দার্শনিক হিরাক্লিটাস

দার্শনিক হিরাক্লিটাস

[বিশ্বশান্তি সংসদ ১৯৬১ সালে যে সমস্ত জয়ন্তী পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন তার মধ্যে গ্রীক বস্তুবাদী দার্শনিক হিরাক্লিাটাস অন্যতম। তাঁহার ঐ সাৰ্দ্ধদ্বিসহস্রতম জন্মবার্ষিকী এই বিশেষ প্ৰবন্ধটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।]

বিশ্ববৈচিত্র্যের ব্যাখ্যানপদ্ধতিতে ‘দ্বন্দ্ব-সূত্রের প্রথম প্রবক্তা হিরাক্লিটাস ছিলেন গ্রাকদর্শনের প্রভাতীযুগের দার্শনিক। থেলিস থেকে হিরাক্লিন্টাস পৰ্য্যন্ত আনুমানিক ৬২৫-৪৭৫ খ্ৰীঃপূর্বাব্দ-ব্যাপী গ্রীকদর্শনের আদিপর্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বলিষ্ঠ বস্তুতান্ত্রিকতা। অবশ্য গ্রীকদর্শনের প্রামাণিক ইতিহাস-গ্রন্থগুলিতে প্রথম যুগের সীমারেখা টানা হয়ে থাকে লিউকিপ্লাস বা ডিমোক্রিটাস পৰ্যন্ত (বাৰ্ণেট ও য়্যুবারবেগ)। এ যুগবিভাগের নিশ্চয়ই একটা সংগত কারণ আছে। লিউকিপ্লাস ছিলেন কণাদ-কল্প দার্শনিকঅর্থাৎ পাশ্চাত্য চিন্তাজগতে পরমাণুবাদের প্রথম সূত্রকার। ডিমোক্রিটাস এই পরমাণুবাদের পরিপূর্ণ রূপকার। এরিষ্টেটলের মেটাফিজিক্স” অনুসারে ইনি বোধহয় ছিলেন প্ৰবীণ লিউকিপ্লাসের ঘনিষ্ঠ শিস্য ও সহকর্মী। পরমাণুবাদ বস্তুবাদের একটি সুনিশ্চিত গুরুত্বপূর্ণ বিকাশধারা। আদি পরমাণুবাদের পরের যুগটি প্রধানতঃ প্লেটো-এরিষ্টেটলের যুগ। এই দুই যুগের সন্ধিকাল পূর্ণ করেছেন প্রোটাগোরাস ও তার সোফিষ্ট সম্প্রদায় এবং স্বয়ং সক্রেটিস।

ডিমোক্রিটাস ছিলেন থেসের অধিবাসী, সোফিষ্টদের ও সক্রেটিসের সমসাময়িক। এথেন্সে তিনি একবার এসেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল অপরিচয়ের অবজ্ঞা। খাস গ্রীসের শিক্ষাসংস্কারের মধ্যেও বোধহয় র্তার দার্শনিক প্রতিভাকে অঙ্গীকার করার মত উপযুক্ত প্ৰস্তুতি তখন ছিল না। পরবর্তীকালে প্লেটো তার দুর্ধর্ষ বস্তুবাদ বরদাস্ত করতে পারেননি, তাই মনে হয়, ঘৃণায় তাঁর নামটা পর্য্যন্ত উল্লেখ করেন নি, তাঁর গ্রন্থগুলি আগুনে সৎকার করার সৎবাসনা প্ৰকাশ করেছিলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু প্লেটোর কল্পলোকবিহারী উত্তঙ্গ দর্শনের অনস্বীকাৰ্য্য প্রভাব সত্ত্বেও গ্রীকদের বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক প্রতিভাকে বিন্দুমাত্র স্নান করা সম্ভব হয়নি। এরিষ্টেটলের সর্বতোমুখী বিস্ময়কর মনীষা অন্ততঃ প্লেটোর “ভাব-নগরের” (World of ldeas) বিশুদ্ধ নাগরিকদের বিশেষ সন্মান দেখাতে রাজী হয়নি। এরিষ্টোটলের পরে আর একজন মহান মনীষী ইপিকিউরিয়াস ডিধোক্রিটাসের পরমাণুবাদকে পূৰ্বগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করেন, সঙ্গে সঙ্গে নিৰ্ভীক মানবিকতার আবেদন-সংবাহী এক সুনিয়ন্ত্রিত নীতিশাস্ত্র প্রবর্তন করেন। আর এক দিকে, প্ৰাচীন পিথাগোরাস যে বিশুদ্ধ ‘গণিত’শাস্ত্র প্রবর্তন কবে ছিলেন তারই ধারা ধারণ করে গণিতবিজ্ঞান নব নব শাখায় বিকাশ লাভ করে এবং বিশুদ্ধ ও ফলিত বিজ্ঞানের বহুক্ষেত্রে বস্তুমুখী গ্ৰীক প্রতিভা সুদূরপ্রসারী সাফল্য অর্জন করে।

কিন্তু ডিমোক্রিটাসের পরে গ্রাকদর্শনে বস্তুবাদী চিন্তাধারায় সাময়িক ছেদ ঘটেছিল বলেই, এবং বস্তুবিমুখ বিশুদ্ধ ভাববাদী দর্শনের চূড়ামণি প্লেটোর শাণিত তর্ক-তরবারির আঘাতেই প্ৰধানতঃ এই ছেদ ঘটানে| সম্ভব হয়েছিল বলেই দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাসে থেলিস থেকে ডিমোক্রিটাস পৰ্য্যন্ত নৃত্যুনাধিক আড়াইশ বছরের এই কালখণ্ডকে গ্রীক দর্শনের প্রথম পৰ্য্যায় বলে চিহ্নিত করা মোটেই অসংগত নয়। স্বয়ং এরিষ্টোটল এই যুগবিভাগের সাক্ষী। তথাপি থেলিস থেকে হিরাক্লিাটাস পৰ্য্যন্ত আনুমানিক দেড়শ বছরের একটা অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। কারণ, হিরাক্লিাটাস ছিলেন গ্রীকদর্শনে বস্তুবাদী ডায়লেক্‌টিক্সের শীর্ষবিন্দু। আর থেলিস ছিলেন। পুরাকল্পকাহিনীর অযত্নসিদ্ধ স্থূল বস্তুতন্ত্র থেকে মননশীল বস্তুবাদে উত্তরণের প্রথম সোপানভূমি। নিরন্তর দ্বান্দ্ৰিক গতিবাদী হিরাক্লিটাসের পর যে প্রধান পুরুষ দর্শনের দরবারে অবতীর্ণ হলেন তার নাম পারমেনাইডিস। তিনি প্রচার করলেন এক গতিহীন নিষ্কম্প অদ্বৈততত্ত্ব-গতি মিথ্যা, বহু মিথ্যা, দ্বন্দ্ব মিথ্যা, এক শ্বাশত স্থিতিশীল অখণ্ডসত্তাই একমাত্ৰ সত্য। গ্রীকদর্শনে হিরাক্লিাটাস পৰ্য্যন্ত প্ৰবাহিত বস্তুবাদী মননধারার পর পারমেনাইডিস হলেন সর্বপ্রথম বিপরীত ব্যতিক্রম। এ ব্যতিক্রম সম্পূর্ণ, কিন্তু সাময়িক। পারমেনাইডিসের জীবন শেষ না হতেই সিসিলি দ্বীপের আক্রাগাস অধিবাসী, তৎকালীন গণতান্ত্রিক শিবিরের বিশিষ্ট নেতা এমপিডোক্লিাস গ্রীক চিন্তাধারায় বস্তুতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রত্যাবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্ৰহণ করেন। রহস্যবাদী পিথাগোরীয় ধর্মমতের প্রভাব থেকে মুক্ত না হলেও বিশ্ববীক্ষণ পদ্ধতিতে হিরাক্লিন্টীয় দর্শনের গভীর বস্তুদৃষ্টি এমপিডেক্লিসের দার্শনিক মতকে সংগঠিত করতে সাহায্য করেছিল। তাছাড়াও এরিষ্টেটলের মতে ইনি ছিলেন অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রবর্তক এবং “গেলেনে”র মতে ইনি ছিলেন ইতালীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা। তথাপি বস্তুবাদী চিন্তাধারায় পারমেনাইডিস সর্বপ্রথম একটি বিশিষ্ট ও পরিপূর্ণ ব্যতিক্রম এ কথা চিন্তা করে থেলিস-হিরাক্লিাটাস যুগটিকে গ্ৰীক দর্শনের আদিপর্ব বলে চিহ্নিত করাই যুক্তিসংগত। “The Earlier lonic Natural Philosphy’ যুবারবেগের এই নামকরণ যথার্থ। এ নামকরণের বিশেষ তাৎপৰ্য্য হ’ল এই যে বিশ্বপ্ৰকৃতির বস্তুতান্ত্রিক বীক্ষণ ও ব্যাখ্যান প্রচেষ্টাতেই দর্শনের আদি অভ্যুদয়। বলা বহুল্য আদিপর্বের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী মূলতঃ বস্তুমুখী ও বিজ্ঞানমুখী হলেও প্রাথমিক অনুসন্ধিৎসার সময়ে চিন্তানায়কদের চিন্তাধারার মধ্যে কিছু পরিমাণে অকপট অবৈজ্ঞানিক স্থূলতা অপরিহাৰ্য্য।

তথাপি হিরাক্লিাটাস ছিলেন এযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক, র্যার সূক্ষ্ম বস্তুদৃষ্টি এই সহজ স্কুলতাকে বহুদূর অতিক্রম করেছিল, যার কাছে বিশ্ববিবর্তনের মৌলিক সূত্র সর্বপ্রথম ধরা পড়েছিল। হিরাক্লিন্টাস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জগতের অব্যৰ্থ নিয়ামক সূত্র ঘোষণা করলেন-বিপরীতের অন্তবিরোধের উপরেই ঐক্যের প্রতিষ্ঠা। এই ক্ৰমান্বয়ী ক্রমবিকাশশীল অন্তবিরোধ নিরবচ্ছিন্ন জাগতিক গতির নীতিসূত্র। এই গতিসূত্রের ভিত্তিতেই নব নব উন্মেষশালিনী বস্তুপ্রকৃতি নিত্য নূতন সৃষ্টির পথে অগ্রসর হয়। জগতের প্রত্যেকটি বস্তু এক অস্থির প্রবাহে প্ৰবাহিত। একই নদীতে দুবার নাম যায় না, একই সূৰ্য্য দুদিন ওঠে না। হিরাক্লিন্টাস বর্তমানযুগের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অসম্পূর্ণ আদিসূরি। তার দ্বান্দ্বিক গতিসূত্ৰকে, কোন কোন অংশে, সাংখ্যদর্শনের সহিত তুলনা করার কথা মনে হতে পারে। কেবল মাত্র গতির দিক থেকে বিচার করলে বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষণিক্যবাদ, কেবল মাত্র দ্বন্দ্রের দিক থেকে বিচার করলে সাংখ্যদর্শনের প্রকৃতি-পরিণামবাদ আংশিকভাবে হিরাক্লিটীয় দর্শনের সাদৃশ্যবাহী বলে ধারণা হতে পারে। কিন্তু সাংখ্য ও বৌদ্ধ যোগ করলেই হিরাক্লিাটাস হয় না, দ্বন্দ্ব আর গতি যোগ করলেই দ্বান্দ্বিক গতি হয় না। বস্তুর স্বাভাবিক অন্তবিরোধ বস্তুনিরপেক্ষ বিশুদ্ধতর্কের (formal logic) পরিধির মধ্যে বাধা পড়েনা বলে বৌদ্ধ সাংখ্য ও অদ্বৈতবেদান্ত পরিবর্তনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনটি বিভিন্ন বিভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শন পূর্বাপর ক্ষণসমূহের মধ্যে কোন অন্বয় বা বাস্তব যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারল না। আর ক্ষণিকবাদের অর্থ দাঁড়াল–প্রকৃতি discrete e discontinuous, সূক্ষ্যতম অসংখ্য বস্তুক্ষণের নিরন্বয় সমষ্টিমাত্র। প্রবাহবিধৃত এ সমষ্টিও বাস্তব নয়, “বিকল্পের” বিলাস মাত্র। তাই শেষ পৰ্য্যন্ত কাৰ্য্যকারণ সম্পর্কের কোন বাস্তব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া তাদের পক্ষে অসাধ্য হয়ে উঠল। বিজ্ঞানবাদ ও শূন্যবাদের মননশাস্ত্ৰে কাৰ্য্যকারণ-সম্বন্ধ একটা “বিকল্প” বা বুদ্ধি-নির্মিত ধারণামাত্ৰে পৰ্য্যবসিত হল। অদ্বৈত বেদান্ত পারমেনিডিসের মত গতি ও পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে ব্যাখ্যার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেল। সাংখ্য বস্তুনিহিত দ্বন্দ্ব ও গতিকে স্বীকার করে অনেক দূর অগ্রসর হয়েও শেষরক্ষা করতে পারল না, পরিবর্তন স্বীকার করেও নূতন বস্তুর উৎপত্তি স্বীকার করতে পারল না। কিন্তু হিরাক্লিাটাসের সার্থক বস্তুদৃষ্টি বস্তুনিরপেক্ষ “বৌদ্ধ-ন্যায়ের” (formal laws of thought) কাছে নতি স্বীকার করল না। তিনি নিরন্তর দ্বান্দ্ৰিক শক্তির মাধ্যমে নূতনের উদ্ভব-সূত্র উদ্ভাবন করলেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মূলতঃ বস্তু বুদ্ধিকে অনুসরণ করে না। কিন্তু বুদ্ধিই বস্তুকে অনুসরণ করে। ঠিক একথাটি তিনি তার সংক্ষিপ্ত পংক্তিগুলির মধ্যে ঘোষণা করেন নি। কারণ, জেনোর Paradox-এর দুষ্ট সরস্বতী তখনও জাগ্ৰত হয়নি। প্লেটোর বিচার-দ্বন্দ্বের কুট পদ্ধতি তখনও আবিস্কৃত হয় নি, এবং এরিষ্টোটলের ন্যায়শাস্ত্র তখনও জন্মলাভ করেনি, তাহলে হিরাক্লিাটাস স্পষ্ট ভাষায় বলে যেতে পারতেন–Contradiction যখন বস্তুর স্বভাবসিদ্ধ ন্যায়ধর্ম (The Natural Law of Things) তখন এরিষ্টোটলের Law of Contradiction সামগ্রিক দৃষ্টিতে অচল ও অক্ষম।

এরিষ্টোটল তার মেটাফিজিক্সের প্রথম খণ্ডে প্লেটো-পূর্ব দার্শনিকদের আলোচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করলেন-থেলিস থেকে আরম্ভ করে আদিপর্বের দার্শনিকদের মধ্যে একটা বিষয়ে ঐক্য সুস্পষ্ট। এরা সবাই মনে করেন যে বস্তু থেকে বস্তুর উৎপত্তি। বস্তুতেই বস্তুর লয়। বস্তুই বস্তুর আদি কারণ, বস্তুজগতের উৎপত্তি ও গতির জন্য এই জগতের বহির্ভূত কোন দ্বিতীয় বা নিমিত্ত কারণের প্রয়োজন নেই। অবশ্যই এরিষ্টোটল এই মতের বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন যে, আদি দার্শনিকদের এই মত থেকে কেউ মনে করতে পারেন যে বস্তুজগতের উৎপত্তি ও গতির জন্য উপাদান-কারণই যথেষ্ট, কোন সর্বশেষ সাধারণ নিমিত্ত কারণের প্রয়োজন নেই। কিন্তু মানুষের অগ্রগতির সঙ্গে একটা চেতন নিমিত্ত কারণের প্রয়োজন অনুভূত হল। কাঠ নিজের থেকেই পালঙ্ক তৈয়ার করেন, ব্রোঞ্জ নিজের থেকেই মুতি গড়ে না। অর্থাৎ উপাদানের অতিরিক্ত একজন চেতন কারিগরের প্রয়োজন। সুতরাং বস্তুজগতের নিমিত্তকারণ হিসেবে মূল বস্তুতে অন্ততঃ প্ৰাথমিক গতি-সঞ্চার করার জন্য এক শাশ্বত সত্তার উপস্থিতি আবশ্যক, যে নিজে গতিহীন, কিন্তু গতিসঞ্চারী। চেতন নিমিত্তকারণের স্বপক্ষে এরিষ্টেটলের এই যুক্তির সাংখ্যদর্শনের বিরুদ্ধে শংকর-প্ৰযুক্ত যুক্তির সাদৃশ্য উল্লেখযোগ্য, শয্যানির্মাণের উদাহরণটিতেও বিস্ময়কর মিল রয়েছে।

এরিষ্টোটল কর্তৃক সমালোচিত এই আদি বস্তুতন্ত্রের শিরোমণি সূত্রকার হিরাক্লিাটাস ঘোষণা করেন -“সর্বসাধারণের এই বস্তুজগৎ কোন দেবতা বা মানুষ সৃষ্টি করেন নি। বস্তুজগৎ এক চিরঞ্জাব অগ্নিস্বরূপ-চিরকাল ছিল, বর্তমানে আছে এবং চিরকাল থাকবে। এ আগুন প্ৰতিমুহূর্তে সমভাবে জলে আর নিভে” (অর্থাৎ প্ৰজ্বলন আর নির্বাপণ একই প্রক্রিয়ার দুইটি সমান্তরাল প্ৰকাশভঙ্গী)। হিরাক্লিটাসের বাচনীতি অনেকটা সংক্ষিপ্ত সূত্রাকার দৈববানীর মত, আপাতদৃষ্টিতে রহস্যময়। তখনকার ধর্মবিশ্বাসে দৈববাণীর প্রতিষ্ঠা বোধহয় হিরাক্লিটাসের বাক্য-বিন্যাসরীতির উপর অলক্ষ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তথাপি বিশ্বের সারবস্তুকে এক অনিৰ্বাণ অগ্নিরূপে কল্পনা করার ভিতরে কোন অতিপ্রাকৃত অতীন্দ্ৰিয় রহস্য লুকিয়ে নেই। এই কল্পনার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিমুহুর্তে পুরাতনের মৃত্যু ও নূতনের অত্যুদয়, অথচ প্রবাহরূপে এক অনির্বাণ অবিচ্ছিন্ন ঐকিক সত্তা,- এই বস্তুবাদী অদ্বৈত ধারণাকে প্ৰকাশ করার পক্ষে অগ্নিশিখা অপেক্ষা সার্থকতর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভারতীয় বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষণিকবাদের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানপ্ৰবাহ ও বস্তুপ্রবাহের ধারণা স্পষ্ট করার জন্য অগ্নিশিখার দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে, হিরাক্লিাটাস নদীর স্রোতের দৃষ্টান্তও টেনেছেন। তাহলে থেলিসের মত আদি বস্তুকে জল বলে কল্পনা করতে বাধা কোথায়। এখানেই অগ্নিকল্পনার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বপ্ৰকৃতিতে যে বস্তু মানুষের ধ্যানধারণার উপর সব চেয়ে বেশী প্রভাব বিস্তার করে তা হল সূৰ্য। সূৰ্য্যের সঙ্গে পৃথিবীর সম্বন্ধ সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ। সূৰ্য্য একটি প্ৰজ্বলিত অগ্নিপিণ্ডরূপেই প্ৰতিভাত-“উজ্জ্বলতম, বিশুদ্ধতম, উত্তপ্ততম অগ্নির আধার। এই সূৰ্য্য।” আকাশের অগণিত নক্ষত্ৰকেও এক একটি অগ্নিময় বস্তুলোক বলে ধারণা করাই স্বাভাবিক। হিরাক্লিাটাসের দর্শন ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে পরবত্তী যুগে থিওফ্রেস্টাস বলেছেন—হিরাক্লিটাসের মতে সূৰ্য্য যেন একটা প্ৰজ্বলিত অগ্নিপাত্র; তার অনাবৃত মুখের দিকটা পৃথিবীর দিকে ফেরানো; সাগরের উত্তপ্ত নিশ্বাস শুষে নিয়ে সেই মুখ দাউ দাউ করে জলছে। বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত এই মহাগ্নিকে সর্ববস্তু সর্বতেজ ও সর্বশক্তির আধার বলে কল্পনা করা হিরাক্লিটাসের পক্ষে সঙ্গত ও স্বাভাবিক। বস্তুজগৎ এই অনাদি অগ্নির প্ৰজ্বলিত প্রবাহ। জরাথুষ্টীয় ধর্মমতে অগ্নির ঐশ্বৰ্য্য প্ৰতিফলিত। ঋগ্বেদের প্রারম্ভ। অগ্নিতেজে দীপ্তিমান। ঈশোপনিষদের ঋষি প্রার্থনা করেছেন -“হে সূৰ্য্য, তোমার সত্যের মুখ স্বর্ণপাত্রে ঢাকা। এই মুখ তুমি খুলে দাও, আমাদের সত্যদৃষ্টি অবারিত হোক।” স্পষ্টতই প্ৰভাতের সূৰ্য্যকে সমগ্রতেজে আবিভূতি হবার জন্য এ উদাত্ত আবেদন। প্ৰসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য ঈশোপনিষদের শাংকরী ব্যাখ্যায় অনেক কষ্ট-কাল্পনিক অপব্যাখ্যার সুস্পষ্ট ছাপা পড়েছে। এই সূৰ্য্যপ্রার্থনার ঠিক পূর্বের শ্লোকটির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।-“সৃষ্টি ও ধ্বংসকে যে একই সঙ্গে জানে সে ধ্বংসের দ্বারা মৃত্যুকে অতিক্ৰম করিয়া সৃষ্টির দ্বারা অমৃত ভোগ করে।” ঠিক এর পরেই সুৰ্য্যের স্বর্ণ/বরণ অবারিত করার প্রার্থনা। ঈশোপনিষদের বহু শ্লোকে বস্তুজগতের প্রক্রিয়া সম্পর্কে দ্বান্দ্ৰিক চিন্তার ইঙ্গিত রয়েছে।

হিরাক্লিাটাস ছিলেন এশিয়া মাইনরের গ্রীক উপনিবেশ এফিসাসের অধিবাসী। গ্ৰীকদর্শনের আদিপর্বের বস্তুবাদী দার্শনিকগণ কেহই মূল গ্রীসের অধিবাসী ছিলেন না। থেলিস, এনাক্সিমেন্তার, এনাক্সিমেনিস, ও হিরাক্লিটাস এরা সকলেই ছিলেন আয়োনিয়ার অধিবাসী। এশিয়া মাইনরের উপকূলভাগ ও তার সমীপবর্তী দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে যে গ্ৰীক উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল তখন তার নাম ছিল আয়োনিয়া। পিথাগোরাস, পারমেনিডিস, এমপিডোক্লিস, লিউকিপ্লাস, ডিমোক্রিটাস, প্রথম যুগের এইসব বিশিষ্ট দার্শনিকরাও কেহই খাস গ্রীসের অধিবাসী ছিলেন না। এনাক্সাগোরাসের জন্ম ও শিক্ষা-দীক্ষা আয়োনিয়ায়, যদিও পরে তিনি পেরি ক্লিসের আমন্ত্রণে এথেন্সে বসবাস করেছিলেন। পিথাগোরাস সামোস থেকে দক্ষিণ ইতালীর ক্রোটনে চলে যান। লিউকিপ্লাস আয়োনিয়ার নগরী মিলেটাসের অধিবাসী, যেখানে থেলিস গ্রীক দর্শনের গোড়াপত্তন করেন। গ্রীক দর্শনের শৈশব কৈশোর ও যৌবনের এই স্থানগত বৈশিষ্ট্য নিশ্চয়ই অনুধাবনযোগ্য। বিশেষ করে গ্রীকদর্শনের প্রথম চারণভূমি এথেনীয় গ্রীস না হয়ে আয়োনিয়া হ’ল কেন এ প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক।

মার্ক্সীয় দর্শন যে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের সূচনা করেছে, সেই মতে কোন সমাজের সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারণা, তার শিল্প সাহিত্য দর্শন সেই সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের পরোক্ষ প্ৰতিচ্ছবি। এই মত বর্তমানকালে ব্যাপকতম স্বীকৃতি লাভ করেছে। অবশ্য দর্শনের গবেষণায়, বিশেষত প্ৰাচীন দর্শনের ইতিহাস বীক্ষণে এই দৃষ্টিভঙ্গী প্রয়োগ করতে গিয়ে কোন হঠকারী যান্ত্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার বিরুদ্ধে যথেষ্ট হুশিয়ারী থাকা প্ৰয়োজন। অনেক সময়ে বলা হয়ে থাকে যে, সমাজে শ্রেণীবিভাগের আবির্ভাবের পূর্বে ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী দর্শনের আবির্ভাব সম্ভব নয়। বস্তুজগৎ সত্য না বস্তুনিরপেক্ষ বিশুদ্ধ জ্ঞানসত্তাই সত্য, বস্তু ও জ্ঞানের দ্বন্দ্ব-বন্ধুর এই তর্কময় তত্ত্বজিজ্ঞাসার প্রথম আবির্ভাব তখনই সম্ভব যখন সমাজে বিপরীতমুখী স্বাৰ্থদ্বন্দ্বের প্রতিনিধিস্থানীয় দুইটি শ্ৰেণী আবিভূতি হয়েছে; যখন একদিকে এজাতীয় তত্ত্বনির্ণয়ে কালক্ষয় করার মত অবসর ভোগী পরশ্রমোপজীবী এক শাসক ও শোষক শ্রেণী, অপরদিকে এই পরভুক শ্রেণীর বিলাসব্যসন ও বাঁচার উপকরণ উৎপাদনে ব্যস্ত শ্ৰমমাত্র সম্বল এক শাসিত ও শোষিত শ্রেণী আবিভূতি হয়েছে। সমাজের ইতিহাসে একথা সত্য বলেই প্রমাণিত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে  আরও একটু বলা প্রয়োজন যে শুধু ভাববাদী দর্শন কেন, দার্শনিক চিন্তার প্ৰথম উন্মেষ যে বস্তুবাদী দর্শন তারও উৎপত্তি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ ছাড়া সম্ভব নয়। তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও বিশ্ববীক্ষণ ব্যতীত কোন চিন্তাকে দার্শনিক চিন্তা বলা যায় না। এ জাতীয় চিন্তায়, তা যতই প্ৰাথমিক স্তরের হ’ক না কেন, কিছু-পরিমাণে যুক্তি ও সূক্ষ্মমননের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। সূক্ষ্ম মননের উপযোগী ব্যাকরণের নিয়মনিয়ন্ত্রিত ভাষাবিন্যাস-কৌশলও আয়ত্তে থাকা আবশ্যক। ইন্দ্ৰিয়লব্ধ অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণের (universalization) দ্বারা বিমূর্ত ভাবধারণার (abstract concepts) সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। হিরাক্লিটাসের সংক্ষিপ্ত ও খণ্ডিত গ্রন্থের পংক্তি কয়টির দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়, এজাতীয় জটিল ভাবনার অভ্যুদয় প্ৰাচীনতম শ্রেণীহীন সমাজে কল্পনা করা যায় না। কঠোর কায়ক্লেশে কোনও রকমে জান্তব জীবন বাঁচিয়ে রাখার দায় থেকে মুক্ত এক পরাভুক অবসর ভোগী শ্রেণীর উদ্ভব না হলে প্রথম যুগের বস্তুবাদী মনন ও ভাবনাও সম্ভব হতনা। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে। কিন্তু শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থার ভিতরেই সূক্ষ্ম মননের উপযোগী অবসর মেলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী।

আদি দর্শনের উৎপত্তির প্রশ্নটি অন্য এক দিক থেকেও বিচার করা যেতে পারে। প্রথম যুগের তত্ত্বজিজ্ঞাসার স্বরূপ কি? মূলতত্ত্ব বস্তু না জ্ঞান-এ DBBB DBDD DY S S BDBDBBD BDBB DBD D DBDBS BDD ছিল প্ৰাথমিক জিজ্ঞাসার রূপ। একথা যেমন গ্ৰীক দৰ্শন সম্পর্কে তেমনই ভারতীয় দর্শন সম্পর্কেও সত্য। এক বিজ্ঞানস্বরূপ অদ্বৈততত্ত্বের তুলনায় এক মূল-বস্তুতত্ত্ব থেকে বহুর উৎপত্তির ধারণা প্রাচীনতর। সে তত্ত্ব বস্তু না বিজ্ঞান এ পরিবর্তীকালের প্রশ্ন। লক্ষ্য করার বিষয় যে অদ্বৈতবাদী পারমেনিডিসও তার অদ্বৈততত্ত্বকে কোথাও বিজ্ঞানস্বরূপ বলেননি। অবিশ্য গতি, পরিবর্তন ও বহুত্বকে অস্বীকার করার যুক্তিসঙ্গত পরিণতি হিসাবে বস্তুজগতও বিলুপ্ত হয়, তখন অদ্বৈততত্ত্বে বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। পারমেনিডিস নিজে তাঁর মতবাদের এই যৌক্তিক পরিণতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিনা জানা যায়না। আদিম শ্রেণীহীন গোষ্ঠীসমাজে যেমন বস্তু ও জ্ঞানকে বিভক্ত করা সম্ভব ছিল না তেমনি এক ও বহুকেও পৃথকভাবে বিচার করা সম্ভব ছিল না। শ্রম বিভাগ, উদ্বত্ত উৎপাদন, পণ্যের উৎপত্তি, মুদ্রাপ্ৰচলন ও লৌহনির্মিত যন্ত্রপাতির আবির্ভাবে যখন আদিম গোষ্ঠীসমাজে ভাঙ্গন ধরলা, একের ভিতরে যখন শ্রেণী:স্বার্থের সংঘাত উপস্থিত হল, এক যখন দ্বিধা ত্ৰিাধা বহুধা বিভক্ত হল, তার পূর্বে সমাজমানসে এক ও বহুর দার্শনিক তত্ত্বজিজ্ঞাসা জাগ্রত হয়নি। একের অন্তরে বহুর আবির্ভাবের এই সামাজিক প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা বহুদিন ধরে সমাজমানসে সঞ্চিত হয়েছে আর তারই তাত্ত্বিক রূপ এক ও বহুর সম্বন্ধজিজ্ঞাসায় বস্তুবাদী বিশ্ববীক্ষণে প্ৰতিফলিত হয়েছে।

ব্রোঞ্জযুগ ও মিশেনীয় সভ্যতার অবসানে নূতন গ্ৰীক সভ্যতা লৌহ হাতিয়ারের আশীৰ্বাদ নিয়ে জন্মলাভ করল। শ্রেণীভেদ ও শ্রমবিভাগ তীব্রতর হল। উদ্বত্ত উৎপাদনের পরিমাণ বহুপরিমাণে বেড়ে গেল, পণ্যের বাজার বিস্তৃতি লাভ করল, মুদ্রার প্রচলন ব্যাপকতর হল, অভিজাত ভূস্বামী, দাস ও স্বাধীন কারিগরের সঙ্গে বণিকশ্রেণীর আবির্ভাব ঘটল। এই নূতন পণ্যসভ্যতার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠল গ্রীক উপনিবেশ আয়োনিয়া। খাস গ্রীসের তুলনায় আয়োনিরায় এই সভ্যতা বিস্তারের সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশী। বেবিলন, লিডিয়া, পাশিয়া, ফিনিসিয়া ও মিশরের সহিত আয়োনিয়ার প্ৰত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এই অর্থনৈতিক যোগাযোগ সাংস্কৃতিক যোগাযোগের পথ উন্মুক্ত করে দিল। মিশর ও বেবিলনের বৈজ্ঞানিক প্রতিভার সঙ্গে আয়োনিয়ার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটল। ক্রমবিস্তারশীল পণ্য-সভ্যতার অন্তরালে আয়োনিয়ান সমাজের অন্তদ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে উঠল। এ সভ্যতা ছিল মূলত দাস শ্রমের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং এ সভ্যতার সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতার কথা একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন। একদিকে অভিজাত ভূস্বামীদের সঙ্গে ধনষ্ফীত বণিকশ্রেণীর সংঘাত, অন্যদিকে শ্রমজীবী নিপীড়িত শ্রেণীর অসন্তোষ বিক্ষোভ ও বিদ্ৰোহ আয়োনিয়ান নগরীগুলিতে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। এইভাবে মিশর বেবিলনের প্রাচীন বস্তুবিজ্ঞানের সহিত এক অন্তদ্বদ্বাকীর্ণ সমৃদ্ধিশালী নূতন পণ্য-সভ্যতার মিলনভূমি হিসেবে গড়ে উঠল গ্ৰীক অয়োনিয়ার সমাজমানস। প্ৰথম শ্রেণীবিভক্ত সমাজে বহুমুখী ভাঙাগড়ার পটভূমিতেই আয়োনিয়ান গ্ৰীকমানসে বস্তুতান্ত্রিক তত্ত্বজিজ্ঞাসার প্রথম উন্মেষ সম্ভব হয়েছিল।

এক সমন্বিত আদিম গোষ্ঠীসমাজ থেকে বহুধাবিদীর্ণ দাসশ্রমভিত্তিক সমাজে উত্তরণের এই দীর্ঘ দ্বান্দ্ৰিক প্রক্রিয়া সমাজমানসের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। সমাজবাস্তবের এই বিবতন প্রক্রিয়া হিরাক্লিাটাসের দ্বান্দ্রিক দর্শনের বিশ্ববীক্ষায় পরোক্ষভাবে প্ৰতিফলিত হয়েছে, বলা বাহুল্য এক মূৰ্ত্ত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার এই বিমূৰ্ত্ত সাধারণীকরণ ঘটেছিল অলক্ষ্যে, দার্শনিক-মনের অবচেতন অন্তরালে। তথাপি একহিসেবে হিরাক্লিাটাস ছিলেন আদিপর্বের দার্শনিকদের মধ্য সবচেয়ে সমাজ-সচেতন। আয়োনীয় দার্শনিক সম্প্রদায় কিন্তু রাজনীতি-ক্ষেত্রেও সক্রিয় অংশ গ্ৰহণ করেছিলেন। হিরোডোটাসের মতে থেলিস সমগ্র আয়োনিয়াকে নিয়ে, টিয়াস নগরীকে রাজধানী ক’রে, একটি যৌথরাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিলেন। থেলিসের মৃত্যুর পর আয়োনিয়ার রাজনৈতিক জীবনে অন্তদ্বন্দ্ব, বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। দাস ও প্রভুর মৌলিক সংঘাতের পরিধির অভ্যন্তরে অভিজাত ভুস্বামীশ্রেণী ও পণ্যবাহী বণিকতন্ত্রের সংঘৰ্য প্ৰচণ্ড আকার ধারণ করল। হিরাক্লিাটাস এ সংঘাতের নিরপেক্ষ দর্শকমাত্র ছিলেন না। তিনি অভিজাত প্ৰতিক্রিয়ার পক্ষে এবং গণতন্ত্র ও জনসাধারণের বিপক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। গণতন্ত্র, বণিকতন্ত্র ও জনসাধারণের প্রতি তার অবজ্ঞা ও শ্রেণী-বিদ্বেষ ছিল অপরিসীম। নিজ শ্রেণী স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি এই সংঘাতের তাৎপৰ্য্য বুঝতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন তাঁর অভিজাত শ্রেণীকে বাঁচতে হলে তীব্ৰ সংঘর্ষের ভিতর দিয়েই বাঁচতে হবে। এফিসিয়া থেকে তাঁর ভ্রাতার নির্বাসনের পর গণতন্ত্র ও জনসাধারণের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা আরও প্রবল হয়ে উঠল। শুধু আয়োনীয় সমাজের অন্তদ্বন্দ্বই নয়, তিনি তার জীবনে পারস্যের আধিপত্যের বিরুদ্ধে আইয়োনিয়ান গ্রীকদের সফল বিদ্রোহও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সুতরাং বস্তুজগতের অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁর কাছে একটি দার্শনিক তত্ত্বমাত্র ছিলনা। এই তত্ত্বকে তিনি তাঁর শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজজীবনে প্ৰতিফলিত হতে দেখেছিলেন। বস্তু প্ৰকৃতির গতিধর্ম ও অন্তদ্বন্দ্ব তার পূর্ববর্তী মিলেশীয় দার্শনিকদের ধারণাতেও ধরা পড়েছিল। মিলেশীয় এনাক্সিমেণ্ডারও বিপরীতের দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি এই দ্বন্দ্বকে নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছিলেন। তিনি এই দ্বন্দ্বকে অন্যায় মনে করতেন এবং সমন্বয়ের ভিতরে দ্বন্দ্বের অবসানের পথ খুঁজেছিলেন। কিন্তু হিরাক্লিাটাস অন্তর্দ্বন্দ্বকে অনতিক্রমণীয় বস্তুস্বভাব হিসাবে দেখেছিলেন। তাঁর মতে ঐক্য সাময়িক ও আপেক্ষিক, কিন্তু সংঘর্ষ সর্বাত্মক। তাই সংঘৰ্ষই ন্যায়ধর্ম। সমাজের মূল সংঘর্ষ যে প্ৰভু ও দাসের ভিতরে এ উপলব্ধি তার ছিল। “যুদ্ধ সকলের পিতা, সকলের প্রভু। যুদ্ধই দেবতা ও মানুষ সৃষ্টি করেছে। স্বাধীন মানুষ ও দাসদের সৃষ্টি করেছে”-এ,উক্তি হিরাক্লিটাসের। বস্তুজগতে বিপরীতের বিরোধকে তিনি যুদ্ধের নৈতিক ন্যায্যতায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। হোমার যুদ্ধের অবসান কামনা করেছিলেন বলে হিরাক্লিন্টাস তাকে ক্ষমা করতে পারেন নি। “হােমার বুঝতে পারেন নি যে তিনি জগতের ধ্বংসের কামনা করছেন, তার প্রার্থনা চরিতার্থ হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।” “হোমারকে চাবুক মারা উচিত।” বিশ্বমনীষার ইতিহাসে হিরাক্লিাটাস যে অমোঘ দার্শনিক সত্য আবিষ্কারের প্রথম গৌরব অর্জন করেছিলেন, তার নিজ শ্রেণীস্বার্থের কলুষিত দৃষ্টিভঙ্গী সেই সত্যকে অপব্যাখ্যার স্তরে টেনে নামিয়েছিল। বিপরীতের অন্তদ্বন্দ্বই যে একদিন শ্রেণীহীন যুদ্ধহীন উচ্চতম মানবিক সভ্যতা গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হবে এ বিশ্বাস ও দূরদৃষ্টি সে যুগের হিরাক্লিটাসের কাছ থেকে আশা করা অন্যায় অতিরিক্ত ও অসঙ্গত।

হিরাক্লিন্টাসের সূক্ষ্ম সমাজ চেতনার দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি সূত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। বার্গেট ও টমসন উভয়েই এই সূত্রটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন -“অগ্নির বিনিময়ে সকল বস্তু, সকল বস্তুর বিনিময়ে অগ্নি; যেমন স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে পণ্যদ্রব্য, পণ্যদ্রব্যের বিনিময়ে স্বর্ণমুদ্রা।” সূত্রের উপমাটি খুবই তাৎপৰ্য্যপূর্ণ। পণ্যসঞ্চারী সমাজে সহস্র পণ্যের সঞ্চালনশক্তি মুদ্রাতে কেন্দ্রীভূত, কারণ মুদ্র পণ্যমূল্যের ঘনীভূত প্ৰকাশভূমি। এই সর্বশক্তিময়ী আধারশক্তি থেকে পণ্যসমূহ আপন গতি্‌, শক্তি আহরণ করে। বিনিময়প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুদ্রাদেবী যেন আপনাকে সহস্ররূপে বিকশিত করে। তেমনি বিশ্ববিবর্তনের মূল গতিশক্তি অগ্নিতে কেন্দ্রীভূত। বিবর্তন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্নি আপনাকে অজস্ররূপে অনাদিকাল ধরে প্রকাশ করে চলেছে।

হিরাক্লিটাসের মতে এক ও বহু উভয়েই সত্য। প্রতিক্ষণে পুরাতনের মৃত্যু ও নূতনের অভ্যুদয় ঘটছে—তাই বস্তু বহু ও অনন্ত। আবার নিরবচ্ছিন্ন প্ৰবাহবিধৃত সমষ্টি হিসাবে বস্তু একও বটে। “তাই আমরা একই নদীতে নামি আবার নামি না”—এখানে হিরাক্লিাটাস বৌদ্ধমতের একদেশী দৃষ্টিকে অতিক্রম করেছেন। বৌদ্ধমতে সন্তান বা প্রবাহ মূলত সত্য নয়। উহা সংবৃতি, বিকল্প বা বস্তুশূন্য বুদ্ধিনির্মিত ধারণামাত্র। প্রবাহপতিত এক একটি বস্তুক্ষণই শুধু সত্য। তেমনি অবয়ব বা অংশগুলিই একমাত্র সত্য, অবয়বী, অংশী বা সমুদয় (the whole) মিথ্যা। সুতরাং বৌদ্ধমতে organic ৭unity-ও বিকল্প মাত্র। হিরাক্লিটাসের মতে একটি বস্তু ঐ একই ক্ষণে এক ও বহু। কারণ, বিপরীতের দ্বৈত-দ্বন্দ্ব ছাড়া একের ঐক্য সম্ভব নয়। একের অভ্যন্তরেই উন্মেষমুখী নূতনের সাথে পুরাতনের বিরোধ আরম্ভ হয়। বৌদ্ধমতে একক্ষণের বস্তু সম্পূর্ণ এক ও অদ্বৈত। পূর্বক্ষণ কখনও পরীক্ষণের বস্তুকে গর্ভে ধারণ করে না। এই নিরন্বয় ক্ষণবাদ দ্বান্দ্রিক দর্শনের বিরোধী। হিরাক্লিটাস বলেন “Men do not know how what is at variance agrees with itself. It is an attunement of opposite tensions like that of the bow and the lyre” (fragment-45). “Couples are things whole and things not whole, what is drawn together and drawn asunder, the harmonious and the discordant. The one is made up of all things and all things issue from the one” (fragment-59)” যাহা মৃত্যুশীল তাহা অমর, যাহা অমর তাহা মৃত্যুশীল। একের মৃত্যুতে অন্য বাঁচে, একের বাঁচায় অন্য মরে” (fragment:-60)। বস্তুর অন্তরে বিপরীতের বিরোধ এবং বিরোধের মারফত প্ৰতিমুহূর্তে বস্তুর পরিবর্তন—এই বস্তুনীিতি সাংখ্যদর্শনে স্বীকৃত। পরিবর্তনের তিনটি ধারা-ধর্মপরিণাম অবস্থাপরিণাম ও লক্ষণপরিণাম সম্পর্কে যোগদর্শনের ব্যাসভান্যে প্ৰাঞ্জলভাবে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু তথাপি সাংখ্যযোগদর্শন পুরাতনের মৃত্যু ও নূতন বস্তুর জন্ম স্বীকার করতে পারল না। পরিবর্তন মানে পুরাতনের নিত্য নূতন প্রকাশভঙ্গী মাত্র। যাহা অব্যক্ত ছিল তাহারই অভিব্যক্তি মাত্র। এই দুর্বলতা,  “formal law of thought”-এর নিকট দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর এই নতিস্বীকার সাংখ্যদর্শনকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ থেকে সরিয়ে রাখল। (চৈতন্য-স্বরূপ বহু আত্মার প্রসঙ্গ আর তুলছিনা।)

বৌদ্ধ ও সাংখ্যদর্শনের এই দ্বিবিধ দুর্বলতা হিরাক্লিন্টাসকে স্পর্শ করেনি। তিনি পিথাগোরাসের বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব স্বীকার করেছেন, কিন্তু দার্শনিক ও ধর্মীয় মতের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বহু বিষয়ের জ্ঞান থাকা ভাল। কিন্তু বহুর জ্ঞান থাকলেই লোক বিজ্ঞ হয় না। বিশ্ববিবর্তনের মূল নিয়ামক সূত্র সম্পর্কে গভীর দৃষ্টি অর্জন করাই বিজ্ঞতা (fragments-16, 17, 18, 19)। এই নিয়ামকসূত্ৰকেই তিনি বলেছেন logos, যার ইংরেজী অনুবাদ করা হয়ে থাকে word, (fragments-1, 2)। সে যুগে বহুল প্রচারিত ডায়োনেশীয় ধর্মমতের রহস্যময় ক্রিয়াকলাপকে তিনি তীব্ৰতম ভাষায় আক্রমণ করেছেন (framents 126-180)। আয়োনিয়ার দার্শনিকগণ প্রথম থেকেই মূল গ্রীসের তুলনায় ধর্মীয় সংস্কার থেকে অনেক বেশী মুক্ত ছিলেন।

আধুনিক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের সকল কয়টি সূত্র প্রাচীন হিরাক্লিটাসের কাছ থেকে আশা করা যায় না। তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রাথমিক রূপকার, প্ৰাচীন মনীষীদের মধ্যে অব্যৰ্থ বস্তুসত্যের সার্থকতম নমস্যতম আবিষ্কারক। আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের প্রথম প্ৰবক্তা ছিলেন নিগৃহীত নিপীড়িত মানবের মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতা, আর প্রাচীন যুগের দ্বান্দ্ৰিক বস্তুবাদের প্রথম সূত্রকার ছিলেন লাঞ্ছিত জনতার শত্রুশিবিরের সদস্য ও সমর্থক-এও বোধ হয় ইতিহাসে দ্বান্দ্ৰিক প্রক্রিয়ার এক চমৎকার অভিব্যক্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *