০৩. প্রাচীন ভারতে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার

প্রাচীন ভারতে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার

বৈদিক সাহিত্য (বিশেষ করে ঋগ্বেদ সংহিতা) সাধারণ ভাবে সে যুগে নারীর অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ে নীরব। যদিও পুরুষের অর্থনৈতিক অবস্থান, তাদের জীবিকা ও সম্পদ সম্বন্ধে কিছু তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু নারীর সম্বন্ধে অল্পই জানা যায়। আমরা জানি বৈদিক নারীরা পশম পাকাত ও সম্ভবত বুনত, জল আনত, পশুপালন করত, কিন্তু কেবলমাত্র খোরপোষ বাদে তারা এই সব কাজের জন্য কিছু উপার্জন করত কি না তা জানতে পারি না। নিঃসন্দেহে নারীরা গৃহকর্ম করত; রান্নাঘর ও শিশুপালন তাদেরই এক্তিয়ারে ছিল, কিন্তু এখনও যেমন হয় তখনও সেই কাজগুলির অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোনও হিসেব হত না, ফলে কোনও মাইনে দেওয়া হত না। কুমারীর কোনও পৃথক সত্তা ছিল না; সে তা এক ভাবে পেত কেবল বিবাহের পরে। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে স্পষ্ট ভাবে পুত্রকে বর এবং কন্যাসন্তানকে অভিশাপ বলে অভিহিত করা হয়। তাই স্নেহশীল পিতামাতা বাদে অন্য সকলে কন্যাকে, খুব কম করে বললেও, উৎপাত মনে করত। বিবাহের সময়ে দান করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত গৃহে তার উপস্থিতি কোনও রকমে সহ্য করা হত।

পরবর্তী এক সংহিতায় কিন্তু অত্রি বলেছেন, পিতার, ভ্রাতার বা পুরুষানুক্রমিক সম্পত্তিতে কুমারীর অধিকার আছে।[১] এই সম্পত্তি বিক্রি করার, বাঁধা দেওয়ার বা নিজের বলে ভোগ করার সম্পূর্ণ অধিকার তার ছিল। অবশ্যই আমরা এখানে প্রৌঢ়া কুমারী— কুলপা কুমারী, অমাজু বা অমাজুরার কথা চিন্তা করছি। ‘সাংকৃত্যায়নী’ বা ‘পণ্ডিত কৌশিকী’, উপনিষদের ব্রহ্মবাদিনীর আধ্যাত্মিক মানসকন্যা, যাদের কাছে সম্পত্তির অধিকার, বিক্রয় বা বন্ধকের কোনও গুরুত্ব ছিল না তাঁরা সাহিত্যে উল্লিখিত। হয়তো আরও কোনও কোনও প্রৌঢ়া কুমারী থাকত, যারা না ছিল পণ্ডিত, না করত ধ্যান, যাদের অর্থের প্রয়োজন ছিল জীবনধারণের জন্য, হয়তো ভাল ভাবে ও স্বাধীন ভাবে জীবনধারণের জন্য। এমনও হতে পারে যে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে তাদের সম্পত্তির উপর অধিকার ছিল। কিন্তু অত্রিও সম্পত্তি দান করার অধিকারের কথা কিছু বলেন না। আমরা পরে এই বিষয়ে আসব।

‘যে কুমারীকে বিক্রি করা বা কেনা হয়েছে, তাকে কখনও স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা যায় না।’[২] এর থেকে প্রমাণ হয়, কুমারীদের বেচা-কেনা চলত। কিছু শাস্ত্রগ্রন্থের মতে, অত্যন্ত দুর্গতির অবস্থায় পিতামাতা উভয়ের সম্মতিতে তা সম্ভব হত। কুমারী হিসেবে যে স্ত্রী কেনা হয়েছে, তার গর্ভস্থ পুত্রসন্তান পিতার শ্রাদ্ধাদিকর্মের অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হত। বিবাহের কারণে কুমারীর সতীত্ব, অর্থাৎ সামাজিক দৃষ্টিতে তার কৌমার্যের অক্ষমতা, যথেচ্ছ ভাবে কলুষিত করা যেত না। যে ঈর্ষাবশত তা করে তাকে ২২৫ পণ দণ্ড দিতে হয়।[৩] অতএব তার সামাজিক মর্যাদার অর্থমূল্য ছিল। যে দোষযুক্ত কন্যার দোষগুলি ঢাকা দিয়ে বিবাহ দেয়, তার বরকে ৯৬ পণ দণ্ড দিতে হত।[৪]

‘যে দ্বিজ তার পত্নীর বান্ধবীকে (মনে হয় কুমারী) জানে… তাকে সাধারণ প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠান করতে হবে এবং একটি দুগ্ধবতী ধেনু দান করতে হবে।’[৫]

মনু অনুজ্ঞা দিয়েছেন, ব্রাহ্মণ ভাইয়েরা তাদের পৈতৃক সম্পত্তির তাদের যে ভাগ তার এক চতুর্থাংশ করে পৃথক পৃথক ভাবে তাদের অবিবাহিতা ভগ্নিকে দেবে। তা না করলে তাদের সর্বনাশ হবে।[৬] গৌতম বলেছেন, অবিবাহিতা কন্যারা যদি জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত না হয় তবে তারা মায়ের মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে।[৭] অবিবাহিতা কন্যার ভাইয়েরা মাতার মৃত্যুর পূর্বে না পরে তার স্ত্রীধন দেবে, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। কিন্তু বৌধায়ন ধর্মসূত্র এবং তাঁর বহু পূর্বে তৈত্তিরীয় সংহিতা (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী) অনুসারে: ‘স্ত্রিয়ো নিরিন্দ্রিয়া অদায়াদীঃ’[৮], অর্থাৎ সাধারণ ভাবে নারীরা (বিশেষ করে ভগ্নিরা) পারিবারিক সম্পত্তির ভাগে অনধিকারী।[৯]

কুমারীর বাগদত্ত পতি মারা গেলে সে শুধু তার পিতারই। কুমারী যদি বলপূর্বক অপহৃতা হয় এবং অপহরণকারী তাকে বিবাহ না করে, তবে আইনত অপরের সঙ্গে তার বিবাহ হতে পারে।[১০] ‘নববধূ কুমারী কন্যা, রুগ্না অন্তঃপুরিকা, গর্ভিণী-গৃহস্থ অতিথিকে ভোজন করাবার পূর্বে এদের ভোজন করাতে পারে।’[১১] কন্যাদের কখনও কখনও কিছু শিক্ষা দেওয়া হত, যদিও বৈদিক শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত ছিল; ভরদ্বাজ গৃহ্য সূত্র-তে কোনও কন্যাকে বিবাহ করার বিষয়ে চারটি আগ্রহের কারণ দেখানো হয়েছে— ধন, রূপ, বুদ্ধি ও বংশ।[১২] বুদ্ধির পরিবর্তে মানব গৃহসূত্রে বিদ্যা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ পণ্ডিতা কন্যালাভের জন্য অনুষ্ঠানের নিয়ম আজ।[১৩] এই সব শাস্ত্রগ্রন্থের থেকেই গার্গী, সুলভা, প্রমুখ বিদুষী নারীদের আবির্ভাবের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু যদিও বৈয়াকরণ শিক্ষয়িত্রী নারী বোঝাতে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ তৈরি করার নিয়ম করেছেন,১৪] তাঁরা শিক্ষার দ্বারা উপার্জন করতে পারতেন কি না তা জানবার আমাদের কোনও উপায় নেই। খুব সম্ভব না, কিন্তু ব্যতিক্রম থাকতে পারে। একটি অত্যন্ত অর্বাচীন তান্ত্রিক গ্রন্থ বলে, ‘গৃহস্থের উচিত পুত্রের মতো কন্যাদেরও সমান শিক্ষা দেওয়া।’[১৫]

আট ধরনের বিবাহের কয়েকটিতে বধূর পিতা বরের আত্মীয়দের অর্থ দিত; কেবলমাত্র আসুর বিবাহে বরের পিতা মাতা পণ দিত। আসুর বিবাহে বর নিজের কামনা চরিতার্থ করতে বধূর পিতাকে এবং বধূকেও পণ দেয়।[১৬] ব্রাহ্ম, দৈব ও আর্য বিবাহে বধূর পিতা নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী ধন, অলংকার, একজোড়া বলদ এবং অন্যান্য উপহার দেবে। ব্রাহ্ম বিবাহে প্রসাধিতা ও সুসজ্জিতা কন্যাকে দান করা হত, আর্য বিবাহে বধূকে সম্প্রদান করা হত বরকে একটি বলদ ও একটি গরু বা দুটি বলদ ও দুটি গরু দান করার পরে।[১৭] এই প্রথার প্রতি তৎকালীন সামাজিক জুগুপ্সার প্রকাশ হয় আসুর নামটায়। কিন্তু বিবাহের সময়ে যখন অর্থদান হত তখন বধূ বা তার পিতামাতাই তার সুযোগ পেত। যাকে স্ত্রীধন বলে, তা তিন প্রকারের: পণ, যা দিয়ে বধূকে কেনা হত; যৌতুক, অর্থাৎ বিবাহের সময়ে আত্মীয়-বন্ধুরা বধূকে যে উপহার দিত এবং সৌদায়িক অর্থাৎ বধূ বা বরের গৃহে আত্মীয় বন্ধুদের বধূকে বা দম্পতিকে দেওয়া উপহার। যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন: নারীকে তার বন্ধু, মাতা, স্বামী বা ভ্রাতা যা দেয়, তা হল স্ত্রীধন।[১৮] তার আত্মীয়স্বজন (অর্থাৎ তার পিতামাতার সঙ্গে সম্বন্ধীয় ব্যক্তিরা) এবং তার স্বামী অথবা পিতার পরিবার তাকে বিবাহের পর শুল্ক স্বরূপ যা দেয়, তাও স্ত্রীধন। ১৯] স্পষ্টতই সে সময়ের সমাজ বরের কাছ থেকে বধূর পিতা যে অর্থ নেবে এটা পছন্দ করত না। মনু বলেছেন, জ্ঞানী পিতা কখনওই কন্যাশুল্ক নেবে না, কারণ লোভবশত কন্যাশুল্ক নিলে সে তার সন্তানকে বিক্রি করছে।[২০] এমনকী গোমিথুন বা বলীবদযুগল (কন্যার পিতা বরের কাছ থেকে গ্রহণ করলে) তাও কোনও কোনও শাস্ত্রগ্রন্থে পণ বলে গণ্য হয় (‘পণ গ্রহণ করা, তা বহুমূল্যই হোক বা অল্প মূল্যই হোক কন্যা বিক্রয়ের সমান’)। লক্ষ্য করা যায়, বরকে পণ দেওয়ার প্রথা ছিল— স্পষ্ট ভাবেই হোক বা গূঢ় ভাবেই হোক; কিন্তু বরের পিতার পণ নেওয়ার বিরুদ্ধে কোনও শাস্ত্র নেই, কেউ এই আদান-প্রদানকে বিক্রি বলে না, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয়ই।

কন্যাশুল্কের বিরুদ্ধে এই যে নির্দেশ, তার দ্বারা সূচিত হয় বরপণের সপক্ষে পুরোমাত্রায় ঝোঁক। এটা কুষাণ যুগের সংস্কৃতায়নের একটি অবশ্যম্ভাবী লক্ষণ— যে সময়ে মনুসংহিতার প্রথম সংস্করণ রচিত হয়েছিল। আধুনিক পণ সম্পূর্ণ ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কর্তৃক শৃঙ্খলমুক্ত শক্তিগুলির কার্য।’[২১] ‘পণপ্রথা অসাম্য, অনিশ্চয়তা ও আকস্মিকতার দ্বারা নিরূপিত।[২২] বরের জন্য পণ হল hypergamy (উচ্চতর বিবাহ প্রথা), ‘যা ক্রমিক স্তর বিশিষ্ট বর্ণগুলির মধ্যে ব্যাপক; উচ্চতর শ্রেণিগুলিতে প্রধানত পণ এবং নিম্নতর শ্রেণিগুলিতে প্রধানত কন্যা শুল্ক এবং পণ ও কন্যাশুল্ক দুটিই সামাজিক প্রতিষ্ঠাকামী মধ্যস্তরের পরিবারগুলিতে ব্যাপক।[২৩]

পণই হোক বা কন্যাশুল্কই হোক— তা সমাজে সম্পন্নতার পরিচায়ক, কিন্তু বরপণ কন্যাশুল্কের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু কন্যাশুল্ক গ্রহণের এই যে অনিচ্ছা, তা মনে হয় অনেকগুলি সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। সম্পন্নতা যার ফলে বধূর পরিবার পণ দিতে পারে, তা তো বটেই, এটি ইঙ্গিত দিতে পারে ব্যাপক যুদ্ধের অবসানের, যে যুদ্ধ পুরুষের সংখ্যা হ্রাস করছিল, উচ্চতর বিবাহ প্রথার কামনা, সম্পদ দিয়ে সামাজিক সিঁড়িতে উপরে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত এর ভিত্তি হয়তো এমন কোনও ধারণা, যাতে বধূর পিতা বুঝতে পারছিল যে সে যা পণ হিসেবে খরচ করেছে তা তার পুত্রের বিবাহের সময়ে আদায় করতে পারবে। এই প্রথা অবশ্যই ইঙ্গিত করে নারীর সামাজিক অবনমনের, কারণ যখন একজন পুরুষ একটি কুমারীকে বিবাহ করে এবং তাকে চিরকৌমার্যের লজ্জা থেকে উদ্ধার করে, তখন কন্যার পিতার তাকে কিছু মূল্য দিতে হয় এই উপকারটুকুর জন্য। আড়ম্বর এবং জাঁকজমক দেখাবার বাসনাও এখানে ছিল। খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীগুলির সময়ে সমাজের উপর যাঁর প্রভাব ভগবদ্গীতা এবং বাৎস্যায়নের সঙ্গে সমান ভাবে প্রবল ছিল সেই মধু দুই সহস্র বছর ধরে সমাজ নিয়ন্ত্রিত করেছেন। তিনি ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের বিবাহের বিবরণ দিয়েছেন, যার প্রথম তিনটিতে কন্যার পিতা পণ দেয়, বরকে উপহার দেয়; কেবলমাত্র আসুর বিবাহে এর বিপরীতটাই ঘটে। এর নিচ অর্থে ব্যবহৃত নাম ‘আসুর’ হয়তো দ্রাবিড় অঞ্চলে এর উদ্ভবের সূচনা করে— যেখানে দুশো বছর পূর্ব পর্যন্তও এটি ব্যাপক প্রচলিত প্রথা ছিল।

কিন্তু ‘কন্যাশুল্ক’ অর্বাচীন বৈদিক যুগ থেকে নিয়মিত প্রথা হিসেবে গৃহীত হয়ে এসেছে। আমরা শুনি, ‘ইন্দ্র তুমি ঈষৎ ত্রুটিগ্রস্ত জামাতা বা শ্যালকের তুলনায় অনেক বড় দাতা।[২৪] অতএব ত্রুটিযুক্ত বরেরা অর্থমূল্য ক্ষতিপূরণ দিত। কন্যাশুল্কের সঙ্গে পণকে মেলানোর এক প্রচেষ্টা দেখা যায় আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে (২:৬:১৩:১০:১১)। সেখানে বলা হয়েছে, ‘এ বিষয়ে ক্রয়-বিক্রয় বলে কিছু নেই। বিবাহকালে একশত মহারথী দিতে হবে, এবং তারপর তাদের দাতার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।’ এখানে ক্রয় শুধুমাত্র প্রশংসার উক্তি; সম্বন্ধের মূল ধর্ম। কৌটিল্য বলেছেন, ‘ম্লেচ্ছদের পক্ষে কন্যাবিক্রয় নিন্দনীয় নয়।’[২৫] যাজ্ঞবল্ক্য খুব যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলেছেন, পুত্র বা কন্যা, কাউকেই বিক্রয় করা যায় না।[২৬] এই অংশের উপর মিতাক্ষরা টীকায় বলা হয়েছে যদিও কেউ তার পত্নী বা কন্যাকে বিক্রয় করতে পারে না, তবুও সে তাদের প্রভু।’ মনে পড়ে, পুত্র শুনঃশেফকে পিতা বিক্রয় করতে পেরেছিলেন, কিন্তু কন্যা বিক্রয়েরও উদাহরণ আছে।

পণের ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বধূর ভরণপোষণের মূল্য হিসেবে। এই মত যুক্তিসঙ্গত নয়, কারণ বধূ তার সংসারের কাজকর্মে সাহায্য করে এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও উৎপাদন করে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, এটি কন্যাদানের দক্ষিণা। এ কথাও গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তথাকথিত দক্ষিণা সামাজিক অস্তিত্বহীন নারীর দানের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। এসথার বোসরাপ বলেন যে, বাইরের জগতের উৎপাদনশীল শ্রমশক্তির থেকে নারীকে সরিয়ে নেওয়ার পর পণ এল ক্ষতিপূরণ হিসেবে, কারণ তাদের জায়গায় পুরুষদের পারিশ্রমিক দিয়ে আনতে হল।[২৭] এর মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যের কিছুটা উপাদান থাকতে পারে। পণ স্ত্রীধন নয়, কারণ এটি বরের পিতার প্ররোচনায় দেওয়া হয়। এম এস শ্রীনিবাস বলেন, ‘ভারতীয় উপদ্বীপ ছিল ব্রাহ্মণদের নিয়ে কন্যাশুল্ক এলাকা; সেখান থেকে তা উচ্চতর বিবাহ প্রথার প্রতি এবং সামাজিক উন্নতির প্রতি আকাঙ্ক্ষাবশত উত্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল।’[২৮]

এখন বধূর পিতা যে পণ দিত তা বর ও তার পিতাকে দেওয়া হত, ফলে তা স্ত্রীধনের অংশ কোনও মতেই হত না; তার ব্যবহার বা অপব্যবহার সম্বন্ধে স্ত্রী কোনও কথাই বলতে পারত না। যদি বর কন্যাশুল্ক দেওয়ার পরে ভাবী বধু মারা যেত, তাহলে সে যা দিয়েছে তা ফিরিয়ে নিত।[২৯] অপরার্কের একটি অর্বাচীন গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা হয়েছে ‘সৌদায়িকের উপর স্ত্রীর সম্পূর্ণ অধিকার’— এমনকী স্থাবর সম্পত্তি হলেও সে তা বেচতে বা দান করতে পারে। সে তা অবিকৃত রাখতে পারে; তার স্বামী, পুত্রেরা, তার বা তার স্বামীর ভাইয়েরা তা গ্রহণ করতে বা দান করতে পারে না; তার উপর নারীর সম্পূর্ণ অধিকার। কিন্তু তার আত্মীয়-বন্ধুরা বিবাহের সময়ে তার পিতৃগৃহে যা দেয় তা নির্বাচিত ভাবে যৌতুক, এক শ্রেণির স্ত্রীধন, এবং যা দম্পতিকে বধূ বা বরের গৃহে দেওয়া হয় তা সৌদায়িক এবং তার অন্তত অর্ধেকের উপর বধূর অধিকার। মনু আরও বলেছেন, ‘যে নারীর স্বামী দ্বিতীয় বার বিবাহ করে, তার সমান পরিমাণ ধন (প্রথমা স্ত্রীকে) উচ্ছিন্ন করার জন্য ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দিতে হবে, যদি তাকে স্ত্রীধন না দেওয়া হয়ে থাকে। যদি দেওয়া হয়ে থাকে, তবে অর্ধেক দিতে হবে।’[৩০] কিন্তু ‘পুত্রহীনা পুত্রিকার মৃত্যুর পরে তার স্বামী তার সমস্ত সম্পত্তি বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করবে।’[৩১] বিষ্ণু কিন্তু বলেছেন যে অপুত্রক ব্যক্তির সম্পত্তি তার স্ত্রীগামী হয়, তারপর তার কন্যারা, তারপর তার ভ্রাতারা এবং তারপর তার ভ্রাতুষ্পুত্রেরা তা পায়।[৩২]

এই সব গ্রন্থে আমরা সামাজিক নিয়ম ও মনোভাবের নানা স্থানীয়, আঞ্চলিক ও কালিক ব্যতিক্রম পাই। কোনও কোনও শাস্ত্রকার অপরদের চেয়ে একটু বেশি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন। কিন্তু সাধারণ চিত্রটা স্ত্রীদের পক্ষে আশাহীন ও নির্মম। স্বামী তার পরবর্তী বিবাহের সময়ে তাকে যা দেয় তা সম্পূর্ণ ভাবে তার নিজস্ব। নারদ বলেন, দ্বিতীয় বিবাহের সময়ে স্বামী তার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ তার স্ত্রীকে দেবে এবং সেই সম্পত্তি তার নিজের মতো ব্যবহার করার স্বাধীনতা স্ত্রীর আছে— অন্তত পুঁথিগত ভাবে। যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, দুর্ভিক্ষ, অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান, রোগ বা তা নিজের কারারুদ্ধ থাকার সময়ে ছাড়া স্বামীর স্ত্রীধন স্পর্শ করার অধিকার নেই।[৩৩] যদিও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিগুলি যথেষ্ট নিরীহ শোনায়, সেগুলি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্বামীর সুবিধা মতো ব্যাখ্যা করার অনেক ফাঁকফোকর রেখে দেয়। আর এক জায়গায় যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, ‘স্বামী দুর্ভিক্ষের কালে, কর্তব্যপালনের জন্য, রোগে অথবা বন্দিদশায় যদি স্ত্রীধন ব্যবহার করে তবে তা ফেরত দিতে সে বাধ্য হবে না।’[৩৪] অপর এক গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ‘ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য বা প্রজাপত্য বিবাহে নিঃসন্তান নারীর স্ত্রীধন তার স্বামী পায়।’ তাই নারী তার নিজস্ব সম্পত্তি ব্যবহার করবে, সমাজ এটা দেখতে পারত না বা মেনে নিতে পারত না। বশিষ্ঠ খুব স্পষ্ট ভাবেই তা প্রকাশ করেছেন: ‘স্বামীর পুনর্বিবাহের সময়ে তাকে যা দেওয়া হয়েছে, যা তাকে তার আত্মীয়স্বজন দিয়েছে (সৌদায়িক বা যৌতুক হিসাবে) এবং তার শুল্ক অর্থাৎ যা তাকে বিবাহের পর দেওয়া হয়েছে, তা নারীর সম্পত্তি, তার স্ত্রীধন।’[৩৫] মনু বলেন মাতার স্ত্রীধন কন্যার প্রাপ্য এবং কন্যার পুত্র অপুত্রক পুরুষের সমস্ত সম্পত্তি নেবে।[৩৬] কিন্তু মনু আরও বলেছেন, ‘কোনও নারীর বন্ধু বা আত্মীয়েরা মূঢ়তা বা লোভবশত যদি তার সম্পত্তি ভোগ করে, বা সে সব পাপীরা তার নিজের সম্পত্তি বস্ত্রাদির ভোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করে, তাহলে তারা নরকে যায়।’[৩৭] প্রথমত, পুঁথিগত ভাবে নারীর সম্পত্তি ‘বস্ত্রাদি’ ছাড়াও আরও অনেক বেশি কিছু বোঝাতে পারে। কেননা, গ্রন্থে যেমন বলা হয়েছে এ সম্পত্তি এমন হতে পারে, যা ‘বন্ধু এবং আত্মীয়েরা লোভবশত ভোগ করতে পারে।’ একটি খুব প্রাচীন গ্রন্থ, মৈত্রায়ণী সংহিতা, যা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর বৈদিক গ্রন্থ, সেখানে বলা হয়েছে, ‘নারীর যে আত্মীয়েরা তার স্ত্রীধন গাড়ি, কাপড়-চোপড় এবং স্বর্ণালংকার বিক্রি করে জীবিকানির্বাহ করে, তারা পাপ করছে এবং পরলোকে তারা আরও দুর্ভাগ্যের অধিকারী হবে।’[৩৮] সুতরাং ‘বস্ত্রাদি’ কেবলমাত্র চোখে ধুলো দেওয়া; শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কখনও কখনও, খুব সম্ভব প্রায়শই নির্লজ্জ ভাবে নারী যে সম্পত্তি নিয়ে এসেছে তা ভোগ করত। তাই ধনী পিতার কন্যাও— যা তার স্ত্রীধন থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হয়— শ্বশুরবাড়িতে সত্যকার কোনও নিরাপত্তা পেত না। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং সেই কারণে অর্থকরী জীবিকা থেকে বঞ্চিত, অসহায়, শ্বশুরবাড়ির প্রবল ভাবে সংখ্যাগুরু লোভী মানুষগুলির মধ্যে আশাহীন সংখ্যালঘু নারীর তার নিজত্বের যা কিছু তা রক্ষা করার সত্যিকারের কোনও উপায় ছিল না— তা ভোগ করা তো দূরস্থান। সুতরাং এ ধরনের ঘটনা ঘটত— শাস্ত্রকার শূন্য কল্পনা করছেন না, নিষ্পাপ মস্তিষ্কে কুবুদ্ধিও ঢোকাচ্ছেন না। নরকে যাওয়ার বা পরকালে গুরুতর দুর্ভাগ্য ভোগের ভয় সেই বেচারি মেয়েটির স্ত্রীধন ভোগ করা থেকে তাদের কতটা বাধা দিত সেটাই চিন্তনীয়। অনুপার্জিত ধন ভোগ করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেশ লোভনীয়। দেবল অবশ্য দাবি করেছেন যে, কন্যাশুল্ক এবং সুদ থেকে পাওয়া লভ্যাংশ নারীর নিজস্ব সম্পত্তি, স্বামীর তার উপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। জৈমিনিও বলেছেন, নারী বিশেষ কোনও কোনও ধরনের সম্পত্তির অধিকারিণী। কিন্তু কাত্যায়ন বলেন, নারী তার শিল্পকর্মের দ্বারা যা উপার্জন করে এবং যা অপরে ভালবেসে তাকে দেয়, স্বামী তার অধিকারী। বাকি যা থাকে, তা স্ত্রীধন।[৩৯] এটা পরিষ্কার যে, বিশেষ কিছুই আর বাকি থাকে না, কারণ কাত্যায়নের নির্দেশ নারীর উপার্জন এবং উপহার স্বামীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। অন্য কোনও রকম স্ত্রীধন কল্পনা করা দুষ্কর।

গৃহস্থালির অর্থ এবং সম্পত্তি ব্যবহারে স্ত্রীর ভূমিকা কী? আপস্তম্ব বলেছেন, ‘দম্পতি পারিবারিক ধন ব্যবহার করত।’[৪০] এমনকী দার্শনিক গ্রন্থ পূর্বমীমাংসাও বলেছে: ‘দম্পতি যৌথ ভাবে সম্পত্তির অধিকারী।’[৪১] মনে পড়ে সংস্কৃত ‘দম্পতি’ শব্দের ইন্দো-ইউরোপীয় মূল শব্দটি এসেছে দোমোস+পতি— গৃহস্বামী থেকে। স্পষ্টতই আপস্তম্ব এবং পূর্বমীমাংসা দুইয়েই শব্দের মূল অর্থের সূচনা আছে।

‘স্বামী যদি কাজের জন্য বাড়ি ছেড়ে যায়, তাকে আগে স্ত্রীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে রেখে যেতে হবে।[৪২] ‘তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী যদি মদ্যপান করে বা প্রকাশ্য নৃত্যানুষ্ঠানে যায়, তাকে ছয় কৃষ্ণল দণ্ড দিতে হবে।’[৪৩] কিন্তু স্বামী বা পুত্রের ঋণ শোধ করতে নারী বাধ্য নয়।[৪৪] গোয়ালা, সুরাবিক্রেতা, অভিনেতা, রজক ও শিকারীর স্ত্রী যে ঋণ করবে তা তাদের স্বামীরা শোধ করবে, কারণ তাদের জীবিকা তাদের স্ত্রীর উপার্জনের উপর নির্ভর করে। যে ঋণ সে নিজে শোধ করবে বলে প্রতিশ্রুত, যে ঋণ সে তার স্বামীর সঙ্গে করেছে এবং যা সে নিজে নিয়েছে, এ সবই নারীকে শোধ করতে হবে: অন্য কিছু শোধ করতে সে বাধ্য নয়। ‘ঋণী ব্যক্তির স্ত্রীকে নিলে তার স্বামীর ঋণ শোধ করতে হবে।[৪৫] ঋণ শোধের প্রশ্নটিই নারীর শোধ করার ক্ষমতা উত্থাপিত করে। কিন্তু সে রকম ক্ষেত্রে শোধ করা হয় যৌথ পারিবারিক কোষ থেকে এবং যদি নারীর অধিকার না থাকে তাকে সম্ভবত তার নিজস্ব স্ত্রীধন থেকে। এই ধারণার পিছনে এই অনুমান কাজ করে যে, নারীর সম্পত্তিতে অধিকার থাকা উচিত নয়, তাই তা নেই। মেধাতিথি বলেন, নারী যা উপার্জন করে তা তার স্বামীর।[৪৬] আপস্তম্ব বলেন, ‘কোনও কোনও পূর্বাচার্য মনে করেন, অলংকারগুলি স্ত্রীর নিজস্ব এবং যে সম্পত্তি তার পিতৃকুল থেকে লব্ধ তাও তার নিজস্ব।[৪৭] মনে হয় স্ত্রীর অলংকারের উপরেও তার স্বত্ব বিষয়ে মতভেদ ছিল— যে অলংকার সে তার পিতৃগৃহ থেকে এনেছে! বৌধায়ন বলেছেন, ‘কন্যা মাতার অলংকার ও আর যা নিয়মসঙ্গত, তা পেয়ে থাকে।[৪৮] মনু স্ত্রীধনের একটি ঊর্ধ্বসীমা ধার্য করেছেন—২০০০ পণ পর্যন্ত।[৪৯] কিন্তু ভূমি বা গৃহ স্ত্রীধন হতে পারে না এই শাস্ত্রকাররা এটা বলেন, সম্ভবত এই কারণে যে, সেগুলি শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। জৈমিনি এ বিষয়ে একমত যে নারী কিছু কিছু সম্পত্তির অধিকারিণী হতে পারে এবং হয়ও। মনু বলেছেন স্ত্রীধনের উৎস দুটি: বিবাহের সময়ে, যাত্রার সময়ে, প্রীতির কারণে দান, ভ্রাতা ও পিতামাতার দান। কাত্যায়ন একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যোগ করেছেন: যা সে শিল্পকার্য দ্বারা উপার্জন করে এবং যা তাকে ভালবেসে দেওয়া হয় তা তার স্বামীর অধীন, বাকিটুকু স্ত্রীধন।[৫০] এক নিষ্ঠুর উপলব্ধি হয় যে, তার নিজস্ব উপার্জন তার নিজের নয়। ‘যৌতুক’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, যা একত্র উপবিষ্ট যুগলকে (যুতক) দেওয়া হয়।[৫১] ‘দুষ্টা অমিতব্যয়িনী স্ত্রীর স্ত্রীধনের উপর অধিকার নেই।’[৫২] দুষ্ট ও লোভী শ্বশুরবাড়ির লোকেদের পক্ষে স্ত্রী যে অমিতব্যয়িনী এ কথা প্রমাণ করা এবং যা আইনত তার নিজের তা কেড়ে নেওয়া খুব কঠিন ছিল না। ‘স্বামীর প্রতিশ্রুত স্ত্রীধন স্ত্রীকে অবশ্যই দিতে হবে’[৫৩] —এ কথা বলার পরও আইনের ফাঁক খুঁজে নেওয়াটা সমস্যা ছিল না।

কন্যাশুল্ক দেওয়া স্ত্রীর উপরে একটা বোঝা চাপানো, কারণ সে এবং অন্য সকলে তাকে পণ্যদ্রব্য বলে মনে করত। প্রাচীন গ্রন্থ মৈত্রায়ণী সংহিতায় বলা হয়েছে, ‘স্বামী যে স্ত্রীকে ক্রয় করেছে, সে যখন অপরের সঙ্গে ব্যভিচার করে, তা মিথ্যাচার।’ কিন্তু মনে রাখতে হবে, যখন পণপ্রথার প্রচলন ঘটল, তখন বর কখনওই নিজেকে পণ্যদ্রব্য মনে করত না, যদিও সে স্ত্রীর তুলনায় অনেক বেশি পণ্যদ্রব্য কারণ পণের তুলনায় কন্যাশুল্ক প্রায় কিছুই না, পণ হল সামাজিক প্রতিষ্ঠার লক্ষণ ও অন্যায্য এবং নির্লজ্জ ভাবে অর্থ আদায়।

মনু বলেন, ‘স্ত্রীকে জোর করে বশে রাখা যায় না; নিম্নোক্ত উপায়গুলি প্রয়োগ করে তাকে বশে রাখতে হয়। স্ত্রীদের নিযুক্ত করতে হবে অর্থ সঞ্চয় ও ব্যয় করার কাজে (অর্থাৎ পরিবারের অর্থ রক্ষণাবেক্ষণে) এবং নিজেদের দেহ, গৃহ, বিছানাপত্র, বস্ত্র, আসবাবপত্র পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে। গৃহে বন্দি থাকলে এবং পুরুষ আত্মীয়দের পাহারায় থাকলেও (দুষ্ট নারী যথেষ্ট রক্ষিত নয়।’[৫৪] তাহলে স্ত্রীকে বশে রাখা, যা কি না বৈধ পুত্রসন্তান লাভে আবশ্যিক, তার একটি উপায় হল, তাকে নানা রকম গৃহকর্মে নিযুক্ত রাখা, যেগুলি আর্থিক মূল্যে কখনওই রূপান্তরিত করা যায় না, যার ফলে সর্বদাই তার নিজেকে পরিবারের আর্থিক বোঝা বলে মনে হত।

স্বামী হারাবার পর সমাজ তাকে দেখতে শুরু করত আর্থিক বিপদ এবং ভার হিসেবে। কৃষিপ্রধান সমাজে যৌথ পরিবার ছিল মূল, সেখানে পরিবারের সম্পত্তি কর্ষণীয় ভূমি ভাগ করার আশঙ্কা খুবই বাস্তব ছিল। এ ব্যাপার ঘটতে পারত যদি স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী ভূমি পেত এবং সে পুনর্বিবাহ করলে তার নতুন স্বামী তার ভূমির ভাগ পেত। দুটি ধারণাই অন্য ভাইদের কাছে নিশ্চয়ই জুগুপ্সাজনক ছিল। দু-একজন বাদে পরবর্তী বৈদিক স্মৃতিকারেরা নিয়ম করলেন যে, বিধবাকে স্বামীর শবদেহের সঙ্গে দাহ করা হবে। অথবা তাকে যদি আদৌ বেঁচে থাকতে দেওয়া হয়, তাহলে স্মৃতিকারেরা তার জীবনকে জীবনমৃত্যুতে পরিণত করেছিলেন— তার যে কোনও অর্থনৈতিক আশ্রয় নেই এ বিষয়ে তার দৈনন্দিন জীবনে সহস্র খোঁচা দিয়ে।

যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, ‘যে নারীর স্বামী নেই তার দেখাশোনা করবে তার পিতা, মাতা, পুত্র, ভ্রাতা, শ্বশুর বা শাশুড়ি; না হলে সে নিন্দার ভাজন হবে।’[৫৫] তার অভিভাবকের তালিকায় শেষ দু’জন বাদে বাকি সকলে তার নিজের পরিবারেরই সদস্য, যারা তার রক্ষণাবেক্ষণ করবে বলে প্রত্যাশা করা হয়। আপস্তম্ব, মনু এবং নারদ একমত যে অপুত্রক স্বামীর বিধবা স্ত্রী সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না। কিন্তু গৌতম বলেছেন, সে তার সপিণ্ড ও সগোত্রদের সঙ্গে সমান ভাবে উত্তরাধিকারী।[৫৬] অন্যত্র যাজ্ঞবল্ক্য নিয়ম করেছেন যে, অপুত্রক ব্যক্তির বিধবা প্রথম উত্তরাধিকারিণী।[৫৭] এ ব্যাপারে বিষ্ণু ও কাত্যায়নও যোগ দিয়েছেন। কোনও নারীর স্বামীর যদি আট থেকে দশ বছর কোনও সংবাদ না পাওয়া যায় তবে সে পুনর্বিবাহ করতে পারে।[৫৮] স্বামীর যদি পৃথক ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকে এবং এক বা একাধিক পুত্ৰ থাকে তাহলে বিধবার শুধু ভরণপোষণের অধিকার আছে। নিয়োগ প্রথায় পরপুরুষের বিধবা নারীতে পুত্রোৎপাদন বিষয়ে মনু খুব স্পষ্ট নন। তিনি এর নিন্দা করেন।[৫৯] বিধবা, এমনকী সাধারণ ভাবে নারী নিজে সন্তান পোষ্য নিতে পারে না, কারণ তারা প্রয়োজনীয় বৈদিক মন্ত্ৰ উচ্চারণ করতে পারে না। তাই তারা স্বাধীন ভাবে এমন সন্তান পোষ্য নিতে পারত না। যার উপরে তারা অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভর করতে পারত।

নারদ বিধবার যে সাত রকম ব্যবস্থার কথা কল্পনা করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম বিদেশির দ্বার ক্রীত হওয়া।[৬০] পরাশর নারীর বিষয়ে যে পুনর্বিবাহের বিধান করেছেন তার ফলে সে পুনর্ভব হয় এবং স্বামীর সম্পত্তির অধিকার হারায়। স্মরণ করা যেতে পারে, দায়ভাগ নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বিধবা স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেত, যা মিতাক্ষরা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সম্ভব ছিল না। ফলে দায়ভাগ নিয়ন্ত্রিত বাংলায় ১৮১৫ থেকে ১৮৮০-র মধ্যে সামগ্রিক ভাবে ২৩৬৬ জন বিধবাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, যার মধ্যে শুধু কলকাতাতেই এ রকম নৃশংসতা ঘটে ১,৮৫৮টি। ঋগ্বেদের সময়েও বিধবা করুণার পাত্রীই ছিল, নচেৎ আমরা অবৈধব্যের প্রার্থনা পেতাম না। কিন্তু মহাকাব্যে এবং এমনকী মনুও তাদের মৃত্যুর বিধান দেননি। কুন্তী ও গান্ধারী এবং দশরথের তিন মহিষী এবং বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে বিধবারা বেঁচেই ছিল এবং সম্মানের সঙ্গেই বেঁচে ছিল। নিম্নতর শ্রেণির মধ্যে, যতদিন না সংস্কৃতায়নের দুর্ভাগ্যজনক মিশ্রণ ঘটেছিল, ততদিন পর্যন্ত সতীদাহ ছিল না; তা শুরু হয় সংস্কৃতায়নের সঙ্গে সঙ্গেই। তথাকথিত নিম্নতর শ্রেণিতে বিধবাদের উদাহরণ সাহিত্যে পাওয়া যায় না।

বিধবাদের অর্থনৈতিক সমস্যা আরও জটিল হয়েছিল বহু বিবাহ এবং পুত্রের মাতার বিষয়ে সামাজিক গুরুত্বের কারণে। শুধু কন্যা আছে যার এ রকম বা নিঃসন্তান বিধবারা অর্থনৈতিক ভাবে উৎপীড়িত ছিল এবং সাধারণ ভাবে তাদের পিতামাতা বা ভ্রাতার উপর নির্ভরশীল ছিল। শ্বশুরবাড়িতে তাদের আরোপিত দায়িত্ব হিসেবে দেখা হত। তাছাড়া যে পুরুষের বিভিন্ন বর্ণের পত্নী থাকত, সে তার বিষয় সম্পত্তি আরও জটিল পরিস্থিতিতে রেখে যেত, কারণ বিধবাদের ভাগ্য বিষয়ে স্মৃতিকারদের পরস্পর মতভেদ ছিল। কেউ ভরণপোষণে বিধবার দাবি সমর্থন করতেন, কেউ আবার নামমাত্র ভৃতির পক্ষপাতী ছিলেন। কখনও কখনও আবার শাস্ত্রের বিধি এবং সমাজব্যবহার, যা সাহিত্যে পাওয়া যায়, এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা যায়। গৌতম বলেছেন, ‘নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তি তার স্ত্রীগামী।’[৬১] কিন্তু অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ আমরা শুনি এ রকম একটি বিষয় দুষ্যন্তের কাছে বিজ্ঞাপিত হলে তিনি বলেন যে, শাস্ত্রমতে এই সম্পত্তি রাজকোষে বাজেয়াপ্ত হবে।[৬২] সম্ভবত অন্য কোনও শাস্ত্রগ্রন্থ বা আঞ্চলিক ব্যবহার দ্বারা তিনি উপদিষ্ট ছিলেন।

বিবাহ বিচ্ছেদ পাশ্চাত্য অর্থে স্বীকৃত ছিল না। যদিও এমন শাস্ত্রগ্রন্থও আছে, যেখানে নিয়ম আছে যে, প্রতিকূল পত্নীকেও ত্যাগ করা যাবে না। কিন্তু পারস্পরিক দ্বেষ থাকলে দম্পতি বিচ্ছিন্ন হতে পারে। অর্থশাস্ত্র-তে আছে ‘স্বামী যদি স্ত্রীর দোষে বিচ্ছেদ চায়, তবে সে স্ত্রীর কাছ থেকে যা পেয়েছে তা ফেরত দেবে। যদি অনুরূপ কারণে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে মুক্তি চায় তবে স্বামী তার কাছ থেকে যা পেয়েছে তা ফেরত দেবে না। ধর্মবিবাহে বিবাহ বিচ্ছেদ নেই।[৬৩] এই গ্রন্থে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদ্বেষের কারণে উভয়পক্ষকে বিচ্ছেদের অধিকার দিয়েছে, কিন্তু বিচ্ছেদের বিষয়ে পুরুষের স্বাধীনতা সম্মান পেলেও নারীকে অর্থনৈতিক দণ্ড ভোগ করতে হয়েছে, কারণ সে তার স্ত্রীধন হারাচ্ছে।

সব সমাজেই সাধারণ ধর্ষণ কতকটা ক্ষমার চোখে দেখা হয়েছে। যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন দাসীকে ধর্ষণ করলে পুরুষের দশ পণ দণ্ড হবে।[৬৪] সে যদি ভিক্ষুণীকে ধর্ষণ করে তবে তার দণ্ড ২৪ পণ।[৬৫] প্রভু দাসীকে ধর্ষণ করার বিষয়ে প্রথমেই যে প্রশ্ন মনে আসে, তা হল, সে কি করে পুরুষকে দণ্ড দিতে বাধ্য করবে? কে তাকে বিশ্বাস করবে, কে তার পক্ষ নেবে? বরং ভিক্ষুণীর কথা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং সে হয়তো জোর করলে অর্থ পাবে, কিন্তু গোটা বাস্তবটাই কতকটা অবাস্তব শোনায়।

সাহিত্যে ধর্ষণকারীর বেকসুর খালাস পাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ আছে। তাছাড়া আইন ও সামাজিক প্রথা উচ্চবর্ণের পুরুষের প্রতি এতটাই ক্ষমাশীল ছিল যে, তথাকথিত নিম্নবর্ণের নারীরা তাদের কাছে বিনা মূল্যেই সহজলভ্য ছিল। সুতরাং শাস্ত্র বাধা দেবে এমন প্রত্যাশা ছিল না। সমাজে নারীর অতি নিম্নস্তরের অবস্থানের কারণে সে পুরুষের লালসার কাছে অত্যন্ত অসহায় ছিল এবং সেই পুরুষেরা ধর্মশাস্ত্রকারদের সাহায্যে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে বিনা শাস্তিতে এই আচরণ করত।

অসতী স্ত্রীদের ভয়াবহ রকম নিষ্ঠুর ভাবে শাস্তি দেওয়া হত; যে সব ধর্মশাস্ত্রে এই শাস্তির বিধান আছে, সেগুলি ধর্ষকাম লেখকদের রচনার মতো লাগে। অন্যান্য শাস্ত্রে বিধান আছে: ‘অসতী স্ত্রীকে তার সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে হবে এবং তাকে কষ্টে থাকতে বাধ্য করতে হবে, এক গ্রাস মাত্র অন্ন দিয়ে। তাকে সব সময়ে তিরস্কার করতে হবে, মাটিতে শুতে হবে, কিন্তু তার স্বামীর বাড়িতেই থাকতে হবে। (যাতে সে তার পাপকর্ম থেকে বিরত হয়)।’[৬৬]

এখন প্রশ্ন হল, সে যখন তার কার্যকলাপ সংশোধন করবে, তখন কী হবে? তখন কি তাকে ভরপেট খেতে ও স্বামীর শয্যায় শুতে অনুমতি দেওয়া হবে? ‘যদি স্বামী তার আজ্ঞানুবর্তিনী স্ত্রীকে ত্যাগ করে, যে স্ত্রী কর্মপটু এবং বীর পুত্রের জননী, তাহলে সেই স্ত্রীকে (স্বামীর) সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ এবং ভরণপোষণ দিতে হবে।[৬৭] স্ত্রীর জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ঘটায় এই নিয়মে নির্দোষ স্ত্রীকেও শুধুমাত্র স্বামীর সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ দিয়ে ত্যাগ করা যায়। সমাজে শুধু পুরুষ ও নারীর জন্য দ্বিমুখী বিচারব্যবস্থা ছিল তাই নয়, যে স্ত্রী তার স্বামীর অপ্রিয়, তার পক্ষে তার আইনত যে অধিকার তা পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যায় না। ‘অসতী স্ত্রীকে দৈনন্দিন আহার্যটুকু দিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখতে হবে। সতীত্বের কর্তব্য যে লঙ্ঘন করেছে, সেই স্ত্রীকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাকে বন্দি করে রাখতে হবে এবং খেতে দিতে হবে।[৬৮] ‘ব্যভিচারিণী নারীকে তার অধিকার (ভৃত্যাদির উপরে) থেকে বঞ্চিত করতে হবে, ময়লা কাপড় পরতে দিতে হবে, নামমাত্র খেতে দিতে হবে। যদি সে পরপুরুষের দ্বারা গর্ভবতী হয়, তবে তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে।[৬৯] বশিষ্ঠ বলেন, ‘উচ্চতর তিন বর্ণের স্ত্রীরা শূদ্রের সঙ্গে ব্যভিচার করলে তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে। স্ত্রী যদি স্বামী বা গুরুকে হত্যা করতে চেষ্টা করে, তবে তাকে তাড়িয়ে দিতে হবে।[৭০] গৌতম বলেছেন, ‘যদি উচ্চতর তিন বর্ণের স্ত্রী নিম্নবর্ণের পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচার করে তবে তাকে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হবে।[৭১]

অপর দিকে আপস্তম্ব ও বৌধায়ন দুজনেই বলেন মা যদি গুরুতর অপরাধের জন্য সমাজে একঘরে হয়, তাহলেও পুত্র তার সঙ্গে কথা না বলে তার সেবা করবে।[৭২] একঘরে পিতাকে ত্যাগ করা যায়, সম্ভবত সে নিজের ব্যবস্থা নিজে করতে পারে এবং সে-ই পরিবারের সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে বলে, কিন্তু মায়ের পতন ঘটলেও পুত্র তাকে কখনওই ত্যাগ করতে পারে না। অসতী স্ত্রীর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান এবং পুত্রের মাকে ত্যাগ না করার মধ্যে মৌলিক ও ন্যূনতম মানবিকতার নিষ্কর্ষ, এই শাস্ত্রবিধানের মধ্যে স্বাভাবিক স্ববিরোধিতা আছে। সাহিত্যে কিন্তু ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়, ‘পতিতা’ নারীদের অভিশাপ দেওয়া হয়, শাস্তি দেওয়া হয় এমনকী মেরেও ফেলা হয় (যথা, সীতা, অহল্যা ও রেণুকা)।

বৈদিক যুগ থেকেই ভারতবর্ষে গণিকাবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। নানা প্রতিশব্দ সম্ভবত নন শ্রেণি বা স্তর বোঝায়, তার মধ্যে সর্বোচ্চ গণিকা, যাকে সরকারি ব্যয়ে নানা কলায় শিক্ষা দেওয়া হত; তার মূল্যও সর্বাপেক্ষা অধিক। বৌদ্ধগ্রন্থে বলা হয়েছে, রাজগৃহে সালাবতী প্রতি রাত্রে একশত কার্যাপণ দাবি করত, এবং আম্রপালীর দক্ষিণা নিয়ে রাজগৃহ ও বৈশালীর মধ্যে বিবাদ হয়েছিল। মৃচ্ছকটিক নাটকে ঋগ্বেদ-এর গণিকার অনুগ্রহের জন্য সহস্র সুবর্ণমুদ্রা পাঠানোর বিবরণ পাই; অর্ধকাশীর কাহিনি তো সুপরিচিত। গণিকা থাকত প্রাসাদে প্রাচুর্যের মধ্যে, তার বহু দাসদাসী, কুট্টনি, বিট, পীঠমর্দ, পুরুষ সেবক ও সঙ্গীতকারী থাকত। কৌটিল্য বলেন, গণিকা রাজকোষ থেকে মাসোহারা পেত এবং তার প্রতিনিধি প্রতিগণিকা তার অর্ধেক বেতন পেত। সম্ভবত গণিকার প্রাসাদ, দাসদাসী, সংসার সবই ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি।[৭৩] এর অর্থ হল, গণিকার যে শুধু স্বত্ব ছিল না তাই নয়, তা বেচবার, বাঁধা দেওয়ার বা দান করারও তার অধিকার ছিল না। এই নিয়ম গণিকালয়ে যারা থাকত তাদের জন্য কার্যকর। কিন্তু অবরুদ্ধা, অর্থাৎ যারা কিছু সময়ের জন্য পুরুষের রক্ষিতা হত, এবং নিজেই গৃহ পরিচালনা করত, আমরা অনুমান করতে পারি— এই নারীরা যা উপার্জন করত, তা রাজকোষে প্রয়োজনীয় কর দেওয়ার পরে তাদের নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে যেত।

রাজকোষ থেকে গণিকাদের ১৫০০ থেকে ২০০০ পণ বার্ষিক বেতন দেওয়া হত। যদি কেউ কোনও গণিকার নিষ্ক্রয় দিয়ে তাকে মুক্ত করতে চাইত বা বিবাহ করতে চাইত, তার রাজকোষে ২৪০০০ পণ নিষ্ক্রয় মূল্য দিতে হত। এ অনেক টাকা, কিন্তু গণিকার বেতনও অনেক টাকা। রাষ্ট্র যে গণিকার শিক্ষার ভার নিত, তার একটা কারণ হল, রাজা এবং তাঁর সভাসদরা অনেক সময়েই বিনোদনের জন্য যুবতী ও সুন্দরী গণিকাদের ডাকতেন। আর একটা কারণ হল, গণিকারা সুকৌশলে তাদের খদ্দেরদের কাছ থেকে নানান রাজনৈতিক ভাবে প্রাসঙ্গিক সংবাদ আদায় করত। সেগুলি সংগ্রহ করার জন্যই অধিকাংশ সময়ে গণিকাধ্যক্ষ নিযুক্ত হত।

কিন্তু গণিকারা প্রায় স্বাধীন ভাবেই ধনী হত; অধিকাংশ নগরে তাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তাদের নগরশোভিনী বলা হত এবং তারা ধনী নাগরদের আকর্ষণ করতে পারত। ধম্মপদের টীকায় সালাবতীর কন্যা সিরিমার প্রতি রাত্রে ১০০০ পণ উপার্জন করার বিবরণ পাই। গণিকার তুলনায় সামাজিক ও পরিশীলনের দিক থেকে নিকৃষ্ট রূপাজীবা, যে সাধারণত মদ মাংস ব্যবসায়ীর সঙ্গে বাস করত। তার উপার্জন ছিল মাত্র ৪৮ পণ। কোনও পুরুষ গণিকার কন্যার উপরে বলাৎকার করলে তার ৫৪ পণ দণ্ড হত এবং মায়ের প্রাপ্যের ১৬ গুণ দণ্ডও দিতে হত, হয়তো তার বিবাহের সময়ে মুখবন্ধ করার উপায় হিসাবে। পুংশ্চলী ছিল এই উপজীবিকার শেষ ধাপে, তার কোনও বাঁধা প্রাপ্য ছিল না। কৌটিল্য বলেছেন, বৃদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্তা বেশ্যাদের রাঁধুনি, ভাণ্ডারী, পশম ও তসর বয়নকারিণীরূপে এবং অন্যান্য কায়িক শ্রমের কােেজ নিয়োগ করতে হবে। তাদের ধাত্রী বা মাতৃকারূপে বেশ্যালয়ে অথবা বেশ্যাদের শিক্ষা দেওয়া কাজেও নিযুক্ত করা যেত, যাতে তারা কিছু উপার্জন করতে পারে। কিন্তু কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র-তে তাদের যে অবসর ভাতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা অন্য ভাবে অসহায় এই নারীদের খুব অল্পই নিরাপত্তার আশ্বাস দিত। বেশ্যাকে তার আয়-ব্যয় বিষয়ে বেশ্যালয়ের রক্ষককে জানাতে হত।[৭৪]

দেবদাসী বা মন্দিরের গণিকাদের শস্যে বেতন দেওয়া হত— অন্যান্য কিছু রাষ্ট্রীয় কর্মচারীর মতো। দেবদাসীদের উপার্জন কোথাও স্পষ্ট ভাবে বলা হয়নি এবং তাদের বিশেষ কর্তব্যও উল্লিখিত হয়নি। যে সব ধনী পৃষ্ঠপোষক পরলোকে পুণ্য অর্জনের জন্য মন্দিরে দাসী কিনতেন, তাঁদের সদিচ্ছাতেই এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ্যালয়েই হোক বা মন্দিরেই হোক, কোনও বারাঙ্গনাই নিজস্ব নিরাপত্তা পায়নি; গৌতম ধর্মসূত্র-তে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ‘বেশ্যার হত্যা অপরাধ নয়।[৭৫]

আমরা দেখেছি, সাধারণ ভাবে নারীর উপার্জন বা সম্পত্তির অধিকার ছিল না। প্রাচীন গ্রন্থ শতপথ ব্রাহ্মণ-এ (সম্ভবত অষ্টম-সপ্তম খ্রিস্টপূর্ব শতক) বলা হয়েছে পত্নীর সম্পত্তির উপরে কোনও অধিকার নেই, এমনকী নিজের শরীরের উপরেও নয় (৪:৪:২:১৩)। শতপথ ব্রাহ্মণ-এ এর আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যজ্ঞে লাঠি দিয়ে হবিকে পেটানো হয় যেমন তেমনি স্বামীও স্ত্রীকে পেটাবে, যাতে তার নিজের শরীর বা সম্পত্তির উপরে কোনও অধিকার না থাকে।’[৭৬] কিন্তু সমাজে দানকর্ত্রীর বহু নিদর্শন পাই: শুধু রানিরা নয়, শ্রদ্ধেয় জয়সেনের জৈন শিষ্যা, অথবা সীহমিত্রের জৈনধর্মাবলম্বনকারিণী শিষ্যা, সথিসিহ ও পুষ্যমিত্রের শিষ্যা, ইত্যাদি উদাহরণ আছে।[৭৭] সার্থবাহপত্নী ধর্মসোমা বা শ্রমণদের গৃহস্থ শিষ্যা কোচ্ছা ধার্মিক জৈন ভ্রাতৃগণকে নানা উপহার দিয়েছিলেন। বৃহৎকল্পভাষ্যসূত্র-তে গণিকা আম্রপালীর উদ্যান দানের কথা আছে। অনাথপিণ্ডদের কন্যা বুদ্ধ ও তাঁর হাজার শিষ্যকে আহার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া গণিকা ও অন্যান্য বৌদ্ধ নারীদের মঠ, চৈত্য, বিহার, উদ্যান, সেতু, কূপ, জলাধার ও অর্থ দানের কথা শুনি। খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা মহিষী প্রভাবতী নানা মূল্যবান উপহার দিয়েছিলেন। ওড়িশার ভৌমক রাজবংশে সতেরো জন রাজার মধ্যে ছ’ জন মহিষীর বিবরণ পাওয়া যায়। রাজতরঙ্গিনীতে দিদ্দা খেমা প্রথমে রাজপ্রতিভু হিসেবে এবং পরে স্বয়ং রানি হিসেবে রাজত্ব করেন। একই গ্রন্থে মহিষী চুদ্দা ও ডামরী যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে এই মহিষীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাও ছিল। কিন্তু এর অধিকাংশই তন্ত্র পরবর্তী কালের প্রমাণ যখন ব্যাপক ভাবে নারীকে দেবী ভাবে দেখা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে রানিদের মান্য করা হত, অতিমানবিক শক্তির নিয়ন্তা হিসেবে, যেমন রাজাদেরও মনে করা হত— তাঁরাও ইতিহাসে আগাগোড়াই সম্মানিত হয়েছেন।[৭৮] তেমনি ভাবে যে রানি তাঁর নিজ ক্ষমতায় অর্থের নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তিনিও সম্মানিতা।

প্রথম যে প্রশ্নটা আমাদের মনে জাগে, তা হল: নারীর যদি অর্থ না থাকে, তবে তারা এমন মূল্যবান দান করতে কি করে পারত? একটি উত্তর হল, যে সব ধনী গণিকা নিজেদের গৃহ পরিচালনা করত, তাদের রাজকোষে কর দিয়ে বাকি উপার্জনের অর্থের উপর স্বত্ব ছিল। অনেক সময়েই পাপবোধের কারণে তারা তাদের অর্থের একটা বড় অংশ ধর্মকর্মে ব্যয় করত। দ্বিতীয়ত, সমাজে সবাই শাস্ত্রের অনুশাসন হুবহু পালন করত না, কিছু নারীর স্ত্রীধনের উপর অধিকার ছিলই। বিশেষ করে যদি তারা রাজ পরিবার বা সম্ভ্রান্ত পরিবার বা বণিক পরিবারের নারী হত, তাহলে তা বেশ ভাল পরিমাণ হতে পারত, এবং প্রায়ই তার নিন্দা বা তিরস্কারকে নীরব করিয়ে দেওয়ার অবস্থায় থাকত, কারণ টাকা কথা বলে। তাই তারা দান করতে পারত এবং করতও। তৃতীয়ত, পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন অনুশাসনের আইন সমান্তরাল ভাবে থাকত, বিশেষ করে মাতৃতান্ত্রিক অঞ্চলগুলিতে। চতুর্থত, নারী, সন্ন্যাসী, পত্নী, বিধবা অথবা গণিকার দান বলে যেগুলি লিপিবদ্ধ আছে, তা সব সময়ে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা ঠিক নয়, প্রায়ই ভক্ত বা শিষ্যেরা ধার্মিক, ক্ষমতাশালিনী বা খ্যাতনামা নারীর নামে দান করত। তাছাড়া দাতা স্বামীরাও এ রকম দানে উৎসাহ দিত, যদিও আপস্তম্ব বলেছেন, ‘স্বামী গৃহে না থাকলে স্ত্রী সাধারণ ব্যয়াদি করবে; তা চৌর্য বলে গণ্য হবে না।[৭৯] এর থেকে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত হয় যে, সে যদি অসাধারণ ব্যয় করে তবে সে স্বামীর অর্থ চুরি করছে বলে মনে করতে হবে! কিন্তু সমাজ যথেষ্ট পরিমাণে ফাঁক রেখেছিল যার সাহায্যে অসাধারণ পরিস্থিতিতে নারীরা তাদের নিজের ধন দান করতে বা ব্যয় করতে পারত।

তৃতীয়-চতুর্থ খ্রিস্টপূর্ব শতকে স্পার্টার সম্বন্ধে শুনতে পাই যে, ‘সমগ্র দেশের প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ নারীদের অধীন; এটা এই জন্য যে অনেক ধনী উত্তরাধিকারিণী আছেন, এবং প্রচুর যৌতুক দেওয়া হয়।[৮০] এথেন্সে যৌতুক দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনে বলত যে, বিবাহ শেষ হয়ে গেলে সেটা ফেরত দিতে হবে। ১] রোমান আইনে বধূ কেনা যেত।[৮২] স্বামী যদি (ব্যভিচার ছাড়া) অন্য কোনও কারণে স্ত্রীকে ত্যাগ করত, তাহলে তাকে তার সম্পত্তির অর্ধাংশ দিতে হত, বাকিটা দেবী সেরেস-এর কাছে বাজেয়াপ্ত হত। এই ‘পিকিউলিয়াম’ তারা নিজেদের মতো ব্যবহার করতে পারত, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা পিতার সম্পত্তি। ভোকোনিয়ান আইন অনুসারে আদমসুমারির প্রথম শ্রেণিতে যে ব্যক্তি আসে, অর্থাৎ যে সম্পন্নতম, সে নারী উত্তরাধিকারিণী নিয়োগ করতে পারে না।[৮৪] ক্রীট-এ ‘পিতার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করেই কন্যাকে তার ভাগ দেওয়া যাবে।[৮৫] পুত্রহীন পিতার সম্পত্তি কন্যাগামী হত, তার নাম প্যাট্রিওখস (অথবা এপিক্লেরস)।[৮৬] তাই দেখা যায়, ভোকোনিয়ান আইন, যা সমাজের সর্বাপেক্ষা ধনী অংশের জন্য নিয়ম করেছে, তা বাদে গ্রিস ও রোমে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন আইন অনুসারে নারী সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে পারত এবং পেতও।

গর্তিন আইন অনুযায়ী ‘বিবাহিতা ক্রীতদাসীর নিজস্ব সম্পত্তি থাকতে পারে, কারণ বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়মে বলা হয়, সে তার অস্থাবর সম্পত্তি (সম্ভবত নিজের জিনিসপত্র) এবং ছোটখাটো প্রাণী সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে।[৮৭] ফলে উদার গর্তিন আইন অনুসারে দাসেরও সম্পত্তির অধিকার ছিল। কিন্তু গ্রিস ও রোমেও সাধারণ চিত্রটা খুবই হতাশাব্যঞ্জক— পুরুষের সম্পত্তির স্বত্ব ও ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে, যদিও ভারতবর্ষের তুলনায় আইন অনেক বেশি উদার। নারীর সম্পত্তির উপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ তার উপরে সার্বিক নিয়ন্ত্রণের একটা অঙ্গ। ‘মানুষের প্রজননের উপায় নিয়ন্ত্রণ করতে এবং এই উপায়গুলি তৎকালে কার্যকরী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বার্থে প্রয়োগ করতে রাষ্ট্র বাধ্য হয় তার নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার নারীর নিজের দেহের উপরে বিস্তৃত করতে। সুতরাং, সে তার দেহের উপর সত্যকার স্বত্ব হারায়।[৮৮] মনে পড়ে যজ্ঞের ঘি-কে লাঠি দিয়ে মারার যে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা ব্রাহ্মণে দেওয়া হয়েছে, তা হল ‘এই ভাবে মারলে স্ত্রী তার নিজের দেহ ও সম্পত্তির উপর অধিকার হারায়।’ দেহ ও সম্পত্তির পারস্পরিক স্থানপরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ: দেহও সম্পত্তির অংশ।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দ্রৌপদীকে সর্বসমক্ষে অপমান করতে সভায় টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়ে দুঃশাসনের প্রতি তাঁর প্রশ্ন: ‘রাজা যুধিষ্ঠির কি আমাকে জুয়ায় বাজি রেখে হেরে যাওয়ার আগে নিজেকে বাজি রেখেছিলেন?’ প্রশ্নটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি ইঙ্গিত করছেন যে, যুধিষ্ঠির যদি আগে নিজেকে হারিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর দ্রৌপদীকে বাজি রাখার কোনও অধিকার নেই। অর্থাৎ তিনি মুখে না বলেও স্বীকার করছেন, তিনি কৌরবদের অধিকারভুক্ত, তার মানে, তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি, এবং স্বামী তাঁকে বাজি রাখতে পারেন। এর বহু পূর্বে ঋগ্বেদের জুয়াড়ি আক্ষেপ করে যে, সে তার স্ত্রীকে বাজিতে হেরেছে। সুতরাং স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি হিসেবেই ব্যবহৃত হত। শর্মিষ্ঠা দেবযানীর যৌতুকের অংশবিশেষ ছিলেন; কিন্তু যযাতি দেবযানীকে বিবাহ করে গোপনে শর্মিষ্ঠাকে উপভোগ করেন এবং তাঁর গর্ভে অনু, পুরু ও দ্রুহুর জন্ম দেন। সুতরাং যৌতুকের অচেতন অংশ যেমন স্বামী দখল করতে পারত তেমনই বধূর মানুষ সহচরদেরও সে তা করতে পারত।

নারী যে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারত, মাধবীর কাহিনি তার প্রমাণ:

গালব যখন গুরুদক্ষিণা সংগ্রহ করতে না পেরে রাজা যযাতির কাছে যাচ্ঞা করলেন, তখন যযাতি শূন্য রাজকোষের অজুহাত দিলেন। কিন্তু তিনি গালবকে একটি অন্য সুযোগ দিলেন: রাজার সুন্দরী তরুণী কুমারী কন্যাকে ধার নিয়ে এক বছর রাজাদের কাছে ভাড়া দেওয়া যাবে, যতদিন না সেই রাজাদের একটি করে পুত্র হয় এবং তাঁরা কৃতজ্ঞতাবশত গালবকে কিছু অর্থ দেন। গালব মাধবীকে পরপর তিনজন রাজার কাছে ভাড়া দিলেন এক এক বছর করে, যতদিন না তাঁর গুরুদক্ষিণার খরচ উঠল। যযাতি, গালব বা এই রাজারা, কেউই এই ব্যবস্থাকে নোংরা বা ঘৃণ্য মনে করলেন না এবং গুরুও দক্ষিণা গ্রহণ করলেন— মনে হয় সানন্দেই। একমাত্র মাধবীই এই সমস্ত ব্যাপারের প্রতি গভীর জুগুপ্সা প্রকাশ করলেন এবং পরে দৃঢ় ভাবে বিবাহ করতে অস্বীকার করলেন। তাঁকে একটি অর্থকরী পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং তাঁর অন্তরাত্মা এতে ঘৃণা বোধ করেছিল। তিনি তপস্যা করতে গেলেন।

প্রাচীন ভারতের নারীদের অর্থ উপার্জন, অধিকার বা ব্যয় করার থেকে এবং অর্থ বা অন্য সম্পত্তি বিক্রি, বাধা দেওয়া, গচ্ছিত রাখা বা দান করা থেকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা কয়েকটি কারণ দেখতে পাই। আর্যরা উত্তর ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিকাংশ দখল করে নেওয়ার পর তাদের অল্প মূল্যের দাসের এক সরবরাহ ছিল। পূর্বে পরিবারের মেয়েরা বাইরের অর্থনৈতিক কার্যকলাপে পুরুষের সহায়তা করত এবং তাই তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃত হত। তারা উপার্জনকারী বা উপার্জনকারীর সহায়ক হিসেবে কিছুটা মানবিক সম্মান পেত। কিন্তু যখন বিশাল এক দাস শ্রেণি আর্যদের ব্যবহারে লাগল তখন নারীদের আর বাইরের শ্রমসাধ্য কাজে যোগ দিতে হত না। তত দিনে দেশের ভিতরে এবং সাগরপারে উৎপাদন ও বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত সঞ্চিত হয়েছে শ্রেণিবিভক্ত এক সমাজে অল্পসংখ্যক সুবিধাভোগীর হাতে। ব্রাহ্মণ সাহিত্য থেকে শুরু করে আমরা সমাজের উপরের স্তরে মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারের পরিস্ফুট ভোগের উল্লেখ পাই। সেই সময়ে আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারীর হাতে সম্পত্তি রেখে যাওয়ার উৎকণ্ঠায় অন্তঃপুরেও পুরুষের আরও সজাগ পাহারায় নারীর আরও কঠিন বন্দিত্ব উপস্থিত হল। তাছাড়া এই ভাবে ঘরে থাকায় নারীর রূপের সৌকুমার্য বজায় রইল, যা সম্পত্তির পুরুষ অধিকারীদের কাছে প্রিয়। তখন এ কথা স্পষ্ট হল যে নারীরা, যাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রকৃতপক্ষে নিরক্ষর এবং কেবলমাত্র গৃহকর্মে নিপুণা, তারা অর্থনৈতিক ভাবে তাদের স্বামীদের উপর বোঝা এবং এই থেকেই তাদের ভোগ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করার পদ্ধতি সহজ হল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বাৎস্যায়ন নারীর সম্বন্ধে দুই পরিপ্রেক্ষিতে— কুমারী হিসেবে ও গণিকা হিসেবে— পরিষ্কার বলেছেন, ‘তাদের সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় ভাবে সাজগোজ করতে হবে, কারণ নারী পণ্য।’[৮৯]

এখন নারীদেরই যদি পণ্য বলে মনে করা হয়, সম্পত্তি বা পদার্থ হিসেবে, তাহলে তাদের সম্পত্তি বা ঐশ্বর্য ব্যবহার করার স্বাধীনতা কেউ আশা করে না। সমাজ তাদের ব্যক্তি মানব হিসেবে স্বীকার করতে ভয় পেত

গৃহকর্মে নারীর অবদান কখনও অর্থের নিরিখে পরিমাপ করা হয়নি, তাই যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই অনেক গৃহকর্ম করত, তাদের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তুর জন্য পুরুষের উপরে অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল বলেই মনে করা হত। উৎপাদনের কাজে যুক্ত থাকলেও তা যথেষ্ট নয়, তাকে তবুও বোঝা বলেই গণ্য করা হয় এবং প্রত্যাশা করা হয় সে তার পিতা, ভ্রাতা, স্বামী বা পুত্রের অধীনে থাকবে। যখন তার হাতে টাকা এবং সত্যকারের সম্পত্তি আছে, যা সে নিজের ইচ্ছা মতো ব্যবহার করতে পারবে, তখনই তার অর্থনৈতিক সত্তা স্বীকৃত হয়েছে। আইনেই স্বীকৃতি এবং ব্যয়, সঞ্চয় বা যথেচ্ছ ভাবে নিজের অর্থ ব্যবহার করার সচেতন স্বাধীনতাই তাকে সম্পন্ন নারীর স্থান দিয়েছে। স্ত্রীধন বা সৌদায়িক বা যৌতুক পুঁথিগত ভাবে একান্তই তার নিজস্ব; কিন্তু সমাজের অনুভূতি ও তার নিজের অনুভূতি হল যে, সে ‘ভার্যা’ বা ‘ভরণীয়া’, অর্থাৎ যাকে ভরণ করতে হয় এবং সেই কারণেই ভরণপোষণের জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অধীন, যেমন ‘ভৃত্য’, দাস, তেমনই এবং এতে স্ত্রীধন লুঠ করায় শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সুবিধা হয়। কেবলমাত্র খুব ধনী নারীরা, যেমন রানি, যাদের ঐশ্বর্য রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা বুদ্ধিপ্রাপ্ত, তারাই সত্যি করে নিজেদের অর্থের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখত। অথবা যে গণিকা তার নিজের অর্থ ‘উপার্জন’ করে কর দেয় এবং কখনও এতই সম্পন্ন হয় যে রাজা এবং বণিকরাও তার ক্ষমতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়, সে-ই সময়বিশেষে সমাজে অর্থবল প্রয়োগ করার স্বাধীনতা পায়। তাছাড়া সর্বত্রই ধনী দাতারা সম্মানিত হয় এবং লোভী প্রার্থীদের কাছে অর্থে কোনও কলঙ্ক নেই। ধর্মকর্ম সর্বত্র এবং সর্বকালে অর্থের পাপ স্খলন করে।

কিন্তু এই ব্যতিক্রমগুলি বাদ দিলে সাধারণ ভাবে দাসী, গৃহবধূ বা বিধবারা পুরুষ ও তার পরিবারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকত, কারণ গৃহে তাদের শ্রম যতই গুরুতর হোক না কেন, উৎপাদনমূলক বলে গণ্য হত না। তাদর একমাত্র মূল্য তাদের প্রজননের ভূমিকায়। কিন্তু সেখানেও তাদের ক্ষেত্র হিসাবে দেখা হত, ফসল হল বপনকারীর নিজের। দীর্ঘ শতাব্দী ধরে সমাজ ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে নারীর পায়ের তলা থেকে তার আত্মসম্মানের শেষ অবলম্বনটুকু সরিয়ে নিয়েছে, তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে এবং গৃহে তাকে এমন এক নিশ্চেতন ভূমিকা দিয়ে যাতে তার সাধারণ বুদ্ধি সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এবং পুরুষ ঘোষণা করতে পারে যে, নারীর অর্থের প্রয়োজন নেই এবং অর্থ পেলেও তার উপরে নির্ভর করা যায় না।

.

সূত্রাবলি

১. ৫:৫ ৩৮০]

২. ঐ

৩. মনুসংহিতা ৮

৪. ঐ ৮:২৪৪]

৫. সংবর্ত ১৬২

৬. মনুসংহিতা ৯:১১৮

৭. গৌতম ধর্মসূত্র ২৯:১১

৮. ৫:৫:৮:২

৯. নিরিন্দ্রিয়া অদায়াদা স্ত্রিয়ো ইতিশ্চ মতাঃ/অদায়াদা ভগিন্যেতি।

১০. বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ১৫

১১. বিষ্ণু ধর্মসূত্র ৬৭:৩০

১২. ১:১১

১৩. ৬:৪:১৭

১৪. আচার্যা ও উপাধ্যায়া

১৫. মহানির্বাণতন্ত্ৰ ৮:৩৫, ৪৭

১৬. মনুসংহিতা ৩:৩১৭

১৭. প্রাগুক্ত ১০:১৯

১৮. ধর্মসূত্র ২

১৯. যাজ্ঞবল্ক্য ধর্মসূত্র ২:১৪৫, ১৪৭

২০. ৩:৫১

২১. এম এন শ্রীনিবাস, ১৯৮৯, The Cohesive Role of Sanstitisection, Oxford University Press.

২২. ঐ পৃ. ১৬

২৩. ঐ পৃ. ১২১, টীকা ৫

২৪. ঋগ্বেদ ১:১০৯:২

২৫. ৩:৭৩

২৬. ২:১৭৫

২৭. George Sllen and Union, 197০ Womens Role in Economic Development

২৮. শ্রীনিবাস, পূর্ববৎ, ১৯৮০, পৃ. ১০০

২৯. যাজ্ঞবল্ক্য ধর্মসূত্র ২:১৪৬]

৩০. ৩:৫২

৩১. ব্যাস ধর্মসূত্র ৪:৩০

৩২ . বিষ্ণু ধর্মসূত্র ৮:৪, ৫

৩৩. ৫:৯৫

৩৪. ২:১৫১

৩৫. ১৫:১:১৮

৩৬. ৯:১৩১

৩৭. ৩:৫২

৩৮. মৈত্রেয় সংহিতা ১:১১

৩৯. ৫:৯০৪

৪০. ২:৬:১৩:১৭-১৮

৪১. ৬:১:১৭-২১

৪২. মনুসংহিতা ৯:৭৪

৪৩. ঋণের পরিশোধ

৪৪. সংহিতা ২:৪৯-৫২

৪৬. মনুসংহিতা ৮:৪১৬-এর উপরে টীকা।

৪৭. ধর্মসূত্র ২:৬:১৪:৯

৪৮. ধর্মসূত্র ২:২:৪৯

৪৯. ৮:৪১৬; এবং কাত্যায়ন ধর্মসূত্র ৯০২

৫০. ঐ ৯০৪

৫১. কাত্যায়ন ধর্মসূত্র ৯০৫, ৯০৭, ৯১১

৫২. ঐ ৯১৪

৫৩. ঐ ৯১৬

৫৪. মনুসংহিতা ৯:১০, ১১

৫৫. ১:৮৬

৫৬. ১৮:১৯

৫৭. ২:১৩৫

৫৮. নারদ ধর্মসূত্র, স্ত্রীপুরুষৌ অধ্যায় ৫৫:৯৮-১০১

৫৯. ৯:৬৪-৬৮

৬০. ৫:৪৫

৬১. ধর্মসূত্র ২৯:৯

৬২. ষষ্ঠ অঙ্ক

৬৩. অর্থশাস্ত্র; ধর্মস্থীয় ৩:১৬

৬৪. ঐ ২, ২২:২৯৪

৬৫. ঐ ২, পূর্ববৎ/২৯৬

৬৬. যাজ্ঞবল্ক্য ধর্মসূত্র ১:৭০

৬৭. ঐ ১:৭৬

৬৮. গৌতম ধর্মসূত্র ২৩শ শ্লোক

৬৯. যাজ্ঞবল্ক্য ধর্মসূত্র ১:৭০, ৭২

৭০. ধর্মসূত্র ২১:১২

৭১. ঐ ২৪

৭২. ধর্মসূত্র ১১:১০:২৮, ২৯; ২:২:৪৮

৭৩. মতি চন্দ্ৰ, দি ওয়ার্ল্ড অফ কার্টিসনস, বিকাশ ১৯৭৩, পাতা ৪৮

৭৪. আমার লেখা, ‘প্রাচীন ভারতে গণিকা’ এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত।

৭৫. ২২:২

৭৬. ৪:৪:৩:১৩

৭৭. এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা চতুর্থ খণ্ড, পাতা ১৯৯

৭৮. অষ্টনাম, লোকপালনম মাত্রাভিরনিমিত্ত নপাহ

৭৯. ২:৬:২০

৮০. সিভিলাইজেসন অফ দি এনসিয়েন্ট মেডিটেরিয়ান ‘গ্রিস অ্যান্ড রোম’ প্রথম খণ্ড, পাতা ৫৯৪

৮১. ঐ পূর্ববৎ, ৫৯৬

৮২. ঐ ৩১৪

৮৩. স্ত্রী ও দাসদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি

৮৪. ঐ ৬১২

৮৫. ঐ ৬২০

৮৬. ঐ ৫৯২

৮৭. সারাহ বি পমেরয় ১৯৭৫, গডেস, হোরস, ওয়াইভস অ্যান্ড স্লেভস, নিউইয়র্ক, পাতা ৪১।

৮৮. নওয়াল এল সাদবি ১৯৮০, দি হিডেন ফেস অফ ইভ, ডেড প্রেস, পাতা ৬৩

৮৯. ২:১:১৩, ৪:১:১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *