১২. সংস্কৃত সাহিত্যে অশ্লীলতা

সংস্কৃত সাহিত্যে অশ্লীলতা

সাহিত্যে সুরুচি, সুনীতি, ইত্যাদি সম্বন্ধে একান্ত ঔদাসীন্য যেমন অস্বাস্থ্যকর তেমনিই এ সব নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তাও অসুস্থ মনের লক্ষণ। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া একেবারেই অসম্ভব। দেশে এবং কালে শ্লীলতার সীমারেখা সংকুচিত ও প্রসারিত হতে থাকে। শরীর ও সম্ভোগের বর্ণনার অত্যধিক বাহুল্য ঘটলে সমাজের স্বাভাবিক সুরুচি যেমন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, তেমনই ওই প্রসঙ্গে অস্বাভাবিক কুণ্ঠা ও দ্বিধা থাকলে সাহিত্য সে কুণ্ঠাকে আঘাত করে তার সহজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। হয়তো এই ভাবেই শালীনতার একটা সীমা সাহিত্যে অনুক্ত ভাবে স্বীকৃত হয়ে এসেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কোনও সাহিত্য ‘অশ্লীল’ কিনা তার বিচারের মানদণ্ড কি দিয়ে নিরূপিত হবে। এর উত্তরে ‘অশ্লীল’ শব্দটির ইতিহাস সন্ধান করা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আর্যরা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে যখন মগধের কাছাকাছি আসে তার পরে কথ্য মাগধী ভাষার প্রভাব পড়ে বৈদিক সংস্কৃতে। সংস্কৃতে যেটা ‘র’, মাগধী প্রাকৃতে সেটা ‘ল’; কাজেই বৈদিক শ্রীর’ শব্দ মাগধী-প্রভাবিত ‘শ্লীল’ শব্দে পরিণত হল। ‘শ্রীর’ মানে শ্রীযুক্ত; কাজেই শ্লীলতা বিচারে মূল নিরিখ ছিল সৌন্দর্য। শিল্পে যা সৌন্দর্যের পরিপন্থী তা-ই অশ্লীল। পরিশীলিত মনের পাঠকের রসবোধে যা ব্যাঘাত জন্মায় তাই অশ্লীল।

আবার প্রশ্ন আসছে, কী ধরনের পাঠকের রুচির উপরে এত বড় দায়িত্ব ন্যস্ত করা চলে। তাছাড়া, শুধু পাঠকই কি শ্লীলতা নিরুপণে চূড়ান্ত অধিকারী? এ ব্যাপারে লেখকেরই কি প্রাথমিক দায়িত্ব নয়? বোধহয় এই দুটো মানদণ্ড যুগপৎ প্রয়োগ করলে বিচার অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। অর্থাৎ, কোনও রচনায় লেখকের উদ্দেশ্যই যদি হয় নগ্ন বর্ণনার দ্বারা সুরুচিকে আঘাত করা, এবং সে রচনা পড়ে স্বভাবত বাস্তবভীরু নয় এমন মার্জিতরুচি পাঠকের মন যদি রসগ্রহণে বাধা পায় তবে তাকে অশ্লীল বলতে বাধা থাকে না।

এদিক থেকে সাহিত্যকে মোটামুটি তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথম, যে সাহিত্যে চরিত্র চিত্রণ ও ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে শিল্পীর বিবক্ষিত বিষয় পরিস্ফুট হয় এবং এর জন্যে দেহবর্ণনাকে মোটের উপর গৌণ করে সম্পূর্ণ নেপথ্যে রাখা হয়; দ্বিতীয়, যে সাহিত্যে মন মুখ্য হলেও মনেরই গতি, বৈচিত্র্য, সংঘাত ও পরিণতি রূপায়িত করার প্রয়োজনে দেহবর্ণনাকে যথাস্থানে ও যথাপরিমাণে উপস্থাপিত করা হয়; তৃতীয়, যে সাহিত্য প্রাথমিক ভাবে শরীরের ও সম্ভোগের বিচিত্র ও অনাবৃত বর্ণনাতেই নিয়োজিত। এই তৃতীয় শ্রেণীর রচনাই বাস্তবিক পক্ষে অশ্লীল এবং এ বিচারের নিরিখ হবে লেখকের উদ্দেশ্য ও পাঠকের উপলব্ধি, অর্থাৎ, রচনার সাধনা ও সিদ্ধি

সাহিত্যের উদ্দেশ্য শুধু বাস্তবের যথাযথ বা অকুণ্ঠ বর্ণনা নয়, জীবনের মূল্যমান সম্বন্ধে মানুষের বোধকে উন্নততর, সমৃদ্ধতর করাই সাহিত্যের মূল কৃত্য। এর জন্যে— এবং কেবলমাত্র এর জন্যেই— যদি শরীর বা শারীরিক বিষয় বর্ণনার প্রয়োজন হয় তবে সাহিত্য অবশ্যই তাকে স্বীকার করবে এবং সে সাহিত্য যে কোনও মার্জিত রুচির নিরিখে উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু যখন এ জাতীয় বর্ণনাই মুখ্য হয়ে ওঠে অথবা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বা অযথা দেখা দেয়, তখন তা সৎসাহিত্যরসিকের সুরুচি বা ‘শ্রী’র সীমা লঙ্ঘন করেছে বলেই অশ্লীল।

সংস্কৃত সাহিত্যে রামায়ণ, মহাভারত প্রথম পর্যায়ের রচনা। দেহের সাধারণ সৌন্দর্য বর্ণনার বাইরে খুঁটিয়ে কোনও অবয়ব বা অবস্থা বরনা করার অবকাশ মহাকাব্যের বৃহৎ গতিশীল পরিসরে থাকে না। তাই পৃথিবীর সকল মহাকাব্যই এই অর্থে দেহ সম্পর্কে উদাসীন। একটা যুগের গণমানসের বিরাট আশা, আকাঙ্ক্ষা, অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি যে রচনার উপজীব্য, কোনও বিশেষ চরিত্রের শরীরের খুঁটিনাটি বা সম্ভোগের নিপুণ বর্ণনায় কালক্ষেপ করবার অবকাশ তার থাকে না।

দ্বিতীয় পর্যায়ের সংস্কৃত সাহিত্যে অধিকাংশ শিল্পী— ভাস, অশ্বঘোষ, কালিদাস, অমরু, শূদ্রক, বাণভট্ট, ভবভূতি এঁদের রচনায় মুখ্যত চরিত্রগুলির বিকাশ উদ্ঘাটিত করবার প্রয়োজনেই দেহ ও সম্ভোগের বর্ণনা করা হয়েছে। কালিদাসের কুমারসম্ভব-এ পার্বতীর আপাদমস্তক বর্ণনা করা হয়েছে, সে বর্ণনায় পাঠকের সৌন্দর্যবোধ পরিতৃপ্ত হচ্ছে, কামনার উন্মেষ ঘটছে না। মেঘদূত-এর যক্ষবধূ ও রঘুবংশ-এর সীতার রূপবর্ণনা এবং সন্তানসম্ভবা সুদক্ষিণা ও ইন্দুমতীর দেহবর্ণনাও এই শ্রেণির। বর্ণনাগুলি প্রাসঙ্গিক, কাব্যের নিজস্ব প্রয়োজনসিদ্ধির— অর্থাৎ চরিত্রচিত্রণ ও রসসঞ্চারের প্রয়োজনে এগুলির সৃষ্টি, এবং এইসব অংশে কাব্যের মূলরস পুষ্ট হচ্ছে। তাই কোথাও অসুস্থ সংকেতের আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। চরিত্রবিকাশ বা রসসৃষ্টির প্রয়োজনের সঙ্গে এ অংশগুলির একটা প্রসঙ্গ ও পরিমাণগত সামঞ্জস্য আছে (কবির সুরুচিতেই সে পরিমিতিবোধ স্পষ্ট থাকে), তাই অস্থানে প্রযুক্ত হয়ে এ সব বর্ণনা রসহানি ঘটায়নি। কুমারসম্ভব অষ্টমসর্গে জগৎপিতা ও জগন্মাতা রূপে বন্দিত দেবদম্পতির সম্ভোগবর্ণনায় যে কুরুচি আছে তার কারণ খুব সম্ভব সপ্তম সর্গের পরবর্তী সর্গগুলি প্রক্ষিপ্ত, কালিদাসের রচনা নয়।

কিন্তু কালিদাসোত্তর সাহিত্যে এ জাতীয় উদাহরণ বিস্তর পাওয়া যায়। ভারবির কিরাতার্জুনীয় মহাকাব্যের উপজীব্য হল তপস্যার দ্বারা অর্জুনের দিব্যাস্ত্রলাভের চেষ্টা, তপস্যার অন্তে মহাদেব, কার্তিকেয় ও তাঁদের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ ও অবশেষে মহাদেবের প্রসাদে পাশুপতাস্ত্রলাভ। এ কাহিনিতে রস হল বীররস। কিন্তু অলংকারশাস্ত্রে বলা আছে, অঙ্গীরস অর্থাৎ মূলরস যদি বীররস হয় তবে অঙ্গরস হবে শৃঙ্গার বা হাস্য। মহাকাব্যে অঙ্গরস সঞ্চারের দায় এসেছে ততটা সাহিত্যের নিজস্ব প্রেরণায় নয়, যতটা অলংকারশাস্ত্রের নির্দেশে। অতএব অঙ্গরসরূপে শৃঙ্গাররসের অবতারণা করতে হবে। কোথায়? তপস্যারত বা যুদ্ধোদ্যত অর্জুনের পক্ষে সম্ভোগে প্রবৃত হওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে, কাজেই অঙ্গরসের অনুরোধে গান্ধর্ব অপ্সরা ও ষড়ঋতুকে নায়ক-নায়িকা রূপে আনা হল এবং চার সর্গ ধরে তাদের বিলাসের বর্ণনা চলল। এ বর্ণনায় কবি যতই শিল্পকৌশলের পরিচয় দিন না কেন মূল কাহিনির সঙ্গে আন্তরিক সংযোগে এ অংশ অসম্পৃক্ত বলে এতে পাঠকের রুচিকে পীড়িত করে। চরিত্রের বিকাশের জন্য এলে যা সহজ ভাবে কাহিনির মধ্যে অনুসৃত হতে পারত, তাকে শুধুই বহিরঙ্গের নির্দেশ পালনের জন্য আনতে হল বলে সাহিত্যের কোনও সত্য প্রেরণা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তাই এ বর্ণনা অশ্লীল, ‘শ্রী’ ও সুরুচির সঙ্গে এর বিরোধ।

মাঘের শিশুপালবধ-এ এ ব্যাপার আরও বেশি প্রকট। যুধিষ্ঠিরের অভিষেক সভায় প্রধান অতিথির সম্মানের জন্যে শিশুপাল শ্রীকৃষ্ণের প্রতিদ্বন্দ্বী। এ কাহিনিও বীররসাশ্রিত। নিজস্ব ধর্মে এখানেও শৃঙ্গাররসের কোনও অবকাশ নেই, কারণ মূল কাহিনিকে শৃঙ্গাররস সত্যিই কোনও ভাবে স্পর্শই করতে পারে না। তবু অলংকার শাস্ত্রকারদের নির্দেশে অঙ্গরসের অবতারণা করতে হয়েছে, তাই সপ্তম সর্গে সম্ভোগবর্ণনা, অষ্টমে জলবিহার বর্ণনা, নবমে চন্দ্রালোকবিহার, দশমে মধুপানোৎসব ও একাদশে প্রভাতকালীন সম্ভোগবর্ণনা— এই সমস্ত অংশটি মূলকাহিনির পরিপ্রেক্ষিতে একান্তই প্রক্ষিপ্ত। এখানে পাত্র-পাত্রী সকলেই এই কটি সর্গের জন্যেই সৃষ্ট ও তার পরে পরিত্যক্ত। কাব্যের নিজের প্রয়োজনে এ অংশটি রচিত নয়, কেবলমাত্র অলংকারশাস্ত্রের নির্দেশেই এর সৃষ্টি এবং তৎকালীন পাঠকসমাজের রুচির তাগিদেই। তাই কাব্যপাঠের সময়ে এই সমস্ত শৃঙ্গার পরিক্রমাটি রুচিকে পীড়া দেয়। নগ্ন বর্ণনা— তাতে যত কলাকৌশলই থাক না কেন— যখন দীর্ঘ পাঁচ সর্গ ধরে সম্পূর্ণ অকারণে চলতে থাকে, তখন কৃত্রিম ভাবে প্রাধান্য লাভ করার চেষ্টার অপরাধে কাব্যবিচারে সেটাকে অশ্লীল বলে স্বীকার করতেই হয়; কারণ কাব্যে তার কোনও যথার্থ সার্থকতা নেই। এ অংশে শৃঙ্গাররস পরিবেশন করে কাব্যটি পাঠকের এমন বৃত্তির পরিতৃপ্তি সাধন করেছে যা কাব্যরস উপভোগের দ্বারা চরিতার্থ হয় না। কাব্যে এ অংশে পাঠকের যে সাহিত্যসম্মত প্রত্যাশা বা উপলব্ধি তার মধ্যে শিল্পগত সত্য বা ‘শ্রী’ নেই, তাই এ অংশ অশ্লীল। পরবর্তীকালে তথাকথিত মহাকাব্যে দেহবর্ণনা কাব্যের দীর্ঘ অংশ জুড়ে মুখ্য বা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমনি কুরুচির নজির মেলে হরবিজয় কাব্যের দ্বাদশ থেকে অষ্টাবিংশ সর্গে, কর্ণাভ্যুদয় কাব্যের অষ্টম থেকে পঞ্চদশে, দ্যাশ্রয় কাব্যের সপ্তমে অথবা কুমারপালচরিত-এর চতুর্থে এবং বিহণের চৌরসুরত-পঞ্চাশিকা জুড়ে; যদিও তাতে কোথাও কোথাও সত্যকার রসও দেখা দিয়েছে।

কিন্তু বোধহয় এ জাতীয় কুরুচির প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাওয়া যায় নৈষধচরিত-এর দ্বিতীয়, সপ্তম, ষোড়শ, অষ্টাদশ, ঊনবিংশ ও বিংশ সর্গে। নলদময়ন্তী কাহিনির যে অংশটুকু শ্রীহর্ষের উপজীব্য, মহাভারতে সেটা দুশোরও কম শ্লোকে বর্ণিত। নৈষধে তার পরিমাণ প্রায় ২,৮০০ শ্লোক, অর্থাৎ মহাভারতের প্রতি শ্লোক নৈষধে স্ফীতিলাভ করেছে গড়ে চৌদ্দটি শ্লোকে। এর মধ্যে কবির পাণ্ডিত্যপ্রকাশ, অলংকারপ্রয়োগের কৌশল ও বর্ণনাকে দীর্ঘায়িত করবার নৈপুণ্য বাদ দিলেও কলেবর বৃদ্ধির যেটি প্রধান কারণ তা হল দেহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। নলদময়ন্তী কাহিনি মহাভারতের শ্রেষ্ঠ উপাখ্যানগুলির অন্যতম: প্রবল ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে নল ও দময়ন্তী চরিত্র অপূর্ব মহিমা ও সৌন্দর্যে বিকশিত হয়েছে। এই অসামান্য কাহিনিটির মধ্যে শ্রীহর্ষের নিজস্ব সংযোজনা হল দেহবর্ণনায় নৈপুণ্য ও বহিরঙ্গের অলংকরণ মনকে বাদ দিয়ে শরীর যেখানে একান্ত হয়ে উঠেছে সেখানে ভিন্ন এক ধরনের পাঠক উপস্থিত, যাদের কাছে কাব্যে জীবনবোধ বা রসোপলব্ধি প্রত্যাশিত নয় বরং সম্ভোগবাসনা উদ্রিক্ত করতে পারে এমন নগ্ন বর্ণনা বা তার চেয়েও অশালীন, বহুতর নিপুণ আদিরসের সংকেতই তাঁরা আশা করেন কাব্যে। এ বস্তুর স্রষ্টাও সু-সাহিত্যিক নয়, পাঠকও রসবোদ্ধা নয়। অতএব এ শালীনতাকে অনায়াসে বর্জন করেছে, শিল্পের অনুরোধে নয়, প্রবৃত্তিকে উদ্দীপিত করার দায়ে।

এই তৃতীয় শ্রেণির সাহিত্যে কামনার উন্মেষ ঘটানোই মুখ্য উদ্দেশ্য; দেহ ও সম্ভোগ বর্ণনাই এখানে মূল উপজীব্য; মন এখানে নিতান্তই গৌণ কিংবা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শিল্পের বিচারে এ রচনা রসোত্তীর্ণ নয়; এর সাধনাও হীন, সিদ্ধিও হীন; তাই সাহিত্যে এর কোনও সত্য আসন নেই। সাহিত্যের নিজের প্রয়োজনের বিচারে যা গৌণ, তা যেন আপন অধিকার লঙ্ঘন করতে উদ্যত হয়ে শিল্পের পরিমিতিবোধ ক্ষুণ্ণ করেছে। বহিরঙ্গ যেন মূল উপজীব্যকে আচ্ছন্ন করতে গিয়ে নিজেকেই মর্যাদাচ্যুত করেছে। কালিদাসের কাব্যেও শরীর অত্যন্ত প্রত্যক্ষ ভাবেই বিদ্যমান, কিন্তু সম্পূর্ণ পরিকল্পনার অবয়ববিন্যাসের সঙ্গে কোথাও প্রসঙ্গত বা পরিমাণগত কোনও বিরোধ তার নেই; অতএব সে বর্ণনা সমগ্রের সৌন্দর্যের পরিপূরক; অযথার্থ অধিকারের লোভে উদগ্র ভাবে প্রগলভ হয়ে সমগ্রকে ও নিজেকে শ্রীভ্রষ্ট করেনি। বাণভট্টের কাদম্বরী-তে চণ্ডালকন্যকা, পত্রলেখা, কাদম্বরী ও মহাশ্বেতার রূপবর্ণনা; কাদম্বরীতে সন্তানসম্ভবা বিলাসবতী ও হর্ষচরিত-এ সন্তানসম্ভবা যশোমতীর শরীর বর্ণনা এমনি করে সমগ্র কাহিনির অবিচ্ছেদ্য ও পরিপোষক অংশ হয়ে আছে বলেই এগুলি পাঠকের তৃপ্তিবিধান করে, কুণ্ঠা বা জুগুপ্সা জন্মায় না।

দেহ তার নিজের অধিকারেই সত্য এবং সত্য বলেই সাহিত্য তাকে বর্জন করবে না; প্রয়োজন মতো বর্ণনা করবে। যতটা খুঁটিয়ে বর্ণনা করলে নায়ক-নায়িকার মনের বিকাশ বা চরিত্রের রূপায়ণ দেখানো সম্ভব হতে পারে ততটাই খুঁটিয়ে বর্ণনা করবে, কিন্তু কেবলমাত্র শিল্পের অনুরোধেই। পরিশীলিত রুচির পাঠক যদি বোধ করেন যে, অনাবশ্যক বিস্তারে দেহ বা সম্ভোগ বর্ণনায় কামনার উন্মেষসাধনই একান্ত হয়ে উঠেছে এবং তার দ্বারা রসবোধের বিঘ্ন জন্মাচ্ছে, তবে তা শিল্পগ, কারণেই সাহিত্যে অনুত্তীর্ণ বলে মানতে হবে। সাহিত্যে শিল্পেতর কোনও নৈতিক বা সামাজিক মানদণ্ড প্রযোজ্য নয়। বস্তুত রসোত্তীর্ণ সাহিত্যের পাঠক ও যৌন সাহিত্যের পাঠক শিক্ষাদীক্ষা ও রুচিতে সম্পূর্ণ পৃথক দুই গোষ্ঠীর মানুষ। একটি রচনার দ্বারা অপরটির উদ্দিষ্ট পাঠকের পরিতৃপ্তি ঘটবে না। সাহিত্যের কাছে উভয়ের প্রত্যাশাও ভিন্ন। এই কারণেই দেহবর্ণনার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও কালিদাস সৎ সাহিত্যের স্রষ্টা কিন্তু মাঘ বা শ্রীহর্ষের রচনায় প্রচুর কলাকৌশল ও পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও শিল্পগত সুরুচির বিচারে এঁদের রচনা হীন হয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *