০৪. শাস্ত্রে পণপ্রথা ও স্ত্রীধন

শাস্ত্রে পণপ্রথা ও স্ত্রীধন

বধূদাহন ও অন্যান্য নানা প্রকার পণপ্রথার কারণে হত্যা আজকাল সংবাদপত্রে এতই দৈনন্দিন ব্যাপার যে শাস্ত্রে তার মূল খোঁজার এবং এই সব দুষ্ট ধারণা ও কার্যকলাপের অবসান ঘটানোর তাগিদ বাড়ে। এই সব হত্যার প্রধান কারণ অসন্তুষ্ট শ্বশুর-শাশুড়ি, তাদের অপূরণীয় অর্থলিপ্সা, যা প্রাথমিক ভাবে বর ও তার পরিবারকে বিবাহের সময়ে দেওয়া পণের দ্বারা উদ্দীপিত হয় কিন্তু পরিতুষ্ট হয় না। এর বৃদ্ধি ঘটে অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও লোভকে কেন্দ্র করে এবং এর অবসান নির্ভর করে পুরুষের আত্মমর্যাদার উপরে, যা অনুপার্জিত যে কোনও রকম অর্থ গ্রহণ করে নিজেকে বিকিয়ে দিতে অস্বীকার করে।

সর্ব প্রাচীন ঋগ্বেদ-এর সংহিতায় বধূ বা বরের কারও পক্ষ থেকেই অর্থ বা অন্য কোনও রকম ধনের আদান-প্রদানের উল্লেখ নেই। বিবাহের সর্বপ্রথম উল্লেখ হচ্ছে ‘কুমারী নিজের সঙ্গী বেছে নেয়।’ (ঋগ্বেদ সংহিতা ১০:২৭:১২) বোঝাই যায়, পুরুষ ও তার সঙ্গী বেছে নিত; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এটা স্বাধীন নির্বাচন, কোনও পক্ষের কোনও অর্থদানের উপর নির্ভর করে না। এক জায়গায় ঋগ্বেদ-এ অবশ্য দোষযুক্ত বরের বধূর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা আছে। (১:১০৯:২) ঋগ্বেদ-এর দশম মণ্ডল থেকে শুরু করে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে বিবাহের কয়েকটি বিক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে, যেমন সূর্যকে বলদের গাড়িতে করে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া। এই সূক্তে বলা হয়েছে, বধূর পিতা বরের গৃহে উপহার পাঠিয়েছিলেন (প্রাগুক্ত ১:৮৫:১৩)। এই উপহার স্পষ্টতই কন্যার উদ্দেশ্যে পিতামাতার স্নেহোপহার। এটা প্রকৃতপক্ষে পণ নয়।

পরবর্তীকালের একটি বৈদিক গ্রন্থ, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর আশপাশে সংকলিত তৈত্তিরীয় সংহিতা-য় বলা হয়েছে, নবদম্পতি যখন বরের গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, তখন বধূ ‘ধরে থাকে’ (শকটটি), কারণ বধূ সব ‘গৃহ সম্পত্তির’ কর্ত্রী। (৬:২:১:১) মনু গৃহসম্পত্তির অর্থে ‘পরিনাহ্য’ শব্দটি ব্যবহার করছেন এবং এই মন্ত্রটি ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, বলেছেন, ‘বধূ সম্পত্তির তদারকের দায়িত্ব পেয়েছে।’ (মনু সংহিতা ৯:১) এই ভাবে সাংসারিক সম্পত্তির উপর স্ত্রীর স্বত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। যদিও জৈমিনি বলেছেন নারীদের কোনও কোনও বিশেষ সম্পত্তির অধিকার থাকতে পারে ও থাকে। মনু সংহিতা (৮:৪১৬)-র উপরে টীকা করতে গিয়ে মেধাতিথি বলেছেন, নারী যা উপার্জন করে তা সবই তার স্বামীর। স্পষ্টতই সামাজিক মনোভাব হল নারীর নিজস্ব ধন-সম্পত্তিতে অধিকার নেই। দুঃখের বিষয়, আধুনিক ভারতবর্ষেও বহু পরিবারে এমন মনোভাব এখনও দেখা যায়। পুরুষের যেমন সম্পত্তির উপর সম্পূর্ণ অধিকার, নারীর তা নয়।

তা সত্ত্বেও বিবাহের সময়ে নারীকে তার পরিবার ও বন্ধুবর্গ উপহার দিত এবং পরে তার স্বামীর পরিবারও দিত। পারিভাষিক ভাবে বিবাহের সময়ে অগ্নির সামনে তাকে যা দেওয়া হত (অধ্যগ্নি) এবং স্বামীগৃহে যাওয়ার সময়ে পথে তাকে যা দেওয়া হত (অধ্যাহবনিক)— যা স্নেহবশত (অপরে) তাকে দিত বা তার ভাই বা মাতা পিতা তাকে যা দিত— এই দুটি হল স্ত্রীধন, নারীর ব্যক্তিগত ধন সম্পত্তি। (মনু সংহিতা ৯:১৯৫) মনু যে কেবল বধূর নিজস্ব সম্পত্তি স্বীকার করেন তা নয়, তিনি বলেছেন, কন্যাপণ শুধুমাত্র সর্বনিকৃষ্ট আসুর বিবাহেই গ্রহণযোগ্য (প্রাগুক্ত ৩:৩৯)। অন্যান্য আচার্যদের মতো উদ্ধৃত করে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে আর্য বিবাহে কন্যার পিতা বাধ্য হয় বরকে একটি গরু এবং ষাঁড় দিতে এবং এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নিন্দা করে তিনি বলেছেন, এটি মিথ্যা, ‘কারণ ছোট হোক বা বিশাল হোক, পণ হল আনুষ্ঠানিক ভাবে বরের বিক্রয়।’ (প্রাগুক্ত ৩:৫৩) এর উপর জোর দিতে মনু আরও বলেছেন ‘যে সব বিবাহে কন্যার ক্ষতিপূরণ মূল্য গ্রহণ করা হয়, সেখানে (বরের) বিক্রয় হয় না, সেখানে কন্যা সম্মানিতা হয় এবং তার প্রতি সদয় আচরণ করা হয়। (প্রাগুক্ত ৩:৫৪)

যদি কোনও কারণে স্বামী বধূকে কোনও স্ত্রীধনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার জীবদ্দশায় তা পূরণ করতে না পারে, তার পুত্রদের তখন তা তাদের মাকে দিতে হয়। অপরার্ক নামে এক টীকাকার বলেছেন, স্বামী, পুত্র, ভ্রাতা, এমনকী পিতারও স্ত্রীধন কেড়ে নেওয়ার বা দান করার অধিকার নেই। কেবলমাত্র দুষ্টা ও অপব্যয়ী পত্নী স্ত্রীধনের উপর অধিকার হারাতে পারে। তবে এখানে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে, কারণ স্বামী এবং/অথবা তার পরিবার স্ত্রীকে অপব্যয়ের অপবাদ দিলেই স্ত্রীধন থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারে। এই ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা মনে করি যে জুয়া খেলে, সুরা ও নারীতে, এমনকী কাণ্ডজ্ঞানহীন কার্যকলাপে সম্পত্তি উড়িয়ে দিলে স্বামীকে নিয়ন্ত্রিত করার স্ত্রীর কোনও আইনগত অধিকার নেই। পরাশর তাঁর গৃহ্যসূত্র-এ পরিষ্কার বলেছেন, মাতার মৃত্যুর পর স্ত্রীধন কন্যাদের কাছে যায়। কেবলমাত্র কন্যা না থাকলেই পুত্র তা পেতে পারে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এখানে উদ্দেশ্য হল স্ত্রীধনের সঙ্গে একক ভাবে বধূকে এবং সাধারণ ভাবে তার আত্মীয়াদের যুক্ত করা, বোধহয় এই কারণে যে স্ত্রীধনই নারীর একমাত্র সম্পত্তি। কাত্যায়ন স্ত্রীধনের উপরে আরও পরিস্ফুট: সাতাশটি কারিকায় তিনি বধূর এই একমাত্র সম্পত্তির লক্ষণ করেছেন। বিবাহে যা সে তার পিতামাতা, ভ্রাতাভগ্নি, অন্যান্য আত্মীয়-বন্ধুর কাছ থেকে পায়, যা সে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের কাছ থেকে লাভ করে, প্রথমবার পিত্রালয়ে ফেরার সময়ে তাকে তার পরিবার থেকে যা দেওয়া হয়, তা সবই তার নিজস্ব। কাত্যায়ন বলেন, শুল্ক হল মূল্য, যা বর বধূকে দেয়, বিবাহের সময়ে বা তার গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময়ে। স্মৃতিচন্দ্রিকা বা ব্যবহারময়ূখ-এর মতো পরবর্তী গ্রন্থে এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন করা হয়েছে। বরদরাজ কিন্তু তাঁর ব্যবহার নির্ণয়ে বলেছেন, শুল্ক দুই প্রকার হতে পারে: (১) বধূর শ্বশুর-শাশুড়ি তার পিতামাতাকে যা দেন, যা তার মৃত্যুর পরে তার মা এবং/অথবা ভাইয়েরা পায়; এবং (২) তাকে অলংকার বা গৃহস্থালীর সামগ্রীর মূল্য বাবদে বর যা দেয়। কাত্যায়ন যোগ করেছেন যে, তার ‘শিল্প’ দিয়ে সে যা উপার্জন করে এবং অপরের কাছ থেকে যা পায় তা তার স্বামীর প্রাপ্য, কিন্তু অবশিষ্ট সবই স্ত্রীধন। এতে করে বধূকে প্রায় সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু আর এক স্মৃতিকার দেবল বলেন, ভরণপোষণ, শুল্ক এবং সুদ থেকে যে লাভ হয় তা পুরোপুরি স্ত্রীধন, যার উপরে বধূর সম্পূর্ণ আধিপত্য আছে। মনুর প্রখ্যাত টীকাকার মেধাতিথি বলেছেন অলংকার যদিও সাক্ষাৎ ভাবে বধূকে দেওয়া হয়নি, কিন্তু সে স্বামীর অনুমতি নিয়ে তা পরে, তাই তাও স্ত্রীধনেরই অন্তর্ভুক্ত।

আর এক ধরনের স্ত্রীধনকে বলা হয় সৌদায়িক। যা কিছু যে কেউ দেয়, তা সে তার নিজের পরিবারের হোক, বন্ধু লোক, স্বামীও তার পরিবার বা তাদের বন্ধু হোক— তা সৌদায়িক। (দায়ভাগ ৪:১:২১) অপরার্ক বলেছেন, এই সম্পত্তি সম্পূর্ণ ভাবে বধূর; সে তা দান করতে পারে, বন্ধক রাখতে পারে, যদি তা ভূসম্পত্তি হয়, তাহলেও পরবর্তী গ্রন্থ স্মৃতিচন্দ্রিকা স্ত্রীধন হিসেবে বধূ কত দূর পেতে পারে তার সীমা নির্দেশ করে। সব রকম উৎস এক করলে সে দু’হাজার পণ পর্যন্ত পেতে পারে, কিন্তু সে ভূমির অনুদানও পৃথক ভাবে পেতে পারে। (২:২৮১) ব্যবহারময়ূখ-এ কিন্তু বলা হয়েছে, সে বাৎসরিক দু হাজার পণ উপার্জন হয় এ রকম সম্পত্তির অধিকার পেতে পারে। কিন্তু এককালীন উপহার হিসেবে তার আরও বেশি অধিকার ছিল। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে, পূর্বাচার্যগণ বলেছেন অলংকার এবং অন্যান্য যা ধন তার আত্মীয়রা উপহার হিসেবে দেয় তা পত্নীর নিজস্ব। (২:৬১৪:৯) বৌধায়নের মতো কন্যা মায়ের অলংকার এবং অন্যান্য প্রথাগত উত্তরাধিকার পায়। (ধর্মসূত্র ২:২:৪৯) বশিষ্ঠও বলেছেন, যা মায়ের স্ত্রীধন ছিল, তা তার কন্যাদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে, তা তখন তাদের নিজস্ব স্বাধীন সম্পত্তি (১৭:৪৬)।

ভিন্ন ধরনের বিবাহের উপহার হল যৌতুক। ব্যুৎপত্তিগত ভাবে তার অর্থ বিবাহের সময় দম্পতি (যুতক)কে যা দেওয়া হয়। (কাত্যায়ন ধর্মসূত্র; ৯০৫, ৯০৭, ৯১১) এই বিশেষ উপহারটিতে সম্ভবত দম্পতির যৌথ অধিকার ছিল। পুঁথিগত ভাবে অন্তত এই সম্পত্তির উপর পুরুষের নারীর মতোই অধিকার ছিল।

মনু স্ত্রীধনের একটি রক্ষাকবচের কথা উল্লেখ করেছেন: যে আত্মীয়েরা মূর্খতাবশত (বধূর দাসী, রথ বা বস্ত্র ব্যবহার করে, তাদের সর্বনাশ হয়। (৩:৫২) তাই বোঝা যায়, নারীর স্ত্রীধনকে বেআইনি ভাবে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের ব্যবহার করার ঘটনা ঘটত, এবং তাকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হত। বধূ মনে হয় সম্পূর্ণ ভাবে অসহায় এবং নিজের সম্পত্তি রক্ষা করতে পারত না। এ নিয়ম কিন্তু শুধু ধনী মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (দাসী ও রথের উল্লেখ দ্রষ্টব্য); অপেক্ষাকৃত দরিদ্র যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং যাদের অনেক কম সম্পত্তি ছিল, তারা তাদের যৎসামান্য সম্পত্তির উপরে শ্বশুরবাড়ির লোভী হস্তক্ষেপে নিঃস্ব হয়ে পড়ত।

প্রাচীন ও পূর্ব মধ্যযুগীয় সমাজের দুটি গুরুতর বৈশিষ্ট্য উপরের এই বক্তব্য থেকে বেরিয়ে আসে। প্রথমত, পুঁথিগত ভাবে নারীর সম্পত্তির, এমনকী ভূমির, উপরেও অধিকারের ধারণা ছিল। যেহেতু তাকে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হত না এবং তথাকথিত নিম্ন অর্থাৎ শ্রমজীবী বা কৃষিজীবী শ্রেণি ছাড়া তার অর্থকরী জীবিকাও ছিল না, সে অন্ন বস্ত্র আশ্রয় ও জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য তার স্বামী ও তার পরিবারের পোষ্যই ছিল। তাই তারা তার ধন খুশি মতো খরচ করে দাবি করতে পারত, তার ভরণপোষণের জন্য তা ব্যবহার হয়েছে। সেও তাদের যুক্তি খণ্ডন করতে সফল হত না। রানি বা ধনী নারী, যাদের পিতা বা ভ্রাতা সামাজিক ভাবে তার শ্বশুরবাড়ির চেয়ে বেশি শক্তিশালী, তারা ছাড়া আর সকলের সৌদায়িক স্ত্রীধন বা যৌতুক, সবই স্বামী এবং তার পরিবারের হাতে যেত। যেমন এখনও যায়।

দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রবল ভাবে নাড়া দেয় তা হল, খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীগুলির কালেও, এমনকী মনুর সময় পর্যন্ত, বধূর পরিবারের পক্ষ থেকে বরের পরিবারকে পণ দেওয়ার ধারণা স্বীকৃত ছিল না, অনুমোদিতও নয়। রামায়ণ-মহাভারত-এ সমাজের যে প্রতিফলন ঘটেছে, সেখানে বধূ ও বরের পরিবারের মধ্যে উপহার বিনিময়ের নিদর্শন পাওয়া যায়। মনু খুব পরিস্ফুট ভাবেই বলেছেন যে, বধূর পরিবার যদি পণ দেয় তবে বিক্রয়ের প্রসঙ্গ আসে। ‘পণ’ শব্দটির অর্থ ‘মূল্য’, এবং বধূর পরিবার যদি মূল্য দেয় তবে তারা কী কিনছে? অবশ্যই বরকে, যে তখন ‘পণ’ হয়ে দাঁড়ায়। স্পষ্টতই এ ধারণা সমাজে জুগুপ্সাজনক। এতে বরের সামাজিক সম্মান ও আত্মমর্যাদাও হ্রাস করে, কেননা এতে সে তার শ্বশুরকুলের কাছ থেকে পণ মূল্য গ্রহণ করার লজ্জা অনুভব করে না, ফলে তার দাম্পত্যজীবন ব্যবসায়িক বেচাকেনার উপরে নির্ভর করছে। তার সম্মানবোধের সম্পূর্ণ নিঃস্বতাই প্রমাণ করে। মনুর যুগেও সে সাধারণ ভাবে সমাজ এবং বিশেষ ভাবে তার শ্বশুরবাড়ির দ্বারা স্বীকৃত, তা সে মনে করত না। আবার এই স্বীকৃতি যে শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে সে যে পরিমাণ পণ আদায় করতে পারে তার দ্বারা নির্ধারিত, এমনও সে মনে করত না। পরে পণ দেওয়া নেওয়ার এই ঘৃণ্য প্রথায় লজ্জার লেশমাত্র রইল না। কন্যার পিতামাতা যে মুহূর্তে বর কেনার জন্য মূল্য দিতে সম্মত হল, তখনই তারা বধূর পরিবারকে চাপ দিয়ে আরও বেশি আদায় করার জন্য শ্বশুরকুলের লোভকে আরও শান দিল। এই লোভের যথার্থ খাদ্য যোগাতে না পারার ফল হত— এখনও হয়— বধূর সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার। সে যদি এই যন্ত্রণার জীবন মেনে নিত তাহলে তাকে জীবস্মৃত অবস্থায় বেঁচে থাকতে হত। যদি সে তা না পারত— বা এখনও যদি না পারে— সে আত্মহত্যা করে তার অবসান ঘটায়। যদি তার মধ্যে সেই মরিয়া ‘সাহস’ না আসে, তাহলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তা নিজেদের হাতে তুলে নেয়; বিষ, আগুন, অথবা উঁচু জায়গা থেকে সফল একটি ঠেলা দেওয়া। যে অবাঞ্ছিত বধূর পিতামাতা প্রত্যাশিত কামধেনুর ভূমিকা পালন করতে চায় না বা আর পারে না, তাকে সরিয়ে দেওয়ার কত রাস্তাই না আছে। তা ছাড়া, প্রবাদে বলে, ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গরু মরে।’ শাস্ত্র বিপত্নীককে খোঁচায়— আবার এবং যত শীঘ্র সম্ভব বিবাহ করতে। তারপরে, যদি ভাগ্য ভাল হয় তবে তৃতীয়বার, চতুর্থবার যতবার হয়— নির্লজ্জ ভাবে, বারে বারে। তার বয়স কোনও বাধা নয়, কারণ নারী তো সস্তা পণ্যদ্রব্য, আর কুমারী মেয়ে মা-বাবার লজ্জা। তাই পুনঃ পুনঃ বিবাহ অর্থোপার্জনের একটি বর্ধমান উপায় হয়ে দাঁড়াল এবং এই প্রথা এখন চেতনাকে এত লজ্জাহীন ও অনুভূতিহীন করে তুলেছে যে কোনও পক্ষই আর কোনও লজ্জা অনুভব করে না।

কিন্তু তবু এটি একটি সম্পূর্ণরূপে দুষ্ট ও লজ্জাকর নিয়ম। দরিদ্র পরিবারের বধূ সংসারে কায়িক শ্রম দেয় এবং ধনী ঘরের বধূ ভাল পণ নিয়ে আসে। সুতরাং দ্বিতীয়টি বরকে কিনে নেয়, কিন্তু সে এই প্রথায় লজ্জাবোধ করার পরিবর্তে নিজের বাজার দর নিয়ে বড়াই করে, তাই সহজেই মেনে নেয় সে পণ্যদ্রব্য ছাড়া আর কিছু নয়। এই কুপ্রথা আমাদের সমাজজীবনে এতটাই ওতপ্রোত এবং ব্যাপক যে শিক্ষিত ছেলেরাও কোনও রকম বিবেকের দংশন ছাড়াই এই জঘন্য প্রথাকে মেনে নেয়। প্রায়ই তারা সুবোধ সন্তান হওয়ার ভান করে, নোংরা কাজটা পিতামাতার হাতে ছেড়ে দেয়। শাস্ত্রে বলে, ‘কন্যা একটি পরিবারকে দান করা হয়’, অতএব সমগ্র পরিবার তার কাছ থেকে সেবা আদায় করতে পারে, ইচ্ছামতো তার উপরে অত্যাচার করতে পারে, আরও বেশি টাকা আদায়ের জন্য তার বাবা-মাকে চাপ দিতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত আর পণ না দিলে তাকে মেরে ফেলতেও পারে। তারপরে সে আবার স্ত্রী ঘরে আনে— সমস্ত পদ্ধতিটার পুনরাবৃত্তি করে।

এ কথা সত্য যে পাশ্চাত্য দেশেও পণপ্রথা ছিল— অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের আগে পর্যন্ত নারীকে নিকৃষ্ট জীব ও দাসী হিসেবে দেখা হত। কিন্তু গত দুই শতাব্দীতে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, পশ্চিমে পণের নির্লজ্জ আদানপ্রদান পশ্চিমে লোপ পেয়েছে। শিক্ষা এবং স্ত্রী পুরুষের পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থানের ফলে উন্নততর আলোকপ্রাপ্তি ঘটেছে যা এই প্রথার অবসান এনেছে। কিন্তু শিক্ষা সত্ত্বেও, এমনকী নারীশিক্ষা সত্ত্বেও ভারতবর্ষে বরের পরিবারের এই লোভ কমেনি, মুষ্টিমেয় কিছু লোকের মধ্যে ছাড়া। বরং নানাপথে কালো টাকা ও সহজলভ্য টাকার আবির্ভাবের ফলে এই পণের লোভটা আরও বেড়ে উঠেছে। গোপন পণ, অর্থাৎ মনস্তুষ্টি ঘটানোর উপহার অনুপার্জিত ধনের জন্য লিপ্সা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং সেই ভাবে এই নির্লজ্জ প্রথা চলতেই থাকে। এখন বধূর পরিবার কখনও কখনও হঠাৎ বড়লোক, উপযুক্ত বরের জন্য অর্থ ও অন্যান্য বস্তুতে যে অসীম পরিমাণ খরচ করেছে সে বিষয়ে বড়াই করে বেড়ায়, ভুলে যায় যে এই ভাবে তারা বরের পরিবারকে এই ধারণা দেয় যে এখানে সোনার খনি আছে, অনির্দিষ্টকাল ধরে যা থেকে লাভ করা যায়।

পণ, স্ত্রীধন এবং সৌদায়িক— এই সব উপহারের প্রধান প্রাপক বধু। শুধু যৌতুকের ক্ষেত্রে দম্পতি তার যৌথ প্রাপক। কিন্তু বেশির ভাগ পরিবারেই শ্বশুর-শাশুড়ি নিজেদের মেয়ের বিয়ে দেয় অথবা বরকে বিদেশ পাঠায় বধূর বাড়ি থেকে পাওয়া অর্থে। তারা সহজে  এবং বিনা লজ্জায় বধূর পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা ধন ভোগ করে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের আরও বেশি অর্থলিপ্সা বধূর পিতামাতাকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। সত্য কথা, পরবর্তী শাস্ত্রে অনুচ্চারিত ভাবে, কখনও স্পষ্ট ভাবে এই প্রথা স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের কি ভুলে যাওয়া উচিত, এমন কি মনু, যিনি এমনিতেই প্রাচীন পন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল, তিনিও এমন পরিস্ফুট ভাবে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে কেবলমাত্র আসুর বিবাহেই পণ স্বীকৃত? তিনি এবং আরও কয়েকজন ধর্মশাস্ত্রকার বলেছেন যে এই প্রথার অর্থ হল পণের টাকা নিয়ে নিজের পুত্রকে বিক্রি করা এবং এমন ইঙ্গিত দেন যে, কোনও আত্মসম্মান বিশিষ্ট পুরুষের এই বিক্রয়ে সায় দেওয়া উচিত নয়। পণ দেয় বা নেয় যারা, তাদের সামাজিক ভাবে একঘরে করে রাখা অথবা মাইক্রোফোনে বা পোস্টারে এই ঘৃণ্য কাজ ঘোষণা করা, এই সব হয়তো এই প্রথার বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করবে। মেয়েদের উচিত, যে বর পণ চায় তাকে বিবাহ করতে অস্বীকার করা, তাদের নিজেদের বিবাহের সময়ে পিতামাতার থেকে আদায় করা আরামের সামগ্রীর উপর এই নিকৃষ্ট লোভ ত্যাগ করা উচিত। ছেলেদের উচিত, যেখানে অর্থ বা সামগ্রী— যেমন আসবাব, গহনা, গাড়ি, ফ্রিজ, ইত্যাদি— বধূর সঙ্গে দেওয়া হয়, সেখানে বিবাহ করতে অসম্মত হয়ে তাদের পিতামাতা, পরিবার ও আশপাশের সামাজিক পরিবেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, তাদের বধু ছাড়া আক্ষরিক ভাবে কোনও কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকার করার সংকল্পে স্থির থাকা উচিত, কারণ তা মানবিক সম্মানের পরিপন্থী এবং প্রাচীন গ্রন্থকারেরাও নিম্নতম স্তরের বিবাহই কেবল স্বীকার করেছেন। ছেলেদের উচিত অনুপার্জিত অর্থ গ্রহণ করা যে শুধু অপরাধ তা নয়, তাদের নিজেদের উপার্জনক্ষমতার বিরুদ্ধে অপমান, এ কথা ঘোষণা করা; এই প্রথা তাদের মানবিক সম্মানের অবমাননা এবং তাদের আত্মসম্মানের পরিপন্থী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *