০৬. জিজ্ঞাসা ও সংশয়

জিজ্ঞাসা ও সংশয়

এই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের চাওয়ার চেহারা বদলে গেল। বর্তমান জীবনের অভিজ্ঞতা সুখের নয়, কাজেই একশো বছর বাঁচা মানে একশো বছর মালিক-মহাজনের কাছে লাথিঝাঁটা খাওয়া। সে-বাসনা সাধারণ মানুষের কেন হবে? তাই স্বভাবতই সে চাইবে এ যন্ত্রণা এ জন্মেই শেষ হোক। জন্মান্তর যদি থাকেও তবু তা কাম্য নয়, তার থেকে ছুটি পাওয়াই কাম্য। এই পরিস্থিতিতে শাস্ত্রকাররা প্রতিকার বাতলে দিল: ‘ছুটি চাও? মুক্তি, মোক্ষ? তা তো পেতেই পার যদি বাস্তব জীবনে ধ্যানে একাগ্র ভাবে অনুভব করতে পার, যে তুমি নিজেকে যা অনুভব করছ সে আসল তুমি নও। আসল তুমি ব্রহ্মস্বরূপ। এইটি উপলব্ধি করলেই জন্মান্তর থেকে ছুটি।’ লক্ষণীয়, এ যুগে বৌদ্ধ, জৈন, ব্রাহ্মণ্য, আজীবিক সকলেই মোক্ষের বিধান দিচ্ছে। আজীবিক বলছে, তোমার করবার কিছু নেই, যাই কর না কেন চুরাশি লক্ষ বার তোমাকে জন্মাতে হবে। সে সব জন্মে পাপই কর আর পুণ্যই কর, চুরাশি লক্ষ বারের পরে আপনা-আপনিই জন্মমৃত্যুর শৃঙ্খল খসে যাবে। জৈন, বৌদ্ধরা ধ্যানে, মননে নৈতিক জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়েছে, সেগুলি যথাযথ ভাবে পালন করলে নির্বাণ বা মুক্তি মিলবে।

তা হলে কর্মকাণ্ড থেকে জ্ঞানকাণ্ডে এসে দেখছি জীবনের উদ্দেশ্য এবং সে উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায় দুই-ই বদলে গেছে। এটা অনিবার্যই ছিল। এই পৃথিবীতে দীর্ঘকাল সুখে, স্বাস্থ্যে, সমৃদ্ধিতে বেঁচে থাকার পথে যা বিঘ্ন তা মোচন করার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছিল কর্মকাণ্ড অর্থাৎ যজ্ঞ। পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত জ্যোতিষ্টোম, ইত্যাদি কিছু কিছু ছোটখাটো যজ্ঞের ফল হচ্ছে স্বর্গলাভ, এমন কথা থাকলেও সে সব যজ্ঞ কখনও প্রাধান্য পায়নি। সুখে দীর্ঘকাল পৃথিবীতে থাকার জন্যেই সব যজ্ঞ। ঋগ্বেদ-যজুর্বেদের প্রথম অংশে এই ছিল জীবনের লক্ষ্য। আমরা দেখেছি, এ যুগের মানুষের মনে নানা সংশয় ছিল, দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যে ইন্দ্র তিনি যে আসলে নেই, এমন কথাও ঋষিরা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন। যজ্ঞ, নৈবেদ্য, প্রক্রিয়া এ সব নিয়ে সৃষ্টি, দেবতাদের অস্তিত্ব এ সব নিয়ে বহু প্রশ্ন প্রথম শ-তিনেক বছরের মধ্যেই উচ্চারিত হয়েছে। তবু এ ছিল সমাজের আভ্যন্তরীণ সংশয়, সমাজের মধ্যেই অন্তর্নিহিত। কিন্তু সংশয় সংক্রামক: শ-তিনেক বছরের মধ্যেই এ সংশয় যে ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ হল খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের মধ্যেই বহু সংশয়ী মানুষ সমাজের বিধিবন্ধন উপেক্ষা করে বাইরে চলে গিয়ে নানা মত ও দল তৈরি করে। এবং সংশয় সংক্রামক বলেই এ সব দলে সমমতাবলম্বী লোক বহু সংখ্যায় যোগ দিয়েছিল। যজ্ঞ করতে হয় না, ফলমূল সংগ্রহ করে, ভিক্ষা করে দিনাতিপাত করত এরা, বেদের প্রামাণ্যতা, যজ্ঞের উপযোগিতা, পরলোক, ইত্যাদি নিয়ে এরা সন্দিহান ছিল, যদিও জন্মান্তরে এদের বিশ্বাস ছিল। যজ্ঞ করে পরজন্মের জীবনটাকে সুখিতর বা পূর্ণতর করবার কোনও আশ্বাস নেই বলে যজ্ঞে এরা আরও বেশি উদাসীন হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া যজ্ঞ করে যা পাওয়ার কথা তাও কদাচিৎ, কাকতালীয়বৎ মেলে। ফলে সমগ্র কর্মকাণ্ডে এদের অনীহা। তবু এরা বেঁচে রইল; সর্পাঘাতে মরল না, বজ্রপাতেও না। এবং, মূলত এদের এই ভাল ভাবে বেঁচে থাকাটাই ব্রাহ্মণ্য সমাজের প্রতি একটা প্রতিস্পর্ধা, যার উদ্ভব কিন্তু সন্দেহে।

সমাজে তখন দু-ধরনের ধর্মাচরণ চলিত ছিল, বেদনিষ্ঠ এবং বেদবিরোধী। এ দুটি মতের অন্তর্নিহিত বিরোধে একটা আততি (tension) তৈরি হয়েছিল: দু-দিকে দুটি সম্ভাবনা, এবং দুটিই সমান কার্যকর, দুটি মতের লোকেরাই বেঁচেবর্তে আছে। এই দোলাচলতা সত্ত্বেও যজ্ঞ আরও বেশ কয়েক শতাব্দী চলেছিল কারণ প্রথম সংকট মোচনের ওই একটি সর্বজনগ্রাহ্য পন্থাই মানুষ জানত এবং বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে তার অনুষ্ঠান করতে তারা অভ্যস্ত। দ্বিতীয়ত, যেমন সংকটের সংখ্যা ও প্রকারভেদের সংখ্যা বাড়ছিল তেমনই পুরোহিতদের উদ্ভাবিত যজ্ঞের সংখ্যা ও প্রকারভেদও বাড়ছিল, কাজেই ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্তর্ভুক্ত মানুষ প্রাচীন যজ্ঞ নিষ্ফল হলে নতুন যজ্ঞ সফল হতে পারে এমন আশা করার একটা ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছিল, ফলে যজ্ঞানুষ্ঠান অব্যাহত ছিল। তা ছাড়া ধনী যজমানের সমাজে আত্মপ্রচারের ও আত্মপ্রতিষ্ঠার একটা উপায় ছিল ধুমধাম করে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করা। সাধারণ মানুষ সর্বদেশে সর্বকালে জাঁকজমক ও ধুমধামে আকৃষ্ট ও অভিভূত হয়। অতএব, বৈদিক যুগের শেষ পর্বে যখন দেশে উৎপাদন ও বাণিজ্য এবং বিদেশের সঙ্গে বহির্বাণিজ্যে সম্পদ বাড়ছিল এবং রাজা, রাজন্য, ক্ষত্রিয় এবং বণিক বৈশ্যের হাতে সম্পত্তি পুঞ্জীভূত হচ্ছিল তখন সম্পত্তিমানের নিত্যসঙ্গী ধননাশের আশঙ্কা কিম্বা অকালে প্রাণ হারানোর, বিদেশে বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ও ত্রাস বাড়ছিল। অতএব এ সব সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে পুরোহিতরা নিয়মিত নিত্যনতুন যজ্ঞ উদ্ভাবন করে চলেছিল। তাতে ফল হোক বা না হোক, সাময়িক একটা নিরাপত্তাবোধ আসে, কল্পিত দৈব অভিভাবকের হাতে আসন্ন বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার দায়িত্ব সম্পন্ন করার একটা নিশ্চিন্ততা পাওয়া যায়— সেও একটা ফল, যার জন্য যজ্ঞবিধির পরমায়ু দীর্ঘায়িত হয়েছিল, যদিও তার বিশ্বাসের ভিত্তি টলে গিয়েছিল অনেক আগেই।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের অনেক আগেই আর্য-প্রাগার্য অন্তর্বিবাহের ফলে যে মিশ্র জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয় তার মধ্যে যজ্ঞের পাশাপাশি প্রাগার্যদের মধ্যে চালু পূজাও ধীরে ধীরে স্থান পেয়েছিল। প্রাগার্যদের মধ্যে প্রচলিত উপাসনা দু-ভাবে আর্যধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়। প্রথমত, বেশ-কিছু আঞ্চলিক প্রাগার্য দেবতা শেষ দিকের যজ্ঞে আর্য দেবমণ্ডলীতে স্থান পায়। এরা পূর্বতন আর্য দেবতার পাশাপাশি রইল এবং আর্য প্রণালীতে অনুষ্ঠিত যজ্ঞে হব্য পেতে লাগল। অর্থাৎ এরা বিধিমতে আর্য দেবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। দ্বিতীয়ত, আর্য যজ্ঞের পাশাপাশি প্রাগার্য পূজাপদ্ধতিও সমাজে স্থান পেল এবং দীর্ঘকাল ধরে এ দুটি উপাসনা-পদ্ধতি যুগপৎ চালু ছিল। যজ্ঞে পদ্ধতিগত ভাবে যে সব সন্দেহ ছিল পূজায় তার একটা বিকল্প সমাধান দেখা দিল, কিন্তু পূজাও তো নিয়মিত ফল দেয় না, তাই জনমনে সন্দেহের ক্ষেত্র আরও প্রশস্ত হল।

এই যুগে, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের শেষ ভাগ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত, দেশের ধর্মীয় বাতাবরণ অত্যন্ত অস্বচ্ছ, জটিল ও সংশয়সংকুল। বর্ণবিভক্ত সমাজ তো খ্রিস্টপূর্ব দশম শতক থেকেই ছিল; যজুর্বেদের সময় থেকে ধীরে ধীরে বর্ণের স্থানে দেখা দিল জাতি— বর্ণ ছিল চারটি, জাতি হল অগণ্য। বৃত্তিভেদে এবং অন্তর্বিবাহে এগুলি চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছিল, আর তার সঙ্গে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত গ্রিক, পারদ, পহ্লব, কুষাণ, শক, হূন, প্রভৃতি নানা বিজাতীয় আক্রমণকারীদের সমাজে স্থান দিতে হওয়ায় সমস্ত পরিস্থিতিটা অনেক জটিল ও পরিবর্তনশীল হয়ে রইল। জাতিভেদ সম্বন্ধে একটা অনুচ্চারিত সংশয় নিশ্চয়ই জনমনে প্রবল ভাবেই বিদ্যমান ছিল, সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়কে অনিবার্য গতিতে অবদমিত ও অবনমিত করা হচ্ছিল শুধু ব্রাহ্মণ ও রাজন্যের মহিমা বৃদ্ধি করার জন্যে। সম্পদশালী কৃষক ও ধনী বণিক হিসাবে সমাজে কিছু বৈশ্য বিত্ত-কৌলীন্য অর্জন করেছিল। বাকি নির্ধন বৈশ্য হয়ে সমাজে ক্রমেই নেমে যাচ্ছিল।

শূদ্র চাষও করত, শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করত, গোপালন করত এবং ধনীর গৃহদাসও ছিল, কিন্তু তার গুণ, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সমাজে তার স্থান ছিল সকলের পায়ের তলায়। এখানে সমাজব্যবস্থার অন্তর্নিহিত নৈতিক অবিচার সম্বন্ধে শূদ্র সন্দিহান না হয়েই পারে না। আর শুধু কি শূদ্র? বিনাযোগ্যতায় সমাজে প্রাচুর্য ও সমাদর ভোগ করত যারা তারাই কি মনে মনে বুঝত না যে এ ব্যবস্থা অন্যায়ের ওপরে প্রতিষ্ঠিত। শূদ্রের স্থান এমন নীচে এবং সাধারণ ভাবে অসংগঠিত ছিল বলেই সমবেত ভাবে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য তার ছিল না। তাই জাতিভেদের নৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে শূদ্রের সংশয় বা প্রতিবাদ তেমন ভাবে উচ্চারিত হতে পারেনি। তা হলে আমরা কীসের ভিত্তিতে অনুমান করছি যে সামাজিক ন্যায়বিধানে বঞ্চিত শূদ্র সন্দেহ করত, প্রতিবাদ করত? আমাদের এ অনুমানের যথেষ্ট দৃঢ় ভিত্তি আছে: প্রথমত সাহিত্যে গুহক, শম্বুক, ইত্যাদি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দু-চারটি নজির আছে। আর আছে শাস্ত্রের অন্যায় বিধান, শূদ্র সম্বন্ধে যা যুগের গতিতে কঠোরতর এবং নিষ্ঠুরতর হয়ে উঠেছিল— সেটা এতটাই যে মনুতে শূদ্র ঊনমানব, ন্যূনতম মানবিক অধিকারে বঞ্চিত উচ্চ ত্রিবর্ণের পদতলে পিষ্ট এক জীব। আরও প্রমাণ আছে, ধর্মগ্রন্থে অপরাধী শূদ্রের অমানবিক দণ্ডবিধানে। বেদ পাঠ করলে শূদ্রের জিভটা টেনে উপড়ে ফেলা হবে, কানে বেদের ধ্বনি প্রবেশ করলে সিসা গলিয়ে কানে ঢেলে দিতে হবে। তা হলে কিছু কিছু শূদ্র বেদের নির্দেশে সন্দেহ পোষণ করত এবং বেদবিরুদ্ধ আচরণ করত, যেমন শম্বুক তপস্যা করেছিল। সব শাস্ত্রের কারাগারেই বন্দির নিষ্ক্রমণের ফাঁক থাকে, বন্দি বহু যন্ত্রণায় সে-ফাঁকটা তৈরি করে বেরোবার জন্যে। অর্থাৎ কারাবিধির ধর্মীয়তায়, উপযোগিতায় তার বিশ্বাস নেই, সন্দেহ আছে এবং সন্দেহের বশেই সে প্রতিবাদী আচরণ করে।

এই যেখানে সমাজ, সেখানে যজ্ঞানুষ্ঠানরূপ ধর্মাচরণের বিশ্বাসের পাশাপাশি ছিল নানা বিষয়ে সংশয়াচ্ছন্ন বহু মানুষের মন। দীর্ঘকাল ধরে অনুষ্ঠিত একটি নির্দিষ্ট ধর্মপ্রণালীর পাশাপাশি সংশয় থাকলে এ দুয়ের আততি থেকে উদ্ভুত হয় অবিশ্বাস।[১] বেদের উত্তরার্ধে এ অবিশ্বাস নানা আকারে প্রকাশ পেয়েছে, সংশয়ের উক্তিতে এবং বিকল্প ধর্মাচরণে। এ ছাড়াও প্রাগার্য বিশ্বাসগুলো দেবতা এবং অনুষ্ঠানকে আত্মসাৎ করার ফলে সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে প্রকারান্তরে স্বীকৃতি জানানো হয় বানপ্রস্থ ও যতি বলে দুটি আশ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই অন্তর্ভুক্তি, আরণ্যকে যজ্ঞের রূপক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা এবং কর্মকাণ্ড থেকে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে জ্ঞানকাণ্ডের দিকে অগ্রসরণেও এ অবিশ্বাসের প্রকাশ। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ: কর্মকাণ্ডের অসম্পূর্ণতা, অনুপযোগিতা ও ব্যর্থতাকে স্বীকার করে নেওয়া। আবার বলছি, জ্ঞানকাণ্ড যখন প্রবল আকারে সমাজে প্রচলিত তখনও কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠান সমানে চলছে, এর কারণ আগেই আলোচনা করেছি। মানুষের ইতিহাসে অধিগঠন (superstructure) কখনও রাতারাতি পালটায় না, যদিও যুদ্ধ, সংঘর্ষ, বিপ্লব এবং রাতারাতি ক্ষমতার হস্তান্তরে অবগঠন, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে রাতারাতি পালটাতে পারে। অধিগঠন নির্মিত হতে সময় লাগে, পরিবর্তিত হতেও সময় লাগে। আমাদের কাজ হচ্ছে তার ঝোঁকটা কোন দিকে সেইটে অনুধাবন করা। তাই জ্ঞানকাণ্ডের যুগে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যে জনমানসের না হলেও সমাজবিধাতা পুরোহিত শাস্ত্রকারদের প্রবর্তিত ধর্মাচরণের ঝোঁকটা যে যজ্ঞ-অনুষ্ঠান থেকে সরে জ্ঞান ও মননের দিকে পড়েছে— এ কথা নিঃসংশয়েই বলা যায়। ঘটনাটা একদিনে এবং সহজে ঘটেনি, পথে পথে বিছিয়ে এসেছে মানসিক ভাবে বহু রক্তাক্ত ইতিহাস। কিন্তু সেটা অনিবার্য ভাবে ঘটেছে।

জ্ঞানকাণ্ডের পটভূমিকা রচিত হল আর্যাবর্তের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের গাঙ্গেয় উপত্যকা পর্যন্ত। দীর্ঘ পাঁচ শতকের অভিযাত্রা বহির্জগতে এবং মনোজগতে; এর ফলে মননজগতে যেমন পুর্বানুবৃত্তির মতো অনেক প্রাচীন উপাদান রইল তেমনই প্রাচীনকালে যা অভাবনীয় ছিল এমন বহু লক্ষণ ও উপাদানও দেখা দিল। দুই অংশই বাস্তবে সহাবস্থান করলেও ঝোঁকটা নতুন উপাদান ও নতুন লক্ষ্যে। মনে রাখতে হবে যে, ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রকাররা সমগ্র বেদকেই অর্থাৎ সংহিতা-ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষৎ চারটি অংশকেই অপৌরুষেয় বলছে, অর্থাৎ এই পুরো শাস্ত্রসম্ভার সবটাই দৈব আদেশ বা প্রকাশ, মানুষের রচনা নয়। আজ আমরা জানি, এর সবটাই মানুষের রচনা, কিন্তু যে প্রশ্ন উদ্যত হয়ে ওঠে তা হল বেদ বলতে আমরা যে যজ্ঞনির্ভর ধর্মাচরণ বুঝি তার শাস্ত্র তো সংহিতা ব্রাহ্মণ, সেই পর্যন্তকে অপৌরুষেয় বললেই তো হত; যে অংশ ধীরে ধীরে অন্তত তত্ত্বগত ভাবে যজ্ঞকে অস্বীকার করছে সেই আরণ্যক উপনিষদকেও অপৌরুষেয় বলার কী দরকার ছিল? দরকার সত্যিই ছিল: বহু আয়াসে, কঠোর প্রযত্নে আর্যসমাজ বহু বিরোধী মতবাদকে খণ্ডন করে আত্মসাৎ করে, আগন্তুক ধর্মমতকেও অধিগ্রহণ করে সমাজে একটি সংহতি নির্মাণের চেষ্টা করে চলেছিল। তাই প্রাগার্য দেবদেবী, উপাসনা-পদ্ধতিকে ভেতরে টেনে নেওয়া, বেদবিরোধী প্রস্থানের সন্ন্যাসী সম্প্রদায়কে বানপ্রস্থ ও যতি নামে আশ্রমধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা, যজ্ঞকে রূপক ব্যাখ্যা দিয়ে গ্রহণযোগ্য ও আচরণীয় করে তোলা এবং উপনিষদের প্রশ্ন ও অবিশ্বাসকে সম্মানিত ঋষি প্রবক্তাদের মুখে বসিয়ে সেগুলিকে সামাজিক ও ধর্মীয় সম্ভ্রম দেওয়া ইত্যাদি কারণে সম্পূর্ণ ইহমুখীন সংহিতা-ব্রাহ্মণের ধর্মে আপাত ভাবে হলেও ঐহিকতাবিদ্বেষ দেখা দিল। এখানে জন্মান্তরতত্ত্ব দিয়ে তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া, এবং যেহেতু বহু পূর্ব থেকেই মৃত্যু ও মরণোত্তর অবস্থা নিয়ে জনমানসে প্রবল সংশয় উচ্চারিত হয়েছিল, তাই জন্মান্তরবাদের মধ্যে দিয়ে মৃত্যুর আত্যন্তিকতা অস্বীকার করা হল। এই ভাবে আত্মসাৎ করা, ব্যাখ্যা দিয়ে সমর্থন প্রলম্বিত করা, বাহিরকে নিজসীমার অন্তর্ভুক্ত করা— এই প্রক্রিয়াটা চলেছিল অন্তর্জগতের একটা মরণান্তিক সংগ্রামের রূপে। কাল, সমাজের বিবর্তন, অনিবার্য সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্ক, সংশয়ে দীর্ণ মানুষ যাকে ক্রমান্বয়ে বাতিল করে পেছনে ফেলে যেতে চেয়েছে, যার থেকে ক্রমাগত সরে সরে যেতে চেয়েছে, অনিবার্য পরিবর্তনকে অনুবর্তন বলে ব্যাখ্যা না করলে সমাজ তাকে গ্রহণ করবে কেন? এবং এ ব্যাখ্যাকে দৈব প্রকাশ, অপৌরুষেয় আখ্যা না দিলে মানুষ তাকে মানবে কেন? না মানলে বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠীর, মতবাদের, ধর্মবোধের ও আচরণের সমাহারে গঠিত এই-যে সমাজ ও তার ধর্ম, সে তো অতি সহজেই বহু বিরুদ্ধ মতবাদের সম্মুখীন হয়ে স্খলিত হয়ে পড়ে যেত, চূর্ণ হত তার অধিগঠন। তাই পুরো আপসের, মেনে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসটাকেই অপৌরুষেয় বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়ার যা অভিলষিত ফল ছিল, সামাজিক সংহতি রক্ষা, তা পূর্ণ ভাবে না হলেও বহুলাংশে সিদ্ধ হয়েছে। এই হল সমাজ-কলেবরের ইতিহাস; এর অভ্যন্তরে মর্মকীটের মতো ছিল বহু সংশয়, সন্দেহ, উচ্চারিত এবং অনুচ্চারিত অবিশ্বাস। দ্বিতীয় পর্বে এ সব অন্য একটি মাত্রা পায়, কারণ তখন বহু বেদবিরোধী প্রস্থান স্বতন্ত্র ভাবে সমাজে বিদ্যমান।

জন্মান্তরবাদের উদ্ভব ও বিকাশের পিছনে মৃত্যুভয় ও পরলোক সম্বন্ধে অজ্ঞানের একটা ভূমিকা ছিল। ব্রাহ্মণসাহিত্য থেকেই এটা লক্ষ করা যায়। শতপথ ব্রাহ্মণে পড়ি, যজ্ঞের জন্যে আনা একটা দুগ্ধবতী গাভীকে বাঘে নিয়ে গেলে যজমান রাজা পুরোহিত, খণ্ডিক ও ঔদ্‌গারিক তার প্রায়শ্চিত্ত কী জানতে চান। পুরোহিত ভাবলেন, বলে দিই প্রজারা রাজার অনুগত হবে আর পরলোকে আমি সম্মানের আসনে থাকব। না বললে এর বিপরীতটা হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি বলে দেওয়াই ঠিক করলেন, ‘কারণ ওপারে বহু রাত্রি’। (১১:৪:৪:৫) এখানে দুটো কথা লক্ষ্য করা দরকার: মরণোত্তর অস্তিত্ব দীর্ঘ (বা চির)-স্থায়ী এবং পুরোহিত দিনের কথা ভাবেননি, রাত্রির কথাই ভেবেছেন। ঋগ্বেদেও পরলোক সম্বন্ধে ধারণা ছিল সেটা একটা নিরালোক, নিরানন্দ লোক। এবং যেহেতু তখনও পরজন্মের কল্পনা দেখা দেয়নি তাই সেইটেই তাদের কাছে ছিল চিরদিনের আভাস। তাই এক অর্থে জন্মান্তরবাদ এই নিরবসান দুঃখলোক থেকে পরিত্রাণ হিসেবে দেখা দিল। একেবারে অজ্ঞাত দুঃসময়মণ্ডিত জগতের চেয়ে পরিচিত এই সুখদুঃখের জগৎ অনেকের কাছেই কাম্য মনে হল। বোঝা যায়, মরণোত্তর জীবন নিয়ে ত্রাস বা আশঙ্কা মানুষকে এক অনিশ্চয়ের অস্থিরতার মধ্যে রেখেছিল। ‘…ব্যক্তিগত অমরত্ব তার পূর্বতন বিপরীত অবস্থান (আত্মার অমরত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হল। এ সম্বন্ধে দার্শনিক ব্যাখ্যার পরে …যজ্ঞীয় ধর্মানুষ্ঠান থেকে পরজন্মের ধারণা উদ্ভূত হয় না।’[২]

এ ছাড়াও জীবন, সমাজ, ঔৎপাতিক সংকট, রোগব্যাধি, প্রভৃতি নিয়ে কিছু কিছু প্রশ্ন তো ছিলই; যজ্ঞ, তার উপকরণ প্রণালী এবং দেবতাদের অস্তিত্ব, চরিত্র, মনোভাব এ সব নিয়েও বহু প্রশ্ন উদ্যত ছিল। প্রশ্ন ও সংশয় সম্বন্ধে সমাজে বিভিন্ন ধরনের মনোভাব চলিত ছিল। স্পষ্টত, সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা কারোরই ছিল না, তাই মাঝে মাঝেই প্ৰশ্ন সম্বন্ধে ঋষিদের অসহিষ্ণুতা দেখা যায়। কয়েক জন ব্রাহ্মণ যাজ্ঞবল্ক্যকে কিছু প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, ‘যে দেবতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা যায় না, তাঁর সম্বন্ধে প্রশ্ন কোরো না; অমুক তিথিতে তোমার মৃত্যু হবে, এবং তোমার অস্থিগুলি তোমার বাড়িতে পৌঁছবে না।’ (জৈমিনীয় উপনিষদব্রাহ্মণ; ১:৬:৩) অস্থিচয়নের উপযোগিতায় যে সমাজ বিশ্বাস করে, সেখানে এটি একটি গুরুতর অভিশাপ। এর কারণ কী? দুয়ে দেবতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করা। তা হলে প্রশ্ন সম্বন্ধে একটা অসহিষ্ণুতা ছিল, সম্ভবত মানুষ ক্রমেই বেশি বেশি প্রশ্ন করছে তখন, এবং বহু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না।

প্রশ্নোপনিষদের শুরুতেই একগুচ্ছ প্রশ্ন, ভিন্ন ভিন্ন লোকের মুখে; এঁরা এলেন আচার্য পিপ্পলাদের কাছে পরব্রহ্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা নিয়ে। মনে রাখতে হবে, এই জিজ্ঞাসাটিই নতুন এবং পরব্রহ্ম সম্বন্ধে ধারণাও এর আগে ছিল না। আগে যজ্ঞে বহু সংখ্যায় দেবতার উপাসনা হত, তার মধ্যে পরব্রহ্ম ছিলেন না। এই জিজ্ঞাসু (সুকেশা, সত্যকাম, সৌর্যায়নী, কৌশল্য, ভার্গব ও কবন্ধী)দের পিপ্পলাদ বললেন, তোমরা এক বৎসর তপস্যা, ব্রহ্মচর্য ও শ্রদ্ধায় অতিবাহিত করো। তার পরে এসো। এখানে দুটো ব্যাপার চোখে পড়ে, এঁরা সকলেই মনস্বী তবু ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্যে এঁদের ঋষিত্ব বা মনীষা যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা হল না, এটা বিশেষ ধরনের জ্ঞান, তাই এর জন্যে চাই বিশেষ ধরনের প্রস্তুতি। কী সে প্রস্তুতি? ব্রহ্মচর্য আশ্রম নয়, সংযম, শ্রদ্ধা ও তপস্যা। এটাও নতুন। কর্মকাণ্ডে ধর্মাচরণ ছিল যজ্ঞ, তার উপকরণ ও প্রকরণ দুই-ই পরিচিত, তার অভীপ্সিত ফল ছিল ঐহিক সুখ, দীর্ঘ জীবন। এখন উদ্দেশ্য ব্রহ্মজ্ঞান, উপায় মনন, তপস্যা।

সংবৎসর তপস্যায় অতিবাহিত করে কবন্ধী এসে প্রশ্ন করলেন: ‘প্রজা কোথা থেকে জাত হয়?— কুতো হ বা ইমাঃ প্রজাঃ প্রজায়ন্ত ইতি।’ (প্রশ্নোপনিষদ ১:১:৩) উত্তরে পিপ্পলাদ বললেন, ‘প্রজাপতি প্রজা কামনা করলেন, তিনি তপশ্চরণ করলেন, তিনি তপস্যা করে মিথুন এবং ধন ও প্রাণ উৎপন্ন করলেন; এরা (মিথুন) আমার বহুবিধ প্রজা উৎপন্ন করবে।’[৩] সেই সংহিতা যুগের প্রশ্ন: প্রজা কোথা থেকে এল; উত্তর, মিথুন থেকে, এবং মিথুন এল তপস্যা থেকে; তপস্যাকে ধর্মজগতে প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে এই ভাবে সৃষ্টির মূলতত্ত্ব হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। এর পরে ভার্গব প্রশ্ন করলেন, ‘ভগবন্ ক’জন দেবতা প্রজাকে ধারণ করেন? কারা শরীরকে প্রকাশিত করেন? এদের মধ্যে বরিষ্ঠ (শ্রেষ্ঠ) কে?’[৪] উত্তরে পিপ্পলাদ বলেন, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী, বাক্, মন, চক্ষু, শ্রোত্র— এঁরা প্রকাশ্যে বলেন, ‘আমরা এই শরীরকে দৃঢ়তর করে বিশেষ ভাবে ধারণ করব। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রাণ। তাঁদের মধ্যে বরিষ্ঠ প্রাণ।[৫] এখানে যে প্রশ্ন তাও অনেক পুরোনো, উত্তরেও খুব নতুন কিছু বলা হল না: পঞ্চভূত, বাক্, মন, চক্ষু ও কর্ণ, অর্থাৎ পঞ্চভূতের সঙ্গে মানুষের বিশিষ্ট দুটি উপাদান— বাক্য ও মন— এবং প্রধান দুটি জ্ঞানেন্দ্রিয় চক্ষু ও কর্ণ এরা সৃষ্টি করেছেন মানুষকে।

লক্ষ্যণীয়, প্রশ্ন ছিল, কোন দেবতারা প্রজাকে ধারণ করে? উত্তরে যাঁদের নাম করা হল তাঁরা কেউই দেবতা নন, শ্রেষ্ঠ হল প্রাণ; প্রচলিত অর্থে প্রাণও দেবতা নয়। এর আগে সংহিতায় ইন্দ্র থেকে আরম্ভ করে বহু দেবতাকে স্রষ্টা বলা হয়েছে। সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি পৃথক, এখানে মানুষের দেহমনের উপাদানগুলিকেই সৃষ্টিকর্তা বলা হয়েছে। অর্থাৎ উপাদানগুলিই বিপরিণত হয়ে মানুষের দেহমন নির্মাণ করেছে, কিন্তু মানুষের মধ্যে এ সব থাকলেও যেহেতু সে মানুষ হত না, তাই বলা হয়েছে প্রাণই শ্রেষ্ঠ। এ উপলব্ধি বেশ সাধারণ পর্যায়ের এবং একটি বস্তুবাদী অবস্থানকেই সূচিত করে। যদিও এই প্রশ্নের বাকি অংশে নানা ভাবে প্রাণের গরিমাকীর্তন করা হয়েছে, যেমন আগের প্রশ্নের উত্তরেও ‘রয়ি’ (= ধন) ও প্রাণের সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে বলা আছে। তৃতীয় প্রশ্ন করলেন কৌশল্য :

ভগবন্, প্রাণ কোথা থেকে জাত হয়? কেমন করে তা এই শরীরে আসে। নিজেকে বিভক্ত (বিচ্ছিন্ন) করে কেমন করেই বা চলে যায়? কীভাবে উৎক্রান্ত হয়? বাহ্য ও অধ্যাত্ম শরীরেন্দ্রিয়গুলিকে কীভাবে ধারণ করে?

উত্তর এল:

তুমি অতিপ্রশ্ন (গভীর বা দুয়ে প্রশ্ন) করছ। তুমি ব্রহ্মজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাই তোমাকে বলব। আত্মা থেকেই প্রাণ জাত হয়। মানুষের যেমন ছায়া তেমনই পুরুষে প্রাণ ব্যাপ্ত। মানস সংকল্প থেকে এই শরীরে আসে।[৬]

এখানে প্রশ্নগুলি মৌলিক; আগের অংশে প্রাণের ভূমিকার প্রাধান্য ঘোষিত হয়েছে, এ প্রশ্নে সেই প্রাণের উৎপত্তি এবং নিষ্ক্রান্তি সম্বন্ধে প্রশ্ন, বাহ্য এবং আন্তর পদার্থ প্রাণ কেমন ভাবে ধারণ করে সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা। উত্তরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রাণকে অতিক্রম করে আত্মায় পৌঁছতে হল এবং এইখানে ভাববাদের আশ্রয় নেওয়া হল, মানুষের যেমন ছায়া, তেমনই আত্মা; মনের কামনা থেকেই জীব সৃষ্টি এবং তার দ্বারাই সৃষ্টিকালেই আত্মা জীবে অনুপ্রবিষ্ট হয়। পরে দেহ থেকে আত্মা কী ক্রমে বিনির্গত হয় সে সম্বন্ধে আলোচনা আছে। যেটা সহজেই চোখে পড়ে তা হল, উপমাটির দৈন্য; ছায়া মানুষের শরীরের ভেতরে থাকে না, থাকে বাইরে। আত্মাও কি তাই? সেটা অভিপ্রেত অর্থ নয়, তাই এই উত্তর প্রশ্নের মূল বিবক্ষিত বস্তুটিকে এড়িয়ে গেছে। কেন? কারণ আগে যেমন আলোচনা করেছি, এই যুগে প্রথম চেষ্টা করা হচ্ছে দেহব্যতিরিক্ত হিসেবে আত্মাকে দেখাতে। চেষ্টা সফল হয়নি, কারণ ছায়ার উপমাতে আত্মা দেহের একেবারে বাইরেই রয়ে গেল, তাকে দেহের মধ্যে ঢোকানোই গেল না। অর্থাৎ দেহ-আত্মার বিভাজনটি এখনও ভাল করে মানুষের, এমনকী ঋষিদের চেতনাতেও স্থান পায়নি।

চতুর্থ প্রশ্ন সৌর্যায়নীর:

ভগবন্, এই পুরুষে কারা নিদ্রা যায়? কারা স্বপ্ন দেখে? কারা জেগে থাকে? কোন সেই দেব যিনি স্বপ্ন দেখেন। এই সুখ কার হয়? কীসের (বা কার) মধ্যে সব কিছু সংপ্রতিষ্ঠিত থাকে?’

তাঁকে উত্তর দিলেন:

‘গার্গ্য, অস্তগামী সূর্যের সমস্ত কিরণ তেজোমণ্ডলে একীভূত হয়। বারবার সূর্যোদয়কালে প্রসারিত হয়, এই ভাবে সেই সব পরম দেব মনে একীভূত হয়।’

প্রশ্ন ছিল, পুরুষ নিজেই ঘুমোয়,— স্বপ্ন দেখে, না তার অন্তঃস্থ কেউ? দেহের সুখ কে ভোগ করে? কার মধ্যে মানুষের সব অভিজ্ঞতা আশ্রিত থাকে? লক্ষ করা যায় যে, এ সব প্রশ্নের কোনও সরাসরি উত্তর দেওয়া হয়নি। সুখের অনুভূতি কার হয় তারও উত্তর নেই। অস্তগামী সূর্যের রশ্মিসমূহ সন্ধ্যায় গুটিয়ে আসে, প্রভাতে প্রকীর্ণ হয়। তেমন ভাবেই সেই সব পরম দেব মানুষের মনে একীভূত হন। এর মধ্যে নিদ্রা, জাগরণ, স্বপ্ন, সুখবোধের আধার কী, তার কোনও উত্তর নেই। অস্পষ্ট ভাবে বলা আছে সেই সব পরম দেবরা মানুষের মনে একীভূত হন; বস্তুত এটা উত্তর নয় বরং আর-একটা প্রশ্নের বীজ: পরম দেব কাঁরা, কেন তাঁরা মানুষের মনের মধ্যে একীভূত হন? অন্য নানা দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু মূল প্রশ্নটি অনুত্তরিতই রয়ে গেল। এখানে যেটা চোখে পড়ে তা হল, মানুষ তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাগুলি নিয়ে, তার পরিপার্শ্ব নিয়ে ভাবছে, প্রশ্ন করছে, উত্তর মিলুক বা না-ই মিলুক। শেষ প্রশ্ন করে সত্যকাম: ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুকাল পর্যন্ত প্রণবমন্ত্রের উপাসনা করে, সে কোন লোক জয় করে?’ উত্তরে পিপ্পলাদ বললেন, ‘সত্যকাম, পরব্রহ্ম ও অপরব্রহ্ম হল ওঙ্কার বা প্রণব, অতএব বিদ্বান এই দুটির মধ্যে একটি ব্রহ্মের আশ্রয় পান।’[৮] যে মানুষ সারা জীবন প্রণবমন্ত্রের উপাসনা করে সে মৃত্যুর পরে কোন লোকে স্থান পায়, এই ছিল প্রশ্ন। প্রশ্নটি প্রণিধান করে দেখবার মতো, কারণ ইতোমধ্যেই প্রণবমন্ত্র এমন মহিমা অৰ্জন করেছে যে তার দ্বারা মৃত্যুর পরে সুবিধা হওয়ার আশা রাখে মানুষ। একটি মন্ত্র অন্য হাজার হাজার মন্ত্রকে ছাপিয়ে আধ্যাত্মিক প্রাধান্য অর্জন করেছে। কিন্তু এ প্রার্থনায় জীবনভর নিবিষ্ট থাকবার জন্যে মৃত্যুর পর কিছু ফল পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কী সেই ফল? উত্তরে পিপ্পলাদ যা বলছেন তা পরে বিশদ ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে— মৃত্যুর পরে দুটি মাত্র সম্ভাব্য পরিণতি, প্রথম পিতৃযান, অর্থাৎ পুনর্জন্ম, দ্বিতীয় দেবযান বা পরমাত্মা দর্শন; প্রথমটি পুনর্জন্মের পথ, দ্বিতীয়টি কৈবল্যপ্রাপ্তির। অবশ্য দ্বিতীয়টি সম্বন্ধে কোনও স্পষ্ট উক্তি নেই, তবে দুটি বিকল্পের মধ্যে একটি যখন পুনর্জন্ম অন্যটি স্বভাবতই পুনর্জন্ম না হওয়ার অবস্থা মনে করা যায়। কিন্তু এখানে প্রশ্নটি তাৎপর্যপূর্ণ: যজ্ঞ নয়, শুধুমাত্র প্রণম বা ওংকার মন্ত্রের উপাসনা এবং এই একটি অক্ষরকে এক-অক্ষর, দ্বি-অক্ষর, ত্রি-অক্ষর এই তিন ভাবে বোঝার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে সহজ বুদ্ধির অগম্য, রহস্যগূঢ় একটি তত্ত্বের কথা আভাসিত।

মাণ্ডুক্য উপনিষদের পুরো আগম-প্রকরণে প্রণব অর্থাৎ ওম্ শব্দটিকে ভেঙে অ-উ-ম ধরে নিয়ে এ অক্ষরগুলির প্রত্যেকটির মধ্যে গূঢ় তত্ত্বের মাহাত্ম্য আরোপ করে শব্দটিকে একই সঙ্গে দুর্বোধ্য ও উচ্চমার্গের একটি ভাবসত্তা হিসেবে আনা হয়েছে। সামবেদের সংহিতায় স্তোভ নামে হা-উ, হোই, হোয়ি, হা-বু, ইত্যাদি, বা হিঙ্কার, ওংকার এ সব সমবেত ভাবে উচ্চারিত ধ্বনিকে অতিলৌকিক মহিমায় মণ্ডিত করবার যে চেষ্টা, প্রণবেও তাই। ইহুদিরা যেমন ‘আমেন্’কে অন্য ভাবে মাহাত্ম্য দেয়, তেমনই সংস্কৃতে পরবর্তী সাহিত্যে আমরা স্পষ্ট দেখি ওম্-এর অর্থ ‘হ্যাঁ’। যেমন বাঢ়ম্। আমেনও তাই। অর্থাৎ পুরোহিত যে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন উপস্থিত জনগোষ্ঠী তাতে সমর্থন জানাত হ্যাঁ বা ওম্ বলে। যজ্ঞের আনুষ্ঠানিক পটভূমিকা থেকে তুলে এনে কর্মকাণ্ডে যখন প্রণবকে আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে মণ্ডিত করার চেষ্টা চলছে, তখন স্বভাবতই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে, ওম্ শব্দটি তো যজ্ঞে জনতার সমর্থনসূচক ধ্বনিমাত্র, তাকে এত আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করা কেন? আগম প্রকরণে ও অন্যত্র ওম্ নিয়ে বিস্তৃত রহস্যগম্ভীর ব্যাখ্যার চেষ্টা এই উদ্যত প্রশ্নেরই উত্তরমাত্র। মনে রাখতে হবে, কর্মকাণ্ডে ওম্ যজ্ঞক্রিয়ার অঙ্গ ছিল, সেটা লোকে সহজে গ্রহণ করতে পেরেছিল, কিন্তু জ্ঞানকাণ্ডে যজ্ঞের বিকল্প হচ্ছে মনন। যে মননে আত্মব্রহ্ম একাত্মতা প্রতিপন্ন হয়, অর্থাৎ কর্ম থেকে বিনির্মুক্ত শব্দে পরিণত হল ওম্; যজ্ঞ একে আর মহিমা দেয় না, তবে কীসে আসবে এর গুরুত্ব? একে অতিলৌকিক রহস্যে মণ্ডিত করা সে বিকল্প প্রক্রিয়া। ব্রাহ্মণসাহিত্য থেকে শুরু করে উপনিষদেও একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়, ‘পরোক্ষপ্রিয়া বৈ দেবাঃ’— দেবতারা পরোক্ষ ভাষণ অর্থাৎ অস্বচ্ছ ভাষাই পছন্দ করেন, তাই তাঁদের কথাতে রহস্য আরোপ করা ও অলৌকিক অর্থের আভাস দেওয়া খুবই সহজ।

ঐতরেয় উপনিষদে একটি প্রশ্নমালা দিয়ে শুরু হয় তৃতীয় অধ্যায়: ‘কে তিনি যাঁকে আমরা আত্মা বলে উপাসনা করি, কে সেই আত্মা যার দ্বারা লোকে রূপ দেখে শব্দ শোনে, গন্ধ আঘ্রাণ করে, বাক্য রলে, স্বাদু, অস্বাদুকে বোঝে?’ এর উত্তর হল, ‘এই যে হৃদয়, এই যে মন (এরাই)— যদেতহৃদয়ং মনশ্চেতৎ।’ (৩:১:২) এখানে প্রশ্ন ছিল, ইন্দ্রিয়গুলি যে সব কর্ম করে তা কোন্ আত্মার নিয়োগে? অন্য ভাবে বললে ইন্দ্রিয়কর্মগুলির সঙ্গে আত্মার সম্বন্ধ কী? উত্তরে আত্মার উল্লেখ না করেই বলা হয় ইন্দ্রিয়কর্মগুলি সাধন করে হৃদয় ও মন, এবং এ উত্তর বিজ্ঞানসম্মত, কিন্তু এর মধ্যে আত্মার স্থান নেই; অথচ এ উপনিষদের শেষ হচ্ছে এই বলে, ‘তিনি (বামদেব) উক্ত চৈতন্যস্বরূপ আত্মার দ্বারা এই জগৎ অতিক্রম করে ওই স্বর্গলোকে সব কামনা লাভ করে অমৃত হয়েছিলেন।’[১০] আগেরটির সঙ্গে এ কথার বিশেষ কোনও সংগতি নেই; হৃদয় ও মন তো আত্মা নয়, তারাই ইন্দ্রিয়কর্মের প্রবর্তক। অথচ বামদেব চৈতন্যরূপ আত্মার দ্বারা এই পৃথিবী অতিক্রম করে স্বর্গে গেলেন ও সেখানে তাঁর সর্বকামনা চরিতার্থ হল, অর্থাৎ আত্মাই স্বর্গের সোপান এবং পরলোকে কামনা চরিতার্থ হয় আত্মার দ্বারাই।

তৈত্তিরীয় উপনিষদের শীক্ষাবল্লীতে আচার্য শিষ্যের একটি সংশয়ের কথা নিজেই তুলেছেন, ‘যদি তোমার করণীয় কর্ম বা আচরণ সম্বন্ধে কোনও সংশয় জাগে, (তা হলে) সদসৎ-বিচারক্ষম তরুণ ধার্মিক যে পণ্ডিতরা আছেন তাদের মতো আচরণ কোরো।[১১] সংশয়ের সম্ভাবনা এখানে ধর্ম সম্বন্ধে নয়, আচরণ সম্বন্ধে, এবং সমাধানও ধর্মীয় নয়, নৈতিক। সমস্ত তৈত্তিরীয় উপনিষদেই নীতি একটি মুখ্য আলোচ্য বস্তু এবং এটাও লক্ষ্যণীয়, কারণ কর্মকাণ্ডে নীতি অপ্রাসঙ্গিক। আরও লক্ষ্যণীয় যে নীতির প্রশ্নে উত্তরটা ধর্মগ্রন্থ বা বেদ থেকে আসছে না: সমাবর্তনে অবভূথস্নানের পর বেদপাঠার্থী ব্রহ্মচারী যখন পাঠ সমাপ্ত করে গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশ করতে চলেছে তখন তাকে যে-উপদেশ দেওয়া হয়েছে এরই ঠিক আগে সেই কথাই আবার বলা হয়েছে, ‘যে সব কাজ অনিন্দনীয় তা-ই আচরণ কোরো, তা-ই সেবনীয়; যা আমাদের (আচার্যদের) সুচরিত, সেগুলিই অনুষ্ঠান কোরো, অন্যগুলির (অনুসরণ) কোরো না।’[১২] উপদেশে দু’বার বলা হল, যা আচার্যদের ভাল আচরণ নয়, তার অনুসরণ কোরো না। তার পর এল সংশয়ের কথা, অর্থাৎ এর পরেও যদি ব্রহ্মচারীর মনে আচরণ সম্বন্ধে সংশয় আসে তা হলে— শাস্ত্রের কোনও নির্দেশ নেই, আচার্যদের সুচরিত অনুসরণ করারই অনুজ্ঞা। কেমন আচার্য? যাঁরা পণ্ডিত, সচ্চরিত্র, অরুক্ষ (অর্থাৎ কোমলস্বভাব)— তেমন আচার্যরা অনুরূপ সংশয়িত ক্ষেত্রে যেমন আচরণ করেছেন সেইটিই আদর্শ। নীতির সংশয়ে পূর্বাচার্যদের সদাচরণই নিরিখ। এ শাস্ত্র সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের; সমাজে নানা পরিবর্তন, পরিবারে ও মানুষে-মানুষে সম্পর্কে এবং যজ্ঞ-পরবর্তী চিন্তার প্রসারে, সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলির প্রাদুর্ভাবে আচরণের নিরিখ সম্বন্ধে সংশয়ের উদয় হওয়া স্বাভাবিক। তাই এই ধরনের নীতিগত সংশয়ের কথা শুনতে পাচ্ছি।

কোনোপনিষদের প্রথমেই প্রশ্ন, ‘কেন’শব্দ দিয়ে সে প্রশ্ন শুরু, সেই থেকেই উপনিষদের নামকরণ। প্রথম প্রশ্ন হল:

মন কার ইচ্ছায় প্রেরিত (চালিত) হয়? শ্রেষ্ঠ প্রাণ কার দ্বারা নিযুক্ত হয়ে চলে? মানুষ কার ইচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে বাক্য উচ্চারণ করে? চক্ষু ও কর্ণকে কোন্ দেবতা তাদের কর্মে নিযুক্ত করে?’[১৩]

প্রশ্নগুলি এক কথায় বললে, ইন্দ্রিয়দের কর্মপ্রেরণা কোথা থেকে আসে?’ উত্তরে বলা হচ্ছে:

যিনি কর্ণের কর্ণ, মনের মন, বাক্যের বাক্য, প্রাণের প্রাণ, চক্ষুর চক্ষু স্বরূপ। এই জন্য পণ্ডিতরা ইন্দ্রিয়গুলিকে আত্মা মনে করেন না বলে মৃত্যুর পর অমৃতত্ব লাভ করেন।[১৪]

এটি এবং এর অনুরূপ বহু অংশ কর্মকাণ্ড থেকে জ্ঞানকাণ্ডে উত্তরণের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষণ: এখানে প্রশ্নটি খুবই স্বাভাবিক, ইন্দ্রিয়গুলি যে কাজ করে তা কি স্বয়ংক্রিয় ভাবে না অন্য কোনও শক্তি এগুলিকে অলক্ষ্য থেকে পরিচালনা করে? দার্শনিক ভাষায় বললে দেহ কি দৈহিক ক্রিয়া নিজে সম্পাদন করে না তার অতিরিক্ত কোনও শক্তি দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে? উত্তরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ: চক্ষু, কর্ণ, বাক্শক্তির ওপারে, এমনকী প্রাণ ও মনেরও ওপারে থেকে যিনি এগুলিকে প্রবর্তিত করেন, সে-ই আত্মাকে যে সর্বশ্রেষ্ঠ চালক হিসেবে এবং দেহের নিয়ন্তা হিসেবে স্বীকার করে, সে-ই মৃত্যুর পরে অমৃতত্ব লাভ করে। এখানে প্রশ্নটি পুরাতন, আমরা দেখেছি আগেও ইন্দ্রিয় সম্বন্ধে প্রশ্ন সেই সংহিতা ব্রাহ্মণের যুগ থেকেই আছে। উত্তরটিতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হল: ওই পুরাতন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল, আবার জ্ঞানকাণ্ডের একটি বিশিষ্ট প্রতিপাদ্যকেও— দেহ-দেহী বিভাজন— প্রতিষ্ঠিত করা হল।

আগেই আলোচনা করা হয়েছে, ষোড়শ মহাজনপদের উত্থানের পরে সমাজে নানা রকম বিভাজন দেখা দিয়েছে: ধনিক-শ্রমিক, কায়িক শ্রম, মানসিক শ্রম, ইত্যাদি। এ সবেরই আনুষঙ্গিক দার্শনিক তত্ত্বের দিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত হল তা হল দেহ ও আত্মার বিভাজন। আজ বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা জানি যে ইন্দ্রিয়ের প্রাথমিক প্রবর্তনা আসে স্নায়ুমণ্ডলী থেকে এবং স্নায়ুমণ্ডলী নিয়ন্ত্রিত হয় মন দ্বারা, যে-মন ইন্দ্রিয়-সমাবেশে অব্যতিক্রমী ফল। কিন্তু তা হলে তো দেহ-ব্যতিরিক্ত আত্মাকে স্বীকার করা হয় না, এবং তা না হলে জন্মান্তর, অমরত্ব, মোক্ষ এ সব প্রতিপাদন করা যায় না, কারণ জন্মান্তর বা স্বৰ্গভোগ বা মোক্ষলাভ করবে কে? আত্মা চাই তো তার জন্যে। মনে রাখতে হবে, সংহিতাব্রাহ্মণেও মরণোত্তর স্বর্গ, যমের তত্ত্বাবধানে সুখে থাকা, এ সব বলা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো ইচ্ছাপূরক ভাবনার প্রকাশ, তার মধ্যে কোনও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হওয়ার প্রয়োজনও ছিল না এবং উপায়ও ছিল না। এখন জ্ঞানকাণ্ডে আত্মাই সর্বেসর্বা, এবং তা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন। দেহের ধ্বংসের পরেও তাই তাকে বেঁচে থাকতে হবে, স্বর্গ, অমৃতত্ত্ব বা মোক্ষ পাওয়ার জন্যে। অতএব তাকে দেহবিনিমুক্ত হতে হবে। এখন থেকে আত্মা দেহী, দেহ পঞ্চভূতের সমাহার। দেহের ক্রিয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণ বা মন নয়, আত্মা; কারণ প্রাণ-মনের অবসান ঘটে মৃত্যুতে, মরণোত্তর অস্তিত্ব থাকে শুধু আত্মারই। এখানে যেটি প্রশ্নোত্তরের আকারে দেখা গেল, সমগ্র উপনিষদসাহিত্যের আধাআধি জুড়ে আছে তারই বিস্তারিত বিবরণ, তার লক্ষণ, দেহ থেকে তার সর্বতো ভাবে ভিন্নতা, তার মরণোত্তর অস্তিত্ব এবং ব্রহ্ম-স্বরূপতা।

ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথমেই দেখি তিন জন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সামবেদ সম্বন্ধে আলোচনায় প্রবৃত্ত। ছান্দোগ্য উপনিষদটি সামবেদেরই অন্তর্গত, তাই এঁদের প্রস্তাব খুবই সংগত। এঁদের মধ্যে একজন অন্যদের আলোচনা করতে বললেন, তিনি শুনবেন। এঁদের একজন অপরকে

প্রশ্ন করলেন:

—সামের আশ্রয় কী?

—স্বর।

—স্বরের আশ্রয়?

—প্ৰাণ।

—প্রাণের…?

—অন্ন।

—অন্নের…?

—জল।

—জলের…?

—ওই স্বর্গলোক।

—স্বর্গলোকের…?

—সামকে কেউ স্বর্গলোকের ওপারে অন্য আশ্রয়ে নিয়ে যেতে পারে না, যেহেতু স্বর্গরূপে সামের স্তব করা হয়, তাই আমরা সামকে স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত বলেই জানি।[১৫]

শুনে তৃতীয় জন বললেন, ‘আপনার সাম অপ্রতিষ্ঠিত থেকে গেল— অপ্রতিষ্ঠিতং বৈ কিল তো দালভ্য— সাম।।’ (১:৮৬) তখন তৃতীয় জন প্রশ্ন করলেন, ‘এই লোকের আশ্রয় কী?’ বললেন, ‘আকাশ। পৃথিবীর স্থাবর জঙ্গম সব কিছুই আকাশ থেকেই উৎপন্ন হয় এবং আকাশেই বিলীন হয়।’[১৬] যেটা চোখে পড়ে তা হল, এই যে ব্যাপারটা শুরু হল সামগানের আশ্রয় কী তা নিয়ে এবং উত্তরও খুব স্বাভাবিক ভাবেই ‘স্বর’ বলা হল, তেমনই সহজ স্বরের আশ্রয় প্রাণ, প্রাণের অন্ন, অন্নের জল এবং জলের আকাশ। পরের অংশটা অপ্রত্যাশিত, আকাশ থেকেই সব কিছু উৎপন্ন হয়, এবং আকাশেই সব কিছু বিলীন হয়। আকাশ থেকে সব কিছু উৎপন্ন হয়, এমন কথা অন্যত্র প্রায় নেই। উপনিষদে বরং জল থেকে, স্বেদ থেকে, কামনা থেকে, দ্বিধাকৃত মিথুন থেকে, ইচ্ছা থেকে সৃষ্টির উদ্ভবের কথা নানা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে; এখানে শোনা গেল, আকাশ থেকে সব কিছু উৎপন্ন হয়েছে। হয়তো ছান্দোগ্য সামবেদের উপনিষদ বলে ও সামবেদে সুরের অতএব স্বরের প্রাধান্য বলে এবং সুর-স্বর বায়ুতে আশ্রিত ও বায়ু আকাশে আশ্রিত বলেই আকাশকে সৃষ্টির এবং বিলয়েরও কারণ হিসেবে বলা হল। এবং এখানে সুর আকাশের বায়ুতে মিলিয়ে যায় বলেই সামবেদী জিজ্ঞাসু আকাশকে এত প্রাধান্য দিলেন। এখানে লক্ষ্যণীয়, প্রশ্নগুলির পারম্পর্য এবং আপাত-নিরস্ততা। কোনও উত্তরই চূড়ান্ত বলে যেন স্বীকার করা হচ্ছে না, এবং মূল প্রশ্নটি হল আধার নিয়ে। মানুষ দৃশ্য-জগৎকে বুঝতে চাইছে আধার-আধৃত সম্বন্ধে। সামবেদীর কাছে যে-আধার চূড়ান্ত, সেই আকাশে এসে প্রশ্ন ক্ষান্ত হল। প্রশ্নের পরম্পরা একটি অতৃপ্ত জ্ঞানান্বেষাকেই সুচিত করছে; এ দুটি এ যুগের একটি বৈশিষ্ট্য। সংহিতাব্রাহ্মণ মিলিয়ে যে-কর্মকাণ্ড তা ব্রাহ্মণ-অংশে যজ্ঞকর্মের অসংখ্য অনুপুঙ্খ নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন আছে; কিন্তু উত্তরগুলি কোনওটিই যথার্থ উত্তর নয়, একটা ব্যাখ্যাবিমুখ রহস্য দিয়েই উত্তর দেওয়া হয়েছে।

ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে শ্বেতকেতুকে পাঞ্চালরাজ প্রবাহণ প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার পিতার কাছে শিক্ষা পেয়েছ তো?’ শ্বেতকেতু বললেন, পেয়েছেন; তখন প্রবাহণ প্রশ্ন করলেন :

—প্রাণীরা এই পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বে কোথায় যায় তা জান?

—শ্বেতকেতু বললেন, না, ভগবন্!

—কেমন করে তারা ফেরে জান কি?

—না, ভগবন্!

—দেবযান ও পিতৃযান নামের পথ দু’টি কোথায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে, জান?

—না, ভগবন্।

—চন্দ্রলোক কেন ভরে ওঠে না, জান?

—না, ভগবন্।

—পঞ্চম আহুতিটি দেওয়া হলে জল কেন পুরুষ বলে অভিহিত হয়, জান কি?

—না, ভগবন্।[১৭]

এর পরে শ্বেতকেতু পিতার কাছে গিয়ে অনুযোগ করলেন তাঁকে অসম্পূর্ণ শিক্ষা দেওয়ার জন্যে, যার ফলে তিনি প্রবাহণের প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পারেননি। তখন পিতা গৌতম পুত্রের সঙ্গে প্রবাহণের কাছে শিক্ষার্থী হয়ে এলেন। প্রবাহণ প্রথমে তাঁদের ধন দান করতে চাইলেন। গৌতম প্রত্যাখ্যান করলেন, তিনি ওই প্রশ্নগুলির উত্তরই চাইলেন। তখন প্রবাহণ তাঁদের দীর্ঘকাল বাস করতে বললেন। তার পরে বললেন, ‘এই বিদ্যা আপনার পূর্বে ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রবেশ করেনি— ইয়ং ন প্রাক্ ত্বত্ত্বঃ পুরা বিদ্যা ব্রাহ্মাণান্ গচ্ছতি।’ (৫:৩:৭) এখানে কয়েকটি ব্যাপার প্রণিধান করে দেখা উচিত: পিতাপুত্র যে সব উত্তর জানবার জন্যে প্রবাহণের কাছে প্রার্থী হয়ে এসেছিলেন, প্রবাহণ প্রথমে তাদের উত্তরের বিনিময়ে ধন দিতে চাইলেন। তাঁরা প্রত্যাখ্যান করলে পর প্রথমে দীর্ঘকাল তাঁদের ওখানেই অপেক্ষা করতে বললেন। এতে ওই বিদ্যার মহত্ত্বই সূচিত হল। দ্বিতীয়ত, প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার আগে একটা খবর দিলেন: এ বিদ্যা এর আগে কোনও ব্রাহ্মণের কাছে যায়নি, অর্থাৎ এটি ক্ষত্রিয়ের নিজস্ব বিদ্যা।

এবার লক্ষ করে দেখা যাক, প্রশ্নগুলি কী। মনে রাখতে হবে, প্রশ্নগুলি ব্রাহ্মণের ছিল না, ক্ষত্রিয় প্রবাহণই শ্বেতকেতুর মাধ্যমে প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করেছিলেন ব্রাহ্মণদের; তাঁরা উত্তর দিতে না পারলে তিনিই উত্তর দিলেন। প্রাণীরা এ পৃথিবী থেকে কোথায় যায়— মরণোত্তর অবস্থানের প্রশ্ন; কেমন করে তারা ফেরে— জন্মান্তর সম্বন্ধে প্রশ্ন; পিতৃযানে চন্দ্রের পথ ঘুরে আত্মা পুনর্জন্ম গ্রহণ করে, দেবযানে তারা সূর্যে পৌঁছে মোক্ষ লাভ করে; পুনর্জন্মই বেশি লোকের হয় বলে চন্দ্রের ভরে ওঠার প্রশ্ন ওঠে এবং পঞ্চম আহুতির পরে গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি ঘটে, সে পুরুষ সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করে। পঞ্চম প্রশ্নটি যজ্ঞসংক্রান্ত এবং উত্তর কতকটা রহস্যগূঢ়। বাকি চারটি প্রশ্নই মরণোত্তর অবস্থা নিয়ে এবং বৈদিক সমাজের মানুষ দীর্ঘকাল ধরে এই সব সংশয়ে আক্রান্ত। নতুনের মধ্যে এই যুগে সমাজে জন্মান্তর স্বীকৃত একটি তত্ত্ব, তাই মানুষ কেমন করে পরলোক থেকে পৃথিবীতে ফেরে এবং পুনর্জন্মের পথ ও মোক্ষের পথ কোথায় পরস্পরবিচ্ছিন্ন হয়েছে এ সব নতুন প্রশ্ন, পুনর্জন্ম মানলে এগুলির সম্মুখীন হতে হয়। পুনর্জন্ম মানলেও এ কথা সকলে স্বীকার করত যে, মোক্ষ অর্জন করা দুঃসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ, ফলে কম লোকই মোক্ষ লাভ করে। অধিকাংশই পুনর্জন্মের পথে চন্দ্রে পৌঁছোয়, তাই প্রশ্ন, চন্দ্র ভরে ওঠে না কেন।

সমাজে মরণোত্তর অবস্থিতি নিয়ে সংশয় সুদীর্ঘকাল ধরেই ছিল, জন্মান্তরবাদ আসবার পরে নতুন কিছু সম্ভাবনা দেখা দিল এবং সে সম্পর্কে নতুন কিছু সংশয় দেখা দিল যেগুলি এ যুগের বিশিষ্ট প্রশ্ন। সমাধানগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বস্তুত সেগুলি সমাধানই নয়। কল্পিত পিতৃযান ও দেবযান এবং কল্পিত তাদের বিচ্ছেদ, ফলে চাঁদ ভরে ওঠার প্রশ্নও যেমন অবাস্তব, সমাধানও তেমনই অবাস্তব। কিন্তু যে-ব্যাপারটার গুরুত্ব আছে তা হল এগুলি অধিকাংশই যুগোচিত প্ৰশ্ন।

সংহিতায় এবং ব্রাহ্মণেও যে-সংশয় ছিল, তা হল পরলোক আছে কি না, এবং সেখানে যাওয়ার ভাল নিরাপদ রাস্তা আছে কি না। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে যম সম্বন্ধে পরপর ক’টি সূক্তে স্বর্গে পরলোকগত আত্মারা যমের তত্ত্বাবধানে সুখে থাকে এমন একটা ইচ্ছাপূরক কল্পনায় নির্মিত স্বর্গলোকের খবর পাই; কিন্তু ওই যুগেই রচিত ব্রাহ্মণে সংশয়ের কথা আছে— পরলোক আছে কি না সে-বিষয়ে, সেখানে নিরাপদে যাওয়া যায় কি না সে-বিষয়েও। যারা তাঁদের শ্রেষ্ঠ দেবতা ইন্দ্রের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সংশয়কে দ্বিধাহীন ভাবে উচ্চারণ করেছে এবং বলেছে, ‘ইন্দ্র নেই’, তারা সেই একই যুক্তিতে অর্থাৎ প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে পরলোক সম্বন্ধে যে সংশয় প্রকাশ করবে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। লক্ষ্য করার ব্যাপার হল, প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতা ক্ষত্রিয় এবং ‘এসব প্রশ্নের উত্তর কোনও ব্রাহ্মণ পূর্বে জানেনি’ এই কথাটা।

যখন মনে রাখি যে, ক্ষত্রিয় যুদ্ধ করত, বণিকবাহিনীর সহযাত্রী রক্ষক হিসেবে দূরদূরান্তে যেত, তখন বুঝি, অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা ক্ষত্রিয়ের যেমন ছিল অন্য কারও তেমন থাকার কথা নয়। অতএব, মৃত্যুর পরে মানুষের কী হয়, এ সম্বন্ধে সংশয় ক্ষত্রিয়কে যে ভাবে বিচলিত করবে, অন্যকে তেমন নয়। তাই ক্ষত্রিয় প্রবাহণ ব্রাহ্মণদের বলছেন, এ বিদ্যা পূর্বে কোনও ব্রাহ্মণের কাছে যায়নি। এ সব প্রশ্নও ব্রাহ্মণের শান্তিকে তেমন করে ব্যাহত করেনি, যেমন করে করেছে ক্ষত্রিয়কে। শাস্ত্র ও তত্ত্ব নির্মাণ করেছে প্রধানত ব্রাহ্মণ, তাই পিতৃযান ও দেবযান নিয়ে তত্ত্বগুলো ব্রাহ্মণরা জানত এবং ধীরে ধীরে এগুলি সমাজের অন্য স্তরেও ছড়িয়ে পড়ে; কিন্তু তত্ত্বগুলি জটিল, তাই শাস্ত্রকারদের গোষ্ঠীর মধ্যেই মূলত আবদ্ধ ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নগুলিরই তাৎপর্য বেশি কারণ এগুলির মধ্যে মানুষের কিছু মৌলিক দুশ্চিন্তার চিহ্ন ধরা আছে। এবং যথাযথ উত্তর না থাকায় বুঝতে পারি যে প্রশ্নগুলি রয়েই গেল।

এই সময়কার নতুন যে-বিষয়টি সমস্ত সমাজের ধর্মধারণায় আমূল নাড়াচাড়া দিয়েছিল তা হল আত্মা ও ব্রহ্ম। ছান্দোগ্য উপনিষদে পড়ি, প্রাচীনশাল, সত্যযজ্ঞ, ইন্দ্রদ্যুম্ন, জন, বুড়িল এই পাঁচ জন ধনী বেদজ্ঞ একত্র হয়ে মীমাংসা করতে চাইলেন, ‘আত্মা কে, ব্রহ্ম কী— কো না আত্মা কিং ব্রহ্মেতি।।’ (৫:১১:১) তাঁরা পরামর্শ করে অরুণের পুত্র উদ্দালকের কাছে যাওয়া স্থির করলেন, কারণ বৈশ্বানর আত্মাকে জানেন। আরুণির মনে হল, তিনি এঁদের সব প্রশ্নের উত্তর হয়তো দিতে পারবেন না, তাই তিনি এঁদেরকে নিয়ে কেকয়রাজ অশ্বপতির কাছে গেলেন। অশ্বপতি এঁদের প্রচুর ধন দিতে চাইলে এঁরা গ্রহণে অসম্মত হলেন, শুধু বৈশ্বানর আত্মা সম্বন্ধে তাঁদের প্রশ্নের উত্তরই চাইলেন। তখন অশ্বপতি পরদিন উত্তর দিতে সত্যস্বীকার করলে এঁরা উপনয়ন-প্রার্থীর মতো তাঁর কাছে গেলেন; তিনি উপনয়ন না দিয়েই তাঁদের একে একে প্রশ্ন করলেন, তাঁরা আত্মা বলে কার উপাসনা করেন? একে একে উত্তর এল দ্যুলোক, আদিত্য, বায়ু, আকাশ, জল ও পৃথিবী। রাজা একে একে প্রত্যেকের উত্তর ত্রুটিযুক্ত ও অসম্পূর্ণ বললেন এবং বললেন, তাঁর কাছে না এলে এঁদের কারও মাথা খসে যেত, কারও চোখ অন্ধ হত, প্রাণহানি ঘটত, দেহ খণ্ডিত হত, মূত্রাশয় বিদীর্ণ হত, পা-দুটি শীর্ণ হয়ে যেত। (৫:১২:১,২–১৩:১,২, ১৪:১,২; ১৫:১,২; ১৬:১,২; ১৭:১,২) সকলের প্রশ্নের উত্তরে অশ্বপতি বললেন, প্রত্যেকের দেখার দোষ হল খণ্ডিত ভাবে আত্মাকে দেখা, যিনি বৈশ্বানর আত্মাকে সর্বলোকে সর্বভূতে উপাসনা করেন তিনি এ সকলের মধ্যে অন্ন আহার করেন। (৫:১৮:১)

একবার সনৎকুমারের সঙ্গে নারদের কথা হচ্ছিল, সনৎকুমার বললেন, ‘যে কেউ মনকে ব্রহ্ম বলে উপাসনা করে, সে, মনের গতি যতদূর পর্যন্ত ততদূর পর্যন্ত স্বেচ্ছাগতি লাভ করে। অর্থাৎ ইচ্ছেমতো যাতায়াত করতে পারে।’ তখন নারদ বললেন, ‘ভগবন্, মনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু থাকলে আমাকে ত বলুন।’ সনৎকুমার বলে গেলেন সংকল্প মন থেকে শ্রেষ্ঠ; চিত্ত সংকল্প থেকে, ধ্যান চিত্ত থেকে, বিজ্ঞান ধ্যান থেকে শ্রেষ্ঠ; বল বিজ্ঞান থেকে, অন্ন বল থেকে, জল অন্ন থেকে শ্রেষ্ঠ; তেজ জল থেকে, আকাশ তেজ থেকে, স্মৃতি আকাশ থেকে শ্রেষ্ঠ; আশা স্মৃতি থেকে এবং প্রাণ আশা থেকে শ্রেষ্ঠ। (৭:৩৭:১৫) আলোচনার শুরুতে বলা আছে বাক্— যার মধ্যে সমস্ত বেদ ও সমস্ত বিদ্যা আছে— তার থেকে মন শ্রেষ্ঠ। তার পরে মন কী কী থেকে শ্রেষ্ঠ এই পরম্পরায় প্রাণ পর্যন্ত পৌঁছোল। তখনকার সমাজে মানুষ প্রকৃতি, মানবদেহ মানবমন ও তার বিভিন্ন অবস্থাকে একটা পরিচ্ছন্ন সুপরিনিষ্ঠিত আকল্পের মধ্যে স্থাপন করে বুঝে নিতে চাইছিল। তাই এগুলিকে আপেক্ষিক গুণ ও মান অনুসারে সাজাতে চেষ্টা করছিল কারণ বিশ্বচরাচরে এদের স্থান, গুণ ও মান নিয়ে তাদের মনে প্রশ্ন ছিল।

এক সময়ে দেবতা ও অসুররা আত্মার সন্ধান করতে চাইলেন কারণ তা হলে কাম্যবস্তু লাভ করা যাবে।

‘তখন দেবতাদের মধ্যে থেকে ইন্দ্র আর অসুরদের মধ্যে থেকে বিরোচন সন্ন্যাস নিলেন এবং একে অন্যকে না জানিয়ে সমিধ হাতে নিয়ে প্রজাপতির কাছে গেলেন। তাঁরা বত্রিশ বছর ব্রহ্মচর্য পালন করার পর গেলে প্রজাপতি জিজ্ঞাসা করলেন তাঁরা কী উদ্দেশ্যে এসেছেন। তাঁরা বললেন যে-আত্মায় পাপ, জরা, মৃত্যু, শোক, ক্ষুধা, পিপাসা নেই, যিনি সত্যকাম ও সত্যসংকল্প তাঁরই সন্ধান করা উচিত। আপনার মত হল, যিনি আত্মার পরিচয় পেয়ে তাঁকে উপলব্ধি করেন তিনি সমস্ত লোক ও কাম্যবস্তু পান। আমরা সেই আত্মাকে জানবার ইচ্ছায় ব্রহ্মচর্য পালন করেছি। …প্রজাপতি বললেন, জলপূর্ণ পাত্রে যাঁর প্রতিবিম্ব পড়ে তিনিই আত্মা। তিনি তাঁদের উত্তম বস্ত্রালংকারে সজ্জিত হয়ে একটি জলপূর্ণ পাত্রের দিকে তাকাতে বললেন ও প্রশ্ন করলেন তাঁরা কী দেখছেন। তাঁরা বললেন সুসজ্জিত পুরুষের প্রতিবিম্ব দেখছেন। প্রজাপতি বললেন ইনিই অমৃত ও অভয় আত্মা, ইনিই ব্রহ্ম। দু’জনে শান্তচিত্তে ফিরে গেলেন। প্রজাপতি মন্তব্য করলেন, এরা আত্মাকে না জেনে চলে যাচ্ছে, এমন লোকেরা পরাভূত হয়। বিরোচন গিয়ে অসুরদের বললেন, ইহলোকে এই আত্মা (= দেহ)-কেই উপাসনা ও সেবা করা উচিত, তা হলেই ইহলোক ও পরলোক দুই-ই লাভ করা যায়।’

প্রজাপতি বললেন, ‘এ-ই হল আসুরী উপনিষৎ, এরই ভ্রমে লোকে মৃতদেহকে উত্তম বস্ত্র-অলংকারে সাজায়, মনে করে ওই সজ্জাতেই পরলোক জয় করা যাবে।… ইন্দ্ৰ কিন্তু আবার ফিরে এলেন। প্রজাপতির প্রশ্নের উত্তরে বললেন, এ তো দেহকেই আত্মা জ্ঞান করা, দেহ তো ধ্বংস হয়, সেটা তো আত্মার ধর্ম নয়।’ প্রজাপতি স্বীকার করলেন, বললেন, ‘ঠিকই। তুমি আরও বত্রিশ বছর এখানে তপস্যা করো।’ এর পরে প্রজাপতি বললেন, ‘স্বপ্নে যাকে দেখা যায় সে-ই আত্মা।’ ইন্দ্ৰ তাতেও তুষ্ট হলেন না। প্রজাপতির নির্দেশে আরও বত্রিশ বছর তপস্যার পরে প্রজাপতি বললেন যিনি সুষুপ্ত তিনিই আত্মা, এতেও ইন্দ্র তুষ্ট না হতে প্রজাপতি আরও পাঁচ বছর পরে তাঁকে বললেন, শরীর মরণশীল, যিনি শরীর ধারণ করেন তিনি শোক দুঃখ ও মৃত্যুর অধীন। শরীর আত্মা নয়, কিন্তু আত্মার আধার; যিনি অশরীর, সুখদুঃখ মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করে না। (দেহস্থ) যিনি মনে করেন ‘আমি চিন্তা করি তিনিই আত্মা’। (৮:৭–৮:১২) এই অংশে দেহ ও আত্মার ভেদ খুব স্পষ্ট করে বোঝানো হয়েছে। মনে হয়, দেহাত্মবাদী চার্বাকপন্থী লোকায়তিক কিছু মতবাদ তখন সমাজে চলিত ছিল এবং আত্মা কী সে-বিষয়ে নানা ধরনের সংশয়ও লোকের মনে উদিত হত:

দর্পণে যাকে দেখা যায় সে-ই কি আত্মা?
জলে যার প্রতিবিম্ব পড়ে সে-ই আত্মা?
স্বপ্নে যে দেখা দেয়, সে-ই আত্মা?
স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রা যার, সে-ই কি আত্মা?

দেহব্যতিরিক্ত আত্মার কল্পনা এ যুগেই প্রথম, তাই তার যথার্থ সত্তা নিয়ে স্বভাবতই জনমনে নানা সংশয়। এ আত্মার সঙ্গে পরলোক ও জন্মান্তর জড়িত, কাজেই এর মৃত্যুতে এর শেষ হলে চলে না। বিষয়টি বিতর্কিত বলে জিজ্ঞাসু ইন্দ্র, যিনি দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। যাঁর প্রশ্ন করছেন, এর জিজ্ঞাসা অল্পে বা মাঝপথে তৃপ্তি হয় না যেমন অসুরশ্রেষ্ঠ বিরোচনের হয়েছিল। এতে তত্ত্বটির উৎকর্ষও প্রতিপন্ন হল, আরও বেশি করে হল প্রজাপতি বারবার ইন্দ্রকে নিয়ে বহু বছর ব্রহ্মচর্য পালন করিয়ে নিয়েছিলেন বলে। এতে বোঝানো হল যে এ তত্ত্ব সাধারণ মানুষের বুদ্ধির কাছে অগম্য এবং সহজে এ জ্ঞান লাভ করা যায় না।

***

১. ‘(Disbelief… ) may spring from the tension between a sceptical mind and a religious heart.’— Kirkegaard, p. 3

২. ‘…the idea of personal immorality has only been divorced from the preceeding one (i.e., the non-death of the soul) after a philosophical elaboration, …a concept of another life does not have its origin in the institution of sacrifice.’- Herbert and Mauss, p. 64

৩. প্ৰজাকামো হ বৈ প্রজাপতিঃ, স তপোহতপ্যত, স তপসস্তপ্তা স মিথুনমুৎপাদয়ত রয়িঞ্চ প্রাণঞ্চেতি। এতৌ সে বহুধা প্রজাঃ করিষ্যত ইতি। প্র. উ. (১:৪)

৪. ভগবন্, কত্যেব দেবা প্রজাং বিধারয়ন্তে? কতর এতৎ প্রকাশয়ন্তে? কঃ পুনরেষাং বরিষ্ঠ? (২:১)

৫. আকাশো হ বা এষ দেবো বায়ুরগ্নিরাপঃ পৃথিবী বাঙ্মনশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রঞ্চ। তে প্রকাশ্যাভিবদন্তি বয়মেতাদ্বাণবষ্টভৎ বিধারয়ামঃ।… বরিষ্ঠঃ প্রাণঃ। প্র. উ. (২:২,৩)

৬. ভগবন্, কুত এষ প্রাণো জায়তে? কথমায়ত্যস্মিঞ্চুরীর আত্মনেং প্রবিভজ্য কথং প্রতিষ্ঠতে? কোনোক্ৰমতে? কথং বাহ্যমভিধত্তে? কথমধ্যাত্মমিতি।… তস্মৈ স হোবাচ— অতিপ্রাশন্ পৃচ্ছসি, ব্রতিষ্ঠোঽসীতি, তস্মাত্তেঽহং ব্রবীমি। আত্মন এষ প্রাণো জায়তে। যথৈষা পুরুষেচ্ছায়া এতস্মিন্নেতদাততং মনোকৃতেনায়াত্যস্মিঞ্চুরীরে। প্র. উ. (৩:১-৩)

৭. ভগবন্নেতস্মিন্ পুরুষে কানি স্বপত্তি? কান্যস্মিন্ জাগ্রতি? কতর এষ দেবঃ স্বপ্নান্ পশ্যতি? কস্যেত‍ সুখং ভবতি? কস্মিন্নু সর্বে সপ্রতিষ্ঠিতা ভবন্তীতি।। তস্মৈ স হোবাচ— যথা গার্গ্য! মরীচয়োঽর্কস্যাস্তং গচ্ছতঃ সর্বা এতস্মিংস্তেজোমণ্ডল একীভবন্তি। তাঃ পুনরুদয়তঃ প্রচরন্তি; এবং হ বৈ সর্বং তৎ পরে দেবে একীভবতি। প্র. উ. (৪:১-২)

৮. স যো হ বৈ তদ্ভগবন্ মানুষ্যেষু প্রায়ণান্তমোঙ্কারমভিধ্যায়ীত। কতমং বাব স তেন লোকং জয়তীতি তস্মৈ স হোবাচ।। এতদ্বৈ সত্যকাম পরঞ্চাপরঞ্চ ব্রহ্ম যদোস্কারঃ। তস্মাদ বিদ্বানেতেনৈবায়তনেনৈকতরমন্বেতি। প্র. উ. (৪:১-২)

৯. কোহয়মাত্মেতি বয়মুপাস্মহে কতরঃ স আত্মা যেন বা রূপং পশ্যতি যেন বা শব্দং শৃণোতি যেন বা গন্ধামাজিঘ্রতি যেন বাচং ব্যাকরোতি যেন বা স্বাদু চাস্বাদু বিজানাতি। ঐ. উ. (৩:১:১)

১০. স এতেন প্রজ্ঞেনাত্মনাস্মাল্লোকাদ্ উৎক্রম্য অমুষ্মিন্ স্বর্গে লোকে সর্বান্ কামান্ আপ্ত অমৃতঃ সমভবৎ।। ঐ. উ. (৩:১:৩)

১১. অথ যদি তে কর্মবিচিকিৎসা বৃত্তবিচিকিৎসা বা স্যাৎ। যে তত্র ব্রাহ্মণাঃ সম্মর্শিনঃ। যুক্তা আযুক্তা। অলূক্ষা ধর্মকামাঃ স্যুঃ যথা তে বর্তেরন্। তথা তত্র বৰ্তেথাঃ। তৈ. উ. (১:৩-৪)

১২. যান্যনবদ্যানি কর্মাণি। তানি সেবিতব্যানি। নো ইতরাণি। যান্যস্মাকং সুচরিতানি। তানি ত্বয়োপাস্যানি। নো ইতরাণি।। তৈ. উ. (১:২:২)

১৩. কেনেষিতং পততি প্রেষিতং মনঃ কেন প্রাণঃ প্রথমঃ প্রৈতি যুক্তঃ। কেনেষিতাং বাচমিমাং বদন্তি চক্ষুঃ শ্রোত্রং ক উ দেবো যুনক্তি।। কে. উ. (১:১)

১৪. শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্, বাচো হ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ। চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরা প্রেত্যাস্নাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি।। কে. উ. (১:২)

১৫. কা সাস্নো গতিরিতি স্বর ইতি হোবাচ স্বরস্য কা গতিরিতি প্রাণ ইতি হোবাচ প্রাণস্য কা গতিরিত্যন্নমিতি হোবাচআন্নস্য কা গতিরিত্যাপ ইতি হোবাচ। অপাংকা গতিরিত্যসৌ লোক ইতি হোবাচমুষ্য লোকস্য কা গতিরিতি ন স্বর্গং লোকমতিনয়েদতি হোবাচ স্বর্গং বয়ং লোকং সামভি সংস্থাপয়ামঃ স্বর্গসংস্তাবং হি সামেতি।। ছা. উ. (১:৮:৪,৫)

১৬. অস্য লোকস্য কা গতিরিত্যাকাশ ইতি হোবাচ সর্বাণি হ বা ইমানি ভূতান্যাকাশাদেব সমুৎপদ্যন্ত আকাশ প্রত্যস্তং যান্তি। (১:৯:১)

১৭. বেত্থ যদিতোঽধি প্রজাঃ প্রযন্তীতি ন ভগব ইতি বেত্থ যথা পুনরাবর্তন্ত ইতি ন ভগব ইতি বেথ পথোদেবযানস্য পিতৃষাণস্য চ ব্যাবর্তনা ইতি ন ভগব ইতি।। বেত্থ যথাসৌ লোকো ন সম্পূর্যত ইতি ন ভগব ইতি বেখ যথা পঞ্চম্যাহুতাবাদঃ পুরুষবচসো ভবন্তীতি নৈব ভগব ইতি। ছা. উ. (৫:৩:২.৩)

Leave a Reply to Mihir Ghosh Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *