০৬. খাদ্যের আখ্যান

খাদ্যের আখ্যান

অন্ন কেবলমাত্র জীবনধারণেরই উপকরণ ছিল না। অন্নবান ব্যক্তি সমাজে সমাদর পেত এমন ইঙ্গিতও আছে মাঝে মাঝে। একটির উল্লেখ করা যায়:

জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ শ্রদ্ধাপূর্বক দান করতেন, বহু দান করতেন, বহু পাক করতেন, সব দিক থেকে তিনি (এই উদ্দেশ্যে) চারদিকে পান্থশালা নির্মাণ করিয়েছিলেন যেন সকলে তাঁর অন্নভোজন করুন— জানশ্রুতিই পৌত্রায়ণঃ শ্রদ্ধাদেয়ো বহুদায়ী বহুপাকা আস। স হ সর্বত আবসথান্ মাপয়াঞ্চক্রে সর্বত এব সেন্নমস্যন্তীতি।’ (ছান্দ্যোগ্যোপনিষদ ৪:৩:১)

নিঃসন্দেহে জানশ্রুতি পৌত্রায়ণই একমাত্র ধনী ও অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন না। এই উপনিষদে যে প্রসঙ্গে কথাটা উঠেছে সেটা হল, তিনি নিজের যজ্ঞে পৌরোহিত্য করার জন্যে কোনও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে অনুনয় করতে চান। জানশ্রুতি পৌত্রায়ণের পরিচয় সূত্রে বলা হয়েছে যে, তাঁর বহু অন্ন, তিনি বহু দান করেন এবং সশ্রদ্ধ ভাবে দান করেন। অন্যত্র দান সম্বন্ধে উপনিষদের উপদেশ মনে পড়ে, ‘শ্রদ্ধাসহকারে দান করবে, অশ্রদ্ধায় দিও না।’ তা এই জানশ্রুতি শ্রদ্ধাসহই দান করতেন। কী দান করতেন? বিপুল পরিমাণ খাদ্য। কারণ তাঁর নির্মিত বহু অতিথিশালাতে নিত্য বহু অন্ন পাক করা হত; তাঁর বাসনা ছিল, ‘চারদিক থেকে লোক এসে আমার অতিথিশালায় আহার করুক।’ এই ধরনের অন্নসত্র স্থাপনের পশ্চাতে যে সামাজিক অর্থনৈতিক পটভূমিকা ছিল, স্বভাবতই তা অন্নাভাবের। যাদের নিজেদের বাড়িতে অন্নকষ্ট নেই, তারা রাজার বা ধনীর অতিথিশালায় রোজ খেতে যাবে কেন? কিছু নিশ্চয়ই পান্থ, দূরপথযাত্রী ছিল যাদের বাধ্য হয়েই পান্থশালার অন্ন ও আশ্রয় গ্রহণ করতে হত। কিন্তু অনেকগুলি অতিথিশালায় নিয়মিত বহু অন্ন পাকের ব্যবস্থা নিশ্চয়ই অন্নাভাবগ্রস্ত বহু মানুষের অন্নসংস্থানের জন্যেই। এখানে একটি কথা বেশ প্রাসঙ্গিক— শ্রদ্ধা সহকারে অন্নদান। কথাটা ওঠে এমন ক্ষেত্রেই শুধু যেখানে অশ্রদ্ধায় দান করাটা প্রাসঙ্গিক হতে পারত, অর্থাৎ অন্নহীন দরিদ্রদের অন্ন দেওয়ার ক্ষেত্রেই। সে দেওয়া প্রায়শই হতশ্রদ্ধায় দেওয়া হয়ে থাকে, যাকে আমরা বলি ‘কাঙালিভোজন’। জানশ্রুতির ওই সব অতিথিশালায় প্রত্যহ যা অনুষ্ঠিত হত তা প্রকৃতপক্ষে কাঙালি-ভোজনই বটে। কিন্তু পাছে অভাবকে তাচ্ছিল্য করা হয়, তাই তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে দান করতেন। তিনি মানে তাঁর নির্দেশে ওই পান্থশালার অন্নসত্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা। আরও একটা প্রচ্ছন্ন কারণ অবশ্যই ছিল, অন্তত জানশ্রুতির মনে: তা হল যেখানে দেশব্যাপী অন্নাভাব, যেখানে প্রচুর ক্ষুধা আর অপ্রচুর খাদ্য, সেখানে অন্নহীন মানুষ তো তার অন্নভাবের জন্যে দায়ী নয়, কাজেই তাদের অশ্রদ্ধা করা ঠিক হয় না।

কিন্তু যে ব্যাপারটা প্রথমেই আমাদের চোখে লাগে তা হল, দেশে ব্যাপক অন্নাভাব ছিল ঠিকই; দলে দলে মানুষ জানশ্রুতির অন্নসত্রে গিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করত ঠিকই; কিন্তু দেশে যে অন্ন ছিল না তা তো নয়। জানশ্রুতির ওই অন্নসত্রগুলিতে যে বহু অন্ন পাক হত সেটা তো কোথাও না কোথাও মজুত ছিল— তা হলে দেখা যাচ্ছে, অন্ন ক্ষুধিতের কাছে পৌঁছত না, কারণ বিত্তবানরা তা কিনে নিয়ে জমিয়ে রাখত এবং ক্ষুধিতের অন্নদানসেবা করত। এতে জানশ্রুতিরা দু’ভাবে যশস্বী হতেন: এত অন্ন বাজার থেকে কিনে মজুত করবার মতো বিত্ত তাঁদের ছিল বলে, আর, এত ক্ষুধিতের ক্ষুধা নিবারণের মতো পুণ্যকাজ তাঁরা করতেন বলে। বলাই বাহুল্য, সব বিত্তবান অন্নসংগ্রহ করতে পারলেও বুভুক্ষুর জন্যে তা খরচ করতেন না, অন্ন নিয়ে দেশে ও বিদেশে বাণিজ্য করে বিত্তবানরা বিত্তবত্তর হতেন। এটা শুধু স্বাভাবিক নয়, চিরাচরিত ব্যাপার। বহু অন্ন অর্থ দিয়ে সংগ্রহ করতে পারলে সমাজ বিশেষত যে সমাজে এত অগণ্য ক্ষুধার্ত মানুষ— সে সমাজ ওই ধনী ব্যক্তিকে অন্য চোখে অর্থাৎ সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখে। সে দিনও দেখত, আজও দেখে। অর্থাৎ বিত্তবান ব্যক্তি ক্ষুধিতের অন্ন অর্থ দিয়ে কিনে নিরন্ন সমাজে একটা কৃত্রিম সম্মান পেত। কৃত্রিম, কারণ অন্ন সরাসরি ক্ষুধিতের অন্নপাত্রে না পৌঁছে ধনীর ভাণ্ডারে পৌঁছচ্ছে, এবং এই ধরনের ব্যবসায়ী যদিও নিরন্নকে আহার করিয়ে সে অন্নের সদ্ব্যবহার, অর্থাৎ যথার্থ পরিণতিই ঘটাত তবু ক্ষুধা আর অন্নের মধ্যে যে ব্যবধান সেইখানেই ওই ধনী মজুতকারীর ভূমিকা এবং তাকে অবলম্বন করেই তাদের পুণ্যার্জন। জানশ্রুতির বাসনা ছিল, ‘সকলে আমার অন্ন ভোজন করুক।’ বাসনাটিতে বদান্যতা ছিল তা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু একটু অহমিকাও কি ছিল না? ‘সকলে আমার অন্ন ভোজন করুক’– এ ব্যবস্থা তো স্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক হত সকলে নিজের গৃহের অন্নই যথেষ্ট পরিমাণে আহার করুক এই বাসনা। ঘটনাচক্রে সমাজের অর্থনীতি যখন সে ব্যবস্থা করে না, তখনই জানশ্রুতিরা দুঃখীর পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পুণ্যবান ও যশস্বী হন।

জানশ্রুতি পৌত্রায়ণের কাহিনিতে ব্যাপক অন্নাভাবের পটভূমিকা আছে যার প্রতিকারকল্পে ওই অন্নসত্রগুলির প্রতিষ্ঠা। এ কাহিনির পরবর্তী অংশটিতে আমরা জানতে পারি:

জানশ্রুতি রাজা ছিলেন। ঐশ্বর্য ও অন্নদানের জন্যে তিনি যশস্বী ছিলেন। এক রাত্রে একটি হংস অপর একটি হংসকে বলছে, ‘জানশ্রুতি পৌত্রায়ণের দীপ্তি দ্যুলোক পর্যন্ত প্রসারিত রয়েছে; দেখো, যেন তার তাপ তোমাকে দগ্ধ না করে।’ অন্য হংসটি উত্তরে বলল, ‘যে প্রশংসা কেবল সযুগ্ধা রৈক সম্বন্ধেই প্রযোজ্য, সে প্রশংসবাক্য তুমি কার সম্বন্ধে প্রয়োগ করলে?’ তাতে প্রথম হংসটি জিজ্ঞাসা করল, ‘সেই সযুগ্ধা রৈক্ব কেমন লোক?’ তখন প্রথম হংসটি উত্তরে বলল, ‘পাশা খেলায় সবচেয়ে উঁচু দান পড়লে তার চেয়ে ছোট দানগুলো যেমন তার অন্তর্ভুক্ত হয়, তেমনই অন্য সব পুণ্যবানদের পুণ্য রৈকের পুণ্যেরই অন্তর্গত। রৈকের মতো জ্ঞান অন্য কোনও মানুষের দেখলে তাকে আমি রৈকের মতো জ্ঞানবান বলতাম।’ দুটি হংসের এই আলাপ গাছের নীচে থেকে জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ শুনলেন।

লক্ষ করলে দেখি, রাজা জানশ্রুতি ধনী ছিলেন কিন্তু সযুগ্ধা রৈক্ব অসাধারণ পুণ্যবান ছিলেন এবং বিদ্বানও ছিলেন। পরদিন ভোরে গাত্রোত্থান করার সময়ে রাজার বৈতালিকেরা যখন তাঁর বন্দনা করছিলেন তখন রাজা বললেন, ‘ওহে সযুগ্ধা রৈক্কের মতো কি বললে আমাকে?’ সারথি রাজাকে প্রশ্ন করলেন, ‘রাজন, সেই সযুগ্ধা রৈক্ব কে?’ তখন রাজা রৈক্ব সম্বন্ধে ওই হংসের দেওয়া সংজ্ঞাটি বললেন, তাঁর পুণ্য ও তাঁর বিদ্যা যে অতুলনীয় সে কথা জানালেন। সারথি রৈক্কের খোঁজ করলেন, কিন্তু পেলেন না এবং রাজাকে সে কথা জানালেন। রাজা বললেন, ‘যেখানে ব্রাহ্মণদের খোঁজ পাওয়া যায় সেখানে এঁর সন্ধান কর।’

তখন সারথি দেখলেন, একটা গরুর গাড়ির নীচে শুয়ে একজন লোক তার খোস চুলকোচ্ছে। সারথি সেখানে গিয়ে তাঁকে অভিবাদন করে প্রশ্ন করলেন, ‘মহাশয়, আপনিই কি সযুগ্ধা রৈক?’’হ্যাঁ আমিই সে।’ শুনে সারথি রাজার কাছে গিয়ে বললেন, ‘খোঁজ পেয়েছি, মহারাজ।’ তখন রাজা জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ ছ’শো গাভী, কণ্ঠহার ও অশ্বতরীসমেত রথ নিয়ে তাঁর কাছে এসে বললেন, ‘মহাশয়, রৈক, এই গাভী, রথ, অশ্বতরী ও কণ্ঠহার আপনারই জন্যে এনেছি। আপনি যে দেবতার আরাধনা করে থাকেন তাঁর সম্বন্ধে আমাকে উপদেশ দিন।’ উত্তরে রৈক পরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘হে শূদ্র, গাভীগুলো তোমার কাছেই থাকুক।’ তখন আবার জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ এক হাজার গাভী, রথ, অশ্বতরী কণ্ঠহার, এবং নিজের কন্যাকে নিয়ে রৈকের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘এই সবই আপনার জন্যে এনেছি, এটি আপনার পত্নী, এবং যে-গ্রামে আপনি বাস করেন সে গ্রামটিও আপনারই হোক। আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে উপদেশ দিন।’ রৈক বুঝলেন, কন্যাটিকে উপঢৌকন দেওয়া হচ্ছে বিদ্যাগ্রহণের সূত্রপাতের কামনায়; বললেন, ‘হে শূদ্র, তুমি এ সব এনেছ যাতে এগুলি অবলম্বন করে আমার মুখ খোলাতে পার।’

অতঃপর তিনি জানশ্রুতিকে দার্শনিক তত্ত্ব সম্বন্ধে উপদেশ দিতে শুরু করলেন। মহাবৃষদেশ রৈক্বপর্ণ বলে বিখ্যাত যে সকল গ্রামে রৈক বাস করেছিলেন জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ সে সমস্ত গ্রামই রৈক্বকে দান করেছিলেন। অর্থাৎ রাজার প্রতিজ্ঞা শোনবার পরে রৈক্ব বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করেছিলেন এবং সেই সমস্ত গ্রামই রাজা তাঁকে দান করেছিলেন।

জানশ্রুতির খোস চুলকানো তাৎপর্যপূর্ণ। খোস অপুষ্টি থেকে হয়, অতএব রৈক্ব অভাবগ্রস্ত ছিলেন। জানশ্রুতির উপঢৌকন থেকেও বোঝা যায় ধন দিয়ে অভাবগ্রস্ত পণ্ডিতকে নিজের অনুকূলে আনবার চেষ্টা চলছে, এবং রাজাকে শূদ্র’ বলে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলেও রৈক্ব শেষ পর্যন্ত তাঁর দান গ্রহণ করে তাঁকে আধ্যাত্মবিদ্যার বিষয়ে শিক্ষা দেন। এই শিক্ষারই মাঝামাঝি জায়গায় শুনি:

কাপেয় শৌনক ও কাক্ষসেনি অভিপ্রতারীর কাছে এক ব্রহ্মচারী ভিক্ষা চান। তাঁরা ভিক্ষা না দিয়ে তাঁকে দার্শনিক প্রশ্ন করেন, উত্তরে তিনি বলেন, ‘অদ্বিতীয় দেবতা যে প্রজাপতি, যিনি ত্রিভুবনকে রক্ষা করেন তিনি চারটি মহাত্মাকে গ্রাস করেন। মর্ত্য মানুষ তাঁকে দেখতে পায় না; তিনি বহুরূপে অবস্থিত। এ-অন্ন যাঁর জন্যে, তাঁকেই এটা দেওয়া হল না।’ কাপেয় শৌনক কথাটা ভেবে ব্রহ্মচারীর কাছে এসে বললেন, ‘হে ব্রহ্মচারি, স্থাবর ও জঙ্গম সব কিছু যাঁর থেকে উৎপন্ন হয়, যিনি সমস্ত দেবতার আত্মা, যাঁর দত্ত ভগ্ন নয় এমন ভক্ষক তিনি, এই-যে মেধাবী তাঁকে কেউ ভক্ষণ করে না, কিন্তু তিনি অন্য সব কিছুকে ভক্ষণ করেন বলে (পণ্ডিতরা) বলেন, তাঁর মহিমা অপরিমেয়। আমরা তেমন ব্রহ্মকেই উপাসনা করি।’ তার পর তিনি (অনুচরদের) বললেন, ‘এঁকে অন্ন দাও।’তারা তাঁকে অন্ন দিল।… তাই সমস্ত দিকেই অন্ন দশ-ত্ব প্রাপ্ত হয় (দশগুণ হয়); সেই বিরাট-ই অন্নভোক্তা, সে-ই সব কিছু দেখেছে, অন্নভোজী-ও হয়েছে, এ কথা যে জানে, এ কথা যে জানে— তস্মাৎ সর্বাসু দিক্ষুন্নং দশ কৃতং সৈষা বিরাডন্নাদী ভবতি য এবং বেদ য এবং বেদ।’ (ছান্দোগ্য; ৪:৩:৮)

এই পুরো উপাখ্যানটিতেই কয়েকটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করার মতো। পরের দিকের তত্ত্বকথার বক্তা অপুষ্টির রোগে ক্লিষ্ট, দরিদ্র পণ্ডিত ব্রাহ্মণ রৈক। তা হলে জ্ঞানী ব্রাহ্মণও সেই যুগে— খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতকে— সব সময়ে অভাব থেকে নিষ্কৃতি পেত না। এ সময়ে নানা প্রস্থানের ব্রহ্মচারী সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান হয়, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ সম্মান পেলেও সব সময়ে অন্ন পেতেন না। সব পণ্ডিত যাজ্ঞবন্ধ্যের মতো সৌভাগ্যবান ছিলেন না, রাজা জনকের মতো মুক্তহস্ত পৃষ্ঠপোষক সব বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের ভাগ্যে জুটত না। ফলে জ্ঞানবুদ্ধি নিয়েও বহু পণ্ডিত অভাবে পীড়িত হতেন। কাপেয় শৌনক ও কাক্ষসেনি অভিপ্রতারীর প্রসঙ্গে বায়ু, প্রাণ, ইত্যাদি বিষয়ে দু-চারটি তত্ত্বকথার পরেই রৈক হঠাৎ বলেন যে, এঁদের কাছে ভিক্ষা চেয়ে এক ব্রহ্মচারী ভিক্ষা পেলেন না। প্রশ্ন করে ব্রহ্মচারীর জ্ঞান কতটা তা পরীক্ষা করতে চেষ্টা করেন। উত্তর দিয়ে ব্রহ্মচারী বলেন, ‘এ-অন্ন যাঁর জন্যে, তিনিই তা পেলেন না।’ অর্থাৎ ওঁদের অন্ন বুভুক্ষু ব্রহ্মচারীর জন্যেই হওয়া উচিত ছিল, সে-ই তা পেল না, কথাটা শুনে কাপেয় শৌনকের খটকা লাগে। তিনি পরমাত্মার বর্ণনা দিতে অন্যান্য নানা বিশেষণের সঙ্গে বললেন, ‘যাঁর দাঁত ভাঙা নয় এমন ভক্ষক তিনি, তাঁকে কেউ ভক্ষণ করেন না, তিনি অন্য সব কিছুকে ভক্ষণ করেন; তাঁর মহিমা অপরিমেয়।’

পরমাত্মার বর্ণনায় বলা হয়েছে তিনি অভগ্নদন্ত, অর্থাৎ যাঁর দাঁত ভাঙা নয়। স্বভাবতই মনে পড়ে বৈদিক দেবতা পূষার কথা। গোপথব্রাহ্মণ বলে, প্রজাপতি রুদ্রকে যজ্ঞভাগ থেকে বঞ্চিত করেন; রুদ্র যজ্ঞকে বিদ্ধ করলে তা ‘প্রাশিত্র’ হয়ে যায়, প্রাশিত্র হল যজ্ঞের হবি-র যে অংশ অথর্ববেদের পুরোহিত ব্রহ্মা ভোজন করে। সেই প্রাশিত্রের দিকে তাকিয়ে ভগ অন্ধ হয়ে যান, সবিতার হাত দুটি খসে পড়ে এবং পূষা সেই প্রাশিত্র খেতে উদ্যত হলে তাঁর সব দাঁত ভেঙে যায়। (গোপথব্রাহ্মণ উত্তরভাগ; ১:২) দেবতাদের মধ্যে তা হলে একজন ভগ্নদন্ত ছিলেন পূষা, এবং দেবতা হিসেবে যজ্ঞের হব্য ভোজনে তাঁর অধিকারও ছিল, কিন্তু সেই হব্য ভোজন করতে গিয়ে তাঁর আহারের উপাদান অর্থাৎ দাঁত সব ভেঙে যায়। তা হলে অভগ্নদত্ত হলেন এমন দেবতা, প্রাশ্রিত্রভোজনে যাঁর অধিকার এমন পর্যায়ে স্বীকৃত যাতে তিনি অভগ্নদন্ত থাকতে পারেন। অর্থাৎ সর্ববিধ ভোজনে যাঁর অবিসংবাদিত অধিকার। ভোজনে অধিকার, সমাজে স্বীকৃতি এবং গৌরবের একটি মানদণ্ড।

এই উপাখ্যানে আমরা কাপেয় শৌনক ও কাক্ষসেনি অভিপ্রতারীকে দেখি ভোজনে অধিকারী অন্নবান কৃতী পুরুষ দুজন। এ কথা এমনই সর্বজনবিদিত ছিল যে ক্ষুধার্ত ব্রহ্মচারী তাঁদের কাছেই খাদ্যপ্রার্থনা করে। সমাজে খাদ্যে মানুষের সমান অধিকার ছিল না, ওই ধনী অন্নবানদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত অন্ন ছিল। এক দিকে প্রয়োজনের অতীত বাড়তি খাদ্য, অন্যদিকে অভাবগ্রস্ত বুভুক্ষার ক্ষুধা; কিন্তু এ দুয়ের সংযোগ সর্বদা ঘটত না। ঋগ্বেদের সেই ‘মোঘমন্নং বিন্দতে অপ্রচেতাঃ… কেবলাদী ভবতি কেবলাঘঃ’, অর্থাৎ কৃপণ ব্যক্তি ব্যর্থ অন্ন ভোজন করে; যে একা খায় তার পাপ তার একারই হয়— এ সব কথা সমাজমানসে প্রোথিত ছিল অন্তত তিন-চারশো বছর ধরে; তবু এ উপাখ্যানে দেখি খাদ্যদানে কার্পণ্য। এর পেছনে অন্নবানের সেই ত্রাস: কী জানি, কখন ক্ষুধার দিনে হয়তো খাদ্য জুটবে না। এরা তাই ‘তরাসে নিষ্ঠুর’। অর্থাৎ পর্যাপ্ত অন্ন সংগ্রহ করেও মানুষ বরাবরই ক্ষুধার সময়ে খাদ্য জুটবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কায় ভুগত। এবং নিশ্চয়ই এ আশঙ্কার কারণও ছিল।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য যার ভাণ্ডারে, সমাজে তার সম্মানের স্থান ছিল এটাও এ উপাখ্যানে লক্ষ্য করি। তার উদ্বৃত্ত অন্ন আছে, ভৃত্য আছে, অতএব সমাজে প্রতিষ্ঠাও আছে। যে-বস্তু সমাজে দুর্লভ, সাধারণ মানুষ যা পর্যাপ্ত পরিমাণে সর্বদা পায় না এবং পাবার কামনায় একান্ত উৎসুক থাকে অথচ জানে যে সে রকম পাওয়া জনসাধারণের কাছে স্বপ্নমাত্র, সে-বস্তু, অন্ন। যার প্রচুর পরিমাণে আছে, ইচ্ছেমতো খেতে, দান করতে, বেচতে, জমিয়ে রাখতে পারে সে মানুষ তো সাধারণ লোকের ইর্ষামিশ্রিত সম্ভ্রমের উদ্রেক করবেই; তখনকার অনিশ্চিত অন্নের যুগে যার অন্নভাণ্ডার অপেক্ষাকৃত নিশ্চিত সে তো সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবেই। অন্ন তাই এক গভীর অর্থে ঐশ্বর্য ও সম্মানের মানদণ্ড ছিল।

ছান্দোগ্য উপনিষদের পঞ্চম অধ্যায়ে পড়ি উপমন্যুর পুত্র প্রাচীন শাল, পুলুষের পুত্র সত্যযজ্ঞ, ভাল্লবির পুত্র ইন্দ্রদ্যুম্ন, শর্করাক্ষের পুত্র জন এবং অশ্বতরাশ্বের পুত্র বুড়িল একত্র হয়ে আলোচনা করছিলেন, ‘কে আমাদের আত্মা, কে ব্রহ্ম’। সমাধান না পেয়ে তাঁরা সকলে অরুণের ছেলে উদ্দালকের শরণাপন্ন হলেন। উদ্দালক নিজে উত্তর না দিয়ে কেকয়ের রাজা অশ্বপতির কাছে তাঁদের পাঠালেন। রাজা তখন যজ্ঞ করছিলেন। তিনি এঁদেরকে বললেন যজ্ঞে প্রত্যেক ঋত্বিককে যত দক্ষিণা দেওয়া হবে এঁদের প্রত্যেককে ততটাই দেওয়া হবে। এঁরা বললেন, আমরা এসেছি আপনার কাছে বৈশ্বানর আত্মার স্বরূপ জানতে। রাজা পরদিন তাঁদের উত্তর দেবেন জেনে তাঁরা শিষ্যের মতো সমিৎ (জ্বালানি কাঠ) হাতে নিয়ে রাজার কাছে এলেন। রাজা একে একে তাঁদের প্রশ্ন করে জেনে নিলেন যে তাঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও রূপে বৈশ্বানর আত্মাকে উপাসনা করেন, তাই নানা ভাবে তাঁদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং তাঁদের বংশে ব্রহ্মতেজ জাত হয়। তাঁরা অন্নভোজী হয়েছেন এবং প্রিয় বস্তু দেখেন, কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই খণ্ডিত বা আংশিক ভাবে বৈশ্বানর আত্মাকে জানেন, এবং তাঁরা যদি রাজার কাছে না আসতেন তা হলে তাঁদের সাংঘাতিক দৈহিক ক্ষতি, এমনকী প্রাণনাশ পর্যন্ত ঘটত। অবশেষে তিনি তাদের বলেন, তোমরা আংশিক ভাবে বৈশ্বানর আত্মাকে জেনে অন্ন আহার করছ, কিন্তু কেউ যদি প্রাদেশমাত্র (এক বিঘৎ পরিমাণ) বা অভিবিমান (আকাশের মতো অপরিমেয়) রূপে বৈশ্বানর আত্মাকে জেনে যথাযথ ভাবে উপাসনা করেন, তবে তিনি সকল লোকে, সকলের মধ্যে ও সরল আত্মাতে অর্থাৎ (আত্মার আধার শরীরে) অন্ন আহার করেন। রাজা প্রত্যেককে বলেন, ‘অৎস্যন্নং পশ্যসি প্রিয়মন্ত্যন্নং পশ্যতি প্রিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবর্চর্সং কুলে য এতমেবাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে।’ শেষে বলেন, ‘এতে বৈ খলু যূয়ং পৃথগিবেমমাত্মানং বৈশ্বানরং বিদ্বাংসোহন্নমখ যত্ত্বেতমেবং প্রাদেশমাত্রভিবিমানমাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে স সর্বেষু লোকেষু সর্বেষু ভূতেষু সর্বেস্বাত্মস্বন্নমত্তি। (ছা/উ; ৫:১২:২; ১৩:২; ১৪:২; ১৫:২; ১৬:২; ১৭:২; ১৮:১)

এ উপাখ্যানের উপসংহারটি প্রণিধানযোগ্য: বৈশ্বানর আত্মাকে যে তার স্বরূপে জানে সে সকল লোকে অর্থাৎ ভূলোক, দ্যুলোক, ইত্যাদি সকল স্থানেই সকল প্রাণীর মধ্যে সকল আত্মাতেই অন্ন আহার করে। সকল প্রাণীর মধ্যে, কারণ, তখন জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসের সূচনার যুগ, তাই মানুষ মৃত্যুর পরে নানা অন্য প্রাণীর দেহে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। সকল আত্মাতেই মানে— এ কথায় যে কোনও প্রাণীর দেহের আধারে যে আত্মা থাকে বলে তখন লোকে বিশ্বাস করত সেই সব আত্মাতে অধিষ্ঠিত হয়ে সেই দেহীর রূপে সে অন্ন আহার করে। কে করে? যে বৈশ্বানর আত্মাকে তার স্বরূপে জানে। এই আত্মাকে তার স্বরূপে জানাটাই উপনিষদের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়। কাজেই এ-ই হল এ যুগের মুখ্য জ্ঞেয় বা জানবার ও উপলব্ধি করার বস্তু, যার দ্বারা মানুষ পুনর্জন্ম থেকে মোক্ষ লাভ করে অর্থাৎ জ্ঞানকাণ্ডে প্রতিশ্রুত শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করে। এ কাহিনির উপসংহারে শুনি, এই শ্রেষ্ঠ আত্মজ্ঞান যে লাভ করেছে সে সকল লোকে, সকল প্রকার প্রাণীর দেহে অধিষ্ঠিত হয়ে অন্ন আহার করে। অর্থাৎ মোক্ষের যেন একটা বিকল্প রূপ হল সকল অবস্থায়— জন্মে জন্মে, যে কোনও দেহের মধ্যে থেকেই অন্নভোগী হওয়া। নিরন্তর অন্নের অধিকারী হওয়া এমন একটা বিরল সৌভাগ্য, যা কেবলমাত্র সেই ব্যক্তিই লাভ করে যে বৈশ্বানর ব্রহ্মকে খণ্ডিত ভাবে নয়, পূর্ণরূপে জেনেছে। এ শাস্ত্র বলছে না যে, সে মোক্ষলাভ করে, বরং বলছে সে নিঃ সংশয়ে নিরন্তর অন্নভোজী হয়। অন্যত্র যেমন উচ্চারিত হয়েছে যে অন্নই ব্রহ্ম, সেই কথাটাই এখানে অন্য ভাবে উচ্চারিত হল।

অন্ন শরীরে পরিপাক হওয়ার পর তিন ভাগে বিভক্ত হয়, স্থূল অংশ বিষ্ঠায় ও মধ্যম অংশ মাংসে পরিণত হয় এবং সূক্ষ্ম অংশ মনে পরিণত হয়— অন্নমশিতং ত্রেধা বিধীয়তে তস্য যঃ স্থবিষ্ঠো ধাতুস্তৎ পুরীষং ভবতি যো মধ্যমতন্মাংসং যোৎনিষ্ঠস্তন্মনঃ।’ (ছা/উ; ৬:৫:১) ‘হে সৌম্য, মন অন্নময়, প্রাণ জলময়, বাক্ তেজোময়— অন্নময়ং সৌম্য মন, আপোময় প্রাণন্তেজোময়ী বাগিতি।’ (ছা/উ; ৬:৫:৪) এই সংলাপ আরুণির সঙ্গে তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুর আলাপের একটি অংশ। এখানে শরীরের বর্জ্য পদার্থ, কলেবর— যা মাংসে গঠিত— এবং মন এই তিন ভাগে দেহীকে ভাগ করা হয়েছে এবং এ তিনটির মধ্যে দেহ ও মন অন্নের দ্বারাই গঠিত এ কথা বলা হয়েছে। পরের অংশে প্রাণ জলময়, বাক্ তেজোময় বলা হয়েছে, কিন্তু মনকে অন্নময়ই বলা হয়েছে। দেহীর ব্যক্তিত্বের যে দুটি শ্রেষ্ঠ সত্তা, মন ও আত্মা তাদের সঙ্গে অন্নকে কার্যকরণ রূপে ও অভিন্নরূপে যুক্ত করা হয়েছে। উদ্দালক বলেন, অন্নকে বৈশ্বানর আত্মা বলে জানা-ই সত্য জানা; আর এখানে বলা হল, মন সৃষ্টি করে অন্ন, এতে অন্নের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। বিশেষ করে যখন মনে রাখি যে, উপনিষদ্ জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্গত এবং জ্ঞানকাণ্ডে বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বোধ ও বুদ্ধিকে, তখন সেখানে এই বোধ ও বুদ্ধির আধার, মনের তাৎপর্য সবচেয়ে বেশি। অন্নকে সেই মনের উৎপাদক বলে তার গরিমা বাড়ানো হয়েছে, যেখানে উপনিষদে এর বিপরীতটাই প্রত্যাশিত ছিল। অথচ বারেবারেই দেখছি উপনিষদে অন্নের মাহাত্ম্য নানা ভাবেই ঘোষিত হয়েছে:

আরুণির পুত্র ছিল শ্বেতকেতু, তাঁকে পিতা বললেন, ‘তুমি (গুরুগৃহে) বাস করে ব্রহ্মচর্য পালন কর, সোম্য, আমাদের বংশে বেদাভ্যাস না করে ব্রহ্মবন্ধু (যে ব্রাহ্মণের অব্রাহ্মণোচিত আচার) হয় না। সে বারো বছর বয়সে (গুরুগৃহে) গিয়ে চব্বিশ বছর বয়সে সমস্ত বেদপাঠ শেষ করে গম্ভীর, বেদজ্ঞানে অহংকারী ও অবিনয়ী হয়ে ফিরে এল। পিতা তাঁকে বললেন, ‘সোম্য, তুমি ত গম্ভীর, বেদাভিমানী ও অবিনয়ী হয়েছ।[১]
তার সঙ্গে কিছু শাস্ত্রালাপের পরে আরুণি এক দিন তাকে বললেন, ‘সোম্য, পুরুষের মধ্যে ষোলোটি কলা (অংশ) আছে, তুমি পনেরো দিন কিছু খেয়ো না, কিন্তু যত ইচ্ছা জল পান কোরো, প্রাণ জলময় (অর্থাৎ জলনির্ভর), (তাই) যে জল পান করে তার প্রাণ যায় না।’ শ্বেতকেতু পনেরো দিন আহার করল না, পরে ষোলো দিনের দিন সে পিতার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবা আমি কী বলব?’ আরুণি তাকে বললেন, ‘ঋক্, যজু ও সামগুলি উচ্চারণ কর।’ শ্বেতকেতু বললেন, ‘বাবা, ও-গুলি ত আমার মনে পড়ছে না।’ তখন আরুণি তাকে বললেন, ‘বড় একটা জ্বলন্ত আগুনের যদি সামান্য একটি অঙ্গারমাত্র অবশিষ্ট থাকে, তা হলে তা দিয়ে তার চেয়ে বড় কিছু জ্বালানো যায় না। তোমার ষোলো কলার মধ্যে এখন মাত্র একটি কলাই অবশিষ্ট আছে, তার দ্বারা তুমি বেদগুলি আর অনুভব করতে পারছ না। তুমি গিয়ে আহার কর, পরে আমার সব কথা বুঝতে পারবে।’ শ্বেতকেতু আহার করে আবার বাবার কাছে গেলেন। (তখন) পিতা তাঁকে যা কিছু জিজ্ঞাসা করলেন সে তার সব কিছুরই ঠিক উত্তর দিতে পারল। তখন পিতা তাকে বললেন, ‘সেই প্রজ্বলিত বৃহৎ অগ্নির জোনাকির মতো মাত্র একটি কণা অবশিষ্ট ছিল। তাকে যদি খড়কুটো দিয়ে জ্বালিয়ে তোলা যায় তা হলে (তখন) তার দ্বারা তার চেয়েও বড় বস্তুও পোড়ানো যায়। হে সোম্য, তোমার (অনাহারে) ষোলো কলার মধ্যে একটি মাত্র কলা বাকি ছিল। অন্ন-সংযোগে সেই (ক্ষীণ) কলাটি এখন জ্বলে উঠেছে, তার দ্বারা (তুমি) এখন বেদগুলি উপলব্ধি করছ। অতএব, সোম্য, মন অন্নময়, প্রাণ জলময় এবং বাক তেজোময়।’ পিতার কথায় শ্বেতকেতু এটা বুঝতে পারলেন।[২]

উপবাসের পনেরো দিনে শ্বেতকেতু শুধু জলপান করেছিলেন তাই প্রাণটুকু অবশিষ্ট ছিল, এই জন্যে প্রাণ জলনির্ভর। বেদ উচ্চারণ করবার জন্যে প্রয়োজন বাক্, বাক্ তেজনির্ভর, এই তেজ উপবাসে নির্বাপিত-প্রায় হয়েছিল, উপযুক্ত ইন্ধনে পুনরায় তেজ উদ্দীপিত হলে বেদবাক্য উচ্চারণ করা সম্ভব হল। কিন্তু বাক্য উচ্চারণ করবে তো মন, সেই মন উপবাসে স্তিমিত, নিস্তেজ ও অন্তর্হিতপ্রায় হয়েছিল। সে মন পুনর্জীবিত না হলে বাক্য, বেদবাক্য, আবৃত্তি করবে কে? আর মন কিসে উজ্জীবিত হয়? অন্নে। উপবাসে যে জ্ঞান বিলুপ্তপ্রায় হয়েছিল, অন্ন তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করল মনকে সঞ্জীবিত করে।

এখানে দুটি ব্যাপার প্রণিধান করে দেখা প্রয়োজন। প্রথমেই আরুণি শ্বেতকেতুকে বলছেন, আমাদের বংশে সকলেই বেদচর্চা করে, অবেদজ্ঞ কেউ নেই, অতএব তুমিও যাও গুরুগৃহে বেদপাঠ কর। বারো বছরের শ্বেতকেতু গুরুগৃহে বারো বছর ধরে সমস্ত বেদ পাঠ করল, আয়ত্ত করল। ফিরল বেদজ্ঞানের দম্ভ নিয়ে। পিতা জানেন, এ দম্ভ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে মানায় না। অতএব এ দন্ত দূর করতে হবে। শ্বেতকেতুর দম্ভের ভিত্তি তার বেদজ্ঞান, সে জানে বেদ সে আয়ত্তে করেছে; আরুণি তাকে বোঝাতে চাইলেন যে বেদ আয়ত্ত করলেও তা আয়ত্তে থাকে না। হাতছাড়া হয়ে যায়, অর্থাৎ মন থেকে হারিয়ে যায় যদি মনের যা প্রধান উপাদান, যার ওপরে মনের ভিত্তি তা থেকে সে বঞ্চিত হয়। তাই শ্বেতকেতুকে উপবাস করিয়ে দেখালেন, সুদীর্ঘ বারো বছর ধরে যা সে আয়ত্ত করেছে বলে তার এই দম্ভ, সেটাও সম্পূর্ণতই অন্ন নির্ভর। বারো বছরের সাধনার ধন মাত্র পনেরো দিনের অনাহারে মন থেকে সম্পূর্ণ উবে গেল। এবং যথাযথ আহার করার পরে আবার তা মনে সম্যক্ ভাবে প্রতিভাত হল। অতএব জ্ঞান মন-নিষ্ঠ এবং মন অন্ননির্ভর; অন্নাভাবে জ্ঞান বিলুপ্ত হয়, প্রয়োজনীয় আহারের দ্বারাই মন তাকে ধারণ করতে পারে। যে বেদজ্ঞান প্রবল ভাবে প্রজ্বলিত অগ্নির রূপে তার মনে ষোলো কলায় বিরাজ করছিল, পনেরোটা দিনের উপবাসে তার ক্ষীণ একটি মাত্র কলা অবশিষ্ট রইল, অর্থাৎ আর কদিন উপবাসে দেহই ধ্বংস হত, এবং যেহেতু দেহাভ্যন্তরের মনই জ্ঞানের আধার, তাই দেহনাশে জ্ঞানও নিরবলম্ব হয়ে বিলুপ্ত হত। সেই একটিমাত্র ক্ষীণ কলাকে নেহাৎ স্থূল পুষ্টি, অন্ন দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করার পর বারো বছরের অধীত বিদ্যা আবার মনে উদিত হল।

উপনিষদ বৈদিক যুগের শেষ ভাগের জ্ঞানকাণ্ডের অন্তর্গত; শুধু তাই নয়, বেদের অন্তর্ভাগ বলে ‘বেদান্ত’ এবং পরবর্তী কালে বেদের শ্রেষ্ঠ উৎকর্ষের প্রতীক বলে স্বীকৃত। এ যুগে আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদের উপলব্ধিই সাধনার বস্তু; অধ্যাত্মচর্চার যুগ এটা। কঠোপনিষদে নচিকেতা যমের প্রস্তাবিত সমস্ত ঐহিক সুখকে প্রত্যাখ্যান করেছে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্যে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দু’বার একটি উপাখ্যান বিধৃত হয়েছে, সেখানে মৈত্রেয়ী যাজ্ঞবন্ধ্যের দেওয়া বিপুল সম্পত্তির অর্ধাংশ লাভের সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন অধ্যাত্মবিদ্যা লাভের আশায়। এই সেই যুগ যখন এক দিকে মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ, আরও বহুতর সন্ন্যাসীদের সম্প্রদায় যজ্ঞকে, বেদকে অস্বীকার করে জ্ঞানকে অবলম্বন করে মোক্ষের বা পুনর্জন্মের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবার সাধনা করছেন। সেই যুগে ব্রাহ্মণ্যধারার শাস্ত্র উপনিষদ, জ্ঞানের আধার মনকে স্থূল বস্তুনিষ্ঠ, অন্ননির্ভর বলে প্রতিপন্ন করছে। উপনিষদের আত্মজ্ঞান তত্ত্বনির্ভর, কিন্তু সে জ্ঞান উদিত হয় যে-মনে, সে-মন যে কোনও জ্ঞানকেই ধারণ করে থাকুক তা দেহে আবৃত এবং দেহ অন্নের দ্বারা পুষ্ট হলে তবেই জ্ঞান তার মধ্যে প্রজ্বলিত থাকতে পারে। আগেই বলেছি, অন্নের এই মাহাত্ম্য উপনিষদে ঘোষিত হওয়া খানিকটা বিস্ময় সৃষ্টি করে।

আরুণি শ্বেতকেতুর সংলাপে অন্যত্র এক জায়গায় একবার আরুণি জলকে অশনায়া বলে তার পরেই বলছেন ‘অন্ন ছাড়া আর কী মূল হতে পারে, তাই সোম্য, এই প্রকারে অন্নের মূল দিয়ে জলের মূল খোঁজ কোরো— তস্য ক্ব মূলং স্যাদন্যত্রান্নাদেবমেব খলু সোম্যান্নেন শুঙ্গেনাপো মূলমন্বিচ্ছ।’ (ছা/উ; ৬:৮:৪)

আমাদের মনে পড়ে আরুণি যখন শ্বেতকেতুকে পনেরো দিন উপবাস করতে বলেন তখন বলেছিলেন, ‘যত ইচ্ছা জল পান কোরো, তাতে জীবনরক্ষা হবে।’ আরুণি এখানে কতকটা ব্যুৎপত্তিগত কষ্টকল্পনাতে এর পূর্ব অংশে অশনায়া মানে জল নিষ্পন্ন করলেন, কিন্তু ঠিক তার পরে পরেই বললেন অন্নের মূল দিয়ে জলের মূলের খোঁজ কর। অর্থাৎ কেবলমাত্র জলপানের দ্বারাও অনির্দিষ্টকাল প্রাণরক্ষা হয় না, অন্ন সম্পূর্ণ অপরিহার্য, তাই অন্নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে জলের খোঁজ কোরো। এখানেও অন্নের মহিমা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘অশনায়াপিপাসে’ ক্ষুধাতৃষ্ণাকে মৃত্যু বলে অভিহিত করা হয়েছে বারবার। তাই ব্যুৎপত্তি দিয়ে অশনায়াকে জলের সঙ্গে যুক্ত করলেও পিপাসার স্বতন্ত্র স্থান পূর্ব হতেই নির্দিষ্ট হয়ে আছে, যেমন অশনায়া বা ক্ষুধারও স্বতন্ত্র তাৎপর্য আছে।

এই ছান্দোগ্য উপনিষদেই ‘অন্নব্রহ্ম’ পরিচ্ছেদে নারদ-সনৎকুমার সংলাপে এক জায়গায় পড়ি :

বল থেকে অন্ন অবশ্যই শ্রেষ্ঠ। এই কারণে কেউ যদি দশ দিন না খেয়ে থাকে তা হলে যদিও বা সে (কোনও রকমে) বেঁচে থাকে তবু সে দৃষ্টিহীন, শ্রুতিহীন, মননহীন, বোধহীন, ক্রিয়াহীন ও বিজ্ঞানহীন (বিশেষ-জ্ঞান-রহিত) হয়। আবার (যখন) অন্ন আহার করে (তখন) তার দৃষ্টি, শ্রুতি, মনন, বুদ্ধি ও ক্রিয়া আসে এবং বিজ্ঞানও আসে। অন্নকে উপাসনা কর। যে কেউ অন্নকে ব্রহ্ম বলে উপাসনা করেন, তিনি এমন সব ‘লোক’ (স্থান) লাভ করেন যেখানে প্রচুর পরিমাণে অন্ন ও পানীয় আছে। অন্নের যতদূর গতি তাঁরও ততদূর স্বচ্ছন্দ গতি হয়।[৩]

এখানে প্রথমে বলা হয়েছে, অন্নের অভাবে দশ দিনের উপবাসে মানুষের বহিরিন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় কী ভাবে নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। তার দর্শন, শ্রবণ, মনন, বোধ, ক্রিয়া ও বিশেষ জ্ঞানের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। অর্থাৎ যে সব বিশেষ শক্তি মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে ‘মানুষ’ সংজ্ঞায় অভিহিত হওয়ার অধিকার দেয়, যে-অধিকারবলে সে ব্রহ্মজ্ঞানচর্চার ক্ষমতা পায় এবং জন্মান্তরধারা রোধ করার ব্যবস্থা করতে পারে সেই সব ক্ষমতাই দশ দিন অনাহারে তিরোহিত হয়। আবার ভাল করে আহার করার পরে ধীরে ধীরে সে সব ক্ষমতা ফিরে আসে। অতএব ‘অন্নকে উপাসনা কর।’ যিনি অন্নকে ব্রহ্ম বলে উপাসনা করেন তাঁর এমন সব স্থানে অধিকার জন্মায় যেখানে প্রচুর পরিমাণে অন্ন ও পানীয় আছে; অন্নের সীমা বা গতি যত দূর পর্যন্ত তাঁরও গতি তত দূর পর্যন্ত। অর্থাৎ তিনি যেখানেই থাকুন তাঁর কখনওই অন্নজলের অভাব হবে না। কার এই সৌভাগ্য? যিনি অন্নকে ব্রহ্ম বলে জানেন এবং সে ভাবে উপাসনা করেন। স্মরণীয়, এই পরিচ্ছেদটির নামই হল ‘অন্নব্রহ্ম’। এ অংশের দুটি ভাগ: প্রথমটিতে দেখানো হয়েছে শ্বেতকেতুকে আরুণি যা বুঝিয়েছিলেন অর্থাৎ অন্নাভাবে ইন্দ্রিয়গুলি— বহিরিন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় দুইই— সম্পূর্ণ অসহযোগ করে; তারা যেন থেকেও নেই। অথচ ধর্মসাধনার এই পর্যায়ে যে ব্রহ্মজ্ঞান পুনর্জন্ম খণ্ডন করার জন্যে অপরিহার্য, তার আধার হল মন, এবং মন আশ্রিত থাকে ওই ইন্দ্রিয়গুলির ওপরে। এবং এই অংশে দেখানো হল ইন্দ্রিয়গুলি সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল খাদ্যের ওপরে। তা হলে প্রকারান্তরে উপনিষদের কেন্দ্রবস্তু যে ব্রহ্মজ্ঞান তা-ও একান্তরিত হয়ে নির্ভরশীল হয়ে উঠল অন্নের ওপরে, যেহেতু অন্ন বিনা সকল ইন্দ্রিয়ই নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, মনও বিকল হয়ে যায় এবং সে-অবস্থায় শ্বেতকেতু পনেরো দিন অনাহারের পরে বারো বছরে শেখা বেদজ্ঞান মনেই আনতে পারে না, নতুন করে ব্রহ্ম ও আত্মার একাত্মতা উপলব্ধি করা তো দূরের কথা। আবার অন্ন গ্রহণের পরে ইন্দ্রিয়গুলির সকল ক্ষমতাই ফিরে আসে। এখানে অন্নের সঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞানের সংযোগ প্রায়োগিক ভাবে দেখানো হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে এই উপলব্ধির যে সিদ্ধান্ত সেইটিই উপস্থাপিত করা হয়েছে: এই-ই যখন সম্বন্ধ অন্নের সঙ্গে ব্রহ্মজ্ঞানের, তখন তো অন্নই ব্রহ্ম। যে ব্যক্তির এই দৃষ্টি এসেছে, যে জেনেছে যে অন্ন বিনা অধ্যাত্মচর্চা করা শুধু দুষ্কর নয়, একান্তই অসম্ভব, সে অন্নকে ব্ৰহ্ম জেনে উপাসনা করে। যজ্ঞেও ছিল কর্মকাণ্ডের উপাসনা; তার ফল ছিল ঐহিক সুখের জন্যে কাম্যবস্তু লাভ করা। এবারে অন্নকে ব্রহ্ম জেনে যে উপাসনা, তা যজ্ঞের মতো অনুষ্ঠাননির্ভর কোনও যাগ নয়, তা হল একটা উপলব্ধি: অন্নই ব্রহ্ম। এ উপলব্ধির একটা বহিঃপ্রকাশ আছে; তা হল অন্ন সম্বন্ধে চূড়ান্ত সম্ভ্রমবোধ। সকল দেবতার ওপরে যেমন ব্রহ্মের অধিষ্ঠান, তেমনই পার্থিব বস্তুর সব কিছুরই ওপরে অন্নের স্থান। এ কথা মনে থাকলে মানুষ অন্ন উৎপাদনে তৎপর হবে, সংরক্ষণে উদ্যোগী হবে, অপচয়ের সম্ভাবনা রোধ করবে, দানও করবে নিজের প্রয়োজনের উপযোগী অন্ন সুরক্ষা করার পরে। সংক্ষেপে, সংসারে শ্রেষ্ঠ দেবতার যে সম্মান প্রাপ্য অন্নের প্রতিও যেন মানুষের সেই সম্মান থাকে।

এই ধরনের সতর্কবাণী অন্যত্রও উচ্চারিত হয়েছে। কেন? স্পষ্টতই অন্নের সামাজিক গুরুত্ব সম্পর্কে সকলে অবহিত ছিল না। যে বছর ভাল ফসল হত, সে বছর ফেলে-ছড়িয়ে খাওয়া হত, ফলে খরা-অজন্মার বছরে টান পড়ত। তা ছাড়া, উদ্বৃত্ত অন্ন বণিকের পণ্য হয়ে উঠত, দেশের অভুক্ত মানুষ নিরন্নই থেকে যেত। পরিশ্রমে উৎপাদন করা অন্নকে জীবনদায়ী বলে লোকে এমনিই জানত, কিন্তু স্পষ্টতই যে সম্ভ্রম থাকলে প্রতি কণা শস্য সম্বন্ধে একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত মমত্ববোধ থাকে তা ছিল না। তাই অন্নের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক গুরুত্ব প্রতিপাদন করবার জন্যে অন্নকে, তখনকার শব্দকোষে যেটি শ্রেষ্ঠ অভিধা— ব্রহ্ম— তাই দিয়ে অভিহিত করা হল। মানুষ যেন মনে রাখে, যে-দেহে মনের অধিষ্ঠান, ইন্দ্রিয়গুলি যাতে সংস্থিত, যে-দেহ তার জীবিকার উপাদান জোগায়, যে-মন তার অভীষ্ট ব্রহ্মতত্ত্বকে অনুধাবন করতে সচেষ্ট সে-দেহমন একান্ত ভাবেই অন্ননির্ভর। এই অন্নকে ব্রহ্ম নাম দিলে অন্ন সম্বন্ধে সমাজে একান্ত প্রয়োজনীয় মানসিকতা— সমীহ, সম্ভ্রম, যত্ন, তার বৃদ্ধিপ্রয়াস— এগুলি আসবে, নতুবা অন্ন তার যথার্থ মর্যাদা না পেলে অন্নের প্রতি অবজ্ঞা, অযত্ন উপেক্ষা অন্নের অভাবকেই বাড়িয়েই তুলবে। অর্থাৎ এখনও সমাজে অন্নের জোগান সম্বন্ধে কোনও নিশ্চয়তা নেই। আরও লক্ষ করি, এখানে মহিমার একটা সংজ্ঞা হল, ‘যে সব কিছু খায়’। অর্থাৎ বহুভোজিত্ব বা সর্বভোজিত্ব মহিমার একটা মানদণ্ড। তখনকার সমাজে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার ও সম্মানের একটা ভিত্তি যে ছিল অন্নের প্রাচুর্য, এ আমরা আগেও দেখেছি। এই সংজ্ঞা উচ্চারণ করার পর কাপেয় শৌনক ভৃত্যদের নির্দেশ দিলেন ব্রহ্মচারীকে অন্ন দিতে। ছোট উপাখ্যানটির শুরুতেই এ ব্রহ্মচারী ভিক্ষা চেয়ে না পেয়ে বলেছিলেন, ‘এ অন্ন যার জন্যে, তাকেই এটা দেওয়া হল না।’ স্পষ্টতই সে বলতে চায়, বুভুক্ষু যদি অন্ন না পায় তা হলে অন্নবানের অন্নসম্পদ ব্যর্থ। আবার দেখি, মনস্বী ব্রহ্মচারী, যে তত্ত্বজ্ঞানে কাপেয় শৌনক বা কাক্ষসেনি অভিপ্রতারীর চেয়ে কোনও অংশে ন্যূন নয়, সে নিরন্ন, অন্নভিক্ষা করে; এবং অন্নবান ব্রহ্মজ্ঞরা তাকে বিমুখ করে, অন্ন দেয় না। পরে যখন কাপেয় শৌনক পরমাত্মার সংজ্ঞা নিরূপণ করেন এই বলে যে, তিনি সর্বভোজী তখন তাঁর খেয়াল হয় অন্নভোজিত্বের ওপরে এই যে মর্যাদা আরোপ করা হচ্ছে তার সঙ্গে অন্নপ্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করার কোথাও যেন একটা অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে। তখন সে অনুচরদের ব্রহ্মচারীকে অন্ন দিতে বলে। তা হলে এ সমাজে রৈক্ব’র মতো পণ্ডিত ব্রাহ্মণ অপুষ্টিতে ভোগে, বিদ্বান ব্রহ্মচারী এমন দুজনের কাছে ভিক্ষা চায় যারা তাকে অন্ন দিতে সমর্থ, কিন্তু প্রথমেই তার অন্নভিক্ষা প্রত্যাখ্যান করে। এ সমাজে সকলে খেতে পায় না। গুণী, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, তত্ত্বজ্ঞানীও অভুক্ত থাকে। কাজেই ব্যাপক একটা অভাবের কালো পর্দা সব কিছুর পশ্চাতে দোদুল্যমান ছিল। সারা সমাজে একটা কালো অন্নাভাবের আতঙ্ক পরিব্যাক্ত ছিল।

ছান্দোগ্য উপনিষদে পঞ্চম অধ্যায়ের প্রথম খণ্ডে ইন্দ্রিয়, বাক, চক্ষু, কর্ণ, মন এ সকলের উপরে প্রাণকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে— প্রাণের অধীনে দেহের সব ইন্দ্রিয় কাজ করে। তার পরের খণ্ডে শুনি, প্রাধান্য স্বীকৃত হবার পর প্রাণ প্রশ্ন করছে, ‘আমার খাদ্য কী হবে?’ উত্তরে ইন্দ্রিয়রা বলে, ‘কুকুর ও শকুনি ইত্যাদি সর্ব জীবের যা কিছু অন্ন আছে।’ যা কিছু খাওয়া হয় সবই ‘অন’-এর অন্ন, ‘অন’শব্দটি প্রাণের প্রত্যক্ষ (= সাক্ষাৎ) নাম। ‘যে এ ভাবে জানে তার কাছে কোনও অন্নই অনন্ন হয় না— স হোবাচ কিং মেহন্নং ভবিষ্যতীতি যৎ কিঞ্চিদাশ্বভ্য আশকুনিভ্য ইতি হোচুস্তদ্বা এতদনস্যান্নমনো হ বৈ নাম প্রত্যক্ষং না হ বা এবং বিদি কিঞ্চনানন্নং ভবতীতি।’(৫:২:১) এখানে লক্ষণীয় ‘অন’ (= প্রাণ, প্র + অন)-এর খাদ্য কুকুর থেকে শকুনি পর্যন্ত সব কিছুই। বলাই বাহুল্য, কুকুর বা শকুনি কোনওটাই খাদ্যপদবাচ্য নয়, সহজ অবস্থায় মানুষ এগুলো খায় না। তবে কেন এ দুটো প্রাণীর উল্লেখ? লক্ষ করতে হবে, কোন প্রশ্নের উত্তরে এ কথা; প্রশ্ন করছে প্রাণ, বলছে ‘আমার খাদ্য কী হবে।’ অর্থাৎ প্রাণধারণের জন্যে মানুষ কী খাবে। উত্তরে স্বাভাবিক প্রচলিত খাদ্যের নাম না করে বলা হচ্ছে এমন দুটো প্রাণীর মাংসের কথা যারা স্বভাবত জুগুপ্সা উৎপাদন করে। উদ্দেশ্য হল এই কথা বলা যে, প্রাণধারণের প্রশ্ন যখন তীক্ষ্ণ আকার ধারণ করে, তখন আর বাছাবাছি চলে না; কুকুর-শকুনির মাংস খেয়েও প্রাণরক্ষা করতে হবে। চোখে পড়ে, প্রাণরক্ষার জন্যে শস্যের কথা বলা হচ্ছে না, মাংসের কথাই বলা হচ্ছে। অর্থাৎ, সময়টা শস্যের ঘাটতির সময়, খরা অজন্মা ইত্যাদিতে তখন দুর্ভিক্ষ, যখন দেশে ফসল নেই, তখন প্রাণরক্ষার জন্যে পথের কুকুর ধরে বা আকাশের শকুনি শিকার করেও বাঁচতে হবে। এ সব কথা থাকতই না যদি না দুর্ভিক্ষ একটা সুপরিচিত ঘটনা হত। মনে পড়ে আক্কাদীয় সাহিত্যে পড়ি ‘গম পচা হলেও আমি তা খাই। বীয়ার— (আহ্) স্বর্গীয় জীবন! আমি পরিহার করতে বাধ্য হয়েছি। (দারিদ্রের) এ যাতনা নিদারুণ দীর্ঘ হয়েছে।

বৈদিক সাহিত্যে দুর্ভিক্ষের উল্লেখ আছে, কিন্তু বর্ণনা বা বিবরণ নেই। যখন ভিক্ষা মেলে না তখন দুর্ভিক্ষ— এই অর্থেই দুর্ভিক্ষ বোঝা যায়। নানা কারণে দুর্ভিক্ষ হতে পারে; তার মধ্যে খরার অজন্মা একটি। এই খরাজনিত দুর্ভিক্ষ প্রাচীন মিশরে পর পর সাত বছর হয়। তার একটি বর্ণনা পাই— ‘ফসল নেহাৎ কম, ফলগুলো সব শুকিয়ে গেছে, যা কিছু মানুষ খেত তা দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। প্রত্যেক মানুষ তার সহচরের (ঘরে) চুরি করছিল… শিশুরা আর্তনাদ করছে। যুবকরা প্রতীক্ষা করছে, বৃদ্ধদের হৃদয় বিষাদে ভরা, তাদের পা গুলো বেঁকে গেছে, মাটিতে দুবড়ে পড়েছে, তাদের হাতগুলো জোড় করা। দেশগুলো অভাবে আচ্ছন্ন, মন্দিরগুলো বন্ধ; মঠে দেউলে বাতাস (ছাড়া কিছুই নেই)। সব কিছুই ফাঁকা হয়ে গেছে।

এমনই এক দুর্ভিক্ষের উপাখ্যান পাই ওই ছান্দোগ্য ব্ৰাহ্মণেই :

‘কুরুদেশ’-এ যে বার শিলাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়েছিল, তখন হাতির মাহুতদের গ্রামে, কিশোরী ভার্যার সঙ্গে বাস করতেন অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত উষস্তি চাক্রায়ণ। তিনি এক মাহুতকে নষ্ট-হয়ে-যাওয়া মাষকলাই খেতে দেখে ভিক্ষা চাইলেন। (সে লোকটি) বলল, ‘এই-যে-কটা আমার পাত্রে ঢালা আছে তা ছাড়া আমার তো আর নেই।’
‘ঐগুলো থেকেই আমাকে দাও’ সে ওগুলি তাঁকে দিল, আর বলল, ‘চাইলে এই যে জল আছে (তা-ও নিন)।’
(তিনি) বললেন, ‘তাহলে তো আমার উচ্ছিষ্ট খাওয়া হয়ে যাবে।’
(মাহুতটি) বলল, ‘মাষকলাইগুলোও কি উচ্ছিষ্ট ছিল না?’
(উষস্তি) বললেন, ‘ওগুলো না খেলে বাঁচতেই পারতাম না, পানীয় জল তো আমি যেখানে ইচ্ছা খেতে পারি।’
তিনি খেয়ে উদ্বৃত্তটুকু স্ত্রীর জন্যে নিয়ে এলেন। স্ত্রীটি আগেই ভাল ভিক্ষা পেয়েছিল, (তাই) ওইগুলো নিয়ে রেখে দিল। সকালে উঠে (উষস্তি চক্রায়ণ) বললেন, ‘যদি খানিকটা খাদ্য পেতাম, কিছু ধন লাভ করতাম। ওই রাজা যজ্ঞ করবেন, তিনি আমাকে সমস্ত ঋত্বিকের কাজে বরণ করতেন।’
তাঁকে স্ত্রী বললে, ‘স্বামিন্, তা যদি হয়, তবে (তোমার দেওয়া) সেই নষ্ট মাষকলাইগুলো রয়েছে।
(উষস্তি) সেগুলো খেয়ে সেই আয়োজিত যজ্ঞে গেলেন।[৬]

উষস্তি চাক্রায়ণ যজ্ঞস্থলে গিয়ে দেখেন যে যজ্ঞ আরম্ভ হয়েছে। সামবেদের গানের যে চারজন পুরোহিত উদ্‌গাতা, প্রস্তোতা, প্রতিহর্তা, সুব্রহ্মণ্য, এঁদের মধ্যে প্রথম তিন জনকে উষস্তি বললেন, ‘তোমরা যাঁর স্তব করছ তাঁকে যথার্থ ভাবে না জেনে যদি স্তব কর তাহলে তোমাদের মাথা খসে পড়বে।’ এই কথা শুনে যজমান (যিনি যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন) উষস্তিকে বললেন, মহাশয়, আমি আপনার পরিচয় জানতে চাই। পরিচয় দিলে যজমান বললেন, ‘আমি আপনারই খোঁজ করছিলাম আমার ঋত্বিক কর্মের জন্য; না পেয়ে এঁদের নিযুক্ত করেছি, এখন সমস্ত ঋত্বিক-কর্মের জন্য আপনাকেই বরণ করছি।’ উষস্তি সম্মত হয়ে বললেন, ‘আমার অনুমতি নিয়ে এঁরাই যজ্ঞক্রিয়া সম্পাদন করুন, কিন্তু এঁদের যে পরিমাণ ধন দেবেন, আমাকেও ততটাই দেবেন।’ যজমান বললেন, ‘তাই হবে’। এর পর উষস্তি প্রস্তোতা, উদ্‌গাতা ও প্রতিহতাকে প্রশ্ন করলেন তাঁরা কোন কোন দেবতার স্তব করছেন। তাঁরা অজ্ঞতা নিবেদন করলে উষস্তি যথাক্রমে প্রস্তোতাকে বললেন, ‘প্রাণই সেই দেবতা’, উদগাতাকে বললেন ‘আদিত্যই সেই দেবতা।’ পরে প্রতিহতাকে বললেন, ‘অন্নই (সেই দেবতা), সৃষ্টির সকল প্রাণী অন্নকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে জীবনধারণ করে। সেই অন্ন-দেবতাই প্রতিহারের দেবতা— অন্নমিতি হোবাচ সর্বাণি হ বা ইমানি ভূতান্যন্নমেব প্রতিহরমাণানি জীবন্তি।’ (ছা/উ; ১:১১:৯)

এইখানে কাহিনির প্রথম অংশের সঙ্গে সংগতি খুঁজে পাওয়া যায়। অন্নাভাবে ক্লিষ্ট ব্রাহ্মণ সে দিন সকালে স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘কিছু খেতে পেলে ওই যজ্ঞে পৌরোহিত্য পেতাম, কিছু ধনলাভ করতে পারতাম।’ তিনি যজ্ঞস্থলে আসতেই পারতেন না চণ্ডালের এঁটো মাষকলাইয়ের বাসি উদ্বৃত্তটুকু না খেতে পেলে। অন্ন তার কদর্যতম চেহারায় এসেছিল উষস্তির সামনে, কিন্তু মর্মান্তিক যন্ত্রণায় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, প্রাণরক্ষার উপাদান হিসেবেই অন্নকে দেখতে হবে, জুগুপ্সাকে জয় করে হীনতম অন্নেও জীবনরক্ষা করতে হবে। মনে পড়ে, কুকুর বা শকুনির মাংসকেও প্রাণরক্ষার উপাদান হিসেবে শাস্ত্র সমর্থন করেছে। কাজেই এই উষস্তির দৃষ্টিতে যজ্ঞে প্রধান উপাস্য দেবতা যে হবে প্রাণ এবং তাকে টিকিয়ে রাখার প্রধান উপাদান যে হবে অন্ন তাতে আর আশ্চর্য কী। আদিত্য অর্থাৎ সূর্য জমিতে ফসল ফলাবার এক অপরিহার্য অধিদেবতা। তাই উষস্তির তত্ত্বসমাধানে দেবরাজ ইন্দ্র বা ব্রাহ্মণ্যের প্রতীক অগ্নি বা বৃহস্পতি, পরমাত্মা এঁদের স্থান নেই। জীবনের ভিত্তি প্রাণ, তাকে জীইয়ে রাখার জন্যে ফসল ফলানোর অধিদেবতা আদিত্য এবং জীবনরক্ষার একান্ত অপরিহার্য উপাদান অন্ন- এই তিনটিই প্রাধান্য পেল উষস্তির ব্যাখ্যানে। লক্ষ করি, উষস্তির এই উত্তরের সঙ্গে কোনও যুক্তি বা কারণ নির্দেশ নেই। কেন যে তিনি, প্রাণ, আদিত্য, ও অন্নকে প্রধান দেবতার স্থান দিলেন তার কোনও যুক্তি দিলেন না। ফতোয়ার মতো করেই বললেন, এবং আগের ঋত্বিকরা তা মেনেও নিলেন। অর্থাৎ উপনিষদ এই তত্ত্ব— অন্নের মাহাত্ম্য ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা— করতে চায় এবং তা করছে উপবাসক্লিষ্ট কদর্য খাদ্য দিয়ে কোনও রকমে উদরপূর্তি করে যজ্ঞে এসেছে এমন এক ব্রাহ্মণের বাণী দিয়ে। ভূমিকায় দুর্ভিক্ষের চূড়ান্ত প্রকোপ চিত্রিত করবার পরে বুভুক্ষু ব্রাহ্মণের মুখে অন্নকে প্রধান দেবতা বলে চিহ্নিত করে উপনিষদই এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করল।

এখানে আরও একটা ব্যাপার চোখে পড়ে। যজমানের কাছে উষস্তির শর্ত ছিল অন্য পুরোহিতদের যত দক্ষিণা তিনি দেবেন উষস্তিকে ততটা অর্থাৎ তিনজনের মিলিত দক্ষিণার সমপরিমাণ ধন তাঁকে দিতে হবে, কারণ যজমান তাঁকে ওই তিন পুরোহিতদের স্থলে নিযুক্ত করেছেন। দক্ষিণায় খাদ্য, বস্ত্র, স্বর্ণ, পশু ও দাসদাসী দেওয়ার বিধান ছিল। কিন্তু দক্ষিণার খাদ্য ত খেলেই ফুরিয়ে যাবে, হয়তো সংরক্ষণ করবার মতো কিছু শস্যও পাওয়া যেত, কিন্তু দরাদরির সময়ে শুনি ধনের কথা। তার মানে ওই মারাত্মক দুর্ভিক্ষের দিনেও বেশি দাম দিয়ে খাবার কেনা যেত, অর্থাৎ এখনকার ভাষায় খাদ্যের ‘কালোবাজার’ ছিল। তখন সেই ফসলের আকালের দিনেও যজমান যজ্ঞ করছেন, অর্থাৎ অন্তত সতেরো জন পুরোহিতকে রোজ দু’বেলা খাওয়াচ্ছেন এবং পুরোহিত ছাড়াও যজ্ঞে যে নানা রকম সাহায্যকারী দরকার হত, তাদেরও খাওয়াচ্ছেন। উষস্তির স্ত্রী ভিক্ষা পেয়েছিলেন, কাজেই ভিক্ষা দেওয়ার মতো উদ্বৃত্ত খাদ্য কোনও কোনও পরিবারে ছিল এবং টাকা বা ধনের বিনিময়ে ওই দুর্ভিক্ষের দিনেও কোনও কোনও মজুতদারের কাছে খাবার কেনা যেত। চিত্রটা ব্যাপক খাদ্যাভাবের কিন্তু তারই মধ্যে দুর্নীতি ও কালোবাজারও চালু ছিল। আবার এমন সদাশয় অন্নবান ব্যক্তিও কদাচিৎ পাওয়া যেত যারা উষস্তির কিশোরী বধূটিকে খাবার ভিক্ষা দিতেন। এমন অজন্মা বা দুর্ভিক্ষের সময়ে সাধারণ গরিব মানুষ, যারা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তারা অনেকেই খাদ্যাভাবে মারা যেত বা অখাদ্য খেয়ে অসুখে পড়ত। কেবলমাত্র উদ্বৃত্ত অন্নের অধিকারী মুষ্টিমেয় ধনীদের কাছেই ‘অশনায়াপিপাসে’, অর্থাৎ ক্ষুধাতৃষ্ণা, মৃত্যুর রূপ ধরে আসত না। বাকিরা দুর্ভিক্ষের দিনে কীটপতঙ্গের মতোই মারা যেত।

উষস্তি চাক্রায়ণের কাহিনির ঠিক পরেই ছান্দোগ্য উপনিষদে একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উপাখ্যান আছে তার নাম ‘শৌব উদ্‌গীথ’, অর্থাৎ ‘কুকুরদের সামগান’।

বক দালভ্য— দলভ্য ও মিত্রার ছেলে বক, ওরফে গ্লাব নামে এক ঋষি, বেদ অধ্যয়নের জন্যে গ্রাম থেকে নির্গত হলেন। তাঁর সামনে একটি সাদা কুকুর দেখা দিল। তার কাছে অন্য কুকুররা এসে বলল, ‘মহাশয়, আপনি গান করে অন্নের সংস্থান করুন, আমরা ক্ষুধার্ত। সেই শাদা কুকুরটি তাদের বলল, ‘কাল সকালে তোমরা এই জায়গাতেই আমার কাছে এস। পরদিন বক দালভ্য (মিত্রার পুত্র) গ্লাবও সেইখানে তাদের জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন। তখন (যজ্ঞে) বহিষ্পবমান স্তোত্র গানের সময়ে যেমন (সামবেদের স্তোতারা) পরস্পরের সংলগ্ন হয়ে (যজ্ঞভূমিতে) পরিক্রমা করেন, সেই রকম কুকুরগুলি (পরস্পরের লেজ ধরে?) প্রদক্ষিণ করল। তার পর বসে পড়ে হিংকার উচ্চারণ করল। ওম খাব, ওম পান করব, ওম দেবতা বরুণ, প্রজাপতি, সবিতা এখানে অন্ন আনুন, অন্নপতি! এখানে অন্ন আনুন।[৭]

এই উপাখ্যানটিতে কয়েকটি ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখা প্রয়োজন। শাদা কুকুর এক ধরনের আভিজাত্যের প্রতীক। ঋগ্বেদে প্রগার্যদের সম্বন্ধে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বারবার বলা হয়েছে তারা কৃষ্ণাঙ্গ; অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ আর্যরা উঁচু জাতের এমন ইঙ্গিত এতে আছে। এখানে ওই কুকুরটি পুরোহিতদের নেতৃস্থানীয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ। অন্য কুকুররা তার শরণাগত হয়ে বলে, ‘আপনি গান করে আহার আনুন।’ ছান্দোগ্য উপনিষদ সামবেদের অন্তর্গত; সামবেদের পুরোহিতরা যজ্ঞে গানই করে, সেই যজ্ঞের অন্তে খাদ্যলাভ ঘটে এমন বিশ্বাস এখানে উচ্চারিত। ‘বহিষ্পবমান’ স্তোত্র গাইবার সময়ে পুরোহিতরা ঝুঁকে নীচু হয়ে যজ্ঞস্থলে প্রবেশ করে, এবং পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকে। তার পর যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হলে পুরোডাশ্ ও যজ্ঞে বলিপ্রদত্ত পশুমাংসের ভাগ পায় তারা। এ ছাড়াও যজ্ঞ যদি অভীষ্ট ফল দেয় তো সকলের জন্যেই খাদ্য সংস্থান হয়। বহিষ্পবমান স্তোত্রগানের অনুকরণ করার পরে কুকুররা যে হিংকারধ্বনি উচ্চারণ করে তা এখানে রূপান্তরিত হয়েছে অত্যন্ত শাদামাটা কথায়; বরুণ, প্রজাপতি, সবিতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হচ্ছে, ‘আমরা খাব, পান করব, আমাদের জন্যে খাদ্য আনুন।’ বরুণ এ যুগে জলের অধিদেবতা, অতএব পিপাসা দূর করার জন্যে তাঁর কাছে প্রার্থনা বোঝা যায়। প্রজাপতি ব্রাহ্মণসাহিত্য থেকেই শস্যের, পশু ও মানুষের প্রজনিকা শক্তির অধিদেবতা, প্রজাকে পালন করতে শস্য ও পশুর যে কল্যাণ আবশ্যক, প্রজাপতি তার ব্যবস্থা করেন। আর ফসলের জন্যে, পশুর চারণভূমির উর্বরতার জন্যে যে সূর্যকিরণ প্রয়োজন সবিতা তার অধিদেবতা। সবিতা শব্দের অন্য অর্থ হল জন্মের অধিদেবতা (‘সূ’ ধাতুর অর্থ প্রসব বা জন্ম দেওয়া, সু + তৃচ = সবিতৃ → সবিতা)। কাজেই এই তিন দেবতার উদ্দেশ্যে খাদ্যপানীয়ের জন্যে প্রার্থনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

কাহিনিটি এই প্রার্থনাতেই শেষ, কুকুররা প্রার্থনার ফল পেল কিনা তা বলা হয়নি। যেমন ব্রাহ্মণসাহিত্যে সোমযাগে বহিষ্পবমান স্তোত্রের গান ও আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানই বর্ণিত আছে, যজ্ঞের ফললাভের কথা কিছু বলা নেই। এ উপনিষদ সামবেদের, এ বেদের পুরোহিতদের যজ্ঞে নির্দিষ্ট কর্ম হল গান গাওয়া। যজ্ঞ যদি খাদ্যসংস্থানের জন্য অনুষ্ঠিত হয়, তা হলে উদগাতা ও তার সহকারীদের ভূমিকা হল গান দিয়ে তাদের নির্দিষ্ট যজ্ঞকর্ম সম্পাদন করা, ‘বহিষ্পবমান’ অনুষ্ঠানটির শেষে হিংকার উচ্চারণ করার কথা। এখানে সি-হিংকার স্পষ্ট খাদ্য-প্রার্থনা। আমরা ক্ষুধার্ত, পিপাসিত, আমাদের ভোজন ও পানের ব্যবস্থা কর।’ সেই অশনায়াপিপাসে; এবং এখানে যে-শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ‘অশনায়াম’ তার সোজা মানে হল, ‘খিদে পেয়েছে।’ কুকুরদেরও খিদে পেলে তারা যজ্ঞ কর্মের নকল করে ক্ষুধার অন্ন সংগ্রহ করবার চেষ্টা করে, কারণ তখনকার সমাজ খাদ্য সংস্থানের ওই একটি উপায়ই জানত।

উষস্তি চাক্রায়ণের কাহিনির ঠিক পরেই এই ‘শৌব উদগীথ’— এ দুটি উপাখ্যানের পটভূমিকা একই: ব্যাপক খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষের চিত্র। প্রথমটিতে উষস্তি চণ্ডালের এঁটো, নষ্ট মাষকলাই খেয়ে যজ্ঞ করে পুরোহিতদের তত্ত্বশিক্ষা দিয়েছিলেন: অন্নই প্রধান দেবতা। সামবেদের পুরোহিতরা যে গান করছেন যজ্ঞে, সে গানের উদ্দিষ্ট দেবতা অন্ন। উষস্তি নিজে যজমানের সঙ্গে দরাদরি করে তিনজন পুরোহিতের দক্ষিণা নিজে যাতে পান সেই ব্যবস্থা পূর্বাহ্নেই করে রেখেছিলেন। বাড়ি থেকে বেরোবার আগেই মর্মান্তিক বুভুক্ষার নিষ্ঠুর রূপের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল, তাই তার থেকে পরিত্রাণ পেতে গেলে বাজারে দুষ্প্রাপ্য যে-খাদ্য তা যাতে চড়া দামে হলেও কিনতে পারেন সে সম্বন্ধে যজমানের কাছ থেকে নিশ্চয়তার আশ্বাস লাভ করেছিলেন এবং যজ্ঞনিরত পুরোহিতদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন। বক গ্লাব বেদাধ্যয়নের উদ্দেশে বেরিয়ে যজ্ঞের অভীষ্ট ফল সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করলেন কুকুরদের আচরিত অনুষ্ঠান দেখে। সমাজে খাদ্যাভাব কোন পর্যায়ে গেলে উচ্ছিষ্টভোজী কুকুরদেরও খাদ্যাভাব ঘটে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কাজেই সমাজে তখন মাঝেমাঝেই ব্যাপক অন্নাভাব ঘটত, তাতে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অর্থাৎ বিত্তহীনরা অন্নকষ্টে পীড়িত হত; মুষ্টিমেয় কিছু ধনীই শুধু বাড়তি দামে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারত। অন্নাভাবের চিত্রটি ব্যতিক্রমী নয়, বরং এটি-ই মোটামুটি সাধারণ চিত্র।

***

১. ওঁ শ্বেতকেতুহারুণেয় আস তং হ পিতোবাচ, ‘শ্বেতকেতো বস ব্রহ্মচর্যং, ন বৈ সোম্যাস্মৎকুলীনোহনচ্য ব্রহ্মবন্ধুরিব ভবতীতি। স হ দ্বাদশবর্ষ উপেত্য চতুর্বিংশতিবর্ষঃ সর্বান্ বেদানধীত্য মহামনা অনুচানমানী স্তব্ধ এয়ায় তং হো পিতোবাচ শ্বেতকেতো যন্নু সোম্যেদং মহামনা অনুচানমানী। স্তব্ধোঽসি…।’ (ছা/উ; ৬:১:১-২)

২. ‘ষোড়শকলঃ সোম্য পুরুষঃ, পঞ্চদশাহানি মাহশীঃ কামমপঃ পিবাপোময়ঃ প্রাণো ন পিবতো ছেৎস্যত ইতি। স হ পঞ্চদশাহানি নাশাথ হৈনমুপাসসাদ কিং ব্রবীমি ভো ইত্যূচঃ সোম্য যজুংষি সামানীতি স হোবাচ ন বৈ মা প্রতিভান্তি ভো ইতি। তং হোবাচ যথা সোম্য মহতোহভ্যাহিতস্যৈকোঽঙ্গারঃ খদ্যোতমাত্রঃ পরিশিষ্টঃ স্যাৎ তেন ততোৎপি ন বহু দহেদেবং সোম্য ত ষোড়শানাং কলানামেকা কলাঽতিশিষ্টা স্যাৎ তয়ৈতহি বেদান্ নানুভবস্যশানাথ মে বিজ্ঞাস্যসীতি। স হা শাথ হৈনমুপসসাদ তং হ যৎ কিঞ্চ পপ্ৰচ্ছ সর্বং হ প্রতিপেদে। তং হোবাচ যথা সোম্য মহতোঽজাহিতস্যৈকমদারং খদ্যোতমাত্রং পরিশিষ্টং তে তৃণৈরুপসমাধায় প্রাজ্বলয়েৎ তেন ততোৎপি বহু দহেৎ। এবং সোম্য ত ষোড়শানাং কলানামেকা কলাঽতিশিষ্টাহভুত সা অন্নেনোপসমাহিতা প্রাজ্বালীৎ তয়ৈতর্হি বেদাননুভবস্যন্নময়ং হি সোম্য মন অপোময়ঃ প্রাণস্তেজোময়ী বাগিতি তদ্ধাস্য বিজজ্ঞাবিতি বিজজ্ঞাবিতি।’ (ছা/উ; ৬:৭:১-৬)

৩. অন্নং বাব বলাড়ুয়স্তস্মাদ্ যদ্যপি দশ রাত্রীনার্শ্বীয়াদ্ যদ্যু হ জীবেদথবাহ দ্রষ্টাহ শ্রোতাই মন্তাহ বোদ্ধাহ কর্তাহ বিজ্ঞাতা ভবত্যথান্নস্যায়ৈ দ্রষ্টা ভবতি শ্রোতা ভবতি মন্তা ভবতি বোদ্ধা ভবতি কর্তা ভবতি বিজ্ঞাতা ভবতি বিজ্ঞাতা ভবত্যন্নমুপাস্থেতি। স যোহন্নং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽন্নবতো বৈ স লোকান্ পানবতোহ ভিসিধ্যতি যাবদন্নস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যোহন্নং ব্রহ্মোত্যুপাস্তেৎস্তি। (ছা/উ; ৭:৯:১-২)

৪. ‘Wheat even though putrid, I eat. Beer – life divine I have eliminated from me. Extremely long has been this distress.’ Akkadian Observations on Life and World Order in Ancient Near Eastern Texts pp. 21-23

৫. ‘Grain was scant, fruits were dried up and everything which they eat was short. Every man robbed his companion…. The infant was wailing, the youth was waiting, the heart of the old man was in sorow, their legs were bent, crouching on the ground, their arms were folded. ‘The countries were in need, the temples were shut up; the sanetuarics, held (nothing but ) air. Every(thing) was found empty’. ‘The Tradition of the Seven Lean Years in Egypt’ in Ancient Near Eastern Texts p. 31

৬. মটচীহতেষু কুরুম্বাটিক্যা সং জায়য়োষস্তিই চাক্রায়ণ ইভ্যগ্রামে প্রদাণক উবাস। স হেভ্যং কুল্মাষান্ খাদন্তং বিভিক্ষে তং হোবাচ নেতোহন্যে বিদ্যন্তে যচ্চ যে ম ইম উপনিহিতা ইতি। এতেষাং মে দেহীতি হোবাচ তানস্মৈ প্রাদদৌ হস্তানুপানমিত্যুচ্ছিষ্টং বৈ মে পীতং স্যাদিতি হোবাচ। ন স্বিদেতেঽপ্যুচ্ছিষ্টা ইতি ন বা অজীবিষ্যমিমানখাদয়ন্নিতি হোবাচ কামো ম উদপানমিতি। স হ খাদিতত্বাঽতিশেষাঞ্জায়ায়া আজহার। সাহ এব সুভিক্ষা বভূব তান্ প্রতিগৃহ্য নিদধৌ। স হ প্রাতঃ সঞ্জিহান উবাচ যদ্‌তান্নস্য লভেমহি লভেমহি ধনমাত্রাং রাজাঽসৌ যক্ষ্যতে স মা সর্বরাত্বিজ্যেবৃণীতেতি। তং জায়োবাচ হস্ত পত ইম এব কুল্মাষা ইতি তান্ খাদিত্বাহমুং যজ্ঞং বিততমেয়ায়। (ছান্দোগ্য উপ; ১:১০:১-৭)

৭. অথাতঃ শৈৗব উদ্‌গীথস্তব্ধ বকো দাভ্যো গ্লাবো বা মৈত্রেয়ঃ স্বাধ্যায়মুদ্বব্রাজ। তস্মৈ শ্বা শ্বেতঃ প্রাদুর্বভূব তমন্যে শ্বান উ পসমেত্যোচুরন্নং নো ভগবানাগায়ত্বশনায়াম বা ইতি। তান্ হোবাচেহৈব ম! প্রাতরুপসমীয়াতেতি। তদ্ধ বকো দাভ্যো গ্লাবো বা মৈত্রেয়ঃ প্রতিপালয়াঞ্চকার। তে হ যথৈবেদ বহিষ্পবমানেন স্তোষ্যমাণাঃ সংরব্ধাঃ সর্পন্তীত্যেবমাসসৃপুস্তে হ সমুপবিশ্য হিং চক্রঃ। ওমদামোং পিবামো দেবো বরুণঃ প্রজাপতিঃ সবিতাহন্নমিহাহরদন্নপতেঽন্নসিহাহরাঽহরোঽমিতি। (ছন্দোগ্য উপ; ১] : ১২)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *