১২. নিয়তিবাদ : কারণ ও প্রভাব

নিয়তিবাদ: কারণ ও প্রভাব

প্রকৃত ব্যবহারে নিয়তিবাদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় প্রায় চল্লিশ বছর আগে। এক সপ্তাহ অনুপস্থিতির পরে আমার পরিচারিকা ফিরে এসে জানাল তার দু বছরের শিশুটির বসন্তরোগে মৃত্যু হয়েছে। যখন প্রশ্ন করলাম তাকে টিকা দেওয়া হয়েছিল কিনা, সে উদাস বৈরাগ্যের সুরে জানাল যখন ‘বসন্তে’ মৃত্যুই তার ছেলের ‘কপালে’ ছিল তখন কোনও টিকাই তার মরণকে আটকাতে পারত না। নিশ্চয়ই তার এই মনোভাব অজ্ঞানতা প্রসূত, কিন্তু আমাকে যা আঘাত করল তা হল তার এই সহজ ভাবে মৃত্যুকে মেনে নেওয়া। আর এই মেনে নেওয়া থেকে সে যে শান্তি আর সান্ত্বনা পেয়েছে সেই তথ্য।

আজ যখন কোনও অজ্ঞ কৃষক কারখানায় তৈরি সার ব্যবহার না করে তার অল্প ফসলকেই মেনে নেয়, তখন সে এই একই নিয়তিবাদী মনোভাব দ্বারা চালিত হয়— ‘এ বছর সার দিই বা না দিই ফসল কম হওয়াই কপাল।’ যা ক্ষতিকর তা হল, এই প্রকার নিষ্ক্রিয় মনোভাব প্রগতির পথ রোধ করে। সঠিক শিক্ষার সুযোগ আর অর্থনৈতিক সুযোগ দেওয়া হলে কিন্তু আধুনিক কলাকৌশল এবং তার উপকার সম্পর্কে এই বিরোধী মনোভাব অনেকাংশে লোপ পাবে।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, একটি প্রাচীন ভারতীয় পুরাকথাতে বলা হয়েছে যে পৃথিবী অবস্থান করে বহু ফণাযুক্ত দিব্য সর্প ‘বাসুকি’র মস্তকে, তাই ‘বাসুকি’ যখন তার ক্লান্ত ফণা থেকে পৃথিবীর ভার অপর ফণায় সরিয়ে নেন তখনই ভূমিকম্প হয়। আর একটি পুরাকথায় বলা হয়েছে যখন দানব রাহু চন্দ্র বা সূর্যকে গ্রসে করে তখনই গ্রহণ লাগে। প্রাক্-বিজ্ঞান যুগের মানুষের এই অনুসন্ধিৎসা তার উৎসাহী এবং কৌতূহলী মনেরই পরিচয়। সে মন তাকে প্রেরণা দিয়েছে প্রাকৃতিক ঘটনা প্রপঞ্চ, যে সব ঘটনা তার নিজের আয়ত্তের বহির্ভূত, যাকে দেখে মনে হয়, কোনও মহাজাগতিক বিপর্যয়, সেই সব অনুষঙ্গকে সঠিক ভাবে উপলদ্ধি করতে, অনুসন্ধান করতে এবং ব্যাখ্যা করতে। জ্ঞানের মাধ্যমে, অর্থাৎ জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতি এবং ভূকম্পলিখ্ যন্ত্র প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনুরূপ ব্যাখ্যাগুলি অকেজো হয়ে পড়ে; বৈজ্ঞানিক, কারণ-নির্ভর সম্পর্কের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়; এবং আকস্মিক সুযোগ থাকার অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলি আর স্বীকার করা হয় না। প্রাক্-বিজ্ঞান যুগের কৃষকেরা বৈদিক যুগে শুনাসীরীয় যজ্ঞের মাধ্যমে আর পৌরাণিক যুগে ‘ক্ষেত্রপূজা’ করে ক্ষেত্রের কর্ষণের জন্য দেবতাকে প্রসন্ন করত। এমনকী কৃষির উন্নতির জন্য ‘ক্ষেত্রপতি’, ‘হলধর’, ইত্যাদি দেবতাকেও কল্পনা করা হয়েছি।[১] বৈদিক যুগে খরার প্রতিবিধানের জন্য অনুষ্ঠিত হত কারীরী ইষ্টি, পরবর্তী পুরাণের যুগেও হত নানাবিধ পূজা। অনুরূপ ভাবে ফসল না হওয়ার কারণ হিসাবে মাটিতে বিবিধ রসায়নের ঘাটতিকে খুঁজে দেখা হত না, বরং খোঁজা হত নানা অতিলৌকিক শক্তিকে; যথাযথ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যাদের প্রসন্ন করা গেলে প্রচুর ফসলে আবার পূজকের ঘর ভরে উঠবে। আদর্শ কৃষি-খামারগুলিতে কৃষকদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সার প্রয়োগে মাটির উৎপাদনশক্তি পুনরায় জীবিত করা যায়, এর ফলে কুসংস্কার দূরীভূত হয়েছে, বহু কৃষক সার কিনতে উৎসাহী হয়েছেন। কিন্তু সেচপ্রণালী, খালের জল আর সারের ব্যবহার— এ সবের জন্যই অর্থের প্রয়োজন। আর তাই কেবলমাত্র শিক্ষার ভূমিকাও একটা সীমারেখাতে এসে থেমে যায়। অতএব যতদিন না দেশে জ্ঞানকে পরিব্যাপ্ত করার মতো সামর্থ্য হচ্ছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধাগুলি ব্যবহার করার উপায় সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে না দেওয়া যাচ্ছে— ততদিন নিয়তিবাদ অত্যন্ত দৃঢ় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাবে আত্মবিস্তার করে রাখছে তার মূল অতি গভীরে, ইতিহাসের বহু দূরে প্রোথিত হয়ে রয়েছে।

যদি বিষয়ান্তরে গিয়ে নিয়তিসম্পর্কিত ধারণার উৎপত্তি অনুসন্ধান করি তবে দেখা যায় নিয়তিবাদের উদ্ভব তিনটি মূল কেন্দ্র থেকে— জন্ম, দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু; যার মধ্যে সম্ভবত শেষতমটিই চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ। জন্ম অতীতে হয়েছে, মৃত্যু ভবিষ্যতে আসবে। কিন্তু দুর্ঘটনা, যা আমাদের জীবনকে পদে পদে অনুসরণ করে সে তো মানুষের জীবন ধারণার অন্তর্নিহিত যুক্তিবাদ বিষয়ে বিশ্বাসকে বিদ্রূপ করতে থাকে। এ সব ঘটনা তো বর্তমানের তাই এর পীড়নও বেশি। জন্মের সঙ্গে নিয়তির সম্পর্ক জড়িয়ে আছে এইখানে যে, শিশু তার পছন্দ মতো পিতামাতা কিংবা তার নিজের চারপাশের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশকে বেছে নিতে পারে না। অথচ তাকে সারাজীবন ধরে এই আকস্মিক ঘটনার প্রভাব বয়ে বেড়াতে হয়, কারণ প্রায়ই এই সব সমাপতনের ফলে তার গতিবিধির সীমা নির্দিষ্ট হয়ে যায় অথবা আকস্মিক ঘটনার ফলে তার উচ্চাশা ব্যাহত হয়। অবশেষে, প্রায় প্রতিটি মৃত্যুতেই, অপূর্ণ স্বপ্ন আর অসমাপ্ত কাজের দীর্ঘ তালিকা যেন এক নিষ্ঠুর অকাল সমাপ্তির কথা বয়ে আনে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে: যদিও যুক্তি আর বুদ্ধি তাকে প্রণোদিত করে সযত্নে নিজের জীবনের পরিকল্পনা সাজাতে আর সেই কল্পনা অনুসারে কাজ করতে। তবুও দুর্ঘটনা, ব্যাধি, দুর্ভাগ্য আর প্রিয়জন বিয়োগ অপ্রত্যাশিত ভাবে তার পরিকল্পনা বিনষ্ট করে দেয়, আর শেষ পর্যন্ত মৃত্যু এসে এই সবের উপর যবনিকা টেনে দেয়। অধিকাংশ মৃত্যুই বোধহীন মনে হয়, আর জীবন কখনওই মৃত্যুকে, অস্তিত্বে চরম নঞর্থকতাকে মেনে নিতে পারে না। তাই মৃত্যুতে মানুষকে দুর্ঘটনা আর আকস্মিকতাকে মেনে নিতে হয়, যখন সে এর সংস্পর্শে আসে তখন সে যে ভাষা ব্যবহার করে তা হল একে ‘ভাগ্য’ এই সংজ্ঞায় নির্দিষ্ট করা। কারণ, অত্যন্ত বাস্তব অর্থেই এই সব দুর্ঘটনা মানবীয় প্রচেষ্টাকে যেন বিদ্রূপ করে।

আশ্চর্যের কিছু নেই যে, অধিকাংশ পুরাকথাতেই অসংখ্য নামে ‘ময়রা’র অস্তিত্ব রয়েছে। নিয়তিবাদ একটি বহু প্রাচীন ধারণা; ‘ময়রা’ প্রাচীন দেবী এবং ক্রীট অঞ্চলের লিনিয়ার বি লেখসমূহে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকেই ‘এরিনিস’-এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। গ্রিস দেশে ডেমোক্রিটাস এই মত প্রকাশ করেছিলেন যে, জীবনের একটি সংগত ব্যাখ্যা হল অণু-বাদ। কিন্তু সেই ইউডেমোনিয়া বা হাগেন ও মানুষের আয়ত্তেই ছিল; এবং ডাইওজিনিস লেয়টিয়স বলেছিলেন যুক্তি, ভাগ্য, হাইমারমেনে এবং জেউসের সঙ্গে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। বিধাতার ধারণা ঈষৎ পৃথক এবং ক্লিনথিয়স বলেছেন যদিও বিধাতার হাত ধরে যা কিছু আসে সবই ভাগ্যনির্ধারিত তবু এর বৈপরীত্য ঘটে না। অর্থাৎ যা কিছু ভাগ্যনির্ধারিত সবই কিন্তু বিধিনির্দিষ্ট নয়।[২] এই মতবাদ ভাগ্যের মঙ্গলময় ও অমঙ্গলকারী দুটি বিধানকে আলাদা করে দেখায়। নিয়তিবাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী সমস্যাটি হল স্বাধীন ইচ্ছার ধারণা। ক্রিসিপ্সাস উভয়ের সমন্বয় করতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বিশেষ সফল হননি। ভারতীয় সাহিত্যেও সম্পূর্ণ পূর্বনির্ধারিত রূপে নিয়তিকে একক একটি ছাঁদে ফেলার প্রচেষ্টা করা হয়েছে, কখনও তাকে মানুষী প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য পূরণের সহায়ক রূপে বর্ণনা করা হয়েছে কখনও কখনও প্রচেষ্টাকে নিয়তির সহায়ক বলা হয়েছে। এই ভাবে আমরা উত্তরবৈদিক সাহিত্যেও দেখি, কিছু কিছু রচনা যেখানে নিয়তির সঙ্গে পুরুষকার অর্থাৎ স্বাধীন ইচ্ছা বা প্রচেষ্টার প্রতি স্পর্ধা বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে। পাশ্চাত্যে এই মনোভাব আরও সুস্পষ্ট ভাবে দৃঢ় ভাবে প্রকাশিত হয়েছে সিসেরো’র ডি ফাতো-তে; এখানে নিয়তিবাদকে বর্ণনা করা হয়েছে নৈতিক ভাবে পলায়নপর মনোভাব রূপে। নিয়তির বিধান আর স্বাধীন ইচ্ছা এই উভয় বিষয়ে, ভারতীয় সাহিত্যে একটি সরব দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব দেখা যায়। নিয়তির বিভিন্ন রূপকে বিভিন্ন মহিমান্বিত সংজ্ঞায় ভূষিত করা হয়েছে যেমন ‘ময়রা’, ‘হাইমরমেনে আতে’, ‘এরেনিস’, ‘নিকে’, ‘নেমেসিস’ এবং এই রকম বহু নাম। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দেবকল্পনা ‘ময়রা’, মৃত্যুর সঙ্গে সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু অন্য দিকে জন্মের সঙ্গেও তার সংযোগ রয়েছে। যে জন্ম জীবনের অপর প্রান্তসীমায় অবস্থিত, যা সম্পূর্ণ ভাবে মানুষের নিয়ন্ত্রণ রেখার বাইরে। ইলিয়াড কাব্যে ‘ময়রা’র প্রাচীনতম উল্লেখ পাচ্ছি, সেখানেই সে নিয়তিনির্দিষ্ট মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু পূর্বনির্ধারিত অবস্থা আর মানবিক শক্তির নৈতিক দায়িত্ব, উভয়ের মধ্যে যে সংঘাত তা সুস্পষ্ট হয়ে যায় ওডিসি কাব্যে, যখন জেউস বলেন যে মানুষ ভাগ্য বা দৈব নিয়ন্ত্রণের নামে যে দোষ দেয় তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, প্রকৃতপক্ষে সে তার নিজের কার্যকলাপের ফল ভোগ করে।[৩]

ভারতের প্রাচীনতম ধর্মমূলক সাহিত্য ঋগ্বেদ-এ অবশ্য নিয়তিবাদের কোনও উল্লেখ নেই। এ গ্রন্থ এক যুদ্ধপ্রিয় কর্মোদ্যোগী জনগোষ্ঠীর বিবরণী, যারা দৈব বা নিয়তির পরিবর্তে শক্তি আর মানুষী প্রচেষ্টা দিয়ে অর্থাৎ পুরুষকার দিয়ে বহু উল্লেখযোগ্য জয়লাভ করেছিল। এমনকী অন্যান্য সংহিতা আর ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিও নিয়তিবাদী নয়। অতিলৌকিক শক্তিসমূহ অর্থাৎ দেবতারা এই সব গ্রন্থে বিজয়ী আর্যদের সপক্ষে নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করতে যত্ন করেছেন, আর আর্যরা তাঁদের স্তুতি করেছে প্রশংসা করেছে, তাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ সম্পাদন করেছে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে প্রতিটি দৈনন্দিন প্রয়োজন এবং সংকটময় পরিস্থিতির উপযুক্ত যজ্ঞের কথা সুস্পষ্ট ভাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পরবর্তীকালে দর্শনের যে শাখার উৎপত্তি যজ্ঞীয় ধর্মবিধির প্রয়োজনে, সেই জৈমিনির পূর্বমীমাংসা গ্রন্থে এই সত্য স্বীকার করা হয়েছে যে যথাযথ ভাবে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের ফলে অপূর্ব বা অলৌকিক শক্তিবিশেষ উৎপাদিত হয়, যার সাহায্যে প্রার্থিত উদ্দেশ্যসাধন করা যায়। এই ভাবে যজ্ঞ আর তার ফল, উভয়ের অন্তবর্তী যে মাধ্যম সেখানেই এক অদৃশ্য শক্তির ধারণা বর্তমান রয়েছে— যে শক্তি, পূর্বকালে দেবতারা যা সম্পাদন করেছেন তাও সম্পন্ন করতে পারে। এই শক্তিকে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যাখ্যা বহির্ভূত বলা যায় না, তবে কী ভাবে যথাবিধি যজ্ঞ নিষ্পন্ন হচ্ছে তার সঙ্গেই এই শক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থে এই অপূর্ব-কে দেবতাদেরও অতিক্রমকারী শক্ত বলা যায়, এ এক বিমূর্ত অজ্ঞেয় শক্তি যা প্রকৃতপক্ষে দেবতা নিরপেক্ষ ভাবেই কাজ করে। পরবর্তীকালের নিয়তিবাদের বীজ এখানেই নিহিত, যদিও এখন পর্যন্ত এটি ব্যাখ্যাযোগ্য এবং পূর্ব-নির্ধারণযোগ্য।

আরণ্যক এবং উপনিষদ গ্রন্থাবলিতেও যথাযথ ভাবে নিয়তিবাদের কোনও ধারণা বিস্তারিত ভাবে বিবৃত হয়নি। দৈব নিয়তি, ভাগ্য, কৃতান্ত, বিধিলিপি, ললাটলিখন, প্রভৃতি শব্দ এখনও অজ্ঞাত, কিন্তু বাস্তবত এই সাহিত্যে নিয়তিবাদবিষয়ক ধারণার একটি অত্যাবশ্যক উপাদান বিদ্যমান। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় পৃথিবীতে গ্রিস, রোম, চিন থেকে ইরান এবং ভারতবর্ষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক আন্দোলন দেখা গিয়েছিল। ভারতবর্ষে এই সময় বিভিন্ন তপস্বী সম্প্রদায় যথা জৈন, আজীবিক এবং বৌদ্ধদের উদ্ভব হয়; এমন আরও বহু মতবাদের অস্তিত্ব ছিল, বুদ্ধ যাদের প্রতিনিধিদের মুখোমুখি হন এবং প্রাচীন পালি বৌদ্ধ সাহিত্যে যে সব অগণিত যোগীদের উল্লেখ আছে। দেশ তখন বিবিধ মতবাদ সমন্বিত তপস্বীর দলে পূর্ণ ছিল। সনাতন বৈদিক ধর্ম থেকে তাদের পার্থক্যের মূল কারণ ছিল বেদ ও যজ্ঞবিধিতে তাদের অবিশ্বাস। মুণ্ডক উপনিষদ-এর প্রাচীন গ্রন্থেও আমরা শুনি যে যজ্ঞ হল অনির্ভরযোগ্য তরণী।

কিন্তু এই মনোভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই দেশের ধর্মীয় বাতাবরণে কিছু ঘটনা ঘটেছিল। লৌহ-হলমুখের প্রবর্তনের ফলে, বৃহৎ বৃহৎ ভূখণ্ড কর্ষণ করা সম্ভব হচ্ছিল। ইটের কাঠামো গড়ে তোলার মতো বাস্তুবিদ্যার জ্ঞান প্রচলিত হয়েছিল, তাই ভবিষ্যৎ দুর্দিনের অপেক্ষায় অতিরিক্ত খাদ্য সঞ্চয় করা সম্ভব হচ্ছিল। আর্য-আগমনের পরবর্তী কয়েক শতক-ব্যাপী নিষ্ক্রিয়তার পরে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরায় শুরু হয়েছিল, ফলে খাদ্যের উদ্বৃত্ত এবং কুটিরশিল্পের সম্ভার সমাজের শীর্ষস্থিত কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সব মানুষ কৃষক ও শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানকে নিম্নতমহারে বেঁধে দিয়ে তাদের শ্রমকে কাজে লাগাত। বর্ষপঞ্জির হিসাব পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে, কৃষিকাজ অনেকাংশে নিশ্চিত ভাবে করা সম্ভব হয়েছিল। এবং, যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বন্যা, খরা, পঙ্গপাল, ইত্যাদির উৎপাত বাদ দিলে কৃষিতে উৎপাদিত ফসল অনেকটাই নিশ্চিত ছিল। রেশম সড়ক অনুসরণ করে বাণিজ্য প্রসারিত হয়েছিল এশিয়ার অন্যান্য অংশে এবং মুদ্রার প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যবহার প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যবিধি অনেকাংশে নিরাপদ ভিত্তি পেয়েছিল। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, এই সবের ফলে প্রত্যক্ষ উপকৃত হয়েছিলেন ধনী, বণিক, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়েরা আর পরোক্ষ ভাবে ব্রাহ্মণেরা। এবং এর ফলে প্রত্যক্ষ ভাবে নিঃ স্ব হয়ে পড়েছিল এক বৃহত্তর জনসংখ্যা, যারা ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের উৎপাদক: দরিদ্র, বেশ্যা, চাষি আর অগণ্য শূদ্র। তাদের পক্ষে জীবন হয়ে দাঁড়াল প্রকৃত অর্থে এক অভিশাপ। তাদের জন্য এক ধর্মতত্ত্ব প্রতি-উদ্ভাবন করা হল, যেখানে বলা হল জীবন এক অবিমিশি অভিশাপ, যেখান থেকে সকলেরই মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। পূর্ববর্তী কালে ঋগ্বেদ-এ যে মনোভাব দেখা গিয়েছিল, যেখানে জীবনকে বলা হয়েছে মধুর এক প্রার্থিত বস্তু, একে কামনা করা হয়েছে। এর দীর্ঘ স্থায়িত্ব উপভোগ করতে চাওয়া হয়েছে পূর্ণ ভাবে, এখন দেখা গেল তার চরম বৈপরীত্য এখানে জীবনকে বলা হল অশুভ এক শৃঙ্খল যা পুনরাবৃত্ত হতে থাকে, চরম শান্তি ও মোক্ষলাভের আগে মানুষকে তার থেকে মুক্তি পেতে হবে।

কর্মবাদের তত্ত্ব অনুসারে প্রতিটি কর্মের একটি সমান এবং আনুপাতিক ফল উৎপন্ন হয় যা ইহজন্মে অথবা পরজন্মে ভোগ করতে হয়— তা ভাল মন্দ যাই হোক, এই তত্ত্ব বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল জন্মান্তরবাদের। সম্ভবত জীবনের অসঙ্গতিগুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য মানুষ আজ পর্যন্ত যে সব সমাধান চিন্তা করেছে এটিই তার মধ্যে চতুরতম; সে দিনেও এই মতবাদ উল্লেখযোগ্য ভাবে সার্থক হয়েছিল এবং আজকের দিনেও এই মত সার্থক।

বহু যোগী গোষ্ঠী এই ‘কর্মফলবাদ’-কে নাকচ করেছেন এই বলে যে সৎকর্ম এক প্রকার উপলব্ধি নিয়ে আসে যা মোক্ষলাভের সহায়ক; কেউ কেউ, যেমন আজীবিকরা মনে করেছিলেন মানুষ যে কর্মই করুক না কেন, চুরাশি লক্ষ জন্মের পর মোক্ষ অবশ্যই আসবে অথবা আসবে না। যাই হোক, প্রধান প্রধান গোষ্ঠীগুলি কর্ম ও জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে গ্রহণ করেছিল। এই সময়ের কাছাকাছি, স্বর্গ ও নরকের তত্ত্বও দ্রুত বর্ধিত হয়েছিল যার ফলে পদানত নিম্নবর্গের ভবিষ্যৎ-চিন্তা হয়েছিল আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন। ধনীর লক্ষণীয় ভোগময় জীবনের প্রক্ষেপণ ছিল স্বর্গের দৃশ্য, যা সমসাময়িক নূতন সমৃদ্ধির সহগামীরূপে কল্পিত হয়েছিল। অপরপক্ষে নরক ছিল সেই সব অত্যাচার কুঠুরির দৃশ্য প্রক্ষেপণ, যেখানে নূতন সব শক্তির অধিকারী শাসকবৃন্দ সামাজিক ও রাজনৈতিক অপরাধীদের নিক্ষেপ করতেন। উভয়প্রকার কল্পনার মূলেই ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতা— ফলে মানুষের কল্পনার উপর এর সবল নিয়ন্ত্রণ থাকত।

যদিও তত্ত্বগত ভাবে মানুষই তার নিজ ভাগ্যের রূপকার, প্রকৃতপক্ষে কিন্তু সে তার পরিবেশের শিকার এবং সে নিজেকে বিশেষ বিশেষ বন্ধনে শৃঙ্খলিত বলেই অনুভব করেছে যে শৃঙ্খল তার ইচ্ছাকে প্রায়ই স্বাধীনতা দিত না। মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা, আর বস্তুগত প্রয়োজনের চাহিদা তার বাস্তব জীবনে খুব বেশি স্বাধীন নির্বাচনের সুযোগ রাখত না। সাধারণ মানুষের কাছে জীবন সত্যই ছিল এক অভিশাপ। তাই বর্তমান জীবনের অপ্রীতিকর অবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধ করে পরবর্তী জীবনে অপেক্ষাকৃত উন্নতির মুখ দেখার জন্য মানুষ সব কিছুই করতে রাজি থাকত।

এখানে আমরা আরও মনে করতে পারি যে উত্তরবৈদিক যুগের শেষাংশে, অর্থাৎ সংহিতা সমূহের প্রামাণ্য সংকলনে যখন অথর্ববেদ-এর স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল তখন ধর্মের ক্ষেত্রে মূল ধর্মধারা ক্রমে প্রধান হয়ে উঠেছিল। বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, ইত্যাদি প্রতিবাদী ধর্মগোষ্ঠী এই প্রত্যন্ত ধর্ম ধারাকে অধিকতর সুস্পষ্ট, কুণ্ঠাহীন ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এমনকী ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে অথর্ববেদ, পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ সমূহের মধ্যে কিছু কিছু উপাদান দেখা যায়, যেখানে ওঝাদের জাদু আর ঝাড়ফুঁক প্রান্তিক ধর্মধারার এক বলিষ্ঠ পুনরুত্থানের সংকেত পেয়েছে। মূলত প্রাণবাদী জগৎ তত্ত্বে বিশ্বাসী এই ধর্মধারার মতে মানুষের চারদিকে আছে আত্মা, যক্ষ, দানব, দৈত্য, পরী, ইত্যাদি। এই সব অধিষ্ঠাত্রী আত্মা সহজেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং একবার ক্ষিপ্ত হলে তারা ক্ষমাহীন ভাবে প্রতিশোধ নিতে থাকে। সুতরাং পবিত্র ভাবে জীবনযাপন করা দ্বিগুণ ভাবে কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। যদি কেউ তার নিজস্ব বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করে যায় এবং দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টাও করে তবু সহজেই সে এই সব অতিলৌকিক আত্মা, প্রভৃতির খেয়ালখুশির বা আক্রমণের শিকার হতে পারে। এই ভাবে অবাঞ্ছিত ভাবেও মানুষ তার চারিদিকে শক্তিমান অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অপরাধ করে বসতে পারে। তাই জীবন মানুষের কাছে এক অন্তহীন দুঃখ। তার এই দুর্দশার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ধর্মতত্ত্ববিদরা একটি মার্জিত তত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন যে, মানুষ তার পূর্বজন্মের স্বকৃত কর্মেরই ফল ভোগ করে থাকে। স্বাভাবিক অনুসিদ্ধান্ত হল এই যে, পরবর্তী জীবনে অনুরূপ দুঃখকে এড়িয়ে চলার জন্য মানুষ অনপরাধী হয়ে জীবনযাপন করবে। এবং ভারতবর্ষে যেমন অন্যান্য দেশেও অপরাধশূন্য ভাবে বেঁচে থাকার অর্থ হল সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অনুশাসকদের কোনও রূপ বিরক্তি উৎপাদন না করা। সাধারণ মানুষ তার নিজের কোনও কৃতকর্মকে যখনই ফলের সঙ্গে মেলাতে না পারে, তখনই তার নাম দেয় ‘অ-দৃষ্ট’— যাকে দেখা যায় না, অর্থাৎ নিয়তি। এই ভাবে জানা এবং অজানা শক্তিগুলির সন্তোষ বিধান করা তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, সে ভাগ্যের চরম আধিপত্যকে স্বীকার করে নেয়।

পরবর্তী যুগের বেদাঙ্গ সাহিত্যে ভাগ্যকে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে; জীবনের অসংখ্য দুঃখের আকারে এই ভাগ্যের নানা প্রতিমূর্তিকে গণনা করা হয়েছে; এবং এর বিরূপতাকে প্রশমিত করার জন্য নানা গৌণ নূতন নূতন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক প্রকার সম্পূর্ণ নূতন সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়েছে— এটা ‘প্রায়শ্চিত্ত’— সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কৃত অপরাধের জন্য, সুস্পষ্ট ভাবে সীমারেখা লঙ্ঘন করা বা ছোটখাট অনুষ্ঠানগত ত্রুটি বা শৈথিল্যের জন্য প্রায়শ্চিত্ত। বেদাঙ্গ সাহিত্যের শেষ ভাগে আর একটি সহায়ক সাহিত্য বিকাশ লাভ করেছিল, তা হল শ্রাদ্ধকল্প’ এবং ‘প্রেতকল্প’, এখানে মৃত পূর্বপুরুষদের পরলোকে উন্নীত করার জন্য বিধিনির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই সব আনুষঙ্গিক শাস্ত্র এই জন্যই গড়ে উঠেছিল যে, অন্ত্যেষ্টি ও শবানুগমন সংক্রান্ত এই সব অনুষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্য ছিল মৃত আত্মার সুখ নিশ্চিত করা এবং এই সব অনুষ্ঠান ও তার ফলসমূহ পরলোকের অজানাকে স্পর্শ করতে চায়; সুতরাং এখানে অজ্ঞ জনসাধারণকে কিছুটা জোর করেই যেন ভাবতে বাধ্য করা হচ্ছে যে যদি এই সব অনুষ্ঠান যথাযথ পালন না করা হয় তবে তাদের প্রিয়জন পরলোকে কষ্ট পাবে। সমাজে প্রচলিত নিয়তিবাদী ধারণার এটি অন্যতম ফল।

একটি লক্ষণীয় বিষয় হল, এই যে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যে অপরাধী সেই কিন্তু সন্তোষবিধায়ক ব্যক্তি নয়; সুতরাং মৃত স্বজনের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত পানভোজনের মতোই এই সন্তোষবিধান কল্পনালব্ধ বা পরোক্ষ। স্বজনবিয়োগে কাতর জীবিত আত্মীয় এখানে তার মৃত প্রিয়জনের সেবা করতে পেরে সন্তুষ্ট হন এবং অনুষ্ঠানকারী পুরোহিতের পক্ষে এখানে যথেষ্ট দক্ষিণা পাওয়া সম্ভব হয়। পুরাণগুলিতে যে শ্রাদ্ধের মাহাত্ম্য ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে পুরোহিতদের যথাযথ দক্ষিণা প্রাপ্তির এবং তাদের প্রাপ্য দ্রব্যাদির গুণ ও পরিমাণ বিষয়ে যে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা কেবল আকস্মিক নয়। এই ভাবে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে অজানা ভয়কে কাজে লাগিয়ে পুরোহিতেরা নিজের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলতেন আর সাধারণ মানুষের ধর্মাচরণকেও নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই ভাবে মৃত ব্যক্তি নয়, পরলোকে মৃত ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে জীবিতের উদ্বেগকেই কাজে লাগানো হয়েছিল, এবং অজ্ঞাত ভবিষ্যৎ অবস্থানের সম্পর্কিত চিন্তাই সমাজ থেকে তার প্রাপ্য নিষ্কাশন করে নিত।[৪]

মহাকাব্য ও পুরাণের যুগে, লোকপ্রিয় এই সব শাস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এক নূতন স্তরে, হিন্দুত্বের চরম গঠনমূলকস্তরে প্রবেশ করি। ইতোমধ্যে, বৈদিকযুগের যজ্ঞনির্ভর ধর্ম থেকে সমাজ বহু দূরে সরে এসেছে। যদিও রাজা এবং ধনবান পৃষ্ঠপোষকরা তখনও যজ্ঞানুষ্ঠান করতেন, তবুও বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়ের পূর্বেই জনসাধারণ এই সব যজ্ঞমূলক ধর্মানুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র নিরপেক্ষ দর্শকের পর্যায়ে নেমে এসেছিল, কারণ এই সব যজ্ঞব্যয়ের ভার বহন করা যেমন তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না তেমনই এগুলি ছিল দুর্বোধ্য। কৌমগত সমাজবিধি ভেঙে যাওয়ার ফলে প্রাচীন ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐক্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল; মুখ্য সমষ্টিগত যজ্ঞগুলি হত রাজাদের ও সমাজ প্রধানদের জন্য এবং তাঁদের দ্বারাই এগুলি অনুষ্ঠিত হত। গুপ্ত আধ্যাত্ম রহস্যের জ্ঞান-যোগে মোক্ষলাভ— উপনিষদের এই মতবাদ ছিল সাধারণ লোকের বুদ্ধির অগম্য। সুতরাং তাদের আশ্রয়যোগ্য মতবাদ অতি অল্পই ছিল; এই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এল মহাকাব্য পুরাণের যুগের প্রকাশমান ধর্ম যার নাম হিন্দু ধর্ম। এই ধর্ম তার মূল ভিত্তি করে গ্রহণ করেছিল কর্মফল ও জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে।

সাধারণলোকের মধ্যে নিজেদের ধর্মীয় তত্ত্বকে ফলপ্রসূ ভাবে প্রচারের জন্য মহাকাব্য ও পুরাণগুলি, পুরাকথা কিংবদন্তী ও নানাবিধ আকর্ষণীয় গল্পের অবতারণা করেছিল। মহাভারত থেকে নেওয়া এমন একটি গল্পকে বিচার করা যাক (ত্রয়োদশ-১) :

গৌতমীর পুত্র সর্পাঘাতে মারা গেল। সে তার সন্তানের অকালমৃত্যুর জন্য সাপকে দোষারোপ করল। সাপ তা অস্বীকার করল এই বলে যে ওই বালকের সময় পূর্ণ হয়েছিল, অতএব দোষ কালের। কাল শব্দের অর্থ সময় এবং মৃত্যু উভয়ই। অভিযুক্ত হয়ে কাল তখন বললেন তিনি নিমিত্তমাত্র, বালকের পূর্বজন্মার্জিত নিজকর্মই তার মৃত্যুর সময় ও উপায় নির্ধারণ করেছে।

সুতরাং চরম বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে যে মানুষের নিজ কর্মই তার জন্ম ও মৃত্যুর কারণস্বরূপ। কাল, অন্তক, যম এঁদের সবাইকেই, ভিন্ন ভিন্ন অংশে বলা হয়েছে ধর্মরাজ।[৫] অর্থপূর্ণ ভাবেই এই যুগে দেখা যায়, এই সব কল্পিত শক্তির কাছে দেবতারাও নতিস্বীকার করছেন। উদাহরণরূপে বলা যায় ভবিষ্য পুরাণ-এ দেখা যাচ্ছে বিষ্ণু, কালের আজ্ঞাবহ রূপে কাজ করছেন।[৬] এক কথায় কাল এবং অন্তক রূপে যম হয়ে দাঁড়িয়েছেন ন্যায়বিচার ও পাপের শাস্তি বিধানের প্রতিভূ।[৭] কিন্তু মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে যে অনির্দেশ্য ক্ষমতা তা মৃত্যু নয়, নিয়তি; মূল ধর্মধারা এবং প্রান্তিক ধর্মধারা উভয়ই একে সে ভাবেই স্বীকৃতি দিয়েছে। মহাকাব্য ও পুরাণে গল্পের পর গল্প এই নিয়তির অনির্দেশ্যতা ও অনিবার্যতার কথা শুনিয়েছে।

আলোচ্য সময়ে রচিত বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাবলিতে, বিশেষ করে জাতকও অবদানশতক-এ, পুনর্জন্মের বহু কাহিনি দেখা যায় যেখানে কোনও ব্যক্তিকে তার ইহজন্মের কাজের ফল হিসাবে পরজন্মে উন্নত বা অধোগামী অবস্থায় জন্ম নিয়ে পুরস্কার বা শাস্তিভোগ করতে হয়েছে। মহাকাব্যগুলিও এই প্রকার বিবরণে পূর্ণ। মুখ্য চরিত্রগুলির বিষয়ই হোক আর গৌণ চরিত্রের বিষয়েই হোক কেবল কর্মফলবাদের তত্ত্বই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যাই হোক কর্মফলের মোটামুটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ফল আছে, অস্পষ্ট ভাবে হলেও একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এ বিষয়ে পূর্বাভাস দেওয়া যায় সুতরাং একে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়তির সমান সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। কিন্তু আবশ্যিক ভাবে এটি নিয়তিবাদেরই জন্ম দেয়। এটা কী ভাবে হয়?

কর্মফলবাদের তত্ত্ব এই বিধান দেয় যে, প্রতিটি কাজের একটি সমান বা সামঞ্জস্যপূর্ণ ফল পাওয়া যায়— সে ফল ভাল হতে পারে, মন্দও হতে পারে। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি সেটি এ জন্মে অথবা পরজন্মে ভোগ করেন। কিন্তু কখনওই এই মতবাদে কোনও বুদ্ধিমান বিচারক বা নিয়ন্তার অস্তিত্বের স্বীকৃত নেই যিনি স্থির করবেন কোন কাজের কী ফল হতে পারে।[৮] বৌদ্ধ, জৈনশাস্ত্রে, ব্রাহ্মণ্য মহাকাব্য ও পুরাণে কাহিনির পর কাহিনিতে বর্ণনা করা হয়েছে কর্ম ও তার ফলের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কল্পিত কারণাত্মক বন্ধনের কথা। এই সব গল্পে কল্পনা ও আবিষ্কার শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সে গুণ যথাযথ সমানদর্শিতা বা অবিকল প্রতিরূপের বিকল্প নয়, যা থাকলে এই কর্মফলবাদ যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে উঠতে পারত। এই সব গল্পগুলি পড়লে বোঝা যায় এই তত্ত্বে প্রচুর অসংগতি এবং বৈষম্য রয়েছে, কারণ প্রায়ই দেখা যায় একই ধরনের কাজে বিভিন্ন ফল হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সম্ভবত বৌদ্ধ গল্পসাহিত্যে অধিকতর সামঞ্জস্য বা ঐক্য দেখা যায়। সৎকর্ম ও অসৎকর্ম বিষয়ক পৌরাণিক কাহিনীগুলি মনে হয় আরও বেশি বর্ণময় ও রোমাঞ্চকর। কিন্তু, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি সঙ্গতিপূর্ণ এবং একই প্রকারের সমীকরণের রীতি গড়ে তুলতে এগুলি ব্যর্থ।

সুতরাং পরিকল্পনাবহির্ভূত ভাবে কিছু ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায় এবং বোধসীমার বাইরে অবস্থিত অনির্দেশ্য শক্তিকে বলা হয়ে থাকে ‘অ-দৃষ্ট’—ভাগ্যের একটি প্রতিশব্দ।

মহাকাব্য ও পুরাণের গল্পগুলি আশীর্বাদ এবং অভিশাপের উপাখ্যানের মাধ্যমে ভাগ্যের ক্রিয়াকলাপকে স্পষ্ট করে দেখায়। কোনও ব্যক্তি, কোনও সাধু, ছদ্মবেশী দেবতা অথবা শুধুমাত্র কোনও বিপন্ন ব্যক্তির প্রতি ভাল ব্যবহার করে। পরিবর্তে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে সেই উপকৃত ব্যক্তি উপকারীকে সৌভাগ্যের দীর্ঘ জীবন, রোগমুক্তি, নিঃসন্তান ব্যক্তির জন্য সন্তানলাভ, সম্পদ, স্বর্গসুখ বা অন্য আনন্দের বর দান করে। অথবা কোনও ব্যক্তি যদি কোনও নির্দোষের ক্ষতি করে, সে তাকে কোনও বিপদ, ক্ষতি, অঙ্গহানি নরকবাস বা অন্য কোনও দুঃখের অভিশাপ দেয়। এই সব আশীর্বাদ বা অভিশাপ এই জন্মে অথবা পরজন্মে সফল হয়। আবার এগুলি, বিশেষ করে অভিশাপ অনেক সময়ই সংশোধিত, সীমিত, লঘুকৃত বা বিলম্বিত করা হয়, যদি শাপদাতাকে সকাতর অনুনয়ে সদয় করা যায়। এই সব ঘটনাতে দেখা যায় শাপ বা বর একবার উচ্চারিত হলে এক বিচিত্র রহস্যময় নিজস্ব শক্তি তাতে সঞ্চারিত হয়। যেমন যথাবিধি অনুষ্ঠিত যজ্ঞের মাধ্যমে ‘অপূর্ব’ জন্ম নেয় তেমনই শাপ বা বরের মাধ্যমে সঞ্জাত শক্তিও অপ্রতিরোধ্য। এ যেন জ্যা-মুক্ত তীরের মতো; কিন্তু কদাচিৎ একে ঈষৎ পরিবর্তিত করা যায়। এই সম্ভাবনা অভিশপ্ত ব্যক্তিকে, সেই সব ব্রাহ্মণ বা ঋষি যাঁরা কখনও তপোবল কখনও বা যথাবিহিত ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পরিবর্তন সাধনের ক্ষমতা রাখেন, তাঁদের কাছে ত্রস্ত বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে। উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে এই রূপ অভিশাপ বা বরপ্রাপ্তি অনেক অংশেই বোধের অতীত ভাগ্যের লীলা, ছদ্মবেশী দেবতা বা ঋষিদের দ্বারা এগুলি উচ্চারিত; তাই অনুরূপ ফল দিয়ে থাকে। এই সব বর বা শাপের শব্দগুলি, মানুষের মুখে উচ্চারিত হলেও এগুলি প্রকৃতপক্ষে অতিলৌকিক শক্তি সমন্বিত, দৈবী হস্তক্ষেপের একটি মাধ্যম। প্রায়ই শাপগুলি অপ্রত্যাশিত হয়ে থাকে। এগুলি কোপনস্বভাব ঋষিদের অন্যায্য, অযৌক্তিক ক্রোধ ও অহঙ্কারের প্রকাশ। এই সব সময়ে, সেগুলিকে কেবলমাত্র ভাগ্য বলেই মেনে নেওয়া সম্ভব, কারণ এই সবের পিছনে যে সব ভ্রান্তি বা কর্তব্যচ্যুতি থাকে তার অনুপাতে অভিশাপগুলি খুবই সঙ্গতিহীন অনিশ্চয়তা, আঘাত ও বিস্ময়ের এই সব উপাদান এই সব অভিশাপকে তাই অপরাধীর আয়ত্ত বহির্ভূত এক অনির্দেশ্য শক্তির, ভাগ্যের বহিঃপ্রকাশেই পর্যবসিত করে।

যদিও কর্মফলবাদ সম্পূর্ণ ভাবে ভাগ্য নির্ভর নয়, তবুও কার্যক্ষেত্রে এটি অনিবার্য ভাবে নিয়তিবাদী রূপ ধারণ করে। দেখা যাক, কী ভাবে তা হয়।

উপনিষদ ও পুরাণ-এর এই মধ্যবর্তী সময়ে, ভারতবর্ষের ধর্মমতগুলি এক বিশেষ অপরিণত অবস্থায় ছিল; ভারতবর্ষে কোনও সংগঠিত ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মপ্রতিষ্ঠান ছিল না। প্রাথমিক বৈদিক ধর্মে ছিল ধর্মমত ও অনুষ্ঠানের মধ্যে এক প্রকার সংযুক্তি গঠন করার মতো প্রয়োজনীয় মতবাদের সামঞ্জস্য। এর কারণ অনেকটাই এই প্রকার যে, ধর্মমতের অনুগামী সমাজের প্রকৃতি ছিল মূলত গোষ্ঠী নির্ভর এবং একটি অপেক্ষাকৃত দৃঢ় সংবদ্ধ সমাজ এখানে একত্রে পুরাকল্প ও ধর্মানুষ্ঠানকে অনুসরণ করত। এই বিশাল উপমহাদেশে দূরবর্তী প্রান্তে এই ধর্মমত বিস্তার লাভ করার পরে যখন জাতিসংকর সৃষ্টির ফলে এই ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐক্যের মধ্যে বিভেদ দেখা দিল এবং পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক সংগঠনগুলি অভ্যুত্থানের ফলে গোষ্ঠীনির্ভর সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, তখন এই প্রকার ধর্ম তার উৎপত্তির যথার্থ উদ্দেশ্য হারাল। প্রধান যজ্ঞগুলির অনুষ্ঠান করতে লাগলেন রাজা ও সমাজ প্রধানরা। পারিবারিক সংগঠনগুলি গৌণ ধারার গৃহ্য অনুষ্ঠান ও মঙ্গলাচরণকে আশ্রয় করল। এই গৌণ ধারা এই সময় পুনরুজ্জীবিত হল বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য মতের মাধ্যমে। এই গৌণ ধারার অন্তর্নিহিত সর্বপ্রাণবাদ মূল ও গৌণ ধর্মধারাকে বিভিন্ন প্রকার প্রেত ও আত্মার তত্ত্বে ভরিয়ে তুলল।

কর্মফলবাদের অন্তর্নিহিত অনিশ্চয়ভাবের ফলে স্বর্গ নরক সংক্রান্ত তত্ত্ব ছিল চূড়ান্ত ভাবে পৃথক। মানুষের মৃত্যুর পরে তার পরিণতি কী হয়? যদি সে পবিত্র জীবনযাপন করে থাকে আর পূর্ব জন্মের পাপভার মোচন করে থাকে, তবে সে:

ক) হয় স্বর্গে যায়; অথবা (খ) সুখী আনন্দময় পরিবেশে পুনর্জন্ম লাভ করে অথবা (গ) নরকে যায়; সেখানে অল্পকাল যন্ত্রণা ভোগের পর স্বর্গপ্রাপ্ত হয়; (ঘ) যদি পার্থিব বন্ধন আর বাসনা মুক্ত হতে পারে তবে সে ব্রহ্ম-সাযুজ্য প্রাপ্ত হয়।

যদি সে দুষ্ট, পাপী জীবনযাপন করে থাকে, তবে সে:

(ক) এই ঘৃণ্য দুষ্ট আত্মায় পরিণত হয় এবং ঊর্ধ্বলোকে ঘুরে বেড়ায়; (খ) স্বর্গে যায় ও অল্প কিছুদিন তার প্রাপ্য সামান্য সুখ ভোগের পর নরকে নিক্ষিপ্ত হয়; এবং (গ) পরজন্মে এক অকাম্য হতাশাজনক অবস্থা প্রাপ্ত হয়।

এই সব জটিলতা দ্বিগুণ হয়ে পড়ে, কারণ:

(১) ভাল ও মন্দের বিধিগুলির অস্থিতিশীল ভাব কারণ ভারতবর্ষ কখনওই ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে নীতিবাদ চর্চা করেনি; (২) কোন কাজের কোন প্রতিফল হবে সে বিষয়ে সমপূর্ণ অনিশ্চয়তা; (৩) একজন পক্ষপাতহীন সর্বজ্ঞ বিচারক যিনি নিরপেক্ষ ভাবে শাস্তি আর পুরস্কার দেবেন তাঁর অভাব; (৪) পারলৌকিক জগতের হস্তক্ষেপ এবং সর্বশেষে শাপ ও বর যদিও তার প্রাপকের আচরণ অনুসারেই নেমে আসত, তবু প্রায়ই সেগুলি অপ্রত্যাশিত আর অসঙ্গত। এইগুলি যাঁরা নিতেন তারা ভাগ্যের প্রবক্তা রূপেই কাজ করতেন।

কোনও ব্যক্তির কর্মফলের বিবিধ বিকল্প কোথাও নির্দিষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি এবং তার উৎপাদক কাজের সঙ্গে সঠিক ভাবে তার সম্পর্কও নির্ধারণ করা হয়নি। বৈদিক যজ্ঞের যথাবিধি অনুষ্ঠান করলে ‘অপূর্ব’ উৎপাদিত হয় এবং এই অপূর্ব কাম্যবস্তুর জনক। কিন্তু ‘কর্মফলবাদ’ অ-পূর্ব তত্ত্বের চেয়েও অনিশ্চিত, অবোধ্য। তত্ত্বগত ভাবে তাই বৈদিক ধর্মতত্ত্বের উপলব্ধি পৌরাণিক হিন্দু ‘কর্মফলবাদ’-এর চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়। এই যুগের নিয়তিবাদতত্ত্বের অন্তর্নিহিত বিশৃঙ্খলা অবশ্য এই যুগের ধর্মীয় বাতাবরণের পক্ষে কেবল যথাযথ নয়, এমনকী, অপরিহার্য ছিল।

জ্যোতিষবাদের চর্চাও এই যুগে নিয়তিবাদের বিকাশকে সাহায্য করেছিল। জ্যোতিষীদের সম্পূর্ণ গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল এবং এই ছদ্মবিজ্ঞান সাধারণ মানুষকে যথেষ্ট গভীর ভাবে ভীত ও প্রভাবিত করেছিল। এর উৎপত্তির অন্যতম কারণ ছিল গ্রহ-নক্ষত্রের উপর দেবত্ব আরোপ করা এবং মানুষের ভাগ্যেরউপর তাদের গতিবিধি অবস্থান ও প্রভাব সম্পর্কে সমীহপূর্ণ বিচার। যতক্ষণ পর্যন্ত মানবজীবনে প্রায় কোনও কিছুই অব্যাখ্যাত রইল না ততক্ষণ এই ভাবে অক্লান্ত বিচার চলতে লাগল। প্রত্যেকটি দেশেই জ্যোতিষের চর্চা হত। কারণ মোটামুটি ভাবে ধারণা করা যায় যে দৈনিক জীবনযাত্রা ও বিশ্বাসের সঙ্গে এর কিছু কিছু সম্পর্ক রয়েছে। এই সমীক্ষার থেকে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির সঙ্গে মানব জীবনের নিমিত্তগত সম্পর্ক রয়েছে, যদিও সিদ্ধান্তটি সমর্থনযোগ্য নয়। কালক্রমে ভারতবর্ষে জ্যোতিষ্ক নামাঙ্কিত বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল এবং রাজধানী, দুর্গ, কোষাগার, নগর তোরণ, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এগুলি প্রতিষ্ঠিত হল। এই সব দেবতার পূজার বিধি সম্বলিত শাস্ত্র তাদের বিশেষ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং ভক্তদের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুত বরদানের ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে লাগল।[১০]

বঙ্গ দেশে শনিপূজার সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব ঘটেছে প্রায় এক দশক আগে। এই অশুভকারী দেবতার ছোট একটি ছবি, থালাতে ফুল, ইত্যাদি উপাচারে সাজিয়ে একটি ঠেলাগাড়িতে রাখা হয়। মানুষ প্রণাম করে আর থালাতে প্রণামী দেয়। এই ধর্মানুষ্ঠানটির সুস্পষ্ট এক আর্থসামাজিক মূল্য রয়েছে। কারখানার শ্রমিকদের একটি বৃহদংশই অস্থায়ী শ্রমিক, তাই কাজ হারাবার আশঙ্কায় তারা সর্বদাই ত্রস্ত— যাকে পুরাকল্পের ভাষায় বলা হয় ‘শনির অশুভ দৃষ্টির সামনে পড়া’। এই অতি বাস্তব বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে স্বভাবতই তারা শনিকে পূজা করতে প্রলুব্ধ হয়। এই সমস্ত বিষয়টিরই এক প্রকৃত অমঙ্গলজনক ও করুণ এক তাৎপর্য রয়েছে; তা হল এই সব শ্রমিকদের মাইনে শনিবারেই হয়ে থাকে, আর এই ভীতিপ্রদ দেবতাটির কোপ থেকে মুক্তি পেতে তারা আতঙ্কিত ভাবে দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে চায়। এই ভাবে যে বিপদ অর্থাৎ ব্যয় সংকোচের বিরুদ্ধে এক সঙ্ঘবদ্ধ বিরোধিতার মাধ্যমে প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল তার বিরুদ্ধে দেখা যাচ্ছে এই শান্তিচুক্তির ব্যবস্থা, যার ব্যয়ভার বহন করা এই দরিদ্র শ্রমিকদের পক্ষে কঠিন। অন্যান্য গ্রহদেবতারা জীবনের অন্যান্য নিরাপত্তাহীন ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রিত করেন এবং নিজ নিজ দক্ষিণা আকর্ষণ করেন, যা মন্দিরের কোষ পূর্ণ করে অথবা যে দক্ষিণার গতি হয় পুরোহিতের থলিতে। স্বাভাবিক ভাবেই এই সব গ্রহদের ঘিরে বিশদ পুরাণ কথা আর স্তোত্র, ইত্যাদি গড়ে উঠেছে, কারণ, এই সব দেবতার নিয়ন্ত্রণে যে আতঙ্কের উদ্রেক হয় তা এক অর্থে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যে মানুষ দুর্দশার হীন গ্লানিতে ডুবে আছে তার বিরুদ্ধ মনোভাব আর প্রতিবাদ, প্রকৃত যে শত্রুর বিরুদ্ধে হওয়ার কথা সেই উৎসবে তাকেই সযত্নে আড়াল করে রাখা হয়েছে; পুরোহিত এবং শাস্ত্রকাররা এর প্রকৃত লক্ষ্যকে লুকিয়ে রাখছে। এই ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থান আন্দোলনকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং ফলস্বরূপ সাময়িক ভাবে হলেও বিকাশের পথ রুদ্ধ হচ্ছে।

মহাকাব্য ও পুরাণ যুগের ধর্মমতে ‘কর্মফলবাদ’ জন্মান্তরবাদের তত্ত্ব ছাড়াও বহু নূতন বেদ-পরবর্তী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মধ্যে আছে মন্দির, বিগ্রহ, তীর্থ, সংকল্প, শিবের মতো পবিত্রাতার স্বরূপ কল্পনা; বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের রূপ পরিকল্পনা; পরিবারগত পুরোহিতের মাধ্যমে পূজাপ্রথা এবং পারিবারিক বিগ্রহের প্রবর্তন; এবং আবহাওয়ার অধিষ্ঠাত্রী দেবতাব তত্ত্ব। আধ্যাত্ম জীবনে আশঙ্কার প্রসার হল, সামগ্রিক ভাবে ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্যে অবহেলার ফল কী হতে পারে এই সংশয়; অথবা, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মন্দিরে অধিষ্ঠিত বা পারিবারিক দেবতার প্রতি অবহেলা কিংবা ঈশ্বর ও সাধারণ মানুষের মধ্যস্থ যে পুরোহিত বিশেষ গৌরবভাজন তাঁর প্রতি অবহেলা, ইত্যাদির ফল নিয়ে আশঙ্কা। অন্তরীক্ষে অবস্থিত অদৃশ্য সব শক্তি— দানব, অতৃপ্ত প্রেতাত্মা আর অতৃপ্ত আত্মারা, এঁরা সকলেই মানুষের শান্তি আর সুস্থতাকে বিঘ্নিত করতে পারতেন। আবার অনিচ্ছাকৃত ভাবে সাধুদের কাছেও মানুষ অপরাধী হয়ে পড়ত এবং ইহ বা পরজন্মে অভিশাপগ্রস্ত হত। পুরাণগুলিতে বহু কাহিনি এ বিষয়ে সংযোজিত হল: বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মন্দিরের পুরোহিতবর্গ ছিলেন এ সবের রচয়িতা। তাঁরা বিভিন্ন মতবাদের আনুষ্ঠানিক বিধি প্রবর্তন করলেন এবং সম্ভাব্য সর্বপ্রকার দুঃখদুর্দশার প্রতিকারমূলক অসংখ্য নৈতিক কর্তব্য, সম্প্রদায়গত ভাবে এবং ঋতু-অনুযায়ী নির্ধারণ করলেন; এমনকী প্রায়শ্চিত্ত বিধিরও ব্যবস্থা করলেন।

এই প্রকার ধর্ম এক দিকে সর্বপ্রকার গার্হস্থ্য ও সামাজিক প্রথার দায়িত্ব নিয়েছিল এবং সেগুলির জন্য আচার অনুষ্ঠানের বিধান দিয়ে সন্দেহ এবং অপাত্রে দান হ্রাস করেছিল, অন্য দিকে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনযাত্রাকে অসংখ্য অনুষ্ঠানের জন্য দায়বদ্ধ করেছিল। বৈদিক শ্রৌত ও গৃহ্যকর্মের একত্রীকৃত তালিকার চেয়েও এই সব প্রথার সংখ্যা অনেক বেশি! প্রত্যেক অনুষ্ঠানে একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত পৌরোহিত্য করতেন এবং এ জন্য তিনি দক্ষিণা পেতেন। অবশ্যই এই সব উচ্চবর্ণের স্বার্থেই অজ্ঞ সাধারণ মানুষকে বিশদ ভাবে বোঝানো হত যে, ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ ভাবে দুজ্ঞেয়। কারণ তা হলেই যে সব বাস্তব ও কাল্পনিক বিপদ চারদিকে ঘনিয়ে রয়েছে, যে সব আত্মারা, আশেপাশে আক্রমণের অপেক্ষা করছে তারা মানুষের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ধ্বংস করতে চাইছে। সেই সব বিপদের প্রতিষেধক অনুষ্ঠান করার জন্য আরও আরও বেশি দক্ষিণা আদায় করা যাবে।[১১] পূর্বজন্মের যে সব অভিশাপ ইহজন্মে ফল দিচ্ছে অথবা ইহজন্মের যে সব অজ্ঞানকৃত অপরাধ পরজন্মে কষ্ট দেবে সেই সব দূর করার জন্য পুরোহিতেরা পারিশ্রমিক পাবেন।[১২] এই ভাবে ভাগ্যের এক প্রধান শক্তির প্রকাশ হল অভিশাপ। প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যেও অনুরূপ চিন্তাধারা দেখা যায়। হোমারের লেখায় এরিনিয়েস (Erinyes) প্রায়ই তাদের নিজস্ব ক্ষমতা হারিয়েছে, এবং তখন তারা কেবল কোনও অভিশাপ বা কোনও ব্যক্তির উচ্চারিত অভিশাপের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।[১৩] অভিশাপ ও আশীর্বাদের পক্ষে স্বতন্ত্র ভাবে ফলপ্রসূ হওয়ার ধারণাকে এই ভাবে নৈর্ব্যক্তিক করে দেওয়াতে সেগুলি হয়ে দাঁড়াল সমীহ উদ্রেককারী আধিদৈবিক শক্তিস্বরূপ। এর যুক্তিনির্ভর পরিণতি হল এই যে, সেগুলি কেবল মানুষী শক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে রইল না, কখনও কখনও দেবতাদেরও আয়ত্তে রইল না; এই ভাবে পুরাণ কথা, আখ্যান ও ধর্মতত্ত্ব ভাগ্যের অদৃশ্য শক্তির কাছে বশীভূত হতে হল। সাধারণ মানুষের পক্ষে তার দুঃখ, রোগ, ক্ষতি, মৃত্যু, ইত্যাদির অসংখ্য সম্ভাব্য কারণ বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠল। নিজের দুর্দশার সঠিক কারণ সে কখনওই অনুমান করতে পারল না, কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারল না ও সমস্ত ঘটনাই তার কাছে মনে হল ভাগ্যের লীলা। তার চারপাশ ব্যাপ্ত করে এই যে অতিলৌকিক শক্তির সর্বগ্রাসী জাল, তার কাছে মানুষ আত্মসমর্পণ করল। এই শক্তির নিজস্ব গতি সম্পর্কে তার জানার, অনুমান করার অথবা একে নিয়ন্ত্রণ করার বিশেষ কোনও সম্ভাবনাই তার ছিল না, কেবল খোলা ছিল বহু-বিচিত্র আচারবিধির মাধ্যমে ভাগ্যকে প্রসন্ন করার বা প্ৰায়শ্চিত্ত করার পথ।

আদর্শগত ভাবে কর্মবাদের তত্ত্বের সঙ্গে নিয়তিবাদকে যুক্ত করা যায় না, কারণ কর্মবাদ একটি কার্যকারণ সূত্রের ফলশ্রুতি। নিয়তিবাদকে সঠিক ভাবে কোনও ধর্মের সঙ্গেও যুক্ত করা যায় না, কেননা, মঙ্গলময় দেবতারা, যাঁরা এখন অধিকাংশই মোক্ষদাতা, যথাযথ পূজার দ্বারা তাঁদের প্রসন্ন করা যেত। তাঁদের তুষ্ট করার এক অপেক্ষাকৃত নূতন আবেগনির্ভর উপায় দেখা দিল— ভক্তিমার্গ। তত্ত্ব অনুযায়ী তীর্থযাত্রা এবং ব্রতরক্ষার ফলেও কেবল এ জন্মের নয় বহু পূর্ব জন্মের অজস্র পাপমোচন হয়। সুতরাং তত্ত্বগত ভাবে তারা ভাগ্যকে অস্বীকার করছে। কিন্তু স্বর্গ-নরকের ধারণা কখনওই সুস্পষ্ট রূপে ঘোষিত হয়নি, সুতরাং মৃত্যুর পরে মানুষের ভাগ্য বিষয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। ভ্রান্তি, কর্তব্যে অবহেলা এবং অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো অসংখ্য বিপদের সম্ভাবনা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। আর একটি বিষয়ে এই সময়ে পুরোহিত এবং জাদু চিকিৎসক উভয় গোষ্ঠীই মন দিয়েছিলেন। এটা হল ভবিষ্যদ্বাণী, অমঙ্গলচিহ্ন, কুলক্ষণ, স্বপ্ন, ইত্যাদি, যা কিছুকে অশুভ ঘটনার পূর্ব সূচনা বলে মনে করা হয় এবং ওই সব অমঙ্গলকে এড়ানোর জন্য যার বিরুদ্ধে ধর্মানুষ্ঠানমূলক প্রতিষেধক গ্রহণ করা উচিত।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ (৩৩ অধ্যায়) এবং ভাগবত পুরাণ (৩:১৭)-এ আমরা দুর্লক্ষণ এবং অমঙ্গল চিহ্নের দীর্ঘ তালিকা পাই। ভাগবত-এ দৈত্য হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপুর জন্মের সময় বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। মহাভারত-এর মুখ্য চরিত্রগুলির জন্মকাল এবং যখন তারা যুদ্ধযাত্রা করছে— যে যুদ্ধে তারা ঘটনাক্রমে মৃত্যু অথবা বিজয়ের সম্মুখীন হবে—সেই সময় বহু প্রকার দৈব লক্ষণের বর্ণনা রয়েছে। ইলিয়াড কাব্যে দেখা যায় ভাল এবং মন্দ লক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু বিশ্লেষণে, এই প্রকার শব্দের ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে।[১৩] অমঙ্গল চিহ্ন ও দুর্লক্ষণ সম্পর্কে এই প্রকার মনোভাবের পিছনে এই অনুমান রয়েছে যে, চোখে যা দেখা যায় এবং এর থেকে যার পূর্বাভাস পাওয়া যায়— এই দুইয়ের মধ্যে কোনও অচিন্তিতপূর্ব যুক্তিসম্মত যোগাযোগ আছে; আমাদের চোখ এই আবরণ ভেদ করে দেখতে পায় না, যেহেতু আমরা সাধারণ মানুষ মাত্র। এই যুক্তিকে দৃঢ় করার জন্য অনেক সময় সন্ন্যাসী, দেবতা ও মহাপুরুষরা লক্ষণ ও স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে থাকেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, দুর্লক্ষণতত্ত্ব উপলব্ধি করার জন্য সংগুপ্ত জ্ঞান, যোগসিদ্ধ ক্ষমতা বা অতিলৌকিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।[১৪]

ভারতবর্ষে সেই অর্থে দৈবপ্রত্যাদেশের পীঠস্থান নেই, কারণ এখানে সন্ন্যাসী ও মহাপুরুষরাই দৈবপ্রত্যাদেশ দিয়ে থাকেন। মানুষ উদভ্রান্ত মানসিক অবস্থায় বা কোনও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে পূর্বাভাসের আত্যন্তিক প্রয়োজনে, অথবা তাদের কোনও প্রচেষ্টায় বাধা পেয়ে সাধু সন্তের কাছে যায়, যাঁরা তাদের জন্য আধ্যাত্মিক উপায় খুঁজে বার করেন। আমাদের ডোডোনা (দেবীস্থান) অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মন্দিরের পুরোহিতকুল, যাঁরা শরণার্থীদের প্রার্থনা কী ভাবে পূর্ণ হবে বা আদৌ হবে কি না তা দেখাবার জন্য কোনও আনুষ্ঠানিক শুদ্ধি, ব্রত বা পুণ্য কাজের অনুষ্ঠান করতে বলেন। সম্ভাবনার সূত্র অনুযায়ী কয়েকটি ক্ষেত্রে তা সফলও হয় এবং বলার অপেক্ষা থাকে না যে, ব্যর্থতার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য প্রচুর ভুলভ্রান্তির সুযোগও থাকে। আবার কোনও অতিপ্রাকৃত কার্যকলাপে— যেখানে মধ্যবর্তী হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা (অবশ্যই রহস্যময় ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে) রয়েছে— সেই সব কার্যে বিশ্বাস জন্ম নেয়; যেহেতু এই সব ক্রিয়াকলাপ, শক্তি এবং ভবিষ্যদ্বাণীর পদ্ধতি সব কিছুই অস্পষ্ট, সে জন্য মনে করা হয় এগুলি ভাগ্যেরই বহুবিচিত্র প্রকাশ।[১৫]

কালিদাসের রঘুবংশ কাব্যে নিঃসন্তান রাজা দিলীপ কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের কাছে গিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী ও সমাধান প্রার্থনা করেন; তিনি ঋষির উপদেশ মতো আচরণ করেন ও একটি পুত্র লাভ করেন। মহাভারত-এ নারদ মুনি সত্যবানের আয়ু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন (৩:২৯); অধিকাংশ পুরাণেই এই ভাবে মহাপুরুষেরা মানুষের দুর্দশার কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের উপায় বলেছেন। এর কারণ এই যে তাঁদের পবিত্র তপোবল মহাবিশ্বের অধ্যাত্মশক্তির সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ আত্মিক যোগ স্থাপন করেছে, ফলে তাঁরা জানতে পারেন, এবং যেহেতু তাঁরা পরিণতি বুঝতে পারেন তাই তাঁরা কার্যের যথার্থ প্রতিষেধকও নির্ণয় করেন।

পুরাণসম্মত সর্বপ্রকার কুসংস্কার পোষণ করার পক্ষে মানসিক পরিবেশ ছিল একেবারে যথাযথ। জাদু এবং রহস্যময়তার প্রতি বিশ্বাসের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা হয়েছিল।[১৬] কিন্তু অনির্ণেয় এবং সর্বশক্তিমান নিয়তি সর্বব্যাপী জাল বিস্তার করেছিল। সাধারণ মানুষকে পদানত করে, তাকে পুরোহিত ও শাস্ত্রের নির্দেশ মানতে বাধ্য করেছিল। এর প্রধান অস্ত্র ছিল আতঙ্ক এবং নিয়তির অনির্ণেয়তাই তাকে আরও ভীতিকর করে তুলেছিল।

নিয়তিবাদের তত্ত্ব যখন ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠছে তখন সেই সব শতাব্দীর পর শতাব্দীতেই যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। এই সব শৈব ও বৈষ্ণব আন্দোলনেও প্রায়ই পরোক্ষ ভাবে নিয়তি তত্ত্বকে ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষ করে গোষ্ঠীগত ধর্মতত্ত্বকে মানুষের মনে দৃঢ়মূল করার জন্য যে সব আখ্যান মূলত রচিত হয়েছিল সেগুলির ক্ষেত্রে। এর মধ্যে মুসলিম ধর্মও প্রবর্তিত হয়েছে এবং কিছু মানুষ ধর্মান্তরিতও হয়েছে। কিন্তু জীবনের প্রতি যে গভীর নিয়তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল— যার ফলে মানুষ যে কোনও ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্ফালন বিনা প্রতিবাদে মেনে নিত তার কোনও পরিবর্তনই হল না।

কেউ যদি দরিদ্র, মৃত, বঞ্চিত বা দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় থাকে তবে এ-ই তার নিয়তি। বারংবার আমরা এই প্রবচন শুনতে পাই— ‘নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে’—ভাগ্যকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দীর্ঘতর কাব্যে নাটকে বা ধর্মসাহিত্যে আমরা সহস্রাধিক শ্লোকে এই একই কথা শুনি— নিয়তির সর্বোচ্চ ক্ষমতার কাছে এই নির্বিবাদ আত্মসমর্পণ। এ কথা সত্য যে, আমরা এমন বিবরণও পেয়েছি যেখানে মানুষ তার ক্ষমতার প্রমাণ করার জন্য ভাগ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু সেই যুদ্ধের পরিণতিও হয় পরাজয়। মহাভারতে কর্ণ বলেন, ‘দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মদায়ত্তং তু পৌরুষম— নীচ বংশে জন্ম ছিল ভাগ্যের অধীন কিন্তু আমার পৌরুষ আমার অধীন।’ কিন্তু মহাকাব্যের সব পাঠকই জানেন নিষ্করুণ ভাগ্যের বিরুদ্ধে কর্ণের এই যুদ্ধ অনেকাংশে গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কদের মতো; যারা অতুলনীয় বলশালী সব শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, শুধু হেরে যাওয়া যুদ্ধই করে গেছে কেবলমাত্র তাদের মনুষ্যত্বের গৌরব রক্ষা করতে। কিন্তু গ্রিক ট্র্যাজিক নায়করা যুদ্ধ করেছে দেবতা দ্বারা রক্ষিত সব শত্রুর বিরুদ্ধে, এখানে ধর্মীয় ও সামাজিক শর্ত অনুযায়ী যুদ্ধ সমর্থিত হয়েছে, কারণ তার উদ্দেশ্য কাউকে সাহায্য করা এবং অন্যদের প্রতিরোধ করা তাই এমনকী পরাজিত নায়করাও ভাগ্যের বঞ্চনা অনুভব করে না। কিন্তু ভারতবর্ষে ভাগ্য মানুষের কাছে এক অন্ধ চালিকা শক্তি রূপে উপস্থিত হয়, কেননা, মানুষ নিজেই এই শক্তির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্ধ। সুতরাং কোনও মানুষের এ কথা জানার উপায় নেই যে, পবিত্র জীবনযাপন করা সত্ত্বেও তার কেন বিনাশ হল। মাঝে মাঝে মহাকাব্য ও পুরাণের অতিকথাগুলি ভাগ্যের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে হতভাগ্য মানুষকে জ্ঞান দেয়। এই ভাবে ভাগ্যের বোধ বহির্ভূত প্রকৃতি নির্দিষ্ট করে দেয় কিন্তু তা সত্ত্বেও যেহেতু সামগ্রিক ভাবে অধিকাংশ মানুষের কাছে এই সব ব্যাখ্যা খুবই প্রক্ষিপ্ত ভাবে গ্রহণযোগ্য এবং কোনও কোনও সময়ে এর অস্তিত্বই নেই, তাই কেন তারা এই ভাবে কষ্ট পায় এ বিষয়ে মানুষ সম্পূর্ণ অন্ধকারেই থেকে যায়।

এই সুদীর্ঘ সময়ে অধিকাংশ মানুষের কাছে জীবন ছিল প্রায় অসহনীয়। কৃষক এবং কারিগর এরা অত্যল্প শ্রমমূল্য পেত। স্বল্পসংখ্যক ধনীর হাতেই সম্পদ রাশিকৃত হত। রাজসভায় রচিত কাব্য ও নাটকের পাতা এদের উপভোগের বিবরণেই আকীর্ণ। সমাজের সর্বোচ্চ স্তর আর সর্বনিম্ন স্তরের জীবনযাত্রার মানে এতই পার্থক্য যে, এর জন্য কিছুটা ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কর্মফলবাদ ও জন্মান্তরবাদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত দক্ষতার সঙ্গেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছিল। যেখানে সাধারণ ক্ষেত্রে মানুষ অভাব, রোগ, দুর্দশা এবং শোষণের বিরুদ্ধে সরবে প্রতিবাদ করবে সেখানে এই সব দুষ্ট মতবাদ সহজেই প্রতিবাদী কণ্ঠকে রুদ্ধ করেছিল। কারণ পূর্বজন্মের কার্যকলাপ অজ্ঞাত, অজ্ঞেয়ই রয়ে যায়, তার তথাকথিত যে ফল মানুষ ইহজন্মে ভোগ করে তাই হল অ-দৃষ্ট।

তবুও মানুষ অবদমন আর শোষণকে প্রতিহত করেছে। কারণ, যে কোনও তত্ত্ব যত দৃঢ় এবং আপাতদৃষ্টিতে যত নিয়ন্ত্রক হোক না কেন তা কখনওই মানুষের জীবনতৃষ্ণাকে সম্পূর্ণ বিনাশ করতে পারে না।

মহাকাব্য ও পুরাণগুলিতে নিয়তি আর স্বাধীন ইচ্ছা— উভয়ের আপেক্ষিক কার্যকারিতা বিষয়ে দীর্ঘ বিতর্ক দেখা যায়। যদি পরিণামবাদকে সম্পূর্ণ ভাবে মেনে নেওয়া হয়, তবে তা জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করে, সুতরাং এ বিষয়ক বিভিন্ন শাস্ত্র গ্রন্থগুলি স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধী। প্রথম তাৎপর্যময় শ্লোকটি দেখা যায় মহাভারত-এ, যেখানে আমরা শুনি, চেষ্টা ব্যতীত ভাগ্য নিষ্ফল;[১৭] ভাগ্য কোনও ন্যায়বান পুরুষকে কী করতে পারে?[১৮] অহংকারী, ক্ষমতাবান পুরুষ ভাগ্যের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন না। এর পর উদাহরণের একটি তালিকা আছে : ‘যেমন করে নিঃশেষিত তৈলপ্রদীপে তেল দিলেও’ প্রদীপ নিভে যেতে থাকে তেমনই যখন কর্ম বিনষ্ট হয় তখন ভাগ্যও দুর্বল হতে থাকে।[১৯] ত্রয়োদশ অধ্যায়ে (১১৬-১১৯ পরিচ্ছেদ এবং ১৪৪, ১৪৫ পরিচ্ছেদ) জীবনের নীতিনিষ্ঠ পথ এবং কর্ম থেকে মোক্ষপ্রাপ্তি ও তার ফলকেই জীবনের সারমর্ম বলে দৃঢ় ভাবে ব্যাখ্যা করে। সমগ্র ঊনবিংশ পরিচ্ছেদটি হল কর্ম এবং তার প্রভাব সম্পর্কে পর্যালোচনা। এর প্রথমেই রয়েছে— সৎ বা অসৎ কোনও কর্মই নিঃশেষে অবলুপ্ত হয়ে যায় না, তারা পরিণত হয় অর্থাৎ যথোপযুক্ত ক্ষেত্রে ফলদান করে। এর পরিবর্তে মানুষের নৈতিক দায়িত্ব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছে: বহু আখ্যানেই আপাত-অলঙ্ঘ্য প্রতিকূলতার সম্মুখে মানব প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য। কিন্তু এক প্রকার বিপরীত অর্থাৎ নিয়তিবাদী মনোভাব, যার অন্তলীন ইঙ্গিত হল সচেতন ভাবে এমনকী স্বেচ্ছায় এক অপ্রতিরোধ্য অনির্ণেয় শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করা, সেই বোধ অজস্র আখ্যানে ফুটে উঠেছে এবং এই মনোভাবই সাফল্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে এমন এক জগৎ গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া সবই পুর্বনির্দিষ্ট, ফলে কাঁটায় পদাঘাত করলে তা ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসে।

এই ভাবে, এই নৈতিক ভাবে দুর্বলকারী মতবাদ বিস্তার লাভ করায় অনেক প্রতিরোধের সম্ভাবনা নিশ্চয়ই বিনষ্ট হয়েছিল। কারণ এই মতবাদ একটি সহজবোধ্য স্তরে মানুষকে বোঝায় যে তার ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ অবশ্যই বোধসীমার বহিভূর্ত, কারণ নিয়তিই সব কিছুর চরম নিয়ন্তা। যে সব শক্তি মানুষের ভাগ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলিকে চেনা অসম্ভব; এই বোধের মারাত্মক চাপ মানুষকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয় প্রকার নেতৃত্বের কাছেই এই মতবাদ অত্যন্ত সুবিধাজনক। কারণ, এর সাহায্যে সাধারণ মানুষকে নিবীর্য করে আত্মিক এবং বস্তুগত উভয় বন্ধনেই বেঁধে রাখা সম্ভব ছিল। এই সব সমাজপতিদের হাতে বহু শতাব্দী ধরে নিয়তিবাদ ছিল এক মারাত্মক বলবান অস্ত্র। এক ধর্মীয় বাতাবরণ যার মধ্যে আছে অনেকাংশে জাদু, শুভাশুভ লক্ষণ বিচার, দেবত্ব-আরোপ, দৈববাণী, জ্যোতিষ, অভিশাপ আশীর্বাদ এবং সর্বোপরি যে বাতাবরণকে ক্রমশ এক শক্তিশালী পুরোহিত তন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করেছিল— তা সাধারণ মানুষকে এক ভাবে বন্দি করে রেখেছিল। এই কারণেই প্রায় পনেরো শতাব্দী কাল ধরে এই দুষ্ট শক্তি সম্পন্ন মতবাদ সক্রিয় থাকার ক্ষমতা সংগ্রহ করেছিল।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে নিয়তিবাদ কোনও দার্শনিক তত্ত্ব নয়; এর কোনও ধারাবাহিক বৈজ্ঞানিক জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। কোনও মহাজাগতিক তত্ত্ব, সত্তাতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, কারণতত্ত্ব বা স্বর্গ-নরক বিচার— কিছুই এখানে নেই। কিন্তু যে সমাজে এই নিয়তিবাদ সৃষ্টি হয় সে সমাজে এই সব ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদের উপরই নিয়তিবাদের প্রভাব পড়ে। অবশ্যই এই মতবাদ আবশ্যিক ভাবে আদিম নয়, কারণ প্রায়ই দেখা যায় সমাজের যথেষ্ট শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান স্তরেও এর বিস্তার। তবে সাধারণ ভাবে বলা যায়, এর অন্যতম শর্ত হল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া। যখন প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে, যখন বস্তুগত সমৃদ্ধির ফলে কারিগরি উন্নতির ফল জনগণের কাছে সহজলভ্য হয়, তখন নিয়তিবাদের ভিত্তি শিথিল হয়ে পড়ে। অধিকাংশ সমাজেই সামগ্রিক ভাবে বস্তুগত সমৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিদ্যার বিস্তার আর নিয়তিবাদের মধ্যে এক প্রকার বিপরীত অনুপাত রয়েছে।

অবশ্য কোনও মানুষের পক্ষে প্রকৃতিবিষয়ে সামান্য অতিকথা— বিরোধী বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার জ্ঞান— নিয়তিবাদের বিরোধিতা করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারণ প্রায়ই এই জ্ঞানকে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করার মতো সহায় তার থাকে না (যেমন ঘটে কৃষক ও কৃষি সারের ক্ষেত্রে)। কখনও বা অন্তর্নিহিত বাধাই তাকে বৈজ্ঞানিক সাহায্য আসার পরেও নিষ্ক্রিয় করে রাখে, বিশেষ করে যখন তার সমগ্র জীবনের চিন্তাধারার সঙ্গে কোনও বিজ্ঞান শিক্ষার একটি স্বতন্ত্র অংশকে সংযুক্ত করার পক্ষে তার নিজস্ব শিক্ষাদীক্ষার স্তরটি প্রয়োজন মতো উন্নত না থাকে (যেমন টিকাকরণ ও পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে)। যতদিন জীবনচর্যার এক বৃহদংশ মানুষের সক্রিয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, ততদিন নিয়তিবাদ পল্লবিত হতে থাকে। তার প্রধান কারণ এই যে, জীবন সম্পর্কে এক পুরাণকথানুগ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একে যুক্ত করা সহজ। অন্যান্য বহু দেশের মতো ভারতবর্ষেও এই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রাধান্য দেখা যায়।

নিয়তিবাদের সারমর্ম হল যৌক্তিকতার উপরে আকস্মিকতার, প্রত্যাশিত নিয়ন্ত্রণাধীনের উপর অপ্রত্যাশিতের অচিন্তনীয়ের প্রাধান্য। এর ভিত্তি হল জীবনে আকস্মিক অনায়ত্ত পরিস্থিতি উপস্থিত হওয়ার অতিবাস্তব সম্ভাবনা; এবং জীবনে যে সব ঘটনা যুক্তিসঙ্গত ভাবে প্রত্যাশা করা যায় তার চেয়েও আকস্মিক ঘটনাকে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করার মানসিকতাই নিয়তিবাদ।

ভারতবর্ষে এবং অন্যান্য দেশেও বুদ্ধিনির্ভর জীবনযাত্রার এক মূর্ত প্রতিবাদ হল নিয়তিবাদ বিশেষ করে যেখানে যুক্তিনির্ভরতা আর বুদ্ধি দিয়ে কোনও কোনও সমস্যার সমাধান হয় না।

কালের ক্রম বিচার করলে নিয়তিবাদের উদ্ভব হয় উপনিষদের সমকালে। অন্য ভাবে বলা যায়, মননশীল স্তরের প্রধান অংশ তখন জ্ঞান এবং অধ্যাত্ম-রহস্যকেই জীবন ও বাস্তব সম্পর্কিত একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি রূপে, মোক্ষপ্রাপ্তির অদ্বিতীয় কার্যকরী ধর্মীয় উপায় রূপে ঘোষণা করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি বিপরীত তত্ত্ব সেই সময় দেখা গেল। অবশ্যই ঔপনিষদিক জ্ঞানের উদ্দেশ্য আর আংকাবাদী অ-দৃষ্ট উভয়ের অস্তিত্ব ভিন্ন মেরুতে। কিন্তু জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করে, নিয়তিবাদ নিয়ে এল জ্ঞানের এক তাত্ত্বিক শূন্যতা। জ্ঞানকে নিক্ষেপ করল অন্ধগলি পথে যেখানে মানুষের ভবিষ্যৎ বাস্তবে অজানা, অজ্ঞেয় থেকে যায়। জীবনে প্রত্যেকটি বিষয়ের যে পূর্বাভাস পাওয়া যায় না, সব কিছু পরিকল্পনা মতো হয় না, আয়ত্তে থাকে না এই সত্যকে নিশ্চিত করে নিয়তিবাদ। ক্রমবর্ধমান যুক্তিবাদনিয়ন্ত্রিত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের চেয়েও আকস্মিকতার ভূমিকাকেই সে অনেক বড় করে দেখায়। এই মনোভাব নিষ্ক্রিয়তার এবং উদ্যোগহীনতার জনক এবং কিছু দূর পর্যন্ত এই মনোভাব নির্দিষ্ট শক্তির স্বার্থ রক্ষা করে থাকে।

নিয়তিবাদ যে কোনও সংহত ধর্ম ব্যাখ্যার বিরোধী। যদি দেবতারা মানুষকে সত্য, শিব, সুন্দর ও পূর্ণতার পথের মঙ্গলজনক দিশা দেখান, তারই প্রতিনিধি হয়ে থাকেন তবে ভাগ্য যেখানে ক্রিয়াশীল হবে সেই শূন্যস্থান সৃষ্টি হয় না। মঙ্গলময় দেবতারা যখন মানুষের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণ করেন তখন তার পরিণতি হওয়া উচিত শুধু আনন্দময়। কিন্তু অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, জীবনের প্রতি এই আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক রুক্ষ বাস্তবের মোচড় আছে। সুতরাং, গ্রীণ যেমন বলেছেন, ‘বস্তু জগতের মর্মে পুরাকাহিনির দেবতাদের মঙ্গলময়তা সম্পর্কে এমনকী নৈতিকতার কোনও মূল্য সম্পর্কে একটি গভীর সংশয়বোধ এমনকী নৈরাশ্যবাদ শুধুমাত্র পুরাণোক্ত দেবতাদের সম্বন্ধে নয়, কিন্তু নৈতিকতার মূল ভিত্তি সম্বন্ধেও অন্তর্নিহিত আছে।[২০]

যদি সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহই শুভ শক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে নিয়তিবাদকে কোথাও স্থান দেওয়া যায় না, বিশেষ করে যেহেতু নিয়তিবাদ স্বাধীন বিচারশক্তি ও পুরুষকারের ভূমিকা অস্বীকার করে। পূর্বনির্ধারণ এবং স্বাধীনবিচারের মতো, ক্যালডিনের পূর্বনির্ণয়বাদের মতো বিতর্কই ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণ সাহিত্যের দার্শনিক তত্ত্বালোচনায় প্রধান হয়ে উঠেছে। পুনরায় এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হল গুরুত্বের আপেক্ষিকতা। একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে দৈব পুরুষকার এবং কাল এই তিন শক্তি যুগপৎ মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।[২১] আর এক জায়গায় পরিষ্কার বলা হয়েছে ‘সমস্ত দুর্ভাগ্য এবং দুর্ঘটনা কালের নিয়ন্ত্রণাধীন; কাল যদি বিরুদ্ধে থাকে, ক্রুদ্ধ হয় তবে কী করে আমরা পরিত্রাণ পাব? এটা ব্রহ্মারই বিধি যে, সব কিছু প্রাণীকুলের ত্রিভুবনের সমস্ত শক্তি, কালের অধীন।[২২] আর একটি শ্লোকে বলা হয়েছে ধর্ম, কাল এবং মৃত্যু সর্বদা একত্রে বিচরণ করে।[২৩] মৃত্যুর বারো দিন পরে একজন মানুষকে যমপুরীতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে মৃত্যু কাল ও অন্তকের মাঝে সে যমকে দেখতে পায়।[২৪] কালই সর্ব প্রাণীর সৃষ্টি ও ধ্বংসকর্তা, সকলেই কালের অধীন কিন্তু কাল কারও অধীন নয়।[২৫]

এই কালের প্রয়োজন নিয়তিবাদের ধারণার বিকাশকে পোষণ করার জন্য। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যে সময় তা হল ভবিষ্যৎ এবং মহাকালের রূপ কল্পনা— অসীমের মূর্ত বিগ্রহ; সে হল ভবিষ্যতের প্রায় নির্ভুল রূপমূর্তি। পৌরাণিক অতিকথাগুলিতে শিব, যিনি যুগান্তের ভয়ংকর বিধাতা, তাঁকে বলা হয়েছে ‘মহাকাল’— মৃত্যুর দেবতা। এই দেবতা ভূত-প্রেতের সঙ্গে বিচরণ করেন এবং তিনি যমেরই এক পরিবর্তিত রূপ। তাই যে সব পুরাকথাতে কাল, অন্তক, যম, ধর্মরাজ, ইত্যাদির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে তারা শিবকেও এঁদের সঙ্গে যুক্ত করে। শিবের মধ্যে এবং শিবের দ্বারা কাল ও সময় মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে। লৌকিক ‘ধর্মপূজার’ ক্ষেত্রে যে শিবকে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় তা কোনও আকস্মিক সমাপতন নয়। এই ভাবে পুরাকথার উপযোগী ভাষায় ও ইঙ্গিতে এই বক্তব্যই প্রকাশিত হয় যে, কাল একজন ন্যায্য বিচারক, ধর্ম (ন্যায়), কাল (সময়) ও যম (মৃত্যু) একত্রে নৈতিকতা সম্মত কার্য বিধান করেন। মানুষকে তার ভাগ্যের সঙ্গে যুক্ত করার এটি একটি প্রচেষ্টা— তাকে আশ্বাস দেওয়া যে, কোনও কিছুই নিয়মবহির্ভূত নয়, কারণ দেবতারাই মানবজীবনে কর্তৃত্ব করছেন। কাজেই শেষ পর্যন্ত কোনও কিছুই ভুল হবে না, হতে পারে না। কিন্তু ধর্মতত্ত্বে বা অতিকথায় এ কথা কখনও স্পষ্ট ভাবে স্বীকার করা হয়নি, ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভাগ্য অজ্ঞেয় ও অন্ধকারাচ্ছন্নই রয়ে গেছে।

ন্যায্য এবং নিরপেক্ষ শেষ বিচারের আপাত বাহ্যরূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে চিত্রগুপ্তের পৌরাণিক চরিত্রটিকে সৃষ্টি করে। এই চিত্রগুপ্ত মানুষের ন্যায়— অন্যায় কাজগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখেন, যাতে পরজন্মে সেই অনুযায়ী মানুষ শাস্তি বা পুরস্কার পায়।[২৭] এক অর্থে, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অসংখ্য নিষেধাজ্ঞা আর নিয়তিবাদ পরস্পরের বিপরীতগামী: যদি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সফল তাৎপর্য থাকে, তবে একজনের কৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত বিকল্পে অন্য একজন করতে পারে এবং কর্মের প্রকৃত অনুষ্ঠাতার উপর থেকে নৈতিক দায়িত্ব হস্তান্তরিত হয়।

অভিশাপ এবং আশীর্বাদ, যা মানুষের জীবনধারাকে প্রভাবিত করে, সেগুলি প্রায়ই আবেগতাড়িত বলে মনে হয় এবং কোনও প্রতীতিমূলক অধিবিদ্যাসংক্রান্ত তত্ত্বের সঙ্গে এগুলিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায় না। অনুরূপ ভাবে যদি আত্মা ও প্রেত কোনও মানুষের জীবনকে সত্যই প্রভাবিত করতে পারে তবে তার কৃত ভাল ও মন্দ কাজের গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং অকার্যকর হয়ে দাঁড়ায়।

যদি অনুমান করা যায় যে অভিশাপ ও আশীর্বাদ, আত্মা ও প্রেত, শ্রাদ্ধ ও প্রায়শ্চিত্ত, এমনকী পুরস্কার ভাগ করে নেওয়া (পুরাণগুলি মধ্যে মধ্যেই আখ্যানের সাহায্যে এর উদাহরণ দেয়)— এই সব কিছুই পূর্বনির্দিষ্টতার পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে তখনই কর্ম তার গুরুত্ব হারিয়ে গৌণ হয়ে পড়ে। আর যদি এই নিয়তি অথবা পূর্বনির্দিষ্টতার তত্ত্ব নিজেই কর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে ওই সব অসংখ্য গৌণ মাধ্যমের কল্পনা অপ্রয়োজনীয়, এমনকী পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ে। সুতরাং নিয়তিবাদ বিষয়ে যুক্তিসংগত প্রতিতি উদ্ভাবনের চেষ্টা কখনও করা হয়নি।

তবুও এই নিয়তিবাদের সর্বব্যাপী অস্পষ্টতা হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মীয় পরিবেশকে গ্রাস করে রেখেছে। পুরোহিতদের স্বার্থেই নিয়তিবাদকে তার অসংখ্য প্রকার বহিঃপ্রকাশ আর বিভিন্ন মাধ্যমসহ মেনে নেওয়া হয়েছিল। বৃহত্তর জনসাধারণের আর্থিক অনুন্নত অবস্থা আর বিত্ত জগতেও তার বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবই নিয়তিবাদের অধিপত্যের কারণ। বিভিন্ন স্তরে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিস্তার এবং আর্থিক অবস্থার উন্নতি— এ দুইয়ের মিলিত অবদানে যখন কুসংস্কারমুক্ত, নিয়তির প্রভাব মুক্ত জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি কেবল বাস্তবায়িতই হবে না— অত্যাবশ্যক, অপরিহার্য হয়ে উঠবে, তখনই নিয়তিবাদের শিকড়গুলি সমাজের অভ্যন্তরীণ গঠন থেকে উচ্ছেদ হবে। কিছু দিন বাহ্যিক স্তরে এর প্রভাব অবশিষ্ট থাকতেও পারে কিন্তু ভয় আর বিস্ময়ের জাল বিস্তার করে লৌকিক চেতনাকে অধিকার করার ক্ষমতা তখন নিয়তিবাদ হারিয়ে ফেলবে। আর্থ সামাজিক অগ্রগতি এর মূলকে ধ্বংস করে হয়ে উঠবে সহজসাধ্য, নূতনতর বিকাশের সহায়ক।

***

সূত্রাবলি

১. Cato তাঁর কৃষি সংক্রান্ত লেখায় ভাল ফসলের জন্য জুপিটারের উদ্দেশে বলিদানের কথা বলেছেন।

২. ক্যালসিডিয়াস, টিমেয়াম, ১৪২ অধ্যায়

৩. কনফুসিয়াস ও মেনসিয়াস এর লেখাতে মিং অর্থ জগৎ। গদ্য রচনা এড্ডাতেও ভাগ্যের কথা বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। বেদ-পরবর্তী যুগের ভারতবর্ষেও বোধাতীত এবং ব্যাখ্যার অগম্য একটি ধারণার বিভিন্ন সূক্ষ্মভেদ অনুসারে বিভিন্ন নাম দেখা যায়।

৪. ধর্ম শাস্ত্রগুলিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই মানুষের মৃত্যুর পরের অবস্থা অনিশ্চিত রাখা হয়েছে: বায়ুপুরাণ বলে ‘জানা অসম্ভব; ঋষিরাও এ কথা জানেন না, সাধারণ মানুষের কথা বলা বাহুল্য’ ৫৫:৬৩

৫. তুলনীয় মৎস্যপুরাণ, ১০২; ২২; ১০৭:২৭; ১৩৫:৭৬; ১৩৬:৫; মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৮:৮০

৬. জারবান মতেও সময়ের ধারণাকে এক মহান দেবতার পর্যায়ে উচ্চ করে তোলা হয়েছে।

৭. তুলনীয় মহাভারত ত্রয়োদশ, ১০২:১৪, ১৫

৮. তুলনীয় মহাভারত ত্ৰিংশ: ৬

৯. মধ্যে মধ্যে কেবল চিত্রগুপ্তের অস্পষ্ট রূপকল্পনা যাঁকে শাসকের চেয়ে হিসাবরক্ষক রূপেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

৯ক. এই জন্মের পাপ বা পুণ্যই পরবর্তী জন্মের পরিবেশের ভাল মন্দ নির্ধারণ করে— মৎস্যপুরাণ পৃ. ৩৯:১৯ বিষ্ণুপুরাণ ১:১২, ভাগবতপুরাণ ৫:২২ পৌরাণিক যুগের প্রভাবের দুটি উদাহরণ। পুরাণগুলিতে জ্যোতিষের গুরুত্ব বেড়েছে, সেখানে গ্রহদের ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। অগ্নিপুরাণ অধ্যায় ৫১, ১২৬, ১৩৬: মৎস্যপুরাণ-এ ঋতুনির্ধারণ করার জন্য গ্রহের গতিবিধি এবং প্রকৃতির উপর গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব আলোচিত হয়েছে; অধ্যায় ১২৫, ১২৬। পরবর্তীকালে মানবিক সাদৃশ্যের রূপ কল্পনায় গ্রহ-নক্ষত্রের পূজাবিধি নিরুপিত হয়েছে। এই সব অনুষ্ঠানের নির্দেশ রয়েছে অগ্নিপুরাণ অধ্যায় ১৬৪; মৎস্যপুরাণ অধ্যায় ৫৪ ইত্যাদি, অধ্যায় ৭৩ এবং অগ্নিপুরাণ অধ্যায় ১৯৬, এই সব গ্রহ দেবতা ও তাদের পূজারই একটি শাখাভেদ হল রত্নের সঙ্গে গ্রহগুলির যোগসূত্র যার ফলে রত্নব্যবহার করে গ্রহের প্রকোপ নষ্ট করা যায়। অগ্নিপুরাণ অধ্যায় ১২১, ২৪৬, কুর্মপুরাণ অধ্যায় ৪২, এই নূতন ‘বিজ্ঞানে’র উদাহরণ।

১১. তুলনীয় আত্মা এবং অধিকারের পরিচ্ছেদ অগ্নিপুরাণ ২৯৯ অধ্যায়— যেখানে দুষ্ট আত্মার ৩৮টি নাম আছে।

১২. মার্কণ্ডেয়পুরাণ ১১২ অধ্যায়ে রাজা পৃষধ্রকে শূদ্র হওয়ার অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণ ১:১৯ ইন্দ্র দুর্বাসার অভিশাপে পরাজিত হয়েছিলেন, বিষ্ণুপুরাণ ৫:৩৭ যদু বংশ ঋষির শাপে ধ্বংস হয়েছিল এবং ভাগবতপুরাণ ১১:১। ভাগবত ৪:২তে বলা হয়েছে দক্ষ ও শিব পরস্পরকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। এবং ভাগবত ৬:৭-এ রাজা চিত্রকেতু পার্বতীর শাপে দানব বৃত্র হয়েছিলেন। দেবতা ও অসুরদের বংশপরিচয় এবং আপাত বিচিত্র বহু ঘটনাই রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে অভিশাপে ও আশীর্বাদের ফল বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

১৩. ডিয়েট্রিচ বি সি: ডেথ, ফেট অ্যান্ড দি গডস, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ১৯৬৫৬, পৃ. ২৩৪

১৪. ডিয়েট্রিচ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৪

১৫. মৎস্যপুরাণ ২২৯-২৩৮ অধ্যায়ে বিভিন্ন দুর্লক্ষণের তালিকা আছে এবং ২৩৯] অধ্যায়ে এর প্রায়শ্চিত্ত আছে।[২৪১] অধ্যায়ে আছে এবং ২৪২ স্বপ্নতত্ত্ব। বায়ুপুরাণ-এ দুর্লক্ষণের কথা আছে ১৯:১৬-তে, মার্কণ্ডেয়পুরাণ-এ ৩৪ অধ্যায়ে, অগ্নিপুরাণ অধ্যায় ২২৯ এবং ১২৬ পুরাণের অষ্টম অধ্যায়ে স্বপ্নকে বলা হয়েছে আগামী ঘটনার পূর্বাভাস বহনকারী। অগ্নিপুরাণ ২৩০-২৩৩ অধ্যায়ে নারীপুরুষের মধ্যে শুভাশুভ লক্ষণের তালিকা দিয়েছে; এখানে দুর্লক্ষণের কথা বলা হয়েছে ২৬৩ অধ্যায়ে এবং এই সব লক্ষণজনিত বিপদ থেকে বাঁচবার উপায় রূপে আচার অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে ২৪৩-২৪৪ অধ্যায়ে।

১৬. মার্কণ্ডেয়পুরাণ ৫১, ৭০, ১১৭ অধ্যায়ে এবং অন্য অধিকাংশ পুরাণ গ্রন্থে জাদু এবং ডাকিনী সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা আছে।

১৭. ত্রয়োদশ: ৬:২৫

১৮. ত্রয়োদশ: ৬:২৯ এখানে ধ্রুবপদ— নিয়তির দ্বারা কী বাধাপ্রাপ্ত হয়নি?

১৯. ত্রয়োদশ: ৬:৪৪

২০. গ্রিন ডব্লু-সি: ময়রা; হার্পার অ্যান্ড রো ১৯৬৫ পৃ. ২১৮

২১. মৎস্য পুরাণ ২২১.৮

২২. মংস্য পু. ১৩৬:৫, ৬

২৩. মংস্য পু. ২১০:৫-৭, মৎস্য পু. ২১৩:৩-৭ বলা হয়েছে কাল, মৃত্যু, অন্তক, যম, বৈবস্বত এবং ধর্মরাজ এঁরা সকলেই এক।

২৪. মার্কণ্ডেয়পুরাণ ১০-৭৮

২৫. কর্মপুরাণ ১২:১৭, দ্রঃ কূর্ম, উত্তরভাগ ৩১:৪৩ কাল বিষয়ক আলোচনা।

২৬. প্রজাপতিপুরাণ-এর যিনি সৃষ্টিকর্তা, কালরূপে জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা।

২৭. গরুড়পুরাণ ৩৪ অধ্যায়, এই জন্মের কার্যকলাপের সমতুল্য বা উপযুক্ত ফল প্রাপ্তিই এর বিষয় অধ্যায় ৪, ৫।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *