খাদ্যের প্রার্থনা
মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক–এই এক হাজার বছর সময়কালে বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়। সম্ভবত ভারতের বাইরেই এর রচনা শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে সেই কাজ এ দেশে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এর প্রধান দুটো ভাগ: কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড, অর্থাৎ সংহিতা ও ব্রাহ্মণ এবং আরণ্যক ও উপনিষদ। আমাদের আলোচনায় সংহিতা পর্বকেই বৈদিক সাহিত্যের পূর্বভাগ ধরে নেব, যদিও ব্রাহ্মণের অনেকগুলিই সেই যুগে রচনা হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্বে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদের আলোচনা করব, কারণ বিষয়গতভাবে এ তিনটির সংযোগ অনেক বেশি।
আর্যরা ভারতবর্ষে একবারে আসেনি, দলে দলে, বারে বারে এসেছিল। তাদের মধ্যে একটি দলই বেদ বহন করে এনেছিল— সেটিই হয়তো ছিল শেষ বৃহৎ দল। তখনকার ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সীমানাও খুব স্পষ্ট নয়, হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের দিকের অনেকটা অংশই ভারতবর্ষের সীমার মধ্যেই ছিল। আর্যরা ঠিক কবে কোথা থেকে আসে তাও খুব সুনিশ্চিত নয়।’(১) তবে বর্তমান ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিমে একটি বৃহৎ ভূখণ্ডে যে ইন্দো-ইরানীয় ও ইন্দো-আর্যভাষা কথিত হত, আনুমানিক ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রামশরণ শর্মার মতে, দক্ষিণ পারস্য থেকে, আফগানিস্তান হয়ে বালুচিস্তান পর্যন্ত বিরাট ভূখণ্ড জুড়ে এক প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর বাস ছিল। ইন্দো-পারসিক ও ইন্দো-আর্য ভাষাভাষী লোকেরা ২০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের পর এখানে বসতি স্থাপন করে।’(২)
প্রথম দিকে যে সব আর্য গোষ্ঠী খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে ভারতবর্ষে আসে তাদের বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। কিন্তু ঋগ্বেদের কিছু সূক্ত বহন করে শেষতম যে গোষ্ঠীটি ভারতবর্ষে এল তাদের বিষয়ে জানিবার একমাত্র উৎস ঋগ্বেদ। মনে করা হয় যে, এরা যাযাবর পশুচারী ছিল। হয়তো-বা আরও দূর অতীতে এরা ইয়োরোপের কোনও অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করে, কয়েক শতক পরিক্রম করে, এখানে পৌঁছয়। তখন এদের মূল খাদ্য ছিল। ফলমূল, গরু ছাগলের দুধ, ঘি, দই, ক্ষীর, ইত্যাদি, আর আগুনে-ঝলসানো পশুমাংস। যে সব অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে এরা আসে তাদের মধ্যে অনেকেই চাষ করতে জানত, ফসল থেকে তৈরি রুটিও সে অঞ্চলে এরা কখনও কখনও পেয়ে ও খেয়ে থাকবে। কিন্তু এরা নিজেরা চাষ করতে জানত না। যাযাবর অতীতে এরা যখন কোনও বিপদে পড়ে বা বিপদের আশঙ্কায় দেবতার শরণাপন্ন হত, অথবা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বা ভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে কৃতজ্ঞতায় দেবতা শরণ নিত, তখন এরা খুব সংক্ষিপ্ত একটা যজ্ঞ করত। সম্ভবত দলেরই–প্রবীণতম বা প্রাজ্ঞতম–একজন একটা পরিষ্কার জমিতে একটা পশু বধ করত। সে নিজে বা আর কেউ কিছু মন্ত্র আবৃত্তি বা গান করত। তারপর সেই মাংস আগুনে ঝলসে নিয়ে সকলে ভাগ করে খেত এবং যে লোকটি পশু বধ করে গানে, আবৃত্তিতে যজ্ঞটি নিম্পন্ন করত, সে-ও তার পরই পশুপালক হয়ে দলে যোগ দিত। এই ছিল প্ৰাথমিক পর্বের যজ্ঞ। পশুচারীদের মধ্যে চালু ছিল বলে এ যজ্ঞপদ্ধতির কয়েকটি স্থায়ী লক্ষণও ওই জীবনযাত্রার দ্বারা নিরূপিত হয়েছিল। যেমন, এরা নিজেরা যাযাবর ছিল বলে এদের কোনও মন্দির ছিল না, কোনও দেবমূর্তিও ছিল না। বেদি ছিল পরিষ্কার-করা এক টুকরো জমি। ওই বেদির ওপরে দেবতাদের উদ্দেশে স্তব করে নিজেদের অভ্যস্ত খাদ্য–পশুমাংস, মধু, দুধ, ঘি, ইত্যাদি নিবেদন করত এবং যা তাদের প্রয়োজন তার জন্য প্রার্থনা করত। কী সেই স্তবস্তুতি? দেবতাদের বর্ণনা আর পূর্বে তাঁরা ভক্তদের যা যা দিয়েছেন তার উল্লেখ করে প্রশংসা। আর প্রার্থনা হল: শত্রুজয়, দীর্ঘজীবন, আরোগ্য, স্বাস্থ্য, পুত্রসন্তান, ধনসম্পত্তি (প্রধানত গোধন) এবং সর্বোপরি খাদ্য।
ইতিহাসের প্রথম পর্বে মানুষ ফলমূল সংগ্রহ করত; তার পরে শিকার করে মাংস সংগ্রহ করত। তার পরের পর্যায়ে সে পশুপালন করত। শিকার পাওঁয়া খানিকটা অনিশ্চিত ছিল, কিন্তু পশুপালনে খাদ্যসংস্থান অনেক বেশি নিশ্চিত ছিল। ভারতবর্ষে আসবার সময়েও আর্যরা যাযাবর পশুচারীই ছিল, অনেক পরে প্রাগাৰ্যদের কাছে চাষ করতে শিখেছিল। এ দেশে এসে তারা প্ৰাগাৰ্যদের হারিয়ে দেয়। পরাজিতদের একটি অংশ আর্যদের দাসে পরিণত হয়, বাকিরা বিন্ধ্য পর্বতমালার কাছের অরণ্য অঞ্চলে পালিয়ে যায়। আর্যরা ধীরে ধীরে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে পঞ্জাবে ও পরে উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ দখল করে বসবাস করতে থাকে। বনজঙ্গল পুড়িয়ে চাষের জমির পরিমাণ বাড়াতে থাকে, তত দিনে তারা প্ৰাগাৰ্যদের কাছ থেকে চাষ করতে শিখেছে।
তার আগে প্রথম যখন প্ৰাগাৰ্যদের সঙ্গে সংঘাত হয়, তখনো আর্যরা পশুপালকই ছিল এবং প্রাগার্যদের সম্পত্তি ও খাদ্য লুটপাট করে খাবার সংগ্রহ করত, শিকারও করত, বনে ফলমূল সংগ্রহও করত। কিন্তু এ সব মিলিয়েও যা খাবার জুটত তা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল। শিকারের যুগ থেকে পশুপালনের যুগ পর্যন্ত খাদ্য সংকট তাদের নিত্যসঙ্গী ছিল। শিকার পাওয়া ভাগ্যের ওপরে নির্ভর করত, আর পশুপালনেরও নানা বিপদ ছিল; অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ইত্যাদিতে ঘাসের জমি নষ্ট হয়ে গেলে পশুপালের খাদ্যের অভাব হত এবং তখন পুরনো চারণভূমি ছেড়ে নতুন চারণের উদ্দেশে যেতে হত। এ ধরনের অনিশ্চয়তা লেগেই থাকত। তা ছাড়া পশুপালে মাঝে মাঝে মড়ক দেখা দিত, তখন পশুপালকদের খাবার–দুধ ও মাংসে টান পড়ত। খাবারের জোগানে এই রকম অনিশ্চয়তাতে আর্যরা অভ্যস্ত ছিল। কাজেই দেবতাদের কাছে খাদ্যের জন্যে প্রার্থনা তাদের নিত্যকার প্রধান একটি প্রার্থনা ছিল। এই অংশে আমরা বেদের পূর্বভাগ হিসেবে শুধু ঋগ্বেদ সংহিতা নিয়েই আলোচনা করব।
ঋগ্বেদের কিছু অংশ হয়তো আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করবার আগেই রচনা করেছিল। এই অংশে এবং পরে এ দেশে এসেও তারা যে ঋকগুলি রচনা করে তাতেও খাদ্যের জন্যে বিস্তর প্রার্থনা আছে। এ সব প্রার্থনায় খাদ্যের নানা প্রতিশব্দ পাওয়া যায়। প্রাচীন বিশেষত ‘আস্য’ রচনা–যা মুখে মুখে রচিত এবং স্মৃতিতে সংরক্ষিত–তাতে প্রতিশব্দ-প্রয়োগ বিলাসিত। কোনও প্রাচীন আস্য সাহিত্যেই এক অর্থে বহু প্রতিশব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় না। তবু, এক ঋগ্বেদেই অন্নের চোদ্দটি প্রতিশব্দ পাওয়া যায়: অন্ন, অন্ধস, ইষ, বাজ, পৃক্ষ, পিতু, ভক্ত, শ্রবস, স্বধা, ঊর্জ, ইলা, চন, নমস ও বয়স। এখন এর কয়েকটি হয়তো আঞ্চলিক প্রতিশব্দ, দু-চারটি হয়তো বা কোনও বিশেষ ধরনের খাদ্য বোঝাত। তা হলেও এতগুলি প্রতিশব্দে তখনকার সমাজে খাদ্যের যে বিশেষ গুরুত্ব ছিল তাই বোঝাত। নানা নামে অভিহিত হয়ে খাদ্যের জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা যেন বিশেষ একটি তাৎপর্য পেয়েছে।
খাদ্যের প্রার্থনা কোন দেবতার কাছে করা হত? ঋগ্বেদে খুব কম দেবতাকেই বিশেষ কোনও অভীষ্টের জন্য আহ্বান করা হত। বায়ুবাতঃ, পর্জন্য, আপঃ, নদঃ–এগুলি প্রকৃতির বিশেষ বিশেষ শক্তির প্রকাশ, যেমন, সূৰ্য, চন্দ্র, অগ্নি। কিন্তু প্রার্থনার বেলায় এরা কেউই বিশেষ কোনও অভীষ্ট বস্তু দানের সঙ্গে সম্পূক্ত নন। মোটের ওপরে অধিকাংশ দেবতার কাছেই প্রায় সব রকমের কাম্যবস্তুর জন্যই প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু খুব অবাক লাগে যখন দেখি, খাদ্যের জন্যে বেশ ছোট ছােট, অর্থাৎ কম তাৎপর্যপূর্ণ এমন সব দেবতার কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে র্যাদের উদ্দেশে ঋকও কম, দেবমণ্ডলীতে যাঁদের গুরুত্বও কম। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে ঋগ্বেদের এক চতুর্থাংশ সূক্ত, তাই খাদ্যের জন্যে প্রার্থনা তাঁর কাছেই সবচেয়ে বেশি। ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, অশ্বিনৌ, উষস, বরুণ, আপঃ, নদাঃ, আদিত্যরা, মিত্র, সবিতা, সূৰ্য, সোম (পবিমান)–এরাও ঋগ্বেদে প্রধান দেবতাই, এদের কাছে খাদ্যভিক্ষা স্বাভাবিক। কিন্তু বেশ কিছু অপেক্ষাকৃত গৌণ দেবতার কাছেও খাদ্যের জন্যে প্রার্থনা করা হয়েছে: বৈশ্বানর, দ্রবিণোদা (অগ্নি), পূষা, রুদ্র, সরস্বতী, আপাং নপাৎ, নদী, অরণ্যানী, দধিক্রাবা, ঋভবঃ, শুদ্ধাগ্নি, তুষ্ট, এমনকী ইন্দ্রের দুটি ঘোড়া-হারীও বাদ যায়নি। এর থেকে মনে হয়, স্তোতারা এ ব্যাপারে কোনও রকম কুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না। কে জানে কোন দেবতার বিশিষ্ট কী কী ক্ষমতা আছে? সকলকেই বলা রইল, যার যা সাধ্য আছে দিয়ে দেবেন। খাদ্যের টানাটানির যুগে এটা স্বাভাবিক।
ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলিকে মোটামুটি যে দু-ভাগে ভাগ করা যায়। তার মধ্যে দেবতাদের প্রশংসা বা স্তব বাদ দিলে থাকে প্রার্থনা। আগেই দেখেছি, এ সব প্রার্থনা নিরাপত্তা, পরমায়ু, সম্পত্তি ও খাদ্যের জন্যে। খাদ্য নিয়ে ঋগ্বেদে প্রার্থনা প্রচুর। ভাষায় প্রকারভেদ আছে, কিন্তু মূল সুরাটা একই:
‘(অগ্নি)। আজ তুমি সুমনা হয়ে খাদ্যবিষয়ে, আমাদের দানশীল রক্ষক হয়ো-ইষং পূখতাং সুকৃতে সুদানব তা বহিঃ সীদতং নারাঃ’; (১:৩৬:২) ‘(অশ্বিদ্বয়) তোমরা সৎকার্যকারীকে অন্নে ভরিয়ে দিও’; (১:৪৭:৮) ‘দেব ইন্দ্র নানা রকম খাদ্য দিয়ে আমাদের পূর্ণকর ব্যাপ্ত ভূমিতে— তুং ত্যাং ন ইন্দ্র দেব। চিত্রমিষম্যাপো ন পীপয়ঃ পরিজান; (১:৬৩:৮) (আশ্বিদ্বয়) আমাদের জন্যে খাদ্য বহন করে এনো–আ ন উর্জং বহতামস্থিানা যুবন।।’ (১:১৫৭:৪)
এ সব থেকে দেবতাদের কাছে খাদ্যের জন্যে মিনতি স্পষ্টই বোঝা যায়:
‘ইন্দ্র উধের্ব অন্নের দাতা–উদ্ধের্ব বাজস্য সনিতা; (১:৩৬:১৩) ঊষা অন্ন দাও–উদ্ষো বাজং হি বংশ্ব’; (১:৪৮:১২) ‘সমস্ত স্ত্ৰোতাদের অন্ন দিও–বিশ্বে সচন্তু প্রভৃথেষু বাজম’; (১:১২২:১২) ‘আমরা যেন অন্ন, খাদ্য, সুরক্ষা সুখ ভোগ করি।—ইষমুৰ্জং সুক্ষিতিং সুন্নামশুহিঃ’; (২:১৫:৮) ‘কীর্তির জন্যে অন্ন মুক্ত করে দিও–বাজং শ্রাত্য অপাকৃধি’; (২:১:৬) ‘আমরা নিশ্চিত সুরক্ষার জন্যে অন্নলাভের জন্যে (স্তুতি করছি)—-স্ফারবৃক্তাভিরািতীতী রথে মহে সনয়ে বাজাসাতয়ে’; (২:৩১:৩) ‘ঊষা আমাদের জন্যে গাভী, অশ্ব, বীর্যযুক্ত (অর্থাৎ যা বীৰ্য দান করবে। এমন) স্তবের উপযোগীয় ও অন্ন দান করুনসা অস্মাসুধা গোমদর্শ্ববদুকথ্যমুষো বাজং সুবীর্যম; (১:৪৮:১২) ‘হেইন্দ্র যেন ঐশ্বর্য এবং যা অতিশয় দীপ্ত এমন অন্ন, খাদ্য লাভ করি।—সমিন্দ্র রায়া সমিষা রভেমহি সং বাজেভিঃ পুরুচন্দ্রৈরভিদুভিঃ’ (১:৫৩:৫) অন্নই প্রধান প্রার্থিত বস্তু; এরই জন্যে ভক্তের আর্তি। ‘যে স্তব করছে তার জন্যে সুন্দর অন্নের ব্যবস্থা কর–বর্ত ধিয়ং জরিত্রে বাজপেশসম’; (২:৩৪:৬) ‘অন্নের ব্যবস্থা করা যেন রথের ঘোড়াও আমি লাভ করি; (২:৩২: ৭) ইন্দ্র ও অগ্নি তোমাদের কাছে অন্ন প্রার্থনা করছি-ইন্দ্ৰায়ী ইষং তা আবৃণে৷৷’ (৩:১২:৫)
নানা ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন ভক্ত, ভিন্ন ভিন্ন দেবতার কাছে অসংখ্য বার এই ধরনের প্রার্থনা করেছেন।
ইন্দ্রকে বলা হচ্ছে আমাদের রক্ষা কর, স্তোতাদের পালন কর, আর অন্নে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা কর। এখানে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথা হল, ‘অন্নে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা কর।’ অন্ন কি তারা তখন আহার করছিল না? করছিল; তবে সে আহার কখনও জুটত, কখনও জুটিত না; কারও কারও জুটত, কারও কারও জুটিত না; কখনও প্রয়োজন মতো পরিমাণে জুটত, কখনও অর্ধহার বা স্বল্পাহারে দিন কাটাতে হত। অর্থাৎ প্রয়োজনের অনুপাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ আহার সকলের জুটত না। একটা অনিশ্চয়তা ছিল, ফলে অন্নাভাবের, অনিয়মিত পরিমাণের আহারের আতঙ্ক ছিল। দেবতার কাছে প্রার্থনা–অন্নে ‘অধিকার’ প্রতিষ্ঠা কর। অধিকার থাকলে প্রভুত্ব থাকে, প্রয়োজন মতো অন্ন প্রতিদিনই পাওয়া যায়। সেইটে তখন পাওয়া যাচ্ছিল না বলে নিয়মিত ও পর্যাপ্ত আহারের নিশ্চয়তার জন্য এই প্রার্থনা: সুরক্ষা ও অন্নই মুখ্য অভীষ্ট–রক্ষা চ ন মঘ্যোনঃ পাহি সুরীন রায়ে চ নঃ স্বপত্যা ইষে ধাঃ।।’ (১:৫৩:৫) আনুষঙ্গিক নানা কাম্যবস্তু, সূক্তগুলির মধ্যে মাঝেমাঝেই অনুপ্রবেশ করছে যেমন দেখেছি গাভী, অশ্ব, রথের বাহন। কিন্তু মূল ভিক্ষা হল, তিনি আমাদের অনেক খাদ্য দিন–স নো যান্ধি মহীমিষম।’ (৪:৩২: ৭) এই প্রার্থনাটি অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে: প্রচুর অন্ন দাও। নানা ভাষায় ‘প্রচুর অন্ন’-র জন্যে দেবতাদের কাছে স্তুতি করে প্রার্থনা করা হয়েছে। এর থেকে একটিই সিদ্ধান্ত করা যায়: অন্ন যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছিল না। যথেষ্ট পরিমাণের অর্থ হল, প্রয়োজন মিটবার মতো। প্রয়োজন উদরপূর্তির এবং বল ও শক্তিলাভের জন্য যা পর্যাপ্ত।
মনে রাখতে হবে, যাযাবর পশুচারী আর্যদের জীবনযাত্রা কঠোর ও প্রচুর শ্রমসাধ্য ছিল। ফলে তারা যেমন শারীরিক পরিশ্রম করতে অভ্যস্ত ছিল, তেমনই তাদের ক্ষুধা ও পুষ্টির প্রয়োজনও বেশি ছিল। ভারতবর্ষে এসে তারা যতটুকু খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছিল, স্পষ্টতই তা প্রয়োজনের অনুপাতে পর্যাপ্ত ছিল না। ফলে উদরপূর্তিও হত না, পুষ্টিও হত না। তারা অপুষ্টিজনিত নানা ব্যাধিতে ও রোগে আক্রান্ত হত; যক্ষ্মার কথা ও অন্যান্য অপুষ্টির রোগের কথা অথর্ববেদে পাই। তাই অন্নের প্রাচুর্যের জন্য এ ধরনের প্রার্থনা বারে বারেই উচ্চারিত হয়েছে। নানা ভাষায় প্রাচুর্য বর্ণনা করা হয়েছে, শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে’ ‘অন্নের ধারা’, ‘গাভীযুক্ত অন্ন’ অর্থাৎ অন্ন, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যের জন্যে প্রার্থনা বহু দেবতার কাছেই করা হয়েছে। এ সবের দ্বারা প্রমাণ হয় খাদ্য খানিকটা জুটত, কিন্তু সকলের নয়, খিদে মেটাবার মতো পরিমাণে নয়, পুষ্টিজনক নয়, প্রচুরও নয়। অসংখ্যবার তাই অন্নে প্রাচুর্যের জন্যে নানা ঋষি নানা দেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন। এতে সমাজে খাদ্যাভাবের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
‘স্তোতাদের জন্য অন্ন বহন করে আনো-ঈষং স্তোতৃভ্য আভর’; (৫:৬:২৩) ‘অন্নলাভের পথ দেখিয়ে দাও–রৎসি বাজায় পন্থাম’; (৫:১০:১)। অন্নপ্রাপ্তির জন্য দান কর— আ বাজং দর্ষি সাতয়ে’; (৫:৩৯:৩) ‘যারা স্তব করে তেমন ধনীদের জন্য, অন্ন দান কর-ইষং স্তোতৃভ্যমঘবস্তু আরট্র’; (৭:৭:৭) ‘আমরা পার হয়ে গিয়ে অন্ন লাভ করব–বয়ং তরুত্ৰা সনুয়াম বাজম; (৭:২৬:৫) ‘হে ইন্দ্র নানা ধরনের অন্ন প্রকাশ কর–স ইন্দ্র চিত্র অভি তৃণহি বাজান; (৬:১৭:২) ‘যেন অন্ন লাভ হয়–ভুবৎ বাজস্য সাতয়ে।’ (৫:৯:৭)
‘বৈশ্বানর অগ্নির উদ্দেশে বলা হচ্ছে তিনি ‘অন্ন বর্ষণকারী’–পৃক্ষস্য বৃষ্ণঃ’ (৬:৮:১) ঊষাকে বলছে ‘হে অন্নবতী, শোভন দীপ্তিসহ অন্নের প্রেরয়িত্রী হও–সুগুদুমেন বিশ্বতুরোষো মহিসং বাজেন বাজিনীবতি।’ (১:৪৮:১৬) কেন অন্ন চাই? ‘পুষ্টির জন্যে’–ঈষমশ্যাম ধায়সে।।’ (৫:৭০:২) সেই জন্যে বলছে, ‘শ্রেষ্ঠ অন্ন আমাদের জন্যে বহন করে আনো–ঈষমা বক্ষীহীষং বর্ষিষ্ঠাম।।’ (৬:৪৭:৯) খাদ্যেরও ভালমন্দ আছে, পুষ্টিরও কমবেশি আছে। তাই সবচেয়ে পুষ্টিকর, শ্রেষ্ঠ, বলদায়ী অন্নের জন্যে বারে বারেই প্রার্থনা শোনা যায়। ‘সবচেয়ে বলযুক্ত অন্ন প্রশস্ত মনে করেন বিদ্বানীরা–শবিষ্ঠং বাজং বিদুষো চিন্দধ্বমি।’ (৫:৪৪:১০) বা ‘উৎকৃষ্ট ও প্রচুর পরিমাণ অন্নলাভের জন্যে–মহো বাজস্য গধ্যস্য সাতৌ।’ (৬:২৬:২) অথবা ‘প্রশংসনীয় অন্নলাভের জন্য–বাজস্য রাধ্যস্য সাতৌ।’ (৬:১১:৬)
কেমন সে অন্ন? ‘খাদ্যের মধ্যে কাম্য অন্ন-ইষঃ পৃক্ষ ইষিধঃ…।’ (৬:৬৩:৭) সুরক্ষার জন্যে সবচেয়ে নিকটবতী অন্ন এনে দাও–ভর বাজং নেদিষ্ঠমুতয়ে।’ (৮:১:৪) ‘নিকটবতীর্ণ অন্ন’ শুনলে সহসা অর্থবোধ হয় না। যখন কৃষিভূমিতে নিয়মিত উৎপাদন হচ্ছে না। তখন অন্নকামী মানুষ মৃগয়া, লুণ্ঠন ও প্রাগার্যদের ফসল কেড়ে নিয়ে অন্নসংস্থান করত। নিজস্ব কৃষিভূমি বা বাস্তুর কাছাকাছি–যার কাছে নিজস্ব বা গোষ্ঠীগত পশুচারণভূমি–এগুলি কেড়েকুড়ে দখল করে নিতে সময় লাগা সম্ভব। ততদিন পর্যন্ত প্রয়োজনের সময়ে কাছাকাছি অঞ্চল থেকে প্রয়োজন মতো অন্ন সংগ্রহ করা অনিশ্চিত ছিল। তাই এ ধরনের প্রার্থনা:
‘হে অন্নপতি আমাদের বীর্যাদায়ী ধন দাও–স ত্বং ন উর্জং পতে রয়িং ধাস্ব সুবীর্যম’; (৮:২৩:১২) ‘ইন্দ্র হলেন যশযুক্ত অন্নের অধিপতি–ইন্দ্ৰো বাজস্য দীর্ঘশ্রবসম্পতি’; (১০:২৩:৩) ‘এই অগ্নি হলেন শত সহস্র অন্নের অধিপতি–অয়মগ্নিঃ সািহত্রিণো বাজস্য শতিনম্পতিঃ’; (৮:৭৫:৪) ‘প্রচুর পরিমাণে অন্ন দিতে পারেন, প্রচুর পরিমাণে অন্ন দাও, (পবিত্র কর) সোম, যার সঙ্গে গাভী আছে, হিরণ্য আছে, অশ্ব আছে, শক্তি আছে,–আ পবস্ব মহীমিষং গোমদিন্দো হিরণ্যাবৎ। অশ্ববিদ্বজবৎসুতঃ; (৯:৪১:৪) ‘প্রচুর কাম্য অন্ন ও ধন (দাও)–মহীমিষাং দধাসি সানসিং রয়িম; (১০:১৪০:৫) অন্ন দাও, উজ্জ্বল অন্ন দাওবয়ো দধে রোচমাণো বয়ে দধে’; (৯:১১১:২) ‘আমাদের সহস্র পরিমাণ অন্ন এনে দাও, সোম–ইন্দ বা ভব বিদাঃ সহশ্ৰিণীরিষাঃ’; (৯:৪০:৪) ইন্দ্র, আমাদের কাছে শতপরিমাণ সহস্রপরিমাণ অন্ন নিয়ে এস-ইন্দ্র ণ উপাযাহি শতবাজিয়া। ইষা সহস্রবাজিয়া”; (৮:৯২:১০) ‘সহস্র পরিমাণ অন্ন নিয়ে যেতে যেতে.— গচ্ছন মাবাজং সহশ্ৰিণমা; (৯:৩৯:১) ‘সোম এই সোমযোগে যেন প্রচুর অন্ন পাই (সে ব্যবস্থা কর)–আ নো ইন্দো মহীমিয়ং পবিম্ব (৯.৬৫:১৩) অথবা পাবস্ব বৃহতীরিষ।’ (৯:৪২:৬)
এই শত পরিমাণ সহস্র পরিমাণ, ঠিক কতটা পরিমাণ বোঝােত তার কোনও স্পষ্ট সন্ধান পাওয়া যায় না, কিন্তু কথ্যভাষায় যেমন শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে’ বলে আমরা প্রচুর পরিমাণ বোঝাতে চাই এখানে মনে হয়। সেই ব্যঞ্জনাটাই অভিপ্রেত। অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণ অন্নের জন্যে আকাঙ্ক্ষা এবং প্রার্থনা। বাস্তবে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকলে এ সব প্রার্থনার দরকার হত না। প্রাচুর্যের জন্যে প্রার্থনার পিছনে থাকে বাস্তবে অন্নাভাব। তাই এত ভাবে ওই কথাটাই বলা হচ্ছে।
খাদ্যের জোগান যেন কেউ আচ্ছাদিত করে রেখেছে তাই ভক্ত দেবতাকে বলছে, ‘অন্নের ওপরের আচ্ছাদন তুলে দাও অর্থাৎ মুক্ত করা অন্নের রাশিকে-উর্ণুহি বি বাজান।’ (৯:৯১:৪) দেবতা ইচ্ছা করলে মানুষকে প্রচুর অন্ন দিতে পারেন, যখন দেন তখন কোথাও না কোথাও যেন একটি অন্নভাণ্ডার আছে, তার থেকেই দেন; তাই প্রার্থনা: উন্মুক্ত কর সে ভাণ্ডার, ঢেকে রেখো না, আমাদের বঞ্চিত কোরো না। অকৃপণ হস্তে অন্নদান করবার জন্যে এ ধরনের আরও বহুসংখ্যক প্রার্থনা থেকে বোঝা যায় সমাজে বৃহৎ একটি অংশ পর্যাপ্ত অন্ন পাচ্ছিল না, তাই এই আকুতি। বারংবার একই কথা নানা ভাষায় নানা দেবতাকে বলা, যেন কোনও না কোনও দেবতা কৃপাদৃষ্টিতে ভক্তের দিকে তাকান, তার অন্নাভাব মোচন করেন।
প্রয়োজন শুধু অম্নের নয়, দুধের জন্যে গাভী চাই; নিরাপদে থাকবার জন্যে যুদ্ধ করতে হয়, তাই রথে বাহন অশ্বও চাই; দরকার বীরপুত্রেরও। তাই বারেবারে গাভী, অশ্ব ও পুত্রের জন্য প্রার্থনাও জুড়েছে অন্নের প্রার্থনার সঙ্গে:
‘হে সোম, গাভী, বীর, অশ্ব সমেত অন্নের জন্যে তোমাকে প্রস্তুত করছি, এর থেকে আমাদের প্রতিদিন প্রচুর খাদ্য দাও— গোমন্নঃ বীরবাদশ্ববিদ্বজবৎসুতঃ। পবস্ব বৃহতীরিষঃ’; (৯:৪২:৬) ‘দেবতা তোমরা আমাদের জন্যে প্রতিদিন ধন ও খাদ্য আনো–রায়েষাং নো নেতা ভবতামনু দ্যূন্’ (৩:২৩:২)
খাদ্যের প্রয়োজন শুধু উদরপূর্তির জন্যে নয়, শক্তির জন্যেও। মনে রাখতে হবে, আর্যরা এসে পড়েছিল এক প্রতিকূল পরিবেশে। তখন আর্যাবর্তে ব্যবহারিক জীবনে অনেক বেশি উন্নত সিন্ধুসভ্যতার প্রভাব। যুদ্ধে হোক বা প্রতাপে-পরাক্রমে হোক তাদের হটিয়ে দিয়ে আগস্তুকরা এখানে বসবাস করত। অতএব দ্বন্দ্ব সংগ্রাম লেগেই থাকত, এ সব সংগ্রামে শক্তিমান যোদ্ধার দরকার এবং তাদের শক্তি জোগায় খাদ্য। তাই খাবারে ঘাটতি থাকাটা আর্যদের পক্ষে চুড়ান্ত বিপর্যয়ের ব্যাপার। এই জন্যেই খাদ্যের জন্যে এত তীক্ষ্ণ আর্তি। ঊষার মহিমা এই জন্যেই যে তিনি ‘শক্তি ও অন্ন বহন করে আনেন— বাজমুর্জং বহন্তীঃ’; (৬:১:৫) ‘আকাশ ও পৃথিবী আমাদের শক্তিরূপে (অন্ন) দিন–উৰ্জং নো দৌশচ পৃথিবী পিন্বতাম; (৬:৭০:৬) (বায়ু) স্কুল (= প্রচুর) শুভ্র মোদযুক্ত অন্ন দিন–পীবো অন্না বয়িবৃদ্ধ সুমেধা শ্বেতঃ সিষ্যক্তি’; (৭:৯১:৩) ‘যে অন্ন আমাদের বৃদ্ধি ঘটায় সেই খাদ্য দান করাধাক্ষস্ব পিপুষীমিষমা বাচনঃ।’ (৮:১৩:১৫) এই রকমই শুনি ‘(বায়ু) দান করেছিলেন পুষ্টিবৰ্ধক খাদ্য, অন্ন—অধুক্ষৎ পিপুষীমিষ ঊর্জম।’ (৮:৭৩:১৬)
এই অন্ন গ্রহণ করেও তো মানুষ অনেক সময়ে ব্যাধিগ্রস্ত হয়, তাই ভক্ত সন্তৰ্পণে নিবেদন জানায় যাতে যে-অন্নের দ্বারা রোগ নিবারণ হয়, দেবতা যেন তেমন অন্নই দান করেন: ‘যক্ষ্মারহিত অন্ন প্রচুর পরিমাণে–অযক্ষ্মা বৃহতীরিষঃ’;।৯:৪৯:১) ‘(দেবতা) দোহন করে দাও পুষ্টিবৰ্ধক অন্ন–ধুক্ষস্ব পিপুষীমিষম।’ (৯:৬১:১৫) অগ্নির কাছে প্রার্থনা জানানো হচ্ছে, ‘অগ্নি আয়ু সৃষ্টি কর, শক্তি এবং অন্ন (সৃষ্টি করে দাও)–অগ্ন আয়ুষি পবাস আ সু বোজমিষাং চ নঃ’; (৯:৬৬:১৯) ‘যশোর জন্যে মঙ্গলযুক্ত অন্ন ভোগ করব–উর্জং বসানঃ শ্রবসে সুমঙ্গলঃ। (৯:৮০:৩)। দেবতা হলেন ‘খাদ্যের অধিপতি, পুষ্টির অধিপতি ও সখা–ইনঃ বাজানাং পাতিরিনঃ পুন্তীনাং সখা।’ (১০:২৬:৭) এখানে সখী’ শব্দটি তাৎপৰ্যপূর্ণ। সমাজে বন্ধু তার বন্ধুর আতিথ্য করে পুষ্টিযুক্ত অন্ন দিয়ে; দেবতা যখন তা করেন তখন তিনি মানুষের প্রতি সখার কৃত্যই করেন। দেবতা অনুকুল না হলে, সখা না হলে ভয়স্থান। যিনি ভক্তের প্রয়োজন জেনেও তাকে বিমুখ করেন অথবা তার প্রার্থনায় উদাসীন থাকেন তিনি তো তখন ভক্তের সেখা’ নন, উদাসীন। ভক্তের প্রার্থনা দেবতাকে তার প্রতি অনুকুল করে রাখা। দেবতা অনুকুল না থাকলে ভক্তের ভরসা কোথায়? তার নিজের চেষ্টায়। সে তো পর্যাপ্ত অন্ন উৎপাদন করতে পারছে না। যা উৎপন্ন হচ্ছে তাতে খিদে মেটে না। বহু মানুষই সমাজে অভুক্ত থাকছে, যারা খেতে পাচ্ছে তারাও নিয়মিত ভাবে পাচ্ছে না এবং সর্বোপরি যথেষ্ট পরিমাণে পাচ্ছে না; এমন খাদ্য পাচ্ছে না যাতে তাদের আয়ু ও পুষ্টি বৃদ্ধি পায়। এ সব সংকট থেকে পরিত্ৰাণ পাওয়ার যে উপায় তারা ভাবতে পেরেছিল তা হল। যজ্ঞে স্তব ও হাব্য দান করে দেবতাকে অনুকুল করে তাঁর কাছে মিনতি করা যাতে তিনি সখার মতো আচরণ করেন। প্রকৃতির প্রতিকূলতা ও কৃপণতার বিরুদ্ধে তাদের একমাত্র আশ্রয় হল দেবতার আনুকুল্য। পুষ্টিই অন্নর জন্যে প্রার্থনার মূলে। পুষ্টি থেকে আসবে শক্তি, এবং শক্তিমান জয়যুক্ত হবে। প্রতিকূল পরিবেশে শক্রর ওপরে আধিপত্যই আত্মপ্রতিষ্ঠার উপায় এবং এ সবের মূলে অন্ন, তাই অন্ন পুষ্টির উৎস।
শুধু পুষ্টি নয়, অন্ন জীবনেরই সমার্থক। যাকে গৃহ ও জীবনসাধন অন্ন দিয়েছ–যম্মা অরাসত ক্ষয়ং জীবাতুং চা।’ (৮:৪৭:৪)। তাই প্রার্থনা, ‘পুত্রপৌত্ৰাদিক্রমে যেন অন্ন ভোগ করি।—পুত্র পৌত্ৰাদিভির্ভেজিমগ্নম।’ (৮:৯৩:১৫) এখন প্রশ্ন আসে: সেই যুগের মানুষগুলির কাছে অন্নের রূপ কী ছিল? ভক্ষঃ সখা, খাদ্য হল বন্ধু (তৈত্তিরীয় সংহিতা; ২:৬:৭:৩) ‘আপঃ (জল দেবতা) যাকে দীপ্ত করে অন্নের সেই সোনা-রং ঘৃত মিশ্ৰিত অন্ন…’ (তৈ/সং; ২:৩৫:১:১)। ‘পৃশ্নি (রুদ্রদের মাতা) সে-ই হল অন্নের রূপ–পৃশ্নির্ভবত্যেতদ্বা অন্নস্য রূপম; (তৈ/সং; ২২:১:৭:৫,৫:৫:৬:৩) অন্ন হল প্রজাসাধারণ–অন্নং বিটু; (তৈ/সং; ৩:৫:৭:২) অন্ন শক্তি–অন্নং বৈ বাজঃ; (তৈ/সং’; ৫:১:২:২) শুধু তাই নয়, অন্নকে বহু দেবতার সঙ্গে একাত্ম কল্পনা করা হয়েছে, অন্ন আদিত্য, অন্ন মরুদগণ অন্ন গর্ভ–অন্নং বা আদিত্যোৎস্নং মরুতে অন্নং গৰ্ভ’ (তৈ/সং; ৫:৩:৪:৩) অন্নের পুষ্টিতেই গৰ্ভধারণ করা সম্ভব তাই এখানে অন্নকে গৰ্ভও বলা হয়েছে। তেমনই আবার শুনি ‘অন্ন অগ্নি. বিরাট (ছন্দ)ই অন্ন–অন্নং বৈ পাবকঃ… বিরাভন্নম’। (তৈ/সং; ৫:৪:৬:৩) ‘অন্ন বরণীয়–অন্নং বামঃ’। (তৈ/সং; ৫.৪.৭.২; ৬.১.৬; ৭.৫.৮.৩)
সেই প্রাচীন প্রথম পর্যায়ের বৈদিক সাহিত্যেই অন্নের যখন এত গৌরব কীর্তন, তখন স্বভাবতই মনে হয়, ক্ষুধা সম্পর্কে একটা আতঙ্কের মনোভাব জনমানসে কার্যকরী ছিল। সাধারণ মানুষ বলে সমাজে যাদের স্বীকৃতি আছে তারা সাধারণ খাবারই খেত; যারা তা পেত না তারা অন্য হীন খাদ্য যেমন তেমন করে জোগাড় করে খেত! সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ চণ্ডাল, আৰ্যসমাজের বাইরে অস্পৃশ্য একটি গোষ্ঠী। আর্যরা তাদের বরাবরই ঘৃণা করে এসেছে, কারণ তারা শ্বপাক বা শ্বপচ অর্থাৎ শ্বন বা কুকুরের মাংস পাক করে খায়। অন্য মাংস কিনতে হয়, এ দরিদ্র গোষ্ঠীর সে ক্ষমতা কোথায়? তাই যা কিনতে হয় না, পথেঘাটে ঘুরে-বেড়ানো কুকুর মেরে খেত এই চণ্ডালরা–পেট ভরাবার জন্যে, কতকটা বা পুষ্টিরও জন্যে। ঋগ্বেদে ব্রাহ্মণ বামদেব ঋষি বলছেন, ‘অভাবের জন্যে আমি কুকুরের নাড়ির্তুড়ি রান্না করে খেয়েছি; দেবতাদের মধ্যে কোনও সাহায্যকারী পাইনি, (নিজের) স্ত্রীকে অপমানিত হতে দেখেছি, পরে এক শ্যেন আমার জন্যে মধু আহরণ করে।’ (অবর্ত্যা শুন আন্ত্রাণি পেচে, ন দেবেষু বিবিদে মডির্ততারাম। অপশ্যং জায়ামহীয়মানামধা মে শ্যেনো মধ্বা জাভার। ঋগ্বেদ; (৪:১৮:১৩) এর ওপরে মন্তব্য করবার প্রয়োজন নেই। কতখানি অভাব থাকলে চণ্ডালের খাদ্য, অর্থাৎ কুকুরের মাংসও জোটে না, তাই কুকুরের নাড়ির্ভুড়ি রান্না করে খেতে হয়, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আপনি স্ত্রীকে অপমানিত হতে দেখেন, যেমন লাঞ্ছনা বহু দরিদ্র স্ত্রীর ভাগ্যে জোটে; মানুষ তো দূর, দেবতাদের মধ্যেও কোনও সহায়ক খুঁজে পাননি বামদেব, শেষে কোনও বাজপাখির সঞ্চয় থেকে মধু খেয়ে প্রাণরক্ষা করেন। লক্ষণীয় এই শাস্ত্রাংশটি ঋগ্বেদের প্রাচীনতম অংশ ঋষিমণ্ডলগুলির (দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডল) অন্তৰ্গত। অর্থাৎ, এখানে বামদেবের যে ক্ষুধার তাড়না তাতে ঋষি বাধ্য হয়ে চণ্ডালও যা ফেলে দেয়। সেই কুকুরের নাড়ির্ভুড়ি রোধে খাচ্ছেন। এটি বেদের প্রাচীনতম যুগেরই একটি সমাজচিত্র। এখানে লক্ষণীয়, দেবতাদের মধ্যে কেউ-ই তাকে সাহায্য করেননি। দেবতা কী ভাবে সাহায্য করতেন? কোনও মানুষের চিত্তে করুণা উদ্রেক করে, যাতে অভুক্ত ঋষিকে সে খেতে দেয়। কিন্তু কেউ দেয়নি, অর্থাৎ বামদেবের দুঃসহ ক্ষুধার যন্ত্রণাতে দেবতা বিমুখ, মানুষও। কেউ ডেকে খাওয়ায়নি তাঁকে। এ অবস্থার পেছনে খাদ্যাভাবের ত্ৰাসও আছে। অর্থাৎ মানুষ হয়তো ইচ্ছে থাকলেও সাহস পায়নি তার খাদ্য ভাগ করে খেতে— যদি তারও ওই অবস্থা হয়? সমাজে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য থাকলে এ-অবস্থা হত না। প্রত্যেক সমাজেই কিছু মানুষ থাকে যারা প্রত্যক্ষ ভাবে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে না–শিশু, প্রসূতি, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অসুস্থ মানুষ; সমাজ এদের জন্যে অন্নসংস্থান রাখে। বামদেবের কথায় মনে হয়, তার অন্ন উৎপাদনের সাধ্য বা সঙ্গতি ছিল না এবং সমাজেও সেই পরিমাণ প্রাচুর্য ছিল না যাতে অভুক্তকে আহার দেওয়ার আতিথেয়তা আসে। এখানে ব্যাপক একটি খাদ্যাভাবের পটভূমিকা দেখা যাচ্ছে। খাদ্য যথেষ্ট নেই বলেই হয়তো মানুষ কৃপণ ও অনাতিথেয়। এই কার্পণ্য এমন বলেই বামদেব বলছেন দেবতারাও কেউ সাহায্য করলেন না। দরিদ্র বলে তিনি অভুক্ত, তাঁর স্ত্রী লাঞ্ছিত।
ঠিক এই ধরনের কথা পড়ি প্রাচীন আক্কাদীয়দের এক দরিদ্রের রচনায়। সে তার দুর্দশার দীর্ঘ বিবরণের পরে বলে, ‘কোনও দেবতাই সাহায্য করেননি, কেউ আমার হাত ধরেননি।’
অন্যত্র ভক্ত বলছেন, ‘(হে ইন্দ্র) গাভী দিয়ে উত্তীর্ণ হব দারিদ্র্যজনিত কষ্ট, সকল ক্ষুধা উত্তরণ করব যব দিয়ে—‘গোভিষ্টন্নেমামতিং পু রেবাং যবেন ক্ষুধং পুরুহুত বিশ্বাম।’ (১০:৪২:১০) এই দশম মণ্ডলটি রচনার ও সংকলনের দিক থেকে সবচেয়ে অর্বাচীন, এখানে তখনকার প্রচলিত খাদ্যশস্য যবের উল্লেখ আছে।নাম করেই; এই যবদিয়ে পুরোডাশ(অনেকটা দক্ষিণ ভারতীয় ইডুলির মতো) তৈরি হত, যা ভাত বা রুটির মতো প্রধান একটি খাদ্য ছিল। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ক্ষুধা বর্তমান, এবং তা নিবারণ করবার উপায়ও ভাবছে ভক্তরা।
‘যেন খেতে পাই’–এ প্রার্থনাটা ব্যাপ্ত হয়ে আছে। সারা বৈদিক সাহিত্য জুড়ে। ‘অকুটিলগতি (সরলচিত্ত) আমরা খাদ্য লাভ করব–অপরিহাবৃতাঃ সনুয়াম বাজম’; (১:১০০:১৯) অর্থাৎ ‘আমরা যদি কুটিলতা পরিহার করে নৈতিক ভাবে জীবনযাপন করি, তা হলে, দেবতা আমাদের আহার জোগাবেন’, এমন একটা বিশ্বাস মানুষের চেতনায় অন্তর্নিহিত ছিল। সেই গুরুতর খাদ্যাভাবের দিনে ঠিক কী করলে আহার সম্বন্ধে নিশ্চয়তা আসে তা কেউ ঠিক করে জানত না, তাই চিত্তশুদ্ধিকে খাদ্যলাভের একটা প্রাকশর্ত হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অথবা সরাসরি বলছে, ‘ইন্দ্রের দ্বারা আমরা খাদ্য লাভ করব–বয়মিন্দ্ৰেণ সনুয়াম বাজম; (১:১০১:১১) ‘আমাদের পথ যেন সুগম ও অন্নযুক্ত হয়–সদা যুগঃ পিতুর্মী অস্তু পন্থাঃ’; (৩:৫৫:২১) ‘অন্ন যেন লাভ করতে পারি–ইলাভিঃ সং রিভেমহি’, (৮:৩২:৯) ‘প্রজা ও অন্ন যেন ভোগ করতে পারি–ভক্ষীমহি প্রজামিষম; (৭:৯১৬) ‘যেন অন্নের ওপরে (আমাদের) অধিকার থাকে; যেন অন্নের সবচেয়ে নিকটে থাকতে পারি–ভবা বাজানাং পতিঃ। নি নেদিষ্ঠতমা ইষঃ স্যাম; (৯:৯৮:১২) ‘নেদিষ্ঠতম, সবচেয়ে নিকটবতী, অর্থাৎ অন্নের সঙ্গে যেন আমাদের কোনও দূরত্ব না থাকে। এর মানেটা হল, যেন সহজেই অন্ন লাভ করতে পারি। অন্নের গন্ধযুক্ত খাদ্য যেন খাই, অন্নের গৃহ যেন পাই— অশ্যাম বাজগন্ধ্যং সনেম বাজপস্ত্যম।’ (৯:৯৮:১২)
খাদ্যের জোগানের অবস্থা কী অবস্থায় থাকলে অন্নগন্ধি খাদ্য ও কাম্য হয়ে ওঠে তা বোঝা কঠিন নয়। আরও তাৎপৰ্য্যপূর্ণ হল, অন্নের গৃহ কথাটি–এটিশস্যের ভাণ্ডার বামরাই অর্থে প্রযুক্ত কিনা তা ঠিক জানা যায় না, কিন্তু কোনও একটা জায়গায় শস্য মজুত থাকার আশ্বাসটাই এখানে প্রয়োজনীয়। যেন ‘হা অন্ন, হা। অন্ন’ অবস্থােটা না ঘটে। বলা বাহুল্য, এমনটা না ঘটে। থাকলে এ প্রার্থনা থাকত না। অরণ্যানী’। সূক্তে যথেচ্ছ স্বাদু ফল খাবার জন্যেও প্রার্থনা আছে–স্বাদোঃ ফলস্য জািন্ধ্যায় যথাক্যামং নিপদ্যতো।’ (১০:১৪৭:৫) আগেই বলেছি, ঋগ্বেদের প্রথম পর্যায় থেকেই খাদ্য ও পানীয় ছিল পশুমাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য, শস্য থেকে তৈরি খাদ্য, অরণ্য থেকে সংগ্রহ করা ফল, মধু, সোমরস ও সুরা। ফল ও মধুর জন্যে লোকে বনে যেত, শিকার করতেও যেত পশুমাংস সংগ্রহের জন্যে; অবশ্য পরে পশুপালনের যুগে পশুপাল থেকে পশু হনন করে যজ্ঞ করা হত এবং খাওয়া হত; দুধ ও দুধ থেকে তৈরি দই, ঘোল, ছানা, চারু (পায়সা) এসবও খাদ্যের অংশ ছিল। সেযুগে গ্রামের বাইরেই পশুচারণভূমি এবং তার বাইরেই অরণ্য ছিল। গ্রামের চাষের জমি, বাইরে পশুচারণভূমি এবং তার বাইরে অরণ্যভূমি–এই তিনটি থেকেই মানুষ তার খাদ্য সংস্থান করত।
মানুষ পরিশ্রম করে শিকার, পশুপালন, ফলমূল সংগ্রহ বা চাষ, যা করেই হোক খাবার জোগাড় করত; কিন্তু এর প্রত্যেকটিই নানা ভাবে বিপৎসংকুল ছিল। শিকার পাওয়া, না পাওয়া অনেকটাই নির্ভর করত ভাগ্যের ওপরে। পশুচারণভূমি নষ্ট হয়ে যেত খরা, বন্যায়; তা ছাড়া মাঝে মাঝে পালে মড়ক লাগত, জঙ্গলে নানা হিংস্র জন্তু ছিল, চাষেও অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি, ইত্যাদি নানা বিপদের সম্ভাবনা থাকত। তাই মানুষ কোনও মতেই তার খাবার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত থাকতে পারত না। প্রকৃতির ওপরে নিয়ন্ত্রণ যেটুকু ছিল, তা খুবই প্রাথমিক স্তরের। স্বভাবতই মানুষ কিছু একটা অবলম্বন চাইত যার থেকে তার খাবারের জোগানের সম্পর্কে সে একটা আশ্বাস পায়। এই কারণে সে কল্পনা করল ঊর্ধ্বলোকে কিছু দেবতা তার সুখদুঃখের হিসেব রাখেন। তাঁদের যজ্ঞে ও স্তবে যথাবিধি প্রসন্ন করতে পারলে খাদ্য সম্বন্ধে হয়তো একটা স্থায়ী আশ্বাস থাকে। খাবার যখন মেলে। তখন নিশ্চয়ই কোনও দেবতা মানুষের প্রতি করুণাপরবশ হয়ে তা পাঠান বলেই মানুষ তা পায়। যখন মেলে না, তখন কোনও দেবতার অসন্তোষ বা রোষকেই দায়ী করা হত। কাজেই অন্নসংস্থানের সঙ্গে দেবতাকে প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও পরোক্ষ ভাবে সম্পূক্ত করত সে যুগের জনমানস।
‘মন্ত্রদ্রষ্টা প্রশস্ত অন্ন ধারণ করেন–চাক্ষ্মো যদ্বাজং ধরতে মহী।’ (২:২৪:৯)। কিন্ত এ অন্ন। তিনি ধারণ করেন দেবতার কৃপায়। ইন্দ্রকে বারে বারে বাজসনি’ অর্থাৎ অন্নদাতা বলা হয়েছে। অগ্নিকেও: ‘অগ্নি পরম অন্ন ও ধনের (দাতা)–অগ্নিৰ্বাজিস্য পরমস্য রায়ঃ’; (৪:১৩:৩) ‘(দেবতা) দ্রুত আহরণ করে আনেন স্পাহনীয় (কাম্য) অন্ন–মৰ্ম্মকু বাজং ভরতি স্পাহিরাধাঃ।।’ (৪:১৬:১৬) যে অন্ন সমস্ত ক্ষুধার্তের আকাঙিক্ষত সেই অন্ন দেবতা ভক্তের স্তবে ও যজ্ঞে প্রীত হয়ে দান করেন এমন কথা বারেবারেই বলা হয়েছে। ইন্দ্রের স্তব করা, প্রশংসা কর, স্তাবকের জন্যে যেন তিনি স্ফীত নদীর মত অন্ন দান করেন–নু পুঁত ইন্দ্র নু গৃণান ইষং জরিত্রে নদ্যো ন পীপেঃ ‘ (৪:১৭:১২,২১; ৪:২০:১৬) এ কথা বারে বারে বলার উদ্দেশ্য সম্ভবত ওই উপমাটি যা অন্নকামী ভক্তের মনে ধরেছিল: বর্ষায় ফেঁপে-ওঠা নদীর মতো সুপ্রচুর অন্নসম্ভার। ইনি (দেবতা) যাকে দান করেন তার জন্যে অন্ন আহরণ করেন–অয়ং বাজং ভরতি যং সনোতি।’ (৪:১৭:৯)
শুধু ইন্দ্র, অগ্নি নয় অশ্বিদ্বয়কেও অন্নদাতা বলে বারে বারে অভিহিত করা হয়েছে। অশ্বিনৌ বাজিনী বসু –এ কথা অনেক ঋকেই পাই। (৫:৭৫:৬, ৭; ৫:৭৮:৩; ৮:৫:৩; ১২, ২০, ৩০, ৮.২২.৭, ১৪, ১৮; ৮.২৬.৩, ৮.৮৫.৩; ৮.১০১.৮) পূষা, যিনি মূখ্যত পশুপালনের রক্ষক দেবতা, তার কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে, ‘পূষার স্তব করি, তিনি অজ, অশ্ব ও অন্নের অধিকারী’ অশ্ব বাহন— পূষণং দ্বিজশ্বমুপ স্তোষ৷াম বাজিনম৷’ (৬:৬০:১)। কিন্তু অজ ও অন্ন খাদ্য, তাই পূষার কাছে। এ সব চাওয়া প্রাসঙ্গিক। ইন্দ্র শুধু শত্রুজয়ই করেননি অন্নও দান করেন: ‘যিনি বৃত্রকে বধ করেছেন, তিনি অন্ন দান করেন, বণিকশ্রেষ্ঠ সেই ইন্দ্র কাম্য ধন দান করেন–হস্তা যো বৃত্ৰং সনিতেন্তে বাজং দাতা মকবানি মঘবা সুরাধা।’ (৪:১৭:৮) আশ্বিনারাও অন্ন এবং ধন দান করেন: ‘দুজনেই অন্ন ও ধনের দাতা। (৬:৬০:১৩) দেবতার অন্নদান প্রকারান্তরে সুরক্ষাও দেয়, কারণ, অন্নপুষ্ট সুস্থ মানুষ আত্মরক্ষায় সমর্থ, তাই দেবতা ‘আমাদের অন্ন দান করেই সুরক্ষাও দান করেন–দানো বাজং বি যমতে ন উতীঃ ‘ (৭:৭:৪) অগ্নি অন্নদাতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ–বাজাসাতম (৫:১৩:৫৫, ৫:২০১) ‘(হে দেবতা) তোমার (দেওয়া) অন্নের শক্তি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করুক–বাজো নু তে শবসম্পত্ত্বিস্তম।’ (৫:১৬:৫)
কণ্ববংশীয়দের ঋষি বংশধরদের সম্বোধন করে বলছেন, ‘হে কথারা, স্তবগানে অন্ন (চেয়ে নাও), উত্তম প্রভু, মহাত্মা অন্নপতি দেবতার স্তব গেয়ে অন্নলাভ করা–গাথ শ্রবসং সৎপতিং শ্রাবস্বামং পুরুত্মািনম। কথাসো গাথ বাজিনম।।’ (৮:২:৩৮) দেবতা স্তবে তুষ্ট হলে ভক্তকে অন্নদান করবেন, এমন একটি অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের চিহ্ন বহন করে বহু ঋক। (হে দেবতা) তুমিই গাভী ও অন্নের সত্য ও উৎপৃষ্ট দাতা–ত্বং হি সত্যো অদ্ভুতো দাতা বাজস্য গোমতঃ।’ (৫:২৩:২) শতক্রতু ইন্দ্র, প্রচুর ও মহৎ ধনের দাতা— উরোষ্ট ইন্দ্র রাধসঃ বিভী রাতিঃ শতক্রতো।’ (৫:৩৮:১)। এই ধনের মধ্যে অনুক্ত হলেও অন্নও আছে। তিনি প্রচুর অন্নলাভের জন্যে তোমাদের বিশেষ ভাবে রক্ষা করুন–প্রাবস্তু বস্তুজয়ে বাজাসাতয়ে’; (৫:৪৬) ইন্দ্র এবং অগ্নি এক সঙ্গে বৃত্রনিধন করে অন্ন দান করুন–স্মথস্কৃত্ৰিমুত সনেীতি বাজমিন্দ্ৰা বো। অঅগ্নি সঙ্করী সপর্যাৎ।’ (৬:৬০:১), ‘গাভী প্রমুখ অন্ন দান করুন। ঊষা–উষং গোৎগ্রান উপমাসি বাজান; (১৯২৭) ‘ঊষাগুলি অন্ন আনে, অয়ি অন্নবতি (ঊষা)–বাজপ্রসূতাঃ বাজিনীবতি’; (১.৯২:৮, ১১, ১৩, ১৫) ‘ঊষা সৎ কাজের জন্যে, দানের জন্যে অন্ন বহন করে আনেন-ইষং বহতী সুকৃতে সুদানবে।’ (১:৯২:৩)
অন্যান্য সূক্তে ঊষার একটি অনুষঙ্গ আছে: ভোর হলে পশুপালক পশুপাল নিয়ে গোঠে যায়, চাষি চাষ করতে মাঠে যায়। দুটো কাজই শেষ পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। এ সব কাজে মানুষকে প্রবর্তনা দেন। ঊষা, ভােরে ঘুম ভাঙিয়ে তারা যেন নিজের নিজের খাদ্য উৎপাদনের ভূমিকায় তৎপর হয়। ঊষা তাই গৌণ ভাবে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। ঊষা তাই বাজিনীবতী’ অর্থাৎ অন্নবতী, এবং তাই তার স্তবে খাদ্যের উল্লেখ। ইন্দ্র অন্ন, বল ও শক্তির অধিপতি–স বাজস্য শব্বস্য শুন্মিণস্পতিঃ।।’ (১:১৪৫:১) এখানে অন্ন, বল ও শক্তি পরপর উচ্চারিত। আগন্তুক আর্যরা এ দেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে বল ও শক্তির গুণে: এ শক্তি আসবে কোথা থেকে? অন্ন থেকে, তাই অন্ন এত প্রয়োজনীয়। ‘হে অশ্বিনারা, যে সুরক্ষা দিয়ে স্তোতাকে অন্ন দিয়ে পালন কর সেই সুরক্ষা নিয়ে তোমরা এস-ব্যাভির্বিপ্রং প্র ভরদ্বাজমাবতং তাভিরুষ উতিভিরশ্বিনা গতম।’ (১:১১২:১৩) ‘তোমার দ্বারা রক্ষিত হয়ে, হেইন্দ্র আমরা অন্নলাভ করব–ত্বোত ইদিন্দ্র বাজমস্মনা’ (২:১১:১৬১) বারবারই দেখছি সুরক্ষার সঙ্গে অন্নের একটা সাযুজ্য ধ্বনিত হচ্ছে। এর কারণ একটা প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার মধ্যে আগন্তুক এবং জনগোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্ব দৃঢ় করতে চাইলে প্রথম প্রয়োজন শক্তি, এবং যেহেতু অন্নই সেই শক্তি জোগায় তাই অন্নের জন্যে এত আর্ত আবেদন। ‘ত্বষ্টা দেবগণ ও দেবপত্নীগণের সঙ্গে অন্নে প্রীত হোন–মন্দস্ব জুজুষাণো অন্ধসঃ তুষ্টা দেবেভিজনিভিঃ’; (২:৩৬:৩) ইন্দ্র অন্নকে উন্মোচিত করেছিলেন–অপাবৃণোদিষ ইন্দ্ৰঃ।’(১:১৩০:৩) অৰ্থাৎ দলপতি ইন্দ্রের পরাক্রমের ফলে ফলের লোকেদের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছিল, অন্ন আর তাদের কাছে আবৃত বা দুস্তপ্রাপ্য রইল না। ইন্দ্র, রক্ষাকামী আমরা তোমাদের সুরক্ষার দ্বারা অন্ন বৃদ্ধি করব–স্যাম তে ত ইন্দ্র যে ত উতী অবসুব উর্জং বর্ধয়ন্ত।’ (২:১:১৩) ওই একই ধরনের যোগসূত্র, সুরক্ষার সঙ্গে অন্নের, এখানেও দেখা যাচ্ছে।
দেবতারাই অন্ন দেন, কিন্তু সে-ও একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, সেটি হল যজ্ঞ। মানুষ যজ্ঞে দেবতাদের স্তব করে; তাঁদের আকৃতি, বেশবাস, অস্ত্র, অলংকার, গুণ, শক্তি ও পূর্ববতীর্ণ ভক্তদের তাঁরা কী কী দিয়েছেন তার তালিকা পেশ করে; তা ছাড়াও চারু, পুরোডাশ, সোম, সুরা ইত্যাদি হব্য উৎসর্গ করে–এই বিশ্বাসে যে, স্তবে ও হব্যে দেবতারা প্রীত হন, ফলে ভক্তের প্রতি অনুকুল হয়ে তার প্রার্থিত দ্রব্য তাকে দেন। কাজেই যজ্ঞই সেই প্রক্রিয়া যা দেবতাদের কাছে মানুষের প্রার্থনা পেশ করে, তাদের কাছ থেকে মানুষের প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়ে আনে। ‘সোমরস ছাঁকা হচ্ছে (সোমযোগে) অন্নলাভের জন্যে–পবন্তে বাজাসাতয়ে সোমাঃ’; (৯:১৩:৩) ‘দেবতা অন্ন ও পানীয় দান কোরো–রাস্ব বাজমুত বাংস্ক’; (৬:৪৮:৪)–বলা হচ্ছে যজ্ঞের প্রসঙ্গে। অন্নের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করছি–অন্নং যজেব’; (২:২৪:১২) ‘(দেবতা) হব্য আস্বাদন কর ও অন্ন দান কর–স্বদস্ব হিব্যা সমিষা দিদীহি’; (২:২২:১১, ৯:৩১:২) যজ্ঞ কিসের জন্য করছি? ‘অন্ন লাভের জন্যে এবং ধনলাভের জন্যে— বাজস্য সাতৌ পরমস্য রায়ঃ’; (৭:৬০:১১ (যজ্ঞে) পূষা আমাদের (জন্যে) প্রচুর অন্ন ও রথ রক্ষা করুন; আমাদের স্তব শুনুন ও (আমাদের) অন্নের বৃদ্ধি সাধন করুন–অস্মাকমুর্জ পূষা আবিষ্ট মাহিনঃ। ভুবন্দ্বাজানাং বৃধ ইমং ন শূণবদ্ধবম; (৯:২৬:৯) ‘আমরা অন্ন ও ঋকগুলি দিয়ে অন্ন ধারণ করছি–দধামন্নৈঃ পরি বন্দ ঋগভিঃ।’ (৩:৩৫:১২)
এখানেও যজ্ঞের উপকরণগুলিকে অন্নের উৎপাদক হিসাবে দেখানো হয়েছে:
‘এই তিনি বহু অন্নযুক্ত যজ্ঞে খাদ্য উৎপাদন করছেন–এষ উ স্য পুরুত্রতো জজ্ঞানো জনয়ন্নিষঃ।।’ (৯:৪:১০) যজ্ঞে ‘স্তোতাদের দ্বারা অন্ন ও গাভী (আনতে) যাচ্ছেন–স হি জরিতৃভ্য আ বাজং গোমন্তমবাতি।’ (৯:২৬:৯) ‘সেই (দেবতার) যজনা কর (যিনি দেবেন) কাম্যবস্তু, সকল মানুষের স্তুতির ফলে সঞ্জাত অন্ন–স আ যজস্ব নৃবতীরনু ক্ষণঃ স্পার্থ ইষঃ ক্ষুমতী বিশ্বজন্যাঃ’ (৯:১:৬)
মানুষের প্রয়োজন ও প্রার্থনা এবং দেবতাদের অনুগ্রহ— এর মধ্যে সেতুরচনা করে, যজ্ঞ মানুষের হবিৰ্দন ও স্বস্তুতি বহন করে দেবতাদের কাছে নিয়ে যায়, যাতে তাঁরা করুণাপরবশ হয়ে ক্ষুধিতকে খাদ্য দান করেন। যজ্ঞ, যা আদিমতম ধর্মানুষ্ঠান, তার একটা প্রধান ভিত্তিই হল অন্নের ও অন্যান্য নানা প্রয়োজনীয় বস্তুর অভাব। বলা বাহুল্য, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রার্থনা যেহেতু অন্নের জন্যেই, তাই সহজেই বোঝা যায়, এই প্রাথমিক প্রয়োজনই ছিল যজ্ঞকর্মের মূল প্রবর্তনা।
আবার মানুষ, ইন্দ্র ও বরুণের কাছে এমন প্রার্থনাও করছে যাতে সেই মানুষ নিজেও অন্নদান করতে পারে (ভুয়াসিং বাজদান্নাম ১:১৭:৪), কারণ, অন্নের অভাব সমাজে পরিব্যাপ্ত; খুব ছোট একটি অংশই প্রয়োজনের অনুপাতে যথেষ্ট অন্নের সংস্থান করতে পারত; বাকিরা অন্নাভাবে কষ্ট পেত। স্বভাবতই কিছু মানুষ সেই কষ্ট দেখে তা মোচন করতে উৎসুক হত। তা ছাড়া অন্নহীন সমাজে অন্নদান করার মধ্যে একটা গৌরব আছে। সমাজে প্রতিপত্তি লাভেরও এটা একটা নিশ্চিত পন্থা। তাই অন্ন দান করার মর্যাদা অর্জন করবার জন্যে এই প্রার্থনা। যাদের অন্নের প্রাচুর্য ছিল তারা সকলেই কিন্তু অন্যের অভাব মোচনে তৎপর ছিল না। এখনকার মতো তখনও বিস্তর লোক প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও কৃপণ ছিল। দান করে অন্নভাণ্ডার ক্ষয় করার মতো পরার্থপরতা খুব কম লোকেরই ছিল:
‘যে দান করে সে ভোজক; অন্নকামী প্রার্থী, যে (অনাহারে) হাঁটতে হাঁটতে রোগ হয়ে গেছে তাকে দান করা ঐশ্বৰ্যবানের লক্ষণ–সাইড্রোজ্যে যে গৃহবে দদাত্যন্নকামায় চত্রতে কৃশায়।’ (১০:১১৭:৩) ‘যে অন্ন ভিক্ষা করে, সহানুভূতি-প্ৰাখী যে ব্যক্তিকে (অন্ন) দান করে না, সে বন্ধু নয়–ন স সথা যো ন দদাতি তস্মৈ সচাভুবে সচমানায় পিতুঃ।’ (১০:১১৭:৪) ‘প্রচুর অন্নের মালিক যে ব্যক্তি ঘুরে বেড়ানো দারিদ্র্যপীড়িত যাচকের প্রতি মন কঠিন করে, অন্ন দিয়ে তার সেবা করে না, উত্তরকালে সে কোনও সাহায্যকারী পাবে। না–যে আধুয়ে চরমাণায় পিত্বোৎস্নবান সন রফিতায়োপ জঙ্গুষ্যে। স্থিরং মনঃ কুণুতে ন সেবাতে পুরোতো চিৎ স মৰ্ভিতায়োপজখুকে রং না বিন্দতে।’ (১০:১১৭:২)
‘যে মানুষটা মর্মস্তিক দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট হয়ে মনমরা হয়ে গুমরে রয়েছে তাকে কখনও বিদ্রুপ কোরো না; একে (দারিদ্র্যাকে) অমর দেবতারাই পাঠিয়েছেন।(৪) হেসিয়ড এখানে বলতে চান দেবতাদের ইচ্ছাক্রমেই মানুষ দরিদ্র হয়, অতএব বিধাতার বিধানে যে ব্যক্তি দরিদ্র তার দারিদ্র্য তো তার দোষে ঘটেনি। অতএব, তাকে নিয়ে শ্লেষ বিদ্রূপ করা ঠিক নয়। ‘কোনও কিছুর প্রয়োজন থাকলেও সেটা না জোটাতে পারলে হৃদয় বিষন্ন হয়।’(৫) এই অভাবের চুড়ান্ত প্রকাশ তো অন্নাভাব, এবং অন্নাথী সব সময়ে অন্ন ভিক্ষা করেও পেত না। এমন অভাবগ্রস্তের চিত্র আক্কাদীয় সাহিত্যে পাই। উপবাসে আমার চেহারা (বিকৃত হয়েছে), আমার মাংস ঝুলে পড়েছে, আমার রক্ত (শেষ হয়ে যাচ্ছে), আমার হাড় ভেঙে গেছে। আমার পেশীগুলো (ব্যাধিতে) ফুলে উঠেছে…।’(৬) এই উপবাসের চেহারা পৃথিবীর সর্বত্রই এক। এ হল অন্নাভাবের আদি ও অকৃত্রিম চেহারা।
অন্নপ্রার্থীকে বিমুখ করা তখন সমাজে গৰ্হিত বলে গণ্য হত। এর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকাশ যেমন্ত্রটিতে তা হল, ‘কৃপণ বৃথা অন্ন ভোজন করে, সত্য বলছি, তার বিনাশই ঘটে। সে অর্যম (দেবতা)কে পুষ্ট করে না, বন্ধুকেও করে না; যে একাকী (নিজের) অন্ন ভোজন করে, তার পাপ তার একারই হয়–মোঘমন্নং বিন্দতে প্রচেতাঃ সত্যং ব্রবীমি বধ ইৎস তস্য। নাৰ্য্যমণং পুষ্যতি নো সখায়ং কেবলাঘো ভবতি কিবলাদী।’ (১০:১১৮:৬) এই মন্ত্রে কৃপণের প্রতি ধিক্কারের একটি বিশেষ তাৎপৰ্য আছে। যে সময়কার সমাজের কথা হচ্ছে তখন শুধু যে খাদ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত ছিল না, তাই নয়, তখন যে দুৰ্ভাগ্য দরিদ্র খাবারের সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। শীর্ণ শরীরে, তার একমাত্র ভরসা ছিল কোনও গৃহীর করুণা ও আতিথ্য।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে গ্রিক লেখক হেসিয়াড় বলেন, মানুষের জন্যে বিধাতার নির্দেশিত কাজ করা যাতে মনের প্রচণ্ড গ্লানিতে তুমি ও তোমার স্ত্রী-পুত্র কোনও প্রতিবেশীর কাছে জীবিকার জন্যে প্রাথী না হও ও সে তোমাকে বিমুখ না করে।’(৭)
সমাজে অল্প কিছু লোকের প্রাচুর্য ছিল; খাদ্য-ভিক্ষু আশায় বুক বেঁধে তার কাছে প্রার্থ হত উদরপূর্তির জন্যে। এই প্রাথিত আতিথ্য কিন্তু তখন তার শেষ ভরসাস্থল, সেখানে গৃহস্বামী বিমুখ হলে তখনকার সমাজব্যবস্থায় তার ক্ষুধা নিবারণের আর কোনও বিকল্পই ছিল না। এখনকার মতো খাবারের দোকান বা হোটেল ছিল না, থাকলেও ওই হতদরিদ্রের সঙ্গতি ছিল না। দাম দিয়ে খাবার কেনার। তাই এই ধিক্কার। অর্ষমা আৰ্যদের গোষ্ঠীগত মর্যাদার ও আর্যত্বের প্রতিনিধিস্থানীয় দেবতা। কৃপণ ব্যক্তি অৰ্যমাকেও প্রকারাস্তরে বিমুখ করে, মানুষ সখাকেও। অতএব দেবতাদের মধ্যে কোনও সাহায্যকারী সে পায় না, তাই তার সম্বন্ধে মন্ত্রটি বিধান দিচ্ছে মৃত্যুর। কারণ যে-কৃপণ আন্নোর ভাগ কাউকে না দিয়ে একা খায় তার পাপের বোঝাও সে একই বহন করে। দেবতার হয়ে সমস্ত সমাজ ধিকার দিচ্ছে অন্নদানে বিমুখ ধনীকে। কেন? কারণ তখন সত্যিই বহু দুঃস্থ মানুষেরই অন্নসংস্থান ছিল না। অন্নভিক্ষাই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল।
যে-অন্নদানে কৃপণ তারও আতঙ্কের হয়তো কিছু হেতু ছিল। প্রকৃতির ওপরে তখন মানুষের এতটা নিয়ন্ত্রণ ছিল না যে খাদ্য সম্বন্ধে মানুষ নিশ্চিত থাকতে পারে। খাদ্য সঞ্চয় করার মতো উন্নত বিজ্ঞান ছিল আয়ত্তের বাইরে। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হত মাঝেমাঝেই। শত্রুরা লুঠ করত। খাদ্য। স্বভাবতই মানুষ যা পারত ভবিষ্যতের দুদিনের জন্যে সঞ্চয় করে রাখত। সবটা তার শুধু কৃপণতা নয়, অনিশ্চয় এবং নানা বিপর্যয়ের জন্যে অভাবের সম্ভাবনাও তাকে সন্ত্রস্ত রাখত। তাই অভাবে এবং স্বভাবে মানুষ মাঝে মাঝে কার্পণ্য দেখাত।
এতক্ষণ ঋগ্বেদ সংহিতার কথাই হচ্ছিল। এর দশটি মণ্ডলের শেষেরটি যখন রচনা হয় সম্ভবত সেই সময়েই যজুর্বেদ সংহিতা রচনাও চলছিল। অথর্ব সংহিতার কিছু অংশ ঋক সংহিতার চেয়েও প্রাচীন আবার কিছু অংশ ঋক ও যজুর্বেদের পরের রচনা। যজুর্বেদের প্রধান সংহিতা তৈত্তিরীয়তে যে সমাজ চিত্রটি পাই তাই আৰ্য-প্ৰাগাৰ্য মিশ্রণের চিহ্ন বহন করে। এ মিশ্রণ গোষ্ঠীগত ভাবে অন্তর্বিবাহের দ্বারা সাধিত; এর প্রতিভাস পাওয়া যায়। এর সাংস্কৃতিক অধিসংগঠনে। সংস্কৃতির একটা অংশ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণে প্রতিফলিত। তৈত্তিরীয় সংহিতায় অনুষ্ঠানের কিছু নির্দেশের সঙ্গে যজ্ঞকালে যে পাঠ করতে হবে তাও আছে। এই মন্ত্রগুলিই আমাদের এই সমাজের অবস্থা জানিবার একমাত্র সূত্র। এখানেও দেখি ক্ষুধার প্রকোপ সমান ভাবেই আছে। দেবতাকে বলা হচ্ছে, ‘তুমিই অন্নের সত্য ও আশ্চর্যাদাতা, যে অন্নের সঙ্গে আছে গাভী, বলদ, বশী গাভী–ত্বং হি সত্যে অদ্ভুতো দাতা বাজস্য গোমতে উক্ষান্নায়, বাশান্নায়…।’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা; ১৩:১৪:৭) অন্যত্র শুনি, ‘অগ্নি, আমাদের আয়ুকে পবিত্র কর, খাদ্য অন্ন উৎপাদন কর-আগ্নে আয়ুংষি পাবস্ব আ সুবোজামিষাং চ নঃ।।’ (তৈ/সং; ১:৩:১৪:৮; ১:৬:৬:২) প্রায় সমকালীন অথর্ব সংহিতায় শুনি, ‘লোকজয়কারী, স্বৰ্গপ্ৰাপ্তির উপায় এই যে প্রচুর অন্ন, (দেবতা তুমি) একে ব্ৰাহ্মণের জন্যে নিহিত রেখেছ–ইমমোদনং নি দধে ব্ৰাহ্মণেষু বিষ্টারিতং লোকজিতং স্বৰ্গম।’ (অথর্ব সংহিতা: ৪:৩৪:৪)
খাদ্যে অগ্ৰাধিকার ব্রাহ্মাণেরই যে সমাজে ক্ষুধা ব্যাপক এবং ক্ষুধিতের অধিকাংশ অব্রাহ্মণ, তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষ, সেখানে অন্নকে মুষ্টিমেয় অনুৎপাদক মানুষের অধিকারে রক্ষা করা অমানবিক। কিংবা খাদ্যকেই উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা জানানো হচ্ছে, ‘এস খাদ্য, এস অন্ন, সত্য এস, সুরক্ষা এস–উর্জ এহি স্বধ এহি সুনূত এহীরাবত্যেহীতি।’ (অ/সং; (৮:১০:৪) আগেই দেখেছি পর্যাপ্ত খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিধান করে এবং সুরক্ষা শক্তিমানের কাছে সহজলভ্য। ভক্ত প্রার্থনা করছে, বৈশ্বানরের (অগ্নির) মহৎ মহিমা যে অন্ন তা আমাদের (পক্ষে) শুভ এবং মধুময় হোক–বৈশ্বানরস্য মহতো মহিমা শিবং মহ্যং মধুমদত্ত্বন্নম।’ (আ/সং; ৬:৭:৩) এ অন্ন এক প্রজন্মের জন্যে হলে আশ্বাস যথেষ্ট হয় না। পরবর্তী প্রজন্মও যেন অন্নাভাবে কষ্ট না পায় সে প্রার্থনাও শুনি। যজ্ঞকালে ‘পুত্রের নাম নেয়, (এর দ্বারা) তাকেও অন্নের ভোক্তা করে–পুত্রস্য নাম গৃহ্নাতি অন্নাদ্যমেবৈনিং করোতি।’ (তৈ/সং; ১:৫:৮:৫) শুধু পুত্র নয়, পরবর্তী দ্বাদশ পুরুষ যেন অন্ন ভোজন করে, সে ব্যবস্থাও যজ্ঞের দ্বারা নিশ্চিত করে তুলতে চেয়েছে মানুষ–সযোন্যেবান্নমবা রুন্ধে দ্বাদশাৎ পুরুষাদন্নমত্তি।’ (তৈ/সং; ২.৬.২.৩)
অন্ন যথেষ্ট ছিল না বলেই সমাজে সে সম্বন্ধে নানা কুসংস্কারও দেখা গিয়েছিল। এখনও আমরা যেমন চাল না থাকলে সরাসরি তা বলি না, বলি ‘চাল বাড়ন্ত’, ঠিক তেমনই অথর্ব সংহিতায় শুনি, ‘যে অন্নের মহিমা জানবে সে (অন্নের সম্বন্ধে) বলবে না ‘অল্প’ বা ব্যঞ্জন নেই’, ‘নেই’ (বলবে না), ‘এটা নেই’ (বলবে না), বা কী?’ (বলবে না)–স য ওদনস্য মহিমানং বিদ্যাৎ নাল্প ইতি ব্রায়ান্নানুপসেচন ইতি নেদমিতি চ কিং চেতি।’ (অ/সং; ১১:৩:২৩-২৪) স্পষ্টতই এমন একটা সংস্কার প্রচলিত ছিল যে অন্ন সম্বন্ধে এ জাতীয় নালিশ করলে কোনও দেবতা কোথাও রুষ্ট হবেন, আর অন্নদান করতে চাইবেন না। অন্ন কি সামান্য কোনও বস্তু? এই অন্ন থেকেই প্রজাপতি তেত্রিশ ‘লোক’ সৃষ্টি করেছিলেনএতস্মাদা। ওদনাৎ ত্রয়ন্ত্রিংশতং লোকং নিরমিমীত প্রজাপতিঃ।।’ (অ/সং; ১১:৩:৫২) ‘জলি নিয়ে দম্পতী তণ্ডুল থেকে অন্ন পাক করেন–তা ওদনং দম্পতিভ্যাং প্রশিষ্টা আপঃ শিক্ষান্তী পচতা সুনাথাঃ।।’ (ওই, ১২:৩:৫২) অন্নের মাহাত্ম্য স্পষ্ট উচ্চারণ পেয়েছে: ‘এই অন্ন ভোগ করেই দীর্ঘকাল উদীয়মান সূর্যকে দেখব–ইহেড়য়া সধমাদং মদন্তো জ্যোক পশ্যেম সূর্যমুচ্চরন্তম।’ (অ/সং; ৬:৬২:৩)। এই হল বৈদিক যুগের প্রথমার্ধের অন্তর্নিহিত গভীর বাসনা: মোক্ষ নয়, পুনর্জন্ম নয়, এই জন্মে এই পৃথিবীতেই যতদিন সম্ভব বাস করে উদীয়মান সূর্যের দর্শন পাওয়া এবং এই দীর্ঘজীবনকে সুনিশ্চিত করতে পারে একমাত্র যথেষ্ট অন্নলাভের নিশ্চিত আশ্বাস। স্পষ্টই বোঝা যায় এ আশ্বাস মিলছিল না; সব মানুষের জন্যে যথেষ্ট অন্ন উৎপন্ন হচ্ছিল না; তাই এই কামনা এতবার উচ্চারিত।
ভক্তের প্রার্থনা যেন অন্ন ভোজন করতে পারি। ‘অগ্নি, আমি দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞকর্মের দ্বারা (লব্ধ) অন্নে যেন অন্নভোজী হই–আগ্নেরহং দেবযজ্যায়ান্নাদন্নাদো ভুয়াসম’ (তৈ/সং; ১:৬:১১:৫) অথর্ববেদের বিখ্যাত ভূমিসূক্তে পড়ি ‘হে ভূমি, বল ও পুষ্টি যুক্ত অন্নের ভাগ ও ঘৃত (যেন পাই)–উর্জং পুষ্টং বিভ্রতীমন্নভাগং ঘৃতম…।’ (অ/সং; ১২:১:২৯) অন্নের ওপরে মানুষের প্রাণ নির্ভর করে বলেই বলা হয়েছে অন্নই প্রজা’–অন্নং বিটু।’ (তৈ/সং; ৩:৫:৭:২) এ অন্নের কি কম মাহাত্ম্য? ‘ঋতের প্রথম সন্তান ওদন, প্রজাপতি তপস্যার দ্বারা একে ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছিলেন–য মোদনং প্রথমজা ঋতস্য প্রজাপতিস্তপসা ব্রহ্মাণ্যপচৎ।’ (আ/সং; ৪:৩৫:১) রুদ্রদের মায়ের নাম পৃশ্নি, সেই ‘পৃশ্নিই অন্নের রূপ –পৃগ্নিৰ্ভাবত্যেতদ্বা অন্নস্য রূপম।’ (তৈ/স; ২:১:৭:৫) বিরাট একটি ছন্দের নাম যার তাৎপর্যাযজ্ঞে বারবার উল্লিখিত হয়েছে এবং বহুবার একথা বলা হয়েছে যে এই দশ-অক্ষর-যুক্ত বিরাটই অন্নবিরাডন্নং বিরাজি এব অন্নাদ্যে প্রতিষ্ঠতি।’ (তৈ/সং; ৫:৪:৬:৩) দশাক্ষরা বিরাডন্নম (তৈ/সং; ৩.৩.৫.৫; ৬.১.৯.৬; ৭.৩.৭.৪; ৭.৪.২.১; ৭.৪.৪.৩; ৭.৫.৮.৩; ৭.৫.১৫.২)
এতগুলি মন্ত্রে অন্ন ও বিরাট এর সমীকরণ অন্নের গুরুত্ব বোঝায়–বৈশ্বানর (অগ্নি)-র মহান মহিমায় অন্ন আমার পক্ষে শুভ ও মধুময় হোক–বৈশ্বানরস্য মহতো মহিমা, শিবং মহ্যং মধুমদত্ত্বন্নম।’ (আ/সং; ৬:৭:৩) অন্নকে দেবতাদের সঙ্গে সমীকৃত করে বলা হয়েছে, অন্নই আদিত্য, অন্নই মরুদগণ-অন্নং বা আদিত্যান্নং মরুতঃ।।’ (তৈ/সং; ৫:৩:৪:৩) ‘অম্নই অগ্নি–অন্নং বৈ পাবকঃ ‘ (তৈ/সং; ৫:৪:৬:৩) ‘অন্নই সকল দেবতার সমাহার-বৈশ্বদেবং বা অন্নম’ (তৈ/সং; ৬:৬:৫:৩) অন্নের স্বরূপ কী ছিল তার একটা আভাস মেলে যখন শুনি ‘অন্ন হল যাব–অন্নং বৈ যাবা।’ (তৈ/সং; ৫:৩:৪:৫) অর্থাৎ আর্যরা তখন যাবই উৎপাদন করছে এবং সেটাই প্রধান খাদ্যশস্য। আর দুধ তো পশুপালক আর্যদের, দীর্ঘদিনের খাদ্য ছিলই। এখন তারা শস্য মিশিয়ে পায়স করতে শিখেছে, সে পায়স হয়ে উঠেছে খাদ্যমানুষের, অতএব দেবতারও। চারু নৈবেদ্য দেওয়া হত যজ্ঞে, ‘এ-ই হল সাক্ষাৎ অন্ন যা চারু, চারু দিয়ে অন্নকে অধিকার করে রাখে–এতৎ খলু বৈ সাক্ষাদান্নং যদেষ চারুর্যদেতং চরুমুপদধতি সাক্ষাদেবাম্মা অন্নমবা রুন্ধে।’ (তৈ/সং; ৫:৬:২:৫) এ ছাড়া ভাতের কথাও শুনি, ‘এই যে ওদন, সর্বাঙ্গ, সর্বপূরক, পূর্ণাঙ্গ, যে এ কথা জানে সে-ও সর্বাঙ্গ ও পূর্ণাঙ্গ হয়–এষ বা ওদনঃ সর্বপরুঃ সর্বতনুঃ। সর্বাঙ্গ এবং সর্বপরুঃ সং ভবতি যা এবং বেদ।’ (আ/সং; ১১:৩:৩১) ‘যে অন্ন ভক্ষণ করি, বহুরূপ বহু বিচিত্র সুবর্ণ, অশ্ব, গাভী অথবা অজ, মেষ–এর যা কিছুই গ্রহণ করি। অগ্নি তার হোতা হয়ে, তাকে সুষ্ঠু হবন করুন–যদন্নমন্ত্রি বহুধা, বিরূপং হিরণ্যমশ্বমুগামজামবিম। যদেব কিিঞ্চ প্রতিজগ্রাহমগ্নিশুদ্ধোতা সুহুতং কৃণোতু।’ (অ/স; ৬.৭১.১)
অন্নকে দেবতারূপে দেখার মধ্যেও এর মহার্ঘতা ও দুষ্প্রাপ্যতা এ দুইয়েরই অনুষঙ্গ আছে, আর আছে। এর পবিত্রতার বোধ। আর পাঁচটা প্রয়োজনীয় বস্তুর থেকে অন্ন স্বতন্ত্র। শুধু বহুমূল্য নয়, এটা দেবতার অনুগ্রহের দান, এতে এর মহিমা যেন প্রকাশিত হচ্ছে, এর স্বরূপই হল দেবতা। এর পুষ্টি ও শক্তি দেওয়ার ক্ষমতাও একে অন্য এক মর্যাদা দিয়েছে। ইতিহাসের সেই পর্বে আগন্তুক জনগোষ্ঠী যদি পায়ের তলার মাটিকে শক্ত করতে চায়। তবে শক্তির উৎস তার কাছে প্ৰায় উপাস্য হয়ে দেখা দেবেই। অন্নকে শক্তিস্বরূপ ভেবে নানা ভাবে তার মহিমা কীর্তন করেছে মানুষ।
সে যুগে নিরাপত্তার সঙ্গেই যুক্ত ছিল খাদ্যসংস্থানের সমস্যা। তাই সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছিল ক্ষুধাতৃষ্ণার আতঙ্ক। আগেই দেখেছি বামদেব ক্ষুধা ও অভাবের তাড়নায় কুকুরের নাড়িতুড়ি রান্না করে খেয়েছিলেন। এই ক্ষুধা তাড়া করে ফিরেছে বহু নিরুপায়, বিত্তহীন, অন্নহীন দরিদ্রকে। তাদের মনে হয়েছে ‘ক্ষুধাই শত্ৰু, যে এ কথা জানে সে ক্ষুধা রূপ শক্রকে হনন করে–ক্ষুৎ খলু ভ্রাতৃব্যং য এবং বেদ হস্তি ক্ষুধং ভ্রাতৃব্যম।’ (তৈ/সং; ২:৪:১২:৫) সে প্রাণপণ চেষ্টা করে কোনও মতে খাদ্য সংগ্রহ বা অর্জন করবার। যখন তার ক্ষুধা বিনাশের চেষ্টা সার্থক হয়, তখনই সে ক্ষুধা-শক্রিকে হনন করতে পারে। মানুষ যখন বলে ‘খাদ্য অন্ন আমি গ্রহণ করছি, তখন খাদ্য ও অন্নের দিক অবরুদ্ধ করে। সেই দিকে যে থাকে সে ক্ষুধিত হয়-ইষমুৰ্জমহমদদে ইতীষমেবোর্জিং তম্মে দিশোৎব রুন্ধে ক্ষোধুক ভবতি যস্তস্যাং দিশি ভবতি।’ (তৈ/সং, ৫:২:৫:৬) অন্ন দিয়ে মৃত্যুকে উত্তীর্ণ হওয়ার কথাও শুনি, ‘লোকধারণের নাভিমূল এই ওদন। তার দ্বারা মৃত্যুকে উত্তরণ করব–যো লোকানাং নাভিরেষা তেনৌদনেন তরামি মৃত্যুম।’ (আ/সং; ৪:৩৫ সূক্তটির ১-৬ মন্ত্রের ধ্রুবপদ এই বাক্যটিই)। এর চেয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ কমই আছে: অন্ন দিয়েই মৃত্যুকে তরণ করা যায়। অর্থাৎ আন্নাভাবই মৃত্যু, খাদ্যই জীবন। ‘সংবৎসরের দ্বারা ঐ ব্যক্তি ‘অন্ন আমার, অক্ষুধা আমার’ এই কথা বলে অন্নকে বেঁধে রাখে, এই হল অন্নের রূপ–সংবৎসরেণৈবাস্মা অন্নমবা রুন্ধেহান্নং ম্যেক্ষুচ্চা ম ইত্যহৈতিদ্বা অন্নস্য রূপম।’ (তৈ/সং; ৫:৪:৮:২) ‘সে বন্ধুসমেত প্রজাদের অন্ন ও অন্নভোজনকে অভূদিত করে, সে-ই বন্ধুসমেত প্রজাদের ও অন্নভোজনের প্রিয় আশ্রয় হয়। যে এ কথা বোঝে–স বিশঃ সবন্ধুনম্নমন্নাদ্যমভু্যদতিষ্ঠং।। বিশী চ বৈ সবন্ধুনাং চান্নাদ্যস্য চ প্রিয়ং ধাম ভবতি যা এবং বেদ।।’ (আ/সং; ১৫:৮:২৩) অন্নভোজন এমন একটা ব্যাপার যার নিশ্চয়তা নেই বলেই কেউ যখন বহুজনের, বন্ধুসমেত প্রজাদের জন্য খাদ্যসংস্থান করে তখন সে বহুলোকের প্রিয় আশ্রয় হয়। অন্নদাতা ত প্রকারান্তরে জীবনদাতা-ই। তাই অন্নদাতার প্রশংসার অন্তর্নিহিত থাকে জীবনরক্ষার আশ্বাসের প্রশংসা।
‘ঋতু ছটি, প্রজাপতির দ্বারা এ ব্যক্তির অন্নভোজন গ্রহণ করে ঋতুরা, তারপরে ওকে তা দান করে–যাটু বা ঋতবঃ প্রজাপতিনৈবাস্যান্নাদ্যমাদায়ার্তাবো অস্মা অনুপ্রযচ্ছন্তি’ (তৈ/সং; ৩:৪:৮:৬) ছয় ঋতু মানে সম্বৎসর। উৎপাদন ব্যবস্থা এমন স্তরে ছিল না যে সাধারণ মানুষের সারা বছর খাবার জোটবার কোনও আশ্বাস ছিল, তাই মানুষ ভেবেছিল প্রজাপতি, যিনি ফসলের ও প্রজননের অধিদেবতা, তার কাছে থেকে ঋতুরা যদি খাদ্য সংগ্রহ করে। এবং মানুষকে তা দান করে তা হলে অনাহারের আতঙ্ক কিছু কমে। ‘হে অন্নপতি, আমাদের অন্ন দাও, …অগ্নিই হলেন অন্নপতি, তিনিই একে অন্ন দান করেন–অন্নপতে অন্নস্য নো দেহীত্যগ্নির্ব অন্নপতি স এবাস্মা অন্নং প্রথস্থতি।’ (তৈ/সং; ৫:২:২:১) বারবারই দেখছি অন্ন কোনও দেবতার দান বলে একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। বোঝা সহজ, এর মূলে ছিল অন্নের অপ্রাচুর্য, ফলে যখন কারও আহারের সংস্থান ঘটে, তখন সে খাদ্যকে দেবতার দান বলেই সাদরে গ্রহণ করে। একটা কারণ, উৎপাদন ব্যবস্থা এতটা অগ্রসর ছিল না যে, প্রাকৃতিক বিপর্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়লাভের নিশ্চয়তা দিতে পারত। ফসল ফলাবার সমস্ত চেষ্টাই মাঝে মাঝে ব্যাহত হত, ফলে মানুষের নিজের শক্তির ও তার প্রয়াসের সাফল্যের ওপরে আস্থা রাখা সম্ভব ছিল না। যারা অন্নের বিষয়ে জানত সেই আমাদের কৃষকদল বিদ্যা দ্বারা (ভূমি) খনন করে যা উৎপাদন করেছিল, ‘হে অগ্নি, সেই হব্য রাজা বিবস্বানের উদ্দেশে যজ্ঞে হবন করছি, এ বার আমাদের যজ্ঞিয় অন্ন মধুময় হোক–যদি গ্ৰামং চক্রুনিখনন্ত অগ্নে কাষীক অন্নবিদো ন বিদ্যায়। বিবস্বতে রাজনি তৰ্জ্জুহোমােথ যজ্ঞিয়ং মধুমদস্ত নোৎস্নম।’ (আ/সং; ৬:১১৩:১) ‘বল এবং সুবুদ্ধি সেখানে মরুদগণ প্রচুর ভাবে বর্ষণ করুন যেখানে মানুষের আছে, আমাদের দিকে (তাঁরা) মধু সিঞ্চন করুন–ঊর্জং চ তত্র সুমতিং চ পিন্বত যত্র নরো মরুতঃ সিঞ্চম মধু।’ (অ/সং; ৬:২২:২)
দেবতারা অন্নদান করলেও সেটা যজ্ঞের মারফৎ মানুষের কাছে পৌঁছয়। ধারণাটা এ রকম ছিল যে মানুষ হব্য দিয়ে দেবতার ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে, বিনিময়ে তাঁরা মানুষকে যা যা দান করেন তার মধ্যে এক প্রধান দান হল খাদ্য। এই বিনিময়টা নিম্পন্ন হয় যজ্ঞের মাধ্যমে, যে-যজ্ঞে মানুষ প্রথমে খাদ্য দিয়ে দেবতাকে আপ্যায়ন করে, খাদ্য ও অন্যান্য প্রার্থিত দ্রব্য লাভের আশায়:
‘মানুষ পৃথিবীকে অন্নভোজনের (উদ্দেশ্যে) অনুকুল করতে পারেনি। পৃথিবী এই মন্ত্র দর্শন করেন; তখন তাকে (সে) অন্নভোজনের (উদ্দেশ্যে) অনুকূল করতে পারল—পৃথিবীমান্নাদ্যে নোপানমৎ সেতং মন্ত্রমপশ্যত ততো বৈ তামান্নাদ্যমুপানমৎ’ (তৈ/সং ১:৫:৪:২) অন্নকামী ব্যক্তি (দেবতা) পূষার উদ্দেশে বলিকালে (ছাগ)। হনন করুক, অন্নই পূষা। তার নিজের ভাগ দিয়েই পূষার কাছে উপস্থিত হয়, তাঁরা একে অন্ন দান করেন; সে অন্নভোজক হয়পৌষ্ণং শ্যামমালভেত। অন্নকামঃ অন্নং বৈ পূষা; পূষণমেব স্বেন ভাগধেয়েনোেপ ধাবতি ত এবাস্মা অন্নং প্রযস্থতন্ত্যন্নাদ এবং ভবতি।’ (তৈ/সং ২:১:৬:১) ‘যার জন্য (এ) অন্নভোজী হোক কামনা করবে, সেই হেতু রাজা ইন্দ্রের উদ্দেশে ত্ৰিধাতু (বলি) উৎসর্গ করবে–যং কামায়েত অন্নাদঃ স্যাদিতি তস্মাদেতং ত্ৰিধাতু নির্বােপৎ ইন্দ্ৰায় রাজ্ঞে।’ (তৈ/সং ২:৩:৬:১) ‘অন্নকামী বিশ্বদেবের উদ্দেশে চিত্ররূপা (পশু) হনন করবে, বিশ্বদেবেরই অন্ন সমস্ত দেবতার উদ্দেশে নিজের অংশ নিয়ে উপস্থিত হয়; তাঁরা একে অন্ন দান করেন–বৈশ্বদেবীং বহুরূপামালভেত। অন্নকামো বৈশ্বদেবং বা অন্নং বিশ্বানেব দেবান স্বেন ভাগধেয়েন ধাবতি এবাস্মা অন্নং প্রযচ্ছতি।’ (তৈ/সং ২:১:৭:৫)
বিশ্বদেব বৈদিক সাহিত্যের প্রথম পর্বের শেষের দিকের একটি কল্পনা। সমস্ত দেবতার সমন্বিত দেবমণ্ডলীর একটি কল্পরূপ। এদের কাছে সমবেত ভাবে, আবার এদের মধ্যে কোনও কোনও দেবতাকে একক ভাবেও স্তব করে প্রার্থনা করা হত। যেমন, বরুণের জন্যে সোমরস, যজ্ঞে দান করেও অন্নভোজী হওয়া গেল না:
‘সে এই কৃষ্ণবর্ণ বশ বরুণের (বিশিষ্ট) পশু বশী গাভী দেখতে পেল, সেই কৃষ্ণবর্ণ বিশা গাভী হনন করল তার নিজস্ব দেবতার (বরুণের) উদ্দেশে; তখন (তার) অন্নভোজী হওয়ার জন্যে (বরুণ) অনুকুল হলেন–বরুণং সুষুব্বাণমন্নাদ্যং নোেপানমৎস এতাং বারুণীং কৃষ্ণাং বশ্যামপশ্যৎ তাং স্বায়ৈ দেবতায়া আলাভত ততো বৈ অন্নাদ্যমুপানমৎ’ (তৈ/সং ২:১:৯:১) ‘দেবতাদের মধ্যে অগ্নিই অন্নভোজী–অগ্নিৰ্দেবানামান্নাদঃ ‘ (তৈ/সং ২:৬:৬:৫) ‘আমি (যেন) অন্নবান হই’ এই কামনা যে করে, সে অন্নবান অগ্নির উদ্দেশ্যে আটটি সরায় পুরোডাশ উৎসর্গ করবে–অগ্নয়ে অন্নাবতে পুরোডাশমষ্টকপালং নির্বাপদষঃ কাময়েদ অন্নবান স্যাম।’ (তৈ/স ২:২:৪:১, ওই কথাই অন্য ভাবে আছে তৈ/স ৩:৪:৪:৩) স্তুতিমাত্র ইন্দ্রের দ্বারা অন্নোর আহার নিশ্চিত হয়।’ (তৈ/সং ২:১২:৭:২) যাদের বিষয়ে কামনা করবে। যে সে অন্নবান হোক, এই নিমিত্ত রাজাইন্দ্রের উদ্দেশে ত্ৰিধাতু যাগ অনুষ্ঠান করুক–যং কামায়েত অম্নাদঃ স্যাদিতি তস্মাদেতং ত্ৰিধাতুং নির্বাপেৎ ইন্দ্ৰায় রাজের।’ (তৈ/সং ২:৩:৬:১) বিরাজ ছন্দের মন্ত্রোচ্চারণযুক্ত যোগের দ্বারা অন্নকে অবরোধ করা যায়–বিরাজৈবান্নাদ্য মবরুন্ধে।’ (তৈ/সং ২:৬:১:২) রথীস্তর স্তোত্রের দ্বারাও অন্নভোজনকে অবরুদ্ধ (বা নিশ্চিত) করা যায়। (তৈ/সং ৫:৪:১১:২) কর্ম বা যজ্ঞের দ্বারা (দেবতাদের দ্বারা) অন্ন প্রেরিত হয় এমন কথাও শুনি। (তৈ/সং ৩:২:১১:১)। অন্নকামী দ্ৰোণপাত্রে অন্নসঞ্চয় করবে, দ্ৰোণে অল্প রাখা হয় (অতএব) উৎপত্তিস্থল-সমেত অন্নকে অবরোধ করা যায়।’ (তৈ/সং৫:৪:১১:২) ‘যে অগ্নিচয়ন (যজ্ঞ) করে সে অন্ন ভোজন করে–অগ্নিং চিম্বানমত্তান্নম৷’ তৈ/সং ৫:৬:১০:২) ‘মহাব্রত যাগ যে সম্পাদন করে সে অন্নভোজন(কে) নিশ্চিত করেমহাব্রতাবান অন্নাদ্যাস্যাবারুদ্ধয়ৈ।’ (তৈ/সং ৭:২:২:২) ‘যে দক্ষিণার পাঁচটি পাত্রে অন্ন ও ছাগ দান করে সে অন্ন, তেজ ও শক্তি দোহন (লাভ) করে–ইষং মহা উৰ্জমস্মৈ দুহে যো পঞ্চৌদনং দক্ষিণাজ্যোতিষং দদাতি।’ (অ/সং ৯:৫:২৪)
উপরের মন্ত্রগুলি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, অন্নবান হওয়ার কামনা বৈদিক সমাজের একটি গভীর ও মৌলিক কামনা; এ কামনার ভিত্তি হল সার্বিক খাদ্যাভাব; এবং মানুষ আপন চেষ্টায় যেটুকু উৎপাদন করছে তাতে এই ব্যাপক ক্ষুধা বা খাদ্যাভাবের কোনও প্রতিকার করা যাচ্ছে না। ক্ষুধা সমাজে পরিব্যাপ্ত। মানুষ দেখছে লৌকিক প্রয়াসে এ ক্ষুধার সমাধান নেই, তাই সে দ্বারস্থ হচ্ছে দেবতাদের: জনে-জনে দেবতাদের ডেকে বলছে, অন্ন দাও, শস্য দাও, ক্ষুধা নিবারণ কর; ক্ষুধাতৃষ্ণই মৃত্যু, এ মৃত্যু থেকে বাঁচাও আমাদের। বহু দেবতার কাছে, বিভিন্ন ভাষায়, বারংবার এই প্রার্থনায় ফুটে উঠেছে সমাজের সমবেত এক আর্তি।
মানুষ ক্ষুধায় জর্জর এবং প্রতিকারের কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না, এই অবস্থায় দেবতাকেন্দ্ৰিক যজ্ঞনির্ভর সমাজে যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যাপ্তি ও প্রসার ঘটেই। সমস্ত যজুর্বেদে তাই দেখি, আজ যা নিরর্থক যজ্ঞানুষ্ঠান বলে মনে হয় তারই একটি প্রকাণ্ড সমাবেশ, যেটির মধ্যে প্রতিফলিত রয়েছে একটি অস্তনিহিত অভাব, খাদ্য উৎপাদনের অ-পর্যাপ্ত ব্যবস্থার ফলে করুণ খাদ্যাভাব।’(৮) এই সময়ের যজুর্বেদের সাহিত্যে জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম একক সংজ্ঞা হল ‘গ্ৰাম’, ‘গ্রাম শব্দটির মুখ্য তাৎপর্য তখনও ছিল এক যাযাবর পশুচারী গোষ্ঠী।‘(৯) পরে যজুর্বেদেরই অন্তর্ভুক্ত শতপথ ব্ৰাহ্মণে পড়ি ‘শর্যাতো হ বা ইন্দং মানবো গ্রামেণ চাচার’ (৪:১:৫:২): শৰ্য্যাত গ্রাম, অর্থাৎ পশুচারী যাযাবর জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। এই ভ্ৰাম্যমাণ পশুপালক দল কৃষিতে নিযুক্ত হওয়ার আগে কোথাও স্থিতিশীল হয়ে বসবাস করেনি; পশুপালের জন্যে চারণভূমি যেখানে তৃণশ্যামল, সেখানেই থাকত; খরায়, বন্যায় বা পশুপাল ঘাস খেয়ে যখন রুক্ষ করে ফেলত তৃণভূমিকে তখন দলবল এবং পশুপাল নিয়ে নূতনতর চারণভূমির সন্ধানে তাদের বেরিয়ে পড়তে হত। খাদ্য অর্জনের এই স্তরে মানুষ সম্পূর্ণত প্রকৃতি-নির্ভর। প্রকৃতি সদয় হলে, যথাকলে বর্ষণ হলে, আকস্মিক কোনও দুৰ্যোগ দেখা না দিলে তৃণভূমি পশুপালের এবং প্রকারান্তরে পশুপালকদেরও আহার জোগাত। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটলেই পশু ও পালকের অবধারিত অনাহার ও মৃত্যু, যদি না তারা তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে পারত। এ অবস্থা খাদ্যের প্রাচুর্য সূচিত করে না। প্রাথমিক ভাবে যখন কাঠের ফলার লাঙলের চাষ এরা শিখল তখনও প্রয়োজনের তুলনায় খাদ্যের জোগানে প্রচুর ঘাটতি ছিল, তাই বহু সংখ্যক দেবতার কাছে, খাদ্যের জন্যে বারংবার এত করুণ আকুতি, নানা ভাষায় এত প্রার্থনা। এবং নিত্যনুতন যজ্ঞ আবিষ্কার করে অনুষ্ঠান করে পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো, কিসে খাদ্য সংস্থান নিরাপদ ও পর্যাপ্ত হয়। যজুর্বোদের ক্রমবর্ধমান যজ্ঞের সংখ্যা, জটিলতা ও ব্যাপ্তির পশ্চাতে খাদ্যাভাবের পর্দটিই বেশি করে চোখে পড়ে। ‘অথৰ্ববেদের রচনার কিছু অংশ ঋগ্বেদেরও পূর্বের, আর কিছু অংশে যজুর্বেদ সংকলনেরও পরের, সেই জন্যে অথৰ্ববেদের সব শেষে উল্লেখ। এখানে খাদ্যের সংজ্ঞা এবং সে সম্বন্ধে প্রার্থনায় কিছু বৈচিত্ৰ্য আছে: ব্রীহি, তণ্ডুল, ওদন, শারিশকা শ্যামাক, মাষ,ইত্যাদি। ধন্যবাচক নানা শস্যেরও নাম যেমন পাচ্ছি। তেমনই খাদ্যের অপর অংশ দুধ, দুগ্ধজাত খাদ্য ও মাংসের জন্যে পশুপালের কুশল প্রার্থনা পাচ্ছি। (আ/সং ২:২৬; ৩:১৪; ১৬:৫৯) এ সব পশু যেন হিংস্র শ্বাপদের ও দসু্যর আক্রমণ থেকে রক্ষণ পায় সে জন্যেও পশুপালকের প্রার্থনা পাই। (আ/সং ৪:৩) সহসা বজ্রপাতে শস্যের ক্ষতি যেন না হয় তার জন্যে (আ/সং ৭:১১) এবং কীটপতঙ্গ যেন ফসল না নষ্ট করতে পারে তার জন্যেও প্রার্থনা পাই। (আ/সং ৬:৫০) যা কিছু ক্ষুধার্ত মানুষের উদরপূর্তির উপকরণ জোগায় তার সংরক্ষণের জন্যে প্রার্থনা এখানে আছে। এ ধরনের প্রার্থনার অনুবৃত্তি পরবর্তী যুগেও আছে। আর্য আগস্তুকরা দক্ষিণ-পূর্বে এগোতে এগোতে বিহারের দক্ষিণ-পূর্বদিকে এসে পৌঁছনোর কাছাকাছি সময়ে অথর্ববেদের কিছু অংশ রচিত হয়, তাই অপেক্ষাকৃত পরবর্তী যুগের–যে যুগে সংহিতাগুলির শেষাংেশের সমান্তরাল ভাবে ব্রাহ্মণগুলির প্রথমাংশ রচনা চলছিল— সেই সময়কার চিত্র বিধৃত আছে অথর্ববেদে।
অথর্ববেদের শেষ পর্যায়ের একটি রচনাতে দেখি যে তখন খাদ্যসম্ভারে কিছু বৈচিত্ৰ্য এসেছে। কুন্তাপসূক্তে এক জায়গায় পড়ি: ‘কোনটা তোমার জন্যে আনব? দই, ঘোল না। যবসুরা?’ এই কথা স্ত্রী স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, ‘সেই রাজ্যে, যেখানে রাজা পরিক্ষিৎ রাজত্ব করেন–কাতরত্ত আ হরামি দধি মস্থং পরিসুতম। জায়াঃ পতিং বি পৃচ্ছতি রাষ্ট্রে রাজ্ঞঃ পরিক্ষিতাঃ।।’ (আ/সং ২-:১২৮:৯) এত বিকল্পের অর্থপ্রতীকী সমৃদ্ধি। অর্থাৎ শুধু যে সমাজে কিছু বিত্ত এসেছে তা নয়, এ বিত্ত এসেছে অল্প কয়েকটি ভাগ্যবানের হাতে। রাজা পরিক্ষিতের রাষ্ট্রে ধনীরা ভাল খেত, তাদের ভাণ্ডারে নানা বিকল্প খাদ্য ছিল; পরিতৃপ্ত বধু স্বামীকে তখন প্রশ্ন করতে পারে, ‘কোনটা খাবে, বল?’ অর্থাৎ শুধু উদরপূর্তির জন্যে বাধ্যতামূলক ভাবে যার যেটুকু জোটে তাই নয়, রুচির প্রশ্নও এসেছে সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। পরবর্তী সাহিত্যে পরীক্ষিতের রাজ্যকালকে কলিযুগের সূত্রপাত হিসেবে দেখা হত, অর্থাৎ সে যুগে অন্তত কিছু লোকের ভাগ্যে খাদ্যের বেশ কিছু বিকল্প ও প্রাচুর্য দেখা দিয়েছিল। বোঝা কঠিন নয়, এই কতিপয় ভাগ্যবানের বাইরে বৃহত্তর সমাজে অন্নের জন্যে হাহাকার অব্যাহতই ছিল। রাজা পরীক্ষিৎ ও কিছু বিত্তশালী রাজন্য বা বণিক সারা দেশের সমৃদ্ধি প্রমাণ করে না। শুধু প্রমাণ করে যে তখন শস্য উৎপাদনে কিছু বৈচিত্র্য এসেছিল।
———————–
(১) Habib, Irfan & Faiz Habib, ‘The Historical Geography of India 1800-800 BC.’ in Proceedings of the indian History Congress, 52nd section (ed), K M Srinali, Secy, Indian History Congress, New Delhi, 1991-92, pp. 72-97.
(২)‘… a vast area with a pre-Aryan population extended from South liran through Afganistan to Baluchistan in which the speakers of the Indo-lranian and the Indo-Aryan languages settled after 2000 B C R S Sharma; Looking for the Aryans, Orient Longman, 1995, p 70.
৩ ‘No god helped, none seized my hand,’ ‘Akkadian observations on life and world order’ পরিচ্ছেদ, Ancient Near Eastern Text (ed) J P Pritchard, Princeton, 1955 p.
৪. ‘Never dare to taunt a man with deadly poverty who eats out the heart; it is sent by the
deathless gods.’ Hesiod: Works and Days Loeb. II. 717-18
৫. ‘…it grives the heart to need something and not to have it, bid II, 368-69)
৬. ‘Through starving my appearance. … my flesh is flaccid, my blood is (going) my bones are smashed… my muscles are inflamed.’ ‘Akkadian Observation on life and world order’ in Near Eastern Texts pp. 25-27
৭. ‘Work the works which the gods ordained for men, lest in bitter anguish of spirit you with your wife and children seek your livelihood amongst your neighbours and they do not hced.’ Hessiod, Works and Day II. 398-99
৮. ‘The whole 6f the Taittirya Samhita with its monstrous accretion of what now appears to be senseless ritual reflects a painful underlying necessity shortage of food under the inadequate system of production.’ Kosambi An Introduction… to the Study of Ancient lndian History.’ p. 140
৯. ‘The word grama had still the major connotation of a pastoral group on the move.’ W Rail. Staat und gesellschaft. p. 5
Leave a Reply