দুঃখান্ত পরিণতি ও সংস্কৃত সাহিত্য
বিয়োগান্ত বা দুঃখান্ত পরিণতি অলংকারশাস্ত্ৰে নিষিদ্ধ না হলেও সংস্কৃত সাহিত্যে তা একান্ত দুর্লভ। রামায়ণ মহাভারত-এর শেষ সুরটি বিষাদের; রামায়ণ-এর শেষ প্রক্ষিপ্ত অংশে রামের বৈকুণ্ঠে গমন থাকলেও সীতার পাতালপ্রবেশ ও লক্ষ্মণের সরযুর জলে দেহবিসর্জনে একটা করুণ সুন্দর আছে। মহাভারত প্রথম পর্যায়ে শেষ হয় স্ত্রীপর্বে, সেখানে অন্ত্যভাগের মূলসুর অতলান্তি বিষাদের। পরের অংশ শেষ হয় মহাপ্ৰস্থানে, সেখানেও একে একে চার পাণ্ডব ভ্ৰাতা ও দ্রৌপদীর পতন ও মৃত্যু এবং ধীরে ধীরে যুধিষ্ঠিরের নিঃসঙ্গতা ও একক অন্তিমযাত্রা বিচ্ছেদে করুণ। স্বৰ্গারোহণপর্বের অপেক্ষাকৃত দুর্বল রচনাতে এ সুর কাটে না। এর পরের দীর্ঘ ও বিপুল সংস্কৃত সাহিত্যে কোথাও কোনও দুঃখান্ত পরিণতি নেই। ভাসের উরুভঙ্গ নাটকে মঞ্চে দুৰ্যোধনের উরুভঙ্গ ও মৃত্যু দেখানো হয় বটে, কিন্তু সে মৃত্যু বীরের মৃত্যু, রথে আরোহণ করে স্বৰ্গারোহণ করার সুর দুঃখের নয় এবং সেটিই নাটকের অস্তিম ঘটনা। এ ছাড়া বাকি সব মহাকাব্য ও নাটকই মিলনান্ত বা হর্ষান্ত। এর কারণ কি, সেই আলোচনাই এ প্ৰবন্ধের বিষয়।
পাশ্চাত্য সাহিত্যের অবস্থা প্রথম থেকেই অন্য রকম। গ্রিক সাহিত্যে হর্ষান্ত নাটক (কমেডি) যথেষ্ট থাকলেও সমধিক প্রখ্যাত নাটকগুলি সবই দুঃখান্ত এ কথা সুবিদিত। গ্রিক ধর্মের সঙ্গে নাটকের অঙ্গাঙ্গী যোগ ছিল; মন্দির চত্বরে প্রায় উপাসনার অংশ হিসেবেই অনুষ্ঠিত হত নাট্যাভিনয় এবং ধর্ম যদিও ঈশ্বরসান্নিধ্যে পৌঁছে সুখী হওয়ারই পথ নির্দেশ দেয় এবং নাটকে যদিও দেবতারা অপরিহার্য ভূমিকায় প্রায়ই অবতীর্ণ হন তবু বিখ্যাত নাটকগুলির অধিকাংশই দুঃখান্ত। ইহুদী খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসে ন্যায়বান ঈশ্বর মানুষের কৃত অপরাধের শাস্তি দেন নানাবিধ দুঃখে–ব্যাধি, অর্থহানি, যশোহানি, প্রিয়জনের মৃত্যু। এই সবের দ্বারা মানুষ তার কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে মৃত্যুর মধ্যে শুচি হয়ে স্বর্গে যায়। বাইবেল-এর জোব-চরিত্রটিই প্রথম ট্র্যাজিক বা বেদনন্দিগ্ধ চরিত্র; এর পরে গ্রিক সাহিত্যে প্রোমিথিয়াস, ঈডিপাস, আগামেম্নন, মিডিয়া, ইলেকট্রা এবং অন্যান্য বহু চরিত্র এ ভাবে দেবতার নির্দেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আর্ত ও উৎপীড়িত; মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত। পরে এলিজাবেথীয় যুগে শেক্সপীয়রের ওথেলো, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট্র ও লীয়ার এবং অন্যান্য নায়ককেও এই ধরনের যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সপ্তদশ শতকের সাহিত্যে নায়ক রাজা বা রাজন্য নয়, নাটকের পরিসরও পরিবারের মধ্যে সরে এসেছে কিন্তু বেদনার অভিজ্ঞতা সেখানেও নাটকের কেন্দ্ৰস্থলে। মানুষের উচ্চাশার সঙ্গে সংঘাত কোনও একটি অলঙ্ঘ্য নীতির; এ নীতি ধর্মীয়ও হতে পারে, সামাজিক বা নৈতিকও হতে পারে; কিন্তু এই সংঘাতেই নায়কের যন্ত্রণার সূত্রপাত।
মধ্যযুগীয় সাহিত্যে দেখি প্রলোভনে পড়ে নায়কের পতন ঘটছে এবং বাকি নাটকে যন্ত্রণা ও পীড়নে তার পতনের প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে; অনুতাপে পাপক্ষয় হচ্ছে। দুঃখের মধ্যে এক ধরনের বোধ বা আত্মজ্ঞান জন্মাচ্ছে। (মরালিটি, ফল অব প্রিন্সেস ও প্রাইডু অবু লাইফ নাটকে এই বিষয়বস্তুই নানা প্রকারভেদ আছে। মরালিটি-তে কষ্ট এবং অনুতাপের মধ্যে নায়কের পাপক্ষয় ও মুক্তি ঘটে। প্রাইড অব লাইফ ও ফল অব প্রিন্সেস-এ অহমিকা ও দস্তই নায়কের পাপ, প্রতিকূল ঘটনার প্রতিঘাতে সেই দৰ্পচূৰ্ণ হওয়ার কাহিনিই নাটকের বিষয়বস্তু। এ দুটি ধারায় ঈশ্বরের স্থানে যেন দৈবই মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ)। ষোড়শ শতকে নায়কের চরিত্রে দুঃখভোগের দায়িত্ব দেখানো হতে থাকে এবং এলিজাবেথীয় সাহিত্যেই এ বোধ সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে প্রতিফলিত হয়; ব্যক্তিগত দায়িত্বকেই সুখদুঃখের নির্ণায়ক বলে প্রতিপাদন করা হয়। এ সাহিত্যে। কিছুকাল ফল অব প্রিান্সেস এর ধারাও চলতে থাকে, যেমন চসারের মাঙ্ক’স টেল-এ, গাওয়ারের কনফেসিও আমন্টিস-এ অথবা লীডগেটের ফল অব প্রিন্সেস-এ; কিন্তু এলিজাবেথীয় সাহিত্যে নায়কের ভাগ্যবিধাতা নায়ককেই করা হল, বাইরের প্রতিকুল দেব বা ভগবানকে সে ভূমিকা থেকে অপসারিত করা হল। ইতালীয় নুভেলের মতো অবৈধ প্ৰণয়, হঠকারিতা ও অন্যায় আচরণ থেকে পারিবারিক জীবনে বিপৰ্যয় আসছে এই ধারাটি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এলিজাবেথীয় নাটকে একটি বোধ পাওয়া যায় যে দুঃখবিপর্যয় শুধু ব্যক্তিগত পরিসরেই সীমাবদ্ধ নয়, মহাবিশ্বের মধ্যে কোনও এক বিপর্যয়ের প্রতিভাসও আছে তার মধ্যে।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের একটি গ্রন্থ (ট্ৰাষ্ট্ৰস্ কইসিলিয়ানুস) বলেছে, দুঃখান্ত নাটকের রসের উৎস দুঃখ, হৰ্ষান্তের হাস্য। হরেস্ও তার অ্যাস পেয়েটিক-তে এই মতের সমর্থন করেছেন। এই দুঃখ নানা ধরনের নানা কারণের হতে পারে। চসার তাঁর মাঙ্ক’স টেল-এ একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন দুঃখান্ত নাটকেরা:
Tragedie isto seyn a certyn storie,
As olde books maken us memorie,
Of hym that stood in great prosperitie,
And is yfallen out of high degree,
Into myserie, and endeth wrechedly.
প্রাচীন গ্রন্থগুলি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে দুঃখাস্ত উপাখ্যানের নায়ক (এমন একজন যিনি) অতি উন্নত ঐশ্বৰ্যময় অবস্থা থেকে দুঃখে পতিত হন ও অত্যন্ত গ্লানির মধ্যে অবসিত হন।
এই সংজ্ঞার আলোকে রামায়ণ-এর রাম ও মহাভারত-এর যুধিষ্ঠির দুজনেই দুঃখাস্ত নাটকের নায়ক। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এর দুষ্যন্ত বাইরের দিকে না হলেও দীর্ঘ দুটি অঙ্কে বেদনার মধ্যে কাটান এবং উত্তররামচরিত’-এর রাম প্ৰথম অঙ্ক থেকেই বেদনায় নিমজ্জিত। তা হলেও এ নাটক দুটি এবং পরবর্তী কোনও সংস্কৃত নাটকই পাশ্চাত্য অর্থে দুঃখান্ত নয়। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ দুষ্যন্ত ও শকুন্তলার দুঃখের কারণ মুখ্যত দুর্বাসার শাপ। পরে অবশ্য হংসপাদিক-র গানের মধ্যে দুৰ্য্যন্তচরিত্রের দুর্বলতা দেখিয়ে কতকটা দায়িত্ব চরিত্রেও আরোপিত হয়েছে, যেমন দুষ্যন্তের চিন্তায়, অন্যমন শকুন্তলার অতিথি আপ্যায়নে ত্রুটির দ্বারা শকুন্তলাকেও তার দুঃখের জন্যে কতকটা দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু বলাই বাহুল্য, এ ত্রুটির সঙ্গে দুঃখের যোগ ক্ষীণ ও আপেক্ষিক শুরুত্বে প্ৰায়শ্চিত্ত অনেক তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী। তাছাড়া ত্রুটি ও দণ্ডের মিল যথেষ্ট নেই বলেই দুর্বাসার শাপকে ব্যবহার করতে হয়েছে। শকুন্তলার সামান্য বিচূতি বা দুষ্যন্তর বহুবল্লভতা, যা তৎকালীন নায়কের পক্ষে ত্রুটি বলেই ধরা হত না, তার দণ্ড এত নিষ্করুণ। এই উপাদানে গভীর দুঃখান্ত নাটকের সৃষ্টি হতে পারত, কিন্তু সপ্তম অঙ্কে মিলনের মধ্যে সমস্ত দুঃখভোগ আনন্দে অবসিত হল। অধিকাংশ সংস্কৃত নাটকেই দুঃখের ভূমিকা সংকীর্ণ ও অগভীর।
কীথ তাঁর সংস্কৃত নাটকের ইতিহাসে বলেছেন সংস্কৃত নাটকের আদিপর্বে সম্ভবত নিউ এপিক কমেডির প্রভাব পড়েছিল তার ওপরে পাশ্চাত্য নাটকের ইতিহাসের এই পর্বে যে গ্রিক ও গ্রিক প্রভাবিত রোমান নাটকগুলি রচিত হয় তা লঘু, ও হর্যন্ত। দুঃখ তাতে নেই বললেই চলে, আছে বিপদ এবং বিচ্ছেদের সম্ভাবনা। ঘটনা দ্রুত ঘটে, জটিলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, নায়কের সখা প্যারাসাইটু (বিদূষক জাতীয় চরিত্র) এবং নায়িকার হিতৈষী এবং হিতৈষিণীর প্রতিচক্রান্তে নিষ্ঠুর অভিভাবকের অনুশাসন পরিবর্তিত হয় এবং নায়ক-নায়িকার মিলনে নাটকের সমাপ্তি ঘটে। এই ছকটি মূলত দেখা দিয়েছে বেশ কিছু সংস্কৃত নাটকে নায়িকায় এবং প্রকরণে ভাণে, ব্যায়োগে ও সমবকারে। বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে মালবিকাগ্নিমিত্র, বিক্রমোর্বশীয়, রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা, মালতীমাধব, স্বপ্নবাসবদত্ত, প্ৰতিজ্ঞার্যৌগন্ধরায়ণ ও অবিমার-কে দুঃখের ভূমিকা গৌণ এবং স্বল্পস্থায়ী। মালবিকাগ্নিমিত্ৰ, রত্নাবলী, প্রিয়দর্শিকা-য় ঘটনা প্ৰায় একই ধরনের: রাজা বিবাহিত, অন্তঃপুরের সুন্দরী এক তরুণীর প্রতি আসক্ত, সে-ও তাই; বাধা হল পূর্বপরিণীতা মহিষী ও অন্য রাজবধুরা। এঁরা প্ৰাণপণে চেষ্টা করছেন যাতে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন না ঘটে। বিদূষক ও কখনও-বা অন্য পাশ্বচরিত্রের সহায়তায় রাজা গোপনে সাক্ষাৎ করছেন তরুণীটির সঙ্গে এবং শুরু হয়ে যাচ্ছে রানিদের ক্রোধ ও মান-অভিমানের পালা। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে প্ৰজাপতির নির্বন্ধই এমন যে তরুণীটি রাজার পত্নীরূপে উদ্দীষ্ট ছিলেন; রাজপ্রাসাদে আসবার পথে দৈবদূর্বিপাকের ফলে নিম্পরিচয় আশ্রিতরূপে রাজপ্রাসাদে এসে ওঠে। অতএব রানিরা যখন জানতে পারেন যে দৈবজ্ঞের নির্দেশ হল এই তরুণীটিকে বিবাহ করলে রাজা রাজচক্রবতী হবেন বা অন্য ভাবে তাঁর শ্ৰীবৃদ্ধি ঘটবে তখন তাঁরাই উদ্যোক্তা হয়ে বিবাহ ঘটান। অন্য যে নাটক কটির নাম উল্লেখ করা হল তাতেও প্রকারাস্তরে এই ধরনেরই নাট্যবস্তু। দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে অন্তর্নিহিত কোনও জটিলতার অবকাশ নেই; চরিত্রের বিকাশ, নতুন কোনও জীবনবোধ বা জীবনের কোনও পুনর্মূল্যায়নেরও অবকাশ নেই। নায়ক নায়িকার মিলনের যে বাধাকে অবলম্বন করে নাট্যবস্তু আবর্তিত হচ্ছে তা নিতান্তই বাইরের এবং সেই বাহ্য অন্তরায় আমনই আর এক আপতিক ঘটনার (দৈবজ্ঞের গণনা, ইত্যাদি) দ্বারা অপসারিত হয়ে অন্তে মিলন ঘটা সম্ভব হচ্ছে।
বিক্রমোর্বশীয়-তে এ বাধাকে কতকটা অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে: ঔশীনারী সম্বন্ধে বিক্রম উদাসীন নন; তার প্রেমের চিতার অগ্নি থেকে, উর্বশীর সঙ্গে মিলনের দীপটি জ্বালাতে তিনি দ্বিধা বোধ করছেন। কিন্তু উর্বশীর প্রেম তাকে এত অভিভূত করেছে যে তিনি এ দ্বিধা কাটিয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত। চতুর্থ অঙ্কে তার বিরহের উন্মাদন বর্ণিত হয়েছে। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ চতুর্থ অঙ্কের শেষ থেকে সপ্তম অঙ্কের মাঝামাঝি পর্যন্ত দীর্ঘবিলম্বিত বিরহ। নাটকের বাধা ধীরে ধীরে চরিত্রের অন্তরে সংক্ৰমিত হয়ে তাকে পূর্বের লঘু কামনার উচ্ছলতা থেকে প্রেমের গভীরতায় উত্তীৰ্ণ করে দেওয়ার পরে আসছে মিলন।
এ মিলনও কিন্তু আপেক্ষিত ছিল; দুর্বাশার শাপের খণ্ডনের জন্যে যখন প্রিয়ংবদা ঋষিকে অনুনয় করেন তখন ঋষি বলেন, অভিজ্ঞান দেখলে রাজার বিস্মৃতি কেটে যাবে। অতএব ষষ্ঠ অঙ্কের প্রথম থেকে আমাদের প্রত্যাশা জন্মায় নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটবে। কালিদাসের নাটকগুলিতে দেখছি মিলনের বাধা আগন্তুক বা আপতিক থেকে ক্ৰমে ক্ৰমে নাট্যবস্তুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। চরিত্রের গহনে তার মূল প্রোথিত হচ্ছে এবং দুঃখ স্বল্পস্থায়ী বা গৌণ ভূমিকা থেকে ধীরে ধীরে অধিক তাৎপর্য ও স্থায়িত্ব লাভ করছে। কিন্তু নাটক অনিবাৰ্যরদাপেই হৰ্ষান্ত।
মুদ্রার্যক্ষস-এ নাট্যবস্তু পৃথক গোষ্ঠীর: রাজনীতির পটভূমিকায় দুটি মুখ্য চরিত্র চাণক্য ও রাক্ষসের অভীষ্ট এবং প্রযত্নের সংঘাতই এ নাটকের কাহিনি। এখানেও বাধা বহিরাগত এবং সমাধান ঘটছে চাণক্যের বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্বের দ্বারা। দুটি চরিত্রই এক অর্থে নায়ক কারণ, রাক্ষস প্রচলিত অর্থে প্ৰতিনায়ক একেবারেই নয়; সংঘাত শ্রেয় এবং শ্রেয়স্তরের মধ্যে। ঘটনা প্রধানত যেন ঘটছে দুটি চরিত্রের চিত্তমঞ্চেই, এবং পরিণতি আসছে প্রবল আবেগ বা হর্ষের মধ্যে নয়, বরং আবেগের প্রশমনের মধ্যেই।
মৃচ্ছকটিক-এ চারুদত্ত ও বসন্তসেনার মিলনের বাধা বাইরে বটে। কিন্তু সে বাধা সমাজের এবং আপাত ভাবে দূরপনেয় কারণ বসন্তসেনা গণিকা, একমাত্র ধনের সাহায্যে চারুদত্ত তাঁকে পেতে পারেন এবং নাটকের প্রথম অঙ্ক থেকেই শুনি, চারুদত্ত দরিদ্র। কাজেই এ বাধা গুরুতর, এবং এরই সঙ্গে আর এক বাধা হল ধনী সংস্থানক বসন্তসেনাকে কামনা করে। এতে জটিলতা নাটকে বেড়েছে, কারণ সংস্থানক প্রবল প্রতিপক্ষ। কাজেই এ নাটকের বাধা সম্পূর্ণ ভাবে বহিরাগত নয়; সমস্ত নাটক জুড়ে নায়ক-নায়িকার প্রেম অন্ধ গলিতে মাথা ঠুকে মরে। সমাধান আসে। দশম অঙ্কে কতকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে; কিন্তু সম্পূর্ণ প্ৰস্তুতিহীন নয়। এ সমাধান, কারণ নেপথ্যে যে রাজপরিবর্তন ঘটছে তার প্রস্তুতি নাটকে দীর্ঘকাল ধরেই চলছিল: শর্বিলক, রেভিল, দর্দুরক—এরা ধীরে ধীরে রাজা পালকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করে আর্যককে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে। এই রাজপরিবর্তনের ফলে পূর্ব উপকার স্মরণ করে আর্যক চারুদত্তকে সম্পত্তি ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বসন্তসেনাকে গণিকত্ব থেকে মুক্তি দেন; তার ফলে চারুদত্ত তাকে বিবাহ করতে পারেন। এ নাটকের হর্যন্ত পরিণতি দশম অঙ্কের একেবারে শেষ অংশটুকুতে: দীর্ঘ নয় অঙ্কেরও বেশি নায়ক-নায়িকার প্রেম নিম্পরিণাম দুঃখে আচ্ছন্ন। কাজেই ঠিক দুঃখান্ত না হলেও প্রকৃত অর্থে এ নাটককে হর্যন্তও বলা যায় না, বরং প্রতিহত দুঃখান্ত (averted tragedy) বলাই বোধহয় সংগত হবে। নাটকের মূল সুর করুশই ছিল শেষ অঙ্কের প্রথমার্থ পর্যন্ত। চসারের সংজ্ঞায় মৃচ্ছকটিক দুঃখান্ত নাটক, কিন্তু এবা অস্ত্যভাগে মিলন ও হর্ষ।
তেমনই উত্তররামচরিত। এ নাটক প্ৰথম অঙ্ক থেকে শেষ অঙ্কের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ছিল। দুঃখে মগ্ন: রামচন্দ্র ও সীতা দুজনের দুঃখই স্বতন্ত্র ভাবে অঙ্কের পর অঙ্ক জুড়ে দেখানো হয়েছে। সীতাকে নির্বাসন দেওয়ার পর আর যে রামচন্দ্রের সঙ্গে তার মিলন হবে তার কোনও ইঙ্গিত নাটকে তো নেই-ই, মহাকাব্যেও ছিল না। ভবভূতি বলেছেন,
একে রসঃ করুণ এক নিমিত্তভেদাদ
ভিন্নঃ পৃথক পৃথগিবাশ্রয়তে বিবর্তন।
অম্ভো যথা সলিলমের তু তৎ সমগ্ৰম৷
এক করুণ রসই নিমিত্তভেদে ভিন্ন ভাবে পৃথক পৃথক রূপভেদকে আশ্রয় করে, জল যেমন আবর্ত, বুদ্বুদ ও তরঙ্গময় বিকারকে (আশ্রিয় করে); কিন্তু সমগ্ৰ ভাবে তা জলই। (৩:৪৭)
এই বাণী যে-নাটকের মর্মকথা তার স্বাভাবিক পরিণতি দুঃখাস্ত; কিন্তু সপ্তম অঙ্কে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নাটকীয় সংযোজনে তা হর্ষান্ত হয়ে উঠেছে। কেন? সম্ভবত যে নির্দেশ সমাজে চলিত ছিল–বিয়োগান্তং ন নাটকম–তারই প্রভাবে।
কিন্তু কেন এ নির্দেশ অথবা এ মনোভাব? জীবনে যেখানে বিয়োগান্ত ও দুঃখাস্ত ঘটনা প্রচুর দেখা যায়, অন্যান্য সাহিত্য যেখানে দুঃখান্ত পরিণতিকে পরিহার করেনি। সেখানে সংস্কৃত সাহিত্যে এ সম্বন্ধে এত কুষ্ঠা কেন? এর একাধিক কারণ থাকাই স্বাভাবিক। গ্রিক ধর্মে স্বৰ্গনরকের সঙ্গে পাপপুণ্যের যোগাযোগ সম্বন্ধে স্পষ্ট কোনও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে জানা যায় না। এবং পরবর্তী পর্যায়ের মিস্ট্রি’ অর্থাৎ গুঢ় ধর্মবিশ্বাসের প্রস্থানগুলির (ডিওনিসীয় ইলিউসিনীয় বা অফিক ইত্যাদি) উত্থানের পূর্বে মৃত্যুর পর অনন্ত সুখভোগের ধুব কোনও পন্থা উদ্ভাবিত হয়নি; কাজেই দুঃখান্ততার একটা বাস্তব ভিত্তি ছিল পরলোকতত্ত্বেও। খ্রিস্টধর্মে স্বৰ্গ-নরকনির্ভর করে পাপপুণ্যের ওপরে এবং দুটিই অনন্তকালের, অর্থাৎঅনন্ত দুঃখড়োগের সম্ভাবতা ধর্মের মধ্যেই নিহিত ছিল। জন্মান্তরবাদ না থাকায় দুঃখের আত্যস্তিকতা এক ধরনের বাস্তব সম্ভাবনারূপে মানুষের মনে জাগরূপ ছিল; হয়তো তা আশঙ্কার, তার প্রতিকারের উপায়ও শাস্ত্ৰ বলেছে, কিন্তু বেশ কটি মহাপাতকের (deadly sins) উল্লেখও আছে যার কোনও প্রতিকার নেই, কাজেই অনন্ত দুঃখের আতঙ্কটা বাস্তব ছিল।
ভারতবর্ষে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে পঞ্চম বা চতুর্থ শতকের মধ্যে উপনিষদের ভাবধারা ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মাণ্য উভয় ধর্মই এবং জৈন ধর্মও, জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ স্বীকার করে, অন্যান্য গৌণ সম্প্রদায়গুলিও করত। পাপের ফলে নরক, হীনজন্ম, প্রেতিযোনি, ইত্যাদি নির্ধারিত ছিল ঠিকই, কিন্তু জন্মান্তরীবাদের ফলে কোনও অবস্থাই চিরস্থায়ী বা আত্যন্তিক নয়। বহু জন্ম পরিক্রমার পরে একেবারে শেষ অবস্থাটি দুঃখের নয়, তা সে মোক্ষই হোক আর নির্বণই হোক। ফলে দুঃখের একান্তত দর্শন এবং প্রচলিত সমাজবোধ থেকে অন্তর্হিত হল। মানুষ এ জীবনে দুঃখ পেতে পারে, সে তার পূর্বজন্মে কৃত অপকর্মের ফল, কিন্তু পুণ্য অর্জন করতে করতে ধীরে ধীরে সে মোক্ষ বা নির্বাণের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। এই বৃহত্তর পটভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে দুঃখ একটা সাময়িক অবস্থা মাত্র, অন্তিমে সুখভোগ অবধারিত; লক্ষবর্ষ পরে হলেও সেইটিই চূড়ান্ত পরিণতি। এই বোধ দুঃখাস্ত পরিণতিকে অস্বীকার করবেই।
অ্যারিস্টটল দুঃখান্ত নাটকের যে সংজ্ঞানিরুপণ করেছেন তা হল:
‘দুঃখান্ত নাটক’ এমন নাট্যকর্মের অনুকৃতি যা গভীর এবং সম্পূর্ণ. (যা) করুণা ও আতঙ্কের উদ্রেক ঘটায় এবং ওই আবেগগুলির প্রশমন ঘটায়। (Tragedy, then is an imitation of an action that is serious and complete…exciting pity and fear, bringing about the catharsis of such emotions.) (ষষ্ঠ অধ্যায়)
মনে রাখতে হবে এই দুঃখান্ত নাটকেই অ্যারিস্টটল শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর সংজ্ঞায় ‘গম্ভীর’ শব্দটি তাৎপৰ্যপূর্ণ, কারণ কবিদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, যাঁরা গভীর শ্রেণির (কবি) তারা নাটকে মহৎ কর্ম ও মহামানবদের কর্মের অনুকরণ করেন। (Those who were of a graver sort imitated apiendid deeds and actions of great men.) (চতুর্থ অধ্যায়) গভীর বিষয় কী, সে সম্বন্ধে বলছেন, নাটকে চরিত্র থাকবে. যখন কথা বা কাজ স্পষ্ট সূচিত করবে একটি নৈতিক কর্তব্য নির্ণয় যার দ্বারা নির্ধারিত হবে চরিত্র কেমন ধরনের হবে, কর্তব্য নির্ণয় সৎ হলে চরিত্রটি সৎ হবে।’ (There will be character… if speech or act clearly shows a moral choice indicating what sort of a peron the agent is; his character will be good if his choice is good) (পঞ্চদশ অধ্যায়) বিষয়ের গান্তীর্য, নৈতিক ইতিকর্তব্যতানির্ণয়ের দ্বারা মহৎ হয়ে ওঠা চরিত্রের নায়ক এবং তার গভীর ও সম্পূর্ণ কর্মের দ্বারা দর্শকচিত্তে আতঙ্ক ও করুণার সৃষ্টি এবং নাটকের গতির মধ্যে ওই আবেগ দুটির প্রশমন–এ সংজ্ঞাটির মধ্যে জীবন সম্বন্ধে এমন একটি বোধের লক্ষণ আছে যা সংস্কৃত অলংকারসাহিত্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আতঙ্ক এবং করুণা–দুটির কোনওটিরই উল্লেখ সংস্কৃত কোনও অলংকারগ্রন্থে নাটকের সম্বন্ধে করা হয়নি। নৈতিক ইতিকর্তব্যতা নির্ধারণের মধ্যেই নাট্যবস্তু গভীরতা অর্জন করে। সংস্কৃত নাটকের ক্ষেত্রে নায়িকার প্রকারভেদ শুধু প্রেমের অবস্থাভেদ, আর নায়ক হয়। ধীরোদাত্ত, নয় ধীরললিত, অথবা ধীরোদ্ধত, কিংবা নয় ধীরপ্ৰশান্ত। চারটিই সৎ, এবং অবস্থাবিশেষে তারা কী ভাবে ইতিকর্তব্যতা স্থির করবে তা তাদের প্রকারভেদের দ্বারা পূর্বনির্ধারিত।
সমগ্র সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে মহাকাব্য দুটি থেকে নেওয়া চরিত্র ছাড়া কবিকল্পিত কোনও মন্দ চরিত্র নেই, একমাত্র ব্যতিক্রম মৃচ্ছকটিক-এর সংস্থানক। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ দুর্বাসা, উত্তররামচরিত-এ দুমুখ বা মালতীমাধক-এর কােপালিকও মন্দ, কিন্তু নাট্যকাররা এদের নাটকে সত্যকার চরিত্ররূপে উপস্থাপিত করেননি। এরা নাট্যবস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন উপচরিত্র এবং দুৰ্দৈবের প্রতীক বা কর্মকর; কাজেই এদের মন্দত্ব নাটকের প্রাণকেন্দ্রের বাইরেই থেকে যায়, নাটককে স্পর্শ করে না।
মনে রাখতে হবে, সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের মতে নাটকও কাব্য। দৃশ্যকাব্য–কাজেই কাব্য সম্বন্ধে মৌলিক যে বোধ সেখানে পাই তা নাটক সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। বিষয়বস্তুর দিক থেকে কোনও উদ্ভাবনের অবকাশ নাটকে নেই, নাটকং খ্যাতবৃত্তং স্যাৎ— নাটকের ঘটনা বিখ্যাত (অর্থাৎ সর্বজনবিদিত) হতে হবে।’ কাব্যের যা উদ্দেশ্য মোটামুটি ভাবে নাটকেরও তাই, অর্থাৎ ‘কাব্যং যশসেহর্থকৃতে ব্যবহারবিদে শিবতরক্ষতয়ে/সদ্যঃ পরনির্বতয়ে কান্তাসম্মিততয়োপদেশ যুজে–কাব্য যশ ও অর্থের জন্যে, নীতিজ্ঞানের জন্যে অমঙ্গলনাশের জন্যে, তৎক্ষণাৎ পরম আনন্দলাভের ও বধূর মতো উপদেশ দেওয়ার জন্যে।’ (কাব্যপ্রকাশ ১:২) এই উপদেশ দেওয়ার শাস্ত্রীয় ভঙ্গিও তিনটি: বেদাদি গ্রন্থে যেমন অনুশাসন থাকে, এটা কর, ওটা কোরো না; তা হল গুরুসম্মিত। অথবা মহাকাব্যে যেমন কাহিনি ও উপদেশের মাধ্যমে বলা হয়ে কি করা উচিত বা নয়; তা হল বন্ধুর মতো করে বলা, সখিসম্মিত। যেমন ‘রামাদিবৎ প্রবর্তিতব্যং ন রাবণাদিবৎ–রামের মতো আচরণ করা উচিত, রাবণের মতো নয়।’ আর কাব্য কোনও উপদেশই সরাসরি দেবে না। শুধু কাহিনিটুকু বলেই ক্ষান্ত হবে, তা হল কান্তাসম্মিত। নাটকে এ উপদেশ দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু নাট্যশাস্ত্রগুলি নীরব। ভারতের নাট্যশাস্তু-তে ব্ৰহ্মা বলছেন, ‘ক্রীড়নীয়কমিচ্ছামো দৃশ্যং শ্রব্যঞ্চ যদ্ববেৎ–একটি খেলনা চাই যা দৃশ্য ও শ্রব্য হবে অর্থাৎ মঞ্চে অভিনীত হলে, যা শোনা ও দেখা যাবে।’ (১:২) আর বলছেন, ‘বিনোদকরং লোকে নাট্যমেতদ্ভবিষ্যতি . ঈশ্বরাণাং বিলাসশ্চ—পৃথিবীতে এই নাটক হবে বিনোদনের উপকরণ, ধনীদের বিলাস (হবে)।’ (১:১১৯-২০; ১:১১) আরও স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘দুঃখার্তিশোকনির্বেদখেদবিচ্ছেদকরণম। অপি ব্ৰহ্মপরানন্দাদিন্দমভধিকং পরম/জহার নারদাদীনাং চিত্তানি কথমন্যথা৷–‘দুঃখ, আর্তি, শোক, নির্বেদ, খেদের অবসান ঘটায়, (নাটক), ব্ৰহ্মাপরানন্দের চেয়েও অধিক এই (নাটক সঞ্জাতি) পরম আনন্দ, না হলে (নাটক) নারদ-আদি (ঋষি)-দের চিত্তরহরণ করল কি করে?’ (১:১১)
তাহলে মূল বিবক্ষিত দাঁড়াল এই দুঃখ শোক ও আর্তির জগৎ থেকে মানুষের মনকে সরিয়ে নেওয়ার উপায় হল নাটক। তাই এটা খেলনা, ক্রীড়নক, যা দিয়ে লোকে শিশুকে ভোলায়; এ হল চিত্তবিনোদনের উপায়, এবং ধনীদের বিলাস। শুধু যে বাস্তব থেকে মনকে সরিয়ে দেওয়ার, ছেলে-ভোলাবার ক্রীড়ানক তাই নয়। এর শ্রেণিচরিত্রও স্পষ্ট: ঈশ্বরাণাং বিলাসশচ–ধনীদের বিলাস। নিশ্চয়ই সমাজে অন্য রকম নাটকও ছিল যা সাধারণ মানুষ রচনা করত, অভিনয় করত এবং দেখত। তা যে ছিল তার প্রমাণ হল বিংশতি ভেদ রূপক বা নাটকের, এবং তার মধ্যে আট দশ প্রকারই মাত্র পাওয়া যায়। বাকিগুলি নিশ্চয়ই শিক্ষিত ও ধনীদের বিলাসের পর্যায়ে উঠতে পারেনি তাদের দৈনন্দিন বা নিচুতলার জীবনযাত্রার অতিসাধারণতায় এবং অমার্জিত রচনাভঙ্গির জন্যে। হয়তো তা রিসোন্তীৰ্ণও ছিল না। সব সময়ে, কিন্তু এ কথা জোর করে বলা যায় না, কারণ অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল বহু ভাণ। রক্ষণ পেয়েছে নাগরিক জীবনের বিলাসচিত্র বলে। এগুলির অধিকাংশেরই বিন্দুমাত্ৰ সাহিত্যিক উৎকর্ষ নেই তাও। কাজেই যা রক্ষা পায়নি তা সাহিত্যিক কারণে নয়। সামাজিক কারণেই হয়তো পায়নি এমন অনুমান অসংগত হবে না।
যা বিলাস যা ক্রীড়নক তা গভীর বিষয় পরিহার করবে। এ তো স্বতঃসিদ্ধ। তা বিনোদনের জন্যে বাস্তবের রূঢ়তাকে এড়িয়ে যাবে, কারণ দুঃখ, খেদ, আর্তি এ সব থেকে চিত্তকে সরিয়ে আনাই তো তার উদ্দেশ্য। ফলে অ্যারিস্টটল যাকে গভীর বিষয় বলেছেন, জীবন সম্বন্ধে মৌলিক জিজ্ঞাসা ও সংশয়ের ওপরে যার ভিত্তি, প্রচলিত মূল্যবোধগুলির পুনর্মূল্যায়ন যার লক্ষ্য, তা সংস্কৃত নাটকের উপজীব্য হতে পারল না। ‘কাব্যামৃতরসাস্বাদ’ যদি ব্ৰহ্মাস্বাদসহোদর’ হয় তাহলে কাব্য এবং নাটক দৃশ্যকাব্য ঐহিক জীবনের সুখদুঃখ প্রশ্ন সমস্যাকে পরিহার করে তুরীয় ভাবের সন্ধান করবে। অভিনয় দৰ্পণ-এ নাটকের করণীয় কি তা বলা আছে: ‘কীর্তিপ্রাগলভ্যসৌভাগ্য বৈদগ্ধ্যানাং প্রবর্ধনম/ঔদার্যস্থৈর্যানাং বিলাসস্য চ কারণম।— কীর্তি, প্ৰগলভ্যতা ও পাণ্ডিত্যের প্রবর্ধক, ঔদার্য, স্থৈৰ্যও বিলাসের কারণ (নাটক)।’ অর্থাৎ এ পণ্ডিত ও ধনীর দ্বারা ও জন্য রচিত সাহিত্য। প্রাচীন কালের ভরত থেকে অনেক পরের এই অভিনয় দৰ্পণ পর্যন্ত সকলেই বিলাসের উল্লেখ করছেন; এবং বিলাস আর যাই হোক জীবনজিজ্ঞাসা নয়। দশম শতকের সাগর নদী তাঁর নাটকীলক্ষণরত্নকেশ গ্রন্থে নাটকের যে সংজ্ঞা দেন তা-ও এই ধরনেরই:
ধর্মাদিসাধনং নাট্যং সর্বদুঃখাপনোদকৃৎ।
অনুসেবধ্বমূষস্তস্যোখানং তু নাটকম।
‘ঋষিগণ, আপনারা ধর্ম ইত্যাদির সাধন এবং সকল দুঃখের নিবারক নাট্যের অনুশীলন করুন, নাটক তারই উৎকর্ষ’ (১:৪)
ভামহ কাব্যের সংজ্ঞানিরাপণে বলেছিলেন:
ধর্মার্থকামমোক্ষ্যেষু বৈচক্ষণ্যং কলাসু চ।
করোতি কীর্তিং শ্ৰীতিঞ্চ সাধুকাব্যনিষেবণম।
ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এবং কলাগুলিতে বিচক্ষণতা এবং কীর্তি ও শ্ৰীতি লাভ করা যায় সৎকাব্য সেবনে। (কাব্যালংকার ১:১)
ধনঞ্জয় তার দশরূপক নামের বিখ্যাত নাটকসম্বন্ধীয় গ্রন্থে এই সংজ্ঞার প্রতি শ্লেষ করে বলেন :
আনন্দনিষ্যন্দিষু রূপকেষু বুৎপত্তিমাত্ৰং ফলমল্পবুদ্ধিঃ।
যোহপীতিহাসদিবদাহ সাধুস্তস্মৈ নমঃ স্বাদুপরাঙামুখায়।।
আনন্দনিৰ্বর নাটক থেকে ইতিহাস্যাদির মতো পাণ্ডিত্যমাত্ৰ ফল (পাওয়া যায়) এমন কথা যে সাধু বলেন সেই স্বাদু (বস্তুতে) বিমুখ সাধুকে নমস্কার। (১:৬)
এখানে লক্ষণীয় যে, পূর্বতন গ্রন্থকার নাটক দর্শন ও শ্রবণের ফলগুলির মধ্যে ধর্ম, অর্থ কাম, মোক্ষ, ইত্যাদি এনে যদিও এগুলি জীবনজিজ্ঞাসার অনুকুল নয়। তবুও–এই সংজ্ঞার মধ্যে কিছু গভীর তাৎপর্যের অবকাশ রেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী গ্ৰন্থকার ধনঞ্জয় তা নিয়ে পরিহাসই করলেন, কারণ তার মতে নাটক বিশুদ্ধ আনন্দেরই নির্বর। এই সংজ্ঞায় নাটকের পরিসর সংকীর্ণ ও অগভীর হয়ে রইল। শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ, হ্যামলেট বা লীয়ারকে তো বিশুদ্ধ আনন্দের নির্বর বলা যাবে না। যেমন সফোক্লিসের ঈডিপাস রেক্সকেও বলা যাবে না, অথচ পৃথিবীর নাট্যসাহিত্যের তালিকায় তো এদের স্থান শীর্ষভাগে। কাজেই ওই গভীর বিষয় পরিহার করে, নৈতিক সংঘাতকে বর্জন করে, ক্রীড়নক ও বিনোদন নির্মাণেই যদি নাটক পর্যবসিত হয় তো মানুষ তা দেখবে, শুনবে বা পড়বে শুধু চিত্তবিনোদনের জন্যেই, জীবনকে নতুন করে বোঝবার বা জািনবার জন্যে নয়। এটা সংস্কৃত নাটকের একটা অভিশাপ।
শ্ৰেষ্ঠ সংস্কৃত নাটকগুলিতে বস্তুর (plot) বৈচিত্র আছে, শক্তিশালী আবেগের চিত্রণ আছে, প্রচুর চিত্তহারী বর্ণনা আছে মানুষের ও প্রকৃতির, কিন্তু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের যা প্রাণবস্তু, জীবনের পুনর্মূল্যায়ন, জীবনবোধের প্রসার–তা নেই। এর একটা কারণ হল, চরিত্রনির্মাণ সম্বন্ধে নাট্যশাস্ত্রগুলি কোনও স্বতন্ত্র চিন্তার পরিচায় দেয়নি। নৈতিক সংঘাত প্ৰতিফলিত হবে তো চরিত্রকে অবলম্বন করেই, কিন্তু সে রকম কোনও নির্দেশ কোনও নাট্যশাস্ত্রে নেই। বিষয় যেখানে বহুলাংশে মহাকাব্যনির্ভর, সেখানে ছোটখাটো বৈচিত্র্যের চমক ছাড়া উদ্ভাবনের ক্ষেত্র নেই এবং নৈতিক সংঘাত সম্বন্ধে কোনও নির্দেশ না থাকায় তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেও শাস্ত্ৰমতে নাটকের অঙ্গহানি হয় না। তাছাড়া সৌন্দর্যসৃষ্টিই যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য, সেখানে প্রচুর গীতিকাব্যধর্মী মনোজ্ঞ বর্ণনার সমাবেশ থাকলেই চলে। এ কথা ঠিক যে, চরিত্রকে নৈতিক সংঘাতের সম্মুখীন করে, বহু দুঃখের মূল্যে সে শ্রেয়কে বরণ করছে এমন ঘটনার অবতারণা করতে পারলে উন্নত এক স্তরে সৌন্দর্যসৃষ্টি করা যায়–পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাটকগুলি যা করেছে–কিন্তু তাহলে তা বিনোদন হয় না, ক্রীড়ানক হয় না; ধনীর বিলাসর উপাদানও হয় না। যা হয় তারা কোনও সংজ্ঞাই নেই নাট্যশাস্ত্ৰে।
হেরোডোটাস বলেছেন, ‘সকলের চেয়ে তীব্র দুঃখ যা মানুষ উপলব্ধি করে তা হল অনেক কিছু সম্পাদন করবার উচ্চাশা নিয়ে কিছুই না করতে পারা।’ (৯ম খণ্ড, ষোড়শ অধ্যায়) যে সব দুঃখের উপলব্ধির মধ্যে নায়ক বা নায়িকাকে অবলম্বন করে দর্শক বা পাঠক জীবনের নতুন অর্থের সন্ধান পায় হেরোডোটাস তার একটি সংজ্ঞা দিলেন। আধুনিক নাট্যসমালোচক জর্জ স্টাইনার বলেন, ‘প্রাচ্য শিল্পে হিংস্ৰতা আছে, দুঃখ আছে এবং স্বাভাবিক বা পরিকল্পিত ভাগবিপর্যয় আছে.. কিন্তু ব্যক্তিগত বেদনার ও শৌর্যের যে চিত্রণকে আমরা ট্র্যাজেডি বলি তা হল প্রতীচ্যের শিল্পেরই বৈশিষ্ট্য।… ট্র্যাজেডির নায়ক যে শক্তির দ্বারা বিধবস্ত হয় তাকে সে সম্পূর্ণ বুঝতেও পারে না; চিন্তাপ্রসূত বিচক্ষণতার দ্বারা জয়ও করতে পারে না। আবার এইটিই হল ট্র্যাজেডির কেন্দ্রীয় বস্তু। যেখানে বিপর্যয়ের হেতুগুলি সাময়িক, সেখানে গভীর নাটক হলেও হতে পারে। কিন্তু (যথার্থ) দুঃখাস্ত নাটক হতে পারে না।’ (দ্য ডেথ অরস্ট্রিাজেডি; ফেবার অ্যান্ড ফেবারি; ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৩ ও ৮) করুণ রস থাকলে করুণরসপ্রধান নাটক হতে পারে। কিন্তু তার দ্বারা কোনও নাটক যথার্থ দুঃখান্ত নাটক বা ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠে না। করুণরস বা শোকদুঃখ তো বাস্তবে আছে, কাজেই সাহিত্যে তার প্রতিফলন থাকতেই পারে, তার দ্বারা নাটকটি করুণরসাশিত হতে পারে, যেমন উত্তররামচরিত বা মৃচ্ছকটিক, এমনকী নাগানন্দও। কিন্তু যা সত্যকার দুঃখান্ত নাটক তার শুধু অন্তে দুঃখ নেই, তার জীবন-উপলব্ধির প্রতিক্রিয়াটির মধ্যেই দুঃখ ওতপ্রোত ভাবে অনুসূদৃত। যেখানে মর্মর্যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে জীবনের এক নতুন বোধে উত্তরণ ঘটে নায়ক বা নায়িকার। নীটশে বলেন, ‘শিল্প বাস্তবের অনুকৃতি নয়, তার দার্শনিক উপসংহার, বাস্তবের পাশাপাশি তাকে সৃষ্টি করা হয়, যাতে তার দ্বারা বাস্তবকে জয় করা যায়।’ (দ্য বাৰ্থ অব ট্র্যাজেডি, ডাবলডে এঙ্কর; ১৯৫৬ ১৪২ পৃষ্ঠা) এরই পাশাপাশি মনে পড়ে ‘রূপং দৃশ্যতয়োচ্যতে রূপকং তৎসমারোপাৎ–রূপের আরোপ হয় বলে রূপক (=নাটক), অথবা অবস্থানুকৃর্তিনাট্যম’ (দশরূপক ১:৭) এই অনুকৃতি যদি শোকের হয় তবু তা একটি অনুকৃতিমাত্ৰই, তার দ্বারা জীবনবোধের কোনও প্রসার ঘটে না যদি না মৌলিক কোনও প্রশ্নও তার সঙ্গে উত্থাপিত হয়। যেমন হয়েছে কতকটা মৃচ্ছকটিক বা উত্তররামচরিত-এ যেখানে ভাগ্যবিপর্যয়কে বোঝবার জন্যে একটা অনুচ্চারিত আকৃতি নাটকটিকে কতকটা প্ৰশ্নকািন্টকিত করে রাখে।
বেদান্তদর্শনে ব্ৰহ্মা হলেন রস-স্বরূপ, রিসো বৈ সঃ’; এই রস আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি’। এবং জীবন ব্ৰহ্মাস্বরূপ। কাজেই জীবনের পরিকল্পনায় বেদনার আত্যস্তিকতার স্থান নেই। ধ্বন্যালোক, কাব্যপ্রকাশ, রসগঙ্গাধর, ইত্যাদি প্রখ্যাত অলংকরশাস্ত্রগুলি সবই বেদান্ত নির্ভর, বেদান্ত অন্য সব দর্শনপ্রস্থানগুলিকে গ্ৰাস করে রেখেছিল। এখনও রেখেছে, কাজেই ভারতবর্ষ উচ্চাররণ করেছে এবং বিশ্বাস করবার সাধনা করেছে যে: আনন্দাদ্ধেব খন্বিমানি ভুতানি জায়ন্তে/আনন্দেন জীতানি জীবন্তি/আনন্দং প্ৰখন্তি অভিসংবিশন্তি!—আনন্দ থেকে জীব জাত হয়, আনন্দে বেঁচে থাকে, চলার শেষে আনন্দেই অভিপ্ৰবিষ্ট হয়।’ (তৈত্তিরীয় উপনিষৎ ৩:৬) দুঃখের স্থান কোথায় এখানে? বাস্তবে দুঃখের যে অনুভূতি? খাঁটি বৈদাস্তিক দৃষ্টিতে শেষ পর্যন্ত দুঃখ মায়া, প্রতিভাস, রজজুতে সর্পভ্ৰম। অর্থাৎ দুঃখ অঙ্গ-রাসের মতো নাটকে আনাগোনা করতে পারে প্রয়োজন মতো, কিন্তু নাটকের শেষে সেই সুর বাজবে না কোনও মতেই; শেষে উচ্চারণ করতে পারা চাই ‘ওঁ শাস্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ’। বলতে পারা চাই অথর্ববেদ-এর ভাষায়, ‘যদিহ ঘোরং যদিহ ত্ৰুরং যদিহ পাপং তচ্ছন্তিং তাচ্ছিবং সর্বামিহাশমন্তু নঃ।–এ পৃথিবীতে যা কিছু ঘোর, ক্রুর ও পাপ তা শান্ত হোক, মঙ্গল হোক, আমাদের সব কিছু শান্তিময় হোক।’ (১৯:৯:১৪) প্রার্থনাটি অনাদিকাল থেকে সৃষ্টির বুক চিরে উঠছে, কিন্তু সাহিত্য যখন প্রার্থিতকে লব্ধ বলে মনে করে তখনই তা যথার্থতার সীমা ছেড়ে যায়। এ দর্শনের প্রবল পরাক্রমকে অস্বীকার করবার মতো শক্তিমান শিল্পী ব্যাসবাল্মীকির পরে দেখা দেয়নি। শুধু একবার কালিদাস তাঁর শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য রঘুবংশ-এ সাহস করে দুঃখ ও অবক্ষয়ের এমনই এক চিত্র আঁকলেন কাব্যের অন্তভাগে যে তার পরে আর ‘ওঁ শাস্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ’ বলাও কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু নাটকে? সে যে দৃশ্যকাব্য; যেখানে নাটক দেখার শেষে প্রেক্ষকরা কোনও প্রশ্ন, কোনও গভীর সংশয় কোনও দ্বিধাব্যাকুলতা নিয়ে রঙ্গস্থল ত্যাগ করলে তো চলবে না। মনে রাখতে হবে, নাটকের যে কটি প্রকারভেদ সমধিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেমন নাটক নাটিকা প্রকরণ, ব্যায়োগ ভাণ, ইত্যাদি–এগুলির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজারা বা ধনী বণিকরা। গণিকালয়ের মদনমন্দিরের চত্বরে, রাজসভায়, অথবা মন্দিরপ্রাঙ্গণেই নাট্যাভিনয় হত, সর্বত্রই রাজা বা ধনীই পৃষ্ঠপোষক; এবং নাটক হল ঈশ্বরাণাং বিলাসপ্ত’। তারা চিন্তার উপাদান বা জীবন সম্বন্ধে গভীর কোনও সংশয়ে জর্জরিত হওয়ার জন্যে অর্থব্যয় করত না, চাইত বিনোদন, পেতও তাই; কারণ নাটক সেই খেলানা যা তাদের ভোলাত।
অন্যান্য দেশেও রাজা ও ধনীর আনুকূল্যেই নাটক মঞ্চস্থ হত, কিন্তু সেখানে নাটকের ক্রীড়ানক হওয়ার বা বিনোদন করবার দায় ছিল না। তাই নাটকের কাছে প্রেক্ষকের প্রত্যাশা ছিল জীবনবোধের সম্প্রসারণ, নৈতিক সংঘাতের সম্মুখীন হয়ে নায়ক কেমন করে শ্রেয় ও প্রেয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষুদ্র স্বার্থকে অতিক্রম করতে পারলেন অশ্রুপাত ও মর্মের রক্তক্ষরণের মূল্যে, তা দেখে তারা নিজেদের জীবনসংগ্রামে শক্তিসঞ্চয় করতে চাইতেন। তাই তারা বলেছেন নাটককে হতে হবে গভীর চরিত্র, নৈতিক সংঘাতে জয়লাভ করার দ্বারা এই গভীরতার মর্যাদা অর্পণ করবে নাটককে। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিৰ্ভবতি তাদৃশী: তাঁরা পেলেন কালজয়ী গভীর, গভীর জীবনালেখ্য; আমরা পেলাম ক্রীড়নক।
Leave a Reply