০২. সংশয়ের বীজ

সংশয়ের বীজ

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ থেকে একাদশ-দশম শতক পর্যন্ত যে-কালপর্যায়ের মধ্যে ঋগ্বেদের রচনাকাল সম্পূর্ণ হয়েছিল বলে মনে করা হয় সে সময় বৈদিক আর্যদের বিশ্বাসের ছকটা আসলে কী ছিল, ঋগ্বেদের পাঠ ছাড়া তা জানবার আর কোনও উপায় নেই। আর কোনও প্রমাণ বা দলিল তো পাওয়াই যায় না। অতএব ঋগ্বেদে যা পাওয়া যাচ্ছে তাই আমাদের বৈদিক আর্যদের ওই কালপর্বের বিশ্বাসের তথ্য বলে মেনে নিতে হবে। এই ঋগ্বেদ সংহিতার অধিকাংশই, অর্থাৎ প্রায় শতকরা পঁচাত্তর ভাগ সূক্তেই দেবতার সঙ্গে মানুষের আদানপ্রদানের কথা আছে, অর্থাৎ ‘হে দেব, তোমাকে আমরা এই স্তোত্র, এই হব্য নিবেদন করছি, এটা গ্রহণ করে প্রীত হয়ে তুমি আমাদের প্রার্থিত বস্তু দান করো।’ এই ধরনের প্রার্থনার অন্তরালে কিন্তু ওই সব বিশ্বাসই বর্তমান, অর্থাৎ দেবতা আছেন, প্রার্থনা শুনতে পান, স্তোত্র, নৈবেদ্য ও যথাযথ যজ্ঞানুষ্ঠানে তিনি প্রীত হন, প্রার্থী যা চাইছে তা দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর আছে এবং ইচ্ছাও আছে। সর্বশক্তিমান, মানবহিতৈষী দেবতারা আছেন এবং তাঁরা যজ্ঞকারীর নিবেদন শুনে তাকে তৃপ্ত করবেন এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋগ্বেদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সূক্ত দাঁড়িয়ে আছে। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা সম্ভব যে, তখন অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাসী ছিল। এ সিদ্ধান্তে কিছু ফাঁক আছে, কারণ তখনকার যা প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তাতে ওই বিশ্বাস না থাকলেও তাদের যজ্ঞ করা ছাড়া ইষ্টসিদ্ধির কোনও পথই জানা ছিল না। কাজেই যজ্ঞে প্রার্থিত বস্তু পাওয়া না গেলেও যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত, স্তব ও প্রার্থনার সূক্ত রচিত হত, যজ্ঞে সেগুলি আবৃত্তি ও গান করাও হত। এবং এর নেপথ্যে কিছু মানুষের সংশয়ও জন্মাচ্ছিল, কোথাও কোথাও তা বাড়ছিলও, কিছু সূক্তে তা প্রকাশও পাচ্ছিল। আমাদের বর্তমান এই রচনাটির ভিত্তি এই সূক্তগুলি।

প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে, এ সব সংশয় কাদের মনে উঠেছিল? প্রশ্নকর্তারা কোনও বিশেষ একটি অংশের মানুষ নন, বরং এঁরা তৎকালীন সমাজের বৃহৎ একটি বৃত্তাংশে ছড়িয়ে ছিলেন। এঁদের মধ্যে আছেন ব্রহ্মচর্যের শেষে সমাবর্তনের পরে গৃহে প্রত্যাবৃত ছাত্র, ব্রহ্মচারী; আছেন রাজা, ঋষি, ভ্রাম্যমাণ নানা মতের প্রবক্তা ও গুরু; সাধারণ ক্ষত্রিয়, তরুণ বালক, প্রখ্যাত আচার্য ও আরও অনেকে; অর্থাৎ মোটামুটি ভাবে সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় বহু মানুষ এখন একটি সঙ্গত প্রশ্ন আপনিই আসবে: যে-সমাজে দেবতাদের ওপরে বিশ্বাসের ভিত্তিতেই তখনকার একমাত্র ধর্মানুষ্ঠান— যজ্ঞ— আচরিত হত, সে-সমাজের সাহিত্যে সেই দেবতাদের অস্তিত্ব, সর্বজ্ঞত্ব, মঙ্গলময়ত্ব, সর্বশক্তিমত্তা ও মানবহিতৈষা এবং যজ্ঞের প্রণালী ও তার উপযোগিতা নিয়ে যদিও বা কারও কারও মনে প্রশ্ন উঠে থাকে, তবু সে সব প্রশ্ন ধর্মগ্রন্থে সংরক্ষিত হল কেন? এ সব প্রশ্ন তো সমকালীন ধর্মাচরণের মূলে আঘাত করছে, এগুলো তো অগ্রাহ্য করে বিলোপ করাই হত সমাজস্বার্থের অনুকূল।

এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর বেদ থেকে পাওয়া যায় না, অতএব আমাদের নির্ভর করতে হবে যুক্তিযুক্ত অনুমানের ওপরে। দুটি সম্ভাব্য অনুমান করা যায়: প্রথমত, সংশয়-সূচক ঋক্ বা সূক্ত বা অংশগুলির রচয়িতা বলে যাঁদের নাম পাচ্ছি, তাঁদের বাইরেও সমাজের বৃহৎ একটি অংশের মধ্যেও এ-জাতীয় সংশয় পরিব্যাপ্ত ছিল। এঁদের সংখ্যাটা উপেক্ষনীয় নয় বলেই এ সব সংশয়কে তৎকালীন ঋষিমণ্ডলী গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন মনে করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, যাঁদের নামে সংশয়সূচক অংশগুলি শাস্ত্রে বিধৃত হয়ে আছে তাঁরা তখনকার সমাজে এতটাই সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন যে, তাঁদের রচনা, তাঁদের সংশয় ও প্রশ্ন অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া তখনকার শাস্ত্রে অর্থাৎ ঋগ্বেদ থেকে উপনিষদ পর্যন্ত সাহিত্যে এমন অনেক কথা সংরক্ষিত আছে যা আপাতদৃষ্টিতে তাঁদের তাৎক্ষণিক স্বার্থের প্রতিকূল, তবুও এগুলি রক্ষিত হয়েছে। এর মধ্যে এক ধরনের মৌলিক সত্যনিষ্ঠার প্রমাণ আছে: মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত এত স্তব যদি স্মৃতিতে ধারণ করে রাখা, তাহলে সেই সময়েরই মানুষের সংশয়ের প্রকাশই বা কেন থাকবে না? ঠিক এই কারণেই দ্বেষ, হিংসা, শত্রুতা, স্বার্থপরতা, অন্যের ক্ষতি, সম্পত্তিনাশ, এমনকী মৃত্যু ঘটানোর প্রচেষ্টা এবং দেবতাদের মধ্যেও স্বার্থের সংঘাতের বহু প্রমাণ বেদে রয়ে গেছে। ঋগ্বেদ থেকে উপনিষদে এই সংরক্ষণ প্রাচীন মনস্বীদের উদারতার একটি নজির, এবং এর উত্তরাধিকারীদের, অর্থাৎ আমাদের একটা গর্বের বস্তু।

সংশয়ের আলোচনা করার আগে দেখা দরকার কীসে তাদের সংশয় ছিল না। প্রকৃতির সুনিয়ন্ত্রিত আচরণে— দিনরাত্রি ও ঋতুর নিয়মিত আবর্তনে— একটা দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। তার চিহ্ন এ সাহিত্যে প্রায় সর্বত্র। প্রকৃতির ব্যতিক্রমী আচরণ যেমন খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, পঙ্গপাল নিয়ে তাদের স্বভাবতই ক্ষুব্ধ বিস্ময় ছিল; কিন্তু সেটার কারণ তারা ধরে নিয়েছিল যে, প্রকৃতি নিয়ম মেনে চলে। সে-নিয়ম, প্রকৃতিতে ও সমাজে, ঋত; বরুণ ঋতের অধিদেবতা এ কথাও যেমন শুনি, তেমনই ঋত একটি স্বয়ংক্রিয় শক্তি এ বিশ্বাসও তাদের ছিল। এ ছাড়া সমাজে উচ্চনীচ ভেদেও তাদের বিশ্বাস ছিল। ঋগ্বেদেই বর্ণভেদ দেখা দেয় এবং তখন থেকে উচ্চতার মানদণ্ডে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য— ত্রিবর্ণের পুরুষের স্থান ওপরে; প্রাগার্য, ম্লেচ্ছ, চণ্ডাল, শূদ্র, দাস এবং নারী নীচে। আর্য শ্রেষ্ঠ জাতের মানুষ, বাকিরা অপকৃষ্ট; তাদের চেহারা খারাপ, তারা আচরণহীন, শিশোদর নিয়েই থাকে; আর্য উপাসনা-পদ্ধতিতে তাদের বিশ্বাস নেই। আর্যের উপাসনা-পদ্ধতিই উৎকৃষ্ট। ‘কীকটের (বঙ্গদেশ) লোকেরা যজ্ঞ করে না, ওরা গাভি নিয়ে কী করবে? কাজেই, হে দেবতা, ওদের গাভিগুলো আমাদের এনে দাও।’ এ কথার ভিত্তি ওই আর্য শ্রেষ্ঠত্ব। এবং ওই নীতিতেই আর্যের মানুষের সম্পত্তিতে আর্যের অধিকার আছে, এও তাদের বিশ্বাসের একটা অঙ্গ। ‘রুদ্র, তুমি আমাদের সন্তান ও পশুপালের ওপরে তোমার অস্ত্র নিক্ষেপ কোরো না; তুমি আমাদের শত্রুদের সন্তান, সম্পত্তি ধ্বংস করে দাও।’ দেবতাদের দিয়ে শত্রুনাশ ও শত্রুর সম্পত্তি লুণ্ঠনের জন্যে প্রার্থনার পাশাপাশি ঘটনা হল যে আর্যরা নিজেরাও প্রয়োজন মতো সে-কাজ করত। কাজেই সমাজে বর্ণগত ও লিঙ্গগত উচ্চাবচতায় সাধারণ ভাবে বিশ্বাস ছিল, এবং এই বিশ্বাসের বশে উচ্চবর্ণের মানুষ নিম্নবর্ণের ও বর্ণভেদের (প্রাগার্যদের) বাইরের মানুষদের হীন জেনে প্রয়োজনে তাদের ওপর অত্যাচার করত। আর নারীকে একেবারে প্রথম পর্বের পর থেকেই সাধারণ ভাবে হীন বলে মনে করা হত। সমাজে এ সব বিশ্বাস ভিত্তিস্থানীয় ছিল, এ নিয়ে মতভেদ বা আচরণে ভেদ ছিল না, কারণ এর সবটাই— আর্য, শূদ্র, ম্লেচ্ছ, নারী, পুরুষ— ঘোরতর প্রত্যক্ষ ব্যাপার।

সমাজে যেখানে বিপত্তি, অভাব, অসংগতি, যেখানে তার কোনও প্রত্যক্ষ প্রতিকার ছিল না, সেখানেই স্থান দেবমণ্ডলীর ও তাঁদের কেন্দ্র করে যজ্ঞানুষ্ঠানের। সংশয়ের ভূমি সেইখানেই। প্রশ্ন, সংশয় কীসে? যজ্ঞে যেহেতু মূর্তি ছিল না তাই আর্যদের কাছে তাদের দেবতার উদ্ভব ছিল তাদের কল্পনায়। যাস্কের নিরুক্তে দেবতাদের আকার নিয়ে আলোচনায় দেখেছি মানুষের আকারে কল্পনা করা একান্ত স্বাভাবিক বলে তাই ঘটেছিল; তাই বেদের দেবতারা— প্রকৃতির শক্তি, যেমন বায়ু, সূর্য, চন্দ্র, পর্জন্য, অগ্নি বাদ দিয়ে সবাই মনুষ্যরূপী। তবু যে কিছু কিছু সংশয় ছিল তা জানা যায় যাস্কের নিরুক্তের দৈবতকাণ্ডে। যেখানে প্রশ্ন করা হচ্ছে, ‘তা হলে অশ্বিনরা (দুজন) কারা?’ উত্তরে শুনি, ‘কেউ বলে এরা আকাশ ও পৃথিবী, কেউ বলে এরা দিন ও রাত্রি। আবার কেউ-বা বলে এরা পুণ্যবান রাজা (অর্থাৎ উচ্চবর্গের মহান মানুষ্য)।[১]

এর থেকে বোঝা যায়, দেবতাদের মৌলিক সত্তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল এবং ভাল কাজ করেছে এমন মানুষও দেবতার পদে উন্নীত হয়েছেন। ঋগ্বেদ রচনা শেষ হওয়ার শ-চারেক বছর পরে যাস্ক এ কথা বলেন। কিন্তু, এ কথা মনে করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই ধরনের বিকল্প ভাবনা সমাজে আগে থেকেই ছিল, না হলে ‘কেউ বলে’ বলে যাস্ক তিনটি বিভিন্ন মত উদ্ধার করতে পারতেন না। এই সব বিকল্প মত ঋগ্বেদের সময়েই ক্রমে ক্রমে উদ্ভুত হয়েছিল এবং প্রচলিত ছিল, যাস্ক সেগুলিকে একত্র করে বলছেন মাত্র। দেবতাদের আদিসত্তা বা স্বরূপ নিয়ে তখনই মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল।

দেবতাদের স্বরূপের চিন্তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত যে-প্রশ্নটি তা হল, দেবতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস। সমস্ত যজ্ঞপ্রক্রিয়ার ভিত্তিই, দেবতারা আছেন— এই বিশ্বাস। যজ্ঞে তো দেবতারা বিমূর্ত, তাঁদের আহ্বান করে প্রার্থনা করা হয়। কখনও সে-প্রার্থনা পূর্ণ হয়, কখনও হয় না। স্বভাবতই চিন্তাশীল মানুষ ভাববে, ‘আমরা যে হব্য সাজিয়ে, স্তবগান করে এই সব দেবতাদের আহ্বান করে প্রার্থনা জানাই, এঁদের তো দেখতে পাই না, এঁরা কোথায় থাকেন?’ হিরণ্যস্তূপ ঋষি বলছেন, ‘সূর্য এখন কোথায়, কে তা জানে, কোন্ আকাশে এখন তিনি তাঁর রশ্মিজাল বিকীর্ণ করছেন?’[২] মনে হয়, সন্ধ্যার অন্ধকারে এ প্রশ্ন ঋষির ও অন্য অনেকেরই মনে জেগেছিল: ‘যে-সূর্যকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আকাশে দেখা যায়, সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সেই সূর্য কোথায় যায়, কে তা জানে?’ অর্থাৎ, কেউই তা জানেন না। বামদেব ঋষি বলছেন, ‘কোন পথটি দেবতাদের কাছে পৌঁছেছে, কে তা জানে, কে তা বলবে?’ দেবতাদের যে আবাসগুলি অধোমুখী দেখা যায়, সে সব আবাস কে জানে, কোন গোপন উৎকৃষ্ট অনুষ্ঠানে (তা জানা যায়?)।’ (ঋগ্বেদ ৩:৫৪:৫) ঋষি ঋণঞ্চয় বলছেন, ‘কোথায় থাকেন ইন্দ্র? কোন্ বীর ইন্দ্রকে দেখেছে?’[৩] বামদেব ঋষি প্রশ্ন করেন, ‘কোথায় তোমার বাসস্থান? কেন আমাদের আনন্দিত করছ না?’[৪] অগ্নিদেবতা সম্বন্ধে ঋষি আত্রেয় ইষ জিজ্ঞাসা করছেন, ‘সেই অগ্নি কোথায় থাকেন, যাঁর আগমনে হৃষ্ট ভক্তজনেরা অগ্নিস্থানে অগ্নিকে প্রজ্বলিত করেন?’[৫] অরণি দুটির সংঘর্ষণে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়, এটা তারা চোখেই দেখত। তাই স্বভাবতই মনে প্রশ্ন আসত, যখন মানুষ অগ্নিকে প্রজ্বলিত করছে না, তখন অগ্নি কোথায় থাকেন? তেমনই অন্য এক ঋষি, মান্য, প্রশ্ন করছেন, ‘হে আদিত্যগণ, এই জীবিত যে আমরা, আমাদের অভিমুখে দ্রুত চলে এসো। মৃত্যুর আগে কোথায় থাক তোমরা, আমাদের হবন শোন তো?’[৬] যজ্ঞকালে যাঁদের আহ্বান করে রহুগণপুত্র গোতম ঋষি অগ্নিকে বলছেন, ‘তুমি (আসলে) কে, কোথায় আছ?’[৭] স্তব ও নৈবেদ্য উৎসর্গ করা হচ্ছে, তাঁরা যজ্ঞকারীদের মানসলোকে বাস করেন, বা অবতীর্ণ হন যজ্ঞের সময়ে। কিন্তু অন্য সময়ে? কোথায় থাকেন তাঁরা? গূঢ়, অনুচ্চারিত যে-প্রশ্নটি এর অন্তরালে আছে তা হল: কোথাও তাঁরা সত্যিই আছেন তো?

প্রশ্নটা খুবই জরুরি, কারণ এরই সঙ্গে জড়িত তাদের অস্তিত্বের মৌলিক সমস্যাগুলি যেগুলির সমাধানের জন্যে তারা যজ্ঞ করে। তাই যজ্ঞের উপযোগিতা, পদ্ধতি নিয়ে সংশয় আসবেই, ‘কে সেই যজ্ঞকারী, হে অগ্নি, যে তোমার উদ্দেশে যজ্ঞ সাধন করে সমৃদ্ধি পেয়েছে? হে অগ্নি, কেমন মন নিয়ে আমরা যজ্ঞ করব?’ এর পশ্চাতে একটা হতাশাজনিত সংশয় আছে; যে-মন নিয়ে ভক্ত উপাসনা করছে তাতে অভীষ্ট ফল পাচ্ছে না; তাই এই আর্ত আকুতি। অর্থাৎ যজ্ঞে হব্য ও স্তোত্র দিয়েও প্রার্থী জানে না কেমন মনোভাব নিয়ে যজ্ঞ করলে সেটা সফল হবে। তারই সঙ্গে প্রশ্ন আসে ইন্দ্র— যজ্ঞে যিনি অদৃশ্য— তাঁকে আহ্বান করলে তিনি কেমন করে শুনবেন? ‘স্তোতার (স্তব) ইন্দ্র কেমন করে শোনেন? শুনেও বা কেমন করে তার সুরক্ষার ব্যবস্থা করেন? ইন্দ্রের কোন সব প্রাচীন দানের কথা জানা যায়, এই সব হব্য পেয়ে ইন্দ্র কেমন করে স্তোতার বাসনা জানবেন?’[৯] এ প্রশ্ন যজ্ঞকারীর থেকেই যায়— প্রার্থী স্তব নৈবেদ্য দিয়ে দেবতার উপাসনা করলে দেবতা কেমন করে প্রার্থীর মনোভাব জানবেন? না জানলে তো প্রার্থনা পূরণের প্রশ্নই ওঠে না। ঋষি ত্ৰিত কুৎস বলেন, ‘তোমরা (হে দেবতারা) যারা আলোকিত ত্রিলোকে আছে, তোমাদের ঋত, অনৃত কোথায় থাকে? পূর্বকালে আমরা যে-আহুতি অর্পণ করেছিলাম, সেগুলো কোথায় আছ? তোমরাই তা জান, হে আমার আকাশ ও পৃথিবী।[১০]

প্রার্থনা করে, স্তব করে, নিয়ম অনুসারে যজ্ঞ করেও যখন ফল ফলে না তখন এক গভীর নৈরাশ্য ভক্তকে আচ্ছন্ন করে, সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রশ্নও আসে। এর ঠিক পরেই তাই দেখি, ‘হে দেবতারা, পুরাতনকালে যে সব উপকার করতে, সেই উপকার করার ক্ষমতা তোমাদের কোথায় গেল? কোথায় গেল হে বরুণ ঋতকে ধারণ করার, (ভক্তকে) রক্ষা করার সেই ক্ষমতা? হে অর্যমা, ভক্তকে দুর্গম দেশে পথ দেখাবার ক্ষমতা কোথায় গেল? হে আমার আকাশ-পৃথিবী, তোমরাই তা জান।[১১] ভক্তরা একাগ্রচিত্তে দেবতাদের স্তব করেন, তার পর কী হয় সে সব স্তোত্রের? সেগুলি কি কোথাও পৌঁছোয়? কক্ষীবান বলছেন, ‘হে অশ্বিদ্বয়, কোন সেই স্তব যা তোমাদের প্রীত করে? এমন কোনও স্তোতা কি আছে যে তোমাদের তুষ্ট করতে পারে? তোমাদের ভক্তরা যারা তোমাদের শৌর্য জানে না, তারা তোমাদের কোনভাবে তুষ্ট করবে?’[১২] সব কিছু সাধ্য মতো করেও, দেবতাদের স্তব, খাদ্য দিয়েও যখন অভীষ্ট ফল পাওয়া যায় না তখন সেই দেবতার উদ্দেশে প্রশ্ন নিবেদন করে ভক্ত: ‘তুমি আমাদের প্রতি প্রসন্ন হচ্ছ না, কেন তুমি আমাদের তুষ্ট করার জন্য আমাদের প্রার্থিত দান দিচ্ছ না?[১৩]

যজ্ঞ তো নিষ্কাম কর্ম নয়, বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, বিশেষ অবস্থায় মানুষ যজ্ঞ করত। সে-অবস্থা হয় বিপদের, রোগশোকের অথবা কোনও কোনও বস্তুর অভাবের। এ সব অভাব মেটাবার জন্যে, আতঙ্ক, অনিশ্চয়, অভাব বা বিপত্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যজ্ঞ; বিধিমতে সে-যজ্ঞ করেও যখন প্রার্থীর আশা পূর্ণ হয় না, তখন সে অন্ধগলির প্রান্তে এসে ঠেকে। কারণ, প্রকৃতিকে জয় করার ও অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যে একটি উপায়ই তার জানা আছে: যজ্ঞ সম্পাদন। সে-উপায় যখন নিষ্ফল হয় তখন সে চোখে অন্ধকার দেখে। বহু সূক্তের বহু ঋকেই এই গভীর হতাশা প্রতিফলিত। এই হতাশাতেই অন্তর্নিহিত থাকে প্রশ্ন ও সংশয়। দেবতারা মঙ্গলময়, এমন একটা বিশ্বাস হল সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ডের, সমস্ত যজ্ঞবিধির ভিত্তিভূমি। যখন মানুষ মনে করে যে, বিশ্বচরাচরে ঋত আছে, তার অধিষ্ঠাতা বরুণ আছেন, আছেন অন্যান্য মানবহিতৈষী সর্বশক্তিমান দেবতারা, অথচ তাঁদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই বিশ্বে আছে নানা অশুভ শক্তি, যেগুলি নানা ভাবে মানুষকে ব্যর্থ করে, পীড়া দেয়, তখন সমস্ত বিশ্ববিধান সম্বন্ধেই একটা গভীর সংশয় দেখা দেয়। ‘মন্দের অস্তিত্ব সত্ত্বেও দেবসার্বভৌমবাদ প্রথমে সেই সব তত্ত্বকে অবলম্বন করে সৃষ্ট হয় যেগুলি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করে কেমন করে একজন সর্বশক্তিমান ও সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বর পৃথিবীতে মন্দকে স্থান দিতে সম্মত হন।’[১৪]

সংসারে মন্দের নানা রূপ; তবে সাধারণ ভাবে বলতে গেলে যা-কিছু ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থকে আঘাত করে, তা-ই মন্দ। এ মন্দ প্রকৃতির যে-শক্তি মানুষের অনিষ্টসাধন করে তাতেও যেমন স্পষ্ট, মানুষের দ্বেষহিংসা, ক্ষতিকারক কার্যকলাপ, তাতেও তেমনই প্রকাশিত। আবার যখন দূরারোগ্য রোগ, যন্ত্রণা, অকালমৃত্যু, প্রতিবন্ধিত্ব মানুষকে আঘাত করে শরীরে মনে, তখন সে-ও মন্দের এক রূপ, সহজ বুদ্ধিতে যার কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। তখনই মানুষের মনে গভীর সংশয় দেখা দেয়: দেবতারা যদি মঙ্গলময় ও মানবহিতৈষী হন, তাঁরাই যদি বিশ্বসংসার নিয়ন্ত্রণ করেন তবে যা মানুষের স্বার্থের প্রতিকূল, যা তাকে পীড়া দেয় তার ক্ষতি করে, এমন শক্তিকে তাঁরা এ সংসারে প্রবেশ করতে দিলেন কেন? এই বিরোধ আস্তিক্যের মর্মমূলে টান দেয়, বিশ্বাসকে উৎখাত করতে উদ্যত হয়।

মানুষের মনে দেবতাদের সম্পর্কে সংশয় অনেকগুলি রূপে দেখা দিতে পারে। দেবতাদের সঙ্গে মানুষের প্রথম সম্পর্ক যজ্ঞে: অনুষ্ঠানে প্রার্থনাপূরণ না হলে মানুষ ভাবতে বসে, গোলমালটা কোথায়? যজ্ঞের নৈবেদ্যটা কি ঠিকঠাক হয়নি, মনোমতো হয়নি দেবতাদের? যজ্ঞের প্রক্রিয়া কি তাঁদের অভিমত নয়? আমাদের স্তব কি তাঁদের প্রীত করেনি? এগুলিই যদি কারণ হয়, তাহলে সমস্যা হল, এ সব বিষয়ে তাঁদের অভিরুচি কী তা কেমন করে জানা যাবে? এইখানে ভক্ত ও তার ভগবানের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড মহাশূন্যের ব্যবধান থেকেই যায়।

ঋষি গৌতম প্রশ্ন করেন: ‘দেবতাদের বিধিমতে আরাধনা করার পরেও কোন (ঋত্বিক) জানতে পারেন কার কাছে পৌঁছোল (সেই হবি, ঘৃত ইত্যাদি), কে জানতে পারে সেই উদ্দিষ্ট দেবতা (ইন্দ্র) কে?’[১৫] ত্ৰিত কুৎস প্রশ্ন করেন অগ্নিকে, ‘সমস্ত যজনীয়দের আদিভূত (অগ্নি)-কে প্রশ্ন করি, যিনি (দেবতাদের) দূত তিনি (আমাকে) বলুন, আমাদের (প্রতি বর্ষিত তাঁর পুরাতন প্রসাদগুলি কোথায় গেল? বর্তমানে তাঁর নূতন প্রসাদ কে ভোগ করছে? আমার আকাশ পৃথিবী তা জানেন।’[১৬] দেবতারা আমাদের বলুন, এ প্রার্থনা নানা ভাষায় বারে বারে আছে। আমরা বুঝতে পারছি না, অর্থাৎ সাধারণ বুদ্ধিতে, যুক্তিতে যেমনটি হওয়ার কথা তা হচ্ছে না, মিলছে না হিসেব; অতএব দেবতারা আমাদের বলুন। আমরা সন্দেহ করতে চাই না, কিন্তু যখন দুই আর দুই মিলে বারেবারেই তিন কিংবা পাঁচ হয়, তখন শুধু খটকা লাগে না, সমস্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে টান পড়ে। প্রশ্ন উদ্যত হয় দেবতাদের উদ্দেশে। অথচ দেবতারা তো সংশয় নিরসন করেন না, ভক্তের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন না, কাজেই প্রশ্ন থেকেই যায়। ঋষিরা যখন স্তব রচনা করেন তখন সে সব প্রশংসার উৎস তাঁদের বিশ্বাস এবং প্রয়োজন; স্তবের সঙ্গে যুক্ত থাকে বহুবিধ প্রার্থনা, সুস্থ, বিজয়ী, নীরোগ, দীর্ঘজীবী, প্রাচুর্যপূর্ণ, সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতে যা যা প্রয়োজন তার জন্যে প্রার্থনা। অনেক সময়ে প্রার্থনার সঙ্গে থাকে দানস্তুতি অর্থাৎ কোন দেবতা কোন কোন পূর্বতন প্রার্থীকে কী কী দান করে কৃতার্থ করেছেন তার তালিকা। জ্ঞানের জন্যে, পারিবারিক শান্তির জন্যেও প্রার্থনা থাকে; জীবনের অজ্ঞেয়, রহস্যময় দিক, যা চিরকাল মানুষকে ভাবিয়েছে তাকে বোঝবার জন্যেও চেষ্টা ব্যক্ত হয়েছে বহু সূক্তে।

সারা পৃথিবীতেই জীবনের রহস্য সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা একটা দুর্লভ সম্পদের মতো মুষ্টিমেয় কিছু মনীষী সংগোপনে রক্ষা করেন। ঋগ্বেদ-অথর্ববেদে এমন কিছু সূক্ত আছে যার ব্যাখ্যা প্রশ্নাতীত নয়, নানা ভাষ্যকার নানা ভাবে অর্থ করার পরেও যেগুলির বিবক্ষিত বিষয়টি রহস্যাচ্ছন্নই রয়ে গেছে। অর্থাৎ এগুলি যেহেতু জীবনের মৌলিক রহস্য সম্বন্ধে রচয়িতা ঋষির ব্যক্তিগত উপলব্ধি, যা তিনি স্বভাবতই কতকটা রহস্যাবৃতই রাখতে চেয়েছিলেন, তাই অভিধাগত অর্থ দিয়ে তাঁর উপলব্ধির গহনে প্রবেশ করা যায় না। তেমনই খিলসূক্তে কিছু কিছু সূক্ত আছে যার পশ্চাৎপট হারিয়ে গেছে বলে সেগুলির যথাযথ অর্থ আজ আর জানা যাবে না। এগুলি কতকটা ইচ্ছে করেই ধাঁধার আকারে রচিত, হয়তো এগুলিরও অন্তগূঢ় অভিপ্রেত অর্থের মধ্যে আদিতে কিছু প্রশ্ন নিহিত ছিল, যার সমাধান না করতে পেরে রচয়িতা তাঁর ওই সব অনুত্তরিত প্রশ্ন প্রহেলিকার আকারে সংরক্ষণ করেছেন। এ সব প্রশ্ন স্পষ্ট আকারে নেই বলে এদের আজ আর স্বরূপে চেনা যাবে না। কিছু আছে যা আজকের পণ্ডিতরা ভূমি, পশু ও নারীর প্রজনিকা শক্তি বৃদ্ধির জন্যে— সম্ভবত কিছু সুচিরলুপ্ত অনুষ্ঠানের সঙ্গে— আবৃত্তি করার উদ্দেশ্যে রচনা করেছিলেন; এগুলির মধ্যেও কিছু জিজ্ঞাসা আছে যা জিজ্ঞাসার আকারে উপস্থাপিত নয়, প্রতিপাদিত তথ্যের আকারে রক্ষিত আছে। যা বলতে চাই তা হল সরাসরি প্রশ্ন ছাড়াও গৌণ ভাবে তৎকালীন মনীষীদের নানা জিজ্ঞাসা ও সংশয় নানা আকারে রয়ে গেছে যেগুলিকে অভিধাগত অর্থে চেনা যাবে না, তাই সেগুলির যথার্থ স্বরূপ হয়তো কোনও দিনই উদ্ঘাটিত হবে না।

আমাদের আলোচনা অবশ্য উচ্চারিত প্রশ্ন নিয়েই। আর্যদের দেবমণ্ডলীতে প্রধান দেবতা ছিলেন তাঁদের অভিযানের দেবায়িত সেনাপতি ইন্দ্ৰ। এই দেবায়ন তাঁর মৃত্যুর পরে ঘটেছিল এবং তখন তিনি তাঁর ভক্তদের সব রকম সমস্যার সমাধান করেন। তিনি সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, ধনদাতা, অন্নদাতা, ঋগ্বেবেদের সমস্ত সূক্তের এক-চতুর্থাংশের বেশি অংশের দেবতা ইন্দ্র। প্রথম দিকে দেবমণ্ডলীর প্রধান, পরবর্তীকালে তিনিই হলেন দেবরাজ। ইন্দ্র তাঁর নির্দিষ্ট আধিপত্য প্রয়োগ করলে অন্যান্য দেবতারা যথাযথ আচরণ করবেন, সমস্যা থাকবে না। সেই জন্যে ইন্দ্ৰ সম্বন্ধেই সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ভক্তদের, তাই তাঁকে নিয়েই নানা সংশয়। এত ক্ষমতাবান যে ইন্দ্র ‘কোন বোধে সেই পরমদেবতাকে মানুষ অবধারণ করবে? সেই মহান দেবতা এক নিমেষেই তাঁর মনীষা দিয়ে আশ্চর্য (কর্ম) সম্পাদন করেন। তিনি (ভক্তের পাপ ক্ষমা করেন এবং স্তোতাকে দান করেন।’[১৭] প্রশ্ন বামদেব ঋষির, এবং শুধু তাঁর নয়, বহু ভক্তেরই: ‘এমন যে মহাপরাক্রমশালী ইন্দ্র, কোন মনীষা দিয়ে তাঁকে জানবে মানুষ?’ অর্থাৎ ইন্দ্রকে ধারণা করে বোধের অন্তর্ভুক্ত করা মানুষের সাধ্য নয়।

এখানে প্রশ্ন মানুষের জ্ঞানের বা বোধের সীমা নিয়ে, মানুষের বোধের বাইরে ইন্দ্র; তাঁকে ধারণা করা মানুষের সাধ্য নয়। কিন্তু নেম ভার্গব ঋষির প্রশ্ন আরও মৌলিক। যারা সংগ্রাম (মতান্তরে অন্ন) পেতে চাও, সেই যজ্ঞকারীরা ইন্দ্রকে সত্যই স্তবে পূর্ণ করো— যদি সত্যই তিনি থাকেন।’ বলা হচ্ছে, ‘ইন্দ্ৰ নেই, কে তাঁকে দেখেছে? কার উদ্দেশে স্তব করব?[১৮] নেম ভার্গব বলছেন, ‘যজ্ঞকারীরা কিছু প্রার্থনা করে ইন্দ্রকে তুষ্ট করুক, যদি সত্য বলে কিছু থাকে’। এটা পুরোহিত-যজমানের মধ্যে চিরন্তন দেনাপাওনার সম্পর্ক যা তারা যজ্ঞ করে, দেবতার কাছে প্রার্থনা করে, প্রার্থনা পূরণের আশা করে বহুকাল ধরে বজায় রেখেছে। যজ্ঞে স্তব হব্য ও অনুষ্ঠানের পেছনে যে বিশ্বাসের প্রণোদনা তা হল ইন্দ্রের অস্তিত্বে আস্থা। ইন্দ্র বলে কোনও শক্তিমান ভক্তহিতৈষী দেবতা থাকলে তবে তো ভক্তের অভীষ্ট পূর্ণ হবে? এখানে নেম ভার্গব বলছেন, ‘ইন্দ্ৰই নেই।’ আগেই বলে নিয়েছেন, ‘যদি সত্যই তিনি থাকেন। এখানে সম্ভাবনা দুটো: তিনি আছেন বা তিনি নেই।

ন্যায়শাস্ত্রে প্রথম প্রমাণ হল প্রত্যক্ষ, ইন্দ্রিয় দিয়ে জানা। লোকেরা যদি চোখে ইন্দ্ৰকে দেখে থাকত, তা হলে নেম ভার্গবের আপত্তি টিকত না; সেই জন্যে ইন্দ্রে যারা বিশ্বাসী তাদের কাছে এই প্রত্যাহ্বান, ‘তোমরা যে ইন্দ্রকে বিশ্বাস করে তাঁর উদ্দেশে যথাবিধি যজ্ঞ করে আশা করে বসে থাক যে, তিনি তোমাদের প্রার্থনা পূরণ করবেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কোনও দিন কি সেই ইন্দ্রকে দেখেছে?’ এর উত্তর স্বভাবতই চুপ করে থাকা, কেউ সত্যিই ইন্দ্রকে কোনও দিন দেখেনি। আর ইন্দ্র হলেন দেবশ্রেষ্ঠ, তাঁকেই যদি কেউ কোনও দিন না দেখে থাকে তা হলে বাকি দেবতারা যাঁরা তাঁর তুলনায় নীচে, তাঁদের সম্বন্ধে কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তা হলে সমস্ত যজ্ঞক্রিয়াটাই শুধু নিরর্থক হয়ে গেল না, বিশ্বচরাচর সম্বন্ধে প্রত্যয়ের ভিতটাই ভেঙে গেল, শূন্য বেদির সামনে উচ্চারিত প্রার্থনা বাতাসে মিলিয়ে গেল। প্রতিধ্বনি সংশয়ের ধ্বনিতেই ফিরে এল স্তোতার কাছে।

ঋষি গৃৎসমদ এ সংশয়ের এক ধরনের একটা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যে ঘোর দেবতার বিষয়ে প্রশ্ন করে তিনি কোথায়, কিংবা যারা বলে ইনি নেই, ইনিই তো প্রসন্ন হয়ে বহুতর পুষ্টি, শত্রুদের সম্পত্তি, আহরণ করে এনেছেন, তাঁকে বিশ্বাস কর। হে জনগণ, তিনিই ইন্দ্ৰ।’[১৯] এ ঋক্‌টিতে লক্ষ করবার অনেকগুলি বিষয় আছে। প্রথমত, এটির পূর্বপক্ষ হচ্ছে নেম ভার্গবের স্পষ্ট উক্তি— ইন্দ্ৰ নেই; এতে তার উত্তর দেওয়া হচ্ছে। যিনি প্রসন্ন হয়ে বহু শত্রুসম্পত্তি আহরণ অর্থাৎ হরণ করে এনে আর্যদের পুষ্টি জুগিয়েছেন তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করা তো বাতুলতা। সেই শত্রুসম্পত্তি, সেই পুষ্টি তো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব, কাজেই যিনি তা শত্রুদের কাছ থেকে হরণ করে আর্যদের এনে দিয়েছিলেন তাঁর অস্তিত্বে কেমন করে অবিশ্বাস করা যায়?

এখানে দুটো বিভিন্ন যুগের দুই বিভিন্ন ইন্দ্রের কথা বলা হচ্ছে। আর্যদের সেনাপতি ইন্দ্র যখন প্রথম অভিযানে প্রাগার্যদের পরাস্ত করে তাদের শস্য অন্ন খাদ্য সম্পত্তি পশুপাল হরণ করে এনে দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক সেনাপতির স্মৃতি তো আর্যদের মনে উজ্জ্বল। কালক্রমে তাঁর মৃত্যু হলে আর্যরা কল্পনায় তাঁকে স্থাপন করে ‘দেবরাজ’ করে তুললে পর তিনি আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রইলেন না। তখন তাঁর স্থান স্মৃতিতে কল্পনাপ্রসূত প্রত্যয়ে। ভূমিকা তাঁর একই রইল, অন্তত প্রথম কিছুকাল তিনি বিজেতা সেনাপতি, পরাক্রান্ত নেতা, আগন্তুক আর্যদের অন্নদাতা। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন তিনি আর দৃষ্টিগোচর নন, তখন বিশ্বাসী সংশয়ীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ঐতিহাসিক ইন্দ্রের বাস্তব সত্তা, এবং অনুযোগের সঙ্গে নির্দেশ দিচ্ছে: তাঁকে বিশ্বাস করো জনগণ, তিনিই ইন্দ্ৰ। এই শেষ অংশটি— জনাস ইন্দ্ৰ— চোদ্দোবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে। এত বার আবৃত্তি করার প্রয়োজনটা বোঝা যায়; সংশয়টা একা নেম ভার্গবের ছিল না। বস্তুত নেম ভার্গবের উক্তিতে সংশয়ের ভাষা নেই, প্রত্যয়েরই ভাষা : ইন্দ্ৰ নেই। এ বোধ বহু মনে সংক্রামিত হয়েছিল বলেই এত বারবার তার খণ্ডন করার দরকার পড়ল।

যজ্ঞ সম্বন্ধে আমরা গবেষকদের কাছে যা জেনেছি তাতে আবৃত্তি ও গানের বিশেষ বিশেষ অংশে সমবেত জনতা সক্রিয় অংশ নিত। মনে হয় ওই ‘স জনাস ইন্দ্ৰঃ’ অংশটিও তেমনই একটা অংশ যা সকলে উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তি করত। এই প্রক্রিয়াকে মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন আত্মবিশ্বসনের উপায় (autosuggestion), কোনও একটা উক্তি নিজের কাছে বারবার আবৃত্তি করলে ক্রমে অবচেতনে সেটা প্রত্যয়ের স্তরে দৃঢ় হয়ে যায়।

আরও দুটো জিনিস লক্ষ করবার আছে: প্রথম লোকে যখন অদৃশ্য ইন্দ্রের সর্বশক্তিমত্তা এবং আর্যহিতৈষাতে সন্দিহান, তখন গৃৎসমদ এবং তৎপন্থীরা সে সংশয় নিরসন করতে চাইছেন ঐতিহাসিক ইন্দ্রের আর্যদের অনুকূলে ভূমিকা দিয়ে। মাঝে হয়তো কয়েক শতকের ব্যবধান, কারণ প্রথম ইন্দ্র যে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করবার অন্তত দু-তিনশো বছর আগেই ছিলেন তার প্রমাণ আনাতোলিয়ার বোঘাজ-কো-ঈ শিলালেখে। তিনি সম্ভবত পরাক্রান্ত বিজেতা ছিলেন বলেই আর্যদের পরবর্তী সব পরাক্রান্ত সেনাপতিদের উপাধি দেওয়া হত ইন্দ্ৰ। ইন্দ্র যে একটি পদ তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।[২০] তা হলে নেম ভার্গব অদৃশ্য ইন্দ্রের অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন প্রথম ইন্দ্রের তিরোধানের বেশ কয়েক শতাব্দী পরে, প্রথম জনের আহুত সম্পদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। পরিশেষে এ সমস্ত প্রসঙ্গটার পেছনে আছে সমষ্টিগত ভাবে আর্যদের যজ্ঞফলের ব্যর্থ প্রতীক্ষায় অবসিত সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা। ইন্দ্র থাকলে প্রার্থনা শুনতেন, একদা তো শুনেছিলেন, কিন্তু সে কবেকার কোন ইন্দ্র? তাঁকেই, বা তাঁর স্মৃতিকেই সামনে এনে গৃৎসমদ বলছেন, ‘স জনাস ইন্দ্ৰঃ’। বলছেন, কারণ বলবার খুব মর্মান্তিক প্রয়োজন ঘটেছে। একা নেম ভার্গবই নন, চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী অনেক মানুষই তখন ইন্দ্রের অস্তিত্বে সন্দিহান।

‘দেবতার অস্তিত্বে, এমনকি দেবরাজ (ইন্দ্র)-এর অস্তিত্বে এই সন্দেহ এবং বিশ্বসৃষ্টির মূল ভিত্তিভূমি সম্বন্ধে সংশয়ের উদ্রেকও নাস্তিক্য নয়। এ সব ধারণাকে এর পরেও যুক্তি দিতে হবে যে, ঈশ্বরে বিশ্বাস একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। এ সব যুক্তি তখনই দেখা দেয় যখন দার্শনিক বিকল্প হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে উদীয়মান ভগবদ্‌বিশ্বাস বিশ্বভুবনের ঐকান্তিক উৎস ও অধিপতি সম্বন্ধে ধারণার মুখোমুখি হয়।’[২১]

শুধু একজন দেবতার প্রতি অবিশ্বাস, এমনকী তিনি দেবরাজ ইন্দ্র হলেও তাঁর প্রতি অবিশ্বাসও প্রকৃত নাস্তিক্য নয়। দেবতায় বিশ্বাস ও সৃষ্টির মূল বিমূর্ত শক্তির উৎস— এ দুটি দীর্ঘকাল ধরে পরস্পরের সম্মুখীন হয়ে থাকার পর যখন এদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে অর্থাৎ মানুষ যখন তার কল্পনাসৃষ্ট অবয়বী দেবতায় বিশ্বাস হারায়, তার পরেও সৃষ্টির মূল শক্তির ওপরে বিশ্বাস রাখতে গিয়ে দুটি বিশ্বাসের সংঘাতে যখন সব বিশ্বাস হারাবার যুক্তি সৃষ্টি করে, তখনই দেখা দেয় নাস্তিক্য। সে-বোধ ঋগ্বেদে স্পষ্ট হয়নি, তার উদ্ভব অনেক পরে; তবু তার সূচনা ঋগ্বেদেই।

যজ্ঞ এবং দেবতা সম্বন্ধে তাদের নিশ্চিত জ্ঞানের অভাব সম্বন্ধে ঋষিরা অবহিত ছিলেন: ‘কোন্ বিদ্বান ছন্দগুলির প্রয়োগ জানেন? কেই-বা হোতা, প্রমুখদের স্থানের উপযুক্ত বাক্য জানেন? সাতটি ঋত্বিকের পরের অষ্টম স্বতন্ত্র ঋত্বিক্ কাকে বলে? ইন্দ্রে দুটি অশ্ব (হরী)গুলিকে কে জানে?’[২২] যজ্ঞ যখন একমাত্র উপাসনা, তখন মানুষ সে সব কাম্য বস্তুর জন্য প্রার্থনা করে, তা পাওয়ার সব সম্ভাবনা নিহিত থাকে যজ্ঞ-অনুষ্ঠানটির ওপরে। এর তিনটি মূল অংশ: ১) দেবতা, ২) স্তোত্র ও হব্য, এবং ৩) যজ্ঞের প্রক্রিয়া। এর সবগুলিই মানুষ নিজের কল্পনা ও বুদ্ধি থেকে সৃষ্টি করেছে; এখন, এগুলি যে যথার্থ ও বাস্তব তার তো কোনও প্রমাণ নেই। কে জানে, দেবতারা সত্যই আছেন কি না, মানুষ যে স্তব ও নৈবেদ্য তাঁদের সামনে অৰ্পণ করেন, সেগুলি দেবতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য কি না তা-ই বা কে জানে এবং যে প্রক্রিয়ায় যজ্ঞ সম্পাদন করা হয় তাও-ও তো কোনও এক বিস্মৃত অতীতে মানুষই উদ্ভাবন করেছিল, সে প্রক্রিয়া যে যথার্থ তারও তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাই সংশয় মূল ব্যাপার থেকে প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি— যেমন ছন্দের প্রয়োগ, ইন্দ্রের দুটি অশ্ব— এ সব নিয়েও। কোনওটাই তো দেবতারা মানুষকে বলে দেননি: তাঁরা আছেন কী নেই। কেমন স্তবে তাঁরা প্রীত হন, কোন হব্য তাঁদের মনোমতো এবং কেমন ভাবে যজ্ঞ সম্পাদন করলে তাঁরা তুষ্ট হয়ে প্রার্থীর প্রার্থনা পূরণ করবেন; এ সবই মানুষের অনুমান। অতএব বড় একটা ফাঁক ওখানেই থেকে গেছে। এই অনুপুঙ্খগুলি যোগ করলে হয় যজ্ঞ, কাজেই, এগুলির যে-কোনও একটা ভুল হলেই যজ্ঞ নিষ্ফল হবে, মানুষের প্রার্থনা অপূর্ণ থেকে যাবে। যত কাল যাচ্ছিল নিষ্ফল যজ্ঞের সংখ্যা বাড়ছিল, স্বভাবতই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগছিল গলদটা কোথায়? কারণ তাদের যাবতীয় প্রার্থিত বস্তু যজ্ঞের মাধ্যমেই পাওয়ার কথা, না পেলে বাস্তবজীবনে বহুতর অপূর্ণতা, ক্ষতি, ব্যর্থতা। কাজেই সংশয় যখন আপাত খুঁটিনাটি ব্যাপার— ছন্দ, হব্য, স্তব— নিয়ে তখনও ব্যাপারটা তাদের কাছে জীবনমরণ সমস্যাই। যজ্ঞে অভীষ্ট ফল না পাওয়া গেলে জীবনযাত্রা দুর্বল হয়ে উঠতে পারে, আবার এত ছোট ছোট সব ত্রুটিতেই যজ্ঞ নিষ্ফল হয়ে যেতে পারে। তাই বারেবারে বিভিন্ন অনুপুঙ্খ নিয়ে যে মানুষের মনে সংশয় জেগেছে সেগুলি তুচ্ছ নয়, এবং বস্তুত অনুপঙ্খের চেয়ে অনেক বেশি সেগুলির গুরুত্ব: গোটা যজ্ঞটাকেই নিষ্ফল করে দিতে পারে এই সব আপাত ক্ষুদ্র ত্রুটির যে-কোনও একটাই।

দেবতাদের অস্তিত্ব ছাড়াও যজ্ঞক্রিয়ার যথার্থতা নিয়েও নানা সংশয় ছিল। মানুষ দেবতার প্রসাদ চেয়ে স্তব ও হব্য দিয়ে যজ্ঞে যে অনুষ্ঠান করে তা তো মানুষই ধীরে ধীরে নিজের চিন্তা ও কল্পনা দিয়ে উদ্ভাবন করেছে, সেগুলো দেবতার মনোমতো কি না তা জানবার কোনও উপায়ই নেই। তাই সে অশ্বিনদের প্রশ্ন করেছে: ‘উপাসকের স্তব কে শোনে? কাকে তা প্রীত করে? দেবতাদের মধ্যে কে এই সব শোভন প্রশংসার স্তব শোনেন?’[২৩] অথবা ‘(অশ্বিনরা), কেমন স্তোত্র তোমাদের পক্ষে যোগ্য, (যার দ্বারা) অনুপ্রাণিত হয়ে তোমরা আমাদের কাছে আসবে? কে তোমাদের ক্রোধ বহন করতে পারে?’ (৪:৪৩:৪) এর অর্থ হল: আমরা তো আমাদের অনুমানশক্তির ওপরে ভরসা করে যা তোমাদের পক্ষে উপযুক্ত মনে করি তেমন স্তব করি। কিন্তু সে স্তব যে সত্যিই তোমাদের উপযুক্ত, গ্রহণযোগ্য ও প্রীতিকর সে বিষয়ে আমরা কেমন করে নিশ্চিত হব? যদি আমাদের স্তব তোমাদের অভিমত বা তুষ্টিজনক না হয় তা হলে স্বভাবতই তোমরা ক্রুদ্ধ হবে; তোমাদের সে-ক্রোধ আমরা সামান্য মানুষ কেমন করে বহন করব? মরুতদের প্রশ্ন করা হচ্ছে, ‘কেমন খাদ্য তোমাদের পক্ষে উপযুক্ত?’ (১:১৬৫:১৫) দেবতাদের মধ্যে কনিষ্ঠতম যে অগ্নি তাঁকে আমরা যজ্ঞ সম্বন্ধে প্রশ্ন করছি, তিনিই বলুন, এই যে দেবতারা ত্রিলোকে সঞ্চরণ করেন, স্বর্গে ও মর্ত্যে, এঁদের মধ্যে যথার্থ ও অযথার্থ হব্য সম্বন্ধে কে জানেন? (১:১০৫:৪৫)

এর মধ্যে দুটি জিনিস লক্ষ করবার মতো: মরুতরা বায়ু, তাঁরা কি হব্য আহার করেন, করতে পারেন? তাই মানুষ বিভ্রান্ত বোধ করছে এই ভেবে যে এই যে আমরা মানুষের সুখাদ্য, সুপেয় বস্তু নিবেদন করছি, বায়ু দেবতাদের কাছে কি তা গ্রহণীয়? তাঁরা কি এ সব আহার বা পান করতে পারেন? দ্বিতীয়ত, সূর্য চন্দ্র বায়ু পৃথিবী এ সব দেবতা তো প্রথম থেকেই ছিলেন, কিন্তু মানুষ দু-হাতে অরণি ঘর্ষণ করে সৃষ্টি করল অগ্নিদেবতাকে, তাই সকলের পরে এঁর জন্ম বলে এঁকে কনিষ্ঠতম বলা হচ্ছে। দেখা যায়, জন্মমাত্রই অগ্নি অরণি দুটিকে গ্রাস করে, অতএব, ‘এই যে চরু-পুরোডাশ্-মাংস, ইত্যাদি এনে অগ্নির সামনে নিবেদন করছি, এগুলো ইনি আহার করবেন তো? আগুনে যেহেতু অরণি খণ্ড দুটি ভস্ম হয়ে যায়, হব্যও তেমনই ভস্ম হয়ে যায়; কিন্তু কাঠ তো খাদ্য নয়, এগুলো তাঁর খাদ্য বটে তো? ভস্ম করাই কি আহার? যা ভস্মীভূত হয় তা-ই কি যথার্থ আহার্য?’ এ সব সংশয়ের তো কোনও সমাধান মেলে না। অগ্নি একমাত্র দেবতা যাঁর প্রচণ্ড শক্তি মানুষ নানা রূপে প্রত্যক্ষ করে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোনও কিছুতে অগ্নিসংযোগ করলে অল্প সময়েই তা দগ্ধ হয়, দাবানলে বিস্তীর্ণ অরণ্যানী ভস্মের স্তূপে পরিণত হয়। তাই অগ্নিদেবতা আর্যদের কাছে বিশেষ সম্মানের; অগ্নি ব্রাহ্মণ, প্রত্যেক মণ্ডলের প্রথম সূক্তটি বা সূক্তগুলি অগ্নির উদ্দেশে নিবেদিত। সেই অগ্নিকে প্রীত রাখার অনেক দায়, আর্যরা প্রাগার্য বসতি গ্রাস করছিল অগ্নিসংযোগ করে, এ ভাবেই তাদের বাসভূমির বিস্তার ঘটছিল। আকস্মিক অগ্নিকাণ্ড থেকে আত্মরক্ষা করাও তাদের প্রয়োজন হত। অগ্নিপক্ব খাদ্য প্রস্তুত করা, হিংস্র শ্বাপদ থেকে রাত্রে নিরাপত্তার জন্যে প্রজ্বলিত অগ্নির শরণ নেওয়াও অত্যাবশ্যক ছিল। তাই এমন যে বহুধা-সম্মাননীয় অগ্নি, তাঁর সম্বন্ধে মানুষের নানা প্রশ্ন: যখন আমরা প্রজ্বলিত করি না, তখন তিনি কোথায় থাকেন, আমরা যা দিয়ে তাঁর উপাসনা করি তা তাঁর অভিমত তো?

দেবতাকে উপাসক বারেবারেই প্রশ্ন করছেন, কখন তুমি খাদ্য ও প্রাচুর্য দিয়ে আমার স্তবের ও হব্যের প্রতিদান দেবে? ওইগুলির পিছনের সত্য হল, যজ্ঞ করেও অভীষ্ট ফল না পাওয়া, বা এত বিলম্বে পাওয়া যে, যজ্ঞ ও ফলের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ যুক্তিসিদ্ধ ভাবে স্থাপন করা দুরুহ; তখন স্বভাবতই মানুষের মনে হবে এ ফল আকস্মিক, কাকতালীয়বৎ। ফলে, যজ্ঞ করে প্রার্থিত ফল না পেয়ে স্বভাবতই মানুষ অধীর হয়ে উঠে যজ্ঞের অন্তরালে যে-দেবতাটির কাছে প্রার্থনা নিবেদন করেছিল তাঁরই কাছে এই অযৌক্তিক বিলম্বের জন্যে নালিশ করেছে, ব্যাখ্যা চেয়েছে। জানতে চেয়েছে তার যজ্ঞক্রিয়ার কোনও ত্রুটির জন্যেই কি এই বিলম্ব, নৈবেদ্যটি কি দেবতার মনোমতো হয়নি? বা স্তোত্রটি? এ সব সংশয় যজ্ঞকারীর পক্ষে অনিবার্য, এর থেকে তার অব্যাহতি নেই, যেহেতু কেন ফল হচ্ছে বা কেন হচ্ছে না এ সম্বন্ধে দেবতারা চিরনিরুত্তর।

মানুষ দেবতাদের সম্বন্ধে অতিকথা রচনার সময়ে সর্বদাই অবচেতনে অবহিত থাকে যে, এখন সে যে সব দেবতাকে আহ্বান করে যে পদ্ধতিতে যজ্ঞ সম্পাদন করে যে-যে প্রার্থনা জানাচ্ছে, দূরবিস্মৃত কোনও এক অতীতে (in illo tempore) দেবতারা ঠিক সেই প্রক্রিয়ায় যজ্ঞ করে সেই সব অভীষ্ট ফল লাভ করেছিল। অর্থাৎ, এই যজ্ঞপ্রণালী পরীক্ষিত, ভক্তের প্রার্থনা পূরণ করার ক্ষমতা যে দেবতাদের আছে তা-ও পরীক্ষিত। কিন্তু এ তো মানুষের স্বকল্পিত প্রবোধ; বাস্তবে যখন বিধিমতে যজ্ঞ করেও ফল মেলে না, তখন তো সব কিছুতেই সন্দেহ জাগে: যজ্ঞের হব্যে, স্তোত্রে, যজ্ঞ প্রক্রিয়ায়, ভক্তের অভীষ্টসাধনে দেবতার ক্ষমতায়, ইচ্ছায় এবং সর্বোপরি দেবতাদের অস্তিত্বে।

এই শেষের সন্দেহ সম্বন্ধে পরে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব, আপাতত একটি ঋক্ থেকে এ সন্দেহের সার্বিক চরিত্রটিকে দেখা যেতে পারে: ‘মানুষের মধ্যে কে তোমার বন্ধু (বা আত্মীয়), অগ্নি, কে তোমার উদ্দেশে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে? তুমি প্রকৃত (রূপে) কে, কোথায় তুমি থাক?’[২৪] বোঝা যায়, তখনকার মানুষ যে সব দেবতার স্তব করে যজ্ঞ করত, তাদের যথার্থ অস্তিত্ব নিয়ে, নিবাস নিয়ে এবং প্রার্থনা পূরণের ক্ষমতা ও ইচ্ছে নিয়ে তাদের মনে সংশয় ছিল। অবশ্য সংশয় থাকলেও তো উপায়ান্তর ছিল না। ইষ্টসিদ্ধি ও অতিলৌকিক শক্তির সহায়তা লাভের জন্যে পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষ আদিযুগ থেকে নানা ভাবে যজ্ঞ বা তার অনুরূপ অনুষ্ঠান করে এসেছে। এ সময়ে তাদের মনে যুগপৎ বিদ্যমান থাকত বিশ্বাস ও সংশয়। ইষ্টসিদ্ধি চাই, উপায় যজ্ঞ। দেবতাদের প্রসন্ন করলে তাঁরা অলৌকিক শক্তির সাহায্যে প্রকৃতিকে বশীভূত করে প্রার্থিত বস্তু দান করবেন। কোনও এক ভাবে এ সব বিশ্বাস না থাকলে যজ্ঞই করা সম্ভব হত না। যজ্ঞ সম্পাদন করবার সময় এ বিশ্বাস গৌণ বা অস্থির ভাবে হলেও তাদের চেতনে, অবচেতনে বিরাজ করতই। আবার তারই সঙ্গে থাকত অবিশ্বাস বা তার প্রথম স্তর, সংশয়, হয়তো কতকটা দোলাচলতা।

অথর্ববেদ সংহিতায় নতুন ধরনের একগুচ্ছ প্রশ্ন শুনি। ‘স্কন্তু’ নামে একটি দেবতার কল্পনা দেখি, ইনি বিশ্বভুবনকে ধারণ করছেন স্কম্ভ বা স্তম্ভের মতো। এঁর কাছে প্রশ্ন:

তোমার রূপে বর্ণ কে সঞ্চারিত করল? তার কোন অঙ্গে তপঃ থাকে? আর ঋত? তাঁর বিশিষ্ট ব্রত ও প্রত্যয়ই বা কী? তাঁর কোন্ অংশে সত্য থাকে? তাঁর কোন্ অঙ্গ থেকে উজ্জ্বল অগ্নি দেদীপ্যমান, কোথা থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়? (১১:৮:১৬)

এই ধরনের বহু প্রশ্নের শেষে শুনি: ‘তিনি কে?’ দেবতাদের স্বরূপই ছিল মৌলিক প্রশ্ন। অবশ্যই এ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার কোনও উপায়ই ছিল না। আদিম মানুষের কল্পনা প্রয়োজন অনুসারে ভৌতিক জগৎ থেকে নানা দেবতাকে মনে মনে নির্মাণ করে, স্তবের দ্বারা জনসাধারণের মধ্যে তাঁদের প্রচার করে, যজ্ঞের দ্বারা তাঁদের কাছে নিবেদন করে— সুস্থ, দীর্ঘায়ু, বিজয়ী ও সমৃদ্ধিমান হয়ে বেঁচে থাকার জন্যে বিস্তর প্রার্থনা। কিন্তু চিন্তাশীল মনে এ সব প্রক্রিয়ার পাশাপাশি জেগে থাকে সংশয়।

স্কম্ভেরই মতো ব্রহ্মের উদ্দেশে আরও প্রশ্ন ভক্তের:

তাঁর কোন অঙ্গে থাকে তপ, কোথায়ই বা থাকে ঋত? কোথায় থাকে ব্রত, কোথায় শ্রদ্ধা, তাঁর কোন্ অঙ্গে শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত থাকে? তাঁর কোন অঙ্গ থেকে অগ্নি দীপ্ত হয়, কোন অঙ্গ থেকে প্রবাহিত হয় বায়ু? কোন অঙ্গ থেকে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে চন্দ্রমার। স্কন্তের অঙ্গের পরিমাপ করে মহ, তাঁর কোন অঙ্গে থাকে ভূমি? কোন অঙ্গে অন্তরিক্ষ? কোন অঙ্গে আকাশ আশ্রিত থাকে, কোন দিকে থাকে আকাশের উত্তরের দিক। কাকে পেতে চেয়ে অগ্নি ঊর্ধ্বদিকে ধাবিত হয়, কাকে পেতে ইচ্ছে করে বায়ু প্রবাহিত হয়?… অর্ধমাসগুলি কোথায় চলে যায়, কোথায় যায় মাসগুলি সংবৎসরের সঙ্গে? সেই স্কম্ভকে বল, ‘কে তিনি?’[২৫]

এই স্কম্ভ সর্বোচ্চ এক দেবতার প্রতিনিধি, কাজেই চোখের ওপরে যে সব ঘটনা স্থানে-কালে নিরন্তর নীরবে ঘটে চলেছে, মানবদেহে এবং বিশ্বচরাচরে যে সব অবয়বসংস্থান আছে, অথবা থাকার কথা, সেগুলি সম্বন্ধে যে সব প্রশ্ন চিন্তাশীল মানুষের মনে উত্থিত হয় সেগুলি এই স্কন্তের সামনে উপস্থাপিত করা হয়েছে— সমাধানের আশায়। এ সব প্রশ্নের উদ্ভব সংশয় থেকে ততটা নয়, যতটা জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল থেকে।

স্কম্ভের কল্পনা ও অথর্ববেদে এর সংযোজন কিছু পরবর্তীকালের। তত দিনে মানুষ সর্বাতিগ এক দেবতার কল্পনা করতে পেরেছে, যিনি অগ্নি, বায়ু, পর্জন্য, ইত্যাদির ঊর্ধ্বে। অতএব এত দিন নানা দেবতা সম্বন্ধে নানা পর্যায়ে যত প্রশ্ন জমা হয়েছে তা-ই একগুচ্ছ প্রশ্নের আকারে এখানে উচ্চারিত। লক্ষণীয়, বিমূর্ত কতকগুলি ধারণা, শ্রদ্ধা, ব্রত, তপ এখানে স্থান পেয়েছে। সূক্তটি সম্ভবত উপনিষদ-যুগের, তাই ঔপনিষদিক কিছু প্রশ্ন এর মধ্যে স্থান পেয়েছে। ‘কাল’ অথর্ববেদে একট নতুন বিষয়; এখানে কাল সম্বন্ধে অংশত চেতনা ও প্রশ্ন— অর্ধমাস মাস ও সংবৎসর সম্বন্ধে প্রশ্নের মধ্যে দিয়েই মহাকাল সম্বন্ধে মানুষের ধারণা এখানে প্রতিফলিত। প্রশ্নগুলি ক্রমশ দৃশ্যমান বস্তুজগৎ ছেড়ে অদৃশ্য বিশ্বচরাচরে ক্রিয়াশীল কিছু বিমূর্ত শক্তি সম্বন্ধেও। মানুষ এ সব কিছুই বোঝে না, কিন্তু সে অবহিত যে এ সবই বিশ্ববিধানের অন্তর্গত, এবং এ না বোঝার আকুতি এই সূক্তে স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত।

দেবতাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে মূল প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মেলে না; তাই কবি প্রশ্ন করেন:

ইন্দ্ৰ কোথা থেকে (এলেন)? সোম কোথা থেকে, অগ্নি কোথা থেকে জন্মালেন? ত্বষ্টা কোথা থেকে এলেন, ধাতা কোথা থেকে?…
ইন্দ্র থেকে ইন্দ্ৰ, সোম থেকে সোম, অগ্নি থেকেই অগ্নি, ত্বষ্টা জন্মেছিলেন ত্বষ্টা থেকেই, ধাতা থেকে ধাতা।[২৬]

এ প্রশ্নে প্রকারান্তরে ইন্দ্রের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হল। আর এই ঋকে ইন্দ্র, সোম, অগ্নি, ত্বষ্টা ও ধাতার জন্ম বা উদ্ভব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এঁরা প্রত্যেকেই মুখ্য, পুরোনো দেবতা, বহু সূক্তে এঁদের স্তুতি আছে, অতএব এঁরা আছেন ধরে নিয়েই যজ্ঞে এঁদের আহ্বান ও স্তব করা হয়। এঁদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে গেলে এঁদের উৎপত্তি বা জন্মও স্বীকার করতে হয়। এ ঋকে সেই প্রশ্ন: এঁদের উদ্ভব কোথা থেকে? কৌতূহল নিবৃত্ত করছে পরবর্তী ঋক, সেখানে যে একটি মাত্র উত্তর সম্ভব তাই দেওয়া হয়েছে: যাঁদের উদ্ভব আসলে মানুষের কল্পনাতেই, তাঁরা তো প্রকৃতপক্ষে আত্মসম্ভব, নিজেদের থেকেই নিজেরা উৎপন্ন হয়েছেন। অন্য ভাষায় এর অর্থ হল, এঁরা কল্পনাসঞ্জাত।

চক্ষুষ্মান মানুষ চারদিকে চোখ মেলে তাকিয়ে প্রকৃতির বহু ঘটনার উত্তর পায় প্রকৃতিকে ভাল করে লক্ষ করেই, ঠিক তেমনই আরও বহু ব্যাপারের কোনও সমাধান সে পায় না, না প্রকৃতিতে, না তার আপন বুদ্ধির জগতে, না সে থাকে প্রাচীন মনস্বীদের স্মৃতিতে। অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা যখন মেলে না তখন মানুষ তার প্রশ্ন তুলে ধরে তার দেবতাদের উদ্দেশে, যে-দেবতাদের সে সৃষ্টি করেছে মানুষের চেয়ে সব দিক থেকে শ্রেষ্ঠ সত্তা হিসেবে। তাদের শ্রেষ্ঠতা মেনে নিয়েই স্তব, তাদের শ্রেষ্ঠতা জেনেই প্রার্থনা, এবং প্রশ্ন :

বহুবিধ প্রিয় এবং অপ্রিয় (অভিজ্ঞতা), স্বপ্ন, উৎপীড়ন, শ্রান্তি, আনন্দ, আমোদ এ সব উগ্র পুরুষ কেন বহন করে? আর্তি, অভাব, অমঙ্গল, দুঃখ— এ সব মানুষের মধ্যে কোথা থেকে আসে? সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য, সার্বিক অভাব, চিন্তা, যন্ত্রণা— আসে কোথা থেকে?… এই পুরুষে কে রূপ সঞ্চার করল, কে দিল শরীরের ভার, আর নাম? কে (তাকে) দিল অগ্রগতি, বিচিত্র প্রকাশ, পুরুষকে কে দিল চরিত্র? পুরুষে প্রাণ, অপান, ব্যান, সমান কোন দেবতা আশ্রিত করলেন? কে পুরুষকে যজ্ঞ করতে দিল? তার মধ্যে কে দিল সত্য, কে দিল মিথ্যা? কোথা থেকে এল মৃত্যু, কোথা থেকে অমৃত? কে একে দিল বাস, কে দিল আয়ু, কে দিল শক্তি, কে-ই বা দিল গতিবেগ?[২৭]

মনে রাখতে হবে, এ সব প্রশ্ন যারা করছে তারা কোনও আদিম জনগোষ্ঠী নয়, মোটামুটি সভ্য পরিবেশে বাসকারী মিশ্র প্রাগার্য-আর্য এক জনগোষ্ঠী, যারা শুধু দীর্ঘকাল ধরে যজ্ঞই করছে না, দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির সংঘর্ষে যাদের চিত্তে নানা প্রশ্ন স্পষ্ট রূপ পেয়েছে। প্রশ্নগুলি কী বিষয়ে? মানুষের দেহসংস্থান, মনের বিভিন্ন উপকরণ, বিচিত্র আবেগ, নানা অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্জাত এ সব প্রশ্ন। এগুলির অধিকাংশই দর্শনের ধার ঘেঁষা: সত্যমিথ্যা, মৃত্যু, অমৃত কোথা থেকে এল, মানুষের ওপরে কোন দেবতা? মানুষের পরমায়ু নির্ধারণ করছে কে, তার শক্তি ও গতিবেগ আসে কার কোথা থেকে? প্রথমেই প্রশ্ন বিভিন্ন উপলব্ধি নিয়ে— প্রিয় ও অপ্রিয় অভিজ্ঞতাগুলি, স্বপ্ন, নিশিজাগরণ, আনন্দ, উগ্র আমোদ এ সব মানুষ কেন বহন করে? অভিজ্ঞতাগুলি বাস্তব, চিরন্তন ও সর্বজনীন, অথচ এগুলো আসে কোথা থেকে? প্রথম এ সব প্রশ্ন জীবজগতে আর কারওরই নয়, একান্ত ভাবে মানুষেরই; দ্বিতীয়ত, চারদিকে তাকিয়ে মানুষ দেখেছে এ সব অভিজ্ঞতা কোনও ব্যক্তিবিশেষের নয়, সকলেরই; তৃতীয়ত, সে লক্ষ করেছে দেহসংস্থান ও মনঃসংস্থান মোটামুটি ভাবে সব মানুষেরই একই রকম। তা হলে এ সব কিছু মানুষে আধান করল কে? কোন সে শক্তি যা নিয়ন্ত্রিত করে তার দেহমন, তার রূপ-অবয়ব, তার সুখদুঃখ, তার পরমায়ুর পরিধি, তার মৃত্যু— এবং তার অমৃত? অর্থাৎ মানুষ মানতে চাইছে না যে মৃত্যুতেই সকল অভিজ্ঞতার ইতি টেনে দেওয়া হয়। এ সব প্রশ্ন যেমন গভীর, তেমনই চিরকালীন। এবং ঠিক তেমনই অসমাধেয়। কোথাও এ সবের উত্তর নেই।

কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকেই এ সব মানুষের মনে উদিত হয়েছে এবং উত্তর পাওয়া যাবে না বলে সে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকেনি। ওই অথর্ববেদেই পড়ি: ‘চোখ দিয়ে সকলেই দেখে, মন দিয়ে সকলে জানে না— পশ্যন্তি সর্বে চক্ষুষা ন সর্বে মনসা বিদুঃ।’ (১০:৮:১৪) অর্থাৎ এই যে সব প্রশ্ন মানুষের মনে উদিত হচ্ছে এর কারণ চোখ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় দিয়ে সকলেই বাইরের জগতের তথ্যগুলি গ্রহণ করে। কিন্তু তার থেকে অনিবার্য ভাবে যে সব প্রশ্ন উত্থিত হয়, সেগুলির সমাধান মন দিয়ে পায় না। মোটামুটি প্রশ্নগুলি দু’ ভাগে বিভক্ত: আমার দেহেমনে যা আছে, ঘটেছে, ঘটছে এবং আমার বাইরে বিশ্বপ্রকৃতিতে যা ঘটছে সে সবের পেছনে কোনও নির্ধারক বা নিয়ন্তা আছে কি? থাকলে তাঁকেই এই প্রশ্ন। তাই স্কন্তের কল্পনা, এই বিশ্বভুবনকে যিনি ধারণ করে আছেন। যেমন করে বাড়ি তৈরির আগে ভারবাহী বড় খিলানটা গাঁথা হয়, সেই থামের কল্পনা আরোপ করা হচ্ছে কল্পিত দেবতা স্কম্ভে। এঁর বৈশিষ্ট্য এই যে, থামের মাথা যেমন বাড়ির ছাদ পর্যন্ত প্রলম্বিত থাকে তেমনই এই দেবতার ঊর্ধ্বাগ্রভাগ ভূলোক ছাড়িয়ে দ্যুলোকের দিকে প্রলম্বিত; সেই দ্যুলোক, যেখানে মানুষের দৃষ্টি পৌঁছোয় না। অতএব দ্যুলোকের রহস্যেও স্কম্ভর অধিকার আছে, তাই তাঁর কাছে কিছু দার্শনিক প্রশ্নও করা যায়: পরমায়ু কে নির্ধারণ করে, জীবন- -মৃত্যু-অমৃতত্ব কে নিরূপণ করে? যে প্রশ্ন করছে সে-ও জানে এর উত্তর কোথাও মিলবে না, তবু অনুত্তরিত প্রশ্নের ভার তো মানুষকে নিরন্তর পীড়া দেয়, তাই তার সকল আর্তি নিয়ে সে আসে তার কল্পিত দেবতার কাছে।

এই সব প্রশ্ন কি সংশয়? যে ভাবে উচ্চারিত তাতে এগুলি শুধুই প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা। কিন্তু এগুলির মূলে আছে এক অসহায় নিরুদ্দিষ্ট সংশয়; মানুষ জানে যে সে শুধু প্রশ্নই করবে, সে-প্রশ্ন পৌঁছোবে না কোনওখানে, এখানে যে সব প্রশ্ন দেখলাম, তার বাইরে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেবতাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে। যজ্ঞের প্রণালী, স্তব, নৈবেদ্য সব ঠিক হলেও এ সব যাঁদের কাছে পৌঁছোবে তাঁরা যদি সত্যিই থাকেন, তবেই তো যজ্ঞ থেকে যা চাওয়া হচ্ছে তা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে? ‘দেবতারা তো মানুষের কল্পনা থেকে সৃষ্ট, তার বাইরে বাস্তবে তাঁরা কোথাও আছেন কি না তা জানবার কোনও উপায়ই ছিল না। চারিদিকে চোখ মেললে দেখা যায় সৃষ্টি, মানুষ জানে সব সৃষ্টির স্রষ্টা বা কারণ থাকে। বীজ থেকে শস্য হয়, ডিম থেকে মাছ, পাখি, কীটপতঙ্গ; তা হলে এ সৃষ্টির বীজ কী, কর্তা কে? দেবতা সম্বন্ধে মানুষের ধারণা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় নয় যুক্তিতে (অনুমানে) অথবা মনের ক্রিয়াগুলি সম্বন্ধে ধ্যান থেকেও ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা জন্মায় না, বহির্জগৎকে লক্ষ করেও নয়।’[২৮] আমরা দেখেছি, বহু প্রধান দেবতাকে নিয়েই মানুষের মনে সংশয় ছিল। ঋগ্বেদের সর্বপ্রধান দেবতা ইন্দ্রকে নিয়ে এ সংশয় সংশয়ের স্তর ছাড়িয়ে পৌঁছেছে নেতিবাদের স্তরে নেম ভার্গবের উক্তিতে ইন্দ্রের উদ্দেশে সত্য স্তোম নিবেদন করা, হে অনকামী (বা সংগ্রামকামী) (ভক্ত) যদি সত্য থাকে। নেম এ কথাও বলছে, ইন্দ্র নেই, কে (তাঁকে) দেখেছে? কার অভিমুখে স্তব করব?[২৯]

দেবতাদের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের যে-সংশয় তার মধ্যে একটি হল: এই বিশ্বচরাচর কে সৃষ্টি করেছেন? বেদে নানা দেবতাকেই সৃষ্টিকর্তা বলা হয়েছে, প্রথমাংশে প্রধানত ইন্দ্ৰকে, পরের দিকে বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি, প্রজাপতি, ব্রহ্মন্, হিরণ্যগর্ভ, ইত্যাদি দানা দেবতাকে। যাই হোক এঁদের মধ্যে কোনও একজনকে সৃষ্টিকর্তা ধরে নিলেও বিপত্তি আছে। যে-যুক্তিতে একজন সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকার করতে হচ্ছে তা হল, সৃষ্টি যখন আছে তখন কেউ একজন স্রষ্টা থাকতে বাধ্য। এখন একজন সৃষ্টিকর্তা মানলে ওই যুক্তিতেই তাঁকেও সৃষ্ট বলে স্বীকার করতে হবে এবং তখন আবার ওই প্রশ্নই উঠবে সেই সৃষ্টিকর্তাকে কে স্বীকার করেছিল? তাঁর সৃষ্টিকর্তাকে? কাজেই পিছিয়ে যেতে যেতে কোথাওই পৌঁছোনো যায় না; ন্যায়শাস্ত্রে একে ‘অনবস্থা’ দোষ বলে। সেই অসুবিধা থেকেই যায় এবং প্রথম স্রষ্টার প্রশ্নটি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এই কারণেই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘যাকে ভগবানের সৃষ্টি বলে মনে করা হয় সেই বেদও যদি বলে ভগবান পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তবুও সে উক্তিতে কোনও গুরুত্ব আরোপ করবার কোনও প্রয়োজন নেই।’ অর্থাৎ সৃষ্টির স্রষ্টা খুঁজতে গেলেই অনবস্থা-দোষ ঘটে, তাই ওই সিদ্ধান্ত অচল।

সৃষ্টি যে মৌলিক, ভৌতিক উপাদান থেকেই উদ্ভুত হয়েছে— কোনও দৈবশক্তির বা আত্মিক শক্তির সহায়তা ছাড়াই— এটা হল আধিভৌতিক বা ভূতার্থবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব; এর বিপরীতটি অর্থাৎ কোনও দৈব বা আধ্যাত্মিক শক্তির দ্বারাই সৃষ্টি— এটা আধ্যাত্মবাদ। যখনকার কথা আলোচনা হচ্ছে, তখনকার মানুষ সচেতন ভাবে কোনও সৃষ্টিতত্ত্বই নির্মাণ করেনি; তবু কোনও দেবতাই স্রষ্টা, এ বোধ আর পাঁচটা প্রাচীন সভ্যতার মতো ভারতবর্ষেও প্রচলিত ছিল; এ নিয়ে যথার্থ দার্শনিক স্তরের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত অনেক পরের যুগে, দর্শনপ্রস্থানগুলির উত্থানের কালে হয়েছিল। ঋগ্বেদের যুগে প্রত্যক্ষ সৃষ্টি থেকে স্রষ্টার সন্ধান চলছিল, কারণ তাদের অভিজ্ঞতায় তারা দেখত, বীজ, অণ্ড বা কারণ ছাড়া কার্য, অর্থাৎ শস্য-বৃক্ষ বা অণ্ডজ প্রাণী হয় না; স্বভাবতই ওই স্তরের চেতনাতে ওই স্তরের প্রশ্ন এবং সমাধানই পাওয়া যাচ্ছিল। এই প্রশ্নটি তীব্রতম রূপ পেয়েছে ঋগ্বেদের একেবারে শেষ পর্যায়ে বিখ্যাত ‘অস্যবামীয়’ সূক্তে (সূক্তটির প্রথম দুটি শব্দ ‘অস্য বামস্য’ থেকেই এই নামকরণ)। যে-প্রসঙ্গে কথাটা উঠেছিল, প্রত্যক্ষের জগতে সৃষ্টিকর্তার কোনও হদিস মেলে না, সেই প্রশ্নই এ সূক্তে এক জায়গায় উচ্চারিত সেই আদিমতম স্রষ্টার প্রসঙ্গে, ‘কে তাঁকে প্রথম জন্মাতে দেখেছে?— কো দদর্শ প্রথমং জায়মানম্।’ (১:১৬৪:৪) যিনি বিশ্বচরাচরের আদিস্রষ্টা তিনি যদি কোনও ব্যক্তি হন তো নিরুক্তে যাস্ক যেমন বলেছেন, তাঁরও একটা জন্মক্ষণ থাকবে। তখন কে তাঁকে জন্মাতে দেখেছিল? প্রশ্নটা ওই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ প্রত্যক্ষের। উত্তর প্রশ্নকর্তা ও শ্রোতাদের মনে একটাই: কেউই দেখেনি; অর্থাৎ তাঁর সত্তার সূচনার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তা হলে তাঁর অস্তিত্ব অনুমানসিদ্ধ। অনুমিতিতেও প্রমাণ হয়; কিন্তু সে একটি দীর্ঘতর প্রক্রিয়া, প্রতিপাদ্য থেকে সিদ্ধান্ত পর্যন্ত, যে-প্রক্রিয়া এখানে প্রয়োগ করবার কোনও অবকাশই নেই। ওই ঋকেই বলা হচ্ছে:

যিনি জাত হচ্ছিলেন, নিজে অস্থিমান হয়েও অস্থিহীন কোনও সত্তা থেকে। তাঁর প্রাণ, রক্ত ও আত্মা ছিল। তিনি কোথায়, সেই প্রজ্ঞাবান জ্ঞাতাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করতে কে গিয়েছিল? অনভিজ্ঞ আমি প্রশ্ন করছি, কারণ আমি আমার মন দিয়ে এটা বুঝতে পারছি না, বুঝতে পারছি না দেবতাদের এই সব গূঢ় পদক্ষেপগুলি।[৩১]

এই ঋক দুটির মধ্যে একটি আর্তি প্রকাশ পেয়েছে, জিজ্ঞাসু মানুষ নিজের অজ্ঞতা, অভিজ্ঞতার অভাব খোলাখুলি স্বীকার করছে, বলছে, ‘আমি জানি না, আমি আমার স্বল্পবুদ্ধিতে ধারণ করতে পারছি না। কিন্তু আর কেউ কি কোনও মনস্বী জ্ঞাতার কাছে এ সব প্রশ্ন উপস্থাপিত করেছে, উত্তর পেয়েছে এ সব প্রশ্নের? এই প্রখ্যাত ‘অস্যবামীয়’ সূক্তটির বাকি অংশ গূঢ় রহস্যের ভাষায় রচিত, যার কোনও সরাসরি অর্থ মেলে না। মেলার কথাও নয়, কারণ এর মধ্যে সৃষ্টি, বিশ্বচরাচর, দেবতারা এবং জীবন সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন আছে যেগুলো রহস্যের সান্ধ্যভাষায় রচিত। এখানে সমাধান নেই, বিভিন্ন ভাষ্যকার এবং সায়ণাচার্য যাই ব্যাখ্যা দিন না কেন। তা ছাড়া সায়ণাচার্য এ সব রচনার প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে ব্যাখ্যা করছেন, বিজয়নগরে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরভ্যুত্থানের এবং যজ্ঞক্রিয়ার পুনঃপ্রবর্তনের যুগে; তাঁর ভাষ্যে সব কিছুরই একটা বোধগম্য ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতা আছে। ফলে যা দুয়ে— হয়তো রচয়িতার অভীষ্টই ছিল দুয়ে রূপেই তাকে সংরক্ষণ করা, কারণ তাঁর বোধেই হয়তো বিষয়টা স্পষ্ট ছিল না— সায়ণ তাকেও সুবোধ্য ব্যাখ্যা দিতে তৎপর। ফলে ব্যাকরণ, অন্বয়, ইত্যাদি নিয়ে নানা কসরত তাঁকে এ নিয়ে করতে হয়েছে। এখন খোলাচোখে দেখলে অর্থ অতটা স্পষ্ট হয় না যতটা সায়ণ দেখাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যেটা খুবই স্পষ্ট সেটা হল, প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব, এ সব প্রশ্ন যে তখনকার মানুষের চেতনার মূলে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছিল সেটা খুব ভাল করেই বোঝা যায়। ওই রহস্যগূঢ় ভাষায় প্রশ্নগুলির সমাধান দেওয়ার চেষ্টাতেও একটি চেতনার সমস্যা ও তার ব্যক্তিগত উপলব্ধির সমাধান অন্তর্নিহিত রয়ে গেছে। ফলে দীর্ঘ সূক্তটিতে ঋষির উপলব্ধি গৌণ বা গুহ্য ভাষায় রূপ পেয়েছে, সমাধান বা উত্তরের রূপে নয়। ওই সূক্তেই আরও প্রশ্ন আছে:

তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, পৃথিবীর শেষ কোথায়? জিজ্ঞাসা করি, পৃথিবীর নাভিমূল কোথায়? রেতোবর্ষী অশ্বের রেতঃ সম্বন্ধে প্রশ্ন করি, সমস বাক্যের পরম আধার (স্থান) সম্বন্ধে প্রশ্ন করি। (উত্তর) এই বেদিই হল পৃথিবীর শেষ ভাগ, যজ্ঞ হল পৃথিবীর নাভি, সোম হল বর্ষণশীল অশ্বের রেতঃ, প্রজাপতিই হল ঊর্ধ্বতন আকাশে পরম বাক্য।[৩২]

এখানে পর পর ঋক দুটিতে প্রশ্ন এবং উত্তরের ভঙ্গি আছে, কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, উত্তরগুলি উত্তরই নয়, রূপক সমাধানমাত্র। এখানে প্রশ্নটি যথার্থই প্রশ্ন, অর্থাৎ কোনও অজ্ঞাত বিষয় জানবার জন্যে উচ্চারিত। কিন্তু এখানে উত্তরগুলি অভিধাগত অর্থে উত্তরই নয়, গূঢ় সংকেতপূর্ণ রূপকমাত্র। অবশ্যই পৃথিবীতে বহু দার্শনিক জিজ্ঞাসার সমাধান কোনও কোনও মানুষের মনে আবছা একটা উপলব্ধির রূপেই প্রতিভাত হয়। আপাতদৃষ্টিতে যাকে উত্তর বলে পেশ করা হচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে উত্তর নয়।

এই রকম একটি নিগূঢ়ার্থযুক্ত সূক্তের নাম ‘নাসদীয়’ সূক্ত, অস্যবামীয়ের মতো এটিরও নামকরণ প্রথম শব্দ ক’টির সমাহারে। এটির শুরু ‘নাসাদাসীন্নো সদসসীৎ’ দিয়ে। সায়ণাচার্য বলেছেন পরমেষ্ঠী নামক প্রজাপতি এ সূক্তটি রচনা করেন, এবং এর উদ্দিষ্ট দেবতা হলেন প্রজাপতি। এ সূক্তের শুরুতে শুনি, ‘তখন অসৎ (অবিদ্যমান) ছিল না, বিদ্যমানও ছিল না, আকাশের নীচে কোনও আয়তন ছিল না, আকাশও ছিল না, কোথায় কী কাকে আবৃত করবে, গভীর গহন জলও ছিল না। এখানে কবি যে-মুহূর্তটি কল্পনা করছেন তা হল সৃষ্টির আগেকার এই মুহূর্ত, যখন সৃষ্টিও ছিল না, সৃষ্টির কোনও উপাদানও ছিল না— সদাত্মকও নয়, অনস্তিত্ববাচকও নয়। তখন মহাকাশের ওপরে নীচে কিছুই ছিল না, আবৃত করবার কোনও বস্তুও ছিল না, কোনও উপাদানও ছিল না, আধারও ছিল না। সৃষ্টির প্রাক্কালের সেই মহাশূন্যে সেই সর্বউপাদানরিক্ত একটি অবস্থা কল্পনা করা হচ্ছে। পরের ঋকে সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটন করে বলা হচ্ছে, ‘অন্ধকার দিয়ে প্রথমে অন্ধকার আবৃত ছিল। এ সমস্ত অজ্ঞেয় সলিল ছিল, বিদ্যমান ও অবিদ্যমান দিয়ে আবৃত ছিল (চরাচর): মহৎ তপস্যার দ্বারা ‘এক’ সঞ্জাত হলেন।[৩৪] বলা বাহুল্য, এ কল্পনার মধ্যে একটি বিশ্বচরাচরের রহস্য গূঢ় ব্যঞ্জনার দ্বারা অভিব্যক্ত হয়েছে, এর মধ্যে কবিত্ব অবিসংবাদিত ভাবেই আছে: অন্ধকার দিয়েই অন্ধকার ঢাকা ছিল,… মহৎ তপস্যার দ্বারা ‘এক’ সৃষ্টির আদিভূত সত্তার উদ্ভব হল। সমস্তটাই যতটা ব্যঞ্জনা-ঋদ্ধ ততটাই অভিধাবিরোধী; আবছা একটা বোধ জন্মায়, স্পষ্ট কোনও জ্ঞান জন্মায় না। জীবনের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নগুলি সম্বন্ধে হয়তো এর বেশি স্পষ্ট ভাবে কোনও উত্তরই পাওয়া যায় না। তবু বলতেই হয় অনুত্তরিত এ প্রশ্নগুলি উচ্চারিত হওয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এত গভীর দার্শনিক জিজ্ঞাসার উদ্ভব যে-কোনও প্রাচীন সভ্যতাকেই গৌরবান্বিত করে।

এই সূক্তে আর তিনটি ঋকের পরে ষষ্ঠ ঋকে আমরা অন্য প্রশ্নের সম্মুখীন হই। কবি বলছেন:

কে যথার্থ ভাবে জানে, কেই বা তা স্পষ্ট করে বলেছে, এই সৃষ্টি কোথা থেকে কোনখান থেকে জাত হয়েছে? ওই সৃষ্টির পরে (সৃষ্ট) দেবতারা অর্বাচীন হয়ে গেলেন; তাই কে জানে কোথা থেকে এ সৃষ্টি এসেছে? এই সৃষ্টি যার থেকে হয়েছে সে হয়তো ধারণ করেছিল, হয়তো বা ধারণ করেনি। ঊর্ধ্বতম আকাশ যিনি এ সবের অধ্যক্ষ হয়তো তিনি জানেন, হয়তো বা (তিনিও) জানেন না।[৩৫]

সৃষ্টি নিয়ে মানুষের বিস্ময়ের মূলই হল স্রষ্টা কে, সে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা। এ কথা কে জানে, কার পক্ষে জানা সম্ভব? যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই জানতে পারেন, কিন্তু ঋষির মনে তা নিয়েও সংশয়: তিনিও কি সত্যিই জানেন? অর্থাৎ সৃষ্টি এমন একটা বিরাট রহস্য, যার বৃত্তান্ত হয়তো স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও জানে না। তিনি, সেই আদিম স্রষ্টা এমন মহনীয় যে, তাঁর উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই বাকি দেবতারা তাঁর থেকে অর্বাচীন হলেন। তাঁর পরে বাকি দেবতারা সৃষ্ট হলেন, অতএব দেবতাদের সকলের ওপরে তাঁর স্থান। এ কথা বলার পরেও বলা হচ্ছে সেই তিনিও হয়তো সৃষ্টিরহস্য জানেন না। এ উক্তির মধ্যে প্রাধান্য পাচ্ছে সৃষ্টি নিয়ে মানুষের গভীর সম্ভ্রম ও বিস্ময়, যেন কেউ, এমনকী স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও বিষয়টি জানলে তাঁর মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়।

এর পরের বিখ্যাত ‘প্রজাপতিসূক্তটির বিষয়বস্তু হল সৃষ্টির প্রাক্কালে প্রজাপতি নিজেকে যজ্ঞে উৎসর্গ করেছিলেন যজ্ঞে হননীয় পশুরূপে। সেই আদিমতম ক্ষণে :

কী পরিমাপ ছিল সে যজ্ঞের, কী আকৃতি ছিল, আজ্য কী ছিল, উপকরণ কী ছিল, কী ছিল পরিধি (কাষ্ঠনির্মিত যজ্ঞের উপাদান)? সে যজ্ঞের ছন্দ কী ছিল, প্রউগ নামক উথ (স্তোত্র)-ই বা কী ছিল, যখন সমস্ত দেবতারা দেবতাকে (পশুরূপে হনন করে যজ্ঞ করেছিলেন।[৩৬]

পৃথিবীর অনেক দেশের অতিকথাতেই এমন একটি যজ্ঞকে সৃষ্টির আদিকারণ বলে অভিহিত করা হয়েছে যেখানে দেবতারা কোনও এক দেবতাকেই— অনুমান করা হয় তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দেবতাকেই— যজ্ঞে আহুতি দেন। এই মহৎ হব্য দেওয়ার ফলে তার থেকেই এই মহান বিশ্বচরাচর সৃষ্ট হতে পেরেছিল যেহেতু কার্য (ফল) কারণের (উৎপত্তিহেতু) অনুরূপই হয়। অন্যান্য যজ্ঞে অভীষ্ট ফল গুরুত্বে, স্থায়িত্বে, তাৎপর্যে ছোট মাপের। তাই সে সব যজ্ঞে অশ্ব, বলদ, মহিষ, ছাগ, মেষ ইত্যাদি বলি দিলে চলে, কিন্তু যেখানে যজ্ঞফল হল বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি, সেখানে বলির জীবকে তো অনুরূপ ভাবে মহত্তম হতে হবে, অতএব স্বয়ং প্রজাপতিকে এখানে বলি দেওয়ার কল্পনা করা হয়েছে। সে তো হল, কিন্তু ওই মহাযাগের উপাদান, উপকরণ কী ছিল? যেখানে হব্য স্বয়ং প্রজাপতি, শমিতা ঋত্বিক স্বয়ং দেবতারা, সেখানে যজ্ঞের পরিধি, সীমা, পরিমাপ, ছন্দ, উথ, ইত্যাদি যে কী হতে পারে সে পর্যন্ত সে কল্পনাই পৌঁছোয় না। তাই আবার একগুচ্ছ অনুত্তরিত, অসমাধেয় প্রশ্ন। যজ্ঞে স্তোত্র লাগে, হব্য লাগে, তাই ঋষি হব্যের নির্দেশ দিয়ে যেন বলছেন, এমন মহাবিশ্ব- সৃষ্টিযজ্ঞে, স্বয়ং প্রজাপতি সেখানে হব্য, সেখানে অনুরূপ উত্থ, ছন্দ কেমন হবে, কে তা জানে? অর্থাৎ কেউ জানে না। অথচ সেই আদিম মাহেন্দ্রক্ষণ, সেই আদিমতম মহাযাগ, যার ফল বিশ্বসৃষ্টি— তার উপাদানও অবশ্যই মহত্তম হওয়া চাই। কিন্তু সে অবধি ঋষির কল্পনা পৌঁছোয় না বলেই প্রশ্ন রইল অনুত্তরিত। এবং এর নেপথ্যে অনুচ্চারিত যে প্রশ্ন, তা হল, তেমন কোনও যজ্ঞ কোনও দিন সত্যিই হয়েছিল কি? কে দেখেছে, কে জানে, কে সাক্ষ্য দেবে এই মহাযাগ অনুষ্ঠানের।

যেহেতু বীজ থেকে গাছ হয়, অর্থাৎ কারণ থেকে কার্য হয়, সেহেতু এই বিশ্বচরাচর-সৃষ্টি-রূপ কার্য থেকে অনুমান করতেই হবে যে, মহাকালের আদিম কোনও লগ্নে কোনও একটি ‘কারণ’ দেখা দিয়েছিল বা সংঘটিত হয়েছিল যার কার্য হল সৃষ্টি। এবং সে যুগে যেহেতু যজ্ঞ-অনুষ্ঠানকেই সমস্ত কিছুর বীজ বা কারণ মনে করা হত, তাই সেই প্রথম সৃষ্টিও সম্ভব হয়েছিল কোনও এক মহা বিশ্ব-যজ্ঞ থেকে। এইটে মেনে নিলেও বাকি অংশগুলি আপনাআপনিই এসে যাবে: বিশ্বসৃষ্টির বলির পশুর অনুরূপ মাহাত্ম্য চাই। স্বয়ং প্রজাপতি ছাড়া আর কে-ই বা তা হতে পারে? ওই মহাযাগের ঋত্বিক-পুরোহিত-হোতা ও অনুরূপ হওয়া চাই। অতএব, একমাত্র দেবতারাই এই পৌরোহিত্যের জন্যে উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারেন। এর পরে থাকে ছোট ছোট অঙ্গ— ছন্দ, সাম, যূপকাষ্ঠ, বেদির মাপ, ইত্যাদি কিন্তু এত সব কে তখন দেখেছিল, খেয়াল করেছিল? অতএব ওগুলো রইল প্রশ্ন হিসেবেই, উত্তর মিলল না। কিন্তু তার সঙ্গে মূল প্রশ্নও রইল অনুত্তরিত: সমস্ত যজ্ঞটাই বা কবে কখন কীভাবে ঘটেছিল, কে তা জানে?

পৃথিবীর প্রায় প্রাচীন অতিকথাতেই একটি আদিমতম যজ্ঞের কল্পনা আছে; কারণ যজ্ঞই ইষ্টফল সৃষ্টি করে, অতএব সৃষ্টির আদিতে তেমন এক যজ্ঞ না থাকলে এই বৃহৎ বিশ্বচরাচর সৃষ্টি হল কেমন করে? সেই আদিম যজ্ঞই পরবর্তী সকল যজ্ঞের প্রথমতম আকল্প; এবং দেবতারা তা সম্পাদন করেছিলেন বলে তা স্বভাবতই ফলপ্রসূত হয়েছিল, বিশ্বসৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। বেদের ব্রাহ্মণসাহিত্য, যার প্রথম অংশ এই সব সূক্তের সমকালীন, তাতে বারেবারেই দেখি দেবাসুরের যুদ্ধে প্রথমে দেবতারা পরাজিত হচ্ছেন। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তাঁরা আসছেন প্রজপাতির কাছে নালিশ করতে। তখন প্রজাপতি তাঁদের একটি নতুন যজ্ঞের নির্দেশ দিচ্ছেন; বলছেন, প্রাচীনকালে দেবতারা অনুরূপ সমস্যার সমাধান করেছিলেন এই যজ্ঞটির অনুষ্ঠান করে, দেবতারা সেই নবলব্ধ যজ্ঞ দ্বারা অভীষ্ট সিদ্ধ করছেন।

যে-সমাজে এই কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, সেখানে মানুষ বিশ্বাস করবেই যে, সকল সমস্যার সমাধান করতে পারে যজ্ঞ, সকল প্রয়োজনীয় সৃষ্টির মূলেই যজ্ঞ। তাই যদি হয়, তা হলে, বিশ্ব যখন সৃষ্টি হয়নি, তখন সে সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল কোনও একটি মহৎ চিরকালীন তাৎপর্যপূর্ণ যজ্ঞের অনুষ্ঠানের দ্বারা। এমন যজ্ঞে পশু স্বভাবতই শ্রেষ্ঠ দেবতা, ঋত্বিকরাও দেবতা। এবং সেই শ্রেষ্ঠ দেবতা নিজেকে পশুরূপে উৎসর্গ করে হনন করলে পর সম্ভব হয়েছিল মহাকালের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি— বিশ্বসৃষ্টি। এখানে রহস্যের সমাধান না হোক, কল্পনার মহনীয়তা স্পষ্টই লক্ষ করা যায়।

দশটি ঋকে রচিত ‘প্রজাপতিসূক্ত’ যার অপর নাম ‘হিরণ্যগর্ভসূক্ত’। এর প্রথম ঋকেই বলা হচ্ছে:

প্রথমে হিরণ্যগর্ভ ছিলেন, (বা হলেন)। যিনি জাতমাত্রই সমস্ত জীবজগতের অধিপতি হন, তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে ধারণ করেছিলেন। কোন্ দেবতাকে হবি দিয়ে পরিচর্যা করব? তিনি আমার দাতা, বলের দাতা, যাঁর শাসন সমস্ত দেবতারা উপাসনা করেন, অমৃত ও মৃত্যু যাঁর ছায়া, কোন্ দেবতাকে…। যারা শ্বাস নেয়, চোখের নিমেষ ফেলে তাদের সকলের উপরে যিনি আপন মহিমায় সমস্ত পৃথিবীর রাজা হয়েছিলেন, দ্বিপদ ও চতুষ্পদদের ওপরে যাঁর প্রভুত্ব, কোন্ দেবতাকে…।। হিমালয় প্রভৃতি পর্বতগুলি যাঁর মাহাত্ম্য, সমুদ্র-সহ সমস্ত জলাধার যাঁর, দিক ও উপদিকসমূহ যাঁর দুটি বাহু, কোন্ দেবতাকে…।। যিনি আকাশ ও পৃথিবীকে, স্বর্গকে এবং আদিত্যকেও দৃঢ় করেছেন, অন্তরিক্ষে যিনি জলের নির্মাতা, কোন্ দেবতাকে…।। দীপ্যমান আকাশ ও পৃথিবী যাঁর সুরক্ষায় মনে মনে নিজেদের সুরক্ষিত জেনেছে, উদিত সূর্য যাঁর ঊর্ধ্বে বিভাত হয়, কোন্ দেবতাকে..।। যিনি দেবতাদের একমাত্র অধিদেবতা ছিলেন, কোন্ দেবতাকে…।। যিনি পৃথিবীর জনক, যে সত্যধর্মা আকাশের জন্ম দিয়েছেন, যিনি বিপুল উজ্জ্বল জলরাশির স্রষ্টা, কোন্ দেবতাকে… হে প্রজাপতি, তুমি ভিন্ন অন্য কেউই সমগ্ৰ জাত মাত্রের এই বিশ্বকে ব্যাপ্ত করেনি, যে কামনা নিয়ে আমরা হোম করছি, তা আমাদের (অধিগত) হোক আমরা যেন পৃথিবীর ধর্মসমূহের অধিপতি হই।।[৩৭]

এই প্রখ্যাত সূক্তটিকে প্রজাপতি সূক্ত বলা হয়; সম্ভবত এই কারণে যে, এর শেষ ঋকে প্রজাপতিকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, তুমি আমাদের সকল প্রার্থনা পূরণ কর। এখানে অনেকগুলি বিষয় লক্ষ করবার মতো: সমস্ত সূক্তটির মধ্যে অন্য কোথাও কোনও প্রার্থনা নেই, এবং এই শেষতম ঋকে সূক্তের বাকি ন’টি ঋকে যে ধ্রুবপদ— কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম— সেটি অনুপস্থিত। তা ছাড়া প্রজাপতি বলে এখানে দেবতাকে আহ্বান করা হলেও বাকি অংশের যে দেবতা তিনি পরিচিত প্রজাপতির গুণ ও ক্রিয়ার অনেক ঊর্ধ্বে। সমস্ত সূক্ত জুড়ে যে দেবতার পরিচিতি তিনি মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ, সর্বোচ্চ এবং একমাত্র অধিষ্ঠাতা, সকল সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা। এ কথা সত্য যে, ঋগ্বেদের ঋষিদের একটি প্রবণতা ছিল যে, যখন যে দেবতাকে উদ্দেশ করে স্তব করা হয় তখনকার মতো সেই দেবতাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলেই অভিহিত করা হয়।[৩৮] তা সত্ত্বেও চোখে পড়ে যে, এমন করে সূক্ষ্ম, প্রায় পারমাণবিক স্তরে তুলে ধরে সর্বস্রষ্টা বলে কোনও দেবতাকে বর্ণনা করা হয়নি। আর বিস্ময় সেইখানেই; রচয়িতা ঋষি যাঁকে এত মহান, সর্বশক্তিমান, আকাশপৃথিবী সমুদ্রপর্বত দ্বিপদ-চতুষ্পদের স্রষ্টা এবং সমগ্র বিশ্বভুবনের একমাত্র অধিপতি (ভূতস্য জাতঃ পতিরেকঃ) বলে জানেন, সেই ঋষিই নটি ঋকের শেষে একটিই ধ্রুবপদ করছেন, ‘কোন দেবতাকে হবি দিয়ে উপাসনা করব?’ স্বভাবতই মনে হয়, এই দেবতাকেই তো হবিদান করা চলে, প্রশ্ন কীসের?

এখানে দুটো বিষয় লক্ষ করবার আছে। প্রথমত, এই যে প্রশ্ন, কোন দেবতাকে হবি দেব, তার সঙ্গে ওই ন’টা ঋকের বাকি বক্তব্যের কোনও সংগতি নেই। প্রত্যেক ঋকের প্রথম তিনটি চরণে এক শ্রেষ্ঠ দেবতার স্তব করা হচ্ছে, নানা ভাবে এবং শেষে সমস্ত যুক্তির সংগতি ও ধারাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অকস্মাৎ প্রশ্ন করা হচ্ছে কাকে হবিদান করব। এই অসংগতি এত মৌলিক যে, সায়ণাচার্য থেকে আরম্ভ করে অনেক ভাষ্যকারই বলেছেন, ওই ‘কস্মৈ’-এর অর্থ হল ‘প্রজাপতি’কে, অর্থাৎ ‘ক’ শব্দটির অভিধাগত অর্থই হল প্রজাপতি, কাজেই ওই বাক্যাংশটি কোনও প্রশ্নই নয়, একটি উক্তিমাত্র: ‘প্রজাপতিকে হব্য দিয়ে আরাধনা করব।’ সুবিধেও আছে: শেষ ঋকে প্রজাপতিকে সম্বোধন করে প্রার্থনা জানানো হয়েছে এবং সম্ভবত সেই কারণেই, সূক্তটির নামও দেওয়া হয়েছে প্রজাপতি সূক্ত, স্বভাবতই এ সূক্তে প্রজাপতিই দেবতা এবং প্রতি ঋকে তাঁকেই হবি দেওয়ার কথাই আছে। এ সব দুয়ে দুয়ে চার হয়ে মিলে গেলেও কিছু মুশকিল যে ছিল তার প্রথম প্রমাণ, ব্রাহ্মণশাস্ত্রে এই সূক্তটির উদ্ধৃতিতে দেখছি, ‘তস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম’, অর্থাৎ ‘সেই দেবতাকে হব্য দিয়ে উপাসনা করব।’ এতে কোনও গোলমাল থাকে না; প্রতি ঋকে যে মহান দেবতার বর্ণনা করা হয়েছে তিনটি চরণে, শেষ চরণে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁকেই হবিদান করো। এই পরিবর্তনটিই কিন্তু প্রমাণ যে, ‘কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম’ নিয়ে কিছু মনীষীর মনে অনুপপত্তির সংশয় জেগেছিল, তাই এই সমাধান। বলা বাহুল্য, ব্রাহ্মণসাহিত্যে এ পরিবর্তন কিন্তু ঋগ্বেদের ‘কস্মৈ’-কে স্পর্শ করল না, সেখানে অসংগতি রয়েই গেল।

সে অসংগতি কী? এটা ব্যাকরণের: নামপদ বা বিশেষ্য অকারান্তে শব্দের চতুর্থী একবচনের রূপ হত ‘কায়’ (যেমন নরায়), অর্থাৎ ‘ক’ মানে যদি প্রজাপতি হত শুধুমাত্র তাহলেই ‘ক’ নামপদ হত, এবং সে ক্ষেত্রে ‘প্রজাপতির জন্যে বা তাঁর উদ্দেশে’ এই অর্থে চতুর্থী একবচনে হত ‘কায়’। কস্মৈ স্পষ্টতই সর্বনাম শব্দরূপ, যেমন ব্রাহ্মণে তস্মৈ, মানে ‘তাঁর জন্যে বা তার উদ্দেশে’। ভাষ্যকারদের ওই কসরত ব্যাকরণের ধোপে টেকে না। এ সূক্তটির কেন্দ্রীয় দেবতা প্রায় নিরাবয়ব উচ্চমার্গের একটি ভাবসত্তা, নিয়ম অনুসারে এ সূক্তটির নাম হওয়া উচিত ছিল ‘হিরণ্যগর্ভ’ সূক্ত, কিংবা ‘নাসদীয়’ বা ‘অস্যবামীয়’ সূক্তের মতো প্রথম পদগুলির সমাহারে ‘হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্তত’ সূক্ত। তা না করে শেষ ঋকটি, যেটি সমস্ত সূক্তটির সঙ্গে তাৎপর্যগত ভাবে প্রায় অসম্পৃক্ত, সেটির খাতিরে এটিকে ‘প্রজাপতিসূক্ত’ বলা হয়েছে। ভাষ্যকারদের বিশেষ সুবিধে হয়েছে গায়ের জোরে ‘ক’ মানে ‘প্রজাপতি’ বলা ব্যাকরণের প্রাথমিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করে।

এখন প্রশ্ন থাকে, তা হলে ওই ভাবে প্রত্যেক ঋকের প্রথম তিনটি চরণের সঙ্গে অসম্পৃক্ত চতুর্থ চরণটি ধ্রুবপদ হয়ে উঠল কেন? এ প্রশ্ন কি যথার্থই প্রশ্ন? ঋষি কি সত্যিই জানতে চাইছেন, কাকে হবিদান করব? এ সূক্তটি দশম মণ্ডলের, অর্থাৎ ঋগ্বেদ সংকলনের শেষ পর্যায়ের। এর মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতক থেকে দশম শতকের মধ্যে বিস্তর নতুন নতুন দেবতা যুক্ত হয়েছে, দেবমণ্ডলী ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ও কালিক দেবসমাগমে এত স্ফীত হয়েছে যে, শেষ দিকের বেশ কিছু সূক্তের দেবতা ‘বিশ্বে দেবাঃ’ অর্থাৎ ‘সমস্ত দেবতাদের উদ্দেশে’। যদিও এ সব সুক্তেই কিছু কিছু ঋকে বিশিষ্ট দেবতার নামও করা আছে তবুও সমাহারে একত্র একটি দেবসমাবেশ কল্পনা করা হয়েছে। দেবতা বেড়েছে, যজ্ঞও বেড়েছে, জটিলতাও বেড়েছে, বিশেষ বিশেষ দেবতার উদ্দেশে বিশেষ বিশেষ পশু ও হব্যের বিধানও দেখা দিয়েছে। এই পটভূমিকাতে দেখতে হবে এই সূক্তটিকে, যেটি আদৌ প্রজাপতিসূক্ত নয়। প্রথম মণ্ডলের প্রথমাংশ এবং দশম মণ্ডলের শেষ দিকে বেশ কিছু প্রায় নিরবয়ব ও নির্ব্যক্তিক দেবতা এসেছেন, যেমন পরমাত্মন্, কাল, বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি (এই যুগেই অথর্ববেদের স্কম্ভও দেখা দিয়েছেন)। এঁদেরই মধ্যে প্রধান এই হিরণ্যগর্ভ, যিনি মূলত নির্ব্যক্তিক, কিন্তু পূর্বতন সকল স্রষ্টার ওপরে যাঁর স্থান, কারণ তিনি শুধু বিশ্বচরাচর নয় ওইসব দেবতাদেরও স্রষ্টা। তখন যজ্ঞ চলছে, বিশেষ বিশেষ দেবতাকে আহ্বান করে, আবার দলবদ্ধ ভাবে ‘বিশ্বে দেবাঃ’কেও আহ্বান করে। এই সময়ে যখন কোনও ঋষির উপলব্ধিতে এমন এক দেবাদিদেব সর্বভূতের আদিস্রষ্টা দেবতা উদিত হন, তখন তাঁর দুটো প্রশ্ন জাগে: যেহেতু ইনি আর সকলের ঊর্ধ্বে, তাই এঁর উপযুক্ত হব্য কী তা কীভাবে অনুমান করব। এঁকে কী দিয়ে তৃপ্ত করব? দ্বিতীয়ত, এত যে দেবতা দেবমণ্ডলীতে, ইনি তো তাঁদের একজন নন, অথচ ইনিই শ্রেষ্ঠ, প্রধানতম, আদিমতম। এমন কোনও দেবতা যেহেতু পূর্ববর্তী ঋষিদের কল্পনায় ছিল না তাই এঁর সম্বন্ধে ভাবতে গিয়ে তো মনে হবেই এমন সর্বাতিগ এক দেবতা থাকতে, যজ্ঞে হবি দেব কোন দেবতাকে? তাই প্রত্যেক ঋকের প্রথম তিন চরণে এঁর নৈর্ব্যক্তিক অথচ সর্বাতিশয়ী গুণ, কৃতি ও ক্ষমতার কথা বলে ঋষি প্রশ্ন করছেন, ‘তাহলে হবি দেব কোন্ দেবতাকে?’ বলা বাহুল্য, এ প্রশ্নের উত্তর নেই, তাই শেষ ঋকে পরিচিত পদ্ধতিতে প্রজাপতিকে আহ্বান করে তাঁর কাছে অভ্যস্ত ঐশ্বর্যের জন্য প্রার্থনা করা হল।

***

১. তৎ কাবশ্বিনো দ্যাবাপৃথিব্যাবিত্যেকে অহোরত্রাবিত্যেকে সূর্যাচন্দ্রমসাবিত্যেকে রাজানৌ পুণ্যকৃতাবিত্যৈতিহাসিকাঃ। (১২:১:৫-৮)

২. কেদানীং সূর্য: কশ্চিকেত কতমাং দ্যাং রশ্মিরস্যা ততান।। ঋগ্বেদ (১:৩৫:৭)

৩. ক্ব স্য বীরঃ কো অপশ্যদিন্দ্রম্। ঋগ্বেদ (৫:৩০:১)

৪. কা তে নিষত্তিঃ কিমু নো মমৎসি। ঋগ্বেদ (৪:২১:৯)

৫. কুত্ৰা চিদস্য সমৃতৌ রম্বা নৃষদনে। ঋগ্বেদ (৫:৭:২)

৬. জীবান্নো অভি ধেতনাদিত্যাসঃ পুরাহ থাৎ। কদ্ধ স্থ হবনশ্রুতঃ।। ঋগ্বেদ (৯:৬৭:৫)

৭. কো হ কস্মিন্নসি শ্রিতঃ। (১:৭৫:৩)

৮. কা ত উপেতিমনসো বরায় ভূবদগ্নে শংতমা কা মনীষা। কো বা যজ্ঞৈঃ পরি দক্ষং ত আপ কেন বা তে মনসা দাশেম। (১:৭৬:১)

৯. কথা শৃণোতি হুয়মানমিন্দ্রঃ কথা শৃণ্বন্নবসামদ্য বেদ। কা অস্য পূর্বীরুপমাতয়ো হ কথৈনমাহুঃ পুশুরিং জরিত্র। (৪:২৩:৩)

১০. অসী যে দেবাঃ স্থন ত্রিম্বা রোচনে দিবঃ। কদ্ধ ঋতং কদনৃতং ক্ব প্রত্না ব আহূতির্বিত্তং মে অস্য রোদসী। (১:১০৫:৫)

১১. কদ্ধ ঋতস্য ধর্ণসি কদ্বরুণস্য চক্ষণম্। কদর্যণো মহস্পথাতি ক্রামেম দূঢ্যো, বিত্তং মে অস্য রোদসী। (১:১০৫:৬)

১২. কো রাধদ্ধোত্রাশ্বিনা বাং কো বাং জোষ উভয়োঃ। কথা বিধাত্যপ্রচেতাঃ। (১:১২০:১)

১৩. কিমু নো মমৎসি কিং নো দুদু হর্ষদে দাবা উ। (৪:২১:৯)

১৪. ‘Theodicy originally referred to theories that sought to explain how an all-powerful and all-good God can permit evil in the world. ‘ — Peter Berget, p. 36

১৫. কস্মৈ দেবা আ বহানাশু হোম কো মাংসতে বীতিহোত্রঃ সুদেবঃ। (১:৮৪:১৮)

১৬. যজ্ঞং পৃচ্ছাম্যবমং স তদ্দুত বি বোচেতি। ক্ব ঋতং পূর্বং গতং কস্তদ্বিভৰ্ত্তি নূতনং বিত্তং মে অস্য রোদসী।। (১:১০৫:৪)

১৭. কয়া তচ্ছধে শচ্যা শচিষ্ঠো যয়া কৃণোতি মুহু বা চিম্বঃ। পুরু দান্ত যে বিচয়িষ্ঠো অংহোহথা দধাতি দ্রবিণং জরিত্রে।। (৪:২০:৯)

১৮. প্র সু স্তোমং ভরত বাজয়ন্ত ইন্দ্রায় সত্যং যদি সতমস্তি। নেদ্ৰো অস্তীতি নেম উ ত্ব আহ ক ঈং দদর্শ কমাভি ষ্টবাম।। (৮:১০০:৩)

১৯. যং স্মা পৃচ্ছতি কুহ সেতি ঘোরমুতেমাহু নৈষো অস্তীত্যেনম্ সো অৰ্যঃ পুষ্টীবিজ আ মিনাতি শ্রদস্মৈ ধত্ত স জনাস ইন্দ্ৰঃ।। (২:১২:৫)

২০. আমার The Indian Theogony, Penguin, 2000;-এ ‘ইন্দ্ৰ’ অংশ ‘ইন্দ্ৰ’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

২১. ‘ This skepticism is about the existence of a god, even the king of the gods, and the emergence of impersonal conceptions of the ultimate ground of the universe is not yet atheism. Such conceptions have yet to advance arguments that belief in god is a false belief. Such arguments begin to appear where emerging theistic conceptions of God and conceptions of the absolute source and ruler of the world confront one another as philosophical options over an extended period of time.’ Macmillan Encyclopaedia of Religion. ‘Atheism’. p. 481

২২. কছন্দসাং যোগমা বেদ ধীরঃ কো ধীরং প্রতি বাচং পপাদ। কমৃত্বিজামষ্টমং শুরমাহুহরী ইন্দ্রস্য নি চিকায় কঃ স্বিৎ।। ১০:১১৫:৯

২৩. ক উ শ্রবৎ কতমো যজ্ঞিয়ানাং বন্দারু দেবঃ কতমো জুষাতে। কস্যোমাং দেবীমমৃতেষু প্রেষ্ঠাং হুদি শ্রেষাম সুষ্টুতিং সুহব্যাম্।। (৪:৪৩:১)

২৪. কস্তে জামির্জানানামগ্নে কো দাশ্বধ্বরঃ। কো হি কস্মিন্নসি শ্ৰিতঃ।। (১:৭৫:৩)

২৫. কস্মিন্নসঙ্গে তপ অস্যাধি তিষ্ঠতি কস্মিন্নঙ্গে ঋতমস্যাধ্যাহিতমা ক্ব ব্রতং ক্ব শ্রদ্ধাস্য তিষ্ঠতি কস্মিন্নঙ্গে সত্যমস্য প্রতিষ্ঠিতম্। কস্মাদঙ্গাদ্দীপ্যতে অগ্নিরস্য কস্মাদঙ্গাৎ পবতে মাতরিশ্বা। কস্মাদঙ্গাদ্বিমীতেঽধি চন্দ্ৰমা মহ স্কন্তস্য মিমানো অঙ্গম।। কস্মিন্নঙ্গে তিষ্ঠতি ভূমিবস্য কস্মিন্নঙ্গে তিষ্টত্যন্তরিক্ষম। কস্মিন্নঙ্গে তিষ্ঠত্যাহিতা দ্যৌঃ কস্মিন্নঙ্গে তিষ্ঠত্যুত্তরং দিবঃ।। কং প্রেপ্সন্ দীপ্যতে ঊর্ধ্বো অগ্নিঃ কং প্রেপ্সন্ পবতে মাতরিম্বা।… কার্ধমাসা ক্ব যন্তি মাসাঃ সংবৎসরেণ সহ সংবিদানাঃ। (১০:৭:২-৫)

২৬. কুত ইন্দ্ৰঃ কুতঃ সোমঃ কুতো অগ্নিরজায়ত। কুতত্ত্বষ্টঃ সমভুবৎ কুতো ধাতাত্মজায়ত। ইন্দ্ৰাদিদ্ৰঃ সোমাৎ সোমো অগ্নেরগ্নিরজায়ত। ত্বষ্টা হ জজ্ঞে ত্বষ্টুধাতুধাতাজায়ত। অথর্ব বেদ (১১:৮:৮,৯)

২৭. প্রিয়াপ্রিয়াণি বহুলা স্বপ্নং সবাধমতন্দ্ৰঃ।। আনন্দানুগ্রো নন্দাংশ্চ কস্মাদ্বহতি পুরুষঃ। আর্তিরবর্তিনিঋতি কুতো নু পুরুষেহ মতিঃ। রাদ্ধিঃ সমৃদ্ধির ব্যুদ্ধিমতিরুদিতয়ঃ কুতু।… কোঽস্মিন্ রূপং ব্যদধাৎ কো মহ্যানং চ নাম চ। মাতুং কোৎস্মিন্ কঃ কেতুং কশ্চারিত্রাণি পুরুষে। কোহস্মিন্ প্রাণমবধৎ কো অপানং ব্যানমু। সমানমস্মিন্ কো দেবোঽবি পুরুষে শিশ্রায়।। কোহস্মিন্ যজ্ঞমদধাত্ কো দেবোঽধি পুরুষে। কোঽস্মিন্ সত্যং কোহনৃত্যং কুতো মৃত্যুঃ কুতোহ মৃতম্।। কোহস্মিন্ বাসঃ পর্ষদধাৎ কোঽস্যায়ুরকল্পয়ৎ বলং কোহ স্মৈ প্রাযৈচ্ছৎ কো অস্যাকল্পয়ঞ্জবম্। অথর্ব বেদ (১০:২:৯-১৫)

২৮. ‘Man’s knowledge of God was inferential, being not derived either by meditating on the operations of his own mind, or by observing the process of external nature. — Dictionary of the History of Ideas, m p. 302

২৯. প্র সু স্তোমং ভরত, বাজয়ন্ত ইন্দ্রায় সত্যং যদি সত্যমস্তি। নেদ্ৰো অস্তীতি নেম উ ত্ব আহ ক ঈং দদর্শ কমভি ষ্টবাম।। ঋগ্বেদ (৮:১০০:৩)

৩০. If the Vedas, considered to be the work of God, say that God is the creator of the world, no value need be attached to the statement . ‘ – DP Chattopadhyaya, 1964, Vol. II, p. 25

৩১. কো দদর্শ প্রথমং জায়মানমস্থন্বন্তং যদনস্থা বিভর্তি। ভূম্যা অসুরসৃগাত্মা ক্ব স্বিৎ কো বিদ্বাংসমুপ গাৎ প্ৰষ্টুমেতৎ।। পাকঃ পৃচ্ছামি মনসাবিজানন্ দেবানামেনা নিহিতা পদানি। (১:১৬৪:৪,৫)

৩২. পৃচ্ছামি ত্বা পরমন্তং পৃথিব্যাঃ পৃচ্ছামি যত্র ভুবনস্য নাভিঃ। পৃচ্ছামি ত্বা বৃষ্ণো অশ্বস্য রেতঃ পৃচ্ছামি বাচঃ পরমে ব্যোম। ইয়ং বেদিঃ পরো অন্তঃ পৃথিব্যা অয়ং যজ্ঞো ভুবনস্য নাভিঃ। অয়ং সোমো বৃষ্ণো অশ্বস্য রেতো ব্রহ্মায়ং বাচঃ পরমং ব্যোম।। ঋগ্বেদ (১:১৩৪:৩৪, ৩৫)

৩৩. নাসদাসীনো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রবে নে ব্যোমা পরো যৎ। কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নন্তঃ কিমাসীদ্ গহনে গভীরম্। ঋগ্বেদ (১০:১২৯:১)।

৩৪. তম আসীত্তমসা গূঢ়মগেঽপ্রকেতং সলিলং সর্বসা ইদম্। তুচ্ছ্যোনাম্বে পিহিতং যদাসীত্তপসস্ত‍ মহিনাজায়তৈকম্।। (১:১২৯:২)

৩৫. কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্ৰ বোচৎ কুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ। অর্বাগ্ দেবা অস্য বিসর্জনেনাথ কো বেদ যত আবভূব।। ইয়ং বিসৃষ্টির্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন। যো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্ত্ সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ।। (১:১২৯,৬,৭)

৩৬. কাসীৎ প্রমা প্রতিমা কিং নিদানমাজ্যং কিমাসীৎ পরিধিঃ ক আসীৎ ছন্দঃ। কিমাসীৎ প্রউগং কিমুক্‌থং যদ্দেবা দেবমজন্ত বিশ্বে।। (১০:১০৩:৩)

৩৭. হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে ভূতস্য জাত পতিরেক আসীৎ। স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। য আত্মদা বলদা যস্য বিশ্ব প্রশিষং যস্য দেবাঃ। যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ কস্মৈ…। যঃ প্রাণতো নিমিষতোহত্র মহিত্বৈক ইদ্ৰাজা জগতো বভূব। য ঈশে অস্য দ্বিপদশ্চতুষ্পদ, কস্মৈ…।। যস্যেমে হিমবন্তো মহিত্বা যস্য সমুদ্রং রসয়া সহাহুঃ। যস্যেমাঃ প্রদিশো যস্য বাহু কস্মৈ…।। যেন দৌরুগ্রা পৃথিবী চ দৃল্হা যেন স্বঃস্তভিং যেন নাকঃ। যো অন্তরিক্ষে রজসো বিমানঃ কস্মৈ…।। যং ক্রন্দসী অবসা তস্তভানে অভ্যৈক্ষেতাং মনসা রেজমানে। যত্রাধি সুর উদিতো বিভাতি কস্মৈ…।। ততো দেবানাং সমবর্ততাসুরেকঃ কস্মৈ…।।…যো দেবেম্বধি দেব এক আসীৎ কস্মৈ…।। প্রজাপতে ন ত্বদেবতান্যন্যো বিশ্বা জাতানি পরি তা বভুব। যৎকামাস্তে জুহুমস্তন্নো অস্তু বয়ং স্যাম পতয়ো রয়ীণাম্।। (১০:১২১:১-৮, ১৩)

৩৮. হিন্টারনিৎস তাঁর Ancient Indian Literature, Vol I-এ এ প্রবণতাকে herotheism বা Kathenotheism বলেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *