০২. প্রাচীন ভারতে মাতৃত্ব

প্রাচীন ভারতে মাতৃত্ব

আন্তেকার লিখেছেন, ‘মাতৃত্বের উপরে দেবত্বের আরোপ ভারতবর্ষে যেমন উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছেছিল, এমন আর কোথাও নয়।[১] কিন্তু দেবত্বের আরোপ সমাজে নারীর অবস্থানের বাস্তব অবস্থা প্রতিফলিত না-ও করতে পারে— তা হয়তো কেবলমাত্র ক্ষতিপূরণ, মায়ের প্রতি সমাজের নিস্পৃহতার ক্ষতিপূরণ। তবে প্রাচীন ভারতের সমাজজীবনে মাতৃত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মাতৃত্ব ছিল আবশ্যিক; একটি মেয়েকে শেখানো হত ভাল স্ত্রী, ভাল মা হতে। তাকে ‘একাধিক পুত্রের জননী’ হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করা হত। মনে পড়ে অভিজ্ঞানশকুন্তলম নাটকের চতুর্থ অঙ্কে গর্ভবতী মেয়েটিকে তপস্বিনীরা আশীর্বাদ করছেন, সে যেন বীরপ্রসবিনী এই দুর্লভ সম্মান লাভ করে। গর্ভাধান, গর্ভধারণ, প্রসব এবং প্রসব উত্তর অবস্থাগুলির আনুষ্ঠানিক দিক দেখা যাক।

বিবাহ অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরে নবদম্পতি প্রার্থনা করত, অর্থাৎ বধূ নীরবে সমর্থন করত স্বামীর উক্তি: ‘এস, আমরা মিলিত হই, যাতে আমরা পুত্রসন্তান লাভ করতে পারি, সম্পত্তির বৃদ্ধির প্রয়োজনে পুত্রলাভ করতে পারি।’ বর আরও প্রার্থনা করত, ‘পুত্র, পৌত্র, দাস, শিষ্য, বস্ত্র, কম্বল, ধাতু, পত্নী, রাজা, অন্ন, নিরাপত্তা’।[২] বিবাহের সময়ে বধূর পক্ষ থেকে প্রার্থনা হত, সে যেন কখনও শূন্য কোলে না থাকে (অশূন্যোপস্থা), অর্থাৎ তার কোলে যেন সব সময়ে সন্তান থাকে। অতএব বিবাহ মূলত পুত্রসন্তানের প্রয়োজনে এবং যেহেতু একটি মাত্র পত্নী যে পুত্রসন্তানই প্রসব করবে তার স্থিরতা নেই, তাই বর কোনও ঝুঁকি নেয় না। সে বহু পত্নীর প্রার্থনা করে— তার নববিবাহিত বধূর উপস্থিতিতেই— যে বধূর সামাজিক ভাবে প্রস্তুতি ছিল এ রকম প্রার্থনা মেনে নেওয়ার, কারণ পুত্র তো বংশরক্ষা এবং সম্পত্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়।

গর্ভাধান নামক অনুষ্ঠানে পুত্রসন্তানের জন্য প্রার্থনা আছে; অথর্ববেদ-এ[৩] পুত্রসন্তানের জন্য প্রার্থনা। পরবর্তীকালের এক উপনিষদে বিভিন্ন রকম সন্তান— জ্ঞানী পুত্র, পণ্ডিতা বুদ্ধিমতী কন্যা, ইত্যাদি লাভের জন্য স্বামী তার স্ত্রীকে কি কি খাওয়াবে তার নির্দেশ আছে।[৪] প্রার্থনার শুরু: ‘এস আমরা দু’জনে মিলে পুত্রসন্তান লাভের জন্য চেষ্টা করি।’ স্ত্রী এখানে সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চেষ্ট গ্রহীতা; তার কোনও কথা নেই। তারপরে স্ত্রী গর্ভবতী হলে তার দুটি অনুষ্ঠান করতে হয়: পুত্রসন্তান প্রসবের জন্য পুংসবন এবং সিঁথি ভাগ করার জন্য সীমন্তোন্নয়ন। পুংসবন নামটি থেকেই বোঝা যায় এটা পরিস্ফুট ভাবেই পুত্রসন্তানের জন্মের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত। সব প্রার্থনাগুলিই অত্যন্ত স্বচ্ছ ভাবে কন্যাসন্তানের জন্মে বাধা দেয়, যাতে শুধুমাত্র পুত্রসন্তানই জন্মায়।[৫] সীমান্তোন্নয়ন আরও জটিল একটি অনুষ্ঠান। যে নারীর স্বামী ও সন্তান বেঁচে আছে তারা গর্ভিণীর সামনে বীণা বাজাবে, গান গাইবে ও নাচবে। রান্না করা ভাতের একটি পিণ্ড তার সামনে ধরা হবে এবং তার স্বামী জিজ্ঞাসা করবে: ‘কি দেখছ?’ উত্তর, ‘সন্তান’। আশীর্বাদ, ‘বীরপ্রসবিনী হও, অবিধবা হও।’[৬] ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্র-তে পড়ি রান্না করা ভাতের তিনটি পাত্র তার সামনে রেখে জিজ্ঞাসা করা হয়: ‘কী দেখছ?’ সে উত্তর দেয়: ‘পুত্র ও পশু।’[৭] আর একটি বৈচিত্র্য পাওয়া যায় জৈমিনীয় গৃহ্যসূত্র-তে, যেখানে একটি কাঁসার পাত্রে জল ভরে তাতে এক টুকরো সোনা রাখা হয়। বধূকে প্রশ্ন করা হয়: ‘কী দেখছ?’ সে বলে: ‘সন্তান, পশু, আমার জন্য সৌভাগ্য ও আমার স্বামীর জন্য দীর্ঘ জীবন।’[৮] শাস্ত্রে কোথাও বধূর বা ভাবী মায়ের দীর্ঘ জীবনের জন্য কোনও প্রার্থনা নেই। এবং এই সময়ে প্রসবোত্তর মৃত্যুর হার এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। শুধু স্বামীর দীর্ঘ জীবনের কামনাই শুনি। এর ব্যাখ্যা হয়তো প্রার্থনায় পত্নীশব্দের বহুবচনে পাওয়া যায়; যদি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে পত্নীর মৃত্যু হয়, তবে আর একটি বিবাহ করা চলবে, কারণ শাস্ত্রে নির্দেশ আছে, স্ত্রী সৎকারের পরদিনই স্বামী বিবাহ করবে।[৯] সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্র নির্দেশ দেয়, যে নারীর স্বামী-সন্তান বেঁচে আছে সে নববধূকে নিরামিষ খাদ্য ও মদ দেবে এবং তারপরে তারা গান গাইবে, বীণা বাজাবে ও নাচবে। এ সবই পুত্রসন্তানের জন্মের প্রত্যাশায়।[১০] ঋগ্বেদ-এ গর্ভধারণের বিষয়টিকে নাম দেওয়া হয়েছে উদরমাময়ং। গর্ভের চতুর্থ মাসে স্বামী শজারুর কাঁটা দিয়ে তার চুল আঁচড়ে দেয়— ভূমিতে হলকর্ষণের প্রতীক এবং জোড় সংখ্যার একগুচ্ছ কাঁচা ফল দেয়, যা অসম্পূর্ণ ভ্রূণের প্রতীক। তারপর বীণা বাদন ও নাচ হয়, যার ফলে আশ্বলায়ন বলেছেন, ভ্রূণ ধ্বংসকারিণী কিছু রাক্ষসীকে তাড়ানো হয়। তারপর তাকে ঘৃতের দিকে তাকাতে বলে প্রশ্ন করা হয়: ‘কী দেখছ?’ সে উত্তর করে: ‘সন্তান।’[১২]

অপর গুরুত্বপূর্ণ গর্ভাধানের অনুষ্ঠান হল পুংসবন। তার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদ-এ।[১৩] পরবর্তী সাহিত্যে অনুষ্ঠানের অনুপুঙ্খগুলি পাওয়া যায়। সেখানে আমরা জানতে পারি, গর্ভের তৃতীয় মাসে গর্ভবতী একদিন উপবাস করে থাকলে তারপর তার স্বামী তাকে খাবার দেয়: ভাত, দুটি সিম, এক দানা যব, এক এক গ্রাস দইয়ের সঙ্গে। তারপরে সে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে: ‘তুমি কী পান করবে?’ সে উত্তর দেয়: পুংসবন।[১৪] কখনও কখনও গর্ভাবস্থায় অনবলোভন নামে একটি ছোট অনুষ্ঠান করা হয়; তার উদ্দেশ্য গর্ভপাত নিরোধ করা। আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র-তে এর বর্ণনা আছে।[১৫]

প্রসবের সময় যখন এগিয়ে আসে, জন্মের ঠিক পূর্বে শোষ্যন্তীকর্ম নামে একটি অন্তিম অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়। এটি মনে হয় অত্যন্ত প্রাচীন অনুষ্ঠান, এবং নবাগতের আগমনের সময়ে পরিবার ও সমাজের মধ্যে যে নাটকীয় টান টান ভাব, তার চিহ্ন বহন করে। প্রসবের অব্যবহিত পূর্বে স্বামী স্ত্রীর উপরে জল ছেটাতো, এবং প্রসব হওয়া পর্যন্ত তা ক্রমান্বয়ে চালিয়ে যেত।[১৬]

শিশুর জন্মের পরে পরিবারের প্রধান লক্ষ্য মনে হয় দুষ্ট প্রেতদের দূরে রাখা: তারা নবজাতকের ক্ষতি করে বা তাকে নষ্ট করে। জাতকর্ম অনুষ্ঠানে সূতিকাগ্নি অর্থাৎ জন্মসংস্কারের জন্য বিশেষ ভাবে আহিত অগ্নিতে সর্ষে ও তুষ আহুতি দেওয়া হত। এই আহূতি এগারো বার দিতে হত।[১৭] তখন পিতা হোম করত এবং শিশুর সেই গোপন নাম অস্ফুট ভাবে উচ্চারণ করত, যা শুধু পিতামাতাই জানে।[১৮] তার পরে পিতা সুবর্ণ ও অন্যান্য মাঙ্গলিক দ্রব্য দিয়ে শিশুর মুখ ছুঁত এবং তাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আগে ঘি ও মধু খাওয়াত। তার পরেই কেবল শিশুকে স্তন দেওয়া যেত।

গর্ভিণী নারীর খাদ্যের প্রয়োজন বিষয়ে কিছুটা সচেতনতা ছিল, কারণ আমরা শুনতে পাই, ‘নববধূ, কুমারী কন্যা, রোগী ও গর্ভবতী নারীকে অতিথিরও আগে খেতে দেবে।’

পুত্রের জন্ম থেকে তার শিক্ষালাভের উপনয়ন পর্যন্ত বহু ছোট ছোট অনুষ্ঠান থাকত। প্রথম ছিল বিষ্ণুবলি, তার পরে মেধাজনন তার পরে নামকরণ। এর পরে পিতা পুত্রকে ধরে গৃহের বাইরে নিয়ে আসে (নিষ্ক্রমণ); এর ফলে যেন তার বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে সংস্রব ঘটে। শিশুর প্রথম ভাত খাবার অনুষ্ঠান অন্নপ্রাশন; বর্ষবর্ধন তার দীর্ঘায়ু কামনা করে। প্রথমবার ন্যাড়া হওয়া চৌল এবং শিশু শিক্ষা শুরু করলে বিদ্যারম্ভ। এই সব অনুষ্ঠানেই পিতা অনুষ্ঠান পরিচালনা করে, মাতা শুধুমাত্র পটভূমিকায় থাকে। সে কোনও অনুষ্ঠানেই কিছু করেও না, বলেও না।

শিশুকে মানুষ করার ব্যাপারে তার ভূমিকা কী? কিছুই প্রায় শোনা যায় না, শুধু তির্যক ভাবে বলা হয়, ‘চাতুমাস্যের বরুণপ্রঘাস যজ্ঞে পুরোহিত যজমানের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে, কার সঙ্গে ব্যভিচার করেছ?’[১৯] ‘সেই স্ত্রী বরুণের শাসনীয়া, যে এক পুরুষের হয়েও অপর পুরুষের সঙ্গে সম্বদ্ধ হয়। পাছে সে হৃদয়ে শূল নিয়ে যাগ করে… সে যা স্বীকার করে না তা তার আত্মীয়দের ক্ষতি করে।[২০] সুতরাং সন্তানের মাতা সর্বসমক্ষে নিজের ব্যভিচার স্বীকার করে, যাতে তার স্বামী ও সন্তানদের ক্ষতি না হয়। ‘সে মদ্যপান করে না; তার পুত্রদের জন্য এই তার ব্রত।’[২১] শিশুর লালন-পালনে মায়ের আনুষ্ঠানিক ছাড়া কোনও ভূমিকা যে ছিল তার কোনও ইঙ্গিত আমরা পাই না। আসলে শিক্ষা, শাসন, তদারক এবং পেশাগত বিদ্যা সম্পূর্ণ ভাবে পিতার অধীন। মায়ের একমাত্র অবদান কিছু ব্রত ও অনুষ্ঠান যা পরবর্তী সাহিত্যে পাওয়া যায়। বৈদিক সাহিত্যে গর্ভধারণ, প্রসব এবং কিছু প্রসবোত্তর অনুষ্ঠানের বিবরণ পাওয়া যায়— সবই পিতার কর্তব্য। তারপর উপনয়ন হলে পুত্র আনুষ্ঠানিক ভাবে পিতার— যদি পিতা পেশাদার শিক্ষক হন— না হলে গুরুর শিষ্য হয়ে যায়।

বৈদিক সাহিত্যেও পুত্রসন্তানের প্রতি সমাজের পক্ষপাত অত্যন্ত প্রকট ভাবে লক্ষ্য করা যায়। ‘বন্ধ্যা নারীকে পরিত্যাগ করা যায় (পরিবৃত্তি বা পরিবৃত্তি), কারণ নিঋতি তাতে ভর করেছে।[২২] প্রজনন বিষয়ে অত্যধিক গুরুত্ব প্রমাণের ফলে একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছে— এক অশুভ ধারণা যা কিনা অত্যন্ত কুৎসিত ও সম্পূর্ণ অশুভ, যার বিশেষ কাজ হল সমস্ত রকম শুভ বিষয়কে ধ্বংস করা।[২৩] বন্ধ্যা নারীকে দশ বছর পরে পরিত্যাগ করা যেত; শুধু কন্যার যে জন্ম দেয় যেই নারীকে বারো বছর পরে, এবং মৃতবৎসা মাকে পনেরো বছর পরে।[২৪] পুত্রহীন পত্নীর স্বামীর আবার বিবাহ করা উচিত।[২৫] ভাল নারীর লক্ষণ, ‘যে স্বামীকে সন্তুষ্ট করে, পুত্রের জন্ম দেয় এবং কখনও স্বামীর কথার উত্তর করে না।[২৬]

পরবর্তী ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণে সন্তানকামী নারীর জন্য বহু ব্রতের কথা বলা হয়েছে। ততদিনে নারীর সন্তানদাত্রী এক সম্পূর্ণ দেবীমূর্তির পরিকল্পনা করা হয়েছে— তিনি ষষ্ঠী।[২৭] নারীদের ষষ্ঠী বিষয়ক ব্রতের উদ্দেশ্য তাদের গর্ভধারণের ক্ষমতা বাড়ানো, কারণ তিনি শিশুদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এবং শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠ দিনে সূচিকাগৃহে তাঁর পূজা হয়। তিনি সন্তান দেন এবং তাদের রক্ষা করেন।[২৮] তাঁকে তুষ্ট করতে নানা অনুষ্ঠানের নির্দেশ আছে, যাতে তিনি ক্ষুদ্র শিশুদের মঙ্গল করেন, কারণ শিশু যত ছোট হবে অন্তরিক্ষচারী অসংখ্য বুভুক্ষু প্রেত তাকে গ্রাস করার সম্ভাবনা ততই বেশি।[২৯] গর্ভস্থ শিশু সবচেয়ে ছোট, ভ্রূণাকারে আছে তাই তার বিপদের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। মানব গৃহ্যসূত্র-তে ষষ্ঠীকল্প (৩:১৩:৬) এবং বিনায়ককল্প (২:১৪) এই প্রেতগুলিকে দূর করে শিশুর মঙ্গল বিধান করে।

গর্ভধারণ, নির্বিঘ্নে পুত্র প্রসব ও তার নিরাপত্তা ও দীর্ঘায়ুর জন্য অনেকগুলি ব্রতের নির্দেশ আছে। তাই সেখানে মহাষষ্ঠী ব্রত আছে, সন্তানের জন্য কৃষ্ণাষ্টমী, আট পুত্রের জন্য লোকেশ্বরী বা কোটীশ্বরী, জীবিত পুত্রের জন্য জীবৎ পুত্রিকাষ্টমী। বারো বছর ধরে পালনীয় জ্যেষ্ঠা ব্ৰত আছে; জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের সময়ে মেয়েরা সারা রাত জেগে জ্যেষ্ঠা দেবীর মূর্তিকে পূজা করে। যে নারীর সন্তান মারা যায় অথবা যার দরিদ্র পুরুষের ঔরসে একটিমাত্র পুত্র আছে, এই ব্রত তারই জন্য।[২৯] হেমাদ্রি পুত্রলাভের জন্য দূর্বাষ্টমীর নির্দেশ দেয়।[৩০] হেমাদ্রিতে পুত্রলাভের জন্য নাগব্রত আছে।[৩১] পিতৃব্রতে পুত্রের পিতৃত্বই পুরস্কার।[৩২] আরও পরিস্ফুট পুত্রকাম,[৩৩] পুত্রবিধি, পুত্ৰপাপ্তি,[৩৪] পুত্রীয়।[৩৫] এছাড়া ছোটখাট আরও অনুষ্ঠান আছে, যেমন কৌমব্রত, মরুত, মঙ্গলগৌরী, রুক্মিন্যাষ্টমী, বরাহদ্বাদশী, বিষ্ণু, দেবকী, ব্রতরাজতৃতীয়া, শনি-প্রদোষ, সর্ষপসপ্তমী, সূর্য— সূর্যনাকৎ— সপ্তমী সবই ওই একই উদ্দেশ্যে।[৩৬] মাতৃতে মৃতবৎসা বা একটি সন্তান আছে যার এ রকম নারীর মাতৃকার পূজার বিধান আছে; শ্রাবণকৃত্যা এমন নারীর যার সন্তান শৈশবে মারা যায়। সংঘাতক ব্রত স্বামী ও পুত্রদের সঙ্গে বিচ্ছেদ রোধ করার জন্য। এগুলি এবং সহস্র সংখ্যক আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ষষ্ঠীপূজার জনপ্রিয়তার সাক্ষ্যবহন করে।

বন্ধ্যাত্বের অপবাদ এড়াবার যে তীব্র বাসনা, সেটি সর্বজনীন ঘটনা। সারা পৃথিবীতে এবং যুগ থেকে যুগান্তরে মেয়েরা পুত্র কামনা করেছে এবং অবন্ধ্যাত্ব ঘোচাবার জন্য তপস্যা করেছে; ব্রত পালন করেছে, পূজা করেছে, প্রার্থনা করেছে। ভারতবর্ষে এই ব্রতগুলি সময়ের সঙ্গে সংখ্যায় বেড়েছে; পরবর্তী শাস্ত্রগ্রন্থে পুত্রসন্তান ধারণ করা ও প্রসব করার জন্য আরও অধিকসংখ্যক বিধান আছে।

যে কোনও আদিম জাতির মানুষের মতো ভারতীয়রাও মনে করত যে জগৎটা বিশেষ করে অন্তরীক্ষ ও পাতাল ভূত-প্রেত-পিশাচাদিতে পরিপূর্ণ— তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে জীবিত প্রাণীদের ক্ষতি করা। কিন্তু তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ লক্ষ্য ভ্রূণ ও নবজাত শিশু; এই প্রেতগুলির অনেকেই এদের ভক্ষণ করে পুষ্ট হয়। যাতে তারা ভ্রূণ ও নবজাতকের ক্ষতি করতে না পারে, তাই সহস্র সংখ্যক বিচিত্র ব্রত আবিষ্কার করা হয়েড়ছিল; ওষধি, ফল, মূল, ধাতু, প্রভৃতি নানা কার্যকর পদার্থ এই সব ব্রতে ব্যবহার করা হত; ‘শামান’রা গোপন মন্ত্র আওড়াত। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও যখন মা মৃতসন্তান প্রসব করত অথবা গর্ভধারণই করতে পারত না, তখন তাকে বন্ধ্যা বা গর্ভধারণের পক্ষে অত্যন্ত অশুচি বলে অপরাধী করা হত। বোঝাই যায়, নির্বিঘ্ন প্রসবের পর এই কবচ প্রভৃতি এবং ব্রতগুলি মায়ের চেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও যে মায়ের সন্তানেরা দীর্ঘায়ু হত, তাকে সম্মান করা হত।

প্রেতে বিশ্বাস তার যুক্তিযুক্ত অন্ত পর্যন্ত টেনে নেওয়া হত না, যার ফলে অভাগিনী বন্ধ্যা নারী বা যার সন্তান শৈশবে মারা যায় যে দোষমুক্ত হতে পারে। পুরুষের বন্ধ্যাত্ব আবছা ভাবে জানা ছিল, নিয়োগ প্রথা থেকে যার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিন্তু ‘বন্ধ্যা’ পুরুষ কখনও দোষের ভাগী হত না। ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সাহিত্যে নিঃসন্তান রাজাদের কথা শোনা যায়, কিন্তু অশুভতার কোনও ইঙ্গিত সেখানে নেই। কৃষিকেন্দ্রিক মানুষ হিসাবে প্রাচীন ভারতীয়রা জানত যে মরা বীজ উর্বর ক্ষেতে ফলবে না; কিন্তু তারা সন্তানহীনতার এই দিকটা সম্বন্ধে রহস্যময় নীরবতা পালন করেছিল। সব সময়েই অপ্রসবের জন্য নারীকেই দায়ী করা হত। অবশ্যই প্রেত-পিশাচদের— ধ্বংসকারী অতিপ্রাকৃত শক্তির আবিষ্কারের ফলে কিছুটা দোষ স্খালন হত এবং তাদের কাছ থেকে বিপদ এড়াতে ব্রতের বিধান করা হত।

যদিও অবন্ধ্যাত্ব প্রধান ভাবে কাম্য ছিল, কিন্তু সেটাই শুধু এখানে যথেষ্ট নয়। পুত্র কন্যার চেয়ে উচ্চ স্থান অধিকার করেছিল। সোমযোগের সেই প্রাচীন যুগেও একটি অনুষ্ঠানে কিছু যজ্ঞের বাসন তুলে ধরা হত, কতগুলি আবার নীচে রাখা হত। তেমনই জন্মের সময়ে পুত্রদের উঁচুতে তুলে ধরা হবে, কন্যাদের মাটিতে শোয়ানো হবে। বলাই বাহুল্য, এটি সামাজিক বাস্তবের আনুষ্ঠানিক প্রতিফলন। তাই শুধু কন্যার মায়েদের যে সামাজিক ভাবে পুত্রের মায়ের চেয়ে নিচু চোখে দেখা হবে, তা বিচিত্ৰ নয়।

কিন্তু মাতৃত্বলাভের পরই মা-কে ঠেলে দেওয়া হত পিছনে, অন্তত পরের প্রসব পর্যন্ত।। সে পূজা করতে পারে, আহুতি দিতে পারে, সন্তানদের স্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু এবং মঙ্গলের কামনায় ব্রতপালন করতে পারে, কিছু কিছু স্বাদু খাদ্য পানীয় পরিত্যাগ করতে পারে।[৩৭] কিন্তু এ ধরনের নেতিবাচক এবং আপাত নিষ্ক্রিয় আচরণ ছাড়া মা হিসাবে তার ভূমিকা ধর্মগ্রন্থে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে না। বাড়ির গৃহিণী হিসাবে নিঃসন্দেহে সে আহার্যের তদারকি করত এবং সম্ভবত স্বামী, শ্বশুরকুলের আত্মীয় ও সন্তানদের পরিবেশনও করত। কোনও কোনও মা পরিবারের জন্য রান্নাও করত এবং সেই ভাবে সন্তানদের পুষ্টির বিষয়ে সরাসরি যুক্ত ছিল। সে সম্ভবত সন্তানদের পোশাক-আশাক, খেলনা, গহনা ও অন্যান্য সম্পত্তির দায়িত্বে ছিল। রোগের সময়ে পিতা নয়, সে-ই তাদের সেবা করত এবং তাদের আরামের ব্যবস্থা করত। কিন্তু এ সবই অনুমান, কারণ শাস্ত্র এ বিষয়ে নীরব। যদিও সব শাস্ত্রই শুধু পুত্রের কথাই বলে, মা অবশ্যই নিরপেক্ষ ভাবে সব সন্তানের প্রয়োজনই মেটাত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কথা স্পষ্ট যে সে পুত্রের প্রতি সামাজিক পক্ষপাতের শরিক ছিল। তার সমস্ত সামাজিক সম্মান নির্ভর করত পুত্রের জননী হওয়ার উপরে।

এতৎসত্ত্বেও পিতার তুলনায় মাতার কন্যার চেয়ে পুত্রকে পছন্দ করার কারণ কমই ছিল, যদি না এমন হত যে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিগত না হয়ে সামাজিক এবং এই কারণে নিয়ন্ত্রিত এবং প্রথাগত। পিতার সম্পত্তির মালিকানা ছিল। সে চাইত তার নিজের (অর্থাৎ ঔরস) পুত্রকে সম্পত্তি এবং সম্ভবত কাজ, ব্যবসা বা পেশা দান করে যেতে। মায়ের সম্পত্তির মালিকানা ছিল না, এবং মনে করতে ভাল লাগে যে অনুভূতির দিক দিয়ে তার পছন্দ ছিল মেয়ে— খুব অল্পদিন, বিবাহ পর্যন্ত, যার সঙ্গ সে উপভোগ করতে পারবে। তাছাড়া তার অনুভূতি ও কল্পনা দিয়ে সে কন্যার মধ্যেই নিজেকে দেখতে পাবে। পরবর্তী সাহিত্যে আমরা মাঝে মাঝে দেখি মেয়ের সুখের জন্য মা বাবাকে অনুনয় করছে। কিন্তু মূলত সমাজ কন্যাকে দেখত অভিশাপরূপে। ‘পত্নী বন্ধু, কন্যা দুঃখের আধার, পুত্র স্বর্গের আলো’,[৩৮] অথবা ‘পুত্ৰ নিজস্বরূপ, পত্নী বন্ধু, কন্যা পুরুষের দুঃখমাত্র।’[৩৯]

যেহেতু রুচির ব্যতিক্রম ঘটে, কোনও কোনও পিতা কখনও কখনও বুদ্ধিমতী এবং পণ্ডিত কন্যার কামনা করত। তাই আমরা একটি অনুষ্ঠানের কথা পড়ি: ‘যে চায় তার কন্যা পণ্ডিতা হোক, সে তিল দিয়ে ভাত রাঁধবে এবং দু’জনে তা খাবে।’[৪০] মনে করলে মজা লাগে যে, শঙ্করাচার্যের টীকায় পণ্ডিতা শব্দটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘গৃহকর্মের ব্যাপারে নিপুণা’। ফলে কন্যাদের শাস্ত্রাধ্যয়ন বিষয়ে প্রচলিত নিয়মের পোষকতা করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাখ্যাটি মিথ্যা, পক্ষপাতদুষ্ট এবং ভ্রান্ত; পণ্ডিতা শব্দটি গৃহকর্ম বিষয়ে প্রয়োগ করা হয়নি।

মায়ের পুত্র সম্বন্ধে মনোভাব বা সম্বন্ধ বিষয়ে কোনও বিবরণই তাই আমরা পাই না। সব শাস্ত্রই কিন্তু ‘পুত্র প্রিয়ের চেয়েও প্রিয়তর’[৪১] নিয়েই ব্যাপৃত। বৌদ্ধ শাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘পুত্র পুরুষের ধন।[৪২] শাস্ত্রগুলি একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুত্রের উপকারিতার প্রশংসা করেছে। ‘পুত্র দিয়ে পৃথিবী জয় করা যায়, পৌত্র দিয়ে অমৃত্বলাভ করা যায়।[৪৩] ‘পুত্র জন্মালেই পিতা পূর্বপুরুষের ঋণ থেকে মুক্ত হয়।[৪৪] পুত্র মাতার কাছে কতখানি তা স্পষ্ট হয় যখন কুন্তী পুত্রদের অনুপস্থিতির জন্য আক্ষেপ করেন: ‘মাধব! বৈধব্য, সম্পদহানি বা শত্রুতা কিছুই আমাকে তত দুঃখ দেয় না যা দেয় পুত্রগণের বিরহ।[৪৫]

পিতামাতা সন্তানদের ভালবাসে, কিন্তু বিপদের সময়ে যখন তাদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না তখন তাদের দত্তক নেওয়ার জন্য অপরকে বিলিয়ে দেয়। শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পিতামাতা দু’জনে অথবা তাদের মধ্যে একজন এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।[৪৬] অপর এক গ্রন্থে বলা হয়েছে পিতা অথবা মাতা পুত্র দত্তক নিতে পারে।[৪৭] অতএব পুত্রের ভাগ্যবিষয়ে অত্যন্ত গুরুতর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুঁথিগত ভাবে মায়ের কিছু বলার আছে। কিন্তু পরবর্তী সাহিত্যে দেখা যায়, একা পিতাই এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পুত্রের কাছ থেকে সম্মান মাতার প্রাপ্য। ‘অধ্যাপক দশ শিক্ষকের সমান, পিতা অধ্যাপকের সমান এবং মাতা সম্মানে সহস্র পিতার অধিক।’[৪৮] ‘মাতাকে শ্রদ্ধা করলে পৃথিবী জয় করা যায়, পিতাকে শ্রদ্ধা করলে অন্তরীক্ষ জয় করা যায় এবং গুরুকে শ্রদ্ধা করলে ব্রহ্মলোক জয় করা যায়।’[৪৯] ‘পুত্র মাতার সেবা করবে, যদি মাতা সমাজ পরিত্যক্তা হয় তাহলেও, কারণ তারই জন্যে মাতা বহু কষ্ট সহ্য করে।’[৫০] ‘পুত্র মাতাকে ভরণপোষণ করবে, সমাজপরিত্যক্তা হলেও, তবে তার সঙ্গে কথা বলবে না।’[৫১] ‘সমাজপরিত্যক্ত পিতাকে ত্যাগ করা যায়, কিন্তু মাতাকে নয়। মাতা কখনও পুত্রের পরিত্যাজ্যা নয়।’[৫২] এখানেই শঙ্খ ও লিখিত বলেছেন, ‘পুত্র পিতামাতার বিবাদে কোনও পক্ষ অবলম্বন করবে না, যদি করে, তবে মাতার পক্ষই নেবে, কারণ মাতাই তাকে গর্ভে ধারণ, প্রসব ও লালন-পালন করেছে।’[৫৩] পুত্র মাতার ঋণ থেকে কখনওই মুক্তি পায় না, একমাত্র মুক্তি পায় যদি সে (জটিল ও প্রচুর অর্থসাপেক্ষ) সৌত্রামণি যাগ করে।’’কোনও গুরুই মাতার চেয়ে উচ্চ নয়।’[৫৪] পাণ্ডবেরা বলেন ‘অন্য সব অভিশাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়, মাতার অভিশাপের থেকে মুক্তি নেই।’[৫৫] ‘তখনই কেবল তার বার্ধক্য আসে, তখনই কেবল তার শোক হয়, তখনই কেবল তার জগৎ শূন্য হয়ে যায়, যখন কেউ তার মাকে হারায়।’[৫৬] অজাতশত্রু তাঁর পিতাকে তাঁর আদেশ অমান্য করে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তাঁর মাতাকে হত্যা করতে চাইলে তাঁর মন্ত্রীরা তাঁকে বলেন: ‘এমন আঠারো হাজার মন্দ রাজার বিবরণ পাওয়া যায় যাঁরা পিতৃহন্তা। কিন্তু মাতৃহন্তার কোনও বিবরণ মেলে না।’[৫৭] কিন্তু পরশুরাম তাঁর পিতার আদেশে মাতাকে হত্যা করেছিলেন, যদিও পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রথম বরে তিনি মাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।

মাতা যদি যৌন ব্যভিচারের দোষে দোষী হয়, পুত্রের উপর নির্দেশ আছে, শ্রাদ্ধের সময়ে তার জন্য প্রার্থনা করতে: ‘যদি আমার মাতা কোনও পাপ করে থাকেন, কর্তব্যে অবহেলা করে থাকেন, পিতা যেন সেই বীজ নিজের বলে গ্রহণ করেন।[৫৮] পুত্রের কর্তব্য মায়ের প্রতি সম্মান দেখানো।[৫৯] এবং কখনও মাকে শাস্তি বিধান না করা। যদি তা করে তবে তাকে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।[৬০]

পুত্র নানা শ্রেণির হতে পারত। তার মধ্যে মাতার সাক্ষাৎ যোগ ছিল ঔরস (স্বামীর থেকে জাত), কানীন (বিবাহের পূর্বে গর্ভধৃত), সহোঢ় (বিবাহের সময়ে গর্ভধৃত), পুত্রিকাপুত্ৰ (কন্যার পুত্র, যাকে কন্যার পিতা নিজের পুত্র বলে গ্রহণ করতেন), গূঢ়োৎপন্ন (গোপনে পরপুরুষের দ্বারা উৎপন্ন) এবং নিয়োগ। এর মধ্যে কানীন, সহোঢ় এবং গূঢ়োৎপন্ন বিষয়ে সমাজের আপত্তি ছিল। অন্য দুটি প্রকট ভাবেই সমাজ দ্বারা অনুষ্ঠিত হত। দত্তক নেওয়ার সময়ে পুঁথিগত ভাবে পিতামাতা উভয়েরই সম্মতির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু অনুমান হয়, পুরুষশাসিত সমাজে মায়ের অনুমতি আছে এটা গ্রহণ করেই নেওয়া হত। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে দুস্থ ব্যক্তিরা সন্তান বিক্রয় করত; এ রকম ‘ক্রীত’ পুত্র পিতামাতা দু’জনেরই হত, কিন্তু বিক্রয় বা ক্রয়ের মূল সিদ্ধান্ত পুরুষেরই— মহাকাব্য, পুরাণ ও বৌদ্ধ সাহিত্যে বর্ণিত ঘটনাগুলি তারই প্রমাণ দেয়।

মাতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত জটিলতাগুলি সাহিত্যে প্রকাশ পায়। সব কিছু যে শাস্ত্রের বিধি অনুসারে সহজ সরল ছিল না তা মহাকাব্য, পুরাণ, বৌদ্ধ সাহিত্য এবং প্রাচীন মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে উদঘাটিত হয়। এমনকী বৈদিক সাহিত্যেও পিতা এবং কন্যার মধ্যে (ব্রহ্মা ও বাক্) অবৈধ সম্পর্ক দেখতে পাই। বৌদ্ধ সাহিত্যে মাতা-পুত্রের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের একটি নিদর্শন পাওয়া যায়।

বিশ্বান্তর জাতকে পিতা পুত্রকন্যাকে বিলিয়ে দেয় মাতার অনুমতি ছাড়াই। যদিও শাস্ত্রে নির্দেশ আছে, পুত্রেরা বার্ধক্যে মায়ের দেশাশোনা করবে তবু কুন্তী পুত্রদের ছেড়ে বনে গিয়েছিলেন। গর্ভবতী স্ত্রী স্বামীর কাছে বিশেষ দায়িত্ব ও যত্নের বিষয়, কিন্তু গর্ভবতী অবস্থায় সীতা পরিত্যক্তা হয়েছিলেন বিনা শাস্তিতে। শাস্ত্রে প্রায়ই বলা হয়, ‘ন স্ত্রী দুষ্যতি জারেণ— স্ত্রী উপপতির দ্বারা দূষিত হয় না’।[৬১] কিন্তু সীতাকে এ বিষয়ে শুধুমাত্র সন্দেহের কারণে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। এই অপরাধে অহল্যা অভিশাপ পেয়ে পাষাণমূর্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। বিবাহিতা রমণী ব্যভিচার করলে এক মাসের পর তাকে শুদ্ধ বলে গণ্য করতে হবে।[৬২] কিন্তু রামচন্দ্র বা গৌতম কেউই এই বিধি মানেননি। আরও অসংখ্য এ রকম নিদর্শন মহাকাব্যে ও পুরাণে পাওয়া যায়, যেখানে, যে নারীর পদস্খলন ঘটেছে তাকে কঠোর শাস্তির দ্বারা দণ্ডিত করা হয়। তার মধ্যে কয়েকটি এত বীভৎস যে সেগুলি উচ্চারণ করা যায় না। যাই হোক, বিবাহিতা রমণী শুধু তার স্বামীর থেকেই গর্ভধারণ করবে এবং স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারীর জন্ম দেবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল।

মাতৃত্বের বিষয়ে বা পুত্রের সম্বন্ধে মাতার মনোভাব বিষয়ে কতকগুলি বিচিত্র নিদর্শন পাওয়া যায়। গঙ্গা তাঁর সাত পুত্রকে জলে বিসর্জন দেন। অবশ্য এরা ছিল বসু (স্বর্গবাসী), অভিশপ্ত হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিল। এবং, তাদের শাপ কিছুটা হ্রাস করার একমাত্র উপায় ছিল সদ্য মৃত্যু, যাতে তারা অবিলম্বে স্বর্গে ফিরে আসতে পারে, এবং গঙ্গা তাই করতে অঙ্গীকৃতা ছিলেন। কিন্তু পিতা যখন সদ্যোজাত পুত্রদের তাৎক্ষণিক মৃত্যুতে শোকাবিষ্ট, তখন যে মা তাদের গর্ভে ধারণ করেছেন, প্রসব করেছেন এবং স্বয়ং ডুবিয়ে মেরেছেন, তাঁর দিক থেকে কোনও অনুশোচনা বা বেদনার কথা শুনতে পাই না। দিব্যাঙ্গনা মেনকা ও তাঁর সদ্যোজাত শিশু কন্যা শকুন্তলাকে তাঁর ঋষি স্বামীর সঙ্গেই পরিত্যাগ করেছিলেন। ইন্দ্ৰ তাঁকে আদেশ দিয়েছিলেন বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করতে, যে তপস্যার দ্বারা ইন্দ্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছিল। মেনকা ঋষির সঙ্গে বাস করলেন একটি সুন্দরী কন্যার জন্ম পর্যন্ত। তারপরেই তিনি স্বর্গে চলে গেলেন, কারণ তাঁর কার্য সমাধা হয়েছে। হর্ষচরিত-এ সরস্বতীও সারস্বতের জন্ম দিয়ে তৎক্ষণাৎ স্বর্গে প্রস্থান করেছিলেন। এমনকী হর্ষের মাতা যশোমতীও আসন্ন বৈধব্যের আশঙ্কায় পুত্র হর্ষের করুণ মিনতি অবহেলা করে চিতারোহণ করলেন। সীতাও দুই শিশুপুত্র ফেলে তাঁর মায়ের কাছে চলে গেলেন। মাদ্রী দুই পুত্রকে কুন্তীর কাছে রেখে স্বামীর চিতারোহণ করলেন, কুন্তীও পুত্রদের ফেলে চলে গেলেন। পুরুরবার প্রতি ঊর্বশীর কামনা এতই তীব্র এবং যে কোনও রকম বাধার প্রতি এতই অসহিষ্ণু যে, তিনি নবজাত শিশুকে আশ্রমে লালিত হতে পাঠিয়ে দিলেন। মর্ত্য গণিকার প্রতীক হিসাবে ঊর্বশী স্বাভাবিক ভাবেই কামসর্বস্বতা এবং অপত্যস্নেহহীনতার প্রতিনিধি।

এমনকী গণিকাদেরও কোনও কোনও সময়ে সন্তান জন্মাত। ছেলেদের বলা হত বন্ধুল এবং তাদের গীতবাদ্য ও নৃত্যশিক্ষা দেওয়া হত, যাতে তারা গণিকাদের রঙ্গমঞ্চে নাট্যাভিনয়ে যোগ দিতে পারে। মেয়েদের গান, বাজনা, অভিনয় ও অন্যান্য সুকুমার কলা শেখানো হত, কিন্তু অধিকাংশই তাদের মায়ের জীবিকাই অবলম্বন করত, যদি না কোনও সদয় পৃষ্ঠপোষক তাদের নিষ্ক্রয় করে নিতেন। তখন সেই পুরুষেরা তাদের রক্ষিতা রাখত অথবা বিবাহ করত। যাই হোক, এই সন্তানেরা মায়ের কাছেই মানুষ হত, এবং যুক্তিসঙ্গত ভাবে ধরে নেওয়া যায়, মায়ের সঙ্গে তাদের ভাবগত যোগ থাকত।

অনেক সময়েই অনিচ্ছুক নারীদের উপর মাতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া হত। মহাভারত-এ অম্বিকা ও অম্বালিকা ব্যাসকে দেখে শিউরে উঠেছিলেন, কিন্তু ব্যাসের কাছে আত্মসমৰ্পণ করতে এবং তাঁর সন্তান ধারণ করতে তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন। কোনও কোনও যাগে কুমারী, নিঃসন্তান বধূ ও সন্তানবতী রমণী— এই তিন প্রকারের দক্ষিণা ছিল; তিন শ্রেণিই গ্রহীতার সন্তান ধারণ করত। কুলজাতকে নির্বীর্য ইক্ষাকু রাজার পাঁচশো মহিষীকে প্রতি মাসে তিন রাত্রি করে যে কেউই দাবি করত তার অধীন হতে হত; এই সব রাত্রে রাজার আদেশে প্রাসাদের তোরণদ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হত। অবশ্যই অনেক অনিচ্ছুক নারীর উপরে গর্ভধারণ আরোপিত হত, গল্পে আছে, তারা বিলাপ করেছিল, বাধা দিয়েছিল এবং অবশেষে অসহায় ভাবে বশ্যতা স্বীকার করেছিল। মহাকাব্য ও পুরাণে এমন বহু কাহিনি আছে যেখানে বহু অনিচ্ছুক রমণীর উপরে মাতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অতিথিদের আমোদের জন্য গৃহিণীকে দান করা হত, কখনও বা কুমারী কন্যাদের দান করা হত এবং যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা যায়, তাদের সকলেই সেই সঙ্গীর জন্য আগ্রহী ছিল না। কোনও কোনও গল্পে বলা হয়েছে, তারা ঘৃণা করেছে, কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।

মাতৃত্বের জন্য যে সরল কামনা, তা কুমারী কুন্তীর নবগ্রাপ্ত বর নিয়ে খেলা করার মধ্যে প্রকাশ পায়। তিনি যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করতে পারতেন, এবং তাঁর আহ্বানে দেবতা আসতেন। সূর্য এসে তাঁকে একটি পুত্র দিলেন। কিন্তু বিবাহের পরে তাঁর নির্বীর্য স্বামী পাণ্ডুই তাঁকে প্ররোচিত করেন তিন ভিন্ন ভিন্ন সঙ্গীর কাছ থেকে প্রথম তিন পাণ্ডবকে লাভ করতে। মাদ্রীও প্ররোচিত হয়েছিলেন এবং কুন্তীর কাছ থেকে মন্ত্র শিখেছিলেন। তিনিও এই একই উপায়ে দুই পুত্র লাভ করেন। সমাজ পুত্রের উপর এতটাই গুরুত্ব দিত যে, যে ভাবেই হোক পুত্রলাভ করতে হত। সেই পুত্রেরা যে শুধু আইনসঙ্গত ছিল তা নয়, তার জন্য তাদের কোনও কলঙ্ক ছিল না, এবং উরসপুত্রের সমান অধিকারই তাদের ছিল। নিয়োগ প্রথা বহুল প্রচলিত ছিল। মৃত বা নির্বীর্য পুরুষের সম্পত্তির জন্য পুত্ররূপ উত্তরাধিকারী লাভের কামনাই ছিল এই প্রথার মূলে।

জরৎকারু মুনিকে তাঁর পুর্বপুরুষেরা বলেছিলেন, তিনি পুত্রের জন্ম না দিলে স্বর্গে যেতে পারবেন না। তিনি তা করলেন, কিন্তু পত্নীর সঙ্গে মিলনের পূর্বে তিনি শর্ত রাখলেন যে, সামান্যতম ছল ধরে তিনি পুত্র ও মাতাকে ত্যাগ করে চলে যাবেন। অতএব পুত্র সম্পূর্ণ ভাবে মায়েরই দায় হয়ে দাঁড়াল। পিতা পুত্রের ভরণপোষণের পর্যন্ত ব্যবস্থা করলেন না। অনুরূপ পরিস্থিতিতে শকুন্তলা তাঁর ছেলেকে নিয়ে দুষ্যন্তের সভায় গিয়ে রাজাকে পিতৃ-কর্তব্যে অবহেলার জন্য তিরস্কার করলেন। দুই রাজকুমারের মা সীতা তাদের তপোবনে প্রসব করলেন এবং ভিক্ষুকরূপে লালন করলেন, কেননা তাদের পিতা পুত্রদেরও তাদের মাতার কোনও উদ্দেশ্যই করলেন না।

সুখী পরিবারের প্রতীক শিব, পার্বতী, গণেশ ও কার্ত্তিকেয়, পরে যেখানে লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে যোগ করা হয়েছে। কিন্তু পরিবারের শুরু কার্ত্তিকেয়ের জন্ম দিয়ে। শিব ও পার্বতীর মিলনের কাহিনির ভূমিকায় বলা হয়েছে, তারকাসুর দেবতাদের উত্ত্যক্ত করছিল; তখন দেবতারা ব্রহ্মার কাছে দল বেঁধে যান উপায় জানতে। ব্রহ্মা তাঁদের বলেন, কেবলমাত্র শিব-পার্বতীর পুত্রই অসুরদের বিরুদ্ধে দেবতাদের উপযুক্ত সেনাপতি। কিছু দৈব ষড়যন্ত্রের পর মহাদেব ও পার্বতীর মিলন ঘটল।

এই কাহিনির একটি অন্য রূপ হল ‘রুদ্র অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করে স্কন্দকে সৃষ্টি করলেন।[৬৩] আর একটিতে বলা হয়েছে কার্তিকেয়কে গর্ভে ধারণ ও প্রসবের জন্য উমা অগ্নির স্ত্রী স্বাহাতে প্রবেশ করেছিলেন।[৬৪] আবারও একটিতে বলা হয়েছে, শিবের বীজ অগ্নিতে পড়েছিল, তিনি তা ধারণ করতে অসমর্থ হয়ে তা গঙ্গায় নিক্ষেপ করেন এবং গঙ্গাও অসহ্য তেজ সহ্য করতে না পেরে কুশের মধ্যে নিক্ষেপ করেন এবং সেখানে কৃত্তিকা ভগ্নিগণ তা লালন করেন।[৬৫] এই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন রূপের সমান ধর্ম দুটি; অগ্নি যদিও পৌরাণিক মতে শিবের অপর স্বরূপ, বীজের উৎস শিবের থেকেই। কিন্তু পার্বতীর মাতৃত্ব নিশ্চিত ভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। এই কাহিনিতে এবং এর অন্যান্য রূপে যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে, তা হল কোথাও পার্বতীকে কার্ত্তিকেয়ের মাতা বলে স্বীকার করা হয়নি। আমরা যে ভাবে জানি গণেশ আংশিক ভাবে হস্তী— তাই পার্বতী যাকে জন্ম দিয়েছিলেন, ঠিক সেই পুত্র নন। সরস্বতী এথেনার মতো ব্রহ্মার মস্তক থেকে এবং লক্ষ্মী ভিনাসের মতো মথিত সাগর বেরিয়েছেন। তাই আমাদের সামনে এই বিস্ময়কর তথ্য থাকে— পার্বতী তাঁর সন্তানদের কারওরই সম্পূর্ণ ভাবে মা নন। এই ইতস্তত ভাব কেন, কেন এই ব্যাখ্যাতীত দ্বিধা? বীজ যখন শিবের, তখন কার্তিকেয়ের ক্ষেত্রে তাঁর পিতৃত্ব অবিসংবাদিত— যে কার্তিকেয় সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, মহাসুর তারকের নিহন্তা, দেবসেনার সেনাপতি। কিন্তু বীজের পিতৃত্ব সম্বন্ধে নিঃ সংশয় হলেও তা কোনও নারীর গর্ভে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়নি। সোজা কথায় বলতে গেলে, কার্তিকেয়ের মা হওয়ার গৌরব কোনও নারীই লাভ করেনি। লোক পরম্পরা পার্বতীকে কার্ত্তিকেয়ের সঙ্গে যুক্ত করলেও পুরাণ তা করেনি। মনে রাখতে হবে, ইন্দ্র-শচী ও জয়ন্ত, কৃষ্ণরুক্মিণী এবং তাঁদের পুত্রেরা— এই সব দৈব পরিবারগুলিও শিব, পার্বতী ও তাঁদের সন্তানদের তুলনায় নিতান্তই ফিকে। কিন্তু জীববিদ্যাগত দিক দিয়ে এটি যথার্থ পরিবার নয়।

মনে হয়, এর কারণ নিহিত আছে প্রজননে যৌনসঙ্গীর ভূমিকা বিষয়ে সমাজের অবচেতন ধারণায়। বৈদিক আর্যেরা যখন ভারতবর্ষে এসেছিল, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে, তখন তারা নিজেরা পশুপালক যাযাবর মানুষ ছিল। তারা তাদের পশুপালের মধ্যে প্রজনন ক্রিয়া দেখত এবং জীবতত্ত্বগত প্রজননের মৌলিক জ্ঞান তাদের ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষে দেশীয় কৃষিজীবী মানুষেরা ছিল। আর্যেরা তাদের কাছ থেকে কৃষিশিক্ষা করেছিল, যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করেছিল এবং শিকার ও পশুপালন আহার্য সংগ্রহের একটি পরিপূরক উৎস হিসাবে বজায় রেখেছিল। পশুপালক সমাজে সমগ্র পশুপালক, তা পুরুষই হোক বা স্ত্রী, প্রভুর সম্পত্তি এবং নবজাত বৎসগুলিও স্বাভাবিক ভাবে তারই হত। কৃষিতে যৌথ প্রভুত্ব আছে; ভূমির প্রভু সব সময়ে বীজের প্রভু নয়। তাছাড়া ভূস্বামী সব সময় নিজের জমি চাষ করে ফসল তোলে না। সমাজের অর্থনীতির নানা স্তরে ভূমির, বীজের এবং শ্রমের ভিন্ন ভিন্ন প্রভু ছিল। মহাভারত-এ একটি উপাখ্যান আছে, এখানে পৃথিবী চোখের জল ফেলতে ফেলতে ঈশ্বরের কাছে আসেন, বিক্রয় এবং হস্তান্তরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে। মনে হয় প্রাচীন যুগে ভূমির প্রভুত্ব অপরিচিত ধারণা ছিল; ভূমি কর্ষিত হত মানুষের খাদ্য যোগাতে।[৬৬]

পার্বতীকে কার্ত্তিকেয়ের মাতৃত্ব প্রদান করার বিষয়ে পুরাণবিদের অনীহা হল কার্ত্তিকেয়ের একমাত্র পৌরাণিক জনক হিসাবে শিবকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পন্থা। যে বীজ পার্বতীর গর্ভে আগুন ছিল তা তিনি ছুঁড়ে ফেলতে সোনা হয়ে গেল; তা গঙ্গাকে তীব্র ভাবে দহন করল যতক্ষণ না তিনি তা কূলের ঘাসের উপর ছুঁড়ে ফেললেন, এবং দেবমাতা কৃত্তিকারা তা লালন করলেন। ভাষার ইঙ্গিত ভেঙে বোঝা যায়, শিবের বীজের উন্নততম শক্তি, অসহনীয় সৃষ্টির উত্তাপ, পার্বতী, গঙ্গা— এমনকী কৃত্তিকারা, যাঁরা ধারণ করেনি— এঁদের নিষ্ফল প্রয়াস। অবশেষে তা প্রায় স্বকীয় ভাবেই কুশের মধ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল, যদিও দেবমাতারা প্রায় দাসীর মতোই তাকে লালন পালন করেছিলেন। এই উপাখ্যান পিতা-মাতার ক্রমিক অবস্থান সম্বন্ধে সমাজের মনোভাবের বিষয়টিকে আমাদের কাছে সরাসরি নিয়ে আসে। বীজটি যদিও অবিসংবাদিত ভাবে শিবের, গর্ভ পার্বতীর নয়, অন্য কোনও নারীরও নয়। পার্বতী বীজটিকে নিক্ষেপ করেন; গঙ্গা, যিনি পৌরাণিক মতে মহাদেবের অপর ভার্যা, তা ধারণ করতে পারেননি, এবং কৃত্তিকারা ধাত্রীমাত্র।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে আর্যেরা কৃষিজীবী হয়ে পড়েছিলেন, এবং তাদের জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি কৃষিজীবীরই দৃষ্টিভঙ্গি। পিতামাতা বিষয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত ভাবেই পুরুষতান্ত্রিক। নারী ক্ষেত্র, পুরুষ তার মধ্যে বীজ বপন করে। এই দৃষ্টি প্রধান ভাবে পিতৃতান্ত্রিক, যেহেতু ক্ষেত্র ও বীজ উভয়েই পুরুষের, অতএব পুত্র প্রধানত পিতারই। মনু এ ব্যাপারে নিষ্ঠুর ভাবে স্পষ্টবাদী: ‘বীজ এবং গর্ভের মধ্যে বীজই উৎকৃষ্ট। সব প্রাণী বীজের ধর্ম গ্রহণ করে।’[৬৭] ‘গর্ভের ধর্ম বীজের হয় না।[৬৮] তবে সন্তান কার? এ ব্যাপারেও মনু স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন: ‘যেমন গবাদি পশু, অশ্ব, উট, দাসী, মহিষ, ছাগ ও মেয়ের ক্ষেত্রে পুরুষ সঙ্গীরা বৎসের অধিকারী হয় না, নারীর ক্ষেত্রেও তাই।[৬৯] ‘স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষ যদি পুত্রের জন্ম দেয়, তখন ক্ষেত্র বীজের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং পুত্র তখন স্বামীর, জন্মদাতার নয়।’[৭০] এখানে অবশ্য জন্মদাতা না স্বামী, কে পুত্রের অধিকারী সে বিষয়ে মতভেদ আছে।[৭১] ‘নারী ক্ষেত্র, পুরুষ বীজ।[৭২] পত্নী থাকার উদ্দেশ্য কী? ‘পুত্রের জন্ম, শিশুর লালন-পালন, দৈনন্দিন সেবা, সব কিছুই পত্নীর উপর নির্ভর করে।[৭৩] আর সবচেয়ে বড় কথা, মনু স্পষ্ট ভাবে বলেছেন: ‘নারীর সৃষ্টি কেবলমাত্র জন্ম দেওয়া, তাই তারা পূজ্যা, গৃহের আলো।[৭৪] সুতরাং নারীর সৃষ্টি জন্ম দিতে, পুরুষের সৃষ্টি বংশ রক্ষা করতে।

এই সব ধারণাগুলো যেহেতু সমাজ চেতনায় গভীর ভাবে প্রোথিত ছিল, অতএব মাতৃত্বের ভাবনা কয়েকটি বিশেষ ব্যঞ্জনার অধিগ্রহণ করে: শিশুর জন্মবিষয়ে, কেবলমাত্র প্রসবের সময় ছাড়া, নারীর ভূমিকা কৃষিক্ষেত্রের মতোই নিষ্ক্রিয়। যেমন কর্ষণের পর উপ্ত বীজ আপনা থেকেই বৃদ্ধিলাভ করে ক্ষেত্রের দৃষ্ট ও সক্রিয় প্রচেষ্টা ছাড়াই, তেমনই মাতাও নিষ্ক্রিয় ভাবে বীজ ধারণ করত।[৭৫] ভ্রূণ নিজে নিজেই বাড়ত। ফসল কাটার সময়ে যেমন ক্ষেতের মালিক, যে সম্ভবত বীজ বপনকারীও বটে, এসে ফসল সংগ্রহ করে নিয়ে যায়, তেমনই স্বামী শিশুকে দাবি করে। ক্ষেত্রের মূল্যবোধও এই ধারণায় সমর্থন পায়: গোবৎস, মহিষ, উট, ঘোড়া, ছাগ, মেষ, এদের বৎসরা তাদের জন্মদাতার নয়, পালের মালিকের। এই তালিকায় দাসীর অন্তর্ভুক্তি সমাজে তার যৌন অবস্থান সম্বন্ধে যে মনোভাব তা মর্মন্তুদ ভাবে পরিস্ফুট করে। সে তার প্রভুর পরিবারের সব পুরুষ সদস্যের সহজ ভোগ্যা। তার পুত্র যদি তার স্বামীর সন্তানও হয়, সে তারও নয়, তার স্বামীরও নয়, তার প্রভুর— ক্ষেতে বা কারুকর্মে উৎপাদনমূলক শ্রমে বাড়তি বাহুবল হিসেবে।

মানুষের উৎপাদনের উপায় নিয়ন্ত্রিত করতে এবং তৎকালীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে সেই উপায়গুলি নিবেদন করতে রাষ্ট্র বাধ্য হয়েছিল তার (নারীর) শরীরের উপর তার নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার বিস্তৃত করতে। তাই সে তার নিজের শরীরের উপর প্রভুত্ব হারিয়েছে।[৭৬] নারীর নিজের দেহের উপর অধিকার হারানোর যুগ্ম প্রমাণ হল, দাসীই হোক আর পত্নীই হোক, তাকে তার প্রভু বা স্বামীর যৌন দাবি মেটাতে হত এবং তার গর্ভের ফলের প্রভু হত সে নয়, তার স্বামী বা প্রভু। তাকে প্রায়ই যৌন সংসর্গে বাধ্য হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে হত, দীর্ঘ মাসের পর মাসব্যাপী গর্ভধারণের কষ্ট সহ্য করতে হত, তীব্র গর্ভযন্ত্রণা, লালন-পালন, উদ্বেগ, শিশুকে স্তন্যপান করানো, অসুস্থতায় ও আঘাতে তার সেবা করা সবই করতে হত। কিন্তু শেষ পর্বে শিশু তার নয়, তার স্বামী অথবা প্রভুর।

তা সত্ত্বেও কিন্তু মাতৃত্বের মহিমা উত্তরোত্তর বেড়ে যেতে লাগল; যে বাস্তবকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হত, এ তারই ভাবগত এবং মানসিক ক্ষতিপূরণ। এখানে, ভারতবর্ষে, মাতৃত্বকে ততটাই মর্যাদা দেওয়া হত, যত পরিমাণে সমাজে নারীর অবস্থার অবনতি ঘটছে। ঋগ্বেদ-এর দেবমণ্ডলী প্রধানত পুরুষবহুল।[৭৭] ক্রমশ পরবর্তী শতাব্দীগুলি ধরে দেবতাদের বিবাহিত রূপে দেখানো হতে লাগল, যেহেতু ব্রাহ্মণ-সাহিত্যের সময় থেকেই সমাজে বিবাহ আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু মহাকাব্য ও পুরাণ-সাহিত্যে তাঁদের পুত্রসন্তান জন্মাতে লাগল। পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার সমাজে সর্বব্যাপী প্রয়োজন হয়ে উঠল, যে সমাজে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী পুত্রদের নানা প্রকারভেদ স্বীকার করা হত। তখন দেবী মাতারাও তাঁদের স্বামীদের নামে পরিচিত হতে লাগলেন। সামাজিক বাস্তব তত দিনে নারীকে সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ জননীর ভূমিকায় ঠেলে দিয়েছে। নারী হিসেবে, সামাজিক জীব হিসেবে, স্বাধীন চিন্তা, কর্ম ও ভাবনা বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে তার যে নিজ সত্তা, তা সে খুইয়েছে। যদি সামগ্রিক ভাবে নাও হয়, অন্তত প্রধান ভাবে সে শুধুই মা, পুত্রসন্তানের জন্মদাত্রী।

ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর আশপাশে তন্ত্রের প্রভাব ভারতে অনুভূত হতে লাগল। তন্ত্রে আবার নারীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই সপ্তম শতাব্দীর এক প্রধান গদ্য কবি বাণভট্ট যে দেবী চণ্ডীর উদ্দেশে গদ্যে স্তুতি রচনা করেছেন, তা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। অন্যেরাও তাঁর অনুসরণ করলেন এবং একটি সম্পূর্ণ স্তোত্রসাহিত্য সৃষ্টি হল, যা দেবীদের স্তুতি করে। সপ্তমাতৃকাকে মূর্তিতে পূজা করা হত। তাঁদের কীর্তিকলাপ সৃষ্টি করা হল এবং এই দেবীদের যে সাম্প্রদায়িক পূজা, তার উদ্দেশ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ উপকথা তৈরি হল। এই ভাবে মাতৃকারা কেমন ভাবে তাঁদের সন্তানদের লালন-পালন ও উদ্ধার করেন, তারই গুরুত্বহীন কিছু উপকাহিনি সৃষ্টি হল। দৈবস্তরে মাতৃত্বের এই উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী ফল ফলেছিল মানবিক স্তরে। নারীর অস্তিত্বের একমাত্র হেতু ছিল মাতৃত্ব। ‘নারীদের পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ভূমিকায় এবং তারই মাধ্যমে জীবন কাটাতে অনুপ্রেরিত করা হত এবং মাতা হিসেবেই সর্বাগ্রে তাদের স্তুতি করা হত।’[৭৮] এই ব্যাপার অন্যত্রও ঘটেছিল। ‘ভিক্টোরীয়রা অশান্তি বোধ করে অনেক সময়ে এই অনুভূত শক্তিকে যুক্তিসম্মত করত— মাতৃত্বের আত্মত্যাগমূলক ও লঘু পাক পূজনীয়তায় নারীত্বকে গুলে।[৭৯]

শুধু যে নারীর উপর অনেক সময়ে মাতৃত্ব আরোপিত হত, তাই নয়, নারীরা বাধ্য হত মাতৃত্বকে তাদের জীবনের মূল তত্ত্ব হিসাবে গ্রহণ করতে; তারা বন্ধ্যাত্বের নিন্দা করত এবং গর্ভকে ফলপ্রদ করার জন্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অকথ্য যন্ত্রণা ভোগ করত। পুরুষের বীর্যহীনতা আবছা ভাবে মাত্র জানা ছিল, নারীরাই সব সময়ে সন্তানহীনতার জন্য সামাজিক ভাবে ও মানসিক ভাবে মূল্য দিত। নারীরাই আবার দুর্ভাগিনী বন্ধ্যা রমণীকে দোষ দিত ও ব্যঙ্গ করত, কারণ নারীরা পুত্রধারণের গুণ বিষয়ে পুরুষের সামাজিক মূল্যবোধ অন্তঃসার করেছিল। তাই প্রতিটি বালিকাকে দেখা হত পুত্রসন্তানের ভাবী মাতা হিসেবে, তাকে এই দৈব কর্তব্য পালন করার জন্য শিক্ষা দেওয়া হত এবং তৈরি করা হত এবং যদি সে এ কাজ সম্পন্ন করতে না পারত, তবে সেটা তারই দুর্ভাগ্য; সে নিজে এবং সমাজ তাকে মনে করত সম্পূর্ণ রূপে অশুভ, অসম্পূর্ণ এবং নিষ্ফল জীব। ‘নারীর মাতৃত্ব ছিল লিঙ্গগত কর্ম বিভাগের প্রধান হেতু এবং নারীর উপর পুরুষের শাসনেরও প্রধান হেতু

নারীর প্রতি এবং মাতা হিসেবে তার ভূমিকার প্রতি যে মনোভাব, সেটা যে সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্ভুত, তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। যখন কৃষিপ্রধান সমাজে কৃষিকর্মের জন্য আদিম যন্ত্রাদি ব্যবহার করা হয় এবং কৃষিকর্মের নানা প্রাকৃতিক বিপাকের কারণে ভাল ফসল হওয়ার কোনও স্থিরতা থাকে না, তখন সেই সমাজে চাষবাসের জন্য অনেকগুলি জাতের প্রয়োজন হয়। সেখানে সম্পত্তি রেখে যাওয়ার জন্য পুত্রেরও প্রয়োজন হয়। প্রাসঙ্গিক ভাবে, সেখানে কন্যাসন্তানেরও প্রয়োজন আছে, যে কন্যারা বিবাহ করে সন্তানের জন্ম দেবে। তাই মূলত নারীর উর্বরতার উপরে বিশাল গুরুত্ব দেওয়া হত এবং এ কথা অনুমান করলে ভুল হবে না যে, নারীরা নিজেরাই প্রথম পর্বে উর্বরতাকে শক্তিরূপে ব্যবহার করেছিল। বহুবিবাহের পরিবারে সন্তানের মাতা তার বন্ধ্যা বা নিঃসন্তান সপত্নীর তুলনায় সামাজিক উৎকর্ষ ভোগ করত এবং তার গর্ব করত। বহু অনুষ্ঠানে যে নারীর স্বামী-সন্তান বেঁচে আছে, তারই শুধু অধিকার ছিল। সন্তানবতী নারী কিছু কিছু সুবিধা ভোগ করত, যা থেকে নিঃ সন্তান নারী বঞ্চিত হত। মহাকাব্য ও পুরাণ সাহিত্যে অনেক পুরুষই তার মায়ের নামে পরিচিত। কিন্তু যে সমাজে বহুবিবাহ আছে, সেখানে মাতৃনামের ব্যবহার পুত্রের স্পষ্ট পরিচয়ের একটি পদ্ধতি। তাহলেও তা মায়ের সঙ্গে পুত্রের যোগ নির্দিষ্ট করত এবং অন্তত বুদ্ধিগত ভাবেও তাদের ও মাতৃত্বের সামাজিক স্বীকৃতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করত। কিন্তু মায়ের সামাজিক বন্দিত্ব তার শক্তিকে হরণ করে নিয়েছিল এবং স্বার্থসাধনে তার উর্বরতাকে ব্যবহার করেছিল। তাই এর পক্ষে মাতৃত্ব মানে সহজ সরল যন্ত্রণাভোগ, কারণ সে শেষ পর্যন্ত তার গর্ভের সন্তানকে নিজের বলে দাবি করতে পারত না। এই প্রক্রিয়ায় সে কষ্ট পেত, কিন্তু অবশ্যই ভাবগত ভাবে কিছু সুখ পেত, তার উর্বরতা এবং তার থেকে উদ্ভুত তার পবিত্রতার সামাজিক স্বীকৃতি রূপে।

‘নারীর মাতৃত্ব এবং তার থেকে সুখ পাওয়ার ক্ষমতা প্রবল ভাবে অন্তঃসারকৃত হয়েছে এবং মনস্তাত্ত্বিক ভাবে চাপানো হয়েছে ও বিবর্তনমূলক ভাবে নারীর মনস্তাত্ত্বিক গঠনে গ্রথিত হয়েছে।[৮১] এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি মায়ের ব্যবহারের কাঠামো গঠিত করে। নারীর উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক অনুরপ্রেরণা পরিপূর্ণ ভাবে আত্মসাৎ করেছিল, গ্রহণ করেছিল এবং নিজেদের অজান্তে অন্তঃকৃত করেছিল নারীরাই। এই অন্তঃকৃত করার আর একটি সহায়ক ছিল। বিবাহিতা নারীর শিক্ষার সুযোগ অস্বীকার করা হয়েছিল। নিজস্ব কোনও পেশা, স্বাধীন সামাজিক বা রাজনৈতিক অস্তিত্ব অধিকাংশ সুকুমার কলা এবং বহু বিনোদন থেকে সে বঞ্চিত ছিল। গর্ভধারণই একমাত্র পথ যা তার কাছে খোলা ছিল, যার মাধ্যমে সে তার সামাজিক প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে পারে এবং পারিবারিক ও সামজিক আবেষ্টনে কিছু সম্মান পেতে পারে। জীবিকা উপার্জনের সুযোগ থেকে নারীকে বঞ্চিত করে তাকে অবদমিত করে রাখা সম্ভব হয়েছিল। তার স্বামী তার প্রভু।[৮২] তাই তারা তাদের রুটি-রোজগারকারীর উপর নির্ভরশীল ছিল, মনে করত, স্বামীর সন্তান ধারণ করে তারা প্রভুর কিছুটা ঋণ শোধ করছে।

আর্যরা যখন উত্তর ভারত জয় করেছিল, সেই দেশের কিছু মানুষকে দমন করা বা ক্রীতদাস বানানো হয়েছিল, বাকিরা বিন্ধ্য অঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছিল। যারা পালিয়েছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়ে দাসে পরিণত হয়। নবোদ্ভুত সমৃদ্ধ শ্রেণিতে দাসেদের ব্যবহার করা হত গৃহে কর্মে, গ্রিস ও রোমের মতো সামাজিক উৎপাদনমূলক কাজে নয়।

গৃহকর্মের অনেকটা অংশ দাসেদের হাতে যাওয়ায় এই সব গৃহের নারীরা সমস্ত উৎপাদনমূলক কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল এবং কিছুটা নিষ্প্রয়োজন হল, ফলে তাদের একমাত্র সামাজিক প্রয়োজনীয়তা হয়ে দাঁড়াল সন্তানের জন্ম দেওয়া, যা কোনও প্রাচীন কালে সামাজিক উৎপাদনমূলক ছিল। কারণ, আমরা দেখেছি, সমাজে এই পর্বে অর্থনীতি চালু রাখার জন্য বেশি সংখ্যক হাতের প্রয়োজন হত এবং উদ্বৃত্ত তৈরি করার জন্যও তার প্রয়োজন ছিল।

পুরুষ সমাজ শাসন করত, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করত এবং সমাজের বিভিন্ন অংশের ভূমিকা নির্ধারণ করত। নারীর প্রধান কাজ যখন হয়ে দাঁড়াল সন্তানধারণ, তখন তারা যন্ত্রণারই ভাজন হল এবং পরিবর্তে সম্মান বা ক্ষতিপূরণ সামান্যই পেল। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে অধিকাংশ নারীর কাছে মাতৃত্ব ছিল যন্ত্রণা ও বঞ্চনা।’ বস্তুত মাতৃত্ব ছিল ‘পুরুষের নিয়ন্ত্রণের যে সর্বাপেক্ষা বৈচিত্র্যময় সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তারই ভিত্তিপ্রস্তর… নারীর বন্দিত্বের তথ্য শুধু নয়… কিন্তু যে পদ্ধতিতে এই তথ্য অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল নারীর ওপর পুরুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ব্যবস্থায়।’[৮৩]

প্রাচীন ভারতে মাতৃত্বের ট্রাজেডি ছিল, বিকল্পহীন যে জোর নারীর উপর খাটানো হয়েছিল সেইটা। আর এই জোর ছিল সমাজে সেই সব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির ফল যে শক্তিগুলির উপরে নারীর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পুরুষ উত্তরোত্তর লাভবান হচ্ছিল এবং তার প্রত্যক্ষ সহকারী হিসেবে নারীর তদনুযায়ী ক্ষতি হচ্ছিল। মাতৃত্ব যে আনন্দময় হতে পারে, যখন নারী নিজে তা চায় এবং গর্ভধারণ ও প্রসবের কষ্ট সহ্য করতে প্রস্তুত হয় এই আশায় যে দম্পতির কিছুটা যৌথ নিয়ন্ত্রণ থাকবে সন্তানের উপর, কন্যাসন্তান যে পুত্রের মতোই সুখকর এবং আনন্দদায়ক হতে পারে, মা যে নিজের ইচ্ছায় কষ্ট সহ্য করেছে একটি জীবনকে পৃথিবীতে আনার জন্য, তাই কিছু সম্মান তার প্রাপ্য— এ সব কথা প্রাচীন ভারতে কোনও মা ভাবতেই পারত না। সে শুধু তার উর্বরতার গর্ব করত— যে শক্তি মানবেতর প্রাণীরও আছে— কিন্তু তার কষ্টের জন্য কোনও স্বীকৃতি প্রত্যাশা করত না। তার আনন্দ, তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, তার স্বপ্ন, সবই শিশুর মধ্যে বদ্ধ যতদিন সে সাবালক হয়ে না ওঠে এবং তার পরেও ভিন্ন স্তরে। সন্তানকে আনার ‘ইচ্ছা’ থেকে সে বঞ্চিত, শিশুর মানসিক লালন-পালন ও শিক্ষাদান থেকে সে বঞ্চিত, সে শুধুমাত্র গর্ভধারণের যন্ত্রে পর্যবসিত। যাজ্ঞবল্ক্য-র স্ত্রী শাসনের বিধানের কথা আগেই বলেছি। এই পুরুষেরাই সমাজের চরিত্র গঠন করে। এই ধরনের শাস্ত্র যৌন সংসর্গে নারীর স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, তাকে স্বামীর যেমন খুশি ব্যবহারের যন্ত্র করে তোলে। তাই গর্ভাবস্থা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। সে কি এমন গর্ভাবস্থা উপভোগ করতে পারে, সে কি সামান্যতম আনন্দের সঙ্গে সন্তানের জন্মের প্রতীক্ষা করতে পারে? সত্য কথা, সব গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে এটা ঠিক নয়, কিন্তু মহাকাব্য ও পুরাণে বহু অংশে অনিচ্ছুক নারীকে পুরুষের যথেচ্ছ ব্যবহারের কথা বলা হয়। এ রকম মাতৃত্ব আপনা থেকেই বোঝা হয়ে উঠত, অত্যাচার হয়ে উঠত। যুগ্ম ভাবে প্রাণ সৃষ্টি করা সন্তানকে লালন-পালন করা, সমস্যা ভাগ করে নেওয়া, দু’জনে মিলে বাধা ডিঙোনো, এ সব গ্রন্থে নেই। মায়েরা শৈশবে শিশুর কাছাকাছি আসতে ও থাকতে বাধ্য হত যেহেতু পিতারা তাদের বাইরের জীবিকা ও দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তাই সন্তানেরা স্বভাবতই মাকে বেশি ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনত। ‘সন্তান পালনের ব্যাপারে নারীর সামগ্রিক অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে পিতা অনেক পরে উল্লেখযোগ্য এবং পরিচিত একটি সত্তা হয়ে উঠত।’[৮৪]

তা সত্ত্বেও কিন্তু যে মুহূর্তে পুত্রের দৈনন্দিন শারীরিক প্রয়োজনে মায়ের উপর নির্ভরশীলতা শেষ হত, তখন থেকেই সে তার পিতার উত্তরাধিকারী এবং কন্যা যখন শারীরিক ভাবে মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকত না, তার অল্প পরেই তাকে বিবাহ দেওয়া হত। তখন মা একা হয়ে যেত, যদি না সে একটি গর্ভ থেকে আর একটি গর্ভে চলে যেত— যা প্রায়ই ঘটত। তারপর একটা সময় আসত যখন পরস্পর সন্তান ধারণ এবং গৃহকর্মের ফলে তার যৌবন ও রূপ চলে যেত; তখনই তার স্বামী আরও তরুণী, আরও সুন্দরী এক নারীকে ঘরে আনত, যে স্বামীকে খুশি করবে এবং তার সন্তান ধারণ এবং রক্ষা করবে। পূর্ব স্ত্রীর কোনও কোনও সন্তান, বিশেষ করে পুত্রসন্তান, ঘরে থাকবে এবং পিতার আচরণ থেকে দাম্পত্য জীবনের একটি ছক অন্তঃস্থ করবে। তারা বুঝবে এবং তাদের বৃদ্ধা মা বুঝবে, যে মা হওয়ায় মানসিক কোনও নিরাপত্তা আসে না, সে শুধুমাত্র সন্তান জন্মের যন্ত্র, যাকে অনায়াসে ত্যাগ করা যায়, যখন তার প্রধান উৎপাদনমূলক কাজে সে ব্যর্থ হয়। তাই মাতৃত্বের মধ্যে ছিল সংশয়, উদ্বেগ, অনিরাপত্তা এবং শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা, তার পরিবর্তে সামান্যই ক্ষতিপূরণের সুখ। এ কথা সত্য যে তাকে খেতে পরতে দেওয়া হত আশ্রয় দেওয়া হত, এমনকী যৌন বিষয়ে তার স্খলন হলেও তার পুত্র তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করত এবং তার জন্য প্রার্থনা করত। স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রেরা ধর্মগত ভাবে মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিত। কিন্তু তার স্বামীর জীবদ্দশাতেও যেহেতু সে সামাজিক সম্মান অল্পই পেত, তাই পুত্রেরা যে তাকে সম্মান দেখাতে বাধ্য ছিল না, এমন অনুমান কিছু উদ্ভট নয়। এটাই প্রাচীন ভারতে মাতৃত্বের প্রধান ব্যঙ্গাত্মক দিক। নারীকে মানুষ করা হত এই ভাবনায় যা তাকে শিক্ষা দিত, সে ভাবী মাতা। বালিকা কাল থেকে তাকে এই সামাজিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত ভূমিকার জন্য প্রস্তুত করা হত।

তা সত্ত্বেও, যেমন কৃষিকর্মে থাকে, তেমনই ক্ষেত্র কর্ষনের জন্য অনুষ্ঠান থাকত— পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, ইত্যাদি। কিন্তু কোনওটিতেই গর্ভবতী নারীর সুস্বাস্থ্য, সুখ বা দীর্ঘজীবনের জন্য কোনও প্রার্থনা নেই। এ রকম প্রার্থনা করা হয় পিতার জন্য, যার এ সবের প্রয়োজন নেই, এবং ভ্রূণের জন্য, যার অবশ্য প্রয়োজন আছে। কিন্তু মাতা, ক্ষেত্র, তার পরে অবজ্ঞাত হয়, যত দিন না তার প্রসব হয়। মা শুধু গর্ভধারণের যন্ত্র, বেশিও নয়, কমও নয়। শিশুর আবির্ভাবের জন্য সে অত্যাবশ্যক, কিন্তু শিশু তার পিতার, যার একটি প্রার্থনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য: ‘আমার থেকে জন্ম, অঙ্গ থেকে অঙ্গ, তুমি আমার হৃদয় থেকে জন্মেছ, পুত্র, তুমি আমারই স্বরূপ।’ এখানে ভ্রূণের বৃদ্ধির ব্যাপারে মায়ের অবদান সম্পূর্ণ অবজ্ঞাত এবং শিশুর মানসিক বৃদ্ধির বিষয়ে তার ভূমিকার কোনও স্থানই নেই। এতে তার সঙ্গে শিশুর মানসিক যোগসূত্রও ছিন্ন করা হয়, অন্তত ভাবগত ভাবে। নবজাতকের হৃদয় শুধু তার পিতার এটাই দাবি। ক্ষেত্র যেমন ফসল উৎপাদন করে, কিন্তু তার উপর তার অধিকার নেই, তা ভোগ করতেও পারে না, তেমনই মাকে দেখা হত তেমনই অসার। তাই ফসল তোলার পর অনায়াসে তাকে ভুলে যাওয়া যেত।

দুটি ভাবগত অসাধারণ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। প্রথমটা হল ‘মাতা সহস্র পিতার সমান’ এই ধরনের বক্তব্য। যে শারীরিক জনন ছাড়া পিতা তাঁর সম্পত্তি হিসেবে পুত্রকে পান না, এ সেই তথ্যেরই উদ্দেশ্যে স্তুতি। কতকটা ক্ষতিপূরণও বটে, কারণ আরও উক্তি আছে, ‘মাতৃভক্তির দ্বারা পুত্র পৃথিবী লাভ করে, পিতৃভক্তির দ্বারা স্ব লাভ করে।’ এর মধ্যে পিতা-মাতার ভিতরে সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য পরিস্ফুট হয়। তাছাড়া মায়ের তুলনায় বাবাকে উচ্চাসনে বসাবার সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রয়োজন সত্ত্বেও বাস্তবজীবনে মায়ের নিঃ স্বার্থ সেবা নিঃসন্দেহে তাকে তার সন্তানদের কয়েকজনের কাছে অন্তত অনেক উঁচুতে তুলে দিতে বাধ্য এবং এরই প্রকাশ ঘটেছে মাকে সম্মান দেওয়ার বিধানে।

দ্বিতীয় পার্থক্য হল মাতৃকাদের অস্তিত্ব, যা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ মাতৃগণের সামাজিক বিড়ম্বনার ক্ষতিপূরণ করতে চেষ্টা করেছে। এই মাতৃকাদের অধিকাংশের সন্তান আছে, কিন্তু উপকাহিনিতে মাতা ও শিশুর রূপ বিশেষ দেখানো হয়নি, কয়েকটি বিশেষ ভঙ্গিতে ছবি ও মূর্তিতে ছাড়া। এই মাতৃকারা সর্বশক্তিময়ী, অসুর হননে শ্রেষ্ঠ; অন্তত যে অশুভ শক্তি ক্ষতি করে বলে ভাবা হয়, তাঁরা তাকে খর্ব করেন। স্তোত্রে তাদের স্তুতি করা হয় সন্তানদের রক্ষা করার জন্য। যখন আর্ত তাঁদের কাছে আসে, তাঁরা বর দেন এবং আর্তি দূর হয়। অর্থাৎ তাঁরা তাঁদের মর্ত্য সন্তানদের কাছে সাক্ষাৎ কর্ত্রীর চেয়ে বরং ঘটয়িত্রী। তাঁরা বর ও শাপের মাধ্যমে কাজ করেন, অর্থাৎ ইচ্ছামূলক উক্তির দ্বারা। এ দিক দিয়ে তাঁরা মর্ত্য মায়েদের থেকে ভিন্ন, যে মায়েদের ইচ্ছা ও উক্তি সাধারণত সম্পূর্ণ নিষ্ফল। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের জন্য যা চান তা ঘটে না, যখন মায়েরা সক্রিয় ভাবে সন্তানের মঙ্গল চেষ্টা করছেন, তখনও না। প্রধান পার্থক্য অবশ্যই এই মাতৃকারা পুরোপুরি মুক্ত, স্বাধীন কর্তা, কিন্তু মর্ত্য মায়েরা স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি ও অন্যান্য গুরুজনের অধীন, এমনকী বার্ধক্যে পুত্রেরও অধীন। এছাড়া এবং এরই ফলে, মর্ত্য মায়েরা মাতৃকাদের অতিলৌকিক শক্তির অধিকারী নন, এমনকী লৌকিক শক্তিরও অধিকারী নন। স্বামী ও গুরুজনের অধীন, প্রত্যক্ষ কর্ত্রী হিসেবে সম্পূর্ণ শক্তিহীন মর্ত্য মায়েরা ক্ষমতাহীনতার বেদনা ভোগ করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাতৃকা পূজকেরা দেখান, তাঁরা ভাবগত ভাবে মাকে কত উচ্চে তুলেছেন। যা তাঁরা সত্যি সত্যি তুলেছেন, তা হল ‘মাতৃত্বের ভাবনা’। একে সেই স্তরে তুলেছেন যেখানে তাঁরা অসুরদমন করেন, প্রলয় রোধ করেন, যেমন পূর্বে পুরুষ দেবতারা করেছেন।

অভাগিনী মর্ত্য মায়েরা কি মাতৃকার মূর্তি ও উপকাহিনি থেকে কোনও সান্ত্বনা বা মানসিক পুষ্টি পেতে পারেন, যে মূর্তি পুরুষ দেবতাদের শক্তিরূপে সৃষ্টি করেছেন। মূল কল্পনাটি আসে সাংখ্যদর্শন থেকে, যেখানে পুরুষ নিষ্ক্রিয় ভাবে তার সঙ্গিনী প্রকৃতিকে দিয়ে কাজ করায়। তন্ত্র এই দর্শনকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে, যখন শক্তি একাই উল্লেখযোগ্য এবং শক্তিময়ী দেবী হয়ে উঠেছে। ইতিহাসে মাতৃকাদের উন্নয়ন ও মর্ত্য-মায়ের অবস্থার ক্রমিক অবনমনের মতো বিরাট পার্থক্য প্রকট হয়ে ওঠে। এই দু’টি ঘটনা কুড়িটি ধর্মশাস্ত্র এবং শাস্ত্রগ্রন্থ নিবন্ধের মাঝখানে ঘটেছে। সমাজে নারী হিসেবে, স্বাধীনচেতা কর্ত্রী হিসেবে সামাজিক সত্তা হিসেবে, মুক্ত যৌনসঙ্গী হিসেবে, শিশু পালনে সম-দায়িত্বশীল মাতা হিসেবে, সন্তানের গড়ে-ওঠা ও বৃদ্ধিতে সব সিদ্ধান্তে সহযোগী হিসেবে তার অবস্থান সমানেই নেমে গেছে। মর্ত্য-মা সন্তানের জন্য যা করে দেবী তা করে না: মর্ত্য-মা ন’টি কষ্টদায়ক মাস ধরে ভ্রূণকে গর্ভে ধারণ করে এবং প্রবল যন্ত্রণায় তাকে প্রসব করে; সে শিশুকে স্তন্য দান করে, খাওয়ায়, তার কাপড় বদলায়, তাকে ঘুম পাড়ায়, তার সব শারীরিক প্রয়োজন দেখাশোনা করে, রোগে সেবা করে। অত্যন্ত শ্রমসাপেক্ষ এই শারীরিক কাজগুলি থেকে মাতৃকারা দেবী হিসেবে সম্পূর্ণ ভাবে মুক্ত। কিছুদিন পরে যখন পিতা দায়িত্ব নেয়, মা তখন নীরব ও কতকটা সুদূর দর্শক হয়ে থাকে, পরিবর্তে খুব কমই দাবি করে: ক্বচিৎ আনুষ্ঠানিক সম্মান, বার্ধক্যে ভরণপোষণ এবং প্রয়োজন মতো পৌত্রপৌত্রীদের দেখাশোনা। মাতৃকা কিন্তু ভাবগত ও মানসিক স্তরে তার সন্তানদের সঙ্গে যুক্ত হয়, প্রায়ই সম্মান ও পূজা পায় এবং বিপদের সময়ে তারা বিপদ দূর করতে শক্তিময়ী বররূপা বাণী উচ্চারণ করে। অপর দিকে তারা দৈবস্তরেও সক্রিয়। যেখানে পুরুষ দেবতারা প্রলয় রুখতে নিষ্ফল হয়। মাতৃকারা সেখানে সফল। এই মহতী মূর্তিগুলির সঙ্গে কি কোনও মর্ত্য মাতা সম অনুভূতি বোধ করতে পারে, না নিজেকে এই দেবী রূপে প্রকাশ করতে পারে?

এদের স্থান দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিতে: একজন তার গুরুতর রূপে সীমিত সাংসারিক প্রদেশে, যেখানে সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পিতার আয়ত্তে বলে তার সন্তানদের মঙ্গলের জন্যও নিজের ইচ্ছা খাটাবার স্থান নেই; তাকে কোনও পর্যায়ে তার মত জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করা হয় না, কিন্তু দেবী মায়ের ইচ্ছা মহাবিশ্বের স্তরে সৃজনশীল। মাতৃকা তার কাজ করে কোনও ব্যথা ছাড়াই, দৈব আনন্দে; মর্ত্য মাতা মাতৃত্ব শুরু ও শেষ করে ব্যথার মধ্যে। পুত্র তার শিক্ষা ও জীবিকা শুরু করলে, কন্যার বিবাহ হয়ে গেলে, মা ফিরে যায় তার একাকিত্বের বাঁধা গুটিতে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে আবার গর্ভধারণ না করে। তার মাতৃত্ব তাকে কয়েক মাস আনন্দ দেয়, যতদিন তার শিশু খুব ছোট আছে, তার প্রতি নির্ভরশীল আছে। কিন্তু শীঘ্রই— বড়বেশি শীঘ্র, এই সংক্ষিপ্ত মুক্তির কাল শেষ হয়ে যায় এবং মাতৃত্বের উজ্জ্বলতা ধীরে ধীরে নিশ্চিত ভাবে মিলিয়ে যায়।

***

সূত্রাবলি

১. আলতেকার ১৯৫৬ : ১০১

২. হিরণ্যকেশিন গৃহ্যসূত্র ১:৬:২২:১৪

৩. স্তোত্র তৃতীয়: ২৩; পঞ্চম: ২৫; এবং ষষ্ঠ: ১১

৪. বৃহদারণ্যকোপনিষদ ষষ্ঠ: ৪ষ৪; ১৩। ১৯-২২

৫. হিরণ্যকেশিন গৃহ্যসূত্র দ্বিতীয়: ১:২

৬. গোভিলা গৃহ্যসূত্র দ্বিতীয়: ৭:১-১২; খাদিরা গৃহ্যসূত্র দ্বিতীয়: ২:২৪-২৮

৭. ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্র ১:২:১

৮. ঐ ১:১৭

৯. সামবর্ত সমহিতা ২০; ৪

১০. ১.১১.৪১১. দশম: ৮৬; ২৩]

১২. এই শাস্ত্রীয় আচারটি সামান্য কিছু পরিবর্তিত হয়ে অশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র ১; ১৪, ১-৯, আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্র চতুর্দশ: ১-৮; হিরণ্যকেশিন গৃহ্যসূত্র দ্বিতীয়: ১; বৌদ্ধায়ন গৃহ্যসূত্র প্রথম ১::; পরাশর গৃহ্যসূত্র প্রথম ১:১৫; ভৈখানাসা গৃহ্যসূত্র তৃতীয়: ১২; এবং কথক গৃহ্যসূত্র একত্রিশতম: ১-৫, এ-অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

১৩. ষষ্ঠ: ১১:১]

১৪. সমস্ত প্রকার গর্ভধারণ সংক্রান্ত আচার অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হল পুত্র সন্তানের জন্মদান নিশ্চিত করা। এখানে সামাজিক চাহিদার ব্যাখ্যা করে সেই অনুসারে ব্যাখ্যায়িত করা হয়েছে।

১৫. আচার অনুষ্ঠানের নামটি গুরুত্বপূর্ণ; শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল অজ্ঞাত কাউকে লোভী না করা।

১৬. আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্র চতুর্দশ: ১৩-১৫; হিরণ্যকেশিন গৃহ্যসূত্র দ্বিতীয়: ২:৮-১১: ৩:১; ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্র ১:২২, গোভিলা গৃহ্যসূত্র ১১:৭:১৩-১৪; খাদিরা গৃহ্যসূত্র ১১:২:২৯, ৩০; পরাশর। গৃহ্যসূত্র ১:১৬; কথক গৃহ্যসূত্র-তে ত্রিশতম: ১-৩, বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এর চতুর্থ ভাগের: ৪:২৩ অংশে এর উল্লেখ আছে।

১৭. পরাশর গৃহ্যসূত্র প্রথম: ১৬; আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্র দ্বিতীয়: ১৩:৭-১৪ এবং ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্র প্রথম: ২৩।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এগারো সংখ্যাটি যা হল রুদ্রদের সংখ্যা। যে সকল দেবতারা যারা সাধারণত ভ্রূণ এবং সদ্যজাত শিশুদের ক্ষতিসাধন করে থাকে। মহাভারতের ত্রয়োদশ খণ্ডে রুদ্র শিবের সঙ্গী সাথীদের বিবরণ দেওয়া আছে। এদের কেউ কেউ ভ্রূণের মাংস খায়। অন্যরা সদ্যজাত শিশুদের খেয়ে থাকে।

১৮. প্রাচীন মিশরীয় এবং ব্যাবেলনীয় ধর্মীয় আচার এ ধরনের বিশ্বাসের ধারণা বিদ্যমান। অভিভাবকের কাছে।

১৯. কার্তুমাস্য থেকে

২০. শতপথ ব্রাহ্মণ দ্বিতীয়: ৫:২:২০

২১. জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণ সপ্তদশ, ৩:১

২২. শতপথ ব্রাহ্মণ ষষ্ঠ: ২:৩:১৩; পঞ্চম: ৩:১:১৩
প্রজনন বিষয়ে অত্যধিক গুরুত্বপ্রদানের ফলে একটি ধারণা সৃষ্ট হয়েছে যে একজন মহিলা নিঋতি তাতে ভর করেছে। আত্মায় এক অশুভ ধারণা যা কিনা অত্যন্ত কুৎসিত, শত্রুপরায়ণ। যার বিশেষ কাজই হল সমস্ত রকম শুভ বিষয়কে ধ্বংস করা। নিঋতি-র ধারণা সম্পর্কে জানতে আমার দ্য ইন্ডিয়ান থিওগনি, পৃষ্ঠা ৮০-৯২, ১২৯, ১৬২-১৬৩] দেখুন। বন্ধ্যা মহিলাকে নিঋতি কর্তৃক নিদান এমন একটি কথা সামাজিক অবগুণ্ঠিত মানসিকতা থেকে সৃষ্টি হয়েছে যে মহিলাদের সমাজের প্রাথমিক দায়িত্ব হল সন্তান ধারণ করা। আমরা পরবর্তীকালে বিষয়টিতে আসব।

২৩. আমাদের এই জরুরি বিষয়টি থেকে দৃষ্টি ফেরালে চলবে না যে এই অংশটিতে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানের লক্ষ্যই হল পুত্র সন্তান লাভ। সম্পূরক পাঠ্যে বলা হয়েছে একই আচার বাল্য সন্তানরে জন্য পালন করা যেতে পারে, তবে মন্ত্রোচারণ চলবে না। অর্থাৎ, আচার পালনের সময় কোনও রকম পবিত্র পাঠ্যসমূহ উচ্চারণ করা যাবে না।

২৪. বৌদ্ধায়ন ধর্মসূত্র দ্বিতীয়: ৪-৬; আপস্তম্ব ধর্মসূত্র দ্বিতীয়; ৫:১১-১৪; যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা প্রথম: ৭৩-৮১; মনুসংহিতা নবম : ৪]

২৫. বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র আঠাশতম: ২-৩]

২৬. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ তৃতীয়: ২৪:২৭; আপস্তম্ব ধর্মসূত্র প্রথম: ১০:৫১-৫৩।

২৭. ষষ্ঠী হল ছয় কৃত্তিকার অন্যতম দেবতা। দুলা, নিতাতনি, কুপুনিকা, অভ্রবন্তি, মেঘবন্তী এবং বর্ষাবন্তী। এর মধ্যে কোন তিনটি প্রত্যক্ষ ভাবে বৃষ্টির সঙ্গে সংযুক্ত তা তাদের নামকরণ থেকেই বোঝা যায় প্রথম তিনটি সম্ভবত প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের পৌরাণিক কাহিনি থেকে গৃহীত এবং তা অনেকখানি একই অর্থে। উদাহরণস্বরূপ, আরবি ক্রিয়াপদ ‘দিলি’ বা ভর্তি করা থেকে গৃহীত। অন্য দুটির এখনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি, যাই হোক, কৃত্তিকার সঙ্গে ষষ্ঠীর সম্পর্কটি তার প্রজনন প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে। যেখানে বৃষ্টিপাত হল পৌরাণিক প্রতীক।

২৮. আগ্রহের বিষয় হল তার নাম দেবসেনা, স্বর্গীয় সেনা। স্কন্ধের স্ত্রী। স্কন্ধ হল ছয় মুখ বিশিষ্ট স্বৰ্গীয় সেনাপতি যার সৃষ্টি হয়েছিল তারকা রাক্ষসীকে বধ করতে। সুতরাং ষষ্ঠী সন্তানসম্ভবা বা বাস্তবিক মায়েদের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত। ষষ্ঠী ব্রত (ষষ্ঠীর উপাসনা) মায়েরা পালন করেন পঞ্চম দিনে এবং সূর্যের উপাসনা করা হয় পরবর্তী দু’ দিনব্যাপী। মৎস্যপুরাণ একশত একতম: ১-৮৩।

২৯. ভবিষ্যপুরাণ, উত্তরাখণ্ড

৩০. ব্ৰতখণ্ড দ্বিতীয়: ৩১৫-১৮]

৩১. ভবিষ্যপুরাণ পঞ্চম: ৩১৩]

৩২. ধারণার সৃষ্টি হয়েছে এই ভাবে যে যেহেতু দুর্বা প্রভূত পরিমাণে উৎপন্ন হয় সুতরাং মহিলাদের বহু পুত্রলাভ সম্ভব হবে।

৩৩. ব্ৰতখণ্ড প্রথম: ৫৭২

৩৪. মৎস্য পুরাণ একশত একতম: ২৯-৩০, বিষ্ণুধর্মোক্ত পুরাণ তৃতীয়: ১৮৯:১-৫

৩৫. হিমাদ্রি ব্রতখণ্ড দ্বিতীয়: ১৭১-৭২; কর্তকল্পতরু, ৩৭৪-৭৫

৩৬. হিমাদ্রি, রচনায় উল্লিখিত, দ্বিতীয় ২৩১-৩৩

৩৭. বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ দ্বিতীয়: ৫৫: ১-১২, পুত্রিয়াসপ্তমী (রচনায় উল্লেখিত, ব্রতখণ্ড প্রথম: ৭৮৯৮-৯০)

৩৮. তৈত্তিরীয় সংহিতা ষষ্ঠ: ৫:১০:৩; মৈত্রযানী সংহিতা: চতুর্থ: ৬:৪

৩৯. মায়েদের পানীয় আচার সম্পর্কে উপরের অংশটি দেখুন

৪০. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ সপ্তম: ৩:৭:১৩

৪১. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ: ১৭৩:১০
পরবর্তীকালে এই প্রবণতা অন্য পুস্তিকাতেও লক্ষণীয়। বিষয়টি আংশিক ব্যাখ্যা করা যেতে পারে দেশে প্রচলিত পণপ্রথার মাধ্যমে, যা অভিভাবকদেরকে আর্থিক সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেয়। যদিও মহাভারতের এক জায়গায় বলা হয়েছে যে লক্ষ্মী কন্যাসন্তানদের মধ্যেই বিরাজ করে (দ্বাদশ: ১১:১৪; এছাড়া বিষ্ণুস্মৃতি ৯৯:৪;) কিন্তু তা কোনও ভাবেই সাধারণ সামাজিক প্রবণতাকে বোঝায় না।

৪২. মহাভারত চতুর্থ: ২২:১৭

৪৩. সংযুক্ত নিকায় প্রথম: ৬:৪]

৪৪. বশিষ্ঠ সংহিতা সপ্তদশ: ৩]

৪৫. রচনায় উল্লেখিত, পদ্য ৫৫; মহাভারত পঞ্চম: ৮৮:৬৮

৪৬. মনুসংহিতা নবম: ১৬৮

৪৭. দশম: ১৭১

৪৮. মনুসংহিতা দ্বিতীয়: রচনায় উল্লেখিত ১৪৫

৪৯. রচনায় উল্লেখিত, দ্বিতীয়: ২৩৩

৫০. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র প্রথম: ১০:২৮:৯

৫১. বৌদ্ধায়ন ধর্মসূত্র দ্বিতীয়: ২:৪৮

৫২. বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র একাদশ: ১০; ত্রয়োদশ: ৪৭; বিষ্ণু ধর্মসূত্র সাতান্নতম: ১-৫

৫৩. ৫৭তম: ১-৫

৫৪. অত্রি সংহিতা ১৫১

৫৫. মহাভারত প্রথম: ৩৭:৪

৫৬. মহাভারত ত্রয়োদশ: ২৬৮:৩০

৫৭. অমিতায়ুধ্যানসূত্র

৫৮. হিরণ্যকেশিন গৃহ্যসূত্র দ্বিতীয়: ৪:১০:৭, মনুসংহিতা নবম: ১৮

৫৯. বিষ্ণুসংহিতা একত্রিশতম: ১-৩

৬০. রচনায় উল্লেখিত পঞ্চম: ৩৪]

৬১. অত্রিসংহিতা ১৮৬] এবং অন্যত্র

৬২. যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি প্রথম: ৭২]

৬৩. মহাভারত তৃতীয়: ২২৮: ৩০-৩১]

৬৪. রচনায় উল্লেখিত, তৃতীয়: ২৩০: ৯-১১]

৬৫. মহাভারত-এর লাতিন সংস্করণ নবম: ৪৪। যখন অগ্নি গঙ্গার কাছে বীজ প্রদান করে, তখন গঙ্গ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। জলের অন্য জীবেরা গভীর আর্তনাদ করে ওঠে এবার সে সেই বীজ ধারণ করতে অস্বীকার করে। (লাতিন সংস্করণ ত্রয়োদশ: ৮৫:৫৫-৮২)

৬৬. স্তোত্র ত্রয়োদশ: অথর্ববেদ-এর প্রথম সংখ্যা। প্রাচীন কিন্তু ইতোমধ্যে জমির পরিবর্তিত চিত্র।

৬৭. নবম: ৩৫

৬৮. নবম: ৩৭

৬৯. নবম: ৪৮

৭০. নবম: ৫২

৭১. দশম: ৩২

৭২. নবম: ৩২

৭৩. নবম: ২৭

৭৪. নবম: ২৬

৭৫. নবম: ৯৬

৭৬. সাদবি: ১৯৮০: পৃ. ৬৩

৭৭. চার্বাক: ৮২:৬১

৭৮. রচনায় উল্লেখিত, পৃ. ২১৯

৭৯. চোদরভ: ১৯৭৮: ৯৪

৮০. চোদরভ: ১৯৭৮: ৩৯

৮১. আইনস্টাইন: ১৯৮৮:৭১

৮২. ইংরাজি lord কথাটি এসেছে half (loaf) + ward থেকে— যার অর্থ রুটি জোগায় যে।

৮৩. বৃহদারণ্যকোপনিষদ ষষ্ঠ: ৪:৭

৮৪. আইনস্টাইন: ১৯৮৮:৮১

.

গ্রন্থপঞ্জি

প্রাথমিক উৎস

(ক) বৈদিক গ্রন্থ

ঋগ্বেদ সংহিতা

তৈত্তিরীয় সংহিতা

মৈত্রায়ণী সংহিতা

অথর্ববেদ সংহিতা

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ

জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণ

শতপথ ব্রাহ্মণ

বৃহদারণ্যকোপনিষদ

গোভিল গৃহ্যসূত্র

ভরদ্বাজ গৃহ্যসূত্র

জৈমিনীয় গৃহ্যসূত্র

শাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্র

আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র

হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র

বৌধায়ন গৃহ্যসূত্র

পরাশর গৃহ্যসূত্র

বৈশ্বানর গৃহ্যসূত্র

কাঠক গৃহ্যসূত্র

আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্র

বিষ্ণু ধর্মসূত্র

আপস্তম্ব ধর্মসূত্র

বৌধায়ন ধর্মসূত্র

বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র

(খ) মহাকাব্য ও বৌদ্ধ গ্রন্থ

মহাভারত (পুণা ক্রিটিকাল এডিশন)

সংযুক্ত নিকায় (পালি টেক্সট সোসাইটি সংস্করণ)

অমিতায়ুধানসূত্র

(গ) পুরাণ

মৎস্য পুরাণ

ভবিষ্য পুরাণ

বিষ্ণু ধর্মোত্তরপুরাণ

(ঘ) ধর্মশাস্ত্র

বিষ্ণু সংহিতা

বিষ্ণুস্মৃতিকা বা বিষ্ণু ধর্মসূত্র

বশিষ্ঠসংহিতা সংবৰ্ত্ত সংহিতা

(ঙ) পরবর্তী গ্রন্থ

বর্ষক্রিয়াকৌমুদী

কৃত্যাকল্পতরু

অভিজ্ঞানশকুন্তলম (সম্পাদনা: আর. বসু)

নীলমত পুরাণ

বাণভট্টের হর্ষচরিত (জীবানন্দ বিদ্যাসাগর সংস্করণ)

.

গৌণ উৎস

আলতেকর, এ. এস. ১৯৫৬: The Position of Women in Hindu Civilisation, দিল্লি।

আর্ডনার, ই. ১৯৮০] : Perceiving Women; লন্ডন।

অয়েরবাখ, এন. ১৯৮২] : Women and the Demon; হার্ভার্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস।

বোভয়া, এস. ডি, ১৯৫৩] : The second sex; নিউইয়র্ক।

বার্নাল, এস. ১৯৮৭: The Afro-Asiatic Roots of Classical Civilisation, প্রথম খণ্ড, লন্ডন ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন বুকস।

ব্রিফল, আর. ১৯৫৯] : The Mother, জি. আর. টেলরের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, ম্যাকমিলান।

চোদোরভ, এন. ১৯৭৮: The Reproduction of Mothering : Psychoanalysis and the Sociology of Gender; ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস।

আইজেনস্টাইন, এইচ. Contemporary Feminist Thought; আরউইন পেপার ব্যাকস, প্ৰথম খণ্ড, ১৯৮৪, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৮৮।

ফক, এন. এ. ১৯৮০: Unspoken Worlds : Women, Religious Lives in North Western Cultures; সান ফ্রানসিসকো।

গৌর, এ. ১৯৭৫: Women in India, লন্ডন।

হল, ই. টি. ১৯৬৬: The Hiden Dimension, নিউইয়র্ক।

লাজার, জে. ১৯৭৬] : The Mother Knot, নিউইয়র্ক।

লিখট, এইচ. ১৯৬৩] : Sexual Life in Ancient Greece.

লুহান ও মার্শাল, ১৯৬৭: The Mechanical Bride, বস্টন।

প্লেটো: Laws

রিখটার, ডি. ১৯৭১: ‘The Position of Women’ in Classical Journal, ৬৭নং।

রাডিক, এস. ১৯৮০: 342-67: Maternal Thinking in Feminist Studies, ৬নং, ২নং গ্রীষ্ম।

সাদবি, এন. ও অন্যান্যরা, ১৯৮০: The Hidden Face of Eve; জেড প্রেস।

সেল্টমান, সি. ১৯৫৬] : Women in Antiquity, লন্ডন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *