০০. ভূমিকা – বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য

ভূমিকা

সংশয় ও নাস্তিক্যের মধ্যে প্রকৃতিগত, ব্যাপ্তিগত এবং মাত্রাগত পার্থক্য আছে। সব সংশয় নাস্তিক্য থেকে আসে না। আবার মূল নাস্তিক্যও সংশয়ের চেয়ে গভীর ও ব্যাপক। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আস্তিকেরও সংশয় থাকতে পারে। সংশয় পরিসরে ছোট, গভীরতাতেও তাই। নাস্তিকের সংজ্ঞা হল ‘ঈশ্বরাপ্রামাণ্যবাদী’ অর্থাৎ যে ঈশ্বরকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে না, এবং ‘বেদাপ্রামাণ্যবাদী’ অর্থাৎ বেদকে প্রামাণ্য বলে মানে না। এ ছাড়া উপনিষদে দেখি, যে পরলোকে বিশ্বাস করে না সে-ও নাস্তিক। পরলোক মানে শুধু স্বর্গনরক নয়, পরলোক থাকতে গেলেই মরণোত্তর আত্মা থাকতে হবে। তাই যে পরলোক নয়, শুধু ইহলোককেই স্বীকার করে সে-ও নাস্তিক। পরলোককে স্বীকার করলেও ঈশ্বরকে স্বীকার নাও করা যেতে পারে, এবং এ দুটি স্বীকার করেও বেদের প্রামাণ্যতা যে মানে না সে-ও নাস্তিক। হেমচন্দ্রের অভিধান বলে, নাস্তিকের প্রতিশব্দ হল, বার্হস্পত্য, চার্বাক ও লোকায়তিক। যে ‘নাস্তি’ শব্দ থেকে নাস্তিক শব্দের ব্যুৎপত্তি, তার তিনটি অর্থ হতে পারে: যে ঈশ্বর মানে না, যে পরলোক মানে না এবং যে বেদের প্রামাণ্য মানে না। দেখা যাচ্ছে ঈশ্বর, পরলোক ও বেদে বিশ্বাস পরস্পর-নিরপেক্ষ; তা হলে বোঝা যাচ্ছে যে, এ তিনটিই ছিল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তিনটি মূল স্তম্ভ। পরবর্তীকালে বুদ্ধের আগে যে সব বেদবিরোধী প্রস্থানের উদ্ভব হয়েছিল, তারা সকলেই বেদের প্রামাণ্যে অবিশ্বাসী, ঈশ্বরের অস্তিত্বেও আস্থাহীন। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই পরলোকে বিশ্বাসী; এর সঙ্গে বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিকরাও আছেন। অথচ এই পরলোক নিয়ে ব্রাহ্মণসাহিত্য, আরণ্যক ও উপনিষদে নানা সংশয়। শাস্ত্রমতে এ সংশয়ও নাস্তিক্য, তবে এ নাস্তিক্যের সংজ্ঞা শুরু হয় উপনিষদে।

ধ্রুপদী নাস্তিক

এই কালবিন্দুতে ধ্রুপদী নাস্তিক আবির্ভূত হন। তাঁদের সম্পর্কে সমাজের তীব্র তিক্ততাতেই বোঝা যায় কোনও একটি সুসংহত ছকে এঁরা আর পরস্পর-সাপেক্ষতায় সম্পৃক্ত নন। এর প্রাথমিক সূত্রপাত কিন্তু পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রী নিয়ে পারস্পরিক নির্ভরতা থেকে। নাস্তিক্যের ইংরেজি ‘এথিইজম্’, এ শব্দটির ব্যুৎপত্তি, a-theos থেকে অর্থাৎ ‘অনীশ্বর’ বা ‘ঈশ্বর না মানা’। একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্মে আত্মা ও পরলোক ঈশ্বর-সমর্থিত তত্ত্ব, অতএব ঈশ্বরকে না মানার সঙ্গেই এগুলো সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষে এই তিনটি তত্ত্ব: বেদ, ঈশ্বর ও পরলোক পৃথক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ কেউ এর মধ্যে দুটিকে বিশ্বাস করে, কেউ একটিকে, কেউ-বা কোনওটিকেই বিশ্বাস করে না; যদিও এখানেও পরবর্তী যুগে এই তিনটি পরস্পর-সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এবং বেদ বলতে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ-উপনিষদই বোঝাত না, তার সঙ্গে যজ্ঞও বোঝাত, যেটা বেদের প্রায়োগিক দিক। এই যজ্ঞ সম্বন্ধে সংশয় এবং অনীহা ও নাস্তিক্যেরই একটি প্রকাশ বলে মনে করা হত। যজ্ঞের নানা প্রবক্তা ছিল, নানা গোষ্ঠী ও তার নানা রূপভেদ ও বিবর্তন ঘটেছিল; কিন্তু এ সবের বাইরে উত্তর ভারতে নানা বিকল্প রূপের মধ্যেও একটি বিমূর্ত ‘যজ্ঞ’ ব্যাপার মানুষের চেতনায় ও আচরণে ছিল। নাস্তিকের ঔদাস্য ও অনাস্থা এই যজ্ঞ ব্যাপারটাকে অবলম্বন করেই।

‘যজ্ঞতত্ত্ব অপরিহার্যরূপে বেদের প্রতীকী, এমনকী বেদের বিবক্ষিতের সারবস্তু বলেই স্বীকৃত ছিল। তাই বেদোক্ত যজ্ঞক্রিয়াকে না মানাও নাস্তিক্য। তখন আস্তিক গার্হস্থ্য আশ্রমে থেকে নানা যজ্ঞক্রিয়া করবে, এইটেই ছিল সামাজিক অনুশাসন; তার বিরুদ্ধাচরণ সমাজ সম্পর্কে একটা প্রতিস্পর্ধা, এবং সে-সমাজ তো শাসিত হত এই বেদ দিয়েই। কাজেই এই বিরুদ্ধাচরণ নাস্তিক্য বলেই অভিহিত হত। ক্রমে পরস্পর সংঘর্ষে উত্তীর্ণ হওয়া। যজ্ঞকারী ও নাস্তিক উভয়েই (যজ্ঞ) কর্ম অর্থে গোষ্ঠীগত আনুষ্ঠানিক আদানপ্রদান-নির্ভর কর্মকে পরিহার করে, উভয়ের পার্থক্য হল, বেদের ব্যক্তিগত কর্মের সত্য মিথ্যা বিষয়ে বেদের সার্বভৌম অনুজ্ঞা।… যজ্ঞকারী (ও তার আস্তিক বংশধর) মানুষের লোকাতীত স্তরে উত্তরণের জন্যে লোকাতীত অনুশাসনের কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতা সমর্পণ করে। অপরপক্ষে, নাস্তিক্য লোকাতীতকেই বিসর্জন দেয়— ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্যে।[১] কর্মকাণ্ডের শেষ দিকে বৈদিক সাহিত্যে দেহাতীত আত্মা দেখা দেয়; যজ্ঞেও পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রীর অনেকটাই ভাগ হত পুরোহিত ও যজমানের মধ্যে। পরে যখন আত্মার কল্পনা উদিত হল তখন যজ্ঞকারীরা যজ্ঞতত্ত্বের দ্বারা লোকাতীত সত্তায়— আত্মায় উত্তরণ করলেন এবং এইখানে ঘটল নাস্তিকের সঙ্গে তার মৌলিক বিচ্ছেদ। বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করতে গিয়ে সে তার ব্যক্তিসত্তার অর্থাৎ স্বাধীন চিন্তার অধিকার বিসর্জন দিল লোকাতীত তত্ত্বের কাছে। আর নাস্তিক সেই লোকাতীতত্ত্বকে বিসর্জন দিল ব্যক্তিসত্তার নিজস্ব চিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে। ব্যক্তিচিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার দুটি প্রধান অর্থ: বেদের প্রামাণ্য যেহেতু প্রত্যক্ষ নয়, অর্থাৎ দেবতা, যজ্ঞ, ধর্মাচরণ নিয়ে বেদ যত কথা বলছে তা যেহেতু প্রত্যক্ষ নয় তাই তা বিসর্জিত হল এবং পরে এরই সঙ্গে বিসর্জিত হল দেহব্যতিরিক্ত আত্মা। বিনিময়ে তার চিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকল, অর্থাৎ যে-বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোনও গ্রহণযোগ্য যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে অনায়াসে পরিহার করা হল। উপনিষদে স্বপ্ন ও জাগ্রৎ অবস্থার প্রসঙ্গে বারবার বলা হয়েছে স্বপ্নে মানুষ বহু অবাস্তব বিষয় দেখে। পরে জেগে উঠে জানতে পারে যে, সে-দেখাগুলো সম্পূর্ণ অলীক এবং যে-জগতে জেগে ওঠে সেটাই বাস্তব। তা হলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ বাস্তব জগতের আপেক্ষিক সত্যতাই স্বীকার করা হল।

আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়ী

প্রত্যক্ষ মানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, তাকে স্বীকার করতে গেলে বেদের অতিলৌকিক অনুজ্ঞা স্বীকার করা যায় না। বহু প্রস্থানই বেদের প্রামাণ্যতা মানতে পারেনি। এগুলির মধ্যে প্রধান হল বৌদ্ধমত। আত্মা ও পরলোক মানলেও বৌদ্ধধর্ম বেদকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেনি, যজ্ঞকেও অস্বীকার করেছে। ‘যখন ঐতিহ্যের অভ্যন্তরীণ প্রাস্থানিক বস্তু বিপর্যস্ত হচ্ছে তখনই বাইরের (বাহ্য) ও বিরুদ্ধ (নাস্তিক) বৌদ্ধমতের প্রতিস্পর্ধার বিরুদ্ধে বেদকে উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে।… ঐতিহ্যগত (আস্তিক) ও ঐতিহ্যবহির্ভূত (নাস্তিক) মতের পার্থক্য হল ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে মৌলিক ও পরিচিত লক্ষণ। ঐতিহ্যবাহিত ভারতীয় স্তোত্রসাহিত্যে যেমন, তেমনই অধুনাতন ভারতীয় দর্শনের সমীক্ষাতেও স্পষ্ট।’[২] ‘প্রাচীন গ্রিক ভাষাতেও নাস্তিকতার সংজ্ঞা আদিতে শুধু ঈশ্বরে (অর্থাৎ দেবদেবীতে) অবিশ্বাসীকেই বোঝাত না, ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক বা না করুক, রাষ্ট্রের সর্বস্বীকৃত দেবতাদের (অস্তিত্বে) অবিশ্বাসীকেও বোঝাত। রোম সাম্রাজ্যে (নাস্তিক) খ্রিস্টান অজ্ঞেয়বাদীদের বোঝাত।[৩] দর্শনের কোশগ্রন্থ বলে: ‘সংশয়বাদ একটি সমালোচনাশ্রয়ী দার্শনিক মনোভাব হিসেবে জ্ঞানের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে দার্শনিকদের ও অন্যদের যে দাবি, তাকে প্রশ্ন করে।’[৪] গ্রিক ‘স্কেপটিকস্’ শব্দটি অনুসন্ধিৎসু এই অর্থ বহন করে; সংশয় শব্দটির অর্থ অনুসন্ধান। কোনও নিশ্চিত বিশ্বাসের অভাবই সূচিত করে ‘সংশয়’। ইংরেজি doubt শব্দটি ব্যুৎপত্তির দিক থেকে double শব্দটির সঙ্গে অন্বিত, অর্থাৎ এর মুখ্য অর্থ দ্বিত্ব, ‘এটাও হয়, হয়তো ওটা-ও হয়’— এই মনোভাব। লাতিন dubits প্রাচীন লাতিন dubo, জার্মান zweifel-এ সবের অর্থ দ্বিত্বতা, অর্থাৎ স্থির সিদ্ধান্তের অভাব, দোলাচলতা। তা হলে প্রাচীন গ্রিক, লাতিন, জার্মান সংশয়ের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল, দ্বিধা, অর্থাৎ নিশ্চয়তার অভাব। এর এক প্রান্তে আছে বিশ্বাস, যার মধ্যে অন্তর্নিহিত দৃঢ়তা, স্থিরতা, অসংশয়িত প্রত্যয়। অপর প্রান্তে আছে ঠিক তার বিপরীত মনোভাব: অবিশ্বাস ও নাস্তিক্য; এর মধ্যেও আছে দৃঢ়তা ও অসংশয়। আস্তিকের যেমন দ্বিধা নেই যে, ঈশ্বর, পরলোক, আত্মা, বেদ সবই আছে এবং সবই প্রামাণ্যক, অসংশয়িত, ঠিক তেমনই নাস্তিকের চিন্তাতেও কোনও যথার্থ দ্বিধা নেই। আস্তিকের মতোই নাস্তিকেরও কোনও সংশয় নেই; সে সংশয়ী নয়, বরং নিশ্চিতই জানে বেদ, আত্মা, পরলোক, ঈশ্বর বা দেবতারা কেউই, কিছুই বাস্তবিক পক্ষে নেই বা প্রমাণসিদ্ধ নয়। এ কল্পনাগুলি তার জীবনচর্যায় অকিঞ্চিৎকর, নিরর্থক এবং বাস্তবে নিষ্প্রয়োজন। অর্থাৎ আস্তিক ও নাস্তিক দুজনেরই তত্ত্বগত অবস্থান ইতিবাচক, এবং স্পষ্ট; শুধু সংশয়ীর অবস্থান ইতি-নেতিবাচক, অতএব অস্পষ্ট। অজ্ঞেয়বাদীর অবস্থানও ইতি-নেতির মধ্যবর্তী, কিন্তু স্পষ্ট। সে বলে, কিছু আছে কি না বা কেউ আছে কি না আমি জানি না, জানা যায়ও না। তার জ্ঞানে দোলাচলতা নেই, থাকা-না-থাকা সম্বন্ধে তার না জানাটা খুবই দ্ব্যর্থহীন: সে নিশ্চিত জানে যে, সে নিশ্চিত ভাবে কিছুই জানে না। থাকা ও না-থাকার উভয়মুখী সম্ভাবনাকে সে স্বীকার করে মাত্র; এবং প্রচ্ছন্ন ভাবে সে নিশ্চিত ভাবে জানে না, কিছু আছে কি না, থাকলেও জানা সম্ভব কি না। ঠিক এই অবস্থান প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে কোথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কিন্তু মাঝে মাঝে ‘কে জানে’ এ ধরনের বাক্যাংশ থেকে অজ্ঞেয়বাদের আভাস পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে স্পষ্ট আস্তিক্য, স্পষ্ট নাস্তিক্য এবং স্পষ্ট সংশয়ের প্রকাশই বেশি পাওয়া যায়।

গ্রিসের মতো প্রাচীন ভারতবর্ষেও যজ্ঞক্রিয়াই ধর্মাচরণ ছিল বলে যজ্ঞে ও তৎসংশ্লিষ্ট দেবদেবীতে অবিশ্বাসই ছিল নাস্তিক্য। নাস্তিক্য খুব ব্যাপক শব্দ, এক দিকে কোনও একজনের মনে বিশ্বাসের জগতের সমগ্র ব্যাপারটা নিয়ে আমূল অবিশ্বাস জন্মায় কদাচিৎই। কিন্তু খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্ত ব্যাপারে, যজ্ঞপ্রক্রিয়ায়, বিশেষ বিশেষ দেবতা সম্বন্ধে, তাঁদের উৎপত্তি, অস্তিত্ব, কার্যক্ষমতা, যজ্ঞক্রিয়ার যাথার্থ্য সম্বন্ধে অবিশ্বাস বহু মানুষের মনেই জাগতে পারে। এ ধরনের সংশয় সংহিতা ব্রাহ্মণে, অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের সাহিত্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে বহুবার ব্যক্ত হয়েছে; এগুলি সংশয়, যদিও এর মধ্যে কিছু কিছু নাস্তিক্যের ধারঘেঁষা। নেম ভার্গব যখন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ দেবতা ইন্দ্র সম্বন্ধে অসংশয়িত উচ্চারণ করেন, ইন্দ্রকে কে জন্মাতে দেখেছে? বলছেন, ইন্দ্র বলে কেউ নেই— তখন সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এটা খণ্ড সংশয় থেকে অখণ্ড নাস্তিক্যে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। কারণ তখন ধর্ম হল যজ্ঞ এবং যজ্ঞের মুখ্য দেবতাই ইন্দ্ৰ, কাজেই ‘ইন্দ্ৰ নেই’ বলা সংশয়কে ছাড়িয়ে নাস্তিক্যের পর্যায়ে চলে যায়।

এ দেশে বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব থেকেই সাহিত্যে বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি নানা অংশ নিয়ে সংশয়ের প্রকাশ দেখা গেছে। বেদে যা আছে তার বাইরেও অন্যান্য সংশয়ের প্রকাশ গণমানসে নিশ্চয়ই ছিল, কারণ বেদে সমগ্র গোষ্ঠীর বিশ্বাস বা সংশয়ের সমস্ত অনুপুঙ্খ নিশ্চয়ই বিধৃত নেই, মোটের ওপর বেদ জনসাধারণের ধর্মাচরণ ও তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পটভূমিকার একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্য। তবু তার মধ্যেও অবিশ্বাসের নানা চিহ্ন আছে— দেবতাদের স্বরূপ, আচরণ, অভিপ্রায়, ক্ষমতা এবং যজ্ঞকর্মের যাথাযথ্য সম্পর্কে সন্দেহে। সংহিতা থেকে উপনিষদে পৌঁছোনোর পথ-পরিক্রমায় সংশয়গুলি বাড়ছিল— সংখ্যায়, প্রকারে, গভীরতায় এবং ব্যাপকতায়। যদিও বিশ্বাস ও তত্ত্বের বিবর্তনের নিজস্ব ক্রম থাকে, তবু মোটের ওপরে জীবন ও জীবিকার ভিত্তি— উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্গে তার একটি অঙ্গাঙ্গি যোগ থাকে, কারণ উৎপাদন অর্থাৎ সমাজের অবগঠন বহুলাংশে সমাজের মানসিক অধিগঠনকে নিরূপণ করে। মানুষের অবচেতনে প্রত্যাশা থাকে যে, ‘তার জীবনের ভিত্তিগত গঠনে পুরো অথবা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশগুলি তার বোধগম্য হবে এবং তার কর্মপ্রচেষ্টার নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।’[৫] এই প্রত্যাশাকে চূর্ণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা। মানুষ আবিষ্কার করে যে, তার জীবনের অবগঠনের অনেকটাই তার বোধের এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তখনই দেখা দেয় সংশয়— তার জানা জগতের অংশবিশেষ সম্বন্ধে এবং সৃষ্টি সম্বন্ধে; সে সংশয় সমগ্র জগৎ সম্পর্কে।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গ্রিসে তার্কিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য, ‘যে পৃথিবীটা সকলের পক্ষেই একই রকমের সেটি কোনও দেবতা বা মানুষ সৃষ্টি করেনি; সেটি বরাবরই ছিল, এখনও আছে এবং চিরকালই থাকবে।’[৬] এমন কথা মনে করলে সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টিকর্তার প্রশ্নটা চলে যায়, থাকে শুধু সৃষ্টিটাই, এবং সেটা প্রত্যক্ষ অতএব সংশয়াতীত।

বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সংশয়

উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত ছাড়া আর কোনও দর্শনপ্রস্থানই প্রত্যক্ষকে অস্বীকার করেনি। এরাও স্বপ্নকে অলীক ও অবাস্তব এবং জাগ্রৎ অভিজ্ঞতাকে বাস্তব বলে স্বীকার করে প্রত্যক্ষকে অন্তত একটা আপেক্ষিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ভূতবাদী (যারা প্রত্যক্ষ জীবন ও জীবিতকেই স্বীকার করে, আত্মাকে নয়), পরমাণুবাদী (বৈশেষিক, যারা পরমাণুকে সৃষ্টির সূক্ষ্মতম উপাদান বলে), লোকায়ত, সাংখ্য ও ন্যায়-প্রস্থান সকলেই প্রত্যক্ষকে অবিসংবাদিত সত্তা বলে স্বীকার করে। বেদের যুগে দৃশ্য বা দৃষ্ট বস্তু নিয়ে কারও কোনও সংশয় ছিল না। যা অতীতে ঘটেছে বলে মনে করা হত, অর্থাৎ প্রত্যক্ষের অগোচরে, সেই সব ব্যাপার নিয়ে সংশয় ছিল, যেমন বিশ্বসৃষ্টি বা দেবতাদের উৎপত্তি।

এ ছাড়া সংশয় ছিল যজ্ঞ নিয়ে; কোন্ যজ্ঞে কী ফল পাওয়ার কথা তা বলাই ছিল। যজ্ঞ করেও প্রত্যাশিত ফল না পেলে স্বভাবতই সংশয় জাগে যজ্ঞের প্রক্রিয়া, দেবতাদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা, দেবতাদের যজ্ঞফল দেওয়ার ক্ষমতা, ইচ্ছা এবং শেষত, তাঁদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও। অবশ্যই, কাকতালীয় হিসেবে কিছু কিছু যজ্ঞের ফল পাওয়া যেত। কাজেই এ নিয়ে সংশয় ব্যাপক, গভীর বা সার্বত্রিক হতে পারত না। তবু যত দিন যাচ্ছিল তত নিষ্ফল যজ্ঞের সংখ্যা বাড়ছিল এবং সংশয়ও বাড়ছিল। যজ্ঞে ফল দেওয়ার প্রতিশ্রুতির দায়িত্ব দেবতাদেরই, সেই ভরসাতেই অত স্তোত্র হব্য দিয়ে তাঁদের আরাধনা। ‘ফল না হলে জন্মায় একটা আততি (tension); (সৃষ্ট হয়) দিব্য অঙ্গীকার এবং এর প্রকাশ্য ব্যর্থতা, অন্য আততিটি হল ঈশ্বরের ইচ্ছা, তাঁর দিব্য পথনির্দেশ ও মানবিক স্বাধীনতা। মানুষের বিরুদ্ধাচরণ করবার ক্ষমতা… পরিনির্দিষ্ট ছক ও বিশৃঙ্খলা, দিব্য নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা— এ দুটি দ্বান্দ্বিকতা।[৭] দৈব শৃঙ্খলা, দেবতাদের নিয়ন্ত্রণ এ সব মানতে হলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এ সবের ব্যত্যয়, অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা, নানা ধরনের বিপর্যয় এ সবের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না; ফলে মানুষ সুপরিনির্দিষ্ট দিব্য আকল্পের পৃথিবীতে দেবতাদের প্রতিশ্রুত যজ্ঞফল না পেলে ধাক্কা খায়, তার জানার জগতে এর ব্যাখ্যা মেলে না, তখনই জাগে সংশয়।

শুধু প্রত্যাশিত যজ্ঞফল না পাওয়া নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতায় নানা বিরুদ্ধ, ক্ষতিকর অভিজ্ঞতাও তো আছে: খরা-বন্যা-পঙ্গপাল, ব্যাধি-জরা-মৃত্যু, প্রিয়বিচ্ছেদ, ইষ্টলাভে বঞ্চনা ইত্যাদি বিভিন্ন অপ্রীতিকর তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে মানুষ বুঝে যায় যে, বিশ্ববিধান তার পক্ষে সততই মঙ্গলময় নয়, প্রায়ই দুঃখজনক। দেবতা-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বপ্রকৃতির ওপরে ভরসা রাখা চলে না। ‘প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ যদি সর্বব্যাপী হয়, তা হলে যা কিছু ক্ষতি ও যন্ত্রণা ঘটায় তাকে (এ ভাবে) ব্যাখ্যা করতে হবে যে, সব কিছু জানা থাকলে সেটিকে মানুষের পক্ষে হিতকর বলে মানতে হবে।’ অথচ মানুষের অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে, কাজেই সর্বমঙ্গলময় বিধাতা, বিধাতৃগোষ্ঠী অথবা সর্বমঙ্গলময় বিশ্ববিধান কোনওটাই নিজের উপলব্ধিতে বা বুদ্ধিতে মানুষ পায় না; তাই জাগে সংশয়, যার একটি পরিণতি নাস্তিক্য। সংশয়মাত্রই নাস্তিক্যের জন্ম দেয় না। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বহু মানুষের চেতন ও অবচেতন মনে বহু যজ্ঞের নিষ্ফলতা, বহু সামাজিক বঞ্চনা, দারিদ্র্য, অত্যাচারের পুঞ্জিত স্মৃতি কোনও কোনও চিন্তাশীল মানুষের মনে সৃষ্টি করত সমস্ত বিশ্ববিধান সম্বন্ধে গভীর অবজ্ঞা; বিধাতা বা যজ্ঞে-আরাধ্য দেবদেবীদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে এই ব্যাপক সর্বাত্মক সংশয়ের একটি পরিণতি নাস্তিক্য।

সংশয় ও নাস্তিক্যের অন্তর্বর্তী একটি অবস্থার নাম অজ্ঞেয়বাদ (agnosticism), অর্থাৎ বিধাতা বা দেবদেবীরা আছেন কি না সে-বিষয়ে নিজের জ্ঞানের ও বিশ্বাসের অভাব, এবং জ্ঞানের এই অভাবের প্রকাশ্য স্বীকৃতি: ‘কেউ কোথাও আছেন কি না জানি না, অর্থাৎ থাকতেও পারে, না থাকতেও পারে কিন্তু আমি নিশ্চিত নই।’ এ অবস্থা সংশয়ের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে, কিন্তু পূর্ণ নাস্তিক্য এটা নয়। গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসের ভাষায়: ‘দেবতাদের বিষয়ে আমি জানতে পারি না, তাঁরা আছেন কী নেই, কিংবা কেমন তাঁদের আকৃতি; কারণ জ্ঞানকে প্রতিহত করে অনেকগুলি বিষয়: জ্ঞেয় বিষয়টির দুর্বোধ্যতা এবং মনুষ্যজীবনের স্বল্পায়ুতা।[৯] অজ্ঞেয়বাদের ভিত্তি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। এতে দু-ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে; প্রথমত, নিশ্চিত বিশ্বাসের অভাবে মর্মযন্ত্রণা এক ধরনের আত্মিক নিরালম্বতা; দ্বিতীয়ত, সমস্ত ব্যাপারটা সম্পর্কেই অনীহা ঔদাসীন্য। অর্থাৎ আমি যখন খেয়েপরে ভাল ভাবেই বেঁচে আছি তখন ভগবান থাকুন বা না থাকুন আমার কিছু এসে যায় না। এ ঔদাসীন্য সংশয়ের অন্তরালেও প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে, নাস্তিক্যেও থাকতে পারে। কিন্তু যে-মানুষ জীবনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে গভীর ভাবে দ্বিধাগ্রস্ত এবং এ দ্বিধায় যার মর্মযন্ত্রণা আছে তার পক্ষে ঔদাস্য তো সম্ভব নয়, তার পক্ষে এ-সিদ্ধান্ত জীবনমরণের সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। তবে সংশয়, অজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিক্য এ তিনটির ভিত্তিভূমি শুধু জ্ঞান নয়, বিশ্বাসও, যেটি উপলব্ধির স্তরে অনুভূতির প্রান্তবর্তী। এবং জ্ঞান ও বিশ্বাসের দুইয়েরই সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। এবং ঠিক এই কারণেই এই পুরো ব্যাপারটাই জীবনের গভীরতম অংশ থেকে উদ্ভুত, এবং মর্মের স্পর্শকাতর তন্তুগুলিতে প্রবল যন্ত্রণার স্পন্দন তোলে। বেঁচে থাকার মানে কী, এ নিয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর সর্বদেশে সর্বকালে মানুষ তীব্র ভাবে অনুসন্ধিৎসু। এ সন্ধান শুধু বুদ্ধিগত হলে তা এমন মর্মন্তুদ হত না, শুধু আবেগনির্ভর হলেও হত না, কিন্তু যেহেতু আবেগ এবং মনন এতে সমান ভাবে সম্পৃক্ত, তাই এ ব্যাপারটা সম্পর্কে মানুষের প্রতিক্রিয়া এত জরুরি। আবেগ (emotion), মনন (intellection) এ দুটিই তো ইচ্ছাশক্তি (volition)-কে প্রণোদিত করে, অর্থাৎ মানুষ তার সত্তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় যে-গভীর স্তর থেকে সেখানে সে হয় বিশ্বাসী, নয় অজ্ঞেয়বাদী, নয় নাস্তিক। এবং এ তিনটি বিকল্পই নিরূপণ করে তার বেঁচে থাকার অর্থের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মপন্থা কী। যজ্ঞের যুগে তার জীবনের সমস্ত সংঘাতের, অভাবের, অভিযোগের প্রতিকার চাইবার জায়গা ছিল দেবতাদের অনুগ্রহ এবং সেখানে পৌঁছোবার পথ ছিল যজ্ঞ।

শাস্ত্রে সংশয়

যজ্ঞের যুগের শাস্ত্র রচনার শেষ পর্যায়ে আর্যাবর্তে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। শাস্ত্রগুলি রচিত হচ্ছিল আর্যাবর্তে, গঙ্গার উত্তরে হস্তিনাপুরে। সেখানে কৌরব রাজা নিচক্ষুর আমলে একটি প্রকাণ্ড প্লাবনে আর্যাবর্তের অনেক অংশই বিধ্বস্ত হয়ে যায় খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে। সেই সময়ে যজ্ঞ-সম্পর্কিত শাস্ত্র অর্থাৎ ব্রাহ্মণ এবং সংহিতার শেষাংশ রচিত হচ্ছিল। ওই সময়ে রাজধানী হস্তিনাপুর থেকে যমুনার পারে কৌশাম্বীতে সরিয়ে আনা হয়। ‘এ ঘটনার পরে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রের সৃষ্টিশীল পর্যায়ের যেন অবসান ঘটে; (এর পরেও) আচার্য পরম্পরার নাম পাওয়া যায় এবং নিশ্চয়ই কিছু কিছু বৈদিক শাস্ত্রাংশের পুনরনুশীলন চলছিল… কিছু স্বতন্ত্র রচনা যেন নিবদ্ধ রইল গৌণ শাস্ত্রচর্চায়, যজ্ঞকর্ম, অর্থশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, জ্যোতিষ ও জ্যামিতিতে।’[১০] এর অর্থ, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের মধ্যেই যজ্ঞতত্ত্ব পরিনিষ্ঠিত হয়ে যায়, খুব বড় রকমের কোনও পরিবর্তন আর ঘটেনি। ছোট ছোট যজ্ঞের অঙ্গে সামান্য আঞ্চলিক পরিবর্তন ঘটে থাকতে পারে। কিছু কিছু ছোট যজ্ঞ উদ্ভাবিতও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সমস্ত গোষ্ঠীর পক্ষে অনুষ্ঠিত যে সব বৃহৎ শ্রৌতযাগ, রাজসূয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ, অগ্নিচয়ন, সত্র— এগুলি এর আগেই তাদের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক রূপ ও হোতার আবৃত্তি, উদ্‌গাতার গান এবং অধ্বর্যুর উপাংশু (মৃদু স্তরে) আবৃত্তির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল। তার অর্থ, এর পরে যে সব যজ্ঞের অনুষ্ঠান হচ্ছিল সাধারণ মানুষ তার সঙ্গে সুপরিচিত ছিল। এর ফলে মানুষ একটু দূর থেকে মিলিয়ে দেখতে লাগল যজ্ঞ থেকে যে-ফল পাওয়ার কথা তা পাওয়া যায় কি না। যখন হিসেব মিলছিল না তখন নানা ভাবে নানা সংশয় মানুষের মনে উদ্রিক্ত হচ্ছিল এবং তৎকালীন ও তার পরবর্তী শাস্ত্রে— সংহিতা ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে— উচ্চারিত হয়ে স্থায়ী ভাবে বিধৃত রইল।

পরের যুগে জ্ঞানকাণ্ডে, আরণ্যক উপনিষদে পূর্বতন সংশয়ের উত্তর আর মিলল না, বরং যজ্ঞ তখন ব্যাপক ভাবে অনুষ্ঠিত হলেও ক্রমশ যেন গৌণ একটি ধর্মক্রিয়ায় পর্যবসিত হল এবং আত্মব্রহ্মতত্ত্ব নিয়ে চর্চাই হয়ে উঠল মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। এ পর্যায়ে পরিবর্তিত সমাজজীবনের দ্বারা প্রভাবিত মননজগতে যে সব নতুন সমস্যার উদয় হল, তার মধ্যে জন্ম নিল নবতর সংশয়। এগুলির সঙ্গে পূর্বতন সংশয়ের অনেক পার্থক্য চোখে পড়ে। বিশেষ কোনও দেবতা, তার উদ্ভব, আচরণ, ক্ষমতা, অভিপ্রায় বা যজ্ঞকর্ম ও তার যাথাযথ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন আর তেমন নেই। তার বদলে এবং বিশ্বচরাচর মানুষের শরীর, ইন্দ্রিয়, মন এবং এগুলির সঙ্গে বহির্জগতের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন অনেক বেশি। তা ছাড়া— নতুন কিছু সংশয় আসে আত্মা ও ব্রহ্ম এবং তাদের সম্পর্ক নিয়ে, মরণোত্তর অবস্থান নিয়ে (অবশ্য এ বিষয়ে কিছু সংশয় আগেও দেখা গেছে)। এখন সমাজপতি, শাস্ত্রকার ও পুরোহিতদের সমবেত চেষ্টায় মানুষের জীবনদর্শন ও ধর্মাচরণের লক্ষ্য একেবারে বদলে যায়: পরলোকের অস্তিত্ব এখন স্বীকৃত, অর্থাৎ সাধারণ মানুষ জানে মৃত্যুতেই সব শেষ হয় না, আত্মা থাকে, অতএব পরলোক আছে, স্বর্গ, নরক ও পুনর্জন্ম আছে। স্বভাবতই এখনকার প্রশ্ন মুখ্যত এইগুলি নিয়েই। এই সব উপাত্ত নিয়ে যে-বিশ্ববিধান লোকের মনে দেখা দিল, এ পর্যায়ের প্রশ্নগুলি সেই নিয়ে এবং সে-বিশ্ববিধানের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার বস্তুনিচয়— শরীর, মন, প্রাণ ইন্দ্রিয়, পঞ্চভূত ও বহির্বিশ্ব, ইত্যাদির সম্পর্ক নিয়ে।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে একাধিকবার পড়ি, ‘মৃত্যুর পর চেতনা নেই সে কথা বলছি’ এমন বলেন যাজ্ঞবল্ক্য।’[১১] এটি সংশয়ের উক্তি নয়, নাস্তিক্যের; কঠোপনিষদে নাস্তিকের একটি সংজ্ঞা হল, যে পরলোকে বিশ্বাস করে না সে নাস্তিক। এখন উপনিষদের বিশিষ্ট তত্ত্বগুলির এক মুখ্য প্রবক্তা হলেন যাজ্ঞবল্ক্য। তিনি স্বয়ং বলছেন, মৃত্যুর পরে আর জ্ঞান থাকে না। জ্ঞানই যদি না থাকে তো আত্মা থাকলেও তেমন আত্মা সুখ-দুঃখের অনুভবের বাইরে। কাজেই স্বর্গনরকও তেমন আত্মার পক্ষে নিষ্ফল, পুনর্জন্মও সেই কারণে নিরর্থক। অথচ এই যাজ্ঞবল্ক্যই বৃহদারণ্যক উপনিষদেই একটির পর একটি উপমা সাজিয়ে আত্মার দেহ থেকে দেহান্তরে পরিক্রমা বর্ণনা করেছেন, নানা ভাবে আত্মব্রহ্ম-তত্ত্ব প্রতিপাদন করতে চেয়েছেন। আবার তিনিই বলছেন, মৃত্যুর পরে চেতনা থাকে না। এই যাজ্ঞবল্ক্যই (এমন মতও অবশ্য আছে যে, একাধিক যাজ্ঞবল্ক্য ছিলেন, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন মতের প্রবক্তা) শতপথব্রাহ্মণে অনেক কারণ দেখিয়ে গোমাংসভক্ষণ নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন, এবং বলেই প্রায় এক নিশ্বাসেই বলেছেন, ‘আমি কিন্তু খাব যদি রান্নাটা ভাল হয়’। ইনি ব্রহ্মোদ্যে ব্রহ্মোদ্যে আত্মব্রহ্ম-তত্ত্ব নিয়ে বহু পণ্ডিত ও জিজ্ঞাসুর সঙ্গে তর্ক করেছেন, দৃশ্যমান জগৎ মায়াস্বরূপ ঘোষণা করেছেন, আবার জনকের সভায় উপস্থিত হলে রাজা যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, ‘কী মনে করে ঠাকুর, ব্রহ্মজ্ঞান না গোধনের জন্যে এসেছেন?’ তখন অসংকোচেই বলেছেন, দুটোরই জন্যে, মহারাজ।’ জনক ব্রহ্মিষ্ঠের (ব্রহ্মজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের) পুরস্কার হিসেবে যে বহুসংখ্যক সোনায়-মোড়া শিং গাভি সাজিয়ে রেখেছিলেন, যাজ্ঞবল্ক্য বিনা ব্রহ্ম-সম্বন্ধীয় পরিতর্কে ওই গাভিগুলি নিয়ে বাড়ি চললেন। সমবেত পণ্ডিতরা প্রশ্ন করলে বললেন, ‘যিনি ব্রহ্মিষ্ঠ তাঁকে আমরা নমস্কার করি, কিন্তু আমরা এখন এখানে সকলে গাভীর কামনায় এসেছি।’ কথাটা সত্যও ছিল, তাই প্রতিপক্ষ তেমন আপত্তিও করেনি, তবু তর্ক হয়েছিল।

যাজ্ঞবল্ক্য সম্বন্ধে এত কথা বলার কারণ উপনিষদের বিশিষ্ট আত্ম-ব্রহ্মতত্ত্বের তিনিই মুখ্য প্রবক্তা, তা সত্ত্বেও ঐহিক প্রয়োজন— গাভি অর্থাৎ বিত্ত সম্বন্ধে তাঁর কোনও ঔদাসীন্য নেই। জনকের কাছে তিনি ব্রহ্মজিজ্ঞাসুও বটে আবার গোধনপ্রার্থীও বটে, গোমাংসভক্ষণ সমাজে নিষেধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, ‘আমি কিন্তু খাব’। অর্থাৎ তত্ত্ব ও ব্যবহারিক জীবনে অসংগতি তাঁকে পীড়া দেয় না। তাই উপনিষদের আত্ম-ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিপাদন করেও বলেন, মৃত্যুর পরে চেতনা থাকে না। বলছেন দ্বিধাহীন প্রত্যয়ের স্বরে, ঘোষণার ভাষায়। এই উক্তিতে আত্মা পরলোক জন্মান্তরের সযত্ন রচিত ইমারত যে বিধ্বস্ত হয়ে যায় তা কি তিনি জানেন না? জানেন, কিন্তু তবু যে বলছেন এটা তাঁর তত্ত্ব নয়, উপলব্ধি বা মননজাত তত্ত্ব, একে তিনি অস্বীকার করেন কী করে? মরণোত্তর আত্মার সংজ্ঞা তাঁর যুক্তিবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, তাই দৃঢ়স্বরে তা অস্বীকার করলেন। সমাজের বহু মনীষীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই এই রকম ছিল: কোথাও প্রত্যয়, কোথাও সংশয়, কোথাও স্পষ্ট নাস্তিক্য।

শুধু বৃহদারণ্যক উপনিষদেই নয়, সব-কটি উপনিষদ মিলেও একটি সুসংহত দর্শন একেবারেই পাওয়া যায় না। ‘উপনিষদগুলি স্বতন্ত্র ভাবে অথবা সমগ্র ভাবে কোনও সম্পূর্ণ, সংহত কিংবা যুক্তিপূর্ণ ভাবে সংগঠিত বিশ্বতত্ত্ব উপস্থিত করে না।[১২] একটু ভাবলেই বোঝা যায় উত্তর ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে, প্রায় দু-আড়াইশো বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে, কালে, বিভিন্ন মনীষীর চিন্তার সংকলন এই উপনিষৎ সাহিত্য; ফলে এর মধ্যে যুক্তির সংহতি খোঁজা বাতুলতা। যে যার অভিজ্ঞতা অকুণ্ঠ ভাবে ব্যক্ত করে গেছেন। তাঁরা অধিকাংশই আচার্য ও শিক্ষার্থী; তাঁরা জানতেনও না যে তাঁরা উপনিষদ রচনা করছেন এবং তামাতুলসী গঙ্গাজল ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞাও করেননি যে, নতুন একটি দর্শনপ্রস্থান তাঁরা সৃষ্টি করতে বসেছেন। ফলে বহু পরস্পরবিরোধী উক্তির সমাহার এর মধ্যে রয়ে গেছে। দেশে চিন্তার জগতে আত্মা, পরলোক ও জন্মান্তরকে অবলম্বন করে যে নতুন হাওয়া বইছিল তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এঁরা প্রত্যেকে নিজের উপলব্ধি ও মনন গ্রন্থনা করে রেখে গেছেন। তাতে সৌষম্য ও সংহতি বজায় রইল কি না সেটা লক্ষ্য করার দায়ও তাদের ছিল না, কারণ খুব সম্ভব তাঁদের সকলে পরস্পরকে চিনতেনও না। যজ্ঞ থেকে মানুষের মন সরে গেছে, এমনই একটা পরিবেশে মনীষীরা সমাজে সংহতি রক্ষার জন্যে যজ্ঞের একটা বিকল্প নির্মাণ করছিলেন।

যুক্তির কাঠামো গড়ে উঠেছিল প্রায় দেড় হাজার বছর পরে শংকরাচার্যের হাতে। উপনিষদে যা পাই তা তত্ত্বের দিকে শিথিল, পরস্পর-অসংলগ্ন, কখনও-বা পরস্পরবিরোধীও। তাই তখন যাঁরা জীবন সম্বন্ধে প্রশ্ন করছেন তখন সে-প্রশ্নগুলিও কোনও স্পষ্ট বিষয়কে অবলম্বন করে উদিত হয়নি, ফলে সমগ্র উপনিষদে তত্ত্বের দিকে নানা অসংগতি রয়ে গেছে এবং এইটেই স্বাভাবিক। নানা বিষয়ে নানা অঞ্চলে ও সময়ে বিভিন্ন লোকের মনে নানা সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। এগুলি পরস্পর-অসম্পৃক্ত, একই ধরনের প্রশ্ন বারে বারে উচ্চারিত হয়েছে। এই প্রশ্নের মধ্যে যেগুলি যজ্ঞ বা যজ্ঞীয় দেবতা সম্পর্কে নয়, সেগুলি এই বিশেষ যুগের চিন্তাধারা থেকে উদ্ভুত, জ্ঞানকাণ্ডের নিজস্ব চরিত্র সেগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ সবের মধ্যে যা বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় তা হল, প্রশ্নের বৈচিত্র্য, সংখ্যা ও কৌতূহলের ব্যাপক বিস্তার। সংশয় শুধু একটি স্বাভাবিক মননপ্রক্রিয়াই নয়; সংশয়, অবিশ্বাস ও নাস্তিক্য মানুষের জীবনে একটি যন্ত্রণার অভিজ্ঞতাও বটে। যখন কোনও সংশয় থাকে না, নিজের দেহমন ও বহির্জগৎ সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট সর্বজনস্বীকৃত ছক মানুষ মেনে নিতে পারে তখন সে-অবস্থাটা মানুষের মানসিক শান্তি ও স্থৈর্যের অনুকূল, জীবন সম্বন্ধে একটা আশ্বাস ও স্বস্তি খুবই আরামের অবস্থা। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাওই সম্ভবত সামগ্রিক ভাবে এ-অবস্থা সত্য ছিল না; কিছু সজাগ মনের মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, সে সব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মেলেনি, ফলে অনুত্তরিত প্রশ্ন যন্ত্রণা দিয়েছে সংশয়ে, বিশ্বাসহানিতে, নাস্তিক্যে।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে ইহুদি ধর্মের সৃষ্টিশীল পর্বের অবসান ঘটে। এই সময়ে নানা সংশয়, প্রশ্ন উচ্চারণ করেন মনীষীরা। এজরা ও নেহেমায়াহ এঁদের অন্যতম। এজরা ভগবানকে অনুযোগ জানিয়েছেন, ‘তুমি কাউকেই দেখিয়ে দাওনি তোমার আচরণ কেমন করে বুঝতে হয়।’[১৩] যাঁর আচরণই দুর্বোধ্য, হীনবল ক্ষীণবুদ্ধি মানুষ যদি তা অবধারণ না করতে পারে তবে তা নিয়ে মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। যে-ঈশ্বর মানুষের সৃষ্টিকর্তা বিশ্ববিধানের নিয়ন্তা, তিনি মানুষকে এনে ফেলে রেখেছেন এমন এক পৃথিবীতে যেখানে কেন কখন কী ঘটে তা মানুষের বোধের অতীত। অথচ মানুষ বুঝতে চায় ও বারে বারে অন্ধগলিতে মাথা ঠুকে মরে। তাই এই অনুযোগ, কেন মানুষকে বুঝিয়ে দিলে না কোনও দিন, এই ভুবন যে-নিয়মে চলে তার প্রকৃতি কী? মানুষ বুঝতে চাইছে, পারছে না; কারণ তুমি দুর্বোধ্য আচরণও করবে আর সে-নিয়ে মানুষের মনে বহুবিধ প্রশ্ন যখন উদিত হবে তখন তুমি তাকে কিছুই বুঝিয়ে দেবে না— কী হয়, কেমন করে হয়, তা কেন তেমন ভাবে ঘটে? চারিদিকে তাকিয়ে মানুষ কোথাও তার সংশয়ের সমাধান খুঁজে পায় না। এমন বোধাতীত ভুবন-ব্যবস্থায় মানুষ কী রকম অসহায় এবং মনের জগতে কী পরিমাণ পীড়িত ও বিধ্বস্ত তা কি তুমি জান না? এ যেন ‘আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে/আমায় বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে’। এজরার অনুযোগ আরও গভীর, এমনই দুর্বোধ্য বিশ্ববিধানের মধ্যে যদি আমাকে ফেলে রেখে দেবে, তা হলে, স্রষ্টা, আমাকে এমন করে সৃষ্টি করনি কেন যেন আমার মধ্যে কোনও প্রশ্ন না জাগে? ‘প্রভু আমার, আমি তোমাকে মিনতি করছি (জানবার জন্যে), কেন তুমি আমার মধ্যে বোধশক্তি দিয়েছিলে?’[১৪] এই মর্মযন্ত্রণা থেকে বেদের মনীষীরাও প্রশ্ন করছেন এবং অনুরূপ নিরুত্তর স্তব্ধতার সম্মুখীন হয়েছেন।

সর্বত্রই প্রশ্ন, সংশয়, নিরীশ্বরবাদ, অজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিক্য সমাজবিধায়কদের উষ্মার উদ্রেক করেছে। কেন? কারণ তাঁরা ভেবেচিন্তে যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন জীবনের, বিশ্ববিধানের, প্রকৃতির, মানবেদেহের এবং যে বিধান দিয়েছেন মানুষের সম্ভাব্য বিপদ-আপদের থেকে মুক্তির জন্যে, যে-পন্থার নির্দেশ দিয়েছেন প্রকৃতিকে নিজের অনুকূলে এনে সুস্থ, সুখী, দীর্ঘজীবন লাভ করবার জন্য, মানুষের সংশয় স্পষ্ট উচ্চারিত হলে সে-বিধানের ভিত টলে যায়। পরবর্তীকালে, যখন সমাজে যজ্ঞানুষ্ঠান চললেও বহু মানুষের মনে যজ্ঞ সম্বন্ধে অনীহা দেখা দিয়েছে তখন সমাজে তৎকালীন শাস্ত্রকাররা অন্য কিছু তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছেন। সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের পক্ষে এই নতুন তত্ত্বগুলি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। দেখতে পাচ্ছি রাজা, রাজন্য, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, জিজ্ঞাসু ব্রহ্মচারী ও অন্যান্য কিছু ব্রহ্মসন্ধানী ব্যক্তিই এই নতুন তত্ত্বগুলি সম্বন্ধে আগ্রহী। এই কালপর্বে সংশয় উচ্চারণ করেছেন এঁরাই, সমাধান দেওয়ার চেষ্টাও করেছেন এঁরাই, তবে প্রায়ই প্রশ্নের সঙ্গে সমাধানের কোনও সংগতি থাকেনি। প্রশ্নকর্তারা কখনও-বা ব্যক্তিগত প্রশ্ন ছাড়াও জনমানসে সঞ্চরমাণ অন্য প্রশ্নও উচ্চারণ করেছেন। এঁদের মধ্যে সমাজের বঞ্চিত শ্রমিকরাও আছেন, তাঁরা নিজেরা যে-প্রশ্ন করলে ওপরমহলে উত্তর দেওয়ার কোনও তাগিদ থাকত না, সেই প্রশ্নই কখনও কখনও অন্যান্য মনীষীরা করেছেন। যেমন নচিকেতা। উত্তর বা সমাধান বহু ক্ষেত্রেই সমাজের সুবিধাভোগী, বিত্তবান শ্রেণির স্বার্থের অনুকূলে; যেমন জন্মান্তরবাদ। যে-মানুষ দুঃখে, অভাবে, অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ইহজীবন যাপন করে গেল, তার পক্ষে জন্মান্তর তো অভিশাপ। যতই তাকে বোঝানো হোক, এ জন্মে শাস্ত্র-অনুমোদিত ধর্মাচরণ করলে পরজন্মে সুখী জীবন পাওয়া যাবেই। তবু তার এ সংশয় ঘোচে না যে, পরজন্ম এ জন্মেরই পুনরাবৃত্তি হতে পারে, এবং সে-সম্ভাবনা তার পক্ষে ভয়াবহ আতঙ্কের। তা ছাড়া পরজন্মের অস্তিত্বটা তো সংশয়িত। এদের হয়ে কেউ কেউ বলেছেন, ‘এ জন্ম থেকে পরজন্মে যাওয়ার কোনও পথ নেই’, কিংবা ‘মৃত্যুর পরে কোনও চেতনা থাকে না’। এ সব সংশয় সমাজের বিধায়কদের পক্ষে অত্যন্ত অস্বস্তিকর এবং অপমানকর: তাঁরা যে-বিধান ও যে-সমাধান দিয়েছেন, সংশয়ী তা মেনে নিচ্ছে না, অতএব সে পাপী। সমাজের প্রত্যন্ত দেশে তখন বহু নামে যজ্ঞবিরোধী, বেদবিরোধী নানা প্রস্থানের উদয় হয়েছে, তারা বেদ ও যজ্ঞ বাদ দিয়েও দিব্যি আছে। যেহেতু যজ্ঞকারীদের তারা উপেক্ষা করেছে, তাই সমাজও তাদের নিন্দা করেছে।

লোকায়ত সংশয়

তখনকার সমাজের বোধহয় সবচেয়ে বড় নিন্দাসূচক শব্দই ছিল ‘নাস্তিক’। নাস্তিক বেদ স্বীকার করে না, পরলোক ও পুনর্জন্ম স্বীকার করে না এবং কেউ কেউ আত্মাও স্বীকার করে না। এই শেষোক্তারা চার্বাকপন্থী, এরা বলত, ‘ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ’। অর্থাৎ স্বর্গ নেই, মোক্ষ নেই এবং পরলোকে কোনও আত্মা নেই। উপনিষদে ক্ষীণ ভাবে মোক্ষের কথা আছে, কিন্তু স্বর্গ আত্মা এবং পরলোকের কথা সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে আছে; অতএব বেদের কিছু মৌলিক তত্ত্বকে এরা অস্বীকার করল। যারা এ সব বিশ্বাস করে তাদের সম্বন্ধে এরা বলল, তারা ‘বুদ্ধিপৌরুষহীন’, অর্থাৎ তারা নির্বুদ্ধি এবং নিষ্পৌরুষ অর্থাৎ কাপুরুষ। কাপুরুষ বা নির্বুদ্ধি কেন? কারণ তারা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পারে না বলেই শাস্ত্রকাররা জীবন সম্বন্ধে যা তাদের বুঝিয়েছেন তাই তাঁরা মেনে নিয়েছে। শুধু চার্বাক নয়, বার্হস্পত্য, জৈন, বৌদ্ধ এবং আজীবিকরাও বেদের বহু মৌলিক তত্ত্বকে সম্পূর্ণ ভাবে পরিহার করে নিজস্ব মতামত উপস্থাপিত করেছেন। যজ্ঞের উপযোগিতা এঁরা কেউই মানেননি, এবং বেদ মূলত যজ্ঞনির্ভর। মুণ্ডক উপনিষদেই একবার মাত্র স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করা হয়েছে যে যজ্ঞগুলি অদৃঢ় নৌকো, পারে নিয়ে যাওয়ার শক্তি তাদের নেই। এ ছাড়া পুরো জ্ঞানকাণ্ডে কিন্তু ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে, সমাজে যজ্ঞ চলছে এবং চলবে। তারই মধ্যে এক বিরুদ্ধশক্তি নানা নামে, নানা প্রস্থানে চিহ্নিত হয়ে সমাজে বিদ্যমান। কৌতুকের বিষয় হল, অবৈদিক প্রস্থানগুলিকে পরবর্তী সাহিত্যে সাধারণ ভাবে লোকায়ত বলা হয়েছে। লোকায়ত শব্দের অভিধানগত অর্থ, ‘লোকে আয়ত’ অর্থাৎ যা সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিব্যাপ্ত। যজ্ঞের পরে ফলের অপ্রাপ্তি যজ্ঞযুগে সংশয়ের সবচেয়ে বড় ভিত্তি রচনা করেছিল। তারই সঙ্গে সঙ্গে চক্ষুষ্মান মানুষের অভিজ্ঞতা যখন তার অন্তর্নিহিত ন্যায়ের বোধের বিপরীত হয়, যখন সে দেখে দুর্জনের প্রতিপত্তি বাড়ছে, সজ্জন দু’ বেলা অন্নসংস্থান করতে পারছে না, যে-মানুষ বিবেকবান, সৎ-কর্মচারী, সে নিরন্তর দুঃখই পাচ্ছে, তখন তার জীবন ও ন্যায়বিচার সম্বন্ধে এবং পূর্বতন ‘ঋত’র বোধের সম্বন্ধে অন্তর্নিহিত প্রত্যাশা গুরুতর ধাক্কা খায়; দেখা দেয় সংশয়। লোকায়ত চার্বাকমত যজ্ঞ, আত্মা, দেবদেবী, স্বর্গনরক, পরলোক ও জন্মান্তর স্বীকার করে না, বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করে না। এই মত ও বিশ্বাস লোকে আয়ত বা সমাজে গণমানসে বিস্তৃত ছিল?

এটা স্বীকার করলে বোঝা যায়, শাস্ত্র লোকায়ত মত সম্বন্ধে কেন এত অসহিষ্ণু, কেন চার্বাককে মহাভারত-এ (ও পরে বেণীসংহার নাটকেও) রাক্ষস বলা হয়েছে। দুর্যোধনের বন্ধু বলা হয়েছে। কেন ‘ধার্মিক’ ব্রাহ্মণেরা তাকে তাড়া করে বধ করে। লোকায়তিক চার্বাক তা হলে সেই সব কথাই বলেছেন যা জনসাধারণের মনে সন্দেহের আকারে ছিল; তাঁর ভাষায় তা প্রত্যয়ের রূপে প্রকাশিত হল। বোঝা যায় কেন পরস্পরবিরোধী দর্শনপ্রস্থানও (যেমন মীমাংসা, যার অপর নাম পূর্বমীমাংসা এবং বেদান্ত, যার প্রতিশব্দ উত্তরমীমাংসা) এবং সব-কটি দর্শনগ্রন্থই চার্বাক মত আগে খণ্ডন করে পরে নিজ মত প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর থেকে সূচিত হয় যে, চার্বাক মত আসলে শুধু জনপ্রিয়ই ছিল না; সমাজে এ মতের বহু অনুগামী ছিল, তাই প্রয়োজন হয়েছিল সে-মতকে খণ্ডন করার— যাতে তার প্রসার রোধ করা যায়। মানুষ যখন তার অভিজ্ঞতায় ও মননে স্বর্গনরক, দেবদেবী, আত্মা, পরলোকের অস্তিত্বের কোনও নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ না পেয়ে সন্দিগ্ধ হয়, তখন বেদে নির্দেশিত তত্ত্বগুলিতে সে আর বিশ্বাস রাখতে পারে না। তখনই তার ওপরে নেমে আসে শাস্ত্রকারদের অজস্র কটুবাক্য এবং অভিসম্পাত। জনসাধারণ্যে যখন এ সব সন্দেহ— যার অন্তিম রূপটি হল নাস্তিক্য— প্রসার লাভ করছিল তখন তাকে ‘লোকায়ত’ বলে গাল দেওয়া ছাড়া শাস্ত্রকারদের গত্যন্তর ছিল না। লোকে, লোকমানসে এর বিস্তার ছিল বলেই লোকায়তের সম্বন্ধে আতঙ্কটি এত বাস্তব, এবং তাই এত অসহিষ্ণুতা।

মহাভারত-এর শান্তিপর্বে একটি উপাখ্যানে পড়ি

এক ধনী বণিক রথে চড়ে যাচ্ছিলেন, পথে এক ব্রাহ্মণ চাপা পড়েন; ব্রাহ্মণটি আত্মহত্যা করতে উদ্যত হলে এক শৃগাল তাঁকে নিবৃত্ত করে বলে যে, ‘আত্মহত্যা নাস্তিকোচিত কাজ, এটা করা ঠিক নয়। গতজন্মে সে নিজে নিরর্থক আন্বীক্ষিকী ও তর্কবিদ্যায় অনুরক্ত ছিল, হৈতুক অর্থাৎ যুক্তি দিয়ে সব কিছুর হেতু নির্ণয় করতে চেষ্টা করত, বেদনিন্দক ও নাস্তিক ছিল, তাই এজন্মে শৃগাল হয়েছে।’

এখানে লক্ষ্যণীয় তর্ক, আন্বীক্ষিকী (যুক্তিবিদ্যা) ও নাস্তিকতা এক নিশ্বাসে উচ্চারিত; এগুলি গর্হিত পাপ, যার ফলে বক্তার শৃগালজন্ম হয়েছে। এখানে পুরোহিততন্ত্রের ও শাস্ত্রকারদের উষ্মা যুক্তিবাদের ওপরে— বেদের নিন্দা, নাস্তিকতা, হেতুবাদিত্বের ওপরে। অর্থাৎ পরিষ্কার দুটি বিকল্প: এক দিকে বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে শাস্ত্রকার পুরোহিতদের নির্দেশ মতো যজ্ঞ করা, দেবদেবী, আত্মা, পরলোক, স্বর্গনরক, জন্মান্তরে চোখ বুজে বিশ্বাস করা; অন্য দিকে এ সব সম্বন্ধে মনে সন্দেহের উদয় হলে যুক্তিতর্ক দিয়ে ব্যাপারটা যুক্তিগ্রাহ্য কি না, অর্থাৎ বিশ্বসনীয় কি না বুঝে দেখার চেষ্টা করা এবং যদি যুক্তিতর্কে তার যাথার্থ্য সম্বন্ধে নিশ্চয়তা না মেলে, তবে খোলাখুলি তাকে স্বীকার করা এবং বিশ্বাসের বদলে সংশয় পোষণ করা। শৃগালের উপাখ্যানে উল্লিখিত পাপগুলি একই গোত্রের অর্থাৎ চোখ বুজে আপ্তবাক্যে বিশ্বাস না করে সাধারণ বুদ্ধি, যুক্তি, তর্ক, হেতুবিদ্যা (অর্থাৎ কোনও ব্যাপারে কার্যকারণ সম্বন্ধের খোঁজ করা) এ সবের ওপরে ভরসা রাখা। এতে সমাজপতিদের এত উম্মা কেন? বেদনিন্দক, হৈতুক, তৰ্কাশ্রয়ী মানুষ বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার না করে তার নিজস্ব চিন্তা যুক্তিতর্কের ওপরে ভরসা করে চললে শাস্ত্রকাররা সমাজের সংহতির জন্যে যে-ছকটা তৈরি করেছেন সেটা ঝরে পড়বে। এই অবাধ্যতা তো আধ্যাত্মিক স্তরে একটা প্রতিস্পর্ধা এবং জাগতিক স্তরে অসহযোগ, সমাজের ওপরতলার লোকের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব অস্বীকার করা। পৃথিবীতে কোনও সময়ে কোনও সমাজের অধিকর্তারা সাধারণ লোকের আনুগত্যের এই অভাবকে স্বীকার করেননি, উপেক্ষাও করেননি। এখানেও তাই নানা হুমকি, অভিশাপ, পরজন্মে হীন অস্তিত্বের ভয় দেখানো।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-তে তাই সাংখ্য, যোগ ও আন্বীক্ষিকীকে একই পর্যায়ের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মনুতে আন্বীক্ষিকীকে পরিহার করা হয়েছে; দণ্ডনীতি, অর্থনীতি, ত্রয়ী (বেদচর্চা) ও বার্তাকে (কৃষি, ইত্যাদি) স্বীকার করা হয়েছে। শংকরাচার্য মনুকে বারবার উদ্ধৃত করেন এবং সবচেয়ে প্রামাণ্য ধর্মশাস্ত্র বলে প্রয়োজনীয় শাস্ত্র হিসেবে স্বীকার করেন। মনুই প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের নিরিখ নির্মাণ করেছেন। এবং মনুতে যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝবার শাস্ত্রগুলিকে পরিহার করা হয়েছে। যুক্তির চর্চা না থাকলে সমাজে আপ্তবাক্য, বেদ ও ধর্মশাস্ত্রের অনুজ্ঞাই চূড়ান্ত ভাবে প্রামাণ্য বলে স্বীকৃত হবে, অপর পক্ষে যুক্তিতর্ক ও তৎসংশ্লিষ্ট কোনও বিদ্যা বা শাস্ত্রকে স্বীকার করলেই সমূহ বিপদ। তখন মানুষ নিজের দেহমন, বহিঃপ্রকৃতি, বিশ্বচরাচর, যজ্ঞ, এ সবের সমর্থন যখন যুক্তির মধ্যে পায় না এবং সন্দিহান হয়ে ওঠে, এবং প্রকাশ্যে সে সংশয় যখন ঘোষণা করে, তখন সে বৈপ্লবিক সন্দেহ সংক্রামক হয়ে যায়। অন্য লোকের মনে যদি বীজাকারেও কোনও সংশয় চাপা থাকে তখন প্রকাশ্যে অপরের ঘোষিত সংশয়ে সে আপন সন্দেহের সমর্থন পায়; এমনই করে বিস্তার লাভ করে অবিশ্বাস, ফলে সমাজপতিদের সযত্ননির্মিত সংহতি বিপন্ন হয়। ‘বেদের বক্তব্য সম্বন্ধে শাস্ত্রকারদের যথার্থ আগ্রহ নেই। তার পরিবর্তে তাদের উৎসাহ বেদকে একটি রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখায়— যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরলোক ও দেবতার ভয় দেখিয়ে জনসাধারণকে সার্থক ভাবে বশীভূত রাখা যায়; অতএব তাঁরা সদর্পে ঘোষণা করতে পারেন যে, বেদেই সর্বোত্তম প্রজা বিধৃত আছে।’[১৫] কাজেই ব্যাপক সংশয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিপন্ন হতে পারে বলেই বেদের প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠা করা এত জরুরি, এবং পৃথিবীর সমস্ত ধর্মগ্রন্থ সম্বন্ধেই এ কথা প্রযোজ্য। সন্দেহ প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সংহতিকে বিপর্যস্ত করতে পারে বলেই সন্দেহ সম্পর্কে সমাজপতিদের সদাজাগ্রত আশঙ্কা এবং উদগ্র রোষ।

গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজব্যবস্থা ও তার ধর্মাচরণ ভেঙে গেলে নতুন একটি সমাজের গঠনের সূচনাকালে রচয়িতারা বেদের ব্রাহ্মণসাহিত্যে যজ্ঞের সংখ্যা, অনুপুঙ্খ, ব্যাপ্তি, ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপৃত হয়ে পড়লেন; আশঙ্কা ওই একই, সামাজিক সংহতি পাছে নষ্ট হয়। যুক্তির বেশি প্রয়োগ ঘটলে আপ্তবাক্য প্রামাণ্যতা হারায়, সংশয়ের সংখ্যা, গভীরতা ও ব্যাপ্তি বাড়ে। তা বলে সমাজপতিরা কি যুক্তির কোনও ভূমিকাই স্বীকার করেননি? করেছিলেন বই-কি, শাস্ত্রবাক্য যে অভ্রান্ত, মান্য এবং চূড়ান্ত ভাবে প্রামাণ্য, এইটে প্রমাণ করার জন্যে সুদীর্ঘকাল ধরে ব্রাহ্মণসাহিত্য, দর্শনপ্রস্থানগুলি, টীকা, ভাষ্য, ধর্মশাস্ত্র ও নিবন্ধ রচনা হয়েছে। এবং শুধু ভারতবর্ষে নয়, খ্রিস্টান, ইসলাম ও অন্যান্য সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই এ ব্যাপারটা একই ভাবে ঘটেছে।

এত আয়োজন সত্ত্বেও যদি সংশয়ী বলে, ‘তোমরা যা বলছ তা আমার বিশ্বাস হয় না, কে দেখেছে দেবতাদের উৎপত্তি, কে বলেছে যজ্ঞে ফল হয়, কেন মানতে যাব যা দেখতে পাইনে, বুদ্ধিতে যুক্তিতে যার কোনও হদিস মেলে না তাঁকে?’ এ তো সর্বনাশ সমাজের পক্ষে। কাজেই নাস্তিক, বেদনিন্দক, ইহলোকবাদী, লোকায়তিক ভূতবাদ, সাংখ্য, প্রধানবাদ, পরমাণুবাদ ও ন্যায়- এদের যারা স্বীকার করে তারা এবং এদের ভিনদেশি বিকল্পরা সর্বদেশের শাস্ত্রে ধিকৃত। কিন্তু মুশকিল হল, ‘যদি ভারতীয় দর্শনে কোনও কিছু সার্থক ভাবে প্রাগ্রসর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকে তবে তা হল লোকায়ত মত, অর্থাৎ (সেই মত যা বলে) চেতনা, যাকে সাধারণত আত্মা বা মনের বিশিষ্ট লক্ষণ বলা হয়, তা কেবলমাত্র বস্তু থেকেই উদ্ভূত।’[১৬] এই মত ছিল লোকায়ত। লোকে তো জানত যে আত্মা বলে কোনও কিছুকে দেখা যায় না, অতএব সেটা আছে কি না, মৃত্যুর পর থাকবে কি না এ বিষয়ে তা স্বাভাবিক ভাবেই লোকের সন্দেহ হবে। চার্বাক যেমন বলেন, শাক থেকে সুরা হয়, অথচ শাকে সুরার কোনও গুণই নেই; রাসায়নিক প্রক্রিয়াতেই বস্তুর এমন গুণগত আকৃতিগত, প্রকৃতিগত পরিবর্তন হয়; কাজেই শরীরে বিশিষ্ট ধরনের অবয়বসংস্থান ঘটলে আপনিই তার থেকে চেতনার উদ্ভব হয়। যেমন চুন সাদা, হলুদ হলদে রঙের, অথচ এ দুটি মেশালে লাল রং হয়, অথচ লাল রং হলুদেও ছিল না, চুনেও ছিল না। রাসায়নিক প্রক্রিয়াতেই উপাদানে অবিদ্যমান গুণ বা লক্ষণ পরিণত পদার্থে উদ্ভূত হয়। তেমনই করে মানুষের শরীরের ইন্দ্রিয়ের বিশেষ ধরনের সমাবেশ ঘটলে, ইন্দ্রিয়গুলিতে অনুপস্থিত নতুন ব্যাপার, চেতনার উদয় হয়, এই চেতনাতে আছে মনন, ইচ্ছা ও অনুভব। এর বাইরে চেতনার কোনও প্রকাশ লোকায়ত দর্শন মানেনি। এই দিয়েই মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলির ব্যাখ্যা হয়; হয় না শুধু মরণোত্তর আত্মার। সাধারণ মানুষের সে আত্মায় কোনও প্রয়োজনই নেই, এবং যেহেতু ইন্দ্রিয়গুলির কাছে তার কোনও প্রমাণ মেলে না, চিন্তায় কল্পনায় কেউ কেউ তাকে শাস্ত্রকারদের নির্দেশিত রূপে অবধারণ হয়তো করতে পারেন, কিন্তু অধিকাংশ সাধারণ মানুষের এমন আত্মার কোনও প্রয়োজনও নেই এবং দেহবিনিমুক্ত এই অবস্তুকে তারা সম্যকরূপে ধারণাও করতে পারে না, চায়ও না। অতএব একটি লোকায়ত অনাস্থা বৈদিক সমাজে ব্যাপক ভাবেই ছিল।

বিশ্বাসের পরম্পরা

অনাস্থা কীসে? আগেই দেখেছি, বেদের প্রামাণ্যতায়, দেবদেবী, স্বর্গনরক, পরলোক, আত্মা ও জন্মান্তরে। অনাস্থা নেতিবাচক; কিন্তু আস্থা বা বিশ্বাস যে সাধারণ মানুষের এ সব তত্ত্বে কোনও দিন ছিল, তারও তো কোনও প্রমাণ নেই। সেই ঋগ্বেদের আদিপর্বের ঋষিমণ্ডলগুলি (২-৭) থেকেই তো বহু অনাস্থার প্রকাশ রয়েছে। তা হলে সর্বজনীন বা ব্যাপক ভাবে বিশ্বাস কোনও দিন ছিল তা প্রমাণ করা যাবে না, বরং যেটা স্বতঃসিদ্ধ সেটা হল, কিছু মানুষ সর্বদেশে সর্বকালে বিশ্বাস না করে বাঁচতে পারে না; তাদেরকে সমাজপতি ও শাস্ত্রকাররা যা বিশ্বাস করতে বলত তারা তাই বিশ্বাস করত। সম্ভবত এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তাই সমাজে সংহতি রক্ষিত হত, যজ্ঞক্রিয়া সম্পাদিত হত, বিশেষ কোনও বৈপ্লবিক চিন্তা প্রশ্রয় পেত না। এরা সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও আপনিই প্রমাণিত হয় যে, সমাজে সংখ্যালঘু মানুষ অন্য রকম ছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করার দরকারই বোধ করত না; তাদের মননে ও আচরণে এ সব সম্বন্ধে একটা সহজাত ঔদাসীন্য ও অনীহাই ছিল। চিরকালই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের সম্বন্ধেই এ কথা প্রযোজ্য। এদের মধ্যে অধিকাংশই হয়তো সক্রিয় ভাবে যজ্ঞক্রিয়ায় যোগ দিত। কিন্তু সে-ব্যাপারে বিশ্বাসের বদলে যা তাদের প্রণোদিত করত, তা দীর্ঘকালের ঐতিহ্য থেকে সঞ্জাত একটা জড়, অসচেতন অভ্যাস, যেমনটি আজও অধিকাংশ পুজোআচ্চার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সত্য। আর সর্বদেশে সর্বকালে যা সত্য তা হল সমাজে স্বল্পসংখ্যক কিছু মানুষ ছিল যারা বিশ্বাস করতে চাইত, কিন্তু পারত না। এদের চিত্তবৃত্তি অতিশয় জাগ্রত ছিল, তাই যুক্তিতে মননে যাকে সিদ্ধ করতে পারত না তা বিশ্বাসও করতে পারত না। এদের সাধ্য ছিল না মননের সাক্ষ্যের বিরুদ্ধে শুধু চিরাচরিত, ঐতিহ্যগত আপ্তবাক্য বলেই কোনও কিছুর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও সেই অনুসারে আচরণ, অর্থাৎ সচেতন ভাবে, স্বেচ্ছায়, সক্রিয় ভাবে যজ্ঞকর্মে অংশগ্রহণ করার।

আর্যদের যজ্ঞনির্ভর সমাজের বাইরে তখনই ছিল বৃহৎ প্রাগার্য গোষ্ঠী, যাদের ধর্মবিশ্বাস এবং আচরণ ও অনুষ্ঠান অবশ্যই ভিন্ন ছিল। বেদ এদের মধ্যে কাউকে তুচ্ছ করে ‘যতি’ বলেছে এবং খবর দিয়েছে যে দেবশ্রেষ্ঠ ইন্দ্র যতিদের সালাবৃকদের (wolf-hounds?) কাছে সমর্পণ করেছেন। আবার কোনও কোনও অবৈদিক, সম্ভবত প্রাগার্য গোষ্ঠীর সম্বন্ধে তাচ্ছিল্য ভরে বলা হয়েছে যে, তারা শিশুদেব, অর্থাৎ হয়তো একান্ত ভাবে যৌনতাপরায়ণ অথবা লিঙ্গপূজক। এ ছাড়াও নানা রকমের মতবাদ অবশ্যই ছিল কারণ যজুর্বেদের ‘শিবসংকল্পসূত্র’ এবং অথর্ববেদের বহু সূক্তে উল্লেখ পাই ‘যাদের বিশ্বাস ও আচরণ ভিন্ন’। তাই নানা মত ও পথ তখনই সমাজে সহাবস্থান করত, যদিও সম্ভবত, অধিকাংশের না হলেও মুখ্য অংশের ধর্মাচরণ ছিল যজ্ঞকেন্দ্রিক। কিন্তু সমাজের মানুষ যারা কৌতূহলী, স্বাধীনচেতা, নিজের গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও আচরণে অতৃপ্ত তারা সেই অনুসন্ধিৎসা বা নানা ধরনের মত, পথ ও আচরণের যাচাই করত। সমাজে প্রচলিত আপ্তবাক্যনির্ভর ধর্মাচরণে এরা অসহিষ্ণু। এরা সন্দেহ প্রকাশ করত কথায় এবং সম্ভবত আচরণেও। প্রথাসিদ্ধ ধর্মাচরণকে নিয়ে এরা কখনও ব্যঙ্গকৌতুক করেছে, কখনও-বা জিজ্ঞাসু ব্রহ্মচারীর মতো অধিক বিদ্বান বা মনস্বীর কাছে আপন সংশয় ব্যক্ত করে সমাধানের সন্ধান চেয়েছে। তৎকালীন ইতিহাস ও সাহিত্য থেকে যেটা প্রতিপন্ন হয় তা হল, একটি প্রধান মত ও বহুজন-আচরিত একটি ধর্মপন্থা থাকা সত্ত্বেও তখনই সমাজে বহু বিশ্বাসের আকল্প চালু ছিল, এবং কালের গতিতে এ সব আকল্প বহু ধৰ্ম ও দর্শনপ্রস্থানের আকারে নানা বিকল্পের রূপে প্রতিভাত হচ্ছিল। ফলে চোখ বুজে বেদরচয়িতাদের বিশ্বাস মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা অনেকেরই ছিল না। প্ৰতিবাদী বা অবিশ্বাসীকে সব দেশেই চিরকাল সমাজের শক্তিমান গোষ্ঠী অবজ্ঞা করেছে। বাইবেল-এ বারবার বলা হয়েছে, ‘মূঢ় মনে মনে বলেছে ঈশ্বর নেই।’[১৭] ইসলামি ধর্মতত্ত্বে নাস্তিকের পরিণাম খুব যন্ত্রণাময় একটি নরক ‘হাবিয়া দোজখ’-এ। ভারতবর্ষেও বারবারই বলা হয়েছে নাস্তিক, চার্বাকপন্থী, লোকায়ত, বার্হস্পত্যপন্থী, ইত্যাদি মানুষের পরিণতি শোচনীয়। সমাজের শৃঙ্খলা, যজ্ঞনিষ্ঠ ধর্মবোধে যাদের অন্তরাত্মা শান্তি পায়নি, যারা সৃষ্টিতে, বিশ্বচরাচরে এবং সমাজে কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি— শাস্ত্রে তাদের প্রতি অতি পরুষ অভিশাপবাণী উচ্চারিত হয়েছে। তারা প্রকাশ্যে প্রতিরোধী, অন্তরে প্রচ্ছন্ন বিপ্লবী। শাস্ত্রকর্তারা যে-শৃঙ্খলা রচনা করেছেন, তাদের কাছে সেটা শৃঙ্খল বলে প্রতিভাত হয়েছে, কারণ তার মধ্যে কার্যকারণ পরম্পরার শৃঙ্খলা নেই। এই কার্যকারণের সন্ধান করে যে-যুক্তিপ্রস্থান, তা-ই পরবর্তীকালে আন্বীক্ষিকী— তর্কশাস্ত্র বলে অভিহিত হয়েছে এবং এগুলির চর্চাকে শাপশাপান্ত করা হয়েছে।

ধর্মবিশ্বাসের উদ্ভব নিয়ে পণ্ডিতেরা মোটামুটি একমত যে, এর উৎসে আছে ভয় ও বিস্ময়। বিশ্বচরাচরে পূর্বাভাস ছাড়াই বহু বিপদ আসে— ঝড়, বজ্রপাত, খরা, বন্যা, মহামারি, অভাব, অনাহার, ঈতি (শস্যের ক্ষতিকারী ঘটনা), শোক, মৃত্যু এবং বিচ্ছেদ। এ ছাড়াও ছিল হিংস্র শ্বাপদ ও শক্তিমান অত্যাচারী গোষ্ঠী এবং বহু আকস্মিক দুর্বিপাক এগুলির ওপরে মানুষের হাত ছিল না, তাই ভয় জাগত প্রাণে। সে-ভয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই মুখ্যত সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, সর্বশক্তিমান দেবতার কল্পনা। এ ছাড়া ছিল বিস্ময় : ঋতুর নিয়মিত আবর্তন, প্রকৃতির শোভা ও বিস্তার, সূর্য চন্দ্র নক্ষত্র, গিরিনদীসমুদ্রের উদার সৌন্দর্য, আকাশের ব্যাপ্তি, মানবদেহের শোভা– কে এ সব সৃষ্টি করল? যে-ই করে থাকুক সে মহান, শক্তিমান, মঙ্গলময়, শ্রীময়— অতএব নমস্য। এখানে কার্যকারণবোধের কোনও ব্যাপারই নেই; আছে শুধু পৃথিবী ও মানুষের শোভায়, মহিমায় মানুষের মুগ্ধতা। ভয় জাগে মানুষের নিয়ন্ত্রণক্ষমতার বাইরের ঘটনা থেকে— যে-অশুভ ভয়ংকর, ক্ষতিকর শক্তি বিশ্বে, জীবনে ও সমাজে বিদ্যমান, যার কাছে প্রতিনিয়ত পরাজিত হচ্ছে মানুষের সীমিত ক্ষমতা। স্বভাবতই সে-সম্বন্ধে মানুষের মনে একটা প্রবল ত্রাসের সৃষ্টি হয়। এখানেও কার্যকারণ সম্পর্ক মানুষের বোধের সম্পূর্ণ বাইরে থাকে। কেন কী হয়, মানুষ ভেবে পায় না। শাস্ত্রকার সমাধান জুগিয়ে দেন দেবমণ্ডলী নির্মাণ করে; জীবনের সমস্ত বিপদ-বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে তাঁদের শরণাপন্ন হওয়ার যথাবিহিত উপায় নির্দেশ করে। সে-উপায় যজ্ঞ। কেমন করে করতে হবে সে বিষয়েও তাঁরা বিস্তারিত নির্দেশ দেন। কিন্তু সমস্ত বোধের ও বিশ্বাসের জগৎটি নির্মিত হয় কার্যকারণ পরম্পরাকে পরিহার করে। যতক্ষণ এই সব নিয়ে জীবনের অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বাস্তবে এবং/বা কল্পনায় নিস্তার পায়, ততক্ষণ সবই ঠিকঠাক চলে। কিন্তু যখন কারও মনে প্রশ্ন আসে, দেবতারা যে আছেন তার প্রমাণ কী? যজ্ঞে যে ইষ্টফল পাওয়া যায় তা যখন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলছে না তখন তারই বা প্রমাণ কী? যজ্ঞ যে প্রণালীতে অনুষ্ঠিত হয় সেটা যে যথার্থ, অর্থাৎ দেবতাদের প্রীতিজনক, তার প্রমাণ কোথায়? এই অবস্থায় মানুষ না জেনে খোঁজ করে কার্যকারণ সম্পর্কের, এবং এইটিকেই পৃথিবীর সর্বত্রই চিরদিনই অত্যন্ত আপত্তিজনক এবং সমাজের পক্ষে নাশকতামূলক আচরণ বলে মনে করা হয়েছে।

যজ্ঞ এবং বিশ্বাসের আকল্পের অনুপুঙ্খ নিয়ে সন্দেহ থেকে আরম্ভ করে সমস্ত বিশ্বাসের মূল তত্ত্বটি সম্পর্কে সংশয় জাগলে তা নাস্তিক্য বলেই অভিহিত হয়। সংশয়, অজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিক্য একই অভিজ্ঞতার বিভিন্ন মাত্রা ও স্তরে বিন্যস্ত; চূড়ান্ত অবস্থানটি নাস্তিক্য, অর্থাৎ বিশ্বাসের সার্বিক অভাব। কিন্তু ‘যথার্থ ধর্মবিশ্বাসে… সর্বদাই একটি সন্দেহ সংশ্লিষ্ট থাকে।’[১৮]

বিশ্বাসে যেমন সন্দেহ অন্তর্লীন থাকে, তেমনই সন্দেহের অন্তরেও একটি বিশ্বাস থাকে। কবি টেনিসন বলেন, ‘খাঁটি সন্দেহের মধ্যে অনেক বেশি বিশ্বাস থাকে।’[১৯] কী সেই বিশ্বাস? কার্যকারণ-পরম্পরা; আজ এখনও আমরা না বুঝতে পারলেও সেটা যে আছে এমন বিশ্বাস। সন্দেহ ও নাস্তিক্যের ভিত্তিভূমি মানুষের অবচেতনে এই প্রত্যয় যে, সংসারে নিষ্কারণ কিছুই ঘটে না, সব কিছুই কার্যকারণ পরম্পরায় গ্রথিত, তার কতক আমাদের জানা। কিছু-বা অজানা, কিন্তু সত্যকার আকস্মিক বলে কিছুই নেই। কোনও না কোনও দিন সেই সব কারণ জানা যাবে, যা এখনও মানুষের অজানা।

প্রশ্ন ও প্রগতি

এই প্রত্যয় সন্দেহের ভিত্তি বলেই সন্দেহ পৃথিবীর জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণ। আপেল মাটিতে পড়ে কেন, এ প্রশ্ন নিউটনকে যদি বিচলিত না করত তা হলে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কৃতই হত না; জ্ঞানের জগতে অগ্রগতি প্রতিহত হত, ওই সূত্রে গ্রথিত আরও অনেক আবিষ্কারই হতে পারত না। তেমনই, কে দেখেছে ইন্দ্রকে জন্মাতে? এ প্রশ্ন মানুষকে ভাবিয়েছে যে, যেহেতু সব মানুষই একদিন জন্মায় এবং অধিকাংশ দেবতাই যাস্কের মতে মনুষ্যাকৃতি, তাই ইন্দ্রেরও নিশ্চয়ই একদিন জন্ম হয়েছিল, কিন্তু কেউ তো তা দেখেনি। অতএব ইন্দ্রের জন্ম ব্যাপারটাই সংশয়াচ্ছন্ন এবং তার ফলে ইন্দ্রের অস্তিত্বও সংশয়াতীত নয়। নেম ভার্গব বলে: ইন্দ্র নেই। এই উক্তি খণ্ডন করতে একটি সূক্ত জুড়ে ধ্রুবপদ সৃষ্টি করতে হল, ‘স জনাস ইন্দ্ৰঃ’। কিন্তু জনমানসে প্রশ্ন এবং নেম ভার্গবের ইন্দ্রকে অস্বীকার করা ঘোষণাটি রয়ে গেল। পুরোনো বহু দেবতা, ভগ, পর্জন্য, ইলা, ভারতী, মার্তণ্ড, অর্যমা, দক্ষ, অংশ— এরা ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে গেল, নতুন অনেক দেবতা স্থান পেল দেবমণ্ডলীতে, দেবমণ্ডলীর বিবর্তন ঘটল, তা আর স্থাণু রইল না। তেমনই পূর্বতন বহু যজ্ঞে ফল হচ্ছিল না দেখে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করেছে, সরে এসেছে, কখনও-বা কোনও সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ে যোগ দিয়েছে কারণ সমাজের মূল ধর্মধারা তাদের চিহ্নিত করেছে নাস্তিক, বেদবিরোধী বলে। এই বিরোধ প্রকাশিত হয়েছে সন্দেহের রূপে, কখনও-বা আরও গভীর, ব্যাপক বা মৌলিক হলে, নাস্তিক্যের রূপে। এর ফলে চিন্তাশীল মানুষ নতুন করে চিন্তা করেছে, কখনও উত্তর পেয়েছে, তখন সমাজে জ্ঞানের জগতের পরিসর বেড়েছে। রাহুকেতুর গ্রাসে সূর্য- -চন্দ্ৰ-গ্রহণ মানুষ ততদিনই বিশ্বাস করেছে যতদিন তার চেয়ে সংগততর কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেলেই জ্ঞান বেড়েছে, মানুষ পুরাতন কুসংস্কার ত্যাগ করে কার্যকারণ-পরম্পরার সন্ধান পেয়ে জ্ঞানের জগতের দিক্‌চক্রবালকে প্রসারিত করেছে।

দেখা যাচ্ছে, জ্ঞানের বৃদ্ধির জন্যে, ঐতিহ্যবাহিত কুসংস্কারের পরিবর্তে কার্যকারণ-সংবলিত যথার্থ তথ্য জানবার জন্যে প্রাথমিক প্রয়োজনই হল সন্দেহ, অস্বীকার করা, প্রচলিত ধারণার বিরোধিতা করা, শাস্ত্র-পুরোহিতের দেওয়া ব্যাখ্যাকে পরিহার করা, তাকে ভুল, অযথার্থ বলে ঘোষণা করা। এর পরে যদি কেউ সংগততর, বেশি যুক্তিপূর্ণ কার্যকারণ-পরম্পরায় গ্রথিত কোনও সমাধান পেশ করেন যা সমাজপতিরা তাদের স্বার্থহানি না হলে স্বীকার করে; আর তাদের স্বার্থহানি হলে সরাসরি নাস্তিক, পাষণ্ড, পাপী বলে ব্যাখ্যাত ও প্রশ্নকর্তা দু’জনকেই শাপশাপ্ত করে। কিন্তু যখন সমাধান পাওয়া যায়, তখন সমাজ জ্ঞানের জগতে এক ধাপ এগিয়ে যায়। এটা সম্ভবতই হত না যদি না প্রাথমিক স্তরে প্রশ্ন, সন্দেহ বা নাস্তিক্য ঘোষিত হত। যজ্ঞ ও বেদ সম্বন্ধে সংশয় ঘোষিত হতে হতে জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক ও আরও বহু বেদবিরোধী প্রস্থান রচিত হয়েছে, ফলে জীবনজিজ্ঞাসা গভীরতর হয়েছে, দর্শন ও নীতি সমৃদ্ধ হয়েছে। যজ্ঞকে অস্বীকার করে জন্ম নিয়েছে জন্মান্তরবাদ, মোক্ষ ও নির্বাণের কল্পনা, এতে সমাজের অগ্রগতি নিশ্চয়ই হয়নি বরং ক্ষতিই হয়েছে; কিন্তু পরম্পরাক্রমে লব্ধ বিশ্বাসের ছকটিকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার এই চেষ্টার (justifying the ways of God to men) মধ্যে নতুন করে চিন্তা করতে হয়েছে মানুষকে, এবং বানপ্রস্থ ও যতি দুটি আশ্রমকে আশ্রমবর্গের অন্তর্গত করতে হয়েছে, এতে কিছুকালের জন্য অন্তত সামাজিক সংহতি রক্ষিত হয়েছে।

যাস্কের বহু ব্যুৎপত্তি ভুল। কিন্তু শব্দমাত্রেরই যে ব্যুৎপত্তি আছে এই বিশ্বাসই ব্যুৎপত্তিশাস্ত্রের সৃষ্টির মূলে এবং এরই বিশ্বাস এসেছে প্রশ্ন ও সন্দেহের মধ্যে দিয়ে, ‘তৎ কাবশ্বিনৌ?’ ‘তা হলে অশ্বিনরা কারা?’ উত্তরে যা বলা হল, তার সব-কটি বিকল্পই ব্যুৎপত্তি হিসেবে অগ্রাহ্য। কিন্তু দেবতাদের একটি বাস্তব পটভূমিকা আছে, এ বিশ্বাসের ওপরেই সব-কটি বিকল্প প্রতিষ্ঠিত, এবং এ উত্তর মিলত না যদি মূলে প্রশ্নটি না থাকত। সমস্ত বেদাঙ্গের সৃষ্টি ওই প্রশ্ন থেকে। (অথর্ববেদে যত উদ্ভিজ্জ ও খনিজ দিয়ে রোগ সারার কথা আছে তার সবই বিজ্ঞানসিদ্ধ নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতায় পাওয়া কিছু জ্ঞানের সঙ্গে প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকে উৎপন্ন অনুসন্ধিৎসা ওই সব আবিষ্কারের মূলে।) রোগই একটা প্রশ্ন, স্বাস্থ্য স্বাভাবিক, তার থেকে বিচ্যুতিই রোগ; তা কেন হবে এই প্রশ্নই ভেষজশাস্ত্র আবিষ্কারের মূলে। পৃথিবীতে এখনও অনেক জাতি আছে যারা মোটামুটি এক ধরনের চলনসই জীবনযাত্রার উপায় নির্ধারণ করে সেই অনুসারে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, তার বাইরে তাদের উন্নতি হয়নি, কারণ তার বাইরে তারা প্রশ্নই করেনি।

যে-জাত যত বেশি তীব্র, দুরূহ, গভীর ও ব্যাপক প্রশ্ন করেছে, নিতান্ত হতদরিদ্র না হলে সে-জাত প্রশ্নোত্তরের কার্যকারণ পরম্পরা অবলম্বন করে তত বেশি এগোতে পেরেছে। আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে স্তব্ধ নিস্তরঙ্গ সুখের বদ্ধ জলাশয়ে বাস করা যায়। অনেকে তা করেওছে। কিন্তু অন্য বিকল্পটি মানুষের মনুষ্যত্বের মর্যাদার পক্ষে বেশি গৌরবজনক।

পরিশেষে, মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভারতীয় আর্যদের প্রথমতম রচনা ঋগ্বেদের প্রথম পর্যায় থেকেই এত সংশয়। একটি সজীব জনগোষ্ঠীই পারে, পদে পদে সংশয় বোধ করতে। এ কথা অনায়াসেই ধরে নেওয়া যায় যে, তদানীন্তন মানুষের মনে যত সন্দেহ এসেছিল তার সবই রক্ষিত হয়নি। হয়তো বহু প্রশ্ন সমাজপতিদের কাছে অত্যন্ত অস্বস্তিজনক ছিল বলে সেগুলিকে লুপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল, যে-কারণে চার্বাকের মতবাদ পূর্ণাঙ্গ ভাবে রক্ষিত হয়নি। চার্বাকের প্রভাব যে জনমানসে খুবই বিস্তৃত ছিল তার প্রমাণ, এ মতকে খণ্ডন না করে কোনও দর্শনপ্রস্থান-রচয়িতাই জলগ্রহণ করেননি। তা-ও চার্বাকমতের যেটুকু রক্ষিত হয়েছে তার মধ্যে শাস্ত্রসুলভ সংহতি নেই, শুধু সেইটুকুই চার্বাকের কৃতি হলে চার্বাকের জনপ্রিয়তা এত বাড়ত না এবং চিন্তাশীল মানুষ তাঁর অনুগামী হতেন না। তেমন মানুষ যে চার্বাকপন্থী হয়েছিলেন তার প্রমাণ হল, এ মতের খণ্ডনে এত গরজ, ঔৎসুক্য ও চিন্তাশ্রম। শুধু নির্বোধরা চার্বাকপন্থী হলে শাস্ত্রকাররা এত ভয় পেত না। বহু বুদ্ধিমান মানুষ তাঁর মতের অনুসরণ করেছিলেন বলেই তাঁর সম্বন্ধে এত আতঙ্ক। এবং চার্বাকের মত ধর্মের মূল ধরে টান দিয়েছিল, আত্মা পরলোক ঈশ্বর অস্বীকার করে। নাস্তিক্য সন্দেহের চূড়ান্ত অবস্থান। আনুষঙ্গিক বহু সন্দেহ ধীরে ধীরে এসে ঠেকে নাস্তিক্যে। নেম ভার্গবের ‘ইন্দ্র নেই’ বলা সেকালে নাস্তিক্য। নচিকেতা যখন বলে, ‘কেউ কেউ বলে মৃত্যুর পরে কিছুই থাকে না’ তখন সে সমাজে সঞ্চরমাণ নাস্তিক্যকেই প্রকাশ করে।

অত প্রাচীনকালে অত মৌলিক সংশয় ও নাস্তিক্য যে-জাতির মধ্যে উদ্‌গত হতে পেরেছিল, সে-জাতি নিঃসংশয়ে একটি অত্যন্ত সজীব, নিয়ত মননশীল জাতি, যারা প্রশ্ন- সমস্যা-সংকুল চিন্তাজগতে আপস করতে অস্বীকার করেছিল। প্রচলিত মত ও পথে তাদের চিত্ত তৃপ্তি পায়নি, তাদের চাই ভূমা, কারণ তাদের ‘নাল্পে সুখমস্তি’। ঐতিহ্যধারায় প্রাপ্ত বিশ্বাস, শাস্ত্র ও আপ্তবাক্যকে আজ থেকে সওয়া তিন হাজার বছর আগে যে-ভারতীয়রা সন্দেহ করে জীবন সম্বন্ধে নানা মাত্রার, নানা যন্ত্রণাদীর্ণ জিজ্ঞাসাকে এত তীব্র ভাবে উচ্চারণ করতে পেরেছেন, তাঁরা অবশ্যই নমস্য; কারণ তাঁরাই যুক্তিতর্কের সূত্রে নবতর সত্যের পথে এ জাতিকে রওনা করে দিতে পেরেছেন। তাঁদের সংশয় ও নাস্তিক্য আমাদের গর্বের বস্তু— এক সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার। তাই নিয়েই এই লেখা।

রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে ২০০০ সালে (পুনর্মুদ্রণ ২০০৯)। গাঙচিল থেকে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধসংগ্রহ-র জন্য এর যথাসম্ভব পরিমার্জন করার চেষ্টা হয়েছে।

***

১. ‘It is no longer a question of denying a particular person’s (or groups) sacrifice, but of denying the abstract institution of sacrifice. The doctrine of sacrifice is either true or false. It is at this point that the classical nastika makes his appearance. The utter acerbity of their relations signifies the fact that they are no longer bound together in a complementary pattern. The initial point is, however, the breakthrough out of mutual dependence in the contest for the goods of life. Both ritualist and nastika reject karman in the sense of the (sacrificial) ‘work’ of agonistic exchange between two parties. What divides them is the truth or falsehood of the doctrine of individual karman regulated by transcendent Veda injunction… . The ritualist (and his astika progeny) in order to safeguard man’s transcendence subjects his freedom to transcendent injunction. The nastika, on the other hand, surrenders his transcendence in favour of man’s freedom. ‘ – J. C. Heesterman, p. 184

২. ‘It (Veda) is invoked against the internal sectarian disintegration of the tradition, as well as against the ‘external’ (bahya) and heterodox (nastika) challenges of Buddhism … . The distinction between ‘orthodox’ (astika) and ‘heterodox’ (nastika) systems is among the most basic and familiar traditional Indian doxographies as it is in modern surveys of Indian philosophy.’— Halbfass: p. 16 and p. 237

৩. ‘(Greek (ABEOS) atheos originally used in Greece of all those who whether they believed in god or not, disbelieved in the official gods of the state… In Roman empire (the word ) was used by pagans to denote Christian agnosticism.’— The Oxford Dictionary of the Christian Church, p. 100 )

৪. Macmillan Encyclopaedia of Philosophy: Skepticism, Vol. VII, p. 499

৫. ‘The assumption that all or the most significant features of these structures are knowable and controllable by human effort…’ Guy E. Swanson, p. 188

৬. ‘The World which is the same for all, has not been made by any god or man: it has ever been, is now, and ever shall be…’ Orphic Fragments; 334 EBc 30; quoted in George Thomson: Vol. II, p. 227

৭. ‘ (the tension) between the divine promise and its ostensible failure to be fulfilled; the other is a tension between God’s will, His providential guidance and human freedom, the refractory nature of man… the double dialectic between design and disorder, providence and freedom.’- Robert Alter, p. 141

৮. ‘If Nature’s providence is all inclusive, then any event which causes injury or suffering has to be integrated as something which, if all the facts were known, would be recognized as beneficial by man.’- A.A. Long, p. 170

৯. ‘About the gods, I am not able to know whether they exist or do not exist, nor what they like in form, for the factors preventing knowledge are many: the obscurity of the object, at the shortness of human life. ‘ – Protagorus for 4. The Sophist

১০. ‘After this event the creative period of Brahmanism appears to have come to and end, lines of teachers are recorded and there was clearly some revision of Vedic texts… but original composition seems to have been confined to the subsidiary studies, actual law, linguistics, astronomy and geometry. – A. K. Warder, p. 28

১১. ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তি ইতি আরে ব্রবীমীতি হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্য। বৃহদ. (২:৪:১২; ৪:৫:১৩)

১২. ‘The Upanisads either individually or as a whole do not offer a complete, consistent and logically systematized conception of the world.’— Hajime Nakamura, p. 79

১৩. ‘(Thou) has not shown anyone how thy way is to be comprehended. ‘ – Ezra 3:3

১৪. ‘I beseech you, my lord, why have I been endowed with the power of understanding.’- Ezra 4:22 )।

১৫. ‘…the lawgivers are not really interested in the actual contents of the Veda. What they are interested instead in is the Veda as a political instrument which can be effectively used to keep the people under control with the fear of the other world and gods etc. which, because they boldly proclaim as supreme wisdom supposed to be contained in the Veda.’- Chatterjee, p. 180

১৬. ‘…if there is anything in traditional Indian philosophy that has successfully stood the test of advanced scientific knowledge, it is the proposition of the Loka-yatas viz. that consciousness— ordinarily understood as the differential of the spirit or the soul– is only a product of matter.’— Chatterjee, op. cit., p. 610

১৭. ‘The fool hath said in his heart, there is no god Psalms. 14:1, 53:1, etal

১৮. ‘Authentic religious faith… must always entail doubt. – Macmillan Encyclopaedia of Religion.’ Doubt, p. 425

১৯. ‘There lives more faith in honest doubt.’- In Memoriam, (১৩৫ নং স্তবক)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *