মৃচ্ছকটিক
নাটকের প্রকারভেদ অনুসারে মৃচ্ছকটিক প্রকরণ। ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্র-তে বলেছেন, কবি নিজের শক্তিতে যখন উদ্ভাবিত কাহিনি ও নায়ক সৃষ্টি করে নাটক রচনা করেন তখন সেটি প্রকরণ হয়। প্রকরণ দুই প্রকারের: শুদ্ধ ও সংকীর্ণ। নায়িকা কুলস্ত্রী হলে প্রকরণটি শুদ্ধ, গণিকা থাকলে সংকীর্ণ। (যত্র কবিরাত্মবুদ্ধ্যা বস্তু শরীরঞ্চ নায়কমেব চ/ঔৎপত্তিকং প্রকুরুতে প্রকরণমিতি তদবুধেৰ্জ্জৈয়ম। নাট্যশাস্ত্ৰ ২০:৪৮) প্রায় দেড় হাজার বছর পরে খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতকে বিশ্বনাথ তাঁর সাহিত্যাদর্পণগ্রন্থে বলেছেন, প্রকরণের ঘটনা হবে লৌকিক, কবিকল্পিত; মূল রস-শৃঙ্গার; নায়ক-বিপ্ৰ, অমাত্য অথবা বণিক যিনি ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষের চর্চায় নিরত এবং ধীরপ্রশান্ত। নায়িকা কখনও কুলনারী, কখনও বেশ্যা কখনও বা দুজনেই থাকবে। (ভবেৎ প্রকরণে বৃত্তং লৌকিকং কবিকল্পিতম/শৃঙ্গারোইসী নায়কন্তু বিপ্রোমাত্যেথবা বণিকঃ /সাপায়ধর্মকামার্থপরো ধীরপ্রশান্তকঃ/নায়িকা কুলজা কপি বেশ্যা কপি দ্বয়ং কৃচিৎ। ৬:২৫৩-৫৪) দেখা যাচ্ছে ভরত ও বিশ্বনাথের মধ্যে যে কালের ব্যবধান তার মধ্যে কিছু কিছু প্রকরণ রচনা হয়েছে এবং প্রকরণের সংজ্ঞা আরও স্পষ্ট অনুপুঙ্খতা অর্জন করেছে; ফলে নায়কের সামাজিক পরিচয় ও চরিত্র, একই নাটকে কুলনারী ও বেশ্যার যুগপৎ উপস্থিতি এবং মূল রসের প্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্টতর নির্দেশ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ভরত ও বিশ্বনাথ দুজনেই বলেছেন কাহিনি কবিকল্পিত হবে; বিশ্বনাথ যোগ করলেন ‘লৌকিক, তাই নায়ক এখানে রাজা নয়, অমাত্য বা বণিক এবং বিপ্ৰ (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয় বা বৈশ্য), উন্নতচরিত্র ও ধর্মপরায়ণ।
মৃচ্ছকটিক-এর কাহিনি বা বস্তু সম্পূর্ণই লোকায়ত। বৃহৎকথা-য় এ কাহিনির সংক্ষিপ্ত বীজ আছে, কথাসরিৎসাগর-এও তার বিভিন্ন অংশের সূত্র আছে। কথাসরিৎসাগর-এ গণিকা কুমুদ্দিকার প্রতি আসক্ত উজ্জয়িনীর এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। (৫৮:২) ওই গ্রন্থেরই অন্যত্র পাই রূপণিকা নামে গণিকা এক ব্ৰাহ্মাণের প্রতি আসক্ত। (১২:৪) গণিকা মন্দনিকার প্রাসাদের সঙ্গে বসন্তসেনার প্রাসাদের বর্ণনা মেলে; (৩৮:২০-২৭) যেমন এর অষ্টাদশ অধ্যায়ে দেখি জুয়াড়িরা মন্দিরে ঢুকে পড়ছে। মৃচ্ছকটিক-এর নয় অঙ্কের রাজা পালক ও দশম অঙ্কের নতুন রাজা গোপালপুত্র আর্যক; কথাসরিৎসাগর-এ প্রদ্যোত ও অঙ্গরাবতীর দুই পুত্রের নাম গোপাল ও পালক। ভাসের বিখ্যাত নাটক চারুদািক্তচার অঙ্কে সমাপ্ত, সেখানকার কাহিনি মৃচ্ছকটিক-এর পঞ্চম অঙ্কের কাহিনি পর্যন্ত। মনে হয়, নাট্যরচনায় এই নাটকটিই শূদ্ৰককে প্রণোদিত করে। কাব্যালংকার্যসূত্র-এর রচয়িতা বামন তাঁর গ্রন্থের উদাহরণে যে শ্লোক ও উক্তিগুলি উদ্ধৃত করেছেন তার মধ্যে দুটি চারুদত্ত ও মৃচ্ছকটিকে আছে। প্রথম, ‘যাসাং বলি সপদি মদগৃহদেহলীনাম; দ্বিতীয়, ‘দ্যুতং হি নাম পুরুষস্যসিংহাসনং রাজ্যম; তৃতীয় একটি, ‘ব্যসনং হি নাম সোচ্ছাসং মরণম— ভাসে আছে এবং এর প্রতিধ্বনি পাই মৃচ্ছকটিকে।
সুক্তিমুক্তাবলী-তে একটি শ্লোক আছে, শূদ্ৰককথাকার ছিলেন র্যামিল ও সোমিল। এঁদের কাব্য ছিল অর্ধনারীশ্বরের মতো। (তৌ শূদ্ৰককথাকারেী রমৌ রামিলসোমিলীে/কাব্যং যয়োদ্ধয়োরিাসী দর্ধনারীনরোপমৌ।) এর এক অর্থ হতে পারে এদের একজনের কাব্য অপরের কাব্যের পরিপূরক ছিল, অথবা অন্য অর্থ হতে পারে। এঁরা দুজনে যৌথ ভাবে একখানি শূদ্রককথা রচনা করেছিলেন। এ কাব্য পাওয়া যায় না। তবে একটি শূদ্ৰককথা-র অস্তিত্ব ওই শ্লোক থেকে জানা যায়।
শূদ্রকের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে আজও বিতর্কের অবসান ঘটেনি। প্রথম বা দ্বিতীয় শিবমার রাজা (সপ্তম থেকে অষ্টম শতকের), আভীর রাজা শিমুক (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের), শিশুক, শিংশুক, ইত্যাদি নানা নামে, নানা স্থানে ও নানা যুগে নাট্যকারকে স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণে আমরা শিমুক, শিশুক, সিন্ধুক ও শিপ্রক, ইত্যাদির নামের রাজাদের কথা পাই। কিন্তু শূদ্ৰক যদি সাতবাহন বংশীয় হন তবে ওই বংশের রাজারা ব্ৰাহ্মণ্যাগর্কিত ছিলেন। বাণভট্ট কাদম্বরী-তে এক শূদ্রক রাজার উল্লেখ করেছেন যিনি জন্মান্তরে চন্দ্রপীড় ও চন্দ্র ছিলেন (দণ্ডী তাঁর দশকুমারচরিত-এ শূদ্রকের বহু জন্মের কথা উল্লেখ করেছেন)। তার থেকে মনে হয় খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতেই —বাণভট্টের যুগে— এই শূদ্রক এক ইতিহাস-বিখ্যাত রাজা ছিলেন। দক্ষিণাত্যের এক রাজা দ্বিতীয় শিবামার কল্পনার তু নামে একটি হস্তিশিক্ষার গ্রন্থ রচনা করেন, এর পৌত্র শিবমর সম্বন্ধে। ৭২৬ খ্রিস্টাব্দের বারদুর শিলালেখে পাই যে ইনি শতায় ছিলেন (স্মৃত্যাবিরোধেন বর্ষশতপূৰ্ণায়ুঃ)। বেতাল পঞ্চবিংশতি-র বীরবরোপাখ্যানে শূদ্রক এক বিজয়ী রাজ; তার কর্মচারী বীর্যবর রাজার মৃত্যু আসন্ন জেনে নিজের পুত্রকে বলি দিয়ে শূদ্রকের জন্য শতবর্ষ পরমায়ুবর দেন। মৃচ্ছকটিক-এও রাজা শূদ্রকের শতবর্ষ পরমায়ুর উল্লেখ আছে, তিনি হস্তিশিক্ষাবিৎ এমন কথাও আছে। এ সব থেকে মনে হয় নাটকে শূদ্ৰাক-পরিচিতির শ্লোকগুলিতে বহু প্ৰখ্যাত রাজার গুণাবলী একত্র করে নাট্যকার শূদ্রকে আরোপিত হয়েছে। এ শূদ্রক সম্ভবত কাদম্বী-তে উল্লিখিত রাজা শূদ্রক, যাঁর কথা অষ্টম শতকের আলংকারিক বামন তাঁর কাব্যালংকার্যসূত্রবৃক্তি-তে শ্লেষগুণের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, এবং একাদশ শতকে কলহণ তাঁর রাজতরঙ্গিণী-তে র্যাকে বলেছেন বিক্ৰমাদিত্যের তুল্য। রায়মুকুট-এ শূদ্ৰক বধ’ নামে এক পরিকথা, পঞ্চশিখরচিত শূদ্ৰাকচারিত এবং বিক্ৰমাস্তশ্বন্দ্ৰক নামে এক নাটকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তামিলনাড়ুতে প্রাপ্ত দন্তীর অবন্তীসুন্দরীকথা-র এক পাণ্ডুলিপিতে একটি শ্লোক পাওয়া যায় যার অর্থ হল: শূদ্ৰক স্বচ্ছ অসিধারে বারবার পৃথিবী জয় করে তারপরে আত্মচরিতার্থক রচনায় পৃথিবীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। (শূদ্ৰকেশাসকৃজ্জিত্বা স্বচ্ছয়া খড়গধারয়া/জগদভুয়োহভ্যবষ্টৰূং বাচা স্বচরিতীৰ্থয়া।) এখানে সম্ভবত শূদ্ৰাক-বিরচিত কোনও অধুনালুপ্ত আত্মচারিত অথবা শূন্দ্রক রচিত নামক লুপ্ত রচনাটিরই উল্লেখ পাচ্ছি। বামন তাঁর কাব্যালংকার্যসূত্রবৃক্তি-তে শূদ্ৰক বিরচিতেষু প্রবন্ধেযু (৩:২:৪) লিখেছেন; বহুবচন থেকে মনে হয় শূদ্ৰক মৃচ্ছকটিক ছাড়া অন্য গ্ৰন্থও রচনা করেছিলেন।
শূদ্ৰক নামটিতেও বৈশিষ্ট্য আছে; শুনেই বোঝা যায় এ নাম পৈত্রিক নয় (অশূদ্র পিতামাতা সন্তানের এ নামকরণ করবেন না, শূদ্র পিতামাতাও করবেন না)। হয়তো এটি উপাধিরূপেই ব্যবহৃত। মনে হয় কোনও শূদ্ৰজাতীয় রাজা বা/এবং নাট্যকার যশস্বী হওয়ার পরে তাঁর শূদ্র-পরিচয় স্বার্থিক ‘ক’-প্রত্যয়যোগে বিশেষণরূপে ব্যবহার করেন। একাদশ শতকের ভাগবতপুরাণ-এ পড়ি দক্ষিণাত্যের অন্ধভৃত্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শিমুক ছিলেন বৃষল অর্থাৎ শূদ্র। ইনি নাট্যকার না-ও হতে পারেন। তবে নাটকটি দক্ষিণাত্যের, এমন অনুমানের কিছু কিছু ভিত্তিও আছে; নানা আচার সংস্কার ও দক্ষিণাত্যের কিছু কিছু শব্দ এতে আছে (যথা কর্ণাটকলহ, দেবী সহ্যবাসিনী, খুণ্টমোড়ক, বরগুলাম্বুক, ইত্যাদি শব্দ বা বীরকের উক্তি ‘বয়ং দক্ষিণাত্যাঃ’, ইত্যাদি)।
নাটকের নাট্যকারের কাল নিয়ে যেমন বিসংবাদ স্থান নিয়েও তেমনই। ভাষায় সামাজিক পটভূমিকার কিছু অংশে দক্ষিণাত্যের প্রভাব স্পষ্ট, অথচ মুখ্যত এ নাটকে ঘটনা ঘটছে উজয়িনীতে, নাটকে উজ্জয়িনী সম্বন্ধে বহু গর্কিত উক্তিও আছে। এমন হতে পারে যে, উজ্জয়িনীর ঘটনা হিসেবেই নাট্যবস্তু পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়েছিল, তাই দক্ষিণী নাট্যকার উজ্জয়িনীতেই এর স্থাপনা করেন, তবু দাক্ষিণাত্যের কিছু কিছু চিহ্ন এতে থেকে যায়। অবশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত সম্ভাবনাও খণ্ডন করা কঠিন। ভাষা থেকে নিঃসংশয়ে কিছু বোঝা যায় না। চারুদত্ত, শর্বিলক, আর্যক, অধিকরণিক, দর্দুরক এবং পঞ্চমাঙ্কে একবার বসন্তসেনাও সংস্কৃত বলছেন। শৌরসেনী, যা মুখ্য নাটকীয় প্রাকৃত তাতে কথা বলছেন বসন্তসেনা, সূত্ৰধার, বীরক, চন্দনক, শ্রেষ্ঠীকায়স্থ, মদানিক, ধুতা ও বসন্তসেনার মা। মৈত্ৰেয় বলছেন প্রাচ্যা; সংবাহিক, কর্ণপুরক, বর্ধমানক, স্থাবরক, রদনিক এরা বলছে মাগধী এবং সংস্থানক বলছে নিকৃষ্টতম প্রাকৃত, শাকারী।
দশম অঙ্কে রাজনৈতিক পটভূমিকা পরিবর্তনের ফলে যে-আর্যক রাজা হলেন নাটকে তিনি গোপালদারক। এ শব্দের একটি অর্থ গোয়ালার ছেলে; কিন্তু এ-অর্থ সংগত মনে হয় না, কারণ, প্রথমত, সংস্কৃত নাটকে গোয়ালার ছেলে সংস্কৃত বলে না, প্রাকৃত বলে। দ্বিতীয়ত, গোয়ালার ছেলের নাম আৰ্যক হওয়া, খুব আপেক্ষিত নয়। তৃতীয়ত, দশম অঙ্কের ৫০ সংখ্যক শ্লোকে পড়ি আর্যকতাঁর বংশমর্যাদা রক্ষা করেছেন, এ কথা গোয়ালার ছেলে সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতে প্ৰযুক্ত হত না। কাজেই এখানে গোপালদারক মানে আর্যকের পিতার নাম গোপাল। নাটকটির নামকরণেও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রকরণের নাম হবে নায়ক-নায়িকার নামে, যেমন মালতীমাধবা। সে হিসেবে এ নাটকের নাম হওয়ার কথা চারুদত্তবসন্তসেনা, কিন্তু হল মৃচ্ছকটিকা এ নামের সূত্র ষষ্ঠ অঙ্কের প্রথমে একটি আপাতগৌণ ঘটনায় নিহিত। পূর্বরাত্রে প্রিয়সঙ্গমের পরে সকালে বসন্তসেনা যাবেন উদ্যানে চারুদত্তের কাছে; চারুদত্ত আগেই সেখানে গেছেন। সকালে বাড়িতে চারুদত্তের পুত্র রোহসেনের কান্না শুনে দাসীকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করে বসন্তসেনা জানতে পারলেন, রোহসেন প্রতিবেশীর ছেলের সোনার খেলনাগাড়ি নিয়ে তার সঙ্গে খেলছিল। সে ছেলেটি তার গাড়ি নিয়ে বাড়ি গেছে, তাই কান্না। তাকে ভোলাতে দাসী একটি মাটির গাড়ি নিয়ে আসে, তাতে রোহসেনের মন ওঠে না, কান্নাও থামে না। শুনে বসন্তসেনার চোখে জল এল। দেখে রোহসেন বলল, ‘তুমি কে?’ বসন্তসেনা বললেন, ‘আমি তোমার মা হই।’ ছেলে বললে, ‘না, আমার মা এত গয়না পারেন না।’ তখন বসন্তসেনা সাশ্রুনেত্ৰে একে একে নিজের অঙ্গ থেকে অলংকারগুলি খুলে রোহসেনের মাটির গাড়িতে দিয়ে বললেন, ‘যাও, বাবা, এগুলো দিয়ে সোনার খেলনাগাড়ি গড়িয়ে নিও।’
এই খেলার মাটির গাড়িই সংস্কৃতে মৃৎ-শকটিক, তার থেকেই নাটকের নাম। এর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার কারণ হল, নামকরণে শূদ্ৰক প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করে এই ঘটনাটি দিয়েই যখন নামকরণ করেছেন তখন নিশ্চয়ই এর কোনও গূঢ় নিহিতার্থই তাঁর উদ্দিষ্ট ছিল।
এক অর্থে এই নিহিতার্থই নাটকের মূল বিবক্ষিতের রূপক-চুম্বক। এ নাটকের প্রথম পাঁচ অঙ্কের ঘটনা ভাসের চাইেক্লদত্ত নাটকের চার অঙ্ক থেকে নেওয়া। নায়িকা নায়কের অভিসারে যাচ্ছেন, এখানে তাদের আসন্ন মিলনের সংকেতের মধ্যে ভাসের নাটকের পরিসমাপ্তি। কিন্তু মৃচ্ছকটিক-এ নাট্যবস্তুর যা কিছু গৌরব তা নিহিত আছে যষ্ঠ থেকে দশম অঙ্কে। নাটকের অন্তর্নিহিত সমস্যা দেখা দেয় ষষ্ঠে, জটিল হয়ে ওঠে সপ্তম থেকে নবমে, দশমে তার চূড়ান্ত পরিণতি। কাজেই মৃচ্ছকটিক যেখানে নাটকীয় তাৎপর্যের গভীরতা অর্জন করছে তার সবটুকু কৃতিত্ব শূদ্রকেরই। এবং ষষ্ঠ অঙ্ক থেকেই সে অংশের সূচনা। এই ষষ্ঠ অঙ্কের শুরুতেই এই ঘটনা, এবং এরই মধ্যে নামকরণের উৎস।
নাট্যকার এখানে মঞ্চে একটি দৃশ্য দেখালেন, সালংকারা বসন্তসেনা অলংকার খুলে মাটির গাড়িতে ভরে দিয়ে নিরাভরণা হলেন, কারণ, অলংকৃত অবস্থায় রোহসেন তাঁকে মা যাচ্ছিল। এখানে দুটি ঘটনা ঘটল। যার রূপক তাৎপর্য আছে: একটি, বসন্তসেনার অলংকার মোচন; দ্বিতীয়টি, মাটির গাড়ি সোনায় ভরে ওঠা।
সমাজে ভালমন্দের যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব আছে তা যেন একটি সাংকেতিক রূপকল্প হয়ে এখানে দেখা দিল: রাজা পালক ও তার শ্যালক শকার ধনী, তারা দুজনেই শক্তিমান ও দুর্জন। চারুদত্ত, শবিলক, সংবাহক, দদুরক, স্থাবরক, বর্ধমানক, মন্দনিকগ, রদনিক, গোহ, আহীিন্ত এরা সকলেই সৎ ও দরিদ্র। ব্যতিক্রম একজনই ছিলেন, বসন্তসেনা। ইনি ধনী। কিন্তু সৎ। ষষ্ঠ অঙ্কে যখন তিনি নিরলংকর হলেন তখনই যেন তিনি দরিদ্র চারুদত্তের পাশে এসে দাঁড়াতে পারলেন। আর, মঞ্চের ওপরে যখন একটা মাটির গাড়িতে সোনার গহনা ভরে দেওয়া হল তখন সেই গাড়িটাই নাটকের সৎ চরিত্রগুলির প্রতীক হয়ে উঠল, বাইরে যাদের দৈন্য ও ভঙ্গুরতা (যেমন, বসন্তেসেনার গণিককুলে জন্ম, চারুদত্ত ও অন্যান্য সৎ চরিত্রগুলির দারিদ্র) অথচ অন্তরের চরিত্রবল যাদের খাঁটি সোনা, তাদের প্রতীক হয়ে উঠল। ওই মৃৎ-শকটিকা। এই একটি রূপকের মধ্যে নাটকের মূল কথাটুকু বিধৃত হয়ে রইল এবং এর দ্বারাই নাটকের নামকরণের যথার্থতা প্ৰতিপন্ন হল।
যদিও অধিকাংশ সংস্কৃত নাটকে রাজাই নায়ক, মৃচ্ছকটিক-এ কিন্তু রাজা নেপথ্যেই থাকে। এ নাটকের অন্য চরিত্রগুলি সমাজের সব স্তর থেকে সংকলিত হয়েছে এবং বহু সামাজিক অবস্থা ও বৃত্তি চরিত্রগুলিতে প্রতিফলিত। নেপথ্যে রাজা, প্রকাশ্যে একদা-ধনী চারুদত্ত, ধন্যবতী। বসন্তসেনা, কুলপুত্র শর্বিলক ও সংবাহক, সহসা-ধনী সংস্থানক, অধুনাদরিদ্র দর্দুরক, দরিদ্র চারুদত্তের বান্ধব মৈত্ৰেয়, গণিকা মন্দনিকা, ভৃত্য স্থাবরক, বর্ধমানক, দাসী রদনিকা ও দরিদ্র চণ্ডাল। বৃত্তির দিক থেকে গণিকা, বণিক, বিট, চেট, অধিকরণিক, শ্রেষ্ঠীকায়স্থ, দাস-দাসী, চোর, সংবাহক, শ্রমণ, হাতির মাহুত, প্রবহণক, জুয়াড়ি, চণ্ডাল–সবাই আছে। বর্ণের দিকে আছে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, কায়স্থ ও চণ্ডাল। মধ্যে মধ্যে একই বৃত্তিধারী ব্যক্তিদের মধ্যে ভিন্ন চরিত্রের মানুষ বৈচিত্র্য এনেছে; যেমন, দুই বিট, বীরক-চন্দনক, গোহি-আহীন্ত।
নায়ক হিসেবে যেমন চারুদত্তের চরিত্রে, নায়িকা হিসেবে তেমনই বসন্তসেনার চরিত্রে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব আছে। চারুদত্ত বিবাহিত পুত্রবান এবং স্ত্রী ধূতার প্রতি উদাসীন নন; কিন্তু তাঁর জীবনে একটি নতুন ও প্রবল প্ৰেম দেখা দিয়েছে সামাজিক নিয়মে যার চরিতার্থতার পথ রুদ্ধ, কারণ গণিকাকে ধন দিয়েই পাওয়া যায় এবং তিনি বর্তমানে নির্ধন। বসন্তসেনা গণিকা; চারুদত্তের প্রতি তাঁর প্রেম অন্ধগলিতে মাথা কুটে মরে কারণ তাঁর কাছে আসবার মতো অর্থসম্বল চারুদত্তের নেই। কিন্তু এ প্রেমে বসন্তসেনার জন্মান্তর ঘটে গেছে, তাই কায়মনোবাক্যে তিনি গণিকাবৃত্তি পরিহার করেছেন। যে-অলংকার কাটি নাটকের নামকরণে এত তাৎপৰ্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে প্রথম অঙ্কে বসন্তসেনা কৌশলে সেগুলি চারুদত্তের কাছে গচ্ছিত রাখেন যাতে আবার তাদের দেখা হয়। সে গহনাচুরি করেও দৈবক্রমে চোর শর্বিলক মদনিকার নিষ্ক্রয়মূল্য হিসেবে অলংকারগুলি বসন্তসেনাকেই এনে দেয় এবং চুরির অপবাদ ঘোচাতে বিদুষক ধূতার বহুমূল্য মুক্তামােলা এনে দিলেন বসন্তসেনাকে। বসন্তসেনা বলে পাঠালেন সেই সন্ধ্যাতেই চারুদত্তের কাছে যাবেন।
নানা প্রাসঙ্গিক বস্তুর (sub-plot) মাধ্যমে চারুদত্ত ও বসন্তসেনা যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা নন, সেখানে তাঁদের মনুষ্যত্বের ও মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এবং এই একটি নাটকে অন্তত চারুদত্ত ও বসন্তসেনা শুধু পরস্পরের রূপমুগ্ধ নন, গুণে অভিভূত। পঞ্চম অঙ্কে এদের ক্ষণিক মিলন। ষষ্ঠ থেকে দশমে বিরহ ও বহু প্রতিকুল অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে দুজনে দুঃখের মূল্য দিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি এসে প্রেমকে জীবনের গভীরে অর্জন করলেন।
যদিও এ নাটকে বহু পার্শ্বচরিত্রের তাৎপৰ্য আছে (যেমন আর্যক, স্থাবরক, শবিলক, সংবাহক, চন্দনক ও বসন্তসেনা-মাতা) তথাপি সংক্ষেপে অন্তত দুটি গৌণ চরিত্র সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। এঁদের মধ্যে একজন হলেন মৈত্ৰেয়, বিদূষক। সংস্কৃত নাটকে বিদুষকের একটি সুপরিচিত ভূমিকা আছে–সে ভাঁড় ও ঔদরিক। মৈত্ৰেয় কোনওটিই পুরোপুরি নন, অথচ দুটি লক্ষণই তাঁর চরিত্রে বিদ্যমান, তিনি ভোজনরসিক ও পরিহাসপ্রিয়। প্রথম পরিচয়েই দেখি মৈত্ৰেয় তাঁর অপেক্ষিত ভূমিকাকে লঙ্ঘন করে গেলেন; যে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলে বন্ধু চারুদত্তের দারিদ্র্য প্রকাশ্যে অবমানিত হয় তা তিনি অনায়াসে ও সগৰ্বে প্রত্যাখ্যান করলেন। নাটকে তার প্রধান পরিচয়, তিনি অনায়াসে ও সগর্বে প্রত্যাখ্যান করলেন। নাটকে তার প্রধান পরিচয়, তিনি চারুদত্তের বন্ধু— যে বন্ধু দুদিনে রাষ্ট্রবিপ্লবে ও শ্মশানে পাশে থাকে, যে বন্ধু বন্ধুর মৃত্যুর পরে প্রাণধারণ করার কথা ভাবতেই পারে না, যে বন্ধু চারুদত্তের সম্মান রক্ষার জন্যে নিত্য উদ্যত, চারুদত্তের স্বার্থের কাছে যার আর সবই গৌণ হয়ে যায়।
সংস্থানকের যে বিট তার চরিত্রেও বৈশিষ্ট্য আছে। সংস্থানকের বৃত্তিভোগী সহচর তিনি। দারিদ্র্যের চাপে একটি অমানুষের পার্শ্বচর হওয়ার যে গ্লানি সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ ভাবে অবহিত। সংস্থানক শুধুমুর্থনয়, সে ধূর্ত, নিষ্ঠুর, কামুক, স্বার্থপর ও অত্যাচারী। তবু দুৰ্দৈবক্রমে তারই স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সচেষ্ট থাকার চরাচরিত ভূমিকাতেই বিট অভ্যস্ত ছিলেন এবং মনিব সংস্থানকের স্বার্থে বারবার নিষ্ঠুর ভাবে বসন্তসেনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ধনী সংস্থানকের ইচ্ছাপূরণে আপত্তি করা একান্ত অসংগত। গণিকার উচিত প্ৰিয়-অপ্রিয় সঙ্গপ্ৰাথীর সঙ্গে সমান ভাবে আচরণ করা, কারণ সে পথের পাশের লতা, যে-কেউ তার ফুল ছিঁড়ে নিতে পারে। কিন্তু এই বিট যে, মুহূর্তে শুনলেন বসন্তসেনা চারুদত্তের প্রতি অনুরক্তা তৎক্ষণাৎ তার মনোভাবে গভীর পরিক তঁন এল, বসন্তসেনার প্রেম তার কাছে সম্রামের বস্তু হয়ে উঠল এবং বসন্তসেনা-চারুদত্তের মিলনের জন্যে সর্বতো ভাবে আনুকুল্য করা ও মনিব সংস্থানকের কামুকতার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করাই তার কাছে একান্ত কর্তব্য হয়ে উঠল। শকার যখন বসন্তসেনার গলা টিপে ফেলে রেখে গেল তখন তাকে মৃত জেনে সাশ্রনেত্রে বিটের সেই আশীর্বাদ: সুন্দরি, এর পরজন্মে নির্মল কোনও বংশে জন্মিও, তোমার গণিকজন্মের যন্ত্রণার যেন এখানেই অবসান ঘটে। আমাদের মনে হয়, বৌদ্ধভিক্ষুর পরিচর্যায় যখন বসন্তসেনা পুনরুজজীবিত হন তখন যেন বিটের আশীর্বাদ সফল হল: সত্যই যেন বসন্তসেনার এক নবজন্ম ঘটল। আগেই তিনি ঐশ্বর্যের সমস্ত চিহ্ন মোচন করে এসেছেন, এবার এই নবজন্মে। সেই নিরাভরণা বসন্তসেনা, নাটকে যাঁকে বারবার বলা হয়েছে বসন্তশোভার মতো সুন্দরী, তিনি যেন প্রেমের মহিমায় অন্য এক সর্বশুচিলোকে উদিত হলেন। আসন্ন মৃত্যুর সামনেও যিনি অকুণ্ঠ ভাবে প্রেমের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছেন, তিনি এবার সত্যই সহধর্মিণী হলেন চারুদত্তের, যিনি নিজেও প্রেমের জন্যে মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত হয়েছিলেন।
এ নাটকে ঘটনা দ্রুত ঘটেছে, বহু বিচিত্র উপকাহিনি অঙ্গাঙ্গী ভাবে মূল ঘটনার সঙ্গে সুগ্রথিত হয়ে সংহত একটি নাট্যবস্তু সৃষ্টি করেছে। দু-একবার ছাড়া সংলাপ বা বর্ণনার দ্বারা ঘটনার গতি কখনওই প্রতিহত হয়নি (বসন্তসেনার গৃহবর্ণনায়; হয়তো এটি পরবর্তীকালের সংযোজন। এছাড়া দারিদ্র্য বা বর্ষার বর্ণনায় বহু শ্লোকের সমাবেশেও ঘটনার গতি ব্যাহত হয়, কিন্তু স্পষ্টতই এগুলি সব শূদ্রকের রচনা নয়, বহু কবির রচনা প্রক্ষিপ্ত হয়েড় নাট্যগতিকে মন্থর করে তুলেছে)। প্ৰথম অঙ্কের ঘটনা প্রথম দিন সন্ধ্যা থেকে রাত্রি, দ্বিতীয় অঙ্কে দ্বিতীয় দিন দিনের, তৃতীয়ে দ্বিতীয় রাত্রির, চতুর্থে তৃতীয় দিন দিনের, পঞ্চমে তৃতীয় দিন রাত্রির, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টমে চতুর্থ দিন দিনের ঘটনা ও দশমে পঞ্চম দিন দিনের। অর্থাৎ দশ অঙ্ক মিলে মাত্র চার দিনের ঘটনা, এতেই বোঝা যায় ঘটনার গতি কত দ্রুত ও অপ্ৰতিহত।
মৃচ্ছকটিক নাটকটি পাশ্চাত্য জগতে খুবই সমাদর লাভ করেছে। তার কিছু কিছু কারণ এতক্ষণ দেখা গেল–যেমন নামকরণ, অতিলৌকিকের অনুপস্থিতি, বৃহৎ সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিসর, সমাজের বিভিন্ন বৃত্তির মানুষের সমাহার, কয়েকটি ভাবকল্প ও রূপক অনুষঙ্গের উপস্থিতি, ঘটনার দ্রুত গতি ও চরিত্রচিত্রণে বৈশিষ্ট্য।
মৃচ্ছকটিক-এ মূল কাহিনি ছাড়াও কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বস্তু আছে, যেমন জুয়া খেলা, চুরি, বেয়াড়া হাতির কাহিনি, ইত্যাদি। এইগুলি নানা ভাবে মূল নাট্যবস্তুকেই পুষ্ট করে। কিন্তু মূল বা আধিকারিক (main plot) এবং প্রাসঙ্গিক বস্তু সব কটির মধ্যেই কতকগুলি রূপকের অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে, তার মধ্যে একটি হল তাড়া করা। প্রথম অঙ্কেই দেখি সংস্থানক বসন্তসেনাকে তাড়া করছে, তারপরে সংবাহককে তাড়া করছে জুয়াড়ি ও সাভিক, খুঁটভাঙা হাতি তাড়া করছে সন্ন্যাসীকে, সপ্তম অঙ্কে আর্যককে তাড়া করছে রাজপ্রহরীরা।
আর একটি হল আশ্রয় প্রার্থনা: প্ৰথম অঙ্কে বসন্তসেনা চারুদত্তের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে আশ্রয় পাচ্ছেন, দ্বিতীয়ে, সংবাহক আশ্রয় পায় বসন্তসেনার কাছে এবং সপ্তমে আর্যক আশ্রয় পেলেন চারুদত্তের কাছে। অন্য একটি রূপক-অনুষঙ্গ হল বিপর্যাস–প্রবহণ বিপর্যাস বা গাড়িবদলের ফলে বসন্তসেনা এসে পড়লেন শকারের মুঠোর মধ্যে এবং এরই পরিপূরক বিপৰ্যাসটির ফলে আৰ্যক রক্ষা পেলেন রাজরোষ থেকে, চারু দত্তের আশ্রয় ও প্রশ্ৰয় পেয়ে; এবং এ দুটিই নাটককে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে দেয়। তাড়া করার ব্যাপারে লক্ষ্য করি ভালকে মন্দ তাড়া করছে, আশ্রয়দানে ভালকে ভাল আশ্রয় দিচ্ছে আর বিপর্যাসের ক্ষেত্রে দৈব সক্রিয়। অর্থাৎ নাটকটি যে ভাবরূপের জগতে চলাফেরা করছে সেখানে মুখ্যত মানুষই ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করছে, দৈবের ভূমিকা যেটুকু সেখানেও মানুষের প্রতিরোধ উদ্যমে সংকট কেটে যাচ্ছে। সংস্কৃত নাট্যজগতে এ ঘটনা অত্যন্ত বিরল।
সংস্কৃতে অন্য যে বিখ্যাত প্রকরণটি আছে, ভবভূতির মালতীমাধব সেখানে দৈব নাটকের গতি ও পরিণতির পক্ষে অপরিহার্য (সৌদামিনীর যোগসিদ্ধির দ্বারা আকাশপথে ভ্ৰমণ)। তন্ত্রচারের জন্যে সেখানে কাপালিক অঘোরাঘন্ট ও তার শিষ্যা কপালকুণ্ডলার দ্বারা মালতীর অপহরণ, হতাশ মাধবের নিজের দেহমাংস দিয়ে দেবীকে প্রসন্ন করার উদ্যোগ–এ সব নাটকটিকে সম্পূর্ণ লৌকিক স্তর থেকে কতকটা সরিয়ে নিয়ে যায়, অথচ এগুলি মূল কাহিনির অপরিহার্য অংশ। অর্থাৎ এখানে নায়ক-নায়িকার মিলনের বাধাও যেমন কতকটা অতিলৌকিক জগৎ থেকে আসছে, তার নিরসনও তেমনই ঘটছে অলৌকিক শক্তির দ্বারা। এ ছাড়া দৈব ও অলৌকিকের প্রভাব দেখি অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ ঋষিশাপ, অগ্নিগৃহে দৈববাণী, আশ্রমবৃক্ষ থেকে বধূসজ্জা লাভ, মাতলির অলৌকিক শক্তিতে বিদূষকের অদৃশ্য হওয়া, পুষ্পক রথে দুষ্যন্তের স্বৰ্গে যাওয়া, সর্বদমনের অলৌকিক রক্ষাকরণক, ইত্যাদি। তেমনই বিক্রমোর্বশীয়-এ উর্বশীর তিরস্করিণী বিদ্যার শক্তিতে অদৃশ্য হওয়া, কুমারবনে প্রবেশমাত্র লতায় পরিণত হওয়া, সংগমনীয় মণি’-র সাহায্যে স্বরূপ ফিরে পাওয়া ইত্যাদি; এবং এ সবই নাটকের পরিণতির পক্ষে অপরিহার্য। অন্যান্য নানা নাটকে দৈবশক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বহু উদাহরণ আছে। সে দিক থেকে মৃচ্ছকটিক-এর সংঘাত সমস্যা ও তার নিরসন, সবই ঘটছে সম্পূর্ণ মানবিক জগতে। এ নাটকে অন্যায়ের, অমঙ্গলের দায়িত্বও যেমন মানুষের, তার প্রতিকারের দায়িত্বও তেমনই মানুষই নিয়েছে–কখনও একক ভাবে, কখনও বা যৌথ ভাবে। সামাজিক স্তরে একক ভাবে অন্যায় করেছে শকার, প্ৰতিকার করেছেন মুখ্যত চারুদত্ত, নেপথ্যে বসন্তসেনা, মৈত্ৰেয়, বিট ও অন্য কয়েকজন। রাষ্ট্রিক স্তরে দুষ্কৃতকারী রাজা পালক ও তার সহচরবৃন্দ, তার প্রতিকার করেছেন আর্যক, শর্বিলক, দর্দুরক, রেভিল, সংস্থানকের বিটরাষ্ট্রবিপ্লবের দ্বারা। নেপথ্যে সাহায্য করেছেন চারুদত্ত, মৈত্ৰেয়, চন্দনক, এঁরা। এ রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে কতকগুলি সামাজিক অন্যায়েরও প্রতিকার হল: যেমন, বসন্তসোনার বধুত্বলাভ, সামাজিক ও আর্থিক ভাবে চারুদত্তের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শবিলকের যশ ও অর্থলাভি, চন্দনকের পদোন্নতি, সংবাহকের শ্রমণ-প্রধানের পদপ্রাপ্তি ও শকারের প্রকাশ্য লাঞ্ছনা। অর্থাৎ সমাজের অন্যায়মোচনের দায়িত্ব এ নাটকে মানুষ একই নিয়েছে। বিচারক যেখানে যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে সুবিচার করতে অক্ষম, প্রজারা যেখানে অন্যায়কারী রাজার দুঃশাসনে পীড়িত, অপদার্থ অত্যাচারী শকারের অপ্ৰতিহত প্ৰতাপে যেখানে সৎ দরিদ্র বণিক, বৌদ্ধভিক্ষু ও সুন্দরী গণিকা থেকে অধিকরণিক পর্যন্ত সকলেই সন্ত্রস্ত, সেখানে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই, সমবেত উদ্যোগে রাষ্ট্রবিপ্লবের দ্বারা এ অন্যায় রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে রাজাকে হত্যা করে সৎ ও বীর এক রাষ্ট্রনায়ককে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে।
মৃচ্ছকটিক-এর কবিত্বেও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যদিও পরবর্তীকালের বহু প্ৰক্ষেপ নাটকের প্রচুর ক্ষতি করেছে। তবু কবিত্বের বিচারে মূল ও প্রক্ষেপকে পৃথক করে নেওয়া দুরূহ নয়। স্বভাবোক্তির সাহায্যে অনলংকৃত ব্যঞ্জনা-ঋদ্ধ কাব্য নির্মাণ করা শ্রেষ্ঠ কবিরই সাধ্য; মৃচ্ছকটিক-এ মধ্যে মধ্যে এ ধরনের কবিতার দেখা মেলে। পঞ্চম অঙ্কে যখন বসন্তসেনা বর্ষভিসারে এসেছেন। চারুদত্তের বাড়িতে তখন বিট সে-খবরটা বাড়ির মধ্যে পাঠাচ্ছেন:
‘চারুদত্তকে গিয়ে বলো, বনে বনে যখন কদম বকুল ফুটে উঠেছে তেমন এক দিনে ইনি প্রেমের আনন্দে প্ৰেমাস্পদের বাড়িতে এসেছেন। এর কেশভার সিক্ত, পথে আসতে বিদ্যুৎ-স্ফুরণে ও মেঘগর্জনে ইনি চমকে চমকে উঠেছেন, তবুচারুদত্ত, আপনাকে দেখবার আকাঙ্ক্ষায় ইনি এসেছেন; এখন দ্বারদেশে দুটি পায়ের নূপুরের কাদা ধুয়ে নিচ্ছেন।‘
একটু আগে আমরা লাল শাড়ি ও বর্ষার শাদাফুলের অলংকরপরা সুন্দরীতিমা বসন্তসেনাকে অভিসারিকাবেশে ঘনান্ধকার পথে দেখেছি। এখন দেখছি চারুদত্তের গৃহের দ্বারদেশে, প্রফুল্লমুখে নিচু হয়ে নুপুরের কাদা ধুয়ে নিচ্ছেন। পরনে রক্তবসন ও বর্ষার শ্বেতপুষ্পের আভরণ; সিক্ত তাঁর কেশ বেশ এবং এই নিচু হয়ে নুপুর ধোওয়ার ভঙ্গিটি–সব মিলে একটি ছবি হয়ে উঠেছে। অথচ নানা ব্যঞ্জনার অনুরণন এ শ্লোকে নিহিত। প্রথম অঙ্কের শেষ শ্লোকে কাদা ছিল তাঁর সামাজিক মালিন্যের প্রতীক, আজ মিলনের পূর্বমুহূর্তে এই ধুয়ে ফেলা যেন সে কথারই রেশ বহন করে। তাছাড়া মিলন-মুহুর্তে নূপুরের নিকশটুকুও না বাদ যায়। চতুর্থ অঙ্কের শেষ থেকে অকাল দুদিনের ব্যঞ্জনা ছিল তাদের প্রেমের পথে সামাজিক অন্তরায়। এখন প্রবল মেঘগর্জন, বিদ্যুৎ ও বর্ষণের মধ্যে অভিসারে আসবার বর্ণনায় শুধু যে চারুদত্তকে দেখবার জন্যে তাঁর গভীর আকুলতা প্রকাশ পাচ্ছে ও হৃষ্টা’ শব্দে প্রেমের আনন্দ ফুটে উঠেছে তা-ই নয়, প্রেমের অপরাজেয় শক্তিতে আর সব বাধাকে পরাস্ত করার ইঙ্গিতও সূচিত হচ্ছে।
এ নাটকের মূল অংশে অলংকার প্রয়োগের আতিশয্য নেই, তবু তার মধ্যে কবিত্বের কয়েকটি নিদর্শন বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথম অঙ্কে রাত্রের অন্ধকারে ত্ৰস্ত বসন্তসেনা ছুটে চলেছেন, গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে, তাঁর লাল আঁচলের ঝিলিক দেখে মন হচ্ছে যেন মনঃশিলার গুহায় টাঙির ঘায়ে মনঃশিলা চুৰ্ণ উড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন অন্ধকারে কেউ মুঠো মুঠো রক্তপদ্মের কুঁড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে।’ কিংবা সদ্বংশজাত বুদ্ধিমান দুর্জন যেন সার-দেওয়া খেতের কঁটিগাছ। অথবা, প্রখর গ্রীষ্মের পর গাঢ় অন্ধকার বর্ষাদিনে যখন সকল থেকে বাদল এসে বেলা ফুরিয়ে যায় তেমনই একটি দিনের বর্ণনা: ‘প্রচণ্ড গ্ৰীষ্মতাপে তপ্ত পৃথিবী যেন মেঘভবনে মেঘের ছত্রের নিচে এক ধারাগৃহে জলধারার নিচে বসে শীতল স্নিগ্ধ আরামে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়েছে।’ পরিচিত জগৎ থেকে উপমান সংগ্ৰহ মাঝে মাঝে বেশ সার্থক, যেমন শকারের মুখে, ‘গাছের ডালে বাঁদর ঝুলছে যেন ফলন্ত কঁঠাল।’ কিংবা, ‘প্রখর গ্ৰীষ্মের দুপুরে তপ্ত মাটি যেন শতপুত্রের মৃত্যুতে সন্তপ্ত গান্ধারী।’
অন্য এক ধরনের গভীরতর, সমৃদ্ধতর কবিত্ব মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ নাটকটির উপরে নূতন আলোকপাত করে, তার একটি হল মাটির গাড়িতে সোনা–আমরা আগেই দেখেছি। অন্য এক জায়গায়, সপ্তম অঙ্কে, দেখি আৰ্যক চারুদত্তের প্রবহণে নিরাপদে চলে যাওয়ার ঠিক আগে চারুদত্ত-আর্যকের মুখে খণ্ডিত শ্লোকের সেই সংলাপটি, যার পরস্পরের পরিপূরক বাক্যাংশে সমস্ত নাটকটি একটি উজ্জ্বল মহিমা লাভ করে। এই শ্লোকের দ্বিতীয়ার্ধ চারুদত্ত ও আর্যকের মুখে চারটি অর্ধচরণে পরিণত হয়েছে।
‘চারুদত্ত আৰ্যককে বলছেন: পথে চলিবার সময়ে দেবতারা তোমাকে রক্ষা করুন;
আর্যক: আপনিই তো আমাকে রক্ষা করলেন;
চারুদত্ত: নিজের ভাগ্যই তোমাকে বাঁচিয়েছে;
আৰ্যক: সেখানেও আপনিই তো হেতু।‘
লক্ষ্য করা যায়, দেবতার স্থানে মানুষ এখানে অভিষিক্ত; ভাগ্য বা দৈবকেও নাট্যকার মানুষের কাছে গৌণ করেছেন যেন মানুষই একান্ত হয়ে ওঠে। যেন মানুষই সংসারে মঙ্গলের বিধায়ক দেবতা নয়।
অষ্টম অঙ্কে শকার যখন বিটকে বলছে, ‘এই নির্জন বাগানে বসন্তসেনাকে মেরে ফেললে কে দেখতে পাবে?’ উত্তরে বিট বলছেন, ‘সূর্য-চন্দ্ৰ আকাশ-বাতাস দশ দিক আমার অন্তরাত্মা ও পাপপুণ্যের সাক্ষী এই পৃথিবী— এরা সবাই দেখবে।’ এর অন্তর্নিহিত অর্থটি হল, মানুষ সত্য আচরণের জন্যে সমস্ত চরাচরের কাছেই দায়বদ্ধ এবং শেষ জবাবদিহিট বাকি থাকে নিজের অন্তরাত্মার কাছে, সেখানে মিথ্যাচরণ হল আত্মপ্রবঞ্চনা।
সাহিত্যের চূড়ান্ত বিচার জীবনের পুনর্মূল্যায়নে; সেই মানদণ্ডে মৃচ্ছকটিক-এর স্থান অধিকাংশ সংস্কৃত নাটকের ঊর্ধ্বে, তার কারণ এখানে জীবনবোধের গভীর মূল্যায়নের চিহ্ন রয়েছে। চারুদত্তের জীবনে এক দিকে দাম্পত্য সম্পর্ক, দারিদ্র্য অন্য দিকে গণিকার প্রতি প্রেম; গণিকা বসন্তসেনার চারুদত্তের প্রতি প্রেম, অন্যদিকে গণিকাবৃত্তি ও শকারের প্রলোভন; মৈত্ৰেয়ের প্রচলিত বিদূষকের ভূমিকা ও আপনি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে চারুদত্তের প্রতি গভীর অকৃত্রিম বন্ধুগ্ৰীতি; নিরুপায় শবিলকের অভ্যস্ত নৈতিক মূল্যবোধে চৌর্যে অনিচ্ছা ও মন্দনিকার প্রতি গভীর প্রেমে চৌর্যে প্রবৃত্ত হওয়া; মন্দনিকার প্রেম ও বসন্তসেনার প্রতি আনুগত্যে ও আপনি সততায় অন্যায়ের মূল্যে নিষ্ক্রয় অর্জনে আপত্তি; শকারের বিটের প্রচলিত বিটসুলভ কর্তব্য ও মানবিক দায়িত্ব; চন্দনকের রাজকাৰ্যও বিবেকা; চারুদত্তের রাজদ্রোহিতার শঙ্কা ও নিরপরাধ শরণাগতকে আশ্রয়দান; বসন্তসেনার মায়ের কন্যার প্রতি স্নেহ ও নিরপরাধ চারুদত্তকে রক্ষা করার দায়িত্ব; এমনকী দুই চণ্ডালের মধ্যেও রাজনিয়োগ ও বিবেকবোধের সংঘাত— এই ভাবে বহু পরস্পরবিরোধী মূল্যবোধের সংঘাতের মধ্যে নাটকটির প্রাণবস্তু নিহিত আছে। সংস্কৃত নাটকে সাধারণত চরিত্রগুলি আগাগোড়া একটি নির্দিষ্ট ছকে গঠিত হয়, (যেমন নায়কের ছক হল ধীরোদাত্ত, ধীরোদ্ধত, ধীরললিত, ধীরপ্রশান্ত, ইত্যাদি)। তাই চরিত্রের মধ্যে বিবর্তন বা পরিবর্তনের বিশেষ অবকাশ থাকে না। কিন্তু শকারের বিট, সংবাহক, চন্দনক, বসন্তসেনা-মাতা এরা সকলেই নৈতিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়ে নিজেরা প্রচলিত মূল্যবোধকে যাচাই করে পরিবর্তিত রূপে তাকে অর্জন করতে পেরেছেন; এইখানে চরিত্রগুলি জীবন্ত ও বিশ্বসনীয় হয়ে উঠেছে।
এ নাটকে বহু বিচিত্র সুর লেগেছে। বিভিন্ন ধরনের মানুষ–রাজা থেকে চণ্ডাল, শিশু থেকে বৃদ্ধ, ধনী থেকে নির্ধন, সজ্জন থেকে দুর্জন–নানা ধরনের ভাষা, নানা ধরনের কবিত্ব, নানা ধরনের হাস্যরস–ভঁড়ামি, শ্লেষ সামাজিক ব্যঙ্গ ও ব্যক্তিগত বিদ্রূপ— বহু বিচিত্ৰ ঘটনার সমাবেশ বহু স্বার্থের সংঘাত নানা রসের আনাগোনা, সব মিলে নাটকটি যে শুধু সমাজের ও মানব-জীবনের একটি সুবৃহৎ বৃত্তাংশকে সার্থক ভাবে প্রতিফলিত করেছে তা নয়, জীবনের নানা আবেগসঞ্জাত উপলব্ধি ও নীতিগত মূল্যবোধের অবতারণা, বিশ্লেষণ ও পুনর্মূল্যায়নও করতে পেরেছে। এবং সমস্তটাই করেছে লোকায়ত স্তরে, অবিশ্বাস্য অতিলৌকিককে পরিহার করে, যা সংস্কৃত সাহিত্যে বিরল। এইখানেই মৃচ্ছকটিক অনন্য।
খুব ভালো লাগলো, তবে শব্দগুলি খুব শক্ত।
সুন্দর