১৪. চৌরপঞ্চাশক

চৌরপঞ্চাশিকা

চৌরপঞ্চাশিকা কাব্যটির মোট ৯৮টি পাণ্ডুলিপি এ যাবৎ পাওয়া গেছে (Barbara Stoler Miller: Fantasies of Love thief; Columbia University Press; 1971 দ্রষ্টব্য) এগুলিকে মোটামুটি দু ভাগে ভাগ করা যায়: উত্তর ভারতীয় ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতীয়। এই দ্বিতীয় পাঠটির দুটি অংশ: (ক) একশোটি কাহিনিমূলক শ্লোক ও মূল কাব্যের চারটি শ্লোক নিয়ে পূর্ব পঞ্চাশৎ; ও (খ) পরিচিত পাঠের পঞ্চাশটি শ্লোকে উত্তর পঞ্চাশৎ, এর অন্তে কয়েকটি অধিক শ্লোক সন্নিবিষ্ট। বিখ্যাত ক্যাটালোগাস্ ক্যাটালোগারাম-এ চৌরসুরতপঞ্চাশিকা ও চৌরীসুরতপঞ্চাশিকা, বিল্‌হণপঞ্চাশিকা ও শশিকলা পঞ্চাশিকা নাম ও কাব্যের উল্লেখ আছে। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক লাসেন ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গ্রন্থাগারে একখানি কাশ্মীরি পাণ্ডুলিপি পান ও অধ্যাপক পেক্রস্ ফন বোলেনকে দেন; তিনি গণপতির টীকাসমেত একটি জার্মান সংস্করণ ১৮৮৬ সালে প্রকাশ করেন। ওই বছরেই পরে একটি জার্মান সংস্করণ প্রকাশিত হয়। (Wilhelm Solf: Die Kashmir Recension der Pancasika) ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ৪৩৮:১৮৮৪-৮৭] সংখ্যক পাণ্ডুলিপিতে তিনটি বিভিন্ন পাঠের সংকলন পাওয়া যায়; এতে বিল্ণচরিত কাব্যের পরে আরও ৯০টি শ্লোক আছে। তিনটি পাঠভেদের মধ্যে পাঁচটি শ্লোক সাধারণ— এগুলি আর্যাবর্ত পাঠের ১, ২, ১১, ১২ ও ৫০ সংখ্যক শ্লোক। চৌরপঞ্চশিকা-র টীকাকারদের মধ্যে গণপতি, মহেশ্বর, পণ্ডিত, রাম তর্কবাগীশ (রামোপাধ্যায়) ও রাধাকৃষ্ণের নাম পাওয়া যায়।

আমেদাবাদে চিত্রশালায় চৌরপঞ্চাশিকা-র আঠারোটি শ্লোকের চিত্রায়ণ সংরক্ষিত আছে, এগুলি পশ্চিম-ভারতীয় চিত্রকলার রীতিতে ষোড়শ শতকে অঙ্কিত। পদ্মশ্রী মুনি জিনবিজয়জির সৌজন্যে এগুলি মেহ্তা সংগ্রহে স্থান পায় ও ১৯৬৭ সালে শ্রীমতী লীলা শিবস্বরকার নয়া দিল্লি থেকে এগুলির প্রতিলিপিও সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন (The pictures of the Caurapancasika: A Sanskrit Love Lyric). এর আগে বার্লিংটন ম্যাগাজিনের নবতিতম সংখ্যায় এ ছবিগুলি প্রকাশিত হয়েছিল।)

অনুবাদ

১৮৪৮ সালে প্যারিসে চৌরকাব্যের ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়, এইটিই প্রথম বিদেশি অনুবাদ। এর পরে ১৮৯৬ সালে স্যার এডউইন আর্নল্ড ইংরেজি ছন্দে একটি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ভারতীয় ভাষায় প্রথম গুজরাতি অনুবাদ (বিটুহলের) প্রকাশিত হয় শশিকলাবিরহবিলাপ নামে ষোড়শ শতকের শেষে; মারাঠি অনুবাদ হয় ১৬৭১ সালে।

চৌরপঞ্চাশিকা-র বাংলা অনুবাদ ও ছায়ানুবাদ নানা ভাবে নানা সময়ে হয়েছে। গোবিন্দদাসের কালিকামঙ্গলকাব্যে চৌতিশায় (চৌত্রিশটি পদ্যে) সুন্দর বিদ্যাকে স্মরণ করছে। অন্য কবিরাও চৌতিশা লিখেছেন, এগুলিতে স্বর-ব্যঞ্জনক্রমে আদ্যাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে প্রত্যেক পয়ারের আদিতে। বাংলা অনুবাদে নায়িকার নাম কোথাও শশিকলা, যা যামিনীপূর্ণতিলকা নয় নায়কও চোর বা বিল্‌হণ নয়— সর্বত্রই নায়িকা বিদ্যা, নায়ক সুন্দর। এর কারণ মনে হয় চৌরপঞ্চশিকা-র প্রথম শ্লোকের শেষ চরণটি— ‘বিদ্যাং প্রমাদগণিতামিব চিন্তয়ামি— মনে হয় সে যেন মোহাচ্ছন্ন বিদ্যা।’ এর থেকেই নায়িকা বিদ্যা নাম পেয়েছে। বাংলায় তাই মঙ্গলকাব্যের এই অংশটি বিদ্যাসুন্দর নামেই পরিচিত। কৃষ্ণরামের কালিকামঙ্গলে সুন্দর রাজার কাছে ন’টি শ্লোক পাঠ করছেন, এগুলি চৌরকাব্যের নটি শ্লোকের অনুবাদ। কাশীনাথ ব্রজবুলিতে কিছু কবিতা রচনা করেছেন (সুর-সংযোগে) যা চৌরপঞ্চাশিকা—অনুবাদ বা ভাবার্থ নয়, বরং বিল্হণ কাব্যের অনুসরণে বিদ্যাসুন্দর কাব্য। বস্তুত বিদ্যাসুন্দর কাব্যাংশগুলির আখ্যানভাগ বিল্‌হণ কাব্য থেকেই সংগৃহীত। অষ্টাদশ শতকে ভারতচন্দ্রের বিন্দাসুন্দরই সমধিক প্রসিদ্ধ। এখানে সুন্দর রাজার সামনে চৌরপঞ্চাশিকা-র প্রথম ও শেষ শ্লোকের বাংলা অনুবাদ করে (‘ক’ পুঁথি অনুসারে অবশ্য সমগ্র চৌরপঞ্চাশিকা-রই বাংলা অনুবাদ)। রাজা কন্যার রূপ ও সম্ভোগশৃঙ্গারের বর্ণনায় লজ্জিত হন, শ্মশানে সুন্দর পঞ্চাশটি পয়ারে কালিকার স্তব করেন। চৌতিশার মতো এগুলিরও আদ্যাক্ষর স্বর-ব্যঞ্জন-ক্ৰমে বিন্যস্ত। দেবী স্বয়ং অভয়দান করলে রাজার চেতনা হয় এবং বিদ্যা ও সুন্দর কৈলাসশিখরে যান। অষ্টাদশ শতকের শেষে (১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে) টীকাকার রাম তর্কবাগীশ দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেন যে চৌর কবি সুন্দর দেবী কালিকার উদ্দেশে শ্লোকগুলি রচনা করেন।

অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে কবীন্দ্র মধুসূদন চক্রবর্তী সম্পূর্ণ চৌরপঞ্চাশিকা-র অনুবাদ করেন পয়ার ছন্দে। ওই শতকেরই শেষার্ধে দ্বিজ রাধাকান্ত মিশ্রের বিদ্যাসুন্দর-এ মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত সুন্দর রাজার সামনে চৌরপঞ্চাশিকা-র প্রথম সাতটি ও শেষ দুটি শ্লোকের অনুবাদ করেন ও শ্মশানে চৌতিশায় কালীর স্তব করেন। ভারতচন্দ্রের সমকালীন কবি রামপ্রসাদ সেন কবিরঞ্জন তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যে চৌরপঞ্চাশিকা-র প্রথম দুটি, আটাশ ও শেষ, শ্লোকের অনুবাদ করেন।

বররুচির প্রণীত বলে খ্যাত একটি বিদ্যাসুন্দর কাব্য আছে, এটি সংস্কৃতে বিদ্যা ও সুন্দরের উক্তি— প্রত্যুক্তিক্রমে ৫৭টি শ্লোকে রচিত। (এটি শ্রীপ্রফুল্ল পালের অনুবাদে শ্রীঈশানচন্দ্র ঘোষ বসুমতী সংস্করণে প্রকাশ করেন ১৮৭৩ সালে।) পরিশেষে, অনেক বাংলা মঙ্গলকাব্যে বিদ্যাসুন্দর অংশে সুন্দরের মুখে দ্ব্যর্থবোধক পঞ্চাশটি বাংলা কবিতা পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটির যুগপৎ বিদ্যাপক্ষে ও কালীপক্ষে ব্যাখ্যা সম্ভব। কাশীনাথ সার্বভৌম চৌরপঞ্চাশিকা-র যে টীকা করেন এ ধরনের দ্ব্যর্থক অনুবাদ তারই ভিত্তিতে রচিত। অন্যান্য গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট বিদ্যাসুন্দরের দ্ব্যর্থক অনুবাদে কোনও ভণিতা নেই বলে এগুলি ভারতচন্দ্রের বলে মনে করা হত; কিন্তু এখন নিঃসংশয়ে জানা গেছে এগুলি নন্দকুমার কবিরত্নের অনুবাদ। (১৯৭৪ সালে বিশ্ববাণী থেকে প্রকাশিত শ্রীঅবন্তী সান্যাল সম্পাদিত হাজার বছরের প্রেমের কবিতা-য় শ্রীঅলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের অনুবাদে চৌরপঞ্চশিকা-র ন’টি শ্লোকের বাংলা অনুবাদ আছে। ইংরেজিতে প্রাগুক্ত বারবারা স্টোলার মিলার-এর বই ও The Hermit and the Love Thief, Columbia University Press, 1978, বইতে চৌরপঞ্চশিকা-র একই অনুবাদ সন্নিবেশিত আছে।

চৌরকবি ও কাহিনির পটভূমিকা

স্যার আর্নল্ড এডউইনের ধৃত পাঠে চৌরপঞ্চাশিকা-র পঞ্চাশটি শ্লোকের পূর্বে আরও চুয়াত্তরটি শ্লোক পাওয়া যায়; কাব্যমালার পাঠে এগুলি পূর্বপীঠিকা এবং এতে কবির পূর্ব জীবনী আছে, এখানে কবি বিল্হণই চোর। শেষের পঞ্চাশটি শ্লোক উত্তরপঞ্চাশৎ, এটিই চৌরপঞ্চাশিকা। বিল্হণের পূর্বপীঠিকা পড়ে জানা যায় মহিলাপত্তনে বীরসিংহ নামে এক চাপোকট রাজা ছিলেন, চম্পাবতী এঁর রাজধানী ছিল, ৯০২ খ্রিস্টাব্দে এঁর মৃত্যু হয়। এঁর কন্যার নাম উত্তর ভারতীয় পাণ্ডুলিপিতে শশিকলা এবং কর্ণাটে প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিতে মদনাভিরামের কন্যা যামিনীপূর্ণতিলকা। বিল্‌হণ তাঁর নিজের রচিত বিক্রমাঙ্কদেবচরিত গ্রন্থে আত্মকথা কিছু বলেছেন, সেখানে কিন্তু চৌরপঞ্চশিকা-র অনুরূপ কোনও অভিজ্ঞতার কথাই বলেননি। বিক্রমাঙ্কদেবচরিত ১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিল্হণের পরিণত বয়সের রচনা। এখানে যে বিবরণ আছে সে অনুসারে তিনি ১০৬২-৬৫ সালের মধ্যে স্বদেশ পরিত্যাগ করেন ও একাদশ শতকের শেষ দিকে দেশভ্রমণ ও সাহিত্য রচনা করেন। রাজতরঙ্গিনী-র সপ্তম সর্গে দেখি রাজা কলশের রাজত্বকালে বিল্হণ তাঁর স্বদেশ কাশ্মীর পরিত্যাগ করে কর্ণাটে যান; সেখানকার রাজা পরমাদি তাঁকে সভাপতিপদে বরণ করে বিদ্যাপতি উপাধি দেন (শ্লোক ৯৩৫-৩৮; এ উপাধিও কি নায়িকার নাম ‘বিদ্যা’ হওয়ার অন্যতম কারণ?)। বিক্রমাঙ্কদেবচরিতে বিল্‌হণ বলেছেন, যারা সীমা মেনে চলে না, সর্বদা লজ্জাজনক অশুদ্ধ ভাষা বলে সেই গুর্জরদের পথে পড়ে যে সন্তাপ তিনি অর্জন করেছিলেন সোমনাথ দর্শন করে তা মোচন করেন; এখানে কি চৌরপঞ্চাশিকা-র অভিজ্ঞতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে?

বিল্হণকাব্যে পাই রাজা বীরসিংহ কন্যা শশিলেখার অধ্যাপকরূপে কবিকে নিযুক্ত করেন কিন্তু পাছে পরস্পরের প্রতি তাঁদের আসক্তি জন্মায় এই আশঙ্কায় তাঁদের বলেন যে রাজকন্যা কুষ্ঠরোগিণী ও বিল্‌হণ জন্মান্ধ। দারুযবনিকার দুই পারে থাকতেন ছাত্রী ও অধ্যাপক। এক পূর্ণিমা রাত্রে সহসা যবনিকা সরিয়ে পরস্পরকে দেখেন তাঁরা এবং অনুরাগের সঞ্চার হয়; গোপনে তাঁরা নিয়মিত মিলিত হতেন। কিছুদিন পরে রাজা জানতে পারেন ও কবির প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। ঘাতকেরা যখন তাঁকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে তখন অতীতের মিলনের স্মৃতি তাঁর মনে উদ্বেল হয়ে ওঠে এবং পঞ্চাশটি শ্লোকে তিনি শেষবারের মতো স্মৃতিচারণ করেন। তাঁর কাব্যনৈপুণ্য এবং আবেগের গভীরতায়, মুগ্ধ অভিভূত রাজা দণ্ড প্রত্যাহার করেন ও সসম্মানে তাঁর হাতে রাজন্যাকে সমর্পণ করেন।

বাংলা অনুবাদে এ-কাব্যের যে পরিণতি হোক না কেন চৌরপঞ্চাশিকা-য় শ্লিষ্ট অর্থ নেই, তার কোনও দ্যোতনাই নেই, এটি স্পষ্টতই শৃঙ্গাররসের কাব্য। প্রাক্কাহিনিটি ঐতিহাসিক সত্য কিনা সে গবেষণা নিষ্ফল; আসন্ন মৃত্যুর কালো যবনিকাখানি পশ্চাতে আছে মনে রেখে কাব্যটি পড়লে এর তীব্রতা অনুভূত হয় এবং এখানেই সম্ভবত ওই প্রাক্ কাহিনিটির উপযোগিতা ও সার্থকতা।

প্রভাব

বিল্‌হণ তাঁর কর্ণসুন্দরী কাব্যে বলেছেন যে তিনি কাব্যরচনায় কালিদাসের অনুগামী, একথা চৌরকাব্যে খুব স্পষ্ট ভাবে অনুভব করা যায়; অজবিলাপ ও মেঘদূত-এর বহু অনুকরণ এ কাব্যে পাওয়া যায়। এও এক ধরনের বিলাপকাব্য, কারণ কাহিনি অনুসারে কবি তো জানতেন না যে তাঁর আসন্ন মৃত্যু প্রতিহত হবে। বরং মেঘদূত-এর যক্ষ জানত যে চার মাস পরে তার বিরহের অবসান ঘটবে, চৌরকবি কিন্তু সম্পূর্ণ নিরাশচিত্তেই প্রিয়তমার স্মৃতিটুকু পাথেয় নিয়ে মৃত্যুপথে অবতীর্ণ। দুই নায়কই নায়িকার ক্ষীণতা সুকুমারতা স্মরণ করে আশঙ্কিত যে এ বিরহ তাদের প্রিয়তমা সইতে পারবে না। এখানে চৌরপঞ্চাশিকা-য় তীক্ষ্ণতা বেশি, কারণ নায়ক প্রেমের জন্যে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।

কাহিনি

সংস্কৃত সাহিত্যের অধিকাংশ কাব্যনাটকই রামায়ণ-মহাভারত থেকে আখ্যানভাগ সংগ্রহ করেছে, উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমগুলির মধ্যে প্রধান উদয়নকথা। বৃহৎকথা-য় এর উল্লেখ থাকলেও নিশ্চয়ই এর আগেই কাহিনিটি জনপ্রিয় হয়েছিল। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে নাট্যকার ভাস এ কাহিনি অবলম্বন করে একাধিক নাটক রচনা করেছেন ও পঞ্চম শতকে কালিদাস যে ভাবে ‘উদয়নকথাকোবিদগ্রামবৃদ্ধান্’ বলেছেন মেঘদূত-এ, তাতে মনে হয় গাঁয়ের ছেলেবুড়ো সকলে ভিড় করে গাঁও-বুড়োর মুখে এই অপূর্ব প্রেম কাহিনিটি তন্ময় হয়ে শুনত। হয়তো দাক্ষিণাত্যে এমনই একটি কাহিনি ছিল চোর কবির এই গোপন প্রেমের কাহিনি। দুই কাহিনিতেই গুরু-শিষ্যার প্রেমই কাহিনির মূলবস্তু চৌরকবির কাহিনি এমন করেই স্থানীয় শ্রোতার মর্ম স্পর্শ করেছিল যে শুনতে পাই :

বসো শুভ্রমৃতবসন্তসময়ঃ পুষ্পং শরণ্মল্লিকা।
ধানুষ্কঃ কুসুমায়ুধঃ পরিমলঃ কস্তুরিকাস্ত্রং ধনুঃ।।
বাণী তর্করসোজ্জ্বলা প্রিয়তমা শ্যামা বয়ো যৌবনং
মার্গঃ শাংকর এব পঞ্চমলয়া গীতিঃ কবিবিল্‌হণঃ।।

(বসনের মধ্যে (শ্রেষ্ঠ) শুভ্র বাস, ঋতু বসন্ত, ফুল শরতের মল্লিকা, ধনুর্ধর পুষ্পধনু মদন, প্রিয়তমা সদ্যযৌবনা নারী, বয়স যৌবন, ধর্মমার্গ শৈব, গান পঞ্চমলয়যুক্ত এবং কবিকুলে শ্রেষ্ঠ বিল্‌হণ।

অত্যুক্তি বাদ দিলেও বিল্হণের আঞ্চলিক যশ এ শ্লোকে প্রতিষ্ঠিত। প্রসন্নরাঘবে জয়দেব কবিতা নায়িকা সম্বন্ধে বলেছেন:

যস্যাশ্টৌরশ্চিকুরনিকরঃ কর্ণপুরো ময়ূরো।
ভাসো হাসঃ কবিকুলগুরুঃ কালিদাসো বিলাসঃ।।
হর্ষো হর্ষো হৃদয়বসতিঃ পঞ্চবাণুসত্মস্তু বাণঃ।
কেষাং নৈষা কথয় কবিতাকামিনী কৌতুকায়।।

(চৌবকবি যাঁর কেশকলাপ, ময়ূর কবি যাঁর কর্ণাভরণ, ভাস হাসি, কবিকুলগুরু কালিদাস যাঁর বিলাস, শ্রীহর্ষ যাঁর আনন্দ, বাণভট্ট যাঁর চিত্তে মদনস্বরূপ এমন কবিতাকামিনী, বল, কার না কৌতুকের হেতু? )

এখানে সম্ভবত প্রচ্ছন্ন প্রেমের কবি বলেই বিল্হণকে অন্ধকার কেশকলাপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। চৌরকবির এই গোপন প্রেম, ধরা পড়ে প্রাণদণ্ডাজ্ঞা এবং মৃত্যুর ঠিক পূর্বাহ্নে তদ্‌গতচিত্তে কবিতায় প্রিয়ামিলনের স্মৃতিমন্থন এবং সে কাব্যের মহিমায় অভিভূত প্ৰসন্ন রাজার প্রাণদণ্ডের পরিবর্তে কন্যাদান— এ সমস্ত ব্যাপারটির ঐতিহাসিকতা যত ক্ষীণই হোক না কেন মৃত্যুর মুখোমুখি এসে প্রেমিকার স্মৃতিতে বিহ্বল কবিচিত্তের এই উচ্ছ্বাস; এটি নিশ্চয়ই আপামর সাধারণের চিত্তজয় করেছিল— এর করুণ মাধুরী দিয়ে। এবং জনমানসে এ কাব্য যে অক্ষয় আসন লাভ করেছিল তা শুধু এর কাব্যমাহাত্ম্যে নয়, ওই আসন্ন মৃত্যুর ক্রূর পটভূমিকার মাহাত্ম্যেও বটে।

খণ্ডকাব্য চৌরপঞ্চাশিকা

চৌরপঞ্চাশিকা কাব্যটি খণ্ডকাব্যের অন্তর্গত অর্থাৎ এ কাব্যে শ্লোকগুলি পরস্পর সংবদ্ধ নয়, কোনও আখ্যান বিবৃত করে না, ন্যূনাধিক পঞ্চাশটি আপাতবিচ্ছিন্ন শ্লোকের সমাহারে কাব্যটি রচিত। এই যুগেই শতককাব্যগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর পূর্বযুগে ভর্তৃহরির শতকত্রয় (নীতিশতক, বৈরাগ্যশতক ও শৃঙ্গারশতক), অমরুর অমরুশতক, বাণভট্টের চণ্ডীশতক, ময়ূরকবির সূর্যশতক-ই সমধিক প্রসিদ্ধ শতককাব্য। এগুলির মধ্যে শৃঙ্গারশতকও অমরুশতক-ই চৌরপঞ্চাশিকা-র সঙ্গে তুলনীয়। অপরপক্ষে শতককাব্য ছাড়াও শৃঙ্গাররসাশ্রিত কবিতার অনুরূপ সংকলন পাই; এগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কালিদাসের মেঘদূত, পরে এর অনুসরণেও কিছু শৃঙ্গাররসের দূতকাব্য রচিত হয়। সম্ভবত কালিদাসেরও পূর্বে মাত্র বাইশটি শ্লোকের একটি কবিতাগুচ্ছ ঘটকর্পরকাব্য (ইয়াকবি এটিকে প্রাক্কালিদাস রচনা বলেছেন)। এখানে বিরহিণী মেঘকে দিয়ে বিদেশে প্রেমিককে বার্তা পাঠাচ্ছে। (সম্ভবত এটি ও মেঘদূত দুটিরই ওপর চিনা এক মেঘদূতকাব্যের প্রভাব আছে)। পরবর্তীকালে গোবর্ধনাচার্যের আর্যাসপ্তশতী ৭০০টি আর্যা শ্লোকের সমষ্টি, তেমনই ময়ূরাষ্টকের আটটি শ্লোকে মিলনের অন্তে আসন্ন বিরহের বর্ণনা। বিষয়গত ভাবে চৌরপঞ্চাশিকা-র সঙ্গে কিছু মিল থাকলেও ময়ূরের কবিত্ব বিল্হণের তুলনায় দীন, তেমনই সুভাষিতাবলী বা কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-তে পাণিনির নামে আরোপিত শৃঙ্গাররসাত্মক শ্লোকগুলি চৌরপঞ্চাশিকার তুলনায় অপকৃষ্ট। কেবল মেঘদূত, অমরুশতকও শৃঙ্গারশতক-এর কয়েকটি কবিতা ঘটকর্পরকাব্য ও গীতগোবিন্দ-এর কিছু শ্লোকের সঙ্গেই চৌরপঞ্চাশিকা-র তুলনা চলে। মেঘদূত-এর প্রভাবই এ কাব্যে বেশি; মেঘদূত-এর মতো একটি ছন্দেই সমগ্র কাব্যটি রচিত। কিন্তু মেঘদূতে শ্লোকগুলির বিষয়গত পারম্পর্য আছে, চৌরকাব্যে তাও নেই। আসন্নমৃত্যু প্রেমিকের স্মৃতিতে মিলনের বিভিন্ন লীলায় প্রেমিকার ভূমিকা, রূপ, আচরণ ও প্রতিক্রিয়া একে একে উদিত হচ্ছে, এইটি এর বিষয়গত যোগসূত্র। যেমন আঙ্গিকগত যোগসূত্র হচ্ছে প্রায় প্রত্যেক শ্লোকের শুরুতে ‘অদ্যাপি তাং’ এবং শেষ দিকে ‘স্মরামি’ বা ‘চিন্তয়ামি’— আজও তাকে মনে পড়ে। এটি ধ্রুবপদের মতো এবং আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্লোকগুলিকে একসূত্রে গ্রথিত করে।

চৌরপঞ্চাশিকা-য় অলংকারপ্রয়োগ খুবই পরিমিত, উপমা রূপক ও উৎপ্রেক্ষাই মূলত ব্যবহৃত হয়েছে। এ কাব্যে আঙ্গিকগত কলাকৌশল বা দুরূহতা নেই বললেই হয়। বর্ণনা নৈপুণ্যে মিলনলীলার নানা দৃশ্য যেন চিত্রশালার পটের মতো একে একে উদঘাটিত হচ্ছে এবং শব্দেবর্ণেগন্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে ইন্দ্রিয়গোচর হয়ে উঠছে— এ কাব্যের উৎকর্ষ এইখানেই। লজ্জা, মান, কোপ, দ্বিধা, আত্মসমর্পণ, বেদনা, ক্লেশ, খেদ, ক্রন্দন, তন্দ্রা, ঔৎসুক্য, শ্রান্তি, হর্ষ এ সব যেমন স্পষ্ট চোখে দেখা যায়। শৃঙ্গার এখানে স্থায়িভাব, আর এই যে নানা ব্যাভিচারিভাবের ঐশ্বর্য এর দ্বারা কাব্যটিতে যেন বিচিত্র বর্ণসমাবেশ ঘটেছে। আর আছে আড়ম্বরের বাহুল্য— তরুণী নায়িকার গৌর বর্ণ, সুকুমার অবয়বসংস্থান, তার মহার্ঘ বসন, অলঙ্কার প্রসাধনের বর্ণাঢ্যতা, তার কেশকলাপের বিস্তার, পুষ্পাভরণ, অগুরুচন্দনকস্তূরীকুঙ্কুমের গন্ধমদিরতা ও ওষ্ঠাধরে তাম্বুলরক্তিমা— এ সবের বর্ণনায় মনে হয় মিলনমন্দিরের বাতাসও যেন পুষ্পসজ্জার সম্ভারে ও ধূপের সৌরভে মন্থর। শুধুমাত্র নিপুণ শব্দগ্রন্থনার দ্বারা উদ্দীপনবিভাবের এমন একটি আবহ রচনা করা সহজসাধ্য নয়, এখানে বিল্‌হণের অবিসংবাদিত কৃতিত্ব।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিল্হণের ঘনসন্নিবদ্ধ সমাস ও সুপ্রযুক্ত অনুপ্রাসের মাধ্যমে তাঁর উপলব্ধ অনুভবটি বারেবারেই যথাযথ ভাবে রূপায়িত হয়ে সার্থক ভাবে পাঠকচিত্তে সঞ্চায়িত হয়েছে। দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যায়: ‘অদ্যাপি তাং সুরতজাগরঘূর্ণমান—তিযগ্বলত্তরলতারকমায়তাক্ষীম।’(৫) একটি মাত্র সমাসে শুধু যে নায়িকার জাগরক্লান্ত চোখ দুটির বর্ণনা তা নয় মিলনান্তিক অনুভাবেরও বর্ণনা। শুধুমাত্র শব্দের ঝংকারে অনুপ্রাসের মাধুর্যে বিবক্ষিত বস্তু এক ভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে বারংবার; যেমন প্রথম শ্লোকেই— ‘অদ্যাপি তাং কনকচম্পকদামগৌরীং ফুল্লারবিন্দবদনাং তনুরোমরাজিং…’ এখানে শুধু যে নায়িকার গৌরবর্ণ ও সুন্দর মুখ বর্ণিত হলো তা নয়, দুটি ফুলের অনুষঙ্গে সৌকুমার্য সতেজতা ও কমনীয়তাও ব্যঞ্জিত হল। তেমনই,— ‘অদ্যাপি তাং নয়নকজ্জলমুজ্জ্বলাস্যং;’ (৪০) এখানে অনুপ্রাসের মধ্যে সুন্দর একটি মুখে দুটি কাজলকালো উজ্জ্বল চোখ অতি সহজে ফুটে উঠেছে। নায়িকার বর্ণনায় অন্যত্র একটি সমাস প্রয়োগ করছেন— ‘শৃঙ্গারবারিরুহকানন-রাজহংসীং’; (২২) প্রেমের পদ্মবনে সে যেন রাজহংসী। সমাসবদ্ধ এই রূপক অলংকারে গৌরাঙ্গী রাজকন্যার রাজহংসীর মতো চলার আভাস শৃঙ্গাররসের উদ্দীপক দেহকান্তি এবং পদ্মবনের অনুষঙ্গের মধ্যে সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতার ব্যঞ্জনা নিহিত আছে।

শিল্প-সমীক্ষা

যে প্রেমের চিত্র বিল্‌হণ এঁকেছেন মুখ্যত তা হল নবপরিণীতা দম্পতির প্রণয়চিত্র; গোপন মিলনের কাহিনিটি তাঁর সৌষ্ঠববৃদ্ধি করেছে। এ কাব্যে আছে— বাসকসজ্জা, পূর্বরাগ, মান, মানভঞ্জন, উৎকণ্ঠা, বিরহ, মিলন ইত্যাদি শৃঙ্গারের নানা বিচিত্র অবস্থার রূপায়ণ। প্রধানত সম্ভোগলীলার। এর পটভূমিকা করুণরসের, নায়কের আসন্ন মৃত্যু ও নায়িকার আসন্ন বিরহের। লক্ষণীয়, যে নায়ক জানে যে তার মৃত্যু আসন্ন, অনিবার্য, তবু কোথাও তা নিয়ে তার বিলাপ নেই, তার একমাত্র চিন্তা, তার বিরহে তার প্রণয়িণী কি করে বাঁচবে।

আজকের পাঠকের কাছে হয়তো এ কাব্য অত্যধিক দেহাশ্রয়ী মনে হবে। এ প্রেম যেন সম্পূর্ণই দেহনিষ্ঠ সম্ভোগশৃঙ্গারেই পর্যবসিত। দেহকে উপভোগ্য ও মনোহারী করে তোলার অপর্যাপ্ত উপকরণসম্ভার— বসন উত্তরীয় অলংকার অগুরু কুঙ্কুম চন্দন মুক্তামালা পুষ্পহার কবরী অলকাতিলকা কাজল ওষ্ঠরঞ্জনী তাম্বুলরাগ। সখীরা, গেহসজ্জা, যৌবন, মিলনের আকাঙ্ক্ষা ও তৃপ্তি সব মিলে প্রথম প্রণয়ের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে যেন অতিক্রম করতে পারেনি কাব্যটি! সেই সদ্য সঙ্গসুখলাভের উদ্দামতাই যেন এর সীমা নিরুপরণ করছে। তবু এই উচ্ছ্বাসই কখনও কখনও তার আপন তীব্রতাতেই নিজের লঘু ভঙ্গুরতাকে অতিক্রম করে কাব্যের অলকায় উত্তীর্ণ হয়।

গভীরতায় পরিনিষ্ঠিত প্রেমের দু-চারটি উদাহরণ দেওয়া যায়: ‘আজও ফিরে ফিরে মনে আসছে সে দিন রাত্রে (প্রণয়কলহে) কুপিতা রাজকন্যা আমার হাঁচির পরে ‘দীর্ঘজীবী হও’ এ কথা উচ্চারণ করেনি (বটে) কিন্তু নীরবে কানে তার সোনার মঙ্গলপল্লবটি ধারণ করেছিল।’ (১১) ‘…আজ এই দিবসের অবসানেও যদি তাকে দেখতে পাই তবে পৃথিবীর রাজত্ব, স্বর্গ এমনকী মোক্ষও ত্যাগ করতে পারি।’ (২৩) এই অতিশয়োক্তি প্রেমিকের, কিন্তু ওই বিশেষ উপলব্ধির তীব্রতার মুহূর্তে এটি আর অতিশয়োক্তি থাকে না, এবং সেই কারণেই কবিতাটি একানে বিশেষ ভাবে রসোত্তীর্ণ হয়। এমনই আর একটি আপাত-অত্যুক্তি হল ‘আজও, এই অন্তিম মুহূর্তেও আমি এই দেখে বিস্মিত হচ্ছি যে সব কিছু জেনেও আমার বুদ্ধি দেবতাদের পরিত্যাগ করে ‘কান্তা আমার, প্রিয়তমা আমার, একান্তই আমার তুমি’, বলে প্রতি মুহূর্তে কেবল তারই দিকে ধাবিত হচ্ছে।’ (২৭) এখানে তরুণ প্রেম তার চপলতা পরিহার করে অনুভবের গভীরতাকে স্পর্শ করেছে এবং এর দ্বারা কাব্যটি নতুন একটি মাত্রা লাভ করেছে। ‘আমার যাওয়ার কথা কানে আসা মাত্র ভীরু হরিণীর মতো আর্ত হয়ে উঠল তার চোখ দুটি, বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরতে লাগল, মুখটি নত করে রইল সে— আজও মনে পড়ছে সে দৃশ্য।’ (২৮) আমার প্রিয়ার মুখটির স্মৃতি দিনে-রাতে আমার চিত্তকে পীড়িত করছে আজও; পূর্ণচন্দ্রের মতো সে মুখের লাবণ্য রতিকে পরাজিত করে, আজ সামনে এল প্রতিপদ, আর তাকে দেখতে পাব না।’ (৩২) সংস্কৃত সাহিত্যে সুন্দর মুখের উপমানরূপে চন্দ্র ও পদ্ম বহু পুরাতন, কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদের সৌন্দর্য যে মুখে সেটি দৃষ্টি থেকে অন্তর্হিত হলে বিরহের অন্ধকারের লগ্ন প্রতিপদ আসন্ন, এ কথা বিচ্ছেদের তীব্রতাকে এমনই স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করেছে যার তুলনা বিরল। কবি বলছেন… ‘আমার জীবনের একমাত্র আশাস্থল সেই তরুণীটিকেই স্মরণ করছি… জন্মান্তরে সেই যেন আমার গতি হয়— স্বর্গ নয়, মোক্ষ নয়, যে প্রেমের অতৃপ্ত তৃষ্ণা নিয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে জন্মান্তরে যেন সেই প্ৰেম চরিতার্থ হয়। (৩৩) আসন্নমৃত্যু প্রেমিকের এই অন্তিমবাসনা কাব্যটিকে নতুন এক গৌরব দান করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *