কালিদাস-কাব্যে কয়েকটি আদিকল্প
কাব্য রচনাকালে কবির মানসপটে যে চিত্ৰকল্প (ইমেজ)-গুলি আনাগোনা করে–শুধু বাক্যগত নয়, সমগ্র আলেখ্যকে ব্যাপ্ত করেও–তাদেরই আদি-উৎসকে বলছি আদিকল্প (আর্কিটাইপি)। সাহিত্যের মাধ্যমে কবি তাঁর উপলব্ধি শ্রোতার মানসে সঞ্চার করতে চান। কিন্তু রচনার পূর্বে তাঁর উপলব্ধির জন্যে তাঁকে কয়েকটি বস্তুকে মনে-মনে আশ্রয় করতে হয়–কখনও সচেতন ভাবে, কখনও-বা অবচেতনার অনুপ্রেরণায়। এগুলিই সাহিত্যের উপাদান। উপাদানের মধ্যে যেমন ভাষা, ছন্দ আর অলংকারের বহু বিচিত্ৰ উপকরণ আছে, তেমনই আছে কথাবস্তু। বর্তমান প্ৰবন্ধের উদ্দেশ্য কালিদাস-সাহিত্যে কয়েকটি আদিকাল্পর সন্ধান।
প্রাচীন ইন্দো-ইয়োরোপীয় সাহিত্যে কয়েকটি আদিকল্প পরবর্তীকালের মানুষের মগ্নচৈতন্যে সংরক্ষিত ছিল; সেগুলি নবরূপ ধারণ করেছে কালিদাস-সাহিত্যে। যেমন, ভারতীয় সাহিত্যে বিক্রমোর্বশীয় কাহিনির সংলাপ-রূপ রয়েছে। ঋগ্বেদ-এর একটি সংবাদ-সূক্তে; (১০:৯৫) শতপথব্রাহ্মণ-এ (১১:৫:১)। এটি পূর্ণতর রূপ পেয়েছে। কিন্তু নিশ্চয়ই এটি অনেক প্রাচীন কাহিনি, তাই এটি অন্যান্য ইন্দো-ইয়োরোপীয় দেশের সাহিত্যশিল্পে নানা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। সোয়ান লোকু নামে রুশ ব্যালেতে তাই এর দেখা পাই। ম্যাথু আরনলডের দ্য ফব্রুসেকশন মারম্যান এবং অন্যত্র বহু সাহিত্যে তাই এ কাহিনি ফিরে-ফিরে এসেছে। ঋগ্বেদ-এ উর্বশীর হংসীরদপপরিগ্রহ আছে: তা আতয়ো ন তন্থঃ শুস্তুস্ত স্বাঃ–তাদের শরীর হংসীর মতো শোভা পাচ্ছিল। (১০:৯৫৯)। শতপথব্রাহ্মণ-এ দেখি: তদ্ধ তা অন্সরস আতয়ো ভূত্বা পরিপাণ্ডুবিরে–সেখানে সেই অন্সর্যারা হংসীরূপে জলে ভাসছিল। (১১:৫:১:৪) মূল ইন্দো-ইউরোপীয় কাহিনিতেও উর্বশীর হংসীরূপে হ্রদে বিহার করার কথা ছিল বলে মনে করার হেতু রয়েছে। নাটকে বাস্তবানুগ হতে গিয়ে কালিদাস এ অংশটি পরিহার করেছেন, কিন্তু এটি যে তার অবচেতনে আনাগোনা করছিল তার ইঙ্গিত রয়ে গেছে বিক্রমোর্বিশীয় নাটকের কয়েকটি চিত্রকল্পে। মনে রাখতে হবে, মূল কাহিনিতে নায়ক যখন বিরহার্ত, তখনই নায়িকা হংসীরূপে দেখা দিচ্ছে। বিক্রমোর্বশীয়-র প্রথম তিনটি অঙ্কে হংসের চিত্ৰকল্প সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, কিন্তু চতুর্থ অঙ্কে, অর্থাৎ বিরহের রূপায়ণের প্রবেশক থেকেই হংসীর চিত্ৰকল্প নানা ভাবে আসছে:
সহচরীদুঃখালীঢ়ং সরোবরে সিন্ধম।
বাষ্পাববল্পিতনয়নং তাম্যাতি হংসীযুগলকম।
সহচরীর দুঃখে কাতর অবস্থায় সরোবরে স্নিগ্ধ বাষ্পসজলনেত্ৰে হংসীযুগল ক্লিষ্ট হচ্ছে।
এর কিছু পরেই:
চিন্তাদুনমানসিক সহচরীদর্শনলালসিকা।
বিকসতি কমলমনোহরে বিহরতি হংসী সরোবরে।
চিন্তাক্লিষ্ট মানসে সহচরীকে দেখবার জন্যে উৎসুক হংসী পদ্মসরোবরে বিহার করছে।
নাটকের অন্তিম শ্লোকেও শুনি::
প্রাপ্তসহচরীসঙ্গমঃ পুলকপ্রসাধিতাঙ্গোঃ।
স্বেচ্ছাপ্রাপ্তবিমানো বিহরতি হংসযুবা।
সহচরীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পুলকিতদেহ হংসযুবা স্বেচ্ছায় আকাশে উড়ে যাচ্ছে।
কাজেই দেখছি, ইন্দো-ইয়োরোপীয় কাহিনির এই অংশটিকে কবি নাটকের কাহিনির মধ্যে স্থান না দিলেও চিত্রকল্পে সেটিকে উপস্থাপিত করেছেন। এটি যে প্রাচীন ইন্দো-ইয়োরোপীয় কাহিনি, তার প্রমাণ–অন্য ইরোরোপীয় সাহিত্যেও এর সাক্ষাৎ মেলে। আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন লোককথায় বারেবারেই হংসীরূপ নারীতে আরোপিত হয়েছে, এবং এর অনুষঙ্গ হল ইহলোক-পরলোকের মধ্যে আনাগোনা করার ক্ষমতা, যেমন হংস। জলস্থলে আর আকাশের মধ্যে স্বচ্ছন্দে বিহার করতে পারে।
‘The form of a Swan-perhaps because it is that of a creature of land, waterand land, a creature whose milleu has no boundaries-is appropriate for communication between two worlds (Alwyn Rees and Brinley Rces: Celtic Heritage. Thames and Hudson, London, 1961, P-236.) (হংসের এই কারণে যে, এই প্ৰাণী স্থলের, জলের ও স্থলের এবং যার বিচরণক্ষেত্রের কোনও সীমারেখা নেই; দুই পৃথিবীর মধ্যে যোগাযোগে যথোপযুক্ত।) ওয়েলশ কাহিনিতে দেখি, লীনই ফান নামে জলচারিণী দেবী প্রেমিকের উপহার প্রত্যাখ্যান করতে থাকে, শেষে একদল রাজহংসী তাদের হংসবেশ ত্যাগ করে হ্রদের জলে নামলে প্রেমিকটি তাদের মধ্যে সুন্দরীতিমার বেশ হরণ করে, আর তাকে মেয়েটির পিতার কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। আয়ারল্যান্ডে এওখেইড আর এতেইনের কাহিনি, এবং সুপ্ৰসিদ্ধ কুখুলেইন্ন আর তার রাজংসীরূপিণী প্রেমিকার কাহিনিতেও এই একই কল্পচিত্র। ইয়োরোপের অন্যান্য লোককথাতেও এ কাহিনির নানা প্রতিরূপ পাওয়া যায়; কাজেই মনে হয়, এটির একটি প্রাচীন ইন্দো-ইয়োরোপীয় আদিকল্প ছিল। কালিদাস এটি পেয়েছেন ঋগ্বেদ আর শতপথব্রাহ্মণ-এর কাহিনি থেকে।
এই কাহিনির একটি দিক হচ্ছে মানব আর অপ্সরার প্ৰেম। শতপথব্রাহ্মণ-এ এ প্রেমের একটি সম্ভাব্য সংকটের সমাধান দেওয়া হয়েছে: পুরুদারবা মর্ত্য মানব, উর্বশী নভশ্চারিণী অপ্সরা; একদিন পুরস্কারবার মৃত্যু ঘটবে, উর্বশী। কিন্তু চিরজীবিনী। শতপথব্রাহ্মণ-এ পুরূদরবা একটি যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে গন্ধৰ্ব হয়ে উর্বশীর সঙ্গে দীর্ঘকাল মিলিত হতে পারলেন। কালিদাসের নাটকের শেষ অঙ্কে দেবতার অনুগ্রহে ঊর্বশীকে তাঁর প্রিয়তমের বিচ্ছেদ সহ্য করতে হল না, তারা দুজনেই আমরণ মর্ত্যে মিলিত জীবনযাপন করবার অধিকার পেলেন। এই সমস্যা খুব স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হয়েছে প্রাচীন গ্রিক দেবকাহিনিতে। দেবী এয়স (উষস, বা লাতিন অরোরা) প্রেমে পড়লেন মর্ত্য তরুণ টিথনসের সঙ্গে। টিখনসের মিনতিতে দেবী এয়সতীকে বর দিলেন অমরতার। কিন্তু দুজনেই ভুলে গেলেন যে অমরতা বাৰ্ধক্য নিবারণ করবে না। টিথনস স্থবির, পঙ্গু, জরাগ্রস্ত হয়ে গুহায় শুয়ে থাকেন অমরতার অভিশাপ নিয়ে; আর প্রতি প্ৰত্যুষে চিরতরুণী এয়সতাঁকে দেখে যান। এই সমস্যার সমাধানে শতপথব্রাহ্মণ-এ একটি যজ্ঞ আছে, যার দ্বারা পুরুদারবা গন্ধৰ্বত্ব আর অমরত্ব লাভ করেন; পুরাণে শুনি এঁরা একষট্টি হাজার বছর মিলিত জীবনযাপন করেন!! কালিদাস এ সমস্যার অন্য সমাধান দিয়েছেন: পঞ্চম অঙ্কে নারদ স্বৰ্গ থেকে দেবতাদের নির্দেশ জানান, ইয়ঞ্চ ঊর্বশী যাবদায়ুঃ তব সহধর্মচারিণী ভবত্বিতি–এই উর্বশী পূর্ণ আয়ুষ্কাল ধরে তোমার সহধর্মচারিণী হোক।’
দ্বিতীয় যে আদিকল্পের কথা মনে আসে সেটির উৎস ইন্দো-ইয়োরোপীয় যুগের থেকেও প্রাচীনতরকাল থেকে সভ্যমানুষেরচিত্তের গহনে প্রোথিত। কালিদাসে এর প্রকাশরতিবিলাপে। সংস্কৃত সাহিত্যে অনুরূপ একটি বিলাপ পাই মৈত্ৰায়ণী-সংহিতা-য় যমীর বিলাপে। (১:৫:১২) যম-যমী ভাইবোন, আবার প্রণয়ী-প্ৰণয়িনী। যমের মৃত্যুতে যমীর শোক কোনও প্ৰবোধ মানে না; সাত্মনা দিতে গেলে যমী কেবলই বলেন, ‘এইমাত্র তো যম মারা গেল।’ যম তখনও মর্ত্য (যো মমার প্রথমে মর্ত্যানাম; অথৰ্ববেদ ১৮:৩:১৩)। কাজেই তাঁর মৃত্যু আছে, কিন্তু যমী তা মানতে পারছেন না। তাই দেবতারা পরামর্শ করে রাত্রির সৃষ্টি করলেন; পরদিন যমী কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন, ‘যম কাল মারা গেছে।’ এ কাহিনির লাতিন প্রতিরূপ পাই খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের কবি আপুলেইয়ুসের গ্রন্থ দ্য গোলডেন অ্যাস-এর সপ্তম থেকে নবম অধ্যায়ে। অনবদ্য কবিত্বের সঙ্গে সেখানে একটি কাহিনির উপস্থাপনা ঘটেছে যা প্রত্যক্ষ ভাবে মূল কাহিনির সঙ্গে অন্বিত নয়। সুন্দরীতিমা দেবী ভেনাসের পুত্ৰকিউপিড় (= মদন) প্রেমে পড়েছেন সাইকির সঙ্গে, যে সাইকি রূপে ভেনাসের প্রতিদ্বন্দিনী। মর্তে ভেনাসের পূজা অবহেলিত, কিউপিড় মাতৃ-আজ্ঞা লঙ্ঘন করেছেন এবং সাইকি কিউপিন্ডের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছেন। তাই ভেনাসের শাপে অবশ্যম্ভাবী বিচ্ছেদ দেখা দিল। সাইকি কেঁদো-কেঁদে বিরহযাপন করে। অনেক দুঃখের পথ পেরিয়ে তাদের পুনর্মিলন ঘটল।
বাইবেল-এর ‘সঙস অব সলোমন’-এও ভাইবোন প্রণয়-প্ৰণয়িনী। সেখানেও প্ৰণয়িণীর বিরহ রূপ পেয়েছে অমর শোকগাথাতে:
By night in my bed sought him whom my soul loveth. I sought him but
found him nought. will rise now and go about the city in the streets and in the broadways. I will seek him whom my soul loveth. I sought him but I found him not. (‘Song of Solomon’ Ch. 3, Verses 1-3) (নিশীথশয্যায় আমি তাকেই খুঁজি আমার হৃদয় যাকে ভালবাসে। তাকে খুঁজি কিন্তু পাই না। এখন আমি শয্যা ছেড়ে বেরোবো–শহরের পথে রাজপথে তাকে খুঁজতে আমার হৃদয় যাকে ভালবাসে, তাকে চাই, কিন্তু পাই না।) সম্ভবত এ কাহিনির প্রাচীনতর সংস্করণ সুমেরীয় দেব কল্পনায়।ইনান্না-দেবী (যাঁর আসিরীয় নাম ইশতার)-র প্রেমিক ছিলেন দুমুজি (আসিরীয় তন্মুজ)। দুমুজির মৃত্যুর পরে ইনান্না কেঁদে-কেঁদে তাঁর সন্ধান করে বেড়ালেন, দুমুজির সন্ধানে পরলোকে দেবমণ্ডলীতে উপস্থিত হয়ে তাঁর জীবন ভিক্ষা করলেন–দুমুজি পুনরুজ্জাজীবিত হলেন। (সম্ভবত এরই একটি প্রতিরূপ পাই মনসামঙ্গলের বেহুলা-উপাখ্যানো।)। কিন্তু এরও পশ্চাতের অতীতে হয়তো এ কাহিনির সূত্রপাত মিশরীয় দেবকথার অসিরিস-আইসিস-উপাখ্যানে। এরাও ভাইবোন এবং প্রেমিক-প্রেমিকা। লোভী ভাই সেথ-এর চক্রান্তে অসিরিসের মৃত্যু ঘটল। আইসিস কেঁদে ফেরেন দেশে-দেশান্তরে। পনেরো শ’খ্রিস্টপূর্বাব্দের আমেনমোসের গাথায় আছে–দুপুরের চিলনির মতো কেঁদে সে বেড়িয়েছে সারা মিশর, মৃত অসিরিসের পুনরুজ্জীবনের আশায়। লক্ষণীয়, মিশরে এ কাহিনির সঙ্গে অনুষ্ঠান ছিল, প্যালেস্টাইনেও ছিল, এবং উভয়ত্রই সে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য–শস্যক্ষেত্রে এবং প্রাণিজগতে উর্বরতা এবং বীর্যবত্তার বৃদ্ধিসাধন। কালিদাসও রতিবিলাপকে ব্যবহার করেছেন এবং রতিকে বিরাহিণী রেখেছেন। হরপার্বতীর মিলন পর্যন্ত। তারপরে দেবতাদের অনুনয়ে মহাদেব মদনকে সঞ্জীবিত করেন; তস্যানুমেনে ভগবান বিমনু্যব্যাপারমাত্মন্যপি সায়কানাম–বিগতক্ৰোধ ভগবান আপনার প্রতি তার শর সন্ধান ব্যাপার অনুমোদন করলেন। (কুমারসম্ভব, ৭:৯৩)
অতিপ্রাচীন আর-একটি আদিকল্প পাই রঘুবংশ-এ, যার পুর্বরূপ আছে রামায়ণ-এ রামচন্দ্ৰ যুদ্ধশেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করবার পরে দশরথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে, যেমন ঘটেছিল। রামায়ণ। গ্রিক ইলিয়াদ আর লাতিন ঈনীড-এও মৃত পিতার সঙ্গে উত্তরপুরুষের সাক্ষাৎকারের কাহিনি আছে।
অন্য-এক ধরনের আদিকল্প কালিদাস পান লোকসাহিত্য থেকে, এবং নানা বিচিত্র রূপে এগুলি তিনি ব্যবহার করেছেন। লোকসাহিত্যের দুটি বৈশিষ্ট্য: অতিশয়োক্তি এবং অতিলৌকিকতার আশ্রয়গ্রহণ। কালিদাস সত্যকার শিল্পী, তাই অতিশয়োক্তি তিনি পরিহার করেছেন, কিন্তু অতিলৌকিক উপাদান গ্ৰহণ করে কাব্যানুগরূপে ব্যবহার করতে তিনি বিমুখ নন। অতিলৌকিক উপাদান কালিদাস-সাহিত্যে বহুরূপে অনুপ্রবিষ্ট। প্রথমত, ধরা যাক অতিলৌকিক বস্তু: যেমন বিক্রমোির্বশীয় সংগমনীয় মণি, স্পর্শমণিরই অন্য-এক সংস্করণযার সাহায্যে পুরুদরবার আলিঙ্গনে লতারূপিণী উর্বশী নারীদেহ ফিরে পেলেন। কিংবা অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ রক্ষাকরণ্ডক–যা অবাঞ্ছিত ব্যক্তির স্পর্শে সাপ হয়ে যায়, তারই মাধ্যমে দুষ্যন্ত পুত্র সর্বদমনকে পেলেন। অথবা রঘুবংশ-এর সেই মালাটি, যার স্পর্শেইন্দুমতীর প্ৰাণনাশ ঘটল। রঘুবংশ-এ শুনি, প্ৰাখী কৌৎসের জন্যে রাজা অজ যেই কুবেরের সঙ্গে যুদ্ধে উদ্যত, ওমনি, হিরন্ময়ীং কোষগৃহস্য মধ্যে বৃষ্টিঃ শশংসুঃ পতিতাং নভস্তঃ:–রাজকোষের মধ্যে আকাশ থেকে স্বর্ণময় বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেল।’(৫:২৯) অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ চতুর্থ অঙ্কে পতিগৃহে যাত্রার পূর্বে শকুন্তলার বাসনালংকারপ্রাপ্তিও তেমনই একটি অতিপ্রাকৃত উপাদান। রূপান্তরে অতিলৌকিকের দ্বিতীয় একটি পরিচয় আছে। যেমন, রঘুবংশ-এ মতঙ্গে শাপে প্রিয়ংবোদর গজরদপপ্ৰাপ্তি; (৫:৫৩) স্বরূপ ফিরে পাওয়ার পর ইনি অজকে একটি সম্মোহন-অস্ত্র দেন যার সাহায্যে ইন্দুমতীর স্বয়ংবারের পরে অজ সমবেত যুদ্ধোদ্যত রাজমণ্ডলীকে পরাস্ত করেন। বিক্রমোর্বিশীয়-তে উর্বশীর কুমারবনে লতায় পরিণত হওয়াও একটি লোকসাহিত্যের উপাদান। রঘুবংশ-এ রাজা দিলীপ দেবধেনু নন্দিনীর সেবা এবং প্রাণের বিনিময়েও নন্দিনীকে রক্ষা করার চেষ্টা যখন তাকে তুষ্ট করেন, তখন পুত্রহীনতার শাপ থেকে তাঁর মুক্তি ঘটে–সেও একটি অলৌকিক ঘটনার সাহায্যে। নন্দিনী বলেন, ‘দুগ্ধ। পয়ঃ পত্রপুট মদীয়ং পুত্ৰোপড়ুঙ্ক্ষেতি তমাদিদেশ–পুত্র, আমার দুগ্ধ পত্রপুটে দোহন করে পান করে!’ (২:৬৫) আমরা জানি, বহু রূপকথায় এই রকমই মন্ত্রপূত ফল বা শেকড় যথাবিধি সেবন করে অপুত্ৰক পুত্ৰ লাভ করে। দশরথের মহিষীদের চারুভক্ষণের কাহিনি তো রামায়ণ-এ ছিলই।
রঘুবংশ-এর সূচনাতেই লোকসাহিত্যের একটি পরিচিত কথা পাই–রাজা দিলীপের সবই আছে: একতিপত্ৰং জগতঃ প্ৰভুত্বং নবং বয়ঃ কান্তমিদং বপুশচ— পৃথিবীর একচ্ছত্র আধিপত্য, তরুণ বয়স, সুন্দর দেহ। নেই কেবল পুত্রসন্তান, রাজসিংহাসনে বা রাজবংশে উত্তরাধিকারী। ঠিক যেমন শুনি রূপকথায়; রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়ােশালে ঘোড়া, সুন্দরী রানি–কিন্তু রাজার ছেলে হয় না। এবং রঘুবংশ-তে এর সমাধানও এল রূপকথারই রূপ ধরে; সেবায় প্রীত নন্দিনীর দুগ্ধপান। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ রাজার সবই আছে, নেই কেবল পুত্রসন্তান। বিক্রমোর্বিশীয়-তে কাহিনির অস্ত্যপর্বে অপুত্ৰক রাজা পুত্রবান হন। এখানেও ঠিক এমনই আর-একটি রূপকথার সূত্র পাই: জটিল সমস্যার চূড়ান্ত মুহুর্তে সমাধান আসে অলৌকিকের পথ ধরে। যেমন, আজ যখন কুবেরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত তখন স্বর্ণবৃষ্টি হয়ে সমাধান হল, অথবা শাপের অবসানে যখন উর্বশীর স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের দুর্লগ্ন উপস্থিত তখন নারদের মুখে ইন্দ্রের নির্দেশে আসন্ন বিপদ নিকারিত হল। ৰূপকথাতেও ঠিক এমনই ঘটে: ডাকাতরা যখন বন্দিকে দেবীর সামনে বলি দিতে খাড়া তোলে, তখনই দৈবনিয়ন্ত্রণে ঘটনার গতি আমূল পরিবর্তিত হয়।
দৈববাণী লোকসাহিত্যের আর-একটি উপাদান। অত্যন্ত সংকটময় কয়েকটি মুহুর্তে কালিদাস দৈববাণীর আশ্রয় নেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ কথা অগ্নিগৃহে দৈববাণী শোনেন যে শকুন্তলা দুষ্যন্তের পরিণীতা বধূ, এবং তারই সন্তানের জননী হতে চলেছেন। মানুষের মুখে এ কথা শুনলে সম্পূর্ণ সংশয়চ্ছেদ হত না এবং ঋষি শকুন্তলাকে ওই ভাবে অভিনন্দিত করতেন না। নাটকের পক্ষে অত্যাবশ্যক এই দৈববাণী। কুমারসম্ভব-এর পার্বতী যে হরবধু হবেন সে সম্বন্ধে নারদের ভবিষ্যদ্বাণী শুনি; (১:৫০) কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণদৈববাণী শুনি চতুর্থ সর্গে যখন রতি সহমৃতা হওয়ার জন্য চিন্তারোহণে উদ্যত। দৈববাণীই তখন জানিয়ে দেয় যে মদন পুনরুদ্ধজীবিত হবেন–হরপার্বতীর মিলনের পরে। (৪:৪৮)
পৃথিবীর সব লোকসাহিত্যেই এক কল্পলোকের চিত্ৰ আছে যেখানে নিত্যসুখজরা-মৃত্যু-বেদনা, মর্তজীবনের অপূর্ণতা যেখানে অনুপস্থিত। ভারতীয় সাহিত্যের আদিপর্বে শুনি:
যত্ৰ কামা নিকামাশ্চ যত্ৰ ব্ৰঞ্জস্য বিষ্ট্ৰপম।
স্বধা যত্ৰ তৃপ্তিশ্চ তত্র মামৃতং কৃধি।
যত্ৰানন্দাশ্চ মোদাশ্চ মুদঃ প্ৰমুদ আসতে।
কামস্য যাত্রাপ্তাঃ কামাস্তাত্র মামমৃতং কৃদ্ধি।
যেখানে কামনার তৃপ্তি, যেখানে স্বধা ও তৃপ্তি সেখানে আমাকে অমর করো। যেখানে আনন্দ, আমোদ, হর্ষ ও প্রকৃষ্ট হর্ষ আছে, কামনার যেখানে চরিতার্থতা, সেখানে আমাকে অমর করে। (ঋগ্বেদ ৯:১১৪:১০-১১)
মহাভারত-এ উত্তরকুরুর বর্ণনা, সত্যযুগের বর্ণনা–আকৃষ্টপচ্যা পৃথিবী পুটকে পুটকে মধু হলকর্ষণে পৃথিবীতে শস্য উৎপাদন করতে হয় না, প্রতি পত্রপুটে যেখানে মধু পাওয়া যায়। এরও পশ্চাতে আমরা অন্যান্য প্রাচীনতর সাহিত্যে এমনই স্বপ্নস্বগের চিত্ৰ পাই। এ স্বৰ্গ দূরে— হয় স্থানে, নয় কালে, কিংবা উভয়তই। বোধহয় পৃথিবীর প্রাচীনতম স্বপ্নস্বর্গের বর্ণনা পাই মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ভাগের নিপুরের এক শিলালেখে দিলমুনের বর্ণনায়:
Where the croak of the raven was not heard, the bird of death did not utter the cry of death, the wolf did not rend the lamb, the dovc did not mourn. there was no widow, no sickness, no old age, no lamenation. (সেখানে কাকের কর্কশধ্বনি ছিল না; মৃত্যুপক্ষী যেখানে ডাকত না মরণের ডাক; ভেড়াকে ছিঁড়ে খেত না। নেকড়ে বাঘ, পারাবত গাইত না দুঃখগীতি; যেখানে বিধবা ছিল না; অসুখ ও বার্ধক্য ছিল না, ছিল না কোনও দুঃখ।)
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে পৃথিবীর প্রথম মহাকাব্য গিলগামেশ-এর কাহিনিতেও অনুরূপ একটি কল্পচিত্ৰ পাই। গিলগামেশা যাচ্ছে উতনপিশতিমের কাছে:
There was the garden of the Gods, all round him stood bushes bearing gems… there was fruit of carnelian with vine hanging from it beautiful to look at: lapis lazuil leaves hung thick with fruit, sweet to see. For thorns there were haematite and rare stone, agates and pears out of the sea. (The Epic of Gilagamesh, Penguin, Ch. Hv) (সেখানে ছিল ঈশ্বরের বাগান, তার চাদ্দিকে ঘিরে ছিল রত্নের ঝাড়… সুন্দর দেখতে লতা থেকে ঝুলে থাকা ফল; লাপিস লাজুহল পাতার ফাঁকে ঝুলে থাকা ফল। কাঁটার বদলে ছিল গৈরিক লৌহ আকর এবং দুস্তপ্রাপ্য পাথর–সমুদ্র থেকে উঠে আসা চুনি পান্না।)
বাইবেল-এ এ স্বৰ্গ আছে সৃষ্টির আদিতে আর প্রলয়ের অন্তে। সৃষ্টির আদিতে গার্ডন অব ঈড়ন-এ অভাব, জরা, মৃত্যু, অতৃপ্তি নেই। আবার বুক অব রেহুেলেশন-এ পড়ি:
And I saw a new heaven and a new earth… and God shall wipe away all tears from their eyes, and there shall be no more death, neither sorrow nor crying, neither shall there be any more pain, for the former things are passed away. (Ch, XXI: 1, 4) (আমি এক নতুন স্বৰ্গ ও নতুন পৃথিবী দেখলাম… এবং ঈশ্বর তাদের চোখ থেকে সব অশ্রু মুছে দেবেন; এবং সেখানে কোনও মৃত্যু থাকবে না, দুঃখ ও কান্না থাকবে না? আর এগুলো যেহেতু থাকবে না। তাই কোনও যন্ত্রণাও থাকবে না।)
কালিদাসের সাহিত্যে এই কল্পচিত্রটি নানা রূপে ফিরে-ফিরে দেখা দিয়েছে। কুমারসম্ভব এর প্রথম সর্গের হিমালয়বৰ্ণনায় একটি দুঃখবিনিমুক্ত দেবস্থান আনন্দভূমিরূপে বৰ্ণিত। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ মারীচের আশ্রমও প্রায় তাই: সৎকল্পবৃক্ষ বন, কাঞ্চনপদ্মরেণুকাপিশ জল, রত্নশিলাগৃহ, ইত্যাদির বর্ণনা শেষ করছেন কবি–যৎকাঙ্ক্ষতি তপোভিঃ:–মানুষ তপস্যার ফলরূপে যা চায়।’ (৭:১২) কুমারসম্ভব-এ ওষধিপ্রস্থের সুদীর্ঘ বর্ণনাও এই পর্যায়ের। সমস্ত আকাঙ্গিক্ষত ভোগ্যবস্তুর সমাহারে মানুষের ভোগবাসনা এখানে কল্পনায় চরিতার্থ হয়: ‘যৌবনান্তং বয়ো যস্মিন্নান্তকঃ কুসুমায়ুধাৎ— বয়স যেখানে যৌবন ছাড়ায় না, যেখানে মদন (প্রেমে) ছাড়া অন্য মৃত্যু নেই।।’ (৬:৪৪) এত সুখ যে ‘স্বৰ্গভিসন্ধিসুকৃতং বঞ্চনামিব মেনিরে:–স্বৰ্গসুখের পুণ্যকে তাঁরা বঞ্চনার মতো মনে করেন।’ (৬:৪৭)
কিন্তু কালিদাস-কাব্যে সার্থকতম স্বপ্নস্বৰ্গবোধহয় মেঘদূত-এর উত্তরমেঘের অলকাবর্ণনায়। এখানেও পৃথিবীর বঞ্চিত ব্যর্থকাম মানুষের, ব্যাধিবেদনা-জরা–মৃত্যু-জৰ্জরিত মানুষের স্বপ্নের অভিপ্রসারণ একটি পরমাভোগ্য নিত্যসুখের কল্পলোকে। ঐশ্বৰ্য সৌন্দৰ্য সম্ভোগ বৈচিত্র এবং অনায়াসলব্ধ অবিচ্ছিন্ন সুখের একটি স্বল্পধাম কবি উত্তরমেঘের প্রথম এগারোটি শ্লোকে নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে একটিতে প্রেমের চিত্রায়ণে সিদ্ধহস্ত কবি মানুষের প্রেমিক সত্তার জন্যে চিরন্তন কাম্যস্বৰ্গ সৃষ্টি করেছেন:
আনন্দোখং নয়নসলিলং যত্ৰ নান্যৈানমিত্তৈীর্ন্যান্যস্তাপঃ
কুসুমশরজার্দিষ্টসংযোগসাধ্যাৎ।
নাপ্যন্যস্মাৎ প্রণয়কলহাদ্বিপ্রয়োগোপপত্তির্বিত্তেশানাং ন
চ খলু বয়ো যৌবনাদন্যদস্তি।
যেখানে অশ্রু শুধু আনন্দেরই, অন্য কোনও কারণের নয়, প্রেমের তাপ ছাড়া অন্য তাপ যেখানে নেই এবং সে তাপও প্রিয়মিলনে নির্বাপিত হয়; প্রণয়-কলহ ছাড়া যেখানে বিরহ নেই, এবং যক্ষদের যেখানে যৌবন ছাড়া অন্য বয়সই নেই।
এর মধ্যে কুমারসম্ভাব-এর ওষধিপ্রস্থের বর্ণনার ‘যৌবনান্ডং বয়ো যস্মিন্নাস্তকঃ কুসুমায়ুধাৎ’-এর প্রতিধ্বনি আছে। লক্ষণীয়, উত্তরমেঘের এই শ্লোকের সমস্ত বোকাটা পড়ে বিপ্ৰয়োগোপপত্তি’ শব্দটির ওপরে। বিরহভীরু প্রেমিকের স্বগের কল্পনা তো এমনই এক নিত্যমিলনের ধামের মধ্যেই চরিতার্থ। তাই রঘুবংশ-এ রামচন্দ্র পরিত্যাগ করলে পর সীতা পরজন্মের জন্যে একটিমাত্ৰ কামনা উচ্চারণ করেন, ‘ভুয়ো যথা মে জননাস্তরেহপি ত্বমেব ভর্তা ন চ বিপ্রয়োগঃ–পরজন্মে আবার যেন তোমাকেই স্বামী পাই, আর যেন বিচ্ছেদ না। হয়।’ (১৪:৬৬) তাই যক্ষ মেঘকে আশীৰ্বাদ জানায়, মা ভূদেবং ক্ষণমপি চ তে বিদ্যুতা বিপ্ৰয়োগঃ–(তোমার বধূ) বিদ্যুতের সঙ্গে যেন তোমার এক মুহুর্তের বিচ্ছেদও না হয়।’
কালিদাস-সাহিত্যে প্রেমের যে চিত্র তার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অনেকেই বলেছেন যে, কবি দেহনিষ্ঠ প্রেমকে তপস্যার দ্বারা শোধন করে স্থায়ী মিলনে উত্তীর্ণ করেছেন। কিন্তু মনে হয়, কবির চিত্তের গহনে যে চিত্ৰকল্পটি সক্রিয় ছিল তা তপস্যা নয়, যজ্ঞ। উদাহরণে বলা যায়, কুমারসম্ভব-এ মদনের মৃত্যুর হেতুরূপে উল্লেখ করা হয়েছে,
অভিলাষমুদীরিতেন্দ্ৰিয়ঃ স্বসূতামাকারোৎ প্রজাপতিঃ।
অথ তেন নিগৃহ্য বিক্রিয়ামভিশপ্তঃ ফলমেতদন্থভুৎ ৷
প্ৰজাপতিকে নিজের দুহিতার প্রতি অভিলাষী করে (মদন)…সেই কারণে অভিশাপে তাকে এর ফল ভোগ করতে হয়। (৪:৪১)
মেঘদূত-এ স্বাধিকারপ্ৰমত্ত যক্ষ তার বিচূতির পূর্ণ মূল্য শোধ করেছে তীব্র বিরহের মমর্যন্ত্রণায়। মালবিকাগ্নিমিত্ৰ-তে বিরহ নেই বললেই হয়; মালবিকা আর অগ্নিমিত্রের পরস্পরের আদর্শনে যে ব্যাকুলতা তা অনেকটা লঘু স্তরেই চিত্রিত হয়েছে। অগ্নিমিত্ৰ মধ্য যৌবনে উত্তীর্ণ তাঁর পিতা আর পুত্ৰ যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত, তিনি অন্তঃপুরে একটি সুন্দরী তরুণীকে দেখেই চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। এ মনোভাবকে প্রেম বললেও এ প্ৰেম অগভীর, এবং নাটকের শেষ পর্যন্ত তা কোনও গভীরতায় পৌঁছিয়নি। এ প্রেমের বাধাও যেমন অকিঞ্চিৎকর, তার নির্যাকরণও তেমনই লঘু স্তরের। বিক্রমোর্বিশীয়-এ কিন্তু চিত্রটি অন্য রকম–এখানে নায়ক-নায়িকার বিরহ দুবার; প্রথম বার দ্বিতীয় অঙ্কে ইষ্টজনকে লাভ করবার ব্যাকুলতা, প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় চঞ্চল। দ্বিতীয় বার চতুর্থ অঙ্কে, যেখানে পুরুদারবার বিরহ মৰ্মস্পশী। পুরূদরবা প্রমোদবনে এসেছেন, রাজকাৰ্যসচিবদের হাতে অৰ্পণ করে; উর্বশী এসেছেন একমাত্র পুত্রকে পিতামাতার কাছ থেকে নির্বাসন দিয়ে, দুজনেই এসেছেন নিরঙ্কুশ সম্ভোগের আশায়। এই উদ্বেল কামনার ধ্বংসবীজ। তার নিজের মধ্যেই নিহিত ছিল, তাই অহেতুক ঈর্ষায় উদভ্ৰান্ত হয়ে ঊর্বশী অসতর্কে কুমারবনে প্রবেশ করে লতায় পরিণত হলেন এবং পুরূরবা কেঁদে-কেঁদে উন্মত্তপ্রায় হয়ে তাঁকে খুঁজে ফিরলেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এও বিরহ দুটি পর্যায়ে–প্রথম বার দ্বিতীয় আর তৃতীয় অঙ্কে আদর্শনের ক্ষোভে আর হতাশায়, এবং দ্বিতীয় বার ষষ্ঠ অঙ্কে দুষ্যন্তের নিরন্ত মমর্যন্ত্রণায়। নেপথ্যে শকুন্তলারও, যার পরিচয় সপ্তমে পাই, ‘বসনে পরিধূসারে বসানা নিয়মক্ষমমুখী ধূতৈকবোণিঃ –ধূলিধূসর দুখানি বস্ত্র পরণে, ব্ৰতশীৰ্ণ মুখ, (বিরহদিনের) একটি বেণী ধারণ করে আছেন।’
প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই অভিশাপ প্রকট বা প্রচ্ছন্ন এবং তা এসেছে কর্তব্যে বিচূতির অপরাধেই। নায়ক বা নায়িকার মর্মদ্ভদ যন্ত্রণার মধ্যে প্রতিকার বা পুনর্মিলন ঘটেছে।
এই যন্ত্রণাভোগ প্ৰায়শ্চিত্ত যাগ আর কাম্যেষ্টির মিলিত প্ৰতীক। মনে রাখতে হবে, কালিদাসের কাল ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের পুনরভু্যখানের যুগ, যজ্ঞ তখন মহাসমারোহে বারংবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গুপ্তরাজারা নতুন করে যজ্ঞ করছেন, এমন কথা শিলালেখেও পাওয়া যায়। দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্ত বিক্রমাদিত্য, যাঁর রাজত্বকালেই সম্ভরত কালিদাসের আবির্ভাব, তিনি মথুরা শিলালেখে বলছেন, ‘চিরোৎসন্নাশ্বমেধাহর্তৃর্মহারাজশ্ৰীগুপ্তপৌত্রস্য… দীর্ঘকাল যা অনুষ্ঠিত হয়নি সেই অশ্বমেধের সম্পাদক মহারাজ শ্ৰীগুপ্তের পৌত্র’… ইত্যাদি।
গুপ্তযুগ যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রাদুর্ভাবকাল; সমগ্ৰ কালিদাস-সাহিত্যে যজ্ঞের কথা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে বার বার উল্লিখিত হয়েছে। রঘুবংশ-এর শুরুতেই রঘুবংশীয় আদর্শ বর্ণনা হচ্ছে, যথাবিধিহুতাশ্মীনাম–র্যারা যথানিয়মে যজ্ঞগ্নিতে আহুতি দিয়ে থাকেন। (১:৬) রাজা রঘুর বিষয়ে, ‘দুদোেহ গাং স যজ্ঞায়, শস্যায়, মঘবা দিবম— যিনি পৃথিবীকে দোহন করেন যজ্ঞের জন্য,ইন্দ্ৰ আকাশকে দোহন করেন শস্যের জন্য।’ (১:২৬) দিলীপের পত্নী সুদর্শনার বর্ণনা, ‘অধিবরস্যেব দক্ষিণা–তিনি যেন যজ্ঞের দক্ষিণা।’ (১:৩৯) বশিষ্ঠকে দিলীপ বলছেন:
হবিরাবর্জিতং হোতত্ত্বয়া বিধিবদগ্নিষু।
বৃষ্টিৰ্ভবতি শস্যানামবিগ্রহবিশোষিণম।
হে হোতা, তুমি যথানিয়মে হাব্য এনেছ অগ্নির উদ্দেশ্যে, (তাই)। অনাবৃষ্টিতে শুষ্ক শস্য বৃষ্টি পায়। (১:৬২)
রঘুবংশীয়দের পরিচয়, এঁরা ‘ইজ্যাবিশুদ্ধাত্মা–যজ্ঞের দ্বারা শুদ্ধ হয়েছেন।’ (২:৭৫) দিলীপের পুত্র রঘু বিশ্বজিৎযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। দশরথের বর্ণনায় শুনি, ‘ঋষিদেবগণাস্বধাভুজাং শ্রুতযাগপ্রসবৈঃ স পার্থিবঃ–স্বধাভোজী ঋষি ও দেবগণের জন্যে বহু বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন এই রাজা।’ (৮:৩০) ইন্দুমতীর স্বয়ংবরে অনুপরাজের বর্ণনা, অষ্টাদশদ্বীপনিখাতযুপাঃ–আঠারোটি দ্বীপে তাঁর (যজ্ঞে পশুবলির) যুপ প্রোথিত।’ রাজা কুশের পুত্র অতিথির বর্ণনা: তিনি অনুষ্ঠান করেন, ‘প্রচুরদক্ষিণাযুক্ত বহু যজ্ঞেরযজ্ঞঃ পৰ্যাপ্তদক্ষিণাঃ।।’ (৭:১৭)। মালবিকাগ্নিমিত্র-এর বিষ্কম্ভকে নাটকের বর্ণনা: ‘দেবনামিদমামনন্তি মুনয়ঃ শান্ত ক্ৰতুং চক্ষুষম— মুনিরা বলেন, নাটক দেবতাদের শান্ত চক্ষুগ্রাহ্য যজ্ঞ।’ (১:৪)। এই নাটকের অন্তে এক অশ্বমেধযজ্ঞের উল্লেখ আছে (চতুর্থ অঙ্কে)। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এর সূচনাতেই, যা স্ৰষ্টুঃ সৃষ্টিরাদ্যা বহতি বিধিহুতাং যাহবিৰ্ষা চ হোত্রীযিনি স্রষ্টার প্রথম সৃষ্টি, যিনি যথানিয়মে (অগ্নিতে) প্রদত্ত হব্য বহন করেন, যিনি হবিঃ, যিনি হোতা।’ (১:১)। দুষ্যন্তের বর্ণনা করছে সারথি, মৃগানুসারিণং সাক্ষাৎ পশ্যামীব পিনাকিনমযেন মৃগরূপধারী যজ্ঞের অনুসরণকারী শিবকেই সাক্ষাৎ দেখছি।’ দ্বিতীয় অঙ্কে ঋষিদের ইষ্টিবিয়ের কথা আছে। যজ্ঞ সমাধা হলে পর দুষ্যন্ত চলে গেছেন–অদ্য স রাজর্ষিরিষ্টিং পরিসমাপ্য ঋষিভিবিসজিতঃ–আজি যজ্ঞ শেষ হওয়ার পরে ঋষিরা সেই রাজাকে বিদায় দিয়েছেন।’ চতুর্থ অঙ্কে কথা শকুন্তলাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, ‘দিষ্ট্যা ধূমাকুলিতদৃষ্টেরপি যজমানস্য পাবক এবাহুতিঃ পতিতাঃ–সৌভাগ্যক্রমে ধুমে আকুলিতদৃষ্টি যজমানের আহুতি ঠিক অগ্নিতেই পড়েছে।’ ষষ্ঠ অঙ্কে সানুমতী বলছেন, ‘শ্রুতং ময়া শকুন্তলাং সমাশ্বাসয়ন্ত্যা মহেন্দ্ৰজনন্যা মুখাদ্য যজ্ঞভাগোৎসুকী/দেবাস্তথা করিষ্যস্তি যথাচিরেণ ধর্মপত্নীং ভর্তা অভিনন্দ্দিষ্যতি।-ইন্দ্রের জননী যখন শকুন্তলাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তখন তার মুখে শুনেছি যে যজ্ঞভাগের জন্যে উৎসুক দেবতারা এমন (ব্যবস্থা) করবেন যাতে অচিরেই ধর্মপত্নীকে তাঁর স্বামী অভিনন্দিত করবেন।‘ নাটকের শেষে তাই মারীচ দুষ্যন্তকে আশীর্বাদ করছেন, ত্বমপি বিততযজ্ঞং বজ্ৰিণং গ্ৰীতিয়ালম–তুমিও যজ্ঞবিস্তার করে বজ্রধারী ইন্দ্ৰকে প্রীত করো।’ স্পষ্ট উল্লেখ ছাড়া উপমানেও ফিরে-ফিরে এসেছে যজ্ঞ। শকুন্তলা, সর্বদমন আর দুষ্যন্ত যেন শ্রদ্ধা বিত্তং বিধিশ্চেতি–শ্রদ্ধা, ধন ও (যজ্ঞের) বিধান।।’ এ রকম অনেক উদাহরণ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কালিদাসের চিত্তে তৎকালীন সমাজে যজ্ঞের পুনরানুষ্ঠান, বহুদিনের আচলিত যজ্ঞের পুনঃপ্রবর্তন বিশেষ একটি তাৎপর্য বহন করত।
যজ্ঞ দ্বারা মানুষ তার অভীষ্ট লাভ করে এবং কৃত দুষ্কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে। তপস্যার মতো যজ্ঞেও যজমান কৃচ্ছসাধন করেন, শুদ্ধাচারী থেকে উপবাস আর নিয়ম পালন করেন এবং ভোগ্যবস্তুর ভোগ থেকে বিরত থাকেন। এখানে যজ্ঞের সঙ্গে তপস্যার মিল; কিন্তু যজ্ঞে অগ্নিক্রিয়া প্ৰত্যক্ষ, অভিধাগত— তপস্যায় ব্যঞ্জনগত। বিরহের যন্ত্রণা এই দাহের, অগ্নিক্রিয়ার রূপকল্প। কাতায়ন শ্রেণীতসূত্ৰ-র ভায্যে আছে: উদ্দিশ্য দেবতাং দ্রব্যত্যাগো যাগঃ’–দেবতার উদ্দেশে দ্রবত্যাগই যজ্ঞ।’ তপস্যায় ত্যক্ত দ্রব্যের পুনর্ভোগ নেই, যজ্ঞে আছে। যজ্ঞের আগে আর পরে যজমানের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, তপস্যায়। সাধারণত তা নয়। ব্ৰত কাম্যেষ্টির মতোই, কিন্তু এতে অগ্নিক্রিয়া নেই এবং এর দ্বারা ভোগ্যবস্তুর শুদ্ধিসম্পাদন হয় না। এইখানেই কালিদাস-সাহিত্যে যজ্ঞের রূপকল্পের সার্থকতা। যজমান হব্যের একাংশ দেবতাকে দেন, যজ্ঞের আগুনে সে-অংশ ভস্মসাৎ হয়, এবং কেবলমাত্র তখনই হব্যের বাকি অংশ হুিতশেষ বা প্ৰশিত্র হয়, তা যজমান গ্ৰহণ করেন।
কালিদাস-সাহিত্যে প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় বিহুল নায়ক-নায়িকার কর্তব্যে ত্রুটি ঘটে। প্রেম এমনই একান্ত হয়ে ওঠে যে তা সম্ভোগসর্বস্ব রূপে প্রতীয়মান হয়। কিছুকালর জন্যে নায়ক বা নায়িকা বঞ্চিত হয় প্রিয়মিলন থেকে। এই বিরহের যন্ত্রণা তার প্রায়শ্চিত্তআত্মবিস্মৃতির, কর্তব্যে বিচূতির। এই বঞ্চিত হওয়ার দ্বারা তার বাকি জীবনে সেই প্রেম হতশেষরূপে দেখা দেয়। বিক্রমোর্বশীয় চতুর্থ অঙ্কে বিরহ এবং মিলনের পরেই উর্বশী পুরদরবাকে বলছেন:
মহান খলু কালস্তব প্রতিষ্ঠানান্নির্গতস্য।
কদাচিন্দসুয়িষ্যন্তি মহং প্রকৃতয়ঃ তাদেহি নির্বতোবহে।
বহুদিন হল তুমি প্রতিষ্ঠান-নগর থেকে বেরিয়ে এসেছ, হয়তো প্রজারা আমার প্রতি ক্রুদ্ধ হবে, তাই চলো ফিরি।
এ নাটকের শেষ অঙ্কে তাদের পুনর্মিলিত জীবনের বর্ণনা:
প্রবিশ্য নগরমিদানীং সসৎকারোপচারৈঃ
প্রকৃতিভিরনুরজ্যমানো রাজ্যং করোতি।
নগরে প্রবেশ করে এখন প্রজাদের দ্বারা বহু উপচারের সম্মান আর অনুরাগ পেয়ে তিনি রাজত্ব করছেন।
এবারে সেই উদ্দাম প্ৰেম আপন সীমার মধ্যে সুষমা লাভ করেছে, আর তা কর্তব্যে বিচূতি ঘটায় না, বরং কর্তব্যে প্রেরণা জোগায়। এবারে সে প্রেম হয়েছে হুতশেষ, তার আতিশয্য দগ্ধ হয়ে বাকিটুকু পরিণত হয়েছে প্ৰাশিত্রে, যার মধ্যে ভোগ আর ত্যাগ একটি সামঞ্জস্যের মধ্যেই বিধৃত।
এর ব্যতিক্রম উনমানবের ক্ষেত্রে, যেমন তাড়কার কামনাসর্বস্ব আবেগ। তার মধ্যে ত্যাগ নেই বলে কোনও শুভকে তা বহন করে না। মানুষের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম অগ্নিবর্ণে, যার কামনার আলেখ্য বিভীষিকাময় : রাজদর্শনে আগ্রহী প্রজাদের জন্যে যিনি দুটি পদতল প্রসারিত করে রাখেন, কারণ অবিচ্ছিন্ন সম্ভোগ থেকে এক মুহুৰ্তও তিনি বিরত হতে প্রস্তুত নন। এর পরিণাম ক্ষয়, অকালমৃত্যু; এ ভোগসর্বস্ব কামনা অভিশপ্ত। ত্যাগের মধ্যে দিয়ে যখন প্ৰেম আসে না তখন তার রূপ উগ্র, কামনাসর্বস্ব। (রবীন্দ্ৰনাথের চণ্ডালিকা নাটকে এ প্ৰেম অভিচার আর উচাটনকে আশ্রয় করে সার্থকতা খুঁজেছে।)
কালিদাস মুখ্যত পুরুষেরই বিরহ বর্ণনা করেছেন–রামচন্দ্ৰ, দুষ্যন্ত, পুরুদারবা, যক্ষ, অজ। এঁদেরই বিলাপ তাঁর কাব্যনাট্যতে নানাসুরে অনুরাণিত। সীতা, শকুন্তলা, উর্বশী, যক্ষবন্ধুএঁরা নেপথ্যে বিরহ যাপন করেছেন। দেবতার বেলাতেই শুধু ব্যতিক্রম; উমার বিরহের মৰ্মস্পশী চিত্র এঁকেছেন কবি, রতিবিলাপ কুমারসম্ভবের কেন্দ্ৰস্থলে। মদন-রতির উপাখ্যান কালিদাসেরই উদ্ভাবন। পরবর্তী পুরাণগুলি খুব সম্ভব মহাকবির কাব্য থেকেই এ কাহিনি পেয়েছে। কাহিনিটি অসামান্য তাৎপৰ্যপূর্ণ। কারণ, প্রেম সম্বন্ধে কালিদাসের যে উপলব্ধি আর বোধ, তা এই প্রতীকী কাহিনিতেই মূর্ত হয়ে উঠেছে। প্রেমের অধিদেবতা মদন তাঁর উচ্ছৃঙ্খল শরসন্ধানের বিলাসে প্রজাপতিকে গর্হিত কামনায় অনুপ্রেরিত করেছিলেন। পরে, দ্বিতীয় বারে, উদাসীন শিবকে লক্ষ্য করে যখন কামুকে জ্যা আরোপণ করলেন তখন, শিক্ষুরুন্ধুদৰ্চিঃ সহসা তৃতীয়াদক্ষোঃ কৃশানুঃ কিল নিম্পপাত-সহসা তাঁর তৃতীয় নেত্র থেকে স্মৃলিঙ্গ-জুলা অগ্নি নিৰ্গত হল।’ (৩:৭১) সে অগ্নিতে মদন ভস্মসাৎ হলেন, রতির আর্ত বিলাপে আকাশ বাতাস শিহরিত হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রতির আত্মহত্যা নিবারিত হল। পুনর্মিলনের আশ্বাসে, দৈববাণীতে। এর অব্যবহিত পরের সর্গেই আর-এক দেবীর বিরহের বর্ণনা–পার্বতীর সুকঠোর তপস্যা।
মদন-রতির উপাখ্যানে কালিদাস প্ৰেম সম্পর্কে তার শিল্পীর উপলব্ধিকে একটি প্রতীকী রূপ দিয়েছেন। মদনের ভস্ম হয়ে যাওয়া যজ্ঞে হব্যবস্তুর দগ্ধ হওয়ারই প্ৰতীক। কিন্তু দগ্ধ হলেও মদন দেহবিনিমুক্ত অমুর্তভাবে বিদ্যমান ছিলেন, তাই হরপার্বতীর মিলন সম্ভব হল–কিন্তু তা হল সম্পূর্ণ অন্য এক স্তরে। বিবাহে এ মিলন যখন অন্য স্তরে উন্নীত হতে চলেছে, তখন মদন ভস্মদেহ থেকে পুনর্বার স্বমূর্তি পরিগ্রহ করলেন এবং তখনই পার্বতী হুতশেষরূপে ফিরে পেলেন তার প্রেমকে, তার প্রিয়তম শিবকে। কালিদাসের ইষ্টদেবতা শিব। তাই হরপার্বতীর প্রেমের আর মিলনের প্রসঙ্গেই প্ৰেম সম্বন্ধে তাঁর উপলব্ধিটিকে মূর্ত করে, প্রত্যক্ষ করে তুললেন মদন-রতির উপাখ্যানে। কালিদাস-সাহিত্যে প্রেমের রূপায়ণে তাই এই উপাখ্যানটিই কেন্দ্ৰবিন্দুরূপে অবস্থিত। তাঁর উপলব্ধি এখানে প্রতীকী হলেও সম্পূর্ণ ভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
রতি যেখানে প্রেমের আর্তিতে বিহুল, প্রায় উন্মাদ, পার্বতী সেখানে কঠোর নিষ্ঠাভরে আহুতি দিচ্ছেন তার রূপযৌবন আর সম্ভোগকামনাকে, একাগ্রচিত্তে চাইছেন তার শিবকে, জীবনের সঙ্গী-রূপে। আহুতি সমাপ্ত হলে তাপসরদপী শিব এলেন তার তপস্যার দ্বারদেশে, হতশেষ হয়ে উঠল। প্রেম। মদন যখন ভস্মীভূত তখনই এ প্রেম পরস্পরের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পেল। এর সূচনায় মদন ছিল উন্মাদনারূপে, মাঝে সেই প্রেমদেবতার পূর্ণতর সত্তার উদ্দেশে পার্বতী নিবেদন করলেন তার মনোহারিণী শক্তিকে, মদনের স্বেচ্ছাচারকে। তারপর তারা যখন মিলিত হলেন তখন দেবতাদের অনুরোধে মহাদেব মদনকে পুনরুজ্জীবিত করলেন। কালিদাস জানেন, যত মহৎই হোক প্ৰেম, তার মধ্যে কামনা থাকবেই, আসঙ্গলিন্সাকে সে কখনওই পরিহার করবে না। যে কোনও বনস্পতিই অদৃশ্য মূলের সাহায্যে মাটির নিচে রসসন্ধান করে, রসশোষণ করে, এই মূলকে বাদ দিয়ে সে বাঁচে না। কিন্তু শিকড় থাকবে যথাস্থানে, মাটির নিচে; অগোচরে তার আহৃত রস সঞ্চারিত হবে সমস্ত তরুণদেহে; তবেই ফুল ফুটবে উপরের শাখায়; ফলভারে আনত হয়ে আসবে শাখা; সার্থক হবে তার তরুজন্ম। তাই সংযত মিলনের প্রহরেই পুনরুজজীবিত হয় মদন। তাই যক্ষ নির্মল শরৎকালে পরিণতচন্দ্রিক রাত্ৰিতে মিলিত হবে যক্ষবন্ধুর সঙ্গে; পুরুদরবা নতুন করে পাবেন হুতশেষরূপে তাঁর প্রেমকে; অপুত্ৰক রাজা নিজেকে ফলবান দেখবেন আয়ুর মধ্যে–বধু আর সন্তান নিয়ে কর্তব্যে অবিচল থেকেই প্রেমের ঐশ্বৰ্য অনুভব করবেন। দুষ্যন্ত দীর্ঘবিরহানলে হব্যের মতো প্রেমের দাহ্য অংশটুকু আহুতি দিয়ে প্রাশিত্ররূপে ফিরে পাবেন যা তাঁর ভোগ্য সেই প্রেমকে; অপুত্ৰক দুষ্যন্ত পাবেন সর্বদমনকে আর কল্যাণী বধূকে। এই আহুতি যে দিতে পারল না তার প্রেম দুরন্ত কাম হয়ে জ্বলে মরল অতৃপ্ত জ্বালায়। সে কাম অগ্নিবর্ণের ক্ষয়রোগ আনে, চিন্তানলে অকালে পুড়িয়ে দেয় তার সমস্ত জীবনকে। আহুতি নেই, তাই হুতশেষও রইল না।
গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য বোধহয় পরিমিতিবোধ। এ যুগের বিষ্ণুমূর্তি সূর্যমূর্তি দেখলে শিল্পীর সুষমাসৃষ্টির ক্ষমতায় চিত্ত শ্রদ্ধাঙ্গুত হয়। মূর্তিগুলি একটি অস্ফুট স্মিতহাস্যে উজ্জ্বল; এ হাস্যটি রেখামাত্রসার; একটু কম হলে মূর্তি হত গভীর, একটু বেশি হলে হত। উচ্ছল। এই পরিমিতিবোধই কালিদাসেরও সবচেয়ে বিস্ময়কর কৃতিত্ব। সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যে এ আর দ্বিতীয় বার দেখা দেয়নি; পরবর্তী সাহিত্য আতিশয্যদুষ্ট, এক কালিদাসই প্রায় সম্পূর্ণভাবে একে জয় করতে পেরেছেন। সৌষম্যবোধ তাঁর শিল্পকে নতুন করে একটি মাত্ৰা দিয়েছে। তার কাব্যনাটকে এর একটি পরিচয় মেলে প্রেমের রুদ্যপায়ণে। তার সাহিত্যসৃষ্টিতে প্রেমের তরুটির মূল ভূমির গভীরে প্রোথিত, কাণ্ডশাখাপল্লবে তার বিস্তার দৃষ্টিগোচর; বসন্তের অজস্র সমারোহে তার পুষ্পসম্ভার ঊর্ধ্বের্ব প্রসারিত; ফলের ঋতুতে ফলোদগমে তার পূর্ণ পরিণতি। প্রেমের আত্মত্যাগ যজ্ঞক্রিয়ার মতো নিম্পাদিত হলে পর নতুন পর্বে প্রেমের যে বিকাশ তাতে ঐশ্বৰ্য আছে, আতিশয্য নেই; ভোগ আছে কিন্তু তা একান্ত হয়ে ওঠেনি; কর্তব্যের সঙ্গে তার আর সংঘাত নেই।
এই বিশেষ বোধটি নানা বিচিত্র রূপকল্পে চিত্রিত হয়েছে, এবং এটি কবির নিজস্ব উপলব্ধি থেকে সঞ্জাত। মিশর-ব্যাবিলন-গ্রিসের বিরাহিণীর বিলাপগাথা বাণিজ্যপথে ভারতে অনুপ্রবেশ করে থাকলেও কালিদাস-সাহিত্যে মদন আর রীতির প্ৰেমকাহিনি যে তাৎপর্য বহন করে তার কোনও আদিকল্প অন্যত্র নেই। এ উপলব্ধির পশ্চাতে আছে গুপ্তযুগের শিল্প আর বিজ্ঞানের যুগপৎ প্রসার এবং উন্নতি, বহির্বাণিজ্য আর আভ্যন্তরিক শৃঙ্খলা থেকে যে নিরাপত্তার বোধ আর আত্মপ্রত্যয় আসে তা-ও আছে, এবং সর্বোপরি আছে একটি দৃঢ় প্রত্যয়: প্রেম বিদেহ নয়, কিন্তু দেহসর্বস্বও নয়; এবং পূর্ণতম বিকাশের স্তরে কল্যাণের সঙ্গে তাঁর আত্যন্তিক বিরোধ নেই। দেহের মধ্যে থেকেই একটি উর্ধশিখ প্ৰদীপ হয়ে তা জুলতে পারে। এই প্ৰত্যয়টি কালিদাসের কাব্যে একটি কেন্দ্রীয় আদিকল্প, এবং এর স্রষ্টা তিনি স্বয়ং।
Leave a Reply