১৮. বাংলা গদ্য সাহিত্য

বাংলা গদ্য সাহিত্য

উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগৃতির সার্থক রূপায়ণে সাহায্য করেছিল বাংলা গদ্য ভাষা। এর সূচনা আঠারো শতকেই হয়েছিল। লোক গদ্যেই কথা বলত। তা ছাড়া দলিলাদি সম্পাদন ও অন্যান্য বৈষয়িক কাজকর্মে গদ্যই ব্যবহৃত হত। চিঠিপত্রও গদ্যে রচিত হত। ১৭৭১ ও ১৭৭২ খ্রীস্টাব্দে লিখিত মহারাজ নন্দকুমারের দুখান সুদীর্ঘ চিঠি পাওয়া গিয়েছে। পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর সম্পাদিত ‘চিঠিপত্রে সমাজচিত্ৰ’ নামক পুস্তকে অষ্টাদশ শতাব্দীর অনেক চিঠির নমুনা দিয়েছেন। নবদ্বীপাধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের একখানা দানপত্রও পাওয়া গিয়েছে। সাহিত্যও গদ্যে রচিত হত। ১৭৫০ খ্রীস্টাব্দে লিখিত এক পুথি থেকে দীনেশচন্দ্ৰ সেন এক উদ্ধৃতি দিয়েছেন। উদ্ধৃতিটি-’পরে সেই সাধু কৃপা করিয়া সেই অজ্ঞান জনকে চৈতন্য করিয়া তাহার শরীরের মধ্যে জীবাত্মাকে প্ৰত্যক্ষ দেখাইয়া পরে তাহার বাম কৰ্ণেতে শ্ৰীচৈতন্য মন্ত্র কহিয়া পরে সেই চৈতন্য মন্ত্রের অর্থ জানাইয়া পরে সেই জীব দ্বারা-এ দশ ইন্দ্ৰিয় আদিযুক্ত নিত্য শরীর দেখাইয়া পরে সাধক অভিমানে শ্ৰীকৃষ্ণাদির রূপ আরোপ চিন্তাতে দেখাইয়া পরে সিদ্ধি অভিমান শ্ৰীকৃষ্ণাদির মুক্তি পৃথক দেখাইয়া প্রেম লক্ষণার সমাধি ভক্তিতে সংস্থাপন করিলেন।’ হরপ্ৰসাদ শাস্ত্রীও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত ‘স্মৃতিকল্পদ্রুম’’ নামে এক বাংলা গদ্যগ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। রমেশচন্দ্ৰ মজুমদারও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত বাংলা গদ্যগ্রন্থের মধ্যে কুচবিহারের রাজমুনশী জয়নাথ ঘোষের ‘রাজোপাখ্যান’, ‘ভাষা পরিচ্ছেদ’ নামক সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলা গদ্য অনুবাদ ও ‘বৃন্দাবনলীলা’ নামক গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। ‘বৃন্দাবনলীলা’র গদ্যের নিদর্শন -’কৃষ্ণ যে দিবস ধেনু লইয়া এই পর্বতে গিয়াছিলেন সে দিবস মুরলির গানে যমুনা উজান বহিয়াছিলেন এবং পাষাণ গালিয়াছিলেন।’

এছাড়া, খ্রীস্টান মিশনারীরাও খ্রীস্টধর্ম প্রচারের জন্য বাংলা গদ্যে ছোট ছোট পুস্তিকা রচনা করে গিয়েছেন। তবে এগুলো সব রোমান হরফে ছাপা। এরূপ গ্রন্থের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে ১৭৪৩ খ্রীস্টাব্দে দম আস্তোনিও (ভূষণার এক ধর্মান্তরিত হিন্দু) রচিত ‘ব্ৰাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’। নীচে এই বইয়ের গদ্য ভাষার নমুনা উদ্ধৃত করা হচ্ছে—‘রামের এক স্ত্রী তাহার নাম সীতা দুই পুত্রো লব আর কুশ তাহার ভাই লকোন। রাজা অযোধ্যা বাপের সত্য পালিতে বোনবাসী হইয়াছিলেন। তাহাতে তাহান স্ত্রীকে রাবোনে ধরিয়া লিয়াছিলেন। তাহান নাম সীতা। সেই স্ত্রীরে লঙ্কাত থাক্যা বিস্তর যুর্দো করিলেন।’ আর একখানি মিশনারী গ্ৰন্থ মানোএল-দা-আসুম্পসাঁম নামে এক পর্তুগীজ পাদ্রী কর্তৃক ১৭৩৪ খ্রীস্টাব্দে ঢাকার নিকটবর্তী ভাওয়ালে বসে রচিত ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’। এর ভাষার নিদৰ্শন–’আমার কেহ নাহি, কেবল তুমি আমার এবং আমি তোমার; আমি তোমার দাসী; তুমি আমার সহায়, আমার লক্ষ্য আমার ভরসা। তোমার আশ্রয়ে বিস্তর পাপী অধমে, যেমত আমি, উপায় পাইল। তবে এত অধমেরে যদি উপায় দিবা, আমারেও উপায় দিবা।’।

বাংলা গদ্যসাহিত্যের এখানে যে উল্লেখ করা হল, তা থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলা গদ্য লেখবার একটা রীতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল, যদিও এটা বিশেষভাবে উৎকর্ষতা লাভ করেছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রামমোহন রায় ও অন্যান্য অনেকের রচনাতে। আগেই বলেছি যে এই গদ্যসাহিত্যই উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগৃতির সার্থক রূপায়ণে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *