৪. মৌলবাদের জন্মকথা

মৌলবাদের জন্মকথা

মানবসভ্যতার ইতিহাসে ধর্মীয় মৌলবাদ অতি প্রাচীন যেমন কোন ব্যাপার নয়, তেমনি আচমকা সৃষ্টিও হয় নি। ধর্মকে অনাবিল ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অবস্থান থেকে উৎখাত করে, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণী:স্বার্থে তার চরম ব্যবহার থেকে তার উদ্ভব। সাধারণভাবে বল্লে মৌলবাদের সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে হয়তো এভাবে প্রকাশ করা যায়।–

অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস
(এখন থেকে ৫০-৬০ হাজার বছর আগে নিয়ানডার্থাল মানুষের অন্তিম পর্যায়ে। এর থেকে ধীরে ধীরে ঈশ্বর ও আত্মার প্রাথমিক কল্পনার উন্মেষ। প্রধান ভূমিকা পালন করেছে—’মানুষের’ কল্পনা করার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার উন্নত ক্ষমতা, প্রকৃতির কাছে ও প্রকৃতি সম্পর্কে তার অসহায়তা ও অজ্ঞতা।)

প্ৰতিষ্ঠানিক বিভিন্ন ধর্ম
(এখন থেকে প্রায় ৬ হাজার বছর আগে। প্রধান ভূমিকা পালন করেছে—শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সৃষ্টি; মূল্যবোধ, শৃঙ্খলা তথা অনুশাসন সৃষ্টি করে গোষ্ঠীকে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ রাখার তাগিদ)

ধর্ম-নিষ্ঠা
(ঐশ্বরিক শক্তিকে সন্তুষ্ট রাখার বিশ্বাস ও তাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত সততা–>এগুলি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট)

ধর্মান্ধতা বা ধর্মীয় গোঁড়ামি
(প্রধান ভূমিকা পালন করে বিশেষ শ্রেণীর উসকানি, চূড়ান্ত সংকীর্ণ ও অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা, নিজ ধর্মের বিরুদ্ধে ভিন্ন ধর্মের বা ভিন্নতর সামাজিক শক্তির আক্রমণ ও চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়া)

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা । ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদ

ধর্মীয় মৌলবাদ
(বিশুদ্ধ ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদ নিজ ধর্মের তথাকথিত বিপন্ন অস্তিত্বের সময় তার মাহাত্ম্য ও কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রধান দিক হচ্ছে, মানুষের কৃত্রিম ধর্মীয় পরিচয়কেই প্রধানতম পরিচয় হিসেবে মনে করা, এইভাবে মানুষের মধ্যে বিভেদ ও শক্ৰতা সৃষ্টি করা, মানবিক সৌভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট করা এবং নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের স্বাৰ্থ এক বলে প্রচার করা ও ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে শত্রু বা অনুগত থাকার যোগ্য বলে মনে করা। ধর্মীয় মৌলবাদী ধর্মের সুবিধাজনক মূল ভিত্তিটিকে আপোষহীনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং ধর্মান্ধিতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদের নানাদিক তার সঙ্গে সম্পৃক্তভাবে মিশে থাকে। ধৰ্মজীবী শাসক-শ্রেণীর বিপন্ন বা মুমূর্ষ। অবস্থায় অথবা শাসকশ্রেণীর একাংশের দ্বারা রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের বীভৎস ব্যবহারের দ্বারা তার উদ্ভব।)

ধর্মীয় মৌলবাদ ও মৌলবাদী মানসিকতা এইভাবে বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে এক সময় সৃষ্টি হলেও তা আদৌ সর্বজনীন নয়। প্রকৃতপক্ষে একমাত্র অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসের ব্যাপারটিই একসময় সর্বজনীনতা লাভ করেছিল, যদিও এখন থেকে আনুমানিক আড়াই-তিন হাজার বছর আগে বস্তুবাদী চিস্তার উন্মেষের ধারাবাহিকতায় তা আজ আর সর্বজনীন নেই। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানিক বিভিন্ন ধর্ম থেকে ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া অব্দি-সমস্ত স্তরেই আপামর জনসাধারণ তার অংশীভূত হয় নি। একসময় প্রতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিতে বিশ্বাসীর সংখ্যা-তা যে যত আলগাভাবেই হোক না কেন, ছিল তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। ঐ তুলনায় ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির সংখ্যা প্রকৃত বিচারে ছিল অনেক কম। আর ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদীর সংখ্যা আরো কম। মানুষের চিরন্তন শুভবুদ্ধিরই একটি পরিচয় এটি-যদিও তাদের দ্বারা প্রভাবিত, বিপথগামী, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা অনেক।

ধর্মনিষ্ঠ বা ধর্মপ্ৰাণ (devoted to religion, virtuous, pious) ব্যক্তির সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। সুস্থ জীবনের লক্ষ্যে, নিজ ধর্মবিশ্বাসকে, তার আচার অনুষ্ঠান ও শিক্ষাকে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে অনুসরণ করাই তাঁর জীবন-যাপনের প্রধান দিক। মৌলবাদীরা ধর্মনিষ্ঠ নয়; ধর্ম এদের কাছে নিষ্ঠার চেয়ে নিজের স্বাৰ্থ পুষ্ট করার, মানুষকে বিভক্ত করে তথা তার সামগ্রিক আন্দোলনে অনৈক্য সৃষ্টি করে হিংস্রতা প্রকাশ করার একটি মাধ্যম মাত্র। ধর্মীয় মৌলবাদী বলতে একদল এমন ‘মানুষ’কে বোঝায় যাদের মধ্যে ধর্মকে আঁকড়ে রেখে উগ্রতা ও হিংস্ৰতা (এই উগ্রতা ও হিংস্ৰতা সর্বদা নিছক শারীরিক নয়) ধর্মান্ধতা ও পরমত অসহিষ্ণুতা, প্রগতিবিরোধিতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী ইত্যাদির ব্যাপারটি প্রধানভাবে চোখে পড়ে। এর বিপরীতে একজন ধর্মনিষ্ঠ মানুষের কথা বললে বা শুনলে চোখের সামনে প্রথমেই ভেসে আসে ধর্মে নিষ্ঠাবান, মানবপ্রেমিক, উদার একজন মানুষের মুখ। একদা যে অসম্পূর্ণ জ্ঞান ও অসহায়তা থেকে ঈশ্বর ও আত্মাসহ ধর্মের প্রাথমিক ভিত্তিগুলি কল্পিত হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিরা ধর্মকে আঁকড়ে রাখেন নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পূক্তভাবে জড়িয়ে। তাকে শ্রেণীস্বার্থে ব্যবহার করা, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি বা রাজনৈতিক ধান্দাবাজির জন্য ব্যবহার করা থেকে অনেক দূরে তাঁর অবস্থান। ভিন্ন ধর্মের মানুষ তাঁর কাছে শত্রু নয়, তাকে তিনি র্তারই মত ধর্মনিষ্ঠ আরেকজন বলেই গণ্য করেন এবং সম্মান করেন।

ধর্ম যার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেই রিলিজিয়ন (Religion) কথাটি এসেছে re-ligare থেকে যার আদি অর্থ হল ‘পুনর্বন্ধন’ (এই, ligare থেকেই এসেছে ligament কথাটি)। অর্থাৎ দুটি ভিন্ন মানুষকে যা বন্ধন করে তাই রিলিজিয়ন। সংস্কৃত তথা বাংলা ‘ধর্ম-এরও অর্থ যা ধারণ করে, মানুষকে ও মানুষের সমাজকে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন শতধাবিভক্ত মানুষ নিয়ে সমাজ-ধারণ সম্ভব নয়। এইভাবে সমস্ত দিক বিচারে ধর্মের মূলগত অর্থেই ধর্মনিষ্ঠদের বিপরীতে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা আদৌ ধাৰ্মিক নয়, বরং তারা ধর্মবিরোধী—যে ধর্ম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা সেই ধর্মকে সামনে রেখেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের শত্রু বলে দূরে সরিয়ে দেয়। (অবশ্য পরবর্তীকালে ধর্ম বা রিলিজিয়নের এই মূলগত অৰ্থও হাস্যকর হয়ে গেছে, যখন থেকে বিশেষ প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম বিশেষ গোষ্ঠীর বা শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে।)

এগুলি সত্ত্বেও এটিও সত্য যে, ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির মধ্যে নিজ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি এক ধরনের অন্ধত্ব থাকে, যা ধর্মান্ধতা-ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মীয় মৌলবাদেরও একটি প্রাথমিক ভিত্তি। কিন্তু শেষোক্তারা যখন ধর্মবিরোধী বা ধর্মের ভিত্তিকে নাড়া দিতে সমর্থ প্রগতিশীল চিন্তাকে (যেমন বিবর্তনবাদ, বস্তুবাদ ইত্যাদি) হিংস্রভাবে মোকাবিলা করে, ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিরা তাকে উপেক্ষার চোখে দেখেন।

মৌলবাদীরা যখন ধর্মের মূল ভিত্তিতে ফিরে যাওয়ার জন্য জঙ্গী আন্দোলন ও প্রচার করে, ধর্মনিষ্ঠরা তখন নিজের জীবনে তার প্রয়োগ করেই তৃপ্ত থাকেন। সব মিলিয়ে ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির কাছে ধর্ম নিজস্ব ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদী তথা সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গের কাছে তা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের একটি সাংগঠনিক মাধ্যম বা উপায় যা ধর্মের সঙ্গে ততটা যুক্ত নয়। এই উদ্দেশ্য নানা ধরনের হতে পারে,–(ক) নিছক ধর্মীয় মাহাত্ম্য বা বিপন্ন হওয়া ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য, এবং (খ) তার নাম করে নিজেদের শ্রেণীগত আধিপত্য বিস্তার করা ও ক্ষমতা অর্জন করা; এক্ষেত্রে অর্থনীতি ও রাজনীতির নানা দিক যুক্ত করা হয়। দ্বিতীয়োক্ত এই বিশেষ অধ্যমীয় উদ্দেশ্য না থাকার কারণে ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তিরা একক বা বিচ্ছিন্নভাবেই সাধারণতঃ থাকেন, কেউ বা হিমালয়ের নির্জনে ধ্যান আর ঈশ্বর আরাধনার কল্পিত আনন্দে নিমগ্ন থাকেন। অবশ্য যৌথভাবে ধর্মাচরণের জন্য কেউ বা হরিসভা জাতীয় নানা ধরনের ধর্মীয় ক্লাবও গড়েন। অন্যদিকে ধর্মের নাম করে বিশেষ কাৰ্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা সাধারণতঃ সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন সংস্থা গড়ে তোলে, এমন কি এখনকার পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নানা ধরনের রাজনৈতিক দলও।

ধর্মীয় সংগঠনও নানা ধরনের হয়। নিছক সংগঠিত হলেই যে, তার মধ্যে মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক ধান্দা থাকবে তা অবশ্যই নয়, যেমন পাড়ার কিছু ধর্মপ্ৰাণ ব্যক্তি ধর্মকে কেন্দ্র করে আনন্দলাভ করা ও অবসর বিনোদনের জন্য ঐ হরিসভা জাতীয় নানা সংস্থা গড়ে তুলতে পারেন। আবার সাইবাবা, অনুকূলচন্দ্ৰ, মোহনানন্দ, আনন্দময়ী মা, রজনীশ জাতীয় অজস্র গুরুমা-গুরুমহাশয়দের দল ব্যক্তিগত ব্যবসা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির জন্য ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এবং সরলবিশ্বাসী মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ধর্ষণ করে নিজেদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। কখনো বা লোকনাথ বা বালক ব্ৰহ্মচারীর মত লোকদের মৃত্যুর পরেও তার ধান্দাবাজ কিছু ‘ভক্ত’ ব্যবসায়িক কারণে এই ধরনের ব্যবসায়িক সংস্থা জিইয়ে রাখে। পাশাপাশি রামকৃষ্ণ মিশন জাতীয় ধর্মীয় সংস্থাও গড়ে ওঠে, যাদের প্রধান দিক নিজ ধর্মীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সমাজ সেবা, শিক্ষা প্রসার, কিছু বিশেষ মূল্যবোধ গড়ে তোলা ইত্যাদি।

এমন নানা ধরনের ধর্মীয় বা ধর্মভিত্তিক সংগঠনের পাশাপাশি ধর্মীয় মৌলবাদী বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংগঠন আরো নিকৃষ্ট উপায়ে ধর্মকে কাজে লাগায়। এদের মধ্যে তীব্রতার তারতম্য থাকে। সব ধর্মেই মাহিষ্য সমিতি, বৈষ্ণব সম্মেলন, শৈব সভা বা সাদগোপ সভার মত নিছক সাম্প্রদায়িকতা ভিত্তিক নানা সংস্থা তৈরী হয়। বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীগত ও সাম্প্রদায়িক স্বাৰ্থ দেখার জন্য। কিন্তু এদের মৌলবাদী বলা চলে না, কারণ ধর্মের প্রাথমিক ভিত্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জঙ্গী উৎসাহ এবং বৃহত্তর ক্ষমতা লাভের ব্যাপকতর আকাঙক্ষা এদের মধ্যে অনুপস্থিত।

বিশুদ্ধ মৌলবাদী সংগঠন প্রথম গড়ে ওঠে আমেরিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ও আরো সুনির্দিষ্টভাবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ফান্ডামেন্টালিস্টদের মধ্যে। বাইবেল তথা ধর্মের মাহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা করার প্রাথমিক তীব্রতা এদের অস্তিত্ব জুড়ে সম্পৃক্ত ছিল। অবধারিতভাবে শ্রেণীস্বার্থ তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলই, কিন্তু তা প্রধানভাবে প্রকাশ পায় আরো পরে যখন বিবর্তনবাদ ছাড়িয়ে কম্যুনিজমকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারটি সুনির্দিষ্ট মাত্রা পায়। এখনকার মৌলবাদী সংগঠনের মধ্যে এই দিকটি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

নিয়ানডার্থাল মানুষেরা শেষের দিকে ঐশ্বরিক শক্তি ও আত্মজাতীয় কোনকিছুর কল্পনা শুরু করলেও এবং পরবর্তী কালের আধুনিক মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন) তার ক্রমশ বিকশিত ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেও, এগুলি সাংগঠনিক ভাবে বিশেষ প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের রূপ পায় আরো হাজার হাজার বছর পরে,-মাত্র ৫-৬ হাজার বছর আগে, যখন শ্রেণী বিভক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এবং তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে, বিভিন্ন প্রাচীন ধর্ম (যেমন মায়া আজটেকদের) গড়ে ওঠে। এসব ধর্মের প্রায় সবগুলিই এখন অবলুপ্ত, জাদুঘরে ও ঐতিহাসিকদের কাজে কর্মে তা টিকে আছে। পরবর্তীকালে বৈদিক ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম, খৃস্টধর্ম, হিন্দুধর্ম, ইসলাম ধর্ম, শিনটো ধর্ম, কনফুসিয়াসের ধর্ম (বা মতবাদ), শিখ ধর্ম, বাহাই ধৰ্ম ইত্যাদি নানা ধর্ম গড়ে ওঠে। এ ব্যাপারে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। লেখকের ‘ধর্মের উৎস সন্ধানে (নিয়ানডার্থাল থেকে নাস্তিক)’ গ্রন্থে, ২য় সংস্করণ, প্রবাহ, কলকাতা-৯]

এই সব ধর্মের কারোর অবলুপ্তি, কারোর অজস্র বিভাজন, কারোর নানা ভাঙ্গা গড়া উত্থান পতনের ব্যাপারগুলি এটি প্রমাণ করে যে, এগুলি চিরন্তন বা সনাতন যেমন আদৌ নয়, তেমনি তা সম্পূর্ণ মনুষ্যসৃষ্ট, মানুষেরই প্রয়োজনে তৈরী হওয়া। এই প্রয়োজনেই সময়ের সঙ্গে তাদের পরিমার্জনা ও রূপান্তরও ঘটেছে, যেমন বৈদিক ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্তর পেরিয়ে এক সময় তথাকথিত হিন্দুধর্মের রূপ পেয়েছে, যদিও, এইভাবে পরিচিত হওয়ার ব্যাপারটা নিতান্তই হাল আমলের ঘটনা-বৃটিশ শাসনকালে। মৌলবাদীদের নিয়ে মুস্কিল হচ্ছে, তারা এই সময়োপযোগী রূপান্তর ও পরিমার্জনার ব্যাপারটাকে অস্বীকার করে এবং ধর্মের প্রাচীন রাপের সুবিধাজনক দিকগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

এই মৌলবাদ ও মৌলবাদীরা ধর্মের সৃষ্টি বহু পরে জন্ম নিয়েছে, যদিও তারা দ্রুণাকারে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে বর্তমান ছিল। ধৰ্মীয় মৌলবাদের (এবং সাম্প্রদায়িকতারও) পূর্ববর্তী একটি অবস্থা ধর্মান্ধতা বা ধর্মীয় গোঁড়ামি (religious famaticism)। সমস্ত ধরনের যুক্তির পথ পরিহার করে ধর্মের অনুশাসন, রীতিনীতি ইত্যাদিকে যান্ত্রিকভাবে বিশ্বাস করা ও তাকে কাজে প্রয়োগ করা ধর্মান্ধতার প্রধানতম দিক; এর জন্য ধর্মান্ধতা বা গোঁড়ারা অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে বা ধর্ম বিশ্বাসের গণতান্ত্রিক অধিকারকে আঘাত করতে দ্বিধা করে না, এমন কি তাদের শত্রুর পর্যায়েও ফেলে দেয়।

হিন্দুরা বৌদ্ধদের উপর, মুসলিমরা হিন্দু বা বৌদ্ধদের উপর, ইহুদি-খৃস্ট মুসলিমরা পরস্পরের উপর যে অত্যাচার ও নিপীড়ন একদা চালিয়েছে তা ধর্মনিষ্ঠ বা মৌলবাদী মানসিকতা কোনটি থেকেই নয়, এই ধর্মান্ধতা থেকেই এবং কখনো কখনো তার সঙ্গে তীব্র ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদও মিশে ছিল। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন একদল খেটে খাওয়া মানুষ তারই মত মেহনতী কিন্তু ভিন্ন ধর্মের মানুষের উপর হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে খুন থেকে ধর্ষণ-নানা ধরনের অত্যাচার চালায়, তখন তার মধ্যে যুক্তি বোধহীন ধর্মান্ধতার ব্যাপারটিই বেশি থাকে,-যে ধর্মান্ধতা হিংস্র৷ সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিয়েছে।

নিছক ধর্মবিশ্বাস ধর্মান্ধতায় পরিণত হয়। মূলত তখনি যখন মনে করা হয় যে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা তার ধর্ম, তথা তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণী স্বাৰ্থ বিঘ্নিত হচ্ছে। এরই একটি বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিক্রিয়ায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সৃষ্টির সময় খৃষ্টপূর্ব প্রায় পঞ্চম শতাব্দী সময়কালে; তখন ব্রাহ্মণের বৌদ্ধ বা জৈনদের নাস্তিক নামে গালাগালি করেছে। কিংবা আরো আগে যখন বৈদিক ধর্মের বিপরীতে চার্বক বা বাৰ্হস্পত্য দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে; তখন বেদ-ব্ৰাহ্মণের রক্ষকেরা চার্বকদের পুড়িয়ে মেরেছে। (মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের রােজ্যাভিষেকের সময়কার এই পুড়িয়ে মারা: বর্ণনা হয়তো প্রতীকী ছিল, কিন্তু তার মধ্যে চাৰ্ব্বকদের বিরুদ্ধে যুক্তিহীন ধর্মািন্ধাদের হিংস্রতার পরিচয়ও ফুটে ওঠে।)

বিশেষ প্রতিষ্ঠানিক ধর্মে নিষ্ঠা ও বিশ্বাসের ব্যাপারটিতে ধর্মান্ধতা নমনীয়রূপে লুকিয়ে থাকে। তা যদি না থাকে। তবে বিশেষ একটি ধর্মে বিশ্বাসের ব্যাপারটিরই অস্তিত্ব থাকে না এবং তার বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, মূল্যবোধকে একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করারও তাগিদ থাকে না। হিন্দু হলে গরুর মাংস বা মুসলিম হলে শুয়োরের মাংস একেবারেই খাব না-এটি একটি নির্দোষ ধর্মান্ধতার হাস্যকর রূপ। আগেকার দিনের ব্রাহ্মণেরা বা মুনি-ঋষিরা বা হিন্দুদের ‘দেবদেবীরা’। যে আকছারই গরুর মাংস খেত, এমনকি কৃষ্ণ যজুর্বোেদ ব্রাহ্মণকে যে গরুর মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করারও নির্দেশ দেওয়া আছে, কিংবা নিছক অর্থনৈতিক কারণেই যে গো-সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল এবং গরুকে ‘মা’ হিসেবে (অর্থাৎ হিন্দুদের ‘বাছুর’ হিসেবে) ভাবাটা যে কোন কাজের কথা নয়-এ ধরনের সামান্য যুক্তিবোধও প্রয়োগ করা হয় না। একই ভাবে হজরত মহম্মদ যাদের মুসলিম হিসেবে ধর্মস্তিরিত করেছিলেন, তারা যে ধর্মস্তিরিত হওয়ার আগে শুয়োরের মাংসও খেত, কিংবা যথাসম্ভব স্থানীয় শত্ৰু-স্থানীয় মানুষেরা শুয়োর পুষত বলে মুসলিমরা শত্রুদের পোষ্য জীবকে ঘূণ্য হিসেবে প্রচার করেছে অথবা ‘আল্লার সৃষ্টি করা’ গরু-ছাগল খেতে পারলে শুয়োরই বা কেন খাওয়া যাবে না–এ ধরনের কোন কথাবার্তা শোনাও কানে আঙ্গুল দিয়ে বন্ধ করা হয়।

এই ধরনের যুক্তিবিবর্জিত বিশ্বাসের মানসিকতাই (যা প্ৰতিষ্ঠানিক ধর্মের অসংখ্য বাহ্যিক চরিত্রকে বিশিষ্টতা দান করে) এক সময় উগ্র আকার ধারণ ক’রে ধর্মান্ধিতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করে।’* এর জন্য নিজে শহিদ হওয়া ও অন্যদের শহিদ হতে উৎসাহ দেওয়ার কাজ অনায়াসে করা হয়। প্রতিবেশী হিন্দু বা মুসলিমকে খুন করলে, নিজের স্ত্রী বা কন্যার মত এক ভিন্নধর্মাবলম্বিনীকে ধর্ষণ করলে বা ভিন্ন ধর্মের মানুষদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে যে আদৌ নিজের ধর্মের প্রতি শ্ৰদ্ধা প্ৰকাশ করা হয় না এবং নিজেদের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক সমস্যাবলীরও সুরাহা হয় না, এ ধরনের যুক্তিবোধ ধর্মান্ধতাদের মধ্যে থাকে না।

ধর্মান্ধতারা নিজেদের অর্থনৈতিক আন্দোলনকে ধর্মের সঙ্গে গভীরভাবে মিশিয়েও দেয়। ধর্মই যে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলার ও টিকিয়ে রাখার অন্যতম একটি উপায় তা ধর্মান্ধিরা মাথাতেও আনে না। এই ভাবেই ধর্মান্ধতারা নিজ ধর্মের সমস্ত মানুষের সব ধরনের স্বার্থকে অভিন্ন বলে ভাবতে শুরু করে। এই মানসিকতা তীব্রতা পায় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের মধ্যে।

বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন পরিবেশে এই রূপান্তর ঘটে। তবে ধর্মান্ধতা বিশেষ সময়ে ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদ (religious revivalism)-এরও জন্ম দেয়। এই পুনরভ্যুত্থানবাদের সৃষ্টি হয় মূলত ঐতিহ্যশালী ধর্মীয় মূল্যবোধ যখন বিশেষ কালে নানা প্রশ্ন ও বিরোধী যুক্তির সম্মুখীন হয় এবং তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে বলে মনে করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে হিন্দু ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদীদের অভ্যুত্থান এই বাংলায় ঘটেছিল। এইভাবেই। তার আগেইয়ংবেঙ্গল থেকে বিদ্যাসাগরের মত ব্যক্তিরা সনাতন হিন্দু ধর্মের জঞ্জাল ও ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯–১৮৩১)-র মুক্তমন ও যুক্তিবাদী মানসিকতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মূলত সমাজের উপরতলার হিন্দুপরিবারের সন্তানেরা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনকে একটি শক্তিশালী রূপ দান করেন। প্রকাশ্যে গোমাংস ও মদ্যপান করা জাতীয় কাজকে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করার একটি উপায় হিসেবে ভাবা হয়েছিল। (যদিও জনসাধারণের সর্বস্তরে মতাদর্শগত ব্যাপক প্রচার না চালিয়ে ও আর্থ সামাজিক অন্যান্য দিকের সঙ্গে তাকে যুক্ত না করে, বিচ্ছিন্ন ভাবে করা এসব কাজে ব্যক্তিগত ‘হিরোইজম’-ই ছিল বেশি; সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে এমন কাজ ধর্মাচরণকে আরো নিষ্ঠার সঙ্গে আঁকড়ে ধরার প্রবণতাও সৃষ্টি করে।) অন্যদিকে রামতনু লাহিড়ি (১৮১৩–১৮৯৮) প্রকাশ্যে উপবীত ত্যাগ করেন (১৮৫১ সালে) বা রসিককৃষ্ণ মল্লিক (১৮১০-১৮৫৮) আদালতে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে গঙ্গজলের পবিত্রতা অস্বীকার করেন। ডিরোজিয়ানদের এমন কাজকর্ম সুবিদিত এবং তা সমাজে উল্লেখযোগ্য আলোড়নও যে ফেলেছিল তাতেও কোন সন্দেহ নেই। পাশাপাশি ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের (১৮২০–১৮৯১) মত ব্যক্তিত্বরা ডিরোজিয়ান না হলেও হিন্দুধর্মীয় আবিলতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্ৰ চিঠিপত্রের শিরোনামে লোকচারবশত ‘শ্ৰী শ্ৰী হরিঃ শরণম শ্ৰী শ্ৰী হরিঃ’, ইত্যাদি লিখলেও ধর্ম ও ঈশ্বর-বিশ্বাসের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না। তাই দ্বিধাহীনভাবে তিনি এটি জানিয়েছেন, ‘বেদান্ত ও সাংখ্য যে দর্শনের দুটি ভ্ৰান্ত ধারা এ ব্যাপারে আর তর্কের অবকাশ নাই। এগুলি মিথ্যা হলেও হিন্দুদের কাছে অপরিসীম শ্রদ্ধা পায়।’ (‘That the Vedanta and Sankhya are false systems of philosophy is no more a matter of dispute. These systems, false as they are, command unbound reverence from the Hindus.’–কাউন্সিল অব এডুকেশনের সেক্রেটারি এফ আই মুয়াট-কে লেখা চিঠি, ৭ই সেপ্টেম্বর ১৮৫৩)। অন্যদিকে সাংগঠনিকভাবেও হিন্দুধর্মের উপর আঘাত আসে ব্রাহ্মধর্ম সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। (ব্রাহ্ম সমাজ বা ব্রাহ্মসভার প্রথম অধিবেশন হয় ১৮২৮-এর ২০শে অগাস্ট।)

এগুলি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তখনকার বাঙলার শিক্ষিত সমাজে মুক্তমন ও সংস্কারের যে পরিমণ্ডল তৈরী হয়েছিল তার বহিঃপ্রকাশ এসব। নতুন ইয়োরোপীয় জ্ঞান ও আধুনিক মননের সঙ্গে পরিচয় এই মুক্তমন গড়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছিল। কিন্তু হিন্দুধর্মের চিরাচরিত। ঐতিহ্যের প্রতি এ ধরনের আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় এবং ব্রাহ্মধর্ম ছাড়া খৃষ্টধর্মের দ্বারাও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে, ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদী মানসিকতাও সৃষ্টি হয়। এই চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল, অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা রূপ পায় শশধর তর্কচূড়ামণি (১৮৫১-১৯২৮)-র মত মানুষদের মধ্যে। একদিকে ইনি যেমন সহবাস-সম্মতি আইন’ প্রণয়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেন, তেমনি হাঁচি-টিকটিকির বাধানিষেধ জাতীয় হাস্যকর কুসংস্কারগুলিরও ‘বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা’ দিয়ে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। অন্যদিকে গদাধর চট্টোপাধ্যায় তথা শ্ৰীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬–১৮৮৬) ও তার ভাবশিষ্য নরেন্দ্রনাথ দত্ত তথা স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩–১৯০২)-এর মত বর্তমানে অতি প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা ও সংস্কারকরাও হিন্দুধর্মের ঐ টালমাটাল অবস্থায় নব্যহিন্দুত্বের (NeoHinduism) এক উদার চিস্তার প্রচার করেন। ঈশ্বরচন্দ্ৰ যাকে ভ্ৰান্তদর্শন বলেছিলেন সেই বেদান্ত আর ভক্তিবাদ তাদের এধরনের প্রচারে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। পুনরভ্যুত্থানবাদীদের সমস্ত বৈশিষ্ট্য তাঁদের মধ্যে না থাকলেও ‘অভ্যুত্থানমধৰ্মস্য’–এর প্রতিক্রিয়ায় তাদেরও সৃষ্টি।

এই তথাকথিত অধর্মের অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮– ১৮৯৪)-এর মত পণ্ডিত সাহিত্যসম্রাটের লেখাতেও প্রতিফলিত হয়। তিনি শুধু হিন্দুত্ব ও কৃষ্ণতত্ত্বের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষাস্ত হননি, আনন্দমঠ’-এর মত উপন্যাসের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদী মানসিকতারও প্রচার করেন, যা ঐ পরিবেশে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদের কাছাকাছিই বা সমার্থক ছিল। এমন কি আনন্দমঠের প্রথম দিকের সংস্করণে বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা থাকলেও, পরে বৃটিশ তোষণের জন্য, তথা নিজের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও শ্রেণীস্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে, এসব কথা পাল্টে তার পরিবর্তে ‘নেড়ে।’ তথা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘূণার বীজ বপন করেন। দু’তিন হাজার বছর আগে বহিরাগত তথাকথিত আর্যরা যেমন ভারতের আদিবাসিন্দাদের সঙ্গে লড়াই করে পরে একাত্ম হয়েছিল, তেমনি কয়েকশত বছর আগে মুসলিমরাও ভারতে পদার্পণ করে একসময় এদেশেরই লোক হয়ে গেছে। আর বর্তমানের মুসলিম জনসংখ্যার বৃহদংশ এ দেশেরই ধর্মান্তরিত মানুষ। তবু এই ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করে, এখনকার হিন্দু মৌলবাদীদের মত, বঙ্কিমচন্দ্রও ‘মুসলিমদের বিদেশী হিসাবে দেখিয়েছিলেন, এবং জাতীয়তাবাদ বা ভারতীয়ত্ব বা দেশজ-সবকিছুর হিন্দুত্বের সঙ্গে অভিন্ন রূপ কল্পনা করেছিলেন।’ (আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতা, বিপান চন্দ্র)। এইভাবেই ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদীরা-ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ও মৌলবাদের সূত্রপাত ঘটায়, যে সাম্প্রদায়িকতা আমাদের দেশে আগে এভাবে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত ছিল না।

জাতীয়তা ও স্বদেশ প্রেমের নামে এমন হিন্দু ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা একাকার হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি শুধু বঙ্গদেশে নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতীয় ভূখণ্ডেই মাথা চাড়া দিতে শুরু করে। বাল গঙ্গাধর তিলকের মত কিছু অসাধারণ দক্ষ, এমনকি দেশপ্রেমিকের হাতে তার সূচনা। তবে তিলকের দৃষ্টিভঙ্গীতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলি অবশ্যই প্রাধান্য পেত, কিন্তু এটিও সত্য যে, ‘তিলক তঁর হিন্দু ধর্মীয় ভাবসম্পন্ন গণেশ পূজা এবং শিবাজী উৎসব প্রচারের মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে হিন্দুত্বের সংশ্লেষ বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন’ এবং অন্যদিকে ‘অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্ৰ পাল এবং লালা লাজপত রাই প্রমুখ চরমপন্থী নেতারা তাদের রাজনৈতিক বক্তৃতা ও রচনায় হিন্দুপ্রতীক, বাকরীতি ও পুরাণকে ব্যবহার করতেন। ভারতকে অনেক সময়ে মাতৃদেবী বলে উল্লেখ করা হত, বা কালী, দুর্গ ও অন্যান্য হিন্দু দেব-দেবীদের সঙ্গে তুলনা করা হত।’ (ঐ) এটি অবশ্যই ঠিক যে, এই সব নেতৃবৃন্দ বা তাদের কাজকর্মকে সরাসরি ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদী বা সাম্প্রদায়িক বলা যায় না। কিন্তু তারা, হয়তো বা অসচেতনভাবেই এবং মুসলিমদের প্রতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পোষণ না করেই, এই ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থান ও সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে গেছেন। এখনো আমাদের দেশে এই সব নেতৃবৃন্দকেই পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রচার করা ও মহীয়ান করা হয়। তাদের অবদানের প্রাপ্য মর্যাদা অবশ্যই দেওয়া উচিত, কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্তরে তাদের অন্যদিকগুলিকে অস্বীকার করে বিশুদ্ধ ভক্তি ও সন্দেহাতীত মহত্ব প্রচারের মানসিকতা থেকে বর্তমান রাষ্ট্রীয় চরিত্রটিকে আঁচ করা যায়।

ঘটনাচক্ৰে অথবা হয়তো কোন বিশেষ ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে (যে ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদ(২) থেকে মার্ক্সবাদের মত নানা বৈজ্ঞানিক চিন্তার উদ্ভব হয়তো ভূমিকা পালন করেছে), বাংলায় তথা ভারতে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এই ধর্মীয় পুনরভু্যত্থানবাদীদের উদ্ভবের সময়ে আমেরিকাতেও সৃষ্টি হচ্ছিল ফান্ডামেন্টালিজম-এর ভিত্তি। এর আগেই বলা হয়েছে। ইয়োরোপে সংগঠিতভাবে ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদ (Revivaism) সৃষ্টি হয়েছিল আরো আগে,-অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। এর একটি কারণ নিশ্চয়ই এই যে, মুক্ত চিন্তা, ধর্মীয় কুসংস্কারগুলির উপর আঘাত করা এবং ধর্মের ভিত্তিটিকেই নাড়া দেওয়ার কাজটি ইংল্যাণ্ডে তথা ইয়োরোপে শুরু হয়েছিল ভারতের থেকে অনেক আগে। প্ৰতিদেশে সব সময়েই এই স্রোতবিরোধী ধারা লোকচরিত্রের একটি অংশ। কিন্তু কখনো কখনো তা বিশেষ মাত্রা পায়। ইংল্যাণ্ডে সপ্তদশ শতাব্দীতে তো বটেই এমন কি পঞ্চদশ শতাব্দীতেও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কাজকর্মের উদাহরণ কম নেই। ১৪৯১-তেই এক ছুতোর দীক্ষাস্নান, স্বীকারোক্তি ইত্যাদি প্রথাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তখন বিশেষত যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিশেষভাবে দানা বাঁধে। লোলার্ড গোষ্ঠীর একজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘ধর্মযাজকেরা জুডাস-এর থেকেও খারাপ। জুডাস তিরিশ পেন্সের জন্য যিশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল। যাজকেরা তো আধাপেনির বিনিময়ে মানুষকে দলে দলে বিকিয়ে দিচ্ছে।’ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানবিরোধী এ ধরনের অজস্র আন্দোলন ও মতামত ক্রমশঃ বিকশিত হয়েছে এবং সপ্তদশ শতাব্দীর আসন্ন পুঁজিবাদী বিপ্লবের রাস্তা মসৃণ করেছে। একদিকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেমন পুরনোকে ছেড়ে নতুন পথ খোঁজার চিন্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (আর তার নেতৃত্ব মূলত দিয়েছে ইংল্যাণ্ডের নীচুতলার পছিয়ে থাকা নিপীড়িত মানুষরাই), তেমনি অন্যদিকে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও নিত্যনতুন আবিষ্কার ও সত্যের সন্ধান শুরু হয়েছে, যার একটি ফলশ্রুতি প্রগতিশীল পুঁজিবাদের উদ্ভব তথা শিল্প বিপ্লব। ধর্মীয় ক্ষেত্রে ডিগার, র্যান্টার, ফ্যামিলি পন্থা, লেভেলার, কোয়েকার ইত্যাদির মত প্রতিবাদী গোষ্ঠীগুলির নেতৃত্ব মূলত এসেছিল জনসাধারণের দরিদ্র পিছিয়ে পড়া অংশ থেকেই।

ধর্মের অস্তিত্বের সংকটের সময়ে (অন্তত যখন এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে ভাবা হয়), তখন সম্ভবামি যুগে যুগে’-র এই ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদ থেকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। পুনরভ্যুত্থানবাদের মধ্যে ধর্মের বিপন্ন অস্তিত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আকাঙক্ষাই প্রধানতম। বিশুদ্ধ ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদীরা লড়াই করে তাদের বিরুদ্ধে বা সেই চিন্তা ও শক্তির বিরুদ্ধে যারা বা যা তাদের ধর্মকে হতমান করে অথবা যখন সামগ্রিক ভাবে ‘ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি’। এক্ষেত্রে বিশেষ ভিন্ন ধর্ম এই ভূমিকা পালন করলে তার বিরুদ্ধেও লড়াই চলে, অন্যথায় সাধারণভাবে এর মধ্যে বিশেষ সম্প্রদায়কে হেয় করা বা আপন সম্প্রদায় থেকে পৃথক করার মানসিকতা বিশেষ গুরুত্ব পায় না। পুনরভ্যুত্থানবাদীদের মধ্যে ধর্মের শ্রেণীগত স্বাৰ্থ সংশ্লিষ্ট থাকলেও, ধর্মপ্রতিষ্ঠার আপাত সদিচ্ছার তুলনায় তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কিন্তু ধর্মীয় পুনরভুত্থানবাদের তীব্রতা প্রায়শই তার এই নিছক ধর্মমাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার আকাঙক্ষাকে ছাড়িয়ে সম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, অন্তত তাদের জন্মদাতার ভূমিকা পালন করে। ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার যুক্তিহীন আবেগ প্রায়শঃই পুনরভ্যুত্থানবাদীদের নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার, আপন ধর্মের মূল নিষ্কলুষ অবস্থাকে দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করার ও বিরুদ্ধবাদী চিন্তাকে হিংস্রভাবে মোকাবিলা করার দিকে ঠেলে দেয়, অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী করে তোলে। ইয়োরোপে প্রোটেস্টাণ্টদের মধ্যে অষ্টাদশ শতকে উদ্ভূত রিভাইভ্যালিজম উত্তর আমেরিকায় প্রসারিত হওয়ার পর, ঊনবিংশ শতকে ফান্ডামেন্টালিজ সৃষ্টির পথকে সুগম করেছে; অবশ্যই এক্ষেত্রে বিবর্তনবাদ ও মার্কসবাদ জাতীয় বৈপ্লবিক চিন্তা ইন্ধন জুগিয়েছে এবং ক্রমশঃ পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থায় নতুনতর মাত্রার শ্রেণীদ্বন্দ্ব অনুঘটকের কাজ করেছে।

একসময় ভারতীয় ভূখণ্ডেও হিন্দু ও মুসলিম এই দুই প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের অবস্থায় কাটিয়েছে। উভয়ের নানাবিধ ধর্মীয় উৎসব, ধর্মীয় সংস্কার ও অন্যান্য চিন্তাভাবনাকে উভয়েই গ্ৰহণ করেছে। মহররমের তাজিয়া ও মহরম হিন্দুদের কাছেও কম আনন্দদায়ক ছিল না। এমন কি অনেক স্থানে অনেক হিন্দু মেয়েদের মধ্যে এমন বিশ্বাসও ছিল যে, তাজিয়ার নীচ দিয়ে হাঁটলে তারা সন্তানের মা হবে। পীরবাবার কাছে মানত শুধু মুসলিমরা নয়, জন্মসূত্রে যারা হিন্দু তারাও করত। দুর্গাপূজা বা কালীপূজার মত হিন্দু ধর্মীয় উৎসবে ও মেলায় মুসলিমরা,-পূজা না দিক, পৌত্তলিকদের অনুষ্ঠান বলে না। সরে গিয়ে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করত। অশ্বখগাছের তলায় ঠাকুরের থানে মানত করে বা ঢ়িল বেঁধে নিঃসন্তান মুসলিম রমণীরাও তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণের চেষ্টা করত। হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐক্যের এই অতি স্বাভাবিক সামাজিক ধারা এখনো নেই তা নয়’(৩), কিন্তু উভয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভেদের মানসিকতা যে ব্যাপকতা লাভ করেছে। ঐ ব্যাপকতা আগে (অন্তত ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের পূর্বে) মোটেই ছিল না। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা মুসলিমদের অস্পৃশ্য ভেবেছে কিংবা মৌলানা-মৌলবীর মত উচ্চস্তরের মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের কেউ কেউ হয়তো কঠোরভাবে পৌত্তলিক ধর্মানুষ্ঠান পরিহার করেছে, কিন্তু সাধারণভাবে সমাজে উভয়ের মধ্যে ঘূণা-হিংসা-বৈরিতা ছিল না এবং তাই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত ঘটনায় নীচুতলার হিন্দু-মুসলিম প্রতিবেশীদের অন্তত বৃহদাংশের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে হত্যা থেকে ধর্ষণের মত ক্রিয়াকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার মানসিকতাই অনুপস্থিত ছিল। ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিম সর্বত্রই এই চিত্র কমবেশি ছিল। তাই পাঞ্জাবের ১৮৮১-এর আদমসুমারীর উপর ডেনজিল ইবেটসন-এর গবেষণামূলক রচনায় এমন মন্তব্য দেখা যায়, ‘বাস্তব ক্ষেত্রে পাঞ্জাবের পূর্বাঞ্চলে ধর্মান্তর ধর্মািন্তরিতের জাতের উপর কোন প্রভাব ফেলে না। মুসলমান, রাজপুত, গুজার, বা জাট সমস্ত সামাজিক, উপজাতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে তার হিন্দু ভাইদের মতই একজন রাজপুত, গুজার বা জাট। তার সামাজিক প্রথা অপরিবর্তিত, তার উপজাতিক বাধনিষেধের শৃঙ্খল শিথিল হয় নি, তার বৈবাহিক ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নিয়ম অপরিবর্তিত;… … …’ ইত্যাদি।

মূলত ইংরেজদের দ্বারা চিহ্নিত ঐ তথাকথিত ইসলামী আমল থেকেই এই ধর্মপরিচয়কে পাত্তঃ-না-দেওয়া সামাজিক বন্ধুত্ব মোটামুটি ছিলই। কিন্তু ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের নামে হিন্দুত্বের পুনরভ্যুত্থানবাদী ক্রিয়াকাণ্ড সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে অভিন্ন হতে থাকে। বৃটিশরা নিজ স্বার্থে এই ধর্মীয় বিভাজন ও বিদ্বেষের বীজ বপন করতে থাকে,-এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার হলেও কোন সহায়ক ভিত্তি না থাকলে ইংরেজদের পক্ষেও এই সাম্প্রদায়িকতার চাপা থাকা আগুনে হাওয়া দেওয়া সম্ভব হত না। বিপানচন্দ্র। যেমন মন্তব্য করেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী উলামাও মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয়, এমনকি সাম্প্রদায়িক পরিচিতি বাড়াতে ও সাম্প্রদায়িকতাবাদের প্রসারে প্রচণ্ডভাবে সাহায্য করেছিলেন’ এবং ‘অনুরূপভাবে, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী দয়ানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ ও বিপিনচন্দ্র পাল এবং অন্যান্যরা ধর্মভাবকে উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং এইভাবে পরোক্ষে হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিচিতি বোধকে উৎসাহিত করেছেন।’

ভারতের মাটিতে ঐ উলামা-দিয়ানন্দদের দল যদি না থাকত। তবে ইংরেজদের সাধ্য ছিল না। সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার। এরা আপন ধর্মের অভ্যুত্থান ঘটানোর বা মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার নামে সাম্প্রদায়িকতার ও পরবর্তীকালে মৌলবাদের পিতৃত্বের (হয়তো বা অজানিত ভাবে) ‘গৌরব অর্জন করেছে। সমাজের বিশেষ কিছু অর্থনৈতিক অবস্থানের মানুষেরা (যেমন বিপন্ন অস্তিত্বের জমিদার গোষ্ঠী, নতুন গজিয়ে ওঠা গ্ৰাম্য জোতদার শ্রেণী, মহাজন, ব্যবসায়ী ইত্যাদিরা) নিজেদের সংকীর্ণ শ্রেণী:স্বাৰ্থ বজায় রাখতে তথা সম্পদ-প্রতিপত্তি বাড়াতে রাজনীতির মধ্যে ধর্মের অনুপ্রবেশকে উৎসাহিত ও ব্যবহার করছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবীদের বৃহদংশ এদের মধ্য থেকেই উঠে এসেছিল; এরাই শিক্ষাদীক্ষা, রাজনৈতিক মতাদর্শ গঠন, সংবাদপত্র প্রকাশনার মাধ্যমে জনমত গঠন, ইত্যাদির নেতৃত্ব দিত এবং এরাই হাতের কাছে ধর্মকে পেয়ে তাকেই বা অন্য কিছু না পেয়ে ধর্মকেই ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এরা স্বাভাবিকভাবেই বুঝেছিল যে, সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ভাঙ্গিয়ে নিজের নেতৃত্ব ও শ্রেণীস্বার্থ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কারণ, ধর্ম যে যুক্তিবোধহীন আনুগত্য, অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস তথা সমাজ সম্পর্কে শ্রেণীসচেতনতা-মুক্ত ধারণাবলীর শিক্ষা দেয়, ঐ সব শিক্ষা সমাজের উপরতলার ব্যক্তিদের স্বাৰ্থপুষ্ট করার ক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ।

এইভাবে ধর্মকে ধনী-দরিদ্রদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্তর থেকে নামিয়ে তারা রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা শুরু করে। তারা এমন মানসিকতাকে সুকৌশলে প্রতিষ্ঠা করতে থাকে যে, মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রধানতম দিক হচ্ছে ধর্মপরিচয়, তাই নিজ অস্তিত্বের স্বার্থে ধৰ্মরক্ষা প্রয়োজন এবং আপনি ধর্মের সবাই সুহৃদ, তাদের সবার স্বাৰ্থ এক। অর্থাৎ বিশুদ্ধ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি শুরু হয়। স্বদেশের ও নিজ ধর্মের শাসকশ্রেণীর উপর সামান্য আঘাত না করে শুধু বৃটিশদের হটিয়ে দেশের দরিদ্র জনসাধারণের লাভ যে আসলে বিশেষ কিছুই হবে না—এ বোধকে জগতে না দিয়ে, এই সামন্ত ও উঠতি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা দেশবাসীর মনে এই বোধকেই প্রতিষ্ঠিত করল যে, বিদেশী ও স্বদেশী উভয় শাসককে নয়, শুধু বৃটিশদের হঠানোই একমাত্র কাজ তথা স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদ। এই শ্রেণী নিতে চেয়েছিল বিদেশী শাসক হটিয়ে স্বদেশী শাসকের ভূমিকা এবং তথাকথিত স্বাধীনতা আন্দোলনের পর তাই-ই হয়েছে। এই লক্ষ অর্জনের ক্ষেত্রে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করতে তারা বিশেষ ধর্মকেই সুবিধাজনক মাধ্যম হিসেবে অনুভব করেছে ও গ্রহণ করেছে। তাই বঙ্কিমের ‘বন্দেমাতরম’ হিন্দু-গন্ধে ভরা, গান্ধীর স্বাধীনতা আন্দোলন হিন্দুরসে জারিত (শত ঐক্যের কথা বলেও) এবং পাকিস্তানকামীদের কাছে তো ইসলাম ধর্মই ছিল একমাত্র ভিত্তি। এইভাবে এরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে খুচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছে এবং আগুন নিয়ে খেলা করেছে। এখন এ খেলার রিং-মাস্টার হিন্দু-মুসলিম মৌলবাদীরা।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ইংরেজরা ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয়দের বিভাজন ক’রে, তাদের ঐক্য বিনষ্ট করে, শাসন করার কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। ম্যালকম (১৮১৩) থেকে এর শুরু। ১৮৫৮-তে লর্ড এলফিনস্টোন বলেছিলেন। ‘ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল ছিল প্রাচীন রোমান নীতি এবং আমাদের তা গ্ৰহণ করা উচিত’। ১৮৬২-তে ভারতের রাষ্ট্রসচিব চার্লস উড ভাইসরয়কে জানিয়েছিলেন, ভারতের ‘জাতিগুলির’ অন্তৰ্দ্ধন্দ্বই ভারতে ইংরেজদের শক্তি যোগাবে এবং তাই ‘এই বিভেদকারী শক্তিকে জিইয়ে রাখতে হবে, কারণ সমগ্ৰ ভারত আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলে আর কতদিন আমরা টিকে থাকতে পারব?’ ১৮৮৭-তে রাষ্ট্রসচিব ক্রস ভাইসরয়কে লিখেছিলেন, ‘এই ধর্মীয় মনোভাবের বিভাগ আমাদের পক্ষে খুবই সুবিধাজনক’। ১৯২৫-এ রাষ্ট্রসচিব বার্কেনহেড ভাইসরয়কে লিখেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি চিরস্থায়ী হোক, সবসময় সর্বান্তকরণে আমি এই আশা রাখছি।’ চাৰ্চিলও এই নীতি অনুসরণ করে গেছেন এবং ভারতের বৃটিশ প্রশাসন মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের উল্টো পাল্লার ওজন হিসাবে’ চিরকাল ব্যবহার করে গেছে। হিন্দু ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী উভয় সম্প্রদায়ের জাতীয়তাবাদী ‘মহান’ নেতারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই বিলিতি নীতিকে উৎসাহিত করেছেন, — অবশ্যই নিজ স্বার্থে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৃটিশদের আবিষ্কার করা এই ধর্মীয় বিভাজনের পদ্ধতি শক্তিশালী ও উৎসাহিত হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ধমীর্ণয় পুনরভ্যুত্থানবাদীদের দ্বারা। হিন্দু ‘জাতীয়তাবাদী’ ও মুসলিম ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ অনেকাংশে এই শক্তি ও উৎসাহের ফসল।

ধর্মনিরপেক্ষ, শ্রেণী সচেতন, জনগণের নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন নয়,-ধৰ্ম-সম্পূক্ত, শ্রেণী-নিরাসক্ত, স্বদেশীয় অভিজাতদের (ভবিষ্যতের শাসকবৃন্দের!!) নেতৃত্বাধীন তথাকথিত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, কোন না কোনভাবে সরাসরি বৃটিশ আধিপত্য হয়তো কমিয়েছে, কিন্তু তা একই সঙ্গে দেশবাসীকে দীর্ঘস্থায়ী বৃহত্তর দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে—এই দাসত্ব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাসী মানসিকতার দাসত্ব, যা ক্রমশ মৌলবাদী দৈত্যের জন্ম দিয়েছে। (একই সঙ্গে স্বদেশী সামন্ত পুঁজিপতি ও শাসকশ্রেণীর দাসত্বও।)

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আর্যসমাজ, হিন্দু মহাসভা জাতীয় নানা হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে ওঠে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদী ঐতিহ্য-সচেতনতা—এসবের সাংগঠনিক বহিঃপ্রকাশ ছিল এই ধরনের সংস্থার সৃষ্টি। আর্যসমাজ শুরুতে পুরোহিতদের দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করলেও পরে গোহত্যা বন্ধ করা ও উর্দুর পরিবর্তে দেবনাগরী লিপির হিন্দিভাষা প্রচলন করার মত আন্দোলনের দ্বারা এই সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করায় যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল। মদনমোহন মালব্য বা লালা লাজপত রাই-এর মত কংগ্রেসী নেতারা হিন্দু মহাসভাতেও সক্রিয় ছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে ১৯৩০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ে কংগ্রেস এবং হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির কর্মীরা প্রায় একই ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীকালে গোলওয়ালকার বা সাভারকর-এর মত হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা তথা মূলগতভাবে মৌলবাদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ও ‘তাদের চর গান্ধীর’ বিরুদ্ধে হিন্দুদের সতর্ক করতে থাকেন। কংগ্রেসী নেতৃত্বের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব জওহরলাল নেহরু ১৯৫৮-এর ১১মে কংগ্রেস অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় মন্তব্য করেছিলেন,-’সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা খুব সহজেই ‘জাতীয়’ বলে চালানো যায় এবং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে আখ্যা দিতেও দেরী হয় না।’ প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসের শুরুর দিকে এই ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাকেই জাতীয়তাবাদ বলে ভাবা হয়েছে এবং পরবর্তী কালে আর এস এস-বিশ্বহিন্দু পরিষদ-জনসংঘ বা বিজেপি-র মত সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী হিন্দু সংগঠনগুলি এই মানসিকতাকেই প্রধান ও তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরেছে। কংগ্রেস যখন হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা সম্পূক্ত জাতীয়তাবাদকে ধীরে ধীরে পরিত্যাগ বা পরিমার্জিত করেছে, তখন ঐ শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে এই সব হিন্দুত্ববাদীরা।

অন্যদিকে মুসলিমদের একাংশ এক সময় যেমন কংগ্রেসের আপাত সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করে প্রচার করেছে এবং সাধারণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করেছে, তেমনি পরবর্তীকালে হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের আরো সংগঠিত ও জঙ্গী করে তুলেছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের সৃষ্টি করেছে। মুসলিমদের মধ্যকার এই প্রতিক্রিয়া অনেকটা স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হলেও, তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত করার ও প্রচার করার কাজটিও হিন্দুত্ববাদীরা সুকৌশলে তীব্রতর করেছে। মুসলিমদের অভারতীয়, ভারতীয়তত্ত্বের শিকড় বহির্ভূত, বহিরাগত ইত্যাদি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসবের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা দেখে তখনকার উগ্ৰ সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে ফ্যাসিবাদের মিল অনেকে(৪) অনুভব করেন। অনেকে এও লক্ষ্য করেন যে ১৯৩৭-এর পর সাম্প্রদায়িকতা নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করছিল, যা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ধর্মীয় মৌলবাদে রূপান্তরের সময় বলে চিহ্নিত করা যায়।

কিন্তু, এই রূপান্তরের পেছনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছাড়া আরো বহুজনের অতীত ও সাম্প্রতিক ক্রিয়াকাণ্ডও যে ভূমিকা পালন করেছে এবং মৌলবাদী শক্তিকে রসদ জোগানের কাজে অংশগ্রহণ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দক্ষিণপন্থীদের মধ্যকার তো বটেই, এমন কি বামপন্থী নামে চিহ্নিত কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা বুদ্ধিজীবীরা যখন নিজেদের ও সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে রাজনৈতিক ও অন্যান্য স্বাধসিদ্ধির জন্য কাজে লাগাতে থাকে, তখন ধর্মের এই ক্রমরূপান্তর রোধ করা মুস্কিল। এর অর্থ অবশ্যই এ নয় যে, মহাত্মা গান্ধী সহ সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসকে এবং বামপন্থীদের সাম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী বলা হচ্ছে। এরা সচেতনভাবে ধর্মকে সাম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন, তা হয়তো ততটা নয়, যতটা নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে নিজ ধর্মবিশ্বাস (যেমন মূলত হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস), ধর্মীয় পরিচয়, ঈশ্বর বিশ্বাস, বিশেষ ধর্মগ্রন্থের কথাবার্তা ইত্যাদির প্রতিফলনকে সচেতনভাবে পরিহার করার ব্যাপারে অক্ষম হয়েছিলেন। এই অক্ষমতা মৌলবাদ প্রতিরোধে তাদের অক্ষমতারই অংশ।

এবং এইভাবে ধর্মবিশ্বাসের সাম্প্রদায়িক রূপান্তরও ঘটে। ধর্মীয় মৌলবাদী হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত সাম্প্রদায়িক হওয়া। সব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা মৌলবাদী নয়, কিন্তু সব ধর্মীয় মৌলবাদীরা অবশ্যই সাম্প্রদায়িক। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, বারংবার বলা দরকার, এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গী, যেটিতে প্রাথমিকভাবে মানুষকে মানুষ হিসাবে গণ্য না করে বিশেষ এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবেই গণ্য করা হয়। অর্থাৎ মানুষের এই কৃত্রিম ধর্মীয় পরিচয়ই তাদের কাছে প্রধান পরিচয়। উপরন্তু এটি আসলে আপনি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ও ধর্মকে অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করে(৫) আর ভিন্ন ধৰ্মসম্প্রদায়ের সবাইকেই শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, এবং অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে শ্রেণী:নিবিশেষে আপন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সবার স্বার্থকে অভিন্ন বলে বিশ্বাস করতে শেখায়। মৌলবাদ এসব তো করেই, উপরন্তু সে নিজ ধর্মের বিশুদ্ধ মূল রূপকে (যা অবশ্য বিতর্কিত) পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপরেও জোর দেয়। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের কাছে এই ধর্মীয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু এ দুটি এবং ধর্মীয় পুনরভ্যুত্থানবাদও, ‘নুনচিনির সরবতের মত পরস্পরের সঙ্গে মিশে থাকে, শুধু কখনো নুন বা চিনির মাত্রার হেরফের ঘটে মাত্র। এরা সবাই এটিও প্রচার করার চেষ্টা করে যে, নিজ ধর্মের নির্দেশিত পথেই জনসাধারণের সব সমস্যার সমাধান হবে। যেহেতু এই প্রচার সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক, তাই বিপজ্জনকও বটে। এবং প্রকৃতপক্ষে এর মধ্য দিয়ে নিজ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী:ই, জনসাধারণ নয়,–তারা শুধু প্ৰতারিত হয় এবং তাদের ধর্মবিশ্বাস এদের হাতে ধৰ্ষিত হয় মাত্র।

সাম্প্রদায়িকতা শুধু ধর্মীয় নয়,-ভাষাগত, জাতিগত, প্রাদেশিক, এমন কি অঞ্চলগত বা গোষ্ঠীগতও হতে পারে। (মৌলবাদ এখনো এত বৈচিত্ৰ্য পায় নি।) এখানেও সাম্প্রদায়িকতার মূল দৃষ্টিভঙ্গী অক্ষুন্ন থাকে। অর্থাৎ এই ধরনের সাম্প্রদায়িকতাও শ্রেণী:স্বার্থের বিভিন্নতা উপেক্ষা করে ও মানুষকে এটি বোঝানোর চেষ্টা করে যে, ভিন্ন ভাষার, জাতির বা প্রদেশের সব মানুষই তার শত্রু (ভাষা আন্দোলনের মত আন্দোলন থেকে ভাষাগত সাম্প্রদায়িকতাবাদের এ একটি বড় তফাৎ), একই ভাষার বা জাতির বা প্রদেশের সবার স্বার্থ এক ইত্যাদি। আমরা বাঙালী’-র মত এমন সংগঠিত সাম্প্রদায়িকতা বা অহমীয়া-উড়িয়া ইত্যাদিদের মধ্যেকার আঞ্চলিক সাম্প্রদায়িকতা দু এক দশক আগেও অনুপস্থিত ছিল। মৌলবাদের পাশাপাশি, এদের সৃষ্টির পেছনেও, সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাবের সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান সংকট ও বিপন্নতাবোধ এবং ক্ষমতালিঙ্গু বিশেষ গোষ্ঠীর উসকানি প্রধান ভূমিকা পালন করে। বাঙালীদের স্বার্থ বুঝি মারোয়াড়িরাই (বা এ জাতীয় অন্যরা) বিপন্ন করে তুলেছে, এমন ধরনের প্রচার করা হয়। (যেমন করা হয়, ‘হিন্দু বা মুসলিমরা মুসলিম বা হিন্দুদের নানাবিধ সংকটের প্রধান কারণ—’ মুসলিম বা হিন্দু সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদীদের এমন কথাবাতাঁর মধ্য দিয়ে।) আসামে বা উড়িষ্যায়। ‘বাঙালী খেদাও’ কিংবা ইংল্যাণ্ডজার্মানিতে ‘এশিয়ান হটাও’ জাতীয় দেশি-বিদেশী অজস্র উগ্ৰ সাম্প্রদায়িকতাবাদী ফ্যাসিস্ট কায়দার আন্দোলনেও একই কাজ করা হয়। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের মত সর্বত্রই এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতা এটি ভুলে যায় ও অন্যদের ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে যে, বেকারত্ব থেকে শুরু করে নানা অর্থনৈতিক সংকটের কারণ কয়েকজন জন্মসূত্রে বাঙালী, মারোয়াড়ী, এশিয়ান বা কৃষ্ণাঙ্গ ইত্যাদিরা নয়; তার প্রধান কারণ লুকিয়ে আছে নিজেদের অক্ষমতা ও অযোগ্যতার পাশাপাশি, প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই, যে ব্যবস্থা বৈষম্যভিত্তিক ও শোষণজীবী।

প্রকৃতপক্ষে এইভাবে সাম্প্রদায়িকতার ও মৌলবাদের সৃষ্টির মধ্যে এক সংকটের অনুভবের সঙ্গে হতাশাও মিশে থাকে। যে শাসকশ্রেণী ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এই সংকট ও হতাশার মূলে তারা তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে এই ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে (ও ধর্মীয় মৌলবাদকেও)। মদত দিতে থাকে। কারণ তারা স্পষ্টই অনুভব করে, এবং উল্লসিত ও নিশ্চিন্ত হয় এটি জেনে যে, এই ধরনের আন্দোলনে জনসাধারণ তার মূল শক্রকে চেনার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তাদের সমস্ত উদ্যম ও উৎসাহ ভিন্নপথে চালিত হয়ে যায়, ফলত প্রকৃত শত্রু যে শ্রেণী ও গোষ্ঠী তাদের উৎখাত করায় জনসাধারণ কখনোই সফল হবে না।

আমেরিকার ফান্ডামেন্টালিস্টরা যখন (পরবর্তীকালের ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মত)। কম্যুনিজম-কে প্রধান শত্রু হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করে, তখন তার মধ্যে এদিকটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। পরবর্তিত পরিস্থিতির অর্থনৈতিক সংকটে ভীত-সন্ত্রস্ত পুঁজিপতিরা তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে কম্যুনিজম রুখতে ফান্ডামেন্টালিজমকে উৎসাহিত করে। এখনো প্রধানতম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকায় এর (এবং তার আরো পরিমার্জিত রূপের) অস্তিত্ব এই সুগভীর স্বাৰ্থবোধকে পরিস্ফুট করে। এর ফলে আমেরিকার জনগণের সংকট কমে তো নি, বরং ক্রমবর্ধমান। যে সময়ে আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলির বহির্বিশ্বে ব্যবসা দ্বিগুণ হয়েছে, ঐ সময় আমেরিকার শ্রমিকদের গড় সাপ্তাহিক আয় কমেছে শতকরা ১৮ ভাগ, দরিদ্র আমেরিকানদের সংখ্যা বিগত ২০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যায় পৌঁছেছে এবং ৪০ বছর আগে আমেরিকানদের আয়ের যে বৈষম্য ছিল তা আরো বেড়েছে। বেকারি, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ইত্যাদিও ক্রমবর্ধমান। (নিউ ইয়র্কের কাউন্সিল অব ইন্টারন্যাশন্যাল অ্যাফেয়ার্সের সভাপতি ওয়ার্ড মোরেহাউসের প্রবন্ধ, ফ্রন্টলাইন, ২১.৫-৯৩)

আমেরিকার মানুষ মানেই পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদী বা এই মানসিকতার,—তা আদৌ নয় এবং এ ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ থাকার কারণ নেই। কিন্তু যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় তারা রয়েছেন, সেটির চরিত্র এই এবং আমেরিকার জনগণের বৃহদংশই তার দ্বারা তথা তার প্রতিভূ মুষ্টিমেয়ের দ্বারা শাসিত ও শোষিত। আর ব্যাপারটি এত সূক্ষ্মভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, মুষ্টিমেয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমেরিকার জনগণের বৃহদংশই এ ব্যাপারে সচেতন নয়। তাই তাঁরা ধর্মেও আছেন, জিরাফেও (অর্থাৎ বিজ্ঞানপ্ৰযুক্তির ক্ষেত্রেও) আছেন। এরই একটি প্রতিফলন ঘটে, আমেরিকার ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মপরিচয় থেকে মুক্ত ব্যক্তির স্বল্পতা থেকে, যে স্বল্পতা আমেরিকার মত জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশে কিছুটা স্ববিরোধী মনে হয়।(৬) আসলে তা স্ববিরোধী নয়, কারণ শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার নাও ঘটাতে পারে তথা ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তার না-ও রোধ করতে পারে। এই বিজ্ঞানমনস্কতাই মানুষকে তার সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও সাহায্য করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যান্ত্রিক ও সংকীর্ণ স্বার্থে বিকৃত ব্যবহার বিজ্ঞানমনস্কতার পরিবর্তে যান্ত্রিকতার জন্ম দেয়। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, আমেরিকায় প্রায় সর্বতোভাবে ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা দেশে কম বেশি, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ তথা শাসকশ্রেণীর সেবাদাস হিসেবেই নিয়োজিত।

এর অন্য আরেকটি প্রতিফলন ঘটে, বিজ্ঞানের সাহায্যে (আসলে বিজ্ঞানের মৃত্যু ঘটিয়ে) অমানবিক হিংস্রতা প্রকাশে ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেও। যে আধিপত্যকামী ঔদ্ধত্য আমেরিকার মত সাম্রাজ্যবাদী দেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, ঐ বৈশিষ্ট্য নিছক সরকারী নয়। জনমানসের বড় অংশ জুড়েই তা আছে এবং রাষ্ট্রীয় পরিচালন ব্যবস্থা এদেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এরই একটি প্রতিফলন দেখা যায় ১৯৪৫-এ হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমাবর্ষণ নিয়ে আমেরিকাবাসীদের মতামত সম্পর্কিত একটি সমীক্ষায়। হিটলারকে লজা দিয়ে আমেরিকা তখন এই বোমাবর্ষণের মাধ্যমে অত্যাক্স সময়ে খুন করেছিল ২ লক্ষ ২০ হাজার নির্দোষ মানুষকে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে পঙ্গু-ব্যাধিগ্রস্ত করে দিয়েছে। এই ১৯৯৫-এর জুলাই মাসে করা একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, আমেরিকাবাসীর প্রায় অর্ধেকই হিরোসিমা-নাগাসাকিতে বোমাবর্ষণকে সমর্থনা করে এবং তার জন্য আমেরিকার অনুতপ্ত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই বলেও মনে করে। বিশেষত যারা বয়স্ক তাদের মধ্যে এই বোধ আরো তীব্ৰ।(৭) প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ও আগের অধ্যায়েই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আমেরিকার মৌলবাদী (ফান্ডামেন্টালিস্ট)-দের একটি বড় দাবী হচ্ছে উগ্র কমিউনিজম বিরোধী বৈদেশিক নীতির পাশাপাশি সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানো। সব মিলিয়ে শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিছক প্রসারই ধর্মীয় মৌলবাদের সৃষ্টিকে রোধ করতে যথেষ্ট নয়। এই মৌলবাদী হিংস্ৰতারই অন্য একটি দিক সাম্রাজ্যবাদী পাশবিকতা, যা তার অস্তিত্বের স্বার্থেবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে।

এটি তার অস্তিত্বের সংকট-অনুভবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যে অনুভব তাকে তথা তার প্রতিনিধিশ্রেণীকে ধর্মের দিকেও ঠেলে দেয়, এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার জন্ম দিতে সক্ষম। একদা প্রগতিশীল ও বৈজ্ঞানিক চেতনাসম্পন্ন বুর্জোয়াদের এই করুণ অবনমনের প্রসঙ্গে অধ্যাপক জর্জ টমসন তার ‘An Essay on Religion’–a 335 করেছিলেন, ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ইতিহাসকে বিচার করলে ধনতন্ত্রের আসন্ন ধ্বংসের বাস্তব চিত্রটিই প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং এই বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হতে বুর্জেয়া চিন্তানায়কদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীকে ঘুরিয়ে ধরবার বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিত্যাগ করে দার্শনিক ভাববাদ বা দুজ্ঞেয়বাদে আশ্রয় নেবার একটি মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে!’ কিন্তু ধনতন্ত্রের আসন্ন ধ্বংসের’ বাস্তবতার কথা বল্লেও, ধনতন্ত্র এত সহজে রাস্তা ছাড়তে প্ৰস্তুত নয়। সে কৌশল পাল্টায়, চেহারায় ‘মেক আপ’ দেয়। ‘বিজ্ঞানেও অগ্রসর’ সাম্রাজ্যবাদী দেশে ধর্মের ব্যবহার, শক্তিশালীভাবে টিকে থাকা এবং ফান্ডামেন্টালিজম তথা মৌলবাদের সৃষ্টি, বিকাশ ও অস্তিত্বের পেছনে এই দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার মত, শিল্পবিপ্লবের সূতিকাগার ইংল্যান্ডেও একই ভাবে রাজতন্ত্রের প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় মানসিকতা এবং ধর্মের ব্যাপকতর ব্যবহার ও অস্তিত্ব বর্তমান।

অন্যদিকে পুঁজিবাদের অসম বিকাশের এলাকা এই ভারতীয় উপমহাদেশ। বুর্জেয়া বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, রেনেসা—কোনটিই এখানে হয় নি। চূড়ান্ত বৈষম্যের আধা সামন্ততান্ত্রিক এই দেশ বিশ্বের নানা সাম্রাজ্যবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী দেশের অবাধ মৃগয়াক্ষেত্র। স্বাধীনভাবে সমস্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্কের রূপান্তর ঘটিয়ে পুঁজিবাদের প্রগতিশালী ভূমিকার বিকাশ এখানে ঘটে নি। কত বিচিত্র স্বার্থের কত বিচিত্র স্তরের শ্রেণীবিভাগ থাকে। এসব দেশে। এখনকার ধর্মীয় মৌলবাদের দ্রুতশক্তিবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ধরনের বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর ভূমিকা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

এই ধর্মীয় মৌলবাদীদের নেতৃস্থানীয়রা অবশ্যই শাসকশ্রেণীর একটি অংশ, যে অংশ তীব্রভাবে ধর্মকে ব্যবহার করতে চাইছে এবং অপর অংশের সঙ্গে এই বিশেষ

মৌলবাদের উৎস সন্ধানে br>

স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারছে। ধর্মকে এইভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ধর্মের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা, নিজ ধর্মীয় মাহাত্ম্য ও মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা

তাদের জঙ্গীভাবে করতে হচ্ছে।

এবং এরা উৎসাহী সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। পরবর্তী স্তরের অর্থাৎ মধ্যশ্রেণীর স্বচ্ছল গোষ্ঠীর পরিবারগুলিকে। বিশেষত উত্তর ভারতে বিগত দু’তিন দশকে যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তার ফলশ্রুতিতে উঠতি এই শ্রেণী নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে এমন বিকল্প ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতিকে সুবিধাজনক হিসেবে অনুভব করেছে। নতুন শহুরে মধ্যশ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে যারা নানা ধরনের ঋণ, ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগের উৎসাহদান ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় সত্তরের দশক থেকে সংখ্যায় অনেক বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলেও কিছু এলাকায় সবুজ বিপ্লব (যেমন উত্তরপ্রদেশের নানা স্থানে) কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়েছে। প্রকৃত বুর্জেয়া বিকাশের অভাবের কারণে, মানসিকভাবে এই শ্রেণী এখনো সামন্ততান্ত্রিক,–ধৰ্ম-পূজা আচ্চা-সতীমাহাত্ম্য ইত্যাদি তাদের মনপ্ৰাণ জুড়েই ছড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় নেতৃস্থানীয় হিন্দু মৌলবাদীদের জঙ্গী হিন্দুত্বের প্রচার এবং মুসলমানরা তাদের আধ্যাত্মিক-অর্থনৈতিক সবদিক থেকে বিপদগ্ৰস্ত করতে পারে, এমন ভয়ের সঞ্চার করার ফলে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি বড় অংশই হিন্দু মৌলবাদকে আত্মরক্ষার প্রধান উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন তথাকথিত হিন্দুদের একত্রিত করতে শুধু হিন্দুত্বের প্রচার নয়, রাম মাহাত্ম্যকে সুনির্দিষ্টভাবে সামনে রাখা এবং বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ‘রাম জন্মভূমি উদ্ধার’ (তার পরে আছে মথুরা, বেনারস ইত্যাদি ইত্যাদির শতশত ‘মন্দির’–অর্থাৎ এই উদ্ধার কর্মের দীর্ঘস্থায়ী ধারাবাহিকতার প্রচার)-এ ধরনের কর্মসূচীকেও তীব্রতার সঙ্গে হাজির করা হল। দূরদর্শনে রামায়ণের প্রদর্শন অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞান প্ৰযুক্তিভিত্তিক, অতীব সক্রিয় ধর্মপ্রচারও এ ধরনের জঙ্গী কর্মসূচীর ক্ষেত্র প্রস্তুত করায় কিছুটা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সমাজের একেবারে পিছিয়ে থাকা, দরিদ্রতম মেহনতী মানুষদের চেয়ে এই ধরনের মধ্যবর্তী ব্যক্তিরাই মৌলবাদের বড় সহচর। এরা কিছু সুযোগসুবিধা পেয়েছে, তাকে আরো বাড়াতে চায়, ভিন্নধর্মের মানুষদের হটিয়ে নিজেদের পথ পরিষ্কার করতে চায়। ফলে হিন্দু হিসেবে (বা বিশেষ ধর্মীয়গোষ্ঠী হিসেবে) নিজেদের অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে সুনিশ্চিত করার প্রশ্নের সঙ্গে এই অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা অর্জনের লক্ষ্যও মিলেমিশে যায়।

মৌলবাদের সৃষ্টি ও টিকে থাকার পেছনে এই শ্রেণীগত অবদান বিরাট হলেও, এটিও ঠিক যে, সংখ্যায় কম হলেও, কিছু মানুষ নিছক ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে এদের দােসর হয়। কিন্তু এদের এ বিশ্বাস বিকৃত ধর্মবিশ্বাস। বিকৃত এই কারণে যে, শুদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে অন্যকে ছোট করার বা অন্য ধর্মের মানুষদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা তীব্রভাবে মোটেই থাকে না। তবু আর এস এস-বিজেপি চক্ৰ বা জামাতে ইসলামীর মত হিন্দু-মুসলিম সব মৌলবাদীদের মধ্যেই এমন হিন্দুত্ব বা ইসলামের প্রতি আনুগত্যের কারণে সচেতন বা অসচেতনভাবে তাদের খপ্পরে গিয়ে পড়া ব্যক্তির অভাব নেই। কিন্তু মৌলবাদীদের মধ্যে পাল্লা ভারী মেকী ধর্মানুগতদের দিকেই।

হিন্দুমহাসভার মত হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভূস্বামীদের স্বাৰ্থ রক্ষণ করা। মহাসভার সভাপতি ভি. ডি. সাভারকর তাঁর ‘হিন্দুরাষ্ট্র দর্শন’-এ ভূস্বামী ও প্রজার মধ্যে কোনো ‘স্বার্থপর’ শ্রেণীগত বিরোধের নিন্দা করেন। যুক্তপ্রদেশ থেকে পাঞ্জাব—নানা রাজ্যে মুসলিম লীগও প্রধানত নির্ভর করত। স্বধর্মের ভূস্বামীদের উপর। এইসবু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির দুস্বামীদের আসল লক্ষ্য ছিল ধৰ্মরক্ষার চেয়ে নিজ শ্রেণীস্বার্থ বজায় রাখা।

জামাতে ইসলামীর মধ্যেও ইসলামের প্রতি অশ্রুপাত করা লোকেদের চরিত্র এমন মেকী মুসলিমেরই। বদরুদিন উমর তার মৌলবাদের বাঙলাদেশী সংস্করণ’ প্রবন্ধে (১৬ই এপ্রিল ১৯৯২ সাপ্তাহিক খবরের কাগজ’-এ প্রথম প্রকাশিত) যেমন জানিয়েছেন, ‘এদেশে সব থেকে জনপ্রিয়া’ বলে কথিত এক অর্ধশিক্ষিত (সাধারণ শিক্ষা তো বটেই এমন কি ইসলামিয়াত এবং ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে এর কোন ধারণা নেই) জামাতী ওয়াজকর নেওয়ালা ইসলামের নামে প্রত্যেক ওয়াজের জন্য বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার টাকা ফি নিয়ে থাকে। এটা তার ব্যবসা। ধর্মীয় মৌলবাদের নামে ব্যবসাদারী বাংলাদেশের ইসলামী মৌলবাদীদের একটি বৈশিষ্ট্য। সকলেই যে উপরোক্ত অর্ধশিক্ষিত মৌলভীর মত ওয়াজ করে ধন অর্জন করে তা নয়। এরা কেউ ব্যাংকের ডিরেকটর, কেউ হাসপাতালের ডিরেকটর, কেউ কোন বিদেশী পাইপ লাইনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু যেভাবেই হোক, এদের নেতৃত্বের প্রধান অংশটিই এভাবে ইহকালে আখের গোছাতে ব্যস্ত।’

পাকিস্তানেও, জিয়াউল হকের সময় ছিল মৌলবাদী উত্থানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাল। এই সময়ও কিছু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছিল। কিন্তু তার মূল চরিত্রটি ছিল বিদেশী,-বিশেষত সাম্রাজ্যবাদী ও অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদী দেশের ঋণ নিয়ে নানাভাবে তার সাহায্যে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শ্ৰীবৃদ্ধি ঘটানো। দরিদ্রদের জন্য তার কোন ভূমিকা ছিল না, বরং নেতিবাচক প্রভাবই ছিল। তাই দেখা যায় ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের গ্রামে দারিদ্র্য সীমার নীচের মানুষ ছিল শতকরা ৩৫ ভাগ, ১৯৭৯-এ তা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ৩৭ ভাগ। জিয়া-অৰ্থনীতির সামগ্রিক চরিত্রের আঁচ এ থেকে পাওয়া যায়। আর এই অবস্থায় একদিকে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ দরিদ্র জনসাধারণকে ভুলিয়ে রাখতে ধর্মের আফিম গেলাবে এবং অন্যদিকে নিজেরাও ধর্মকে আঁকড়ে রাখবে (অর্থাৎ ধর্মানুসরণের ভান করবে)-এতে অস্বাভাবিকত্ব হয়তো বিশেষ কিছু নেই। হিন্দু বিরোধিতা, বাঙলাদেশ বিরোধিতা (এবং বাঙলাদেশের মুসলিমরা প্রকৃত মুসলিম নয়—এমন প্রচার) ইত্যাদিও এই কারণেই করতে হয়।

আখের গোছানোর ধান্দায় ব্যস্ত মানুষেরা মৌলবাদীদের পুষ্টি জোগানো, এমনকি উত্থান ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাহায্য করলেও, শুধু এটিই মৌলবাদ সৃষ্টির প্রধান দিক নয়। আগেই বলা হয়েছে, ধর্মের প্রতি বিশ্বাস, ধর্মান্ধতা, আপন অস্তিত্বের সঙ্গে ধর্মপরিচয়কে একাত্ম করে তোলা এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মতাদর্শ বা ভিন্ন ধর্মের দ্বারা এই ধর্মের তথা আপন অস্তিত্বের বিপন্নতাবোধের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি যেমন এই সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে, তেমনি বিশেষ শ্রেণীর আধিপত্যকামী, নেতৃত্ব লোভী, অর্থনৈতিক সুবিধাবাদী মানসিকতাও এই সৃষ্টিকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু এটিও সব নয়। ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্টির পেছনে আরেকটি বড় ভূমিকা পালন করে, জনসাধারণের সামনে উপযুক্তভাবে সংগঠিত সঠিক দিশার শূন্যতাও।

এই দিশাকে মার্কসীয় দর্শন অনুসারী হতেই হবে তার কোন মানে নেই। প্রকৃতই ধর্মনিরপেক্ষ উদার মতাদর্শও যদি সংগঠিতভাবে জনগণের নেতৃত্ব দিতে ও তাদের সমস্যার সমাধানে নিজের আন্তরিক ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাদের আস্থা অর্জন করতে ও জনগণের বৃহদংশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ, উদার, মানবতাবাদী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারে (অন্তত তাদের সামনে তা রাখতে পারে), তাহলে মৌলবাদের সৃষ্টি ও বিস্তার ব্যাহত হতে বাধ্য। যখনই যেখানে এই শূন্যতা থাকে তখন, অন্যান্য শর্তসাপেক্ষে, ধর্মীয় মৌলবাদ এই শূন্যতা পূরণ করতে এবং জনগণের হতাশার সমাধান করার অভিনয় করে তাদের বন্ধু হতে এগিয়ে আসে। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে ধর্মকে এমন মৌলবাদী জঙ্গীপনা করতে হচ্ছে, কারণ আধুনিক বিশ্বে তথাকথিত ঐসব প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের অস্তিত্ব যে বিপন্ন তা অনুভব করা যাচ্ছে(৮), ফলত তার প্রতিক্রিয়ায় ধর্মের মূল বা শিকড়ে ফিরে যাওয়ার তাগিদটিকে অর্থনৈতিক শ্রেণী স্বার্থের সঙ্গে মেলাতে হচ্ছে। (কারণ এখনকার প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও সংকটের মুখে নিজেকে বাঁচাতে গ্যাট চুক্তি থেকে হাজারো কৌশল নিতে বাধ্য হচ্ছে। তবু দেশের মানুষের বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, ক্রম হ্রাসমান মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মাথাপিছু আয়, এগুলি রোধ করা যাচ্ছে না।)

মৌলবাদ এইভাবে হতাশা ও নেতিবাচক অবস্থার ফসল। অলৌকিক শক্তির কল্পনা মানুষের আদিম বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। অন্যান্য প্রাণী বা জীবজন্তু থেকে যে সব দিক মানুষকে গুণগতভাবে পৃথক করেছে, এটি তার অন্যতম। ধর্মের ও তার অনুশাসন-মূল্যবোধের সংকলন মানুষের মানবিক ইতিবাচক দিকেরই প্রকাশ, যদিও ক্রমশ তার শ্রেণী স্বার্থে ব্যবহারও ঘটেছে। কিন্তু নিজের সমাজ ও গোষ্ঠীকে সুশৃঙ্খলভাবে ধরে রাখার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা পশুদের গোষ্ঠী থেকে মানুষের সমাজকে আলাদা করে। এবং এর ফলেই মানুষ পরিবর্তিত পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী তার চিন্তাভাবনা, সমাজ-অৰ্থনীতি তথা ধর্মেরও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কিন্তু যখন এই পরিবর্তনকে অস্বীকার করা হয় এবং ধর্মের নাম করে মানুষে মানুষে চূড়ান্ত বৈরিতামূলক বিভেদ, পারস্পরিক ঘূণা ও ব্যাপক জনগণকে প্রতারণা করার মাধ্যমের সৃষ্টি করা হয়, তখন আর তা মানবিক ও ইতিবাচক থাকে না। তখন আর ধর্ম মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাচীন তথা অন্তত তৎকালে প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে না। বর্তমান পৃথিবীতে নতুন জ্ঞানের আলোয় ঈশ্বর বিশ্বাসের তথা ধর্ম বিশ্বাসের বৈপ্লবিক পরিমার্জনার প্রয়োজনও স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে। এ অবস্থাতেও ধর্ম যদি রাস্তা না ছেড়ে দেয় এবং ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী ক্রিয়াকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার পাশাপাশি মানুষের মনুষ্যত্ব ও আর্থসামাজিক বিকাশকে আচ্ছন্ন করতে থাকে, তবে এই ক্রিয়াকাণ্ডের উচ্ছেদ করাটাই অন্যতম প্রাথমিক দায়িত্ব।

কিন্তু এই দায়িত্ব যাদের করার কথা বা যাঁরা করবেন বলে প্ৰতিশ্রুতি দেন, তারা যদি সংগঠিত না হন এবং দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রেও যদি ফাঁকি থাকে, তবে ঐ শূন্যতার সুযোগে ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ মাথা তুলে চাড়া দেবেই। বাস্তবত দেখা গেছে। যখন জনগণকে নিয়ে সুস্থ সামাজিক সংগ্রাম পরিচালিত হয় ও তার জোয়ার আসে, তখন সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিগুলো পিছু হঠতে বাধ্য হয়। কয়েক দশক আগে এই বাংলায় ব্যাপক বামপন্থী আন্দোলন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদী জাতীয়তাবাদের প্রসার-প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। সত্তরের দশকের তথাকথিত নক্সাল আন্দোলনের সময়ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান আদৌ লক্ষণীয় ছিল না। কিন্তু সারা ভারতব্যাপী এই বৈপ্লবিক আন্দোলন (তার সমস্ত ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও)। যখন এক সময় ব্যর্থ হল এবং মানুষকে হতাশ করল, তখন নানা গুরুবাবা-মাতাজিদের জঙ্গী আবির্ভাব নতুন করে ব্যাপকভাবে ঘটতে শুরু করল। ধর্মকে কিছু মানুষও আঁকড়ে ধরল শান্তি ও মুক্তির উপায় হিসাবে। এমন কি সংখ্যায় নগণ্য হলেও এমন লড়াকু নক্সাল’ কর্মীদের কেউ কেউ বিজেপি-র মত মৌলবাদী সংগঠনে যুক্ত হয়েছে—এমন উদাহরণও রয়েছে এবং ধাৰ্মিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে এমন উদাহরণ তো আছেই।

আরো আগে ভারতে যখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ার এসেছে তখনও এই সব ধর্মীয় অপশক্তি মাথা চাড়া দিতে পারে নি। ‘১৯১৮ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত বছরগুলি ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম ও হিন্দু মুসলিম ঐক্য, উভয়েরই সুখকর সময়। ১৯২৬-এর পর বামপন্থার উত্থান, ট্রেড ইউনিয়নদের এবং যুব আন্দোলনের বৃদ্ধি এবং সাইমন কমিশন বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন আবার জনগণকে উদ্দীপিত করে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমিয়ে দেয়। ১৯৩০-৩৪-এ আইন অমান্য আন্দোলন গোটা দেশে ঝড় বইয়ে দেয়। হিন্দু ও মুসলিম সকলেই ব্যাপক সংখ্যায়। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সাম্প্রদায়িক দলগুলি ও নেতারা হয়। কার্যত অবসর গ্ৰহণ করেন অথবা ইতস্ততভাবে জাতীয় আন্দোলনকে সমর্থন করেন।. ১৯২০-র দশকের শেষে ও ১৯৩০-এর দশকে ক্রমবর্ধমানভাবে হিন্দু, শিখ ও মুসলিম যুবক ও শ্রমিকরা এবং অনেক এলাকায় কৃষকরা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য তাকাচ্ছিলেন কমিউনিস্টদের, সমাজতন্ত্রীদের, নওজয়ান ভারত সভার, বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের এবং নেহরু ও সুভাষচন্দ্ৰ বসুর দিকে। মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা, আর.এস.এস. এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সংগঠনের প্রভাব ছিল নূ্যনতম।’ (বিপিনচন্দ্ৰ)

এই ভাবেই ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত বা ধর্মনিরপেক্ষ বৈপ্লবিক আন্দোলন যেমন সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের উত্থানে বাধা দেয়, তেমনি তাদের অভাবও তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

পৃথিবী জুড়েই বামপন্থী আন্দোলনের দুর্বলতা ও নানা ধরনের ভাঙ্গন, বিভ্রান্তি যেমন এখন জনমানসে কোন বিকল্প আশা জাগানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে মৌলবাদের উত্থানে এটিও বড় ভূমিকা পালন করছে। প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা ব্যক্তিরাও সংগঠিত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ নন। এ অবস্থায় সামাজিক-অৰ্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনগণের হতাশা ঈশ্বর ও ধর্মকে আঁকড়ে রাখার তথা সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে।

আর তথাকথিত বামপন্থীরা বা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মত তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরা যখন সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ও সাময়িক সমস্যাকে এড়ানোর জন্য ধর্মীয়, এমনকি ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তির সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তাদের সহযোগী সংগ্ৰামী হিসাবে গ্ৰহণ করে এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে, তখন জনসাধারণের সামনে আরো জটিল বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং এই সব অপশক্তির গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে। এমনকি ধর্মীয় মৌলবাদীসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা যাঁরা বলেন (যেমন ভারতে বামপন্থীরা ও কংগ্রেসীরা) তাঁরাও ঐক্যবদ্ধ নন। ছুৎমার্গ ত্যাগ করে অন্তত এই বিষয়ে যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ে, আবার নয়া ফ্যাসিস্ট ঐ ধর্মীয় অপশক্তিগুলির বিরুদ্ধেও লড়ে। ফলে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইটিও যেমন দুর্বল হয়, তেমনি তাদের আসল শত্রু কে তা নিয়েও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।

এই বিভ্রান্তি আরো বাড়ে যখন দেখা যায় তথাকথিত বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিরা শুধু দলগতভাবে ধর্মীয় অপশক্তির সঙ্গে আঁতাত গড়ার উদাহরণ সৃষ্টি করা নয়, ব্যক্তিগতভাবেও ধর্ম ও ধর্মাচরণকে অনুসরণ করেন। মুখে মার্কসীয় দর্শনের কথা বলেও এবং বামপন্থী দলের কমী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেও, যখন নেতৃস্থানীয় বা বিরল দু’ চারজন বাদে, বাকী সবাই পূজাআচ্চায় অংশগ্রহণ করা বা উৎসাহ দেওয়ার সঙ্গে, শ্ৰাদ্ধ-’শুভ’ বিবাহ-উপনয়ন-পৈতে-কোরান খানিনামাজ জাতীয় নানাবিধ ব্যক্তিগত ক্রিয়াকাণ্ডে নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মানুষ্ঠান করেন (অন্তত তার সক্রিয় প্রতিবাদ করেন না, বরং সমর্থনে নানা যুক্তি দেখান) এবং নিজের প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম পরিচয়কেও দূর করেন না, তখন অন্য মানুষ এদের বস্তুবাদী দর্শন ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে খুব একটা আমল যে দেবেন না তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাশাপাশি দেখা যায়, যে ব্যক্তিত্বের উদাহরণ লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারত, পশ্চিমবঙ্গের সেই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, তার অতীত সংগ্রাম ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব সত্ত্বেও, ডঃ পাচু গোপাল রায়ের ভাষায়, ‘রিলিজিয়াস ওয়াইফ’ ও ‘ক্যাপিট্যালিস্ট সন’-কে সপ্ৰেমে-সস্নেহে মদত দিয়ে যান। অবশ্যই তাঁর সহকমী নেতৃত্বের অনেকেই এই ধাৰ্মিকতা ও পুঁজিলোভী মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। কিন্তু কারোর ব্যক্তিগত আচরণ ও বিশ্বাসে আঘাত না করার নাম করে, সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এমন দু একজনের এবং তার ঘনিষ্ঠতমদের মধ্যেও এমন আচরণ ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়াই না করাটা বামপন্থার অন্তঃসারশূন্যতার দিকে ইঙ্গিত করতে যথেষ্ট। এ অবস্থায় ধর্মের জনবিরোধী অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা তথা বস্তুবাদী দর্শনে অন্যদের শিক্ষিত করার কাজের ভিত্তিটিই আলগা হয়ে যায়। বামপন্থীদের এমন রিলিজিয়াস ওয়াইফ’-রা মৌলবাদী নিশ্চয়ই নন, হয়তো হবেনও না, কিন্তু তা সাধারণ মানুষকে রিলিজিয়াস’ না হওয়ায় অনুপ্রাণিত অন্তত করে না। এবং এরা যদি ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির শিকার হন তবেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে বলা যায়, সংগঠিত বামপন্থী দলের এহেন উদাহরণ এবং অন্যান্য বামপন্থীদের অসংগঠিত অবস্থানের সঙ্গে, প্রায় দু দশক ধরে তথাকথিত বাম-শাসনের পরেও এখানকার জনগণের নানা সমস্যার এমন কিছু গুণগত কোন পরিবর্তন ঘটে নি, বরং বাড়ছে। ব্যাপারটি অবশ্যই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা জটিলতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বিচ্ছিন্নভাবে একটি দেশের একটি রাজ্যে জনগণের সব সমস্যার সমাধান ঘটে যাবে, এটি ভাবাটাও হাস্যকর। কিন্তু সমস্ত কয়েমী স্বার্থগুলিকে প্ৰতিহত করে জনগণকে সংগঠিত করার এবং সংগঠনের সর্বস্তরে বস্তুবাদী দার্শনিক প্রচারের কাজও নিতান্তই অবহেলিত, অন্তত সংগঠন বাড়ানো ও ভোট কুড়ানোর উদ্যোগের তুলনায়। এ অবস্থার একটি ভয়াবহ পরিণতি হল, বিজেপি-র মত ধর্মীয় মৌলবাদীদের পশ্চিমবঙ্গের মত ‘বামপন্থী’, ‘আলোকিত রাজ্যেরও তৃণমূল অব্দি সংগঠনের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হওয়া-তা সে যত দুর্বল ভাবেই হোক না কেন। এই বিস্তারকে উপেক্ষা করার ভবিষ্যৎ পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য।

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ প্রতিরোধে বামপন্থা ও বামপন্থীদের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি বলেই ব্যাপারটি বেশি নাড়া দেয়। ভারতের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সহ অন্যান্য দক্ষিণপন্থীদের থেকে এ প্রত্যাশা অনেক কম, তার বড় কারণ তারা বস্তুবাদী দর্শনের কথাই বলে না, এবং ভাববাদের বিরুদ্ধে লড়াইটিও তাদের কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত নয়। তবু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেও এই দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বকে দেখা যায় সাইবাবার মত ম্যাজিসিয়ানধর্মব্যবসায়ীদের বা চন্দ্ৰস্বামীর মত ধান্দাবাজ ধৰ্মজীবীদের পেছনে পেছনে ঘুরতে, মন্দির-মসজিদ-গীর্জার ঐশ্বরিক শক্তির কাছে নতজানু হতে, যজ্ঞ ও জ্যোতিষসহ নানা অপবৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকাণ্ডের সাহায্য নিতে। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কথা বলা প্ৰয়াত রাজীব গান্ধীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। এদের কেউ এসব করেন নিজস্ব বিশ্বাস থেকে, কেউ বা ভোটের বাক্সের দিকে তাকিয়ে। আর জাতপাতের রাজনীতি তো বাম-ডান সব রাজনৈতিক দলেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্ম ও জাতপাতের অস্তিত্ব সমাজে আছে বলেই রাজনীতিতে তা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু তা অবশ্যম্ভাবী। নয়। সচেতন শুভ ইচ্ছায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিও করা সম্ভব এবং তাইই কাম্য, তাইই সুস্থ। আসলে অৰ্জ্জুন যেমন জলে মাছের ছায়া দেখে মাছকে বাণবিদ্ধ করে দ্ৰৌপদীকে লাভ করেছিলেন, এইসব ক্ষমতালিঙ্গু রাজনৈতিক দলগুলিও ভোটারদের ধর্মবিশ্বাসের দিকে লক্ষ্য রেখে ধর্মের বাণে তাদের হৃদয়বিদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এবং লাভ করতে চান আকাঙ্খিত গদিটি।

এইসব রাজনৈতিক দলগুলির কাজের পদ্ধতিতেও ধর্মীয় মৌলবাদীদের মত রাজনৈতিক সংকীর্ণতার আভাষ পাওয়া যায়। এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা সাধারণ মানুষ ধর্মীয় মৌলবাদীদের কথাবার্তাতেও খুব একটা অস্বাভাবিকত্ব খুঁজে পায় না। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ যেমন মানুষের মানুষ পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় বা সম্প্রদায়গত পরিচয়কেই প্রধান বলে গণ্য করে, উগ্র-অনুগ্র ‘কম্যুনিষ্ট’ বা কংগ্রেসসহ নানা রাজনৈতিক দলও একই ভাবে মানুষের মানুষ পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে কে কোন পার্টি করে বা কোন পার্টির কাছাকাছি-এইটিকেই প্রধান বিবেচ্য বলে মনে করে। শত্ৰু-মিত্ৰ চেনা বা শ্রেণীবিভাজন করা অবশ্যই দরকার, কিন্তু যখন তার নাম করে ভিন্ন রাজনৈতিক দলের দরিদ্র এক ছাপোষা মানুষ বা কৃষক-শ্রমিককেও শত্রুর পর্যায়ে ফেলে দেওয়া হয় কিংবা হত দরিদ্র এক কনস্টেবল ট্রাফিক পুলিশকে শ্রেণীশত্রু হিসেবে গণ্য করে হত্যা করা হয় (এবং বিরাট বৈপ্লবিক কাজ করা হল বলে তৃপ্ত হওয়া যায়), তখন তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের সংকীর্ণতার খুব একটা তফাৎ পাওয়া যায় না।

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদীরা যেমন আপনি সম্প্রদায়ের বা ধর্মের সবার স্বার্থ সমান করে দেয় (অন্তত প্রচারের ক্ষেত্রে) এবং ভিন্ন সম্প্রদায় বা ধর্মের সবাইকে শত্রুর পর্যায়ে ফেলে দেয়, এই রাজনৈতিক দলবাজাদের বৃহদংশও তাই করে। ভিন্ন রাজনৈতিক দলের উপযুক্ত দাবিগুলিও তাদের কাছে মর্যাদা পায় না। ধর্মের নাম করে মানুষে মানুষে যখন এই অসুস্থ বিভেদ সৃষ্টি হয়, তখন বুদ্ধ-মহাবীরচৈতন্য-নানক বা রামকৃষ্ণের মত বহু ধর্মীয় নেতাই মানবিক সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। একইভাবে মার্কস বা গান্ধীর মত রাজনৈতিক মতাদর্শের বহু প্ৰবক্তাও কখনো এটি বলেন না যে, তাকে কেন্দ্র করে একটি সংকীর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধতার সৃষ্টি হোক। তবু ধর্ম এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের এমন বিকৃত ব্যবহার ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মৌলবাদীরা করে যায়। ধর্মীয় মৌলবাদীরা ধর্মের বিতর্কিত সুবিধাজনক মূল দিকগুলিকে সময়োপযোগী না হলেও আপনি শ্রেণীস্বার্থে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাজনৈতিক মৌলবাদীরাও একইভাবে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে সময়ের সঙ্গে পরিমার্জিত না করে হুবহু প্রয়োগ করে চলে এবং তার থেকে খুঁটিনাটি বিচ্যুতিতে গেল গেল’ রব তোলে। ধর্মীয় মৌলবাদীরা রাম বা কৃষ্ণের মত এক একটি চরিত্রকে বেছে নিয়ে অন্ধভাবে তার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠায় নামে, রাজনৈতিক মৌলবাদীরাও মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্টালিন-মাওসেতুং (-শিবদাস ঘোষ)-মহাত্মা গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী-রাজীব গান্ধী)-দের প্রতি অন্ধ ব্যক্তিপূজা শুরু করে। এদের কোন ধরনের সমালোচনাকেই প্রতিক্রিয়াশীলতা বা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মেরুর অন্তর্ভুক্ত বলে ছাপ মেরে দেওয়া হয়। একইভাবে ধর্মীয় মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরাও ধর্মের খুঁটিনাটি বিচ্যুতিতেই ‘ধম বিপন্ন’ বলে আওয়াজ তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই মসজিদের সামনে শুয়োর মেরে রেখে এই ধরনের মুসলিমদের ক্ষেপিয়ে দেওয়া যায়(৯) আর মহরমের মিছিলে এই ধরনের হিন্দুদের গা কসকস করতে থাকে। রাজনৈতিক দলবাজি করতে করতে এই ধরনের অমানবিক বিভেদ সৃষ্টি, বৈরিতা, সংকীর্ণতা ইত্যাদির চর্চা যখন চলে তখন ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা একই কর্মপদ্ধতি চালিয়ে খুব একটা নিন্দাৰ্থ হয়ে ওঠে না। সরল ধর্মবিশ্বাসী মানুষ দেখে ধর্মীয় এইসব লোকেরা অন্তত তার ধর্মবিশ্বাসকে মর্যাদা’ দেয়, ধর্মীয় গোষ্ঠীর স্বাৰ্থ রক্ষায় ‘প্ৰাণপাত’ করে। ঐসব শ্রেণীভিত্তি, অর্থনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণের মত বড়বড় বিচারের চেয়ে কাজকর্ম ও মানসিকতার এই বাহ্যিক সাদৃশ্যও অনেক মানুষকে রাজনৈতিক মৌলবাদীদের কোল থেকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের কোলে ঠেলে দেয় এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের গ্রহণীয় করে তোলে।

সংকটাপন্ন অস্তিত্বের অনুভব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এই সংকট নতুন মতাদর্শের কারণে হতে পারে—আমেরিকায় যেমন ফান্ডামেন্টালিজম-এর সৃষ্টি হয়েছিল প্রাথমিকভাবে খৃস্টের অভ্যুত্থান জাতীয় ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন মিলেনারিয়ান আন্দোলনের স্তর পেরিয়ে বিবর্তনবাদ ও কম্যুনিজমকে ধর্মের অস্তিত্ব বিপন্নকারী হিসেবে অনুভব করে। এই মতাদর্শগত বিপন্নতার প্রতিফলন ঘটে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও যখন সামন্তশ্রেণী এবং বিশেষত বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের শ্রেণীগত সংকট অনুভব করতে থাকে। তাই ফরাসী বিপ্লবের আগে যে প্রগতিশীল বুর্জেয়ারা ধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তারাই পরে ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করে। হিন্দু ও ইসলামী মৌলবাদীদের ক্ষেত্রেও এটি কম বেশি সত্য। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই ধর্মকে কোণঠাসা করতে থাকে, ততই এরা মরিয়া হয়ে ওঠে। হিন্দু মৌলবাদীরা তাই কয়েক সহস্র বছরের পুরনো রামমাহাত্ম্যকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বৈদিক শিক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে চায়। মুসলিম মৌলবাদীরা ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষাকে জোরদার করে, হাজার দেড়েক বছরের পুরনো কোরান ও হাদিসকে হুবহু অনুসরণ করতে চায়।

সব মিলিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদের সৃষ্টি, টিকে থাকা ও পরিপুষ্টির জন্য কয়েকটি শর্তের কথা উল্লেখ করা যায়

(১) প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রতিকুল শক্তির কাছে মানুষের অসহায়তা এবং অসম্পূর্ণ জ্ঞান,

(২) যে ব্যবস্থার উপরিকাঠামো হিসেবে ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাস টিকে থাকে ঐ ব্যবস্থার অস্তিত্ব,

(৩) ধর্মের ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মত বৈজ্ঞানিক তথ্য, চিস্তা ও আদর্শএর উদ্ভব, এবং তার প্রতি প্রতিক্রিয়া,

(৪) শাসকশ্রেণীর বিশেষ অংশের বিপন্নতাবোধ, এবং তাদের মধ্যে এই বিপন্নতা কাটানোর জন্য নিজেদের ও নিজেদের অধীনে অন্যদের সংগঠিত করতে ধর্মকে ব্যবহার করার প্রবণতা,

(৫) চারপাশে সুবিধাভোগী ধর্মবিশ্বাসী মধ্যশ্রেণীর অস্তিত্ব এবং তাদেরও নিজ স্বার্থের ও অস্তিত্বের সংকট,

(৬) ধর্মবিশ্বাসী বিপুল সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাদের বিভ্রান্ত করা যায় ও যারা নিজ ধর্মের স্বার্থে বিভ্রান্ত হতে প্ৰস্তুত এবং দীর্ঘকালীন সমস্যার কারণে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া হতাশা,

(৭) বৈজ্ঞানিক, ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা গণমুখী বামপন্থী আন্দোলনের অভাব বা দুর্বলতা,

(৮) জনগণের বৃহদংশের সচেতনতা সৃষ্টি করা, আস্থা অর্জন করা ও সমস্যা সমাধান করার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ-বামপন্থীদের ব্যর্থতা,

(৯) ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তির অস্তিত্ব ও প্ররোচনা এবং তাদের দ্বারা নিজেদের সামাজিক-অৰ্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে বলে বিশ্বাসের সৃষ্টি হওয়া,

(১০) জনগণের বৃহদংশের সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক তথা সুস্থ জীবন যাপনের নানা সমস্যাবলীর সমাধানে অক্ষম এবং বৈষম্যভিত্তিক, শোষণজীবী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী শাসকশ্রেণীর দ্বারা, জনগণের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করে। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য তথা আত্মরক্ষার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক কৌশল।

শাসকশ্রেণীর একাংশের এই ষড়যন্ত্রমূলক কৌশলই ধর্মীয় মৌলবাদের জন্ম দেয়। মানুষের হতাশা আর যুক্তিহীন ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাস তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখে। বিকল্প বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের অভাব বা ব্যর্থতা তার জন্য স্থান ছেড়ে দেয়। এই মৌলবাদ মানুষের সংগ্রামকে বিপথগামী করে। সংগ্রামী মানুষদের ধর্মের নামে বিভক্ত ও দুর্বল করে দিতে এবং মূল শত্রুর পরিবর্তে পরস্পরের মধ্যে হানাহানি করে শক্তিক্ষয় করতে প্ররোচিত করে। সমাজ ও তার সমস্যা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি অর্জনে বাধা দেয়। মন ও চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে অলীক ও কল্পিত ঈশ্বরে বিশ্বাসের দ্বারা এবং এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানিক ধর্মে মোহের দ্বারা। বৈজ্ঞানিক মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে ও মানুষকে ভালবাসতে বাধা দেয়। এইভাবেই মৌলবাদ তার অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক, প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র নিয়ে গণশত্রুদের অভিষেকের আয়োজন করে।

ধৰ্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা সচেতনভাবে সৃষ্টি করা একটি মানসিকতা তথা বিশেষ ধরনের আন্দোলনের প্রক্রিয়া। ঐশ্বরিক অলৌকিক শক্তির ও আত্মা জাতীয় কোন একটি কিছুর কল্পনা ও বিশ্বাস, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নানা বিধিনিষেধ ও সংস্কারের সৃষ্টি ইত্যাদির মত মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা জনগণের মধ্যে প্রায় সর্বজনীনভাবে ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে সৃষ্টি হয় না। তাকে সক্রিয় উদ্যোগে সৃষ্টি করা হয়। সৃষ্টি করে স্বল্পসংখ্যক কায়েমী স্বার্থের সংকীর্ণ চিন্তার কিছু মানুষ। তারা তাকে ছড়িয়ে দেয় জনগণের মধ্যে। অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা, যুক্তিহীন আবেগ, সুস্থ বিকল্পের অভাব, নিজস্ব হতাশা ও নানাধরনের বিভ্রান্তির কারণে জনগণের একাংশ তাকেই নিজের মুক্তির পথ ভেবে বসে। এই ভাবনা তাকে যখন সর্বনাশের দোরগোঁড়ায় দাঁড় করায়, তখন সে দেখে সে নিজের ভাইকে হত্যা করেছে, প্রতিবেশী বন্ধুকে পর করে দিয়েছে, সে নিজে আটকেছে আরো শক্তিশালী বাঁধনে। আর দেখে, ঐ দোর গোঁড়ার বহু দূরে সব মৌলবাদীরা পরস্পরের কঁধে হাত দিয়ে এই বাঁধন হাতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

——————
(১)এই যুক্তিবোধহীন অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাস হচ্ছে ধর্মান্ধতাত তথা ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী মানসিকতার সৃষ্টি ও টিকে থাকার একটি বড় ভিত্তি। ১৯৯৫ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর একেই মূলধন করে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা সম্ভবত তাদের পরিকল্পিত এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ ষড়যন্ত্রের রিহার্সেল করে; সারা ভারতে ও ভারতের বাইরেও তারা সুকৌশলে রটিয়ে দেয় যে, গণেশ মূর্তি (এবং শিব, দুৰ্গা ইত্যাদির মূর্তিও) ভক্তদের দেওয়া দুধ পান করছে। লক্ষ লক্ষ সরল ধর্মবিশ্বাসী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এর ফলে দলে দলে বাড়িতে বা মন্দিরে ঐ সব মূর্তিকে দুধ খাওয়াতে থাকে এবং সারা ভারত জুড়ে আচমকা এক গণউন্মাদনার সৃষ্টি হয়। আমেরিকা-ইংল্যাণ্ডের মন্দিরেও তার খামতি ছিল না। ব্যাপারটি যে সুপরিকল্পিতভাবে প্রচারিত একটি গুজব ও রটনা, তা বোঝার জন্য শুধু এটি বোঝাই যথেষ্ট যে, অতি অল্প সময়ে এমন গুজব ছড়িয়েছে প্রধানত শহরাঞ্চলে যেখানে এস টি ডি করে টেলিফোনে এমন গুজব ছড়ানো গেছে বা গুজব ছড়ানোর নির্দেশ দেওয়া গেছে। গ্রামের লোকেরা বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে ধারণা থাকলেও, সেখানে এই উন্মাদনা ছড়ায়নি। গণেশের গুড়ই হোক বা ছাগলমূর্তির পা-ই হোক,-দুধ, মদ, সাবান জুলি, কেরোসিন তেল ইত্যাদি, তরলের পৃষ্ঠটান (surface tension) & Kirrtt isfits first (Capiliary action)-এর জন্য এই তরলসহ চামচ ওখানে ঠেকালে সেটি আস্তে আস্তে বেয়ে যায়। এতে অলৌকিকতার কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু বিশ্বহিন্দু পরিষদ সহ নানা হিন্দুত্ববাদী ও হিন্দুমৌলবাদী গোষ্ঠীই এটিকে দৈবী ব্যাপার বলে এবং আগামী শতাব্দী যে ‘হিন্দু শতাব্দী’ হতে যাচ্ছে তার লক্ষণ বলে অভিহিত করেছে। (এশিয়ান এজ, আনন্দবাজার পত্রিকা ইত্যাদি; ২২৯.৯৫) সব দেখে শুনে মনে হয় ব্যাপারটি মৌলবাদীদের একটি সুপরিকল্পিত কর্মসূচীর অঙ্গ। কত তাড়াতাড়ি তারা দেশ জুড়ে যুক্তিবোধহীন ও ধর্মবিশ্বাসী অসংখ্য মানুষকে (হিন্দুদের) উন্মত্ত করে তুলতে পারে,-যথাসম্ভব তা যাচাই করার জন্যই গণ উন্মাদনার সৃষ্টি।

এইভাবে ভবিষ্যতে কোন একদিন যদি তারা হঠাৎ দেশজুড়ে রটিয়ে দেয় যে, মথুরা বা অযোধ্যায় কয়েক শত হিন্দুকে মুসলমানরা মেরে ফেলেছে (এবং তা জোরদার করতে কিছু দরিদ্র বস্তিবাসী হিন্দুকে তারা মেরেও ফেলতে পারে) তবে ভয়াবহ মুসলিম নিধন ও তার প্রতিক্রিয়ায় উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো সম্ভব হবে। ২১শে সেপ্টেম্বর যারা দুধ ভরা চামচ নিয়ে গণেশ মূর্তির দিকে ছুটেছিল, তারাই তখন কোন যুক্ত বা তথ্যের ধারে কাছে না গিয়ে, কোনকিছু তলিয়ে না দেখে, ছুরি হাতে প্রতিবেশী মুসলিমদেৱ দিকে ছুটে যাবে। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিন্দুমৌলবাদীদের পরিকল্পিত জঙ্গী লড়াই-এর রিহার্সেল হল না তো ঐ গণেশের দুধ খাওয়ার গণ উন্মাদনার সৃষ্টি?

(২) বিবর্তনবাদ’ কথাটি এখানে একটি পৃথক তত্ত্ব হিসেবে তো বটেই, মানুষের ক্রমশ বিকশিত বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির প্রতীকী হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

(৩) পশ্চিমবঙ্গের বহু মুসলিম বাঙালী রমণীই প্রতিবেশী হিন্দু মহিলাদের প্রভাবে দুর্গাপূজার সময় অনায়াসে পূজার নতুন শাড়ি কেনেন। গ্রামের মহররমের মেলায় হিন্দু শিশুরা হুটোপাটি করে আসে।

(৪) যেমন, মুসলিম লীগের ১৯৩৬-র সভাপতি ও শুরুর দিকের উদারপন্থী পর্যায়ের একজন প্রথম সারির নেতা, এস, ওয়াজির হাসান। তিনি ১৯৩৮-এর ফেব্রুয়ারীতে একটি চিঠিতে নেহেরুকে লিখেছিলেন, ‘কেবল মুসলমান-হিন্দুদের মধ্যেই নয়, মুসলমানদের নিজেদের মধ্যেও বিকৃতি, মিথ্যা এবং ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার শুরু হয়েছিল গত অক্টোবরে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনের সভাপতির ভাষণ থেকে। দিনে দিনে সংখ্যালঘুদের অধিকারের মুখোশের আড়ালে সত্যের অপলাপ ও ধর্মীয় বিদ্বেষ আরো বেড়েই চলেছে।’

(৫) যেমন, যখন অন্য ধর্মের নাম না করেও, শুধু হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বলা হয় যে, এটি পরমতসহিষ্ণু, সবচেয়ে উদার, এর মধ্যে নানা মত ও পথ মিলিত হয়ে এর এক বিশেষ বৃহত্তর রূপ দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি, তখন স্বাভাবিকভাবেই এইসব কথার এই অর্থ দাঁড়ায় যে অন্যান্য ধর্ম এরকম পরমতসহিষ্ণু নয়,উদার নয়, নানামতের মিলনক্ষেত্ৰনয় ইত্যাদি। একইভাবে মুসলিমদের অনেকেইএমন কথা বলেন যে, ইসলামেই একমাত্রসাম্য ইত্যাদির কথা আছে, তখন তারও এমন সাম্প্রদায়িক অর্থ দাঁড়ায়।

(৬) আমেরিকায় ঈশ্বরবিশ্বাস ও ধর্মপরিচয় থেকে মুক্ত (atheist ও, nonreligious) ব্যক্তির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬.৮ শতাংশ (১৯৮০ সালে)। অন্যদিকে মঙ্গোলিয়ায় তা ৬৫ শতাংশ (১৯৯০), উরুগুয়েতে ৩৫.১ শতাংশ (১৯৮০), জামাইকায় ১৭.৭ শতাংশ (১৯৮২), বুলগেরিয়ায় ৬৪.৫ শতাংশ (১৯৮২), ইটালিতে ১৬.২ (১৯৮০) ইত্যাদি। অন্যদিকে যেসব দেশে সমাজতন্ত্রের স্বপক্ষে ব্যাপক গণ আন্দোলন ঘটেছে, অন্তত যেসব দেশ সমাজতান্ত্রিক (বা কমিউনিস্ট) হিসেবে পরিচিত সে সব দেশে এ হার অনেক বেশি, যেমন চীনে ৭১.২ (১৯৮০), কিউবায় ৫৭.১ (১৯৮০), উত্তর কোরিয়ায় ৬৭.৯ (১৯৮০), আলবেনিয়ায় ৭৪.১ (১৯৮০) ইত্যাদি।

(৭) বিবেক দংশন নেই মার্কিনীদের।–হিরোসিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের পঞ্চাশ বছর পরেও এই দুষ্কর্ম সঠিক হয়েছে বলে মনে করেন অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক। সি বি এস নিউজ ও নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক যৌথ সমীক্ষায় মার্কিনীদের এই অভিমতের কথা জানা গেছে। সমীক্ষার ফল প্ৰকাশ করা হয় সোমবার।

‘২৬ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করেন, ১৯৪৫ সালের ৬ই ও ৯ই আগস্ট হিরোসিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা নিক্ষেপের জন্য আমেরিকার ক্ষমা চাওয়া উচিত নয়। আর ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যে ৮৪ শতাংশই ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না’ বলে জানিয়েছেন।

‘সব মিলিয়ে ৫৮ শতাংশ মার্কিন নাগরিকের বিশ্বাস, এই দুই শহরকে ধ্বংস করা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা নৈতিকতার মানদণ্ডে বেঠিক কাজ হয় নি। যাদের বয়স ৬৫-এর উপরে তাদের মধ্যে ৬৮ শতাংশই এই মতের শরিক।

‘উল্লেখ্য, দশ বছর আগে অনুরূপ এক সমীক্ষার ফলাফলও ছিল একই। এবারের সমীক্ষাটি ২৩শ্রে থেকে ২৬শে জুলাই পর্যন্ত চালানো হয়েছিল।’ (গণশক্তি; ২৮,৯৫)। তবু আশার কথা আমেরিকাবাসীর বেশকিছু অংশই এইসব মতের শরিক নন। অর্থাৎ তাদের বিবেক দংশন আছে।

(৮) যেমন কয়েক দুশক আগেও ভাবা যেত না যে পৃথিবীর এক পঞ্চমুংশেরও বেশি মানুষ নিজেদের ঈশ্বরবিশ্বাসমুক্ত বা নাস্তিক (atheist) ও ধর্মপরিচয়মুক্ত (nonreligious) হিসেবে প্রকাশ্যে সাগর্বে ঘোষণা করবেন, সরকারিভাবে এই হিসাব নথিভুক্ত হবে এবং তাঁরা সম্মানের সঙ্গে ঘুরেও বেড়াবেন।

(৯) এবং একইভাবে হিন্দুদেরও। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক জানোয়ারেরা এরই সুযোগ নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষের শুভবুদ্ধি ধর্মকেন্দ্ৰিক এই পশুত্বকে প্রতিহত করতে সক্ষম। যেমন, ‘সিউড়ি, ৩ আগস্ট-বীরভূমের খয়রাশোল থানার লোকপুর গ্রামে একটি দুর্গামন্দিরের নাটমন্দিরে মঙ্গলবার রাত্রে দুষ্কৃতীর দল একটি গরুর কটা-মুণ্ডু রেখে যায়। কিন্তু বুধবার এলাকার হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলিতভাবে ওই ঘটনার প্রতিবাদে এক সম্প্রীতি-মিছিল বের করে ওই চক্রান্ত ভেস্তে দেয়। এদিন এলাকার দোকানপাটও বন্ধ রেখে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে ‘ধিক্কার দিবস’ পালিত হয়।’ (আজিকাল; ৪-৮-৯৫) ধর্মনিষ্ঠা ও ধর্মান্ধতার মধ্যে, ধর্মের অসাম্প্রদায়িক ও সাম্প্রদায়িক প্রয়োগের মধ্যে এবং অমৌলবাদী ও মৌলবাদী রূপান্তরের মধ্যে মানুষের ধর্মবিশ্বাস দোদুল্যমান থাকে। কিন্তু সচেতন থাকলে ধর্মবিশ্বাসীরাও ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে যে প্রতিহত করতে পারেন, তা এই ধরনের আরো অসংখ্য ঘটনা থেকে স্পষ্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *