1 of 2

২৬. কুলসুমের হাতের তালুর স্পন্দনে

কুলসুমের হাতের তালুর স্পন্দনে চেরাগ আলির গলায় মুনসির শোলোকের ডাকে তমিজের বাপ চোখ মেলে। চোখ মেলতেই তার চোখ ফের খুঁজে যায়। নয়নের মাঝখানে সে দেখে, বাঙালি নদীর বোগা স্রোত ধরে তার নৌকা চলেছে পোড়াদহের দিকে। স্রোত রোগা হলে কী হয়, দেড় মণ ওজনের বাঘাড় মাছ আর দুই-দুইজন পুরুষমানুষশুদ্ধ নৌকাটিকে নিজের শরীরের ওপর নাচায় শালী নটিমাগীর মতো। স্রোতের দুলুনিতে ঘুম আরো গাঢ় হয়। নৌকায় একা জাগে তমিজের বাপ, আর জাগে। বৌডোবা দয়ের বাঘাড়। কী মস্ত বড়ো বাঘাড় গো! দুই মণের কম নয়। তমিজের বাপের দাদা বাঘাড় মাঝি নাকি তিন মণ বাঘাড় ধরেছিলো? তা হোক, দাদা তার একটু ওপরেই থাক। এই বাঘাড় কি দাদার মাছের নাতি? না-কি তারও বেটা? তা সেদিক থেকে বাঘাড় মাছটার সঙ্গে তমিজের বাপের একটা আত্মীয়তা তো আছেই। তমিজের এ বাপ ভালো করে মাছটার শরীর দেখে। তারার আলোয় তার গায়ের চখরখরা দাগ ঝাপসা হলদেটে দেখায়। বয়সের ছোপলাগা ছাই রঙের বাঘাড় মাছটার একটা চোখ স্থির হয়ে ছিলো তারার দিকে। তা বয়সের চাপেই হোক আর আত্মীয়তা থেকেই হোক, তমিজের বাপের কর্তৃত্ব সে মেনে নিয়েছিলো। কী জানি, বাঘাড় কেন এমন চুপচাপ হয়ে গেলো কে জানে? নৌকা বাওয়াই কি আর তমিজের বাপের নিজের কবজায় ছিলো? মনে হয় না।-পোড়াদহ মাঠের বটগাছের পাশ দিয়ে নৌকা যে কখন পার হয়ে গেলো সে বুঝতে পারলো না। পোড়াদহ মেলার বটতলায় তো তখন ঠাকুরের পূজা চলছে ধুমসে। সন্ন্যাসী ঠাকুরের পায়ের নিচে মানতের জোড়া জোড়া পায়রা বাঁধা অবস্থায় পড়তে শুরু করেছে, কতো দূর থেকে জটামাথা সন্ন্যাসীরা দলে দলে এসে বসে গেছে গাঁজার কলকে। হাতে। এসব কিছুই তার চোখে পড়লো না? কেন? নৌকার পাটাতনের এক কোণে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমায় বুধা আর গোটা পাটাতন জুড়ে শুয়ে শুয়ে বাঘাড় কী ফন্দিই আঁটে যে, পোড়াদহ মেলার ঘাট তমিজের বাপের নজরেই পড়লো না? ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা প্রায় পোয়া ক্রোশ গেছে এই স্রোতের পাশে। সেই রাস্তা ধরে যমুনার পাঙাস, রুই, কাতল, আড় আর ছোটো বাঘাড়ের গোরুর গাড়ি রাতভর চলেছে ক্যাচকাঁচ করে; তমিজের বাপ দিশা পায় নি। গোরুর গাড়ির ক্যাচক্যাচ কাতরানি সুরে সুরে বাজিয়ে তুলছিলো ফকিরেরই কোনো শোলোক এবং তমিজের বাপ, বলা তো যায় না, বেসুরো ও হেঁড়ে গলায় নিজেও গলা ধরেছিলো তার সঙ্গে। বুধা শুনতে পেরেছিলো কি-না কে জানে, কিন্তু বাঘাড় মাছ নিশ্চয়ই সাড়া দিয়েছিলো। নইলে তার লেজ নাড়ানো পর্যন্ত থেমে গেলো কেন? আবার এমনো তো হতে পারে, বাঘাড়টাই তার ঠাণ্ডা রক্তের হিম ছুঁয়ে দিয়েছিলো তমিজের বাপের শরীরে আর তাইতে সে সব ভুলে এক নাগাড়ে খালি নৌকা বেয়েই গেলো, দুই পাশের কিছুই তার নজরে পড়লো না।

পোড়াদহ মেলার মাঠ বাঁয়ে ফেলে শঙ্করের ঘাট পেরিয়ে তমিজের বাপের নৌকা ঢুকে যায় কাৎলাহার বিলে। বিলে তো বাঙালি পানি ঢালে বিলের উত্তর সিথান দিয়েই। তমিজের বাপ নৌকা নিয়ে ঢুকলো সেদিক দিয়েই, অথচ পাকুড়গাছ তার চোখেই পড়লো না। এটা অবশ্য মুনসিরই কারসাজি। গিরিরডাঙার মানুষ সবাই তো তার ওয়ারিশ। দিন নাই, রাত নাই, বর্ষা বাদল খরা শীত নাই, কত্তো বচ্ছর থেকে পাকুড়গাছে বসে সে পাহারা দিয়ে আসছে তার ওয়ারিশদের। তারই খাটানো গায়েবি জালের ভেতর দিয়ে নৌকা চলে এবং তমিজের বাপ দেখতে পায় যে, ছাই রঙের ভেড়ার পাল সাঁতার কেটে চলেছে তার পাশাপাশি একই তালে ও একই গতিতে। বিলের ওপর নৌকা চলে তরতর করে, ফকিরের ঘাটে এসে পৌঁছুতে ভেড়াগুলো মাথা ঘুরিয়ে ফিরে চলে উল্টো স্রোতে। ওদের আর দেখা যায় না, তবে পানির ঢেউ থেকে বোঝা যায়, গজার মাছের চেহারা ফিরে পেয়ে ড়ুবসাঁতার দিয়ে তারা চলে যাবে পাকুড়তলার দিকে। বিলের দক্ষিণে নৌকা পৌঁছুতে পৌঁছুতে পানির ওপরকার কুয়াশায় লাগে গোলাপি আভা। এবং গোটা বিল তিরতির করে কাঁপে। তার মানে মুনসি এখন শুরু করেছে তার গায়েবি। জাল গোটানো। এখন ঠিক সুবেহ সাদেক। মুনসির জাল গোটানোর সময় বিলের মাছ যে যেখানে যেমন আছে ঠিক তেমনি স্থির হয়ে থমকে থাকবে। বিলের দুই পাশের গোরুবাছুর বলো, হাঁসমুরগি বলো, মানুষজন বলো, ঘাস লতা গাছপালা কেউ এক তিল। নড়বে না। তমিজের বাপ ধন্দে পড়ে, একটু দেরিই হয়ে গেলো। এখন মুনসিকে এই মাছ না দেখিয়ে সে পোড়াদহ মেলার দিকে নৌকা ফেরায় কীভাবে?

এমন সময় ফজরের আজান শুনে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মুনসি জালের দড়ি ধরে সোজা উড়াল দেবে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে। এখনই সময়। মুনসিকে একবার দেখাবার জন্যে বাঘাড় মাছটাকে সে দুই হাতে ধরে তার মস্ত বড়ো মাথাটাকে রেখে দিলো নৌকার গলুইয়ের ওপর। আজান শেষ হতেই তমিজের বাপ আবছা আলোয় আর আবছা আন্ধারে দেখলো, মুনসি, হঁ্যা মুনসি ছাড়া আর কে হবে?-এসে দাঁড়িয়েছে মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছের কাছে, বিলের ধার ঘেঁষে। মুনসি তার ফুটো গলায় জিগ্যেস করে, মাছ নিস?

তমিজের বাপ তখন গোলাপি রঙলাগা কুয়াশায় চোখ ভরে দেখে নেয় মুনসিকে। আগুনে তৈরি তার সাদা দাড়ি মিশে গেছে কুয়াশায়, মুনসির ভাঙা গালের দুই পাশে ও চিবুকের নিচের গোলাপি কুয়াশা তার দাড়িরই আস্ফালন ছাড়া আর কী? তার মাথার কালো পাগড়ির দাপটে ওপরের কুয়াশা একটু ময়লা। বুকের শেকলে লোহার ঝনঝন আওয়াজ তুলে মুনসি হাঁকে, বিলের মাছ লেয় কেটা রে? কেটা? শুনে তমিজের বাপের বুক কাঁপে। কিন্তু ভয়ে নয়। তা হলে?—মুনসিকে দেখে?-না, তাও নয়। তমিজের বাপ তো জানে, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গা থেকে সাফ দিলে সাফ নজরে তাকাতে পারলে গিরিরডাঙার মাঝিপাড়ার বাসিন্দা মনসির দেখা পাবেই। আসলে তার গতর কাপে মুনসির বেড়াজালের টানে। গোটা কালাহারের বিল তো তারই জালে ধরা পড়ে, আবার ছাড়া পায় এই জাল থেকেই। তা সেই মুনসির এখন রাগ হবে না কেন? —বিলের মাছ, বিলের পানি, বিলের বাসিন্দা মাঝিপাড়ার মানুষ সবই তো তারই ওয়ারিশ। আর এখন বিল দখল করে কোথাকার কোন শরাফত মণ্ডল তো মুনসির রাগ হবে না? এই তো কাল যমুনার মাঝিরা মুনসিকে খাজনা দিয়ে বিলের মাছ সব ঘেঁকে নিয়ে গেলো, আজ মেলায় তারা সেই মাছ বেচবে। গিরিরডাঙার মাঝিদের বেটাবেটিরা একটা পুঁটি কি খলসে পর্যন্ত পাতে দেখতে পারলো না। তো মুনসি রাগ করবে না তো কি খুশিতে নাচবে?–পানির মাছ তো সব মুনসিরই সম্পত্তি। কাৎলাহারের মাছ তো বটেই, যমুনার মাছ বলো, বাঙালির মাছ বলো, মরা মানাসের দয়ের মাছ, এমন কি মুনসির সেই আমলে শাহ সুলতানের দরগায় কোম্পানি খাজনা ধরলে দুঃখে লজ্জায় শুকিয়ে যাওয়া করতোয়ার মাছ পর্যন্ত সবই মুনসির পোষা জীব, সবাই মুনসির বশে। চেরাগ আলি বলতো, মুনসির লোহার পান্টিতে মাছের নকশা। তা হলে? তা হলে এই বড়ো বাঘাড় মাছটাও তো তারই পাওনা। এতো বড়ো মাছটা ধরতে পারলেও মেলায় আর নেওয়া। গেলো না, তমিজের বাপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে : মুনসি কোনোদিন তার দিকে ফিরে তাকালো না, তার দিকে মুনসির খালি নিনজর। না বাপু, যাই কও, মুনসির লালচটা একটু বেশি। চেরাগ আলি ফকিরকে মুনসি এতো দয়া করেছে, তার ওপর তার রহমতের আর শেষ ছিলো না, এর রহস্যটিও তমিজের বাপ বোঝে। কী?-না, হাটে হাটে, পথে পথে, চাষের জমিতে, রেলগাড়িতে দোতারায় সুর তুলে মুনসির শোলোক মানুষকে শুনিয়ে ফকির আসলে তোয়াজ করেছে মুনসিকে। মুনসি বড়ো তোয়াজের কাঙাল গো! তমিজের বাপের তো শোলোক বলার ক্ষমতা নাই, সে আর তোয়াজ করে কী করে? আবার এতোদিন তো সে বিলের ধারে ধারে ঘুরে বেড়িয়েছে খালি হাতে, তাকে তাই মুনসি দেখাও দেয় নি। আজ আর তার হাতে এতো বড়ো বাঘাড় মাছ, মুনসি নিজেই উঠে এসেছে একেবারে দক্ষিণ মাথায়।-তা যার যা পাওনা তা তাকেই দেওয়া লাগে। দীর্ঘশ্বাসটি সম্পূর্ণ ফেলার আগেই তমিজের বাপ মুনসির পাওনা। মুনসিকেই ফিরিয়ে দেয়। তার হাতের ধাক্কায় বাঘাড় মাছ একটু সরে যায়, তারপর ঝপাত করে আওয়াজ হলে বিলের পানিতে তোলপাড় ওঠে, গোলাপি কুয়াশায় লাগে সাদা রঙ এবং মস্ত বাঘাড় তার শ্যাওলা কালো চখরাবৃখরা দাগ নিয়ে ড়ুব দেয় কাৎলাহার বিলের ভেতরে। চোখের পলকে সে নেমে যায় অনেক নিচে এবং উত্তরে পাকুড়তলায় যাবার জন্যে লম্বা ড়ুবসাঁতার দেয়। হয়তো এই মাছ ধরার জন্যেই আলোর সোয়ার হয়ে মুনসি তার আগেই পৌঁছে যাবে বিলের উত্তর সিথানে; পাকুড়গাছে নিজের আস্তানায় বসে শকুনের চোখের মণি হয়ে সারাটা দিন সে ফালাফালা করে দেখবে সূর্যের যাওয়া আর। আসা অথবা বোদ হয়ে সে মিশে থাকবে রোদের সঙ্গে। আর হাপসে গেলে পাকুড়গাছের ঘন পাতায় হরিয়াল পাখির বুকের ছোটো লোমের মধ্যে লোমশিশু হয়ে হরিয়াল পাখির মাংসের ওমে টানা ঘুম দেবে সারাটা দিন।

তবে মুনসি তখনো উড়াল দেয় নি। বিলের পাড় থেকে হাঁক ছাড়ে এই শালা মাঝির বাচ্চা, খানকির পয়দা, এটি আয়, লাও এই ঘাটোত ভেড়া।

মুনসির ধারাই অন্যরকম, সে গালি দিয়ে কাছে ডাকে। ব্যাকুল হয়ে নৌকা ঘাটে ভিড়িয়ে তমিজের বাপ কাদায় নামতেই তার মাথায় পড়ে মাছের নকশা আঁকা লোহার পান্টির এক বাড়ি। বাড়ি মারতে মারতে ফুটো গলায় মুনসি হাঁক দেয়, এই শালা ডাইঙার বাচ্চা, শালা বারোভাতারির পয়দা, জাউরা শালা, মাছ চুরি করবার আসিস? লিত্যি তুই বিলের ধারত ঘুরিস, আমি জানি না, না? টাকা পয়সা খরচ করা লায়েবের হাতোত পাহোত ধরা হামি বিল পত্তন লিলাম, শালা তোক মাছ খিলাবার জন্যে?

লোহার পান্টির বাড়িতে তমিজের বাপের মাথা ঘুরে যায়, মুনসির বেশিরভাগ কথা সে বুঝতেই পারে না। তবে ঝাপসা চোখে তার নজরে পড়ে, মুনসির পাগড়ি খসে পড়েছে, তার মাথায় কিসতি টুপি; তার বুকের শেকল চাপা পড়েছে গরম চাঁদরের নিচে, তার গলার ফুটো মাফলার দিয়ে ঢাকা। এমন কি হাতের লোহার পান্টিটাও বোলওয়ালা খড়মের আদল নিয়েছে। তমিজের বাপের সামনে থেকে মুনসি হাওয়া হয়ে সেখানে রেখে যায় শরাফত মণ্ডলকে। তাইতো, শিমুলগাছের সাদা বকেরা ওপরে ওড়ে, বিলের ধারে শরাফত মণ্ডলকে পিতিষ্ঠা করে মুনসি উড়াল দিয়েছে পাকুড়তলার দিকে। শরাফতের পেছনে টর্চলাইট হাতে তার বড়ো বেটা আবদুল আজিজ। আবদুল কাদের হঠাৎ করে ধরে ফেলে বাপের খড়ম ধরা হাত। আরো কেউ কেউ বোধহয় ছিলো। হরমতুল্লাহ এলো কোত্থেকে? বৈকুণ্ঠের মতো কাকে যেন দেখা গেলো। তার পাশে ওটা কি তমিজ?

এগুলো সবই তমিজের বাপের সামনে বড়ো এলোমেলো ঠেকে। মুনসি একেবারে এখানে এসে তাকে দেখা দিয়ে গেলো, তার লোহার পান্টির বাড়িতে মাথা তার টনটন। করে। তারপর সে কি পাকুড়তলায় গেলো? কিছুই মনে নাই। এতোসব কাণ্ড দেখতে সে কেবলি হাপসে যায়। তার গতরটা বড়ো কাপে। জ্বরের পুরু কম্বলের নিচেও সে ওম পায় না। আরে সে তো সে, উত্তরে পাকুড়তলা থেকে দক্ষিণে সাদা বকে ছাওয়া শিমুলগাছ পর্যন্ত কেবলি কাপে। বিল বলো, ডাঙা বলো, কিছুই থিতু হতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *