০৮. সংযোজন – শিল্পকলা

সংযোজন – শিল্পকলা

গত পঁচিশ ত্ৰিশ বছরের ভিতর প্রাচীন বাঙলার নানা জায়গা থেকে পোড়ামাটির প্রচুর ফলক, পাথর ও মিশ্র ধাতুর তৈরি প্রচুর মূর্তি ও প্রতিমা এবং সংখ্যায় বেশ কিছু নূতন সচিত্ৰ পাণ্ডুলিপি আমাদের গোচরে এসেছে। এ-সব নূতন আবিষ্কার তথ্যের দিক থেকে নিশ্চয়ই মূল্যবান, এবং সেই হেতু আমাদের জ্ঞাতব্য। এই কারণেই গ্ৰন্থ-শেষের চিত্র-সংগ্রহে দেখা যাবে, মাত্র কয়েকটি পুরাতন নিদর্শন ছাড়া আর যত শিল্প-নিদর্শন ছাপা হয়েছে তা সবই প্রায় নূতন আবিষ্কার; শুধু তাই নয়, এ-সব নিদর্শনের অধিকাংশ এখনও সর্বজনের গোচরে আসেনি। কিন্তু কোনও আবিষ্কার, কোনও তথ্যই এমন নয় যে, গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রকাশিত History of Bengal, vol. 1-3 real exists firsfrégis &fs2.itis (R-Kists (sett বলেছিলাম , যে-রেখাঙ্কন করেছিলাম, রূপ (form) ও প্রসঙ্গের (content-র) যে-বৰ্ণনা ও ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম তাতে কিছু সংশোধন বা পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। যা কিছু নূতন তথ্য জানা গেছে তা শুধু আগেকার বক্তব্যের পরিপূরক মাত্র। তবে, তথ্যমাত্র হলেও মৃৎশিল্পে, ধাতব প্রতিমাশিল্পে এবং চিত্রশিল্পে গত পঁচিশ-ত্রিশ বছরে গুণে ও পরিমাণে অর্থবহ এমন নূতন তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে যে, অন্তত এ-তিনটি বিষয় কিছু কিছু সংযোজন প্রয়োজন মনে করছি। স্থাপত্যশিল্প সম্বন্ধেও হয়তো দু-চার কথা বলা প্রয়োজন হতে পারে।

মৃৎশিল্প

চন্দ্ৰকেতুগড়ে ও ময়নামতী-লালমাই পাহাড়ে প্রত্নখননের ফলে এবং তাম্রলিপ্তের সুবিস্তীর্ণ সমতলে প্রত্নানুসন্ধানের ফলে অগণিত পোড়ামাটির ছাচে ঢালা ফলক ও হাতে গড়া নানা শিল্পনিদৰ্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, তবে হাতে-গড়া নিদর্শন সংখ্যায় বেশি নয়। তাম্রলিপ্ত ও চন্দ্ৰকেতুগড়ে যা পাওয়া গেছে, শিল্পশৈলীর উপর নির্ভর করে সাধারণ ভাবে বলা যায়, তা সবই নির্মিত হয়েছিল খ্ৰীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে শুরু করে খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতকের ভেতর, তবে অধিকাংশই, দশভাগের আট ভাগ, কি তারও বেশি, খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর ভেতর, অর্থাৎ তথাকথিত শুঙ্গ-শক-কুষাণ আমলে, বিশেষ ভাবে খ্ৰীষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, যখন এই দুই সামুদ্রিক বন্দরে ভারত-রোম বাণিজ্যের সমৃদ্ধ বিস্তার ও তার আনুষঙ্গিক নাগরিকতার গভীর প্রভাব। ফর্ম বা রূপে হয়তো তেমন নয়, কিন্তু কনটেনট বা বিষয়বস্তুতে এ-দুয়েরই প্রভাব কিছুতেই দৃষ্টি এড়াবার কথা নয়, না চন্দ্ৰকেতুগড়ে, না তাম্রলিপ্ততে। গ্রন্থের শেষে মৃৎশিল্পের যে-সব প্রতিলিপি মুদ্রিত হয়েছে তার ভেতরও অনেক নিদর্শন আছে যাতে এ-প্রভাব সুস্পষ্ট। চিত্র-পরিচিতিতে তার ইঙ্গিত রাখতে চেষ্টা করবো। বেশ কিছু ফলকের শীর্ষদেশে বা পেছনে উপরের দিকে এক বা একাধিক ছিদ্র থেকে অনুমান হয়, ফলকগুলির ব্যবহার হতো ঘরের দেয়াল বা কুলুঙ্গী সাজাবার জন্য, এবং সে সব ঘর তাম্রলিপ্ত ও চন্দ্ৰকেতুগড়ের (Gange বন্দরের?) নাগরিকদের। এ-গ্রন্থের প্রথম সংস্করণেই বলেছিলাম, নূতন আবিষ্কারগুলো দেখে আবার বলছি, এ-যুগের, অর্থাৎ শুঙ্গান্ত শক-কুষাণ আমলের (প্রথম থেকে প্রায় চতুর্থ খ্ৰীষ্টীয় শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত) মৃৎফলকগুলির বিষয়বস্তুতে, অলংকরণে, কেশবিন্যাসে, পরিধেয়-বিন্যাসে এবং সাধারণ ভাবে ও রূপে যে রুচির পরিচয় স্বপ্ৰকাশ তা স্পষ্টতই নগর রুচি, কৃষিজীবী বা ছোট কারুজীবী গ্রামবাসীর গ্রামীণ রুচি নয়। এই নগর রুচিই গুপ্ত আমলের মৃৎশিল্প পর্যন্ত বিস্তৃত।

তবে, সপ্তম-অষ্টম শতকের পাহাড়পুরের এবং অষ্টম-নবম দশম শতকের ময়নামতীর মৃৎশিল্প নিদর্শনগুলি সদ্যোক্ত মৃৎশিল্পের সমগোত্রীয় নয়; ভাবে, রূপে ও রীতিতে পাহাড়পুর ও ময়নামতীর মৃৎশিল্পের চরিত্র ভিন্নতর। কী শিল্পীরূপে কী বিষয়বস্তুতে এদের উপর লোকায়ত জীবনের প্রতিফলন সুস্পষ্ট, তা পাহাড়পুরের বর্ণনাত্মক শিল্পেই হোক বা ময়নামতীর স্থাপত্যালংকরণে পশুপক্ষীর বিচিত্ৰ কল্পিত শিল্পীরূপেই হোক। স্মরণ রাখ, ভালো যে, এই শিল্পদ্রব্যগুলি ব্যবহৃত হয়েছিল বাণিজ্য-নগরে গৃহের শোভাবর্ধনের জন্য নয়, দু-টি বৌদ্ধ ধর্মপ্ৰতিষ্ঠানের মন্দির-বিহারের প্রাচীর সজ্জার জন্য।

মৌর্য-পর্বের মৃৎশিল্প নিদর্শন স্বল্প হলেও কিছু কিছু পাওয়া গেছে তাম্রলিপ্ত ও চন্দ্ৰকেতুগড় উভয় জায়গা থেকেই। আবক্ষ যক্ষিণী মূর্তির মুখাবয়ব ও তার গড়ন, তার মোটা ও ভারী কনের গয়না এবং তার পর্যাপ্ত কেশদামের বিন্যাস অনিবার্য ভাবে প্রাচীন পাটালীপুত্রের ধ্বংসাবশেষ থেকে আহৃত যক্ষিণী মূর্তিগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঠিক শুঙ্গ আমলের নয়। কিন্তু কেশবিন্যাসে, শিরোভূষণে, অলংকরণে শুঙ্গ লক্ষণযুক্ত প্রচুর ব্যক্ষিণী মূর্তি আহৃত ও আবিষ্কৃত হয়েছে। এ দু-জায়গা থেকেই। ভূষণালংকারের প্রাচুর্য, যৌনপ্রতীকের প্রাধান্য ও কোনও কোনও ফলকে শস্য বা মাছের প্রতীকের ব্যবহার থেকে স্বভাবতই মনে হয়,শ্ৰীষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের এই ফলকগুলি প্রায়শ প্রজনন-শক্তির, প্রাচুর্যের, শ্ৰী বা লক্ষ্মীর প্রতীক বলেই গণ্য করা হতো। কোনও কোনও ফলকে পুরুষ ও নারীর পরিধেয় বিন্যাসের রীতি গন্ধার শিল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, আবার কোনও কোনও ফুলকে পুরুষের দেহের গড়ন ও দেহভঙ্গি স্মরণ করিয়ে দেয়। কুষাণ-শিল্পের কথা বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গ্রেকো-রোমান শিল্পের কথা। তাম্রলিপ্তের অনেক ফলকে গ্রেকো-রোমান শিল্পের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট, আর চন্দ্রকেতুগড়ে পদযুগল-সহ যে-পাদুকা জোড়ার মৃৎপ্রতিলিপিটি পাওয়া গেছে তা যে গ্রেকো-রোমান তাতে সন্দেহ করবার কোনও কারণ নেই, পদযুগলটি যারই হোক। বস্তুত, এ-দুই বন্দরের ধ্বংসাবশেষের ভেতর কুষাণ-আমলের, অর্থাৎ দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকের অসংখ্য মৃৎফলকে মথুরা অঞ্চলের শিল্পীরূপের প্রভাবের চেয়েও গন্ধার অঞ্চলের শিল্পের প্রভাব যেন বেশি সক্রিয় বলে মনে হয়। তাম্রলিপ্তে কয়েকটি ফলক পাওয়া গেছে যার বিষয়বস্তু বৌদ্ধ জাতকের গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে, এবং একটি মৃৎভাণ্ড পাওয়া গেছে যার স্কন্ধগাত্র ঘিরে ধারাবাহিকতায় রামায়ণের একটি কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। জাতক-ফলকগুলি নিঃসন্দেহে খ্ৰীষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতকের, কিন্তু মৃৎভাণ্ডের নিচু রিলিফটির শিল্পীরীতি দেখে মনে হয়, ভাণ্ডটি একাদশ-দ্বাদশ শতকের আগে তৈরি হয়নি, যখন বন্দর হিসেবে তাম্রলিপ্তের অস্তিত্ব আর কিছু ছিল না। অষ্টম-নবম-দশম শতকীয় ময়নামতীর মৃৎশিল্প সম্বন্ধে নূতন করে বলবার কিছু নেই; এ-শিল্প মোটামুটি ভাবে পাহাড়পুরের সমসাময়িক মৃৎশিল্পেরই অনুরূপ। তবে, একটি নিদর্শনের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে; এই ফলকটি পাওয়া গেছে ময়নামতীর শালবন-বিহারের ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে, এবং এতে রূপায়িত হয়েছেন হয় কোনও বোধিসত্ত্ব অথবা কোনও রাজকুমার। প্রচুর অলঙ্কারশোভিত, কুঞ্চিত ও দুল্যমান কেশদামযুক্ত, মুকুটপরিহিত, সুঠাম ও সুমণ্ডিতদেহ এই নরমূর্তিটি নবম শতকীয় প্রস্তর-ভাস্কর্যেরই মৃৎশিল্পানুবাদ বা প্রতিরূপ ՀԱՀ।।

পাঠ-পঞ্জি

তাম্রলিপ্তে মৃৎশিল্প-নিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রচুর। এই নিদর্শনগুলি প্রধানত আশুতোষ মুজিয়ুম, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের সংগ্রহশালা এবং তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। তাম্রলিপ্তের মৃৎশিল্প নিয়ে ছোট ছোট ইংরেজি ও বাঙলা নিবন্ধ এদিক-সেদিক কিছু কিছু প্রকাশিত হয়েছে, তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালা থেকে একটি প্রচার-পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু এই অতি মূল্যবান আবিষ্কার নিয়ে বিশদ আলোচনা আজও কিছু হয়নি, প্রামাণিক গ্ৰন্থও লেখা হয়নি। চন্দ্ৰকেতুগড়ের নিদর্শনও কিছু কম সুপ্রচুর নয়; সেগুলি রক্ষিত আছে প্রধানত আশুতোষ মুজিয়ুমে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব-দপ্তরের সংগ্রহশালায়। এগুলো নিয়ে কিছু কিছু ইংরেজি বাঙলা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে; তার ভেতর থেকে দু-তিনটি উল্লেখ করা যেতে পারে,

*RM, Dasgupta, P.C., “Early Terracottas from Chandraketugarh” in Lalit Kala (Historical), no. 6. October, 1959; Chakravorty, D. K. “Some inscribed Terracotta Sealings from Chandraketugarh” in Journal of the Numismatic Society of India, XXXIX, Parts।-l, 1977; Ray, Niharranjan, “Chandraketugarh, a Port-city of Bengal; its Art and Archaeology”, in Pushpanjali, an annual volume on Indian art and culture, Bombay, 1980.

ধাতব প্রতিমা-শিল্প

প্রস্তর-ভাস্কর্যের প্রচুর নিদর্শন ইতিমধ্যে প্রাচীন বাঙলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। কিন্তু আগেই বলেছি, এ-সম্বন্ধে শিল্পরূপ ও রীতির দিক থেকে নূতন কিছু বলবার নেই। গ্ৰন্থশেষের চিত্ৰ-সংগ্রহে এই সব নূতন আবিষ্কারের অনেকগুলি নিদর্শনের ফটো-প্রতিলিপি মুদ্রিত হয়েছে এবং চিত্র-পরিচিতিতে সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও দেওয়া হয়েছে। ধাতব মূর্তিশিল্প সম্বন্ধেও প্রায় একই উক্তি করা যেতে পারে।

তবে, ইতিমধ্যে ময়নামতীর ধ্বংসাবশেষ থেকে, চট্টগ্রাম জেলার ঝেওয়ারী গ্রাম থেকে এবং পশ্চিমবঙ্গের দু-একটি জায়গা থেকে বেশ কিছু ধাতব প্রতিমা-শিল্পের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই নিদর্শনগুলির কথা কিছু বলতেই হয়।

ঝেওয়ারীর আবিষ্কার এ—গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশের অনেক আগেই হয়েছিল; সে-সংস্করণের একাধিক জায়গায় তার উল্লেখও ছিল, কিন্তু ধাতব প্রতিমাগুলি সম্বন্ধে শিল্পকলা অধ্যায়ে বিশেষভাবে কিছু বলিনি। এখন দু-চার কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি এবং সে-উদ্দেশে বর্তমান সংস্করণের চিত্ৰ-সংগ্রহে তিনটি নিদর্শনের প্রতিলিপি মুদ্রিত হচ্ছে। এই নিদর্শন তিনটিকে ঝেওগারীর শ্ৰেষ্ঠ তিনটি প্রতিনিধি বলে মনে করা যেতে পারে। এদের একটি সমপদস্থানে দণ্ডায়মান, অভয়মুদ্রালাঞ্ছিত বুদ্ধমূর্তি; দ্বিতীয়টি, লীলাসনোপবিষ্টা, মুকুট ও বিচিত্রীলংকারশোভিত, প্রসারিত দক্ষিণকরকমলে ধনভাণ্ড ও বামহস্তে শস্যশীর্ষধুতা মহাযান বৌদ্ধদেবী বসুধারা; এবং তৃতীয়টি ধ্যানাসনোপবিষ্ট, ভূমিস্পর্শমুদ্রালাঞ্ছিত বুদ্ধ। প্রথম ও দ্বিতীয়টি স্পষ্টতই দশম শতকীয় পূর্ব-ভারতীয় প্রস্তর-ভাস্কর্য শিল্পীরূপের ধাতব অনুবাদ। তৃতীয়টি একাদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল বলে আমার অনুমান, কিন্তু সমকালীন পূর্বভারতীয় প্রস্তর বা ধাতব শিল্পের রূপের সঙ্গে এই মূক, আড়ষ্ট বুদ্ধ প্রতিমাটির সমগোত্রীয়তা ততটা আছে বলে যেন আমার মনে হয় না। যতটা আছে সমসাময়িক আরাকানী বৌদ্ধ প্রতিমাশিল্পের সঙ্গে। ঝেওয়ারীর প্রায় সব নিদর্শনই বৌদ্ধধর্মীয়, এবং অধিকাংশই একাদশ-দ্বাদশ শতকীয়; সন্দেহ নেই, সবই ছিল স্থানীয় কোনও বৌদ্ধ মন্দির-বিহারের সম্পত্তি। অনুমান হয়, এই মন্দির-বিহারের সঙ্গে সমসাময়িক আরাকানের বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলির একটা যোগাযোগ ছিল এবং সেই যোগাযোগের ফলেই একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় ঝেওয়ারীর ধাতব শিল্পের সঙ্গে আরাকানী প্রতিমা শিল্পের কিছুটা আত্মীয়তা ঘটে থাকবে।

ময়নামতীর ধ্বংসাবশেষ থেকে বেশ কিছু ধাতব প্রতিমাশিল্প-নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, তার ভেতর থেকে যে কয়েকটি নিদর্শনের প্রতিলিপি বর্তমান সংস্করণে ছাপা হচ্ছে সেগুলিকে ময়নামতীর ধাতব প্রতিমা শিল্পের প্রতিনিধি বলে মনে করা যেতে পারে। চিত্র-পরিচিতিতে নিদর্শনগুলির প্রতিমা-পরিচয় পাওয়া যাব; এখানে সংক্ষেপে শিল্পীরূপের কথা বলাই প্রাসঙ্গিক হবে। নিদর্শন ক’টি সবই নবম-দশকীয় পূর্বভারতীয় প্রস্তরশিল্পের প্রায় ধাতব অনুবাদ। শুধু তা-ই নয়, এ-গুলির সঙ্গে সমসাময়িক বিহারের, অর্থাৎ কুর্কিহার ও নালন্দার, বিশেষ ভাবে নালন্দার, ধাতব প্রতিমা শিল্পের সাদৃশ্য এত গভীর ও সর্বতোভদ্ৰ যে, কেউ যদি বলে এ-গুলি রচিত ও নির্মিত হয়েছিল নালন্দারই কর্মশালায় তা হলে তাকে খুব ভ্রান্ত বলা হয়ত যায় না। প্রমাণ কিছু দেওয়া কঠিন, প্রায় অসম্ভব বললেই চলে, তবু, আমার অনুমান, এই ছোট ছোট নিদর্শনগুলি নালন্দার কর্মশালায়ই নির্মিত হয়েছিল এবং সেখান থেকে ভক্ত বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা এগুলি বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন ভবদেবী-মহাবিহারের মন্দিরে নিবেদন করুবার জন্য।

ধৰ্মকৰ্ম-অধ্যায়ের সংযোজনে বলেছি, নবম-দশম-একাদশ-দ্বাদশ শতকে উত্তর বর্ধমান, বীরভূম, বিশেষ ভাবে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া অঞ্চলে জৈনধর্মের বেশ প্রসারলাভ ঘটেছিল। গত পঁচিশ-ত্রিশ বছরের ভেতর এ-ব্যাপারে প্রচুর প্রত্ন-প্রমাণ পাওয়া গেছে; তার ভেতর মন্দির ও প্রতিমা-প্রমাণও আছে, এমন কি ধাতব প্রতিমারও। তেমন একটি সুন্দর ধাতব প্রতিমাশিল্প-নিদর্শন বর্তমান সংস্করণের চিত্র-সংগ্রহে প্রকাশিত হচ্ছে। কায়োৎসর্গ ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান, পাদপীঠে ঋষভলাঞ্ছিত, নগ্ন, জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের এই প্রতিমাটি স্পষ্টতই নবম শতকীয় পূর্ব-ভারতীয় প্রতিমাশিল্পের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।

পূর্ব-ভারতীয় ধাতব শিল্পের ইতিহাস, রূপ, রীতি ও আঙ্গিক সম্বন্ধে কালানুক্রমিক, ধারাবাহিক বিশ্লেষণ ও আলোচনা পাওয়া যাবে বর্তমান গ্রন্থকারের প্রকাশেমুখ সুবৃহৎ একটি গ্রন্থ (Eastern Indian Bronzes, Lalit Kalia Akademi, New Delhi)।

চিত্রশিল্প

এ—গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের শিল্পকলা-অধ্যায়ে যখন লিখেছিলাম তখন মাত্র ২১টি চিত্রিত পাণ্ডুলিপি আমার জানা ছিল এবং তার উপর নির্ভর করেই চিত্রশিল্প সম্বন্ধে আমার যা বক্তব্য তা বলেছিলাম। সে-বক্তব্যে নূতন কিছু সংযোজনের প্রয়োজন আমি বোধ করছিনে, অর্থাৎ শিল্পরূপ ও রীতি সম্বন্ধে নূতন কথা বলবার মতো অর্থগৰ্ভ নূতন আবিষ্কার ইতিমধ্যে বিশেষ কিছু হয়নি। তবে, কিছুদিন আগে অধ্যাপক শ্ৰীসরাসীকুমার সরস্বতী প্রাচীন বাঙলার চিত্ৰকলা সম্বন্ধে একটি অতি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করছেন (“পালযুগের চিত্রকলা”, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৭৮ : পূ: ১৮৮, ৪৫ রঙীন ও ১০ সাদাকালো চিত্র)। এ-গ্রন্থে গ্রন্থকার এই শিল্পের ইতিহাসের সুশৃঙ্খল একটি ধারাবাহিক বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন, কালক্ৰম অনুসরণ করে; শিল্পীরীতি ও প্রতিমালক্ষ্মণও আলোচনা করেছেন, কিন্তু সবচেয়ে যা মূল্যবান তা হচ্ছে, প্রচুর নুতন তথ্যের সংবাদ তিনি বহন করে এনেছেন, এবং তার ভেতর অনেক তথ্য তার নিজেরই আবিষ্কার। র্যারা এ-বিষয়ে বিশেষভাবে উৎসাহী তারা তো গ্ৰন্থখানা পড়বেনই, কিন্তু সাধারণ ইতিহাস-পাঠকেরও গ্রন্থোক্ত নূতন তথ্যগুলো জানা উচিত।

গ্ৰন্থকার সর্বসুদ্ধ অনুনি ৬০ খানা চিত্রিত পুঁথির সংবাদ দিচ্ছেন এবং বলছেন, “এ ছাড়াও আছে কিছু সংখ্যক তারিখ-বিহীন চিত্র-সংযুক্ত নেপালী পুঁথি।” যাই হোক, সদ্যোক্ত এই ৬০ খানা চিত্ৰিত পুঁথিতে তিনি তিন ভাগে ভাগ করেছেন; ভাগ তিনটি এই:

১. তারিখ-সহ চিত্র সংযুক্ত পূর্ব-ভারতীয় পুঁথি (২৮)। তালিকাশেষে প্রত্যেকটি পুঁথির তারিখ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আছে।

২. তারিখ-বিহীন, চিত্র-সংযুক্ত পূর্ব-ভারতীয় পুঁথি (১৪)।

৩. তারিখ-সহ চিত্র-সংযুক্ত নেপালী পুঁথি (১৮)। এ-পুঁথিগুলি লিখিত ও চিত্রিত হয়েছিল নেপালে, কিন্তু সমসাময়িক নেপালে যে পুঁথিচিত্রশৈলী প্রচলিত ছিল তা স্পষ্টতই পূর্ব-ভারতীয়, এবং সেই হেতু পর্তমান প্রসঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। এ-ক্ষেত্রেও তালিকা শেষে তারিখ সম্বন্ধে প্রয়োজনানুরূপ আলোচনা আছে।

চিত্রাঙ্কনের রীতিপদ্ধতি সম্বন্ধে গ্রন্থকার যে আলোচনা করেছেন এবং সে-প্রসঙ্গে যে-সব নিদর্শন উদ্ধার করেছেন তা পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ তাতেও কিছু নূতন তথ্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

স্থাপত্যশিল্প

ধর্মকর্ম অধ্যায়ের সংযোজনে বর্ধমান জেলায় পানাগড়ের কাছে ভরতপুর গ্রামে যে বৌদ্ধ স্তূপটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, তার কথা ইতিপূর্বেই বলেছি। এযাবৎ আমরা যতদূর জানি, এই স্তূপটিই প্রাচীন বাঙলার আদিতম স্তূপ। স্তূপটির পাটাতনটিই শুধু অবশিষ্ট আছে, উপরিভাগের আর যা কিছু সবই মাটির ধূলায় মিশে গেছে। সুতরাং কী ছিল অণ্ডের, হর্মিকের ও ছত্রাবলীর আকৃতি-প্রকৃতি কিছুই আজ আর বলবার উপায় নেই। গোলাকৃতি পাটাতনটি দাড়িয়ে আছে একটি সমাচতুষ্কোণ ভিতের উপর; ভিতটির প্রত্যেকটি দিকে পাঁচটি করে রথ বা Projection, অর্থাৎ এটি একটি পঞ্চরথভৃপ যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে ওড়িশার রত্নগিরির ধ্বংসাবশেষের ভেতর। ভিত ও পাটাতন তৈরি হয়েছিল ইটের উপর ইট সাজিয়ে, গেঁথে গেঁথে; বোধ হয় সমস্ত স্তূপটিই ছিল ইটের তৈরি। পাটাতন-কুলুঙ্গির প্রস্তর বুদ্ধ-প্রতিমাগুলির শিল্পশৈলী ও স্তূপটির গঠনরীতি ও রূপ দেখে মনে হয়, স্তূপটি নির্মিত হয়েছিল নবম শতকের কোনও is GTI (Excavations at Bharatpur, by S. N. Samanta in Burdwan University Souvenir, 1980)।

ইতিমধ্যে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায় যে বেশ কয়েকটি রেখবর্গীয় দেবায়তনের খবর জানা গেছে, তার কথা ইতিপূর্বেই বলেছি। অধিকাংশ মন্দির ইটের তৈরি, কিন্তু দু’একটি পাথরের মন্দিরও আছে। এ-গুলি সম্বন্ধে স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে নূতন কিছু বলবার নেই; সবই রেখবর্গীয় মন্দির-শিল্পের স্থানীয় ক্ষুদ্রতর সংস্করণ। তবু, এ-সমস্তই তথ্য হিসেবে জ্ঞাতব্য। এমন কয়েকটি মন্দিরের প্রতিলিপি চিত্ৰ-সংগ্রহে মুদ্রিত হ’লো। মন্দিরগুলি সবই দশম-একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় বলে অনুমান হয়।

এ-গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ যখন প্রকাশিত হয় তখন সুবিস্তৃত তেলকুপীগ্রামের অবস্থিতি ছিল বিহারন্তর্গত মানভূম জেলার রঘুনাথপুর থানার অধীনে। ১৯৫৬ খ্ৰীষ্টাব্দে রঘুনাথপুর থানা তেলকুপীসহ চলে এলো পশ্চিমবঙ্গে, পুরুলিয়া জেলায়। পাল-সম্রাট রামপাল (আ, ১০৬৯-১১২২) যখন কৈবৰ্তরাজ ভীমের হাত থেকে বরেন্দ্ৰ পুনরুদ্ধার করেন তখন তাঁর অনেক ‘সামন্ত-মহাসামন্ত তাকে সাহায্য করেছিলেন; এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন তৈলকল্পীর রুদ্রশিখর। বর্তমান তেলকুপী প্রাচীন তৈলকল্পীর ভ্ৰষ্টরূপ এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই; তেলকুপী-পাঞ্চের্ট (পঞ্চকোট) অঞ্চল এখনও শিখরভূম, অর্থাৎ শিখর রাজবংশের অঞ্চল বলেই পরিচিত। দশম থেকে ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত এই শিখরভূমের রাজধানী তেলকুপী স্মার্ত-পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য পঞ্চদেবতা পূজার এবং আঞ্চলিক ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্পের, বিশেষভাবে স্থাপত্য শিল্পের একটি জনপ্রিয় প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল। এ-গ্ৰন্থ যখন রচিত হচ্ছিল, তখন আমি সে-সব প্রত্নসাক্ষ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আজ এ—গ্রন্থের বর্তমান সংস্করণ যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখন সে-সব প্রত্নসাক্ষ্যের কিছুই আর লোকচক্ষুর গোচরে নেই। প্রায় ২৫/২৬টি মন্দির তাদের ধ্বংসাবশেষের বিভিন্ন অবস্থায় তখনও ইতস্তত দাড়িয়েছিল, প্রাচীন ঐশ্চর্য ও গৌরবের মূক সাক্ষী হিসেবে। আজ পাঞ্চেটি বা পঞ্চকোটে দামোদর নদের যে বিরাট বাঁধ তৈরি হয়েছে তার ফলে সমস্তই ডুবে গিয়েছে দামোদরের গভীর জলের নীচে। একটি মন্দিরের চূড়াও আজ আর দেখা যায় না; কিছু যে এখানে কখনও ছিল এমনও মনে হয় না। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বানুসন্ধান বিভাগ যখন জানলেন, তেলকুপীর সলিল-সমাধি রচিত হচ্ছে তখন আর এই বিপুল প্রত্নসাক্ষ্যকে রক্ষা করবার কোনও উপায়ই অবশিষ্ট ছিল না।

আর একবার প্রমাণিত হ’লো যে, বর্তমান জীবিত মানুষের দাবি-দাওয়া অতীত ও মৃত্যু মানুষের প্রত্নসাক্ষ্যের দাবি-দাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিমান! এ নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই; ভাব-বিলাসেরও কোনও স্থান এ-ক্ষেত্রে নেই।

যাই হোক, আমার একমাত্ৰ সাস্তুনা এই যে, যার উপর ভার পড়েছিল তেলকুপীর এই প্রত্নসাক্ষ্য যতটা পারা যায় ততটা অন্তত উদ্ধার করা এবং তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করা, তিনি আমার অন্যতম প্রাক্তন-ছাত্রী, ডাকটর শ্ৰীমতী দেবালা মিত্র, যিনি বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সৰ্ব্বেক্ষণের এডিশনাল ডিরেকটার-জেনারেল। প্রাচীন দলিলপত্র ঘেঁটে, একাধিকবারু মজমান তেলকুপী পরিদর্শন করে তেলকুপীর প্রত্নসাক্ষ্য সম্বন্ধে যা কিছু “জ্ঞাতব্য তথ্য প্রভূত পরিশ্রমে তিনি তা উদ্ধার করছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ Telkupi-a submerged temple site in West Bengal (Memoirs of the Archaeological Sorvey of India, no. 76) থেকে আহরণ করে তেলকুপীর তদানীন্তন ধর্ম ও স্থাপত্য শিল্প সম্বন্ধে দু’চার কথা এখানে সংযোজন করছি, ইতিহাস নির্মাণের পথে কত বাধা বিষ্ম তার একটু আভাস দেবার জন্য।

প্রাচীন তৈলকল্পী যে একটি সমৃদ্ধ মন্দির-নগরী ছিল, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মন্দিরগুলির ধ্বংসাবশেষ থেকেই তা অনুমান করা যায়। তা ছাড়া ১৯৫৬-৫৭ সালে দামোদরের জলের নীচে একেবারে তলিয়ে যাবার আগেও যে এই নগরী ও তার উপকণ্ঠে অন্তত ২৫/২৬টি মন্দির ধ্বংসের নানা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল তা শ্ৰীমতী দেবালা মিত্রের আহৃত প্রত্নসাক্ষ্য থেকেই জানা যায়। এই মন্দির-নগরীর কেন্দ্র ছিল যাকে সেদিন পর্যন্তও লোকেরা জানতো ভৈরবথান বা ভৈরবস্থান বলে; এই ভৈরব থানেই ছিল অন্তত ১৩টি মন্দির। ছোট ছোট আরও কত মন্দির যে ছিল তার কোনও হিসেবই নেই। তা ছাড়া, ইতস্তত দাড়িয়েছিল আরও ১৩টি। যে-কোনও দেবস্থানই সাধারণ লোকের কাছে পরিচিত ছিল “থান’ বা স্থান বলে; এই নগরীতে এমন ‘থান’ ছিল অনেক, যেমন, নিরনীথিান, দূৰ্গাথান, চরকাথান, শিবথান, কালীথান, জামকুকড়াথান ইত্যাদি।

তৈলকল্পী এই অঞ্চলে প্রধানত স্মার্ত-পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। মন্দিরগুলিতে যে-সব দেবদেবীদের পূজাৰ্চনা হতো প্রত্নসাক্ষ্য থেকে জানা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে ছিলেন উমা-মহেশ্বর, বিষ্ণু, নরসিংহাবতার, মহিষমৰ্দিনী দুর্গ, মাতৃকাদেবী, লিঙ্গরূপী শিব, অন্ধকাসুরবধরত। শিব, লিকুলীশ শিব, সূর্য গণেশ ইত্যাদি। সংখ্যা থেকে অনুমান হয়, শৈব ধর্মেরই প্রাধান্য ছিল বেশি। অন্তত একটি জৈন মন্দিরও বোধ হয় ছিল; একটি মন্দিরের জগমোহন অংশে জৈন নেমিনাথের শাসন-দেবী অম্বিকার একটি বৃহদাকৃতি প্রতিমা পাওয়া গেছে!

স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে তেলকুপীর মন্দিরগুলিকে উত্তর-ভারতীয় রেখবর্গীয় মন্দিরের আঞ্চলিক একটি রূপ বললে ভুল কিছু বলা হয় না। স্থানীয় বেলে পাথরে তৈরি এই মন্দিরগুলি সবই আয়তনে ছোট, দৈর্ঘ্য ও পরিসরে আপেক্ষিকভাবে ক্ষুদ্রাকৃতি। পুরুলিয়ার অন্যত্র রেখবর্গীয় সে-সব মন্দির ধ্বংসের বিভিন্ন দশায় আজও দাড়িয়ে আছে (চিত্ৰ-সংগ্রহে এমন ২/৩টি মন্দিরের ছবি প্রকাশিত হয়েছে), এ-মন্দিরগুলি তাদেরই সমগোত্রীয়, আকৃতিতে এবং প্রকৃতিতেও। এই ধরনের মন্দির শুধু পুরুলিয়াতেই নয়, বাঁকুড়া ও বর্ধমানেও আছে, ওড়িশাতেও আছে। পঞ্চদশ শতকীয় (১৪৬১ খ্ৰীষ্ট শতক) বরাকারের মন্দির তিনটিও একই পরিবারভুক্ত বলা যেতে পারে। তেলকুপীর কোনও মন্দিরেই কোনও লিপিসাক্ষ্য নেই; সুতরাং মন্দিরগুলির নির্মাণ কাল সম্বন্ধে সুনিশ্চিত ভাবে কিছু বলবার উপায় নেই। তবে স্থাপত্য রীতি থেকে মনে হয়, এ-অঞ্চলের এই রেখবর্গীয় মন্দির-নির্মাণ শুরু হয়েছিল নবম-দশম শতকে এবং একটানা অন্তত ত্ৰয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত চলেছিল।