০৭. মন্দির স্থাপত্য

মন্দির স্থাপত্য

লিপি ও সাহিত্য-সংক্ষ্যে জানা যায়, প্রাচীন বাঙলায় মন্দির নির্মিত হইয়াছিল অসংখ্য; কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শতকের কয়েকটি ভগ্ন, অর্ধভগ্ন মন্দির ছাড়া এই অসংখ্য মন্দিরের কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। অথচ ভারতীয় স্থাপত্যের ইতিহাসে মন্দিরেই যাহা কিছু বাঙলার বৈশিষ্ট্য। বাঙলার মন্দিরই ব্যবদ্বীপ ও ব্ৰহ্মদেশের বিশিষ্ট মন্দির-স্থাপত্যের মূল প্রেরণা। সমসাময়িক লিপিমালা ও সাহিত্যে প্রাচীন বাঙলার কোনও কোনও মন্দিরের সমৃদ্ধির বর্ণনা দৃষ্টিগোচর; কোনও কোনও মন্দিরের আপেক্ষিক প্রসিদ্ধিও ছিল, সন্দেহ নাই। এমন দুই চারিটি মন্দিরের প্রতিকৃতি দেখা যায় সমসাময়িক পাণ্ডুলিপিচিত্রেী এবং তক্ষণফলকে, যেমন রাঢ়া ও পুণ্ড্রবর্ধনের বুদ্ধ-মন্দির, বরেন্দ্রর তারা-মন্দির, সমতট, বরেন্দ্ৰ, নালেন্দ্র, রাঢ়া এবং দণ্ডভুক্তির লোকনাথ মন্দির। এই সব মন্দিরের প্রতিকৃতির আকৃতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, প্রাচীন বাঙলায় মোটামুটি চারিটি বিভিন্ন শৈলীর মন্দির-নির্মােণরীতি প্রচলিত ছিল। রীতি ও শৈলীর এই বিভিন্নতা ভূমি-নকশানির্ভর নয়, বস্তুত, প্রত্যেকটি রীতিতেই ভূমি-নকশার যুক্তি ও বিন্যাস প্রায় একই ধরনের। এই বিভিন্নতা প্রধানত গর্ভগৃহের উপরিভাগ অর্থাৎ ছাদ বা চালের রূপ ও আকৃতিনির্ভর। সদ্যোক্ত চারিটি রীতি নিম্নোক্ত ভাবে তালিকা।গত করা যাইতে পারে।

১. ভদ্র বা পীড় দেউল। রীতিতে গর্ভগৃহের চাল ক্রমহ্রস্বায়মান পিরামিডাকৃতি হইয়া ধাপে, ধাপে উপরের দিকে উঠিয়া গিয়াছে। ধাপ বা স্তর সংখ্যায় তিনটি, পাচটি বা সাতটি। সর্বোচ্চ এবং ক্ষুদ্রতম স্তরের উপরে আমলক ও চূড়া। এই ভদ্র বা পীড় দেউলই ওড়িশার রেখা বা শিখর-মন্দির সমূহের সম্মুখভাগের জগমোহন বা ভোগমণ্ডপ।

২. রেখা বা শিখর দেউল। এই রীতিতে গর্ভগৃহের চাল ঈষদবক্ৰ রেখায় শিখরাকৃতি হইয়া সোজা উপরের দিকে উঠিয়া গিয়াছে। শিখরের উপরিভাগে আমলক ও চূড়া। এই রেখা বা শিখর দেউল উত্তর-ভারতীয় এবং ওড়িশার নাগর পদ্ধতির মন্দিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তায় যুক্ত।

৩. স্তূপযুক্ত পীড় বা ভদ্ৰ দেউল। এই ধরনের দেউলে চালের ক্রমহ্রস্বয়মান পিরামিডাকৃতি স্তরের উপরে একটি স্তূপ। স্তূপটির উপর চূড়া।

৪. শিখরযুক্ত পীড় বা ভদ্ৰ দেউল। এই ধরনের দেউলের চালের ক্রমহ্রস্বায়মান পিরামিডাকৃতি স্তরের উপর একটি শিখর। শিখরের উপর চূড়া।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন, এই চার বিভিন্ন রীতির প্রত্যেকটির স্থাপত্য-নিদর্শন আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছায় নাই; তৃতীয় ও চতুর্থ রীতির মন্দিরের কোনও নিদর্শন আমরা আজও জানি না, যদিও ঐ ধরনের মন্দির ছিল, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করা চলে না। প্রথমোক্ত রীতির নিদর্শনও জানি, দুয়ে তাহা বলা যায় না, তবে, দ্বিতীয় রীতির মন্দিরের কয়েকটি নিদর্শন আজও দৃষ্টিগোচর।

১. প্রথমোক্ত রীতির, অর্থাৎ, ভদ্র বা পীড় দেউল যে প্রাচীন বাঙলার সুপ্রচুর ছিল তাহার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় অগণিত প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ মন্দিরের প্রতিকৃতিগুলিতে। এই রীতির প্রাথমিক রূপটি দেখিতেছি ঢাকা আশ্রফপুরে প্রাপ্ত সপ্তম শতকের ব্রোঞ্জনির্মিত একটি ফলকে। চারিটি খাজকাটা কাঠের স্তম্ভের উপর ঢালু ক্রমহ্রস্বায়মান দুটি চাল, তাহার উপর সুন্দর একটি চূড়া। ইহাই এই রীতির মন্দিরের মূল রূপ; এই রূপই ক্রমশ আরও সমৃদ্ধ এবং জটিল হইয়াছে। একটি একটি করিয়া ঢালু চালের সংখ্যা গিয়াছে বাড়িয়া, সর্বোচ্চ চালটির উপর চূড়ার নীচেই গ্ৰীবাদেশের গোলাকৃতি আগুটি ক্রমশ আমলক শিলায় বিবর্তিত হইয়াছে, এবং গ্ৰীবানিম্নের চালটির (ঘােড়চক্রের) চারিকোণে চারিটি ঝম্পসিংহ-মূর্তির অলংকরণ সংযোজিত হইয়াছে। ভূমি-নকশা সাধারণত চতুষ্কোণ রথাকৃতি; প্রত্যেক দিকের বিলন্বিত রেখাটি কেন্দ্রীয় অংশটির সম্মুখ দিকে বাড়াইয়া দিয়া রথের আকৃতি দান করা হইয়াছে। এই ধরনের রথাকৃতি ভূমি-নকশায় উপর দুই বা ততোধিক ঢালু ক্রমহ্রস্বায়মান চালের মন্দির, মধ্যযুগের বাঙলাদেশেও সুপ্রচলিত রীতি ছিল, সন্দেহ নাই। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের অনেক মৃৎফলকে এই ধরনের মন্দিরের প্রতিকৃতি বিদ্যমান। প্রায় সমসাময়িক কালের ইষ্টকনির্মিত এই রীতির মন্দিরের একাধিক নিদর্শন (যেমন বাঁকুড়া জেলার এক্তেশ্বর মন্দিরের নদীমণ্ডপ)। আজও দৃষ্টিগোচর। লোকায়ত বাঙলার দ্বিতল বা ত্রিতল খড়ের চালের রূপ হইতেই যে এই রীতির উদ্ভব, তাহাঁতে সন্দেহের কোনও কারণ নাই। যাহাই হউক, প্রাচীনতর রূপের বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর একমাত্র প্রস্তর-ফলকে উৎকীর্ণ প্রতিকৃতি-চিত্রেই দৃষ্টিগোচর; মন্দিরাবশেষ কিছু নাই বলিলেই চলে। হিলিতে প্রাপ্ত এবং ঢাকা-সাহিত্য-পরিষদে রক্ষিত কল্যাণ-সুন্দর শিবমূর্তির ফলকে, চব্বিশ পরগণা-কুলদিয়ার এবং রাজশাহীর-বরিয়ার সূর্যমূর্তির ফলকে, বিক্রমপুরের রত্নসম্ভব-মূর্তির ফলকে, ঢাকা-মধ্যপাড়ার বুদ্ধমূর্তি-ফলকে, বিরোলের উমা-মহেশ্বর প্রতিমা-ফলকে, এবং রাজশাহী-কুমারপুরের একটি সুবৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের উপর উৎকীর্ণ প্রতিকৃতিতে এই রীতির মন্দিরের বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরগুলি ধরিতে পারা খুব কঠিন নয়।

২. দ্বিতীয়োক্ত রীতির অর্থাৎ রেখা বা শিখরা-দেউলের সর্বপ্রাচীন নিদর্শন বোধ হয় বর্ধমান-বরাকরের ৪ নং মন্দিরটি। এই মন্দিরটি পাথরে তৈরি, নিচু ভিতের উপর গর্ভগৃহটি অপেক্ষাকৃত উচ্চ, এবং গর্ভগৃহের উপর খর্বাকৃতি একটি রেখা বা শিখরের চাল। গোড়া হইতেই শিখরের ক্রমবিক্ৰ রেখাটি উপরের দিকে উঠিয়া গিয়াছে; শিখরের উপর একটি বৃহৎ আমলক-শিলা। শিখরের পগ রেখাগুলি সুতীক্ষ্ণ ও সুকঠোর সারল্যে নিয়ন্ত্রিত। স্থাপত্যরূপের দিক হইতে এই মন্দিরটি ভুবনেশ্বরের পরশুরামেশ্বর মন্দিরের সমকালীন, অর্থাৎ অষ্টম শতকীয়।

এই রেখা-দেউলের বিবর্তনের পরবর্তী স্তরটি ধরা পড়িয়াছে তিনটি ক্ষুদ্রায়তন নিবেদন-মন্দিরে; এই তিনটির দুইটি পাথরে তৈরি (একটি দিনাজপুরে এবং আর একটি রাজশাহী নিমদীঘিতে প্রাপ্ত), তৃতীয়টি ব্রোঞ্জে গড়া (এবং চট্টগ্রাম জেলার ঝেওয়ারীতে পাওয়া)। আকৃতি-প্রকৃতি এবং বিবর্তনের দিক হইতে এই তিনটিই সমকালীন, সন্দেহ নাই। রেখাকৃতি ভূমি-নকশার উপর গর্ভগৃহ; গর্ভগৃহের চারদিকে চারিটি ত্ৰিবলীতে তোরণা বা কুলুঙ্গি; চালে ক্রমবিক্ৰাকৃতি শিখর এবং শিখরের শীর্ষে সংকীর্ণ গ্ৰীবার উপর আমলক। বিবর্তনের এই স্তরেও পগরেখা তীক্ষ ও সরল, তবে শিখরের অঙ্গে চৈত্য-গবাক্ষের অলঙ্কার। পাথরের নিদর্শন দুইটিতে গর্ভগৃহ ও শিখরের মাঝখানে দুই বা তিনস্তরে মণ্ডনায়িত রেখা, কিন্তু ব্রোঞ্জ-নিদর্শনটিতে তাহা নাই।

বিবর্তনের তৃতীয় স্তরে প্রায় চারি পাঁচটি ভগ্ন ও অর্ধভগ্ন নিদর্শন বিদ্যমান— বর্ধমানের সিদ্ধেশ্বর-মন্দির, বাঁকুড়া জেলার দোহার-গ্রামের পাথরে তৈরি সরেশ্বর ও সল্লেশ্বর-মন্দির, এবং সুন্দরবনের জটার-দেউল। প্রথম চারিটি মন্দিরের অত্যন্ত ভগ্নদশা; পঞ্চম মন্দিরটির এমন সংস্কার-সংরক্ষণ করা হইয়াছে যে, ইহার মূল আকৃতি-প্রকৃতিই গিয়াছে বদলাইয়া। এই মন্দিরগুলি ভূমি-নকশা, গর্ভগৃহ, শিখর ও অলংকরণ প্রভৃতির বিশ্লেষণ করিলে সহজেই ধরা পড়ে, সদ্যোক্ত শিখরাকৃতি নিবেদন-মন্দিরগুলির সঙ্গে ইহাদের মৌলিক পার্থক্য বিশেষ কিছু নাই, তবে এই মন্দিরগুলি আয়তনে ও অলংকরণে আরও সমৃদ্ধতির, আকৃতি-প্রকৃতিতে আরও জটিলতর। মৌলিক পার্থক্যের মধ্যে শুধু দেখিতেছি, শিখরের পগরেখাগুলির তীক্ষ্ণতা মার্জনা করিয়া একটু গোলাকার করিয়া দেওয়া হইয়াছে। তাহার ফলে সমগ্র শিখরটিরই আকৃতি হইয়া পড়িয়াছে খানিকটা গোলাকার। তাহা ছাড়া, মূল শিখরের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্রাকৃতি শিখরালংকারে সজা সংযোজিত হইয়াছে এবং প্রবেশ তোরণের দিকে একটি অলিন্দও যোগ করা হইয়াছে। দেউলিয়ার মন্দিরটি বোধ হয়। পাচটির মধ্যে সর্বপ্রাচীন এবং ইহার কিছুকাল পরেই বহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর-মন্দির। এই দুইটি মন্দিরেই শিখরের পগরেখা গর্ভগৃহের ভূমি পর্যন্ত আলম্বিত এবং রেখার তীক্ষতা মার্জিত ও গোলায়িত। বহুলাড়ার সিদ্ধেশ্বর-মন্দিরটির গর্ভগৃহের বহিঃপ্রাচীরে কুলুঙ্গির অলংকার এবং শিখরের কেন্দ্রীয় রথটিতে ক্ষুদ্রাকৃতি শিখরালংকার। এই মন্দির দুটি বোধ হয় দশম-একাদশ শতকীয়৷ দেহারের সরেশ্বর ও সল্লেশ্বর-মন্দির দুইটির গর্ভগৃহের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নাই; তবে, গর্ভগৃহের আকৃতি-প্রকৃতি দেখিয়া মনে হয়, এই দুটি মন্দির ও বহুলারার সিদ্ধেশ্বর-মন্দিরের সমসাময়িক। সুন্দরবনের জটার-দেউলটিও বোধ হয় একই কালের, কিন্তু যুক্তিহীন, জ্ঞানহীন সংস্কার ও সংযোজনার ফলে মন্দিরটির মৌলিক রূপ আজ আর কিছু বুঝিবার উপায় নাই। তবে পুরাতন এবং সংস্কারপূর্ব একটি আলোকচিত্র হইতে মনে হয়, এই দেউলটিও অনেকটা সিদ্ধেশ্বর-মন্দিরের মতনই ছিল, তবে শেষোক্ত মন্দিরের শিখরের রেখা বোধ হয় ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি বক্ৰ।

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বর্ধমান-বরাফরের ১, ২ ও ৩ নং মন্দির তিনটিকে দ্বাদশ-শতকীয় বলিয়া মনে করিতেন; কিন্তু এরূপ মনে করিবার কোনও সঙ্গত কারণ নাই। বস্তুত গঠনরীতির দিক হইতে এই তিনটির একটিও চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের আগেকার মন্দির বলিয়া মনে হয় না। বর্ধমান-গৌরাঙ্গাপুরের ইছাইঘোষের দেউলটি সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা বলা চলে; এই মন্দিরটি যেন আরও পরবর্তী। তবে, মধ্যযুগেও যে বাঙলাদেশে রেখা বা শিখরা-দেউল নির্মিত হইত, বিশেষভাবে পশ্চিম-বাঙলায়, এই মন্দিরগুলি তাহার প্রমাণ।

প্রাচীন বাঙলার রেখা বা শিখরা-দেউলগুলি বিশ্লেষণ করিলে সহজেই ইহাদের সঙ্গে ভুবনেশ্বরের শত্ৰুঘ্নেশ্বর, পরশুরামেশ্বর, মুক্তেশ্বর প্রভৃতি মন্দিরের সাদৃশ্য ধরা পড়িয়া যায় এবং

পূর্ববর্তী। তাহা ছাড়া, বাঙলার মন্দিরগুলির আর একটি বৈশিষ্ট্যও ধরা পড়ে; ওড়িশার মন্দিরগুলির মতো এই মন্দিরগুলির কোনও জগমোহন বা ভোগমণ্ডপ কিছু নাই, আমলক-সহ শিখর-শীর্ষ গর্ভগৃহই দেউলের একমাত্র অঙ্গ; অবশ্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে জগমোহনের পরিবর্তে সম্মুখ দিকের দেয়ালে একটি অলিন্দের সংযোজন আছে। ওড়িশার লিঙ্গরাজ ও পরবর্তী মন্দিরগুলির ভূমি-নকশায়ও অলংকরণে যে বৈচিত্র্য ও জটিলতা তাহাও বাঙলার মন্দিরগুলিতে নাই। বস্তুত, বাঙলার মন্দিরগুলি ক্ষুদ্রকায় হইলেও খুব মার্জিত ও সংযত রুচির পরিচয় বহন করে; চৈত্য-গবাক্ষ ও ক্ষুদ্রায়তন শিখরালংকার ছাড়া এই মন্দিরগুলির বিশেষ আর কোনও অলংকরণ নাই।

৩. স্তূপশীর্ষ ভদ্র বা পীড়-দেউলের নিদর্শন প্রাচীন বাঙলায় খুব বেশি দেখা যায় না। তবে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রক্ষিত একটি পাণ্ডুলিপি-চিত্রে নালেন্দ্ৰ নামক স্থানের লোকনাথ-মন্দিরের একটি প্রতিকৃতি আছে। এই প্রতিকৃতিতে এই ধরনের মন্দিরের অন্তত একটি নিদর্শন দৃষ্টিগোচর। চতুষ্কোণ গৰ্ভগৃহের উপর ক্রমহ্রস্বায়মান ঢালু চালের কয়েকটি স্তর, তাহার উপর একটি বৃহদায়তন স্তূপ এবং প্রত্যেকটি স্তরের চারিটি কোণে কোণে একটি একটি করিয়া ক্ষুদ্রাকৃতি স্তূপের অলংকরণ। ইট বা পাথরের তৈরি এই রীতি কোনও দেউল নির্মাণের কোনও সাক্ষ্য আমাদের সম্মুখে নাই। তবে নির্মিত যে হইত। তাহার প্রমাণ এই পাণ্ডুলিপি-চিত্রটি। ব্ৰহ্মদেশ-পাগানের অভয়দান এবং পাটো থাম্যা-মন্দির (একাদশ-শতক) দুটির স্থাপত্যরূপ ও রীতির পশ্চাতে যে এই ধরনের মন্দিরের অনুপ্রেরণা বিদ্যমান, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নাই।

৪. শিখর শীর্ষ পীড় বা ভদ্ৰ দেউলেরও নির্মাণ-নিদর্শন আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই; তবে একটি পাণ্ডুলিপি-চিত্রে পুণ্ড্রবর্ধনের বুদ্ধ-মন্দিরের যে প্রতিকৃতি আছে এবং কয়েকটি প্রস্তর-ফলকে যে ধরনের কয়েকটি মন্দির উৎকীর্ণ আছে তাহাতে অনুমান করা চলে যে, এই শিখর শীর্ষ পীড় বা ভদ্ৰ দেউলও বাঙলাদেশে সুপরিচিত সুপ্রচলিত ছিল। এই ধরনের মন্দিরের চতুষ্কোণ গৰ্ভগৃহের উপর স্তরে স্তরে ক্রমহ্রস্বায়মান চাল এবং সর্বোচ্চ চালটির উপর বক্ররেখায় একটি শিখর, শিখরের উপর আমলক-শিলা; বৌদ্ধমন্দির হইলে আমলক-শিলার উপর একটি অতি ক্ষুদ্রকায় স্তূপের প্রতীক। শিখরের আকৃতি কোথাও হ্রস্ব, কোথাও দীর্ঘািয়ত। ব্ৰহ্মদেশের পাগান নগরে একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় থাটবিঞ, টিহ্‌-লো-মিনহ-লো. শোয়েগু-জ্যি ও অন্যান্য অনেকগুলি মন্দিরের পশ্চাতে প্রাচীন বাঙলার এই ধরনের মন্দিরের অনুপ্রেরণা বিদ্যমান।

পাহাড়পুরের মন্দির

প্রায় পঁচিশ বৎসর আগে রাজশাহী জেলার পাহাড়পুর গ্রামে এক বিরাট ধবংসস্তূপ উন্মোচন করিয়া একটি বিপুলকায় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। চারিদিকে কক্ষসারি লইয়া সুবিস্তৃত বিহারের ধ্বংসাবশেষ, তাহারই সম্মুখে বিস্তৃত প্রাঙ্গণের কেন্দ্ৰস্থলে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরের চাল নাই, চুড়া নাই; চারিদিকের প্রাচীর পড়িয়াছে ভাঙিয়া; প্রদক্ষিণ পথ, পূজাকক্ষ, সমস্তই ইটে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে; তবু এই বিরাট ধ্বংসাবশেষের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ইহার গঠনরেখা ও রীতি ধীরে ধীরে অনুসরণ করিলে ইহার সামগ্রিক আকৃতি-প্রকৃতি ক্রমশ চোখের সম্মুখে ফুটিয়া ওঠে। তখন স্বীকার করিতে বাধা থাকে না, এই মন্দির প্রাচীন বাঙলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিস্ময়। ভারতীয় ও বহির্ভারতীয় স্থাপত্যের ইতিহাসে এই মন্দির গরিমায় উজ্জ্বল এবং রূপে ও রীতিতে তুলনাহীন না হইলেও এই জাতীয় আপাতজ্ঞাত সকল সর্বতোভদ্র মন্দিরের পুরোভাগে ইহার স্থান।

ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্ৰে ‘সর্বতোভদ্র’ নামে একশ্রেণীর মন্দিরের উল্লেখ ও পরিচয় আছে। এই ধরনের মন্দির চতুষ্কোণ এবং চতুঃশালগুহ, অর্থৎ ইহার চারিদিকে চারিটি গর্ভগৃহ এবং সেই গৃহে প্রবেশের জন্য চারিদিকে চারিটি তোরণ। শাস্ত্রানুযায়ী এই ধরনের মন্দির হইত। পঞ্চতল, প্রত্যেক তলের ষোলোটি কোণ অর্থাৎ চতুষ্কোণের প্রত্যেকটি বাহু সম্মুখে বিস্তুত করিয়া এক এক দিকে চারিটি (চারিদিকে ষোলোটি) কোণ রচনা, প্রত্যেক তল ঘিরিয়া প্ৰদক্ষিণ পথ এবং প্রাচীর; সমগ্র মন্দিরটি অলংকৃত হইত। অসংখ্য ক্ষুদ্রাকৃতি শিখর ও চূড়ায়। পাহাড়পুরের সুবিস্তৃত মন্দিরটি এই সর্বতোভদ্র মন্দিরের উজজুল নিদর্শন। এই ধরনের সর্বতোভদ্র মন্দির ভারতের নানাস্থানে নিশ্চয়ই নির্মিত হইয়াছিল, নহিলে বাস্তুশাস্ত্ৰে ইহার উল্লেখ থাকিবার কথা নয়; কিন্তু এক পাহাড়পুর ছাড়া ভারতবর্ষে আর কোথাও এই ধরনের মন্দির আজ আর দৃষ্টিগোচর নয়, আর কোনও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও এ-পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। বোধ হয় মন্দির-স্থাপত্যের এই রূপ ও রীতি ভারতবর্ষে বহুল প্রচারিত ও অভ্যস্ত হইতে পারে নাই; তবে এই রূপ ও রীতি যে বহির্ভারতে, অন্তত প্রাচীন যবদ্বীপ ও ব্ৰহ্মদেশের মনোহরণ করিয়াছিল, এ-সম্বন্ধে সুপ্রচুর সাক্ষ্য বিদ্যমান। ব্ৰহ্মদেশে প্রাচীন পাগান নগরের চতঃশাল থািটবিএঃ বা সর্বজ্ঞ, শোয়েগু-জ্যি, টিহু-লো-মিনহ-লো প্রভৃতি মন্দিরের পশ্চাতে এই ধরনের সর্বতোভদ্র মন্দিরের অনুপ্রেরণা ছিল এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। যবিদ্বীপে প্রাস্বনাম নগরীর প্রাচীন লোরো-জোংরাং মন্দির, শিব-মন্দির প্রভৃতিও একই অনুপ্রেরণায় কল্পিত ও গঠিত। কালের দিক হইতে অষ্টম-শতকীয় পাহাড়পুর-মন্দির ইহাদের সকলের আদিতে।

স্বৰ্গত কাশীনাথ দীক্ষিত ও অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী মহাশয়দের আলোচনা-গবেষণার ফলে পাহাড়পুর মন্দিরের মৌলিক রূপ-প্রকৃতি ও গঠন আজি ধরিতে পারা সহজ হইয়াছে। এই সুবৃহৎ মন্দির উত্তর-দক্ষিণে ৩৫৬.৫ ফিট ও পূর্ব-পশ্চিমে ৩১৪.২৫ ফিট বিস্তৃত। মূলত মন্দিরটির ভূমি-নকশা চতুষ্কোণ; প্রত্যেক দিকের বাহু সম্মুখ দিকে একাধিকবার (তিনবার) বিস্তৃত করিয়া অনেকগুলি কোণের সৃষ্টি করা হইয়াছে এবং সমগ্র নকশাটিকে সমান্তরালে প্রসারিত করা হইয়াছে চারিদিকে। মূল চতুষ্কোণ নকশাটির সমগ্র ভূমির উপর একটি শূন্যগর্ভ বিরাটকায় চতুষ্কোণ স্তম্ভ সোজা উপরের দিকে উঠিয়া গিয়াছে; ইহারই সর্বোচ্চ স্থাপিত ছিল মন্দিরের শীর্ষ, কিন্তু সে-শীর্ষ এবং স্তম্ভটিরও উপরের অংশ ভাঙিয়া পড়িয়া গিয়াছে; কাজেই শীর্ষটি কি শিখরাকৃতি ছিল, না ছিল স্তুপাকৃতি তাহা নির্ণয়ের কোনও উপায় আজ আর নাই। শূন্যগর্ভ দৈত্যকায় স্তম্ভটির দেয়াল অতি প্রশস্ত, কারণ চারিদিকের সমান্তরাল প্রসারের চাপ ও ভারের অনেকাংশ পড়িত এই দেয়ালের উপর। এই চতুঃসংস্থান-সংস্থিত স্তম্ভটিই সমগ্র মন্দিরটির কেন্দ্ৰ, ইহাকে আশ্রয় করিয়াই প্ৰত্যেকটি ক্রমহ্রাস্বায়মান স্তর এবং স্তরোপরি প্রদক্ষিণ পথ ও প্রাচীর চতুঃশালগুহ, মণ্ডপ প্রভৃতি সমস্তই কল্পিত, রচিত ও প্রসারিত। ভিত্তিস্তর বাদ দিলে মন্দিরটির সর্বসুদ্ধ ক’টি ক্রমহ্রস্বয়মান স্তর ছিল, বলা কঠিন। শাস্ত্রানুযায়ী সর্বসুদ্ধ পাচটি স্তর বা তল থাকিবার কথা; হয়তো তাহাই ছিল, কিন্তু আপাতত ধ্বংসাবশেষের মধ্য হইতে দৃষ্টিগোচর হইতেছে ভিত্তিস্তরসহ মাত্র তিনটি। মন্দিরটি চতুর্মুখ, অর্থাৎ “সর্বতোভদ্র হওয়া সত্ত্বেও ইহার প্রবেশ তোরণ উত্তর দিকে। অঙ্গন হইতে সোপান বাহিয়া উপরে উঠিলেই ভিত্তিস্তরের সমতলে একটি সুপ্ৰশস্ত চত্বর; এই চত্বর অতিক্ৰম করিলেই দক্ষিণতম প্রান্তে বেষ্টনী প্রাচীরের তোরণ ভেদ করিয়া ভিত্তিস্তরের সর্বতোভদ্ৰ প্ৰদক্ষিণ-পথে প্রবেশ। প্ৰদক্ষিণ-পথটি ঘুরিয়া চলিয়া গিয়াছে মন্দিরের চারিদিকে এবং পথটির প্রান্ত বাহিয়া বেষ্টনী-প্রাচীর। এই প্ৰদক্ষিণ-পথের যে কোনও দিক হইতে সোপানশ্রেণী বাহিয়া হ্রস্বায়িত প্রথম তলে বা স্তরে আরোহণ করা যায়। এই স্তরেও একই প্রকারের প্রদক্ষিণ-পথ, বেষ্টনী-প্রাচীর, তদুপরি এক একদিকে এক একটি করিয়া মণ্ডপ। প্রথম তল হইতে সোপান বাহিয়া দ্বিতীয় তলে আরোহণ করিলেই স্পষ্টত বুঝা যায়, এই তলই সর্বপ্রধান তল, কারণ এই তলই সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ, এই তলেই কেন্দ্ৰস্থিত শূন্যগর্ভ স্তম্ভটি চারিদিকে চারিটি গর্ভগৃহ এবং প্রত্যেক গর্ভগৃহের সম্মুখে এক একটি করিয়া বৃহৎ মণ্ডপ। সন্দেহ নাই, এই চারিটি গর্ভগৃহই ছিল প্রধান দেবগৃহ বা পূজাগৃহ এবং ইহাদেরই সম্মুখের মণ্ডপে পূজারীরা নৈবেদ্য ইত্যাদি লইয়া সমবেত হইতেন। মণ্ডপ ও দেবগৃহ দক্ষিণে রাখিয়া চারদিক ঘিরিয়া প্ৰদক্ষিণ-পথ এবং বেষ্টনী-প্রাচীর। এই তলের উপরে আর কোনও তল ছিল। কিনা এবং সেই তলে কোনও পূজাগৃহ ছিল। কিনা, বলা কঠিন। ইহার উপর আর যাহা কিছু ছিল সমস্তই ভাঙিয়া ধ্বসিয়া পড়িয়া গিয়াছে। কাজেই এই মন্দিরের উপরিভাগের আকৃতি-প্রকৃতি কী ছিল তাহা লইয়া কল্পনা-জল্পনা করা চলে, কিন্তু নিঃসংশয়ে কিছু বলা চলে না।

কাশীনাথ দীক্ষিত মহাশয় অনুমান করিয়াছিলেন, পাহাড়পুরে বোধ হয় একটি চতুর্মুখ জৈন-মন্দির ছিল এবং এই চতুর্মুখ জৈন-মন্দিরটিই বোধ হয় ছিল পাহাড়পুর-মন্দিরের মূল অনুপ্রেরণা। এ-অনুমান মিথ্যা না-ও হইতে পারে। এই ধরনের চতুর্মুখ বা সর্বতোভদ্র মন্দির ব্ৰহ্মদেশের প্রাচীন পাগান-নগরীতেও নির্মিত হইয়াছিল, এমন প্রমাণ বিদ্যমান। আনন্দ, সর্বজ্ঞ, টিহু-লো-মিনহ-লো প্রভৃতি মন্দিরেও দেখা যায়, কেন্দ্রে একটি বিরাটকায় চতুষ্কোণ স্তম্ভ সোজা উঠিয়া গিয়াছে উপরের দিকে এবং তাহার শীর্ষে শিখর বা স্তূপ। এই স্তম্ভটির চারিদিকের চারিমুখে প্রত্যেক তলে চারিটি সুউচ্চ সুবৃহৎ কুলুঙ্গি কাটিয়া বাহির করা হইয়াছে; প্রত্যেক কুলুঙ্গিতে বুদ্ধ-প্রতিমা। প্রত্যেক দিকের তোরণদ্বার হইতে একটি সুদীর্ঘ অলিন্দ পথ সোজা চলিয়া গিয়াছে প্রতিমার সম্মুখ পর্যন্ত; দুই দিকে সমান্তরালে আরো দুইটি অলিন্দ এবং এই অলিন্দ রেখাশ্রেণী ভেদ করিয়া কেন্দ্রীয় স্তম্ভটির চারদিক ঘিরিয়া একাধিক প্রদক্ষিণ-পথ চলিয়া গিয়াছে। পাহাড়পুর-মন্দিরের বিন্যাসের সঙ্গে পাগানের এই জাতীয় মন্দিরগুলির বিন্যাসের সমগোত্রীয়তা কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। এ-কথা সত্য যে, পাহাড়পুর-মন্দিরের কেন্দ্রীয় স্তম্ভে কোনও কুলুঙ্গি কাটা নাই; কিন্তু তাহার পরিবর্তে চারিদিকের দেয়ালের সম্মুখেই স্থাপনা করা হইয়াছে চারিটি গর্ভগৃহ ও মণ্ডপ। আসল কথা হইল কেন্দ্রীয় স্তম্ভটি এবং তাহাকে ঘিরিয়া চারিদিকের পূজািস্থান ও প্ৰদক্ষিণ-পথ। এই রূপ চতুর্মুখ সর্বতোভদ্র মন্দিরের রূপ এবং এই রূপই পাহাড়পুর, পাগানে এবং লোরো-জোংরাং—এ দৃষ্টিগোচর।

পোড়ামাটির ইটে, কাদার গাঁথুনীতে পাহাড়পুর-মন্দির তৈরি। বহিঃপ্রাচীরের দেয়ালের স্কন্ধে কিছু কিছু অলংকরণ এবং অগণিত পোড়ামাটির ফলক ছাড়া ঐশ্বর্য প্রচারের আর কোনও চেষ্টা নাই। মহাস্থানের গোকুল এবং গোবিন্দভিটার স্তূপেও কিছু কিছু এই ধরনের অলংকরণ ও মৃৎফলক নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে। পাহাড়পুরের ভিত্তিপ্রাচীরগাত্রে প্রস্তরফলক।-নিদর্শনও অপ্রচুর নয়। এই সুবৃহৎ মন্দির একদিনে নির্মিত হয় নাই, বলাই বাহুল্য; বহুদিনের অনবসর চেষ্টায় এত বড় মন্দির নির্মাণ সম্ভব। পরবর্তীকালে নানা সময়ে নানা সংযোজনাও হইয়াছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সমগ্র মন্দিরটির পরিকল্পনায় ও গঠনে এমন একটি সুসম সংহত সমগ্রতা আছে যে, মনে হয় মন্দিরটি আগাগোড়া একই ভাবনা-কল্পনার সৃষ্টি এবং মোটামুটি একই সময়ে নির্মিত। খুব সম্ভব, নরপতি ধর্মপোলই ইহার পোষক এবং তাঁহারই রাজত্বকালে সোমপুরের এই মন্দির ও বিহার রচিত হইয়াছিল। এই মন্দির ও বিহার প্রাচীন বাঙলার গৌরব।

প্রাচীন বাঙলা ও বহির্ভারতের মন্দির

পাহাড়পুর-মন্দিরের সঙ্গে বহির্ভারতের পাগান, লোরো-জোংরাং প্রভৃতি স্থানের কোনও কোনও শ্রেণীর মন্দিরের সমগোত্রীয়তার কথা বলিয়াছি। কিন্তু শুধু পাহাড়পুর-মন্দিরই নয়। প্রাচীন বাঙলার যে কয়েকটি রূপ ও রীতির মন্দিরের কথা কিছু আগে বলিয়াছি সে-সব রূপ ও রীতির মন্দিরের সঙ্গে বহির্ভারতের বিশেষভাবে ব্ৰহ্মদেশের এবং যবদ্বীপের অনেক মন্দিরের একটা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। সে-সব মন্দিরের তুলনা করিলে প্রাচীন বাঙলার মন্দিরগুলির আকৃতি-প্রকৃতিও অনেকটা পরিষ্কার হইতে পারে। যে ক্রমহ্রস্বায়মান ঢালু। চালের ভদ্র বা পীড় রীতির মন্দিরের কথা আগে বলিয়াছি, ব্ৰহ্মদেশে এই রীতি এক সময়ে সুপ্রচলিত ছিল এবং পরেও সমস্ত মধ্যযুগ জুড়িয়া কাঠে ও ইটে, বেশির ভাগ কাঠে, এই ধরনের ‘পায়াথাট’ বা প্রাসাদ-মন্দির প্রচুর নির্মিত হইত। পাগানের আনন্দ-মন্দিরের অনেকগুলি প্রস্তরফলকে পঞ্চস্তলে, সপ্ততিলে, এই ধরনের মন্দির উৎকীর্ণ আছে। এই পাগানেরই বিদগ তাইক (ত্রিপিটক)–মন্দির ও মিমালাউং চ্যঙ্গ মন্দির (একাদশ ও দ্বাদশ শতক) এই ধরনের মন্দিরের সুস্পষ্ট নিদর্শন। ক্ষুদ্রাকৃতি এবং একটি মাত্র পাথরে তৈরি এই ধরনের মন্দির যবন্দ্বীপের চণ্ডী-পানাতরমের প্রাঙ্গণে দুই চারিটি আজও বিদ্যমান। বলিদ্বীপে ও ব্রহ্মদেশে তো এই ধরনের ভদ্র বা পাড় দেউল আজও নির্মিত হয়, তবে সাধারণত কাঠের। এই ভদ্র বা পাড় শ্রেণীর মন্দির ছাড়া চতুষ্কোণ গৰ্ভগৃহের উপর স্তূপ বা শিখর শীর্ম ভদ্র বা পীড় দেউল তো প্রাচীন ব্ৰহ্মদেশের চিত্তই হরণ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয় এবং তাহা প্রায় ষষ্ঠ-সপ্তম শতক হইতেই।   প্রোম-হমজার ষষ্ঠ-সপ্তম শতকীয় বেৰে, লমে’থনা, ইয়াহানাদা-প্ত প্রভৃতি মন্দির হইতে আরম্ভ করিয়া পাগানের একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় স্তূপশীর্ষ পাটো থাম্মা ও অভয়দান এবং শিখর শীর্ষ আনন্দ, সর্বজ্ঞ, থিটুসোয়াদা, টিহু-লো-মিনহ-লো মন্দির পর্যন্ত সমস্তই এই ধরনের দেউলের সউজ্জল নিদর্শন। তাহা ছাড়া, হামজা ও পাগানের প্রচুর মুৎ ও প্রস্তুর-ফলকে এই ধরনের মন্দিরের উৎকীর্ণ নিদর্শন বিদ্যমান। যবন্দ্বীপের স্তূপশীর্ষ চণ্ডা-পাওন মন্দিরও এই রীতিরই অন্যতম নিদর্শন। বলা বাহুল্য, প্রাচীন প্রাচ্যদেশ, বিশেষভাবে প্রাচীন বাঙলাদেশই এই সব বহির্ভারতীয় প্রচেষ্টার মূল অনুপ্রেরণা।

উপরোক্ত চারিপ্রকারের মন্দিরশৈলী ছাড়া খননবিষ্কারের ফলে প্রাচীন বাঙলার আরও কয়েকটি এমন মন্দিরের অস্তিত্ব জানা যায় যাহা কোনও শ্রেণী-চিহ্নে চিহ্নিত করা যায় না। এই মন্দিরগুলির যে কিছু সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় এমন নয়; তবু ইহাদের কথা না বলিলে মন্দির-কাহিনী অসম্পূণ থাকিয়া যায়। দিনাজপুর জেলার বৈগ্রামের যে-মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান সে-মন্দিরটি বোধ হয় ৪৪৮-৪৯ খ্রী তারিখের গুপ্তপট্টোলীকথিত শিবানন্দী-মন্দির। ভূমি-নকশা হইতে মনে হয়, ইহার গর্ভগৃহ ছিল চতুষ্কোণ এবং চারিদিক ঘিরিয়া ছিল প্ৰদক্ষিণ-পথ; পশ্চিম দিকে ছিল ইহার প্রবেশ তোরণ। চালের কী যে ছিল রূপ বলিবার কোনও উপায় নাই। গুপ্ত-আমলের এক ধরনের মন্দিরে যে প্রদক্ষিণ-পথযুক্ত চতুষ্কোণ গৰ্ভগৃহ এবং সমতল চালের রীতি প্রচলিত দেখা যায়, এই মন্দিরটি সেই রীতির হওয়া বিচিত্র নয়। মহাস্থানের আশে পাশেও দুই চারিটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। এখানকার বৈরাগী-ভিটায় পাল-আমলের দুইটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান; ইহাদের মধ্যে একটির ভূমি-নকশা যে প্রাচীন বাঙলার সুঅভ্যস্ত ও সুপরিচিত প্রসারিত চতুষ্কোণ, এ-সম্বন্ধে সন্দেহু নাই। মহাস্থানের গোবিন্দ-ভিটায়ও কয়েকটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টিগোচর; ইহাদের মধ্যে কয়েকটি মন্দির গুপ্ত-আমলের হওয়াও অসম্ভব নয়; কিন্তু আজ আর ইহাদের মৌলিক রূপ সম্বন্ধে কিছুই বলিবার উপায় নাই। এই স্থানেরই গোকুল-পল্লীতে, সুবৃহৎ মোড়স্তাপে এক সময় একটি অতিকায় মন্দির প্রতিষ্ঠিত ছিল। খনানাবিষ্কারের ফলে আজ শুধু তাহার ভিত্তিভূমির কতকটা পরিচয় পাওয়া যায়। এই ভিত্তিভূমির বিন্যাস ঠিক একটি মাকড়সার জালের মতন করিয়া বোনা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চতুষ্কোণ কোষকক্ষের সমষ্টি মাত্র। একটু মনোযোগে বিশ্লেষণ করিলে বুঝিতে দেরী হয় না যে, এই কোযকক্ষের জালের পরিকল্পনা শুধু বৃহৎ পরিকল্পনার একটি মন্দিরের ভিত্তিভূমিকে দৃঢ় করিয়া গড়িবার জন্য। মন্দিরটির ভূমি-নকশা শুধু ধরা যায়, আর কিছুই বিদ্যমান নাই। বহু বাহুবিশিষ্ট এই ভূমি-নকশার বহু কোণ এবং ইহাদের মধ্যে বিধৃত একটি সুবৃহৎ বৃত্ত। এই বৃত্তের চারিপাশ ঘিরিয়া নিরেট চারিটি সুপ্ৰশস্ত দেয়াল এবং এই দেয়াল চারিটির উপরই ছিল মন্দিরটির স্থাপনা। দেয়াল এবং বৃত্তের ফাক ভরাট করা হইয়াছে, সমান্তরালে দেয়ালের পর দেয়াল গাথিয়া এবং মাটি ভরাট করিয়া। এ-সমস্তই যে মন্দিরটির ভিত্ সুদৃঢ় করিয়া গড়িবার জন্য তাঁহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই সুবৃহৎ মন্দিরের কী যে ছিল আকৃতি-প্রকৃতি, তাহা বুঝিবার এতটুকু উপায় আজ আর নাই।

সমসাময়িক ওড়িশার ভুবনেশ্বরে বা পুরী-কোেনারকে বা মধ্য-ভারতের খাজুরাহোতে, ব্ৰহ্মদেশের পাগানে বা ব্যবদ্বীপের প্রাস্বনাম-পানাতরমে, কাম্বোজের অঙ্কোর-থোমে বা দক্ষিণ-ভারতের কাঞ্চীপুরে বা অন্যত্র যে সুবিস্তৃত মন্দির-নগরীর কথা আমরা জানি, প্রাচীন বাঙলার কোথাও সে ধরনের সুবিস্তৃত মন্দির-নগরীর পরিচয় পাইতেছি না। প্রত্নসাক্ষ্যই হোক আর সাহিত্য বা লিপি-সাক্ষ্যই হোক, সমস্ত সাক্ষ্যেরই ইঙ্গিত যে বিচ্ছিন্ন দুই চারিটি মন্দিরের দিকে এবং সে-মন্দিরও খুব বৃহদায়তন নয়। বস্তুত, এক পাহাড়পুর এবং গোকুলের মন্দির দুটি এবং হয়তো আরও দুই চারিটি ছাড়া বৃহৎ কল্পিত, বিস্তৃতায়তন মন্দিরের কথা বড় একটা জানা যায় না, অন্তত প্রত্নসাক্ষ্যে তেমন প্রমাণ নাই। মনে হয়, অধিকাংশ মন্দিরই ছিল স্বল্পায়তন। বস্তুত, প্রাচীন বাঙলায় স্থাপত্যের ক্ষেত্রে বৃহৎ দুঃসাহসী কল্পনা-ভাবনা, বৃহৎ কর্মশক্তি বা গভীর গঠন-নৈপুণ্যের পরিচয় খুব বেশি নাই; গ্রাম্য কৃষিনির্ভর জীবনে সে-সুযোগও ছিল স্বল্পই। প্রাচীন বাঙলায় স্থাপত্যেই শুধু নয়, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রেও প্রাচীন বাঙালী খুব বৃহৎ দুঃসাহসী কল্পনা-ভাবনার দিকে কোথাও অগ্রসর হয় নাই, খুব প্রশস্ত ও গভীর গঠনকর্মে নিজের প্রতিভাকে নিয়োজিত করে নাই। ইহার কারণ দুর্বোধী নয়। তাহার কৃষিনির্ভর জীবনের অর্থসম্বল ছিল পরিমিত, চিত্তসমৃদ্ধি ছিল ক্ষীণায়ত এবং বৃহৎ গভীর দুঃসাহসী জীবনের গভীর ও ব্যাপক উল্লাসের কোনও গভীর ও প্রশস্ত স্পশ সে জীবনে লাগে নাই। কাজেই শিল্পেও সে পরিচয় নাই।