০১. বেদ রচনার গোড়ার দিক

বেদ রচনার গোড়ার দিক

সাধারণ ভাবে অর্ধশিক্ষিত ও শিক্ষিত ভারতবাসীর মনে একটা বিশ্বাস ব্যাপক ভাবে দীর্ঘকাল ধরেই আছে যে বেদের যুগের মানুষ বেদে বিশ্বাসী ছিল। পরিসংখ্যানগত ভাবে হয়তো কথাটা ঠিকই, অর্থাৎ বেশির ভাগ মানুষ হয়তো বেদে বিশ্বাসী ছিল। এ কথা বললেই যে-দুটি প্রশ্ন আসে তা হল: ১) বেদের যুগ কোনটা? এবং, ২) বিশ্বাস কীসে ছিল? ঐতিহাসিকরা মোটের ওপর খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত বৈদিক সাহিত্যের রচনাকালের ব্যাপ্তি ধরেন। এর মধ্যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের মধ্যেই ঋক্‌সংহিতা/ও যজুঃসংহিতা রচনা সমাপ্ত হয়েছিল। এটা কিছুটা আগেও হয়ে থাকতে পারে, কারণ, বৈদিক আর্যরা এ দেশে আসার সময়ই কিছু পূর্বপরিচিত সূক্ত— কবিতা ও গান সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সামবেদ কোনও স্বতন্ত্র রচনা নয়, ঋগ্বেদের সূক্তগুলির নানা বিন্যাসে এটি রচিত। অর্থাৎ, যজ্ঞে গান গাইবার জন্যে ঋগ্বেদের কবিতাগুলিকে সুবিধে মতো সাজিয়ে এ বেদটি নির্মিত যাতে, সামবেদের গায়ক উদ্‌গাতারা যজ্ঞে গান করতে পারেন। ঋগ্বেদের হোতারা এগুলো যজ্ঞে আবৃত্তি করতেন। অথর্ববেদের কিছু অংশ ঋগ্বেদেরও পূর্বে রচিত, কিন্তু ধর্মাচরণের সম্ভ্রান্ত ধারার মধ্যে সেগুলির স্থান হয়নি। এর কিছু অংশ ঋগ্বেদ থেকে সরাসরি ধার নেওয়া, সামান্য অদলবদল করে সাজানো।

অন্য কিছু ঋগ্বেদ সামবেদ সংকলিত হওয়ার পরে রচিত। এবং ওই দুটি বেদের সংকলন সমাপ্ত হয়ে যাওয়ায় ওগুলিতে স্থান না হওয়াতে কিছু কিছু রচনা অথর্ববেদে সন্নিবেশিত হয়। যজুর্বেদের মন্ত্রগুলি ঋগ্বেদ রচনার সামান্য কিছু পরে (কিছু-বা অনেকটাই সমকালে) রচিত হতে শুরু করে এবং ঋগ্বেদ সংকলিত হওয়ার অনেক পরে শেষ হয়; এই কারণে ঋগ্বেদ রচনা খ্রিস্টপূর্ব দশম শতক নাগাদ শেষ হলেও যজুর্বেদের রচনা ও অথর্ববেদের রচনা ও সংকলন আরও কিছুকাল ধরে চলতে থাকে। যজুর্বেদ রচনা খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতক নাগাদ শেষ হয়, অথর্ববেদ আরও দু-তিনশো বছর ধরে চলে। যজুর্বেদের মূল ধারা ধরেই ব্রাহ্মণসাহিত্যের সূচনা। ঋগ্বেদে গদ্য একেবারেই নেই, যজুর্বেদে কোথাও কোথাও গদ্য আছে এবং সেই ধারাতেই অথর্ববেদেও কিছু গদ্য আছে। আর ব্রাহ্মণসাহিত্য পুরোপুরি গদ্যেই রচিত। তবে এ পর্যন্ত সবই— এবং এর পরেও শ-তিনেক বছর পর্যন্ত— বেদের যে-সাহিত্য রচনা হয় তা সম্পূর্ণ ‘আস্য’, অর্থাৎ বৈদিক আর্যরা নিরক্ষর ছিল তাই তারা মুখে মুখে রচনা করত, এবং পুত্র-শিষ্য-পরম্পরা সে-সাহিত্য কণ্ঠস্থ করত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত এই ছশো বছর মুখ্যত বেদ রচনাকাল— বৈদিক যুগ। এর পরে, উপনিষদ। অন্তত মুখ্য উপনিষদগুলি রচনা হওয়ার পরেও বেদের সম্পর্কে অন্য সাহিত্য রচিত হতে থাকে; তার নাম সূত্র বা বেদাঙ্গসাহিত্য: সে-রচনা চলে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত। এর সঙ্গে পূর্বের বৈদিক সাহিত্যের প্রভেদ হল, আগেরটিকে বলা হয় অপৌরুষের অর্থাৎ এটি কোনও মানুষের রচনা নয়, এ সাহিত্য দৈবশক্তির দ্বারা ঋষিদের কাছে প্রতিভাত। যদিও বেদাঙ্গসাহিত্য রচনার কালে দেশে লিপি ও লেখা এসে গেছে, কিন্তু রচনা দেখে বোঝা যায় যে, বেদাঙ্গও আস্য রচনা। কারণ, এটি নিরতিশয় সংক্ষিপ্ত, সূত্রের আকারেই সমস্তটা রচিত হয়েছিল। অর্থাৎ লেখা তখন মানুষের ঐহিক সাংসারিক নানা প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে, শাস্ত্র রচনায় বা ধর্মাচরণে নয়।

বেদের কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক হলেও এর তিনটি ভাগ করা যায়: (ক) ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব বেদের অধিকাংশ সংহিতার রচনাকাল- খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে অষ্টম শতকের শেষ বা সপ্তম শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত; (খ) অথর্ব সংহিতার শেষার্ধ ও ব্রাহ্মণসাহিত্য রচনাকাল (যদিও প্রথমদিকের ব্রাহ্মণগুলির রচনা এর আগেই শুরু হয়ে গেছে), অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে ষষ্ঠের শেষ ও পঞ্চমের পূর্বার্ধ পর্যন্ত; এবং (গ) বেদাঙ্গ-সাহিত্য রচনাকাল অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতককাল।

বৈদিক আর্যরা যখন ভারতবর্ষে আসে তখন তারা সঙ্গে নিয়ে আসে যাযাবর সময়ের পশুচারিতা, এবং পথে যেখানে যেখানে দু-এক বছর থেমেছিল সেখানে পেয়েছিল কৃষিকাজের অভিজ্ঞতা। এ দেশে এসে তারা সম্মুখীন হল কৃষিজীবী এক সুস্থিত নাগরিক সভ্যতার। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ থেকে দশম শতক পর্যন্ত মুখ্যত কৃষি ও পশুপালনই ছিল তাদের জীবিকা; এর সঙ্গে সঙ্গে ছিল যুদ্ধ, মৃগয়া ও লুণ্ঠন। এখানে আসবার পরে পায়ের তলায় মাটি পেতে কিছু সময় লেগেছিল, কিন্তু তার পর থেকেই মোটামুট সব-কটি বৃত্তি অব্যাহত রেখেই বেদের পরবর্তী অংশ অর্থাৎ ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের প্রথমার্ধ এবং দশম মণ্ডল, যজুর্বেদসংহিতা, অথর্ববেদের প্রথম দিকের রচনা এবং একেবারে গোড়ার দিকের ব্রাহ্মণগুলি রচনা চলছিল। এই অধ্যায়টি এইগুলির রচনাকালকে অবলম্বন করেই।

এই সময়ে উৎপাদনব্যবস্থা যা ছিল তা প্রয়োজনের পক্ষে পর্যাপ্ত ছিল না। প্রাগার্যদের কাছ থেকে হরণ করা এবং নিজেরা দখল করে পাওয়া জমি, ফসল গোধন, লুণ্ঠন, মৃগয়া এ সব মিলেও প্রয়োজনের অনুপাতে যথেষ্ট খাদ্যসম্পদ জুটত না। নিরন্তর খাদ্যাভাব, অনাহার, ও দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনায় উৎপীড়িত ছিল জনসমাজ। এর ওপরে শীতের দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে আসায় নতুন কিছু রোগব্যাধির আক্রমণও ছিল; আর ছিল প্রাগার্যদের দ্বেষহিংসা এবং তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ, এবং নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীকলহ। দুর্ভিক্ষ, মহামারি, প্রাগার্যদের কাছে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা ও অভিজ্ঞতা দুটিই বাস্তব ব্যাপার ছিল। অকালমৃত্যু, জরা এগুলোও জীবনযাত্রার অঙ্গ ছিল। খরা বা অজন্মা, প্লাবনের মতো পশুপালে মড়কের ফলে পশুনাশ— এ-ও মাঝে মাঝে ঘটত। বহু দূরদেশে থেকে দু-তিন শতাব্দী ধরে ধাপে ধাপে এখানে-ওখানে থেমে থেমে এ নতুন দেশে এসে, সচ্ছলতা, স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা, দীর্ঘপরমায়ু— এ সব সুনিশ্চিত করার কোনও উপায় তাদের জানা ছিল না। তাই যজ্ঞ। এবং পৃথিবীর সব প্রাচীন সমাজে কোনও না কোনও না আকারে যজ্ঞ ছিল। আর ছিল জাদুবিদ্যা, প্রাচীন পৃথিবীর সব সমাজেই যা চালু ছিল— যজ্ঞের সঙ্গে এর উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। প্রভেদ হল, যজ্ঞে দেবতাদের অনুরোধ করা হয় প্রার্থীর মনস্কামনা পূরণ করার জন্যে, আর জাদুবিদ্যায় কোনও দেবতাকে না ডেকে সরাসরি কোনও অতিলৌকিক শক্তির দ্বারস্থ হয়ে ওই প্রার্থনাগুলোই পেশ করা হয়। কোনওটাতেই নিশ্চিত ফল মেলে না, তবু মানুষ যেখানে অন্যথা সম্পূর্ণ নিরুপায়, সেখানে ইষ্টসাধনের জন্যে কোনও না কোনও চেষ্টা সে করবেই। বেদের যুগে যজ্ঞ এবং যাদু যুগপৎ চলিত ছিল। জাদুর কোনও সুসংহত শাস্ত্র আমরা পাই না, কেবল ঋগ্বেদে কিছু কিছু সূক্ত এবং অথর্ববেদে বেশ-কিছু সূক্তে এর অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে— যদিও অনুষ্ঠানের কোনও নির্দেশিকা পাওয়া যায় না। কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রক্রিয়া মোটামুটি স্পষ্ট ও ব্রাহ্মণ ও সূত্র সাহিত্যে সম্পূর্ণ ভাবে পাওয়া যায়। এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, যজ্ঞের মধ্যে বহুলাংশে জাদুবিদ্যা অনুপ্রবিষ্ট ছিল, কারণ যজ্ঞানুষ্ঠান কেমন করে উদ্দিষ্ট ফল দেবে তা জানা ছিল না বলেই ‘হিংটিংছট’ ধরনের কিছু কিছু অংশ যজ্ঞে ইতস্তত চোখে পড়ে।

তা হলে যে-ছবিটা চোখে আসে, তা হল ব্যাপক নিরাপত্তার অভাব— জীবনের সকল ক্ষেত্রেই— এবং এর প্রতিবিধানের জন্যে নানা বিচিত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান। মনে রাখতে হবে পশুচারী জীবনে যজ্ঞ ছিল নেহাতই সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান: দেবতার উদ্দেশে স্তবগান ও আবৃত্তির সঙ্গে পশুহত্যা এবং পরে সেটি রেঁধে খাওয়া। কৃষিজীবী সুস্থিত জীবনে বীজ বোনা ও ফসল তোলার মধ্যে সময়ের ব্যবধান অনেক বেশি এবং এমন স্থিতিশীল সমাজে সমস্যাও অনেক বেশি। ফলে, একটি ছোট গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় যারা সমাজের নানা সমস্যা, অভাব-অভিযোগের প্রতিকারের জন্যে ক্রমাগতই নতুন নতুন যজ্ঞ উদ্ভাবন করবে, নবতর প্রক্রিয়া বানিয়ে তুলবে এবং সমাজের অসহায় মানুষ অনন্যোপায় অবস্থাতে সে সবই মেনে নিয়ে নতুন নতুন অনুষ্ঠান করবে। কাকতালীয়বৎ ফল আসবে কোনও কোনও অনুষ্ঠানে। আবার, সম্ভাব্যতার বিজ্ঞান অনুসারে কোনও কোনওটা নিষ্ফলও হবে। তবু মানুষ ফিরে ফিরে সেই সব যজ্ঞের অনুষ্ঠানই করবে, কারণ ইষ্টসিদ্ধির জন্যে আর কোনও পথই তার জানা নেই।

এই ছিল বেদের প্রথম পর্যায়ে মানুষের সামাজিক অবস্থান এবং তার মানসিক পরিমণ্ডল। সে চোখ মেলে দেখে সমস্যা-পরিকীর্ণ জীবনযাত্রা; তার থেকে সে সর্বান্তঃকরণে মুক্তি কামনা করে এবং সমাজের বিজ্ঞ বয়স্ক মনস্বীরা যজ্ঞক্রিয়ার মাধ্যমে যে প্রতিবিধান প্রবর্তন করেছেন তা-ই অনুষ্ঠান করে চলে— ফল হোক বা না হোক। ফল না হলে সে নিজেকে, নিজের যজ্ঞক্রিয়াকে দোষ দেবে এবং আবার যজ্ঞ করবে, যেহেতু আর কোনও প্রতিবিধান তার জানা নেই, জাদু ছাড়া। এমন মনে করার যথেষ্ট সংগত কারণ আছে যে যজ্ঞ আর জাদু সমাজের বিভিন্ন স্তরে একই সময়ে অনুষ্ঠিত হত (যেমন এখনও হয়। শিক্ষিত বাড়িতে বিপদে পুরোহিত ইষ্টদেবতার অথবা নৈমিত্তিক অনুষ্ঠানের দেবতার পুজো করে, এবং ফল না হলে বা দেরি হলে পরিবারের অন্য স্তরে ওঝা, গুণিন ডেকে ঝাড়ফুঁক করা হয়। দেবতা মারফত পূজার ইষ্টসিদ্ধির প্রয়াস, আর দেবতাকে বাদ দিয়ে অতিলৌকিকের সাহায্যে ওই উদ্দেশ্যই সিদ্ধ করার চেষ্টা— এ দুটিই যুগপৎ আচরিত হয়)। অথর্ববেদের যে সব জাদু-অংশ ঋগ্বেদের পূর্ববর্তী তা সেই সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছিল যখন সমাজের বেশি শক্তিমান অংশ যজ্ঞ করছিল; কাজেই কালগত ভাবে এ দুটি সমকালীন ছিল।

এই মানসিক বাতাবরণের মধ্যে সৃষ্ট খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতক পর্যন্ত কালে রচিত ঋগ্বেদ সংহিতা। এ সাহিত্যের অধিকাংশটাই যজ্ঞকেন্দ্রিক, যদিও অনুষ্ঠানের কথা এতে সরাসরি তেমন নেই যেমন আছে দেবতাদের উদ্দেশে স্তব ও গান, যার নাম সূক্ত। এর অধিকাংশেই দেবতাকে বলা হচ্ছে: ‘তোমাকে এই দিলাম, তুমি আমাদের এই দাও।’ এক কথায়, ঐহিক সুখস্বাচ্ছন্দ্য, যেটা প্রকৃতিকে মানুষের স্বার্থের অনুকূলে জয় করার দ্বারা পাওয়া যায়, সেই জয় করার কাজটা দেবতার হাতে দেওয়া হচ্ছে, হব্যের বিনিময়ে। এ সব প্রার্থনাই তখনকার সমাজে জীবনমরণের সমস্যা; প্রাগার্য ঈর্ষার পরিমণ্ডলে টিকে থাকার সমস্যা, প্রকৃতির নানা দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার সমস্যা। এটা মনে রাখলে প্রার্থনাগুলির আকুতি আমাদের কাছে অর্থবহ হয়। নিশ্চয়ই সে-সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করত যে, যজ্ঞে হব্য ও স্তব দিয়ে দেবতাদের যথাবিহিত ভাবে আহ্বান ও মিনতি করলে তাঁরা ইপ্সিত ফল দেবেন। আগন্তুক উৎপাত না ঘটলে যথাকালে ফসল ফলত, অকস্মাৎ রোগব্যাধি না হলে মানুষ দীর্ঘজীবীই হত, শক্তিতে ও অস্ত্রে উৎকর্ষ থাকলে শত্রুজয়ও অবশ্যম্ভাবী ছিল; সেটা যজ্ঞ করলেও হত, না করলেও হত।

যেহেতু প্রতিবার যজ্ঞে প্রার্থিত ফল মেলে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শত্রুর জিঘাংসার বিরুদ্ধে মানুষ স্বভাবতই অসহায়, তাই ফল ফলুক বা না ফলুক দেবতাদের দ্বারস্থ হলে মনে একটা আশ্বাস জন্মায় যে, তার প্রার্থনা পূর্ণ হবে। মানুষের সার্বিক অসহায়তা এমনই ছিল যে, এ ধরনের আশ্বাস মনে মনে নির্মাণ না করলে সে বেঁচে থাকতেই পারত না। তবু মানুষ যে দিন চোখ খুলে বহির্জগৎকে দেখতে শুরু করেছে সে দিন থেকেই সে হিসেব মেলাতে চেষ্টা করেছে: দেবতাকে যথোচিত স্তব ও নৈবেদ্য দিয়েই প্রার্থনা করা সত্ত্বেও কেন সর্বদা ফল পাওয়া যায় না? এ চিন্তা অন্য জীবের নেই, সে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশেষ দেবতার আরাধনা করে না, কাজেই বঞ্চিত বোধ করার কোনও কারণই তার নেই। মানুষের আছে। ফলে ঋগ্বেদের আদিপর্ব থেকে তার হিসেবে গরমিল দেখা দিয়েছে। যখনই দুই আর দুয়ে চার হয়নি, তখনই সে প্রশ্ন করেছে; এ প্রশ্নের উদ্ভব এক ধরনের যন্ত্রণায়, হিসেব না মেলার অর্থ বিশ্বাসের ভিত টলে যাওয়া। হিসটারম্যান যেমন বলেছেন, ‘তখন ব্যাপারটা আর একটি বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যজ্ঞকে অস্বীকার করা নয়, বরং যজ্ঞ নামক নিরবয়ব প্রতিষ্ঠানটিকেই অস্বীকার করা। যজ্ঞতত্ত্ব হয় সত্য নয় মিথ্যা।’[১] যত দিন যাচ্ছিল ততই হিসেব না মেলার অভিজ্ঞতা বাড়ছিল, অতএব বাড়ছিল প্রাণপণ শক্তিতে বিশ্বাসের সঙ্গে অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা; এবং এখানে যে অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতা তারই অনুপাতে বাড়ছিল সন্দেহ। মানুষ বাক্‌নির্ভর জীব, তাই সে যুগের বহুতর সন্দেহ বেদেই বিধৃত আছে। যজ্ঞের যুগে মানুষ কী বিশ্বাস করত? এর উত্তর কোথাও স্পষ্ট উচ্চারণে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ঋগ্বেদ থেকে যা বোঝা যায় তা হল, জনসাধারণ মোটের ওপরে বিশ্বাস করত: ১) দেবতারা আছেন; ২) তাঁরা মানুষের হিতৈষী অর্থাৎ মানুষের কষ্টের প্রতিকার করতে চান; ৩) তাঁরা শক্তিমান অর্থাৎ মানুষের অভীষ্ট পূরণের ক্ষমতা তাঁদের আছে; এবং ৪) যজ্ঞে স্তোত্র ও হব্য পেলে তাঁরা প্রীত হন ও ভক্তের প্রার্থনা পূরণ করেন। ধীরে ধীরে আরও একটা বিমূর্ত ব্যাপারে তাদের বিশ্বাস জন্মেছিল: এ বিশ্বচরাচর নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে একটা অমোঘ শুভশক্তির দ্বারা, যাকে তারা পরে ‘ঋত’ নাম দিয়েছিল। দিনরাত্রির পর্যায়ক্রমে বা ঋতুগুলির নিয়মিত আবর্তন এই ঋতেরই প্রকাশ। চরাচরের অন্তর্নিহিত সত্য হল এই ঋত, যা দেবতাদের দ্বারা লঙ্ঘিত হয় না, যার বিপরীতে অবস্থান ‘অনৃত’ বা মিথ্যার। এ সব বিশ্বাস ছিল তাদের পায়ের তলায় মাটি, মাথার ওপরের আকাশ। এগুলো টলে গেলে তাদের ভুবনে দেখা দেয় চূড়ান্ত বিপর্যয়। ধর্ম তাই সংহতি আনে; বার্জারের কথায়, …মানুষের ইতিহাসে ধর্ম হল নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী প্রাচীরগুলির অন্যতম।’[২] এই ‘ঋত’ বা বিশ্বের অন্তর্গত এক নৈতিক ভিত্তি যার প্রকাশ প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতায় এবং মানুষ সেই ভাবে প্রকৃতির অনুসরণ করে যাতে তার সমাজ চলতে পারে নিয়ম মেনে। ঋতের মতোই এক অদৃশ্য নীতিনিষ্ঠ আবর্তন ও আচরণের অনুসরণে মানবসমাজ নিয়ন্ত্রিত হলেই মানুষের মঙ্গল, এ-ই ছিল উপপাদ্য।

মুশকিল বাধে দু-জায়গায়: প্রথমত, প্রকৃতি বারবার নিজেই নিজের নিয়মকে ভাঙে- কখনও কখনও বর্ষাকালে দেখা দেয় খরা, অথবা অতিবৃষ্টি আসে, হঠাৎ ঘটে ভূমিকম্প, পশুপালে মড়ক লাগে, তৃণভূমি শুকিয়ে ওঠে, অথবা ছুটে আসে পঙ্গপাল, দেখতে দেখতে যত্নে লালিত ফসল ধ্বংস হয়ে যায়, বিদেশি শত্রু আক্রমণ করে, মানুষের সমাজে দেখা যায় মহামারি, ঘটে ব্যাপক অকালমৃত্যু। এ সব সময়ে মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি টলে যায়। সহসা সে আবিষ্কার করে যে, প্রকৃতি, জীবন, সমাজ যেমন ভাবে চলার কথা, তেমন ভাবে চলছে না। হঠাৎ সে দেখে সংসারে অশুভ, অমঙ্গল, পাপ, অনৃত আছে; তার সহজ বোধবুদ্ধিতে জীবনের ছক যা হওয়া উচিত তেমন হয় না, ধাক্কা লাগে যখন তার সাধারণ বুদ্ধিতে জীবনের জটিলতার কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। ক্লিফোর্ড গির্জ তাই বলেন, ‘ধর্মকে দেখতে হবে অন্তত সাধারণ বুদ্ধির ক্ষেত্রে অনুভূত একটা ন্যূনতার পরিপ্রেক্ষিতে; জীবন সম্পর্কে সামগ্রিক একটা মনোভঙ্গির প্রেক্ষাপটে। সাধারণ বুদ্ধির ওপরে একটা প্রতিঘাতের রূপেও (ধর্মকে) দেখতে হবে।[৩] বৈদিক আর্যরা জীবন বা সমাজ সম্বন্ধে যে একটি ছক বা নকশা তৈরি করেছিল, তার মধ্যে নিয়মের ভূমিকা ছিল সর্বব্যাপী। সেখানে ব্যত্যয় দেখা গেলে সমস্ত সংহতি টলে যায়। মানুষ সর্বদাই কামনা করে তার ব্যক্তি ও সমাজজীবন চলবে একটা স্বীকৃত, পরিচিত নিয়ম ধরে, যেমন চলে চন্দ্রসূর্য, শীতগ্রীষ্ম। সাধারণ ভাবে চলেও তাই, কিন্তু মাঝে মাঝে শৃঙ্খলা ভেঙে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা বা সুসংহত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সব শক্তি দেখা দিত, তার নানা রূপ: ভিন্ন গোষ্ঠীর বা আগন্তুক গোষ্ঠীর শত্রু, যার হাতে পরাজয় এমনই এক অবাঞ্ছিত অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা; আর ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয় বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, অজন্মা এবং মহামারি মানুষ ও পশুর। এ সবের মধ্যে মানুষ দেখতে পেত তার জীবনে ও সমাজে হিসেবের বাইরে এক অশুভ শক্তির অনুপ্রবেশ। আকাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্যে সে মনে মনে কল্পনা করল দেবতার। নিজেরই শক্তিমত্তার এক প্রতিরূপ হিসেবে। যাযাবর অবস্থা থেকে আর্যরা প্রাগার্য রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এসে দেবতাদের দেখল রাষ্ট্রশক্তি, বিশেষত সে-শক্তির নিয়ন্তার প্রতিভূ রূপে। আর্থার উফের কথায়, ‘দেবতারা রাষ্ট্রের শক্তির রূপক, এ রূপক হল, রাষ্ট্র পরিচালক ও ন্যায়াধীশের।’[৪]

মানুষ কোন নিরিখে তার দেবতাকে নির্মাণ করেছিল? বুদ্ধিমান, শক্তিধর, সক্রিয়, সাহায্যপরায়ণ। এমন একটিই জীব তার জানা ছিল: মানুষ। কাজেই মানুষ নিজের রূপেই অধিকাংশ দেবতাকে কল্পনা করেছিল; অবশ্য কিছু কিছু উপকারী এবং/বা ক্ষমতাশালী নিসর্গবস্তুকেও সম্ভ্রমে বা আতঙ্কে সে দেবায়িত করেছিল। যেমন সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, পর্জন্য, ইত্যাদি। কিন্তু অধিকাংশ দেবতাতেই সে নিজের আকৃতি ও প্রকৃতি আরোপ করে নির্মাণ করল। প্রতীচ্যে এ নিয়ে পরিহাসবিজল্পনা আছে, ঈশ্বর মানুষকে নির্মাণ করলেন নিজের প্রতিরূপ হিসেবে। কিন্তু মানুষও তো ভদ্রলোক, তাই সে ঈশ্বরকে নির্মাণ করল নিজের প্রতিরূপে।’ এর মধ্যে একটি সত্যও নিহিত আছে।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দেই এই দেবনির্মাণকার্য অনেকটাই সম্পূর্ণ হয়েছিল; তবে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে আনাতোলিয়ার বোঘাজ-কো-ঈ শিলালিপিতে ইন্দ্র, বরুণ, নামত্য, ইত্যাদি কয়েকজন বৈদিক দেবতার নাম পাওয়া যায়। বৈদিক যজ্ঞে দেবতাদের বিগ্রহ থাকত না, তবু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যাস্ক তাঁর নিরুক্ত গ্রন্থে প্রশ্নটা তুলেছেন। দৈবতকাণ্ডে আগে বললেন, দেবমণ্ডলীর অবস্থান ‘নররাষ্ট্রের মতো—তত্রৈতন্নররাষ্ট্রমিব।’ (৭:৫:৯) অর্থাৎ দেবতারাও একটি সংহত সমাজে বাস করেন যার গঠন মানুষের রাষ্ট্রেরই মতো। পরে প্রশ্ন তুললেন, দেবতাদের আকার বিষয়ে— ‘অথাকারচিন্তনং দেবতানাম্।’ (৭:৬:১) এর উত্তর দিতে গিয়ে প্রথমে বললেন, ‘কেউ কেউ বলে পুরুষের মতোই হবে— পুরুষবিধাঃ সুরিত্যেকম্।’ (৭:৬:১) কিন্তু বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি এগুলি স্পষ্টতই পুরুষাকৃতি নয়। তা হলে? তা হলে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, কেউ কেউ বলে ‘পুরুষবৎ নয়— অপুরুষবিধাঃ সুরিত্যেকম্।’ (৭:৭:১) দু’রকম মতের সমাহারে সিদ্ধান্ত করলেন, ‘অথবা উভয়বিষয়ই হবে— অপি বোভয়বিধাঃ স্যুঃ।’ (৭:৭:৭) অর্থাৎ অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র তো প্রত্যক্ষ ভাবেই মনুষ্যরূপী নয়, এদের আকৃতি মানুষ নির্মাণ করতে পারেনি, এরা যে-রূপ দৃশ্যমান সেই রূপেই পূজ্য। কিন্তু বিভিন্ন প্রয়োজনে যে সব শক্তিধর সহায়ক ও আশ্রয়রূপী দেবতা মানুষ নির্মাণ করেছে, তাদের তো স্বাভাবিক ভাবেই মনুষ্যরূপে কল্পনা করেছে। তাঁদের কান থাকা চাই ভক্তের প্রার্থনা শোনার জন্যে; মন, সহানুভূতি, দয়া, হিতৈষা থাকা চাই মানুষের মতো; ক্ষমতা থাকা চাই মানুষের প্রার্থনা পূরণ করার। আর চাই বস্ত্রালংকার, মানুষের মতো সজ্জা এবং বাহুতে বল, অস্ত্রশস্ত্র, রথবাহন, যাতে দ্রুত এসে মানুষের সংকট মোচন করতে পারেন। মানুষের বিপদে দুর্যোগে যাতে দেবতারা অনুকূল হয়ে তাদের পরিত্রাণ করেন ও প্রার্থিত বস্তু জোগান সেই জন্যে মানুষও দেবতাকে তার প্রতি সদয় করে তোলবার জন্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য নৈবেদ্য হিসেবে দিত এবং দেবতার শক্তি, মানবহিতৈষার নানা স্তব আবৃত্তি করে ও গান গেয়ে শোনাত, যাতে দেবতারা তাদের প্রতি অনুকূল হয়ে তাদের ইষ্টসিদ্ধি করেন। এই ভাবে নানা বিপদসংকুল পরিবেশে দেবতাদের সঙ্গে একটা পারস্পরিক আদানপ্রদানের সম্পর্ক কল্পনা করে নিয়ে মনে মনে বিপদ থেকে ত্রাণের বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল। এর জন্যে বিগ্রহধারী দেবতা অত্যাবশ্যক ছিল না, কল্পনায় দেবশক্তিকে সহায়রূপে পাওয়াই ছিল প্রয়োজন— ‘লোকায়ত ধর্মে চূড়ান্ত ভাবে প্রয়োজনীয় ছিল কোনও দেব বা দেবীকে অব্যবহিতরূপে কাছে পাওয়া… সে বিগ্রহধারীই হোক অথবা বিমূর্তই হোক।’[৫]

দেবতাকে কাছে পাওয়া বা তাঁর কাছে নিজেদের বিপদের সংবাদ ও ত্রাণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিবেদন পৌঁছে দেওয়ার আকুতি থেকেই ধীরে ধীরে বিধিবদ্ধ ধর্ম গড়ে উঠেছিল। এর অবশ্যই নানা স্তর ছিল: অত্যন্ত সরল সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক স্তর থেকে প্রার্থনার চরিত্র পরিবর্তিত হতে হতে ধর্মানুষ্ঠান ক্রমে বিচিত্রতর হয়ে উঠছিল, দেবতারাও সংখ্যায় বাড়ছিলেন চক্রবৃদ্ধিহারে, বাড়ছিল পুরোহিতের সংখ্যা, যজ্ঞের সংখ্যা এবং সার্বিক জটিলতা। বহু প্রাচীন দেবতা পরিত্যক্ত হচ্ছিলেন, কারও বা চরিত্র পরিবর্তন ঘটছিল, এবং ধীরে ধীরে বহু নতুন দেবতা দেবমণ্ডলীতে স্থান পাচ্ছিলেন। শেষ দিকে দেবতারা সংখ্যায় এত বেশি হলেন যে, মাঝে মাঝেই তাঁদের নাম ধরে না ডেকে এক সঙ্গে বিশ্বে দেবাঃ’ বলে সম্বোধন করা হচ্ছিল। জীবনে হার মানতে হচ্ছিল আগন্তুক নানা প্রাকৃতিক বিপদ-আপদের কাছে, রোগব্যাধি ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা বিপর্যস্ত হতে হচ্ছিল, ফলে নতুন নতুন বিপদে পরিত্রাণের জন্যে নতুন নতুন দেবতা উদ্ভাবন করা হচ্ছিল।

দেবমণ্ডলীর অনেকেই আর্যদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন, অনেকেই সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে এবং পরে ব্রহ্মাবর্তে।[৬] আরও কিছু এসেছিল প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণকালে এবং পরে এখানকার প্রাগার্য নানা নৃগোষ্ঠীর সংস্রবে এসে; তাদের দেবমণ্ডলী থেকে আত্মসাৎ-করা নতুন কিছু দেবদেবীর অনুপ্রবেশ ঘটে আর্য দেবমণ্ডলীতে। মনে রাখতে হবে, এ দেশে আসবার সময়ে আর্যরা একটি সংহত গোষ্ঠী ছিল না, এবং এখানেও কোনও সংহত প্রাগার্য প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটেনি। ‘পশ্চিম এশিয়ার মতো আগন্তুক আর্যরা পরাক্রান্ত শত্রু অথবা বৃহৎ সাম্রাজ্যের সম্মুখীন হয়নি, হলে তারা সংহত হয়ে উঠে অনেক শক্তিশালী একটি নিজস্ব সুসংহত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাধ্য হত।’[৭] তা যখন হয়নি তখন ছোট ছোট গোষ্ঠীর আর্যদের সংঘর্ষ ঘটতে লাগল অনুরূপ প্রাগার্য গোষ্ঠীর সঙ্গে। জয়-পরাজয়ের পরে অধিকাংশ প্রাগার্য গোষ্ঠী সন্ধি করল আর্য গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে এবং তাদের সঙ্গে মিশে গেল। এই সন্ধির অনিবার্য শর্ত এবং ফল ছিল দু-পক্ষের ধনসম্পত্তি, জমি, ফসল, পশুপাল ও অন্যান্য স্থাবর জঙ্গম সম্পত্তির আদানপ্রদান এবং অন্তর্বিবাহ; এর ফলে একটি মিশ্র নৃগোষ্ঠী গড়ে উঠল, আর্য-প্রাগার্যদের সমাহারে। এরই সূত্র ধরে আদানপ্রদান ঘটে উপাস্য দেবতা ও উপাসনা-পদ্ধতির। এই ভাবেই আর্য দেবমণ্ডলীতে ক্ৰমে ক্ৰমে বহু প্রাগার্য দেবদেবীর অনুপ্রবেশ ঘটল। সমান্তরাল প্রক্রিয়ায় পূর্বতন দেবমণ্ডলীর বেশ-কিছু আর্য দেবতা ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হচ্ছিল। এর মধ্যে, বিশেষত ছিলেন সেই দেবতারা যাদের, বিশিষ্ট সংজ্ঞা, ভূমিকা বা তাৎপর্যের স্মৃতি তত দিনে ধূসর হয়ে এসেছে— যেমন ভগ, অংশ, দক্ষ, তার্যমন্ এবং আপ্রীসূক্তগুলিতে উল্লিখিত অগ্নিবাচক এবং বিস্মৃত তাৎপর্যের অন্য দেবতারা, ‘দ্বারো দেব্যঃ ঊষাসানক্তা’, ইত্যাদি। দেবমণ্ডলীতে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত একটি প্রক্রিয়ায় এদের বিবর্তন ঘটছিল: পূর্বের কিছু দেবতাকে বর্জন, কিছু দেবতার তাৎপর্যে পরিবর্তন এবং নতুন কিছু দেবতার আবির্ভাব। এই শেষোক্তরা বেশির ভাগই আসছিল প্রাগার্য গোষ্ঠীর উপাসিত দেবমণ্ডলী থেকে।

মানুষের সমাজে ও দেবতাদের সমাজে যখন এই সংমিশ্রণ ঘটে তখন সে সময়ের মানুষের প্রত্যয়ের জগতে যা কিছু ধ্রুব অবলম্বন ছিল, সেগুলি হল দেবতাদের অস্তিত্ব, তাদের সর্বশক্তিমত্তা ও মানবহিতৈষা। আর বিশ্বাস ছিল, বিজেতা গোষ্ঠীর বাহুবল ও অস্ত্রবলের উৎকর্ষে; অতএব বিজিতের ন্যূনতায়। এরই ফলে একটি নৈতিক মানদণ্ড তৈরি হল: প্রাগার্যের সম্পত্তিতে আর্যের ন্যায়সংগত অধিকার। লুণ্ঠন অব্যাহত ভাবে চলেছিল- বহু সূক্তে দেবতাদের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে, প্রাগার্য সম্পত্তি লুঠ করে এনে আর্যদের দেওয়ার জন্যে। অবশ্যই লুঠ একতরফা ছিল না, প্রাগার্যরাও আর্যদের সম্পত্তি লুঠ করত। ফলে আর্যরা তাদের ‘রাক্ষস’ (কথাটার আদি অর্থ ছিল, ‘যাদের থেকে রক্ষা করতে হয়— যেভ্যো রক্ষ্যতে’) বলত। এ ছাড়া আর্যদের কোনও কোনও গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা ছিল, সেখানেও পরস্পরের সম্পত্তি লুঠতরাজ করা চলত। অনুপ্রবেশকারী আর্যদের অধিকার বাহুবল ও অস্ত্রবলের জোরে, প্রাগার্যদের জোর ছিল আদিম স্বত্ববোধে; কাজেই সংঘর্ষ কতকটা অনিবার্যই ছিল।

এ সব ও অন্যান্য নানা জাতের অশুভ, ক্ষতিকর অভিজ্ঞতা মাঝে মাঝে তাদের বিশ্বাসের ভূমিতে আলোড়ন জাগাত: দেবতারা মানবহিতৈষী, সর্বশক্তিমান তবু এত অমঙ্গল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, শত্রুর হানা, রোগব্যাধি, লুঠতরাজ কেন হয়? অশুভ বা মন্দকে তারা বলত পাপ কিল্বিষ, কলুষ, পাদ্মন্, ইত্যাদি। মঙ্গলময় দেবতাদের সঙ্গে একই বিশ্বে এত অমঙ্গল কেমন করে থাকতে পারে? অথর্ববেদের একটি প্রার্থনা, সারা পৃথিবীর সর্বকালের একটি প্রার্থনা হল: ‘যদিহ ঘোরং যদিহ ক্রুরং যদিহ পাপং তচ্ছান্তং তচ্ছিবম্। সর্বমেব শমস্তনঃ।।— এখানে (পৃথিবীতে) যা কিছু ঘোর, যা কিছু নিষ্ঠুর, যা কিছু পাপ, তা শান্ত হোক, মঙ্গলে পরিণত হোক, এখানে সব কিছু শান্তিপূর্ণ হোক।’ (১৯:৯:১৪) এই প্রার্থনা কখনও কোথাও পূর্ণ হয়নি, তবু সর্বত্রই উপলব্ধ ও উচ্চারিত হয়েছে। ম্যাকক্লস্কি দেখাচ্ছেন, ‘সহজতম আকারে সমস্যাটি হল এই: ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। ঈশ্বর সর্বমঙ্গলময়, তবুও মন্দ আছে… এগুলির যে-কোনও দুটো যদি সত্যি হত, তা হলে তৃতীয়টি মিথ্যা হত।’[৮] এই মতের স্বাভাবিক যুক্তিগত সিদ্ধান্তটি উমা গুপ্ত-র কথা থেকে নেওয়া যেতে পারে: ‘মন্দের উপস্থিতি থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত করতেই হয় যে, কোনও সর্বশক্তিমান মঙ্গলময় ঈশ্বর থাকা অসম্ভব।’[৯]

ফলে নানা সংশয় দেখা দিল, অভ্যস্ত প্রত্যয়ের পুনর্বিবেচনা শুরু হল, কারণ সেন্ট অগাস্টিন যেমন বলেছেন, ‘মানুষ তা-ই বিশ্বাস করে যা বিশ্বসনীয়’ (Nullus quippe credit, nisi prius cogitaverit esse credendum)। স্পষ্টতই বিশ্বসনীয়তার সংজ্ঞার মধ্যে এসে গেছে যুক্তি, তাই সর্বশক্তিমান, সর্বমঙ্গলময়ের বিধানে মন্দের, অশুভের অবস্থান যুক্তি দিয়েই অবিশ্বনীয়। অতএব মানুষ অবিশ্বসনীয়কে বিশ্বাস করতে দ্বিধাবোধ করল। যদি কোনও সর্বশক্তিমান মঙ্গলময় ঈশ্বর বা দেবকুল না থাকেন তো মানুষের নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও দোলাচলতা আসে; কোন নীতিতে চলা উচিত, সে নিয়েও মনে প্রশ্ন আসে। আর্যদের দীর্ঘ যাত্রাপথে এ ধরনের মন্দের অভিঘাত বেশ দীর্ঘকাল ধরেই তাদের বিশ্বাসকে ধাক্কা দিচ্ছিল। ক্লিফোর্ড গির্জের ভাষায়, ‘বিপর্যস্ত হওয়া, দুঃখ এবং নৈতিক দ্বিধার অজ্ঞেয়তার বোধ… যদি সেগুলি যথেষ্ট তীব্র হয় অথবা দীর্ঘকাল ধরে সেগুলিকে বহন করতে হয় তা হলে জীবন যে বোধগম্য বা আমরা চিন্তা করে জীবনের ছকে নিজেদের সার্থক ভাবে মানিয়ে নিতে পারি এই ধারণার মূলই প্রত্যাহত হয়।’[১০] অর্থাৎ মঙ্গলময়, সর্বশক্তিমান দেবতাদের কর্তৃত্বের অধীনে বাস করার ভরসাটা টলে গেলেই আসে সংশয়। মানুষ সর্বদাই চেয়েছে নির্ভরযোগ্য একটি বিশ্বপরিকল্পের মধ্যে বাস করতে, কারণ সেখানেই তার ধ্রুব আশ্রয়, নির্ভয়, নিশ্চিন্ত অবস্থান

অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, প্রথম যুগে দেবতাদের মধ্যে ক্ষমতার কোনও আনুপাতিক স্তরবিন্যাস ছিল না, এমনকী বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও কোনও ধ্রুব অপরিবর্তনীয় ভিত্তি ছিল না। প্রথমত, আর্যরা দীর্ঘকাল ধরে ধাপে ধাপে নানা দেশ পেরিয়ে এসেছে, এসেছে অন্যান্য বহু ধর্মবিশ্বাসীর দেশ পেরিয়ে, সেখানে অনিবার্য ভাবেই তাদের নিজেদের বিশ্বাসও বিবর্তিত এবং পরিবর্তিত হয়েছে। কাজেই প্রাচীন গ্রিসের মতো এখানেও কোনও অনড় অবশ্যস্বীকার্য বা সর্বস্বীকৃত বিশ্বাসের ভিত্তি তাদের থাকা সম্ভব ছিল না। প্যাট্রিক দেখাচ্ছেন, ‘কোনও ধ্রুব বিশ্বাসের কাঠামো ছিল না, যাতে চিত্ত বিক্ষিপ্ত হতে পারে; আর তার চেয়েও যা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় তা হল (দেবতাদের) কোনও উচ্চনীচ ক্রম ছিল না। ধর্ম ছিল উপাসনানির্ভর। এবং পুরোহিতদের ভূমিকা তাঁদের ক্ষমতার চেয়ে সম্মানই বেশি দিয়েছিল।’[১১] উপাসনানির্ভর ধর্মের ভিত্তি হল উপাস্যদের সম্বন্ধে আস্থা। কী সেই আস্থা? যেমন আগেও বলেছি, তাঁরা আছেন, তাঁরা সর্বশক্তিমান, মঙ্গলময়, মানবহিতৈষী এবং উপাসনা যদি যথাযথ রীতিতে নিষ্পন্ন হয় তা হলে তাঁরা প্রার্থীর অভিষ্ট সিদ্ধ করেন।

***

১. ‘It is no longer a question of denying a particular person’s (or group’s) sacrifice, but of denying the abstract institution of sacrifice. The doctrine of sactifice is either true of false.’— JC Heesterman, On th origin etc.

২. ‘…religion has been one of the most effective bulwarks against anomy throughout human history.’ – Peter Berger, p. 87

৩. ‘Religion must be viewed against the background of the insufficiency, or anyway the felt insufficiency, of common sense, as a total orientation toward life and it mut also be viewed in terms of formative impact upon common sense.’— Clifford Geertz, p. 96

8. ‘… gods are a metaphor for the system of authority, the state. The metaphor in one of rulers and judges…’— Arthur Wolf, p. 19

৫. ‘….a crucial ingradient in folk religion is the immediate presence of and access to a god or a goddess…which may be iconic or aniconic . ‘ – GD. Sontheimar & Herman Kulke (ed.), p. 4

৬. সরস্বতী দৃষদ্বত্যোদেবনদোর্ষদন্তরম্। তং দেবনির্মিতং দেশং ব্রহ্মাবর্তং প্রচক্ষতে। মনুসংহিতা; (২:১৭)

৭. ‘Unlike in Western Asia the immigrating Aryans did not encounter mighty enemies and big empires which would have forced them to unite and to establish a more effective political organization of their own. – Herman Kulke & Dietmar Rothermund, p. 45

৮. ‘In its simplest form the problem in this: God is omnipotent, God is wholly good; and yet evil exists… if any two of them were true, the third would be false.’ – H J M McClosky, p. 46, God and Evil, ed. Nelson

৯. ‘We must conclude from the existence of evil that there cannot be an omnipotent, benevolent God.’— Uma Gupta, p. 84

১০. ‘Bafflement, suffering and a sense of intractable ethical paradox are … if they are intense enough or are sustained long enough radical challenge to the proposition that life is comprehensible and that we can by taking thought orient ourselves effectively within it.’— Clifford Geertz. p. 100

১১. ‘There were no dogmas to confuse the mind, and what was still more remarkable, there was no hierarchy. The religion was one of worship and the position of the priesst conferred more honour than power. ‘ — MM Patrick, p. 4

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *