০৭. নারীর স্থান: রামায়ণ ও মহাভারত-এ

নারীর স্থান: রামায়ণ ও মহাভারত-এ 

রামায়ণ 

রচনাকালের দিক থেকে দেখলে রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় থেকে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের মধ্যে রচিত; মহাভারত রচনা সম্ভবত শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম বা চতুর্থ শতক থেকে এবং শেষ হয় খ্রিস্টিয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে। অর্থাৎ বুদ্ধের পরের আট বা ন’শ’ বছরের মধ্যে এ দুটি মহাকাব্য রচিত হয়; এদের মধ্যে মহাভারত আগে শুরু হয়ে পরে শেষ হয়; রামায়ণ পরে শুরু হয়ে আগে শেষ হয়; আগে পূর্ণকলেবর মহাকাব্যের রূপ পায় বলেই সম্ভবত এর নাম আদিকাব্য। মনে রাখতে হবে, রামায়ণ শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে; কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাৎস্যায়নের কামসূত্র, শ্রীমদ্ভাগবদ্‌গীতা এবং মনুসংহিতা, এই ক্রান্তিকালের রচনা। এর কিছু পরেই শুরু হয়ে যায় পুরাণগুলির রচনা। রামায়ণ ও মহাভারত-এ পরবর্তী সংযোজিত অংশগুলি অভিপৌরাণিক, অর্থাৎ পুরাণে প্রতিফলিত যে সামাজিক মূল্যবোধ ও শাস্ত্রীয় অনুশাসনের সমাবেশে ভারতীয় ধর্মচিন্তা তার বিবর্তিত রূপে ক্রমে ‘হিন্দুধর্ম’ বলে অভিহিত হল, এই অভিপৌরাণিক অংশেই আমরা সেগুলির সাক্ষাৎ পাই। এ দিকে রামায়ণ ও মহাভারত-এর মূল কাহিনি দুটি সম্ভবত অনেক প্রাচীনকাল থেকেই গাথায় ও আখ্যানে জনমানসে সঞ্চরণ করছিল; ফলে মহাকাব্য দুটিতে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের দুটি চিত্র পাই: একটি মূল কাহিনির আর একটি সংযোজিত বা প্রক্ষিপ্ত অভিপৌরাণিক অংশের। 

প্রথমে রামায়ণ-এর কথাই ধরা যাক। যেহেতু এর রচনা শুরু হয় পরে, সে জন্যে এর মূল অংশের মধ্যেই ওই অভিপৌরাণিক অংশের কিছু অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তবু দেখি কৈকেয়ীর সাহস হয় রাজাকে পূর্ব প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ করতে; লক্ষ্মণ বনগমন করলেও ঊর্মিলা তাঁর সঙ্গে না গিয়ে প্রাসাদেই থেকে গেলেন; দশরথের মৃত্যুর পরে রানিরা ‘সতী’ হননি, বিধবা অবস্থায় বেঁচেই রইলেন। মন্দোদরী বিলাপ করবার সময়ে স্বামীকে নিন্দা করে বলছেন: 

ন কুলেন ন রূপেণ ন দাক্ষিণ্যেন মৈথিলী। 
ময়াধিকা বা তুল্যা বা তত্ত্ব মোহান্ন বুধ্যসে।। 

সীতা বংশগৌরবে, রূপে বা দাক্ষিণ্যে (কিছুতেই) আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, এমনকী আমার তুল্যও নয়, তুমি মোহবশে সে কথা বুঝলে না। (৬:১১১:২৮) 

স্বামীগর্বে অনেক প্রশংসা করলেন রাবণের রূপ, গুণ, শৌর্য ও চরিত্রের। কিন্তু দোষও দিলেন: 

ত্বয়া কৃতমিদং সর্বমনাথং রাক্ষসং কুলম্। 
সুহৃদাং হিতকামানাং ন শ্রুতং বচনং ত্বয়া।। 

তুমি এই সমগ্র রাক্ষসকুলকে অনাথ করেছ; হিতৈষী বন্ধুদের কথা তুমি শুনলে না। (৬:১১১:৭৬) 

শুধু যে রাক্ষসনারী বলে মন্দোদরীই নিন্দা করেছেন স্বামীর তা নয়, রামচন্দ্ৰ প্ৰত্যাখ্যান করার পরে সীতাও বলেছিলেন: 

মদধীনং তু যত্তন্মে হৃদয়ং ত্বয়ি বর্ততে। 
পরাধীনেষু গাত্রেষু কিং করিষ্যাম্যনীশ্বরী।। 

আমার নিজের আয়ত্তে আমার যে মন তা তো তোমাতেই আছে, আমার যে শরীরটা পরাধীন সেটার সম্বন্ধে অক্ষম আমি কি করব। (৬:১১৬:৯) 

আগেও রামচন্দ্রকে বলেছিলেন: স্বেন চারিত্রেণ তে শপে— আমার চরিত্রের শপথ করে বলছি। (৬:১১৬:৬) আরও বললেন : 

সহ সংবৃদ্ধভাবেন সংসর্গেণ চ মানদ। 
যদি তেহহং ন বিজ্ঞাতা হতা তেনাস্মি শাশ্বতম্।। 

তুমি আমি একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি সেই (এত দিনের) সংসর্গেও যদি তুমি আমাকে না জেনে থাক তবে তো চিরদিনের জন্যেই আমি হতভাগিনী। (৬:১১৬:১০) 

এই সীতা, রামায়ণে যিনি শুধুই মুখ্য নয়, বলতে গেলে একমাত্র নারীচরিত্র, তাঁর জীবনের ঘটনাগুলি লক্ষ্য করলেই রামায়ণে নারীর স্থান সম্বন্ধে একটা ধারণা হবে। রাক্ষস অকম্পন সীতার বর্ণনা করেছিল: 

নৈব দেবী ন গন্ধবী নাপ্সরা ন চ পন্নগী। 
তুল্যা সীমন্তিনী তস্যা মানুষী তু কুতে। ভবেৎ।। 

দেবী, গন্ধর্বী, অপ্সরা, নাগিনী কোনও নারীই সীতার সমকক্ষ নয়, মানুষী বা কেমন করে তাঁর তুল্য হবে? (৩:৩১:৩০) 

এই অনন্যা নারী স্বামীর বনগমনের সংবাদ পেয়েই তৎক্ষণাৎ মনস্থির করলেন তিনি ও বনে যাবেন। মূল কাহিনিতে সম্ভবত সীতা স্বামীর বিরহের আশঙ্কাতেই বনে যেতে চেয়েছিলেন, পরে যে-সব সংযোজন হল তার মধ্যে সেই অভিপ্রায়টিকে চিনে নেওয়া যায়; যেমন সীতা বলছেন : 

       ত্বয়া বিনা নরব্যাঘ্র নাহং তদপি রোচয়ে।
বা,    ত্বদ্বিয়োগেন মে রাম ত্যক্তব্যমিহ জীবিতম্। 

অথবা,      উত্থিতায়াস্ত্বয়া নাথ তদৈব মরণং বরম্। 
                       ইমং হি সহিতুং শোকং মুহূর্তমপি নোৎসহে 

হে নরব্যাঘ্র তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বর্গেও রুচি নেই। (২:২৭:২১) তোমার বিরহে রাম, আমাকে প্রাণ ত্যাগ করতে হবে। (২:২৮:৫) তুমি পরিত্যাগ করলে আমার মৃত্যুই ভাল। (২:৩০:২০) এ-শোক আমি এক মুহূর্তও সহ্য করতে পারব না। (২:৩০:২১ ) 

এ সব কথা প্রেমের; যে প্রেম অদর্শন বিচ্ছেদ সহ্য করার সম্ভাবনার চেয়ে মৃত্যুকেও বরণীয় জ্ঞান করে। এ সীতা প্রাচীনতর উপাখ্যানের নায়িকা, যিনি পতিব্রতা বলে নয়, রামকে ভালবাসতেন বলেই স্বেচ্ছায় সানন্দে তাঁর সঙ্গে বনে গিয়েছিলেন, কর্তব্য বা পতিব্রতাধর্ম পালন করছেন বলে নয়। কিন্তু, এরই সঙ্গে প্রায় ওতপ্রোত ভাবে মিশে রয়েছে পরবর্তীকালের পতিব্রতাধর্ম, যা ম্লান করে দিয়েছে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমের মহিমাকে। এইখানেই শুনি, শ্রুতিৰ্হি শূয়তে পুণ্যা ব্রাহ্মনাণাং যশস্বিনাম্— যশস্বী ব্রাহ্মণদের পুণ্য উক্তি শোনা যায়।’ কী সেই উক্তি? না, ‘ভর্তা হি পরমদৈবতম্— স্বামীই পরম দেবতা।’ (২:২৯:১৬) কিংবা : 

              ইহ প্রেত্য চ নারীণাং পতিরেকো গতিঃ সদা 
অথবা,      প্রাসাদাগ্রে বিমানৈর্বা বৈহাহসগতেন বা। 
              সর্বাবস্থাগতা ভর্তুঃ পাদচ্ছায়া বিশিষ্যতে।। 

ইহজগতে ও পরলোকে সর্বদাই পতিই হল নারীর একমাত্র গতি। (২:২৭:৬) সে প্রাসাদের ওপরে, বিমানে, আকাশে যেখানেই হোক স্বামীর পদচ্ছায়ার বিশিষ্ট স্থান। (২:২৭:৯) বিদায়কালে সীতা কৌশল্যাকে বলছেন: 

নাতন্ত্রী বাদ্যতে বীণা নাচক্রো বিদ্যতে রথঃ। 
নাপতিঃ সুখমেধতে যা স্যাদপি শতত্মজা।। 

তন্ত্রীহীন বীণা বাজে না, চক্রহীন রথ হয় না। পতিহীনা নারী শতপুত্রের জননী হলেও সুখ পায় না। (২:৩৯:২৯) 

অথবা রামকে বলছেন: 

গতিরেকা পতির্নার্য়া দ্বিতীয়া গতিরাত্মজঃ। 
তৃতীয়া জ্ঞাতয়ো রাজংশ্চতুৰ্থী নৈব বিদ্যতে।। 

নারীর একটি গতি স্বামী, দ্বিতীয় পুত্র, তৃতীয় আত্মীয়রা, চতুর্থ কোনও গতি তার নেই। (২:৬১:২৪ ) 

রাবণ যখন সীতাকে হরণ করতে এলেন তখন সীতা তাঁকে যে ভাষায় প্রত্যাখ্যান ও তিরস্কার করছেন তার অনেকটাই প্রেমে ও স্বামিগর্বে বলা, শুধু পতিব্রতাধর্ম থেকে নয়। বলছেন, ‘নৃসিংহং সিংহসংকাশমহং রামমনুব্রতা/— আমি সিংহসদৃশ সেই নরসিংহ রামের অনব্রতা।’(৩:৭৪:৩৩) প্রচণ্ড ধিক্কার দিচ্ছেন রাবণকে তার ধ্রুবপদ যেটি বারেবারে উচ্চারণ করছেন তা হল, 

‘রাঘবস্য প্রিয়াং ভার্যাং যত্ত্বমিচ্ছসি রাক্ষস।— তুমি রামের প্রিয় বধূকে চাইছ, রাক্ষস।’
আশীবিষস্য বদনাদ্দংষ্ট্রামাদাতুমিচ্ছসি।… 
কালকূটং বিষং পীড়া স্বস্তিমান্ গন্তুমিচ্ছসি।…
সূর্যাচন্দ্রমসৌ চৌভৌ পাণিভ্যাং হর্তুমিচ্ছসি।…
অগ্নিং প্রজলিতং দৃষ্ট্বা বস্ত্রেণাহতুমিচ্ছসি। 

সাপের মুখ থেকে দাঁত নিতে চাইছ; কালকূট বিষ পান করে স্বস্তিতে চলে যেতে চাইছ; সূর্য ও চন্দ্রকে হাত দিয়ে হরণ করতে চাইছ, জ্বলন্ত আগুনকে বস্ত্র দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছ? (৩:৪৭:৩৯, ৪০, ৪২, ৪৩) শুধু পতিব্রতের কথা এ নয়, এর মধ্যে আছে সীতার গভীর প্রেমের প্রকাশ। আর রামচন্দ্রকে নিয়ে গর্ব, যে গর্বে তিনি রাবণকে বলেন, ‘তোমার সঙ্গে রামচন্দ্রের পার্থক্য হল: বনে সিংহ এবং শৃগালের যে পার্থক্য, সোনার সঙ্গে সীসা-লোহার যে পার্থক্য, গরুড়ের সঙ্গে কাকের যে পার্থক্য তাই : 

যদন্তরং সিংহশৃগালয়োবনে… 
যদন্তরং কাঞ্চনসীসলোহয়োঃ… 
যদন্তরং বায়সবৈনতেয়য়োঃ… (৩:৪৭:৪৫, ৪৬, ৪৭) 

তাই ‘ইন্দ্রের ভার্যা শচীকে অপহরণ করেও বাঁচা সম্ভব কিন্তু রামের ভার্যা আমাকে নিয়ে গিয়ে তুমি স্বস্তি পাবে না। 

অপহৃতা শচীং ভার্যাং শক্যমিন্দ্রস্য জীবিতুম্। 
ন হি রামস্য ভার্যাং মামানীয় স্বস্তিমান্ ভবেৎ।। (৩:৪৮:২৩) 

এ কথা অহংকারের, যে অহংকার তাঁর রামকে নিয়ে, রামের শৌর্য ও পত্নীপ্রেমে বিশ্বাস থেকে যে অহংকার জন্মায়। 

এই সহজ অনুভূতির মহিমাকে বারে বারে ক্ষুণ্ণ করেছে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধান, যা যত্রতত্র প্রক্ষিপ্তরূপে মিশে আছে এই মহাকাব্যে। আগে মনে করা হত রামায়ণ-এর প্রক্ষেপ শুধু বাল ও উত্তরকাণ্ডে; এখন গবেষণায় যা জানা যায় তা হল ও দুটি কাণ্ড প্রায় সম্পূর্ণই প্রক্ষিপ্ত, কিন্তু অন্যান্য কাণ্ডেও প্রচুর পরিমাণে প্রক্ষেপ আছে। জে. এল বুকিংটন-এর প্রামাণ্য বই দ্য রাইটিয়াস রাম (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৪)-তে গ্রন্থকার দেখিয়েছেন একটি ক্ষত্রিয় বীরের কাহিনি কী ভাবে ধীরে ধীরে ধর্মগ্রন্থে পরিণত হল এবং ক্ষত্রিয়বীর কী ভাবে অবতারে পরিণত হল। এই বিবর্তনে অভিপৌরাণিক প্রক্ষেপগুলির ভূমিকা খুবই স্পষ্ট। রাবণ যখন ছল করে রামের মৃত্যু ঘোষণা করলেন তখন সীতা ভাবলেন: 

নূনং মমৈব শোকেন স বীরো লক্ষ্মণাগ্রজঃ।
দেবলোকমিতো যাতস্ত্যত্ত্বা দেহং মহীতলে।। 

নিশ্চয়ই আমারই শোকে বীর রামচন্দ্র দেহত্যাগ করে দেবলোকে চলে গেছেন। (৫:২৬:৩৮)

হনুমানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দীর্ঘ এক প্রশ্নমালায় রামের কুশলসংবাদ জেনে নিলেন। প্রশ্ন করলেন, ‘ক্বচিন্মাং বষযনাদম্মান্মোক্ষয়িষ্যতি রাঘবঃ— রামচন্দ্র আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন তো?’ (৫:৩৬:২০) 

এই সীতাকে দীর্ঘদিনের অদর্শনের পর রামচন্দ্র যখন প্রথম দেখলেন তখন কী বললেন? — যুদ্ধ করে যে জয়লাভ করেছি সে তোমার জন্যে নয়— ন ত্বদর্থং ময়া কৃতঃ।’(৬:১১৫:১৫) তাহলে কেন করলেন? ‘প্রখ্যাতস্যাত্মবংশস্য ন্যঙ্গঞ্চ পরিমার্জতা— নিজের বিখ্যাত বংশের কলঙ্ক মোচনের জন্য করেছি।’ (৬:১১৫:১৬) 

প্রাপ্তঃ চারিত্রসন্দেহা মম প্রতিমুখে স্তিতা।
দীপো নেত্রাতুরস্যেব প্রতিকূলাসি মে দৃঢ়া।।
তদ্‌ গচ্ছ ত্বানুজানেহদ্য যথেষ্টং জনকাত্মজে।
এতা দিশ দিশো ভদ্রে কার্যমস্তি ন মে ত্বয়া।।
কঃ পুমাংস্ত কুলে জাতঃ স্ক্রিয়ং পরগৃহোহিষতাম্। 
তেজস্বী পুনরাদদ্যাৎ সুহৃল্লোভেন চেতসা।।
রাবণাঙ্কপরিক্লিষ্টাং দুষ্টাং দুষ্টেন চক্ষুষা।
কথং ত্বাং পুনরাদদ্যাং কুলং ব্যাপদিশন্মমহৎ।।
যদর্থং নির্জিতা মে ত্বং সো য়মাসাদি      ময়া। 
নাস্তি মে ত্বষ্যভিম্বঙ্গো যথেষ্টং গম্যতামিতি।। 

তোমার চরিত্রে (আমার) সন্দেহ, আমার সামনে তুমি আছ এতে আমি (তোমার প্রতি) প্রতিকূল বোধ করছি যেমন চোখের রোগীর সামনে দীপ থাকলে (তার কষ্ট) হয়। অতএব এই দশদিকের যেখানে ইচ্ছা তুমি যাও, তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি, তোমাতে আর আমার কোনও প্রয়োজন নেই। সদ্বংশজাত কোন তেজস্বী পুরুষ, পরগৃহে বাস করেছে এমন নারীকে বন্ধুত্বের লোভে পুনর্বার গ্রহণ করবে? রাবণের অঙ্ককলঙ্কিতা, তার দুষ্ট দৃষ্টিতে দূষিতা যে তুমি, সেই তোমাকে কেমন করে আমি পুনর্বার গ্রহণ করব আমার মহৎ বংশকে দূষিত করে? যে কারণে তোমাকে উদ্ধার করেছি সে উদ্দেশ্য আমার সিদ্ধ হয়েছে; তোমাতে আমার আর কোনও আসক্তি নেই। যেখানে ইচ্ছে চলে যাও। (৬:১১৫:১৭-২১) 

এতেও যথেষ্ট হল না, সীতার ভবিষ্যতের পথও দেখিয়ে দিচ্ছেন রাম: 

তদস্য ব্যাহৃতং ভদ্রে ময়ৈতৎ কৃতবুদ্ধিনা। 
লক্ষ্মণে বাথ ভরতে কুরু বুদ্ধিং যথাসুখম্।। 

আজ সুবুদ্ধিপ্রণোদিত হয়ে তোমাকে বলে দিলাম, হে ভদ্রে, লক্ষ্মণ অথবা ভরত যাতে তোমার সুখ হয় তাকেই বরণ কোরো। (৬:১১৫:২২) 

মনে রাখতে হবে, বনগমনের পূর্বে লক্ষ্মণ যখন সুমিত্রাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন তখন সুমিত্রা তাকে বলেছিলেন: 

ক্ষরামং দশরথং বিদ্ধি মাং বিদ্ধি জনকাত্মজাম্। 
অযোধ্যামটকীংবিদ্ধি গচ্ছ তাত যথাসুখম। 

রামকে দশরথ বলে মনে কোরো, সীতাকে মনে কোরো আমি, অরণ্যকে অযোধ্যা জ্ঞান কোরো, যথাসুখে চলে যাও বৎস।  

এই নির্দেশের জন্যে লক্ষ্মণ সীতার পায়ের অলংকার ছাড়া আর কিছু চিনতে পারেননি, কারণ প্রণাম করার সময়ে শুধু পা-ই দেখতে পেতেন। আজ সেই লক্ষ্মণকেও অপমান করলেন রামচন্দ্র; সীতাকে তো চূড়ান্ত ভাবেই করলেন। কয়েকটি রামায়ণ-এর সংস্করণে প্রত্যাখ্যানের সময়ে আরও কিছু কথা রামের মুখে দেওয়া আছে; আর মহাভারত-এর বনপর্বে রামোপখ্যানে তো সংশোধিত সংস্করণেও তা রক্ষিত আছে। সেখানে রাম বলছেন : 

গচ্ছ বৈদেহি মুক্তা ত্বং যৎ কার্যং তন্ময়া কৃতম।।
মামাসাদ্য পতিং ভদ্রে ন ত্বং রাক্ষসবেনি।
জরাং ব্রজেথা ইতি মে নিহতো য়ং নিশাচরঃ।।
কথং হ্যস্মদ্বিধো জাতু জানন্ ধর্মবিনিশ্চয়ম্।
পরহস্তগতাং নারীং মুহূর্তমপি ধারয়েৎ।।
সুবৃতত্তামসুবৃত্তাং বাপ্যহং ত্বামদ্য মৈথিলি। 
নোৎসাহে পরিভোগায় শ্বাবলীঢ়ং হবির্যথা।। 

যাও, বৈদেহি, তুমি মুক্ত। যা করণীয় ছিল তা আমি করেছি। আমাকে স্বামিরূপে পেয়ে, ভদ্রে, তুমি রাক্ষসের গৃহে জরাগ্রস্ত যাতে না হও তাই আমি রাক্ষসকে বধ করেছি। আমার মতো লোক যে ধর্মাধর্ম-বিনিশ্চয় জানে সে পরহস্তগতা নারীকে কেমন করে এক মুহূর্তের জন্যেও ধারণ করবে? তুমি সচ্চরিত্রই হও বা দুশ্চরিত্রই হও, মৈথিলি, তোমাকে আমি আজ ভোগ করতে পারি না, তুমি (এখন) সেই ঘিয়ের মতো যা কুকুরে লেহন করেছে। (মহাভারত ৩:২৭৫:১০-১৩) 

এখানে কয়েকটি বিষয় বিশ্লেষণ করলেই তৎকালীন সমাজে নারীর স্থান, বিশেষত ওই অধিপৌরাণিক অংশ সংযোজিত হওয়ার পর, তার স্থান কী ছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, ‘তুমি মুক্ত’—কী থেকে মুক্ত? বিবাহবন্ধন থেকে? এত সহজ তা? ধর্মসূত্রে আছে ধর্ষিতা নারীকেও পরের মাস থেকে স্বামী শুচি জ্ঞান করবেন। এবং রামায়ণ রচনা বেশ কয়েকটি ধর্মসূত্রের সমসাময়িক, আর কয়েকটির পরবর্তী। কাজেই এ শাস্ত্র রামের অজানা থাকার কথা নয়। তবু সীতা পরিত্যাগে রামের কোনও দ্বিধা নেই। তারপর রাম ব্যাখ্যা করে রূঢ় সত্যটি বলছেন, যুদ্ধটা তিনি কেন করলেন: ঈক্ষ্বাকুবংশের মর্যাদা রক্ষার জন্যে এবং নিজের বীরখ্যাতি অক্ষুণ্ণ রাখবার জন্যে। রামের স্ত্রী হয়ে সীতা রাবণের প্রাসাদে জরাপ্রাপ্ত হলে সেটা রামের শৌর্যের হানি ঘটায়, তাই যুদ্ধ করেছেন। সে যুদ্ধ সীতার জন্যে নয়। রামের মতো সূক্ষ্ম ধর্মবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি পরহস্তগতা নারীকে মুহূর্তের জন্যেও বা কি করে ধারণ করবেন? অতএব সীতা সচ্চরিত্রই হোন বা দুশ্চরিত্র, রামের পক্ষে তাঁকে ‘ভোগ’ করা সম্ভব নয়। প্রাচীন ভারতে নারীর স্থান ওই ‘পরিভোগায়’ শব্দে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কেন ভোগে লাগবেন না সীতা? কুকুরে-চাটা ঘি যেমন যজ্ঞে ব্যবহার করা যায় না, তেমনই পরহস্তগতা নারীও তার স্বামীর ভোগে লাগে না। মনে রাখতে হবে, এতটা অপরাধ সীতার প্রতি স্বয়ং রাবণও করেনি। রাবণ সীতাকে ধর্ষণ করেছে কিনা জেনে নেওয়ারও প্রয়োজন নেই এবং সীতার কোনও অধিকার নেই তাঁর অদর্শনের কালে রাম কী করেছেন সে প্রশ্ন করবার। প্রাচীন ভারত নারীর ‘সতীত্ব’ খুব ভাল বুঝত, ‘সতী’ শব্দের ওই অর্থে কোনও পুংলিঙ্গ শব্দও সৃষ্টি করেনি। অর্থাৎ স্বামীর একনিষ্ঠতার অভাব সমাজের চোখে গর্হিত ছিল না, স্ত্রীকে শুধু সন্দেহের বশেই ত্যাগ করা চলত। এত বড় অন্যায় অপমানের পরে সীতা লক্ষ্মণকে চিতা নির্মাণ করতে বললেন। 

অপ্রীতেন গুণৈৰ্ভর্ত্রা ত্যক্তায়া জনসংসদি। 
যা ক্ষমা মে গতির্গন্তুং প্রবেক্ষ্যে হব্যবাহনম্।। 

স্ত্রীর গুণে যে প্রীত নয় এমন স্বামী যখন জনসভায় স্ত্রীকে ত্যাগ করে তখন সেই স্ত্রীর যে পথে যাওয়া সম্ভব তাই করব; অগ্নিপ্রবেশ করব। (৬:১১৬:১৯ ) 

জনসভায় সকলের প্রত্যাশা রাম লক্ষ্মণকে সীতার চিতা রচনায় বাধা দেবেন, কিন্তু : 

ন হি রামং তদা, কশ্চিৎ কালান্তক্যমোপমম্। 
অনুনেতুমথো বক্তুং দ্রষ্টুং বাপ্যশক‍ সুহৃৎ।। 

রামকে তখন কাল অন্তক ও যমের মতো দেখাচ্ছিল, তাঁকে অনুনয় করা, তাঁকে কিছু বলা বা (এমনকী) তাঁর দিকে চেয়ে দেখার সাধ্যও কোনও বন্ধুর ছিল না। (৬:১১৬:২২) 

রামের এই নৈতিক আত্মতুষ্টি ও দুষ্কৃতকারীর শাস্তিবিধানের ভূমিকাটি এসেছিল তৎকালীন সমাজের স্ত্রী-পুরুষের আপেক্ষিক মূল্যবোধ থেকে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিরপরাধ স্ত্রীকে সন্দেহের বশে ত্যাগ করা যে কোনও রকম অন্যায়ই নয় এই দৃঢ় ধারণা। 

এর পরে সীতা বললেন: 

যথা মে হৃদয়ং নিত্যং নাপসপতি রাঘবাৎ।
তথা লোকস্য সাক্ষী মাং সর্বতঃ পাতু পাবকঃ।
কর্মণা মনসা বাচা যতা নাতিচরাম্যহম্।
রাঘবং সর্বধর্মজ্ঞং তথা মাং পাতু পাবকঃ।।
আদিত্যো ভগবান্ বায়ুর্দিশশ্চন্দ্ৰস্তথৈব চ।
অহশ্চাপি তথা সন্ধ্যে রাত্রিশ্চ পৃথিবী তথা।। 
যথান্যেপি বিজানন্তি তথা চারিত্রসংযুতাম।। 

যেহেতু আমার হৃদয় রামচন্দ্র থেকে কখনও সরে যায়নি, অতএব লোকসাক্ষী অগ্নি আমাকে সর্বদিকে রক্ষা করুন। কাজে, মনে, কথায় যেহেতু সর্বধর্মজ্ঞ রামকে কখনও লঙ্ঘন করিনি, সেহেতু অগ্নি আমাকে রক্ষা করুন। ভগবান, আদিত্য, বায়ু, দিকগুলি, এবং চন্দ্র, দিন, সন্ধ্যা, রাত্রি ও পৃথিবী এবং অন্যেরাও যেহেতু জানেন আমি এই রকম চরিত্রবতী। (৬:১১৬:২৫, ২৭, ২৮) 

এই শপথ করে অগ্নিপ্রবেশ করার দুটি দিক আছে একটির নাম ‘সত্যক্রিয়া’। কোনও ব্যক্তির প্রতি অন্য কেউ সন্দেহ করলে সে নিজের নির্দোষিতা প্রতিপাদন করবার জন্যে প্রকৃতির নিত্যস্থায়ী শক্তিগুলিকে সাক্ষী মানে। অন্য দিকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ রকম অবস্থায় চার রকমের বিচার আছে: বিষ, অগ্নি, জল ও তুলা অর্থাৎ নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করবার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি নিরপরাধ হয় তাহলে বিষভক্ষণ করলে শরীরে বিষক্রিয়া হয় না, অগ্নিপ্রবেশ করলে দগ্ধ হয় না, জলে ডুবলে মৃত্যু হয় না এবং তুলাদণ্ডে তার ওজনের তুলনায় সে লঘুভার হয়ে যায়। সীতা এই শপথ করে অগ্নিপ্রবেশ করে যখন দগ্ধা হলেন না তখন ধর্ম এবং রাষ্ট্রের বিচারের দৃষ্টিতে তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ হল। বলা বাহুল্য, তৎকালীন বিশ্বাসের পটভূমিকায় এ শপথ করতে পারত একমাত্র সম্পূর্ণ নিরপরাধ ব্যক্তিই— মনে, কথায় ও কাজে যে শুচি। 

অযোধ্যায় ফিরে স্বল্পকাল সুখভোগের পর লোকেরা রামের বিষয়ে বলতে লাগল: 

কীদৃশং হৃদয়ে তব সীতাসম্ভোগজং সুখম্। 
অঙ্কমারোপ্য তু পুরা রাবণেন বলাদ্ধৃতম।। 

রাবণ যাকে অঙ্কে আরোপণ করে সবলে হরণ করেছিল, সেই সীতার সম্ভোগে তোমার হৃদয়ে কেমন সুখ হয়? (৭:৪৩:১৭) 

লক্ষণীয়, সীতার অগ্নিপরীক্ষার সাক্ষী অন্তত দুজন ছিলেন, রাম এবং লক্ষ্মণ। দেবতারা, বিশেষত ব্রহ্মা এসে সীতার শুচিতা ঘোষণা করেছিলেন— এ সব কিছুই উল্লেখ করা হল না। প্রজাদের শ্লেষযুক্ত বাক্য শুনে রাম বিচলিত হলেন, কারণ প্রজারা বলল: 

অস্মাকমপি দারেষু সহনীয়ং ভবিষ্যতি। 
যথা হি কুরুতে রাজা প্রজাস্তমনুবর্তন্তে।। 

(এমন হলে) আমাদের স্ত্রীদেরও (এই অপরাধ) সহ্য করতে হবে। রাজা যেমন করে প্রজা তারই অনুবর্তন করে। (৭:৪৩:১৯) 

রাম বললেন, এই পৌরাপবাদ তাঁর মর্ম ছেদন করছে। লক্ষ্মণকে বললেন সীতা তাঁর শুচিতার প্রমাণ দিয়েছেন (৭:৪৪:৬-১০), তবু, অকীর্তিনিন্দ্যতে দেবৈঃ কীর্তিলোকে পূজ্যতে— দেবতারা অকীর্তির নিন্দা করে, পৃথিবীতে কীর্তি পূজিত হয়। (৭:৪৪:১৩ ) 

অতএব সীতা পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। পরিত্যক্তা সীতা লক্ষ্মণের মুখে রামকে বলে পাঠালেন: 

যচ্চ তে বচনীয়ং স্যাদপবাদসমুখিত। 
ময়া চ পরিহর্তব্যং ত্বং হি মে পরমা গতি।। 

এই অপবাদ থেকে তোমার যে নিন্দা রটেছে সেটা পরিহার করাই আমার কর্তব্য, কারণ তুমি আমার পরম গতি। (৭:৪৮:১৩, ১৪) 

সমাজে নারীর তখন এই স্থান, নারীর পরমা গতি হন স্বামী। স্ত্রীর প্রতি অন্যায় অভিযোগ, মিথ্যা সন্দেহ খণ্ডন করার দায় নেই স্বামীর, কিন্তু স্বামীর নিন্দা সর্বতো ভাবে পরিহার করাই স্ত্রীর একান্ত কর্তব্য। 

রাজসভায় দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে সীতাকে নিজের শুচিতা আবার প্রতিপাদন করবার আদেশ দিলেন রাম। সভায় সীতা কিছু বলার আগেই বাল্মীকি বললেন, 

বহুবর্ষসহস্রাণি তপশ্চর্যা ময়া কৃতা। 
নোপাশীয়াং ফলং তস্যা দুষ্টেয়ং যদি মৈথিলী।।
মনসা কৰ্মনা বাচা ভূতপূর্বং ন কিল্বিষম্। 
তস্যাহং ফলমশ্রামি অপপা যদি মৈথিলী।। 
ইয়ং শুদ্ধসমাচারা অপাপা পতিদেবতা। 

বহু সহস্র বৎসর আমি তপস্যা করেছি, সীতা যদি দুশ্চরিত্র হন তবে সেই তপস্যার ফল আমি ভোগ করব না। মনে, কাজে, কথায় কখনও অন্যায় করিনি, সীতা যদি নিষ্পাপ হন তবে আমি তার ফল ভোগ করব। এই (সীতা) শুদ্ধচরিত্রা, নিষ্পাপ, পতিই এর দেবতা। (৭:৯৬:২০, ২১, ২৩) 

বাল্মীকির এত বড় শপথই রাম এবং প্রজাদের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ হওয়ার কথা। নিষ্পাপ যে ঋষি বহু সহস্র বৎসর তপস্যা করেছেন তাঁর পক্ষে চূড়ান্ত যা শপথ হতে পারে, তাই তিনি বারে বারে প্রকাশ্যে রাজসভায় ঘোষণা করলেন। সমাজে নারীর স্থান কোথায় নেমে গেলে এর পরেও প্রজাদের সন্দেহ ঘোচাবার জন্যে সীতার আবার অগ্নিপরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে? শেষ পর্যন্ত বাল্মীকিও বললেন সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে। সীতা বললেন: 

যথাহং রাঘবাদন্যং মনসাপি ন চিন্তয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমহতি।।
মনসা কর্মণা বাচা যথা রামমভ্যর্চয়ে।
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমহতি।। 
যথৈতৎ সত্যমুক্তং মে বেস্মি রামাৎ পরং ন চ। 
তথা মে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমহতি।। 

রাঘব ছাড়া অন্য কাউকে যদি মনেও না চিন্তা করে থাকি, তবে মাধবী দেবী (পৃথিবী) আমাকে বিবরে (আশ্রয়) দিন। মনে, কাজে কথায় যদি রামকেই অর্চনা করে থাকি, তবে মাধবী দেবী বিবর দিন। রাম ছাড়া আর কাউকেই জানি না। এ কথা যদি সত্য বলে থাকি তবে মাধবী দেবী বিবর দিন। (৭:৯৮:৭, ৮, ৯) 

এ সীতার শেষ সত্যক্রিয়া। এখানে যেটা লক্ষণীয় তা হল সীতা নিজের শুচিতার প্রমাণের বিনিময়ে কি চাইছেন। একবারও বলছেন না, যে আমি রামের প্রতি বিশ্বাসিনী হয়ে থাকলে যেন তিনি এবং প্রজারা আমার প্রতি সন্দেহ ত্যাগ করেন; আমি আবার রামের প্রিয়বধূ হয়ে তাঁর সান্নিধ্যে থাকি; সিংহাসনে তাঁর পাশে স্থান পাই। সে সব সাধ তাঁর সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে; বেশ বুঝতে পারছেন, প্রজারা আবার সন্দেহ করতে পারে এবং রাম কোনও দিনই তাঁর পক্ষ সমর্থন করবেন না, বারে বারেই তাঁকে অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। যে সমাজে নারীর এই স্থান, তাকে সন্দেহ করতে গেলে যুক্তি তথ্য কিছুরই প্রয়োজন হয় না, বিশ্বাস করতে গেলে সমাজ ক্ষুব্ধ হয়— সেখানে নারী রাজসুখ পেলেও সম্মান ও মানুষের মর্যাদা কোনও দিনই পাবে না। সেই জন্যে, আত্মমর্যাদা রক্ষা করবার জন্যে একটি চরম সত্যক্রিয়ার শপথ গ্রহণ করে নিজের শুচিতা প্রমাণ করলেন; কিন্তু রামের কাছে, সমাজের, জীবনের কাছে আর কোনও প্রার্থনা বা প্রত্যাশা তাঁর নেই। সারাজীবন ধরে অনন্যচিত্তে যে রামকেই তিনি চিন্তা করেছেন, ভালবেসেছেন, অনুগমন করেছেন রাম তাঁর কী মূল্য দিলেন? পৃথিবী সীতাকে নিয়ে যাওয়ার পরে রাম ‘ক্রোধশোকসমাবিষ্ট’ হয়ে পৃথিবীকে বললেন: ‘আনয় ত্বং হি তাং সীতাং মত্তো হং মৈথিলীকৃতে— সেই সীতাকে তুমি নিয়ে এস, মৈথিলীর জন্যে আমি উন্মাদ।’ (৭:৯৮:৯) 

বিরহে তাঁর কষ্ট হয়ে থাকতেই পারে, আর বিবাহও তিনি করেননি কিন্তু তার তো একটা কারণ পৃথিবী সীতাকে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই সীতার সম্পূর্ণ নির্দোষিতা প্রমাণিত হয়েছিল, ফলে সর্বজনসমক্ষে রাম তো এক রকম অপরাধী প্রতিপন্ন হয়েইছিলেন। অন্তত কতকটা অপ্রতিভ তো হওয়ার কথাই। বিশেষত, বাল্মীকির অত গুরুতর শপথবাক্যের পরে তো তিনি অগ্নিপরীক্ষার আজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে পারতেন। করেননি বলেই বাল্মীকি সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বললেন। করেননি, এই ক্ষোভেই সীতা জীবনে এমনকী রাম সম্বন্ধেও সম্পূর্ণ বীতস্পৃহ হয়ে পৃথিবীতে আশ্রয় চাইলেন। এর পরে রামের বিরহকে খুব গুরুত্ব দেওয়া যায় না। সীতাহরণের পরে রাম এত উন্মাদের মতো আচরণ করেছিলেন যে ছোট ভাই লক্ষ্মণ তাঁকে বারে বারে আতিশয্য প্রকাশ থেকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন। অথচ যাঁর অত বিরহোন্মাদ তিনি দীর্ঘ অদর্শনের পর প্রথম দেখেই সীতাকে বললেন, ‘তোমার জন্যে যুদ্ধ করিনি, নিজের সম্মানের জন্যেই করেছি। যাও তুমি, তুমি সচ্চরিত্রই হও অসচ্চরিত্রই হও, তোমাকে ‘ভোগ’ করতে পারিনে, তুমি কুকুরে চাটা ঘি। লক্ষ্মণ ভরত যাকে হয় গ্ৰহণ কর।’ মনে রাখতে হবে সেদিন লঙ্কায় সীতার চরিত্রে রাম ছাড়া আর কেউই সন্দেহ করেনি রাম ছাড়া। অর্থাৎ লোকাপবাদের কথা ওঠবার আগেই রাম নিজে সর্বপ্রথমে সীতাকে অপবাদ দিলেন। অসহায় নারীকে পরপুরুষ স্পর্শ করেছে, এই হল অমার্জনীয় অপরাধ। সীতা বললেন, ছেলেবেলা থেকে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি, তুমি কি চেননি আমাকে? বললেন, আমার মতে তো তুমিই একমাত্র; যে দেহটার ওপরে আমার কর্তৃত্ব ছিল না সেটাই কি এত বড় হয়ে উঠল? মনের শুচিতা ও দেহের শুচিতাকে সমাজ সেদিনও পৃথক করে বিবেচনা করেনি, আজও করে না। তাই অশোকবনে থাকার সময়ে ইন্দ্র এসে সীতাকে দিব্য ক্ষীর খাইয়ে গেলেন, যাতে রাবণের অন্ন তাঁকে না গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু ভবভূতির ভাষায় ‘যথা স্ত্রীণাং তথা বাচাং সাধুত্বে দুর্জনো জনঃ— সংসারে লোকে বাক্য ও নারীর শুচিতা মানতে চায় না।’ 

ওই যে পতি দেবতা, পতি নারীর একমাত্র গতি, পতির স্ত্রীকে সন্দেহ করবার অবাধ অধিকার এবং সে সন্দেহবশে স্ত্রীকে ত্যাগ করবার অধিকার, জনসাধারণের নারীর চরিত্রে সন্দেহ করবার এবং সে সন্দেহবশে নিরপরাধা নারীকে দণ্ড দেওয়ার অধিকার— এ সবই এসেছে অভিপৌরাণিক যুগের সামাজিক মূল্যবোধ এবং নারীর স্থান নিরূপণের একতরফা অধিকার থেকে। লক্ষণীয় যে, লঙ্কায় সীতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে দেওয়া হয়নি। প্রশ্নও করা হয়নি তাঁর আচরণ সম্বন্ধে। তাঁর একমাত্র অপরাধ রাবণ হরণ করবার সময়ে তাঁকে স্পর্শ করেছিল। পরপুরুষের স্পর্শ তখন এতবড় অপরাধ হয় যখন নারী একান্ত ভাবে অন্তঃপুরচারিণী হয়ে ওঠে। একটিমাত্র পুরুষ— স্বামী— ছাড়া অন্য কারও সঙ্গ তার পক্ষে তখন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তার বিচারের পদ্ধতি হল: নির্দোষিতা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত ধরে নেওয়া হবে সে যে দোষী। সমাজের অনুরূপ কোনও একনিষ্ঠতার দাবি পুরুষের কাছে নেই। এবং নারী একনিষ্ঠতা, শুচিতা দিয়েও সমাজে সসম্মানের আসন অর্জন করতে পারে না। আমরণ পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। 

নারীর অবস্থার এই অবনমন রামায়ণ-এ অত্যন্ত স্পষ্ট। কাহিনির মধ্যে অন্তলীন হয়ে আছে পূর্বতন যুগে নারীর কতকটা স্বাধীন আচরণ যেমন শবরী একাকিনী আশ্রমে বাস করেন। কিন্তু তার পাশাপাশি দেখি গৌতম অহল্যাকে মর্মান্তিক শাপ দেন। অর্থাৎ নারীর সামান্যতম স্খলন সমাজ ক্ষমা করে না। যদিও পুরুষের স্খলন সম্বন্ধে সে অনেক সহিষ্ণু। 

মহাভারত 

মহাভারত-এ এ-চিত্র আরও প্রত্যক্ষ, ব্যাপক এবং নিঃসন্দিগ্ধ। যেহেতু মহাভারত-এর কলেবর রামায়ণ-এর চতুর্গুণ (রামায়ণ-এ শ্লোকসংখ্যা চব্বিশ হাজার, মহাভারত-এ এক লক্ষের কিছু কম এবং যেহেতু মহাভারত-এর রচনাকালের ব্যাপ্তি রামায়ণ-এর অন্তত দ্বিগুণ, সে জন্যে এখানে সমাজের যে চিত্রটি পাই তার পরিসর ব্যাপকতর। অতএব এর মধ্যে প্রাচীনতর কালের সমাজচিত্রও যেমন আছে, রামায়ণ-এর বহু পরবর্তীকালের চিত্রও তেমনই আছে। ফলে মহাকাব্যের কাহিনির সৃষ্টির আদিমতম যুগের— হয়তো বৈদিক যুগের অব্যবহিত পরবর্তী যুগের— যে চিত্র পাই, স্বভাবতই, তা রামায়ণ-এর চেয়ে অনেক প্রাচীন। এবং যেহেতু এর শেষতম সংযোজনটি রামায়ণ-এর শেষাংশের চেয়ে অন্তত দুশ’ (তিনশ’ও হতে পারে) বৎসর পরের, সেহেতু এতে অভিপৌরাণিক সংযোজনগুলি আরও প্রত্যক্ষ ভাবে পুরাণধর্মী। 

মহাভারত-এর আদিমতম অংশ থেকে শেষতম অংশের ব্যবধান অন্তত আটশত বৎসর; এই দীর্ঘকালের মধ্যে সমাজ তো একই অবস্থায় থাকেনি ফলে বিবর্তনের চিত্রও মহাভারত-এ স্পষ্টতর। আদি ক্ষত্রিয়কাহিনি রচনার পরে কিছু নৈতিক কাহিনির সংযোজন হয়, যেগুলি সার্বজনীন; দেশ ও কালের সীমাকে অতিক্রম করে বিরাজিত। শেষতম অর্থাৎ দ্বিতীয় সংযোজনের কর্তা ভৃগুবংশীয় ঋষিরা, এটি ব্রাহ্মণ্য সংযোজন বলে খ্যাত। নারী ও শূদ্রের অবনমনের স্পষ্টতম চিত্র পাই এই অংশে। 

আদি ক্ষত্রিয় কাহিনি যখন গাথারূপে রচিত হয় সেই প্রাচীন যুগে নারীর কতকটা স্বাধীন সঞ্চরণের ও আচরণের কিছু চিহ্ন মহাভারত-এ রয়ে গেছে। গান্ধারী বারে বারে ধৃতরাষ্ট্রকে অনুযোগ করছেন, ধিক্কার দিচ্ছেন, বলছেন দুর্যোধনকে শাসন করতে, শাসন না মানলে ত্যাগ করতে; ধৃতরাষ্ট্র নিজে যে পন্থাকে ন্যায় বলে বিবেচনা করেন তার অনুসরণ করছেন না— কাপুরুষতা ও অন্ধ পুত্রস্নেহের কারণে। (২:৭৫:৮-১০; ৫:১২২:৯)। প্রকাশ্য রাজসভায় স্বামীকে ভর্ৎসনা করে সমস্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের জন্যে তাঁকে দায়ী করছেন। এখানে প্রচলিত অর্থে তিনি পতিব্রতা স্ত্রী নন। নারী হয়ে কৃষ্ণকে প্রকাশ্যে অভিশাপ দিচ্ছেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তিনি নিবারণ করতে পারতেন অথচ করেননি বলে সবংশে নিধনের শাপ দিলেন তাঁকে। (১১:২৫:৪২) কুন্তী প্রচলিত অর্থে স্নেহময়ী জননী, কিন্তু, যখন তাঁর মনে হল পুত্রেরা ক্ষত্রিয়োচিত আচরণ করছে না, তখন তিনি বিদুলার উপাখ্যানটি কৃষ্ণের মুখে বলে পাঠালেন, যে উপাখ্যানে বিদুলা তাঁর পুত্র রাজা সঞ্জয়কে ক্লীবোচিত নিষ্ক্রিয়তার জন্যে ধিক্কার দিচ্ছেন। ৫:১৩২-১৩৫) দ্রৌপদী তাঁর স্বামী স্বয়ং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে জীবনের নৈতিক, রাষ্ট্রিক ও দার্শনিক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে প্রচণ্ড তর্ক করেছিলেন। (৩:৩৭, ৩০, ৩২, ৩৭) প্রচলিত অর্থে এবং পরবর্তী অনুশাসনের দৃষ্টিতে পতিব্রতার উপযুক্ত আচরণ এটা নয়। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সঙ্গে কুন্তী যখন অরণ্যবাসের বাসনা জ্ঞাপন করলেন তখন পুত্রদের কোনও যুক্তি ও অনুরোধ তিনি মানেননি। (১৫:১৬-১৭) যদিও শাস্ত্র বলে, ‘রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রাঃ,—বার্ধক্যে নারীর রক্ষা করবে পুত্ররাই।’ দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে আশ্রমে রেখে চলে গেলেন। কয়েক বৎসর পরে শকুন্তলা বালকপুত্রটিকে নিয়ে রাজসভায় এসে প্রচুর কটুবাক্য বলে রাজাকে ভর্ৎসনা করলেন। (১:৬৯:১-২৭)। নারীর মুখে পুরুষের প্রতি এত কঠিন ধিক্কারবচন ব্রাহ্মণ্য সংযোজনে অকল্পনীয়। 

মহাভারতে নারী সোমপান করেন; (১৫:১৭:১৭) প্রকাশ্যে চলাফেরা করেন এবং নিজেদের সম্বন্ধে বহু সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেন। পিতৃমতী কন্যা পিতার অনুমতি ব্যতীত পুরুষের সঙ্গে মিলিত হন (শকুন্তলা, সত্যবতী এবং আরও অনেকেই); প্রয়োজন হলে নিজের ঈপ্সিত পুরুষটিকে পাওয়ার জন্যে প্রকাশ্য রাজসভায় পিতা রাজার সঙ্গে তর্ক করে নিজের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করেন, যেমন সাবিত্রী। ভীষ্ম যখন অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকাকে হরণ করে আনেন তখন অম্বা তাঁকে জানান যে তিনি শাল্বরাজকে কামনা করেন। শুনে ভীষ্ম তাঁকে শাল্বের কাছে পাঠান। পরবর্তীকালের নারী সাহসই পেত না নিজের গোপন প্রেমের কথা পরপুরুষকে জানাতে; এবং সে পুরুষও তার প্রেমের মর্যাদা দিত না। পাণ্ডু কুন্তীকে বলেন ঋতুকালে নারী যে কোনও পুরুষের সঙ্গে সহবাস করতে পারে, তাতে কোনও দোষ নেই। (১:১১৩:২৫-২৬); এবং কুন্তী পর্যায়ক্রমে তিনজনের সঙ্গে মিলিত হন। দময়ন্তীকে পরিত্যাগ করে নল যখন চলে যান এবং দীর্ঘকাল যখন তাঁর সন্ধান পাওয়া যায় না তখন, বয়ঃপ্রাপ্ত দুটি সন্তানের জননী দময়ন্তী অসংকোচে মা-কে বলেন নলের বিরহে তাঁর পক্ষে জীবনধারণ করা সম্ভব নয় (৩:৫৩-৭৮), অতএব পুনর্বার যেন দময়ন্তীর স্বয়ম্বর আহ্বান করা হয়। 

পরের যুগে এমন একটা ব্যাপার কল্পনাও করা যায় না। কচ যখন দেবযানীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন তখন দেবযানী তাঁকে শাপ দেন। সে শাপ ফলে যায়, এর দ্বারা মহাভারত-কার যেন বলছেন এ শাপ দেওয়ার অধিকার দেবযানীর ছিল। পরে শর্মিষ্ঠার বিবাহের যৌতুকরূপে সে যযাতির গৃহে আসে এবং সেখানে নিজের অনুরোধক্রমে যযাতির গোপন প্রেমিকা ও তাঁর সন্তানের জননী হয়। (১:৫৯) পরে শর্মিষ্ঠা যখন সব জানতে পারে তখন দেবযানী যযাতিকে মিথ্যাবাদী ও মূর্খ বলে তিরস্কার করে। রুরুর প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে প্রমদ্বরা তাকে বিবাহ করেন। হিড়িম্বা ভীমসেনকে সম্মত করান তাঁর প্রেম গ্রহণ করতে ও তাঁকে বিবাহ করতে। তেমনই উলূপী ও চিত্রাঙ্গদাও উপযাচিকা হয়ে অর্জুনকে প্রেম নিবেদন করেন, এঁদের বিবাহ করেন অর্জুন কিন্তু ঊর্বশীকে প্রত্যাখ্যান করেন। নারী স্বয়ং প্রেমপ্রার্থিনী হয়ে পুরুষকে যুক্তি ও মিনতির দ্বারা সম্মত করাচ্ছে— এ চিত্র পরে বিরল হয়ে আসে। প্রথম যুগের রচনায় পুরুষ যখন নারীর প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে প্রার্থনা জানায় তখন নারী নিজের শক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শর্ত স্থাপন করে এবং পুরুষ তা স্বীকার করে; সত্যবতী, গঙ্গা, শকুন্তলা এর দৃষ্টান্ত। কৌরবদের মধ্যে নারীর বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল এমন কথাও শুনি দ্রৌপদীর বিবাহের সময়ে বাদপ্রতিবাদে। (১:১২২:৭) জটিলা এবং বাক্ষীও বহুপতিকা ছিল এমন উল্লেখ আছে। (১:১৯৬:১৪-১৫) নারী নিজের অভিরুচিমত কুমারী থেকে পস্যা করতে পারত তার দৃষ্টান্তও আছে। সিদ্ধা, শিবা (৫:১০৯:১৯) এবং শাণ্ডিলের তাপসী কন্যার (৯:৫৪:৬-৮) উল্লেখই তার প্রমাণ। পরে নারীর এ অধিকার সম্পূর্ণ প্রত্যাহৃত হয়। ঋষি অত্রির স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করে তপস্যা করতে যান। তাঁর তপস্যায় প্রীত শিব তাঁকে সন্তানের বর দেন এবং তিনি সেখানেই শুধুমাত্র দৈব-বরেই সন্তানবতী হন। (১৩:১৪ ) 

ব্রাহ্মণ সংযোজনে যেখানে নারী সর্বতো ভাবে গৌণ এবং পুরুষের অধীন, পূর্বতন অংশে পড়ি, যে প্রলুব্ধ করতে আসে সতী স্ত্রীর অশ্রু অগ্নি হয়ে তাকে দগ্ধ করে। (১:১৮২:৬) এতে সতীত্বের মাহাত্ম্য ঘোষণার সঙ্গেই আছে, যে কোনও নারীকে নির্বিচারে ভোগ-অধিকারের অস্বীকৃতি, যা পরে তেমন ভাবে আর থাকেনি। তবুও, পূর্ববর্তী অংশে তার অশ্রুর অগ্নিতে পরিণত হওয়ার অপেক্ষা নেই, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর প্রেমেরই সে শক্তি আছে; যে ব্যাধ দময়ন্তীকে কামনা করেছিল সে দময়ন্তীকে আক্রমণ করতে উদ্যত হওয়ামাত্রই ভস্মে পরিণত হল। এ নারী শক্তিমতী, এ অশ্রুপাত করে না, অন্যায়ের সামনে ক্রোধে জ্বলে ওঠে। সৈরিন্ধ্রীরূপিণী দ্রৌপদী কামুক কীচককে পদাঘাত করে, অপরাধীর দণ্ডের জন্যে অতি প্রাকৃতের প্রতীক্ষা করে না, অশ্রুপাতও করে না। (৪:১৬:১৯-২০) নারীর চরিত্র ও আচরণ নিয়ে শাস্ত্ৰ যেখানে বহু নির্দেশ দিয়েছে সেই অংশে দৈবশক্তিতে দেবতার মধ্যস্থতায় অপরাধী দণ্ডিত হয়েছে; তার আগে অসংযত কামুকের প্রলোভন প্রতিহত করেছে নারী নিজেই উদ্যত ক্রোধ ও ঘৃণা দিয়ে তর্ক করেছে, যুদ্ধ করেছে, অভিশাপ দিয়েছে, ভর্ৎসনা করেছে, পদাঘাত করেছে আত্মরক্ষার জন্যে। 

মহাভারত-এ কামনায় প্রণোদিত হয়ে নারীপুরুষের মিলনের বিরুদ্ধে বিস্তর নিষেধ রয়েছে। বিবাহ ক্রমে ক্রমে প্রেমের একমাত্র আশ্রয়ভূমি হয়ে উঠল; কন্যা আর বেদের অনুশাসনে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিজের রুচিমত সঙ্গী বেছে নেয় না— ‘স্বয়ং সা মিত্রং বনুতে জনেচিৎ নির্দেশ মেনে’; বরং কন্যাকে এখন পিতা দান করেন তাঁর রুচিমত পাত্রে। ব্যাপারটা ব্যক্তিগত থেকে কুলগত হয়ে উঠছে; ধর্মশাস্ত্রও বলেছে, কুলেই প্রদান করা হয় কন্যাকে। অথচ পূর্বতন অংশে বারবার দেখছি প্রেমে নারীর স্বাতন্ত্র্য ছিল, আপন জীবনসঙ্গীকে সে নির্বাচন করতে পারত, পুরুষের মতোই প্রেমে, প্রেমনিবেদনে এবং প্রেমাস্পদকে নিজের অনুকূল করার চেষ্টা করার অধিকার তার ছিল, এর জন্যে সে নিন্দিত হত না। স্বয়ং ভীষ্মও অম্বার প্রেমের কথা শুনে তাকে ধিক্কার দেননি। 

ব্যভিচারের অপরাধে নারী পুরুষের সমান দণ্ডের কথা দু-একটি স্থলে দেখা যায়; (১২:১৬৫:৬৩) এমনকী ব্যভিচারে নারী নির্দোষ, কারণ পুরুষ বলাৎকার করলে নারী অসহায় এমন কথাও আছে। (১২:২৬৫:৪০) মহাভারত-এর প্রথম অংশে এমন বহু ব্যভিচারের কাহিনি আছে যার সম্বন্ধে বিচার বা দোষারোপ নেই, যেন তথ্যই পরিবেশিত হচ্ছে শুধু। এমনই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নরনারীর মিলনের ফলে মহাভারত-এর বহু মুখ্য নায়কেরই জন্ম — বেদব্যাস, ভীষ্ম, কর্ণ, পঞ্চপাণ্ডব এবং বহু উপনায়কের এ ভাবেই জন্ম। এত অসংকোচ এ ঘটনাগুলির বিবরণ এবং সে বিবরণে ওই মিলনের ধর্মীয়তা প্রতিপাদনের কোনও চেষ্টামাত্রই নেই। মনে হয় এমন বহু ঘটনা লোকমুখে চলিত ছিল এবং সমাজে যে এমন ঘটনা ঘটে থাকে সে সম্বন্ধে সমাজ অবহিত ছিল। তার সমর্থন বা নিন্দা কোনওটাই প্রকট ছিল না। 

এই নিন্দা যখন উগ্র হয়ে উঠল তার আগে নারীর স্থান সমাজে অনেক মেনে গেছে; সে তখন কোনও পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি— হয় পিতার, নয় স্বামীর। কন্যা বা পত্নী ছাড়াও সমাজে নারী আছে— সেই নারীসাধারণ সম্বন্ধে স্পষ্ট, উচ্চারিত বোধটি হল: নারী নরকের দ্বার। মোহিনীরূপে দেখা দেয় সে, পুরুষের কামনার উদ্রেক করে, অতএব পুরুষ প্রলুব্ধ হলে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নারীরই। ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে ওঠার পরই তো ‘না বলিয়া পরের দ্রব্য গ্রহণ করা’-র প্রশ্ন ওঠে। ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের বহু পূর্ব হতেই এ সময়ের সূচনা, যদিও এই সময়কার মনোভাব স্পষ্ট ভাবে লিপিবদ্ধ হয় ব্রাহ্মণ্য সংযোজনেই। এই অংশে দেখি নারী অশুভ, সমস্ত অমঙ্গলের হেতু, কন্যা দুঃখের। (১:১৫৯:১১) শান্তিপর্বে মুমূর্ষু ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, নারীর চেয়ে অশুভতর আর কিছুই নেই, বৎস, নারীর প্রতি পুরুষের কোনও স্নেহমমতা থাকা উচিত নয়। (১২:৪০:১; ১৩:৪৩:২৫) পূর্বজন্মের পাপের ফলে এ-জন্মে নারী হয়ে আসতে হয়। (৬:৩৩:৩২) বা, নারী সর্পের মতো, পুরুষের তাকে কখনওই বিশ্বাস করা উচিত নয়। (৫:৩৭:২৯) ত্রিভুবনে এমন কোনও নারীই নেই যে স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য। (১২:১০:২০) এতেও বোধ হয় যথেষ্ট হল না, তাই দেবতার দোহাই পাড়া হল: প্রজাপতির ইচ্ছা যে নারী স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য নয়। (১২:২০:১৪) যে ছ’টি বস্তু এক মুহূর্তের অসতর্কতায় নষ্ট হয় তা হল: গাভী, সৈন্য, কৃষি, স্ত্রী, বিদ্যা এবং শূদ্রের সঙ্গে সম্বন্ধ (৫:৩৩:৯০) নারী একা ধর্মাচরণে অধিকারিণী, শুধুমাত্র স্বামীর সঙ্গেই সে ধর্মানুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে। (৮:৪:১৩) এইটি অবশ্য বৈদিক যুগের শেষ পর্যায় থেকেই আছে, সম্ভবত যখন থেকে উপনয়নে তার অধিকার প্রত্যাহৃত হল তখন থেকেই। এবং তাও হল আর্যরা যেহেতু প্রাগার্য নারী বিবাহ করতে থাকেন অতএব আর্যবর্ণ ছাড়া অন্য কাউকে উপনয়ন দেওয়া কার্যত বন্ধ হয়ে গেল, দু-চারটি ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও। 

বহু স্থানে সতী ও কর্তব্যপরায়ণা নারীর প্রশংসা আছে, (১:১১০ এবং অন্যত্র) তার চূড়ান্ত চরিতার্থতা হল ভক্তিতে স্বামীকে প্রসন্ন করা এবং তাঁর সন্তান ধারণ করা। কর্মনিষ্ঠ পতিব্রতা নারী হল তপস্বিনী, (১৩:১৪৬:৪৮-৫১) গৃহিণীর ভূমিকায় সার্থকতায় পুণ্য আছে এবং এ পুণ্যের প্রশংসায় মহাভারতের ব্রাহ্মণ্য অংশ মুখর। প্রাচীনতর অংশে বহু বিধবা আছে। সত্যবতী, কুন্তী এবং বহু মৃত বীরের ও কৃষ্ণের স্ত্রীদের উল্লেখ আছে, এঁরা কেউই সহমৃতা হননি; শুধু মাদ্রী একাই সহমৃতা হন এবং সেও সমাজের নির্দেশে নয়, ব্যক্তিগত অপরাধবোধে। এঁরা কেউই পুনর্বার বিবাহ করেননি, কিন্তু অম্বিকা, অম্বালিকা নিয়োগপ্রথার দ্বারা সন্তান ধারণ করেছিলেন। প্রোষিতভর্তৃকার জন্যে কঠোর নির্দেশ আছে, যাতে তার আচরণে শুধু চাপল্য নয় কোনও রকম সজীবতাও না প্রকাশ পায়। (১২:১২৩:১৬, ১৭) স্বামী কাছে থাকলে যথাসম্ভব মনোযোগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে স্ত্রী তার সেবা করবে। যে স্ত্রী মধুরভাষিণী তার প্রশংসাও যেমন আছে, (৫:৩৩:৮৬) যে পরুষভাষিণী তার নিন্দাও তেমনি আছে। (৫:৩৩:৮৪)। যে বধূর শাশুড়িকে গৃহকর্ম করতে হয় অথবা যে শাশুড়ির কোনও রকম নিন্দা করে তার পাপ হয়। (১৩:৯৩:১৩১) পতিব্রতা সতীর এমনই মাহাত্ম্য যে ধর্মব্যাধের উপাখ্যানে তপস্বীকে আসতে হল পতিব্রতার কাছে ধর্মে শিক্ষা নিতে। (৩:২০৫ ) 

পরবর্তীকালে বিবাহিতা নারী শিবিকায় আরোহণ করে যাতায়াত করতেন (১:৭৩:২১, ৮০:২১; ৩:৬৯:২৩; ১৫:২৩:১২)। লঙ্কাকাণ্ডে যুদ্ধের শেষে রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে সীতাও আসছিলেন শিবিকায়। তাঁরা পুরুষ সহযাত্রীর তত্ত্বাবধানে যাতায়াত করতেন এবং অন্তঃপুরেও বসনে আবৃত, অবগুণ্ঠিত হয়ে বাস করতেন। (৫:৮৬:১৬; ১৫:১৫:১৩) সভায় যখন আসতেন তাঁদের বসবার জন্যে স্বতন্ত্র একটি অংশ থাকত। (১:১৩৪:১২) বিবাহিতা নারী দীর্ঘদিন পিত্রালয়ে বাস করলেও সেটা নিন্দনীয় বলে গণ্য করা হত, এতে নাকি তার যশ, চরিত্র ও গুণ নষ্ট হয়ে যায়। (১:৭৪:১২) অর্থাৎ ক্রমেই বিবাহিতা নারীর একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল শ্বশুরালয়। পিত্রালয়ে দীর্ঘকাল বাস করলে নারী কলঙ্কিনী হয়। (৫:৩৯:৮০) কারণটা সহজেই অনুমান করা যায়, তেমন নারীকে স্বামী-পরিত্যক্তা বা স্বামী ও শ্বশুরকুলের অপ্রীতিভাজন বলে মনে করা হত এবং তার চেয়ে বড় কলঙ্ক কম‍ই ছিল। স্বয়ং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নারীর নিন্দা করে বলেছেন নারী হল সমস্ত অমঙ্গলের মূল; (১২:৬) ভীষ্ম বলেছেন নারীর দ্বারা বংশ কলঙ্কিত হয়; (১২:৪-৮); কৃষ্ণ বলেছেন নারী কলঙ্কিতা হলে বর্ণসংকর হয় এবং তার থেকে চূড়ান্ত সর্বনাশ হয়। (৬:২৩:৪১) 

ক্রমে ক্রমে কৈশোরের পরে নারীর বিবাহ বাধ্যতামূলক বলে গণিত হল, কুমারী নারীর কথা বড় একটা আর শোনা যায় না। কুণিগর্গের কন্যা বহুদিন তপস্যা করার পরে যখন স্বর্গে উত্তম স্থান লাভ করার জন্য দেহত্যাগ করতে উদ্যত হলেন তখন নারদ এসে তাঁকে বললেন কুমারী কন্যার জন্যে স্বর্গে কোনও সম্মানের আসন নেই, কারণ, সে অশুচি। অগত্যা ওই বর্ষীয়সী তাপসীকে বিবাহ করে তার পরে প্রাণত্যাগ করতে হল। (৯:৫২:১) ওই অধ্যায়েই আর একটি অনূঢ়া নারীর কাহিনি আছে। যৌবনে তিনি বিবাহের অনেক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন কারণ কোনওটিই তাঁর মনের মতো ছিল না। বহুদিন তপস্যা করার পরও তাঁকেও শুনতে হল অবিবাহিতা নারী অশুচি, অতএব একরাত্রির জন্য তাঁকে গালবের স্ত্রী হতে হল যাতে তিনি স্বর্গে স্থান পান। তপস্বিনী সুলভা যখন রাজা জনকের সভায় দার্শনিকতত্ত্ব আলোচনার জন্য আসেন তখন জনক নানা বিদ্রূপাত্মক কঠোর বাক্যে তাঁকে আলোচনা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। নিতান্তই জ্ঞানান্বেষণায় এসে এত রূঢ় কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি পরদিনই সভা ত্যাগ করে চলে যান। (১২:৩২০) মনে পড়ে, গার্গীর প্রশ্নে কোণঠাসা হয়ে যাজ্ঞবল্ক্যও তাঁকে নিবৃত্ত করার প্রয়াসে বলেন, অতিরিক্ত প্রশ্ন কোরো না, গার্গি, তোমার মাথা খসে পড়বে। এমন কথা কোনও পুরুষ বিদ্যার্থীকে তো জনক বা যাজ্ঞবল্ক্য বলেননি কখনও। এ-কাহিনিগুলি থেকে বোঝা যায়, প্রথমত, অবিবাহিতা নারীকে নিয়ে সমাজ স্বস্তি পেত না, বিবাহ তার পক্ষে তাই বাধ্যতামূলক হয়ে উঠল। জরৎকারু ঋষির ক্ষেত্র ভিন্ন, সেখানে তিনি বিবাহ করে পুত্রসন্তান উৎপাদন না করলে পূর্বপুরুষদের পিণ্ড-তর্পণের ব্যবস্থা হয় না, তাই তাঁর বিবাহের প্রয়োজন; তাঁর নিজের স্বর্গপ্রাপ্তির বাধা হত না তপস্যায়। বস্তুত শাস্ত্রে, সাহিত্যে আমরা বহু অকৃতদার তপস্বীর কথা পাই যাঁদের কৌমার্যের জন্যে স্বর্গলাভে কোনও ব্যাঘাত হয়নি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষিতা নারী সংখ্যায় নিতান্তই মুষ্টিমেয় ছিল বলে সহসা কোনও বিদূষী ও বুদ্ধিমতী নারীর সামনে এলে পুরুষ কিছু বিচলিত বোধ করতেন। ব্রহ্মজ্ঞানের ফল যে সমদর্শিতা সেটা তো নারী ও শূদ্রে এসে বরাবরই ঠেকে গেছে, শিক্ষিতা নারী তাই প্রতিপক্ষ পুরুষের উষ্মাই জাগাত, শিক্ষার্থিনী হয়ে এলেও পুরুষ হয়তো নিরাপদ বোধ করত না। 

নারীর কাছে সমাজের প্রত্যাশা হল সে সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী ও গৃহকর্মনিপুণা হবে স্বামী ও শ্বশুরকুলের জন্যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করবে, সন্তান, মুখ্যত পুত্রসন্তানের জন্ম দেবে। তাদের লালন এবং স্বামী ও তার আত্মীয়দের সেবা করবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা তার মন, চিন্তা, ব্যক্তিত্ব থাকবে না। সে ছায়ানুগামিনী হবে তার স্বামীর। যদিও তেমন স্ত্রীর ভাগ্যেও সন্দেহ ও লাঞ্ছনা জুটবে, এ আমরা সীতার ভাগ্য থেকেই জানি। নারীর, বিশেষত স্ত্রীর প্রতিশব্দগুলি, লক্ষ্য করলেও খানিকটা বোঝা যায় সমাজে তার স্থান কী ছিল। রামায়ণ মহাভারত-এই বর্ণনা ও সম্বোধনে প্রথম এ শব্দগুলির দেখা মেলে; পরবর্তী সাহিত্যে এই জাতীয় বিশেষণাত্মক শব্দ চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে। কয়েকটি দেখলেই বোঝা যাবে কোন সংজ্ঞায় নারী সমাজে ও সাহিত্যে আবির্ভূত— ভার্যা, যাকে ভরণ করা হয়, ভৃত্যের সঙ্গে এর পার্থক্য শুধু প্রত্যয়টিতে। এইখানেই পুরুষের জোর স্পষ্টত, নারীকে সে অন্ন জোগায়, নারীকে কারণ নিজের ভরণপোষণ অর্জন করার মতো বিদ্যা তাকে দেওয়া হত না। বৃত্তিতে বা সম্পত্তিতে তাকে অধিকারও দেওয়া হত না; তাই সে একান্তই নির্ভরশীল ছিল স্বামীর ওপরে। কামিনী, রমণী, কান্তা—শেষের দুটি শব্দ পুংলিঙ্গে ‘প্রিয়’ বোঝায়, অর্থাৎ একটি নারীর পক্ষে যে পুরুষ প্রিয় সে তারই রমণ ও কান্ত; কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে ব্যক্তিনিরপেক্ষ এই সংজ্ঞা, যেন তার ধর্মই পুরুষের তৃপ্তিবিধান করা। আর একটি প্রতিশব্দ, জায়া, যাতে পুরুষ সন্তানরূপে জাত হয়। এছাড়াও বর্ণনাত্মক সম্বোধনগুলির অধিকাংশই দেহের অনুষঙ্গ বহন করে— যেমন রম্ভোরু, সুশ্রোণী, পীনস্তনী, ইত্যাদি (আরও নিচে, কতকটা অপমানসূচক অথচ বহুলব্যবহৃত শব্দ বরারোহা, ইত্যাদিও আছে।) মুখ্যত যৌনসম্ভোগের বস্তুরূপেই নারীর পরিচয়। 

নারীকে সমাজে স্থান দেওয়ার প্রশ্নই যাতে না ওঠে এমন কতকগুলি ব্যবস্থা ছিল। যেমন দুই একটি ব্যতিক্রম বাদে সাধারণ ভাবে শিক্ষায় নারীর অধিকার ছিল না। এই সময়কার ই রচনা মনুসংহিতা। পুত্রের শিক্ষাব্যবস্থার বিধান দেওয়ার পর বলেছে, কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ, কন্যাকেও এই রকম শিক্ষা দিতে হবে এবং অতি যত্নে পালন করতে হবে। কিন্তু ঠিক তার পরেই বলা আছে, নারীর পক্ষে বিবাহ হল উপনয়ন, পতিগৃহে বাস হল গুরুগৃহে বাস এবং পতিসেবা হল বেদাধ্যয়ন। (মনুসংহিতা ২:৬৭) অর্থাৎ বিবাহ করে পতিগৃহে থেকে পতিসেবা করাই তার বেদপাঠের বিকল্প, তাতে একই ফল লাভ করবে। ফল যাই লাভ করুক না কেন বিদ্যা তো সে লাভ করল না। এটা ঠিক যে, 

পুরাকল্পে তু নারীণাং মৌঞ্জীবন্ধনমিষ্যতে। 
অধ্যাপনঞ্চ বেদানাং সাবিত্রীবচনং তথা।। 

পুরাকল্পে কিন্তু নারীদের উপবীত ধারণ, বেদ অধ্যাপনা এবং সাবিত্রী পাঠ (প্রবর্তিত) ছিল। (স্মৃতি চন্দ্রিকা, সংস্কারকাণ্ড, মহীশূর সংস্করণ, ৬২ পৃষ্ঠা) 

কিংবা হারীত ধর্মশাস্ত্র-তে পড়ি, দ্বিবিধা স্প্রিয়ো ব্রহ্মবাদিন্যঃ সদ্যোবশ্চ— নারী দু-প্রকারের, ব্রহ্মবাদিনী ও সদোবধূ। তৎসত্ত্বেও সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যের ব্রহ্মবাদিনীদের আঙুলে গোণা যায়। বাকি সবই তো বধু, যাদের পতিসেবাই হল বেদাভ্যাস। শিক্ষা ছাড়াও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ছিল না। এর ফলেও সমাজে স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে স্থান পাওয়াও তার পক্ষে কঠিন ছিল, কারণ ভরণপোষণের জন্য তাকে পরমুখাপেক্ষী হতেই হত, তা সে পিতাই হোক বা স্বামীই হোক। তৃতীয়ত, কোনও অর্থকরী বৃত্তির শিক্ষা বা ব্যবহার তার পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল; হয়তো সমাজের একেবারে নিচের স্তরের মেয়েরা কুটিরশিল্প, ইত্যাদি বৃত্তিকরী বিদ্যার চর্চা করে সংসারে সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্য করতে পারত। কিন্তু, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত স্তরে নারীর কোনও বৃত্তির কথা রামায়ণ বা মহাভারত-এ (বা অন্যত্র কোথাও বড় একটা) পাওয়া যায় না। ফলে সে পুরুষের ওপরে আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল হতে বাধ্য হত। চতুর্থত, সমসাময়িক শাস্ত্রে ও সাহিত্যে দেখি, নারীর নিজের দেহের ওপরেও কোনও অধিকার ছিল না। একমাত্র ব্যতিক্রম গণিকা, যার শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করত। তার দেহের ওপরে বেশ খানিকটা স্বাধীনতা তার ছিল এবং সে অন্নবস্ত্রের জন্যে কোনও পুরুষের দয়ার ওপরে নির্ভর করত না। যত গর্হিতই হোক তার বৃত্তি— এবং নিঃসংশয়ে তা অত্যন্ত গর্হিত ছিল— তার দ্বারা সে স্বাধীন ভাবে উপার্জন করতে পারত। 

গণিকাই হোক কুলবধূই হোক, পুরুষের মনোরঞ্জনের দ্বারাই নারীর ভরনপোষণের সংস্থান হত। মর্তের গণিকা স্বর্গের অপ্সরারূপে চিত্রিত— তাদের বিবরণ যা পাই তা থেকে সমাজে রূপোপজীবিনীর আচরণ, ভূমিকা ও স্থান জানা যায়। রামায়ণ মহাভারত-এ সর্বত্রই অপ্সরা আসে ঋষির ধ্যানভঙ্গ করতে বা অন্য ভাবে ইষ্টসিদ্ধি করতে— যেমন ঋষ্যশৃঙ্গ উপাখ্যানে। এরা রূপসী তরুণী, কিন্তু এদের ভূমিকা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়; ইন্দ্র বা অন্য দেবতারা কোনও ঋষির তপে বা যজ্ঞে অসহিষ্ণু ও বিচলিত বোধ করলে অপ্সরা পাঠিয়ে তাদের ধ্যানভঙ্গ ঘটাতেন। ইষ্টসিদ্ধি হলে পর এরা স্বর্গে ফিরে আসত। এই যে চিত্তবৃত্তিবর্জিত দেহসর্বস্ব তরুণীর কল্পনা, মোটের ওপর এ-ই ছিল নারীর কাছে পুরুষের প্রত্যাশা। সে যেন শুধুই ভোগ্যবস্তু; তা না হলে রাম উচ্চারণ করে সীতাকে বলতে পারতেন না, ‘নোৎসাহে পরিভোগায়— (তোমাকে) ভোগ করতে পারি না।’ 

নারীর এই ভোগ্যবস্তু ভূমিকা রামায়ণ মহাভারত-এ নানা ভাবে চিত্রিত আছে। প্রথমত উপাখ্যানে। অসংখ্য উপাখ্যানে নারী এই ভূমিকায় অবতীর্ণ। একটি কাহিনি উল্লেখ করা যেতে পারে: 

ঋষিকুমার গালব যযাতির কাছে এলেন। গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সংগতি নেই। তাই রাজা যদি তাঁকে অর্থ সাহায্য করেন। ঠিক সেই সময়ে যযাতির অর্থসংকট ছিল, তাই গালবকে বললেন, তুমি আমার এই সুন্দরী তরুণী কন্যা মাধবীকে নিয়ে যাও। কোনও রাজার কাছে এক বৎসরের জন্যে একে দিলে রাজা এর কাছ থেকে যে পুত্রসন্তান লাভ করবেন তার বিনিময়ে তোমাকে অর্থ দেবেন। গালব মাধবীকে নিয়ে পরপর তিনজন রাজাকে এক এক বছরের জন্যে ভাড়া দিলেন। বিনিময়ে যে অর্থ পেলেন তা দিয়ে অবশেষে তাঁর গুরুদক্ষিণার উপযুক্ত অর্থ সঞ্চিত হল। তখন তিনি মাধবীকে পিতা যযাতির কাছে এনে ফিরিয়ে দিলেন। (মহাভারত ৫:১১৮-২২) 

এ কাহিনিতে নারীর স্থান মর্মান্তিক রূপে স্পষ্ট। প্রথমত পিতা নিজে অর্থদান করতে না পেরে কুমারী কন্যাকে প্রায় গণিকাবৃত্তিতে ঠেলে দিচ্ছেন, নিজে ব্রাহ্মণকুমারকে গুরুদক্ষিণার অর্থ দেওয়ার পুণ্যটি লাভ করবার জন্যে। দ্বিতীয়ত সমাজে এমন অন্তত তিন জন রাজা পাওয়া গেল যারা সুন্দরী তরুণী কুমারীটির দেহ এক বৎসরের জন্য ভাড়া করতে দ্বিধা করেন না; পুত্রসন্তান লাভ করার কি নিষ্ঠুর হৃদয়হীন উপায়। তৃতীয়ত ব্রাহ্মণ ঋষিকুমার অনায়াসে এ কদর্য উপায়ে লব্ধ অর্থ নিলেন এবং নিজের উদ্যমে তিন জন রাজার কাছে মাধবীকে বাঁধা দিয়ে সে অর্থ সংগ্রহ করলেন। চতুর্থত, এই ভাবে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে গুরুদক্ষিণা দিতে তাঁর বাধল না। কাহিনিটির কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই ভাবে যে মেয়েটির লাঞ্ছনা ও নিগ্রহ হল যযাতি তাকে বিবাহ করতে বললেন, সে সম্মত হল না, তপস্যা করতে গেল। যযাতি স্বর্গে যাওয়ার সময়ে দেখা গেল তাঁর সঞ্চিত পুণ্যে কিছু কম পড়ছে, তখন মাধবীর পুণ্য থেকে সেটুকু পুরণ করে তিনি স্বর্গে গেলেন। সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ঐহিক পারমার্থিক সর্বপ্রকার বঞ্চনাই মাধবীর ভাগ্যে জুটল। এ সবের পশ্চাতে সমাজমানসে যে বোধটি সক্রিয় ছিল তা হল: নারী ব্যক্তি নয়, বস্তু এবং ভোগ্যবস্তু। 

এই বোধ বারে বারে প্রমাণিত হয় যখন দেখি হস্তী, হিরণ্য, রথ, অশ্ব, ভূমি, ইত্যাদির সঙ্গে নারীও যুক্ত হচ্ছে দানের তালিকায়। (১:১৯৮:১৬, ৮১; ৮১:৩৭; ২২১:৪৯; ৪:৩৪:৫; ১৫:১৪:৪ এবং অন্যত্র বহু স্থানে) এ দান বিবাহে, শ্রাদ্ধে, বিজয়োৎসবে, অতিথি আপ্যায়নে যজ্ঞে এবং সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে। অর্থাৎ নারীর দেহ ও শ্রম পুরুষের ভোগ্যবস্তু, এ নিয়ে শাস্ত্রকারদের কিছুমাত্র কুণ্ঠা নেই। এবং এ প্রথা চলে আসছিল বৈদিক কাল থেকেই। মহাভারত-এ একাধিক কাহিনি আছে যেখানে অতিথিকে আপ্যায়ন করতে গৃহস্বামী আপন স্ত্রীকে পাঠাচ্ছেন তার শয়নকক্ষে। কখনও বা অতিথির স্বরূপ পরে ধ্যানযোগে জানা যাচ্ছে যে তিনি সাক্ষাৎ ধর্ম; কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়; স্ত্রীকে পাঠাবার সময়ে (বা গুরুর অবর্তমানে শিষ্য যখন গুরুপত্নীকে অতিথির কাছে পাঠায়) তখন তো জানা ছিল না যে, অতিথি সাক্ষাৎ ধর্ম, তখন মানুষ জেনেই তো পাঠানো হয়েছিল। 

নারী যে প্রলোভন সে কথা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবার জন্য এক নারী অপ্সরা পঞ্চচূড়াকে দিয়েই বলানো হয়েছে নারীর কামবৃত্তি স্বভাবতই পুরুষের থেকে অধিক। (১৩:৩৮) অপ্সরা হল গণিকার স্বর্গের প্রতিরূপ; তাহলেও এ আখ্যান উদ্দেশ্যমূলক তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলেন, আদিকালে পুরুষ এতই ধর্মপরায়ণ ছিল যে দেবতাদের ঈর্ষা হল। তাঁরা তখন নারীর সৃষ্টি করলেন পুরুষকে প্রলুব্ধ করে ধর্মচ্যুত করবার জন্য। (১৩:৪২) বাইবেল-এ ঈভের ভূমিকা স্মরণীয়। তবু ঈভ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আদমকে প্রলুব্ধ করেনি, স্বয়ং শয়তান তাকে প্রেরণা দিয়েছিল। মহাভারত-এ নারীর স্বভাবই হল পুরুষের অধঃপতন ঘটানো। স্বয়ং দেবতারা তাঁকে এ কাজের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। 

প্রথম যুগের রচিত অংশে নারী পুরুষের সমকক্ষ না হলেও অনেক অংশে তার আচরণের স্বাধীনতা ছিল; তার চিন্তা করার ক্ষমতা এবং স্বতন্ত্র মানসিকতা স্বীকৃত হয়েছিল। অর্থাৎ তখন সে ব্যক্তি ছিল, বস্তুতে পরিণত হয়নি, যদিও তার চেতনার গভীরে ধীরে ধীরে অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল পুরুষের তুলনায় সে হীনতর জীব এবং তার ওপরে পুরুষের যেন এক বিধিনির্দিষ্ট অধিকার আছে। একটি উপাখ্যান অনুধাবন করলে এটি স্পষ্ট হয়। দ্যুতসভায় যুধিষ্ঠির যখন জুয়াতে একে একে সব সম্পত্তি, ভাইদের এবং নিজেকেও বাজি রেখে হারলেন, আর কিছুই যখন অবশিষ্ট রইল না তখন কৌরবদের প্ররোচনায় দ্রৌপদীকে বাজি রেখে খেললেন, এবং হারলেন। কৌরবদূত যখন অন্তঃপুরে দ্রৌপদীকে এ সংবাদ দিল, মনস্বিনী নারী তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘যুধিষ্ঠির কি আগে নিজেকে বাজিতে হেরেছেন, না আগে আমাকে বাজি রেখে হারিয়ে পরে নিজেকে হেরেছেন?’ অর্থাৎ আগে নিজেকে হারলে তো দ্রৌপদী তখন আর তাঁর সম্পত্তি নন। এ প্রশ্নের মধ্যে দ্রৌপদীর স্বাধীন চিন্তার পরিচয় আছে। কিন্তু ওই তেজস্বিনী নারীও অবহিত ছিলেন না যে, আগে হোক পরে হোক তাঁকে বাজি রাখার অধিকারই যুধিষ্ঠিরের ছিল না। এই ধরনের ছোটখাট উক্তি ও ঘটনার মধ্যেই ধরা পড়ে সমাজে নারীর স্থান তখনই এতটাই অবনমিত যে চেতনায় নারী অধীন হয়ে রয়েছে। 

সাবিত্রীর উপাখ্যানে নারীর পূর্বতন কিছু স্বাধীনতা দেখতে পাই। রাজা অশ্বপতি পুত্রের জন্য বর চেয়ে পেলেন তেজস্বিনী কন্যা, সাবিত্রী। সাবিত্রী যৌবনে উপনীতা হলে অশ্বপতি সেই ‘জ্বলন্তীমিব তেজসা’ কন্যাকে বললেন: 

ইদং মে বচনং শ্রত্বা ভর্তুরন্বেষণে ত্বর। 
দেবতানাং যথা বাচ্যো না ভবেয়ং তথা কুরু।। 

আমার এই কথা শুনে স্বামীর সন্ধানে ত্বরান্বিত হও, যাতে আমি দেবতাদের কাছে নিন্দিত না হই। (৩:২৭৭:২৬ ) 

তখন সাবিত্রী বৃদ্ধ সচিবদের সঙ্গে নিয়ে রথে চড়ে রাজর্ষিদের তপোবনে অন্বেষণ করতে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন সভায় নারদ অশ্বপতিকে অনুরোধ করছেন কন্যার বিবাহের জন্যে। অশ্বপতি সাবিত্রীকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবানকে তিনি নির্বাচন করেছেন। নারদ সত্যবানের নানা গুণের প্রশংসা করে বললেন তাঁর একমাত্র দোষ হল, তার পরমায়ু মাত্র এক বৎসর। শুনেই অশ্বপতি সাবিত্রীকে বললেন, তুমি অন্য কাউকে বরণ কর, সাবিত্রী। সাবিত্রী বললেন : 

সকৃদংশো নিপততি সকৃৎ কন্যা প্ৰদীয়তে।
সকৃদাহ দদানীতি ত্রীণ্যেতানি সকৃৎ সকৃৎ।
দীর্ঘায়ুরথবাপ্পায়ুঃ সগুণো নিগুণোপি বা।
সকৃদ্বতো ময়া ভর্তা ন দ্বিতীয়ং বৃণোম্যহম্।।
মনসা নিশ্চয়ং কৃত্বা ততো বাচাভিধীয়তে। 
ক্রিয়তে কর্মণা পশ্চাৎ প্রমাণং মে মনস্ততঃ।। 

(অংশবিভাগের সময়ে) ভাগ একবারই পড়ে; কন্যাকে একবারই সম্প্রদান করা হয়; ‘দান করলাম’ এ কথা একবারই বলা হয়— এ তিনটি একবার একবারই হয়। দীর্ঘায়ু অথবা অল্পায়ু হোন, গুণবান অথবা নির্গুণ হোন, একবার স্বামীকে বরণ করেছি, দ্বিতীয় কাউকে বরণ করব না। লোক মনে নিশ্চয় করে, কথায় উচ্চারণ করে বলে, পরে (সেটা) কাজে করে; এ ব্যাপারে আমার মনই প্রমাণ। (৩:২৭৮:২৫-২৭) 

এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে, পিতা অশ্বপতি এবং দেবর্ষি নারদ দুই মান্যজনের নির্দেশ পরামর্শ উপেক্ষা করে, প্রকাশ্য রাজসভায়, সাবিত্রী যাঁকে ভালবেসেছেন তাঁকেই বিয়ে করবেন এই মর্মে তর্ক করলেন এবং তাঁর মত উপেক্ষিত হল না। তিনি যাঁকে চেয়েছিলেন তাকেই বরণ করতে পারলেন। সমাজের এই স্থিতিস্থাপকতা, যা গান্ধর্ববিবাহেও স্বীকৃত, তা ক্রমেই লুপ্ত হয়ে গেল। এই সব নারীরা— সাবিত্রী, সীতা, দময়ন্তী— এঁরা গভীর প্রেমের বশে স্বামীর জন্যে যে ত্যাগস্বীকার করেছেন, পরবর্তী যুগে সেইটে পতিব্রতাধর্মের অনুশাসনে পরিণত হল কিন্তু যে শক্তিতে তাঁরা তা করতে পেরেছেন সেই মৃত্যুঞ্জয় প্রেমের সার্বভৌমতা, তার কোনও স্বতঃস্ফূর্তি স্বীকার করবার শক্তি সমাজে আর রইল না। 

ফলে পতিব্রতাধর্ম কতকগুলি যান্ত্রিক নির্দেশের সমাহারে পরিণত হল। এর খুব ভাল একটি দৃষ্টান্ত বনপর্বে যেখানে সত্যভামা দ্রৌপদীকে প্রশ্ন করছেন, পাঁচটি স্বামীকে তুমি কী উপায়ে তুষ্ট এবং বশীভূত রেখেছ? 

তব বশ্যা হি সততং পাণ্ডবাঃ প্রিয়দর্শনে। 
মুখাপেক্ষাশ্চ তে সর্বে তত্ত্বমেতদ্‌বীহি মে।। 

অয়ি প্রিয়দর্শনে, পাণ্ডবরা যে সর্বদাই তোমার বশে আছে, তোমার মুখাপেক্ষী হয়ে আছে তার রহস্যটি আমাকে বল। (৩:২২২:৫) 

সত্যভামা জানতে চাইলেন কোনও রাসায়নিক চূর্ণ বা মন্ত্র দ্রৌপদী ব্যবহার করেন কিনা। দ্রৌপদী বললেন: 

ন জাতু বশগো ভর্তা স্রিয়াঃ স্যান্মন্ত্রকারণাৎ (৩:২২২:১২) 

ওইসব যারা ব্যবহার করে, 

পাপানুগাস্তু পাপাস্তাঃ পতীনুপসৃজন্ত্যত। 
ন জাতু বিপ্রিয়ং ভর্তুঃ স্ক্রিয়াঃ কাৰ্যং কথঞ্চন।। 

তারা পাপিষ্ঠা, পাপের অনুসরণ করে স্বামীদের ক্ষতি করে। স্বামীর অপ্রিয় কিছু করা স্ত্রীর কখনও উচিত নয়। (১৬) 

পরে দ্রৌপদী বললেন কি করে তিনি পাঁচটি স্বামীকে তুষ্ট রাখেন: 

দুর্ব্যাহৃতাচ্ছঙ্কমানা দুঃখিতাদ্দুরবেক্ষিতাৎ। দুরাসিতাদ্দুরজিতাদিঙ্গিতাধ্যাসিতাদপি।।
না ভুক্তবতি নাস্নাতে নাসংবিষ্টে চ ভর্তরি।
ন সংবিশামি নাস্নামি সদা কর্মকরেম্বপি।
নিরতাহং সদা সত্যে! ভতূর্ণামুপসেবনে।
পত্যাশ্ৰয়ো হি মে ধর্মো মতঃ স্ত্রীণাং সনাতনঃ। 
সব দেবঃ স গতির্নান্যা তস্য কা বিপ্রিয়ং চরেৎ।। 

মন্দ কথা বলতে আমার শঙ্কা হয়, দুঃখিত হয়ে অপ্রিয় ভাবে দৃষ্টিপাত করতেও, অপ্রিয় ভাবে থাকতে, চলতে, ইঙ্গিত করতে, আসন গ্রহণ করতেও শঙ্কা হয়। (২০) স্বামীর এবং ভৃত্যদের ভোজন সাঙ্গ না হলে আমি আহার করি না, স্নান সমাপ্ত না হলে স্নান করি না, তিনি না উপবেশন করলে বসি না। (২৩) সত্যভামা, আমি অহরহ স্বামীদের সেবায় নিরত। আমার মতে স্ত্রীদের সনাতন ধর্ম পতিকে অবলম্বন করেই। (২৮) স্বামীই দেবতা, স্বামীই গতি, এমন যে স্বামী কে তার অপ্রিয় আচরণ করবে? (৩৫) নিজের আচরণ সম্বন্ধে দ্রৌপদী আরও বলছেন: 

অহং পতীন্নাতিশয়ে নাত্যশ্নে নাতিভূষয়ে। 
নাপি পরিবদে শ্বশুং সর্বদা পরিযান্ত্রিতা।। 

আমি স্বামীদের চেয়ে বেশি শয়ন, ভোজন ও অলংকরণ করি না। শাশুড়ির সঙ্গে তর্ক করি না, সর্বদা বশবর্তিনী হয়ে থাকি। (৩৬) 

এই দ্রৌপদী প্রাথমিক ক্ষত্রিয়কাহিনির দ্রৌপদী নন, আর কিছু না হোক স্বামীদের বিশেষত জ্যেষ্ঠ এবং শ্রেষ্ঠ ধর্মজ্ঞ স্বামী যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তিনি শুধু তর্ক করেননি, প্রচুর ধিক্কার এবং অনুযোগ করেছেন। দ্রৌপদীর এত বশংবদ রূপ মূল কাহিনিতে পাওয়া যায় না; ব্রাহ্মণ্য অংশের রচয়িতা যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য এক দ্রৌপদী সৃষ্টি করলেন। এঁর শক্তির আর একটি উৎস ওইখানেই দেওয়া আছে: 

সর্বংরাজ্ঞঃ সমুদয়মায়ং চ ব্যয়মেব চ। 
একাহং বেদ্নি কল্যাণি! পাণ্ডবানাং যশস্বিনাম্।।
একাহং বেদ্নি কোশং বৈ পতীনাং ধর্মচারিণাম্।। 

কল্যাণি! রাজার ও যশস্বী পাণ্ডবদের সমস্ত আয় এবং ব্যয় একা আমিই জানি। (৫১) ধর্মচারী স্বামীদের ধনভাণ্ডারের বিষয়ে একা আমিই জানি। (৫৪) 

এ দ্রৌপদী মূল কাহিনির, যার ব্যক্তিত্বকে নানা ভাবে সম্মান দেখিয়েছেন কবি। পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য সংযোজনের কালে শেষ দিকের ধর্মসূত্রগুলির চাপে সম্পত্তিতে নারীর কোনও অধিকার ছিল না। অবশ্য এখানেও দ্রৌপদী আয়ব্যয়ের অধিকারিণী, সে কথা বলা নেই। বলা আছে, তিনি শুধু সব কিছুর খবর এবং হিসাব রাখেন। তবু ধর্মসূত্রে যেখানে স্বামীর ধন স্বামীর প্রবাসে থাকাকালে স্ত্রী শুধু প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারেন, দান করতে পারেন না, সে যুগের পরে স্বামীরা আয়ব্যয়ের সমস্ত ব্যাপার স্ত্রীর গোচর করে রাখতেন এমন মনে করবার কোনও হেতু নেই। মনু এবং অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রকাররা এ ব্যাপারে রূঢ় ভাবেই স্পষ্টভাষী। দ্রৌপদী ক্ষত্রিয়কাহিনির নায়িকা, তিনি কিছু কিছু অধিকারে স্বামীদের কাছে সমতা ভোগ করতেন— এ সেই প্রথম যুগের নারীর বর্ণনা। তাঁর সঙ্গে তুলনা কুন্তীর, গান্ধারীর, যাঁরা প্রয়োজন মতো স্বামীর সঙ্গে তর্ক করেছেন, স্বামীকে দোষারোপ করেছেন, গঞ্জনা দিয়েছেন। অর্থাৎ এ সেই যুগের চিত্র যখনও নারীকে সর্বতো ভাবে পুরুষের বশ্যতাস্বীকার করতে হয়নি। মানুষ হিসেবে, সমাজে ব্যক্তি হিসেবে কিছু মর্যাদা তার অবশিষ্ট ছিল। 

ব্রাহ্মণ্য সংযোজন 

যাকে এখন আমরা হিন্দু ধর্ম বলি ধর্মসূত্র ততটা তার ধর্মগ্রন্থ নয়, যতটা দুটি মহাকাব্য, কুড়িটি ধর্মশাস্ত্র, আঠারোটি মহাপুরাণ এবং বেশ কয়েকখানা উপপুরাণ। এর মধ্যে রামায়ণ ও মহাভারতই আদিমতম পর্বের গ্রন্থ এবং প্রথমেই দেখেছি দুটিরই অন্তত দুটি স্পষ্ট ভাগ—মূল ক্ষত্রিয়কাহিনি ও ব্রাহ্মণ্য সংযোজন। মূল অংশ মনে হয় রচনার বেশ কয়েকশো বছর পূর্ব হতেই গাথা ও কাহিনিরূপে জনমানসে বিদ্যমান ছিল; ভাটচারণদের গানে আবৃত্তিতে লোকমুখে সঞ্চরমাণ ছিল। ফলে পরবর্তী সংযোজকরা এ অংশে বিশেষ হস্তক্ষেপ করতে পারেননি। ইচ্ছার অভাবে নয়, শুধু কাহিনির যে-রূপটি দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে কাব্যগুণে অমর হয়ে ছিল তার পরিবর্তন সাধারণ শ্রোতা মেনে নেবে না বলে। সে জন্যে যখন মূল মহাকাব্য দুটি প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তখন এই পর্যায়ের সংযোজকরা এ দুটিকে পর পর হাতে নিলেন তাঁদের বক্তব্য, বিধিনিষেধ, অনুশাসন এই জনপ্রিয় আধারে ভরে দেওয়ার জন্যে। এতে তাঁদের শ্রোতা হন সমগ্র সমাজ। রামায়ণ-মহাভারত-এর কাব্যরসে যাঁরা মুগ্ধ তাঁরা এখন বাধ্য হয়েই মহাকাব্যের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট এই সব প্রক্ষিপ্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিপৌরাণিক তত্ত্ব শুনতে লাগলেন। এগুলি অভিপৌরাণিক, কারণ পুরাণে যে সামাজিক তথা ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রচারিত তার প্রথমতম রূপ এই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিতে পাই। এগুলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারণ এগুলির মধ্যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের তদানীন্তন নবতম যে বিবর্তন পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম আখ্যা পেল তার নিজস্ব যে মূল্যবোধ তার প্রকাশ এখানে; এ মূল্যবোধের দুটি প্রধান দিক প্রথমত শূদ্রের দ্বিতীয়ত নারীর অবমূল্যায়ন। তৃতীয়ত ব্রাহ্মণের মহিমাকীর্তন, চতুর্থত সাম্প্রদায়িক ধর্মের প্রবর্তন যথা শৈব, বৈষ্ণব, ইত্যাদি। এগুলি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা এদের বক্তব্যেই স্পষ্ট এবং এগুলির অধিকাংশই সাম্প্রদায়িক পুরোহিতের রচনা যারা সকলে শিক্ষিত ছিল না। ফলে এ অংশগুলি কাব্যমূল্যে নিকৃষ্ট। 

নারীর অবমূল্যায়ন সমাজ নানা কারণে প্রয়োজনীয় মনে করেছিল। এখন যুক্তি উপস্থাপিত করা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত বহু বহিঃশত্রুর আক্রমণে তখন উত্তর ভারত বিপর্যস্ত, তাদের মধ্যে অনেকেই দস্যু, যাদের আক্রমণ থেকে নারীকে রক্ষা করা দুঃসাধ্য ছিল তাই অবরোধ প্রথা বিস্তৃতি ও কঠোরতা লাভ করে। এ যুক্তি তুর্কি আক্রমণ সম্পর্কেও দেওয়া হয়। নারী শিক্ষিত, স্বাবলম্বী হলে যতটা অসহায় হয় অশিক্ষিত পরমুখাপেক্ষী হলে অবশ্যই অনেক বেশি হয়; কাজেই এই সব কুযুক্তি নারীকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যেই সৃষ্ট। ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমাজে যখন বাড়তে লাগল তখন বিশেষ সুবিধাভোগী একটি শ্রেণি সৃষ্ট হল, যে শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্যেই নারী তার পূর্বেকার অধিকার থেকে উত্তরোত্তর বঞ্চিত হতে লাগল। এই স্বার্থ হল সম্পত্তির উত্তরাধিকারের জন্যে। পরিবারের পুরুষ কর্তা একাগ্র ভাবে কামনা করতে লাগল যাতে একমাত্র ঔরস পুত্রের জন্যেই সে তার সব সঞ্চয় রেখে যেতে পারে। এখন কি করে নিশ্চিত হওয়া যাবে পুত্রটি সত্যিই তারই ঔরস পুত্র কিনা? যদি স্ত্রীকে অন্য সমস্ত পুরুষের সাহচর্য থেকে পুরোপুরি সরিয়ে রাখার নিশ্চিত ব্যবস্থা করা যায় একমাত্র তখনই গৃহকর্তা আশ্বস্ত হতে পারে পুত্রটি তারই। এই স্বার্থপ্রণোদিত কামনা যে কতটা উদগ্র এবং উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল তার একটি প্রমাণ মহাভারতের একটি শ্লোকে আছে: 

ন চন্দ্রসূর্যৌ ন তরুং পুন্নান্নো যা নিরীক্ষতে। 
ভর্তৃবর্জং বরারোহা সা ভবেদ্ধর্মচারিণী।। 

যে নারী স্বামী ব্যতীত কোনও পুংলিঙ্গান্ত (নামের বস্তু), চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষও দর্শন করে না সেই ধর্মচারিণী। (১২:১৪৬:৮৮) 

এ অবরোধ ব্যবস্থা পর্দাপ্রথার এক চূড়ান্ত ও উন্মত্ত সংস্করণ। পুরুষের সান্নিধ্য থেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখতে পারলে গৃহস্বামী আশ্বাস পায় যে পুত্রটি তার, অতএব তার সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পত্তি ভোগে সে অধিকারী। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশের অনুপাতে নারী তার স্বাধীনতা হারায়। বলা বাহুল্য, এ অপচেষ্টা সর্বত্র সার্থক হয়নি— হয় না বলেই। অলংকারশাস্ত্রের অধিকাংশ উদাহরণ শ্লোকে অবৈধ প্রণয়েরই দৃষ্টান্ত। ‘জার’ ও ‘জারিণী’ ঋগ্বেদ থেকেই অসংখ্যবার ব্যবহৃত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বাৎস্যায়ন কামসূত্র রচনা করলেন, তাতে অসংকোচে পরস্ত্রী ও অনূঢ়া কুমারীকে কী ভাবে প্রলুব্ধ করে অনুকুল করে এনে ভোগ করা যায় তার অনুপুঙ্খ সবই দিলেন। কাজেই এ কথা অনুমান করলে ভুল হবে না যে কুলস্ত্রী মাত্রেই অবরোধের মধ্যে থাকলেই সতীসাধ্বী থাকত। এর ফলে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত পুরুষ স্ত্রীর জীবন বিষাক্ত করে তুলত এবং যখন আশ্বস্ত থাকত তখন নিশ্চয়ই কখনও কখনও তার যত্নে-উপার্জিত সম্পত্তি গিয়ে পড়ত স্ত্রীর উপপতি বা প্রেমিকের জারজ সন্তানের হাতে। এর ফলে, বিশেষত সুন্দরী তরুণী স্ত্রীর জীবন বিষময় হয়ে উঠল। সমাজ মানসে রামচন্দ্র যে সন্দেহের বিষ ঢেলে দিলেন, যে অন্যায় অবিচারের প্রবর্তন করলেন তার ফল এখনও অব্যাহত আছে। এখনও সন্দেহে পরিত্যক্ত অসংখ্য নারী দাসীবৃত্তি অবলম্বন করে। সন্দেহে পরিত্যাগ ছাড়াও সত্যকার পদস্খলনে পরিত্যক্তা ছিল— আরও সহজে হতে পারত এটা। তা ছাড়াও ছিল পুত্রসন্তানকামনায় পরপর বিবাহ করা— অম্বিকা, অম্বালিকা ও দাসীর গর্ভে ব্যাসের সন্তান উৎপাদন। কুন্তীর স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষদের (কাহিনিতে তারা দেবতা হয়ে উঠেছে অবশ্য) দ্বারা ক্ষেত্রজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার মধ্যে রয়েছে ওই পুরুষ বংশধরের জন্য অদম্য আকুতির ফল। 

নারীর মনুষ্যত্বের অবমাননার বহুপ্রকার ব্যবস্থা এই সময়ে শুরু হয়। যজ্ঞে দক্ষিণার তালিকায় সে আগে থেকেই ছিল; রামায়ণ-মহাভারত-এ আরও কয়েকটি কারণে নারী দান করা হত: প্রথমত, অতিথি আপ্যায়নে, যে কোনও বৃহৎ ক্রিয়াকর্মে— শ্রাদ্ধে, উৎসবে, যুদ্ধযাত্রায়, যুদ্ধজয়ে, যৌতুকে— নারী দান ও ভোগ্যসামগ্রীর তালিকায় স্থান পেল। দ্বিতীয়ত অন্যান্য ভোগ্যবস্তুর সঙ্গে সুন্দরী তরুণী নারী দান করতে পারা দাতার সামাজিক প্রতিপত্তির পরিচায়ক হয়ে উঠল; অর্থাৎ ধনী আত্মপ্রচারের জন্যে নিরপরাধ বহু নারীকে অসম্মান করতে দ্বিধা করত না। রাজঅন্তঃপুরের দাসীও রাজপরিবারের পুরুষের ভোগ্যবস্তু ছিল, এমন কাহিনিও পাই; অর্থাৎ এই দরিদ্র নারীদের শ্রমের সঙ্গে দেহও দান করতে হত। বহুপত্নীত্বেও নারীর অসম্মান ছিল এবং এ অসম্মান অনুষ্ঠিত হত পরিবারের মধ্যে, যেখানে সন্তানরা দেখত তাদের জননীর অসম্মান, এবং যেখানে বন্ধ্যা, বিগতযৌবনা এবং শ্রীহীনা বধূ জানতই যে তরুণীতরা এবং সুন্দরীতরা নারীকে এনে গৃহস্বামী পূর্বপরিণীতার সম্মান ধুলিতে লুটিয়ে দেবেন— পরিবারের বৃহৎ পরিসরে তাবৎ আত্মীয়পরিজনের সামনেই। 

পুরাণে নারীর যে চূড়ান্ত অবমাননা নির্লজ্জ অসংকোচে অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে রামায়ণ-মহাভারত-এ তার সূচনা মহাকাব্য দু’টির ব্রাহ্মণ্য প্রক্ষেপে। ক্ষত্রিয়কাহিনির নারীর যে চিত্র আগে থেকে ছিল তা যথাসম্ভব তেমনই রাখা আছে; রসোত্তীর্ণ যে সাহিত্য সমাজের স্মৃতিতে ভাস্বর, তাকে ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা তাই ব্যর্থ হত। কিন্তু ওই রসোত্তীর্ণ সাহিত্যকেই জনশিক্ষার মাধ্যমরূপে ব্যবহার করল সমাজের ব্রাহ্মণ্য মূল্যবোধের প্রবক্তারা, জনগণকে যে নানাবিধ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল ক্রমে ক্রমে তার মধ্যে মুখ্য একটি শিক্ষা: ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমহতি— স্বাধীনতায় নারীর কোনও অধিকার নেই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *