচর করে রাখার প্রয়াস, এখানেও সেটা লক্ষ করা যায়। মনে পড়ে প্রাচীন নরওয়ের মহাকাব্য প্রোজ এড্ডা-তে অমনই একটি গাছের বর্ণনা আছে। Snorri Sturlusson-এর সংকলিত এই প্রাচীন গদ্য-মহাকাব্যে এবং ছন্দে রচিত এল্ডার এড্ডা-তেও Yggdrasil নামের একটি অ্যাশ্ গাছের কথা আছে।

এ দেশে অশ্বত্থ যেমন সনাতনত্বের প্রতীক ওখানে অ্যাশ্ও ঠিক তাই। প্রোজ এড্ডা-তে পড়ি :

‘পরমেশ্বরকে গাংলেরি (গিল্ফ, অসুরজাতীয় জীব) প্রশ্ন করলেন, ‘দেবতাদের প্রধান নিবাস বা পবিত্র স্থলটি কোথায়? পরমেশ্বর বললেন, ‘সেটি অ্যাশ্ ইগড্রাসিলের পাশে…. ওই বনস্পতিটি বিধৃত আছে তিনটি মূলের দ্বারা যেগুলি দূরবিসারী। একটি ঈসীর (দেবতা)দের মধ্যে, দ্বিতীয়টি কুয়াশা-দৈত্যদের মধ্যে এবং তৃতীয়টি নিহাইম্‌ (পাতাল)-এর ওপরে।… ওই অ্যাশ্ গাছটির তৃতীয় মূলটি আকাশে এবং এর মূলটি হল উর্দদের পবিত্র ঝরনা।[২২]

পরে বলা আছে, ‘বনস্পতিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল অ্যাশ্ ইগড্রাসিল্’। (পৃ. ৬৬) এল্ডার এড্ডা-য় আছে, ‘যে সব ঘোড়ায় চড়ে দেবতারা প্রত্যহ (মানুষের) ভাগ্য নির্ণয় করতে যান অ্যাশ্ ইগড্রাসিল থেকে’। (পৃ. ৬৪) শেষোক্ত বইটির শেষে সমগ্র এড্ডা সাহিত্য থেকে সংকলন করে ইড্রাসিলের যে-ছবিটি দিয়েছেন তাতে এই গাছটি স্বর্গ-মর্ত-পাতাল ব্যাপ্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। উপনিষদেও এই ব্রহ্মবৃক্ষটি চরাচর ব্যাপ্ত করে আছে; এর ঊর্ধ্বে দেবলোক, মধ্যে নরলোক, নীচে পাতাল। এর থেকে মনে হওয়া সম্ভব যে ইন্দো-ইউরোপীয় যুগের কিছু মনীষীর মনে হয়েছিল, এমনই একটি বৃক্ষের আকারে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ শক্তি রূপ পরিগ্রহ করেছে। এ দেশে অশ্বত্থ যেমন সনাতনত্বের প্রতীক, উত্তর ইউরোপে অ্যাও তাই, তার থেকেই প্রথম নরনারীর সৃষ্টি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নচিকেতার পরলোক সম্বন্ধে প্রশ্নের উত্তরে এই ব্রহ্মবনস্পতির অবতারণার হেতু কী। এর পরের শ্লোকেই একে চরাচরের সৃজনীশক্তি বলা হয়েছে এবং তার পরে সেই শ্লোকটি তৈত্তিরীয় উপনিষদেও আছে: ‘এর ভয়ে অগ্নি তাপ দেয়, সূর্য তাপ দেয়, এর ভয়ে ইন্দ্র, বায়ু এবং পঞ্চম মৃত্যু ধাবিত হয়।’[২৩] কোনও শক্তির মহিমা-কীৰ্তন করতে হলে তাকে ভয়াবহ করে তোলা একটি পরিচিত প্রক্রিয়া; কিন্তু এখানে ভয় পায় কারা? পৃথিবীর নিয়ামক শক্তিগুলি: অগ্নি, সূর্য ও বায়ু; এ ছাড়া দেবরাজ ইন্দ্র এবং মৃত্যু। অর্থাৎ প্রাকৃতিক শক্তিগুলির চালনা করেন ব্রহ্ম; দেবতারাও যে এর অধীন তা দেখাবার জন্যে ইন্দ্রের নাম করা হয়েছে। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। (লক্ষণীয় ইগড্রাসিল সম্বন্ধেও বলা হয়েছে, এটি দেবতাদের পীঠস্থান (পৃ. ৪২)। এর পরের অংশটিই নচিকেতার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত: মৃত্যু ধাবিত হয় ব্রহ্মের ভয়ে। ভয় কীসের? বিশ্বচরাচরে যে ঋত ক্রিয়াশীল বলে তার সমস্ত প্রকাশ নিয়মানুবর্তী, তার ব্যত্যয় হওয়ার ভয়। অতএব মৃত্যু স্বেচ্ছাচারী নয়, ব্রহ্মের নির্দেশেই সক্রিয়। অতএব কোথাও যেন এতে একটা আশ্বাস আছে, বেহিসেবি, বেনিয়মে কিছুই হওয়ার নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নচিকেতা এ আশ্বাসের সন্ধান করেনি, সে ধরেই নিয়েছিল যমের ইচ্ছা হলে পরমায়ু শেষ হয়— জীবিষ্যামি যাবদীশিষ্যসি ত্বম্। (কঠ. ১:১:২৭)। তার পরের শ্লোকেই বলা হয়েছে, ‘এই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পূর্বে যার মৃত্যু হয় সে আবার সৃষ্টির ভূমিতে শরীর নিয়ে আসে— ইহ চেদশকদ্বোদ্ধুং প্রাক্ শরীরস্য বিস্রসঃ। ততঃ সর্গেষু লোকেষু শরীরত্বায় কল্পতে।।’ (কঠ. ২:৩:৫)

একটা হদিস পাওয়া গেল মরণোত্তর অবস্থা সম্বন্ধে: ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করবার পূর্বে মৃত্যু হলে পুনর্জন্ম হয়। এ বার প্রশ্ন ব্রহ্মজ্ঞানের ‘আয়নায় যেমন প্রতিবিম্ব দেখা যায়, বুদ্ধিতে তেমনই আত্মার দর্শন লাভ করা যায়। স্বপ্নে যেমন দর্শন তেমনই পিতৃলোকে, জলে যেমন তেমন গন্ধর্বলোকে; ব্রহ্মলোকে আলো ও ছায়ার মতো স্পষ্ট করে (দেখা যায়)’।[২৪] স্পষ্টতই এটি কোনও অসংশয়িত উত্তর নয়। সূর্য ও ছায়ার মতো স্পষ্ট আত্মদর্শন বললে সত্যিই কিছু বোঝায় না, ব্রহ্মলোকে তত্ত্বগত ভাবে আত্মদর্শন হওয়ারই কথা নয়, আত্মা ও ব্রহ্মের একত্ব সাধিত হয় মাত্র। গন্ধর্বলোক বলতে পরবর্তী টীকাকাররা দেবলোক অর্থ করছেন; স্পষ্টই বোঝা যায় এক সারি অনেকান্ত উপমা ব্যবহার করা হয়েছে ব্রহ্মলোকের উৎকর্ষ বোঝাতে। আগের শ্লোকে বলা হল, এ জীবনে ব্রহ্মজ্ঞান না হলে জন্মান্তর হয়, অর্থাৎ আভাসে বলা হল এখানে, আলো ও ছায়ার মতো পৃথক করে দেখা যায়। দেখবার পরে কী হয় বলা হয়নি।

পরের তিনটি শ্লোকে শুনি ইন্দ্রিয়গুলির উৎপত্তি জেনে পণ্ডিত শোক ত্যাগ করেন, ইন্দ্রিয়ের ওপারে মন, মনের পরে সত্ত্ব, তার পরে মহান আত্মা ও মহতের পরে অব্যক্ত, অব্যক্তের পরে পুরুষ, ব্যাপক এবং লিঙ্গহীন ‘যাঁকে জেনে জীব মুক্ত হয় ও অমৃতত্ব পায়— যং জ্ঞাত্বা মুচ্যতে জন্তুরমৃতত্বম্ চ গচ্ছতি।।’(কঠ. ২:৩:৮) এই অমৃতত্ব কী তা কখনও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। অমর আত্মার রূপ চোখে দেখা যায় না; মনে মনীষার দ্বারা প্রকাশিত হন আত্মা; ‘যারা এটা জানে তারা অমৃত হয়— য এতদ্বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি।।’ (কঠ. ২:৩:৯) মন যখন ইন্দ্রিয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, বুদ্ধি ক্রিয়াহীন হয় তাকেই পরম গতি বলা হয়। (কঠ. ২:৩:১০) এই অবস্থাকেই যোগ বলে, ইন্দ্রিয়ধারণা তখন স্থির, (মানুষ) তখন অপ্রমত্ত, যোগের উৎপত্তি বিনাশ আছে— যখন হৃদয়ের গ্রন্থিগুলি ছিন্ন হয়, তখন মর্ত্যমানুষ অমৃত হয়, এই হল অনুশাসন (কঠ. ২:৩:১৪)। হৃদয় থেকে নিঃসৃত একশোটি নাড়ির মধ্যে একটি ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে বেরিয়ে গেছে, সেই ঊর্ধ্বে নিষ্ক্রান্ত নাড়ি অবলম্বনে অমৃতত্ব লাভ করা যায়। বাকিগুলির দ্বারা অন্য দিকে গতি হয় (কঠ. ২:৩:১৬)। বুড়ো আঙুলের আয়তন পুরুষ হল অন্তরাত্মা, সর্বদা মানুষের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট থাকেন। মুঞ্জঘাস থেকে যেমন তার শিসটা ছিঁড়ে নেওয়া হয় সেই ভাবে ধৈর্য ধরে ওই অন্তরাত্মাকে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, তাকে শুক্র ও অমৃত বলে জানবে (কঠ, ২:৩:১৭)। দ্বাদশ শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘পরমাত্মাকে বাক্য দিয়ে জানা যায় না, মন বা চক্ষু দিয়েও নয়, যারা আত্মা সম্বন্ধে ‘আছে’ এই কথা বলে, (তারা জানে) তা ছাড়া অন্য কোনও ভাবে একে জানা যায়?’[২৫] পরে (আত্মাকে) ‘আছে’ বলে উপলব্ধি করতে হবে সগুণ ও নির্গুণ বা সোপাধিক ও নিরুপাধিক দু ভাবেই ‘আছে’ বলে উপলব্ধি করলে পরে তবেই তা যথার্থত প্রসন্ন হবে (অর্থাৎ আত্মপ্রকাশ করবে)।[২৬] এ দুটি শ্লোকে কিন্তু কঠোপনিষদের একেবারে প্রথমে যমের প্রতি নচিকেতার যে-প্রশ্ন তারই যেন প্রচ্ছন্ন উত্তর দেওয়া হচ্ছে।

নচিকেতা বলেছিল, ‘মৃত্যুর পরের অবস্থা নিয়ে এই যে সংশয়, কেউ কেউ বলে (মৃত্যুর পরে) কিছু থাকে আবার অনেকে বলে কিছুই থাকে না, এ সম্বন্ধে আপনি আমাকে বলুন।’ (কঠ. ১:১:২০) এতক্ষণে যেন যম প্রকারান্তরে, সে-প্রশ্নের উত্তর দিলেন, যারা আত্মাকে ‘আছে’ বলে জানে তারাই জানে, অন্য কোনও ভাবে জানা যায় না। কিন্তু এ কি উত্তর? এ তো নচিকেতার প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া। যারা ‘আছে’ বলে জানে, নচিকেতার প্রশ্নের অর্ধাংশ তারা, যারা ‘নেই’ বলে জানে? তাদের সম্বন্ধে যম বললেন তাদের কোনও মতেই আত্মজ্ঞান হবে না কারণ একমাত্র ‘আছে’ বলে উপলব্ধি করলেই জানা যায় আত্মাকে। ইংরেজিতে যাকে বলে auto-suggestion (নিজেকে বলে বলে বিশ্বাস করানো) এ তো তাই। মুশকিল হল, যমের দাবি এর চেয়েও বেশি— যারা ‘আছে’ বলে উপলব্ধি করে; উপলব্ধি করাটা তো মানুষের হাতে নেই। মন, চক্ষু, বাক্য দিয়ে জানা যায় না, ‘আছে’ বলে উপলব্ধি করলেই তার জ্ঞান পাওয়া যায়, ইংরেজিতে একে বলি begging the question। উপলব্ধি ছেলের হাতের মোয়া নয়, ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায় না; সূচ্যগ্রবুদ্ধি, প্রভূত বিদ্যা উপযুক্ত আচার্য, জ্ঞান বা মনস্বিতার দ্বারাও পাওয়া যায় না। বুদ্ধির জগতের বাইরে অনুভবের জগতে উপলব্ধি, চেষ্টা করেও পাওয়ার নয়। তা হলে শেষ পর্যন্ত ওই দৈবকৃপাতে এসে ঠেকছে, যদিও এ দুটো শ্লোকে সে-কথা বলেনি। কিন্তু এমন ভাবে বলা হয়েছে যেন উপলব্ধি করা মানুষের সাধ্যের বা আয়ত্তের মধ্যে। সংশয়ীকে যম তার আলোচনার পরিধি থেকে সম্পূর্ণ বাদ দিলেন, অথচ সংসারে সৎ, বিবেকী, যথার্থ সংশয়ী মানুষ আছে। সংশয় যাদের আত্মপ্রতারণা নয়, সংশয় যাদের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা, তাঁদের কোনও গতি যমের বিধানে নেই। যে সংশয়ী তাকে পুরো হিসেবের বাইরে রাখা হল যেন সে ইচ্ছে করেই বিশ্বাস করছে না, বিশ্বাস করতে পারছে না বলে নয়।

শেষ শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘মৃত্যুর দ্বারা কথিত এই বিদ্যা ও সমগ্র যোগবিধি লাভ করে নচিকেতা ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হল, রজোগুণ থেকে এবং মৃত্যু থেকে মুক্ত হল, অন্য যে-কোনও অধ্যাত্মবিদও এই অবস্থা লাভ করে।’[২৭] এক অর্থে নচিকেতার প্রশ্নের চেয়ে বেশি উত্তর দেওয়া হল: আত্মার বিভিন্ন পরিণতি এবং সেগুলির নির্ণায়ক কর্মের কথা বলা হল। এ সব সম্বন্ধে তখনকার জনমানসে উদগ্র জিজ্ঞাসা ছিল; মৃত্যুর পরে সত্যিই কিছু থাকে কি না, থাকলে তার লক্ষণ কী, পরিণতি কী, এ পরিণতি কি মানুষ কোনও ভাবে নিরূপণ বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? এই সব প্রশ্নের উত্তর যম দিয়েছেন, বাড়তি অনেক তথ্যও জানিয়েছেন। সে-যুগে যেটি নতুন তথ্য তা হল ইন্দ্রিয়যুক্ত মানুষের প্রকৃত সত্তা তার দেহ নয়, দেহাতীত যে আত্মা সেই আত্মাই অমর। মৃত্যুর পরে এ জন্মের কর্ম অনুসারে তার দু’ রকম গতি হতে পারে: পিতৃযান যাতে নানা পথ ঘুরে বারবার জন্মাতে হয়, অন্তিমে জন্মান্তর-ধারা থেকে মুক্তি ঘটে। দ্বিতীয় পন্থাটি হল দেবযান, সে-ও এ জন্মের কর্ম দ্বারা নিরূপিত হয়, সে-পথে মৃত্যুর পরে আত্মা কিছু পথ ঘুরে সূর্যের পথ ধরে মোক্ষ প্রাপ্ত হয় বা তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা ব্রহ্মে লীন হয়। এর মধ্যে প্রচলিত লোকবিশ্বাসও স্থান পেয়েছে, যেমন মৃত্যুকালে বুড়ো আঙুলের মাপের আত্মা মাথার খুলি ভেদ করে নির্গত হয়। আধ্যাত্মিক স্তরে আত্মার বিস্তার অনন্ত, কিন্তু এই ক্ষুদ্র মানবদেহে সেই বিপুল আত্মা কেমন করে বাস করে? স্বভাবতই, আত্মার সঙ্গে নতুন এই পরিচয়ের যুগে এ সব প্রশ্ন মানুষের মনে উঠবেই, তাই নচিকেতার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যম এ-জাতীয় নানা প্রশ্নের উত্তর দিলেন।

***

১. উশন্ হ বৈ বাজশ্রবসঃ সর্ববেদসং দদৌ। তস্য হ নচিকেতা নাম পুত্র আস।। (মুণ্ডক. ১:১)

২. তং হ কুমারং সন্তং দক্ষিণাসু নীয়মানাসু শ্রদ্ধা বিবেশ, সোহমন্যত।। পীতোদকা জগ্ধতৃণা দুগ্ধদোহা নিরিন্দ্রিয়াঃ। অনন্দা নাম তে লোকাস্তান্ স গচ্ছতি তা দদাৎ।। (কঠ. ১:১:২-৩)

৩. স হোবাচ পিতরং তত, কস্মৈ মাং দাস্যতীতি। দ্বিতীয়ং তৃতীয়ং তং হোবাচ মৃত্যুবে ত্বা দনানীতি।। (কঠ. ১:১:৪)

৪. বহুনামেমি প্রথমো বহুনামেমি মধ্যমঃ। কিং স্বিদ্ যমস্য কর্তব্যং যন্ময়াদ্য কবিষ্যতি।। (কঠ. ১:১:৫)

৫. অনুপশ্য যথা পূর্বে প্রতিপশ্য তথা পরে। সস্যমিব মর্ত্যঃ পচ্যতে শস্যমিবাজায়তে পুনঃ।। (কঠ. ১:১:৬)

৬. বৈশ্বানরঃ প্রবিশত্যতিথি ব্রাহ্মণো গৃহান্। তস্যৈতাং শান্তিং কুর্বন্তি হর বৈবস্বতোদকম্।। (কঠ. ১:১:৭)

৭. আশাপ্রতীক্ষে সঙ্গতং সুনৃতাং চেষ্টাপূর্তে পুত্ৰপশুংশ্চ সর্বান্। এতদ্বৃত্তে পুরুষস্যাল্পমেধসো যস্যানশন্ * বসতি ব্রাহ্মণো গৃহে।। (কঠ. ১:১:৮)

৮. তিস্রো রাত্রীর্যদবাসীগৃহে ম্যেনশন্ ব্রহ্মন্নতিথিনমস্যঃ। নমস্ত্যেস্তু ব্রহ্মন্ স্বস্তিমেহস্তু তস্মাৎ প্রতি ক্ৰীন্ বরান্ বৃণীম্ব।। (কঠ. ১:১:৯)

৯. স্বর্গে লোকে ন ভয়ং কিঞ্চনাস্তি ন তত্র ত্বং ন জরয়া বিভেতি। উভে তীত্বাশনায়াপিপাসে শোকাতিগো মোদতে স্বৰ্গলোকে।। স ত্বমগ্নিং স্বর্গ্যমধ্যেষি মৃত্যো প্ৰৱুহি ত্বং শ্রদ্দধানায় মহ্যম্ স্বর্গলোকা অমৃতত্বং ভজন্ত এতদ্বিতীয়েন বৃণে বরেণ।। (কঠ. ১:১:১২-১৩)

১০. প্র তে ব্রবীমি তদু মে নিবোধ স্বর্গমগ্নিং নচিকেতঃ প্রজানন্ অনন্তলোকাপ্তিমথো প্রতিষ্ঠাং বিদ্ধি ত্বমেত নিহিতং গুহায়াম্।। (কঠ. ১:১:১৪)

১১. লোকদিমগ্নিং তমুবাচ তস্মৈ যা ইষ্টকা যাবতীবা যথা বা। স চাপি তং প্রত্যবদদ্ যথোক্তমথাস্য মৃত্যুঃ পুনরেবাহ তুষ্টঃ।। তমব্রবীৎ প্রীয়মাণে। মহাত্মা বরং তবেহাদ্য দদামি ভুয়ঃ। তবৈব নান্না ভবিতায়মগ্নিঃ সৃঙ্কাং চৈমামনেকরূপাহং গৃহাণ।। (কঠ. ১:১:১৫,১৬)

১২. যেয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে অস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে। এতদ্বিদ্যামনুশিষ্টস্ত্বয়াহং বরাণামেষ বরস্তুতীয়ঃ।। (কঠ. ১:১:২০)

১৩. দেবৈরত্রাপি বিচিকিৎসিতং পুরা ন হি সুবিজ্ঞেয়মগুরেষ ধর্মঃ। অন্যং বরং নচিকেতো বৃণী স্ব মা মোপরোসীরতি মা সৃজৈনম্।। (কঠ. ১:১:২১)

১৪. দেবৈরত্রাপি বিচিকিৎসিতং কিল ত্বং চ মৃত্যো যন্ন সুজ্ঞেয়মাখ। বক্তা চাস্য ত্বাদ্‌গন্যো ন লভ্যো নান্যো বরস্তল্যো এতস্য কশ্চিৎ।। (কঠ. ১:১:২২)

১৫. শতায়ুষঃ পুত্রপৌত্রান্, বৃণীত্ব বহুন্ পশূন্ হস্তিহিরণ্যমশ্বান্। ভূমেমহদায়তনং বৃণীত্ব স্বয়ং চ জীব শরদঃ যাবদিচ্ছসি।। এতত্তুল্যং যদি মন্যসে বরং বৃণীম্ব বিত্তঃ চিরজীবিকাং চ। মহাভূমৌ নচিকেতত্ত্বমেধি কামনা ত্বা কামভাজং করোমি।। যে যে কামাঃ দুর্লভ মর্ত্যলোকে সর্বান্ কামাংশ্ছন্দতঃ প্রার্থয়স্ব। ইমা রামা সরথা সতূর্যা ন হীদৃশা লম্ভনীয়া মনুষ্যৈঃ আভির্মৎপ্রত্তাভিঃ পরিচারয়স্ব নচিকেতো মরণং মানুপ্ৰাক্ষীঃ।। (কঠ. ১:১:২৩-২৫)

১৬. শ্বোবাবা মর্ত্যস্যঃ যদন্তকৈত‍ সর্বেন্দ্রিয়াণাং জরয়ত্তি তেজঃ। অপি সর্বং জীবিতমল্লমেব তবৈব বাহা তব নৃত্যগীতে।। ন বিত্তেন তৰ্পণীয়ো মনুষ্যো লপ্স্যামহে বিত্তমদ্রাক্ষ্ম চেৎ ত্বা। জীবিষ্যামি যবদীশিষ্যসি ত্বং বরস্তু মে বরণীয়ঃ স এব।। (কঠ. ১:১:২৬,২৭)

১৭. অজীর্যতানমৃতানামুপেত্য জীন্ মর্ত্যঃ ক্বধঃস্থ প্রজানন্। অভিধ্যায়ন্ বর্ণরতিপ্রমোদান্ অতিদীর্ঘে জীবিতে কো রমেত। যস্মিন্নিদং বিচিকিৎসন্তি মৃত্যে যৎ সাম্পরায়ে মহতি রুহি নস্তৎ। যোহয়ং বরো গূঢ়মনুপ্রবিষ্টা নান্যং তস্মান্নচিকেতা বৃণীতে।। (কঠ. ১:১:২৮,২৯)

১৮. অয়ং লোকো নাস্তি পর ইতি ‘মানী পুনঃ পুনবশমাপদ্যতে মে।। (কঠ. ১:২:৭)

১৯. যস্য ব্ৰহ্ম চ ক্ষত্ৰং চ উভে ভবতি ওদনঃ। মৃত্যুর্যস্যোপসেচনং ক ইখা বেদ যত্ৰ সঃ।।

২০. নাচিকেতমুপাখ্যানং মৃত্যুপ্রোক্তং সনাতনম্ উক্ত্বা শ্রুত্বা চ মেধাবী ব্রহ্মলোকে মহীয়তে।। (কঠ. ১:৩:১৬)

২১. ঊর্ধ্বমূল্যোহবাকশাখ এষোহশ্বত্থঃ সনাতনঃ। তদেব শুক্রং তদ্বুহ্ম তদেবামৃত মুচ্যতে। অস্মিল্লোকাঃ শিতাঃ সর্বে তদু নাত্যোতি কশ্চন। এতদ্বৈ তৎ।। (কঠ. ২:৩:১)

২২. ‘Gylf Gangleri asked the High One where is the chief place or sanctuary of the gods? The High One replied ‘It is by the ash Yggdrasil… The tree is held in position by three roots that spread far out: one is among the Aesir the second among the frost ogres…the third extends over Niflheim… The third root of the ash tree is in the sky, and under the root is the sacred spring of Urd.’- The Prose Edda, pp. 44-45

২৩. ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূর্যঃ। ভয়াদিন্ত্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুধাবতি পঞ্চমঃ।। (২:৩:৩) তৈত্তিরীয় উপনিষদ (কঠ. ২:৮:১)

২৪. যথাদর্শে তথাত্মনি, যথা স্বপ্নে তথা পিতৃলোকে। যথাঙ্গু পরী দদৃশে তথা গন্ধর্বলোকে ছায়াতপয়োরিব ব্ৰহ্মলোকে।। (কঠ, ২:৩:৫)

২৫. নৈব বাচা ন মনসা প্রাপ্তং শক্যো ন চক্ষুষা। অস্তীতি ৱুবতো্য ন্যত্র কথং তদুপলভ্যতে।। (কঠ. ২:৩:১২)

২৬. অস্তীত্যেবোপলব্ধব্যস্তত্ত্বভাবেন চোভয়োঃ। অস্তীত্যেবোপলব্ধস্য তত্ত্ব-ভাবঃ প্রসীদতি।। (কণ্ঠ. ২:৩:১৩)

২৭. মৃত্যুপ্রোক্তাং নচিকেতোহথ লব্‌ধ্বা বিদ্যামেতাং যোগাবধিং চ কৃৎস্নম্। ব্রহ্মপ্রাপ্তো বিরজোহভূদ্বিমৃত্যুরন্যোহপ্যেবং যো বিদধ্যাত্মমেব।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *